Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প60 Mins Read0
    ⤷

    ১. সময়ের সুতোর গুলিটা

    সময়ের সুতোর গুলিটা যেন গড়িয়ে পড়ে গেছে কার কোল থেকে, সুতো খুলতে খুলতে এগিয়ে যাচ্ছে লাফ খেতে খেতে, ঘণ্টা-মিনিটগুলোর উপর দিয়ে। বড়ো যেন তাড়াতাড়ি লাফাচ্ছে।

    সকাল থেকে দুপুরে পৌঁছে গেল দিনটা এর মধ্যেই।

    আর একটু পরেই চারটে বাজবে।

    বিকেল চারটে।

    ইলাকে পৌঁছতে হবে সেইখানে সম্বুদ্ধ এসে অপেক্ষা করবে। অথচ ভয়ানক এখন আলস্য হচ্ছে ইলার, ইচ্ছে হচ্ছে এই নরম বিছানাটায় পড়ে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে নেয়।

    ঘুম। নরম মিষ্টি আর নিরুদ্বেগ একটু ঘুম। কত দিন যেন তেমন একখানা ঘুম ঘুমোয়নি ইলা। অনেক দিন। সেই যেদিন থেকে সম্বুদ্ধকে দেখেছে, সেদিন থেকে। দিনের শান্তি আর রাতের চিন্তা। কেড়ে নিয়েছে সম্বুদ্ধ ইলার।

    ইলার পাহাড়ি ঝরনার মতো বাধাবন্ধহীন নিরুদ্বেগ কৈশোর জীবনটা তরতরিয়ে এগিয়ে চলছিল নুড়ি ছাপিয়ে ওঠার গুঞ্জন গান গেয়ে, সম্বুদ্ধ এসে সামনে দাঁড়াল বড়ো একখানা পাথরের চাইয়ের মতো।

    ওকে অগ্রাহ্য করে ভেসে বহে যাবে, এ পারছে না ইলা। আবর্ত উঠেছে ওকে ঘিরে ঘিরে। যন্ত্রণা আছে তার, আছে অস্বস্তি।

    তবু সুখও আছে। অসহ্য সুখ!

    পূর্বজন্ম মানতে হচ্ছে আমায়, ইলা বলেছিল সম্বুদ্ধকে, শত্রু ছিলে তুমি আমার। মহাশত্রু ছিলে পূর্বজন্মে।

    সম্বুদ্ধ অবশ্য এ অপমানে ক্ষুব্ধ হয়নি, বরং হেসেই উঠেছিল। হেসে হেসে বলেছিল, অথবা মহাজন। অধমর্ণ ছিলে তুমি আমার। ধার রেখে মরেছিলে। এ-জন্মে সেই ধার শোধ নিচ্ছি কড়ায়-গণ্ডায়।

    মায় সুদ। ইলা বলেছিল রেগে উঠে। আরওঁ বলেছিল, কে আসতে বলেছিল তোমাকে আমার সামনে? কত সুখে থাকতাম যদি জন্মেও তোমার ওই হাড়-বিচ্ছিরি মুখটা না দেখতাম।

    আমিও তোমার সঙ্গে একমত, সম্বুদ্ধ গম্ভীর মুখটা নিয়ে বলেছিল, আমারও মনে হয় ও-কথা। ওই পোড়া কাঠের মতো তুমি কে যদি না দেখতাম। এতদিনে

    এই, ভালো হবে না বলছি।

    ভালো হবার কিছুই তো রাখনি। তোমার কবলে না পড়লে জীবনে কত কি ভালো ভালো ঘটতে পারত।

    বটে না কি! ইলা চোখ কুঁচকেছে, শুনি সেই ভালোর লিস্টঃ

    যথা, ভালো কনে, ভালো একখানা শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরের দেওয়া ভালো ঘড়ি, ভালো আংটি, ভালো ভালো যৌতুক

    ইস্! আশা কত! কোন্ শ্বশুরের দায় পড়ত তোমাকে জামাই করে ওই সব ভালো ভালো দিতে! কারুর যদি কানা-খোঁড়া একটা মেয়ে থাকত, হয়তো ভুলিয়ে-ভালিয়ে গছিয়ে দিত।

    দেখা হলেই ঝগড়া করা একটা রোগ ওদের। আর দেখা করবার জন্যেই ছটফটানি।

    সকালবেলা ঘুম ভাঙা থেকে ঘুমের মধ্যের স্বপ্ন সব ভরে থাকে সেই চিন্তায়। কিন্তু শুধু এক-আধবার দেখা হওয়ায় কদিন আশ মেটে? সর্বদা দেখতে ইচ্ছে করে, আরও নিবিড় করে পেতে ইচ্ছে করে, কেড়ে নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে ইলাকে ইলাদের বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে।

    কিন্তু ইলা বলেছে, ওই বর্বর ইচ্ছেগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। কেড়ে নিয়ে পালাতে গেলে ছেড়ে দেবে না তোমাকে কেউ, তেড়ে গিয়ে হাতে হাতকড়া লাগাবে।

    ওই তো! ওই দুঃখেই তো! দৈবাৎ তুমি এই বাইশের তিন রামদয়াল রোডে জন্মে ফেলেছে। বলে যে, এদেরই সম্পত্তি হয়ে গেছ, এ-কথায় বিশ্বাসী নই আমি, অথচ মানতেই হচ্ছে সেই কথা।

    তা হোক–ইলা বলে, কোনো কিছু মানব না, এ-ইচ্ছেটা বুদ্ধিমানের ইচ্ছে নয়।

    .

    অতএব বুদ্ধিমানের মতোই ইচ্ছেটা করে ওরা। সম্পর্কটা আইনসঙ্গত করে নেবার ব্যবস্থা করে। যাতে ইচ্ছে করলেই ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেই চেষ্টাই করছে। কিন্তু সেটা কি এমন লুকিয়ে-চুরিয়ে ছিচকে চোরের মতো?

    ইলা বলে, তুমি আমায় নিয়ে যাবে দেউড়ি দিয়ে রাজসমারোহে, সেটাই সুখ, সেটাই গৌরব—

    সম্বুদ্ধ হেসে ওঠে, দেবে সেই পাসপোর্ট তোমার রামদয়াল রোড?

    তবু ইলা বলেছিল, না হয় দিদি-জামাইবাবুকে বলি।

    সম্বুদ্ধ বলেছিল, খেপেছ! এ-সব ক্ষেত্রে কেউ নিরাপদ নয়। দিদি-জামাইবাবু তোমায় নিয়ে ফর অ্যাডাল্ট দাগা বিলিতি প্রেমের সিনেমা দেখতে যায়, অথবা লেডি চ্যাটার্লির প্রেম নিয়ে আলোচনা করে তোমার সঙ্গে বলে, ভেব না, তোমার প্রেমে পড়াকে অ্যালাউ করবে। সেরেফ তোমার মা-বাবাকে লাগিয়ে দিয়ে আমাদের পারানি নৌকোখানাকে বিশবাঁও জলে ফেলে দেবে।

    ইলা মুখ ভার করে বলে, সত্যি, কি সেকেলেই আছে এখনও আমাদের দেশ! বিশেষ করে এ-ব্যাপারে!

    সমুদ্ধ অবশ্য হাসে। বলে, শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই।

    সব দেশেই? কী যে বল? ওদেশে–

    ওদেশের প্রগতিশীলতার নমুনা শুধু এইটুকু—গার্জেনের অনুমোদিত পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে যদি ওদের মেয়ে-ছেলেরা প্রেমে পড়ে, তাহলে ওরা খুব পিঠ চাপড়ায়। নচেৎ রাগারাগি, বকাবকি, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ইত্যাদি পুরনো পদ্ধতিগুলো ঠিকই আছে। আর আমাদের দেশে প্রেমটাই অননুমোদিত। সবটাই রাগারাগির–

    তবু ওরা রাগারাগির ধার ধারে না। নিজেরা বেরিয়ে পড়ে।

    সেটা আমরাও করতে পারি। কোনো কিছুর ধার না ধরলে আর চিন্তা কি? তবে আমরা না হোক, তোমরা অনেক ধার ধারতে চাও।

    সম্বুদ্ধ হেসে কথাটা শেষ করে, মা-বাবা যদি আর তোমার মুখ না দেখেন, এই ভেবে তোমার ভয়, দিদি-জামাইবাবু পাছে তোমায় ধিক্কার দেয়, তাতে তোমার ভয়, অতএব এই চোরের পথ ধরা।

    .

    আজ সেই দিন। চোরের পথ ধরে বিয়ে করতে যাবে ওরা। বিকেল চারটের সময় প্রতীক্ষা করবে সম্বুদ্ধ। আর ইলার এখন কিনা ইচ্ছে দুপুরের নির্জনতায় জানলা-দরজা বন্ধ করে নরম ছায়াময় ঘরে একটু গা ছেড়ে দেওয়া ঘুম দেয়।

    তবু সে-ইচ্ছেকে বাদ দিয়ে উঠতেই হল ইলাকে। চুল বাঁধল, প্রসাধনের টুকিটাকি সেরে নিল, তারপর নিত্যদিনের সাজ সেজে বেরিয়ে পড়ল পৌনে চারটের চড়া রোদ্দুরে।

    প্রায়ই এ-সময় ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে যায় ইলা, কাজেই ইলার মা অমলা প্রশ্ন করলেন না। শুধু বললেন, উঃ, যা রোদ! একটা ছাতা নিলে পারতিস। বলে পাশ ফিরে শুলেন।

    ছাতা ইলা নেয় না। কোনোদিনই নেয় না, তবু অমলা রোজই বলেন। আর রোজই ইলা সে-উপদেশ উড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। ভাবে, বয়েস হলেই মানুষের উপদেশ দেওয়ার ইচ্ছেটা এমন বাড়ে কেন! কিন্তু আজ তা ভাবল না।

    আজ মায়ের ওই উপদেশবাণীটুকুর মধ্যেই যেন অবাধ একটা স্নেহের স্পর্শ পেল ইলা, আর চোখের কোলে এক ঝলক জল এসে গেল।

    অকৃতজ্ঞ! অকৃতজ্ঞ।

    ইলার মতো এমন অকৃতজ্ঞ মেয়ে আর কটা আছে? যদিও সম্বুদ্ধ অনেক উদাহরণ দেখিয়েছে তাকে এমন গোপন বিবাহের, এবং পরে আবার সব ঠিক হয়ে গেছে, সে-উদাহরণও দেখিয়েছে, তবু ইলার ওই কথাই মনে এল। আর সত্যিই ঘরের কোণ থেকে ছাতাটা টেনে বের করে ঠুকে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

    খানিক পরে, চোখের জল শুকোলে মনে পড়ল সম্বুদ্ধ নিশ্চয় হাসবে। বলবে, হঠাৎ? ছাতার আড়ালে আত্মগোপন নাকি?

    উত্তরটা প্রস্তুত করে রাখল ইলা। বলবে, তা নয়। রোদে ঘেমে কালো হয়ে যাই, এ ইচ্ছে নেই আজ।

    ওদের প্রোগ্রামে আছে, রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বেরিয়ে কোথাও ঢুকবে দুজনে একসঙ্গে খেতে। এই।

    এর চাইতে বেশি কোনো অনুষ্ঠান আর কি সম্ভব? কিন্তু শুভরাত্রিটা?

    ফুলশয্যার সেই অনুষ্ঠানটা? সেও কি শূন্য একটা সন্ধ্যার যন্ত্রণার মধ্যেই সমাপ্ত হবে? কোনো কিছু উপায় নেই?

    .

    খেতে ঢুকল ওরা দুজন, আর উইটনেস্ দুজন। অসীম আর কুমকুম। দুজনেই এদের দুজনেরই বন্ধু।

    আর ওরা নিজেরাও পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছে যেন ক্রমশ। তবে ওদের আর এদের মতো লুকোচুরির সুড়ঙ্গ পথ ধরতে হবে না। ওদের দুজনেরই প্রগতিশীল বাড়ি।

    তা, ওরাই উপায়টা বাতলাল। বলল, একটা নেমন্তন্নর ব্যাপার ঘটানো ছাড়া উপায় নেই, এবং সেটা যাতে বেশ খানিকটা সময় আহরণ করতে পারে।

    কুমকুম বলল, বেশ, আমি নেমন্তন্ন করছি গিয়ে। বলব তোর মাকে, বাড়ি থেকে আমরা সবাই আমাদের চন্দননগরের বাড়িতে যাচ্ছি, ইলাও চলুক আমার সঙ্গে। ফিরতে রাত হয়ে গেলে ভাববেন না। তারপর অবশ্য কোনো আকস্মিক অনর্থপাতে রাত হয়ে যাবে। আমি বাড়ি থেকে ফোন করে দেব, ইলা আজ এখানেই–

    ইলা রাগ করে বলে, আমাদের বাড়িতে ফোন কোথায়?… আর সে তুই যতই খবর দিস, বাবা ঠিক এসে হাজির হবেন। রাত দুটো বাজলেও।

    বেশ, তবে বলব চন্দননগরে থাকা হবে একটা রাত।

    ইলা মাথা নেড়ে বলল, তাহলে তো আসতেই মত দেবেন না।

    সম্বুদ্ধ বলে, ঠিক আছে। চল, এখনই গিয়ে দুজনে প্রণাম করে আসি, সব গোল মিটে যাক।

    ইলা শিউরে উঠে বলল, ওরে বাবা! সে অসম্ভব।

    তবে নিরীহর মতো যাবি চন্দননগরে, রাতে ফিরবি না। আমি সকালে তোকে এনে দেব সঙ্গে করে, বলব রাতে ভীষণ জ্বরে ধরেছিল–

    হেসে গড়িয়ে পড়ে কুমকুম।

    কিন্তু ইলা এই হাসি-তামাশার মধ্যে নিজেকে পৌঁছতে পারে না। ইলার বুকের মধ্যে ভয়ানক একটা যন্ত্রণা ধাক্কা দিচ্ছে। ইলা যেন এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে।

    এদের কাউকেই এখন ভালো লাগছে না। অসীম কুমকুম কাউকে না।

    মনে হচ্ছে এতদিন ধরে ওরাই যেন তাকে প্ররোচনা দিয়ে দিয়ে একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

    সম্বুদ্ধও। সম্বুদ্ধকেও যেন এখন ভয়ের মতো মনে হচ্ছে।

    তাই ইলা কুমকুমের হাসির পর নীরস স্বরে বলে, ও-সব কথা রাখ, ও হবে না। রাত দশটা সাড়ে-দশটার মধ্যে যাতে ফেরা যায় সে-রকম কোনো ব্যবস্থা–

    সম্বুদ্ধও প্রায় রেগে ওঠে।

    সম্বুদ্ধ বলে, তা তোমার যখন এত অসুবিধে, তখন থাক না হয়।

    ইলা ভ্রভঙ্গি করে। বলে, তা, তোমার যদি খুব সুবিধে থাকে তো চল না তোমাদের বাড়িতেই। তোমার বউদিরা ফুলের বিছানা পেতে রাখুন, বরণডালা সাজিয়ে বসে থাকুন। আমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়ে উঠছি।

    সেটা হবে না।

    এইটাই হচ্ছে কথা। অগাধ লোক সম্বুদ্ধদের বাড়িতে। আর তারা নাকি মারাত্মক রকমের সেকেলেপন্থী। এখনও ব্রাহ্মণ-কায়স্থে বিয়ে অনুমোদন করে না। সম্বুদ্ধ যে এই বিয়েটা করেছে, সে শুধু শীঘ্রই একটা ভালো পোস্ট পেয়ে মাইশোরে চলে যেতে পারবে বলে। যতদিন না যাচ্ছে, ততদিন যা হোক করে–

    শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, শুধু কুমকুমের বাড়িতে নেমন্তন্নর ছুতো করে রাত দশটা পর্যন্ত কোনো একটা হোটেলে গিয়ে

    একবার অন্তত একত্র রাত্রিবাস না হলে বিয়েটা মঞ্জুর হবে কি করে?

    কুমকুম হেসেই অস্থির, কী ভীতু তুই বাবা! বিয়ে হয়ে গেল, তবু এখনও এত ভয়?

    চুপি চুপি কানে কানে বলল ইলার। বলল, এখনও কি পরপুরুষ বলে মনে হচ্ছে নাকি রে? কৌমার্য-ভঙ্গের অপরাধে কেস করবি?

    ইলা আরক্ত মুখে বলল, থাম। অসভ্যতা করিসনে। আর মনে মনে বলতে লাগল, সে-কথা তো অস্বীকার করতে পারছি না। বিয়ে হয়ে গেছে, এ-অনুভূতি কই আমার?

    প্রতিদিনের চেহারায় নতুন কি রঙ লাগল?

    তারপর ভাবল, ছি ছি! লুকোচুরি করে আবার বিয়ে! নাঃ, আজই খুলে বলব। যা থাকে কপালে। মায়ের কাছে হয়তো পারব না, দিদির কাছে বলব।

    তারপর অকারণেই নিজেকে ভারী দুঃখী মনে হল ইলার। যেন কে ওকে খুব বড়ো ঠকানো ঠকিয়েছে।

    ওই, ওই লোকটা। ভালোমানুষের মতো বসে আছে এখন।

    ওই তো বিয়ে বিয়ে করে এত অস্থির করেছে।

    অবশ্য তার দিকে যুক্তি এই—তুমি যখন বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত অপাপবিদ্ধা থাকতে চাও, পৃথিবীর ধূলি-মালিন্যের ছায়া দেখলে শিউরে ওঠ, তখন, বিয়েটার জন্যে ব্যস্ত হওয়া ছাড়া উপায় কি আমার?

    তা কই? বিয়ে হলেই বা কী লাভের আশা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে?

    আসল কথা, রাজপথ ছেড়ে গলি রাস্তা ধরলে হবেই অসুবিধে।

    বিয়ে। বিয়ে না ছাই। মনে মনে ভাবতে থাকে ইলা, একে আবার বিয়ে বলে। সকাল থেকে সাতবার খেয়ে, নিত্যি-পরা একটা শাড়ি পড়ে নিজে নিজে এলাম আমি বিয়ে করতে! ছিঃ! জীবনের এই পরম শুভদিনে, মা-বাপের সঙ্গে পঞ্চাশ গণ্ডা মিথ্যে কথা বলতে হচ্ছে আমায়। আর—আর স্বামীর কাছে প্রথম আত্মনিবেদনের রাত্রিটি আসবে অবৈধ মিলনের আতঙ্কিত কুৎসিত চেহারা নিয়ে।

    বারে বারেই চোখে জল আসে ইলার।

    .

    গল্পে মন বসে না, পরামর্শে মন বসে না। ইলা বলে, আমি যাই এবার।

    আমরা ঠিক করেছিলাম চারজনে একটা সিনেমা দেখে তবে—

    না-না, মা-র কাছে ধরা পড়ে যাব।

    সম্বুদ্ধ রাগ করে। কিন্তু বলতে পারে না,–পড় ধরা, আমি আছি।

    ও থাকবে। পরে থাকবে।

    যখন মাইশোরের চাকরিটার তারিখ আসবে, এখানের কাজের তারিখ শেষ হবে। তখন সম্বুদ্ধ ইলার মা-বাপের নাকের সামনে বিয়ের এই দলিলটা ধরে দিয়ে, তাদের মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে। এই পরিকল্পনা সম্বুদ্ধর। নিজের বাড়ির সামান্যতম সাহায্যমাত্র নেবে না। কেউ যেন বলতে না পারে ঠাকুরপোর বিয়ে দিলাম আমরা।

    .

    দিদির বাড়ি ইলাদের বাড়ির কাছেই।

    ইলা ভেবেছিল আগে দিদির বাড়ি নেমে দিদির কাছে অপরাধ ব্যক্ত করে ফেলবে।

    হয়ে গেছে বিয়ে, আর তো লাগিয়ে দিয়ে তাদের জীবন-তরণীকে বিশবাঁও জলে ঠেলে দিতে পারবে না দিদি-জামাইবাবু।

    বলবে। না বলে থাকতে পারবে না।

    এতখানি ভার বহন করে ঘুরে বেড়ানো বড়ো কঠিন। কিন্তু হল না।

    শুনল দিদিরা ও-বাড়িতেই গেছে।

    বলল দিদির বাড়ির চাকর।

    শুনে হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিথর হয়ে এল ইলার। কেন! কেন হঠাৎ?

    এ-ঘটনা যে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন ঘটে, সন্ধ্যাবেলা যে দিদি বাপের বাড়ি, আর জামাইবাবু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে থাকে, সে-কথা মনে পড়ল না ইলার। ওর মনে হল সব বোধ হয় ফাস হয়ে গেছে।

    আর ওঁরা সবাই একত্রিত হয়ে বোধ হয় ইলার জন্যে ফাঁসি-কাঠের ব্যবস্থা করছেন।

    সম্বুদ্ধ যে ওকে আশ্বাস দিয়েছিল, আইনত তোমায় কিছু করতে পারবেন না ওঁরা, তুমি নাবালিকা নও। বড়োজোর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। তা সেও লোকে পারে না। কেলেঙ্কারির ভয় আছে। লোকলজ্জার ভয় আছে। ওইখানেই জব্দ গার্জেনরা—সে আশ্বাসও কাজে লাগছে না।

    পালাবে? কিন্তু কোথায়?

    কে বরণডালা নিয়ে বসে আছে ইলার জন্যে?

    আস্তে আস্তে বাড়ি এল।

    বাইরে থেকে জামাইবাবুর দরাজ গলার হাসি শুনতে পেল।

    যাক, তবে পরিস্থিতি খুব খারাপ নয়। বোধ হয় ফঁস হয়ে যায়নি।

    স্বস্তিবোধ করে এগিয়ে আসে, আর আবার সেই হাসির আওয়াজ যেন বসবার ঘরটার ছাদ ভেদ করে। ওই রকম আমুদে মানুষ হেমন্ত। দরাজ হাসি, দরাজ গলা, প্রচুর খাওয়া, প্রচুর স্বাস্থ্য। জামাইবাবুকে ইলার খুব ভালো লাগে।

    .

    কিন্তু আজ হঠাৎ জামাইবাবুর ওপর খুব একটা হিংসে হল ইলার।

    শ্বশুরবাড়িতে এসে দিব্যি জমিয়ে বসেছেন ভদ্রলোক। প্রায় রোজই আসেন, তবু মায়ের জামাই-আদরের কমতি নেই।

    জামাতা না দেবতা!

    অথচ ইলার বর এই আদরের কণিকাপ্রসাদও পাবে না। ইলার বর কোনোদিন এ-বাড়িতে এমন জমিয়ে বসে দরাজ গলায় হাসতে পাবে না।

    অথচ সম্বুদ্ধ কম বাক্যবাগীশ নয়। কথায় তার ছুরির ধার।

    মা বলেন, আমার বড়ো জামাইটি যেমন, ছোটোটি যদি তেমন হয় তবেই আমোদ। তা এমনটি কি আর হবে? হয়তো গোমড়ামুখোই হবে।

    মা-র সেই ছোটো জামাইয়ের মুখটা কেমন, তাই দেখবেন না মা।

    এ-বাড়িতে কি কোনোদিন আসেনি সম্বুদ্ধ?

    এসেছে।

    বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে, ইলার ছোটো ভাই কি চাকরের সঙ্গে কথা বলেছে। কথা আর কি, ইলাকে ডেকে দেওয়ার কথা। একদিন ইলার বাবা দোতলার বারান্দা থেকে দেখেছিলেন। বলেছিলেন, নীচে ছেলেটি কে সেই থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে?

    ইলা বলেছিল, ওঁর ভাগ্নীর সঙ্গে পড়েছিলাম আমি, লাইব্রেরির একখানা বই ছিল ওঁর কাছে—

    তাড়াতাড়ি নেমে গিয়েছিল ইলা এই ফাঁকা উত্তরটা দিয়ে।

    পরে বলেছিল সম্বুদ্ধকে কিরকম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তা বল? আমাদের ক্লাশের নন্দিতা বলে একটা মেয়ে বলেছিল, ওই যে কবিতা-টবিতা লেখেন সম্বুদ্ধ ঘোষ, উনি আমার সম্পর্কে মামা হন। কাজে লাগিয়ে দিলাম কথাটা। তা ছাড়া লাইব্রেরির বইটাও দিলাম ঢুকিয়ে।

    কিন্তু এত বুদ্ধি প্রকাশ করেই কি পার পেয়েছিল নাকি ইলা? পরে বারবার জেরা করেননি ইলার বাবা? ছেলেটি কে? কোথায় থাকে? নাম কি? ইত্যাদি।

    এমনভাবে বলেছেন, যেন জেরা নয়, শুধু গল্প করা।

    নামটা শুনে ভুরুটা একবার কুঁচকে ছিলেন। কিন্তু এ-কথাটা তো বলতে পারেননি, ঘোষেদের ছেলের সঙ্গে মেশবার এত কি দরকার তোমার?

    তাই বলেছিলেন, রাস্তায় ঘোরে, এটা দেখতে ভালো নয়। বাড়িতে এনে বসাও। তোমার মা-র সঙ্গে আলাপ করে দিও। খুশি হবেন।

    ইলা বলতে পারেনি খুশি হবার মতো কি পাবেন মা-বাবা? মা তো কারও সামনে বেরোতেই চান না। এখনও সেই মধ্যযুগীয় প্রথায়।

    .

    বড়ো জামাইয়ের সঙ্গেও প্রথম প্রথম ঘোমটা দিয়ে কথা বলতেন ইলার মা। এখন খুব ফ্রী। সম্বুদ্ধর সঙ্গে মা-র এই ফ্রী কি জীবনে আসবে?…যদি সম্বুদ্ধর কথামতো পরে ভবিষ্যতে সব ঠিক হয়ে যায়ও।

    হয় না। কাটা গাছ জোড়া লাগে না।

    ভাঙা মন ঠিক খাপ খায় না।

    ঘোষের ছেলেকে কিছুতেই সমাদরে জামাই বলে গ্রহণ করবেন না অমলা!

    হিংসের নিশ্বাসটা ত্যাগ করে আস্তে ঘরে এসে ঢুকল ইলা।

    আর সঙ্গে সঙ্গে আর একবার মনে হল তার এই সুখস্বর্গ থেকে স্খলিত হয়ে পড়েছে সে। এই জমজমাট মজলিশের মাঝখানে কোনোদিন আর এসে বসতে পারবে না।

    ইলা দুঃখী। ইলা নির্বোধ।

    .

    ওকে দেখেই দিদি হইহই করে উঠল। এতক্ষণে আসা হল মেয়ের! কোথায় থাকিস সন্ধে পার করে?

    ওই তো, অমলা বলে ওঠেন, রোজ সেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি। কী যে এক রিসার্চ ধরল। চেহারা হয়েছে দেখ না! সেই ভর দুপুরে বেরিয়ে—নিসনি তো ছাতা!

    ছাতা।

    এতক্ষণে মনে পড়ল ইলার, ছাতা বলে একটা বস্তু ছিল তার কাছে। ছিল, এখন আর নেই। কে জানে কোথায় পড়ে আছে। অতএব একটু হাসল। দিদি বলল, এখন আর দেরি করে লাভ নেই, উঠছিলাম। এই চটপটই বলি—একটি ছেলের ফটো এনেছি, দেখ দিকি কিরকম লাগছে? পছন্দ অপছন্দ খুলে বলিস বাপু। তোর জামাইবাবুর আবার অনেক ঢং কি না। বলেন, আগে ছোটোশালী পাত্রের চেহারাটা অ্যাপ্রুভ করুক, তারপর কথা পাড়া যাবে।

    ইলার মাথা থেকে পা অবধি একটা বিদ্যুৎ-প্রবাহ বহে যায়।

    ছেলের ফটো!

    বিয়ের তোড়জোড়! হঠাৎ আজই!

    এটাই কি তাহলে এদের শাস্তির ধরন নাকি? ফাঁস হয়ে গেছে ইলার গোপন তথ্য, সেটা নিজেরা জেরা না করে ইলার মুখ থেকেই বার করতে চায়? নইলে আজই কেন? বুক কেঁপে ওঠে ইলার, তবু মুখে হারে না। বলে জামাইবাবুর বিবেচনার শেষ নেই। তবে বিবেচনাটা মাঠে মারা গেল। আমি ওই সব পাত্ৰাপাত্রের মধ্যে নেই।

    ইলার বাবা ছিলেন না ঘরে, মা ছিলেন। বলে উঠলেন বেশ একটু ঝঙ্কার দিয়েই। তা থাকবে কেন? দুপুর রোদ্দুরে টো টো করে ঘুরে শুধু বস্তা বস্তা বই গিলবে।…

    মা হঠাৎ আজকেই দুপুর রোদ্দুরের কথা তুললেন। অথচ প্রায়ই তো যায় ইলা।

    নির্ঘাত।

    নির্ঘাত।

    ওঁরা কিন্তু আর বেশি বললেন না।

    ইলার দিদি নীলা বলল, যথেষ্ট আদিখ্যেতা হয়েছে, রাখ তুলে। ফটোটা নিয়ে যা, ঘরে রাখ গে, নির্জনে বসে দেখগে যা।

    হেমন্ত বলে, আর সেই যে ছেলের গুণাবলী লিপিবদ্ধ করে এনেছিলে, সেটাও দিয়ে দাও শালীকে। এক সঙ্গে রূপ-গুণ দুইয়েরই বিচার হয়ে যাক।

    হুঁ, তোমার যত অসভ্যতা! নীলা বলে, ওটা বাবাকে দেখাব বলে নিয়ে এসেছি–

    আহা বুঝলাম! কিন্তু যে-মহিলা বিয়েটা করবেন তাকে আগে দেখানোই যুক্তিসঙ্গত।

    তা, যুক্তিসঙ্গত কাজই করে নীলা। ইলার শোবার ঘরের টেবিলে ছবিটা আর লেখাটা রেখে দিয়ে আসে।

    লজ্জাশীলা এখন লজ্জা করছেন, একা ঘরে নিবিষ্ট হয়ে দেখবেন।

    ছবি হেমন্তর অফিসের এক সহকর্মীর ভাইপোর। সম্প্রতি ওদেশ থেকে ঘুরে এসেছে, এদেশ থেকে যথারীতি শিক্ষাদীক্ষা শেষ করে।

    ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আর চেহারাখানা দেখুক ইলা।

    রঙ অবিশ্যি ফরসা নয় বলে গেছে নীলা। সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছে, পুরুষ-মানুষের ফরসা রঙ একটা কুদৃশ্য।

    হেমন্তর রঙ ফরসা।

    তাই এই ধারালো কটাক্ষ নীলার।

    দুপুর রোদ্দুর থেকে পরা শাড়ি-ব্লাউজ বদলাতে ইচ্ছে করছিল ইলার, কিন্তু কী যে এক লজ্জা এল! মনে হল, মা হয়তো ভাববেন মেয়ে ওই ছবিটা দেখবে বলেই শাড়ি বদলানোর ছুতো করে ঘরে ঢুকল।

    অথচ এই আজই ইলার বিয়ের এই তোড়জোড় দেখে তো হাসিই পাবার কথা।

    বারবার ইচ্ছে হল ইলার, মনে মনে খুব হাসে। হাসে এঁদের এই গতানুগতিক প্রথার পথ ধরে মেয়ে পারের চেষ্টা দেখে, মেয়ে যে ইতিমধ্যে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেছে, একথা ভেবে হাসে, কিন্তু পারে না।

    বরং ভয়ানক যেন একটা অভিমান আর আক্রোশ আসে। বলতে ইচ্ছে করে, এতদিনে টনক নড়ল তোমাদের? কটা দিন আগে হলেও হয়তো এমন করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম না।

    কটা দিন কেন, কাল, গত কাল রাত্রেও যদি দিদি আসত, হয়তো আপাতত পিছিয়ে রাখতাম সম্বুদ্ধকে।

    আজ, আজ আসার বাসনা হল দিদির।

    তারপর হঠাৎ খেয়াল হল এই চিন্তাগুলো সম্বুদ্ধর প্রতি তার নিষ্ঠার পরিপন্থী।

    ছি ছি, এসব কি ভাবছে সে।

    বরং ভাবা উচিত, ভাগ্যিস বাবা-মা এর আগে মেয়ের বিয়ের চিন্তা করতে বসে যাননি। তাহলে হয়তো লড়াইয়ের মুখে পড়তে হত।

    কোথাকার কে এক ইঞ্জিনিয়ার—তার ছবি দেখতে আমার দায় পড়ে গেছে।

    শাড়ি বদলাতে গেল খেতে বসার আগে। দিদি চলে গেছে তখন।

    তাড়াতাড়ি চলে এল, কিছুতেই না মা ভাবতে পারেন ছবিটা দেখছে ইলা।

    খিদের নাম ছিল না, তবু খাবে না বলতে অস্বস্তি। যদি মা প্রশ্ন করেন, খিদে নেই কেন? কোথাও কিছু খেয়ে এলি বুঝি? তাই খেতে বসা।

    বিয়ে করে বেরিয়ে বিয়ে হওয়া বিয়ে হওয়া ভাব মনে আসেনি, এল এখন। মায়ের সঙ্গে খেতে বসে।

    ঠিক বিয়ে হয়ে যাওয়ারই যে অনুভূতি তাও নয়, তবু কিছু যেন একটা হয়ে যাওয়া। কেন আজ সকালে যে-ইলা মায়ের সঙ্গে খেতে বসেছিল, সে-ইলা নয় সে। এখনকার এই ইলা, অন্য ইলা, আর একজন ইলা।

    মায়ের সঙ্গে যেন বহুযোজন দূরত্ব এসে গেছে এ-ইলার। খেতে বসে দুই মায়ে-ঝিয়ের সেই প্রাণ-খোলা আর গলা-খোলা গল্পের স্রোত যেন আর বইবে না। যেন বড়ো একখানা পাথরের চাই এসে পড়েছে তার মুখে।

    খাচ্ছিস না তো মোটে–

    বললেন অমলা।

    ইলা বলল, খাচ্ছি তো! খেতে লাগল জোর করে।

    মা মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন, হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে মনটা উচাটন হয়েছে।

    হবে, হতেই পারে।

    অমলার যখন প্রথম বিয়ের কথা হয়েছিল, সাতদিন খেতে পারেনি ভালো করে।

    হেমন্তর যেমন কাণ্ড, আগে কনে পাত্র পছন্দ করবে, তবে নাকি বিয়ের প্রস্তাব। শুনেও বাঁচি। ক্রমশ দেশের চাকা যেন ঘুরে উলটে গেছে। তা, এ-ছেলেকে আর অপছন্দ করতে হয় না। গুণেই তো পছন্দ। তাছাড়া দেখতেও ভালো। রঙ ময়লা বলেছে, সে তো ফটোতে তত বোঝাও যাচ্ছে না। এমনিতে নাক-মুখ-চোখ পরিষ্কার তী, যাকে প্রশস্ত ললাট বলে, তাই। আর সবটা মিলিয়ে একটা বুদ্ধিদীপ্ত পরিচ্ছন্নতা। অমলার খুব ভালো লেগেছে।

    অমলার মেয়েরও লাগবেই।

    .

    তা, অমলার অনুমান হয়তো মিথ্যা নয়। অমলার মেয়ে সেই ছবিখানা হাতে নিয়ে বসে রয়েছে দীর্ঘ একটা সময়। রাত্রে ঘুমের সময়।

    অমলার ঘরের পাশেই ইলার এই ছোট্ট ঘরটা। মাঝখানে দরজা, পরদা ফেলা থাকে। মানে থাকত।

    সম্বুদ্ধর সঙ্গে ভাৰ হবার পর থেকেই কৌশলে ওই দরজাটা বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ইলা। বলে, পড়ার অসুবিধে।

    কেন?

    খুব স্পষ্ট একটা কারণও অথচ নেই। মাঝে মাঝে চিঠি লেখার শখ ইলার, তাই লেখে। সেটা কিছু না। আসলে নিজেকে একলা করে নিয়ে বসার একটা আলাদা সুখ, আলাদা রোমাঞ্চ।

    মাঝখানের দরজা খোলা থাকলে মনে হয় যেন ইলার চিন্তাগুলো মা-র কাছে গিয়ে পৌঁছচ্ছে। যেন মায়ের চোখ ইলার নিভৃত হৃদয়ের দরজায় এসে দৃষ্টি ফেলছে। পরাধীনতার একটা বন্ধন যেন লেগে থাকে সর্বাঙ্গে। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন লাগে।

    তাই এ ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

    আজও দরজাটা বন্ধ করে দিল। বেশ একটা নিশ্চিন্ত সুখের আশা পেল যেন। বসল বিছানায়।

    ভাবল ওই ছবি ওখানে থাক পড়ে। দায় পড়েনি আমার কার-না-কার একটা ছবি দেখতে। আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল না।

    বসেই রইল।

    বসে থাকতে থাকতে মন ঘুরে গেল। ভাবল, দেখলেই বা কী?

    ওই একটা ছবি দেখা না-দেখায় আমার কি এসে যাবে? বরং ওই না দেখে ফেলে রাখাটাই ওকে বড়ো বেশি গুরুত্ব দেওয়া যেন।

    নিক্তির কাঁটা এদিকে ঝুঁকল।

    ছবিখানা অবহেলাভরে হাতে তুলে নিল। একবার দেখেই ফেলে রাখল। তারপর আবার যেন নতুন কিছু একটা কৌতূহলে ফের তুলে নিল।

    তারপর দেখছে।…দেখে দেখে যেন শেষ হচ্ছে না।

    মুখ-চোখ মন্দ নয় লোকটার।

    নেহাত বোকাটে বলেও মনে হচ্ছে না।…বিলেত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার শুনছি, বোকা হবার কোনো কারণও নেই অবশ্য।

    তা, কনে একটা ভদ্রলোকের জুটবেই ভালো মতো।

    ওদের বাড়িটাও ভালো বলেই বোধ হয়। সম্বুদ্ধদের মতো গোয়ালবাড়ি নয়। ভালো ভাবছি এই জন্যে, মা-বাপ আছে বলছিল দিদি, আর সে মা-বাপ যখন খরচা করে বাইরে পাঠিয়েছে ছেলেকে, ভালো হওয়াই স্বাভাবিক।…

    নিজেদের জানাশোনা কারুর সঙ্গে বিয়েটা হলে মন্দ হত না। একটা জানা মেয়ের ভালো বিয়ে হত।

    জানা মেয়ে খুঁজতে লাগল মনে মনে। হরিকাকা, মেয়ের বিয়ে বিয়ে করে পাগল হচ্ছেন।

    হন বাবা! এই রূপে-গুণে আলো করা ছেলের সঙ্গে হরিকাকার মেয়ে! ছি ছি! বিদ্যে-বুদ্ধির বালাই মাত্র নেই মেয়েটার।

    ন-মামার মেয়ে অতসী?

    নাঃ, সে মেয়ে তো একটি ফ্যাশনের অবতার।

    কেন একটা ভালোমানুষ ছেলের মাথাখাওয়া হবে!

    বেলামাসির মেয়েটাও বিয়ের মতো হয়েছে, কিন্তু টাকাই আছে বেলামাসিদের, কালচার নেই।

    তবে কে? তবে কাকে?

    আরও অনেক মাসি-পিসি-কাকার কথা মনে মনে তোলপাড় করল ইলা। যাঁরা নাকি মেয়ের বিয়ের কথা বলে থাকেন। একটাকেও পছন্দ হল না। কোনোটাকেই যোগ্য মনে হল না।

    এই সভ্য-ভব্য মার্জিত চেহারার লোকটার সত্যিকার একটা ভালো কনে হওয়া উচিত।

    কে কোথাকার ওই লোকটার কনের চিন্তায় ইলা কেন মাথা ঘামাচ্ছে, সে কথা ভাবল না ইলা।

    আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ার পরও আরও অনেকক্ষণ ঘামাতেই লাগল মাথা।

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article দুই নায়িকা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }