Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নাটক সমগ্র – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প166 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    শিল্পী

    প্রথম দৃশ্য

    [রোগ-শয্যায় শায়িত লায়লি – অস্তমান সপ্তমীর চাঁদের মতো ক্ষীণপ্রভ। গভীর অন্ধকার রাত্রি। শিয়রে বিমলিন-জ্যোতি তৈল-প্রদীপ আর চিত্র-অঙ্কনরত স্বামী।]

    লায়লি :

    তোমার ছবি আঁকা হল? – (চিত্রকর নীরবে-একমনে ছবি এঁকে চলেছে) – ওগো শুনছ?

    চিত্রকর :

    (চমকে উঠে) অ্যাঁ! আমায় ডাকছিলে লায়লি?

    (লায়লি অভিমানে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে চোখের জল গোপন করল। চিত্রকর আবার একমনে চিত্র আঁকতে লাগল।)

    লায়লি :

    (পাশ ফিরে গভীর দীর্ঘ-নিশ্বাস মোচন করে) দোহাই! তুমি অন্য ঘরে ছবি আঁক গিয়ে! আমার বড্ড বিশ্রী লাগছে! (শেষের কথা কয়টা বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল)

     

    (চিত্রকরের হাত হতে তুলি পড়ে গেল – লায়লির কান্না-দীর্ণ স্বরের তীব্রতায়)

    চিত্রকর :

    (সবিস্ময়ে) লায়লি! তুমি কাঁদছ?

    লায়লি :

    (তীব্রস্বরে) না! রহস্য করছি! তুমি একটু অন্য ঘরে উঠে যাবে? দয়া করে আমায় একটু একলা থাকতে দাও!

    চিত্রকর :

    (উদাসীনভাবে) আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। তোমার রোগ-যন্ত্রণা আর বাড়াতে চাইনে তোমার কাছে থেকে। (চলে যাওয়ার উপক্রম করল।)

    লায়লি :

    যেয়ো না। দুটো কথা আছে, শুনে যাও।

    চিত্রকর :

    (বসে পড়ে) বলো।

    লায়লি :

    ওখানে না। আমার পাশে এসো বসো।

    চিত্রকর :

    (লায়লির পাশে বসে) বলো। (আনমনে লায়লির কপোল ও ললাট হতে অলকগুচ্ছ তুলে দিতে লাগল।)

    লায়লি :

    সত্যি করে বলো দেখি, তুমি বিয়ে করেছিলে কেন?

    চিত্রকর :

    বিয়ে করার জন্যই।

    লায়লি :

    হেঁয়ালি রাখো। তুমি শিল্পী, তুমি কেন আমাকে তোমার দুঃখের সাথি করে তোমার স্বচ্ছন্দ জীবনকে এমন বোঝা করে তুললে? আমি জানি আর তুমিও জান, তুমিও শান্তি পাচ্ছ না, আমিও সোয়াস্তি পাচ্ছিনে, আমাদের এই টানাটানির জীবন নিয়ে।

    চিত্রকর :

    তুমি সেরে ওঠো, তারপর সব কথা বলব। আজ নয়।

    লায়লি :

    না, তুমি আজই বলো। মরতেই যদি হয়, তবে ও-জিনিসটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভালো। জীবনে অনেক টানাহেঁচড়া করেছি, মরণে আর ওটা সইবে না।

    চিত্রকর :

    সব কথা কি সব সময় মানুষ বলতে পারে লায়লি? … আমি কি শুধু শিল্পীই? আমি কি সিরাজ নই? বিয়ে তোমায় করেছে মানুষ-সিরাজ, শিল্পী-সিরাজ নয়।…তোমাতে আমাতে দ্বন্দ্ব কোন্খানে, জান? তুমি চাও শুধু মানুষ-সিরাজকে, শিল্পী-সিরাজকে তুমি দু-চোখে দেখতে পার না। অথচ আমি মানুষ-সিরাজ যতটুকু, তার অনেকগুণ বেশি শিল্পী-সিরাজ।

    লায়লি :

    (অনেকক্ষণ ভেবে) ধরে নিলুম, তোমার কথাই সত্যি। তা হলেও, আমার মাঝে কি শুধু রক্ত-মাংসের মানুষেরই ক্ষুধা পরিতৃপ্তির সমাপ্তি আছে, আনন্দবিলাসী শিল্পীর ধেয়ান-লোকের কোনো কিছুই নেই?

    চিত্রকর :

    আছে। তোমাকে আমার ধেয়ান-লোকে পাই, যখন তুমি থাক আমার ধরা-ছোঁয়ার আড়ালে। তখন তুমি শুধু আমার অঙ্ক-লক্ষ্মী নও, শিল্পী-সিরাজের হৃদয়-লক্ষ্মী, ধেয়ানের ধন।… যে ফুলের মালা সন্ধ্যায় লাগে ভালো, নিশিশেষে তা যদি বাসি ঠেকে, লায়লি তার জন্য অপরাধী তুমিও নও, আমিও নই। চির-সুন্দরের তরে নিত্য নব-তৃষা মানুষের চিরকেলে অপরাধ। এই তৃষা যার যত প্রবল, সে সুন্দরের তত বড়ো ধেয়ানী। মানুষের শৃঙ্খলিত সমাজে হয়তো সেই আবার তত বড়ো অপরাধী।…মস্ত ভুল করেছি লায়লি, স্বর্গের সুন্দরকে ধুলার আবিলতায় নামিয়ে।

    লায়লি :

    আমিও বুঝতে পারিনে, অপরাধ কার কতটুকু। তোমার কলঙ্কে যখন দেশ ছেয়ে গেছে, তখনও আমি তোমায় ভালোবেসেছি সকলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সবাই যখন বড়ো করে দেখত তোমার কলঙ্ক, আমি তখন দেখেছি তোমার জ্যোৎস্না। আমি কতদিন অহংকার করে বলেছি, ‘কলঙ্কী চাঁদকে দেখে সাগরের বুকেই জোয়ার জাগে, খানা-ডোবা চাঁদকে চেনেও না, তাদের বুকে জোয়ারও জাগে না।… কিন্তু আজ কেন মনে হচ্ছে, আমিও তোমায় ভালোবাসিনি, তোমার যশ, তোমার খ্যাতিকে ভালোবেসেছি। নইলে সাগরে জোয়ার তো শুধু পূর্ণিমার চাঁদকে দেখেই জাগে না, অমানিশির নিরুজ্জ্বল চাঁদকে দেখেও সে সমান উতলা হয়।

    চিত্রকর :

    দূরে থেকে তুমি ভালোবেসেছিলে – শিল্পীকে, কাছে এসে পেতে চাও সিরাজকে – মানুষকে।…এটাই তোমাদের নারীর ধর্ম। তোমরা আকাশের জ্যোতিষ্ক হতে চাও না – হতে চাও মাটির ফুল। তোমরা শুধু দূরের সুন্দরের ধ্যানেই তৃপ্ত হতে পার না, নিকটের নির্মমকেও পেতে চাও। যে বিরহে তোমরা বেদনা-ক্ষুণ্ন বিষাদিনী, সেই বিরহে পুরুষ হয়ে ওঠে ধেয়ানী তপস্বী। তোমরা কাঁদ, পুরুষ ধ্যান করে। তোমরা যেখানে কর অভিসম্পাত, পুরুষ সেখানে করে স্তব।

    লায়লি :

    কী জানি, তোমাদের সব কথা সব সময় বোঝা যায় না। আজও বুঝি না।… আমার দুঃখ এইটুকু যে, আমার বলতে তোমার কাছে কিছু পেলুম না। শিল্পী-সিরাজ তো সকলের। সেখানে আর একার দাবি অস্বাভাবিক আবদার, তা বুঝি। কিন্তু যদি দেখি, সিরাজ শুধু শিল্পীই, সে মানুষ-শিরাজ নয়, সেখানে আমার সান্ত্বনা কোথায়? দূরের মানুষ অল্প নিয়েই খুশি থাকতে পারে, আমার পোড়াকপাল – আমি যে তোমার নাকি সহধর্মিণী, নইলে কীসের দুঃখ আমার?

    চিত্রকর :

    উপায় নাই লায়লি, উপায় নাই! যাদের আমি একদিন আমার সকল হৃদয়-মন দিয়ে চেয়েছি, আজ তারা সবাই আমার কাছে পুরাতন হয়ে উঠেছে। শিল্পী-আমারই জয় হল। মানুষ আমি বহুদিন হল মরে গেছি, মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না কেন যেন আর আমায় বিচলিত করতে পারে না। শুধু মনে হয় প্রাণ ভরে সুন্দরকে দেখে যাই, রেখায় রেখায় রঙে রঙে তাকে অমর করে যাই। আমরা শিল্পীরা তো চির-নূতন করে রেখেছি, চির-যৌবন দিয়েছি সুন্দরকে, আমাদের মনের নবীনতা দিয়ে, যৌবন দিয়ে।…যখন মনে করি, তুমি আমার কেউ নও, মনে হয় কোন লোকের যেন অপরিচিতা, তখন তুমি সুন্দর। যখন তোমায় পাই বাহুর বন্ধনে বুকের পাশে, তখন তুমি নারী – প্রজাপতির পাখার রং-এর মতো ছুঁলেই রং যায় মুছে।

    লায়লি :

    আমি যদি মরে যাই, তোমার দুঃখ হবে না? তুমি কাঁদবে না?

    চিত্রকর :

    না। শয্যাপার্শ্বে বাহুর বন্ধনে যাকে ধরতে পারিনি, তাকে ধরব ধেয়ানের গোপন-লোকে। আমার তুলির রেখায় রেখায় রঙে রঙে তোমায় দান করব চির-বৈচিত্র্য, চির-নবীনতা, চির-যৌবন। মরলোকের বধূ আমার হবে অমর লোকের অপ্সরি। আমার গৃহলক্ষ্মী হবে নিখিল-শিল্পীর বিশ্বলক্ষ্মী!

    লায়লি :

    ওগো দোহাই তোমার! আমি চাইনে অত গৌরব, অত মহিমা! তুমি আমায় বাঁচিয়ে তোলো! আমি বাঁচতে চাই। তোমায় পেতে চাই ! মরতেই যদি হয়, এত দারুণ তৃষ্ণা নিয়ে মরতে চাইনে। আমি মরতে চাই স্বামীর কোলে, পুত্র-কন্যা আত্মীয়-স্বজনের মাঝে। যেতে চাই বাড়ি-ভরা ক্রন্দনের তৃপ্তি নিয়ে। এমন করে এই মাঠের মাঝে শূন্য ঘরে এক পাষাণের পায়ের তলে পড়ে মরবার আমার সাধ নেই!

    চিত্রকর :

    (অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে) উপায় নেই লায়লি, উপায় নেই! সত্যিই আমি নিরুপায়। (বাহিরে দরজায় কাহার করাঘাত শোনা গেল) কে?

     

    (বাহিরের শব্দ।) আমি তোমার বন্ধু।

    লায়লি :

    (চিৎকার করে) খুলো না! দোর খুলো না! আমি চিনেছি, ও কে। ও ডাইনি, ও চিত্রা।

    চিত্রকর :

    ছিঃ লায়লি! তুমি শিক্ষিতা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, এ কী ব্যবহার তোমার?

    চিত্রা (বাহির হতে) :

    আমি ভিতরে যাব না বন্ধু, তুমি বেরিয়ে এসো।

    লায়লি :

    যাও! তোমার বাইরের ডাক এসেছে। তোমার সুন্দরের ধ্যান আমি ভাঙব না। আমায় ক্ষমা করো। আমি যেদিন থাকব না ওই চিত্রার মাঝেই আমাকে স্মরণ করো।

    [চিত্রকর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। ঘরের প্রদীপও সাথে সাথে নিভে গেল।]

     

    দ্বিতীয় দৃশ্য

    [লায়লির পিত্রালয়। নদীতীরে সুরম্য অট্টালিকার নির্জন প্রকোষ্ঠে লায়লি ও চিত্রকর। সপ্তমী চাঁদের পানসে জ্যোৎস্না বাতায়ন-পথে এসে শিল্পীর চোখে-মুখে পড়ে তাকে বন্দি দেবকুমারের মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল। শিল্পী নদীর ঢেউয়ে চাঁদের খেলা দেখছিল]

    লায়লি :

    ‘লায়লি’ মানে জান?

    চিত্রকর :

    (উদাস স্বরে) জানি – নিশীথিনী।

    লায়লি :

    সত্যিই আমি নিশীথিনী – অমা-নিশীথিনী। চাঁদ নেই, তারা নাই, – অন্ধকার আর আকাশ!

    চিত্রকর :

    (হেসে) আর একজন লায়লি ছিল, তার প্রেমিকের নাম ছিল মজনু, অর্থাৎ উন্মাদ।

    লায়লি :

    জানি।

    চিত্রকর :

    কিন্তু সে লায়লি এ লায়লির মতো সুন্দর ছিল না।

    লায়লি :

    (তীব্র স্বরে) দোহাই! আর বিদ্রুপ কোরো না। ও প্রশংসা চিত্রাকে করো, সে খুশি হবে।

    চিত্রকর :

    হয়তো হবে। তবু মনে হয়, তুমি সুন্দর, চিত্রা অপূর্ব।

    লায়লি :

    তার মানে?

    চিত্রকর :

    তুমি ধরার চাঁদ, চিত্রা আকাশের চাঁদ। ওই নদীর ঢেউ-এ চাঁদের লীলা দেখছ? ওকে বোঝা যায় না, ও কেবলই রহস্য।

    লায়লি :

    এই কথা বলবার জন্যেই কি এখানে এসেছ? যদি তাই এসে থাক, তবে দয়া করে তুমি ফিরে যাও। তোমার আর চিত্রার মাঝে গিয়ে আমি দাঁড়াতে চাইনে। আমি বহু কষ্টে বেঁচে উঠেছি।

    চিত্রকর :

    কীজন্য এসেছিলাম লায়লি, তা আর মনে নেই। এখন মনে হচ্ছে ওই চাঁদ ওই নদী আর ওই নদীর জলে চাঁদের খেলা দেখতেই এসেছি যেন। (অনেকক্ষণ ধরে কী ভাবলে) কদিন থেকে এও মনে হচ্ছিল, তুমি আমায় ডাকছ। সত্যি কি তুমি ডেকেছিলে আমায়?

    লায়লি :

    মা তাই বলেন। যখন রোগ খুব বেড়েছিল, তখন নাকি তোমায় ডাকতাম অজ্ঞান অবস্থাতেও।

    চিত্রকর :

    কি জানি লায়লি, কিছু বুঝিনে। অদ্ভুত এই মানুষের মন। কাছে থাকলে যাকে মনে হয় বোঝা, দূরে থেকে সে-ই কী করে এমন আকর্ষণ করে, বুঝতে পারিনে। আমার মাঝে এই যে মানুষের আর শিল্পীর দ্বন্দ্ব বেধেছে এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই এসেছি এখানে – একেবারে ‘মরিয়া হইয়া’।

    লায়লি :

    কী জানি, আমার ভয় করছে কেন তোমাকে দেখে অবধি। মনে হচ্ছে কী একটা সংকল্প করছ তুমি মনে মনে। তুমি কি কোথাও চলে যেতে চাও?

    চিত্রকর :

    তাই। আমি চলে যাব বলেই এসেছি। মানুষ কেবলই পিছু টানছে – শিল্পী কেবলই ইঙ্গিত করছে দূরের পানে – যে পথে বাঁশির সুর যায় উধাও হয়ে, ফুলের সুবাস যায় হাওয়ায় মিশে। মনে হয় ওই কোকিল, পাপিয়া ‘বউ কথা কও’ – সকলে আমার বন্ধু, ওরা আসে গান করে, আবার চলে যায়।

    তারলায়লি :

    তারা আবারও আসে, আবার গান করে।…দেখো, আমি অনেক ভেবে দেখেছি, তোমাকে জোর করে ধরে রেখে আমারও শান্তি নেই। তুমি যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াও, শুধু মাঝে মাঝে আমায় দেখা দিয়ে যেয়ো। (বলতে বলতে কন্ঠরোধ হয়ে গেল)

    চিত্রকর :

    আসব, আপনা থেকেই আসব। আর যদি না আসি, ভুলে যেয়ো।

    লায়লি :

    (শান্তস্বরে) তাই ভুলে যাব। আজই এখনই যাও, তাহলে, ওই চাঁদ ডোবার আগেই।

    চিত্রকর :

    (ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল) লায়লি!

    লায়লি :

    দাঁড়াও! যাবার আগে একটা জিনিস উপহার দেবো, নেবে?

    চিত্রকর :

    দাও। (লায়লি অন্য ঘর হতে একটি চিত্র এনে চিত্রকরকে দিয়েই চলে যাচ্ছিল) একি! এ চিত্র কে আঁকলে?

    লায়লি :

    (চলে যেতে যেতে) আমি!

    চিত্রকর :

    অ্যাঁ! তুমি?

    লায়লি :

    হাঁ, ওই আমার দীর্ঘ বিরহের তপস্যার স্মৃতি।

    চিত্রকর :

    এই দীর্ঘ দিন মাস শুধু আমারই ছবি এঁকেছে? যে তোমার জীবনকে ব্যর্থ…

    লায়লি :

    (মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) ব্যর্থ করনি শিল্পী। কিন্তু সেকথা তুমি বুঝবে না (চলে গেল)।

    চিত্রকর :

    (চিত্রখানা ললাটে স্পর্শ করিয়ে) তুমি সুখী হবে, তুমি সুন্দরের সান্নিধ্য লাভ করেছ (ধীরে ধীরে নেমে দূর জ্যোৎস্না-ধৌত পথে মিলিয়ে গেল। লায়লি বাতায়ন-পথে তাই দেখতে দেখতে মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেল)।

     

    তৃতীয় দৃশ্য

    [শৈল-নিবাস। সন্ধ্যা]

    চিত্রা :

    আচ্ছা সিরাজ, একটা কথা বলব, তুমি সত্য করে উত্তর দেবে?

    চিত্রকর :

    ‘সিরাজ’ নয় চিত্রা, শিল্পী বলো, বলো, বন্ধু বলো – যা বরাবর বলেছ।

    চিত্রা :

    আর কিছু না? তুমি শুধু শিল্পীই? শুধু আনন্দ-লোকের নিঃসঙ্গ স্বপ্নচারী তুমি? এই মাটির মদির গন্ধ তোমায় মাতাল করে তোলে না?

    চিত্রকর :

    তোলে চিত্রা। সে শুধু নিমেষের জন্য। তারপর উড়ে চলি ঊর্ধ্বে, আরও ঊর্ধ্বে, যে ঊর্ধ্বলোক হতে পৃথিবীর চিহ্ন মুছে যায়। ঊর্ধ্বে, নিম্নে চারপাশে শুধু আকাশ, শুধু সুনীলের শান্ত উদার শূন্যতা, সেইখানে উঠে গাই আনন্দের গান। সেইখানে বসে রচনা করি আমার চিত্রলেখা।

    চিত্রা :

    আচ্ছা, আমায় চিত্রা বল কেন? আমি তো চিত্রা নই।

    চিত্রকর :

    জানি। কিন্তু তুমি যে আমার সুন্দরের প্রতীক। আমার শিল্পী-লক্ষ্মী, ধেয়ান-প্রতিমা তুমি।

    চিত্রা :

    তুমি এমন করে বল বলেই তো তোমায় কাছে – আরও কাছে পেতে ইচ্ছে করে – যেমন করে আমার নোটন-পায়রাগুলিকে বুকে জড়িয়ে চুমু খাই তেমনই করে। আমিও তোমায় শাপভ্রষ্ট দেবকুমার শিল্পী বলেই জানতাম। তাই তোমার কাছে এসেছিলাম শ্রদ্ধার পূজাঞ্জলি নিয়ে। তুমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখলে। আমার রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে, তবু ওই চাওয়া দেখে মনে হল, আমার এত রূপ সার্থক হল এতদিনে। মনে হল, এত রূপ ধরবার মতো শুধু এই দুটি চোখই আছে পৃথিবীতে। তোমার স্তব-গানে আমার হৃদয় শতদলের মতো বিকশিত হয়ে উঠল! (দীর্ঘশ্বাস মোচন করে) হায় উদাসীন! তুমি আমায় বুঝবে না। তুমি বিকশিত শতদলের শোভা দেখ শুধু, বেদনায় শতদল বিকশিত হয়ে ওঠে সে বেদনার কী বুঝবে তুমি?

    চিত্রকর :

    সত্যি চিত্রা, শিল্পী চাঁদ পাখি – এরা আর সব বোঝে, শুধু বোঝে না বেদনা।

    চিত্রা :

    তুমি পাষাণ অ্যাপোলো। তবু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, সত্যি তোমার মনে আর কোনো লোভ নেই? যে ফুল কাননে ফোটে, তাকে কাননেই ঝরতে দিতে চাও, মালা করে গলায় পরাতে ইচ্ছা করে না?

    চিত্রকর :

    না বন্ধু, ফুলের সুবাসই আমার পক্ষে যথেষ্ট, তাঁকে গলায় জড়িয়ে ফাঁসি পরবার সাধ আমার নহে।

    চিত্রা :

    আমি অন্যের হলে তোমার দুঃখ হবে না?

    চিত্রকর :

    হবে। সে দুঃখ আমার জন্য নয়, তোমার জন্য। সুন্দর ফুল এমনি ঝরে পড়ে তা সওয়া যায়, কিন্তু তাকে জোর করে বৃন্তচ্যুত করে কাঁটা বিঁধে মালা করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।

    চিত্রা :

    (দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান স্বরে) ও-ব্যথা তো সকলের জন্যে। একা-আমার জন্য তোমার কোনো ব্যথাই নেই?

    চিত্রকর :

    (আকুল স্বরে) না চিত্রা। আমি শিল্পী, হৃদয়হীন নির্বেদ উদাসীন শিল্পী!

    চিত্রা :

    (সজল কণ্ঠে) তা হলে আমি যাই?

    চিত্রকর :

    (শান্ত স্বরে) যাও।

    চিত্রা :

    তোমার একটা কিছু দেবে আমায় – তোমায় মনে রাখবার মতো কিছু?

    চিত্রকর :

    (তার তুলি নিয়ে) এই নাও।

    চিত্রা :

    এ কী? তুলি? তুমি আর ছবি আঁকবে না?

    চিত্রকর :

    (সাশ্রুনেত্রে) না চিত্রা! আমার এই তুলি বহু হৃদয়ের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে, আর পারি না!

    চিত্রা :

    (সবিস্ময়ে) এ কী শিল্পী?

    চিত্রকর :

    এই সত্যি চিত্রা! জীবনে এই প্রথম অশ্রু এল আমার চোখে। যেই তুমি চলে যেতে চাইলে, অমনি কেন আমার এই প্রথম মনে হল, এমন সুন্দর বিশ্ব কে যেন তার স্থূল হস্ত দিয়ে মুছে ফেলছে! – আমি চললাম চিত্রা!

    চিত্রা :

    (হাত ধরে) কোথায় যাবে বন্ধু?

    চিত্রকর :

    (ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেই হাতে চুম্বন করে) যে-পথে পৃথিবীর কোটি কোটি ধূলিলিপ্ত সন্তান নিত্যকাল ধরে চলেছে, সেই দুঃখের, সেই চিরবেদনার পথে। (প্রস্থান)

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদিয়ো ফুলদল বিছায়ে
    Next Article ছোটো গল্প – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    ব্যথার দান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    গানের মালা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    যুগবাণী – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মহুয়ার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }