Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নাটক সমগ্র – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প166 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    সেতু-বন্ধ

    –কুশীলবগণ–

    ইঁট, কাঠ পাথর, লোহা, যন্ত্র, যন্ত্রী,
    ভারবাহী পশু ও মানুষ, পীড়িত মানবাত্মা,
    সেতু, মেঘ, বৃষ্টিধারা, তরঙ্গ,
    পদ্মা, জলদেবী, মীনকুমারী,
    ঝড়, বজ্রশিখা,
    বন্যা…

    প্রথম অঙ্ক
    প্রথম দৃশ্য

    মেঘলোক

    [মৃদঙ্গ বাজাইতে বাজাইতে ‘মেঘ’-এর প্রবেশ। ‘মেঘ’-এর নীলাঞ্জন অনুলিপ্ত অঙ্গ, উচ্ছৃঙ্খল ঝামর চুল স্কন্ধদেশ ছাইয়া ফেলিয়াছে। চূড়ায় বঙ্কিম শিখীপাখা ফিকে-নীল ফিতা দিয়া বাঁধা। ললাটে বহ্নিশিখা-রঙের প্রদীপ-রক্তচন্দন যেন বজ্রাগ্নি। স্নিগ্ধ নয়নে ঘন কাজল ঝলমল করিতেছে, – যেন এখনই জল ঝরিয়া পড়িবে। গলায় হলুদ-রাঙা রাখি দিয়ে বাঁধা গম্ভীর নিনাদী মৃদঙ্গ। পরনে পেনসিল দিয়া ঘষা শ্লেট রঙের ধড়া ও ঢিলা নিমাস্তিন । দুই হাতের মণি-বন্ধে কাঁচা সোনার বলয়-কঙ্কণ। মৃদঙ্গে আঘাত হানার বিরতিতে দুই বাহু ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হইতেছে, সুবর্ণ-কঙ্কণ-বলয় বিজুরির ঝিলিক হানিতেছে। পৃষ্ঠদেশ ব্যাপিয়া সাতরঙা বিরাট জলধনু।
    অন্তরীক্ষ হইতে স্নিগ্ধ-গম্ভীর কন্ঠের একতান-সংগীত ভাসিয়া আসিতেছে – সেই গানের তালে তালে ‘মেঘ’-এর মৃদঙ্গ বাদন ও নৃত্য]

    গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু
    নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভু॥
    সে নাচ-হিল্লোলে জটা-আবর্তনে
    সাগর ছুটে আসে গগন-প্রাঙ্গনে।
    আকাশে শূল হানি
    শোনাও নব-বাণী
    তরাসে কাঁপে প্রাণী
    প্রসীদ শম্ভু॥
    ললাট-শশী টলি জটায় পড়ে ঢলি,
    সে শশী-চমকে গো বিজলী ওঠে ঝলি
    ঝাঁপে নীলাঞ্চলে মুখ দিগঙ্গনা,
    মুরছে ভয়-ভীতা নিশি নিরঞ্জনা।
    আঁধারে পথ-হারা
    চাতকী কেঁদে সারা,
    যাচিছে বারিধারা,
    ধরা নিরম্বু॥

    [গান করিতে করিতে একদল নৃত্যপরা কিশোরীর বেশে ‘বৃষ্টিধারা’র প্রবেশ। তাদের পরনে মেঘ-রং কাঁচুলি, ধানী-রং ঘাঘরা – পাড় জরির। নীল জমিনে সাদা ডোরা-কাটা কাপড়ের হালকা উত্তরীয়। পায়ে ছড়া নুপূর, কারুর পায়ে পাঁইজোর গুজ্‌রি। সবুজ আলতা-ছোপানো পদতল। হাতভরা সোনালি-রং রেশমি চুড়ি, কঙ্কণ, কেয়ূর। শ্রোণিতে ফোটা-কদমের ঢিলে চন্দ্রহার। বুকে জুঁই-চামেলির গোড়ে মালা। আঁখি-পাতার কূলে কূলে চিকন কাজললেখা। কপোল কেতকিপরাগ-পাণ্ডুর। জোড়া ভুরু লুলিতে অলকে হারাইয়া গিয়াছে। ভুরু-সন্ধিতে কাঁচপোকার টিপ। কর্ণমূলে শিরীষ-কুসুম। কারুর কটিতে ছোট্ট গাগরি, কারুর হাতে ফুল-ঝারি। কেহ বিলম্বিতবেণি, কেহ আলুলায়িত কুন্তলা। বিলম্বিত-বেণি কিশোরীরা আনমনে স্খলিত মন্থরগতিতে পদচারণা করিয়া ফিরিতেছে, মুক্ত-কুন্তলা বালিকারা নাচিয়া নাচিয়া ফিরিতেছে, জড়াজড়ি করিয়া – ঘুরিয়া ফিরিয়া। এক কোণে একটি বালিকা একরাশ কেয়াফুল বুকে জড়াইয়া পা ছড়াইয়া উদাস চোখে চাহিয়া আছে। ‘বৃষ্টিধারা’র নৃত্য-গানের ছন্দে ছন্দে অন্তরীক্ষ হইতে রাশি রাশি জুঁই, চামেলি, বেলি, বকুল, দোপাটি, টগর ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। ওই গানের তালে তালে ‘মেঘ’-এর মৃদঙ্গ বাদন ও নৃত্য।]
    বৃষ্টিধারার গান

    অধীর অম্বরে গুরু গরজন মৃদঙ বাজে।
    রুমু রুমু ঝুম মঞ্জরির-মালা চরণে আজ উতলা যে।

    এলোচুলে দুলে দুলে বন-পথে চল আলি,
    মরা গাঙে বালুচরে কাঁদে যথা বন-মরালী।

    উগারি গাগরি-ঝারি
    দে লো দে করুণা ডারি,
    ঘুঙট উতারি বারি
    ছিটা লো গুমোট সাঁঝে॥

    তালিবন হানে তালি, ময়ূরী ইশারা হানে;
    আসন পেতেছে ধরা মাঠে মাঠে চারা-ধানে।

    মুকুলে ঝরিয়া পড়ি আকুতি জানায় যূথি,
    ডাকিছে বিরস শাখে তাপিতা চন্দনা তূতী।
    কাজল-আঁখি রসিলি
    চাহে খুলি ঝিলিমিলি,
    চল লো চল সেহেলী
    নিয়ে মেঘ-নটরাজে॥

    [বৃষ্টিধারার বালিকাদের নাম – রেবা, চিত্রা, কঙ্কা, চূর্নী, মঞ্জু, নীরা, বিন্দু, নীপা, কৃষ্ণ, চম্পা, অশ্রু, মন্দা।]
    মেঘ :
    ওগো নৃত্যপরা নূপুরিকার দল! তৃষ্ণাতুরা ধরার আবেদন কি এতদিনে পৌঁছোল তোমাদের দরবারে? চাতকীর চক্ষু যে বিশুষ্ক হয়ে উঠল তোমাদের করুণা যেচে যেচে!
    মন্দা :
    (সেই আনমনা বালিকাটি, যে একরাশ কেয়া বুকে করে বসে ছিল) সত্যি বলেছ রাজা, দিদিদের আর নূপুর পরাই হয় না। কাজল ঘষে ঘষে চোখে জল ভরে এল, তবু কাজল পরাই আর শেষ হয় না! আমি তো কোন সকালে উঠে কেতকী-বিতানে এসে পথ চেয়ে বসে আছি। (বেণি জড়াইতে জড়াইতে) বেণিটাও জড়াবার ফুরসৎ পাইনি!
    রেবা :
    তোর বাপু সব-তাতেই অতিরিক্ত তাড়া-হুড়ো। আমরা বলি, নটরাজের মাদলই আগে বেজে উঠুক, ঝলুকই আগে বিজলির ইঙ্গিত – তা না – মেঘ না চাইতেই জল! ভোর না হতেই বেরিয়েছেন পাড়া বেড়াতে! একবার তমালতলায়, একবার কদম-শাখায়, একবার পাহাড়তলির শাল-বীথিকায়, একবার কেয়াবনের নাগ-পল্লিতে –
    মন্দা :
    আর তোমরাই বা কীসে কম রেবাদি? ঘুমুর বাঁধছ তো বাঁধছই! ঝিল্লি বেচারি সন্ধে থেকে সুর দিয়ে হয়রান! কেশ এলো করছ তো করছই! কত যে বিজুলি-ফিতে ছিঁড়ল – কত যে লোধ ফুলের প্রাণ গেল গাল রাঙাবার রেণু জোগাতে!
    বিন্দু :
    তুই থাম মন্দা! আচ্ছা রাজা, আজ যে অসময়ে তোমার মৃদঙ্গে তালি পড়ল! আমরা সব কেউ সাগর-দোলায় কেউ শৈল-শিরে ঘুমুচ্ছি হঠাৎ জেগে দেখি কিরণমালা পূর্বে-হাওয়ায় পালকি নিয়ে হাজির, হাতে তার নীপের শাখা।
    মেঘ :
    তোমাদের অভিযানে বেরুতে হবে, বিন্দু!
    বৃষ্টিধারার সকলে :
    অভিযানে বেরুতে হবে? আবার কার বিরুদ্ধে অভিযান, রাজা? এবার কোন্ দৈত্যপুরী ভাঙবে?
    মেঘ :
    গন্ধর্ব-লোকের পদ্মাদেবী আমাদের স্মরণ করেছেন। তাঁর বুকের উপরে বাঁধ বাঁধবার জন্যে নাকি দুর্দান্ত যন্ত্রপতির ষড়যন্ত্র চলেছে। পদ্মা এ অপমান সইবেন না। তিনি আমাদের সাহায্য চান।
    চিত্রা :
    ওমা, কী হবে? যন্ত্রপতির স্পর্ধা তো কম নয়! তার রাজ্য পশ্চিম হতে ক্রমেই পূর্বে প্রসারিত হয়ে চলেছে উন্মত্ত বুভুক্ষায় – তা দেখছি, তাই বলে সে-ঔদ্ধত্য যে পদ্মাকেই লাঞ্ছনা হানতে এগুবে – এ বার্তা শুধু নতুন নয় রাজা – অদ্ভুত!
    কঙ্কা :
    এই অতিদর্পীকে একটা অতি বড়ো শাস্তি না দিলে আর চলে না, রাজা!
    চূর্ণী :
    তোমার ব্রহ্মাস্ত্র নিশিত বজ্র, তোমার সেনাপতি পবন, তার মারণসেনা বন্যা তুফান ঝঞ্ঝা – সব প্রস্তুত তো রাজা?
    মঞ্জু :
    হাঁ, সব প্রস্তুত বইকী! ওলো চূর্নী, রাজার কঠিন বজ্র যে এখন শ্রীমতী বিদ্যুল্লতার গলায় কোমল হার হয়ে ঝলমল করছে। বলি রাজা, তোমার হাতের বজ্র ভেঙে কি শেষে প্রিয়ার গলার হার গড়ালে? হা কপাল! যেমন রাজা, তেমনই সেনাপতি! সেনাপতি পবনদেব ওদিকে ফুল-কুমারীর মহলে মহলে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছেন! মালতীর কানে ফুঁ, মল্লিকার গালে সুড়সুড়ি, কামিনীর চোখের পাতায় চুমকুড়ি, কমলের খোঁপা ধরে টান – এই তো বীরবরের কীর্তি! উপযুক্ত রাজার উপযুক্ত সেনাপতি!
    মেঘ :
    (হাসিয়া) সত্যিই আমার সেনাপতির ধনুর্বাণ কামদেব চুরি করেছেন, মঞ্জু! আর আমার বজ্রাগ্নি লুকিয়েছে (মঞ্জুর কপোলে মৃদু অঙ্গুলি আঘাত হানিয়া) তোমাদের ওই কালো আঁখি-কোণে!
    নীরা :
    বেশ তো রাজা, তালে এ অভিযানে আর তোমার হিমালয় ছেড়ে যাবার দরকার কি? শুধু আমরাই যাই না কেন, দেখি এ আঁখির আগুনে যন্ত্ররাজ দগ্ধ হয় কি-না!
    মেঘ :
    অমন কাজ কোরো না নীরা, কোরো না! ও হতভাগ্য, যত পুড়বে তত খাঁটি হবে, তত ওর শান্তি বাড়বে। তোমাদের আঁখির আগুনে – ওর কঠিন হিয়া গলবে না, নীরা! কত অশ্রুই না ঝরছে নিরন্তর অনন্ত আকাশ গলে ওর প্রতপ্ত ললাটে, তবু ওই অশান্ত দৈত্য-শিশু শান্ত হল না। পুড়িয়ে ওর কিছু করতে পারবে না, আগুনই ওর প্রাণ। ওকে ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
    নীপা :
    তোমায় যদি পথে পথে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারি রাজা, ওই দৈত্যটাকে আর পারব না?
    কৃষ্ণা :
    ওরে নীপা, আমাদের রাজা হল দেবতা – উপরের মানুষ, তাই ওকে পলকা হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ানো দুরূহ নয়, কিন্তু ওটা যে হল দৈত্য, তাইতো ও এত ভার! ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয়েই তো ও এমন করে চোখ-কান বুঁজে মাটি কামড়ে পড়ে আছে! তাই তো ও স্থানু। ওকে ভাসানো অত সহজ হবে না!
    অশ্রু :
    ঠিক বলেছিস কৃষ্ণা! ফুল সুন্দর বলেই একটু ছোঁয়ায় ঝরে যায়, একটু ফুঁয়ে উড়ে যায়! আর ওই দৈত্যটা কুৎসিত, তাইতো ও হয়ে উঠল বোঝা, ওর আসন হল অটল। ওর পায়ে মাথা খুঁড়লে শুধু ললাটই হবে ক্ষত, আসন এক বিন্দু টলবে না!
    মেঘ :
    দেব-দানবের এ-যুদ্ধ চিরন্তন, অশ্রু! ওই মায়াবী দৈত্যটা হাজার রূপ ধরে হাজার বার আমাদের স্বর্গ আক্রমণ করেছে, প্রতিবারেই ওদের আক্রমণ আমরা প্রতিহত করেছি। আমাদের একমাত্র ভয়, ওরা ঘোর মায়াবী! কোন্ ছিদ্র দিয়ে যে স্বর্গপুরী প্রবেশ করবে – তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ওদের রূপার কাঠির ছোঁয়ায় কত রূপের পুরী পাষাণ-পুরী হয়ে উঠল। ও কাঠি যাকে ছোঁবে, সেই হয়ে যাবে জড়। ও-রূপার কাঠি জাদু জানে! ওরা যদি তাই দিয়ে একবার এ-স্বর্গকে ছুঁতে পারে, তাহলে এর সমস্ত আনন্দ এক মুহূর্তে পাষাণ হয়ে যাবে, এর পারিজাতমালা শুকিয়ে উঠবে!
    অশ্রু :
    তাহলে কী উপায় হবে রাজা! ও যদি আমাদের আনন্দপুরী ছুঁয়ে দেয়? তুমি খুব বিপুল করে প্রাচীর গাঁথ না কেন আমাদের স্বর্গ ঘিরে!
    মেঘ :
    ওরে বাস্ রে! তাহলে কি আর রক্ষা আছে! ওরা তো তাই চায়। তারই জন্যে তো ওরা আমাদের নিরন্তর রাগিয়ে তুলছে। প্রাচীর তুললেই তো ওদের ভাঙবার পশুত্বটাকে প্রচণ্ড করে তোলা হবে। আমরা একটা কিছু আড়াল তুললেই ওরা সেইটে অবলম্বন করে উঠে আসবে স্বর্গে। অবলম্বন পাচ্ছে না বলেই তো ওরা মাঝপথ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে ফিরে যাচ্ছে, এ স্বর্গলোকের সীমা খুঁজে পাচ্ছে না।
    চম্পা :
    কিন্তু রাজা গন্ধর্বলোক তো প্রাচীর তুলেই ওদের আক্রমণ প্রতিহত করতে চাচ্ছে।
    মেঘ :
    মূর্খ ওরা, তাই ওদের আজ কী দুর্দশা হয়েছে দেখ। যন্ত্ররাজের যে পথ কিছুতেই মাটি ছাড়িয়ে উঠতে পারছিল না, দেয়াল তুলে গন্ধর্বলোক সেই পথকে স্বর্গের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে! ওই দেয়াল ধরেই ওরা ওদের উপর এসে পড়েছে দলে দলে।
    চম্পা :
    রাজা, এইবার যদি ওরা স্বর্গে এসে পড়ে?
    মেঘ :
    ভয় নেই চম্পা। আমাদের এ অলখপুরীর দশ দিক মুক্ত। তাই তো ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে, পথ খুঁজে পাচ্ছে না। বন্ধদ্বার দুর্গেই পড়ে শত্রুর পরিপূর্ণ আক্রোশ। আড়ালের ইঙ্গিতে শত্রুকে আহ্বান করার মতো দুর্বুদ্ধি আর নেই। নিম্নে দৃষ্টিপাত করে দেখ, কী বীভৎস ওই যন্ত্রী-সেনা – ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহা, চুন, সুরকি, ধুলো-বালি! – ওদের সংখ্যা করা যায় না – কেবল স্তূপ আর স্তূপ! প্রাণ যেন হাঁপিয়ে ওঠে! সব প্রাণহীন! আর প্রাণহীন বলেই অন্যেরে প্রাণে মারতে ওদের বাজে না! ওই দেখো, গন্ধর্বলোকের প্রাচীর ধরে ওরা কীরকম ছেয়ে ফেলছে ওদের দেশ – মারীভয়ের মতো! এ সুবিধা যদি না করে দিত গন্ধর্বলোক, তাহলে ও পাপ অন্ধকারের নীচেই পড়ে থাকত মুখ থুবড়ে।
    চিত্রা :
    কিন্তু রাজা, যন্ত্ররাজের ওই সেতু-বন্ধকে এত ভয়েরই বা হেতু কী? অমনি সেতুবন্ধ দিয়েই তো সীতার উদ্ধার হয়েছিল!
    মেঘ :
    উদ্ধারই বটে, চিত্রা! ওই সেতুবন্ধে পদার্পণে পাপে আগুনে পুড়েও সীতার কলঙ্ক পুড়ল না – শেষে পাতাল প্রবেশ করে উদ্ধার খুঁজতে হল।
    রেবা :
    বুঝেছি রাজ, সকল বন্ধন ও বন্ধনী হতে মুক্ত রাখাই হয়তো আমাদের স্বর্গপুরীর শ্রেষ্ঠ আত্মরক্ষা!
    মন্দা :
    আচ্ছা রাজা, যন্ত্ররাজের এই সেতুবন্ধের উদ্দেশ্য কী?
    মেঘ :
    এই সেতুবন্ধ যে পাতালপুরীর সীতার উদ্ধার করবে না মন্দা, ও করতে চায় স্বর্গলক্ষ্মীকে বন্দিনী। ওই সেতুবন্ধ স্বর্গ-প্রবেশের লঙ্ঘন-সোপান। ওই সেতুবন্ধের লৌহ-বর্ম দিয়ে সে স্বর্গলক্ষ্মীর কেশাকর্ষণ করে টেনে নিয়ে যাবে – তাই বলে তার সমুদ্ধত কৃষ্ণ-পতাকা!
    কৃষ্ণা :
    তাহলে ওকে দুঃশাসনের মতো মারও খেতে হবে, রাজা!
    মেঘ :
    ঠিক বলেছ কৃষ্ণা, অনাগত সে দিন এল বলে। এখন চলো, পদ্মা দেবীর নিরাশা-শুষ্ক কূল পানে। যন্ত্রপতির আয়োজন দেখে তার পর সেনাপতি পবন-দেবকে খবর দেওয়া যাবে। সে ততক্ষণ ফুলমহলায় বিশ্রাম করে নিক।

    [নৃত্য-গান করিতে করিতে মেঘ ও বৃষ্টিধারার প্রস্থান।]

    হাজার তারার হার হয়ে গো
    দুলি আকাশ-বীণার গলে।
    তমাল-ডালে ঝুলন ঝুলাই
    নাচাই শিখী কদম-তলে॥
    ‘বউ কথা কও’ বলে পাখি
    করে যখন ডাকাডাকি,
    ব্যথার বুকে চরণ রাখি
    নামি বধূর নয়ন-জলে॥
    ভয়ংকরের কঠিন আঁখি
    আঁখির জলে করুণ করি,
    নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলি
    আকাশ-বধূর নীলাম্বরী।

    লুটাই নদীর বালুতটে,
    সাধ করে যাই বধূর ঘটে,
    সিনান-ঘাটের শিলা-পটে
    ঝরি চরণ-ছোঁয়ার ছলে॥

    দ্বিতীয় দৃশ্য

    [যন্ত্রপতির রাজসভা। বিশাল লৌহমঞ্চে বিশালকায় যন্ত্রপতি উপবিষ্ট। পশ্চাতের আঁধার-কৃষ্ণ যবনিকা জুড়িয়া ভীতপ্রদ রক্তাক্ত অট্টালিকার পর অট্টালিকা – জীবজন্তু-তরুলতা-পরিপূর্ণ। বিরাট অমঙ্গলের প্রতীকসম ঊর্ধ্বে প্রসারিত-পক্ষ বিপুল শকুনি – ভীষণ দৃষ্টিতে নিম্নে চাহিয়া আছে। যন্ত্রপতির কঠিন মুখে রক্ত আলো পতিত হইয়া তাহাকে আরও ভীষণ করিয়া তুলিয়াছে। মস্তকে লৌহ-মুকুট। মুকুটমণি – ইলেকট্রিক-টর্চ। সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া লৌহ-জালির সাঁজোয়া। দক্ষিণ করে স্থূল লৌহদণ্ড, বামকরধৃত দীর্ঘ শৃঙ্খলে বদ্ধ ক্ষুধিতদৃষ্টি সিংহ, হিংস্রমতি শার্দুল, শাণিত-নখর ভল্লুক ও কুটিল-ফণা ভুজঙ্গী – পদতলে পড়িযা ঘুমাইতেছে। প্রাসাদচূড়ায় কৃষ্ণপতাকায় ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’ কাটিয়া তাহারই নীচে লেখা হইয়াছে – ‘বিদ্বেষ শোষণ পেষণ!’]
    ‘যন্ত্র’ – বিপুল স্থূলকায়, কদাকার, অন্ধদৃষ্টি। বড়ো বড়ো নখদন্ত। দক্ষিণ হস্তে জাঁতাকল, বাম হস্তে প্রকাণ্ড সিগার – বেয়াদবের মতো তাহারই পুঞ্জীভূত ধূম মুখ দিয়া অবিরত বাহির করিতেছে। মস্তকে চিমনি-আকৃতির লম্বা টুপি। পৃষ্ঠদেশ ব্যাপিয়া বিরাট চক্র। রক্ত-বস্ত্র, রক্ত-দেহ। তাহার পৃষ্ঠে চক্রের সাথে সাথে সেও অনবরত ঘুরিযা ফিরিতেছে।
    ইঁট, কাঠ, পাথর, যেন নেশা খাইয়া ঝিমাইতেছে। কেবল লৌহের উজ্জ্বল কঠিনদৃষ্টি।
    ইঁটের পরনে পিরান ও সুর্কি-রং চাহারখানার ঢিলে আরবি পায়জামা। মাথায় লালরঙা চৌকো টুপি, খর্বকায়, অলস-দৃষ্টি সিমেন্ট-রং-রঞ্জিত মুখ। পায়ে চৌকো বুট।
    কাঠ। স্থূল কর্কশ বস্ত্র শীর্ণকায় দীর্ঘাকৃতি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বিশুষ্ক মুখ। শির নাঙ্গা। ম্লান দৃষ্টি, নখ চুল বড়ো বড়ো।
    পাথর। মুখ চোখ বস্ত্র ধূমল বর্ণ। স্থূল কদাকার, কতকটা কচ্ছপের মতো। যেন শুধু পেট আর মাথা। শিরে জবড়জং কৃষ্ণ-উষ্ণীষ। হাত পা ভারী ভারী। মুখ চ্যাপটা, চোখ ছোটো।
    লোহা। আলকাতরা-রং – দীর্ঘাকৃতি, বলিষ্ঠ-দেহ, কঠোর-দৃষ্টি, বদ্ধ-মুষ্ঠি তিক্ত-কণ্ঠ। আঁট-সাট জামা।
    [যন্ত্র, ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া বন্দনাগীত গাহিতেছে।]

    গান

    নমো হে নমো যন্ত্রপতি নমো নমো অশান্ত।
    তন্ত্রে তব ত্রস্ত ধরা, সৃষ্টি পথভ্রান্ত॥
    বিশ্ব হল বস্তুময়
    মন্ত্রে তব হে,
    নন্দন-আনন্দে তুমি
    গ্রাসিলে মহাধ্বান্ত॥

    শংকর হে, সে কোন্ সতী-শোকে হয়ে নৃশংস
    বসেছ ধ্যানে, হয়েছ জড়, সাধিতেছ এ ধ্বংস।
    রুক্ষ তব দৃষ্টি-দাহে
    শুষ্ক সব হে,
    ভীষণ তব চক্রাঘাতে
    নির্জিত যুগান্ত॥
    যন্ত্র :
    আর তো আমাদের পথ এগোয় না রাজা, সামনেই খরস্রোতা পদ্মা – স্বর্গের নিষেধ-বাণীর মতো।
    যন্ত্রপতি :
    ওকে ওর গতি লঘু করতে বলো!
    যন্ত্র :
    জানি রাজা, বহু স্রোতস্বতী তোমার আদেশ পালন করেছে, কিন্তু পদ্মা তাদের সম্রাজ্ঞী!
    যন্ত্রপতি :
    তুমি ভুলে যাচ্ছ সেনাপতি যে, আমিও সম্রাট। ওকে বলো – এ আমার আদেশ!
    যন্ত্র :
    যে-মন্দাকিনী ইন্দ্ররাজের ঐরাবতকে তৃণকণার ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল – এ তারই জ্যেষ্ঠা কন্যা। তার তরঙ্গ-সেনার হুহুংকারে প্রলয়-নর্তনে ধরণি প্রকম্পিত!
    যন্ত্রপতি :
    ধরণি প্রকম্পিত হতে পারে – আমি নয়। ওকে খবরটা পৌঁছে দাও – ওর বুকের উপর দিয়ে প্রস্তুত হবে আমার পথ!
    যন্ত্র :
    সে খবর সে শুনেছে, রাজা। তার তরঙ্গ-সেনা পর্যন্ত এ খবর শুনে ফেনা ছুঁড়ে বিদ্রুপ করে!
    ইঁট :
    মনে হয়, যেন গায়ে থুথু দিয়ে অপমান করলে!
    যন্ত্র :
    আরে বাপু, তুমি থামো! – রাজা, এ অভিযানে তোমায় অধিনায়কত্ব করতে হবে।
    যন্ত্রপতি :
    তুমি কি ওর হাঙ্গর-কুমির দেখে ভয় পেয়ে গেলে সেনাপতি?
    যন্ত্র :
    না রাজা, আমার ভয় শক্ত-কিছু নিয়ে নয়, ভয় আমার ওই তরল তরঙ্গসেনাকে। ও যদি কামড়াত, তাহলে আমার ভয়ের কিছু ছিল না, কিন্তু ও তো কামড়ায় না – শুধু সমস্তক্ষণ ঠেলে! ধরতে গেলে আঙুলের ফাঁক দিয়ে যায় গলে!
    পাথর :
    আজ্ঞে, বেটা একে মনসা, তাতে আবার ধুনোর গন্ধ ওই পবন ব্যাটা। ও যখন এসে যোগ দেয়, তখন আমার এই কাবুলি বপুখানিকেও তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়ে!
    ইঁট :
    আজ্ঞে, আর আমাকে তো সুরকি-গুঁড়ো করে দেয়!
    কাঠ :
    আমার খাতির ততোধিক! কান ধরে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে খাওয়াতে যখন দেয় রাম-ছুট, তখন দু-পাশের লোক বলে – মড়া ভেসে যাচ্ছে।
    লোহা :
    (সগর্বে) আমি বরং গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরি, তবু ওদের মতো ভেসেও যাই না, ভেঙেও পড়ি না!
    পাথর :
    হাঁ, তাই থাপ্পড় কষিয়ে তোমার মুখটা দেয় নয়ের মতো করে বেঁকিয়ে – তার পর বেশ করে বালি চাপা দিয়ে – দেয় জ্যান্ত কবর!
    যন্ত্র :
    চুপ করো সব! – তোমাদের সমবেত শক্তি দিয়ে ওকে প্রতিরোধ করতে হবে – একলা যে যাবে তাকেই অকূলে ভাসতে হবে!
    কাঠ :
    ভাসতে হয় তো সকলেই হবে সেনাপতি, তবে এবার সকলে একসাথে ভাসব – এই যা সান্ত্বনা! বাবা, পদ্মার যে চেহারা দেখে এসেছি তা মনে করলে এখনও কাঠ হয়ে যেতে হয়! স্রোত তো নয় – যেন লাখে লাখে পাহাড়ে অজগর ফোঁসাচ্ছে – মোচড় খাচ্ছে। তার পর কুমিরগুলো যেন খেজুর-গুঁড়ির ঢেঁকি। (অন্য দিকে চাহিয়া) হাঙরগুলোর মুখ কিন্তু আমাদের সেনাপতিরই মতো!
    যন্ত্র :
    দেখো, তুমি বড়ো হালকা। তোমাদের দুর্বলতায় রাজা ক্রুদ্ধ হচ্ছেন।
    যন্ত্রপতি :
    সেনাপতি, আমি এখন চললাম। তোমরা প্রস্তুত হও – পদ্মাকে শাসন করতেই হবে। [প্রস্থান]
    পাথর :
    আচ্ছা সেনাপতি, রাজার অত আক্রোশ কেন ওই জলধারার ওপর? ওকে কি না বাঁধলেই নয়? আমরা ওকে কি ডিঙিয়ে যেতে পারিনে? তা হলে খাসা হত কিন্তু! ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। তখন একবার দেখে নিতাম – ওর তরঙ্গ-সেনা কত লাফাতে পারে? আমরা হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালে বোধ হয় ওকে আলগোছে ডিঙিয়ে যেতে পারি।
    যন্ত্র :
    সে চিন্তার ভারটা আমার উপরেই ছেড়ে দাও। তোমাদের যা বলি তাই করো এখন। – আমাদের যন্ত্রপতি স্বর্গ জয় করতে চান, তাঁর যন্ত্ররথের পথের বাধা ওই বিপুল স্রোতধারা – ও যেন স্বর্গের গড়খাই – ওর তরঙ্গ যেন স্বর্গের সীমান্তরক্ষী সৈন্য। ওকে জয় করতে পারলেই স্বর্গজয় সহজ হয়ে উঠবে।
    ইঁট :
    স্বর্গের সরস্বতীকে তো আগেই বন্দী করেছি সেনাপতি, তাঁর বীণার তারকে বেতার-যন্ত্রের কাজে লাগিয়েছি – তাঁর পদ্মবনকে করেছি কাঠ-গুদাম! স্বর্গে আর আছে কী?
    যন্ত্র :
    (পাথরের প্রতি) দেখো, তোমায় ভারিক্কি বলেই জানতাম – তোমাকেও দেখছি হালকা কাঠের ছোঁয়াচ লাগল! – (কাঠের প্রতি) দেখো, তোমার হালকা হওয়ায় কিন্তু একটা সুবিধাও আছে। তোমায় তরঙ্গ সহজে ডুবাতে পারে না। ভেসে এক জায়গায় কূলে ঠেকবেই!
    পাথর :
    আজ্ঞে, ডুবলে কিন্তু ভরাডুবি!
    যন্ত্র :
    আঃ, থামো তুমি! (কাঠের প্রতি) দেখো, তোমায় নৌকা হয়ে দেখে আসতে হবে – কোথায় পদ্মার তরঙ্গ-সেনা উদাসীন, কোথায় ওর গতিবেগ লঘু।
    লোহা :
    আচ্ছা, সেনাপতি, পদ্মাকে কি বন্দিনী করবে?
    যন্ত্র :
    না। তা করতেও পারব না, আর পারলেও করতাম না। আমরা পদ্মাকে চাই না – চাই স্বর্গলক্ষ্মীকে। এই স্রোতের জল সেই স্বর্গের প্রাণধারা। এই প্রাণ-ধারার গতিবেগ সংযত করা ছাড়া একেবারে বন্ধ করলে যার জন্যে এই অভিযান, হয়তো সেই স্বর্গলক্ষ্মীকে হারাব – এবং পাব দক্ষযজ্ঞের সতীকে! আমাদের রাজমন্ত্রী কৌটিল্য তা হতে দেবেন না।
    কাঠ :
    কই সেনাপতি, মন্ত্রী কৌটিল্যকে তো দেখতে পেলুম না কখনও।
    যন্ত্র :
    সবচেয়ে মূল্যবান যে, তাকে রাখতে হয় সবচেয়ে গোপনে। মন্ত্রী কৌটিল্যই হল আমাদের রাজ্য-রক্ষার রক্ষাকবচ। আমরা সকলে, মায় রাজা পর্যন্ত, ওই কৌটিল্যেরই অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ নিদর্শন।
    পাথর :
    ঠিক বলেছে সেনাপতি, দুর্বুদ্ধি যিনি, তিনি থাকেন দেখার অতীত হযে। ষড়যন্ত্রকে দেখতে যাওয়া দুরাশা!
    ইঁট :
    আমারও তাই মনে হয়, সেনাপতি, জগৎটাকে সৃষ্টি যেই করুক – ওর মালিক যেই হোক – ওকে চালায় কিন্তু শয়তান!
    যন্ত্র :
    ওহে, তোমাদের কথাবার্তায় রাজদ্রোহের গন্ধ পাচ্ছি। রাজার এবং ভগবানের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলে তার শাস্তি কী, জান?
    কাঠ :
    জেল কিংবা নরক। – এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ!
    যন্ত্র :
    এই! চুপ! চুপ! ওই রাজা আসছেন, শুনলে আর রক্ষে থাকবে না।
    যন্ত্রপতি :
    সেনাপতি! আজই যাত্রা করো পদ্মাতীরে তোমার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। সৈন্য পরিচালনের ভার আমিই গ্রহণ করব। (ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহার প্রতি)!প্রিয় সৈনিকগণ! তোমাদেরই আত্মদানে আমার এই বিশাল সাম্রাজ্য। এর যা কিছু গৌরব, যা কিছু প্রতিষ্ঠা – সব তোমাদেরই। আমাদের এ যুদ্ধ স্বর্গ-মর্ত্যের চিরন্তন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জড় ও জীবের, বস্তু ও প্রাণের, মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ের! অমৃতে আমাদের অধিকার নেই, তাই আমরা অমৃতকে তিক্ত করে তুলতে চাই! যে-বেদনা আজ মহাজড়, সেই বেদনার বিক্ষোভে দেবতার আনন্দকে পঙ্কিল করে তুলতে চাই। প্রকৃতিকে আমরা বশীভূত করেছি – এইবার স্বর্গরাজ্য জয়ের পালা। আমাদের পথের প্রধান প্রতিবন্ধক ওই মুক্ত স্রোতস্বতী – আনন্দলোকের গোপন প্রাণ-ধারা। ওকে বাঁধব না – ওর বুকের উপর দিয়ে চলে যাব আমাদের চলার চিহ্ন এঁকে। –স্বর্গের আনন্দলক্ষ্মী করবে এই জড় জগতের পরিচর্যা – এই দম্ভের দীপ্ত তিলক তোমরা পরাও এই মর্ত্যলোকের লাঞ্ছিত ললাটে। অহংকারের এই উদ্ধত পতাকা স্বর্গের বুকে প্রতিষ্ঠা করো, বীর!
    সকলে :
    জয় যন্ত্রপতি কী জয়! জয় যন্ত্রপতি কী জয়!!
    যন্ত্র :
    সৈন্যগণ, গাও আমাদের সেই যাত্রাপথের কুচকাওয়াজের গান!

    গান

    চরণ ফেলি গো মরণ ছন্দে
    মথিয়া চলি গো প্রাণ।
    মর্ত্যের মাটি মহীয়ান করি
    স্বর্গেরে করি ম্লান॥
    চিতার বিভূতি মাখিয়া গায়
    লজ্জা হানি গো অন্নদায়,
    বাঁধিয়াছি বিদ্যুল্লতায়,
    দেবরাজ হতমান॥
    পাতাল ফুঁড়িয়া করি গো মাতাল
    রসাতল-অভিযান॥

    তৃতীয় দৃশ্য

    [সিংহাসনারূঢ়া মকর-বাহিনী পদ্মা। পরনে জল-তরঙ্গ শাড়ি, হাওয়ায় কেবলই ঝিলমিল করিতেছে। গায়ে কাঁচা রৌদ্র-কিরণের উড়ুনি। কাশ-বন চামর ঢুলাইতেছে। বেলা-ভূমে হাঙ্গর কুম্ভীর প্রহরীর কার্য করিতেছে। দুই তীরে বালুচরের শ্বেত পর্দা ঝুলানো। অগণিত মীন-সেনা সিংহাসনের চারিপাশে পায়চারি করিয়া ফিরিতেছে। জলদেবী গণ বন্দনা-গান গাহিতেছে।]

    নমো নমো নমো হিম-গিরি –সূতা
    দেবতা-মানস-কন্যা।
    স্বর্গ হইতে নামিয়া ধূলায়
    মর্ত্য করিলে ধন্যা॥
    আছাড়ি পড়িছ ভীষণ রঙ্গে
    চূর্ণি পাষাণ ভীম তরঙ্গে,
    কাঁপিছে ধরণি ভ্রুকুটি ভঙ্গে,
    ভুজঙ্গ-কুটিল বন্যা॥
    কূলে কূলে তব কন্যা কমলা
    শস্যে-কুসুমে হাসিছে অচলা,
    বন্দিছে পদ শ্যাম-অঞ্চলা
    ধরণি ঘোরা অরণ্যা॥

    [জলদেবীদের নাম –তরঙ্গিণী, সলিলা, অনিলা, তটিনী, নির্ঝরিণী, বালুকা।]
    পদ্মা :
    তোদের এ গান থামা, তরঙ্গিণী। এ বন্দনা-গান আজ আমার গায়ে বিদ্রুপের মতো বিঁধছে।
    তরঙ্গিণী :
    জানি মা, তোমার বেদনা কত বিপুল। কিন্তু যন্ত্রপতির এ স্পর্ধার দণ্ড কি আমরা দিতে অসমর্থ, মা?
    পদ্মা :
    আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে তরঙ্গিণী। কত বাধাই না দিলাম। যন্ত্রপতির অগণিত সেনা-সামন্ত আজও আমার বালুচরের তলে তাদের সমাধি রচনা করে পড়ে রয়েছে, তবু তো তাকে আটকে রাখতে পারলাম না। সে আমার বুকের ওপর দিয়ে তার উদ্ধত যাত্রা-পথ রচনা করে গেল। (অদূরে সেতু-বন্ধ দেখা যাইতেছিল, সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া) ওই দেখেছিস তার সেতু-বন্ধ? ও যেন কেবলই আমার মাথায় চড়ে বিদ্রুপ করছে! অসহ্য তরঙ্গিণী, অসহ্য এ অপমান!
    সলিল :
    কী চতুর ওই যন্ত্রপতিটা, মা! কাপুরুষ – আমাদের ভয়ে আমাদের নাগালের বাইরে ওর পথ রচনা করেছে। পেতাম ওকে তরঙ্গের মুখে, তা হলে ওর ওই আকাশস্পর্শী স্পর্ধার মুখের মতো শাস্তি দিয়ে ছাড়তাম!
    বালুকা :
    তাহলে এতদিন ওই বালুচর হত ওর সমাধি।
    পদ্মা :
    যুদ্ধজয় শুধু শক্তি দিয়ে হয় না, সলিলা, শক্তির চেয়ে বুদ্ধিরই বেশি প্রয়োজন বড়ো যুদ্ধে।
    অনিলা :
    আচ্ছা মা, ওর পথ না হয় আমাদের নাগালের ঊর্ধ্বেই রইল, কিন্তু ও-পথের মূল তো রয়েছে আমাদেরই বুকের উপর প্রোথিত। সে-মূলকে কি আমরা উপড়ে ফেলতে পারিনে?
    পদ্মা :
    আমার শক্তিহীন তরঙ্গ-সেনাকে সে কথা জিজ্ঞেস করো অনিলা। সে চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমবার – কেন, বহুবারই আমরা তাদের ও পথমূলকে উচ্ছেদ করেছি, কিন্তু আর পারা গেল না। ওর বিপুল ভারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি আর আমার তরঙ্গসেনার রইল না!
    নির্ঝরিনী :
    আচ্ছা, মা আমরা তো পারলাম না। কিন্তু আমাদের এ-অপমান – এই পরাজয় দেখে স্বর্গের দেবতারা কী করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলেন, তাই ভাবছি। তুমি আকাশের দেবতাদের আহ্বান করো না একবার!
    পদ্মা :
    আমি দেবরাজ ইন্দ্রের সাহায্যও চেয়েছি, নির্ঝরিণী। দেবরাজ তাঁর মেঘ-রথে চড়ে দেখেও গেছেন সব। তিনিও যে যন্ত্রপতির এই অতি বিপুল স্থূলকায় দেখে বিস্মিত – হয়তো বা ভীতও হয়েছেন। আমার মরাল দূতী এই সেদিন ফিরে এসেছে। তিনি বলেছেন, এর জন্য তাঁকে বড়ো রকম প্রস্তুত হতে হবে। পরাজয়ের লজ্জাকে তাঁর অতিমাত্রায় ভয়!
    তটিনী :
    কিন্তু মা, অসুরের হাতে দেবরাজের পরাজয় তো বহুবারই হয়ে গেছে।
    পদ্মা :
    বারে বারে পরাজিত হয়েই তো তাঁর এত ভয়, তটিনী! তাঁর পরাজয়ের পথ অনুসরণ করে যদি অসুরের দল আবার স্বর্গ আক্রমণ করে!
    [হঠাৎ ঊর্ধ্বে মেঘের দামামা-ধ্বনি শোনা গেল। পদ্মাদেবী উৎকর্ণ হইয়া উঠিলেন।]
    পবন :
    (হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া) দেবী! স্বর্গে দামামা বেজে উঠেছে। আমার অগ্রজ দেবরাজ সেনাপতি ঝঞ্ঝা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে পড়লেন বলে! আদেশ দিন দেবী, আমি আমাদের সৈন্যসামন্তদের প্রস্তুত হতে বলি।
    পদ্মা :
    (উত্তেজনায় দণ্ডায়মান হইয়া) তুমি প্রস্তুত হও সেনাপতি! এখনই তরঙ্গ-সেনাদলকে কূলে কূলে দামামা-ধ্বনি করতে বলো। সকলে যেন তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকে। আমি দেবরাজ সেনাপতিকে অভ্যর্থনা করে আনি। জয় মা ভবানী! (পদ্মা শ্বেতমরালীর ডানায় চড়িয়া ঊর্ধ্বে উড়িয়া গেলেন। তরঙ্গ-সেনা, হাঙ্গর, কুমির, মীনদল, জলদেবীগণ অতি ব্যস্ততা-সহকারে বাহির হইয়া গেল। পশ্চিম গগন অন্ধকার করিয়া কৃষ্ণমেঘ দেখা দিল। দেখিতে দেখিতে মেঘ সারা আকাশ ছাইয়া ফেলিল। ঊর্ধ্বে ভীষণ শনশন শব্দে ঝঞ্ঝা আসিয়া উপস্থিত হইল। পদ্মার জল সম্ভ্রমে বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া যেন দেবরাজ সেনাপতিকে অভিবন্দনা জ্ঞাপন করিল।)
    [ঝঞ্ঝার উচ্ছৃঙ্খল ঝামর-কেশ ত্রস্ত স্কন্ধ হইতে স্খলিত হইয়া ধরায় লুটাইয়া পড়িতেছে। হস্তে ধূলি-গৈরিক পতাকা। কর-খর্পরে ধূমায়িত অগ্নি। বক্ষদেশে বিদ্যুতের যজ্ঞোপবীত। চরণে খর-ধ্বনি নূপুর। নয়নে বজ্রাগ্নি-জ্বালা। বাহুতে ছিন্ন শৃঙ্খল। দিগন্ত-ছাওয়া কুটিল ভ্রু-ভঙ্গি। নিযুত বাসুকি কোটি ফণা বিস্তার করিয়া ছত্র ধরিয়াছে। তাহাদের নিশ্বাসের শব্দে স্বর্গ-মর্ত্য শিহরিয়া উঠিতেছে। – যেন দ্বিতীয় প্রলয়ের শংকর।]

    অন্তরীক্ষে গান

    হর হর শংকর! জয় শিব শংকর!
    দানব-সন্ত্রাস জয় প্রলয়ংকর!
    জয় শিব শংকর॥
    নিপীড়িত জন-মন-মন্থন দেবতা!
    আনো অভয়ংকর স্বর্গের বারতা!
    জাগো মৃত্যুঞ্জয় সংঘাত-সংহর।
    জয় শিব শংকর॥
    এসো উৎপীড়িতের রোদনের বোধনে
    বজ্রাগ্নির দাহ লয়ে রোষ-নয়নে॥
    ভীম কৃপাণে লয়ে মৃত্যুর দণ্ড
    দৈত্যারি-বেশে এসো উন্মাদ চণ্ড
    ধ্বংস-প্রতীক মরু-শ্মশান-সঞ্চর!
    জয় শিব শংকর॥

    [ঊর্ধ্বে ঝঞ্ঝা, পদ্মা, বজ্রশিখা, মেঘ, পবন। নিম্নে তরঙ্গ-সেনা, সেতু জলদেবীগণ, মীনকুমারীগণ, ভারবাহী পশু ও মানুষ, পীড়িত মানবাত্মা।]
    ভারবাহী মানুষ :
    (অন্তরীক্ষ লক্ষ করিয়া) জাগো দেবতা! আর এ ভার বইতে পারিনে। যন্ত্র-রাজা আমাদের ক্ষুধার অন্নের বিনিময়ে আমাদের সর্বস্ব হরণ করেছে। আমাদের আত্মাকে হত্যা করে পশু করে তুলেছে। আমাদের পিঠে হয়েছে কুব্জ, আমাদের দেহ হয়েছে রোগ-জীর্ণ, খর্ব। আমাদের কর্তব্য হয়েছে ওদের ভার বহন। জাগো, দেবতা, জাগো!
    ভারবাহী পশু :
    জাগো রুদ্র জাগো! নিপীড়িত কুলিরও অধম হয়েছি আমরা। যন্ত্ররাজের পশুত্ব আমাদেরও নীচে গিয়ে পৌঁছেছে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত-প্রাণ আমরা। আমরা দিবসে হই তার ভারবাহী, নিশীথে হই ক্ষুধার আহার্য। জাগো রুদ্র, এই অপমৃত্যুর হাত হতে আমাদের রক্ষা করো!
    পদ্মা :
    ওই শোনো, শোনো দেবরাজ-সেনাপতি! নিম্নে পীড়িত মানবাত্মা, ভারবাহী পশুর ক্রন্দন-ধ্বনি! আমারই কূলে ওরা ওদের শান্ত নীড় রচনা করেছিল। যন্ত্রপতি ওদের ধরে আমারই সর্বনাশ করিয়েছে। হানো তোমার বজ্রাঘাত, আর আমি সইতে পারিনে!
    ঝঞ্ঝা :
    মাভৈঃ! ভয় নাই দেবী। যন্ত্ররাজের পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। ওকে আরও অগ্রসর হতে দিতে দিলে আমাদের স্বর্গের সদর-দ্বারে গিয়ে সে হানা দিবে। আমি বিধাতার ইঙ্গিত নিয়ে এসেছি। (বজ্রকে দেখাইয়া) ওই দেখো তার মৃত্যুদণ্ড – জ্বলন্ত অগ্নি-শিখায় লিখা! – পবন! মেঘরাজ! – তরঙ্গসেনা! – বন্যাধারা! সকলে প্রস্তুত তো?
    [ঊর্ধ্বে ও নিম্নে সমবেত কণ্ঠের জয়ধ্বনি উত্থিত হইল। সেতু-বন্ধ কাঁপিয়া উঠিল।]
    এইবার আমাদের প্রলয়-নাচের পালা শুরু হোক।… দেবী! তুমি নিম্নে গিয়ে তোমার তরঙ্গসেনা বন্যাধারাকে পরিচালিত করো। … পবন! তুমি তোমার পরিপূর্ণ গতিবেগ নিয়ে সেতু-বন্ধের ঊর্ধ্বদেশ আক্রমণ করেো। বন্যা-ধারাকে, তরঙ্গ-সেনাদলকে পশ্চাতে থেকে শক্তি দাও, সাহস দাও, পরিচালিত করো, ওদের মাঝে আরও আরও গতিবেগ সঞ্চারিত করো। মেঘ! তুমি সাগর শূন্য করে সকল গিরি-শির রিক্ত করে জলধারা বর্ষণ করো! তরঙ্গ-সেনা তোমার শক্তিতে, অধীর উন্মাদনায় উন্মত্ত ফেনায়মান হয়ে উঠুক!… বজ্রশিখা! তুমি তোমার অগ্নিদণ্ড নিয়ে সেতু-বন্ধের শিরোদেশে, পদমূলে আঘাতের পর আঘাত করো। – ধরণিধর বাসুকীকে খবর দাও, সে তার ফণা আস্ফালন করে ধরণিকে কাঁপিয়ে তুলুক। ভেঙে ফেলুক ওই অসুরের দম্ভ সেতু-বন্ধ!
    [ঊর্ধ্বে নিম্নে ঘন ঘন জয়ধ্বনি উঠিতে লাগিল – “জয় গন্ধর্ব-লোকের জয়! জয় দেবরাজ ইন্দ্রের জয়! জয় মা ভবানী! জয় শংকর”!… পৃথিবী টলমল করিয়া উঠিল। ঘন ঘন বজ্রপাত ও অবিরল ধারে বৃষ্টি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে পদ্মার ঢেউ ভীম নর্তনে দুই কূল প্লাবিয়া তুলিল। তরঙ্গ-সেনাদলের গিরিমাটি-রাঙা উত্তরীয় পবন-বেগে উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। জলদেবীগণ, মীনকুমারীগণ, হাঙ্গর, কুমির – সকলে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। সকলে সেতুবন্ধে আঘাত করিতে লাগিল। ক্রমে শত শবভারবাহী মানুষ ও পশুর দল হাতুড়ি শাবল গাঁইতি এবং শৃঙ্গ লইয়া সেতুবন্ধকে আক্রমণ করিল। সেতুবন্ধ কাঁপিয়া উঠিল।]
    সেতু :
    জয়, যন্ত্ররাজের জয়! সাবধান স্বর্গ স্বর্গ-বিলাসীর দল! ও-আঘাত আমার অচেনা নয়। বহুবার ওর শক্তি পরীক্ষা করেছি। (হঠাৎ বজ্রাঘাতে টলমলায়মান হইয়া) উঃ! যন্ত্ররাজ! আর পারিনে। দেবতাই বুঝি জয়ী হল!
    (বাষ্পরথে সসৈন্যে যন্ত্ররাজের আগমন)
    যন্ত্ররাজ :
    জাগো যন্ত্ররাজ-সেনা, জাগো! স্বর্গের চক্রান্তকে চিরদিনের মতো ব্যর্থ করতে চাই। আজকার জয় দিয়ে স্বর্গরাজ্য জয়ের কল্পনা বাস্তবে পরিণত করতে হবে। জাগো যন্ত্রী, জাগো সেনাদল!
    [ইঁট, কাঠ পাথর প্রভৃতি যন্ত্ররাজ-সেনার ও সেনাপতি যন্ত্রের ঘন ঘন জয়ধ্বনি করিতে লাগিল।…দেবাসুরের ভীষণ রণ-কোলাহল ক্লেদে ধরণি আকাশ পঙ্কিল ধূম্রাক্ত হইয়া উঠিল।]
    ঝঞ্ঝা :
    কোথায় নিশিত পাশুপতাস্ত্র! জাগো! দেবতার উদ্যত দণ্ড হয়ে যন্ত্ররাজের বক্ষ ভেদ করো। সাবাস! (পাশুপতাস্ত্র নিক্ষেপ ও যন্ত্ররাজের পতন। সঙ্গে সঙ্গে সেতুবন্ধও ভীষণ শব্দে পদ্মাগর্ভে নিপতিত হইল।)
    পদ্মা :
    জয় মা ভবানী। জয় দেব-শক্তির! গন্ধর্ব-লোকের জয়! (যন্ত্ররাজের বুকে ত্রিশূল হানিয়া) আজ হতে মর্ত্যে পশুর রাজত্বের অবসান হল! (যন্ত্ররাজের বিকট আর্তনাদে আকাশ যেন ফাটিয়া চৌচির হইয়া গেল।)
    ঝঞ্ঝা :
    জয় দেবরাজ ইন্দ্রের! জয় মন্দাকিনী-সূতা পদ্মাদেবী! আজ গন্ধর্ব-লোকের সাথে স্বর্গও অসুর-ত্রাস থেকে মুক্ত হল। জয় শিব শংকর!
    [তরঙ্গ-সেনাদল দলে দলে আসিয়া পতিত সেতুবন্ধের উপর পড়িয়া তাহাকে গ্রাস করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিপুল সেতুবন্ধ পদ্মাগর্ভে লীন হইল। উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ গগন-চুম্বন-প্রয়াসী হইয়া উঠিল।…দেখিতে দেখিতে মেঘ কাটিয়া গিয়া পূর্ব গগন রাস-রঙা রামধনু-শোভিত হইয়া উঠিল। অস্তপাট সোনার গোধূলি-রঙে রাঙিয়া উঠিল। সূর্যদেব সহস্র কর বর্ষণ করিয়া পৃথিবীকে আশীর্বাদ করিলেন। পদ্মা তরঙ্গ-শিরে একরাশ ছিন্ন শতদল লইয়া স্বর্গের পানে তুলিয়া ধরিলেন, ঝঞ্ঝার ধূর্জটি-কেশে পরাইয়া দিলেন। দূর মেঘ-লোকে বিজয়-দামামা-ধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল।]
    যন্ত্র :
    (মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে) আমার মৃত্যু নাই। দেবী! আজ তোমারই জয় হল। দেবতার মতো দানবও বলে, – ‘সম্ভবামি যুগে যুগে।’ আমি আবার নতুন দেহ নিয়ে আসব। আবার তোমার বুকের ওপর দিয়ে আমার স্বর্গজয়ের সেতু নির্মিত হবে।
    পদ্মা :
    জানি যন্ত্ররাজ! তুমি বারেবারে আসবে, কিন্তু প্রতিবারেই তোমায় এমনি লাঞ্ছনার মৃত্যু-দণ্ড নিয়ে ফিরে যেতে হবে!

    যবনিকা

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদিয়ো ফুলদল বিছায়ে
    Next Article ছোটো গল্প – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    ব্যথার দান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    গানের মালা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    যুগবাণী – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মহুয়ার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }