Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিতু আর তার বন্ধুরা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প171 Mins Read0
    ⤷

    ০১. বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়

    ০১. বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়

    নিতুর বয়স যখন দশ বছর তিন মাস এগার দিন তখন নিতুর মা মারা গেলেন। নিতুর বাবা তখন, ও নিতুর মা গো, তুমি আমাকে কোথায় ফেলে চলে গেলে গো, আমার কী হবে গো এই সব বলে মাথা চাপড়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন টানা সাতদিন। আট দিনের দিন নিতুর বাবা কান্না থামিয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করলেন, নিতু রে, তোর নিশ্চয়ই একা একা খারাপ লাগছে?

    নিতু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

    বাবা উদাস উদাস চেহারা করে বললেন, তোর জন্য একটা নূতন মা খুঁজে আনতে হবে।

    নিতু চোখ কপালে তুলে হা হা করে বলল, না, না, বাবা লাগবে না! একেবারেই লাগবে না।

    নিতুর বাবা কথা শুনলেন না এক মাসের মাঝে বিয়ে করে একজন নূতন মা নিয়ে এলেন। নিতুর আসল মা ছিলেন হালকা পাতলা এই মা হলেন মোটাসোটা। আগের মা ছিলেন হাসিখুশি আর, এই মা হলেন বদরাগী। সত্যিকারের মা ছিলেন সাদাসিধে ভালোমানুষ আর এই মা হলেন কুটনী বুড়ি। বিয়ের পর অনেক কষ্ট করে এক দুই সপ্তাহ মুখে হাসি ধরে রাখলেন তারপর তার আসল রূপ বের হয়ে এল। নূতন মায়ের যন্ত্রণায় নিতুর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে

    নিতুর বয়স যখন দশ বছর পাঁচ মাস সতের দিন তখন একদিন তার বাবা তাকে ডেকে বললেন, আজকাল স্কুলে কোনো লেখা পড়া হয় না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পড়াশোনা ছিল খুব হাই স্ট্যান্ডার্ড।

    নিতুর বাবা আসলে কী বলতে চাইছেন বোঝার জন্যে নিতু চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। নিতুর বাবা বললেন, আমরা যখন তোর মতো ছোট ছিলাম তখন বাবোর নাম বলতে পারতাম, কান চুলকানোর ইংরেজি বলতে পারতাম।

    আমরাও পারি।

    পারিস নাকি? শুনে মনে হল বাবার একটু মন খারাপ হল। মুখ গম্ভীর করে বললেন, যাই হোক, পড়াশোনার পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা কমপ্লিট প্যাকেজ।

    প্যাকেজ?

    হ্যাঁ। বুঝলি—অঙ্ক করার সাথে সাথে ঘুমানো শিখতে হয়, ইংরেজি গ্রামারের সাথে ভাত খাওয়া।

    বাবা কী বলতে চাইছেন বুঝতে না পেরে নিতু এবারে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। বাবা নিতুর চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে বললেন, তাই ঠিক করেছি তোকে একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে দিয়ে দেব।

    কী স্কুল?

    রেসিডেন্সিয়াল স্কুল। মানে যেখানে তুই থাকবি এবং পড়াশোনা করবি। একই সাথে স্কুল আর হোস্টেল।

    নিতু অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, তার নূতন মা শেষ পর্যন্ত বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন! বাৰা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, দেখবি কী সুন্দর স্কুল। ফিটফাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যে রকম ডিসিপ্লিন সে রকম পড়াশোনা।

    নিতু কোনো কথা না বলে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, দেখবি তোর কত ভালো লাগবে। নিজে নিজে স্বাধীনভাবে থাকবি।

    নিতু এবারে বাবার দিকে তাকিয়ে একরকম জোর করে দাঁত বের করে হাসল। বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, কী হল? এরকম করে হাসছিস কেন?

    আনন্দে।

    আনন্দে?

    হ্যাঁ।

    কীসের আনন্দে?

    আমার বয়স মাত্র দশ সেই আনন্দে। যদি আমি আরেকটু বড় হতাম তাহলে তোমরা আমাকে জোর করে ধরে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে। কী বাঁচা বেঁচে গেছি সেই আনন্দে।

    বাবা অবাক হয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কিছু বললেন না। নিতু ঠিকই আন্দাজ করেছে, তার নূতন মা সত্যি সত্যি আফসোস করেছে কেন সে আরো কয়েক বছর বড় হল না তাহলেই তো বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করে দেয়া যেত।

    সপ্তাহখানেক পরে নিতু একটা স্যুটকেসে তার জামা কাপড়, তার প্রিয় গল্পের বই আর তার ছেলেবেলার কয়েকটা পুতুল ভরে নিল। স্যুটকেসের তলায় রাখল তার মায়ের একটা ফ্রেম করা ছবি। তার ঘুমানোর সাথী টেডি বিয়ার ভোটকা মিয়াকে হাতে নিয়ে নূতন স্কুলে রওনা দিল। বাবা তাকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ট্রেনে, ট্রেন থেকে নেমে বাস। বাস থেকে নেমে ফেরি। ফেরি থেকে স্কুটার। স্কুটার এসে থামল উঁচু দেওয়াল ঘেরা একটা পুরানো বাড়িতে, দেখে দিনের বেলাতেই কেমন জানি গা ছম ছম করে। উঁচু দেওয়ালের ওপর কাঁটাতার দেওয়া দেখে মনে হয় বুঝি জেলখানা। সামনে একটা বড় লোহার গেট, গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় ভিতরে বড় বড় গাছ। গেটের উপরে একটা সাইন বোর্ড, সাইনবোর্ডে লেখা :

    বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়
    স্থাপিত ১৯৬৭ ইং
    বালিকাদের আবাসিক শিক্ষাঙ্গন
    শিক্ষা এবং শৃঙ্খলার সমন্বয়।

    নিতু ভয়ে ভয়ে দেখল শৃঙ্খলা কথাটি লাল রং দিয়ে লেখা, দেখেই কেমন জানি গা শির শির করে উঠে।

    গেটটা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখা, বাবা ভয়ে ভয়ে কয়েকবার শব্দ করতেই পাশের ছোট ঘর থেকে দরজা খুলে একটা মাথা উঁকি দিল। মানুষটা সম্ভবত দারোয়ান, সারা মুখ চুল দাড়িতে টাকা। কবি রবীন্দ্রনাথেরও বড় বড় চুল দাড়ি কিন্তু তাকে দেখে কেমন জানি শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব হয়, এই মানুষটার বেলায় একেবারে উল্টো দেখেই কেমন জানি ডাকাত ডাকাত মনে হয়। লোকটার চুল দাড়ি খাড়া হয়ে আছে দেখে মনে হয় মাথার ওপরে বাজ পড়ে ইলেকট্রিক শক খেয়ে সব চুল দাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। মানুষটা লাল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বাজখাই গলায় হুংকার দিল, কী চাই?

    বাবা মিন মিন করে বললেন, না, মানে ইয়ে আমার মেয়েকে দিয়ে যেতে এসেছি।

    কোন মেয়ে?

    ওর নাম হচ্ছে মানে—

    মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, নাম দিয়ে কী হবে? এখানে সব নম্বর। কত নম্বর মেয়ে?

    বাবা তাড়াতাড়ি নিতুর কাগজপত্র বের করে নম্বর দেখে বললেন, সাতশ বিয়াল্লিশ।

    ইলেকট্রিক শক খাওয়া মানুষটা তার হাতের রেজিস্টার খাতাতে কিছু একটা দেখে গেট খুলে দিয়ে বলল, ভিতরে।

    বাবা নিতুকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন তখন লোকটা আবার ধমক দিয়ে বলল, আপনি ঢুকছেন কেন? আপনি কি এই স্কুলে পড়বেন?

    না—মানে ভিতরে দিয়ে আসি।

    এর ভিতরে বাইরের মানুষের টোকা নিষেধ।

    বাবা নিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে জোর করে একটা খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে বললেন, বলেছিলাম না খুব ভালো স্কুল? দেখেছিস শৃঙ্খলার দিকে কী রকম নজর?

    নিতু মাথা নাড়ল, বলল, একটু বেশি নজর। মনে হয় এখানে চোর

    ডাকাতের মেয়েরা পড়তে আসে।

    নিতুর কথা শুনে বাবা চোখ পাকিয়ে তাকালেন তারপর শুকনো গলায় বললেন, তুই তাহলে ভিতরে যা। ভালো হয়ে থাকিস।।

    খাড়া খাড়া চুল দাড়িওয়ালা ডাকাতের মতো মানুষটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, সেটা আর বলে দিতে হবে না। এই খানে ভালো হয়ে না থাকলে– মানুষটা কথা শেষ না করে ডান হাত দিয়ে ম্যাচ করে গলায় পোচ দেবার মতো একটা ভঙ্গি করল। দেখে হঠাৎ নিতুর শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

    বাবা নিতুর হাতে কাগজগুলি দিয়ে বললেন, যা, দেরি করিস না।

    নিতু এক হাতে তার টেডি রিয়ার ভোটকা মিয়াকে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ভারী স্যুটকেসটা টেনে টেনে ভিতরে ঢুকল। গেটটা পার হওয়া মাত্র পিছনে ঘর ঘর করে সেটা বন্ধ হয়ে গেল, নিতুর হঠাৎ মনে হয় সে বুঝি সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

    গেট থেকে খোয়া বাধানো রাস্তা ভিতরে চলে গেছে। রাস্তার দুই পাশে নানা ধরণের গাছ গাছালি, একটু ভিতরে পোড়াবাড়ির মতো একটা মন খারাপ করা দালান। তার পিছনে টিনের ছাদের ছোট ছোট বাসা। স্কুল হলে যেরকম ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়ের হৈ চৈ কলরব শোনা যাবার কথা এখানে সেরকম কিছু নেই। চারিদিকে কেমন জানি সুমসাম নীরবতা। এটি যেন স্কুল নয়—এটি যেন একটি কবরস্থান।

    কী করবে বুঝতে না পেরে নিতু কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইল তারপর ভারী সুটকেসটা টানতে টানতে মন খারাপ করা দালানটার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। যেতে যেতে সে ফিস ফিস করে বুকে আঁকড়ে থাকা টেডি রিয়ারটার সাথে কথা বলতে শুরু করে, বুঝলে ভোটকা মিয়া, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ঐ দালানটা দেখে ভয় ভয় লাগলেও দেখবে সেখানে সব ভালো ভালো মানুষেরা থাকে। আমারা হাজির হতেই দেখবে সবাই ছুটে আসবে!

    দালানটার কাছে পৌঁছানোর পর কেউ অবিশ্যি ছুটে এল না। ভারী স্যুটকেসটা অনেক কষ্ট করেও সিঁড়ি দিয়ে তুলতে না পেরে সে হাল ছেড়ে দিয়ে স্যুটকেসটার উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। ভোটকা মিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বুঝলে ভোটকা মিয়া, আমরা এখানেই বসে থাকি, যার দরকার সেই আমাদের খুঁজে বের করবে।

    নিতুর সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হল, কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ মনে হল তার সামনে একটি পাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে। নিতু ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকাল, মনে হল প্রায় আকাশের কাছাকাছি মাথা পৌছে গেছে এরকম একজন তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। মানুষটি নিশ্চয়ই একজন মহিলা কারণ একটা শাড়ি পরে আছে, কিন্তু তার চেহারা দেখে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। মাথার চুল শক্ত করে টেনে পিছনে ঝুঁটি করে বেঁধে রাখা, সামনে থেকে মাথায় কোনো চুল আছে কী নেই সেটা বোঝা যায় না। গায়ের রং শ্যামলা, শরীর পাথরের মতো শক্ত। শাড়ি পরলে মেয়েদের চেহারার একটা কমনীয়তা চলে আসে কিন্তু এই মহিলার বেলায় সেটা সত্যি নয়। মেয়েরা যদি আমীর হাবিলদার হতো তাহলে নিশ্চয়ই এই ভাবে শাড়ি পরতো। মহিলার চোখ লাল এবং নিতুকে দেখে সেটা

    আরো লাল হয়ে উঠল। সেই আকাশের কাছাকাছি মাথা থেকে হঠাৎ যেন বিজলী চমকে উঠল, বিশাল একটা মুখ হঠাৎ একটা বড় ট্রাঙ্কের ঢাকনার মতো খুলে যায়, ভিতর থেকে কালো মাড়ি এবং ধারালো দাঁত বের হয়ে আসে এবং নিতু একটা গর্জন শুনতে পায়, এটেনশান।

    নিতু কী করবে বুঝতে পারল না, রাস্তা ঘাটে পুলিশ মিলিটারি যখন মার্চ করে তখন এটেনশন বললে তারা পা ঠুকে সোজা হয় দাঁড়িয়ে যায়। তাকেও কি সে রকম কিছু করতে হবে? কী করবে ঠিক করতে নিশ্চয়ই তার দেরি হয়ে গিয়েছিল কারণ কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ মনে হল একটা বাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং তার ঝুঁটি ধরে প্রায় শূন্যে তুলে তাকে দাড় করিয়ে দিয়েছে। নিতু পিট পিট করে তাকাল এবং দেখতে পেল বিশাল কেঁদো বাঘের মাখার মতো একটা মুখ তার দিকে নেমে আসছে, মাথাটি নামতে নামতে একেবারে তার মুখের কাছে নেমে এল, এত কাছে নেমে যে নিতু তার চোখের লাল শিরা, নাকের ভিতরে লেমি এবং দাঁতের ফাকে লেগে থাকা মাংসের টুকরাগুলি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেল। শুধু তাই নয় তার নাকে ভক করে একটা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়—কেউ যদি বাঘের মুখ খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেয় তাহলে সে নিশ্চয়ই এরকম একটা গন্ধ পাবে। কেঁদো বাঘের মুখের ভিতর থেকে আরেকটা গর্জন বের হয়ে আসে, তু-ই-কে-রে?

    নিতু নাম বলতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেল, মনে পড়ল এখানে কারো নাম নেই, সবার একটি করে নম্বর। সে ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলল, আমি সাতশ বিয়াল্লিশ।

    কেঁদো বাঘের বিশাল ভয়ংকর মাথাটা আস্তে আস্তে আবার উঠে যায়। আকাশের কাছাকাছি থেকে আবার একটা গর্জন ভেসে এল, তোর হাতে এইটা কী?

    নিতু তার হাতের দিকে তাকাল, দুই হাতে সে শক্ত করে তার ভোটকা মিয়াকে ধরে রেখেছে। সে সেটাকে তুলে এনে বুকে চেপে ধরে বলল, এইটা আমার টেডি বিয়ায়। আমি যখন–

    সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কেঁদো বাঘের বিশাল মুখ দেখে মাঝখানে তার কথা বন্ধ হয়ে গেল।

    তুই যখন?

    আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা এইটা আমাকে দিয়েছেন।

    নিচে ফ্যাল।

    নিতু না বুঝে অবাক হয়ে তাকাল তখন সেই পাহাড়ের ভিতর থেকে গর্জন বের হয়ে এল, নি-চে-ফে-লে-দে।

    নিতু ভয়ে ভয়ে তার ভোটকা মিয়াকে নিচে ফেলল, সাথে সাথে সেই বিশাল পাহাড় এগিয়ে এসে ফুটবলে যেভাবে কিক দেয় সেই ভাবে ভোটকা মিয়াকে একটা কিক দিল—ভোটকা মিয়া গুলির মতো আকাশে উড়ে গেল। নিতু একটা চিৎকার করে উঠে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইল সেটা কোথায় গিয়ে পড়েছে তখন সেই ধুমসো পাহাড় আবার গর্জন করে উঠল, খবরদার নড়বি না।

    নিতু পাথরের মতো জমে গেল।

    সামনে তাকা। নিতু সামনে তাকাল।

    সীনা টান, মুখ উঁচু। নিতু সীনা টান করে মুখ উঁচু করল।

    হাত পাশে, আঙুল মুঠ। নিতু হাত পাশে এনে আঙুল মুঠিবদ্ধ করল।

    গোড়ালী জয়েন, মুখ বন্ধ, চোখ খোল। নিতু দুই পায়ের গোড়ালী একসাথে লাগিয়ে মুখ বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে খুলে তাকাল।

    সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাহাড় এবারে স্টীম ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুই কী করেছিস?

    নিতু প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না, ভয়ে সে ঠিক করে চিন্তাও করতে পারছিল না, তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, তার মাঝে কোনো ভাবে নিজেকে সামলে বলল, আমি কিছু করি নাই।

    কেঁদো বাঘের মতো মুখটা এবারে আবার নিচে নেমে এলো, নিতুর নাকে আবার ভুক করে একটা মাংস পচা গন্ধ এসে লাগে। মুখটা আবার ট্রাঙ্কের ডালার মতো খুলে যায়, ভিতর থেকে ধারালো দাঁত আর লকলকে কালো জিব বের হয়ে আসে, ভেতর থেকে হিস করে আওয়াজ আসে, বল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

    আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

    কেঁদো বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, জো-রে। শব্দের ঝাপটায় মুখ থেকে থুতু বের হয়ে এসে নিতুর মুখে লাগল, ঘেন্নায় নিতুর শরীর স্ত্রী রী করে উঠে কিন্তু সে নড়ল না, ভয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

    কেঁদো বাঘের মাথা আবার ওঠে যায়, নাক দিয়ে আবার ইঞ্জিনের মতো শব্দ হয়, মুখের ডালা খুলে আবার শব্দ বের হয়, নিশ্চয়ই কিছু করেছিস, না হলে এখানে কেন পাঠাল?

    নিতু চুপ করে রইল, সত্যি সত্যি তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

    কথা বল নর্দমার পোকা, ছারপোকার ছাও।

    নিতু ভাঙ্গা গলায় যতটুকু সম্ভব জোরে জোরে বলল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

    আমার সাথে মামদোবাজী? এক দিনে পিটেয়ে সিধা করে দেব। হাড়ি ভেঙ্গে গুড়া করে দেব। চামড়া ছিলে ডুগডুগী বানাব। আমাকে চিনিস না তুই বানরের বাচ্চা বানর? তেলাপোকার ডিম? বল সত্যি কথা।

    এবারে নিতু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল, তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি বের হয়ে আসে। ধুমসো পাহাড় আবার হুংকার দিয়ে বলল খবরদার কাঁদবি না, ছিচকাঁদুনে ইঁদুর।

    নিতু অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকে ফেলল।

    তুই কী মনে করিস আমি কিছু বুঝি না? আমার নাক টিপলে দুখ বের হয়? এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আমি আছি চৌদ্দ বছর। আমি তোর মতো শত শত ছেমড়ী দেখেছি। যাদের স্বভাব ইঁদুরের মতো। চোর ছ্যাচড়ের বাচ্চা। গুণ্ডা বদমাইসের বাচ্চা। আমার হাত দিয়ে বের হয়েছে, আমি টিপে টিপে তাদের ভূড়ি ফাঁসিয়ে দিয়েছি। সাপ হয়ে এসেছে, আরশালা হয়ে বের হয়ে গেছে। দেশের যত পাজী হতছাড়া বেয়াদপ বদমাইস শয়তান মেয়েগুলিকে যখন বাপমা সিধে করতে পারে না তখন তাদেরকে পাঠায় এইখানে। আমি সিধে করে ছেড়ে দেই। তোকেও আমি সিধে করব।

    নিতু এবারেও কিছু বলল না, হঠাৎ করে তার চোখের সামনে সারা পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। তার বাবা আর মা মিলে কোথায় পাঠিয়েছে তাকে? কী হবে তার এইখানে?

    পাহাড়ের মতো মহিলা এইবারে কাকে যেন ডাকল, জমিলার মা।

    সাথে সাথে কোথা থেকে যেন জমিলার মা হাজির হল, বেঁটেখাটো একজন মহিলা মুখ দেখে মনে হয় যেন একটা রবোট। কাছে এসে মিলিটারিদের মতন এটেনশান হয়ে বলল, আমাকে ডেকেছেন মাভাম?

    হ্যাঁ। এই নর্দমার পোকা ছারপোকার ছাও, হুক ওয়ার্মকে বি ব্লকে দুইশ কারো নম্বর রুমে দিয়ে আস।

    কোন সিটে ম্যাডাম?

    গিয়ে দেখ, একটাই সিট খালি আছে।

    ঠিক আছে ম্যাডাম।

    মুখে কোনো ভাবভঙ্গি নেই বেঁটেখাটো কিন্তু শক্ত টাইপের সেই রবোট মহিলা নিতুর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নিতুকে বলল, চল।

    নিতু পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার টেডি বিয়ার, ম্যাডাম।

    পাহাড় হুংকার দিয়ে বলল, চোপ। এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে মানুষ ছাড়া আর কিছু থাকতে পারবে না।

    কিন্তু ম্যাডাম। এই টেডি বিয়ারটা আমার আম্মা আমাকে দিয়েছিলেন চোপ বেয়াদপ। চোপ। খামোশ। নিতু কী বলবে বুঝতে পারল না। পাহাড় আবার গর্জন করে বলল, যখন এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে বের হবি তখন তোর মাকে বলিস আরেকটা কিনে দিতে।

    কিন্তু আমার আম্মা মারা গেছেন। কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে তার মায়ের কথা মনে পড়ে সে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

    তোর মা মারা গেছে? নিতুর মনে হল এই প্রথমবার কেঁদো বাঘের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, তুই নিশ্চয়ই এত যন্ত্রণা দিয়েছিস যে সেই যন্ত্রণায় তোর মা মরেছে? ঠিক কি না?

    নিতু কিছু বলল না, অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করল। পাহাড়ের মতো মহিলা হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল, কুইক মার্চ।

    নিতু বুঝল তাকে যেতে বলা হচ্ছে। সে রবোট মহিলার পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে শেষবার এই দানবীর দিকে তাকাল তারপর ফিসফিস করে মনে মনে বলল, আমি যদি আমার মায়ের বেটি হই তাহলে তোমাকে আমি একদিন টাইট করব।

    পাহাড়ের মতো দানবী সেই কথা শুনতে পেল না, শুনতে পেলে সেই মুহূর্তে তার মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবৃষ্টির ঠিকানা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article দীপু নাম্বার টু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }