Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট – অ্যালেক্স মাইকেলিডিস

    লেখক এক পাতা গল্প365 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.১১ থেরাপি রুমে

    ৪.১১

    থেরাপি রুমে আমার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে আছে অ্যালিসিয়া।

    “শুরু করার আগে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম। কিছু বিষয় এখনও পরিস্কার হয়নি…”

    কোন জবাব দিল অ্যালিসিয়া। সেই অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

    “আসলে, আমি আপনার এই দীর্ঘদিন মুখ বন্ধ রাখার ব্যাপারটা বুঝতে চাইছি। জানতে চাই যে কেন কথা বলা থামিয়ে দিয়েছিলেন।”

    প্রশ্নটা শুনে দৃশ্যতই হতাশ মনে হলো অ্যালিসিয়াকে। জানালার দিকে মুখ ফেরালো সে।

    কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম দু’জন। উত্তর জানার জন্যে ভেতরে ভেতরে অধীর হয়ে উঠলেও, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। তাহলে কি অ্যালিসিয়ার কথা বলাটা সাময়িক ছিল? এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে সে? তা হতে দিতে পারি না আমি।

    “অ্যালিসিয়া, আমি জানি ব্যাপারটা আপনার জন্যে কষ্টের। কিন্তু একবার যদি আমার সাথে এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করেন, তাহলে দেখবেন অনেকটাই সহজ লাগছে, সত্যি।”

    কোন উত্তর নেই।

    “চেষ্টা করুন। প্লিজ। এতটা পথ পাড়ি দেয়ার পর হাল ছেড়ে দিবেন না। বলুন আমাকে…কেন কথা বলেননি এতদিন?”

    শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল অ্যালিসিয়া। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল :

    “কিছু…কিছু বলার নেই।”

    “মাফ করবেন, আপনার এই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। বলার মত কিছু না কিছু অবশ্যই আছে।”

    আবারো বিরতি। কাঁধ নাচালো অ্যালিসিয়া। “হয়তো। হয়তো…ঠিকই বলছেন আপনি।”

    “বলুন তাহলে।”

    দ্বিধা ফুটলো অ্যালিসিয়ার চেহারায়। “য-যখন গ্যাব্রিয়েল মারা যায়…প্রথমে…আ-আমি কথা বলার চেষ্টা করি…কিন্তু পারিনি। মুখ খুলেছিলাম, কিন্তু কোন শব্দ বের হয়নি। অনেকটা স্বপ্নের মত… যেখানে চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারি না আমরা…”

    “আপনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তখন। কিন্তু এর পরে তো কথা বলতে সমস্যা হবার কথা নয়, তাই না?”

    “ততদিনে…অর্থহীন মনে হচ্ছিল সবকিছু। বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল।”

    “দেরি হয়ে গিয়েছিল? আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা বলছেন?”

    একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অ্যালিসিয়া। তার মুখের হাসিটা দুর্বোধ্য ঠেকছে এখন। কোন কথা বলল না।

    “আবারো কথা বলা শুরু করলেন কেন?”

    “সেটার উত্তর তো আপনি জানেন।”

    “আসলেই জানি কি?

    “আপনার জন্যে।”

    “আমি?” বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে।

    “আপনি এখানে এসেছেন বলেই…”

    “তাতে কি আসলেও পরিস্থিতির কোন রদবদল হয়েছে?”

    “হয়েছে, আলবত হয়েছে।” পরবর্তী কথাগুলো নিচুস্বরে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল অ্যালিসিয়া। “আমি চাই আপনি বুঝুন, আমার সাথে কী হয়েছিল, কেমন লেগেছিল। আপনার বোঝাটা জরুরি।”

    “আমি আসলেও বুঝতে চাই। সেজন্যেই তো ডায়েরিটা দিয়েছিলেন, তাই না? যাতে আমি বুঝতে পারি। আপনার কাছের মানুষগুলো সেই লোকটার ব্যাপারে আপনার কথা বিশ্বাস করেনি। আপনি বোধহয় নিশ্চিত হতে চাইছিলেন…আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কি না।”

    “আপনি বিশ্বাস করেন।” সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, এই চিরন্তন সত্যটা সবাই যেভাবে বলে, সেভাবেই কথাটা বলল অ্যালিসিয়া।

    মাথা নাড়লাম। “হ্যাঁ। আপনাকে বিশ্বাস করি আমি। তাহলে সেখান থেকেই শুরু করি নাহয়? ডায়েরির একদম শেষে লিখেছিলেন যে লোকটা আপনাদের বাসায় ঢুকে পড়েছে। এরপর কি হয়েছিল?”

    “কিছু না।”

    “কিছু না?”

    মাথা ঝাঁকালো অ্যালিসিয়া। “ভুল ভেবেছিলাম আমি। অন্য একজন এসেছিল”

    “কে?”

    “জিন-ফিলিক্স। প্রদর্শনীর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল সে।”

    “আপনার ডায়েরির লেখাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, তখন কারো সাথে কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না আপনি।”

    জবাবে কাঁধ ঝাঁকালো অ্যালিসিয়া।

    “কতক্ষণ ছিল জিন-ফিলিক্স?”

    “খুব বেশিক্ষণ না। ওকে চলে যেতে বলি আমি। কষ্ট পেয়েছিল, কিছুক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচিও করে। কিন্তু কথা শোনে।”

    “এরপর? জিন-ফিলিক্স চলে যাবার পর কি হলো?”

    “সে ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিনা।”

    “কিছুই বলবেন না?”

    “আপাতত না।”

    আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো জানালার দিকে মুখ ফেরায় অ্যালিসিয়া। অন্ধকার হয়ে আসা আকাশ দেখছে জানালার ফাঁক দিয়ে। মাথা কাত করে রাখার ভঙ্গিতে অনেকটা ছেলেমানুষী ভাব, ঠোঁটের কোণায় হাসির আভাস। আসলে আমাকে এভাবে কৌতূহলের মধ্যে রেখে মজা পাচ্ছে সে।

    “তাহলে কি নিয়ে কথা বলতে চান?” জিজ্ঞেস করলাম।

    “জানি না। শুধু কথা বলতে চাই।”

    তাই আলাপ চালিয়ে গেলাম আমরা। লিডিয়া আর পলের ব্যাপারে কথা বললাম। অ্যালিসিয়ার মায়ের গল্প শুনলাম। আমাদের দুজনের শৈশব নিয়ে স্মৃতিচারণ করলাম। আমার অতীত নিয়ে খুবই কৌতূহলী মনে হলো অ্যালিসিয়াকে। বাবার ব্যাপারে সব বললাম, কিভাবে ভয়ের মধ্যে বড় হয়েছি, কিভাবে বাসা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে এসেছি-এগুলোও বাদ দিলাম না। বোধহয় আজকের এই আমাকে অতীতে কোন বিষয়গুলো প্রভাবিত করেছে সেটা জানাটাই মূল উদ্দেশ্যে ছিল তার।

    গোটা সময় আমি ভাবছিলাম যে আবারও শুরু থেকে সব আরম্ভ করার কোন সুযোগ নেই। একজন থেরাপিস্ট আর তার রোগির মধ্যে যে দেয়ালটা থাকে, সেটা আরো আগেই গুঁড়িয়ে গেছে।

    এখন হয়তো অনেকেরই প্রশ্ন জাগতে পারে যে এখানে কে রোগি আর কে চিকিৎসক।

    .

    ৪.১২

    পরদিন সকালে আবারো দেখা করলাম অ্যালিসিয়ার সাথে। তবে আজকে একদম অন্যরকম লাগছে তাকে। গতকালের তুলনায় অনেক বেশি গম্ভীর আর সতর্ক। হয়তো গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুর ঘটনাটা নিয়ে কথা বলবে বলেই নিজেকে প্রস্তুত করছিল।

    মুখোমুখি বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সচরারচর কিন্তু এমনটা করে না। একবারের জন্যেও চোখ ফেরাচ্ছে না অন্যদিকে। নিজ থেকেই ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু করলো একটু পর। প্রতিটি শব্দ মাপা। একদম ভেবেচিন্তে বলছে যা বলার। অনেকটা ক্যানভাসে যত্নের সাথে তুলির দাগ দেয়ার মতন।

    “সেদিন বিকেলে একাই ছিলাম বাসায়। প্রদর্শনীর জন্যে ছবি আঁকার কথা ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবুও সিদ্ধান্ত নেই যে একবার চেষ্টা করে দেখবো। তাই ছোট ফ্যানটা নিয়ে বাগানের ভেতরে স্টুডিওতে চলে যাই, আর তখন…”

    “আর তখন?”

    “ফোন বেজে ওঠে। গ্যাব্রিয়েল কল করেছিল জানাতে যে শট থেকে ফিরতে দেরি হবে।”

    “এরকমটা কি প্রায়ই করতেন তিনি? আগেই ফোন করে জানিয়ে দিতেন যে দেরি হবে?”

    যেন অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছি এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় অ্যালিসিয়া। “না, কেন?”

    “এমনটাও তো হতে পারে, আপনি ঠিক আছেন কি না সেটা জানার জন্যে ফোন দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল। কারণ ডায়েরিটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, তখন আপনার মানসিক অবস্থা খুব একটা সুবিধের ছিল না।”

    “ওহ, কিছুক্ষণ কথাগুলো নিয়ে ভাবলো অ্যালিসিয়া, এরপর মাথা নাড়লো ধীরভঙ্গিতে। “হ্যাঁ, হতে পারে।”

    “আপনার কথার মাঝে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। গ্যাব্রিয়েল ফোন করেছিলেন আপনাকে। এরপর কি হলো?”

    “তাকে দেখি আমি,” দ্বিধান্বিত স্বরে বলল অ্যালিসিয়া।

    “তাকে?”

    “মানে ঐ লোকটাকে। জানালায় দেখি তার প্রতিবিম্ব। স্টুডিওতে ঢুকে পড়েছিল সে। একদম আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল।”

    চোখ বন্ধ করে ফেলে অ্যালিসিয়া। লম্বা একটা সময় কিছু বলে না।

    “লোকটা দেখতে কেমন ছিল?” যতটা সম্ভব কোমল স্বরে বললাম। “মনে আছে আপনার?”

    জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে অ্যালিসিয়া। “বেশ লম্বা…শক্তপোক্ত শরীর। কালো মুখোশ পরে থাকায় চেহারাটা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম। কি মনে হচ্ছিল জানেন? যেন কালো দুটো গর্তের দিকে তাকিয়ে আছি।”

    “তাকে দেখার পর কি করলেন?”

    “কিছুই না। আসলে এত ভয় পেয়েছিলাম যে…অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকি তার দিকে। হাতে একটা ছুরি ছিল লোকটার। জিজ্ঞেস করি, কি চায় সে। কোন জবাব দেয় না। তখন বলি যে রান্নাঘরের টেবিলে আমার ব্যাগে টাকা আছে। টাকার কোন দরকার নেই আমার’-হেসে বলে লোকটা। ওরকম জঘন্য কাঁচভাঙা হাসি আগে কখনো শুনিনি। ছুরিটা আমার গলায় চেপে ধরে সে, আরেকটু হলেই গলার চামড়ায় কেটে বসতো ধারালো ফলাটা। চুপচাপ কোন শব্দ না করে তার সাথে বাসার ভেতরে যেতে বলে।”

    দৃশ্যটা মনে করার সময় আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো অ্যালিসিয়া। “আমাকে স্টুডিও থেকে লনে বের করে আনে সে। এসময় গেইটের দিকে চোখ যায় আমার। ভাবি যে কোনমতে যদি একবার গেইট পর্যন্ত পৌঁছুতে পারি, তাহলে হয়তো বেঁচে যাবো। সেটাই আমার বাঁচার একমাত্র পথ। তাই মনে সাহস জড়ো করে জোরে একটা লাথি কষাই লোকটার হাঁটু বরাবর, এরপর গেইটের উদ্দেশ্যে দৌড় দেই।” চোখ খুলল অ্যালিসিয়া, মুখে হাসি। “কয়েক সেকেন্ডের জন্যে আসলেও মুক্তি পেয়েছিলাম।”

    এর পরেই হাসিটা মিইয়ে গেল।

    “তখন…তখন পেছন থেকে আমার ওপরে লাফ দেয় লোকটা। মাটিতে পড়ে যাই আমরা। শক্ত করে এক হাতে চেপে ধরে আমার মুখ। ছুরির শীতল ফলার স্পর্শ টের পাই আবারো হুমকি দেয় যে টু শব্দ করলেও মেরে ফেলবে। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই থাকি। তার নিশ্বাস টের পাচ্ছিলাম মুখের ওপরে। এরপর আমাকে টেনে তুলে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়।”

    “এরপর? এরপর কি হলো?”

    “দরজা বন্ধ করে দেয় সে। ভেতরে আটকা পড়ে যাই।”

    ভারি হয়ে আসছে অ্যালিসিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস। দুই গালে রক্তিম আভা। বোধহয় একটু বেশিই চাপ দিয়ে ফেলছি তাকে।

    “কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি নেয়া যাক।”

    মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে দিল অ্যালিসিয়া। “নাহ, দরকার নেই। কথাগুলো বলার জন্যে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি।”

    “আপনি নিশ্চিত? কিছুক্ষণ বিরতি নিলে কিন্তু কোন সমস্যা হবে না।”

    “একটা সিগারেট হবে আপনার কাছে?” কিছুক্ষণ ইতস্ততার পর জিজ্ঞেস করে সে।

    “সিগারেট? আপনি ধূমপান করেন এটা তো জানতাম না।”

    “নাহ, করি না। মানে…আগে করতাম। আছে আপনার কাছে?”

    “আপনি কী করে বুঝলেন, আমি সিগারেট খাই?”

    “গন্ধ পেয়েছি।”

    “ওহ,” লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে উঠে দাঁড়াই। “ঠিক আছে। বাইরে চলুন তাহলে।”

    .

     ৪.১৩

    ক্লিনিকের চত্বরে রোগিদের ভিড়। অন্যান্য সময়ের মতনই দল বেঁধে আলাপ করছে অনেকে, সিগারেট খাচ্ছে। আবার অনেকে শীতের কারণে দুই হাত বকের ওপর ভাজ করে রেখেছে।

    একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিল অ্যালিসিয়া। তার হয়ে আমি জ্বালিয়ে দিলাম ওটা। লম্বা একটা টান দিল সে, একদম লাল হয়ে উঠলো সিগারেটের মাথাটা। তার চোখজোড়া আমার দিকে, দৃষ্টিতে হালকা বিদ্রূপ।

    “আপনি ধরাবেন না? নাকি রোগিদের সাথে সিগারেট খাওয়া মানা?”

    আমার সাথে ঠাট্টা করছে সে, ভাবলাম। তবে এটা ঠিক যে গ্রোভের স্টাফ আর রোগিদের একসাথে ধূমপানের ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধ নেই। তবুও স্টাফরা সাধারণত আড়ালেই ধূমপান করে। আজ অবধি রোগিদের সামনে কাউকে সিগারেট ধরাতে দেখিনি। এখন যদি আমি সিগারেট বের করে অনেকেই চোখ বাকাতে পারে। কেন যেন মনে হচ্ছে সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। হয়তো জানালা থেকে ক্রিস্টিয়ানও তাকিয়ে আছে। ওর বলা কথাটা মনে হল- বর্ডারলাইন রোগিদের একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে। অ্যালিসিয়ার চোখের দিকে তাকালাম। আকর্ষণের ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে, এমনকি কোন প্রকার আন্তরিকতারও ইঙ্গিত নেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির আড়ালে অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ লুকিয়ে আছে। অ্যালিসিয়া বেরেসনকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

    সেজন্যেই বোধহয় ক্রিস্টিয়ান সবসময় তাকে ওষুধ দিয়ে প্রায় বেহুঁশ করে রাখতো। ও কি অ্যালিসিয়াকে ভয় পায়? সত্যি বলতে আমি নিজেও কিছুটা ভয় পাই। আসলে ঠিক ভয় না, বরং বলা যায় যে অতিরিক্ত সতর্ক থাকি তার আশেপাশে। যা-ই করি সাবধানে, ভেবেচিন্তে করতে হবে।

    “মানা হবে কেন?” বললাম। “আমিও ধরাচ্ছি একটা আপনার সাথে।”

    সিগারেট মুখে দিয়ে জ্বালোম। এরপর নীরবে কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ি আমরা, একে অন্যের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে। অ্যালিসিয়া আর আমার মাঝের দূরত্ব বিপজ্জনক রকমের কম, শেষমেশ চোখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। কেমন জানি লজ্জা লাগছিল।

    “আমরা হাঁটি নাহয়?”

    “ঠিক আছে,” মাথা নেড়ে বলল অ্যালিসিয়া।

    চত্বরের সীমানা ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। অন্যান্য রোগিরা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তারা কি ভাবছে কে জানে, তবে অ্যালিসিয়াকে সেসব নিয়ে বিচলিত মনে হলো না। এমনকি তাদের দিকে একবারের জন্যে তাকায়ওনি সে। নীরবেই কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম।

    “এরপর কি ঘটেছিল শুনবেন না?” এক সময় জিজ্ঞেস করলো অ্যালিসিয়া।

    “আপনি প্রস্তুত? আমার কোন সমস্যা নেই।”

    আবারো মাথা নাড়ে অ্যালিসিয়া। “হা প্রস্তুত।”

    “লোকটা তাহলে আপনাকে বাসার ভেতরে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। এরপর?”

    “লোকটা ড্রিঙ্কসের কথা বলে। তাই তাকে গ্যাব্রিয়েলের একটা বিয়ারের ক্যান দেই আমি। আমি নিজে বিয়ার খাই না। আর বাসায় ঐ সময় অন্য কিছু ছিল না।”

    “এরপর?”

    “কিছু একটা নিয়ে কথা বলে লোকটা।”

    “কি নিয়ে?”

    “মনে নেই আমার।”

    “কিছুই মনে নেই?”

    “না”

    আবারো চুপ হয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন দেখলাম মুখ খুলছে না, তাগাদা দিলাম। “ঠিক আছে। আপনারা রান্নাঘরে ছিলেন তখন। কেমন বোধ হচ্ছিল?”

    “আসলে…আসলে কোন বোধজ্ঞানই ছিল না তখন আমার।”

    মাথা নাড়লাম। “ওরকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক। বিপদে পড়লে আমাদের অনুভূতি একদম ভোতা হয়ে যায়। পালাবো নাকি পালাবো না এটা ভাবতে ভাবতে জমে যাই একদম।”

    “আমি জমে যাইনি।”

    “তাই নাকি?”

    “হ্যাঁ,” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে অ্যালিসিয়া। “আসলে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। মনে মনে ছক কষছিলাম কিভাবে পাল্টা আঘাত হানা যায়। লোকটাকে খুনের ফন্দি আঁটছিলাম।”

    “আচ্ছা। খুনটা কিভাবে করতেন আপনি?”

    “গ্যাব্রিয়েলের বন্দুকটা দিয়ে। ওটা কিভাবে নাগালে পাওয়া যায় সেটা ভাবছিলাম।”

    “বন্দুকটা তো বোধহয় আপনি রান্নাঘরে এনে রেখেছিলেন? ডায়েরিতে সেটাই লেখা।”

    মাথা নাড়লো অ্যালিসিয়া। “হ্যাঁ, জানালার পাশের থালা-বাসন রাখার কাবার্ডে।” এই পর্যায়ে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লো অ্যালিসিয়া। “লোকটাকে বলি যে পানি খাবো। গ্লাস আনতে যায় সে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই কাবার্ডের দিকে। মনে হচ্ছিল ওটুকু এগোতেও খুব। বেশি সময় লাগছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাবার্ডের পাল্লা খুলি…”

    “আর?”

    “খালি ছিল ভেতরটা। বন্দুকটা কেউ সরিয়ে ফেলেছিল। এসময় পেছন থেকে লোকটা বলে-গ্লাসগুলো আপনার ডানপাশের কাবার্ডে। ঘরে তাকিয়ে দেখি বন্দুকটা তার হাতে। ওটা আমার দিকে তাক করে হাসছিল সে।”

    “তখন?”

    “কি তখন?”

    “আপনার মাথায় কি চলছিল?”

    “এটাই যে শেষ সুযোগটাও হারিয়ে ফেলেছি আমি-আমাকে মেরে ফেলবে লোকটা।”

    “আপনার মনে হচ্ছিল, লোকটা আপনাকে মেরে ফেলবে?”

    “হ্যাঁ।”

    “তাহলে দেরি করলো কেন সে? বাড়ির ভেতরে ঢোকার পরেই তো কাজটা করতে পারতো।”

    জবাব দিল না অ্যালিসিয়া। তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। হাসছে সে।

    “লিডিয়া ফুপির একটা বাদামি রঙের বিড়াল ছিল। অনেক আগের কথা এটা। বিড়ালটাকে একদমই পছন্দ ছিল না আমার। প্রায়ই খামচে রক্ত বের করে ফেলতো। দয়ামায়া বলে কিছু ছিল না।”

    “পশুপাখিদের ক্ষেত্রে তো দয়ামায়া কথাটা ঠিক খাটেনা। তারা যা করে, আত্মরক্ষার খাতিরেই করে।”

    তন্ময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় অ্যালিসিয়া। “ভুল কথা। অনেক পশুপাখিই নিষ্ঠুর ধরণের। অন্তত ঐ বিড়ালটার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য। বাইরে থেকে প্রায়ই আহত পাখি বা ছোট জীব-জন্তু নিয়ে আসতো। সবগুলোই আধ-মরা। আহত, কিন্তু মারা যায়নি। ওগুলো নিয়ে খেলতো।”

    “আচ্ছা। আপনি কি বলতে চাইছেন যে লোকটাও আপনাকে নিয়ে অনেকটা ওরকমই করছিল? তার জন্যে বিকৃত একটা খেলা ছিল ব্যাপারটা?”

    সিগারেটটা শেষ করে মাটিতে ফেলে দিল অ্যালিসিয়া। এরপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আরেকটা দিন।”

    তার দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম। এবারে নিজেই সিগারেট জ্বাললো সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ ধোয়া ফোকার পর বলল, “গ্যাব্রিয়েলের আটটার দিকে বাসায় ফেরার কথা ছিল। আর তখন বাজছিল ছয়টা। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম আমি। কি ব্যাপার? লোকটা বলে। ‘আমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগছে না আপনার বন্দুকের নলটা আমার শরীরে স্পর্শ করে সে। দৃশ্যটা কল্পনা করে কেঁপে উঠলো অ্যালিসিয়া। “আমি বলি গ্যাব্রিয়েল যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে। এসে কি করবে? আপনাকে উদ্ধার করবে? লোকটা জিজ্ঞেস করে।”

    “জবাবে আপনি কি বলেছিলেন?”

    “কিছু না। শুধু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলাম…এসময় আমার ফোনটা বেজে ওঠে। গ্যাব্রিয়েল কল দিয়েছিল। লোকটা বলে ফোন ধরতে। বন্দুকটা আমার কপাল বরাবর তাক করে রেখেছিল।”

    “এরপর? গ্যাব্রিয়েল কি বলে?”

    “বলে যে…ফটো শ্যুটটায় ঝামেলা হয়েছে, বাসায় ফিরতে আরো দেরি হবে। আমি যেন খেয়ে নেই। কমসেকম দশটা বেজে যাবে তার কাজ শেষ হতে। ফোন কেটে দিয়ে বলি ‘গ্যাব্রিয়েল কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। এর আগেই আপনি চলে যান। হাসে লোকটা। কিন্তু আমি তো শুনলাম দশটার আগে ফিরবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তাহলে। দড়ি নিয়ে আসুন, টেপ হলেও চলবে। আপনাকে বেঁধে ফেলি।

    “সে যা বলে তা-ই করি আমি। জানতাম যে আর কোন উপায় ছিল না। পুরোপুরি আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

    কথা বলা বন্ধ করে আমার দিকে তাকায় অ্যালিসিয়া। একসাথে অনেকগুলো আবেগ খেলা করছে তার দৃষ্টিতে। আসলেও বোধহয় আজকে একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।

    “আমাদের কিছুক্ষণের বিরতি নেয়া উচিৎ এখন।”

    “না, কথা শেষ করতে হবে আমাকে। করতেই হবে।”

    আগের চেয়ে দ্রুত কথা বলছে সে এখন। “বাসায় কোন দড়ি ছিল না, তাই ক্যানভাস ঝোলানোর তার দিয়ে কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় লোকটা। আমাকে লিভিং রুম নিয়ে যায়। এরপর ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসিয়ে বাঁধতে শুরু করে। টের পাচ্ছিলাম, চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে তার। ‘প্লিজ, অনুনয় করি আমি। প্লিজ’ কিন্তু শোনেনা সে। হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। আমি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম, আমাকে মেরেই ফেলবে সে। আসলে…আসলে তখন আমাকে খুন করলেই ভালো হতো।”

    তীব্র আক্রোশের সাথে কথাগুলো বলে সে। হঠাৎ আবেগের এই চরম বহিঃপ্রকাশে অবাক না হয়ে পারি না।

    “এটা কেন বললেন?”

    “কারণ পরবর্তিতে সে যা করে, তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল।”

    এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো কেঁদেই ফেলবে অ্যালিসিয়া। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়া থেকে নিজেকে থামাতে বেশ কষ্ট হলো আমার। ইচ্ছে করছিল তার কপালে চুমু খেয়ে বলি যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করলাম নিজেকে। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললাম।

    “কারো উচিৎ আপনার যত্ন নেয়া, খেয়াল রাখা। আমার নিজেরই আপনার খেয়াল রাখতে ইচ্ছে করছে, অ্যালিসিয়া।”

    “না,” দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো সে। “আপনার কাছ থেকে এসব চাই না আমি।”

    “তাহলে কি চান?”

    জবাব দিলনা অ্যালিসিয়া। বরং উল্টোদিকে ঘরে ভেতরের যাওয়ার দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

    .

    ৪.১৪

    থেরাপি রুমের বাতি জ্বেলে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি অ্যালিসিয়া ইতোমধ্যেই বসে পড়েছে। তবে নিজের চেয়ারে নয়, আমার চেয়ারে বসেছে সে।

    অন্যসময় হলে তার এই আচরণের পেছনে নিগঢ় কোন কারণ খোঁজার চেষ্টা করতাম, কিন্তু এবারে কিছুই বললাম না। আমার চেয়ারে বসে যদি সে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করতে চায়…করতে পারে। আপাতত আমি গল্পের শেষটুকু শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি। তাই চুপচাপ তার বিপরীত দিকে বসে পড়লাম।

    কিছুক্ষণ একদম স্থির বসে থাকার পর মুখ খুলল সে। “আমাকে চেয়ারে একদম শক্ত করে বাঁধে লোকটা। একটু নড়াচড়া করলেই তারগুলো চামড়া কেটে আরো গভীরে বসে যাচ্ছিল, এক পর্যায়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে। তবে সেটা একদিক ভালোই হয়েছিল, ক্ষতস্থানগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কারণে মনের উল্টোপাল্টা ভাবনাগুলো দূরে রাখতে পারছিলাম। সেগুলো অনেক বেশি ভীতিকর ছিল। ভাবছিলাম গ্যাব্রিয়েলকে আর দেখতে পাবোনা কখনো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হবে আমার।”

    “এরপর কি হলো?”

    “ওখানেই ঠাই বসে থাকি আমরা। মজার ব্যাপার কি জানেন? এর আগে আমি সবসময় ভাবতাম যে ভয় পেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু ধারণাটা ভুল ছিল। খুব বেশি গরম লাগছিল তখন, যেন পুরো শরীরে আগুন ধরে গেছে। দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল অবশ্য। তবুও, একদম ভ্যাপসা গরম ছিল ভেতরে। কপাল থেকে ঘাম চুঁইয়ে পড়ার কারনে চোখ জলছিল। লোকটার শরীর থেকে ঘাম আর মদের গন্ধ পাচ্ছিলাম। পুরোটা সময় কথা বলে যায় সে, আমি ভালো করে মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। একটা বড় মাছির শব্দ কানে আসে। বাইরে বের হবার চেষ্টা করছিল সেটা, বারবার তো খাচ্ছিল জানালার কাঁচে। গ্যাব্রিয়েলের ব্যাপারে আমাকে অনেক প্রশ্ন করে লোকটা। কিভাবে আমাদের দেখা হয়েছিল, কতদিন ধরে একসাথে আছি, সংসারে সুখি কি না–এসব। তখন আমার মনে হয় যে কথা বলে সময় নষ্ট করলে বুঝি আমার বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তাই তার প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়া শুরু করি। গ্যাব্রিয়েল, আমার কাজ-সবকিছু নিয়ে কথা বলি। কিছু সময়ের খুব দরকার ছিল আমার। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। এভাবেই একসময় খেয়াল করি, দশটা বেজে গেছে…এরপর সাড়ে দশটা। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের বাসায় ফেরার নাম নেই।

    “দেরি হয়ে গেছে, লোকটা বলে। আজকে বোধহয় আর আসবে না।”

    “আসবে ও, “ আমি জবাব দেই।

    “আমি থাকাতে আপনার সুবিধেই হয়েছে, কি বলেন? “

    “ঠিক এগারোটার সময় বাইরে থেকে একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পাই। জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দেয় লোকটা। একদম ঠিক সময়েই এসেছে, বলে সে।

    ***

    অ্যালিসিয়ার ভাষ্যমতে এরপরের ঘটনাগুলো অনেক দ্রুত ঘটে।

    লোকটা অ্যালিসিয়ার চেয়ারটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয় যাতে দরজা থেকে তার চেহারা না দেখা যায়। বলে যে সে যদি টু শব্দটিও করে, তাহলে গ্যাব্রিয়েলের খুলি উড়িয়ে দিবে। এরপর গা ঢাকা দেয়। সবগুলো বাতি নিভে যায় কিছুক্ষণ পর। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। হলওয়ে থেকে দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ ভেসে আসে।

    “অ্যালিসিয়া?” গ্যাব্রিয়েল ডাক দেয় জোরে।

    কোন জবাব না পেয়ে আবারো ডেকে ওঠে সে। লিভিংরুমে ঢুকে দেখে ফায়ারপ্লেসের কাছে চেয়ার নিয়ে উল্টো ঘুরে বসে আছে অ্যালিসিয়া।

    “এভাবে অন্ধকারে বসে আছো কেন?” জানতে চায় গ্যাব্রিয়েল। কিন্তু কোন জবাব পায় না। “অ্যালিসিয়া?”

    খুব কষ্ট করে চুপ থাকে অ্যালিসিয়া-গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল তার-কিন্তু ততক্ষণে চোখে আঁধার সয়ে এসেছিল। দেখতে পাচ্ছিল, অচেনা লোকটা বন্দুক হাতে এক কোণায় ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বন্দুকের নলটা গ্যাব্রিয়েলের দিকে তাক করা। তার স্বার্থেই মুখ বন্ধ রাখে। অ্যালিসিয়া।

    “অ্যালিসিয়া?” গ্যাব্রিয়েল এইয়ে যায় তার দিকে। “কোন সমস্যা?”

    গ্যাব্রিয়েল হাত বাড়িয়ে অ্যালিসিয়াকে ধরতে যাবে, ঠিক এসময় অন্ধকার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটা। চিৎকার করে ওঠে অ্যালিসিয়া, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গ্যাব্রিয়েল, লোকটা তার ওপর চেপে বসে। বন্দুকটা হাতুড়ির মত করে ধরে গ্যাব্রিয়েলের মাথায় পরপর কয়েকবার আঘাত করে। রক্ত ঝরতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারায় সে।

    এরপর তার অচেতন দেহটা একটা চেয়ারে বসিয়ে তাকেও তার দিয়ে শক্ত করে বাঁধে আততায়ী। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে গ্যাব্রিয়েলের।

    “কি হচ্ছে এসব? কি-”

    বন্দুকটা গ্যাব্রিয়েলের দিকে তাক করে লোকটা। ট্রিগার টেনে দেয়। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় চারপাশ। একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার, ছয়বার। গোটা সময় চিৎকার করতেই থাকে অ্যালিসিয়া।

    গ্যাব্রিয়েলকে ছয়বার গুলি করা শেষে বন্দুকটা মেঝেতে ফেলে দেয় লোকটা। এরপর কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।

    .

    ৪.১৫

    এই হচ্ছে পুরো গল্প। অ্যালিসিয়া বেরেনসন তার স্বামীকে হত্যা করেনি। এক অচেনা আততায়ী তাদের বাসায় ঢুকে পড়ে এবং কোন প্রকার যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই নৃশংসভাবে খুন করে গ্যাব্রিয়েল বেরেসকে। এরপর রাতের আঁধারেই মিলিয়ে যায়। অ্যালিসিয়া সম্পূর্ণ নির্দোষ।

    অন্তত অ্যালিসিয়ার কথা বিশ্বাস করলে এমনটাই ঘটেছিল বলে মেনে নিতে হবে।

    কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। একটা শব্দও না।

    কিছু বড়সড় অসঙ্গতির কথা তো আমি এখনই বলে দিতে পারবো, যেমন-গ্যাব্রিয়েলকে ছয়বার না, পাঁচবার গুলি করা হয়েছিল। একটা গুলি চালানো হয়েছিল বাড়ির ছাদ বরাবর। তাছাড়া পুলিশের লোকেরা অ্যালিসিয়াকে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় নয় বরং রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিল। দুই হাত দিয়ে দরদ করে রক্ত ঝরছিল তার। অ্যালিসিয়া আমাকে বলেনি যে লোকটা তার বাঁধন খুলে দিয়েছিল কি না। তাছাড়া পুলিশের লোকদের কেন এই কথাগুলো বলেনি এটারও যুক্তিযুক্ত কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।

    হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত, সে মিথ্যে বলেছে। মুখের ওপরে এভাবে অকপটে মিথ্যে বলার কারণে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। এক মুহূর্তের জন্যে সন্দেহ হলো যে সে বোধহয় পরীক্ষা করে দেখছে আমি তাকে বিশ্বাস করি কি না। যদি তা-ই হয়, তাহলে আমার মাথায় কি চলছে তা তাকে বুঝতে দেব না একদমই।

    চুপচাপ বসে রইলাম ওখানে।

    এই প্রথম আগে কথা বলল অ্যালিসিয়া। “আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আজকে আর কথা বলতে পারবো না।”

    মাথা নাড়লাম। একটানা এ রকম বিষয়ে কথা বলার পর যে কারো ক্লান্ত লাগবে।

    “কালকে আবার দেখা করি আমরা,” বলল সে।

    “আরো কিছু বলার আছে?”

    “হ্যাঁ। তবে সেটাই শেষ।”

    “ঠিক আছে। কালকে দেখা হবে তাহলে।”

    করিডোরে অপেক্ষা করছিল ইউরি। অ্যালিসিয়াকে তার রুমে নিয়ে গেল সে। আমি আমার অফিসে চলে আসলাম।

    আগেও বলেছি, সেশন শেষে সবকিছু লিখে ফেলা আমার পুরনো অভ্যাস। থেরাপি সেশনের পঞ্চাশ মিনিটে কি কি কথা হয়েছে তা যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে লিখে ফেলা একজন থেরাপিস্টের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা ছোটবড় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হারিয়ে যাবে চিরতরে। এমনকি সেশন চলাকালীন সময়ে রোগির মুখভঙ্গি বা অভিব্যক্তি কেমন ছিল–এসবও লিখে রাখা ভালো।

    তাই ডেস্কে বসে যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু লিখে ফেললাম। লেখা শেষ হতেই কাগজগুলো হাতে নিয়ে ছুটে গেলাম ডায়োমেডেসের অফিসের ফিকে। তার দরজায় ঠকঠক করলাম, কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া এলো না। আবারো ঠকঠক করার পরেও যখন ডায়োমেডেস কিছু বললেন না, দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখি যে প্রফেসর কাউচে বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন।

    “প্রফেসর?” লাভ হলো না। “প্রফেসর ডায়োমেডেস?” গলা চড়ালাম।

    চমকে জেগে উঠলেন তিনি। ঘুম জড়ানো দৃষ্টি তাকালেন আমার দিকে।

    “কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”

    “আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। পরে আসবো?”

    ভ্রূ কুঁচকে মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। লাঞ্চের পর খানিকক্ষণ ভাতঘুমের অভ্যাস আছে আমার। তাহলে আর বিকালে ঝিমাতে হয় না। বয়স হলে তুমিও বুঝবে।” হাই তুলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “ভেতরে এসো, থিও। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে জরুরি কিছু বলবে। বসো।”

    “জি, আসলেই জরুরি।”

    “অ্যালিসিয়াকে নিয়ে কিছু বলবে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তার ডেস্কের উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসে পড়লাম। এক সেকেন্ড পর প্রফেসরও তার চেয়ারটায় এসে বসলেন, চুলগুলো খাড়া হয়ে আছে একদিকে। চোখে এখনও রাজ্যের ঘুম।

    “আমি কিছুক্ষণ পরে আসি বরং?”

    মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে দিলেন ডায়েমেডেস। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে রাখলেন টেবিলের ওপরে। “আর ঘুম আসবে না আমার। বলো। তাহলে কি হয়েছে?”

    “অ্যালিসিয়ার সাথে কথা বলছিলাম আমি…আপনার পরামর্শ প্রয়োজন।”

    মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। আসলে তা কেটে যাচ্ছে তার। এখন চোখে ভর করেছে আগ্রহ। “কী রকম পরামর্শ?”

    হাতের কাগজগুলো থেকে সবকিছু তাকে পড়ে শোনালাম। অ্যালিসিয়া আমাকে যেভাবে কথাগুলো বলেছে, আমিও ঠিক সেভাবেই বলার চেষ্টা করেছি। প্রফেসর শুনলেন, কী করে একজন আততায়ী অ্যালিসিয়াদের বাসায় ঢুকে গ্যাব্রিয়েলকে খুন করে তার চোখের সামনে।

    আমার কথা বলা শেষ হলে লম্বা একটা সময় চুপ করে থাকলেন। ডায়োমেডেস। তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না মগজে কী চলছে। ডেস্ক থেকে একটা চুরুট বের করে ছোট রূপালী গিলোটিনের সাহায্যে সেটার মাথা কেটে নিলেন সাবধানে।

    “কাউন্টারট্রান্সফিয়ারেন্স থেকেই শুরু করি তাহলে। তোমার নিজের অনুভূতি সম্পর্কে বলল, একদম প্রথম থেকে। অ্যালিসিয়া যখন গল্পটা বলছিল, কেমন লাগছিল তোমার?”

    কিছুক্ষণ ভাবলাম। প্রথম দিকে বেশ উত্তেজিত ছিলাম….আর কিছুটা উদ্বিগ্ন। ভীত।”

    “ভীত? ভয়টা কি তোমার নিজের, নাকি অ্যালিসিয়ার?”

    “দু’জনেরই বোধহয়।”

    “কেন ভয় পাচ্ছিলে?”

    “সেব্যাপারে নিশ্চিত নই। হয়তো ব্যর্থ হবো, এই ভয় কাজ করছিল। অনেক কিছুই নির্ভর করে আছে এর ওপরে।”

    মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। “আর কিছু?”

    “খুব হতাশও লাগছিল। আসলে অ্যালিসিয়ার সাথে সেশনগুলোয় প্রায়ই এই অনুভূতিটা হয়েছে।”

    “রাগ হয়নি কখনো?”

    “হ্যাঁ, হয়েছে।”

    “অবাধ্য সন্তানকে কথা শোনাতে না পারলে বাবাদের যেরকম লাগে, তোমারও ওরকমই লাগছিল?”

    “হ্যাঁ, অ্যালিসিয়াকে সাহায্য করতে চাইছিলাম আমি। কিন্তু সে সাহায্য পেতে ইচ্ছুক কি না তা বলতে পারবো না।”

    আবারো মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। “আপাতত তাহলে আমরা রাগ নিয়ে কথা বলি। এই রাগটা ফুটে ওঠে কি করে?”

    দ্বিধা ভর করলো আমার চিত্তে। “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেশন চলাকালীন সময়ে প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে আমার।”

    “এইতো! এক না এক উপায়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই। গ্রুপ থেরাপি বিষয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে, জানো? সাধারণত ট্রেইনিরা গ্রুপ থেরাপি সেশন পরিচালনা করে। যাইহোক, এম মিল্টন তার গ্রুপ থেরাপি বিষয়ক গবেষণাপত্রের শুরুতে লিখেছিলেন যে ট্রেইনি থেরাপি সেশনের সময় উদ্বিগ্ন হবে না, সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। “

    “এরকম কিছু শুনিনি,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম। “আমি একইসাথে অসুস্থ এবং উদ্বিগ্ন হতাম।”

    হাসলেন ডায়োমেডেস। “তুমি তো আর ট্রেইনিনও। যদিও প্রশিক্ষণের সময়কার অনুভূতিগুলো কখনোই ভোলা যায় না।” চুরুটটা তুলে নিলেন তিনি। “চলো বাইরে যাই।”

    ***

    জরুরি বহির্গমন সিঁড়ির কাছে চলে আসি আমরা। চুরুটে টান দেয়ার পাশাপাশি আমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবছেন ডায়োমেডেস। কিছুক্ষণ পর একটা উপসংহারে পৌঁছে গেলেন।

    “ও মিথ্যে বলছে, তা বোধহয় বুঝতেই পারছো তুমি।”

    “মানে গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সে যা বলেছে? হ্যাঁ, আমারো সেটাই মনে হচ্ছে।”

    “না, শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেই নয়।”

    “তাহলে?”

    “পুরোটাই একটা গাঁজাখুরি গল্প। একটা শব্দও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”

    আমি যে প্রচণ্ড অবাক হয়েছি, তা নিশ্চয়ই আমার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম অ্যালিসিয়ার গল্পের কিছু বিষয়ে হয়তো সন্দেহ পোষণ করবেন প্রফেসর। কিন্তু পুরাটাকেই যে বাতিল করে দেবেন, এটা ভাবিনি।”

    “লোকটার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না আপনি?”

    “না, করি না। আমার ধারণা এই ‘মুখোশধারী আততায়ী’-র ব্যাপারটা অ্যালিসিয়ার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বৈ কিছু নয়।”

    “এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?”

    একটা অদ্ভুত হাসি ফুটলো ডায়োমেডেসের চেহারায়। “এটা আমার আন্দাজ বলতে পারে, আবার এত বছরের পেশাদারী অভিজ্ঞতাও বলতে পারো।”আমি দ্বিমত পোষণ করে কিছু বলার আগেই হাত উঁচিয়ে আমাকে থামালেন তিনি। “আমি কিন্তু এমনটা আশা করছি না যে তুমি আমার সাথে একমত হবে, থিও। অ্যালিসিয়াকে নিয়ে যে কারো চেয়ে অনেক বেশি ভেবেছো তুমি। তাই তার অনুভূতিগুলোর সাথে তোমার অনুভূতিগুলোও জট পাকিয়ে গেছে। সুপারভাইজার হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে সেগুলো আলাদা করতে তোমাকে সাহায্য করা। আর একবার যদি অ্যালিসিয়া সম্পর্কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে পারো, তাহলে দেখবে তার সম্পর্কে তোমার ধারণাই বদলে গেছে।”

    “আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

    “সোজাসুজি বললে, আমার ধারণা শুরু থেকেই তোমার সামনে অভিনয় করছে সে। তোমাকে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করছে। অন্যকে সাহায্য করার তোমার যে স্বভাবজাত গুণ, সেটার ফায়দা লুটতে চেয়েছে আর কি। আমি শুরু থেকেই বুঝেছিলাম যে ওকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করাই তোমার লক্ষ্য। অ্যালিসিয়ারও নজর এড়ায়নি সেটা। সেজন্যে তোমার জন্যে ফাঁদ পেতেছে। প্রেমের ফাঁদও বলা যায়।”

    “ক্রিস্টিয়ানের মত শোনাচ্ছে আপনার কথাগুলো। আমাকে কোন প্রেমের ফাঁদে ফেলেনি অ্যালিসিয়া। তাছাড়া রোগিদের কারো ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে আছে কি না, তা বোঝার মত বুদ্ধিমত্তা রাখি আমি। দয়া করে আমাকে খাটো করে দেখবেন না, প্রফেসর।”

    “তুমি অ্যালিসিয়াকে খাটো করে দেখো না। পুরোটাই তার ভয়ানক একটা চাল।” মাথা ঝাঁকিয়ে ধূসর আকাশের দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “অ্যালিসিয়াকে দেখে মনে হতে পারে যে পরিস্থিতির শিকার, অসহায় এক নারী। কারো উচিৎ তার খেয়াল রাখা বা তাকে রক্ষা করা। নিজেকে ভিক্টিম আর ঐ মুখোশধারী আততায়ীকে ভিলেন সাজিয়েছে সে। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে অ্যালিসিয়া আর ঐ ব্যক্তি একই সত্ত্বা। সে-ই মেরেছে গ্যাব্রিয়েলকে। কিন্তু নিজের কাছে দোষ স্বীকার করতে চাইছে না। তাই এই গল্পটা ফেঁদেছে। এখানে অ্যালিসিয়া নিরপরাধ ভিক্টিম আর তুমি তার ত্রাণকর্তা। আর তুমিও যেহেতু ব্যাপারটার সাথে জড়িয়ে গেছে, ওর প্রভাবে সব দায়িত্বও ভুলতে বসেছে।”

    “মাফ করবেন, আমি আপনার সাথে একমত নই। তাছাড়া সে মিথ্যে বলছে বলেও আমার মনে হচ্ছে না। অন্তত সচেতনভাবে তো নয়ই। গল্পটা আর কেউ না হলেও সে নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস করে।”

    “হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ। তবে অ্যালিসিয়ার বিপদের কারণ সে নিজেই-বাইরের কেউ নয়।”

    আমি জানি যে ভুল বলছেন প্রফেসর, কিন্তু এ বিষয়ে তর্ক করে আর লাভ নেই। হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললাম।

    “এখন কি করা উচিৎ আমার?”

    “অ্যালিসিয়াকে সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করো। তাহলেই কেবল তার সুস্থ হবার একটা সম্ভাবনা থাকবে। গল্পটা যে বিশ্বাস করোনি, এটা একদম পরিস্কার করে বলবে তাকে। অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরে, সত্যটা দাবি করো।”

    “আপনার কি মনে হয়? বলবে সে?”

    “সেটা-” কাঁধ নাচালেন প্রফেসর। লম্বা একটা টান দিলেন চুরুটে। “এ মুহূর্তে কেউ বলতে পারবে না।”

    “ঠিক আছে। কালকে তার সাথে আবারো কথা বলবো আমি। সত্যটা বের করার চেষ্টা করবো।”

    ক্ষণিকের জন্যে অস্বস্তি ভর করলো ডায়োমেডেসের চেহারায়। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলালেন। চুরুটটা দেয়ালে পিষে মাটিতে ফেলে দিলেন আলাপের ইতি টানার ভঙ্গিতে। “কালকেই কিন্তু।”

    .

    ৪.১৬

    কাজ শেষে বাসায় ফিরে আবারো ক্যাথির পিছু নেই। ঠিক আগের দিনের মতোই পার্কে একই জায়গায় অপেক্ষা করছিল তার প্রেমিক। সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণীদের মত একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো দুজনে।

    আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেদিকটায় তাকালো ক্যাথি। এক মুহূর্তের জন্যে ভেবেছিলাম ধরা পড়ে গেছি বুঝি। কিন্তু না, অন্য কোনদিকে মনোযাগ দেয়ার সময়ই নেই তার। এবারে লোকটার চেহারা ভালো করে দেখার চেষ্টা করি, কিন্তু লাভ হয় না। তবে তার শারীরিক গঠন কেন যেন পরিচিত ঠেকছিল। কোথাও হয়তো দেখেছি আগে।

    ক্যামডেনের দিকে এগিয়ে কিছুক্ষণ পর একটা পাবে ঢুকে পড়লো ওরা। দ্য রোজ ক্রাউন। পরকীয়ার জন্যে একদম আদর্শ একটা জায়গা। আমি বিপরীত দিকে ক্যাফেটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একঘন্টা পর বেরিয়ে এলো দুজনে। ক্যাথি পারলে লোকটার কোলে উঠে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়েই দীর্ঘ চুম্বনে আবদ্ধ হলো দুজনে। দৃশ্যটা দেখে পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। ঘৃণা এতটা তীব্র হতে পারে জানা ছিল না।

    একসময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও লোকটা বিদায় জানায় ক্যাথি। বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে। লোকটা রওনা দেয় বিপরীত দিকে। তবে আজকে আর ক্যাথির পিছু নিলাম না।

    আজ লোকটাকে অনুসরণ করবে বলে ঠিক করেছি।

    বাস স্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সে। আমি তার ঠিক পেছনেই আছি। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাসের সামনে ফেলে দেই। কিন্তু সেরকম কিছু করলাম না। সে বাসে উঠে পড়লে আমিও তা-ই করলাম।

    ভেবেছিলাম এই বাসেই সরাসরি বাড়ি ফিরবে সে হয়তো। কিন্তু না, কয়েকবার বাস পাল্টালো লোকটা। কিছুটা দূর থেকে তাকে অনুসরণ করে চলেছি আমি। কিছুক্ষণ পর ইস্ট এন্ডে চলে আসে সে। একটা ওয়্যারহাউজে ঢুকে প্রায় আধাঘন্টা কাটিয়ে দেয়। এরপর আবারো বাসস্টপে গিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ে। এসময় কয়েকটা ফোন করে সে। নিচু গলায় কথা বলছিল গোটা সময়, তবে হাসির শব্দটা ঠিকই শুনতে পাই। কে জানে, হয়তো ক্যাথির সাথে কথা বলছে। ভেতরে ভেতরে হতাশা আর ক্রোধ দলা পাকিয়ে উঠছে। তবুও হাল ছাড়তে রাজি নই, এতটাই গোঁয়ার আমি।

    এক পর্যায়ে বাসার পথ ধরলো সে। বাস থেকে নেমে নির্জন একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলো। এখনও কানে ফোন চেপে রেখেছে। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। যদি এ মুহূর্তে পিছে ফেরে সে, তাহলে আমাকে দেখে ফেলবে। কিন্তু ওরকম কিছু করলো না।এখন যে বাড়িটার সামনে দিয়ে এগোচ্ছি তার উঠোনে বিশাল বাগান, সেখানে শোভা পাচ্ছে বেশ কয়েক জাতের জেইড প্ল্যান্ট।

    আমার নিজের শরীরের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এ মুহূর্তে, মনে হচ্ছে যে আপনা আপনিই চলছে। হাত বাড়িয়ে বাগান থেকে একটা পাথর তুলে নিলাম। বেশ ভারি। আমার হাতগুলো ঠিকই জানে, কী করতে হবে। পাথরটা দিয়ে মাথায় জোরে একবার আঘাত করলেই হারামজাদার যাবতীয় নষ্টামি ছুটে যাবে। আরো কাছে এগিয়ে গেলাম সন্তর্পণে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আজকেই ফয়সালা হয়ে যাবে। সে যদি ফোনে কথা না বলতে তাহলে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যেত এতক্ষণে। আর দেরি করা যাবে না।

    সর্বশক্তিতে পাথরটা দিয়ে লোকটার মাথায় আঘাত করতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক এমন সময় বাম দিকের বাসাটার দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। বেশ কয়েকবার ‘ধন্যবাদ’, ‘বাসায় আসবেন’-কথাগুলো শুনতে পেলাম। দ্রুত পাশে সরে এসে আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। এক মুহূর্তের জন্যে জমে গিয়েছিলাম ওখানেই। ক্যাথির প্রেমিক বাড়িটার দিকে তাকালো, তবে আমাকে দেখেনি।

    আবারো হাঁটতে শুরু করলো সে, তবে এবারে আর পিছু নিলাম না আমি। ঘোর কেটে গেছে। হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল পাথরটা। গাছের আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছি লোকটার ওপরে। একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো সে। এরপর পকেট থেকে চাবি বের করে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল।

    কিছুক্ষণ পর আলো জ্বলে উঠলো রান্নাঘরে। জানালার সামনেই এখন দাঁড়িয়ে আছে সে। তবে রাস্তা থেকে ভেতরের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। কারো সাথে কথা বলছে লোকটা, হাতে ওয়াইনের বোতল। এসময় তার সঙ্গিকে দেখলাম এক ঝলক। আমার বয়সী এক নারী। ইনিই কি লোকটার স্ত্রী? পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না অবশ্য তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো হারামজাদা।

    বাহ, বাইরে একজন, ভেতরে আরেকজন।

    তার মানে আমি একাই যে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার, এমনটা নয়। আমার স্ত্রীর সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এসে এই মহিলার বানিয়ে রাখা খাবার খাচ্ছে সে, যেন কিছুই হয়নি। এভাবে চুপচাপ সব সহ্য করে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। কিন্তু করবোটা কি? মনে মনে যতই খুন করার কথা ভাবি, আদতে তো আমি খুনি নই। তাকে হত্যা করা সম্ভব না আমার পক্ষে।

    অন্য কোন ফন্দি আঁটতে হবে।

    .

    ৪.১৭

    ভেবে রেখেছিলাম, সকালে অফিসে গিয়েই অ্যালিসিয়ার সাথে আগে কথা বলবো। তাকে দিয়ে স্বীকার করাবো যে গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমার সাথে মিথ্যে বলেছে। যেমনটা প্রফেসর ডায়োমেডেস বলেছিলেন, সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করবো তাকে।

    দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সুযোগটা আর হলো না।

    রিসিপশনের আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল ইউরি। “থিও, তোমার সাথে কথা আছে আমার।”

    “কি হয়েছে?”

    তার দিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে যাই। রাতারাতি যেন বয়স বেড়ে গেছে লাটভিয়ান লোকটার! চেহারা একদম ফ্যাকাসে। খারাপ কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই।

    “একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। অ্যালিসিয়া…মানে ড্রাগ ওভারডোজ-”

    “কি? ও ঠিক আছে তো?”

    মাথা ঝাঁকালে ইউরি। “এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু-”

    “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ

    “কিন্তু কোমায়। পরিস্থিতি একদমই ভালো না।”

    “কোথায় এখন?”

    গোলকধাঁধার মত করিডোরগুলো পেরিয়ে আমাকে আইসিইউতে নিয়ে এলো ইউরি। একটা প্রাইভেট রুমে রাখা হয়েছে অ্যালিসিয়াকে। ইসিজি মেশিন আর ভেন্টিলেটরের মৃদু গুঞ্জন কানে আসছে। চোখ দুটো বন্ধ, দেখে মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে।

    আরেকজন ডাক্তারের সাথে সেখানে আগে থেকেই ছিল ক্রিস্টিয়ান। রুমে উপস্থিত জরুরি বিভাগের ডাক্তারটার চাইতে অনেক বেশি ফ্যাকাসে লাগছে তাকে। অবশ্য ডাক্তার নিশ্চয়ই গ্রীষ্মমন্ডলীয় কোথাও ছুটি কাটিয়ে এসেছে, সেকারণেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তামাটে দেখাচ্ছে তার ত্বক। তবে মহিলার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ একদম স্পষ্ট।

    “অ্যালিসিয়া কেমন আছে?” জিজ্ঞেস করলাম।

    মাথা ঝাঁকালো ডাক্তার। “খুব একটা ভালো না। রোগির শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে আমরা বার্বিটুরেট ড্রাগ দিয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে কোমায় নিয়ে যাই। ওর বেলায় সেটা করতেই অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারছে না একদমই।”

    “কী খেয়েছিল?”

    “ওপিওয়িড জাতীয় কোন পেইনকিলার। খুব সম্ভবত হাইড্রোকোড়ন।”

    মাথা নাড়লো ইউরি। “ওর ঘরে ওষুধের খালি শিশি পাওয়া গেছে।”

    “কে খুঁজে পায় ওকে?”

    “আমি,” ইউরি বলল। “বিছানার পাশে মেঝেতে পড়ে ছিল। শ্বাস নিচ্ছিল না। প্রথমে তো ভেবেছিলাম মারাই গিয়েছে।”

    “ওষুধগুলো কিভাবে পেলো জানো কিছু?”

    ইউরি ক্রিস্টিয়ানের দিকে তাকালে জবাবে কাঁধ ঝাঁকায় সে। “ওয়ার্ডে অনেকেই টাকার বিনিময়ে এসব পিল এনে দেয়।”

    “যেমন এলিফ,” আমি বললাম।

    মাথা নেড়ে সায় দিল ক্রিস্টিয়ান। “আমারো ওকেই সন্দেহ হয়।”

    এসময় ইন্দিরা উপস্থিত হলো আইসিইউতে। দেখে মনে হচ্ছে যেকোন সময় কান্না জুড়ে দিবে। “অন্যান্য রোগিরাও খুব বাজেভাবে প্রভাবিত হবে এই ঘটনার দ্বারা,” বলে একটা চেয়ারে বসে অ্যালিসিয়ার হাতে হাত রাখলেন তিনি। ভেন্টিলেটরের ওঠানামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। বড় ঘরটা জুড়ে থকথক করছে নীরবতা।

    “সব দোষ আমার,” কিছুক্ষণ পর বললাম।

    মাথা ঝাঁকালেন ইন্দিরা। “তোমার কোন দোষ নেই থিও।”

    “আমার উচিৎ ছিল ঠিকভাবে ওর খেয়াল রাখা।”

    “তুমি তোমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছে। আমাদের চেয়ে অন্তত অনেক বেশি।”

    “ডায়োমেডেসকে কেউ জানিয়েছে?”

    মাথা ঝাঁকানো ক্রিস্টিয়ান। “তার সাথে এখনও কথা হয়নি।”

    “মোবাইলে ফোন করেছিলে?”

    “হ্যাঁ, বাসার নম্বরেও যোগাযোগ করেছিলাম। লাভ হয়নি।”

    ভ্রূ কুঁচকে ফেললো ইউরি। কিন্তু আমি তো প্রফেসর ডায়োমেডেসকে দেখেছি। গ্রোভেই ছিলেন তিনি।”

    “তাই?”

    “হ্যাঁ, বেশ কিছুক্ষণ আগে অবশ্য। করিডোরের অন্য পাশে ছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন।”

    “অদ্ভুত তো। যাইহোক, হয়তো বাসায় গিয়েছেন। আবার ফোন দিও।”

    মাথা নাড়লো ইউরি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য কোন ভাবনায় ডুবে আছে। অ্যালিসিয়ার এই কীর্তিতে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে সে-ই। খারাপই লাগলো বেচারার জন্যে।

    ঠিক এই সময় ক্রিস্টিয়ানের পেজার বেজে উঠলে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় সে। ইউরি আর ডাক্তারও চলে গেল রুম থেকে।

    “অ্যালিসিয়ার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাও?” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ইন্দিরা।

    জবাবে মাথা নেড়ে সায় দিলাম কেবল। উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে আলতো করে একবার চাপ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইন্দিরা।

    এখন আমি আর অ্যালিসিয়া সম্পূর্ণ একা।

    তার বিছানার বসে হাতে হাত রাখলাম। অন্য হাতটার উল্টোপিঠে একটা ক্যাথেটার লাগানো। খুব সাবধানে ওর হাতের তালুতে আঙুল বুলালাম। শুকনো হাতটার শিরা-ধমনীগুলো অনুভব করতে পারছি। কব্জির এখানটাতেই ছুরি দিয়ে পোছ দিয়েছিল আত্মহত্যা করার জন্যে।

    এভাবেই তাহলে অ্যালিসিয়ার গল্পের ইতি ঘটার কথা ছিল? আবারো নীরবতা নেমে আসলো তার জীবনে। চিরদিনের জন্যে।

    ডায়োমেডেস কী বলবেন কে জানে। ক্রিস্টিয়ান নিশ্চয়ই আমাকে দোষারোপ করার কোন না কোন পদ্ধতি খুঁজে বের করবে। আমি তাকে বেশি চাপ দিয়েছি দেখেই হাইড্রোকোডোন জাতীয় কিছু খেয়েছে সে। দুর্ঘটনাবশত ওভারডোজ হয়ে গেছে, ডায়োমেডেস হয়তো পাল্টা যুক্তি দেখাবেন। কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা তো অ্যালিসিয়ার আগে থেকেই ছিল। এভাবেই এই নাটকের পর্দা নামবে।

    আসলেই কি?

    একটা বিষয় কারোই নজরে আসেনি। এমনকি অ্যালিসিয়াকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করার সময় ইউরিও ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। ওর ডেস্কে ওষুধের একটা খালি শিশি ছিল, সেখান থেকে কয়েকটা পিল নিচেও পড়ে যায়। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে অ্যালিসিয়া।

    কিন্তু আমার আঙুলের নিচে ওর কব্জির কাছে ছোট্ট এই ক্ষতটা তো অন্য কিছুর সাক্ষ্য দিচ্ছে।

    হাইপোডার্মিক নিডলের ছাপটা আমার নজর এড়ালো না। সিরিঞ্জের সুই বিধলে এরকমটা হয়। সত্যটা বুঝতে কোন কষ্ট হলো না আমার। আত্মহত্যা করার জন্যে এক শিশি ওষুধ সাবাড় করেনি অ্যালিসিয়া। তাকে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ মরফিনের একটা ভোজ দেয়া হয়েছে।

    এটা আত্মহত্যার চেষ্টা বা ড্রাগ ওভারডোজ নয়।

    কেউ খুন করতে চেয়েছে অ্যালিসিয়াকে।

    .

    ৪.১৮

    আধা ঘন্টা পর গ্রোভে উপস্থিত হলেন ডায়োমেডেস। ট্রাস্টের সাথে নাকি একটা জরুরি মিটিংয়ে ছিল তার। এরপর হাসপাতালে আসার পথে পাতাল ট্রেনে আধাঘন্টার মত আটকে থাকেন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে। ইউরিকে পাঠান আমাকে নিয়ে নিতে।

    “প্রফেসর এসেছেন। স্টেফানির সাথে কথা বলছেন এখন। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই,” আমার অফিসে এসে বলে ইউরি।

    “ধন্যবাদ। আসছি আমি এখনই।”

    কথা শোনার জন্যে তৈরি হয়েই ডায়োমেডেসের অফিসের দিকে রওনা দিলাম। পুরো ঘটনার জন্যে ট্রাস্টের সামনে বলির পাঠা হিসেবে হাজির করানো হবে কাউকে না কাউকে। এর আগে ব্রডমুরেও এমনটা হতে দেখেছি। সাধারণত রোগির ঘনিষ্ঠ কোন স্টাফকে দোষি সাব্যস্ত করা হয়ে; সেটা ডাক্তার, নার্স কিংবা থেরাপিস্ট যে-ই হোক না কেন। স্টেফানি যে আমার পেছনে লাগবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

    দরজায় একবার নক করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। স্টেফানি আর ডায়োমেডেস ডেস্কের দু’পাশে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। কোন বিষয়ে তর্ক হচ্ছিল দু’জনের।

    প্রথমে ডায়োমেডেস কথা বললেন। গতানুগতিকের চাইতে অনেক বেশি বিচলিত মনে হচ্ছে তাকে। কথা বলার সময় দুই হাত জোরে জোরে নাড়ছেন। “খুব খারাপ হলো ব্যাপারটা। খুবই খারাপ। তা-ও এরকম একটা সময়ে। এই ঘটনার অজুহাত দেখিয়ে ট্রাস্টের তরফ থেকে গ্রোভ বন্ধ করে দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।”

    “এ মুহূর্তে ট্রাস্টের চাইতেও অন্যান্য জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবা উচিৎ আমাদের,” স্টেফানি বলল ক্রোধান্বিত কণ্ঠে। “রোগিদের নিরাপত্তার সবকিছুর উর্ধ্বে। ঠিক কি ঘটেছিল তা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের,” আমার দিকে ঘুরলো সে। “ইন্দিরা বলছিল আপনি নাকি এলিফকে সন্দেহ করছেন? তার মাধ্যমেই হাইড্রোকোডোনের ব্যবস্থা করেছে অ্যালিসিয়া?”

    তৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিলাম না। কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, “আসলে আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু কয়েকজন নার্সকে এ বিষয়ে কথা বলতে শুনেছিলাম। তাছাড়া একটা বিষয় আপনাদের বিবেচনা করা উচিৎ-”

    মাথা ঝাঁকিয়ে আমাকে থামিয়ে দেয় স্টেফানি। “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, তা বুঝতে পারছি। এলিফের কোন দোষ নেই এখানে।”

    “আসলেই?”

    “নার্স স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্রিস্টিয়ান দেখে যে ড্রাগ কেবিনেট হাট করে খোলা। সে মুহূর্তে স্টেশনে কেউ ছিল না। ইউরি দরজায় তালা না দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সুযোগ বুঝে যে কেউ সেখানে ঢুকে ওষুধ হাতিয়ে নিতে পারতো। তখন অ্যালিসিয়াকেও আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছে ক্রিস্টিয়ান। সন্দেহ হলেও কিছু বলেনি। কিন্তু এখন ঘটনা পরিস্কার।”

    “হাসপাতালে এত স্টাফ থাকতে ক্রিস্টিয়ানের নজরেই পড়লো ব্যাপারটা।”

    আমার কণ্ঠে বিদ্রুপের আভাস থাকলেও স্টেফানি সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করলো না। “ইউরির বেখেয়ালিপনা আমিও লক্ষ্য করেছি অনেকবার। নিরাপত্তার বিষয়ে কখনোই অতটা পাত্তা দেয়নি সে। রোগিদের সাথে বন্ধুদের মতন মেশে। মিশুক, সেটায় কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অতিরিক্ত বন্ধুসুলভ ব্যবহার করলে তো বিপদ। আরো আগেই এরকম কিছু ঘটতে পারতো।”

    “বুঝতে পারছি আপনার কথা,” আসলেও বুঝতে পারছি। স্টেফানি কেন আমার সাথে নরম সুরে কথা বলছে সেটা পরিস্কার। ইউরিকে বলির পাঠা বানানো হবে, আমাকে নয়।

    “ইউরি কিন্তু রোগিদের জন্যে কমও করেনি, এটা ভুলে গেলে চলবে না,” বলে ডায়োমেডেসের দিকে তাকালাম। আশা করছিলাম, তিনিও হয়তো কিছু বলবেন। “আমার আসলেও মনে হয় না।”

    আমার কথা শেষ হবার আগেই কাঁধ ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে বলবো যে অ্যালিসিয়া আগে থেকেই আত্মঘাতী কাজকর্ম করে অভ্যস্থ। আর কেউ যখন নিজের প্রাণ বিনাশের জন্যে উঠে পড়ে লাগে, তখন তাকে বাঁচানো কার সাধ্যি?”

    “কিন্তু এটাই তো আমাদের কাজ, তাই না?” শ্লেষমাখা কন্ঠে বলল স্টেফানি। “তাদের এমন কিছু করা থেকে বিরত রাখা।”

    “না।” মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করা। আমরা কিন্তু ঈশ্বর নই। জীবন মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের কোন হাত নেই। অ্যালিসিয়া বেরেনসন বারবার নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে চেয়েছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে তার সফল হবারই কথা ছিল। তবে এবারে অন্তত পুরোপুরি সফল হয়নি।”

    কথাটা বলবো কি না বুঝতে পারছি না। বললে এখনই মোক্ষম সময়।

    “আপনার যুক্তিতে কোন ভুল নেই প্রফেসর,” দ্বিধা ঝেরে ফেলে বললাম। “কিন্তু আমার মনে হয় না অ্যালিসিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।”

    “তোমার ধারণা এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা?”

    “নাহ। দুর্ঘটনাও না।”

    কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “কি বলতে চাইছো থিও? আত্মহত্যার চেষ্টা বা দুর্ঘটনা না হলে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে এসব?”

    “প্রথমেই বলে রাখি, ইউরি অ্যালিসিয়াকে ওষুধগুলো দিয়েছে, এটা বিশ্বাস করি না আমি।”

    “তাহলে, ক্রিস্টিয়ান ভুল দেখেছে?”

    “না,” বললাম। “ক্রিস্টিয়ান মিথ্যে বলছে।”

    স্টেফানি আর ডায়োমেডেস-দু’জনের দৃষ্টিতেই বিস্ময় ফুটলো। তাদের কেউ কিছু বলার আগেই আবারো মুখ খুললাম আমি। অ্যালিসিয়ার ডায়েরিতে ক্রিস্টিয়ানের ব্যাপারে কী পড়েছি সব বললাম তাদের। অ্যালিসিয়ার মানসিক সমস্যার বিষয়ে আগেও গোপনে পরামর্শ দিয়েছে সে, অনেক কিছু জানার পরেও বিচার চলাকালীন সময়ে কিছু বলেনি, গ্রোভে যোগ দেয়ার পর অ্যালিসিয়াকে না চেনার ভান করেছে-এসব শুনে দু’জনেই ভীষণ অবাক হলো। এমনটাই আশা করছিলাম। “অ্যালিসিয়া মুখ না খুললেই তার জন্যে ভালো,” বললাম। “নতুবা তার কুকীর্তি সবার জেনে যাবার ঝুঁকি ছিল।”

    স্টেফানির মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। “কিন্তু থিও, আপনি নিশ্চয়ই এটা বোঝাচ্ছেন না যে সে-”।

    “ঠিকই আন্দাজ করেছেন। এটা কোন আত্মহত্যার চেষ্টা বা ওভারডোজ নয়। অ্যালিসিয়াকে খুন করতে চেয়েছে কেউ।”

    “অ্যালিসিয়ার ডায়েরি কোথায়?” ডায়োমেডেস জিজ্ঞেস করলো। “তোমার কাছে আছে?”

    মাথা কঁকালাম। “না, ওকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই ওর ঘরে আছে।”

    “এখনই ওটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, স্টেফানির দিকে ঘুরে বললেন ডায়োমেডেস। “কিন্তু এর আগে বোধহয় আমাদের পুলিশে খবর দেয়া উচিৎ, তাই না?”

    .

     ৪.১৯

    এরপরের ঘটনাগুলো বেশ তাড়াতাড়িই ঘটলো।

    খবর পেয়ে পুলিশ অফিসারদের একটা দল চলে আসে গ্রোভে। প্রথমেই অ্যালিসিয়ার ঘর আর আর্ট রুম সিল করে দেয়। প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা চিফ ইন্সপেক্টর স্টিভেন অ্যালেন বেশ রাশভারি স্বভাবের। চোখে বিশাল ফ্রেমের একটা রিডিং গ্লাস পরায় মণিগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড় দেখাচ্ছিল। সব বিষয়েই ভীষণ কৌতূহল তার। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো অ্যালেন; ডায়োমেডেসকে যা বলেছি, তার সবকিছুই তাকে বললাম। এমনকি আমার ব্যক্তিগত নোটগুলো দেখালাম ড্রয়ার থেকে বের করে।

    “আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ, মি. ফেবার।”

    “থিও বলে ডাকবেন, প্লিজ।”

    “আপনাকে একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে হতে পারে একটু পর। সামনে আরো কয়েকবার কাজের খাতিরে আমাদের আলাপ হবে।”

    “নিশ্চয়ই।”

    ডায়োমেডেসের অফিসে বসেই সবার সাথে কথা বলছে ইন্সপেক্টর অ্যালেন। আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল সে। এক জুনিয়র অফিসারের কাছে বিবৃতি দেয়ার পর বাইরের করিডোরে ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ক্রিস্টিয়ানকে ডেকে পাঠানো হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ভয় পেয়েছে বেচারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে ভেবে মনে মনে খুশি হলাম। অপেক্ষা ছাড়া করার মত কিছু নেই এখন আমার। গ্রোভ থেকে বের হবো, এমন সময় কি মনে করে একবার নার্স স্টেশনে উঁকি দিয়েই থমকে গেলাম।

    এলিফকে এক হাতে একটা ওষুধের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে ইউরি, আরেক হাতে নগদ কিছু টাকা। বাইরে বেরিয়ে আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকায় এলিফ।

    “এলিফ,” বলি আমি।

    “জাহান্নামে যাও,” বলেই হনহন করে হেঁটে সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল সে।

    ইউরি নার্স স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখেই জমে গেল। “তু তুমি এখানে কি করছো? খেয়াল করিনি,” রীতিমত তোতলাচ্ছে সে এখন।

    “সেটা তো বুঝতেই পারছি।”

    “এলিফ ওর ওষুধগুলো নিতে ভুলে গিয়েছিল। ওগুলোই দিচ্ছিলাম ওকে।”

    “আচ্ছা।”

    তাহলে গ্রোভের ভেতরে অবৈধভাবে রোগিদের ওষুধ সরবরাহের হোতা ইউরি। কিছুক্ষণ আগে ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলে বোধহয় ভুলই করেছি। কড়া নজর রাখতে হবে এখন থেকে।

    “তোমাকে একটা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম,” আমাকে নার্স স্টেশন থেকে দূরে এনে বলল সে। “মি. মার্টিনের ব্যাপারে কি করবো?”

    “মানে?” অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম ইউরির দিকে। “জিন-ফিলিক্স মার্টিনের কথা বলছো?”

    “হ্যাঁ। গত কয়েক ঘন্টা ধরে তো এখানেই আছে সে। সকালে অ্যালিসিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তখন থেকে অপেক্ষা করছে।”

    “কি? আগে কেন বলোনি? পুরো সময় গ্রোভেই ছিল সে?”

    “দুঃখিত, আসলে আজকে এত ধকল গেছে…যাইহোক, ওয়েটিং রুমে আছে সে।”

    “ঠিক আছে। আমি তাহলে তার সাথে গিয়ে কথা বলি।”

    ইউরির বলা কথাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রিসিপশনের দিকে ছুটলাম। জিন-ফিলিক্স এখানে কি করছে? কী চায় সে? কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছে?

    ওয়েটিং রুমে ঢুকে আশপাশে তাকালাম।

    খাঁখা করছে জায়গাটা।

    .

    ৪.২০

    গ্রোভ থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। কিছুক্ষণ পর একটা কণ্ঠস্বর কানে এলো। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। ভেবেছিলাম জিন-ফিলিক্স। কিন্তু মুখ তুলে দেখি অন্য কেউ।

    ম্যাক্স বেরেনসন। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে সে।

    “এসব কি হচ্ছে?” চিল্লিয়ে উঠলো গ্যাব্রিয়েলের ভাই। চেহারা রাগে বিকৃত। দেখে মনে হচ্ছে পুরো শরীরের রক্ত এসে জমা হয়েছে মুখমন্ডলে। “আমাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়ে বলল অ্যালিসিয়ার কথা। কি হয়েছে ওর?”

    এক পা পিছিয়ে এলাম। “শান্ত হোন, মি. বেরেনসন।”

    “শান্ত হবো মানে? আপনাদের খামখেয়ালিপনার জন্যে গ্যাব্রিয়েলের স্ত্রী এখন কোমায়

    মুষ্টিবদ্ধ হাতটা উঁচু করলো সে। ভাবলাম যে ঘুষি বসিয়েই দিবে। কিন্তু দৌড়ে এসে তাকে থামালো তানিয়া। তার চেহারাতেও খেলা করছে রাগ। তবে সেই রাগটা ম্যাক্সের উদ্দেশ্যে।

    “থামো! কি করছো! পরিস্থিতি এমনিতেও যথেষ্ট খারাপ। থিওর কোন দোষ নেই!”

    তাকে পাত্তাই দিল না ম্যাক্স। আমার দিকে ঘুরলো আবারো। চোখে বুনো ক্রোধ। “অ্যালিসিয়া আপনার তত্ত্বাবধায়নে ছিল,” গলার স্বর এখনও চড়িয়েই রেখেছে। “এ রকমটা কিভাবে হতে দিলেন? কিভাবে?”

    রাগের চোটে তার চোখে পানি এসে গেছে। নিজের আবেগ লুকোনোর কোন চেষ্টাই এখন আর করছে না। ওখানে দাঁড়িয়েই কাঁদতে শুরু করলো। তানিয়ার দিকে তাকালাম; অ্যালিসিয়াকে যে ম্যাক্স পছন্দ করে, এটা অবশ্যই জানে সে। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে এখন। কোন কথা না বলে উল্টোদিকে ঘুরে গাড়িতে ফিরে গেল তানিয়া।

    ম্যাক্সের ধারে কাছেও থাকতে চাই না এখন। হাঁটতে শুরু করলাম।

    পেছন থেকে এখনও চেঁচাচ্ছে সে। ভেবেছিলাম পিছু নিবে, কিন্তু ওরকম কিছু করলো না। আগের জায়গা থেকেই আমার উদ্দেশ্যে নানারকম কথা বলছে। কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে একজন পরাজিত মানুষের বেদনার বহিঃপ্রকাশ এসব :

    “এসবের জন্যে আপনি দায়ি! আমার অ্যালিসিয়া…অ্যালিসিয়া। আপনাকে এর মূল্য চুকাতে হবে! শুনতে পাচ্ছেন?”

    ম্যাক্সের চিৎকার থামার কোন লক্ষণ নেই, কিন্তু আমি আর তার একটা কথাও শুনছি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কণ্ঠস্বর পুরোপুরি মিলিয়ে গেল।

    হাঁটা থামালাম না।

    .

     ৪.২১

    হাঁটতে হাঁটতে ক্যাথির প্রেমিকের বাড়ির কাছাকাছি চলে এলাম। প্রায় এক ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর দেখা পেলাম ‘ভদ্রলোকের’। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এসেছে সে। কোথায় যাচ্ছে? ক্যাথির সাথে দেখা করতে? কি করবো সেটা নিয়ে দোটানায় ভুগলাম কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত তাকে অনুসরণ না করারই সিদ্ধান্ত নিলাম। বরং বাড়িটার দিকেই আজকে নজর রাখবো।

    জানালা দিয়ে তার স্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে এখন। ভেতরে ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করছি। সাহায্যের তাগিদ। এই মহিলার তো কোন দোষ নেই, আমার মতনই পরিস্থিতির শিকার সে। তাকে কোন না কোনভাবে সাহায্য করতেই হবে। আমরা যাদের ভালোবেসেছি, তারাই আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

    নাকি ভুল ভাবছি? মহিলা লোকটার পরকীয়ার ব্যাপারে সব জানে? এরকম খোলামেলা সম্পর্কেও অনেকে মজা পায়। হয়তো সে-ও বহুগামী? কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একসময়কার আমার মতনই নির্ভার, সঙ্গিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে। যে লোকটার সাথে প্রতি রাতে একই বিছানায় ঘুমোতে যায় সে, তার ব্যাপারে কড়া কিছু সত্য বলতে চাই আমি। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

    পরবর্তী দিনগুলোতেও বারবার ফিরে গেলাম সেখানে। এর মাঝে একদিন সে বাসা থেকে হাঁটতে বের হয়েছিল। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে অনুসরণ করি আমি। একটা পর্যায়ে সে হয়তো আমাকে দেখেও ফেলে। কিন্তু দেখলেও সমস্যা নেই। আমি তার কাছে নেহায়েতই অপরিচিত একজন। আপাতত।

    কয়েকটা জিনিস কিনে আবারো ফিরে এলাম আগের জায়গায়। রাস্তার অন্য পাশ থেকে বাড়িটার ওপরে নজর রাখছি। কিছুক্ষণ পর জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো সে।

    কী করবো সে বিষয়ে আমার আসলে ওরকম নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। শুধু অস্পষ্ট একটা ধারণা আছে বলা যায়। অনভিজ্ঞ চিত্রশিল্পীদের মতন ব্যাপারটা। ছবিটা কি রকম হবে সেটা জানি, কিন্তু কিভাবে সেটা আঁকতে হবে সে ব্যাপারে ধারণা খুব অল্প। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মূল ফটকে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। বাগানে এখন আমি। শরীরে অ্যাড্রেনালিনের প্রভাব টের পাচ্ছি। বিনা অনুমতিতে অন্য কারো বাড়িতে ঢোকার মধ্যে আলাদা এক ধরণের রোমাঞ্চ আছে।

    ঠিক এসময় পেছনের দরজাটা খুলে গেল। লুকোনোর আশায় চারপাশে তাকালাম। বাগানের ভেতরেই একটা ছোট ঘর ছাড়া গা ঢাকা দেয়ার মত আর কিছু চোখে পড়লো না। অগত্যা সেখানেই আশ্রয় নিলাম। বুক হাঁপরের মত উঠছে নামছে। আমাকে কি দেখে ফেলেছে সে? তার পদশব্দ কানে এলো কিছুক্ষণ পর। এখানেই আসছে। আর পিছু হটার কোন সুযোগ নেই। পেছনের পকেট থেকে একটু আগে কেনা স্কি মাস্কটা বের করে মাথায় গলিয়ে নিলাম। বাইরে থেকে শুধু আমার চোখ দেখা যাচ্ছে এখন। হাতে গ্লোভস পরলাম।

    ভেতরে ঢুকলো মহিলা। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে : “ঠিক আছে, ডার্লিং। আটটার সময় দেখা হবে! হ্যাঁ…আই লাভ ইউ।”

    ফোন কেটে দিয়ে হাতের ফ্যানটা চালিয়ে দেয় সে। কিছুক্ষণ ফ্যানের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে, বাতাসে চুলগুলো উড়ছে। এরপর একটা তুলি হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় জানালার ধারে দাঁড় করানো ইজেলের দিকে। এখনও আমার দিকে পিঠ দিয়ে আছে। হঠাই থমকে যায় সে, জানালায় আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে। প্রথমে বোধহয় আমার ছুরিটার চকচকে ফলাই নজরে এসেছে তার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ধীরপায়ে ঘুরে দাঁড়ালো এরপর। একে অন্যের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলাম আমরা।

    সেবারই প্রথম অ্যালিসিয়া বেরেনসনের সাথে প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল আমার।

    বাকিটা ইতিহাস।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড (রক্তের ঋণ) – অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস
    Next Article ট্রেইটরস ইন দ্য শ্যাডোস : এম্পায়ার অব দ্য মোগল -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }