Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য সি-হক – রাফায়েল সাবাতিনি

    ইসমাইল আরমান এক পাতা গল্প392 Mins Read0

    ২. জ্যাসপার লেই

    ০৬.

    জ্যাসপার লেই

    শোক এবং কষ্টের মধ্য দিয়ে পার হলো সে-বারের বড়দিন। পেনারো হাউস কিংবা গডলফিন কোর্টে কেউ কোনও আনন্দ করল না।

    দিনগুলো গম্ভীর হয়ে কাটাল অলিভার। বেশিরভাগ সময় কাটাল ডাইনিং হলে, ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে রইল ঘন্টার পর ঘণ্টা, জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে মগ্ন হয়ে রইল আপন চিন্তায়। ইতোমধ্যে কয়েক দফা রোজামুণ্ডের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছে ও, সফল হয়নি। গডলফিন কোর্টের ফটকে বাধা দিয়েছে ওকে ভৃত্যরা। ওদের সঙ্গে জোর-জবরদস্তি করবার রুচি হয়নি, তাতে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। ধৈর্য ধরে ও এখন অপেক্ষা করছে রোজামুল্পে রাগ পড়বার। তারপর নাহয় মাস্টার বেইনের স্বাক্ষর করা প্রমাণপত্রটা দেখাবে তাকে।

    হাঁটাচলা করবার মত সুস্থ হয়ে উঠেছে লায়োনেল-বাইরে যায় না, তবে বাড়ির ভিতরে হাঁটাহাঁটি করে। ভাইকে বিরক্ত করবার সাহস হয় না তার, দূর থেকে দেখে অলিভারের করুণ দশা। পিটারের খুনের দায়ে বেচারাকে যে সন্দেহ করছে সবাই, তা কানে এসেছে ওর। এ-ও জেনেছে, তরুণ নাইটের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে রোজামুণ্ড। ও-ই দায়ী এসবের জন্য… না জানি কী ভাবছে অলিভার ওকে নিয়ে। তাই সামনে যাবার সাহস হয় না।

    ইদানীং দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে লায়োনেলকে, কেন যেন আস্থা রাখতে পারছে না অলিভারের উপর। গডলফিন কোর্টের তরুণীটিকে তার ভাই কতটা ভালবাসে, সেটা ভাল করেই জানে ও। তাই আশঙ্কা করছে, বিরহের যাতনা অসহনীয় হয়ে উঠলে হয়তো ভেঙে পড়বে অলিভার। ফঁস করে দেবে সত্যি ঘটনা। এ ছাড়া তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের আর কোনও উপায় নেই ওর। কিন্তু তার ফলে যে লায়োনেলের গলায় ফাঁসির দড়ি পড়বে, সেটা কি ভাববে সে? না ভাবারই তো কথা। কে লায়োনেল? আপন নয়, সৎ ভাই। তার জন্য কেন নিজের প্রেমকে বিসর্জন দেবে অলিভার? দিনে দিনে আশঙ্কাটা জেঁকে বসতে থাকল লায়োনেলের মাথায়।

    সন্দেহের বীজ এমনই এক জিনিস, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহীরুহে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে ডালপালা বিস্তার করে, কিছুতেই মরে না। লায়োনেলের বেলাতেও তা-ই ঘটল। কিছুদিন পর ও আপনাআপনি নিশ্চিত হয়ে গেল, অলিভার বিশ্বাসঘাতকতা করবে ওর সঙ্গে, মুখ বন্ধ রাখবে না কিছুতেই। ধারণাটা বদ্ধমূল হবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা এলোমেলো হয়ে গেল লায়োনেলের, একদিন বিস্ফোরণও ঘটল ভাইয়ের সামনে।

    বিকেলবেলা ফায়ারপ্লেসের সামনে চুপচাপ বসে ছিল অলিভার, ওখানে হাজির হলো লায়োনেল। রুক্ষ গলায় বলল, সারাদিন তুমি এখানে বসে থাকো কেন, বলো তো?

    চোখ তুলে অনুজের দিকে তাকাল অলিভার, তারপর ডাইনিং রুমের জানালার দিকে।

    বৃষ্টি হচ্ছে, মৃদুস্বরে বলল.ও।

    বৃষ্টির দোহাই দিয়ো না। রোদ উঠলেও তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে। বাইরে যাও না কেন?

    গিয়ে কী লাভ? দীর্ঘশ্বাস ফেলল অলিভার। সন্দেহের চোখে তাকায় সবাই আমার দিকে, উল্টো ঘুরলেই পিছনে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। ওসব ভাল লাগে না আমার।

    অ! ব্যাপার তা হলে এ-ই? হিসিয়ে উঠল লায়োনেল। ওসব তো আমার প্রাপ্য, তুমি কেন সইবে… এটাই তোমার যুক্তি, তাই না?

    কী? বিস্মিত হলো অলিভার। ভাইয়ের মুখে এমন কথা আশা করেনি।

    ঠিকই বলছি। তোমাকে বুঝতে বাকি নেই আমার। উপরে উপরে ভালমানুষি, কিন্তু অন্তরে বিষ!

    মনে হচ্ছে অসুখের কারণে তোমার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে, লায়োনেল, ভুরু কুঁচকে বলল অলিভার। কী বলছ তা নিজেও জানো না। উঠে দাঁড়াল ও। কাছে গিয়ে হাত রাখল ভাইয়ের কাঁধে। শান্ত হও। কী হয়েছে বলো তো? আমার উপর আস্থা রাখতে পারছ না? শোনো, একটা বুদ্ধি বের করেছি তোমাকে বাঁচাবার। একটা জাহাজ কিনব আমি, সেটায় চেপে দুভাই বেরিয়ে পড়ব সমুদ্রযাত্রায়। যতদিন ভাল লাগে, ঘুরে বেড়াব সাগরের বুকে। তারপর দূরে কোথাও নেমে পড়ব–এমন জায়গায়, যেখানে তোমাকে-আমাকে চেনে না কেউ। নতুন করে আবার জীবন শুরু করব আমরা।

    জ্বলজ্বলে চোখে অলিভারের দিকে তাকাল লায়োনেল। হঠাৎ একটা চিন্তা খেলল মাথায়… বাজে চিন্তা, লজ্জিত হলো ও; তাই বলে এড়াতে পারল না সেটাকে। পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিচ্ছে তরুণ নাইট, তাতে লায়োনেল হয়তো খুনের দায়ে অভিযুক্ত হবে না, কিন্তু সবাই ভেবে নেবে–পিটারের মৃত্যুতে ওরও হাত আছে। কেন যেন মেনে নিতে পারল না সেটা। হতে পারে সে খুনি, কিন্তু কেউ তো জানে না সত্যটা। বরং পুরো এলাকার লোকজন ওকে নম্র-ভদ্র ছেলে হিসেবে জানে, সম্মান করে। পালিয়ে যাওয়া মানে নিজেকে কলঙ্কিত করা!

    ভাইয়ের অন্তরের টানাপড়েন বুঝতে পারল না অলিভার, ধরে নিল প্রস্তাবটা মেনে নিয়েছে সে। তাই বলল, শোনো, স্মিথিকের ওদিকে একটা জাহাজ নোঙর করেছে… হয়তো দেখেছ ওটাকে। ক্যাপ্টেনের নাম জ্যাসপার লেই, দুঃসাহসী এক অভিযাত্রী সে। প্রতিদিন বিকেলেই পেনিকামওয়াইকের পানশালায় পাওয়া যায় ওকে। পুরনো পরিচয় আছে আমাদের, এরই মধ্যে একদিন কথাও বলে এসেছি। অভিযানে বেরুনোর জন্য ছটফট করছে সে, টাকার অভাবে পারছে না। খরচাপাতি দিলেই জাহাজটা আমাদের হয়ে যাবে, কর্নওয়াল ছেড়ে চলে যেতে পারব আমরা। মানে… তোমার যদি আপত্তি না থাকে আর কী।

    ভেবে দেখি, নীরস গলায় বলল লায়োনেল, অলিভারের উৎসাহে পানি ঢেলে দিল। বেরিয়ে গেল ডাইনিং রুম থেকে।

    আনমনে মাথা নাড়ল তরুণ নাইট। বসে পড়ল আবার ফায়ারপ্লেসের সামনে।

    .

