Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম

    জাহানারা ইমাম এক পাতা গল্প89 Mins Read0

    নয় এ মধুর খেলা – ৫

    ৫

    একটানা সারাদিন ঘুমিয়ে সন্ধ্যার মুখে চোখ মেলল সাব্রিনা। তখন তার চারপাশে বসে ছিল তার মা-বাবা, তার তিন ছেলেমেয়ে, টিনা, হাসান। তাকে চোখ মেলতে দেখেই তার তিন ছেলেমেয়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর—মা, মা, মাগো তুমি ভালো আছ তো?’

    সাব্রিনা দুর্বল দুই হাতে ওদের গলা জড়িয়ে ধরে ফ্যাকাশে হাসি হাসল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালো আছি। তোরা খেয়েছিস?

    ‘আমরা খেয়েছি। তোমারই তো সারাদিনে খাওয়া হয়নি।’

    ‘এখন খাব। হ্যারে খুশ, জাম, জেরি—তোরা আমাকে একটা কথা দে তো

    সাব্রিনার কথা শুনে তার তিন ছেলেমেয়ে, তার বাবা-মা, টিনা, হাসান সবাই অবাক হয়ে গেল। কী বলছে সাব্রিনা?

    খুরশেদ বলল, ‘কী কথা মা?’

    সাব্রিনা থেমে থেমে বলল, ‘তোরা কথা দে, তোরা কখনো আমায় ছেড়ে যাবি না।

    হাসিনা বেগম মৃদুকণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘ও কী বলছিস আবোল-তাবোল?’

    সাব্রিনা তীব্র আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘না, না, আমি ঠিক কথাই বলছি, ওদের বাবা ষড়যন্ত্র করেছে ওদেরকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে—আমাকে আর দেখতে দেবে না ওদের। খুশ, জাম, জেরি—তোরা কিরে কর, তোরা আমাকে ছেড়ে যাবি না—

    ‘খুরশেদ, জামশেদ, জেরিনা তিনজনেই ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘না মা, আমরা ককখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।’ সাব্রিনাও ওদের জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। টিনা দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলল, ‘ও গড, এ যে নার্ভাস ব্রেকডাউনের চেয়েও যা-তা হল। ও যে মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছে।’

    হাসান উঠে দাঁড়িয়ে টিনাকে বলল, ‘ওর জন্য খাবার নিয়ে এস। আমি ততক্ষণে ওর ব্লাডপ্রেশারটা দেখি।’

    ব্লাডপ্রেশার দেখার সময় সাব্রিনা লক্ষ্মীমেয়ের মতো কান্না থামিয়ে ছেলেমেয়ের গলা থেকে হাত নামিয়ে সোজা করে মেলে দিল। হাসান প্রেশার মেপে বলল, ‘না, কমেনি 1 রিনা, তুমি খাওয়ার পরে আরেকটা ট্রাংকুইলাইজার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’

    সাব্রিনা আঁতকে উঠে বলল, ‘না, না, আমি ঘুমোব না। রাশেদ সেই ফাঁকে এসে ওদের নিয়ে যাবে।’

    মাসুদ সাহেব হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে সাব্রিনার খাটের পাশে এসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোকে কথা দিচ্ছি রিনা, আমি বেঁচে থাকতে কেউ তোর বাচ্চাদের এ-বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। হল তো? এবার খাবার খা। তারপর আরেকটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে থাক্। তুই সুস্থ না হলে বাচ্চাদের দেখাশোনা করবি কী করে? ওদেরকে রাশেদের হাত থেকে বাঁচাবি কী করে?

    সাব্রিনা কৃতজ্ঞ ছল্‌ছল্ চোখে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

    ‘ঠিক বলেছ আব্বা। আমি এখুনি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। তুমি কিন্তু ওদেরকে তোমার সঙ্গে নিয়ে শোবে। তা নইলে রাশেদ ঠিক ওদের ভুলিয়ে নিয়ে যাবে।’

    মাসুদ সাহেব উদ্‌গত অশ্রু চোখে চেপে বললেন, ‘না, রাশেদ ওদের কিছুতেই আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। তুই নিশ্চিন্তে ঘুম যা।’

    টিনা সপ্রশংস দৃষ্টিতে বড়চাচার দিকে তাকিয়ে মনে-মনে খুব তারিফ করল তাঁর উপস্থিত-বুদ্ধির। পাগল হয়ে যাবার লক্ষণ সাবিনার মধ্যে পুরোপুরিই দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় বচচ্চা দৃঢ়মুষ্ঠিতে হাল না ধরলে…

