Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প384 Mins Read0

    ১১. সমভূমি থেকে পাহাড়ের দিকে

    ১১.

    একটা ট্রাক সমভূমি থেকে পাহাড়ের দিকে যাত্রা করেছে। খাড়া রাস্তা ধরে উপরে উঠতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে ওটার ইঞ্জিনকে। চালু করা রেডিওর সাথে তাল মিলিয়ে ড্রাইভার গুনগুন করছে। তার সঙ্গী ঘুমুচ্ছে পাশের সিটে। পরনে খাকি পোশাক। তবে পোশাকটা ময়লা। অনেক কাজ করেছে আজ।

    ওরা দুজনই অস্ট্রেলিয়ান। বিগত ৬ মাস ধরে গোয়াডালক্যানেলে রয়েছে। ২০০৬ সালের দাঙ্গার পর থেকে এখানে বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতার জন্য বিদেশিরা আসছে। ওরা হচ্ছে সেরকম বিদেশি ব্যক্তি। তবে ইদানিং ওদের দিনকাল একঘেঁয়েমিতে কাটে। গত কয়েক বছর ধরে এখানে কোনো বড়ধরনের বিপদ-আপদ হচ্ছে না। তাই ওদের ডিউটিও হালকা।

    বিপদজনক মোড়ে এসে সাবধানতা অবলম্বন করল ড্রাইভার। ওপাশ থেকে হুট করে হেডলাইটবিহীন গাড়ি উদয় হতে পারে। সাবধান হওয়া ভাল। তার উপর এখন সন্ধ্যা নেমেছে। দিনের আলো নেই বললেই চলে। এই পথে চলাচলরত গাড়িগুলোর ব্রেক আর নিরাপত্তার কোনো মা-বাপ নেই। কখন কোন গাড়ি বিগড়ে গিয়ে দূর্ঘটনা ঘটাবে তা কেউ জানে না। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাণী, ভেঙ্গে পড়া গাছ, ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়া গাড়ি… ইত্যাদি ঝামেলা তো আছেই। তাই সবমিলিয়ে মোড় পার হওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।

    ‘ধ্যাৎ! এরা রাস্তার মাঝে কী করছে?’ একটা তীক্ষ্ণ বাঁক পেরিয়ে এসে নিজেই নিজেকে বলল ড্রাইভার। সামনের রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলছে ওটাতে। আলফ্রেড, ওঠো।

    আলফ্রেড উঠে হাত দিয়ে চোখ-মুখ ডলল। ট্রাকের গতি কমে গেছে। সামনের রাস্তা বন্ধ। ওদের ট্রাকের পক্ষে ভ্যানটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

    ‘খুউব চমৎকার, সাইমন। এবার ঘণ্টাখানেক এখানে বসে বসে খই ভাজা যাবে!

    ড্রাইভার ট্রাকটাকে দাঁড় করিয়ে ভ্যানের পেছন দিকে নজর দিল। আশা করছি, ড্রাইভারটা যেন এখানেই থাকে। যদি সে সাহায্য চাওয়ার জন্য দূরে কোথায় গিয়ে থাকে তাহলে আমাদের বাশ!

    ‘চলো, চেক করে দেখি।’

    দরজা খুলে ট্রাক থেকে নামল ওরা। ট্রাকের হেডলাইট জ্বালানো, ইঞ্জিনও চালু। ড্রাইভিং সিটের দিকে এগোল সাইমন। ফাঁকা। “ড্রাইভার নেই” এই কথাটা সঙ্গী আলফ্রেডকে বলতে যাবে ঠিক তখনই পাশের ঝোঁপ থেকে চারটে কালো অবয়ব বেরিয়ে এলো। তাদের হাতে ম্যাচেটি। সন্ধ্যার আধো আলোতেও ওগুলোর ফলা ঝলসে উঠল।

    স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াবশত আক্রমণ ঠেকানোর জন্য নিজের হাতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করল সাইমন। কিন্তু ম্যাচেটির কাছে ওর হাতের রক্ত-মাংস তো কিছুই নয়। ওদিকে ঘাড়ে কোপ খেয়ে আলফ্রেড ইতিমধ্যে ভূপাতিত হয়েছে। বেচারা মরে গেছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাওয়ার পরও আরও কয়েকটা কোপ দিল আততায়ীরা।

    মাথার খুলিতে ধারাল কোপ খেয়ে সাইমনের দুনিয়া যেন শব্দ-শূন্য হয়ে গেল। মাটিতে পড়ে গিয়ে ও দেখল ওর খুনি দাঁত বের করে ত্রুর হাসি হাসছে। একটা কণ্ঠ ঝোঁপের ভেতর থেকে হাঁক ছাড়ল।

    যথেষ্ট হয়েছে। এখন ট্রাকটাকে রাস্তা থেকে সরা আর লাশ দুটোকে ঝোঁপের ভেতরে লুকিয়ে রাখ, যাতে কেউ এগুলো খুঁজে না পায়। এখানে অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে। লাশ দুটোর ব্যবস্থা ওরাই ভাল করতে পারবে।

    আততায়ীরা একে অন্যের দিকে তাকাল। ওদের জীর্ণ পোশাকগুলো গরম রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। ৫ মিনিটের মধ্যে দৃশ্যপট থেকে লাশ সরিয়ে ফেলল ওরা। ঘটনাস্থল পরিষ্কার করে ফেলল। এখানে কোনো খুননাখুনি হয়েছে তার আর কোনো প্রমাণই রইল না।

    ‘কাজ শেষ। এবার তোরা কেটে পড়। সমুদ্রে গিয়ে নিজেদেরকে পরিষ্কার করে নিবি। পোশাকে, শরীরে আর অস্ত্রে কোথাও যেন রক্ত লেগে না থাকে। আর মনে রাখিস, কাউকে কিছু বলবি না। যদি একটা শব্দও বলেছিস, তাহলে আমি তোদের জিহ্বা কেটে ফেলব।

    সবাই লোকটার কথা বিশ্বাস করল। কারণ, ওরা জানে এই লোক যা বলে সেটা করেও দেখায়। মাথা নেড়ে আততায়ীরা ভ্যানে উঠে বসল। চটপট ইঞ্জিন চালু হয়ে রওনা হয়ে গেল গন্তব্যের উদ্দেশে। ঘটনাস্থলে এখন শুরু সেই নির্দেশদাতা একা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এইমাত্র খুন হয়ে যাওয়া জায়গাটাকে আবার পরীক্ষা করল সে। হাসল। সবকিছু একদম প্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে। এখন একটা কন্টাক পেপার নিয়ে তাতে লিখতে হবে, বিদ্রোহীরা সব বিদেশি কোম্পানীদেরকে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে, নইলে এরকম আরও বিদেশি খুনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

    চারপাশের জঙ্গল একদম নিশ্চুপ। তবে নিশাচর প্রাণীরা তাদের আজ রাতের ফ্রি ডিনার খাওয়ার জন্য ঠিকই তৈরি হয়ে নিচ্ছে। ঝোঁপ থেকে প্রায় ৬০ ফুট দূরে একটা কালো এসইউভি-তে চড়ল লোকটা। দু’টো অস্ট্রেলিয়ান লাশ আর ট্রাক ফেলে চলে গেল সে। দ্বীপে আরও দুটো খুন হলো আজ। স্রেফ এখানকার ক্ষমতা দখলের জন্য।

    .

    ১২.

    পরদিন সকালে স্যাম ও রেমি হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলো। এবার ডা. ভ্যানা ওদেরকে ঢুকতে দিল হাসপাতালের ভেতরে। বেনজির সাথে দেখা করল ওরা। জীবন বাঁচানোর জন্য বেনজি ফারগো দম্পতিকে অনেক ধন্যবাদ জানাল, যদিও তার ইংরেজি বুঝতে খুব কষ্ট হলো ওদের। বেনজির সাথে ওদের কোনো পূর্ব-পরিচয় না থাকায় বাড়তি কোনো কথা বলার সুযোগ রইল না। তবে বেনজিকে ফারগো দম্পতি নিশ্চিত করল হাসপাতালের যাবতীয় বিল লিওনিড দিয়ে দেবে, সে যেন কোনো দুশ্চিন্তা না করে। কয়েক মিনিট পর ওরা ভ্যানার সাথে বেনজির রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

    ‘আজকে আপনাদের প্ল্যান কী?’ জানতে চাইল ডাক্তার।

    স্থানীয় লোকজনদের আমরা গোয়াডালক্যানেলের লোককাহিনি সম্পর্কে জিজ্ঞাস করব। তারপর খনি দেখতে যেতে পারি।’ বলল রেমি।

    ‘আচ্ছা। তবে সাবধান থাকবেন। শহরের বাইরে কিন্তু রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। আর জঙ্গলে কী থাকতে পারে না পারে তা তো ইতিমধ্যে শুনেছেন। কুমীর কিন্তু এখানকার অনেকগুলো বিপদের মধ্যে একটা মাত্র। এরকম আরও অনেক বিপদ মানুষের জন্য ওঁত পেতে আছে।’

    হ্যাঁ, ম্যানচেস্টার আমাদেরকে জায়ান্টের ব্যাপারেও বলেছেন। স্যাম বলল।

    হাসল ভ্যানা। তবে বোঝা গেল হাসিটা মেকি। এখানে বিভিন্ন রকম গল্প প্রচলিত আছে। মানুষজন অনেক কিছুতে বিশ্বাস করে।

    এরকম গ্রাম্য বিচ্ছিন্ন জনপদের কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়, বলুন? বলল স্যাম। আমরা ভিন্নধর্মী সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করি তারপরও বিষয়টা যেন কেমন কেমন…

    ‘আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে জায়ান্টের গল্প শুনে আসছি। কিন্তু পাত্তা দেইনি। এই লোককাহিনিগুলোকে আমি ধর্মের মতো মনে করি। বিশ্বাস করলে আছে, না করলে নেই। মানুষ সেটাই ভাবে, যা তারা ভাবতে চায়। ভ্যানা বলল।

    কিন্তু তিনি হুটহাট মানুষ গায়েব হওয়ার বিষয়েও বললেন আমাদের। ইদানীং নাকি মানুষ গায়েব হওয়ার পরিমাণ আরও বেড়েছে। জানাল রেমি।

    ‘গুজব শুনেছি পাহাড়ে নাকি এখনও বেসামরিক বাহিনি আছে। আমার মনে হয় এগুলো তাদের কাজ। জায়ান্ট-টায়ান্ট কিছু না।

    বেসামরিক বাহিনি?

    ‘অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনির তরফ থেকে দ্বীপে শান্তি বজায় রাখার জন্য আমর্ড টাস্ক ফোর্স পাঠানো হয়েছিল। স্থানীয় লোকজন তাদেরকে স্বাগত জানালেও কিছু স্থানীয় আছে যারা এটাকে তাদের জন্মভূমিতে বিদেশিদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। দ্বন্দটা এখানেই। এদেরকে বেসামরিক বাহিনি না বলে জঙ্গি বলা ভাল।’

    ‘তাহলে তো গুহার ওদিকে ঘুরতে যাওয়াটা সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ? স্যাম প্রশ্ন করল।

    মাথা নাড়ল ভ্যানা। যদিও সেটা জায়ান্টের জন্য নয়। কিন্তু যা-ই আক্রমণ করুক না কেন। যদি জীবন-ই না বাঁচে তাহলে জায়ান্ট হলেই কী আর জঙ্গি হলেই কী? কোনো পার্থক্য আছে, বলুন?