    উৎসাহ না দেখালেও অলিভারের প্রস্তাব পুরোপুরি অগ্রাহ্য করছে না লায়োনেল। শরীরে আরেকটু শক্তি ফিরে পেতেই ঘোড়ায় চড়ে পেনিকামওয়াইকে আসা-যাওয়া শুরু করল। পানশালায় গিয়ে সখ্য গড়ে নিল ক্যাপ্টেন জ্যাসপার লেইয়ের সঙ্গে। তার মুখে শুনল বিভিন্ন অতীত অভিযানের কাহিনি। আসলে বুঝে নিতে চাইছে, . সমুদ্রযাত্রায় যাওয়া উচিত হবে কি না। তাতে সুবিধে-অসুবিধে কতখানি।

    তবে একদিন ক্যাপ্টেনের মুখে অন্য এক খবর পেল লায়োনেল। উদ্বিগ্ন হবার মত খবর। ঘণ্টাখানেক আড্ডা দেবার পর ঘোড়ায় চড়ছিল ও, এমন সময় জ্যাসপার লেই বলল, কিছু মনে করবেন না, মাস্টার ট্রেসিলিয়ান। আপনার ভাই কী ধরনের গাঁজায় পড়তে যাচ্ছে, সে-সম্পর্কে জানেন কিছু?

    কীসের কথা বলছেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল লায়োনেল।

    মাস্টার পিটার গডলফিনের খুনের কথা। এলাকার বিচারক কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না দেখে গডলফিন পরিবার থেকে আর্জি জানানো হয়েছে কর্নওয়ালের লর্ড লেফটেন্যান্টের কাছে। কিন্তু তাঁর হুকুমও মানতে রাজি হননি, মাস্টার বেইন। জানিয়ে দিয়েছেন, লর্ড লেফটেন্যান্টের অধীনে নয়, সরাসরি ব্রিটেনের রানির অধীনে কাজ করেন তিনি। কিছুতেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবেন না। আঁতে ঘা লেগেছে লর্ডের। শুনেছি বিষয়টা নিয়ে এবার রানির কাছে চিঠি লিখেছেন তিনি, তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পরিস্থিতি সুবিধের নয়, রানি আদেশ দিলে কিছুতেই সেটা অমান্য করতে পারবেন না মাস্টার বেইন।

    গম্ভীর হয়ে গেল লায়োনেল। কিছু বলল না।

    ভাবলাম সার অলিভারকে সতর্ক করে দিই, যোগ করল ক্যাপ্টেন। চমৎকার মানুষ তিনি, দুর্ধর্ষ নাবিক। এমন নাবিক সচরাচর দেখা যায় না।

    পকেট থেকে কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে তার হাতে খুঁজে দিল লায়োনেল। বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে উধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছোটাল ও।

    আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে লায়োনেল। চরম বিপদে পড়তে চলেছে ও। অলিভারকে এবার সত্য প্রকাশ করতেই হবে। আর তার অর্থ–ওর মরণ! বাড়িতে ঢুকে আতঙ্ক আরেক পরত বাড়ল। অলিভার নেই। নিকোলাসের কাছে শুনল, সে গডলফিন কোর্টে গেছে। তারমানে খবরটা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে তরুণ নাইট। ঝামেলা দেখা দেবার আগেই একটা মীমাংসায় পৌঁছুতে চাইছে রোজামুণ্ডের সঙ্গে। নইলে ও-বাড়িতে যাবার দরকার কী?

    লায়োনেলের জানা নেই, ওর আশঙ্কা অমূলক। রোজামুণ্ডের সঙ্গেই দেখা করতে গেছে বটে অলিভার, তবে কোনও ধরনের মীমাংসা করবার জন্য নয়। পরিস্থিতি একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছে ওর জন্য, তাই ঠিক করেছে-আজই মাস্টার বেইনের সই করা প্রমাণপত্রটা দেখাবে রোজামুণ্ডকে। ভেঙে দেবে ওর ভুল ধারণা। অবশ্য ওর মনের আশা পূরণ হলো না। গডলফিন কোর্টের ফটকই পেরুতে পারল না, ভিতর থেকে খবর পাঠাল রোজামুণ্ড–ওর সঙ্গে দেখা করবে না। বিফল মনোরথ হয়ে ঘণ্টাখানেক পর পেনারো হাউসে ফিরে এল ও।

    বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল লায়োনেল। অভিবাদনের ধার ধারল না। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, এবার… এবার তুমি কী করবে, অলিভার?

    ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল তরুণ নাইট। কী করব মানে? কীসের কথা বলছ?

    কেন, খবর শোনোনি তুমি? লর্ড লেফটেন্যান্টের ব্যাপারটা খুলে বলল লায়োনেল। শুনতে শুনতে মেঘ জমল অলিভারের চেহারায়।

    হুম, ভাইয়ের কথা শেষ হলে মাথা কেঁকাল ও। তা হলে এ-কারণেই বোধহয় আমার সঙ্গে দেখা করেনি রোজামুণ্ড। নিশ্চয়ই ভেবেছে আমি ক্ষমা চাইতে গেছি। সখেদে মেঝেতে বুট ঠুকল। নাহ্! চুপ থেকে দেখি আরও খারাপ আকার ধারণ করেছে সমস্যাটা!

    কী করবে তুমি? ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইল লায়োনেল।

    কী করব? ভাইয়ের দিকে ঘাড় ফেরাল অলিভার। আর বাড়তে দেব না ব্যাপারটাকে। সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে ওদেরকে লজ্জায় ফেলব।

    তু… তুমি ওদেরকে আসল ঘটনা বলে দেবে?

    ভাইয়ের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ কান এড়াল না অলিভারের। বিরক্ত হয়ে ও বলল, তুমি বুঝি এখনও ভয় পাচ্ছ? বলেছি তো, তোমার গায়ে আঁচড় পড়তে দেব না। সত্য ঘটনা বলব বটে, তবে শুধু আমার অংশটা। তোমার নাম উচ্চারণ করব না একবারও।

    কীভাবে সেটা সম্ভব?

    প্রমাণপত্রের ব্যাপারে ভাইকে সব খুলে বলল অলিভার। কিন্তু তাতে একটুও স্বস্তি পেল না লায়োনেল। অলিভার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করলে সমস্যা মিটছে না। বরং তাতে আরও জোরেশোরে প্রশ্ন উঠবে–কে তা হলে খুন করেছে পিটারকে? বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে ওর নাম। জানাজানি হবে মালপাসের ওই মেয়েটির সঙ্গে ওর আর পিটারের সম্পর্কের কথা, আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যাবে ওর গায়ে।

    বাঁচার পথ একটাই–অভিযোগের তীর সরতে দেয়া যাবে না অলিভারের দিক থেকে। কিছুতেই ওকে ওই প্রমাণপত্র দাখিল করতে দেয়া যাবে না। কিন্তু কীভাবে? ভাবতে শুরু করল লায়োনেল। ধীরে ধীরে কুটিল এক পরিকল্পনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ওর ভিতরে। নীচ, ঘৃণ্য এক পরিকল্পনা… কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর জন্য এর কোনও বিকল্পও নেই।

    পরদিনই আবার পেনিকামওয়াইকের পানশালায় চলে গেল ও, দেখা করল জ্যাসপার লেইয়ের সঙ্গে। তাকে দিয়েই সারতে হবে কাজটা। গত কিছুদিনে বুঝে গেছে, টাকা পেলে যে-কোনও কাজ করবে লোকটা। ন্যায়-অন্যায় নিয়ে মাথা ঘামাবে না। তবে যা করবার দ্রুত করতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই। রোজামুণ্ডের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না অলিভার, কিন্তু সার জন কিলিগ্রুর মাধ্যমেও প্রমাণপত্রটা পাঠিয়ে দিতে পারে মেয়েটার কাছে। কপাল ভাল যে ভদ্রলোক এ-মুহূর্তে এলাকায় নেই, কী এক কাজে যেন লণ্ডনে গেছেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে ফিরে আসবার কথা। তার আগেই কার্যোদ্ধার করতে হবে লায়োনেলকে।

    জ্যাসপার লেইয়ের সঙ্গে দেখা করল বটে ও, কিন্তু শুরুতেই কাজের কথা পাড়তে পারল না। সাহস হারিয়ে ফেলল, বোধ করল সংকোচ। চুপচাপ ক্যাপ্টেনের গালগল্প শুনল অনেকক্ষণ, মদ গিলল গ্লাসের পর গ্লাস। শেষ পর্যন্ত যখন হাল ছেড়ে দিতে যাবে, তখুনি প্রসঙ্গটার অবতারণা করল লেই।

    সার অলিভারকে সতর্ক করে দিয়েছেন তো?

    ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল যেন লায়োনেল, দেখতে পেল আশার আলো। মাথা ঝাঁকিয়ে ও বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে বলতে পারি না। অলিভার খুবই একরোখা স্বভাবের মানুষ।

    মুখভর্তি লাল দাড়িতে হাত বোলাল লেই। তা হলে বলব, জেনেশুনে ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছেন তিনি। মানে… যদি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারেন আর কী।

    হ্যাঁ, যদি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারে! প্রতিধ্বনি করল লায়োনেল। বুক ধক ধক করছে ওর। ক্যাপ্টেন, চলুন। একটু বাইরে যাই।

    চোখদুটো ছোট হয়ে এল লেইয়ের। লায়োনেলের কণ্ঠস্বরের পরির্তন কান এড়ায়নি। তাড়াতাড়ি সামনে রাখা মদের গ্লাস খালি করল। তারপর বলল, চলুন।

    পানশালা থেকে বেরিয়ে এ দুজনে। হাঁটতে শুরু করল সাগরপারের দিকে। জোর হাওয়া বইছে, বড় বড় ঢেউ উঠেছে সাগরের বুকে। মাথায় ফেনার মুকুট নিয়ে তীরে এসে আছড়ে পড়ছে ওগুলো। দূরে চোখে পড়ছে ক্যাপ্টেন লেইয়ের জাহাজ নোয়ালো-র কালচে অবয়ব, নেউয়ের দোলায় দুলছে ওটা।

    পানির শিকারে গিয়ে কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল লারেনেল। কথা গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। শেষ পর্যন্ত লেই সাহায্য করল তাকে।

    মনে হচ্ছে আপনি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চান, মাস্টার ট্রেসিলিয়ান, বলল ক্যাপ্টেন। নিঃসংকোচে বলতে পারেন, আমি শুনছি।

    দীর্ঘশ্বাস ফেলল লায়োনেল। লেইয়ের দিকে ফিরল। নিচু গলায় বলল, আ… আমি একটা সমস্যায় পড়েছি, ক্যাপ্টেন।

    যে-কোনও ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন। বলুন কী করতে হবে।

    সমস্যাটা অলিভারকে নিয়ে। একরোখামির কারণে সবার বিপদ ডেকে আনছে ও আপনাকে বলে দেয়া প্রয়োজন, যদি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় ওকে, নিঃসন্দেহে হেরে যাবে। পরাজয়টা ওর একার নয়, আমারও। পরিবারের একজন সদস্যের ফাঁসি হওয়া মানে বাকিদের মুখেও চুনকালি পড়া। মাথা তুলে আর দাঁড়াতে পারব না আমি কোনোদিন।

    খাঁটি কথা, একমত হলো লেই।

    আমি চাই না অমন কিছু ঘটুক, বলল লায়োনেল। আর সেটা ঠেকাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, অলিভারকে সরিয়ে ফেলতে হবে এখান থেকে। কিছুতেই ওকে গ্রেফতার হতে দেয়া যাবে না। তারমানে এই নয় যে, ওর শাস্তি চাইছি না আমি। নিরীহ একজন মানুষকে হত্যা করবার ফল পেতেই হবে ওকে, কিন্তু আমি চাই–তাতে যেন আমি কলঙ্কিত না হই।

    তারমানে আপনিও সার অলিভারের শাস্তি চাইছেন? বিস্মিত হলো লেই।

    হা। কারণ পিটার আমার বন্ধু ছিল। তাকে কাপুরুষের মত খুন করেছে অলিভার… আমার সৎ-ভাই! শাস্তি ওকে পেতেই হবে। কিন্তু বিচারের কাঠগড়ায় নয়। অন্যভাবে।

    কীভাবে সেটা সম্ভব?

    আশা করছি আপনি একটা পরামর্শ দেবেন আমাকে।

    কুটিল হাসি ফুটল ধুরন্ধর ক্যাপ্টেনের মুখে। ঠিক লোকের কাছেই এসেছেন আপনি, মাস্টার ট্রেসিলিয়ান। শাস্তি দিতে চান সার অলিভারকে? আপনি বললে আমি তাকে তুলে আনতে পারি। জাহাজে করে নিয়ে যাব প্রাচ্যের কোনও প্ল্যানটেশনে, শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেব! ওসব জায়গায় সার অলিভারের মত তাগড়া জোয়ানের বড় অভাব।

    কিন্তু ও যদি টাকা জমিয়ে ওখান থেকে ফিরে আসে? সন্দিহান দেখাল লায়োনেলকে।

    হুম! তা হলে অন্য কিছু ভাবা যাক। বারবারি সওদাগরদের কাছে দাস হিসেবে বেচে দিলে কেমন হয়? বেতন-টেন কিছু দেয় না ওরা, লোক হিসেবেও খুবই নিষ্ঠুর। আমার জানামতে, আজ পর্যন্ত ওদের জাহাজ থেকে কোনও দাস প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি।

    সেটা বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে না?

    মানুষ খুন করেছে সার অলিভার, নিষ্ঠুরতাই তো তার প্রাপ্য। তা ছাড়া ফাঁসির চেয়ে ভাল পরিণতি ওটা। এতে আপনার উপরেও সন্দেহ সৃষ্টি হবে না কারও। সবাই ভাববে, প্রাণদণ্ডের ভয়ে পালিয়ে গেছেন তিনি।

    লেইয়ের বক্তব্য খতিয়ে দেখল লায়োনেল। বুঝতে পারল, যুক্তি, আছে লোকটার কথায়। তাই মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনার কথাই সই। খরচাপাতি কেমন পড়বে?

    দাড়িতে হাত বোলাল লেই। বেশি না, আপনি আমার বন্ধু মানুষ। একশ পাউণ্ড দেবেন আমাকে… আরও একশ আমার ক্রু-দের জন্য। মোট দুইশ পাউণ্ডে চিরদিনের জন্য মিটে যাবে আপনার সমস্যা।

    একটু ভাবল লায়োনেল। এ-মুহূর্তে অত টাকা নেই আমার কাছে। দেড়শ পাউণ্ড দিতে পারব নগদ, বাকিটা অলঙ্কারে। ঠকবেন না ওতে, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, কাজ শেষ হবার খবর যখন নিয়ে আসবেন, তখন বাড়তি কিছু টাকাও দেব।

    রাজি হয়ে গেল লেই। এবার কর্মপদ্ধতি ঠিক করবার পালা। ক্যাপ্টেন জানতে চাইল, অলিভারকে লায়োনেল পানির ধারে কোনও নির্জন জায়গায় নিয়ে আসতে পারবে কি না। লোক আর নৌকা তৈরি থাকবে তার, বন্দিকে ঝটপট জাহাজে তুলে সাগরে পাড়ি জমাবে সেক্ষেত্রে।

    আশপাশে নজর বুলিয়ে হাসি ফুটল লায়োনেলের ঠোঁটে। পেয়েছে জায়গা। গডলফিন কোর্টের কাছে… ট্রেফুসিস পয়েন্টের নদীতীর বিকেলের রোদে ঝলমল করছে। ওখানে খুব সহজে ফাঁদ পাতা যাবে তার বোকা ভাইটির জন্য।

    দ্রুত সবকিছু ঠিক করে নিল দুজনে। তারপর ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল লায়োনেল। কয়েক ঘন্টা আগেকার ভীত মানুষটির ছায়াও আর অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে। সম্পূর্ণ বদলে গেছে সে।

    .

    ০৭.

    অন্তর্ধান

    কেনাকাটার নাম করে পরদিন সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল লায়োনেল। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে ফিরে এল সন্ধ্যায়। বাড়িতে ঢুকে চলে গেল হলঘরে, অলিভারের সঙ্গে দেখা করবার জন্য।

    গডলফিন কোর্ট থেকে খবর নিয়ে এসেছি, বলল ও। ফটকের সামনে দিয়ে যাবার সময় একটা ছেলে বেরিয়ে এসে বলল, রোজামুণ্ড নাকি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

    চমকে উঠল অলিভার, দ্রুততর হয়ে গেল হৃৎস্পন্দন। ওকে ডেকেছে রোজামুণ্ড! হঠাৎ করে মত বদলাল কেন মেয়েটা, এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে কি না… এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না।

    খুব ভাল খবর এনেছ, ভাই, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ও। আমি এখুনি যাচ্ছি।

    ঝড়ের বেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল অলিভার, বাইরে শোনা গেল ওর ঘোড়ার খুরের টগবগানি, একটু পর মিলিয়ে গেল তা। বড় করে শ্বাস ফেলল লায়োনেল। ঠোঁট কামড়াল। বিবেকের দংশনে জর্জরিত হচ্ছে। একবার ইচ্ছে হলো পিছু নেয় ভাইয়ের.:. থামায় তাকে। কিন্তু শক্তহাতে দমন করল ইচ্ছেটা। পরিকল্পনামত ঘটতে হবে সব। এর উপরৈ নির্ভর করছে নিজের জীবন।

    টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু সেদিকে গেল না লায়োনেল। চলে গেল আগুনের কাছে, অলিভারের চেয়ারে বসল। হাত-পা কাঁপছে–উত্তেজনা, সেই সঙ্গে ঠাণ্ডায়। দুহাত মেলে দিল আগুনের দিকে।

    নিকোলাস উদয় হলো একটু পর। জানতে চাইল লায়োনেল এখন খাবে কি না। নেতিবাচক জবাব দিল লায়োনেল, বলল অপেক্ষা করবে অলিভারের জন্য।

    সার অলিভার কি বাইরে গেছেন? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল নিকোলাস।

    হ্যাঁ, বলল লায়োনেল। তাড়াতাড়ি যোগ করল, কোথায় যাচ্ছে, তা বলে যায়নি আমাকে। আশা করি শীঘ্রি ফিরে আসবে।

    কথাটা ডাহা মিথ্যে। নিকোলাসকে বিদায় করে দিয়ে চিন্তার সাগরে ডুবে গেল ও। মনের টানাপড়েনে আক্রান্ত হয়েছে। ভাইয়ের মহত্ত্বের ব্যাপারে সচেতন লায়োনেল, জানে ওকে নিরাপদ রাখবার জন্য কতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছে অলিভার। সেই ভাইয়ের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে চলেছে ও। নিজেকে নীচ, স্বার্থপর আর ইতর বলে মনে হলো; জাগল ঘৃণা। বোধহয় তার হাত থেকে বাঁচবার জন্যই পাল্টা যুক্তি খাড়া করতে শুরু করল। ত্যাগ স্বীকার করেছে অলিভার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি সত্য ঘটনা ফাঁস করে দেয়, এসব ত্যাগের কী মূল্য আছে? মরতে হবে লায়োনেলকে… জীবন বাঁচাবার অধিকার কি ওর নেই? দুনিয়া বড়ই কঠিন জায়গা-শক্তের ভক্ত, নরমের যম। টিকে থাকতে হলে তাই শক্ত হওয়া প্রয়োজন ওর… হোক সেটা নিজের ভাইকে দমিয়ে। যে-সমীকরণের ফলাফল নির্ধারিত হবে জীবন বা মৃত্যু দিয়ে, সেটাকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য যে-কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে ও, তার জন্য কেন অপরাধবোধে ভুগবে?

    কিন্তু যত যুক্তিই দেখাল লায়োনেল, কিছুতেই মনকে প্রবোধ দিতে পারল না। হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত মেনে নিল, ও একজন স্বার্থান্বেষী খলনায়ক। কিছুতেই এ-সত্যকে অগ্রাহ্য করা সম্ভ নয়। বেশ, তবে তা-ই হোক। হলোই নাহয় খল, কিন্তু তাতে লাভ বৈ ক্ষতি তো হচ্ছে না। ফাঁসির দড়ি থেকে গলাটাই কেব বাঁচছে না, সেই সঙ্গে মালিকানা পাচ্ছে অলিভারের অগা ধনসম্পদের।

    দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল লায়োনেলের মন থেকে। মন্দ কাজে সঙ্গে কিছু ভাল ব্যাপারও তো ঘটে।

    রাতভর ফিরল না অলিভার। ভোর হতেই বাড়ির চাকর বাকরদেরকে পাঠিয়ে দিল লায়োনেল, ওর খোঁজ বের করবার জন্য। বলা বাহুল্য, পুরো এলাকা চষেও মালিকের সন্ধান পেল না তারা। চারদিকে খবর রটে গেল–সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান নিখোঁজ!

    সূর্যাস্তের আগেভাগে লায়োনেল নিজেই বেরুল। চলে গেল সার জন কিলিগ্রুর সঙ্গে দেখা করতে, তাঁকে জিজ্ঞেস করবে–অলিভারের অন্তর্ধান সম্পর্কে কিছু জানেন কি না। ইতোমধ্যে লণ্ডন থেকে ফিরে এসেছেন ভদ্রলোক। লায়োনেলের কথা শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন সার জন। জানালেন, অলিভারের সঙ্গে বেশ কিছুদিন থেকে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি তাঁর। লায়োনেলের সঙ্গে বেশ নম্র ব্যবহারও করলেন তিনি। এমনিতে ওকে বেশ পছন্দ করেন ভদ্রলোক, অলিভারের মত গোঁয়ার আর উদ্ধত বলে ভাবেন না। লায়োনেল ভাল ছেলে বলেও এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা আছে তার মধ্যে।

    আমার কাছে এসেছ, এটাই স্বাভাবিক, বললেন সার জন। কিন্তু নিশ্চিত থাকো, বাছা, সার অলিভারের গায়েব হয়ে যাওয়ায় আমার হাত নেই। আর যা-ই করি, রাতের আঁধারে শত্রুর উপর হামলা চালাবার মত কাপুরুষ নই আমি।

    দুঃখিত, আমি তেমন কিছু বোঝাতেও চাইনি, বলল চায়োনেল। যদি অপ্রীতিকর প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করে থাকি, তার জন্য ক্ষমা চাইছি। আসলে… কী যে করব, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। এমনিতেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছি বহুদিন থেকে; তার ওপর আজকের এই কাণ্ড! বোঝেনই তো, একজন খুনির সঙ্গে বাস করতে গেলে যা হয় আর কী। হতে পারে অলিভার আমার ভাই, কিন্তু যে-অন্যায় ও করেছে, তা বিবেকবান কারও পক্ষে মেনে নেয়া খুব কষ্টকর।

    কী! চমকে উঠলেন সার জন। তা হলে তোমারও ধারণা, অলিভারই পিটারকে খুন করেছে? এ-ব্যাপারে কিছু শুনেছ ওর মুখে?

    এক ছাদের তলায় থাকি আমরা, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল লায়োনেল। মুখে না বললেও অনেক কিছু এমনিতেই বোঝ যায়।

    হুম! গম্ভীর হয়ে গেলেন সার জন। একটু সময় নীরব থেকে বললেন, একটা ব্যাপার… ট্যুরোর বিচারকেরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে বলে আমরা রানির কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। আশা করছি খুব শীঘ্রি তিনি সার অলিভারকে গ্রেফতারের জন্য আদেশ পাঠাবেন। আচ্ছা, এ-খবর কি তোমার ভাই জানে?

    অবশ্যই! আমিই খবরটা দিয়েছি ওকে। বোকা বোকা চেহারা করল লায়োনেল। কিন্তু এ-প্রশ্ন কেন করছেন?

    ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ফুটল সার জনের ঠোঁটে। সার অলিভারের উধাও হয়ে যাবার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা হতে পারে না ওটা? এমন ভাবলে কি দোষ আছে-বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবার ভয়ে…।

    হা যিশু! চমকে ওঠার ভান করল লায়োনেল। আপনি বলতে চাইছেন, ও পালিয়ে গেছে?

    কাঁধ ঝাঁকালেন সার জন। আর কী-ই বা ভাবা যেতে পারে?

    পরাজিতের মত মাথা নামিয়ে ফেলল লায়োনেল। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। উঠে দাঁড়াল ও। অস্ফুট কণ্ঠে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল আরওয়েনাক থেকে। ভিতরে ভিতরে খুশিতে ডগমগ করছে। যা চেয়েছিল, তা-ই ঘটেছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?

    পেনারো হাউসে ফিরে নিকোলাসকে সব বলল লায়োনেল। সার জনের সন্দেহের কথাও জানাল। তবে ওদের পুরনো ভৃত্য এত সহজে মেনে নিল না ব্যাখ্যাটা।

    আপনার কি মাথা খারাপ হলো, মাস্টার লায়োলে? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে। অমন আজগুবি একটা কথা বিশ্বাস করলেন?

    আর কী বিশ্বাস করব, বলো? তেতে উঠল লায়োনেল। গ্রেফতার হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে… এমন সময় ও উধাও হয়ে গেল! পালানো ছাড়া আর কী হতে পারে?

    অসম্ভব! জোর গলায় বলল নিকোলাস। আমার মনিব আর যা-ই হোন, পালাবার মত ভীরু কাপুরুষ নন। যদি সত্যি সত্যি মাস্টার গডলফিনকে খুন করেও থাকেন, বীরের মত মুখোমুখি হবেন বিচারের। কাউকে ভয় পান না সার অলিভার। খোদ শয়তানকেও না।

    তা হলে কোথায় গেছে ও?

    আমি জানি না, মাস্টার লায়োনেল। হয়তো খারাপ কিছু ঘটেছে তার ভাগ্যে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, বেঁচে থাকলে ঠিকই ফিরে আসবেন তিনি।

    কচু ফিরবে! বিড়বিড় করে ভৃত্যকে গাল দিল লায়োনেল। হাসল মনে মনে।

    বলে রাখা ভাল, নিকোলাসের মত মনোভাব এলাকার অন্যান্য লোকজন পোষণ করে না। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গুজব-পালিয়ে গেছে অলিভার। ফলে লায়োনেলের মনের ইচ্ছে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করল।

    সেদিনই বিকেলে ক্যাপ্টেন লেই হাজির হলো পেনারো হাউসে, সার অলিভারের ব্যাপারে নাকি খোঁজ নিতে এসেছে। লায়োনেল তাকে ডেকে পাঠাল হলঘরে। ভৃত্য চলে গেলে বেঁকিয়ে উঠল, আপনি এখনও এখানে কেন? জাহাজ নিয়ে না চলে যাবার কথা?

    কুৎসিত হাসি দেখা দিল লেইয়ের ঠোঁটে। আপনাকে খবর দিতে এলাম, সব ঠিকঠাকমত ঘটেছে। রাস্তায় ওঁত পেতে ছিলাম আমরা, সার অলিভারকে থামাতে একটুও অসুবিধে হয়নি। হাত-পা বেঁধে নিয়ে গেছি জাহাজে। এখন উনি ওখানেই আছেন।

    অলিভার ফেরেনি দেখেই ওটা আন্দাজ করে নিয়েছি আমি। আপনার এখানে না আসলেও চলত।

    না… মানে… আরেকটা কাজ আছে। হিসেবের চেয়ে খরচাপাতি একটু বেশি পড়ে গেছে। বজ্জাত ক্রু-দের কথা আর বলবেন না… সুযোগ পেয়ে বাড়তি টাকা দাবি করে বসেছে। ওদেরকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সব ফাঁস হয়ে যেতে পারে।

    লায়োনেলকে দেখে মনে হলো, এক চামচ তেতো ওষুধ তাকে খাইয়ে দিয়েছে কেউ। কোমরের থলে থেকে কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে ছুঁড়ে দিল ধুরন্ধর ক্যাপ্টেনের দিকে। বলল, আপাতত এর বেশি নেই আমার কাছে।

    না, না! এতেই চলবে। মুদ্রাগুলো পোশাকের ভিতরে চালান করে দিল লেই।

    এখন যান এখান থেকে। আর আপনার ছায়াও দেখতে চাই না পেনারো হাউসের মাশপাশে। কখন রওনা হচেইন?

    পরের জোয়ারেই নোঙর তুলবে সোয়ালো।

    খুব ভাল। একটুও যেন দেরি না হয়।

    মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল ক্যাপ্টেন লেই। সে-রাতেই কর্নওয়াল ত্যাগ করল তার জাহাজ। অলিভারের ভাগ্যে কী ঘটল, তা জানতে পারল না কেউই।

    *

    যত দিন গেল, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এল লায়োনেলের। কেটে গেল মনের অস্থিরতা। যা হবার তা হয়ে গেছে, ও-নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছে সে-মন্দ মানুষেরা কেন যেন সেটা সবসময়েই পায়। দুর্ভাগ্যের শিকার হয় শুধু ভাল মানুষেরা। লায়োনেলের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক।

    অলিভার উধাও হবার ছদিন পর রাজকীয় দূত হাজির হলো ওদের এলাকায়। মাস্টার বেইনের কাছে হস্তান্তর করল স্বয়ং রানির সিলমোহর করা সমন। ফলে লণ্ডনে ছুটে যেতে হলো তাকে। জবাবদিহি করতে হলো নিজের কর্মকাণ্ডের–কেন তিনি একজন খুনিকে সময় থাকতেই গ্রেফতার করলেন না। কেন তাকে পালাবার সুযোগ দিলেন। বলা বাহুল্য, অলিভারের হয়ে সাফাই। গাইলেন তিনি। জানালেন, কীভাবে তরুণ নাইট তার সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছে। কিন্তু কপাল খারাপ তার, কয়েকদিন আগেই অসুখে পড়ে মারা গেছেন সার অ্যাণ্ডু ফ্ল্যাক; কাজেই তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করবার মত কেউ রইল না। এর ফলে পক্ষপাতিত্ব এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত হলেন মাস্টার বেইন। পদচ্যুত করা হলো তাকে, দিতে হলো মোটা অঙ্কের জরিমানা। সবার চোখে অলিভার রয়ে গেল নিষ্ঠুর এক খুনি হিসেবে। কপাল বটে লায়োনেলের!

    যা হোক, সেদিন থেকে জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করল তরুণ ট্রেসিলিয়ান। এলাকাবাসী সহানুভূতি দেখাল ওকে, ভাইয়ের কারণে বেচারা-র দুর্দশায় ব্যথিত হলো তারা, বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। সার ব্যালফ ট্রেসিলিয়ানের দ্বিতীয় ঘরের পুত্রের মত নয়, বরং তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হলো ওকে। মাথা গরম স্বভাবের অলিভার অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সার জনের বিরূপ মনোভাবও অদৃশ্য হলো। লায়োনেল তথা ট্রেসিলিয়ান পরিবারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলবার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখলেন তিনি।

    যা পাবার নয়, তা-ই পেল লায়োনেল। সম্মান, ধনসম্পদ আর প্রভাব-প্রতিপত্তি। দিনে দিনে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ এক মানুষে পরিণত হলো ও। আর অলিভার? সে আর এক কাহিনি।

    .

    ০৮.

    স্প্যানিয়ার্ডের কবলে

    বিস্কে উপসাগর পেরুনোর সময় ঝড়ের কবলে পড়ল সোয়ালো। তবে পুরনো জাহাজটা যথেষ্ট মজবুত, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সাগরকে পরাস্ত করে নিরাপদে ফিনিস্টার অন্তরীপ পেরুল, বেরিয়ে এল শান্ত পানিতে। আকাশে হেসে উঠল সূর্য, দূর হয়ে গেল বাতাসের উপদ্রব। নীল পানি চিরে পুবের বাতাসের ধাক্কায় এগিয়ে চলল তরতর করে।

    আরও আগেই বন্দির সঙ্গে কথা বলবার ইচ্ছে ছিল জ্যাসপার লেইয়ের, কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় জাহাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, সময় করে উঠতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত অলিভারকে যখন সে ডেকে পাঠাল, তখন সোয়ালো পর্তুগাল উপকূলের কাছে পৌঁছে গেছে।

    পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ক্যাপ্টেনের খুপরির মত কেবিনে নিয়ে আসা হলো তরুণ নাইটকে। তেল চিটচিটে একটা টেবিলে বসে লেই তখন সবে দুপুরের খাওয়া শেষ করেছে, আয়েশ করে টানতে শুরু করেছে পাইপ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে কেবিনের অভ্যন্তর। কামরাটায় সূর্যের আলো পৌঁছে না বললেই চলে, মাথার উপর তাই একটা লণ্ঠন ঝুলছে, জাহাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদিক-ওদিক দুলছে ওটা।

    কাঁপা কাঁপা আলোয় বন্দিকে পর্যবেক্ষণ করল ক্যাপ্টেন। গর্তে বসে গেছে অলিভারের চোখ, মুখভর্তি এক সপ্তাহ না কামানো দাড়ি। সারা গায়ে ময়লার আস্তর, পোশাক ছিঁড়ে গেছে এখানে-সেখানে… বন্দি হবার সময় লড়াইয়ের কারণে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত চেহারা। তবে আশ্চর্যরকম শান্ত দেখাচ্ছে ওকে, আচরণে আক্রোশের চিহ্নমাত্র নেই। ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে লেইয়ের মুখোমুখি বসানো হলো, তারপরেও টু শব্দ করল না। শুধু শীতল চোখে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে, তাতেই ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেল লেই।

    ইশারা পেয়ে চলে গেল অলিভারের সঙ্গে আসা দুই নাবিক। দরজা টেনে দিল। কেবিনে এখন শুধু ওরা দুজন। দাড়িতে হাত বুলিয়ে লেই বলল, দুঃখিত, সার অলিভার। মনে হচ্ছে আমার লোকজন ঠিকমত আপনার যত্ন নেয়নি।

    চোয়াল একটু যেন শক্ত হয়ে উঠল অলিভারের। বলল, মায়াকান্না না কাঁদলেও চলবে। অন্য কিছু বলার থাকলে বলো।

    বলব তো বটেই, মাথা ঝাঁকাল মাস্টার লেই। বলার জন্যই ডেকেছি। শুনুন, সার অলিভার, হয়তো ভাবছেন বিরাট অন্যায় করেছি আমি আপনার সঙ্গে; কিন্তু সে-ধারণা ভুল। আসলে আমি আপনার উপকারই করেছি। আমার কাজের ফলে আপনি শত্রুকে চিনতে শিখবেন, বুঝবেন বন্ধুবেশে কে আপনার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। ভবিষ্যতে কাকে বিশ্বাস করবেন না করবেন, সে-সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে আপনার জন্য।

    বাহ্! তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে। তারমানে তুমি বলতে চাইছ, তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত আমার?

    আমি না, ওটা আপনিই বলবেন… সব কথা শোনার পর। আন্দাজ করতে পারেন, আপনাকে অপহরণ করবার নির্দেশ এবং টাকা কে দিয়েছে? কী করতে বলা হয়েছে আপনাকে নিয়ে?

    যদি আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে আমার মন ভোলাবার ফন্দি এঁটে থাকে, তা হলে এখুনি তাতে ক্ষান্ত দিতে পারো, বিরক্ত গলায় বলল অলিভার। তোমার মত লোকের কথা শুনবারই ইচ্ছে নেই আমার, বিশ্বাস করা তো অনেক দূরের ব্যাপার।

    তবু আপনাকে শুনতে হবে, সার অলিভার! জোর দিয়ে বলল লেই। বারবারি উপকূলে নিয়ে গিয়ে মূর-দের কাছে আপনাকে বিক্রি করে দিতে বলা হয়েছে আমাকে। আপনাকে সাহায্য করবার জন্যেই তাতে রাজি হয়েছি আমি।

    তা-ই? সত্যি সত্যি দেখছি আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছ?

    বিশ্বাস করুন! আপনাকে নিয়ে এতদূর দক্ষিণে আসবার ইচ্ছে ছিল না আমার। ঝড়ের কবলে পড়ায় এদিকে আসতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সাগর এখন আবার শান্ত হয়েছে। আপনি চাইলেই উল্টো ঘুরে এক সপ্তাহের মধ্যে আবার আপনাকে কর্নওয়ালে পৌঁছে দেব।

    বিনে-পয়সায় সমুদ্র-ভ্রমণ করাচ্ছ আমাকে? এত উদার হয়েছ কবে?

    অস্বস্তিতে মাথা চুলকাল লেই। ইয়ে… খরচাপাতি কিছুটা তো হয়েছেই। আশা করছি সেগুলো মিটিয়ে দেবেন আপনি। উপকারের বিনিময়ে পুরস্কার-টুরস্কারও দেবেন…

    হেসে উঠল অলিভার। হ্যাঁ, এবার নিজের আসল চেহারা দেখিয়েছ তুমি, দুমুখো সাপ! আমাকে অপহরণ করবার জন্য টাকা নিয়েছ, আবার আমার কাছেও টাকা চাইছ ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। বেঈমানীর একটা সীমা থাকা উচিত!

    একটু যেন আহত হলো লেই। বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন, সার। সৎ লোকের সঙ্গে সৎ থাকা যায়, কিন্তু মন্দ লোকের উপর বিশ্বাস রাখাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তা ছাড়া… এ কাজ আমি করেছি আপনার শত্রুর পরিচয় ফাঁস করবার জন্য। সঙ্গে যদি একটু টাকাপয়সা আসে, মন্দ কী? খুব বেশি দাবি করছি না, আপনার ভাই দুইশ পাউণ্ড দিয়েছে, আপনিও নাহয় তা-ই দিন…।

    কথাটা শোনামাত্র চমকে উঠল অলিভার। নির্বিকার মুখোশটা খসে পড়ল, চেহারা থেকে, পিঠ খাড়া হয়ে গেল ওর, সামনের দিকে একটু ঝুঁকল, দুচোখ জ্বলে উঠল রাগে।

    কী বললে? তীক্ষ্ণস্বরে, প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ও।

    পাইপে টান দিয়ে ভক ভক করে ধোয়া ছাড়ল লেই। বলছিলাম যে, আপনার ভাই আমাকে যে-টাকা দিয়েছে, ওই একই পরিমাণ টাকা যদি…।

    আমার ভাই? তাকে বাধা দিয়ে গর্জে উঠল তরুণ নাইট। আমার ভাইয়ের কথা বলছ তুমি?

    ঠিক তাই।

    মাস্টার লায়োনেল? যেন নিশ্চিত হতে পারছে না অলিভার।

    আর কটা ভাই আছে আপনার? হাসল লেই।

    কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল ক্যাপ্টেনের কেবিনে। থম মেরে বসে রইল অলিভার, যেন হজম করবার চেষ্টা করল লেইয়ের কথা। শেষে বলল, তুমি বলতে চাইছ, আমাকে অপহরণ করবার জন্য লায়োনেল তোমাকে টাকা দিয়েছে? মানে, আমার এই দুর্দশার জন্য ও-ই দায়ী?

    আর কাউকে সন্দেহ করেছিলেন নাকি? বিরস গলায় বলল লেই। নাকি ভেবেছেন, শখের বশে আপনাকে তুলে এনেছি আমি?

    কথা ঘুরিয়ো না! হিসিয়ে উঠল অলিভার। সরাসরি জবাব দাও আমার প্রশ্নের।

    জবাব তো প্রশ্ন করবার আগেই দিয়েছি। তারপরেও যদি আবার শুনতে চান, তা হলে বলি–দুইশ পাউণ্ডের বিনিময়ে মাস্টার লায়োনেল আপনাকে অপহরণ করিয়েছে আমার মাধ্যমে, নির্দেশ দিয়েছে আপনাকে বারবারি উপকূলে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে। জবাবটা যথেষ্ট সরাসরি হয়েছে তো?

    মিথ্যে বলছ তুমি, কুকুর! চেঁচাল অলিভার।

    শান্ত হোন, সার।

    কীসের শান্ত! আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছ তুমি!

    দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল লেই। ভাবল, কিছু। তারপর বলল, বেশ, তা হলে দেখছি সত্য-মিথ্যে প্রমাণ করে দিতে হয়।

    উঠে দাঁড়াল সে। চলে গেল কেবিনের একপাশে, মেঝেতে রাখা কাঠের সিন্দুক খুলে একটা কাপড়ের থলে হাতে নিল, ওটা-সহ ফিরে এল টেবিলে। থলের ভিতর থেকে কয়েকটা অলঙ্কার বের করল লেই, সেগুলো বিছিয়ে দিল অলিভারের সামনে।

    দুইশ পাউণ্ডের পুরোটা নগদ দিতে পারেনি মাস্টার লায়োনেল, বলল ক্যাপ্টেন। ঘাটতি পুরণ করেছে এসব অলঙ্কার দিয়ে। ভাল করে দেখুন, সার অলিভার, চিনতে পারছেন কোনোটা?

    হেলাফেলার দৃষ্টিতে টেবিলের উপর দৃষ্টি ফেলল অলিভার, কিন্তু পরমুহূর্তেই হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে গেল। প্রথমেই চিনতে পারল একটা আংটি, তারপর একজোড়া পুরুষালি কানের দুল-দুটোই লায়োনেলের। এরপর চিনল একটা চেইন-সহ লকেটও নিজের হাতে উপহার দিয়েছিল ভাইকে। শুধু তাই নয়, সামনে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি অলঙ্কার ওর পরিচিত… কোনও ভুল নেই।

    বুকের কাছে মাথা ঝুঁকে গেল অলিভারের। বাজ পড়া মানুষের মত স্থবির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত হাহাকার করে উঠল, হা ঈশ্বর! লায়োনেলও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল? তা হলে কে রইল আমার এ দুনিয়ায়? চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এল ওর, বুক ভরে গেল চরম বিষাদে। বিড়বিড় করল, অভিশপ্ত আমি… অভিশপ্ত!

    চোখের সামনে এসব প্রমাণ না দেখলে ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করত না অলিভার। বরং এতদিন রোজামুগুকেই দায়ী বলে ভেবেছে ও! মনে করেছে, আইনের স্বাভাবিক পন্থায় ভাইয়ের মৃত্যুর বিচার না পেনো প্রতিশোধ নিয়েছে মেয়েটা। ওকে গডলফিন কোর্টে ডেকে পাঠানোর নাম করে ফাঁদে ফেলেছে, অপহরণ করিয়েছে দুই ক্যাপ্টেনের মাধ্যমে। খারাপ লেগেছে রোজামুণ্ডকে দোষী ভাবতে, কিন্তু কিছুটা হলেও সান্ত্বনা ছিল তাতে… মেয়েটাকে আবেগের কাছে পরাজিত বলে ভাবতে পারছিল। অথচ এখন? লায়োনেলের ব্যাপারে কীভাবে প্রবোধ দেবে নিজেকে?

    অকল্পনীয় একটা ব্যাপার… এতদিনের স্নেহ, ভালবাসা আর মায়ার প্রতিদান ছেলেটা এভাবে দিতে পারে! কী না করেছে অলিভার ভাইটির জন্য। ওকে আগলে রেখেছে বিপদে-আপদে, ওর অপরাধের দায় টেনে নিয়েছে নিজের কাঁধে… অথচ তার বিনিময়ে নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে লায়োনেল। কেন? নিজের জীবন বাঁচাবার জন্য? নাকি ওর ধন-সম্পদের জন্য? কারণ যা-ই হোক, একটা বিষয় পরিষ্কার-অপাত্রে ভালবাসা দান করেছে। অলিভার। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছে নিজের ঘরে। সেই সাপ দংশন করেছে ওকে সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্তে। কিন্তু না, মুখ বুজে সেই দংশন সহ্য করবে না অলিভার। যোদ্ধা ও, সত্যিকার বীর… জবাব দেবে এই বিশ্বাসঘাতকতার।

    যেমন হঠাৎ করে দুঃখে ভরে গিয়েছিল অন্তর, ঠিক সেভাবেই আবার চলেও গেল তা। সে-জায়গা দখল করল ক্রোধ আর প্রতিহিংসা। ঝট করে মাথা তুলল অলিভার-বদলে গেছে মুখের ভাব, দুচোখে রুদ্র আগুন। তাকাল ক্যাপ্টেন লেইয়ের দিকে, লোকটা চুপ করে ওর প্রতিক্রিয়া দেখছে।

    মাস্টার লেই, বলল অলিভার, আমাকে ইংল্যাণ্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কত টাকা চাও তুমি?

    ওটা তো বলেই দিয়েছি–দুইশ পাউণ্ড, জবাব দিল লেই। উঠিয়ে আনার জন্যও তা-ই পেয়েছিলাম। দুটোয় কাটাকাটি হয়ে যাবে।

    দুইশ না, আমাকে ট্রেফুসিস পয়েন্টে নামিয়ে দিতে পারলে তার দ্বিগুণ দেব আমি তোমাকে।

    চোখ পিটপিট করল লেই, সরু হয়ে এল দৃষ্টি। সন্দিহান হয়ে উঠেছে। নিজ থেকে এত টাকা দিতে চায় না কেউ। নিশ্চয়ই এর পিছনে অন্য কিছু আছে।

    কী মতলব ভাঁজছেন, সত্যি করে বলুন তো?

    মতলব? কিছুই না? বলল অলিভার। অন্তত তোমার কোনও ভয় নেই। ঈশ্বরের দিব্যি, যা কিছু ঘটে গেছে, তাতে তোমার ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। তা ছাড়া তোমাকে এ-মুহূর্তে আমার প্রয়োজনও বটে। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই।

    একটু ভাবল লেই। যুক্তি দেখতে পেল ওর কথায়। ঠিকই বলেছে তরুণ নাইট-মাস্টার লায়োনেলের তুলনায় সে একটা দুগ্ধপোষ্য শিশু বৈ আর কিছু নয়। মশা মেরে হাত গন্ধ করবার মানুষও নয় সার অলিভার। বরং উপকার করতে চলেছে লেই, সেজন্যে কৃতজ্ঞ হবার কথা।

    কথা দিন, আমার কোনও ক্ষতি করবেন না, তবু নিশ্চিত হবার জন্য বলল ক্যাপ্টেন।

    ধরে নাও পেয়ে গেছ, অলিভার বলল। আমাকে ট্রেফুসিস পয়েন্টে পৌঁছে দেয়ামাত্র প্রতিশ্রুত টাকা পেয়ে যাবে তুমি। ওতে কোনও চালাকি থাকবে না। সন্তুষ্ট? তা হলে এবার আমার হাতদুটো খুলে দাও। এভাবে থাকতে আর ভাল লাগছে না।

    মাথা ঝাঁকাল লেই। আপনার সুবিবেচনার প্রশংসা করছি, ব্যাপারটা এত সহজভাবে নিয়েছেন বলে। আমার আসলে কোনও দোষ নেই, স্রেফ হাতিয়ার হিসেবে আমাকে ব্যবহার করেছে মাস্টার লায়োনেল…।

    হাতিয়ারই বটে তুমি, নোংরা হাতিয়ার, বলল অলিভার। সে যা-ই হোক, হাতদুটো খুলে দাও তো। বোঝাপড়া হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে, এখন আর কয়েদির মত থাকতে চাই না।

    নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল ক্যাপ্টেন লেই। কোমর থেকে ছোরা বের করে কেটে দিল অলিভারের হাতের বাঁধন।

    মুক্তি পেয়েই ঝট করে উঠে দাঁড়াল তরুণ নাইট। কেবিনের নিচু ছাতে ঠুকে গেল মাথা, ব্যথা পেয়ে আবার বসে পড়ল ও। আর তখুনি বাইরে থেকে ভেসে এল উত্তেজিত চিৎকার। দ্রুত দরজার কাছে ছুটে গেল লেই, পাল্লা খুলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। তার পিছু নিল অলিভার। দুজনে পা রাখল পুপ-ডেকে।

    পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘামাল না তরুণ নাইট। আগে বুক ভরে টেনে নিল সমুদ্রের তাজা বাতাস। তারপর দৃষ্টি ফেরাল চেঁচামেচির কারণ জানবার জন্য। নীচে, জাহাজের পাটাতনে ভিড় জমিয়েছে কালিঝুলি মাখা একদল নাবিক। বুলওঅর্কের পাশে দাঁড়িয়ে খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে তারা। একই রকম জটলা রয়েছে ফোক্যাসলে-ও। সবার দৃষ্টি একই দিকে। রোকা অন্তরীপের কাছাকাছি তখন চলছে জাহাজ, তীরের অনেকটাই কাছ ঘেঁষে। এত কাছ দিয়ে যাবার কথা ছিল না। ঝট করে হুইল ধরে থাকা সারেং-এর দিকে ফিরল ক্যাপ্টেন, শাপশাপান্ত করতে শুরু করল তাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার কারণ দেখতে পেল অলিভার। উপকূলের কিনারায় উঁকি দিতে থাকা একটা নদীমুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে এল ভীমদর্শন এক স্প্যানিশ রণতরী, তীরের কাছে এসে পড়া নিঃসঙ্গ জাহাজের অপেক্ষায় ওখানেই ঘাপটি মেরে পড়ে রয়েছিল ওটা। বড় বড় পালে হাওয়ার ধাক্কায় দ্রুত এগিয়ে আসছে জাহাজটা সোয়ালোর দিকে।

    চকিতে হিসেব সেরে নিল লেই। অন্তত পাঁচ নট গতিতে এগোচ্ছে অচেনা শত্রু, অথচ ওদের গতি এক নটের বেশি নয়। শীঘ্রি ধরা পড়ে যাবে। রাগে মুখ বিকৃত হয়ে উঠল তার। কনুইয়ের ধাক্কায় হুইল থেকে সরিয়ে দিল সারেং-কে, নিজেই ধরল ওটা।

    স ব্যাটা, অকর্মার ধাড়ি কোথাকার! খেঁকিয়ে উঠল সে।

    এই কোর্স আপনিই ঠিক করে দিয়েছেন! প্রতিবাদ জানাল সারেং।

    তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু! তীর থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম, নাক বরাবর গিয়ে ওটাকে চুমু খেতে বলিনি! বন বন করে হুইল ঘোরাল লেই।

    মুখ ঘুরিয়ে বাতাসের ভাটির দিকে চলল সোয়ালো। ফুলে উঠল পাল। গতি বাড়ল একটু। সারেং-এর হাতে হুইল আবার তুলে দিল ক্যাপ্টেন। নির্দেশ দিল, এইভাবেই ধরে রাখ। খবরদার, নাক যেন না ঘোরে। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাকি নাবিকদেরকে আদেশ-নির্দেশ দেয়ায়।

    দড়িদড়া নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করল সোয়ালোর কু-রা। মাস্তুল বেয়ে উঠে গেল বেশ কজন। দ্রুত খুলে দিল সবকটা পাল, বাড়তি কয়েকটাও খাটানো হলো। জাহাজ এখন সামর্থ্যের সর্বোচ্চ গতিতে ছুটছে উপকূলের সবুজ পানি চিরে।

    পুপ ডেক থেকে স্প্যানিয়ার্ড জাহাজের দিকে তাকাল অলিভার। স্টারবোর্ডের দিকে একটু সরে গেছে ওটা–সামনে এসে ওদের পথ আটকে দেবার পাঁয়তারা। সোয়ালোর গতি একটু বাড়লেও ওটার তুলনায় এখনও কিছুই নয়। খুব দ্রুত কমে আসছে দুই জাহাজের মধ্যকার দূরত্ব।

    নীচে চলে গিয়েছিল লেই, ফিরে এল একটু পর। চঞ্চল চোখে যাচাই করে নিল অবস্থা। মুখ দিয়ে অবিরাম বেরুচ্ছে অভিশাপ-এমন একটা ফাঁদের ভিতর পা দিয়ে বসায়। বলা বাহুল্য, অভিশাপের বেশিরভাগটাই তার সারেং-কে উদ্দেশ করে।

    এই ফাঁকে সোয়ালোর দৃশ্যমান অস্ত্রশস্ত্রগুলোর ব্যাপারে একটা ধারণা নেবার চেষ্টা করল অলিভার। খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজ করল, মেইন-ডেকের নীচে হয়তো আরও কিছু থাকতে পারে। এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিক্ত চেহারা বানাল ক্যাপ্টেন লেই।

    অস্ত্র থাকলে এভাবে লেজ তুলে পালাই? বলল সে। নচ্ছাড় স্প্যানিয়ার্ডের ভয়ে আমাকে পিঠটান দেবার বান্দা ভেবেছেন? বরং ব্যাটাদের লড়াইয়ের সাধ জন্মের মত মিটিয়ে দিতাম না?

    বুঝে গেল অলিভার, যুদ্ধ করে জয়ের আশা বৃথা। কতক্ষণ ওদের প্রতিরোধ টিকবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ডেকের দিকে নজর ফেরাল ও। মাস্তুলের তলায় জড়ো করে রাখা কাটলাস আর ক্ষুদ্রাস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে নাবিকদের মধ্যে। হাতাহাতি লড়াইয়ে ওগুলোই ওদের ভরসা। দূর থেকে যুদ্ধ করবার জন্য কামান আছে মাত্র দুটো–প্রথমটার গোলন্দাজ কাফ্রি এক পালোয়ান, মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় পাগড়ি পরে। কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে দুজন সহকারী নিয়ে তাকে ছুটে যেতে দেখল জাহাজের বামদিকে।

    নীচ থেকে একজন নাবিককে ডেকে হুইলে দাঁড় করাল লেই, সারেং-কে পাঠিয়ে দিল ফোক্যাসলে, ওখানে বসানো দ্বিতীয় কামানটা চালাবার জন্য।

    পরের কিছুটা সময় ধরে চলল দৌড় প্রতিযোগিতা। ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল সোয়ালো প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেবার, কিন্তু ধীরে ধীরে কাছে চলে এল স্প্যানিশ জাহাজটা। পিছনে হারিয়ে যেতে শুরু করল সমুদ্রতট, ধূসর একটা রেখায় পরিণত হলো খুব শীঘ্রি। হঠাৎ স্প্যানিশ জাহাজের সামনে ধোঁয়ার একটা সাদা মেঘ উদয় হলো, তার পিছু পিছু শোনা গেল কামান দাগার আওয়াজ। সোয়ালোর বো-র এক কেইবল সামনে ছিটকে উঠল সাগরের পানি, ওখানে আছড়ে পড়েছে ওদের ছোঁড়া গোলা।

    হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে কাফ্রি গোলন্দাজকে স্থির থাকতে দেখল অলিভার, ক্যাপ্টেনের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। বো-র দলটাও একই ভঙ্গিতে রয়েছে। হুকুম না পেলে সলতেয় আগুন ধরাবে না।

    আরেকবার গর্জে উঠল স্প্যানিশ জাহাজের কামান, আবারও পানি ছিটকাল সোয়ালোর বো-র সামনে।

    পাল্টা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ওরা, বলল অলিভার।

    দাড়িতে হাত বোলাল লেই। জানাক। ব্যাটাদের রেঞ্জ অনেক বেশি। খামোকা বারুদ খরচ করবার কোনও মানে হয় না। আমাদের স্টক খুব সামান্য।

    তার কথা শেষ হতেই তৃতীয়বারের মত গোলা ছুঁড়ল স্প্যানিশ জাহাজ। এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না ওটা। সোজা এসে পড়ল সোয়ালোর গায়ে। কাঠভাঙার বিচ্ছিরি মড়মড় আওয়াজ উঠল, হুড়মুড় করে জাহাজের মূল মাস্তুল আছড়ে পড়ল পাটাতনের উপরে। ভারী জিনিসটার তলায় চাপা পড়ল দুজন নাবিক… ভর্তা হয়ে গেল। হায় হায় করে উঠল তাদের সঙ্গীরা। কিন্তু আশ্চর্যরকম শান্ত রইল লেই।

    থামো! চেঁচিয়ে উঠল সে। উত্তেজনার বশে সলতের দিকে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে গিয়েছিল কাফ্রি গোলন্দাজ–তার উদ্দেশেই এই চিৎকার। থমকে গেল লোকটা।

    মাস্তুল ভেঙে পড়ায় থেমে যাবার দশা হলো সোয়ালোর, এই সুযোগে শিকারী বাজের মত ধেয়ে এল স্প্যানিশ জাহাজ। ওটাকে রেঞ্জের মধ্যে আসতে দিল লেই, তারপরেই গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, ফায়ার!

    গর্জে উঠল সোয়ালোর প্রথম কামান। পুরো লড়াইয়ে ওই দাগা গেল ওটা। বিস্ফারিত চোখে গোলাটাকে স্প্যানিশ জাহাজের বো-র উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখল লেই। পরমুহূর্তে শুরু করল গালাগাল, গোলন্দাজ কামানকে বড় উঁচুতে তাক করেছে। তাড়াতাড়ি অস্ত্রের মুখ নামাতে শুরু করল কাফ্রি লোকটা।

    সারেং-কে উদ্দেশ করে চেঁচাল এবার লেই, স্প্যানিশ জাহাজের পাশ লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়তে বলল। কিন্তু তার এই ইচ্ছের কথা আঁচ করতে পেরেছে শক্ররা। লক্ষ্যস্থির করবার আগেই ঘুরে গেল জাহাজের মুখ। চতুর্থবারের মত গর্জে উঠল তাদের কামান। সোয়ালোর বামদিকের খোলে আঘাত করল সেই গোলা।

    প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেলো জাহাজ। কাঠ ভাঙল, লাফ দিয়ে মাথা তুলল আগুনের শিখা, সেইসঙ্গে পাক খেয়ে উঠে এল কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ভাঙা খোলের ফোকর দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকতে শুরু করল পানি। চোখের পলকে বামদিকে কাত হয়ে গেল আহত সোয়ালো।

    হায় যিশু! হাহাকার করে উঠল ক্যাপ্টেন লেই। আমরা ডুবছি!

    আসলেই তা-ই। মরণ-আঘাত হেনেছে স্প্যানিশ জাহাজ। কায়দামত এক গোলা ছুঁড়েই ইতি ঘটিয়েছে যুদ্ধের। দ্বিতীয়বার কামান দাগতে পারেনি সোয়ালো। পানির ভারে কাত হয়ে গেছে জাহাজ, দুটো কামানের নলই এখন সমুদ্রের দিকে। প্রতিপক্ষের কোনও ক্ষতি করা আর সম্ভব নয়।

    গানেল আঁকড়ে ধরে স্প্যানিশ জাহাজের দিকে তাকাল অলিভার। আর এগোচ্ছে না ওটা। এগোবার দরকারও নেই। দাঁড়িয়ে পড়েছে সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে। অপেক্ষা করছে সোয়ালোর ডুবে যাবার। তারপর কাছে এসে তুলে নেবে হাবুডুবু খেতে থাকা অসহায় নাবিকদেরকে তাদেরকে নিয়ে যাবে দাস হিসেবে বিক্রি করবার জন্য। অই যন্ত্রণা অনুভব করল ও বুকে-শারীরিক নয়, মানসিক যন্ত্রণা। ফেরা হলো না দেশে। নেয়া হলো না প্রতিশোধ

    ওর বিশ্বাসঘাতক ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এ-জ্বালা সইবে কী করে?

    কিন্তু অলিভারের জানা নেই, নিয়তি ওকে নিয়ে অন্য এক নাটক সাজিয়েছে। মনোবাসনা ঠিকই পূর্ণ হবে ওর, তবে বহু জল গড়াবার পুরে… বেশ কিছুদিন কেটে গেলে। আর তাতে ভূমিকা থাকবে ক্যাপ্টেন লেইয়েরও।

    সে-কাহিনি যথাসময়ে জানবেন পাঠক।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসাবাস অয়ন! সাবাস জিমি!! – ইসমাইল আরমান
    Next Article দ্য পিরামিড – ইসমাঈল কাদরী

    Related Articles

    ইসমাইল আরমান

    সাবাস অয়ন! সাবাস জিমি!! – ইসমাইল আরমান

    July 11, 2025
    ইসমাইল আরমান

    মাসুদ রানা ৪৫৯ – অন্তর্যামী

    July 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.