Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ধুলোবালির জীবন – প্রচেত গুপ্ত

    প্রচেত গুপ্ত এক পাতা গল্প170 Mins Read0

    ধুলোবালির জীবন – ১২

    ১২

    বিধান খুব বিপদে পড়েছে।

    পড়াটাই স্বাভাবিক। একজন অচেনা তরুণী তার বাড়িতে এসেছে। চেনা মানুষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তার সেবা যত্ন শুরু করেছে। যতবার তাকে বারণ করতে গিয়েছে, ততবারই মেয়েটি কড়া গলায় বলেছে, “‌আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন তো।” সে নিজে দুর্বল বলে জোর দিয়ে খুব একটা কিছু বলতেও পারছে না।

    এটা বিপদ ছাড়া আর কী?‌

    ঝুমুর ট্যাক্সিতে জোর করে উঠে পড়ার পর বিধান খুবই অবাক হয়েছিল। কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল, “‌আপনি কোথায় নামবেন?‌”‌

    ঝুমুর উদাসীন ভঙ্গিতে বলেছিল,‌ “‌ভেবেছিলাম এক জায়গায় নামব। এখন ঠিক করেছি, নামব না। আপনাকে বাড়িতে নামাব।”‌

    বিধান চমকে উঠে বলেছিল, “‌সে কী,‌ আমার বাড়ি যাবেন কী!‌ আমার বাড়ি কতদূর।”‌

    ঝুমুর গুছিয়ে বসে বলল, “‌এক কাজ করুন। আপনি বাড়িটা কাছে নিয়ে আসুন। তা হলে আর আমাকে দূরে যেতে হবে না। পারবেন?‌”‌

    বিধান আমতা-আমতা করে বলল, “‌আমি তো এখন ঠিক হয়ে গিয়েছি। ঘুমিয়ে আরও ঝরঝরে লাগছে।”‌

    ঝুমুর বলেছিল, “‌সেই জন্যই তো আরও যাচ্ছি। পথে যদি আবার কোনও গাছ-টাছ দেখে নেমে, গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তখন কী হবে?‌ কে আপনাকে ডেকে তুলবে?‌ সেই জন্য যাচ্ছি।”‌

    বিধান অবাক হয়েছিল। বাহ্, মেয়েটা বেশ করে কথা বলতে পারে তো! বহুদিন পরে তার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলছে। তাকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছে।

    ঝুমুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, “আমি আপনার বাড়ি পর্যন্ত গেলে কোনও সমস্যা আছে?‌”‌

    “‌না-না, তা কেন?‌”‌

    “‌তা হলে ছটফট না করে চুপ করে রেস্ট নিন। ট্যাক্সির সিটকে গাছ ভেবে হেলান দিয়ে আবার একটু ঘুমিয়ে নিন বরং।”

    বিধান এবার না হেসে পারেনি। তার মনে হল, মেয়েটিকে তার ভাল লাগছে। এটা মনে হতেও তার অস্বস্তি হল। ‌‌এরপরেও সে ভেবেছিল, তাকে বাড়িতে নামিয়ে ঝুমুর ফিরে আসবে। ফিরল না। বাড়ির গলির মুখে ট্যাক্সি থামার পর বলল, “চলুন।”

    বিধান বলেছিল, “এবার ‌আমি পারব।”

    ঝুমুর সহজভাবে বলেছিল, “‌আমি‌ পারব না। তীরে এসে তরী ডুবে গেলে কী হবে?‌ আর এক কাপ চা খাওয়াবেন না?‌”‌

    এরপর আর কীভাবে বারণ করে ‌বিধান?‌ যতই হোক, এই মানুষটাই তো তাকে বাঁচিয়েছে। এক কাপ চা সে দাবি করতেই পারে। তারই বলা উচিত ছিল। বাড়িতে কি চা পাতা আছে? মানিব্যাগের কোণে সদর দরজার চাবি ছিল। দরজা খুলে ঢুকতেই, নাক সিঁটকোল ঝুমুর, “‌ইস, ঘরদোরের কী অবস্থা!‌ না, একটা কথা অন্তত সত্যি বলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, বাড়িতে আর কেউ নেই আপনার। নইলে এই অবস্থা হয় না। ‌যান, শোওয়ার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।”‌

    বিধান হেসে বলেছিল, “‌শোওয়ার ঘর বলে আলাদা কিছু নেই ম্যাডাম। একটাই ঘর। ওই পাশে একটা ছোট মতো ঘর আছে বটে, সেটা ব্যবহার করি না।”‌

    ঘরের একপাশে তক্তপোশ, এক কোণে সস্তার লোহার টেবিল। টেবিলে খাতা-বই ডাঁই করে রাখা। ঝুমুর কাঁধের ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে চোখ বড় করে বলেছিল, “বাপ রে,‌ এত বইখাতা‌!‌ মাস্টারি করেন নাকি?‌”

    “‌ওই আর কী। কোচিং-এ পড়াই। পেট চালাতে হবে তো।”‌

    “বই তো দেখছি সব অঙ্কের।”

    বিধান মিনমিন করে বলেছিল, “‌অঙ্ক করাই।”‌

    ঝুমুর আঁতকে ওঠার ভান করে বলেছিল, “‌ওরে বাবা রে, আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! অঙ্কের মাস্টাররা ভয়ংকর হয়। আমাদের স্কুলে অঙ্কের টিচার ছিলেন মায়াদি। অঙ্ক ভুল করলে এমন বকুনি দিত!’‌

    “‌আমি কাউকে বকি না ম্যাডাম।”

    “‌বকাবকির মুরোদ আপনার যে নেই, তা তো বুঝতেই পারছি। যদি থাকত, কখন আপনি আমাকে কড়া বকুনি দিয়ে তাড়িয়ে দিতেন! আপনি হলেন ভিতু মাস্টার। আর শুনুন, আমাকে ‘ম্যাডাম-ম্যাডাম’ করবেন না। হাসপাতালেও করছিলেন। তখনও বারণ করেছিলাম। আমার নাম আছে। তখন বলেছিলাম, একটা নাম আছে। এখন বলছি, একটা নয়, অনেকগুলো নাম আছে। ঝুমুর, শান্তা, নন্দা। যে নামটা আপনার পছন্দ, সেটা ধরে ডাকবেন। দাঁড়ান, আগে আপনার এই সুন্দর খাটটা একটু গুছিয়ে দিই। আপনি শুয়ে পড়বেন।”

    বিধান বুঝতে পেরেছিল, এই‌ মেয়েকে আর বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই। শান্ত, মায়া-মায়া দেখতে এই মেয়েটি ঝোড়ো বাতাসের চেহারা নিয়েছে। নিজের খুশিমতো চলবে। বিছানা রেডি করে ঝুমুর বলল, “‌যান হাত পা ধুয়ে এসে শুয়ে পড়ুন। রান্নাঘরটা কোথায়?‌ চা বানিয়ে খাব।”

    বিধান বলল, “‌রান্নাঘর তো নেই। বারান্দার একপাশটা একটু আলাদা করে.‌.‌.‌মনে হয় বাড়িতে চা-পাতাও নেই।”

    ঝুমুর হেসে বলল, “‌আপনার যে কিছুই নেই, ঘরের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে। চা-পাতা থাকলে আশ্চর্য হতাম। তাও একটা ট্রাই নিই।”‌

    তাক হাতড়ে একটা কৌটোতে অল্প চা পাতা পাওয়া গেল। তবে চিনি নেই। কাপও মোটে একটা। ঝুমুর হাসল। সে এদিক-ওদিকের শিশি, কৌটো নাড়াচাড়া করতে লাগল।

    সস্‌প্যান খুঁজে চায়ের জল বসিয়ে ঝুমুর নিজের উপরই অবাক হল। সে এই লোকের বাড়ি পর্যন্ত কেন চলে এল?‌ তা-ও আবার এতটা পথ পেরিয়ে!‌ শুধুই কি আবেগ? যদিও এটা ঠিক,‌ মানুষের ভিতর আবেগ কখন কতটা কাজ করবে, কেউ জানে না। একজন অতি বাস্তববাদীও আবেগতাড়িত হয়। বাস্তবে তার জন্য যা স্বাভাবিক নয়, সেই কাজ করে ফেলে। তবে রোজ যাকে পুরুষ বদলাতে হয় এবং ধূলিকণার মতো গা থেকে টোকা মেরে ফেলে দিতে হয় যাবতীয় পাপপুণ্যের হিসেব, তার চেয়ে বড় বাস্তববাদী ক’জন আছে?‌ কিন্তু বিধান নামের এই মানু্ষটার জন্য শুধুই কি তার ভিতর আবেগ কাজ করছে?‌ না, পুরোটা তা নয়। সঙ্গে খানিকটা দায়িত্ববোধও ছিল।‌ লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল রাস্তায়। উচিত ছিল এড়িয়ে নিজের কাজে চলে যাওয়া। কলকাতা শহরে এই ঘটনা অহরহ ঘটে। রোজই তো কতজন মুখ থুবড়ে পড়ে! তারপরেও এড়িয়ে যেতে পারেনি ঝুমুর। নানা কারণে পারেনি। তার মধ্যে একটা কারণ অবশ্যই ফুলগাছ। ভাঙা টব, দোমড়ানো ফুলগাছ নিয়ে কখনও কাউকে পথে পড়ে থাকতে দেখেনি ঝুমুর। এমনকী ধরে তোলার সময়ও লোকটা গাছের কথা বলেছিল। অতি সামান্য একটা বিষয়। পুরুষমানুষ তো কম দেখা হল না এইটুকু জীবনে। কখনও-কখনও ঘেন্নায় গা পাক দিয়ে ওঠে ঝুমুরের। আজ বিধানকে দেখে মনে হল, এই মানুষটাকে সুখ–‌দুঃখ, লোভ, যন্ত্রণা কিছু স্পর্শ করে না। এ থাকে নিজের মধ্যে।

    ছাঁকনি খুঁজে চা ছাঁকল ঝুমুর। কাপ আর গ্লাসে ঢালল। বেশি ভাবা হয়ে গিয়েছে। পরে কোনও সময় নিজের ছেলেমানুষিতে হাসি পাবে নিশ্চয়ই। তবে সেই মুহূর্তের জন্য ভাবনাটা সত্যি ছিল। এক মুখ না-কাটা দাড়ির বিষাদমাখা মুখ তাকে থমকে দিয়েছিল। নিজের কাছে বলতে লজ্জা কী?‌ বিধানকে একা ছেড়ে দিতে মন চায় না। আবার এমনও হতে পারে, এসব কিছুই নয়।

    ঝুমুর চা নিয়ে ঘরে এসে দেখল, বিধান আধশোওয়া হয়ে আছে। পায়ের আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে গেল।

    “‌উঠবেন না। এই নিন চা।”‌

    কাপ এগিয়ে নিজে গ্লাস নিয়ে চেয়ারে বসল ঝুমুর। বলল, “‌কেন এতদূর আপনার সঙ্গে ছুটে এসেছি জানেন বিধানবাবু?‌”‌

    “না, জানি না।”

    ঝুমুর গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, “‌আপনার গাছের গল্পটা শুনব বলে আপনাকে ধাওয়া করেছি। আমার মনে হয়েছে, এটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা। আজকাল ইন্টারেস্টিং ঘটনার খুব অভাব। সব থোড়-বড়ি-খাড়া। গাছের গল্প শুরু করুন।”‌

    বিধানের অদ্ভুত লাগছে। মেয়েটার‌ ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এবাড়িতে অনেকদিন আছে। ঝুমুর আজ একটা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। রং মিলিয়ে জামা। কপালে একটা ছোট্ট টিপও দিয়েছে। সবুজ রঙে কি মায়া বেশি হয়?‌ হয় বোধহয়। শ্রীজিতাও যখন সবুজ রঙের জামা পড়ত, তখনও তাকে নরম লাগত।

    “ও কিছু নয়।”‌

    ঝুমুর বলল, “‌বলতে না চাইলে বলবেন না। ‘ও কিছু নয়’ বলছেন কেন?‌”‌

    একটু চুপ করে থেকে বিধান বলল, “আমার মেয়ের জন্য গোলাপ গাছের চারা কিনেছিলাম। ওর জন্মদিন ছিল। জন্মদিনের গিফট।”‌

    ঝুমুর ভুরু কুঁচকে বলল, “‌আপনার মেয়ে!‌ এই যে বললেন, আপনার কেউ নেই!‌”‌

    বিধান চায়ের কাপটা হাত বাড়িয়ে অগোছালো টেবিলে রাখল। বলল, “তোয়ার ‌আট বছর বয়স। মায়ের সঙ্গে কলকাতায় থাকে।”

    ঝুমুর অস্ফুটে বলল, “ও।”‌

    বিধান ক্লান্ত হেসে বলল, “আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। আমার সঙ্গে কে থাকবে বলুন দেখি! তা-ও তো শ্রীজিতা অনেকদিন সহ্য করে ছিল। আমি মেয়েকে মাসে একদিন দেখতে যাই। জন্মদিনে শখ করে একটা লাল গোলাপফুলের গাছ চেয়েছিল। আমি নার্সারি থেকে টবে গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। দেওয়া হল না। যাক পরে.‌.‌.‌”

    একটু চুপ করে থেকে ঝুমুর বলল, “‌সরি, আমি বুঝতে পারিনি।”‌

    বিধান বলল, “‌না-না, আপনি কেন সরি হবেন?‌”‌

    ঝুমুর নরম গলায় বলল, “টব সুদ্ধু গাছ কেউ ভিড় বাসে অত দূর নিয়ে যায়?‌ আপনি তো আচ্ছা বোকা।”‌

    বিধান বলল, “গাড়ি করে যাওয়ার পয়সা কই?‌ ট্রেনে গেলেও তো এক কাণ্ড হত। আবার সেই বাসে.‌.‌.‌ যাক, যা হওয়ার হয়েছে। আপনি ছিলেন বলে বেঁচে ফিরেও এলাম।”‌

    ঝুমুর ‘‌বলা উচিত হবে না’‌ ভেবেও বলে ফেলল, “‌মেয়েকে জানিয়েছেন?‌”‌

    বিধান বলল, “‌জানাব কী করে?‌ ফোনটাই তো নেই! তা ছাড়া.‌.‌.‌তা ছাড়া ওর মা জানলে হয়তো চিন্তা করবে। তার চেয়ে থাক, পরে একসময় না হয় আবার গাছ নিয়ে যাব।”

    ঝুমু্র বলল, “‌আপনার মোবাইল ফোনের নম্বরটা, আমার ফোন থেকে সার্ভিস প্রোভাইডারকে বলে রাখি। পরে যখন নতুন ফোন নেবেন, নম্বরটা তো লাগবে।”‌

    বিধান হেসে বলল, “‌থাক, আমি আর ফোন-টোন নেব না। আমার আর কার সঙ্গে কথা আছে?‌”‌

    কথার মধ্যে কি অভিমান র‌য়েছে?‌ ঝুমুর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। উঠে দাঁড়াল। বলল, “‌আমি এবার একটা ছোট কাজ করব। আপনি না বললেও করব। সুতরাং না বলে বিরক্ত করবেন না। আমিও আপনাকে আর বিরক্ত করব না। কাজ শেষ হলে চলে যাব।”‌

    বিধান অবাক হয়ে তাকাল। ঝুমুর শাড়ির আঁচল সামলাতে-সামলাতে বলল, “আমি রান্নাঘরে দেখে নিয়েছি চাল, ডাল এবং ক’টা আলু রয়েছে। আমি খিচুড়ি বানাব। আপনি খাবেন। খেয়ে ঘুমোবেন।”‌

    বিধান আপত্তি করতে গিয়ে দেখল ঝুমুর মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা এমন করছে কেন?‌ সে কি কোনও মায়ায় পড়ে গিয়েছে?‌ ধুলোবালিতে পড়ে থাকা একটা অচেনা মানুষের জন্য কীসের মায়া?‌

    দশ মিনিটের ব্যবধানে পরপর দু’‌ ‌বার লোক এল। দরজায় কড়া নাড়ল। দু’‌‌বারই দরজা খোলার জন্য ঝুমুর বেরিয়ে এল। আবার থমকে আড়ালে চলেও গেল। বাড়িতে দুম করে একজন অচেনা মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে দেখে কেউ কিছু মনে করতে পারে। এটা কলকাতা শহর নয়। উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হল বিধানকে। প্রথমবার কোচিং-এর এক ছাত্র। ‘‌‌স্যার’‌ কালকে যাননি বলে খোঁজ নিতে এসেছিল। মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে ভয় পেয়ে গেল।

    “স্যার, আপনার কী হয়েছে?‌”‌

    বিধান জোর করে হেসে বলল, “কিছু না। পা পিছলে পড়ে চোট পেয়েছি। দু’‌দিন শুয়ে থাকতে হবে। তারপর থেকে যাব।”

    দ্বিতীয়বার যে-লোকটি এল, তাকে চিনতে পারল না বিধান।

    রোগা পাতলা চেহারার লোকটা গড়গড় করে বলে যেতে লাগল।

    “‌মাস্টার বলে পাড়ার সবাই চেনে আপনাকে। নইলে ঘুরে মরতে হত। কিশোরীগঞ্জ তো এইটুকু ছোট জায়গা নয়। যাক, সুফলদা ক’দিন আপনাকে ফোন করে করে পাগল হয়ে গিয়েছে।”‌

    বিধান ফ্যাল‌ফ্যাল করে চেয়ে রইল। লোকটা হেসে বলল, “আমাকে চিনতে পারলেন না? চিনবেন কী করে!‌ ‌আপনাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর আপনার অফিসে গিয়েছি। ক্যান্টিনে ডিম সাপ্লাইয়ের কনট্র্যাক্ট পেয়েছি‌। বজবজে বাড়ি।”‌

    বিধান বলল, “‌ও।”‌

    “‌সুফলদা বলল, দ্যাখ তো এই লোককে খুঁজে পাস নাকি। তোর বজবজের কাছেই হবে। সুফলদার অর্ডার ফেলতে পারি?‌ শুনলাম এক সময় আপনি এখানেই চাকরি করতেন, এখন পড়ান। বললেন এই চিঠিটা দিতে। চিঠি পেয়েই যেন চলে যান। ভেরি আর্জেন্ট। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম অফিস থেকে, আপনার নাকি চাকরি গিয়েছে।”‌

    লোকটাকে আর কথা বলতে না দিয়ে, চিঠি নিয়ে দরজা বন্ধ করল বিধান। ঝুমুর এসে বিরক্ত গলায় বলল, ‌“‌পরিশ্রমটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এত লোক আসছে। আপনার তো ঘুমোনোর কথা। এর চেয়ে হাসপাতালই তো ভাল ছিল।”‌

    বিধান হাসল। বলল, “‌আর হবে না। আপনি চলে গেলে বাইরে থেকে চাবি তালা দিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়ব। কেউ এলে ভাববে বাড়িতে নেই।”‌

    ঝুমুর বলল, “‌পুরনো কায়দা। লোকে ধরে ফেলে। এভাবে কি পালানো যায়?‌ যাক, আপনি যা ভাল বুঝবেন।”‌

    ঝুমুর খিচুড়ি নিয়ে এল। নিজেও নিল। চামচ পাওয়া গেল একটা। বিধানকে চামচ দিয়ে নিজে হাত দিয়ে খেতে লাগল। এর মধ্যে সন্তোষ ফোন করেছিল। আজ কাজ আছে।

    ঝুমুর বলল, “‌নেব না। শরীর খারাপ।”‌

    সন্তোষ বলল, “বাইরের পার্টি।”

    ঝুমুর বলল, “‌হোক। আজ পারব না। কাল রাত জাগা গিয়েছে।”

    সন্তোষ বলল, “‌ঠিক আছে অপেক্ষা করে দেখুন না। শরীর তো ভালও হয়ে যেতে পারে। বাইরের পার্টি। পেমেন্ট হাই হবে।”‌

    খিচুড়ি খেয়ে বিধান নিচু গলায় বলল, “‌ভাল হয়েছে। অনেকদিন পর মুখ বদল হল।”‌

    ঝুমুর একটু চুপ করে থেকে শান্তভাবে বলল, “‌আমি অনেকদিন পরে নিজেকে একটু বদল করলাম।”‌

    বিধান অবাক হয়ে বলল, “‌বদল!‌”‌

    ঝুমুর মুখ নামিয়ে খানিকটা নিজের মনেই যেন বলল, “‌বাড়ির বাইরের কাউকে এত ভালবেসে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ালাম।”

    ‘‌ভালবাসা’ কথাটা মুখ ফসকে বলে খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল ঝুমুর। তাড়াতাড়ি সহজ করার চেষ্টা করল। মুখ তুলে বানানো হাসি হেসে বলল, “‌আসলে সেবা-টেবা করা হয় না তো। একটা সুযোগ পেলাম।”

    এঁটো কাপ, বাটি, থালা ধুতে-ধুতে ঝুমুরের কেমন কান্না পেল। এখান থেকে এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। আর নয়। এই মানুষটার কাছে থাকলে সমস্যা বাড়বে। কিছু মায়া আছে, যা সুযোগ পেলেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে। এই মানুষটা যদি থেকে যেতে বলে?‌ শরীর হালকা কেঁপে উঠল ঝুমুরের। কী আশ্চর্যের!‌ রাতের পর রাত পুরুষমানুষরা তাকে রাখতে চায়, তাদের চেহারা সাজপোশাক থাকে চকচকে। সে পৌঁছনোর আগে দাড়ি কামিয়ে রাখে। গায়ে কখনও সেন্ট লাগিয়ে নেয়। অথচ এই রোগা মানুষটার মাথায় ব্যান্ডেজ, গালভরতি দাড়ি, জামা–‌কাপড়ের অবস্থাও মলিন। এখনও পথের ধুলোবালি লেগে আছে। তারপরেও মনে হচ্ছে, মানুষটার পাশে বসে থাকি। এটা আশ্চর্যের নয়?‌ চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বিধানের কাছে ফিরে এল ঝুমুর।

    “এবার চললাম।”‌

    বিধান বোজা চোখ খুলে মৃদু স্বরে বলল,‌ “‌আচ্ছা।”

    ঝুমুর ব্যাগ তুলে নিয়ে বলল, “‌সাবধানে থাকবেন।”‌

    বিধান একটু দ্বিধা করে বলল, “‌ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না। তারপরেও একটা প্রশ্ন করি?‌”‌

    “বলুন।”‌

    “‌আপনি আমার জন্য এত করলেন কেন‌?‌ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন… তা-ই তো অনেক ছিল।”‌

    ঝুমুর একটু চুপ করে রইল। তারপর গাঢ় স্বরে বলল, “‌আমি ঠিক জানি না। আপনাকে বড্ড একা, অসহায় মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, আপনি একা নন, আপনি নিজের সঙ্গে থাকেন,” তারপর একটু থেমে বলল‌, “‌ধুস, ওসব কিছু নয়। আসলে একটা খেলা খেললাম।”‌

    বিধান বলল, “‌খেলা!‌”

    ঝুমুর বলল, “‌হ্যাঁ নিজের সঙ্গে খেলা। পুরুষমানু্ষকে কি শুধুই ঘেন্না করি?‌ নাকি ভালবাসতেও পারি।”‌

    বিধান বিড়বিড় করে বলল, “‌বুঝতে পারলাম না।”‌

    ঝুমুর একটু হেসে বলল, “আমার মতো যে-মেয়েকে প্রতিদিন পুরুষমানুষদের সঙ্গে শুয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তার কথা বোঝা কঠিন। আপনার কোনও দোষ নেই। যাক, আমি চললাম। আসুন আমাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিন। আর যদি পারেন, মেয়েকে একটা খবর দেবেন। সে বেচারি আপনার ফুলগাছের জন্য অপেক্ষা করে আছে।”

    মানুষ কি কখনও চরিত্রের একেবারে উলটো কোনও কাজ করে?‌ অবশ্যই করে। করে বলেই মানুষের জীবন এত রহস্যময়, এত সুন্দর।

    দরজা খুলে বিধান‌ ঝুমুরের হাত ধরল। ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজল ঝুমুর। পুরুষমানুষের এই স্পর্শের জন্যই কি একটা নারীজীবন অপেক্ষা করে থাকে?‌

    বিধান নিচু গলায় বলল, “‌তুমি আর কখনও আমার কাছে আসবে না ঝুমুর। কখনও না। আমি সম্পর্কে ভয় পাই।”‌

    ঝুমুর চোখ খুলে সামান্য হেসে বলল, “জানি, আপনি একথা বলবেন। আমি কথা দিচ্ছি, আর কখনও দেখা হবে না। আমি আপনার মতো সম্পর্ককে ভয় পাই না। ভালবাসি।”‌

    ঠিক এই সময়ে উঠোনের অল্প ক’টা সিঁড়ি টপকে উঠে এল শ্রীজিতা। সে এই বাড়িতে আসেনি কখনও, কিন্তু ঠিকানা জানত। বিধানের কাছ থেকে নিয়ে রেখেছিল।

    বিধান অবাক হয়ে বলল, “‌শ্রীজিতা তুমি!‌”‌

    শ্রীজিতা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। বিধান এক তরুণীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে!‌ ঝুমুর চকিতে মুখ তুলে শ্রীজিতাকে দেখল। কয়েক মুহূর্ত চোখাচোখি হল দু’জনের।

    বিধানের হাত ছাড়িয়ে নেমে গেল ঝুমুর।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরুপোর খাঁচা – প্রচেত গুপ্ত
    Next Article পঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত

    Related Articles

    প্রচেত গুপ্ত

    দেরি হয়ে গেছে – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    পঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    রুপোর খাঁচা – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    মাটির দেওয়াল – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নুড়ি পাথরের দিনগুলি – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নিষাদ – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }