Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিউকামার – কেইগো হিগাশিনো

    কেইগো হিগাশিনো এক পাতা গল্প310 Mins Read0

    অধ্যায় ১ – রাইস ক্র্যাকার দোকান মালিকের মেয়ে

    এক

    “তাও ভালো যে গরমটা একটু কমেছে। কে বলবে যে কেবল জুনের ১ তারিখ!”

    দোকানের পেছনের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে বললো সাতোকো। রাইস ব্র্যাকারের প্যাকেটগুলো শেলফে সাজিয়ে রাখবে সে এখন।

    “কেবলই হাসপাতাল থেকে ফিরলে তুমি, দাদিমা। এখনই এত দৌড়ঝাঁপ করাটা উচিৎ হচ্ছে না কিন্তু। বাবা দেখলে আমার খবরই আছে,” ভ্রু কুঁচকে বললো নাহো।

    “আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না তোর। শরীর ভালো না হলে কি হাসপাতাল থেকে ছাড়তো? তাছাড়া আমি না থাকলে ব্যবসা দেখবে কে শুনি? সবকিছু শিখে রাখ আমার কাছ থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তোকে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য, কথাটা শুনিসনি?”

    “উফ! আবারো সেই এক কথা,” মেয়োনিজ ফ্লেভারের একটা রাইস ক্র্যাকার মুখে দিয়ে বললো নাহো।

    নাতনির দিকে মুখ ফেরালো সাতোকো।

    “যখনই তাকাই, দেখি তোর মুখে রাইস ক্র্যাকার। বুঝলাম এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা, তাই বলে একটার পর একটা খেয়েই যেতে হবে নাকি? বলি একই জিনিস খেতে এত ভালো লাগে? অরুচি ধরে না?”

    “এটা নতুন ফ্লেভার।”

    “নতুন হোক আর পুরনো, রাইস ক্র্যাকার তো রাইস ক্র্যাকারই। আমার একদমই ভালো লাগে না। দাঁতের বারোটা বাজিয়ে দেয়।

    “তাহলে পঞ্চাশ বছর ধরে এই দোকানটা চালিয়ে যাচ্ছো কেন, শুনি?”

    তোকে আগেও অনেকবার বলেছি নাহো, আমরা রাইস ক্র্যাকার বিক্রি শুরু করেছি ত্রিশ বছর আগে। প্রথমে কেবল বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি বিক্রি হতো দোকানে। কিন্তু একদিন তোর বাবা বলে যে রাইস ক্র্যাকারের ব্যবসা শুরু করবে। আহ! সুইট বিন জেলিগুলোর স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।”স্বাদ ‘এখনও’ মুখে লেগে আছে মানে? এই তো কিছুদিন আগেও না খেলে!”

    এই সময় হৃষ্টপুষ্ট গড়নের স্যুট পরিহিত একটা লোক কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো দোকানে।

    “হ্যালো,” একবার বাউ করে বললো সে।

    “ওহ, মি. তাকুরা, এসেছেন তাহলে। ধন্যবাদ,” সাতোকো বললো। “এই গরমে আপনাকে এখানে টেনে আনার জন্যে দুঃখিত।

    “ব্যাপার না। এটা তো আমার কাজের অংশ। তাছাড়া, বিকেলের পর গরম একটু কমেছে। দুপুরের দিকে তো সহ্যই করা যাচ্ছিল না।”আপনি নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত। ভেতরে এসে বসুন, ঠাণ্ডা কিছু খান,” দোকানের পেছনের ঘরটার দিকে ইশারা করে বললো সাতোকো। ওখানেই তাদের লিভিংরুম।

    “ধন্যবাদ, কিন্তু আমাকে কেবল ওটা দিয়ে দিলেই চলবে,” হাত দিয়ে একটা আয়তক্ষেত্র এঁকে দেখালো তাকুরা।

    “আমার মেডিক্যাল সার্টিফিকেটটা তো? কোন সমস্যা নেই, নাহো আর আমি আজকে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ওকে বলেছি যে একা যেতে পারবো, তবুও পিছু ছাড়েনি।”স্যান্ডেল খুলে ফেললো সাতোকো।

    “তুমি থাকো, দাদীমা। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি,” দাদীর উদ্দেশ্যে বলে পেছনের ঘরে ঢুকে পড়লো নাহো

    “তুই জানিস তো ওটা কোথায় রাখা?” সাতোকো হাঁক ছাড়লো। “জানবো না কেন? আমিই তো রেখেছি। তুমিই বরং জানো না যে কোথায় কি রাখা।”

    দোকান থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেল নাহো। নিশ্চয়ই দাদীমা কোন মন্তব্য করেছে।

    “চা নিয়ে আসতে ভুলিস না,” সাতোকো বললো কিছুক্ষণ পর। “হ্যাঁ বাবা, আনবো!” মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করলো নাহো। ওর দাদী একটু বেশিই করেন মাঝেমাঝে

    একটা গ্লাসে ঠাণ্ডা উলং চা ঢেলে ট্রেতে করে দোকানে নিয়ে এলো সে। সাকোতো আর মি. তাকুরা হাসিমুখে গল্পে মশগুল।

    “আগের চেয়ে অনেক ভালো দেখাচ্ছে আপনাকে। চারদিন আগেই তো একবার এসেছিলাম বোধহয়। তখনকার তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে,” অভিভূত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো তাকুরা।

    “বাসায় ফিরে আসলেও লাভ হয়েছে। এখন আগের চাইতে অনেক ভালো বোধ করছি। সব কাজও করতে পারি, কিন্তু নাহো খালি পেছনে লেগে থাকে। কিছু করতে দিতে চায় না।”

    “কারণ ও আপনাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে,” হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে উলং চায়ের একটা গ্লাস তুলে নেয়ার সময় বলে তাকুরা।

    অনেক ধন্যবাদ। চমৎকার হয়েছে চা’টা।”

    “এই নাও, দাদিমা।”

    নাহো একটা খাম বাড়িয়ে ধরলো সাতোকোর দিকে।

    “ধন্যবাদ।”

    খামের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে তাকুরার হাতে ধরিয়ে দিল সাতোকো। বেশ সময় নিয়ে ভেতরের লেখাগুলো পড়লো তাকুরা।

    “ওরে বাবা! পুরো দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন আপনি? খুব বেশি সমস্যা হয়নি তো?”

    “আর বলবেন না। এখনকার হাসপাতালগুলোর হিসেব নিকেশ বুঝি না। ভর্তি হলাম এক সমস্যা নিয়ে, আর ওরা চিকিৎসা শুরু করলো আরেক সমস্যার। দুই মাস সেই রোগের ঔষধই দিয়েছে টানা।”

    “সার্টিফিকেটে লেখা আপনার বাইল ডাক্টে একটা ইনফেকশন হয়েছিল। ওহ, অ্যানিউরিজমের পরীক্ষাও করেছে দেখছি।”

    “অ্যানিউরিজম কি জানেন তো? রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল ভেতরে একটা শিরায়। সেটার অপারেশন করাতেই ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু পরে আর অপারেশন হয়নি।”

    “সামনে তো অপারেশন হবে, নাকি?”

    “হওয়ার তো কথা। কিন্তু আপাতত অপারেশন ছাড়াই যতদিন চলা যায়। এই বয়সে অপারেশন একটু বেশিই ঝুঁকিপূর্ণ।”

    “বুঝতে পেরেছি। এসব সিদ্ধান্ত নেয়াটা একটু কঠিনই, “ তাকুরাকে দেখে মনে হচ্ছে অস্বস্তিতে ভুগছে সে।

    “সার্টিফিকেটটা ঠিক আছে তো?” সাতোকো জিজ্ঞেস করলো।

    “হ্যাঁ। সেদিনও কিছু দরকারি কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। সব হয়ে গেছে, এখন কেবল এটা অফিসে নিয়ে গিয়ে বাকি কাজটুকু যত দ্রুত সম্ভব সেরে ফেলব। আপনার হাসপাতালের বিলের টাকা আগামী মাসের মধ্যে পেয়ে যাবেন।”

    “এখন আবার অফিসে ফিরবেন? এই সময়ে?”

    “আরে, ওসব নিয়ে ভাববেন না। কাজ শেষ না করে বাড়ি যেতে আমার নিজেরও ভালো লাগে না।” সার্টিফিকেটটা ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রাখলো তাকুরা। নাহোর উদ্দেশ্যে হেসে বললো, “চায়ের জন্যে ধন্যবাদ।”

    “ধন্যবাদটা আসলে আপনার প্রাপ্য,” জবাবে বললো নাহো

    তাকুরাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিল সাতোকো।

    প্রায় দু’ঘন্টা পর ফুমিতাকা(নাহোর বাবা) বাড়ি ফিরল। তার পরনের সাদা শার্টটার কলারে ময়লার দাগ।

    “পাইকারি বাজারে গিয়েছিলাম,” জুতো খুলে বললো সে। “আসার পথে দেখলাম কোদেনমাচোতে অনেক ভিড়। কিছু হয়েছে মনে হয়। পুলিশে গিজগিজ করছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা বা ওরকম কিছু না, এটা নিশ্চিত।”

    “তাহলে আবার কি হলো?” নাহো জিজ্ঞেস করে।

    “গুরুতর কিছু না হলে তো আর পুলিশ আসবে না।”

    “এই এলাকাটা আর নিরাপদ নয়,” সাতোকো বলে এসময়। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সদ্য রান্না করা মিসো স্যুপটা চেখে দেখছিল সে। “অনেক বেশি নতুন মুখ দেখি এখন রাস্তায় বের হলেই। নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলোতে থাকে সবাই।”

    ফুমিতাকা কিছু না বলে টিভিতে বেইজবল দেখায় মনোযোগ দিল। নাহো টেবিলে বসে আছে। দাদিমার এই অভিযোগ অনেক পুরনো। মহল্লায় নতুন আগতদের একদমই পছন্দ নয় তার। তাদের কারণেই নাকি এখানে অপরাধের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।

    ওদের বাসায় নিয়ম হচ্ছে রাতের খাবার সবাই মিলে একসাথে খাবে। ফুমিতাকা বাইরে থাকায় নাহো আর সাতুকো তার জন্যে অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। সাধারণত আরো আগেই ডিনার সেরে নেয় কামিকাওয়া পরিবারের সদস্যরা।

    এক সপ্তাহ আগ অবধি ঘরের সব রান্না নাহোই করতো, কিন্তু সাতুকো হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসায় সবকিছু এখন আবার স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে গেছে।

    নাহো যখন কিন্ডারগার্টেনের ছাত্রী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তার মা। তখনকার স্মৃতি খুব বেশি মনে না থাকলেও ঘটনাটা ওর মনে চিরস্থায়ী একটা দাগ ফেলে দেয়। কষ্টটা পুরোপুরি ভুলতে পারেনি কখনোই। তবে পারিবারিক ব্যবসার খাতিরে বাবা সবসময় কাছেই থাকায় আদর যত্নের অভাব হয়নি। তাছাড়া দাদি তো আছেই। মা’র ভালোবাসার অভাব কোন কিছুতেই পূরণ হয় না, এটা ঠিক। কিন্তু সাতোকো সেই অভাব কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিয়েছে। এমনকি স্কুলে নাহোর টিফিন বক্স অনেকেরই ঈর্ষার কারণ ছিল।

    এপ্রিলে নাহো যখন জানতে পারে তার দাদী গুরুতর অসুস্থ, খুব কষ্ট পায়। কিছুতেই কান্না থামছিল না তার। ফুমিতাকা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে মেয়েকে।

    সাতোকো যেমনটা ইন্স্যুরেন্স সেলসম্যান লোকটাকে বলেছে কিছুক্ষণ আগে। প্রথমে ছোট একটা অপারেশনের জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সে। কিন্তু অপারেশনের আগে ভীষণ জ্বর আসায় ডাক্তাররা তারিখ পিছিয়ে দেয়। জ্বরে তিনদিনের মতন অচেতন থাকে সাতোকো। চতুর্থ দিনে হুঁশ ফিরে পায়। নাহো আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সেদিন।

    ডাক্তার জানায় যে কোলানজাইটিসের কারণে ওরকম জ্বর হয়েছিল। বাইল ডাক্টে এক ধরণের ইনফেকশন। সেই মুহূর্তে নাহো বুঝতে পারে তার দাদীর বয়স হয়েছে। যে মানুষটার উপরে এতদিন সবকিছুর জন্যে ভরসা করতো, তার শরীরটা এখন রোগে-শোকে ন্যুব্জ।

    হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর নাহো দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল- “তুমি এতদিন আমার খেয়াল রেখেছ, এবার আমরা তোমার খেয়াল রাখব।“

    “নাতনির কথা শুনে সেদিন সাতোকোও আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। শব্দ করে কেঁদে ওঠে সবার সামনেই।

    তবে দাদী আর নাতনির এই সুসম্পর্ক খুব বেশিদিন বহাল থাকে না। প্রথম দিকে বাড়ি ফেরার পর নাহোর ঘরকন্নার কাজে করা ছোটখাটো ভুলগুলো আমলে না নিলেও, ধীরে ধীরে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় সাতোকো। নাহোর সব কাজেই খুঁত ধরতে শুরু করে সে। মাঝে মাঝে দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়েনি। বদমেজাজী এবং চাঁছাছোলা জবানের সাতোকো বুঝত না, বা বোঝার চেষ্টা করতো না যে তার কথা শুনে কষ্ট পাচ্ছে নাহো। ওদিকে নাহো নিজেও তার দাদীর মেজাজ পেয়েছে। যা হবার তা-ই হলো শেষমেষ। একদিন পাল্টা বলে ওঠে নাহো- “এতই যদি ঘ্যানঘ্যান শুনতে হয় সবসময়, আমি ইস্তফা দিলাম। তুমি নিজেই করো।“

    কিছুদিনের মধ্যেই রান্নাঘর থেকে সবখানে স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করলো সাতোকো।

    এতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় ফুমিতাকা। নাহো যতদিন রান্নাঘরের দায়িত্বে ছিল, প্রায় দশ কেজির মত ওজন হারিয়েছে সে। এখন সাতোকো রান্নার দায়িত্ব নেয়ায় হারানো ওজনগুলো ফিরে পাচ্ছে।

    “তুমি তো বিউটি স্কুলে ঠিকঠাক যাচ্ছ, তাই না?” ফুমিতাকা জানতে চায় নাহোর কাছে। “ক্লাস করতে সমস্যা হচ্ছে না তো?”

    “না, বাবা। একদিনও বাদ পড়েনি। আজকে ছুটি, এজন্যেই বাসায় আমি।”

    “ঠিক আছে, তাহলে।”

    “আমাদের ছোট্ট নাহো নামকরা হেয়ারড্রেসার হবে! আশা করি কোন সমস্যা পাকাবে না আবার।“

    “সমস্যা পাকাবো কেন?” আগুনঝরা দৃষ্টিতে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে নাহো। এখন ওর পক্ষে তো আর বলা সম্ভব না যে সাতোকোর অসুস্থতার সময় বেশ কয়েকটা ক্লাস বাদ দিতে হয়েছিল, যে কারণে পিছিয়ে পড়েছে কিছুটা।

    “তোমাকে আমরা বিউটি স্কুলে পাঠাচ্ছি যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারো, নিজের হাত খরচটুকু যোগাতে পারো,” ফুমিতাকা বলে। “জানি এই কথাটা আগেই বলেছি অনেকবার, কিন্তু―”

    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি আমি। অনেকবার না, কয়েক কোটি বার বলেছ। যারা নিজের হাতে উপার্জন করে না, তাদের খাবার মুখে দেয়ার কোন অধিকার নেই।”

    দুই

    নাহোর বিউটি স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে এপ্রিল মাস থেকে ভর্তির পর ক্লাস শুরু হবার অপেক্ষা করছিল, সেই সময় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় সাতোকোকে। ফলে সমসাময়িক অন্যান্যদের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাড়তি ক্লাস করে সেটুকু পুষিয়ে নিয়েছে এখন। ছোটবেলা থেকেই ওর স্বপ্ন একজন নামকরা হেয়ারড্রেসার হবে। হাইস্কুল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ইচ্ছে কখনোই ছিল না।

    ওদের পারিবারিক ব্যবসাটার অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়। ধুকে ধুকে কোন রকম চলছে আর কি। তাছাড়া সাতোকোর বয়সও একটা বিষয়। ফুমিতাকাও ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বার্ধক্যের দিকে। নাহো জানে ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে তাকেই হাল ধরতে হবে। আর সেজন্যে অর্থনৈতিক দিক কারো উপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না সে।

    বিউটি স্কুলটায় ক্লাস চলে চারটা অবধি। সবসময় চারটা বিশের সাবওয়ে ধরে বাসায় ফেরে নাহো। হামাচো স্টেশনে নেমে যায়। সেখান থেকে থিয়েটারের সামনে দিয়ে একটু হেঁটে েেগলে কিয়োসুবাশি বুলভার্দ। কাছেই ওদের বাসা। ফেরার পথে বেশ কয়েকজন লোককে কাঁধে স্যুট ঝুলিয়ে যেতে দেখল নাহো। আজকে প্রচণ্ড গরম।

    ওদের রাইস ক্র্যাকার শপটার নাম ওমাকারা; দোকান কাম বাসা আমাজাকি গলির একটু ভেতরের দিকে ওমাকারা। এই রাস্তায় বেশ অনেকগুলো দোকান।

    তবে গলিটাকে কোন দিক দিয়েই হাল ফ্যাশনের বা অভিজাত বলা যাবে না। দোকানগুলোর জানালায় বয়স্ক মহিলাদের কাপড় ঝুলছে। লাঞ্চটাইমে দেখা যায় অফিসের লোকেরা খাওয়া শেষে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে হাঁটছে। মহল্লাটা সম্পর্কে ইতিবাচক একটা বিষয়ই বলা যায়। এদো যুগের উত্তরাধুনিক টোকিও’র স্বাদ পেতে চাইলে এখানে আসতে হবে আপনাকে। কিছুটা বড় হবার পর নাহো বুঝতে পারে যে এসবের একটা সাংস্কৃতিক বা ঐতিহ্যগত মূল্য আছে। টোকিও শহরে এরকম গলি এখন আর খুব বেশি অবশিষ্ট নেই।

    হোজুকিয়া নামের একটা হস্তশিল্পের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল নাহো, দোকানটার সামনে বেশ কয়েকটা কাঠের লাটিম আর জাপানিজ ড্রাম সেট ঝুলছে। এসময় অ্যাপ্রন পরিহিত একটা অবয়ব ভেতর থেকে হাত নাড়ল ওর উদ্দেশ্যে। মেয়েটার নাম মিসাকি সুগাওয়ারা। হোজুকিয়ার পার্ট টাইম শপ অ্যাসিস্ট্যান্ট সে। নাহোর চাইতে বছর খানেকের বড়। কিছুদিন যাবত বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের।

    “বিউটি স্কুলে সবকিছু কেমন চলছে?”

    “খারাপ না।”

    “বাহ। লেগে থাকো এবারে।”

    “দেখি কি হয়,” হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বলে নাহো ।

    হোজুকিয়ার তিনটা দোকান পরেই ওমাকারা। ওখানে পৌঁছে নাহো দেখল দরজার সামনে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের পরনে স্যুট। আরেকজন কিছুটা ক্যাজুয়াল পোশাকে এসেছে। হাফ হাতা চেক শার্টের নিচে একটা টিশার্ট।

    ওদের দোকানের প্রায় সমস্ত খদ্দরই নারী, তাই নাহো ধরে নিল লোক তিনজন হয়তো ভেতরে ঢুকবে না। কিন্তু ও দরজার দিকে হাত বাড়ানো মাত্র টি-শার্ট পরিহিত লোকটাও একই কাজ করলো। শেষ মুহূর্তে সে পিছিয়ে না গেলে ধাক্কা লেগে যেত দু’জনের।

    “সরি। প্লিজ, আপনি যান আগে,” লোকটা হাত দিয়ে ভেতরে যাওয়ার ইশারা করে বললো। মুখে চওড়া একটা হাসি তার।

    “না, না। আপনি যান। আমি এখানেই কাজ করি।

    জবাবে মাথা নাড়ল লোকটা।

    “তাই নাকি? তাহলে তো ভালো সময়েই এসেছি বলতে হবে,“ বলে ভেতরে ঢুকে গেল সে।

    নাহো আর লোকটাকে একসাথে ঢুকতে দেখে বিস্ময় ভর করলো ভেতরে বসে থাকা ফুমিতাকার চেহারায়। “গুড আফটারনুন, স্যার,” বললো সে।

    একটা লাজুক হাসি ফুটলো লোকটার মুখে। “মাফ করবেন, কিন্তু রাইস ক্র্যাকার কিনতে আসিনি আমি। বাইরে আমার দুই বন্ধুকে দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমরা পুলিশের লোক।” প্যান্টের পকেট থেকে ব্যাজ ওয়ালেটটা বের করে দেখিয়ে বললো সে। পরিচয় পত্রও দেখাল।

    নিজের জীবদ্দশায় এই প্রথম দোকানে কোন পুলিশ অফিসারকে দেখল নাহো। পরিচয় পত্রে লোকটার নাম লেখা- ডিটেকটিভ কিয়োচিরো কাগা।

    লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বয়শ ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের মধ্যে। কিন্তু একদম সঠিক বয়সটা আন্দাজ করা কঠিন।

    “আগামীকাল কি তাকুরা নামে কেউ এখানে এসেছিল? ওনার পুরো নাম খুব সম্ভবত শিনিচি তাকুরা। নিউ সিটি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন।”

    প্রশ্নটা শুনে অবাকই হলো নাহো।

    “হ্যাঁ, এসেছিলেন তো,” কোনমতে বলে সে।

    “আপনি কি তখন এখানে ছিলেন?”

    “হ্যাঁ, আমি আর দাদী ছিলাম। দোকানটা আমরা নিজেরাই সামলাই।”

    মাথা নাড়ে কাগা।

    “টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশের দু’জন ডিটেকটিভ আপনাদের সাথে একটু সেই ব্যাপারে কথা বলতে চান। আমি কি তাদের ভেতরে ডাকব?”

    টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ নামটা শুনে ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল নাহোর শরীর বেয়ে। সাধারণত গুরুতর কোন অপরাধ ঘটলে তবেই তদন্তে নামে মেট্রোপলিটন পুলিশ। ছোটখাটো কেসগুলো স্থানীয় থানার অফিসারেরা সামলায়।

    “আমি…মানে…” সাহায্যের আশায় বাবার দিকে তাকায় নাহো। “জ্বি, নিশ্চয়ই। কিছু হয়েছে নাকি?” ফুমিতাকা জিজ্ঞেস করে। “একটা বিষয়ে একটু খোঁজ নেয়া দরকার। আপনাদের খুব বেশি সময় নষ্ট করবো না আমরা।”

    “আচ্ছা। মা’কে ডাকব?”

    “মানে ওনার দাদীর কথা বলছেন?” নাহোর দিকে একবার তাকিয়ে বলে কাগা। “খুবই ভালো হয় তাহলে।”

    “একটু অপেক্ষা করুন,” বলে দোকানের পেছনের ঘরটায় উধাও হয়ে যায় ফুমিতাকা।

    বাইরে অপেক্ষারত লোক দু’জনকে ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বলে কাগা। গম্ভীর চেহারার এই দুই ডিটেকটিভের বয়স আন্দাজ করতে পারলো না নাহো। পঞ্চাশের আশেপাশে হতে পারে। মাথায়

    কাঁচাপাকা চুল। স্যুটগুলো পরিপাটি। শারীরিক গঠনের সাথে বেমানান গোল ভুড়ি। নিজেদের নাম বললো লোক দু’জন। কিন্তু নাম দু’টো এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল নাহোর।

    ফুমিতাকার সাথে সাতোকো ভেতরে আসা মাত্র দুই ডিটেকটিভের মধ্যে তুলনামূলক বয়স্কজন প্রশ্ন করতে শুরু করলো।

    “আমরা জানতে পেরেছি যে গতকাল এই ভদ্রলোক এসেছিলেন আপনাদের দোকানে। এটা কি সত্যি?” একটা ছবি দেখাল বয়স্ক ডিটেকটিভ। তাকুরাকে দেখা যাচ্ছে ওখানে

    “জ্বি, সত্যি,” নাহো আর সাতোকো একসাথে বললো।

    “সময়টা কি আপনাদের মনে আছে? ঠিক ক’টা নাগাদ এসেছিলেন তিনি?”

    “কয়টার সময়? তোর মনে আছে?” নাহোর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে সাতোকো ।

    “ছয়টা, সাড়ে ছয়টা হবে…”

    “আপনারা কি নিশ্চিত যে তিনি সাড়ে ছ’টার আগে আসেননি এখানে?” ডিটেকটিভ জানতে চায়।

    “আপনি বোধহয় ঠিকই বলছেন,” নাহো মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে। “আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত নই। তখনও আলো ছিল বাইরে।“

    “বছরের এই সময়ে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা অবধি আলো থাকে, জবাবে বলে ডিটেকটিভ। “যাইহোক, আমি তাহলে ধরে নিচ্ছি আপনারা একদম সঠিক সময়টা বলতে পারবেন না।”

    “একদম ঘড়ি ধরে সঠিক সময়টা বলতে পারছি না…সরি,“ সন্দিহান কন্ঠে বলে সাতোকো।

    “মি. তাকুরা এখানে কেন এসেছিলেন?’

    “আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম কিছুদিন আগে। সেই সংক্রান্ত কিছু কাজে। বিলের টাকা পেতে হলে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। সেটা নিতেই এসেছিলেন মূলত।”

    “ছিলেন কতক্ষণ?”

    “এই ধরুন,” সাতোকো কিছুক্ষণ ভাবে। “দশ মিনিট হবে বড়জোর।”

    পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিল নাহো। তার দৃষ্টি কাগার দিকে। এই মুহূর্তে রাইস ক্র্যাকারগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে স্থানীয় স্টেশনের এই ডিটেকটিভ। দুই সহকর্মীর জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে কোন আগ্রহ নেই তার।

    “এরপর কোথায় যাবেন, সেই বিষয়ে কি কিছু বলেছিলেন উনি?” বয়স্ক ডিটেকটিভের প্রশ্ন এখনও শেষ হয়নি।

    “অফিসে যাবেন বলেছিলেন। আমার সার্টিফিকেটটা জমা দিতে হতো।”

    “বুঝতে পেরেছি,” মাথা নাড়ে বয়স্ক ডিটেকটিভ। “তাকে কেমন দেখেছিলেন আপনারা?”

    “মানে?”

    “তাকে তো আপনারা আগেও দেখেছেন। এবারে কোন কিছু কি ভিন্ন মনে হয়েছিল?”

    “নাহ, ওরকম তো লাগেনি। তুই কি বলিস?” নাতনির দিকে তাকায় সাতোকো।

    “তার স্যুটটা ভিন্ন ছিল,” নাহো বলে। “এর আগে যেবার এসেছিলেন একটা নীল রঙের স্যুট পরনে ছিল তার, কিন্তু কালকের স্যুটটা ছিল ধুসর। এটাতে বেশি ভালো মানিয়েছিল তাকে, সেজন্যেই মনে আছে আমার।“

    “কি পরে এসেছিল সেটা জানতে চাইছি না। তাকে কি কোন কারণে অস্থির মনে হচ্ছিল দেখে?”

    “নাহ, ওরকম মনে হয়নি।”

    নাহোর জবাব শুনে ডিটেকটিভ কিছুটা হতাশ হলেও জোর করে মুখে একটা হাসি ফোটালো।

    “তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে যে আপনারা মি. তাকুরার এখানে আসার একদম সঠিক সময়টা মনে করতে পারছেন না। ছ’টার আগেও হতে পারে আবার ছ’টার পরেও হতে পারে। তাহলে ধরে নেই ‘সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে’।“

    “হ্যাঁ, এরকমই হবে,” দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে নাহো।

    “বেশ। আমাদের সময় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।

    “মাফ করবেন, কিন্তু মি. তাকুরা ঠিক আছে তো?” নাহো জিজ্ঞেস করলো।

    “আপাতত শুধু এটুকুই শুনে রাখুন যে এসব একটা চলমান তদন্তের অংশ।” কাগার দিকে তাকিয়ে একবার ভ্রু নাচায় বয়স্ক ডিটেকটিভ। পুলিশের তরফ থেকে পুরো পরিবারকে ধন্যবাদ জানায় সে।

    আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে যায় তিনজন।

    “কালকে কোদেনমাচোর ঘটনাটার সাথে এসবের সম্পর্ক আছে কিনা কে জানে,” নাহোর বাবা বলে সময়

    “মানে?”

    “পেপারে দেখোনি?” ফুমিতাকা ভ্রু কুঁচকে বলে। “একজন ভালো নাপিতের সবসময় উচিৎ পেপার পড়া।”

    “নাপিতগিরি করার জন্যে ক্লাস করছি না আমি, বাবা, কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলে পেছনের ঘরে চলে আসে নাহো। পেপারটা এখানেই রাখা।

    ফুমিতাকা যে ঘটনাটার কথা বলছিল সেটার প্রতিবেদন স্থানীয় সংবাদের পাতায় ছাপা হয়েছে। কোদেনমাচোর এক ফ্ল্যাট থেকে পয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একাই থাকত সে। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে তাকে। কোন প্রকার ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল না অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে। অর্থাৎ, খুনী মহিলার পরিচিত কেউ। স্থানীয় পুলিশ এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট তদন্ত চালাচ্ছে।

    “এরকম জঘন্য কিছুর সাথে কখনোই জড়াবে না মি. তাকুরা। উনি একজন সাচ্চা টোকিওয়াইট টোকিওর আদি নিবাসী)।” সাতোকো বলে। নাহোর পাশে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের উপর দিয়ে পেপারটা দেখছে সে।

    “ডিটেকটিভ ভদ্রলোকের প্রশ্নের ধরণ শুনে মনে হলো মি. তাকুরার অ্যালিবাই যাচাইয়ের জন্যে এসেছিলেন। খুব সম্ভবত সন্দেহভাজনদের একজন সে।”

    “উফ, পুলিশ কি ভাবলো সেই চিন্তা বাদ দে তো। আমরা তো বললামই মি. তাকুরা এখানে এসেছিল গতকাল। এখন নিশ্চয়ই ছেড়ে দিবে।”

    “ওরা কিন্তু একদম সঠিক সময়টা জানতে চাইছিল বারবার। এটা নিশ্চয়ই তদন্তের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু।”

    “তোমাদের কি আসলেই সময়টা মনে নেই?” দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলে ফুমিতাকা যেমনটা বললাম, সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছয়টার ভেতরে। এর থেকে সঠিক সময় আর কি বলবো?”

    “তোমাদের দিয়ে আসলে কিচ্ছু হবে না।”

    “এটা আবার কেমন কথা বললে, বাবা? সারাদিন কত লোক আসে দোকানে। সবার আসার সময় মুখস্থ করে রাখব নাকি?”

    এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মাথা বের করে নিল ফুমিতাকা

    “আমার তো বাপু খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে,” সাতোকো ভ্রু কুঁচকে বলে। “আশা করি মি. তাকুরা খুব দ্রুত এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে।”

    ******

    ডিনারের পর দোকানের সামনের দিকে বৈদ্যুতিক শাটারটা বন্ধ করার জন্যে গেল নাহো। শাটারটা প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়েছে এমন সময় অন্য পাশে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। সাথে সাথে স্টপ বাটনটা চেপে ধরলো।

    শাটারের নিচ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল লোকটা। ডিটেকটিভ কাগা। চোখাচোখি হলো ওদের। হেসে দোকানে পা রাখলো লোকটা।

    “আপনার কি কিছুক্ষণ সময় হবে?”

    “উম…হ্যাঁ। বাবাকে ডাকব?”

    “না, আপনি থাকলেই হবে। একটা বিষয়ে আরো কিছু প্রশ্ন ছিল।”

    “জ্বি, বলুন?”

    “মি. তাকুরার পোশাকের ব্যাপারে- আপনি বলছিলেন একটা স্যুট পরে ছিলেন তিনি, তাই তো?”

    “হ্যাঁ। ধুসর স্যুট। এর আগে নীল স্যুট পরে এসেছিলেন দোকানে।”

    বোকাটে একটা হাসি ফুটলো কাগার মুখে। “রঙের বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই,” হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলো সে। “আপনার কি এটা মনে আছে যে এখানে থাকার সময় তার পরনে স্যুটটা ছিল কিনা?”

    “হ্যাঁ, ছিল।”

    “আমারো সেটাই মনে হয়েছে। বিশেষ করে আপনি যখন বললে স্যুটটায় মানিয়েছিল ওনাকে।”

    “এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

    “আমি আসলে নিজেও পুরোপুরি নিশ্চিত নই কারণটা সম্পর্কে,” তাক থেকে রাইস ক্র্যাকারের একটা প্যাকেট তুলে বললো কাগা। “এই প্যাকেটটা দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে। নিব আমি,” নাহোর হাতে ৬৩০ ইয়েন ধরিয়ে দিল সে।

    “ধন্যবাদ।”

    “ঠিক আছে। থাকেন তাহলে,” আবারো মাথা ঝুঁকিয়ে আধখোলা শাটারের নিচ দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেল কাগা।

    হতবুদ্ধ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সামনে এগিয়ে শাটারের সুইচ বন্ধ করে দিল নাহো। তবে শাটারটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বাইরে উঁকি মারতে ভুলল না।

    ল্যাম্পের আলোয় এখনও স্যুট কোট পরিহিত কয়েকজনকে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। আজকের দিনের মত কাজ শেষ। নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরছে কিংবা বন্ধুদের সাথে কোথাও ড্রিঙ্ক করতে যাচ্ছে। কাগাকে দেখা গেল না কোথাও।

    তিন

    পরদিন সকাল থেকেই প্রচণ্ড গরম। ক্লাস শেষে স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কয়েক ধাপ উঠতে না উঠতেই ঘামে ভিজে গেল পুরো শরীর।

    ফুমিতাকা দোকানের বাইরে রোদ ঠেকানোর জন্যে শামিয়ানা টাঙ্গাচ্ছিল। “এসে পড়েছো,” মেয়েকে দেখে বিড়বিড় করে বলে সে।

    “হ্যাঁ, বাবা। আজকে কি ডিটেকটিভদের কেউ এসেছিল নাকি?”

    “আমাদের দোকানে আসেনি, ফুমিতাকা বলে গলা খাদে নামিয়ে। “কিন্তু শুনেছি এখানকার অন্য সবার সাথে কথা বলছে।”

    “কে জানে কেন!”

    “সবাই বলাবলি করছে এখনও মি. তাকুরার বিষয়েই খোঁজ খবর নিচ্ছে। প্রত্যেককে একই প্রশ্ন- সেদিন মি. তাকুরাকে দেখেছিল কিনা। যা বুঝছি, আমাদের দোকানে সে ঠিক কখন এসেছিল এই তথ্যটা কেসের জন্যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।”

    “আমরা যা বললাম, সেটুকু যথেষ্ট নয় পুলিশের জন্যে?”

    “মনে তো হচ্ছে না,” ফুমিতাকা আবারো দোকানে ফিরে গেল।

    আশপাশে নজর বুলালো নাহো। ডিটেকটিভদের দলটা এখন আশেপাশেই কোথাও আছে কিনা কে জানে।

    ওদের দোকানের বাইরে রাস্তার ঠিক উল্টো পাশে একটা ক্যাফে। সেটার জানালায় চোখ পড়তেই পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেল। যাকে দেখেছে, সে-ও পাল্টা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুখে অস্বস্তিমাখা একটা হাসি তার।

    রাস্তা পার হয়ে ক্যাফেতে ঢুকে সরাসরি সেই টেবিলে চলে গেল নাহো।

    কার উপরে নজর রাখছেন এখান থেকে?” কাগার কাছে জানতে চাইল ও।

    “কারো উপরেই না। আপনি বসুন, প্লিজ,” হাত উঁচিয়ে ওয়েট্রেসকে ডাকল কাগা। “কি নিবেন?”

    “কিছু লাগবে না।”

    “আহহা, এভাবে বলবেন না তো। খান কিছু,” বলে মেনুটা ওর দিকে ঠেলে দিল ডিটেকটিভ।

    “আচ্ছা, একটা ব্যানানা মিল্কশেক,” বসতে বসতে ওয়েট্রেসকে বললো নাহো। “আপনি কি আমাদের দোকানের উপরে নজর রাখছেন?”

    “আরে কি মুশকিল! বললাম তো, কারো উপরে নজর রাখার জন্যে এখানে বসিনি আমি।

    “তাহলে কি করছেন?”

    “কিছু না। বলতে পারেন আয়েশ করে আইস কফি খাচ্ছি। কাজে ফাঁকি আর কি।” স্ট্র থাকা সত্ত্বেও গ্লাসটায় বড় একটা চুমুক দিল কাগা

    “মি. তাকুরা কি কোদেনমাচো খুনের কেসের একজন সন্দেহভাজন?”

    কিছুটা শক্ত হলো কাগার চেহারা। অন্য টেবিলগুলোর দিকে তাকাল সে।

    “আপনি কিছুটা আস্তে কথা বললে খুশি হবো আমি।”

    “আমার প্রশ্নের জবাব দিন, নাহলে আরো জোরে কথা বলবো। “ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথার এলোমেলো চুলের একবার হাত বুলালো কাগা।

    “হ্যাঁ, মি. তাকুরা আমাদের সন্দেহভাজন তালিকায় আছেন। ঘটনার দিন ভিক্টিমের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। তার ভিজিটিং কার্ড আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একটা লিফলেট ওখানে খুঁজে পেয়েছি আমরা। ওনার ভাষ্যমতে অবশ্য ইন্স্যুরেন্সের কাজেই নাকি গিয়েছিলেন।”

    “ব্যস এটুকুই?”

    “আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করলে এটুকুই যথেষ্ট। “ এসময় নাহোর ব্যানানা মিল্কশেক নিয়ে এলো ওয়েট্রেস। চওড়া স্ট্র দিয়ে একবারেই গ্লাস খালি করে ফেলল ও।

    “মি. আমাদের দোকানে কখন এসেছিলেন, এটা জানা কি আসলেও জরুরী?” খানিকক্ষণ বাদে বললো নাহো।

    আনমনা হয়ে কিছুক্ষণ ভাবল কাগা, এরপর চকিতে মাথা নাড়ল একবার। “মি. তাকুরা ভিক্টিমের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েছে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। ভিক্টিম তখনও বেঁচে ছিল। এই বিষয়ে আমরা নিশ্চিত কারণ তার একটু পরেই দোকানে গিয়েছিল সে।”

    “তাই? কি কিনতে গিয়েছিল?”

    “সেটা জেনে আপনি কি করবেন?” প্রশ্নটা শুনে একটু অবাকই হয়েছে কাগা।

    “কিছু না, এমনি কৌতূহল হলো আর কি। মানে, কেনাকাটার কিছুক্ষণের মধ্যেই তো খুন হয় সে, তাই না?”

    “তার তো আর ধারণা ছিল না যে কেউ তাকে খুন করার পরিকল্পনা এঁটেছে। দোকানে না যাওয়ারও কোন কারণ নেই। রান্নাঘরের জন্যে কাঁচি কিনেছিল, যান, বলেই দিলাম। আপনি বোধহয় দোকানটা চেনেন। কিসামিয়া?”

    “হ্যাঁ, চিনি।”

    “যাইহোক, এই বিষয়টা থাক। আবারো মি. তাকুরার কথায় ফিরি আমরা। তার ভাষ্যমতে ভিক্টিমের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আপনাদের ওখানে এসেছিলেন সরাসরি। এরপর কাগজপত্রগুলো চলে যান অফিসে। ওগুলো ওনার এক নারী সহকর্মীর হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি ফেরার জন্যে বের হন।”

    “এখানে সমস্যাটা কি?”

    বাড়ি ফেরার পথে এক বন্ধুর সাথে ড্রিঙ্ক করতে গিয়েছিলেন মি. তাকুরা। এখন আমরা যদি তার বন্ধুর বলা সময় অনুযায়ী পেছন দিক থেকে হিসেব করতে থাকি, তাহলে দেখা যায় মি. তাকুরা ছয়টা চল্লিশে অফিস থেকে বেরিয়েছেন। কিন্তু তাকুরার সেই নারী সহকর্মী আমাদের জানায় তিনি অফিস থেকে বেরিয়েছেন ছয়টা দশে। সেইক্ষেত্রে ত্রিশ মিনিটের একটা শুন্যস্থান থেকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছেন কি বলছি? এই ত্রিশ মিনিটের মধ্যে কোদেনমাচোর সেই অ্যাপার্টমেন্টটায় গিয়ে খুন করে আবারো ফিরে আসা খুবই সম্ভব তার পক্ষে। আমরা তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাকুরা জানান তিনি অফিস থেকে বের হন ছয়টা চল্লিশ নাগাদ। বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার আগে কোথাও থামেনওনি। তার ধারণা সহকর্মী সময়ের ব্যাপারটা ভুল বলেছে।”

    “হয়তো আসলেও ভুল বলেছে।”

    “সমস্যাটা হচ্ছে আমরা আরো কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছি, যাদের মতে তাকুরা ছয়টার পরে অফিসে ফিরেছে। এতজন মানুষের কথা তো আর উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেই ক্ষেত্রেও ত্রিশ মিনিটের হিসেব মিলছে না। তবে তাকুরা এবং তার নারী সহকর্মী একটা বিষয়ে একমত। অফিসে দশ মিনিটের বেশি ছিলেন না তিনি। মি. তাকুরার মতে আপনাদের দোকান থেকে বেরিয়ে সরাসরি অফিসে গিয়েছেন সেদিন। সেই ক্ষেত্রে আপনাদের দোকান থেকে তিনি কখন বেরিয়েছিলেন সেটা জানাটা বড্ড জরুরী।”

    একটানা কথাগুলো বলে গেল কাগা। পুরো বিষয়টা হজম করতে একটু সময় লাগলো নাহোর।

    “এবারে বুঝতে পারছি আপনি কেন বারবার একদম সঠিক সময়টা জানতে চাইছিলেন তখন।”

    “সেটাই। আর যেহেতু আপনি বা আপনার দাদী কেউই সময়টা মনে করতে পারছেন না, তাই এই রাস্তার আশপাশের দোকানগুলোয় খোঁজ খবর নিয়ে দেখছিলাম সেদিন বিকেলে কেউ তাকে যেতে দেখেছে কিনা। দুর্ভাগ্যবশত, কেউই ওনাকে আপনাদের দোকানে ঢুকতে দেখেনি। ক্যাফের স্টাফদের সাথেও কথা বলেছি, কিন্তু লাভ হয়নি।”

    “এখন কি করবেন?”

    “ঠিক নিশ্চিত নই আমি,” একবার আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে কাগা। নাহো খেয়াল করলো ডিটেকটিভের চোখ এখনও বাইরের রাস্তায়। “আমরা যেহেতু আপাতত আর কোন সন্দেহভাজনের ব্যাপারে কিছু জানি না, মেট্রোপলিটন পুলিশের সবাই তাকুরাকে নিয়েই মেতেছে।”

    “এটা কোন কথা! ওনার পক্ষে একটা মাছি মারাও সম্ভব নয়।

    “মাফ করবেন মিস, কিন্তু খুনীর বন্ধুরা সবসময় এসবই বলে।”

    “মি. তাকুরার কোন মোটিভই নেই খুন করার।”

    “হুম।”

    “এই হুম মানে কি?”

    “মানে হচ্ছে খুনী নিজে থেকে বলার আগে প্রায় ক্ষেত্রেই মোটিভটা অজানা থেকে যায়। হয়তো মেট্রোপলিটন পুলিশের ওরা ওনার পেট থেকে মোটিভটা বের করছে এখন।”

    “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সবকিছু ওনাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে শান্তিই পেয়েছেন।”

    “তাই নাকি?”

    “হ্যাঁ। এতে আপনার কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না।“

    আইস কফিটা আগেই শেষ করেছে কাগা। এবারে পানির গ্লাসটা তুলে নিল সে।

    “এই কেসে মূল তদন্তের ভার মেট্রোপলিটন পুলিশের। আমরা যারা স্থানীয় পুলিশের সদস্য, তাদের কাজ কেবল টুকটাক সাহায্য করা। আসলে আমাদের যা নির্দেশ দেয়া হয়, সেটুকুই করি কেবল।“

    “ভ্রু কুঁচকে কাগার ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকালো নাহো। “আর আমি কিনা ভেবেছিলাম আপনি অন্যান্য পুলিশদের চাইতে একটু ভিন্ন। এভাবে চলতে থাকলে আপনি এসব স্থানীয় থানা থেকে বের হয়ে কখনোই উপরের দিকে যেতে পারবেন না।”

    “আসলে কোথাও আটকে যাওয়া ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু ব্যাপারটা কি, এই স্টেশনে সদ্য বদলি হয়ে এসেছি আমি, তাই খুব বেশি কিছু এখনও জানি না। সবকিছুর সাথে পরিচিত হচ্ছি ধীরে ধীরে, সবাইকে চেনার চেষ্টা করছি। এই ডিস্ট্রিক্টটা কিন্তু বেশ অন্যরকম। একটা ঘড়ির দোকানে গিয়েছিলাম; মারাত্মক সুন্দর একটা ঘড়ি দেখলাম। একটা প্রিজমের তিন দিকে তিনটা ঘড়ি। সবগুলো আবার একইসাথে চলে। ওটার কলকব্জা কিরকম, কে জানে!“

    “আপনি যে তখন বলছিলেন কাজে ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ওটা মজা করে বলেননি, তাই না?” মিল্কশেকের বিলের টাকাটা টেবিলের উপরে রাখা নাহো। কাগোর টাকায় কিছু খাওয়ার ইচ্ছে বা রুচি হচ্ছে না ওর।

    “আজকে আবারো বেশ গরম পড়েছে,” জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে কাগা। “দেখুন, নিনগিয়োচো স্টেশনের দিক থেকে যারা আসছে, তাদের বেশিরভাগেরই শার্টের হাতা গোটানো। কোটও খুলে রেখেছে।”

    “তাতে আমার কি?” তীক্ষ্ম কন্ঠে বলে নাহো। এখন আর ভদ্রতার ধার ধারছে না।

    “দেখুন, ওই যে আরেকজন আসছে। কেবলই স্যুটটা খুলে কাঁধে ঝোলালো। বেচারা।”

    “এই গরমে তো সেটাই করা উচিৎ, তাই না?”

    “সকালের তুলনায় অবশ্য এখন গরম কিছুটা কমে। ওই দেখুন, উনি কিন্তু স্যুট খোলেননি।”

    নাহো দেখল আসলেও একটা লোক স্যুট গায়ে দিয়েই হাঁটছে।

    “আপনি কি আমাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন?” কন্ঠস্বর থেকে বিরক্তিটুকু গোপন রাখতে পারছে না নাহো ।

    “ভালো করে খেয়াল করুন। কি দেখছেন? যারা ডান থেকে বামে যাচ্ছে, মানে নিনগিয়োচো থেকে হামাচোর দিকে যাচ্ছে, তারা স্যুট খুলে নিয়েছে। কিন্তু যারা বাম থেকে ডান দিকে যাচ্ছে, মানে বিপরীতে, তারা সবাই স্যুট পরে আছে।”

    এবারে সিট থেকে ঘুরে রাস্তার দিকে তাকাল নাহো।

    আসলেও বেশ ভিড় ওখানে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে অফিসের লোকজন। ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। চোয়াল ঝুলে গেল নাহোর। কাগা ভুল বলেনি, ডান থেকে বামে যারা যাচ্ছে, তাদের সবার স্যুট হাতে বা কাঁধে

    “ভুল বলেননি,” বিড়বিড়িয়ে বলে নাহো।

    “কিন্তু কেন? এটা কি কাকতালীয়?”

    “কোন কিছুকেই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিবেন না। কোন কারণ আছে কিনা ভেবে দেখার চেষ্টা করবেন।”

    “কারণটা কি আপনার জানা আছে ডিটেকটিভ কাগা?”

    “জানতেও পারি,” কাগার মুখে হাসি।

    “হাসছেন কেন এভাবে?” বেআক্কেলের মতন, শেষ কথাটা মনে মনে বললো নাহো।

    “নিজেকে নিয়ে খুব আত্মতুষ্টিতে ভুগছি ভাবলে ভুল করবেন। সত্যি কথা বলতে, কারণটা বলে দেয়ার পর আপনার কাছেও হয়তো বিষয়টা ওরকম আহামরি কিছু মনে হবে না। এটা কিন্তু মোটামুটি একটা অফিস পাড়া বলা যায়। বাইরে যাদের দেখছেন, তাদের বেশিরভাগই হামাচোর কোন না কোন প্রতিষ্ঠান বা ফার্মে চাকরি করে। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। এখন বাজছে সাড়ে পাঁচটা। এই সময়ে কারা ডান দিক থেকে বামের রাস্তায় যাবে, মানে নিনগিয়োচো থেকে হামাচোর দিকে?

    “এখন কয়টা বাজছে, সেটা বিবেচনায় নিলে…” নাহো কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলে। “তারা নিশ্চয়ই অফিসে ফিরছে।”

    “ঠিক। অর্থাৎ, অন্যভাবে বললে এই মানুষগুলো সারাদিন অফিসের বাইরে ছিল। তাদের কাজও বাইরে, সেলস কিংবা সার্ভিসে। আর যারা বাম থেকে ডানদিকে যাচ্ছে তারা কিন্তু সারাদিন অফিসেই কাজ করেছে। আর সারাদিন যেহেতু তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে ছিল- উল্টোদিক থেকে আসা সহকর্মীদের তুলনায় তাদের গরম তুলনামুলক কিছুটা কম লাগছে। সেই কারণেই স্যুট খোলেনি। তাছাড়া এখন বিকেল হওয়াতে তাপমাত্রা এমনিতে ও বেশ কমে গেছে। হামাচো থেকে যারা আসছে, তাদের একটু ভালো করে খেয়াল করুন। বেশিভাগই বয়স্ক। আমার ধারণা তারা সবাই অফিসের মোটামুটি উর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মী। খুব বেশি ছোটাছুটি করতে হয় না। আর এই কারণেই একদম সাড়ে পাঁচটা বাজার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়তে পেরেছে।”

    কাগার কথা শুনতে শুনতে রাস্তায় নজর বুলাচ্ছে কাগা। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও ডিটেকটিভের কথা উড়িয়ে দেয়ার মতন না ।

    “বাহ…আমার ধারণা আপনি ঠিকই বলছেন। এর আগে কখনো বিষয়টা খেয়াল করিনি।”

    “খেয়াল না করাটাই স্বাভাবিক আসলে।”

    মাথা নেড়ে সায় জানালো নাহো, এরপর বিস্ফোরিত নয়নে কাগার দিকে তাকালো।

    “এর সাথে কি খুনের ঘটনার কোন সম্পর্ক আছে?”

    টেবিল থেকে বিলের কাগজটা তুলে নিল কাগা।

    “আপনার মনে আছে সেদিন বারবার আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম মি. তাকুরা কি পরে এসেছিলেন?

    মাথা নাড়ল নাহো। “স্যুট পরাই ছিল তার, বেশ সতেজ দেখাচ্ছিল।”

    “কিন্তু মি. তাকুরার কাজ কিন্তু ক্লায়েন্টদের সাথে গিয়ে কথা বলা। অর্থাৎ, দিনের বড় একটা সময় বাইরেই কাটে তার। তিনি আমাদের বলেছেন ভিক্টিমের কোদেনমাচোর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে সরাসরি আপনাদের ওখানে গিয়েছিলেন। তাহলে কিন্তু বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হয়ছে তাকে। সেক্ষেত্রে তার স্যুটটা অত পরিষ্কার দেখানোর কথা ছিল না, এমনকি স্যুটটা গায়েই থাকার কথা ছিল না। বোঝাতে পারছি আপনাকে?”

    “হ্যাঁ…কিন্তু অনেকে তো গরম লাগলেও স্যুট খোলে না।”

    “এটা অবশ্যই একটা সম্ভাবনা। তবু, আমার ধারণা এই দিকটা ধরে এগোলেই ওই হারানো ত্রিশ মিনিটের খোঁজ পেয়ে যাব আমরা।” উঠে দাঁড়িয়ে বিল মেটানোর জন্যে ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে তাকালো কাগা।

    “দাঁড়ান, দাঁড়ান, কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?”

    “এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি কিছু আপনাকে জানানো সম্ভব না আমার পক্ষে। আসলে আমাকেই আরেকটু খোঁজখবর করতে হবে ধাঁধার উত্তরটা বের করার জন্যে,” ক্যাফে থেকে একসাথে বের হবার সময় বললো কাগা।

    চার

    ডিনারের সময় নাহো ডিটেকটিভ কাগার সাথে হওয়া আলাপ সম্পর্কে খুলে বললো সবাইকে। সাতোকোকে হারানো ত্রিশ মিনিটের বিষয়টা বোঝাতে বেশ কষ্ট হয়ে গেল অবশ্য। খাতায় তাকুরোর সেদিনকার কাজগুলোর সময়ক্রম নাহো লিখে দেয়ার পর গোটা বিষয়টা অবশেষে বুঝতে সক্ষম হলো তার দাদী।

    “ধুর,” সব শুনে নাক দিয়ে শব্দ করে বলে সাতোকো। “আমার মনে হয় না ওই ত্রিশ মিনিটে কিছু যায় আসবে এমনিতেও।”

    “একজন মানুষকে খুন করার জন্যে ত্রিশ মিনিট যথেষ্ট সময়। সেজন্যেই পুলিশের লোকেরা এত গুরুত্ব দিচ্ছে বিষয়টাকে।”

    “তাহলে বলতে হবে এখনকার পুলিশগুলো একদম গর্দভ। প্রথমত, মি. তাকুরার পক্ষে আসলেই এমন কিছু করা সম্ভব কিনা? একদমই না। সে ওরকম মানুষই না। কোন কথা দিলে সবসময় কথা রাখে, অন্যদের বোঝার চেষ্টা করে। মানুষের মধ্যে এসব গুণাবলী কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই কিন্তু—”

    হাত তুলে দাদীকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিল নাহো।

    “আমরা সবাই জানি মি. তাকুরা একজন ভালো মানুষ। এই কথা বারবার বলে লাভ নেই। এখন জরুরী বিষয় পুলিশের কাছে সত্যটা প্রমাণ করা।”

    “আমি তো সেটাই বলছি। পুলিশের লোকদের সাফ জানিয়ে দিতে হবে সে কতটা ভালো মানুষ। তারা মি. তাকুরাকে সন্দেহ করছে কারণ সে মানুষ হিসেবে কেমন এটা তাদের জানা নেই।”

    “এমনি সময় নষ্ট করছি, “ বিড়বিড় করে বলে নাহো। ফুমিতাকার দিকে তাকায় একবার। গম্ভীর মুখ করে চুপচাপ বসে আছে সে

    “কি ভাবছ এত, বাবা?”

    “হ্যাঁ? ওহ, আমি ভাবছিলাম মি. তাকুরা আসলেও ওই কথাগুলো বলেছে কিনা।”

    “কোন কথা?”

    “এই যে কোদেনমাচো থেকে কাজ সেরে তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল সেদিন, এরপর সরাসরি অফিসে চলে গেছে।”

    “ডিটেকটিভ কাগা তো সেটাই বললেন।”

    “হুম। কিন্তু…” আবারো গভীর ভাবনায় ডুবে গেল ফুমিতাকা।

    “কোন সমস্যা, বাবা?”

    “নাহ, বুঝতে পারছি না কিছু।”

    “ওই কাগা না কি নাম যেন ডিটেকটিভটার। দেখতে সুন্দর আছে কিন্তু,” চা বানাতে বানাতে বলে সাতোকো। “চাইলে কোন সামুরাই গল্পের নাটকে নায়ক হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। চেহারাও চালাক চতুর।”

    “আমার মনে হয় উনি যথেষ্ট চালাক। আজকে বেশ অদ্ভুত কিছু কথা বলেছেন আমাকে।” এরপর নাহো সাতোকোকে কাগার বলা স্যুট সংক্রান্ত বিষয়টা খুলে বললো।

    “আরে! ঠিকই বলেছে তো!” সাতোকোর কন্ঠে বিস্ময়। “আমার মাথায় কখনো এই চিন্তা আসতো না।”

    “যাইহোক, ডিটেকটিভ কাগা ভাবছিল মি. তাকুরা কেন আমাদের সাথে দেখা করতে আসার সময় জ্যাকেট পরা অবস্থাতেই ছিল। এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই হয়তো সেই হারানো ত্রিশ মিনিটে কি ঘটেছে তা জানা যাবে।”

    “কিভাবে?”

    “সেটা এখনও জানেন না তিনি।

    “ওনার চিন্তাভাবনার ধরণটাই দেখি আলাদা। ভালো গোয়েন্দা হতে পারবে সামনে।”

    “হয়তো,” বলে চায়ের কাপটা তুলে নেয় নাহো। “তার কথা বলার ধরণ শুনে অবশ্য আমার মনে হয়নি কেসটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যাথা আছে। তাছাড়া আমার সাথে ওভাবে খোলাখুলি একটা চলমান কেস নিয়ে কথা বলাও পেশাদারিত্বে মধ্যে পড়ে না।”

    “তুইই তো জানতে চেয়েছিলি।”

    “জানতে চাওয়া এক বিষয় আর বলা আরেক বিষয়। আমার কাছে একটু খটকা লেগেছে। কি বলো, বাবা?” সমর্থনের আশায় বাবার দিকে তাকালো নাহো।

    “কি?….. ওহ, হ্যাঁ। খটকা লাগার মতনই।”

    উঠে দাঁড়াল ফুমিতাকা।

    “যাই, গোসলটা সেরে ফেলি। আজকের রান্না খুব ভালো হয়েছিল।”

    ঘাড় কাত করে ফুমিতাকার দিকে তাকালো নাহো। আজকে এতটা অন্যমনস্ক কেন বাবা?

    পাঁচ

    শেষ বিকেলে বাইরে গিয়ে শামিয়ানাটা খুলে ফেলল ফুমিতাকা। এটা তার প্রতিদিনকার কাজ। দুপুরের তুলনায় গরম কমেছে এখন, কিন্তু দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ছে। গরম একদম জাকিয়ে বসার আগে শেলফের সাজসজ্জা বদলে ফেলতে হবে। কয়েকটা রাইস ক্র্যাকার বিয়ার আর স্ন্যাকসগুলোর সাথে রাখলে বিক্রি বাড়বে।

    এসময় ফুটপাতে একটা ছায়া দেখে সে বুঝতে পারল কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। কাস্টোমার মনে করে কেবলই স্বাগত জানানোর জন্যে মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেলল। লোকটাকে চেনে ফুমিতাকা। কিছুক্ষণ আগেও তাকে নিয়েই ভাবছিল।

    “আজকেও প্রচণ্ড গরম পড়েছিল, না?” কাগাই প্রথমে বললো কথা।

    “অনেক। আপনি বোধহয় আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চান, কিন্তু ও তো ফেরেনি।”

    হাত নেড়ে মানা করে দিল কাগা।

    “আমি আপনার সাথেই কথা বলার জন্যে এসেছি। একটু সময় হবে?”

    চমকে উঠে অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠলো ফুমিতাকা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কাগার দিকে। কাগাও পাল্টা তাকিয়ে রইলো। শেষ পর্যন্ত ফুমিতাকাকেই দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হলো।

    “জ্বি, নিশ্চয়ই। ভেতরে আসুন,” কাঁচের দরজার পাল্লাটা একদিকে সরিয়ে বললো ফুমিতাকা।

    “আপনার মা কোথায়?”

    “এখানেই আছে। ডাকবো?”

    “না। তিনি যদি এখানে থাকেন, তাহলে আমাদের একটু অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলাটাই ভালো।”

    কাগার বয়স ফুমিতাকার চেয়ে কম হলেও তার কথা বলার ভঙ্গিতে স্বভাবসুলভ এক ধরণের কর্তৃত্ব আছে। এবারে নিছক আলাপ করার জন্যে আসেনি সে।

    দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একবার মাথা নাড়ে ফুমিতাকা। ভেতরে ঢোকে দু’জন।

    “মা, জেগে আছো?” হাঁক ছাড়ে নাহোর বাবা।

    “কেন, কি হয়েছে?” পেছনের ঘর থেকে পাল্ট প্রশ্ন ছুটে আসে। “আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। দোকানটা দেখবে?

    পাচিনকো খেলতে যাচ্ছ, না? এই বুড়ো বয়সেও হুঁশ হলো না। মেয়ে এত বড়,” স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে বাইরে আসার সময় ফুমিতাকার পেছনে কাগাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। “আরে আমাদের নায়ক ডিটেকটিভ দেখাছি। মি. তাকুরাকে এখনো সন্দেহ করছেন নাকি আপনারা?”

    “খোঁজ খবর চলছে আর কি।”

    “আপনার উপরে ভরসা আছে আমার। তাকুরা লোক ভালো। খুন-টুন তাকে দিয়ে হবে না। আমার কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারেন।”

    “খুন না করলেই ভালো। শুনলাম আপনি কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন, এখন শরীর কেমন?”

    “একদম ঠিকঠাক। আসলে হাসপাতালে যাওয়াটাই একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। “ ছেলের দিকে তাকায় সাতোকো। “তুমি কি ডিটেকটিভ কাগার সাথে কথা বলার জন্যে বাইরে যাচ্ছ? তাহলে মি. তাকুরা সম্পর্কে জানাতে ভুলো না। বেচারা ভালো একটা মানুষ, ফেঁসে গেছে।”

    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলবো মা,” কাগার দিকে ফেরে ফুমিতাকা। “চলুন তাহলে?”

    “নিজের খেয়াল রাখবেন,” সাতোকোর উদ্দেশ্যে বলে বেরিয়ে আসে কাগা। “আপনার মা’র শরীর এখন ভালোই মনে হচ্ছে?” দোকান থেকে বেরিয়ে বললো ডিটেকটিভ।

    “এখনও সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি টানা কাজ করতে পারে।”

    রাস্তার অন্য পাশের ক্যাফেটাতে গিয়ে বসলো দু’জনে। গতরাতে নাহো ডিটেকটিভ কাগা সম্পর্কে কি বলেছিল তা মনে পড়লো ফুমিতাকার। ওয়েট্রেস এলে আইসড কফি অর্ডার করলো দু’জনেই ফুমিতাকা সিগারেটের প্যাকেট বের করলে তার দিকে অ্যাশট্রেটা ঠেলে দিল কাগা।

    “গতকাল আপনার মেয়ের সাথে এখানে কথা হয়েছিল আমার।”

    “জানি।”

    “আপনাকে বলেছে তাহলে? ভালোই হলো।”

    “আপনার অদ্ভুত পর্যবেক্ষণটার বিষয়েই কথা হয়েছে আরকি। অদ্ভুত বলাটা ঠিক হচ্ছে নাকি জানি না। রাস্তার দু’দিক থেকে স্যুট পরিহিত অফিস কর্মীরা দুই ভাবে হেঁটে যায়। এতদিন এলাকায় থাকছি, আমি নিজেও খেয়াল করিনি।”

    “আসলে ছোটখাট সব কিছুই খেয়াল করি আমি। অভ্যাস হয়ে গেছে ওভাবে চিন্তা করতে করতে। দোকানে মি. তাকুরা কি পরে এসেছিল, সেই চিন্তাটা মাথায় ঢুকে যায়। ওরকম গরমের মধ্যে সারাদিন বাইরে কাটানোর পর কেউ কেন স্যুট গায়ে দিয়ে থাকবে?

    আইসড কফি দিয়ে গেল ওয়েট্রেস। একটা সিগারেট জ্বাললো ফুমিতাকা।

    “কারণটা জানতে পেরেছেন?”

    “বলতে পারেন।”

    “তাই?”

    “আপনাকে শুনে মনে হচ্ছে না খুব একটা অবাক হয়েছেন জানতে ইচ্ছে করছে না?”

    “আসলে…সেটা নয়…”

    “আমার যা বলার, সেই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই আপনার মি. কামিকাওয়া। কারণ বিষয়টা সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত আছেন আপনি।”

    আইসড কফির গ্লাসটা কেবলই হাতে নিয়েছিল ফুমিতাকা। মাঝপথেই থেমে গেল হাতটা। “মানে?”

    “মি. তাকুরা স্যুট পরে আপনাদের দোকানে গিয়েছিল কেন? জবাবটা অত কঠিন কিছু নয়। কারণ সেদিন বাইরে পুরোটা সময় কাটানোর পর আপনাদের দোকানে যায়নি সে। বরং অফিসে গিয়ে হাতের সমস্ত কাজ শেষ করার পর বের হয়েছিল। আর তখনই দেখা করে আপনার মা আর মেয়ের সাথে। আর অফিসে যেহেতু এয়ার কন্ডিশনার আছে, স্যুট পরে থাকতে কোন অসুবিধে হয়নি মি. তাকুরার।”

    মাথা নিচু করে আছে ফুমিতাকা।

    “কোদেনমাচো থেকে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বের হয়ে ছ’টার মধ্যে অফিসে ফিরে যায় তাকুরা,” ডিটেকটিভ বলেই চলেছে। “সাতোকো কামিকাওয়া অর্থাৎ আপনার মা’র হাসপাতালের বিল এবং সার্টিফিকেট সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র এক নারী সহকর্মীর হাতে তুলে দিয়েই বেরিয়ে যান। আপনাদের দোকানে কিছুটা সময় কাটানোর পর বের হয়ে ড্রিঙ্কের জন্যর এক বন্ধুর সাথে পাবে দেখা করেন, এরপর সেখান থেকে বাসায় ফেরেন। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সাথে তার সেদিনকার কাজের এই ক্রম পুরোপুরি মিলে যায়। সেই হারানো ত্রিশ মিনিটের হিসেবও পাই। আমরা ধরে নিতে পারি যে সেই ত্রিশ মিনিটে অফিস থেকে আপনাদের দোকানে যান তিনি এবং আপনার মা, সাতোকো কামিকাওয়া এবং আপনার মেয়ে, নাহো কামিকাওয়ার সাথে কথা বলেন মি. তাকুরা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটা খটকা থেকেই যায়, যেটার সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না। আপনার মা’র ইন্স্যুরেন্স ক্লেইমের ফাইলটা জমা দিতে হলে তো তাকে মেডিকেল সার্টিফিকেটটা সংগ্রহ করতে হবে। অর্থাৎ, আপনাদের দোকানে যাওয়া আগে তার পক্ষে কিছুতেই কাগজপত্রগুলো জমা দেয়া সম্ভব না। আর এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্নটার উদ্ভব ঘটে- মি. তাকুরা কি সেদিন আসলেই এভাবে সবকিছু করেছিলেন? আর যদি করেই থাকেন, তাহলে আমরা জিজ্ঞেস করলে ঝেরে কাশছেন না কেন?”

    ফুমিতাকা মুখ তুলে দেখল তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একদম সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে ডিটেকটিভ।

    “আপনি…আপনি তো মনে হয় সবই জানেন।

    এবারে হাসি ফুটলো কাগার মুখে।”

    “শিন-ওহাশি হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমি। ওখানকার কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে কথাও হয়েছে। সবকিছু খুলে বলেছেন তিনি আমাকে। কেবল আপনার মা’র অসুখের ধরণ সম্পর্কে কিছু বলেননি।”

    দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে রাখা আইসড কফির গ্লাসে একবার চুমুক দিল ফুমিতাকা। এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “নিহনবাশি স্টেশনে নতুন যোগ দেয়া ডিটেকটিভ সাহেব খুব বুদ্ধিমান, সেটা বলতেই হবে।”

    “ডাক্তার ভদ্রলোক দু’টো পৃথক পৃথক সার্টিফিকেট দেয়ার কথাটা স্বীকার করেছেন। একটায় আপনার মায়ের সত্যিকার শারীরিক অবস্থার বর্ণনা আছে, আরেকটায় মিথ্যে। এটা কেন করলেন তিনি? তার ভাষ্যমতে আপনিই অনুরোধ করেছিলেন।

    “জ্বি, ঠিক বলেছেন। আমিই তাকে কাজটা করতে বলেছিলাম। এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমার মা একটু জেদি ধরণের নিজের ইন্স্যুরেন্স ক্লেইমের কাজটা নিজেই করবে বলেছিল। ক্লেইমের জন্যে আবার মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। আর আমি চাইছিলাম না মা দেখুক সার্টিফিকেটে কি লেখা।”

    “এজন্যে ডাক্তারকে বলেছেন আপনার মা’কে নকল একটা সার্টিফিকেট দিতে।”

    মাথা নেড়ে সায় জানাল ফুমিতাকা।

    প্রথমে ডাক্তার সাহেব আমাকে বলেন যে কাজটা নিয়ম বহির্ভূত, তিনি পারবেন না। কিন্তু লোকটা আসলে ভালো মানুষ। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যান। তবে শর্ত দেন যে জাল সার্টিফিকেটটা মা বাদে আর কেউ দেখবে না। হাসপাতাল থেকে মা বাড়িতে চলে আসলে আমি গিয়ে আসল সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসি।

    “যেটা আপনি মি. তাকুরাকে দেন—”

    “সেদিনই ছ’টা বাজার কিছুক্ষণ আগে। আমি নিজেই তার অফিসে গিয়েছিলাম।”

    সেক্ষেত্রে মি. তাকুরার হাতে তখন আর একটা কাজই ছিল। জাল সার্টিফিকেটটা আপনার মা’র কাছ থেকে নিয়ে আসা। কাগজপত্র সব সহকর্মীকে বুঝিয়ে দিয়ে আপনাদের দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেন তিনি।

    ভ্রু কুঁচকে মাথা চুলকাতে শুরু করে ফুমিতাকা

    “মি. তাকুরাকে আমি আসলেই বিপদে ফেলে দিয়েছি। উনার একদম পোক্ত অ্যালিবাই আছে, কিন্তু সেই ব্যাপারে আপনাদের কিছু জানাতে পারছেন না কারণ আমার অনুরোধে নিয়মের বাইরে গিয়ে একটা কাজ করেছেন। এখন চাইলে আপনাদের সব খুলে বলতে পারেন, আমার পক্ষ থেকে কোন বাঁধা নেই।”

    “মি. তাকুরা জাল সার্টিফিকেটের ব্যাপারে কিছু বলেননি আমাদের।”

    “কারণ তিনি জানেন এটার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলাটা আসলেই উচিৎ হবে না। আমাকে কথাও দিয়ে বলেছিলেন ‘টোকিওতে জন্ম আমার। টোকিওতে বড় হয়েছি। পেটে বোমা ফাটলেও কাউকে কিছু জানাবো না।’”

    “তাহলে আপনি কিছু বললেন না কেন?”

    ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল ফুমিতাকা। কথা খুঁজে পেল না কিছুক্ষণ। অবশেষে বললো, “মা’র আসলে বাইল ডাক্টের ক্যান্সার ধরা পড়েছে।”

    “ওহ…” গম্ভীর হয়ে উঠলো কাগার অভিব্যক্তি।

    “তার শারীরিক অবস্থা এমন যে এখন অস্ত্রোপচারও সম্ভব না। ডাক্তার বলেছে কয়েকদিন পর আবার চেক-আপ করাতে। ততদিন বাসাতেই চিকিৎসা চলবে। কিন্তু কাজের আগের উদ্যোম কখনো ফিরে পাবে না,” লম্বা একটা শ্বাস ফেলল ফুমিতাকা। “মা’র হাতে বড়জোড় ছয় মাস আছে।”

    “আপনাকে সমবেদনা জানানো ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আসলে আর কিছু করার নেই।”

    মলিন হাসি ফোটে ফুমিতাকার মুখে।

    “সেজন্যে ধন্যবাদ, কিন্তু আমি চাই না আর কেউ সত্যিটা জানুক। বিশেষ করে আমার মা আর নাহো।”

    “আমি বুঝতে পারছি,” কাগা বলে।

    “নাহো আমার মা’কে নিজের মায়ের মতনই ভালোবাসে। ও যখন খুব ছোট তখন আমার স্ত্রী মারা যায়। তখন থেকে দাদীই কোলেপিঠে বড় করেছে। ওর বিউটি ক্লাসের কোর্স শেষ হবার আগ অবধি কিছু বলতে চাচ্ছি না আমি।” এসময় ভিন্ন একটা চিন্তা ভর করে ফুমিতাকার মনে। “অবশ্য বেশিদিন সত্যটা লুকানো বোধহয় আর সম্ভব না। মি. তাকুরার অ্যালিবাইয়ের জন্যে মুখ খুলতেই হবে।”

    মাথা ঝাঁকাল কাগা।

    আমি আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছি। আমাদের স্টেশন থেকে একজন এই বিষয়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথে আলোচনা করেছে। এখন আমাদের কেবল আপনার কাছ থেকে একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পেলেই চলবে।”

    “আচ্ছা। তাহলে আমি বিবৃতি দিলেই আর কোন সমস্যা হবে না।”

    “সরি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে।”

    “কোন ব্যাপার না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে মিতাকা। কোদেনমাচোতে যা মহিলা খুন হয়েছে, সে একাই থাকত?”

    “জ্বি।”

    “পরিবারে কেউ নেই?”

    “এক মুহূর্তের জন্যে চোখ নামায় কাগা। মুখের হাসিটা এবারে কিছুটা কাষ্ঠল দেখায় তার। ফুমিতাকা বুঝতে পারে যে এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছে না ডিটেকটিভ।

    “মাফ করবেন। চলমান তদন্তের বিষয়ে নিশ্চয়ই মুখ খুলতে পারবেন না আপনি।”

    “না, আসলে এই তথ্যগুলো নিয়ে অতটা লুকোছাপার কিছু নেই। ভদ্রমহিলা স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে একাই থাকতেন। একটা ছেলেও আছে তার। তবে স্বামীর সাথে খুব একটা দেখা হতো না।”

    “তাই নাকি?”

    “উনি কেন নিহনবাশিতে থাকতে এসেছেন, এই বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি আমরা। এই এলাকার নবাগত রহস্যময় আগন্তুক বলতে পারেন।”

    ফুমিতাকার চোখেমুখে বিস্ময়। “আপনার মতনই তাহলে।”

    “বলা যায়।”

    হেসে উঠলো দু’জনই।

    “ওই তো আপনার মেয়ে,” রাস্তার দিকে দেখিয়ে বললো কাগা! দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ডিসপ্লে কেসে রাইস ক্র্যাকারগুলো সাজিয়ে রাখছে নাহো। কাঁচের দরজাটা ঠেলে সাতোকো বেরিয়ে এলো এসময়। কিছু কথা হলো দু’জনের মধ্যে। নাহোর চেহারা কালো হয়ে গেল।

    “নাহো যদি জানে যে আমাদের দেখা হয়েছে, তাহলে নানারকম প্রশ্ন করতে শুরু করবে।”

    “তাহলে নাহয় বলে দিন যে মি. তাকুরাকে আমরা সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি।”

    মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল ফুমিতাকা। “আপনি কি এই স্টেশনে কিছুদিন থাকবেন?”

    “মনে হয়।”

    “বাহ, ভাল সংবাদ। ভালো রাইস ক্র্যাকার খেতে ইচ্ছে হলে আমাদের দোকানে এসে পড়বেন।”

    “নিশ্চয়ই।”

    আইসড কফির টাকাটা টেবিলে রেখে বিদায় জানাল ফুমিতাকা।

    এসময় শার্টের হাতা গুটিয়ে এক অফিস কর্মীকে হনহন করে হেঁটে যেতে দেখা গেল ক্যাফের পাশ দিয়ে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleম্যালিস – কিয়েগো হিগাশিনো
    Next Article দ্য মিরাকলস অব দ্য নামিয়া জেনারেল স্টোর – কেইগো হিগাশিনো

    Related Articles

    কেইগো হিগাশিনো

    স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – কিয়েগো হিগাশিনো

    August 1, 2025
    কেইগো হিগাশিনো

    দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স – কিয়েগো হিগাশিনো

    August 1, 2025
    কেইগো হিগাশিনো

    দ্য রেড ফিঙ্গার – কেইগো হিগাশিনো

    August 1, 2025
    কেইগো হিগাশিনো

    দ্য মিরাকলস অব দ্য নামিয়া জেনারেল স্টোর – কেইগো হিগাশিনো

    August 1, 2025
    কেইগো হিগাশিনো

    ম্যালিস – কিয়েগো হিগাশিনো

    August 1, 2025
    কেইগো হিগাশিনো

    দ্য নেম অব দ্য গেম ইজ অ্যা কিডন্যাপিং – কেইগো হিগাশিনো

    August 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.