    কিন্তু মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে যেতে-যেতে বারান্দাতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মাসুদ সাহেব। মেঝেতে বসে পড়ে তিনি দুইহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে রইলেন, যাতে কান্নার শব্দ সাবিনার ঘরে না-যায়। সাব্রিনা কেবলে রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমের বড়িটি গিলে চোখ বুজেছে। ঘুমটাই এখন ওর সবচেয়ে দরকারি ওষুধ।

    সে-রাত্রে সাব্রিনা লক্ষ্মীমেয়ের মতো ঘুমোল। কিন্তু গোল বাধল পরদিন সকালে। হয় সালেহা খাতুন নিজেই চাটগাঁয়ে ছেলেকে ফোন করেছিলেন কিংবা রাশেদই ঢাকায় ফোন করে মার কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনেছিল। সে যাই হোক, সে শনিবারের সকালের ফ্লাইটেই ঢাকা ফিরে এল।

    সকালে সাব্রিনা ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে নাশতা করেছে, তার তিন ছেলেমেয়েই তাকে নাশতা খাইয়েছে। তারপর বলেছে ‘তুমি এখন আবার শুয়ে থাক, আমরা নিচে থেকে নাশতা করে আসি।

    সাব্রিনা আজ সকালে অনেকটা স্বাভাবিক। ওরা সবাই ডাইনিংরুমে নাশতা খেতে-খেতে নানা খোশগল্পে মেতে গিয়েছিল। পাক্কা আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে এই প্রথম একটুখানি স্বস্তি। হঠাৎ ওপরে ঝন্‌ঝন্ করে কাচ ভাঙার শব্দ হল এবং সেইসঙ্গে সাব্রিনার চিল-তীক্ষ্ণ চিৎকার। ওরা সবাই হকচকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে একসঙ্গে দৌড়লো দোতলায়। কী হল? কী হল?’

    দোতলার বারান্দায় উঠেই সবাই মুখোমুখি হয়ে গেল রাশেদের। সে উদ্ভ্রান্ত, ভীত, বিহ্বল মুখে দ্রুতপায়ে সিঁড়ির দিকে আসছিল। ওদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর দ্রুতবেগে টিনার সামনে এসে বজ্রমুষ্ঠিতে তার হাত চেপে ধরে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, ‘তুমি। এই যে, তোমাকে বলতে হবে কী করেছ তুমি রিনাকে? কী খাইয়ে ওর মাথা গোলমাল করে দিয়েছ? কেন আমার বাড়িতে রাতদুপুরে লালমুখো সায়েব যায়? কেন রিনা আমায় গ্লাস ছুড়ে মারে?’

    হাসান এবং মাসুদ সাহেব একসঙ্গে রেগে গিয়ে ‘এ কী বেতমিজি হচ্ছে?’ বলে এক ধাক্কায় রাশেদকে সরিয়ে দিলেন। মাসুদ সাহেব কঠিনকণ্ঠে বললেন, ‘তুমি না-জানিয়ে চোরের মতো দোতলায় উঠেছ কেন? আমার মেয়ে অসুস্থ, তাকে তুমি উত্তেজিত করেছ। তার যদি কিছু হয় তাহলে তোমার নিস্তার নেই জেনো। তোমার সব কুকীর্তির কথা আমরা জেনে গেছি। ভালো চাও তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এ-বাড়ি থেকে।

    রাশেদের মুখ হিংস্র হয়ে উঠল। বড়চাচা, অভিভাবক এবং শ্বশুর বলে কোনো মান্যজ্ঞান রইল না, চেঁচিয়ে বলল, ‘যাব, তবে আমার বউবাচ্চাদের নিয়ে। তার আগে নয়।’

    হঠাৎ সাব্রিনার তীব্র চিৎকার শোনা গেল, ‘খুশ, জাম, জেরি কোথায় তোরা? আব্বা গো, আমার বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কিছু করছ না—’ বলতে বলতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল সাব্রিনা এবং বারান্দার মেঝেতে পা পিছলে পড়ে জ্ঞান হারাল।

    মুহূর্তের জন্য সবাই হতভম্ব হয়ে গেল, তারপরই ‘হায় হায় এ কী হল!’ বলতে বলতে ছুটে গেল সামনের দিকে। হাসান, খুরশেদ আর টিনা সাব্রিনার অচেতন দেহ তুলে ঘরে নিয়ে গেল। জামশেদ, জেরিনা কাঁদতে কাঁদতে মার সঙ্গেসঙ্গে ঘরে ঢুকে গেল। মাসুদ সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘দেখলে তো, কী সর্বনাশটা তুমি করলে আমার মেয়ের? বেরোও, এক্ষুনি বেরোও—’

    হাসান ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাশেদের কাঁধে হাত রেখে মোলায়েম গলায় বলল, ‘নিচে এসো রাশেদ, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’ বলে তাকে টেনে নিচে নিয়ে গেল। যেতে-যেতে বলল, ‘যে কারণেই হোক, আর যার দোষেই হোক, সাব্রিনার মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সতর্ক না হলে ওকে আর কোনোদিনই ভালো করে তোলা যাবে না। এ সময়ে তোমাকে ধৈর্য ধরতেই হবে রাশেদ। তোমার মায়ের ভার্সন শুনে খেপে তোমার কোনো লাভ হবে না ভাই। তুমি এখন বাড়ি যাও। ক’দিন এ বাড়িতে এসো না। আমিই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।’

    পোর্টিকোতে রাশেদের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। হাসান কথা বলতে বলতে রাশেদকে ধীরে আকর্ষণ করে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। মনিবকে দেখে ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই হাসান হাতের মৃদু চাপে রাশেদকে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিল। ড্রাইভারকে বলল, ‘সাহেবকে বাড়ি নিয়ে যাও।’

    পরের ক’দিন সাব্রিনার অবস্থা খুব খারাপ গেল। পড়ে গিয়ে ডান গাল, কাঁধ, বাহু ছেঁচে কালসিটে পড়ে গেছে। ভাগ্য ভালো, কোথাও ভাঙেনি বা কাটেনি। কিন্তু জ্বর এল। শরীরের ডানপাশে অসহ্য ব্যথা, নড়তে পারে না; তার মধ্যে সে খুশ, জাম, জেরিকে ঘর থেকে বেরোতেই দিল না। তার এক কথা, এক চিৎকার, রাশেদ ওদের ধরে নিয়ে যাবে। আর কোনোদিনও তাকে দেখতে দেবে না। ওদেরকে মায়ের ঘরে বসে খেতে হল, রাতে মায়ের ঘরে ঘুমোতে হল।

    ওদিকে রাশেদ আর তার মা ক্রমাগত এ-বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল, মাসুদ সাহেব থানায় খবর দিয়ে একটা পুলিশগার্ড মোতায়েন করলেন গেটে। খুরশেদদের স্কুল যাওয়া বন্ধ, তাদের পড়াশোনা মাথায় উঠল। হাসান আগেই মনোবিজ্ঞানী ডা. আহমেদকে কল্ দিয়েছিল বাসায়। তিনি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন সব ঘটনা শুনে ডা. আহমেদ পরামর্শ দিলেন সাব্রিনাকে এই পরিবেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে।

    তখন হাসান, টিনা, মাসুদ সাহেব, হাসিনা বেগম পারিবারিক মিটিঙে বসলেন। ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ থেকে হাসানের বাবা-মাও এসে গেছেন। অনেক আলাপ-আলোচনার পর স্থির হল, সাব্রিনাকে ছেলেমেয়েসহ নিউইয়র্কে ওর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

    হাসান বলল, ‘নিউইয়র্ক পাঠানোটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কিন্তু তার আগে ব্যাপারটা রাশেদকে জানাতে হবে।’

    মাসুদ সাহেব উত্তপ্ত স্বরে বললেন, ‘ওই পশুটাকে আবার জানানোর দরকার কী?’

    হাসান বিনীত স্বরে বলল, ‘না বড়চা। রাশেদ খুশ, জাম, জেরির বাবা। বাচ্চাদের ওপর ওর একটা আইনগত অধিকার রয়েছে। ওর এখন দুইকান কাটা, ওর আর চোখের পর্দা নেই, তাই ও একটা যা-তা কাণ্ড করে হৈ চৈ ফেলে দিতে পারে। সেটা আমাদের পরিবারের জন্য মোটেও সুখের হবে না। তাছাড়া ঢাকা এত ছোট জায়গা—আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠবে। তাদের এ-বাড়িতে বেড়াতে আসা বেড়ে যাবে। যেখানে-সেখানে মুখরোচক কথার আড্ডা বসবে, সেগুলো আবার আমাদের কানে আসবে। না বচচা, সেসব সহ্য হবে না। আপনারা এদিকে এদের পাসপোর্ট-ভিসা করতে থাকুন, নিউইয়র্কে হাসিবকে ফোন করে সব জানান। রাশেদকে বোঝানোর কাজটা মা-ই ভালো পারবেন। মেচাচিকেও বোঝাতে হবে।

    হাসানের মা বললেন, ‘হ্যাঁ, ছোটবেলায় ও তো মানুষ হয়েছে আমার কোলে। ওর ওপর আমার বিশেষ দাবি আছে। আমি ওকে ঠিক বুঝিয়ে মানিয়ে নেব।

    হাসিনা বেগম বললেন, ‘হ্যাঁ, এইটাই সবদিক দিয়ে ভালো পন্থা। আসলে রাশেদ ও তো আমাদের পর নয়, আজকালকার জমানা যা হয়েছে তাতে হাতে অঢেল টাকা হলে অনেকেই আর সামাল দিতে পারে না। আর রিনারও দোষ আছে। সে এত চাপা হল কেন? সে তো আগে আমাদের কিছু বলতে পারত। তাহলে নিজের মধ্যে গুমরে গুমরে আজ এমন সর্বনাশটা হত না!’

    টিনা বলল, ‘বচ্চাচি, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। এখন ওকথা বলা খুবই সহজ। তখন রিনার পক্ষে ওটা করা মোটেই সহজ ছিল না।’

    ঠিক হল, হাসানের বাবা-মা কয়েকটা দিন রাশেদের বাড়িতে থাকবেন। বাবা মারা যাবার পর রাশেদ এই ফুপাকেই বাবার মতো জেনে এসেছে। হাসানের মা-ও রাশেদের বিশেষ আবদারের মানুষ।

    রেনে সব খবর পেল টিনার মুখে। সে টিনাকে ভীষণভাবে ধরে পড়ল সাব্রিনার সাথে তার একবার দেখা করিয়ে দেবার জন্য। টিনা সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘সে কিছুতেই সম্ভব নয়। সমস্ত ব্যাপারটা এত অল্প সময়ে এত দ্রুত ঘটেছে যে ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়ার মতো। এ অবস্থায় তোমার মতো একজন লালমুখো সায়েবকে যত ঢাকাঢুকো দিয়েই নিয়ে যাই-না কেন, সেটা ফাঁস হয়ে যাবেই। তা ছাড়া সাব্রিনাও দেখা করতে চায় না।’

    রেনের হৃৎপিণ্ড হঠাৎ লাফ দিয়েই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘সে বলেছে?’

    ‘সেদিন রাত্রেই তো তোমাকে বলে দিয়েছে সে আর তোমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না।’

    রেনে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘সে রাতের কথা বাদ দাও। এই ক’দিনের মধ্যে বলেছে কিনা!’

    টিনা বিরক্ত হল,’এখন সে কি আর বলার পর্যায়ে আছে? এখন তো তার মানসিক ভারসাম্যই নেই।’

    ‘না, না, তোমার কথা ঠিক নয়। সে হঠাৎ মনে খুব আঘাত পেয়েছে বটে কিন্তু মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে যাবে কেন? তুমি একবার তাকে বলো যে আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। এত ঘটনার পর এখন তো সে মত বদলে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতে পারে। পারে না কি? বলো?’

    টিনা আরো বিরক্ত হতে গিয়েও পারল না। রেনের ভেতরের কষ্টটা তার দুইচোখে এমনভাবে ফুটে রয়েছে, দেখে টিনার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। কোমলকণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করব।’

    রেনের মুখে আশার আলো জ্বলে উঠল যেন, সে বলে উঠল, ‘কাল তাহলে এইসময় তোমার বাসায় আসব?’

    টিনার খুব মায়া হল। সে হঠাৎ আবেগাক্রান্ত হয়ে রেনের গলা জড়িয়ে ধরে তার গালে গাল রাখল, তারপর মাথা সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই এসো।’

    পরদিন রাত্রে বাড়ি ফিরতে টিনার বেশ দেরি হল। প্রায় বারোটা। গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকতেই হেডলাইটের আলো পড়ল বারান্দায় বসে-থাকা রেনের ওপর। টিনা গাড়ি থেকে নেমে অবাক কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এত রাত পর্যন্ত বসে রয়েছ!

    রেনে একটু অপ্রস্তুত হাসি হেসে দুইহাত কচলে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে! আমার কোনো কষ্ট হয়নি।

    হাসান রেনের দিকে তাকিয়ে ‘হ্যালো’ বলে ভেতরে চলে গেল। সে সবই জানে কিন্তু রেনে বিব্রত হতে পারে ভেবে সে দাঁড়াল না। রেনে টিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওয়েল?’

    টিনা বলল, ‘সরি রেনে। সাব্রিনা কোনোক্রমেই তোমার সঙ্গে দেখা করবে না। সে তোমাকে বলেছে সমস্ত ব্যাপারটা ভুলে যেতে। সেইরকমই তো কথা ছিল তোমার সঙ্গে। তুমি যেখানে বদলি হয়েছ, সেখানে চলে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করো। সাব্রিনা তার বাচ্চাদের নিয়ে শান্তিতে বাস করতে চায়।’

    রেনের মুখ থেকে সমস্ত রক্ত সরে গিয়ে মুখটা কাগজের মতো সাদা দেখাল। সে স্থিরদৃষ্টিতে টিনার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর অদ্ভুত এক নিষ্প্রাণ ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল, ‘সে আবার তার স্বামীর কাছে ফিরে যাবে। পানিতে ছুরি ডুবিয়ে তুলে নেবার মতো সমস্ত…সবকিছু আবার মসৃণ হয়ে যাবে। ঠিক আছে, তাই যদি সে চায়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। তাকে বোলো, আমি তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করি।’ বলে রেনে বারান্দা থেকে নেমে গেটের দিকে হাঁটা দিল। টিনা অবাক হয়ে চেয়ে রইল—রেনে তাকে শুভরাত্রিও জানাল না।

    রেনে গাড়ি রেখেছিল গেটের বাইরে রাস্তার পাশে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে বহুক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগল আর ভাবতে লাগল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল টিনাকে আর কিছুই বলবে না। কিন্তু চাকরিজীবনের অলিখিত আইনে যা নিষিদ্ধ, সেই কাজটাই সে করবে। সে মালয়েশিয়ায় তার বদলি ক্যান্সেল করিয়ে নিউইয়র্কে পোস্টিং নেবে। টিনা আগামী সপ্তাহেই সাব্রিনাকে নিয়ে নিউইয়র্কে যাচ্ছে। রেনের মালয়েশিয়া যেতে এখনো দেড়মাস দেরি। এই সময়ের মধ্যে সে বদলি ক্যান্সেল করাবে। যদি না পারে, চাকরিই ছেড়ে দেবে। নিউইয়র্ক শহরে অন্য একটা চাকরি যোগাড় করতে তার মোটেও কষ্ট হবে না। সে নিজের কানে সাব্রিনার মুখ থেকে শুনতে চায় যে, সাব্রিনা তাকে চায় না। তার আগে সে পৃথিবীর অন্য কারো মুখের কথা বিশ্বাস করবে না।

    তিন-চারদিন পরে আবার সে টিনার বাসায় গেল। হাসিমুখে বলল, ‘আমি কালকে কাপ্তাই বেড়াতে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। তাই আজকেই তোমাকে বঁভয়াজ বলতে এলাম। কামনা করি তোমাদের যাত্রা শুভ হোক, যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হোক।

    টিনা ভেতরে ভেতরে খুব অবাক হল রেনের এই পরিবর্তন দেখে। কিন্তু মুখে শুধু ধন্যবাদ জানাল। রেনে খুব নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘ও হ্যাঁ, নিউইয়র্কে তোমাদের ঠিকানাটা আমায় দাও তো।’

    টিনা সন্দিগ্ধ-সুরে বলল, ‘তুমি তো যাচ্ছ মালয়েশিয়ায়। নিউইয়র্কের ঠিকানা নিয়ে কী করবে?’

    রেনে ঠোঁট উলটে বলল, ‘সাব্রিনাকে গেটওয়েল কার্ড পাঠাব মালয়েশিয়া থেকে।’

    রেনের নির্লিপ্তভাব দেখে টিনা মনে-মনে একটু আহত হল। একটু নাড়া খেতেই সাহেবের বাচ্চার প্রেম কপূরের মতো উবে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই মন ফিরিয়ে ফেলেছে! কাপ্তাই বেড়াতে যাচ্ছে!

    .

    সাব্রিনার যে কোনোকালে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছিল, তা আজকের এই সাবিনাকে দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নেই। গত দশবছরে তার যেন বয়সও বাড়েনি মনে হচ্ছে। পরিবর্তনের মধ্যে টিনা দেখল চুলটা লম্বা করেছে। দুষ্টু হেসে বলল, ‘যেখানে যেটা স্টাইল, অ্যাঁ? ঢাকায় ছোট চুল, নিইউয়র্কে লম্বা?’

    রেনে হেসে বলল, ‘ওর ডাক্তারির জন্য যত-না, ঐ লম্বা চুল আর শাড়ির জন্য ও বেশি নামকরা।’

    সাব্রিনা ভেংচি কাটল, ‘হ্যাঁ, তাই বই কী! লম্বা চুল আর শাড়ি দেখিয়েই তো অসুখ ভালো করি।’

    রেনে বাঁ চোখ মটকে বলল, ‘অবিশ্বাস করার কিছু নেই, এশিয়ার সাধু-সন্ত, পীর-ফকিররা ঝাড়ফুঁক করেই তো অসুখ সারিয়ে তোলে।’

    রেনের চেহারা, ভাবভঙ্গিরও বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কেবল আরেকটু মোটা লাগে, চোখের কোল ফোলাফোলা দেখায়। সাব্রিনার বড় ছেলে খুরশেদও মা’র সঙ্গে ফ্রাংকফুর্ট বেড়াতে এসেছে। সে বোস্টনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি. করছে। জামশেদ, জেরিনাও বোস্টনেই পড়াশোনা করছে। খুরশেদের বয়স এখন চব্বিশ। একেবারে মা’র মতো মুখের আদল, কিন্তু মা’র মতো চুপচাপ নয়। বাপের প্রণোচ্ছল হৈচৈ করার স্বভাবটা পেয়েছে। সে মাকে খেপানোর মতো গলা করে বলল, ‘মা, তুমি ভেংচি কাটলে কী হবে, রেনের কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এদেশে কত ভারতীয়, বাংলাদেশী মেয়ে বাস করছে; তারা শাড়ি ছেড়ে প্যান্ট, স্কার্ট ধরেছে। তুমি কিন্তু শাড়ি ছাড়নি। বুঝলে খালা, নিউইয়র্কে বরফ যা পড়ে শীতকালে, সেই বরফেও মাকে কোনোদিন প্যান্ট পরতে দেখলাম না। শাড়ির নিচে গোছ পর্যন্ত উঁচু স্নো-বুট। যা দেখায় না মাকে!

    সাব্রিনা এবার ভেংচি কাটল ছেলেকে, ‘যা দেখায় না মাকে! যা, ওঠ, তৈরি হয়ে নে। রুথরা অপেক্ষা করবে।’

    ‘রুথ কে? কোথায় যাবার প্ল্যান?’

    রেনে জবাব দিল, ‘আমার মা’র নাম রুথ। আমার মা-বাবা এখানেই থাকেন তো। ওঁদের সঙ্গে দেখা করতেই এবার আসা। বহু বছর পরে এলাম!’

    সাব্রিনা রেনের মাকে নাম ধরে বলাতে হঠাৎ মনে-মনে একটা ধাক্কা খেল টিনা। আরো ধাক্কা খেল, যখন শুনল খুরশেদও বলছে, ‘হ্যাঁ, রুথ অপেক্ষা করা একদম পছন্দ করে না। এই নিয়ে কার্টের সঙ্গে তার যা লাগে না! কার্ট তো অলওয়েজ লেট লতিফ।’

    রুমে গিয়ে তৈরী হতে-হতে সাব্রিনা টিনাকে রেনের পারিবারিক জীবনের একটা পরিচিতি দিল। রুথ রেনের আপন মা নয়, রেনের বাবা কার্ট প্রথম বিয়ে করেছিলেন এক আমেরিকান মেয়েকে। রেনে সেই আমেরিকান মায়ের ছেলে। তিনি মারা যান রেনের তিনবছর বয়সে, তখন কার্ট দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন স্বজাতি মার্জান মেয়ে। রেনের দুটি সৎবোন ও তিনটি সৎভাই আছে। তারা সকলেই বিবাহিত। তাদের কেউ জার্মানিতে, কেউ ফ্রান্সে, কেউ আমেরিকাতে বাস করে। এবার সবাই সব জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছে, ওদের বাবার পঁচাত্তর বছর বয়স পূর্তি উপলক্ষে। প্লাটিনাম জন্মবার্ষিকী। এই-যে ওরা সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়েছে, এটাই ওদের তরফ থেকে বাবাকে উপহার। রুথ আর কার্ট বাস করেন ফ্রাংকফুর্ট থেকে বিশমাইল দূরে হ্রীজবাদেন নামে গ্রামে, সেখানে তাঁদের ছোট্ট কটেজে সবার জায়গা হওয়া সম্ভব নয়। তাই তাঁদের ছেলেমেয়েরা সবাই ফ্রাংকফুর্ট শহরে বিভিন্ন হোটেলে এসে উঠেছে। আজ দুপুরে সবাই যাচ্ছে জ্বীজবাদেন আর ফ্রাংকফুর্টের মাঝামাঝি রাউয়েন্টহাল গ্রামে; সেখানকার জ্বীন্সার হাউজ খুব নামকরা রেস্তোরাঁ। ওখানে সবাই রুথ আর কার্টকে পার্টি দিচ্ছে।

    চুলে ব্রাশ চালাতে চালাতে সাব্রিনা বলল, ‘পার্টির পর আমরা সবাই হীজবাদেন-এ যাব। সেখানে কার্টের ওয়াইন-টেস্টিং হবে।’

    ‘ওয়াইন টেস্টিং মানে?’

    ‘রুথ আর কার্ট-এর ওয়াইন তৈরীর একটা ছোট্ট কারখানা আছে। বাড়িতেই।’

    ‘বাড়িতেই?’ টিনা উত্তরোত্তর অবাক হয়ে চলেছে।

    ‘হ্যাঁ, এখানে প্রচুর আঙুর ফলে তো। তাই গ্রামে-গ্রামে অনেক জার্মান পরিবার কুটিরশিল্প হিসেবে নিজেদের বাড়িতে আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরি করে। কেউ যখন ওয়াইন কিনতে আসে তখন তাকে বিভিন্ন বছরের তৈরী ওয়াইন-বোতল খুলে ছোট্ট গ্লাসে ঢেলে চাখতে দেখা হয়। তিন-চাররকর্ম চেখে কাস্টমার তারপর কেনে। আমরাও আজ যাব ওয়াইন চাখতে। দেখবে, তোমার খুব মজা লাগবে।’

    একটা কথা বহুক্ষণ থেকে টিনার মাথায় ঘুরছিল, এবার সেটা বলেই ফেলল, ‘আচ্ছা, তুমি রেনের বাবা-মাকে নাম ধরে বলছ। রেনেও তাই। খুরশেদও তাই শিখেছে দেখলাম।

    ‘ইয়োরোপ-আমেরিকায় অনেক পরিবারে এটাই রেওয়াজ। রেনে বলে নাম ধরে ডাকাই ভালো। মানুষের মঙ্গে মানুষকে একটা বিশেষ সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা হয় বলেই পৃথিবীতে এত জটিলতা।’

    ‘বারে, এটা আবার কেমন কথা! মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। একে অন্যকে ছাড়া একাকী বাস করতে পারে না। মানুষের জন্যই তো প্রয়োজন সম্পর্কের বাঁধন।’

    ‘মানুষের জন্য সম্পর্ক প্রয়োজন, বাঁধন নয়। সন্তানের প্রতি বাবা-মার কর্তব্য, বাবা-মার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি পুত্রবধূর কর্তব্য, স্বামী ও সংসারের প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য—এতসব কর্তব্যের বাঁধ দিয়ে মানুষের জীবনকে অহেতুক জটিল আর যন্ত্রণাময় করে তোলা হয়েছে। সন্তান-স্নেহের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসাকেও পবিত্র দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদি নাম দিয়ে কীরকম কমার্শিয়ালাইজ করে ফেলা হয়েছে, দেখ না। বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি সন্তানের পবিত্র কর্তব্য ও দায়িত্বের কথা বলে বলে মানুষের জীবন থেকে নির্মল ভালোবাসাকে পঙ্কিল করে তোলা হয়েছে। এতসব বাঁধনের খেলা না থাকাই ভালো। যা থাকবে তা হল স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা, মমতা, দায়িত্ববোধ।’

    টিনা অবাক হয়ে সাব্রিনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন গুছিয়ে, এত কথা একসঙ্গে বলতে সাব্রিনাকে সে কখনো দেখেনি। সাব্রিনা থামলেও সে খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইল। তারপর বলল, ‘এসব কি রেনের মত?’

    ‘রেনের মত। তবে তার কাছ থেকে ধার করিনি। নিজের জীবনটা উলটে-পালটে বিশ্লেষণ করে, অনেক ঠেকে, অনেক দেখে, অনেক বুঝে তবে শিখেছি।’

    ‘তোর ছেলে দেখছি রেনেকে খুব সহজভাবে নিয়েছে।’

    ‘হ্যাঁ, রেনেকে বিয়ে করার আগে ওদের তিন ভাইবোনকেই সব খুলে বলেছি। আমার সমস্যা নিয়ে ওদের সাথে আলোচনা করেছি, ওদের মত নিয়েছি। সেইজন্যই আমাদের মা-সন্তানের সম্পর্কে জটিলতা আসেনি, ভালোবাসায় ফাটল ধরেনি। জেরিনা ও রেনেকে খুব পছন্দ করে।’

    ‘জেরিনা, জামশেদ আসেনি যে?

    ‘ওদের সামনে পরীক্ষা। ওরা পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা যাবে। যাবার পথে হ্রীজবাদেনে থেমে একসপ্তাহ বেড়িয়ে যাবে।’

    খুরশেদ দরজায় নক্ করে বলল, ‘কই, হল তোমাদের? আমরা রেডি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রওনা দিতে না পারলে রুথের বকুনি আছে তোমাদের কপালে, বলে দিলাম কিন্তু।’

    .

    টিনার প্লেন ছাড়ার কথা সন্ধ্যা ৬টায়। এখন ৫টা বাজে। ব্যাগেজ চেক-ইন হয়ে গেছে। টিনা আর সাব্রিনা এখন বসে আছে নিউইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে।

    ‘বেশ কাটল ক’টা দিন। আর কিছুদিন থেকে গেলেই পারতে।’ টিনার প্রোগ্রাম শেষ হবার পর সে গত একমাস ধরে থেকেছে নিউইয়র্কে সাব্রিনার বাড়িতে।

    ‘নারে। হাসান বড় একা পড়ে গেছে। দু-মাসের ওপর দেশছাড়া। অবশ্য তুমি ও তো এখন একা পড়ে যাবে। রেনের ফিরতে আরো দুমাস।’

    ‘রেনের তো চাকরিটাই এরকম। প্রতিবছরই তো ওকে দু-তিনমাসের জন্য কোথাও-না-কোথাও যেতে হয়। এ বছর উগান্ডা, গতবছর ছিল জাকার্তা, সামনের বছর হয়তো যাবে দিল্লি।’

    ‘তোমার খারাপ লাগে না?’

    ‘না। একা লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু খারাপ লাগে না। কারণ এখানে আমার একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি আছে। আমি ডাক্তার, দিনভর রুগী নিয়ে ব্যস্ত থাকি, আমিও মাঝে মাঝে সেমিনার-কনফারেন্সে দেশ-বিদেশে যাই। আমি প্রথমে একটা গোটা মানুষ, আলাদা মানুষ। তারপর রেনের বউ। তাই আমার খারাপ লাগে না বা অসহ্য লাগে না। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাঁক আছে, অদর্শন আছে, বিরহ আছে; কিন্তু ফাঁকি নেই, ভণ্ডামি নেই, লুকোচুরি নেই। তুমি তো সবই জানো টিনা, তুমিই ভালো বুঝতে পারবে, আমি খুব সুখী। জীবনটার একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি আমি।’

    যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য প্রথম ডাক পড়ল। টিনা উঠতে গেলে সাব্রিনা বলল, ‘মাত্র প্রথম কল। আরেকটু বসো। ঢাকায় ফিরে সবাইকে আমার হয়ে হ্যালো বোলো। রাশেদ কেমন আছে? ওর বউ?’

    ‘ওরা ভালো। ওদের এখন দুটো বাচ্চা। জানো তো?’

    ‘হ্যাঁ, জানি। খুরশেদ গতবছর ঢাকা গেছিল দু-মাসের ছুটিতে। ওর মুখে সব শুনেছি।’

    টিনা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তুমি আর রেনে একটা বাচ্চা চাও না?’

    ‘সময় পেলাম কই? রেনে বলল, ‘আগে ডাক্তারটিা ঠিক করে নাও। জানো তো; এদেশে ডাক্তারি করতে হলে নতুন করে পরীক্ষা দিতে হয়। বড় কঠিন সে পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা দিলাম। পাসও করলাম। তারপর কত কাঠখড় পোড়ানো হল। হাসপাতালে চাকরি পাওয়া, প্রাইভেট প্র্যাকটিস জমানো। ভীষণ স্ট্রাগ্ গেল ক’টা বছর।’ একটু চুপ করে থেকে সাব্রিনা হঠাৎ ফিক্ করে হাসল, ‘এখনো ভেবে দেখিনি, তবে বলা যায় না, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারি সামনের দু-এক বছরে।’

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইহুদি প্রশ্নে – কার্ল মার্কস
    Next Article বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    Related Articles

    জাহানারা ইমাম

    একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম

    August 13, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বুকের ভিতর আগুন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }