Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ধুলোবালির জীবন – প্রচেত গুপ্ত

    প্রচেত গুপ্ত এক পাতা গল্প170 Mins Read0

    ধুলোবালির জীবন – ৩

    ৩

    বাসে ভিড়।

    বাস যত কলকাতার দিকে এগোচ্ছে, ভিড় বাড়ছে। বিধান কোনও রকমে একটা সিট পেয়েছে। পুরো সিট নয়, আধখানা সিটের একটু বেশি। ঠেসেঠুসে বসতে হয়েছে। বিধানের কোলের উপর একটা টব। টবটা মাটি মাখা। একটা ছোট সাইজ়ের গাছ রয়েছে। কাঁটা আর পাতা দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, গাছটা গোলাপের। একটা কুঁড়িও রয়েছে। খুব ছোট একটা কুঁড়ি। বিধান দু’ হাত দিয়ে অতি সাবধানে টবটা ধরে আছে।

    বসার জায়গা না পেলে, টব নিয়ে যাওয়া মুশকিল হত। হাতে অনেক কিছু নিয়ে বাসে দাঁড়ানো যায়, ফুলের টব নিয়ে দাঁড়ানো যায় না। কোনও সিটের তলাতেও রাখা যেত না। কাত হয়ে পড়লে মাটি এবং গাছ, দুটোই নষ্ট। এত পরিশ্রমই জলে। গাড়ি ভাড়া করে বজবজ থেকে কলকাতায় যাওয়ার মতো টাকা বিধানের কাছে নেই। মাসের পনেরো তারিখ হতে চলল কোচিং সেন্টারের এখনও বেতন হয়নি। সেন্টারটা মাখন পালের, বর্ধমানের লোক। কলকাতায় দেখা হল কুড়ি বছর পর। তখন ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে বিধান। চাকরি চলে গিয়েছে। চলে যাওয়া নয়, আরও খারাপ। হিসেবের টাকা নিয়ে গোলমালের জন্য সাসপেন্ড হয়েছে। অফিস নালিশ করলেই পুলিশ গ্রেপ্তার করবে। ক’দিনের মধ্যে শ্রীজিতার সঙ্গে পাকাপাকিভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। কাগজপত্র সব তৈরি, শুধু দু’জনের সই করা বাকি। মিউচুয়াল ডিভোর্স, ফলে সমস্যা কিছু নেই। বাড়িতে আর থাকে না বিধান। শ্রীজিতাই বারণ করেছে। শিয়ালদার একটা সস্তার হোটেলে ঘর নিয়েছে। সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। কাজকর্মের খোঁজ করে। রাতে এসে হোটেলে শুয়ে পড়ে। টাকাও ফুরিয়ে আসছিল। মাঝে-মাঝে রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে ট্রেনের আসা যাওয়া, লোকজনের ব্যস্ততা দেখত বিধান। গেটের টিকিট চেকাররাও বুঝত লোকটা ‘ফালতু’। এই সময় একদিন শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা হয়ে গেল মাখনদার সঙ্গে।

    মাখনদা চিনতে পেরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করেছিল, “কী করছ?‌ কোথায় থাকো?”

    বিধান হেসে বলেছিল, “কিছু করি না। কোথাও থাকি না। যেখানে জায়গা পাই, রাত কাটাই।”

    “বিয়ে করেছ?”

    বিধান সামান্য হেসে বলেছিল, “একা থাকি।”

    “তা হলে আমার সঙ্গে চলো।”

    বিধান অবাক হয়ে বলেছিল, “কোথায়!‌”

    মাখনদা বলেছিল, “বজবজের কাছে একটা স্কুলে বদলি হয়েছিলাম। অবসর নেওয়ার পর কোচিং করেছি। ভাল অঙ্কের টিচার খুঁজছি। তুমি তো একসময় ভাল অঙ্ক করাতে। চলো আমার সঙ্গে। মাইনে বেশি না হলেও, চলে যাওয়ার মতো পাবে। সস্তায় ঘর দেখে দেব। আরও দু’-একটা পড়ানো যদি ধরিয়ে দিতে পারি, তা হলে তো কথাই নেই।”

    বিধান একটুও না ভেবে বলেছিল, “যাব। তবে দুটোদিন সময় দিতে হবে।”

    মাখনদা এক গাল হেসে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল, “খুব বড় একটা চিন্তা দূর করলে। অঙ্কের মাস্টার ভাল না হলে কোচিং চলে না।”

    ‌‌বিধান বিকেলে শ্রীজিতাকে ফোন করেছিল, “একটু তাড়াতাড়ি করা যায় শ্রী?”

    শ্রীজিতা অবাক গলায় বলেছিল, “কী তাড়াতাড়ি করব?”