    স্যামের দিকে তাকাল রেমি। ওনার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু।

    ‘তা ঠিক। আচ্ছা, ডা. আপনাকে ধন্যবাদ বেনজি’র সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য। ভ্যানাকে বলল স্যাম। বেচারার সাথে যে দূর্ঘটনা ঘটে গেছে সেটা খুবই বেদনাদায়ক।

    হুম, সতর্ক থাকবেন যাতে ওরকম ঘটনা আপনাদের সাথে না ঘটে। এই দ্বীপ বেশ বুনো প্রকৃতির। কুমীর ছাড়াও আরও অনেক জানোয়ার আছে এখানে।

    ‘মনে থাকবে। সতর্ক করে দেয়ার জন্য আবারও ধন্যবাদ।

    পার্কিং লটে রাখা নিশান গাড়ির দিকে এগোল ওরা। সূর্য ইতিমধ্যে খুব নিষ্ঠার সাথে তার প্রচণ্ড তাপ বিকিরণ করতে শুরু করে দিয়েছে। পুবদিকে রওনা হলো ফারগো দম্পতি। গতকাল যে রাস্তায় গিয়ে বৃষ্টির পানির কারণে ফিরে যেতে হয়েছিল আজ সেখানে পানি নেই তবে পুরো রাস্তা কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে।

    গাড়িকে ফোর-হুঁইল ড্রাইভ অপশনে নিলো স্যাম। ঝাঁকির সাথে ব্যাপক দুলুনি খেয়ে ওদের নিশান এগিয়ে চলল। মনে হলো ওরা গাড়িতে নয় কোন থিম পার্কের রাইডে চড়েছে। রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল থাকায় অনেকখানি সূর্যের আলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এখন।

    ‘এত ঝক্কির রাস্তা পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি অথচ রুববা বেঁচে আছে কিনা সেটাই জানি না আমরা।’ রেমি বলল।

    ‘বাঁচা-মরার কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে, বলো? তুমি কেন এসব ভাবছ? তোমার অ্যাডভেঞ্চারধর্মী চিন্তাধারার কী হয়েছে? অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে চিন্তা করলেও তো পারো।

    ‘অ্যাডভেঞ্চারসহ অন্যান্য সুন্দর অনুভূতিগুলোকে আমি এক মাইল পেছনে রেখে এসেছি।’

    খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

    হু, ঝাঁকির দমকে সকালের নাস্তা বোধহয় হজমই হয়ে গেল।

    আধাঘণ্টা পর তীক্ষ্ণ বাঁক পেরিয়ে একটা লম্বা বটগাছের দেখা পেল ওরা। বটগাছের নিচে গ্রাম্য ধাঁচের একটা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে, এখানে বিদ্যুৎ কিংবা টেলিফোনের লাইন কোনটাই নেই। গাড়ি থামতেই স্যামের দিকে তাকাল রেমি।

    ‘হাহ। আর তুমি বলো হোটেলটা ফালতু, তাই না। তাহলে এটা কী?

    ‘জীবনে যে আর কত চমক দেখতে হবে কে জানে।

    “দেখো কাউকে পাওয়া যায় কিনা।

    হুম, দেখছি।’

    ‘আমি বরং গাড়িতেই থাকি। বাইরে তো খুব গরম। গরমে যদি তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে আমি সাহায্য করব। দু’জন একসাথে অসুস্থ হওয়ার কী দরকার?

    ‘বাহ! তুমি আমার কত যত্ন নাও! তুমি অনেক ভাল। অথচ আমি ভেবেছি, এসির বাতাস খাওয়ার জন্য গাড়িতে থাকতে চাইছে…’।

    ‘একে এসি বলে? গরম বাতাস ছাড়া কী বেরোচ্ছে এসি থেকে, শুনি?

    “আচ্ছা, তুমি গাড়িতে থাকো। আমি গিয়ে কথা বলে আসছি। তোমার চোখে কাউকে পড়েছে? কুঁড়েঘরের দিকে বলল স্যাম।

    নড়াচড়া দেখতে পেয়েছি বলে মনে হলো। তবে সেটা কুমীরও হতে পারে আবার স্কিঙ্কও হতে পারে। অতএব, সাবধানে যেয়ো।

    ‘তোমার কথা শুনে… কী বলব… খুব স্বস্তি পেলাম!”

    ‘তোমাকে স্বস্তি দেয়াটাই তো আমার কাজ!

    গাড়ির দরজা খুলে কুঁড়েঘরের দিকে এগোল স্যাম। ঘরের কয়েক ফুট দূরে থাকা অবস্থায় একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ভেতর থেকে। ভাষাটা স্যাম না বুঝলেও বলার ধরনে ও ঠিকই বুঝেছে ওটা একটা সতর্কবাণী। থেমে দাঁড়াল স্যাম।

    ‘আমি রুবো’র সাথে দেখা করতে এসেছি। ধীরে ধীরে বলল ও। রু বো,’ স্যাম নামটা আবার উচ্চারণ করল। আপনি ইংরেজি জানেন?

    নিশানের ইঞ্জিন চালু করা রয়েছে। ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সব চুপচাপ।

    কুঁড়েঘরের দরজায় একটা অবয়ব হাজির হলো। বৃদ্ধ লোক, হালকা পাতলা গড়ন, চামড়া কুঁচকে গেছে। ঘরের ছায়ায় থেকে স্যামকে পর্যবেক্ষণ করল বৃদ্ধ। বলল, আমি অল্প ইংরেজি কইবার পারি! কী চান আপনে?’

    ‘আমি অরউন ম্যানেচেস্টারের বন্ধু। রুবো’র সাথে দেখা করতে এসেছি।’

    ‘আমি কানে কম শুনি না। প্রথমে একবার কইছেন, তহনি শুনছি। কী জইন্যে আইছেন সেইটা কন।

    কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাস করব। এখানকার লোককাহিনির ব্যাপারে।

    ঘরের ছায়া থেকে বের হলো বৃদ্ধ। সন্দেহ নিয়ে স্যামের দিকে তাকাল। ‘প্রশ্ন জিগানোর জইন্যে বহুত দূর চইল্যা আইছেন।

    বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।’

    বিরক্তি প্রকাশ করে বৃদ্ধ ঘোঁতঘোত করল। আমি রুবো।

    ‘আমি স্যাম। স্যাম ফারগো।’ হাত মেলালোর জন্য হাস বাড়িয়ে দিলো ও। কিন্তু রুবো হাতের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন স্যামের হাতটা খুবই নোংরা। অস্বস্তিবোধ করল স্যাম। ভাবল, হয়তো কোনো স্থানীয় রীতি ভঙ্গ করে ফেলেছে। ওকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে দাঁতবিহীন মাঢ়ি বের করে হাসল বৃদ্ধ।

    ‘চিন্তার কিছু নাই, বুছছেন? আমার এরাম হাত মিলাননা পছন্দ না। এইডা কোনো রীতি না কিন্তু। খালি আমারই পছন্দ হয় না বিষয়।’ বলল রুবো। বইবেন না?’ ঘরের দেয়ালের পাশে থাকা একটা গাছের গুঁড়ি দেখাল সে। কপাল ভাল গুঁড়িটা ছায়ায় আছে।

    ধন্যবাদ।’

    বসার পর স্যামের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল বৃদ্ধ।

    ‘কী চান বইল্যা ফালান?’

    ‘পুরানো দিনের কথা জানতে চাই। পুরানো গল্প। অরউন বললেন আপনি অন্য সবার চেয়ে পুরানো গল্প ভাল জানেন।

    রুবো মাথা নাড়ল। হইবার পারে। অনেক গল্প জানি আমি।

    ‘অভিশাপ সম্পর্কিত গল্প শুনতে চাই। কিংবা কোনো তলিয়ে যাওয়া শহরের গল্প।

    রুবো’র চোখ সরু হয়ে গেল। ডুইবা যাওয়া শহর? অভিশাপ।

    মাথা নেড়ে সায় দিল স্যাম। দ্বীপের ওইপাশের সৈকত নাকি অভিশপ্ত?

    ‘আপনে শহর নিয়া প্রশ্ন করলেন ক্যান?

    ‘দ্বীপে কে যেন অনুসন্ধান চালাচ্ছে। লোকমুখে শুনলাম সে নাকি পানির নিচে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে।

    দূরে তাকাল রুবো। দূরে নদীর বাদামী পানি বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে স্যামের দিকে ফিরল সে। চেহারা কঠিন।

    ‘পুরাইন্না গল্প। এক রাজা আছিল। দেবতাগো রাগায়া দিছিল সেই রাজা। সাগরের মইধ্যে মন্দির বানাইছিল। কিন্তু বড় বড় ঢেউ আইয়া সব ডুবাইয়া দিছে। তারপর থেইক্যা ওই জায়গা অভিশপ্ত।

    কবেকার ঘটনা এটা?

    হাড্ডিসার কাঁধ ঝাঁকাল বৃদ্ধ। বহুত পুরাইন্ন্যা কাহিনি। সাদা চামড়ার লোকগুলান তহনও এইহানে আহে নাই।

    স্যাম আরও কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু রুবো বিস্তারিত কিছু জানাতে পারল না। আধামিনিট চুপচাপ থাকার পর হাসার চেষ্টা করল স্যাম। এতটুকুই?

    মাথা নাড়ল রুবো। শুকনো আঙুল তাক করল গাড়ির দিকে। ওইডা ক্যাডা?

    “ওহ, দুঃখিত। বলা হয়নি। ও আমার স্ত্রী। ইশারা করে রেমিকে এদিকে আসতে বলল স্যাম। রেমি গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এলো।

    একদম কাছে না আসা পর্যন্ত রেমি’র দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বৃদ্ধ।

    ‘রেমি, ইনি হচ্ছেন, রুবো। আমাকে একটা লোককাহিনি শুনাচ্ছিলেন। এক রাজা সমুদ্রে মন্দির বানিয়েছিল কিন্তু তারপর সেটা তলিয়ে যায়। দেবতারা ক্ষীপ্ত হয়েছিল রাজার উপর।

    ‘আপনার সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল। বলল রেমি। বৃদ্ধকে মিষ্টি হাসি উপহার দিল ও। দুর্বল শরীর নিয়ে রুবো উঠে দাঁড়াল। রেমির একটা হাত টেনে নিয়ে হ্যান্ডশেক করল সে। স্যাম কিছু বলল না। হাজার হোক, সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম থাকে।

    বইসো, রেমিকে বলল রুবো। রেমি তাকে আরেকটা হাসি উপহার দিল। স্যামের পাশে বসল রেমি। স্যাম গলা খাকরি দিল।

    ‘আমাদের ধ্বংসাবশেষের কথাই বলছেন উনি, তাই না?

    ‘হ্যাঁ। রুবো পুরো গল্পটা জানেন। বিষয়টা দারুণ।

    রুবো মুখ খুলল। আমি অনেক গল্প জানি।

    ‘অবশ্যই জানেন। আর আপনার ইংরেজি যথেষ্ট ভাল। এরকম ইংরেজি কীভাবে শিখেছেন?

    ‘যুদ্দের সময় আমি আংকেল স্যাম-রে সাহায্য করছিলাম। তহন শিখছি।’

    ‘তাই? তখন অনেক কঠিন সময় গেছে, তাই না?’ বলল রেমি।

    রুবো মাথা নাড়ল। কঠিন দিন আছিল তহন। বহুত লোক মইরা গেছিল। জাপানি গো আমি ঘেন্না করি।

    দ্বীপের ক্ষতি করেছিল জাপানিরা?’

    কয়েকড়া জাপানি করছিল। তার মইদ্যে একজন আছিল চরম খারাপ। কর্নেল।

    কী করেছিল সে?’ স্যাম জানতে চাইল।

    ‘খারাপ কাম করছিল। আমাগোর বহুত লোক মারছিল কর্নেল। লুকায়া লুকায়া গুবেষণা করত।

    একটু কাছে এগিয়ে এলো রেমি? কী? গবেষণা?’

    রুবো অন্যদিকে তাকাল। মেড।

    ‘মেড? মানে, মেডিক্যাল?

    মাথা নাড়ল রুবো। হ। সাদা চামড়ার লোক লইয়্যা গুবেষণা করত। তয় হেই লোকগুলান আমেরিকান আছিল না।’

    স্যাম রেমির দিকে তাকাল। শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে এখানে গবেষণা করত জাপানিরা। কিন্তু কোন জাতির শ্বেতাঙ্গ ছিল তারা? আন্দাজ করতে পারো?

    রুবোর দিকে ফিরল ফারগো দম্পতি। আচ্ছা, এই ঘটনা আমরা এরআগে কখনও শুনতে পাইনি। কেন?

    রুবো শ্রাগ করল। কইবার পারি না। কেউ হয়তো বিষয়ডা ঘারায় নাই।

    তাহলে আপনি বলছেন জাপানিরা এখানে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ছিল? কিন্তু বিষয়টা এভাবে চাপা থাকতে পারে, সেটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’ বলল রেমি।

    রুবো শূন্য দৃষ্টিতে রেমি’র দিকে তাকাল। চাপা? চাপা মারার কথা কইতাছেন নাকি? বুঝবার পারলাম না।

    ‘দুঃখিত। “চাপা” বলতে আমি ঘটনা চাপা পড়ে থাকার কথা বলেছি। আপনি চাপা মারছেন সেটা বলিনি।

    ‘রাজার কাহিনিতে আসি। আপনি আমাদেরকে পুরো গল্পটা শোনাতে পারেন?’ স্যাম উৎসাহ দিল।

    শ্রাগ করল রুবো। কইলাম না, বহুত পুরাইন্ন্যা কাহিনি। বেশি কিছু কওয়ার নাই। রাজা মন্দির বানাইছিল। দেবতারা খেইপা গিয়া মন্দির ডুবায়া দিছে। তারপর থেইক্যা জায়গা অভিশপ্ত। কেউ আর ওইদিকে যাইবার চায় না।

    ‘শেষ?

    হ।

    স্যাম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর জায়ান্ট? জায়ান্টদের নিয়ে কোনো লোককাহিনি নেই?

    রুবোর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। জায়ান্ট সত্য সত্যই আছে। আগে বহুত আছিল। এহন একটু কমছে। তয় আছে।

    ‘আপনি কীভাবে জানেন? দেখেছেন কখনও?

    না দেহি নাই। তয় আমি এরাম বহুত লোকরে চিনি। হ্যারা দেখছে।

    ‘নিজের চোখে না দেখে এভাবে বিশ্বাস করাটা অদ্ভুত না? বিষয়টা তো ভূত দেখার মতো হয়ে গেল। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, ভূত আছে। কিন্তু…’ রুবোর চেহারার অভিব্যক্তি দেখে স্যাম থেমে গেল।

    ‘ভূতরা সত্য সত্যই আছে।’

    ‘তাহলে আমি বিশ্বাস করেন বাস্তবে গুহায় জায়ান্টরা বাস করে?’ বলল রেমি।

    ‘আমি কহনও যাই নাই। গুহায় বদ আত্মা থাকে। জাপানি অফিসারগুলান ওই জায়গায় শুবেষণা করত। বহুত ভূত আছে ওইহানে। সবগুলান খেপা। জায়ান্টও আছে। গুহা ভালা না।’

    স্ত্রীর সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল স্যাম। রুবো গুহা, জাপানি; দুটোর একটাকেও পছন্দ করে না। আর সে রাজার গল্পটাও বিস্তারিত জানে না, তাই বিরক্ত হচ্ছে।

    স্যামের কানের কাছে মাথা নিল রেমি। শুনতে পেয়েছ?

    না তো৷ কী?

    রুবো অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। ফারগো দম্পতির দিকে খেয়াল নেই তার।

    ‘রাস্তার ওদিকে ইঞ্জিনের আওয়াজ পেলাম মনে হলো।

    স্যাম মাথা নাড়ল। আমি শুনতে পাইনি।’ রুবোর দিকে ফিরল ও। ‘রাজার কাহিনিটা কী সবাই জানে? খুব পরিচিত কাহিনি এটা?

    মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। আগের দিনের গল্প এহন কেউ আর করে-টরে না।’

    হঠাৎ নদীর ওদিক থেকে ডাল ভাঙ্গার আওয়াজ এলো। ঝট করে রেমি তাকাল ওদিকে। স্যাম ও রেমি ঝোঁপের দিকে তাকিয়ে শব্দের উৎস খুঁজল কিন্তু কিছুই পেল না। আরও শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে রইল ওরা। কিন্তু সব একদম চুপচাপ। প্রাকৃতিক কিছু আওয়াজ ছাড়া অস্বাভাবিক কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। রুবো’র হাবভাব দেখে মনে হলো তিনি কোনো শব্দ শুনতে পাননি। কয়েক মিনিট পরও যখন আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না তখন ফারগো দম্পতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

    তলিয়ে যাওয়া শহরের ব্যাপারে বৃদ্ধ লোকটিকে আরও কিছু প্রশ্ন করল রেমি। কিন্তু নতুন কিছু জানা গেল না। অবশেষে রেমি আর স্যাম যখন ওখান থেকে উঠল বৃদ্ধ তখনও নির্বিকার। সে উঠে দাঁড়াল না কিংবা ওদেরকে কিছু বললও না।

    কিছু না বললে খারাপ দেখায়। তাই রেমি মুখ খুলল। “ঠিক আছে, রুবো। দ্বীপের ইতিহাস জানানোর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি।’

    নিজের পায়ের দিকে লজ্জাবনত মুখে তাকিয়ে রইল রুবো। ম্যালা দিন পর নতুন মানুষ গো লগে কতা কইলাম। আমারও ভালা লাগছে।’

    ভাড়া করা নিশান গাড়ির দিকে ফিরল ওরা। গাড়ির দরজা খুলতেই ভেতরের ঠাণ্ডা বাতাস ওদের গায়ে এসে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিল। গাড়ির ইঞ্জিন এসিকে চালু রেখেছিল এতক্ষণ। সিটবেল্ট বেঁধে স্যামের দিকে তাকাল রেমি। কী বুঝলে?

    ‘আরেকটা ধাঁধা পেলাম। যতদূর বুঝতে পারছি, প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে রাজার সেই নিমার্ণশৈলী পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। আর সে দূর্যোগকে ইনি দেবতাদের রাগ হিসেবে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। অভিশাপের কারণটা বুঝতে পারলাম এখন। ঘটনা বিস্তারিত মানুষের মনে না থাকলেও লোককাহিনির মূল অংশটুকু ঠিকই মনে আছে।

    ‘এসব তথ্য জানতে পারলে লিও বেশ খুশি-ই হবে।

    ‘তুমি হয়তো খেয়াল করোনি। লিও কোনোকিছুতে সহজে খুশি হয় না। কখনই না।’

    কুঁড়েঘরের দিকে তাকাল রেমি। রুবোকে দেখে মনে হলো, তার বয়স প্রায় ১০০ বছর।

    ‘হ্যাঁ। যুদ্ধের সময় যদি সে মিত্রবাহিনিকে সাহায্য করে থাকে তাহলে তো ওরকম বয়স হতেই পারে।’

    তবে জাপানি কর্নেলের গবেষণার বিষয়টা কীরকম গা ছমছমে একটা ব্যাপার। আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না, এরকম একটা ঘটনার কথা ইতিহাসে লেখা নেই?!

    ‘এই দ্বীপটা অনেক ছোট। ইতিহাসে অনেক ছোট ছোট বিষয় সেভাবে উল্লেখ নেই।’

    ‘হুম।

    ‘খেয়াল করেছ? তোমার সৌন্দর্যের ধার রুবোকেও জখম করেছে! বেচারার যা প্রতিক্রিয়া দেখলাম! মুচকি হেসে গিয়ার বদল করল স্যাম। ‘এখন কোথায় যাবে? সোনার খনি দেখবে নাকি শহরে ফিরবে?’

    ‘বের হয়েছি যখন, তাহলে খনিটা দেখেই যাই। অভিযোগ করছি না, জাস্ট বলছি… এরকম রাস্তা দিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে হোটেলের রুমে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটা অনেক আরামদায়ক।

    বুঝলাম। তাহলে সোনার খনিতে যাচ্ছি আমরা?

    হুম, চলো।

    ***

    গ্রাম্য রাস্তা পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা। গ্রামের জঘন্য রাস্তা পেয়োনোর সময়টুকু ওদের কাছে অনেক দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে চলার সময় বারবার গাড়ির আয়না দিয়ে পেছনে চোখ রাখল স্যাম।

    ‘এখানে শুধু আমরাই ড্রাইভ করছি না। আরও কেউ আছে বলল ও।

    ‘আমার মনে হচ্ছে এই গাড়ির আওয়াজ আমি রুবো’র বাসায় শুনেছিলাম। শহরের বাইরে এসে আমার গাড়ি বাদে এই প্রথম কোনো যানবাহনের দেখা পেলাম আমরা।

    ‘একদিক দিয়ে বিষয়টা স্বস্তির। আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে সাহায্যের জন্য ২০ মাইল দূরে যেতে হবে না।’

    ‘তুমি একরম বাজে চিন্তা-ভাবনা করো কেন?

    “ওহ, দুঃখিত। কী বলব, মনে চিন্তা চলে আসে।

    একটা উপহ্রদকে পাশ কাটাল ওরা। হ্রদের সাথে ছোট্ট একটা গ্রাম ছিল। তারপর পরিত্যাক্ত কুঁড়েঘরঅলা এক শহরে এসে পৌঁছুল ওরা।

    ভূতুড়ে শহর?’ প্রশ্ন করল রেমি।

    হুম, খনি বন্ধ। তাই এই অবস্থা। এখানে থাকার জন্য অন্য কোনো জীবিকার উৎস নেই বলে মনে হচ্ছে।

    .

    দক্ষিণ দিকে এগোল ওরা। পাহাড়ের একপাশের চূড়োয় পৌঁছে সামনে তাকিয়ে একটা দৃশ্য দেখতে পেল। মনে হলো, বিশাল কোনো হাতের সাহায্যে পাহাড়ের চুডোর জঙ্গলকে কেটে ন্যাড়া বানিয়ে দিয়েছে। একটা ভাঙ্গা সিকিউরিটি গেইট দেখা যাচ্ছে এখানে। গেইটের পেছনে থাকা ভবন একদম খালি। ভবনের কাঁচগুলো ভাঙ্গা।

    ‘কী বুঝতে পারছ, স্যাম? রেমি প্রশ্ন করল।

    ‘বুঝতে পারছি, এখানে আমরাই প্রথম পর্যটক নই। এরআগেও কেউ এসেছিল।

    ‘কিন্তু এটা তো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এখানে এভাবে গেইট ভেঙ্গে অনুপ্রবেশ করাটা কেমন কাজ হলো?’

    ‘হয়তো খনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গেইটটা কেউ ভেঙ্গেছে। কিন্তু কেন ভেঙ্গেছে সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। আমাদের ওসব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও হবে। আমরা গেইট ভাঙ্গিনি, কাঁচও ভাঙ্গিনি। কিছু চুরিও করতে আসিনি এখানে।

    ‘ধরা পড়লে এই ব্যাখ্যাগুলো পুলিশকে দিয়ো।’

    ‘এই অজো পাড়াগাঁয়ে পুলিশ আসবে বলে মনে হয় না।

    ‘তোমার কাছে এটাকে ভাল বলে মনে হচ্ছে?

    স্যাম কোনো জবাব না দিয়ে নিশানটাকে একদম মূল প্রসেসিং প্ল্যানের কাছে নিয়ে গেল। এখানে অনেকগুলো পরিত্যাক্ত ট্রাক রয়েছে।

    ‘কেউ-ই নেই এখানে? বিষয়টা রহস্যজনক লাগছে না?’ বলল স্যাম। ওর কণ্ঠস্বর নিচু। গাড়ি থেকে নামবে নাকি এগোব?’

    ‘এগোও।’

    প্ল্যানের শেষ মাথায় পৌঁছুনোর পর গাড়ি থেকে নেমে চারপাশ দেখতে রাজি হলো রেমি। গাড়ি থেমে নামমাত্র ওদের উপর উত্তপ্ত গরম বাতাস হামলে পড়ল।

    রেমি স্যামের দিকে ফিরল। দেখে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের চূড়া কেটে এই খনি বানানো হয়েছে। আমি এরআগে কোথাও এরকম দৃশ্য দেখিনি। কাজটা করে এখানকার প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হয়েছে।

    চারপাশ ঘুরে এসে পরিত্যাক্ত ট্রাকগুলোর কাছে এসে দাঁড়াল ওরা! ওদের গাড়িটা এখানেই পার্ক করে রাখা আছে। গাড়িতে উঠল ফারগো দম্পতি।

    রেমি বলল, এখানে এসে কীরকম দৃশ্য দেখতে পারি সেটা আগেভাগে মনে ঠিক করে রাখিনি ঠিকই… কিন্তু যা দেখলাম… এসব আশা করিনি।’

    শহরের দিকে রওনা হলো ওরা। গাড়ির এসি’র ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ পেয়ে রেমি চোখ বুজল। কিন্তু স্যাম ওকে আরাম করতে দিল না।

    আমাদের সাথে সঙ্গী জুটেছে।

    সোজা হয়ে উঠে বসল রেমি। চোখ মেলল। তো?’

    ‘সে আমাদেরকে তাড়া দিচ্ছে না, আবার পাশ কাটিয়ে চলেও যাচ্ছে না।’

    প্যাসেঞ্জার সাইডের আয়না দিয়ে পেছনের ট্রাকটাকে দেখল রেমি। একটু আস্তে চালাও। ট্রাকটাকে যেতে দেই। আমাদের কোনো তাড়া নেই।’

    নিশানের গতি কমাল স্যাম। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে হাত বের করে ট্রাককে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল দিল। ট্রাকের সামনের অংশ এসে ওদের গাড়ির পেছনে ধাক্কা মারার ঠিক আগমুহূর্তে ট্রাকের বিশাল ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল ওরা। গ্যাস প্যাডেল ঠেসে ধরল স্যাম। গাড়ির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করল।

    ‘শক্ত করে ধরে থাকো।’ রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে পেছনের ট্রাকটাকে দেখল ও। যদিও গাড়ির পেছনের কাঁচ কাদায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে, ট্রাকের অবয়ব দেখা যাচ্ছে তবুও। এবার সামনের রাস্তার দিকে মনোযোগ দিল স্যাম। স্পিডোমিটারের উপর চোখ বুলাল। ওর একটাই ইচ্ছা, এই নিশান গাড়িকে যত বেশি সম্ভব গতিতে তুলে তীক্ষ্ণ বাকগুলো পার হবে।

    ওদিকে ট্রাকের গতিও বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ট্রাকটা বোধহয় ওদের সামনে যেতে চায়। কিন্তু স্যাম সেটা হতে দিল না। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ট্রাকের সামনে এগোনোর জায়গাটুকু নিশান দিয়ে ব্লক করে দিল। সেই সাথে গতি বজায় রাখার জন্য গ্যাড প্যাডেলেও চাপ দিয়ে রেখেছে। মনে মনে আশা করল, ওদের ছোট গাড়িটা দানবাকৃতির ট্রাকের সাথে গতির দৌড়ে এগিয়ে থাকবে।

    বিভিন্ন বাঁক পেরিয়ে এসে সামনে সোজা রাস্তার দেখা পেল স্যাম। নিশানের গতি সর্বোচ্চতে তুলতে কোনো কার্পণ্য করল না। ওর দেখাদেখি ট্রাকের বিশাল ইঞ্জিনও তার গতি বাড়িয়ে দিল। নিশান আর ট্রাকের মধ্যেকার দূরত্ব কমে যাচ্ছে।

    হঠাৎ সামনে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক হাজির হওয়ায় বেকে পা দিল স্যাম। নিশান ব্রেক চেপে গতি কমালেও পেছনের ট্রাক তার গতি কমাল না। সজোরে এসে আঘাত করল নিশানের পেছনের অংশে। ট্রাকের বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে নিশান নিয়ন্ত্রণ হারাল। স্যাম গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার জন্য স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। ট্রাক আরেকটা ধাক্কা দিতেই দুই পা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে সাথে চেপে ধরে সিটের সাথে নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা করল রেমি। এবারের ধাক্কাটা নিশান আর কোনোভাবেই হজম করতে পারল না। ডিগবাজি খেয়ে পাহাড়ী রাস্তা থেকে ছিটকে চলে গেল নদীর দিকে।

    .

    ১৩.

    গাড়ির আঘাতপ্রাপ্ত হুড থেকে হিস হিস শব্দে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। শরীর থেকে সিট বেল্ট খুলতে স্যামকে বেশ কসরত করতে হলো। ওদের নিশান নদীতে আছড়ে পড়েছে। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে পানি ঢুকছে ভেতরে। রেমিও নিজের সিট বেল্ট খুলে ফেলল। গাড়ির ভেতরে অনবরত পানি ঢুকছে। ডুবে যাচ্ছে ওরা।

    তুমি ঠিক আছো? বিস্ফোরিত এয়ার ব্যাগকে একপাশে সরিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করল স্যাম।

    রেমি মাথা নাড়ল। একটু ব্যথা পেয়েছি।’

    নিজের হাত-পায়ের দিকে তাকাল স্যাম। প্রায় তলিয়ে যাওয়া গাড়ির কেবিনে চোখ বুলাল। কীভাবে বের হতে চাও?

    ‘আমার জানালা দিয়ে বের হব।’

    ‘ওকে।’

    আর একটু পরেই গাড়ির পুরোটা পানিতে তলিয়ে যাবে। জানালায় বেশ খানিকটা ফাঁকা অংশ আছে। সেই অংশ দিয়ে প্রথমে বাইরে বেরোল রেমি। তারপর স্যাম বের হলো। রেমি গাড়ি থেকে বের হলেও গাড়ির ঠিক পাশেই অপেক্ষা করছে। হঠাৎ একটা গুলি এসে নদীর পানিতে মুখ গুজল। গুলি করার আওয়াজটাও শুনতে পেল ওরা। রাস্তার ওদিক থেকে গুলি করা হয়েছে। গাড়ি থেকে সরে নদীর গভীরে গেল ফারগো দম্পতি। এবার আরেকটা গুলি এসে গাড়ির ছাদ ফুটো করল। নদীর স্রোত ওদের দুজনকে নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই নদীর গভীরতা মাত্র ৬ ফুট কিন্তু বৃষ্টির পানিতে এখন গভীরতা বেড়েছে।

    ‘মাথা নিচু করে যতদূর সম্ভব পাড় থেকে দূরে সরে যাও। আড়াল নাও, জলদি! রেমিকে উদ্দেশ্য করে বলল স্যাম।

    যাচ্ছি।

    নদীর স্রোতের অনেক আওয়াজ। রেমির জবাবটা স্যাম কোনমতে শুনতে পেল।

    সামনের নদীর গতিপথ সরু হয়ে যাওয়ার ফলে স্রোতের গতি বেড়ে গেছে। ফলে ওরাও এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। নদীর এই অংশের দু’পাশে অনেক ধারালো পাথর আছে। বিপদ হতে পারে ভেবে স্যাম রেমিকে নিয়ে আবার পাড়ের দিকে এগোতে শুরু করল। পাড়ে পৌঁছে ফুসফুস ভরে শ্বাস নিল ওরা। পানিতে সাঁতরে হাঁপিয়ে উঠেছে।

    আরও গুলির শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া রাখল স্যাম। ঘটনাস্থল থেকে এখন কয়েক শ ফুটে দূরে আছে ওরা। আক্রমণকারীদের হাতে যদি পিস্তল থাকে তাহলে সেটার রেঞ্জ এতদূর আসবে না। সেক্ষেত্রে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু যদি স্কোপঅলা রাইফেল থাকে তাহলে ওরা এখনও বিপদমুক্ত নয়।

    ‘অথচ এরআগে শুনেছিলাম এই দ্বীপে নাকি কোনো অস্ত্র, বন্দুক নেই। ফিসফিস করে বলল রেমি।

    ‘আসলে অস্ত্র-আইন শুধু সেইসব নাগরিকদের জন্য যারা আইন মেনে চলে। আমাদেরকে যে-বা যারা আক্রমণ করেছে তারা সেই সভ্য নাগরিকদের কাতারে নেই বলে ধরে নিচ্ছি।’

    নদীর বাঁকে কারও নড়াচড়া দেখল ওরা। মাথা নিচু করল ফারগো দম্পতি। দু’জন স্থানীয় লোককে দেখা যাচ্ছে। একজনের হাতে রিভলবার। এখান থেকে প্রায় ৩০০ ফুটে দূরে তারা। এখনও স্যাম ও রেমি দেখতে পায়নি।

    স্যাম স্ত্রীকে ফিসফিস করে বলল, ‘পাশের ঝোপে চলল। ওপাশ থেকে ওরা দেখতে পাবে না।

    ঝোঁপের ভেতরে আড়াল নিল ওরা। দেখল লোক দু’জন নদীর পাড় ধরে ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে। স্যাম আর রেমি নদীর দু’পাশেই কড়া নজর রাখছে। কোন পাশে কে ওঁত পেতে আছে বলা যায় না। আক্রমণকারী দু’জন আরও কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে গেল। ওরা দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার পর হাঁপ ছাড়ল রেমি। তবে স্যাম ও রেমি কেউ-ই আড়াল থেকে বেরোল না। হয়তো লোক দুটো ব্যাকআপ আনতে গেছে। একটু পর আবার হাজির হবে।

    ১০ মিনিট অপেক্ষা করল ওরা। কোনো শব্দ শোনার কান টান করে রেখেছে। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই শুনতে পেল না।

    মনে হচ্ছে ওরা চলে গেছে। রেমি ফিসফিস করে বলল।

    ‘ঠিক। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো এই “ওরা” টা কারা?

    হয়তো খনির সাথে জড়িত কেউ হবে। কিংবা বেসামরিক লোক। ম্যানচেস্টার হয়তো এদের কথা বলেই আমাদেরকে সতর্ক করেছিল।

    ‘হতে পারে। কিন্তু সে তো বলেছিল ওরা নাকি দ্বীপের মাঝখানে থাকে, গুহার ওদিকে।

    রেমি নদীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বুঝতে পারছি না। আমাদেরকে কেউ কেন রাস্তা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাচ্ছে কিংবা গুলি করে মারতে চাচ্ছে। তারা মিলিশিয়া কিংবা বেসামরিক লোক… যা-ই হোক না কেন… আমরা তাদের কী ক্ষতি করেছি?

    চমৎকার প্রশ্ন করেছ।

    ‘আমরা ২-১ জন বয়স্ক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচলিত লোককাহিনি শুনতে চেয়েছি, ব্যস।

    ‘জায়ান্টের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম আমরা। সেটা ভুলে যেয়ো না। নদীর বাঁকের সর্বশেষ যে স্থানে লোক দুটোকে দেখা গিয়েছিল সেদিকে তাকাল স্যাম। দেখে নিল ভাল করে। মনে হয় কেউ নেই। নিজের ভেজা কাপড়ের দিকে তাকাল। এখানকার আবহাওয়াকে এখন “ভাল” বলতে ইচ্ছে করছে। যা গরম, এই ভেজা পোশাক কয়েক মিনিটের মধ্যে শুকিয়ে যাবে।

    ‘তা ঠিক। কিন্তু এখান থেকে মেইন রোড তো প্রায় ৬-৭ মাইল দূরে। সে-খেয়াল আছে?

    ‘আছে, আছে। পায়ে হেঁটে যাওয়াটাই বোধহয় নিরাপদ হবে, কী বলো? নদী সাঁতরে তো যাওয়া ঠিক হবে না। কে যেন বলল, এখানকার অধিকাংশ নদীতেই নাকি কুমীর আছে।’

    ‘আবার নেগেটিভ চিন্তা?”

    ‘ওহ, দুঃখিত। এখানকার কোনো নদী-ই কুমীরবিহীন নয়।

    হাসল রেমি। এবার কথাটা একটু কম নেগেটিভ শোনাল। দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল ও। ঘাড় কাত করল।

    ‘জোরে লেগেছে কোথাও?’

    একটু লেগেছে। যারা গাড়ির এয়ার ব্যাগ আর সিট বেল্ট আবিষ্কার করেছিল খোদা তাদেরকে শান্তি দান করুক।’

    পেছনে দুমড়ে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকাল স্যাম। কপাল ভাল, আমি অতিরিক্ত ইস্যুরেন্স করিয়েছিলাম। আশা করা যায়, ওটা দিয়ে ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে।

    হয়তো। রেমি নিজের গালে হাত দিল। ফুলে গেছে।

    ‘এখান থেকে ফেরার দুটো রাস্তা আছে। এক- নদী। দুই- রোড। কোনদিক দিয়ে এগোলে ভাল হবে? অস্ত্রধারীদের মোকাবেলা করে রোড দিয়ে যাবে? নাকি নদীতে নেমে ২০ ফুট কুমীরের সাথে লড়বে? প্রশ্ন করল স্যাম।

    তৃতীয় কেন উপায় নেই?

    তিক্ত হাসি দিয়ে স্যাম মাথা নাড়ল। নেই।

    বয়ে যাওয়া নদীর দিকে তাকাল রেমি। আমি যদি আক্রমণকারী হতাম তাহলে যেখান থেকে আমরা গায়েব হয়েছি ঠিক ওখান থেকে এপর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে চষে ফেলতাম। ওরাও অনেকটা সেরকম-ই করেছে।

    ‘ঠিক বলেছ। একটু পরে স্রোত কমে এলে নদীর গভীরতাও কমবে। আমরা তখন নদী পার হয়ে কোনো রাস্তা খুঁজতে পারব।’ বলল স্যাম।

    ‘পথ তুমি দেখাবে। আর হ্যাঁ, কুমীরের কথা আবার ভুয়ে যেয়ো না।’

    “থ্যাঙ্কস। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম!’

    ধীরে ধীরে নদী পার হতে শুরু করল ওরা। নদীর পানি একদম পরিষ্কার। কোমর পর্যন্ত পানিতে নেমেও ওরা পা দেখতে পাচ্ছে।

    ওপারে পৌঁছে ভেঁজা কাপড় শুকানোর জন্য অপেক্ষা করল ফারগো দম্পতি। তারপর ১৫ মিনিট হেঁটে সৈকতে ফেরার রাস্তায় পৌঁছুল ওরা। দুই ঘণ্টা পর একটা পিকআপ-এর দেখা মিলল। পিকআপটা হাফ লোডেড়। ড্রাইভার রাস্তার মাঝখানে দু’জন আমেরিকানকে দেখেও কোনো অবাক হলো না। কারণ দ্বীপে হরহামেশাই বিদেশি পর্যটকরা আসে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ফারগো দম্পতি পিকআপের পেছনে উঠে লিফট নিল।

    গাড়িতে ওঠার পর স্যামের কাঁধে মাথা রাখল রেমি।

    ‘তোমার ঘাড়ের কী অবস্থা? স্যাম জানতে চাইল।

    একটা ম্যাসাজ করাতে পারলে খুব উপকার হতো।

    ‘শহরে গিয়ে দেখি তোমাকে কোনো স্পা সেলুনে ঢুকিয়ে দিতে পারি কিনা।

    হুম। যা অবস্থা করে এখানকার লোকজন। ম্যাসাজ সেলুন ভাল ব্যবসা করে নিশ্চয়ই।

    ম্যাসাজ নেয়ার আগে লম্বা সময় গোসল করে নিলে বোধহয় ভাল লাগবে।

    ‘তুমি গোসল করার কথা বলে অন্য কিছু বোঝাতে চাচ্ছ না তো?”

    “আরে, না, না। কী বলো। আমি একদম সাদা মনে কথাটা বলেছি, রেমি। খোদর কসম!

    স্বামীর আরও ঘনিষ্ঠ হলো রেমি। তাকাল স্বামীর দিকে। এসব বলেই তো শুরু করে প্রতিবার।

    হনিয়ারা-র কাছাকাছি চলে আসতেই চুপ হলে গেল স্যাম।

    কী করবে এখন?’

    ‘পুলিশের কাছে যাব। এই ঘটনার রিপোর্ট দেব ওখানে।

    “ঠিক আছে। তাহলে ড্রাইভারকে বলল, আমাদেরকে যাতে পুলিশ স্টেশনে নামিয়ে দেয়। কিংবা সেটা সম্ভব না হলে অন্ততপক্ষে যেন বলে দেয় পুলিশ স্টেশনটা কোথায়।

    ড্রাইভারের পেছনে থাকা ছোট্ট জানালায় নক করল স্যাম। চমকে উঠে ড্রাইভার কষে ব্রেক করল। হঠাৎ ব্রেক করায় স্যাম ও রেমি ধাক্কা খেল পিকআপের গায়ে।

    ‘আমাদেরকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে পারবেন? ইংরেজি বলল স্যাম।

    ড্রাইভার ইংরেজি না বুঝলেও “পুলিশ” শব্দটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। মাথা নাড়ল সে। পারবে। পিকআপ আবার চলতে শুরু করল।

    ‘আশা করছি, পুলিশরা শুধু সমাবেদনা জানিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে না। সম্ভবত ওটা একটা ডজ ট্রাক ছিল। সবকিছু এত দ্রুত হয়ে গেল যে নিশ্চিতভাবে বলতেও পারছি না। খেয়াল-ই করতে পারিনি ঠিকভাবে।

    পুলিশ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছে ওরা। এক সার্জেন্ট এসে রিপোর্ট লিখতে শুরু করল। ফারগো দম্পতিকে বেশ বিনয়ীভাবে প্রশ্ন করছে। সে। পুলিশ স্টেশনে এক ঘণ্টা কাটানো পর স্যাম ও রেমি বুঝতে পারল এখানকার পুলিশ বেশ সচেতন। ব্যবহারও ভাল। এরকম একটা দৃর্ঘটনা দ্বীপে ঘটতে পারে এটা তারা আশা করেনি। অফিসার খুব সুন্দর করে বিষয়টা ওদেরকে বুঝিয়ে বলল।

    ‘এই দ্বীপের যত রেজিস্টার্ড ট্রাক আছে সবগুলো চেক করব আমরা। তবে ওতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু ড্রাইভার যদি ভূয়া হয়ে থাকে, যদি লাইসেন্সপ্রাপ্ত না হয় তাহলে হয়তো তাকে আমরা কখনও খুঁজে পাব না।’

    ‘ওরা কিন্তু আমাদের উপর গুলি চালিয়ে ছিল। বিষয়টা গুরুত্বর। আক্সিডেন্টের পর আমরা দুজনকে দেখতে পেয়েছি। আমাদেরকে খুঁজছিল তারা।

    হ্যাঁ। আপনারদের দেয়া বর্ণনা আমি রিপোর্টে লিখে রেখেছি। দু’জন পুরুষ। স্থানীয় বাসিন্দা। উচ্চতা মাঝারি। বিশেষ কোনো চিহ্ন নেই। জিন্সের হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা ছিল। একজনের পরনে বাদামী টি-শার্ট, আরেকজন ফ্যাকাশে নীল।’ বলল অফিসার। কিন্তু সমস্যা হলো আপনাদের এই বর্ণনা সাথে দ্বীপের প্রায় অর্ধেক লোকের মিল পাওয়া যাবে। যা-ই হোক, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব।’ অফিসার মাথা নাড়ল। আপনাদের ভাড়া করা গাড়িটা থেকেও অনেককিছু জানা যাবে বলে আশা করছি। আপনাদেরকে যে ধাক্কা মারা হয়েছিল সেটার প্রমাণ নিশ্চয়ই আছে গাড়িতে। গুলিও হয়েছে বললেন। তাহলে তো গাড়িতে গুলির গর্ত থাকার কথা।

    ‘হ্যাঁ, আছে। সায় দিল রেমি।

    ‘তো আপনারা এই দ্বীপে কী জন্যে এসেছেন?

    ছুটি কাটাতে এসেছি। স্যাম যতটুকু সম্ভব সত্য কথা বলল।

    এখানকার কারও সাথে ঝগড়া হয়েছে? কোনো মতের অমিল কিংবা বিতর্ক?”

    না। এখানকার সবাই তো বেশ ভাল। রেমি উত্তর দিল।

    ‘তাহলে আপনারা বলছেন, আপনাদেরকে খুন করতে পারে এরকম কাউকে আপনারা জানেন না।

    না। আসলে সেটার কোনো মানেই হয় না।’ এবার স্যাম বলল।

    স্যামের দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকাল অফিসার। তবে কেউ না কেউ তো অবশ্যই আছে। মিস্টার ফারগো, এই দ্বীপে এরকম ঘটনা হয় না বললেই চলে। আমাদের দ্বীপের লোকজন সবাই শান্তি প্রিয়। এখানে সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেয়া হয় না। বিশেষ করে বিদেশি অতিথিদের সাথে এরকম আচরণ তো কোনোভাবেই বরদাস্ত যায় না।’

    অফিসারের কথার ধরন শুনে বোঝা গেল বিষয়টা সে স্রেফ পর্যটকদের উপর আক্রমণ হিসেবে দেখছে না। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। অবশ্য স্যাম আর কথা বাড়াল না। থানার কাজ শেষে পায়ে হেঁটে হোটলের দিকে রওনা হলো ওরা।

    বরাবরের মতো এবারও ফ্রন্ট ডেস্কের স্টাফ ওদের দিকে ভয় মাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। হোটেল থেকে বেরিয়ে ওরা যখনই আবার ফিরে আসে প্রতিবারই কোনো না কোনো কাহিনি হয়, আর ওদের চেহারা আর পোশাকেও সেটার ছাপ পড়ে।

    ‘আমরা তো এখানে কালার হয়ে গেলাম। মিনমিন করে বলল রেমি। ‘এরপর তুমি যদি বাইরে কোথাও যাও, আমি আর যাচ্ছি না।’

    স্যাম স্টাফের দিকে তাকিয়ে হাসি দিল। রেমিকে চুপিচুপি বলল, ‘পরেরবার যখন আমি বাইরে যেতে চাইব, তখন তুমি আমার মাথায় ইট দিয়ে বাড়ি মেরে থামিয়ে দিয়ো!

    .

    ১৪.

    স্যাম সেলমার সাথে ফোনে কথা বলছে। সেলমা’র কণ্ঠে উত্তেজনা। কল করেছ দেখে খুব খুশি হয়েছি। তবে তোমার নিশ্চয়ই কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে। এই এক্ষুনি আমি তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলামতোমাদের কাজের জন্য খোঁজ-খবর নিয়ে যা যা পেয়েছি সেগুলো পাঠাতে চাই। তবে তার আগে একটু বর্ণনা দেব।’

    বলল, আমি শুনছি।’

    ‘তোমার কথামতো সলোমন আইল্যান্ড নিয়ে ইন্টারনেটে খোঁজ শুরু করি। কিন্তু ইন্টারনেটে তেমন কোনো তথ্য নেই বললেই চলে।

    ‘তারপরও তুমি থেমে যাওনি?’

    অবশ্যই না। ইন্টারনেট ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে ভাবলাম এমন ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যারা গোয়াডালক্যানেল-এর ইতিহাস সম্পর্কে জানে। খোঁজ নিয়ে দেখি দ্বীপের অনেকেই বিভিন্ন সময় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে গিয়ে বাস করেছে। কারণ, দ্বীপের নিকটবর্তী এই দুটো দেশই বেশ উন্নত।

    ‘ঠিক…’ স্যাম বেশ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। এসব ভণিতা শেষ করে সেলমা কখন আসল কথা বলবে।

    ‘সিডনিতে আমার কিছু বন্ধু আছে। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ওই দ্বীপের ইতিহাস সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জ্ঞান রাখেন এক ভার্সিটির নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর। নাম: ড, সিলভিস্টার রোজ। প্রফেসরকে ফোন করলাম আমি। কথা বললাম অনেকক্ষণ। অমায়িক ব্যক্তি।

    ‘খুব ভাল করেছ।’ বলল স্যাম। মনে মনে আশা করল, সেলমা যেন খুব দ্রুত মূল প্রসঙ্গে কথা বলে।

    ‘প্রফেসর সাহেব বিগত কয়েক বছর যাবত দ্বীপটাকে নিয়ে গবেষণা করছেন। দ্বীপের সংস্কৃতি, বাসিন্দাদের স্বভাব, লোককাহিনি সংগ্রহ করে আসছেন। তাকে ডুবে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ আর অভিশপ্ত সৈকত নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে বলেছিলেন, লগ-বুক দেখে জানাবেন। তো গতকাল প্রফেসর আমাকে নিজেই ফোন করে জানালেন, যা খুঁজছিলেন সেটা পেয়েছেন এবং সেগুলো পাঠিয়েও দিয়েছেন আমার কাছে।

    তুমি পেয়েছ সেগুলো?

    হ্যাঁ। তোমাকে পড়ে শোনাতে চাই।’

    স্যাম চোখ বন্ধ করল। তাহলে তো খুব ভাল হয়।

    ঠিক আছে, পড়ছি। “… এখানকার একটা গল্প নিয়ে আলোচনা করা একদম নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ হলে যেটা হয় গোপনে গোপনে সবাই সেই গল্প নিয়ে আলোচনা করত। আলোচনা হতো বলেই গল্পটা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এখনও টিকে আছে। নইলে অনেক আগেই কালের গভীরে হারিয়ে যেত। গল্পটা আমি শুনেছিলাম গোয়াডালক্যানেলের এক কবিরাজের মুখে। স্থানীয় এক সর্দার আমাকে তাঁর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত বছরে একবার হলেও আমি আর সেই কবিরাজ দেখা করতাম। গতবছর যখন দেখা হয়েছিল তখন একরাতে গল্পটা বলেছিলেন তিনি।”

    সেলমা একটু থেমে গলা পরিষ্কার করে নিল। অনেক বছর আগের কথা। শ্বেতাঙ্গরা এই দ্বীপে আসার আগে… তখন দ্বীপ জুড়ে সব স্থানীয় লোকজন বসবাস করত। একজন রাজা ছিল তাদের। তবে সে কোনো সাধারণ রাজা ছিল না। জাদু জানত। সাগর, আকাশ ও ধরণীর দেবতাদের নির্দেশ দিতে পারতো সে। দ্বীপের বাসিন্দাদেরকে নিয়ে এক শক্তিশালী জাতি গড়েছিল। যুদ্ধের ময়দানে তার শক্তির জন্য সবাই পেত, তেমনি প্রজাদের প্রতি উদার মানসিকতার জন্য ভালওবাসত সবাই। রাজার নাম ছিল লক। তাঁর জীবদ্দশায় এই নাম খুব বিখ্যাত ছিল।”

    ইন্টারেস্টিং।

    ‘গল্প তো কেবল শুরু। “একপর্যায়ে রাজা ঘোষণা দিয়েছিল আলিশান ইমারত তৈরি করা হবে। যেরমকটা এরআগে কেউ কখনও দেখেনি। শ্রমিকদের অনেক বছর পরিশ্রমের মাধ্যমে পাথরের সাহায্যে সাগরে একটা ইমারত নির্মিত হলো। রাজা তো আছে। এবার একটা রাণী দরকার। দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করল রাজা। পাত্রীও সম্ভ্রান্ত ঘরের। দ্বীপের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সর্দারের মেয়ে। কথিত আছে, রাণী খুব সুন্দরী ছিল। ফলে রাজা নিয়ম করে দিয়েছিল কেউ যেন রাণীর দিকে সরাসরি চোখ তুলে না তাকায়। বলা হয়ে থাকে সেখান থেকেই এই দ্বীপের মেয়েদের দিকে সরাসরি চোখ তুলে না তাকানোর রীতি চালু হয়েছে।”

    ‘আর ভেবেছিলাম লজ্জার কারণে সরাসরি তাকানো হয় না।

    ‘উঁহু, তা নয়। “ইমারত নির্মাণ শেষ হওয়ার পর একদিন সকালে বেশ ঘটা করে দ্বীপের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সপ্তাহব্যপী আনন্দ উৎসব করার উদ্দেশে। এরআগে কয়েক মাস ব্যপী বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও বনিকদের কাছ থেকে উপটৌকন সংগ্রহ করেছিল রাজা। যাবতীয় সোনা-দানা, মূল্যবান রতু সব নতুন ইমারতের কোষাগারে রাখা হয়েছিল। রাজা এসব রত্ন প্রদর্শন করছিল সকালের সূর্য উদয়ের সময়। পাশে ছিল তাঁর প্রধান পুরোহিত ও সুন্দরী স্ত্রী। কথিত আছে, দেবতারা রাজার এরকম অহংকার প্রদর্শনে ক্ষিপ্ত হয়ে ভূমিকম্প ঘটান। ওরকম মারাত্মক ভূমিকম্প এরআগে দ্বীপের বাসিন্দারা কখনও দেখেনি। ভূমিকম্পে দ্বীপের অনেক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি রাজার আলিশান ইমারতও সাগরে তলিয়ে যায়। যারা ইমারত দেখতে এসেছিল তাদের অধিকাংশ নিখোঁজ হওয়ার পর অল্প কয়েকজন প্রাণে বাঁচতে পেরেছিল তখন। এই ভূমিকম্পের পর তারা অনুধাবন করল, রাজার অত্যাধিক বাড়াবাড়ির কারণেই এরকম দূর্যোগ দেখা দিয়েছে। প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে রাজা। তাই এরকম রাজার নাম দ্বীপবাসীরা আর কখনও উচ্চারণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর নির্মিত ইমারত, মন্দির কোনোকিছুই নিয়ে কোনো কথা বলা চলবে না। সেইসাথে সাগরের ওই অংশকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়।” লেখাটা এখানেই শেষ।

    ‘তাহলে সলোমন আইল্যান্ডের এরকম রীতিনীতি সরাসরি ওই ভূমিকম্পের ফল?

    ‘সেরকমটাই তো দেখছি। কিন্তু আমি আটকে গেছি একটা বিষয়ে। সেটা হলো, ধন-রতুগুলো দেবতাদের ক্ষীপ্ত হওয়ার একটা মূল কারণ। যেটার পরিষ্কার মানে দাঁড়াচ্ছে, ওই সম্পদগুলোকেও আর ছুঁয়ে দেখার সাহস করেনি।

    ‘গুপ্তধন। এরকম চ্যালেঞ্জ নিতে আমি কখনওই পিছ পা হইনি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই লোককাহিনির সত্যতা কতটুকু? আদৌ কি কিছু পাওয়া যাবে?

    ‘প্রফেসর এ-ব্যাপারে আর কিছু জানাতে পারেননি। কারণ পুরো বিষয়টা নিষিদ্ধ জ্ঞান। কবিরাজ তাকে এসব গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছিলেন। তাই প্রফেসরের পক্ষে দ্বীপের অন্য কাউকে আর এ-ব্যাপারে জিজ্ঞাস করা সম্ভব হয়নি। প্রায় ১ যুগ ধরে ওখানে যাতায়াত ছিল প্রফেসরের। ওখানকার লোকজনদের সাথে একটা পারস্পরিক বোঝাঁপড়া আর বিশ্বস্ততার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি সম্পর্কটাকে নষ্ট করতে চাননি। কিন্তু গোপন কথা এক কান থেকে দুকান হওয়া মানেই সেটা আর গোপন না থাকা। কবিরাজ হয়তো এভাবে অন্য কাউকেও গল্পটা শুনিয়েছিলেন। আর তিনি নিজেও হয়তো শুনেছিলেন কারও কাছ থেকে। তোমরা যদি ওখানকার লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও এ-ব্যাপারে কিছু জানতে না পারো তাহলে বুঝতে পারবে দ্বীপের বর্তমান প্রজন্ম এই গল্পের ব্যাপারে অজ্ঞ। যারা জানতো তারা মারা গেছে। তাই নতুন প্রজন্ম হয়তো গল্পটা জানে না। কিংবা অতীত জানার ব্যাপারে হয়তো তাদের আগ্রহও নেই।

    আপনমনে মাথা নাড়ল স্যাম। হ্যাঁ। যুদ্ধের পর এই দ্বীপে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো এখানকার লোকজন ইংরেজি বলতে পারে না। যারা বলতে পারে তারা সংখ্যায় খুব কম। শহরের দিকে থাকে তারা। এসব লোককাহিনি তারা জানে না। তাই আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি।

    ‘আচ্ছা, আমি যতটুকু জানতে পেরেছি ততটুকু তোমাকে জানিয়ে দিলাম। তবে প্রফেসর বলেছেন, তুমি যদি তাকে ফোন করো তাহলে উনি আরও কিছু তথ্য জানাবেন। আমি তোমাকে তার নাম্বার আর কিছু কিছু কাগজ স্ক্যান করে পাঠাচ্ছি।’

    ‘ঠিক আছে। কিন্তু তোমার কী মনে হয়, তাঁর সাথে কথা বলে কোনো লাভ হবে?

    ‘যতদূর বুঝেছি, তিনি যা জানতেন সব ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন। নতুন করে হয়তো আর কিছু জানাতে পারবেন না। মূলত তোমার সাথে কথা বলতে চাওয়ার পিছনে তার একাডেমিক স্বার্থ আছে। গোয়াডালক্যানেলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেবেন হয়তো। আমি অবশ্য তাকে এখনও রাজার সেই ইমারতের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার বিষয়টা খোলাসা করে বলিনি।’

    ‘খুব ভাল করেছ। কথা চেপে রাখতে তোমার জুড়ি নেই।

    ‘এটা তো আমার কাজের মধ্যে পড়ে, তাই না? কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রফেসরের ই-মেইল অ্যাড্রেস তোমার ইনবক্সে পেয়ে যাবে। আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন কোরো। একটু ইতস্তত করল সেলমা। তোমাদের এই অভিযান দ্রুত শেষ হলে আমি খুশি হই। সাবধানে থেকো।’

    সম্প্রতি ওদের উপরে হয়ে যাওয়া হামলার কথাটা সেলমাকে জানাবেন না বলে ভাবল স্যাম। কিন্তু বিষয়টা নিজের মাঝে চেপে না রেখে অন্য কাউকে জানানোটা হয়তো নিজের জন্যই মঙ্গল বলে ভাবল ও। ই, আজকের দিন পর্যন্ত সব বেশ ভালই চলছিল।’

    ‘তো আজ কী হয়েছে?

    আমাদেরকে রাস্তা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে গুলি চালিয়েছিল কারা যেন। এছাড়া দ্বীপটা মন্দ নয়’

    সেলমা গম্ভীর হয়ে গেল। তুমি মজা করছ।

    সত্য ঘটনা সবসময় কাল্পনিক গল্পের চেয়েও বেশি বৈচিত্রময় হয়।

    ‘তোমাদের পেছনে কারা লেগেছে?

    ‘তা জানি না।’

    হু। এ-ব্যাপারে আমি কোনো সাহায্য করতে পারি?

    ‘না মনে হয়। তবে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে বিষয়টা জানিয়ে রাখতে পারো। আমরা আবার গুম-টুম হয়ে যাই কিনা!”

    খুব সুন্দর চিন্তা-ভাবনা তোমার!

    যা-ই হোক, সেলমা। আমাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। বরাবরের মতো এবারও আমরা সব ম্যানেজ করে নেব। এখান থেকে নতুন কিছু জানতে পারলে ফোন দেব তোমাকে।’

    স্যাম ফোন রাখতেই ওর দিকে তাকাল রেমি। সেলমা তথ্য যোগাড় করতে পেরেছে তাহলে?

    ‘ওকে কোনোবার ব্যর্থ হতে দেখেছ?”

    “হুম, হয়েছে। এবার বলল, ও কী কী বলল।

    স্ত্রীকে সব খুলে বলল স্যাম।

    ‘আমরা শুধু বন্ধুকে সাহায্য করতে এসেছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে গুপ্তধনও পাওয়া যেতে পারে। আমাদের কপালটাই এরকম। তাই না?

    ‘গুপ্তধনের বিষয়টা সত্য নাকি মিথ্যা, কে জানে। আর হাজার বছরের পুরানো গুপ্তধনের বর্তমানে কী হাল হয়ে আছে তা তো বলা যাচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে, সেগুলো স্রেফ জঞ্জালে পরিণত হয়েছে এতদিনে।

    তুমি সোনা আর অন্যান্য রত্নে কথা বলেছ। ওগুলোর তো এখনও অনেক চাহিদা আছে। এখানে এসে কিন্তু একটা সুন্দর পাথর পর্যন্ত আমাদের চোখে পড়েনি। আমি বলি কি, আমরা অফিসিয়ালি এই অভিযানকে ট্রেজার হান্টিং অভিযান হিসেবে নিই। যাকে যাকে জানানো দরকার জানাই।’

    স্যাম রত্ন উদ্ধারের বিষয়টাকে অতটা গুরুত্ব দিল না। অবশ্যই। লিওকে সব জানাব।

    ‘আর তারপর আমরা যদি গুপ্তধন খুঁজে পাই তাহলে সেগুলো হস্তান্তর করব স্থানীয় সরকারের কাছে। ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকাল রেমি। আউ!

    ‘চলো, ডাক্তারের কাছে যাই।

    ‘হাসপাতালে যেতে হবে না।’

    “মিসেস ফারগো ম্যাডাম, ভুলে যাবেন না আপনি ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে গাড়ি নিয়ে নদীতে আছড়ে পড়েছিলেন। কপট রাগ দেখাল স্যাম।

    রেমি শ্রাগ করল। উফ! আচ্ছা, বাবা, যাব। কিন্তু কোনো ইনজেকশন নেব না কিন্তু! আগেই বলে দিলাম!

    ‘সম্ভব হলে তোমার ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করব। কিন্তু না হলে কী আর করা।

    “বিশ্বাসঘাতক একটা!

    .

    ১৫.

    ‘তেমন কিছুই হয়নি। স্রেফ রগে টান লেগেছে। আপনার দৃষ্টিশক্তিরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। গুরুত্বর কোনো আঘাতের লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সবদিক থেকেই বেশ সুস্থ আছেন।’ রেমিকে চেকআপ করে জানাল ডা. ভ্যানা।

    ভাল খবর।’ স্যাম বলল।

    তবে হুটহাট নড়াচড়া করা যাবে না। চট করে এদিক-ওদিক মাথা ঘোরালে ঘাড়ের ব্যথা আরও বাড়বে। অবশ্য আপনি চাইলে আমি একটা কলারের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। গলায় পেঁচিয়ে পরে থাকবেন। সুবিধে হবে।’

    ভ্রু কুঁচকাল রেমি। ওই জিনিস আমার মোটেও পছন্দ নয়।’

    আসলে কলার গলায় পরতে কারও ভাল লাগে না। যা-ই হোক, পরবেন কি পরবেন না সেটা সম্পূর্ণ আপনার মর্জি। না পরলেও কোনো সমস্যা নেই। মারা যাবেন না। তবে সাবধানে থাকবেন। আপনার ভাগ্য ভাল। ওইরকম একটা দূর্ঘটনার পরও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। তার উপর গুলিও চালানো হয়েছিল। অথচ আপনার তেমন কিছু হয়নি। সামান্য একটু আঘাত পেয়েছেন মাত্র। স্যামের দিকে তাকাল ও। আর আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, আপনার কিছুই হয়নি।’

    ‘এয়ার ব্যাগগুলো ঠিকঠাকভাবে কাজ করেছিল বলে কিছু হয়নি। বলল স্যাম।

    হুম। আচ্ছা, আপনাদের উপর কেন হামলা হয়েছে, সে-ব্যাপারে পুলিশ কোনো সম্ভাব্য কারণ বলেছে?

    স্যাম মাথা নাড়ল। না, তেমন কিছু তো বলল না।

    যাক, বেশি হতাশ হয়ে পড়বেন না। আমাদের দ্বীপটা কিন্তু বেশ সুন্দর। কিন্তু আপনাদের সামনে শুধু খারাপ দিকগুলোই বেশি পড়ছে। বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না।’

    ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না, আমাদেরকেই কেন টার্গেট করা হলো? রেমি এতক্ষণ হাসপাতালের বেডে শুয়েছিল, এখন উঠে বসল।

    ‘সেটা জানার কোনো উপায় নেই। গুজব আছে পাহাড়ে নাকি অস্ত্রধারী বিদ্রোহীরা থাকে। হয়তো আপনারা তাদের কোনো পরিকল্পনা কিংবা কাজে বাগড়া দিয়ে ফেলেছেন। অথবা এমন কিছু দেখে ফেলেছেন যেটা দেখা ঠিক হয়নি।’

    ‘যেমন? জানতে চাইল স্যাম।

    ‘আমার কোনো ধারণা নেই। আমি জাস্ট কিছু ধারণার কথা বললাম। এরআগে আমি এরকম কোনো হামলার কথা শুনিনি। তাই স্রেফ অনুমান নির্ভর কথা বলছি। কেন যেন মানুষ এরকম আক্রমণাত্বক কাজ করে?’ ভ্যানা একটু ইতস্তত করল। আমি এক মহিলার চিকিৎসা করেছিলাম। তার স্বামী ম্যাচেটি দিয়ে কুঁপিয়েছিল তাকে। কোনো কারণ ছাড়াই। মহিলাটা আমাকে বলেছিল, এভাবে কোপানোর কোনো সঠিক কারণ নেই। হয়তো মহিলা এমনকিছু বলেছিল কিংবা করেছিল যেটা খেপিয়ে দিয়েছিল লোকটাকে। ঈশ্বরের কৃপায় মহিলাটা বেচে গিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে তার স্বামীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে নাকি পাহাড়ে চলে গেছে। এমনও হতে পারে সেই লোকটাই আপনাদের উপর হামলা করেছে! কে জানে!?

    ‘আচ্ছা, দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে কতজনের গাড়ি আছে?’ রেমি জানতে চাইল।

    ‘তা তো বলতে পারছি না। এখানকার জনসংখ্যা ১ লক্ষেরও কম। জনসংখ্যার বেশিরভাগই হনিয়ারা-তে বাস করে। আমার মনে হয়, আনুমানিক ৫ হাজার গাড়ি আছে দ্বীপে।

    ‘তাহলে ওই ট্রাকটাকে খুঁজে বের করাটা তো খুব কঠিন কিছু নয়।

    ‘তাত্ত্বিকভাবে বিচার করলে আপনার কথা ঠিক। কিন্তু অধিকাংশ ট্রাক গ্রাম্য এলাকায় থাকে। পুলিশ ১ সপ্তাহ ধরে সময় ব্যয় করে একটা ট্রাককে খুঁজে বের করবে বলে মনে হয় না। আবার করলে করতেও পারে। পুলিশ স্টেশন থেকে কি আপনাদেরকে নিশ্চিত করে কিছু বলেছে?

    তিক্ত হাসি দিল স্যাম। না, সেভাবে কিছু বলেনি।’

    ‘তাহলে তো জবাব পেয়েই গেছেন। আমি দুঃখিত। কিন্তু এখানে থাকতে হলে আপনাকে আশা করা ছাড়তে হবে। কোনোকিছুতেই আশা রাখবেন না। ভাল থাকবেন।

    স্যাম ও রেমি দরজার দিকে এগোল। আচ্ছা। আর হ্যাঁ, আমাকে চেকআপ করার জন্য ধন্যবাদ।’

    ডা. ভ্যানা হাসল। খুব শীঘ্রই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা করছি। আপনাদের দু’জনের উপর দিয়েই বেশ ধকল গেছে। কয়েকদিন বিশ্রাম করা উচিত। আপনাদের কী পরিকল্পনা?

    ‘যেখান থেকে গাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে দূর্ঘটনার ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেব। মালিকের গাড়ি এখন আধুনিক শিল্পকর্মে পরিণত হয়ে গেছে কিনা!’ বলল স্যাম।

    ‘আচ্ছা, বেশ। যা-ই করুন, বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করবেন। এখানে সুন্দর সৈকত আছে। আয়েশ করুন।

    সাথে কুমীরও আছে।

    শহরে নেই বললেই চলে। আমি তো বারান্দায় ককটেল ড্রিঙ্ক নিয়ে বসে সূর্যাস্ত দেখি।

    ***

    প্রখর রোদের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কার রেন্টাল অফিসে গেল ওরা। গাড়ির মালিককে সবকিছু বুঝিয়ে বলল। মালিককে দেখে মনে হলো সে বোধহয় কেঁদেই ফেলবে। বেচারা তার নিশানের এই হাল দেখে খুব কষ্ট পেয়েছে। ফারগো দম্পতি তার কাছ থেকে আরেকটা গাড়ি ভাড়া নেয়ার সাহস করল না। হোটেলে ফেরার আগে পুলিশ রিপোর্টের একটা কপি মালিককে দিল ওরা।

    মেইন রোড়ে ওঠার পর রেমির দিকে ঝুঁকল স্যাম। ফিসফিস করে বলল। ‘পেছনে তাকিয়ো না। আমার মনে হয়, আমাদেরকে ফলো করা হচ্ছে।

    ‘আমার ঘাড়ের যা অবস্থা তাতে আমার পক্ষে পেছনে তাকানো সম্ভবও নয়। কে ফলো করছে?

    ‘অপরিচিত। সেডানে চড়ে আসছে এক লোক। বিষয়টা আমার চোখে পড়েছে কারণ আমাদের সাথে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গাড়িটা।’

    ‘প্রতিবার আমার বাইরে বেরোলেই কোনো না কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবেই। তুমি নিশ্চিত, আমাদেরকে ফলো করা হচ্ছে?

    ‘এক মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারব।’

    হাঁটার গতি কমিয়ে দিল ওরা। আশা করল, সেডানও সেটার গতি কমিয়ে দেবে। কিন্তু দিল না। শ্রাগ করল স্যাম। একটু সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েছি বোধহয়।

    ‘একটু?

    ‘রাস্তায় ট্রাকের ধাক্কা আর গুলির মুখ থেকে ফিরে আসার পর এরকমটা হতেই পারে।

    হয়েছে। তোমার ধারণা ভুল হয়েছে। খুশি হয়েছি।’

    পেছনে তাকাল স্যাম। পথচারীরা সূর্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন ভবনের ছায়ার নিচ দিয়ে পথ চলছে। কেউ ফলো করছে না ওদের। যে যার মতো চলছে।

    হোটেলে ফিরে দেখল লিও ওদের জন্য অপেক্ষা করছে লবিতে। ওরা তিনজন পুল বার-এ গেল। সমুদ্র দেখতে দেখতে কথা বলা যাবে। লিও বয়স্ক লোকদের মতো হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে নিজের স্কুবা ডাইভিঙের ট্রেনিঙের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করল ও। এত কঠিন ট্রেনিঙে লিও খুব বিরক্ত।

    সাঁতরে পাক দিতে বলেছে আমাকে। তাও আবার ২০ পাক! আমার ধৈর্যশক্তি পরীক্ষা করতে চায়। ২ পাক দিয়েই আমার অবস্থা কাহিল। ১০ পাক দেয়ার পর মনে হলো আমার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

    কিন্তু ২০ পাক তো ঠিকই দিয়েছ।’ বলল রেমি।

    ‘তোমার মুখে কী হয়েছে? অবশেষে লিও’র চোখে বিষয়টা পড়েছে। ‘কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে।’

    ‘ওহ, তোমাকে এখনও বলিনি? কে যেন আমাদের গাড়িকে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়ে গুলি চালিয়েছিল। স্যাম বলল। রেমি মাথায় একটু ব্যথা পেয়েছে। নদীর স্রোত ঠেলে আমরা পালিয়ে এসেছি।’

    লিও এমন একটা ভাব করল যেন ওরা দু’জন পাগল। আরে নাহ। ঠিক করে বলল, কী হয়েছে?

    হাসল রেমি। আমি উল্টাপাল্টা বকছিলাম। স্যাম আমাকে মেরে এই হাল করেছে।’

    লিও মাথা নাড়ল। তোমাদের দুজনের যে কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

    “লিও, আমাদেরকে সত্যি সত্যি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কে বা কারা কাজটা করেছে আমরা সেটা জানি না। আজকে সকালে ঘটেছে এসব।

    ওদের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে লিও। মশকরার চিহ্ন খুঁজছে। কিন্তু ফারগো দম্পতির চোখে কোনো ইয়ার্কির চিহ্ন দেখতে পেল না। ‘বিশ্বাস হচ্ছে না।

    ‘আমি জানি। এই মাত্র পুলিশ স্টেশন আর হাসপাতালে কাজ সেরে এলাম। তবে খারাপ খবরের পাশাপাশি ভাল খবরও আছে। সেটা হলো, ধ্বংসাবশেষের কোথাও গুপ্তধন থাকতে পারে।

    ‘বলো কী? জানলে কীভাবে?

    লিও-কে সব খুলে বলল স্যাম। কিন্তু লিও-কে মোটেও উত্তেজিত মনে হলো না। বরং আরও হতাশ লাগছে।

    ‘তারমানে, ওটা রাজার বাড়ি? অভিশাপের সাথে এবার গুপ্তধনও যোগ হলো?’

    ‘তোমার বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এটা খারাপ খবর।’

    এতে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে গেল। আমার তো মনে হয় এজন্যই তোমাদের উপর হামলা হয়েছে। কবিরাজ ছাড়াও অনেকেই জানতো গল্পটা। গুপ্তধনের বিষয়টা নিশ্চয়ই তারাও জানে। হতে পারে অন্য কেউ এটার পেছনে লেগেছে। ডাইভার থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন যারাই ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে জেনেছে… তাদের মধ্যে থেকে কেউ হয়তো বড় কিছু প্ল্যান করে বসে আছে।

    স্যামের দিকে তাকাল রেমি। লিও ঠিকই বলেছে। এখানকার অধিকাংশ লোকই গরীব। এরকম গুপ্তধন পেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে।

    ‘ঠিক। কিন্তু আমরা তো নিশ্চিতভাবে জানি না আদৌ গুপ্তধন আছে কিনা। কিংবা ঠিক কোথায় আছে। তাছাড়া ভুলে গেলে চলবে না, ৮০ ফুট পানির নিচে রয়েছে ওগুলো। আর পানিতে কুমীর আর হাঙর দুটোরই অবাধ চলাচল। গুপ্তধন কোথায় আছে সেটার হদিস বের করার আগেই আমাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করাটা বোকামি নয়?’ বলল স্যাম।

    রেমি মাথা নাড়ল। তুমি বিষয়টাকে জাতিগত বিদ্বেষ হিসেবে দেখছ। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা কোনো কিছুতে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছি কিংবা দাঁড়াতে যাচ্ছি। হতে পারে সেটা স্মাগলিং, ড্রাগস কিংবা অন্য কোনোকিছু। সব ধাঁধার উত্তর আমরা পাচ্ছি না। কারণ অনেক কিছু এখনও আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেছে।’

    মাথা নাড়ল স্যাম। আমরা বউ সবসময় ঠিক কথাটাই বলে। এবারও বলল।

    তাহলে আমাদের কী হবে? আমরা এখন কী করব?’ লিও জানতে চাইল।

    ‘চোখ-কান খোলা রাখা ছাড়া কিছু করার দেখছি না। শিপটা না আসা পর্যন্ত ডাইভও দিতে পারছি না আমরা।’ বলল স্যাম।

    ‘অপরিচিত লোকদের আমার পছন্দ নয়। তার উপর যারা গুলি করে তাদের তো আরও অপছন্দ।

    ‘আমিও তোমার সাথে একমত, বন্ধু। কিন্তু আপাতত আমাদের আর কিছু করার নেই। অপরিচিতদের পরিচয় বের করার পেছনে সময় নষ্ট না করে আমরা বরং সম্ভাব্য গুপ্তধন সম্পর্কে আমাদের অর্জিত জ্ঞানকে ভাল ভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। আমার মনে হয়, এখানে ডাইভ দিতে এখন বিশেষজ্ঞ ডাইভার প্রয়োজন। কারণ বিস্তর অনুসন্ধানের জন্য জাহাজে থাকা ডাইভার যথেষ্ট নয়। একদম পেশাদার ডাইভার দরকার আমাদের, যাদের বেশ অভিজ্ঞতা আছে।’

    লিও মাথা নাড়ল। ওরকম লোকজনকে চেন বলে মনে হচ্ছে?’

    হাসল স্যাম। না, ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় নেই সেভাবে। যাদের সাথে পরিচয় আছে তারা সবাই যে যার ব্যক্তিগত প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। তবে তোক যোগাড় হয়ে যাবে। সেলমাকে বলব। ও সব ম্যানেজ করে দিতে পারবে।’

    রেমি স্যামের একটা হাত তুলে নিল। সবসময় স্যাম কোনো না কোনো দারুণ আইডিয়া বের করে। আমিও স্যামের সাথে একমত। এখানে বিশেষজ্ঞ ডাইভার নিয়ে নামা উচিত।’

    ‘শিপ আসবে কবে?’ লিও প্রশ্ন করল।

    কাল সন্ধ্যায়।

    ‘তাহলে আগামী ২৪ ঘণ্টা নিজেদেরকে নিরাপদে রাখো। খুন হয়ে যেয়ে। এদিকে আমি স্কুবা ডাইভিরে নির্যাতন সহ্য করতে থাকি। কোর্সটা শেষ করতে হবে।’

    রেমি হাসল। ভাল বুদ্ধি।

    বিশেষ করে “খুন হয়ে যেয়ো না” অংশটুকু শুনতে দারুণ লেগেছে।’ সায় দিল স্যাম।

    ‘আঁজোপাড়া গায়ে আর যাচ্ছি না।’ রেমি সাফ সাফ জানিয়ে দিল।

    ‘হুম। এখানে প্রতিদিন আমাদের সাথে কোনো না কোনো অঘটন ঘটেই।’

    ‘আর কালকে নতুন একটা দিন আসছে। অর্থাৎ, আবার নতুন কোনো অঘটন।

    ‘কিন্তু হিসেব করে দেখলাম, আজকেই দুটো অঘটন ঘটে গেছে। ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে পাহাড় থেকে নদীতে পড়া আর গুলিবর্ষণ। সেহিসেবে আশা করা যায়, কালকে কোনো অঘটন ঘটবে না।

    ‘আগে দেখি কী হয়। তারপর তোমার কথা বিশ্বাস করব।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার
    Next Article পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.