    “ও‌‌ই যে সই-টইগুলো।”

    তিনদিনের মাথায় সব কাজ শেষ করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে উঠে বসেছিল বিধান। মাখনদার কোচিং-এ পড়াতে-পড়াতেই আরও ক’টা টিউশন জুটে গেল। এই দুটো কোচিং-এ পড়ানো ছাড়াও কিছুদিন হল, একটা সাইবার কাফেতে দুপুরে দু’ ঘণ্টা বসতে শুরু করেছে বিধান। তারা অল্প কিছু টাকা দেয়।

    আজ টবসমেত গাছ কিনতে টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। শুধু টব আর গাছ নয়, সার টার দিয়ে মাটিও তৈরি করে দিয়েছে নার্সারির ছেলেটা।

    বিধান চাপা টেনশনের মধ্যে রয়েছে। এই গাছের গোলাপ কেমন হবে, তাই নিয়ে টেনশন।‌ তোয়া টকটকে লাল গোলাপ চেয়েছে।

    “আমার জন্মদিনে তুমি কী দেবে বাবা?”

    “তোমার কী চাই?”

    সাত বছরের তোয়া বড়দের ভঙ্গিতে কথা বলতে ভালবাসে। ভঙ্গিটা খুবই মিষ্টি। বাবার প্রশ্ন শুনে সে থুতনিতে আঙুল দিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়েছিল। তারপর ঘাড় কাত করে বলেছিল, “বাবা, তুমি বরং.‌.‌.‌তুমি বরং.‌.‌.তুমি বরং‌ আমাকে একটা বড় গাড়ি দিয়ো।”

    বিধান হেসে বলেছিল, “আচ্ছা দেব।”

    তোয়া চোখ বড় করে বলেছিল, “খেলনা গাড়ি নয় কিন্তু, সত্যি গাড়ি দেবে। আস্ত গাড়ি। ভোঁ করে চলবে।”

    বিধান একটু চুপ করে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, “সত্যি গাড়ি কেনার মতো পয়সা তো আমার নেই বাবা।”

    তোয়া নিজের গালে তার ডানহাতের ছোট্ট তর্জনী দিয়ে কয়েকটা টোকা মেরে বলেছিল, ‘আচ্ছা, তা হলে.‌.‌.‌তা হলে.‌.‌. তুমি বরং আমাকে একটা রোজ় ট্রি দিয়ো। রেড রোজ়। খুব লাল হবে।”

    বিধান অবাক হয়ে বলেছিল, “ওরে বাবা, এই ফ্ল্যাটে তুমি গোলাপ ফুলের গাছ কোথায় রাখবে? তার চেয়ে বরং শুধু গোলাপফুল দিই?”

    তোয়া বায়না করে বলেছিল, “না, আমাকে গাছই দিতে হবে। ব্যালকনিতে গাছ রাখব। পিউদের ব্যালকনিতেও গাছ আছে। ওর বাবা রেখেছে। তুমি কি পিউকে চেনো বাবা?”

    বিধান বলেছিল, “না মা, আমি চিনি না। সে কি ‌তোমার বন্ধু?”

    তোয়া বলেছিল, “ফ্রেন্ড, তবে সবসময় ফ্রেন্ড নয়। যখন ঝগড়া হয়, তখন আড়ি। বাকি সময় ফ্রেন্ড। ও এই হাউজ়িং-এর জি ব্লকে থাকে। থারটিন্থ ফ্লোরে। ওদের একটা ব্যালকনিতে অনেক গাছ। আমি হাত দিলে বলে, ‘দেবাদৃতা, ডোন্ট টাচ। পাপা রাগ করবে। দিস ইজ় মাই পাপাজ় গার্ডেন।’ আমার খুব রাগ হয়েছে। তুমি গাছ এনে দাও, আমিও বাগান করব। পিউ গাছে হাত দিলে বলব, ‘ডোন্ট টাচ্। দিস ইজ় মাই পাপাজ় গার্ডেন।”’

    বিধান‌ লক্ষ করেছে, যত দিন যাচ্ছে তোয়ার মুখে তার একটা আদল আসছে। তবে মিল ঠিক কোথায়, সেটা স্পষ্ট নয়। এই ধারণাটা ভুলও হতে পারে। ভুল হলেই ভাল। কে যেন বলেছিল, পিতৃমুখী কন্যা সুখী হয় না। তার মতো দেখতে হওয়ার দরকার নেই, মেয়ে যেন সুখী হয়। তবে মেয়েটা দিন-দিন দেখতে সুন্দর হচ্ছে। একমাথা ঝাঁকড়া চুল হয়েছে। টানা-টানা দুটো চোখ, টিকোলো নাক। হাসলে বাঁ দিকের গালে হালকা টোল পড়ে। বিধানের গালে টোল পড়ে না। তবে মায়ের কাছে শুনেছিল, ছোটবেলায় নাকি তার গালে টোলের আভাস ছিল। তোয়া কি সেটাই পেয়েছে? হতে পারে। মেয়ের সৌন্দর্যের ব্যাপারে শ্রীজিতারও খুব মন। ফরসা রঙের সঙ্গে মানানসই সুন্দর পোশাক পরায়। মাসে যে একদিন বিধান মেয়েকে দেখতে আসে, সেদিন নিজে থাকলে নিজে, নইলে মিনুকে দিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে রাখে। চুল বেঁধে, গালে একটু পাউডারের পাফ বুলিয়ে, কপালে একটা ছোট্ট টিপ লাগিয়ে মিনু তাকে ড্রইংরুমে নিয়ে আসে। তোয়াকে দেখভালের জন্য কিশোরী মিনুকে রেখেছে শ্রীজিতা। মেয়েটি ভাল। রাতদিন থাকে। সকালে শ্রীজিতা মেয়েকে স্কুলের জন্য তৈরি করে দিলে মিনু বাসে তুলে দিয়ে আসে। দুপুরে এগারোটায় তোয়া স্কুল থেকে ফিরলে তাকে বাস থেকে নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা, স্নান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, বিকেলে নীচের পার্কে খেলতে নিয়ে যাওয়া, সব মিনুর দায়িত্ব। অফিস থেকে ফোনে কন্ট্রোল করে শ্রীজিতা।

    মিনুর একটা কাজই বিধানের জন্য অস্বস্তির। মেয়েটি তাকে ‘জামাইবাবু’ ডাকে। শ্রীজিতাকে যেহেতু ‘দিদি’ বলে তাই বিধান ‘জামাইবাবু’। বিধান‌ অনেকদিনই ভেবেছে, বারণ করবে। কীভাবে করবে, সেটা ঠিক করতে পারেনি বলে এখনও করা হয়নি।

    তোয়া বলেছিল, “বাবা, ‌তুমি গাছ এনে দেবে তো?”

    মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বিধান হেসে বলেছিল, “আচ্ছা দেব। কিন্তু তোমার মা রাগ করবে না?”

    “মা রাগ করলে, আমিও রাগ করব।”

    বিধান মেয়ের পাকা কথা বলার ভঙ্গিতে মজা পেল, “তুমি মায়ের উপর কীভাবে রাগ করো তোয়া?”

    তোয়া বলেছিল, “খাওয়ার সময় মুখ টিপে বসে থাকি, কিছুতেই খাই না। এই ভাবে,” তোয়া তার পাখির মতো ছোট্ট ঠোঁটদুটো চেপে দেখিয়েছিল, “তুমি না দিলে তোমার উপরেও রাগ করব। খেতে বললেও খাব না।”

    বিধান ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলেছিল, “ওরে বাবা, রাগ করতে হবে না। আমি গাছ নিয়ে আসব। মঙ্গলবার তোমার জন্মদিন, সেদিনই নিয়ে আসব।”

    পাশে বসা মাঝবয়সি লোকটির পোশাক ধোপধুরস্ত। বিধান টব হাতে পাশে বসার পর থেকে সিঁটিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, টবের গায়ে লেগে থাকা মাটি নিয়ে সে শঙ্কিত। জামাকাপড়ে লেগে না যায়। খানিক আগে বাস ঝাঁকুনি দিতে টবটা হেলে গিয়েছিল। লোকটি আঁতকে উঠেছিল, “আরে ভাই, চেপে ধরুন, গায়ে পড়বে যে!”

    বিধান টব সামলে বলেছে, “পড়বে না। আমি ধরে আছি।”

    লোকটি নাক মুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলে, “যতসব বেআক্কেলে লোক। বাগান নিয়ে বাসে উঠেছে। কাগজে মুড়ে গাছ নিলেই তো হত।”

    সিটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক চ্যাংড়া ধরনের ছেলে বলল, “বাগানই যখন নিলেন দাদা, বাগানের সঙ্গে এক সেট বেতের চেয়ারও রাখতে পারতেন। বাসে যেতে-যেতে বাগানে বসে চা খেতেন।”

    আশপাশের যাত্রীরা হেসে উঠেছে। বিধানও একটু হাসে। তবে চুপ করে থাকে। ঠাট্টা তামাশা শুনে সে অভ্যস্ত। তার চেহারার মধ্যে কোথাও একটা হাসিঠাট্টার ব্যাপার আছে মনে হয়। লোকে দেখে বুঝতে পারে, একে নিয়ে মজা করলে কোনও সমস্যা নেই। কিছু বলবে না। স্কুল কলেজেও ছেলেরা তার সঙ্গে মজা করত। সেই মজা অনেক সময় নির্মমও হয়েছে। কলকাতার যে অফিসে একসময়ে চাকরি করেছে, সেখানেও একই সমস্যা। বিধানের সঙ্গে দেখা হওয়াই মানে যেন একবার অন্তত তাকে নিয়ে তামাশা করতে হবে।

    “ভাই ‌বিধান, তোমার মতো কেজো লোক আর কয়েকজন থাকলে দেশটার চেহারাই বদলে যেত। দেখো না ভাই, জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে যদি খুঁজে পাও। ধরে নিয়ে এসো। আমরা অফিস দিয়ে দেশোদ্ধার শুরু করি।”

    “ওহে বিধান, এবার বিয়ে থা করো। নিজের এমন চনমনে যৌবন কি শুধুমাত্র অফিস ফাইলের সঙ্গে শুয়ে বসে শেষ করবে?”

    “বিধানদা, তুমি এক কাজ করো। তুমি বরং বিয়ে করে বউকে নিয়ে অফিসে এসে ওঠো।‌ কাজও করবে, ঘর সংসারও করবে। ছুটির পর টেবিলগুলো জুড়লে দিব্যি একটা খাট হয়ে যাবে।”

    শ্রীজিতার সঙ্গে বিয়ের পর আর এক রকম ঠাট্টা শুনতে হত।

    “বিধানবাবু, শুনলাম আপনি নাকি মিসেসের কাছ থেকে এখনও ইয়ের পারমিশন পাননি? সত্যি? ইস একমাস হয়ে গেল, এখনও ইয়ে হল না!‌‌”

    “এই জন্যই বেশি সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়ে বিয়ের আগে দু’বার ভাবতে হয় বিধান। আমি তো বাবা, নিজের দৌড় বুঝে তোমাদের বউদিকে বিয়ে করেছিলাম।”

    হাসিতে সহকর্মীদের চোখ মুখ লাল হয়ে গেলেও, বিধান কখনও তেমন উত্তর দিতে পারেনি। মিনমিনই করেছে। উত্তর দেওয়ার যে খুব ইচ্ছে হয়েছে, এমনও নয়। বুঝে গিয়েছে, এমনটাই শুনতে হবে তাকে। একবার শ্রীজিতার সামনেও এমনটা ঘটেছিল। বিয়ের একেবারে প্রথমদিক তখন। দু’জনে গিয়েছিল গড়িয়াহাটে কেনাকাটা করতে। পারচেজ়ের বিশ্বনাথের সঙ্গে দেখা। শ্রীজিতার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই হয়। একথা সেকথার পর বিশ্বনাথ ঠাট্টার বিশ্রী অভ্যেস চেপে রাখতে পারেনি।

    “তোমার স্বামী তো অফিসে খেটে-খেটে পাগল হয়ে যাবে শ্রীজিতা। আমরা কত বলি, ‘নতুন বিয়ে করলে, মাঝে-মাঝে ডুব মারো বিধান। লাঞ্চটাইমে কেটে পড়ো। বাড়ি গিয়ে বউয়ের হাতের রান্না খাও, গল্পগুজব করো। আরে বাবা, অফিস তো রইল। বউ তো আর নতুন থাকবে না।’ কে শোনে কার কথা? তুমি একটা ব্যবস্থা করো দেখি!”

    শ্রীজিতা ঠাট্টা ধরতে না পেরে অবাক হয়ে বলেছিল, “আমি কী ব্যবস্থা করব!‌‌”

    বিশ্বনাথ ঠোঁট টিপে হেসে বলেছিল, “সে আমরা কী করে বলব? নতুন বউরা স্বামীকে ঘরে আটকে রাখার কত ব্যবস্থা জানে! তার কোনও একটা অ্যাপ্লাই করবে।”

    শ্রীজিতার মুখ থমথমে হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে এসে বিধানকে বলেছিল, “এই ধরনের রাসকেলদের সঙ্গে তুমি অফিসে কাজ করো?”

    বিধান শুকনো হেসে বলেছিল, “কিছু মনে কোরো না শ্রীজিতা। ওরা এই রকমই। কথা বলতে শেখেনি। আমাদের অফিসটাও তো মেঠো ধরনের। ওখানে এরকম ধরনের লোকই বেশি।‌”

    “তোমার অফিস মেঠো না গেছো, আমার জানার দরকার নেই। প্রথমদিন বলে লোকটাকে কিছু বললাম না। দ্বিতীয়দিন হলে চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব। মহিলাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শিখে যাবে। এরা অফিসেও এরকম কথা বলে?”

    “একটু বলে।”

    স্বামীর কথা বলার ধরনে শ্রীজিতার সন্দেহ হয়েছিল। ভুরু কুঁচকে বলেছিল, “সবাইকে বলে, নাকি কেবল তোমাকে বলে?”

    ‌বিধান সহজভাবে বলেছিল, “সবাইকেই বলে। তবে ‌আমাকে নিয়ে একটু বেশি…”

    শ্রীজিতা সেদিন অবাক হয়েছিল খুব, “তুমি এমন গলায় বলছ যেন তুমি একজন জোকার! তোমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করবে, এটা নরমাল ব্যাপার?”

    “বাদ দাও শ্রীজিতা।”

    শ্রীজিতা রাগে হিসহিসিয়ে উঠে বলেছিল, “লোকে আমার স্বামীকে নিয়ে মজা করে, সেটা বাদ দেব!‌ এখন বুঝতে পারছি, দোষ এই লোকগুলোর নয়। দোষ তোমার। তোমার ব্যক্তিত্বের অভাব।”

    ‌বাস আবার ঝাঁকুনি দিল। পাশের মাঝবয়সি এবার প্রায় লাফিয়ে উঠল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, “আমার গায়ে মাটি পড়লে কিন্তু আপনার সমস্যা আছে। টব নিয়ে বাসে ওঠা বের করে দেব। ওই টব জানলা দিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেব, কিছু বলতে পারবেন না কিন্তু।”

    বিধান চুপ করে রইল। টব আনা ছাড়া উপায় ছিল না। কে টব এনে তোয়াকে গাছ লাগিয়ে দেবে? নার্সারি থেকে সার দিয়ে মাটি তৈরি করে দিয়েছে। সেসবই বা হত কী করে? শ্রীজিতাদের হাউজ়িং-এ মালি আছে। ভিতরের বাগানটাও ছড়ানো আর সুন্দর। কিন্তু তাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে এসব কে করাবে? শ্রীজিতার সময় নেই। মিনু পারবে না। সে যদি নিজে থাকত, একটা কথা ছিল। কিন্তু শ্রীজিতা অ্যালাও করবে না। যেদিন ডিভোর্সের কাগজপত্রে পাকাপাকি সই সাবুদ হল, সেদিন উকিলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে শ্রীজিতা মেয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিল,‌ “তোয়ার কাস্টডির বিষয়টা কী হবে?”

    বিধান প্রথমটায় বুঝতে না পেরে বলেছিল, “মানে! কীসের কাস্টডি?”

    “তোয়া কার কাছে থাকবে? তুমি কোর্টে অ্যাপিল করতে পারো, তাতে লাভ হবে বলে মনে হয় না। এতটুকু মেয়ে তার মায়ের কাছেই থাকে। এখন ভাগ করেও থাকতে পারবে না। আর একটু বড় হলে আলাদা কথা। মেয়ের নিজের মতামত তৈরি হবে। ‌তারপরেও যদি তুমি চাও, কোর্টে বলতে পারো। সেক্ষেত্রে আমিও ফুল কাস্টডির জন্য অ্যাপিল করব।”

    বিধান সামান্য হেসে বলেছিল, “খেপেছ শ্রীজিতা? ‌আমি কোথায় মেয়েকে রাখব? আমার নিজেরই মাথা গোঁজার ছাদ নেই। আর ছাদ থাকলেই বা কী হত? তোয়াকে কি আমি মানুষ করতে পারব? নিজেই মানুষ হতে পারলাম না। ও তোমার কাছেই থাকবে। আমার কোনও দাবি নেই।”

    শ্রীজিতা সদ্য ডিভোর্স করা স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে ছিল। নিচু গলায় বলেছিল, “দাবির কথা বাদ দাও‌। অধিকার বলে তো একটা কিছু আছে। আফটার অল ইউ আর হার ফাদার।”

    বিধান বলেছিল, “আমি ওসব ভাবছি না। আমি কলকাতা থেকে চলে যাব। এই শহর আমার ভাল লাগছে না।”

    শ্রীজিতা একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “গুড। আসল ব্যাপারটাই যখন মিউচুয়ালি হয়ে গেল, তখন মেয়েকে নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন না ওঠাই ভাল।”

    এর মাসখানেক পরে শ্রীজিতাই এক দুপুরে ফোন করেছিল। বিধান সেদিন সাইবার কাফের কাজটার জন্য কথা বলতে যাচ্ছিল। মোবাইল কানে দিয়ে বলেছিল, “কেমন আছ শ্রীজিতা?”

    সেই উত্তর না দিয়ে শ্রীজিতা বলেছিল, “তোমার সঙ্গে কথা ছিল।”

    “বলো।”

    “তোমার কয়েকটা জামাকাপড়, একটা ফোটো অ্যালবাম, কিছু কাগজপত্র এ বাড়িতে রয়ে গিয়েছে। আমি প্যাকেটে ভরে রেখেছি। এসে নিয়ে যেয়ো।”

    বিধান বলেছিল, “আচ্ছা।”

    শ্রীজিতা বলেছিল, “আমি না থাকলে মিনুর কাছ থেকে নিয়ে নেবে।”

    “মিনু কে?”

    “তোয়ার জন্য একটা মেয়েকে রেখেছি। আমাকে তো অফিসে যেতে হয়।”

    বিধান একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোয়া কেমন আছে?”

    শ্রীজিতা বলেছিল, “সর্দি-জ্বর হয়েছিল। এখন ঠিক আছে,” একটু থেমে ফের বলেছিল, “শোনো, তুমি যদি মনে করো, মাঝেমধ্যে এসে মেয়েকে একবার দেখে যেয়ো।”

    “আচ্ছা।”

    শ্রীজিতা বিরক্ত গলায় বলেছিল, “কীসের ‌আচ্ছা‌? এরকম নির্লিপ্ত ধরনের উত্তর দেওয়ার অভ্যেস এবার ছাড়ো বিধান।”

    বিধান বলেছিল, “আমি তো জানি, তোমার ওখানে যাওয়ার অধিকার আমার নেই। এখন তুমি যখন বলছ, একদিন যাব। জিনিসপত্র নিয়ে আসব, তোয়ার সঙ্গেও দেখা হবে।”

    “একদিন যাব ব্যাপারটা নয়। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখো, তুমি রাজি কি না। মাসে একদিন করে আমার এখানে এসে মেয়ের সঙ্গে দেখা করে যাবে। আমি চাই না, মেয়ে বড় হয়ে কখনও আমাকে বলুক যে, আমি তাকে তার বাবার কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছিলাম।”

    বিধান বিড়বিড় করে বলেছিল, “ধন্যবাদ শ্রীজিতা।”

    শ্রীজিতা এবার খানিকটা শক্ত গলায় বলেছিল, “তবে একটা শর্ত আছে। তুমি তোয়ার কাছে থাকবে ‌পনেরো–কুড়ি মিনিট, খুব বেশি হলে আধঘণ্টা। আমার মনে হয় না, এর বেশি সময়ের দরকার আছে। ওইটুকু মেয়ে কতটুকুই বা বুঝবে।”

    বিধান গদগদ হয়ে পড়েছিল। শ্রীজিতা যে তাকে এই সময়টুকু দিয়েছে, তা-ই অনেক। বলেছিল, “আধঘণ্টা লাগবে কেন? মেয়েটাকে একটু দেখতে পারলেই হবে।”

    শ্রীজিতা আবার একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “মনে থাকে যেন। আশা করি এই শর্ত আমরা মেনে চলব। আর একটা কথা, ছুটির দিন আসবে না। ওদিন আমি থাকি। আমি তোমার মুখোমুখি হতে চাই না।”

    সময়ের শর্ত মেনেই বিধান মেয়ের কাছে যায়। তারপরেও কোনও কোনও মাসে সময়সীমা পেরিয়ে যায়। মিনুর কাছ থেকে খবর পেয়ে শ্রীজিতা বিরক্ত হয়।

    ফোন করে। কিছুদিন আগেই হয়েছে। তোয়া নাচের স্কুলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরল। তার সঙ্গে কথা বলে বেরোতে-বেরোতে অনেকটা সময় লেগে গেল। রাতে ফোন করল শ্রীজিতা, “ফ্ল্যাটে আজ বেশি সময় ছিলে?”

    বিধান খানিকটা ইতস্তত করে বলেছিল, “তোয়া নাচ শিখতে গিয়েছিল। আমি জানতাম না।”

    শ্রীজিতা ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “গত সোমবার ক্লাস হয়নি বলে আজ এক্সট্রা ক্লাস ছিল। তুমি মিনুর কাছ থেকে যখন শুনলে তোয়া নেই, ঘণ্টাখানেক ঘুরে আসতে পারতে।”

    বিধান কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, “তোয়ার সঙ্গে বেশিক্ষণ ছিলাম না শ্রীজিতা। ওর জন্য অপেক্ষা করতেই সময় চলে গিয়েছে।”

    শ্রীজিতা আরও ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “কারও জন্য অপেক্ষা করাটাও তো তাকে সময় দেওয়া।”

    টেলিফোনের ওপাশে বিধান চুপ করে থাকে। শ্রীজিতা নিচু গলায় বলেছিল, “বিধান, গত মাসেও তুমি বেশি সময় ছিলে বলে আমি খবর পেয়েছি। আমি চাই না দীর্ঘ সময় তোয়া তোমার সঙ্গে কাটাক।‌ আমরা যেটুকু সময় ঠিক করেছি, তার বেশি সময় তুমি তোয়ার ওখানে না থাকলে আমি খুশি হব। তোয়ার পক্ষে সেটা মঙ্গল হবে। এমনকী তোমার জন্যও। অহেতুক মায়া তৈরির কোনও কারণ নেই‌। আমি মেয়েকে সবরকম মায়ার বাইরে রেখে বড় করতে চাই। আশা করি তুমি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে।”

    বিধান অস্ফুটে বলেছিল, “‌অবশ্যই করব।”

    আজ তোয়ার জন্মদিন। শ্রীজিতা কাল রাতে বিধানকে ফোন করেছিল, “তুমি নাকি কাল আসছ? মেয়েকে বলেছ শুনলাম।”

    বি‌ধান থতমত খেয়েছিল, “হ্যাঁ.‌.. তোয়া বলছিল.‌.‌.‌‌”

    টেলিফোনেই মৃদু হাসল শ্রীজিতা, “হঠাৎ মেয়ের জন্মদিন নিয়ে দরদ উথলে ওঠার কারণ জানতে পারি? একটা সময় তো পালিয়ে গিয়েছিলে।”

    বিধান শান্তভাবে বলল, “সেই ঘটনা একবারই ঘটেছে শ্রীজিতা।”

    শ্রীজিতা বলল, “ওই একবারই তো তোয়ার জন্মদিন সেলিব্রেট করেছিলাম।”

    বিধান চুপ করে থাকে। ঘটনাটা সত্যি। সেবার সন্ধেবেলা শ্রীজিতা পার্টি দিয়েছিল। তার অফিস কলিগ আর কাজের সঙ্গে যুক্ত এমন কয়েকজনকে ডেকেছিল।‌ বাড়িতে নয়, এয়ারপোর্টের কাছে এক হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েটে। খাবার, মদ, নাচ গান, সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। শ্রীজিতা সব করছিল। চেনাজানা এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। বিধানকে কিছু বলেনি। সে সবটা জানতে পারে আগের দিন রাতে। শ্রীজিতা জানিয়েছিল।

    রাত এগারোটা তখন। বেডরুমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল শ্রীজিতা। থাইয়ের কাছ পর্যন্ত একটা হলুদ রঙের নাইটি পরে হাতে পায়ে রাতের ক্রিম মাখছিল। এই সময়টায় ড্রেসিং টেবিলের পাশে দাঁড়ানো বেতের ল্যাম্প জ্বালায় শ্রীজিতা। ল্যাম্প থেকে আবছা হলুদ আলো শ্রীজিতার মুখে, গায়ে পড়ে। সেই আবছা হলুদ আলোর সঙ্গে নাইটির রং মিশে যাওয়ার জন্য শ্রীজিতাকে দেখাচ্ছিল নগ্ন। শ্রীজিতা রূপসি। সাধারণ রূপসি নয়, তার চেয়ে বেশি। ফরসা রং, টিকোলো চোখমুখ। নিয়মিত চর্চা করে শরীরকে রেখেছে মেদহীন ঝরঝরে। মেয়ে হওয়ার কারণে পেট ও বুকের শেপ যেটুকু এলোমেলো হয়েছিল, তাকে দ্রুত নিজের জায়গায় ফিরিয়ে এনেছিল। শরীরের এই দুই অংশেই শ্রীজিতা আকর্ষণীয়। অফিসে যতই কাজ থাক, একবার জিম না ঘুরে সে বাড়ি ফেরে না। খাওয়াদাওয়া করে মেপে। ঘাড় পর্যন্ত চুল ঝাঁকড়া এবং কোঁকড়ানো। ঝকঝকে দাঁতে হাসলে মনে হয়, জীবনের কোনও মলিনতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

    বিধান পাশে শুয়ে থাকা তোয়ার গায়ে হাত দিয়ে বলেছিল, “মেয়ের জন্মদিনে বড়দের এই হইচই না করলে হত না?”

    স্বামীর কথা শুনে শ্রীজিতা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়েছিল, “হঠাৎ একথা?”

    বিধান বলেছিল, “আগে তো এতটা জানতাম না। তোমার কাছে এখন শুনলাম, তাই বলছি।”

    শ্রীজিতা তার বড়-বড় দুটো চোখ সরু করে বলেছিল, “আগে শুনে কী করতে? খরচ দিতে? সে মুরোদ আছে? চাকরি তো করো দু’ পয়সার।”

    বিধান বুঝতে পেরেছিল কথাটা সে ভুল বলে ফেলেছে। সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, “তাই তো বলছিলাম এতটা খরচ.‌.‌.‌”

    ‌শ্রীজিতা আরও রেগে গিয়েছিল, “আমার পরিচিতদের ডাকলে তাদের জন্য খরচ করতে হবে। তারা ঢালাও সিস্টেমে পাত পেড়ে বসে ভাত-মাংস-দই খেতে আসবে না। পার্টি দিতে হয়। তুমি ভাল করেই জানো বিধান, ওরা তোমার পরিচিতদের মতো নয়।”

    বিধান তাড়াতাড়ি করে বলেছিল, “আমি সেকথা বলিনি।”

    শ্রীজিতা আবার ঘুরে বসে, “একথা-সেকথা-কোনও কথাই বলবে না। বিয়ের আগে তো তোমাকে বলেছিলাম, আমার কোনও বিষয়ে নাক গলাবে না। বিয়ে করছি… ব্যস এইটুকু। বিয়েতে কাউকে বলিনি, তোয়ার মুখেভাতও বুড়ি ছোঁওয়ার মতো করে হয়েছে। সেই সময় কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর মতো ক্ষমতা ছিল না। এমনকী মেয়ের পাঁচ বছর বয়েসেও কিছু করতে পারিনি। তখন সবে চাকরি শুরু করেছি। এখন আমার সামর্থ্য হয়েছে। তোমাকে বিয়ে করে একসময়ে যে ভিখিরির জীবন যাপন করেছি, সেখানে কোনও ভদ্রলোককে ডাকার উপায় ছিল না।”

    বিধান কী বলবে বুঝতে পারেনি। চুপ করে ছিল। সেই সময়ে এরকম হত। কিছু বললেই শ্রীজিতা বিরক্ত হত, রেগে যেত।

    বিধান অস্ফুটে বলেছিল, “ঠিক আছে তুমি যেরকম ভাল বুঝবে।”

    শ্রীজিতা আয়নার দিকে ঘুরে বলেছিল, “অফিসের ‌ওরা অনেকদিন ধরে খাওয়ানোর জন্য বলেছিল। তোয়ার জন্মদিন একটা উপলক্ষ মাত্র। দয়া করে একটা ভদ্রসভ্য ড্রেস পরে ঠিক সময়ে চলে যেয়ো। খাবার জায়গায় থেকো। বাকি পার্টি আমি বুঝে নেব।”

    বিধান আমতা-আমতা করে বলেছিল, “মে‌য়ে অত রাত পর্যন্ত থাকতে পারবে? আমি বরং ওকে নিয়ে .‌.‌.‌”

    শ্রীজিতা ঘাড়ে ক্রিম লাগাতে-লাগাতে বলেছিল, “বিধান, তুমি কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি। তুমি মেয়েকে হইচই হুল্লোড় থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছ। একটা কথা শুনে রাখো, আমি মেয়েকে আমার মতো করে মানুষ করব। ওর ধ্যান-ধারণা, জীবন বিশ্বাস যেন আমার মতো হয়। বদ্ধ এঁদো পানা পুকুরের মতো জীবন ও বহন করবে না। কনভেন্টে পড়বে, হস্টেলে থাকবে, বিদেশে যাবে। সে তার বাবার মিডিওকার জীবন চিনবে না। সে যেমন লেখাপড়া করবে, তেমন বন্ধুবান্ধব, পার্টি চিনবে। তোয়াকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”

    পরদিন বিকেলে ‘একটু আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল বিধান। সন্ধে পর্যন্ত‌ পথে-পথে ঘুরেছিল। একটা সিনেমা হলে টিকিট কিনে ঢুকে পড়েছিল। সিনেমার নাম দেখার আগেই ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে দেখে তার শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে বসার ঘরের ডিভানে।

    পরদিন কোনও রাগারাগি করেনি শ্রীজিতা। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে-হতে বলেছিল, “এখন থেকে বাইরেই শোবে। মেয়ে বড় হয়েছে।”

    বিধান মাথা চুলকে বলেছিল, “শ্রীজিতা কাল আসলে.‌.‌.‌”

    “না এসে ভালই করেছ। ওখানে তুমি মানাতে পারতে না।”

    বিধান উঠে দাঁড়ায়। এবার নামতে হবে। টব হাতে ভিড় ঠেলে বাস থেকে নামা খুব কঠিন। কোনওক্রমে সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এক হাতে টব, অন্য হাতে রড ধরে নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে। শেষ সিঁড়িতে পা রেখে অপেক্ষা করে বাস থামা পর্যন্ত। বাস থামে না, স্পিড কমায় মাত্র। পা এগিয়ে দেয় বিধান, আর তখনই কেউ একজন পিছন থেকে হালকা ধাক্কা মারে।

    রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিধান। হাতের টব ছিটকে যায়।

    বাস চলে যাওয়ার পর উলটো ফুটপাথ থেকে যে-মেয়েটি ছুটে আসে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা বিধান তাকে বিড়বিড় করে বলে, “আপনি আগে, ওই টবটাকে একটু দেখুন। ওতে গাছ আছে।”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরুপোর খাঁচা – প্রচেত গুপ্ত
    Next Article পঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত

    Related Articles

    প্রচেত গুপ্ত

    দেরি হয়ে গেছে – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    পঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    রুপোর খাঁচা – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    মাটির দেওয়াল – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নুড়ি পাথরের দিনগুলি – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নিষাদ – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }