Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিতু আর তার বন্ধুরা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প171 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. স্লীপ ওয়াকিং

    ০৪. স্লীপ ওয়াকিং

    ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে এসেমব্লিতে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কী কারণ কারো জানা নেই এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে কয়েকবার হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে ব্যায়াম করতে হয়। ব্যায়াম শেষ করে সবাই এখন ক্লাশরুমে যাবে, ঠিক তখন খোরাসানী ম্যাডাম দুই পা এগিয়ে এসে হুংকার দিয়ে বলল, চামচিকার দল। ছারপোকার ডিম। ইঁদুরের বাচ্চারা

    এটি নূতন কিছু নয়, খোরাসানী ম্যাডাম গালি না দিয়ে কথা বলে না, কাজেই এর পরে কী বলবে শোনার জন্যে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, জমিলার মা বলেছে কাল রাতে ছাতিম গাছটাতে নাকি একটা পরী নেমেছিল। সে নিজের চোখে দেখেছে।

    নিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠে, হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ যেন লাফিয়ে গলার কাছে এসে ঢোল বাজানোর মতো শব্দ করতে থাকে। খোরাসানী ম্যাডাম জল্লাদের মতো সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, জীন পরী এত জায়গা থাকতে বুতুরুন্নেসা স্কুলে হাজির হল কেন?

    কেউ কোনো কথা বলল না।

    সকাল বেলা আমি ছাতিম গাছটা দেখতে গিয়েছিলাম। পরী ভুল করে তার পাখা ফেলে গিয়েছে কী না দেখতে। খোরাসানী ম্যাডাম আরেকবার সামনে দিয়ে হেঁটে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কী দেখেছি জানিস ছারপোকার দল, হুকওয়ার্মের ছাও?

    নিতু এবং তার পাঁচ রুমমেট ছাড়া অন্য সবার মাঝে সূক্ষ্ম কৌতুহল জেগে উঠলেও কেউ কোনো কথা বলল না। খোরাসানী ম্যাডাম তার কেঁদো বাঘের মতো মুখটাকে আরো ভয়ংকর করে হাত উপরে তুলে মুঠিটা খুলে ফেলল, নিতু দেখল তার ঘুমের কাপড়ের ছেড়া অংশটুকু হঠাৎ করে তার মনে হল সে বুঝি হাঁটু ভেঙ্গে ধড়াস করে পড়ে যাবে। অনেক কষ্ট করে নিতু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, এইটা কার কাপড়ের টুকরা? এক্ষুনি বল, না হলে আমি তোদের সবাইকে এই খানে নীল ডাউন করিয়ে রেখে ঘরে ঘরে গিয়ে তোদের কাপড় চেক করে দেখব। এটা যার কাপড়ের টুকরা তাকে আমি–

    খোরাসানী ম্যাডাম কথা শেষ না করে মুণ্ডু ছিঁড়ে নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ হাঁ করে কোৎ করে গিলে ফেলার ভঙ্গি করল এবং ব্যাপারটি কারো কাছে এতটুকু অসম্ভব বলে মনে হল না।

    নিতু ঘামতে শুরু করল, সত্যি সত্যি যদি ঘরে ঘরে গিয়ে কাপড় চেক করতে শুরু করা হয় তাহলে সে ধরা পড়ে যাবে। শুধু যে সে ধরা পড়বে তাই নয়, কাপড় খুঁজতে গিয়ে যখন ভোটকা মিয়াকে পেয়ে যাবে তখন কেন সে মাঝ রাতে ছাতিম গাছে উঠেছিল সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকবে না। সে নিজে যদি এখন স্বীকার করে একটা গল্প ফেঁদে বসে–

    কোন ইবলিশের বাচ্চা শয়তানের ছাও সাপের বংশ ছাতিম গাছে ওঠেছিলি?

    কেউ কোনো কথা বলে না। নিতু দ্রুত চিন্তা করতে থাকে—ঠিক ঠিক সিদ্ধান্ত যদি না নেয় সে জন্মের মতো শেষ হয়ে যাবে।

    খোরাসানী ম্যাডাম হঠাৎ আবার আকাশ ফাটিয়ে হুংকার দিল, কথা বল বিষ ফোড়ার পুঁজ, বাদুরের বমি–

    নিতু তখন হঠাৎ হাত তুলে গলায় স্বর খুব স্বাভাবিক রেখে বলল, ম্যাডাম, কাপড়ের টুকরাটা কী একটু দেখতে পারি।

    এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় একশ জন মেয়ে এবং ছয়জন ম্যাডাম আর একজন বুয়া এক সাথে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে মাথা ঘোরানো ঘোরতর বেআইনী কাজ জেনেও সব কয়টি মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিতুকে দেখার চেষ্টা করল।

    খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল তার মাথায় বুঝি বাজ পড়েছে, খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলর, কী? কী বললি?

    নিতুর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ঢাকের মতো শব্দ করছে কিন্তু সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে খুব স্বাভাবিক থাকার ভান করে শান্ত গলায় বলল, আমি কাপড়টা একটু কাছে থেকে দেখতে চাইছিলাম।

    খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর কথা শুনে এত অবাক হয়েছে যে রেগে উঠতেও ভুলে গেছে, আবার তোতলাতে তোতলাতে বলল, কে-কে-কেন?

    আমার ঘুমের কাপড়টা অনেকটা এই রকম।

    অনেকটা এইরকম?

    জি ম্যাডাম?

    খোরাসানী ম্যাডাম কাপড়ের টুকরাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেল—এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুখটা ভয়ংকর করে বাঘের গর্জনের মতো হুংকার দিয়ে বলল, এইখানে আয়।

    নিতু তখন কুলকুল করে ঘামছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, কিন্তু প্রাণপণে নিজেকে শান্ত রেখে হেঁটে হেঁটে খোরাসানী ম্যাডামের কাছে এগিয়ে এল। খোরাসানী ম্যাডাম তার ঘুমের কাপড়ের ভেঁড়া টুকরাটা ওপরে ধরে রাখল যেন নিতুকে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। নিতু কাছে আসতেই কাক করে তার ঘাড় ধরে হ্যাচকা টানে উপরে তুলে নিয়ে কাপড়ের টুকরাটার সামনে তাকে ধরে রাখে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিতু ছটফট করতে থাকে, যখন মনে হয় নিশ্বাস আটকে তার বুক ফেটে যাবে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে ওপর থেকে ছেড়ে দিল, সে নিচে পড়ে গিয়ে তাল সামলে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। খোরাসানী ম্যাডাম তখন তার কেঁদো বাঘের মতো মুখটা নিচে নামিয়ে এনে দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় জিজ্ঞেস করল, কাপড়টা কি চিনেছিস ঘেসে সাপ? চিনে জোক? মাকড়শীর ডিম?

    জি ম্যাডাম। নিতু মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে সবাই শুনতে পারে সে রকম ভাবে বলল, এইটা আমার জামার কাপড়ের টুকরা।

    নিতর গলার স্বর শুনে সবাই এত অবাক হল যে আকাশ থেকে একটা বজ্রপাত হলেও বুঝি কেউ এত অবাক হত না। সবচেয়ে বেশি অবাক হল খোরাসানী ম্যাডাম নিজে, তার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ এইভাবে একটা কথা বলতে পারে খোরাসানী ম্যাডাম চিন্তাও করতে পারে না। খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, তোর জামার কাপড়ের টুকরা মাঝ রাতে ছাতিম গাছে কেমন করে গেল?

    জানি না ম্যাডাম।

    জানিস না?

    না, ম্যাডাম।

    খোরাসানী ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুই মাঝরাতে কেন ছাতিম গাছে উঠেছিলি জানিস না?

    না ম্যাডাম। তবে—

    খোরাসানী ম্যাডাম চোখ ছোট ছোট করে বলল, তবে?

    তবে আমার শরীরে ব্যথা এবং পায়ে খামচির দাগ দেখে মনে হয়—

    দেখে মনে হয়?

    দেখে মনে হয় আমি নিশ্চয়ই উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়েছি। আর–

    আর?

    কুকুর বিড়াল কিছুএকটা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে।

    খোরাসানী ম্যাডাম মুখ হাঁ করে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার সামনে প্রায় একশ মেয়ে বিস্ফোরিত চোখে এই নাটক দেখতে লাগল। খোরাসানী ম্যাডামের কেঁদো বাঘের মতো মুখটাকে কেমন জানি বিচিত্র দেখাতে থাকে। হঠাৎ করে তার ভয়ংকর কুকুর সিংঘির কথা মনে পড়েছে, যদি দশ বার বছরের একটা মেয়ে সেই ভয়ংকর কুকুরের আক্রমণকে কুকুর বিড়াল আঁচড়ে দিয়েছে বলে ব্যাখ্যা করে তবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে।

    নিতু মুখ শক্ত করে বলল, আমি শুনেছি আমি নাকি ঘুমের মাঝে স্লিপ ওয়াকিং করি। নিশ্চয়ই গত রাতে আমি স্লিপ ওয়াকিং করেছি।

    খোরাসানী ম্যাডাম খানিকক্ষণ নিতুর মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, স্লিপ ওয়াকিং করার জন্যে এখনই এই মেয়েটার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলবে নাকি ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখবে চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত আরেকটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যা। লাইনে গিয়ে দাঁড়া। দেখি তুই কত বড় ধড়িবাজ। খালি মুণ্ডুটা ছিড়ব না কি পুরো শরীরটাকে কিমা বানিয়ে সিংঘিকে খেতে দিব একটু ভেবে দেখি।

    নিতু বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে লাইনে নিজের জায়গায় দাঁড়াল। এ যাত্রা সে বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু কতক্ষণের জন্যে বেঁচেছে কে জানে।

    টিফিনের ছুটিতে লম্বা মতন একটা মেয়ে এসে নিতুর চুল টেনে ধরল, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই ছেমড়ি।

    নিতু মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল, জোড়া ভুরু, কেঁকড়া চুল দুই গালে ফুস্কুরির মতো ব্রণ। নিতুর চুল টেনে মাথা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, এই

    ছেমড়ি, তুই গুল গপ্পা মারার জায়গা পাস না?

    নিতু ঝটকা মেরে নিজের মাথা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমাকে ছেমড়ি বলবে না।

    তাহলে কী বলব?

    আমার নাম নিতু।

    মেয়েটা তার ছোট ছোট ধারালো দাঁত বের করে হেসে বলল, নিতু বড় কঠিন নাম, বলতে গিয়ে দাও ভেঙ্গে যায়। ছেমড়ি কলা খুব সোজা। এই দ্যাখ ছে-ম-ড়ি! কতসোজা! যেন খুব মজার ব্যাপার হয়েছে সে রকম ভান করে মেয়েটা দুলে দুলে হি-হি করে হাসতে শুরু করল।

    নিতু কী করবে বুঝতে পারল না। সব ক্লাশে এ রকম একটা করে মেয়ে থাকে যার যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ট হয়ে যায়। আগে স্কুল থেকে বাসায় গেলে এদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচা যেতো কিন্তু এখানে কী হবে? স্কুল থেকে যাবে হোস্টেলে সেখানে তো এই যন্ত্রণা আরো দশগুণ বেড়ে যাবে।

    মেয়েটা নিতুর আরো কাছে এসে বলল, ভেবেছি তোর গুল পট্টি আমি বিশ্বাস করেছি?

    কর নাই?

    না। তোর মতো মিথুকদেরকে দেখলেই চেনা যায়।

    তাই নাকি?

    হ্যাঁ। তুই নিশ্চয়ই মহা বদমাইস সেই জন্যে তোকে টাইট করার জন্যে এখানে পাঠিয়েছে।

    নিতু মাথা নাড়ল। বলল, ঠিকই বলেছিস। মেয়েটা একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, কী বললি?

    বলেছি যে তুই ঠিকই বলেছিস। আমি এত বড় বদমাইস যে আমার বাসায় কেউ আমাকে টাইট করতে পারে নাই।

    মেয়েটা ছোট ছোট চোখে তাকাল, তুই কী করেছিলি?

    তুই পত্রিকা পড়িস? ভোরের কাগজে বের হয়েছিল। জুলাই মাসের আঠার তারিখে। তৃতীয় পৃষ্ঠা।

    কি বের হয়েছিল?

    নিতু উদাস উদাস মুখ করে বলর, তোর যদি সখ থাকে তাহলে তুই নিজেই পড়ে নে। খরবটার হেড লাইন ছিল অমানুষিক!

    অ-অমানুষিক?

    হ্যাঁ। আমি সে রাতেও স্লিপ ওয়াকিং করতে বের হয়েছিলাম। তবে সেদিন খালি হাতে ছিলাম না। হাতে ছিল একটা কুড়াল।

    কুড়াল?

    হ্যাঁ। চাইনিজ কুড়াল। এইরকম ছোট। নিতু হাত দিয়ে দেখাল, তবে খুব খার।

    মেয়েটার চোখে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর বিস্ময় এবং শেষে আত ওঠল। শুকনো গলায় বলল, কী করেছিলি চাইনিজ কুড়াল দিয়ে?

    নিতু ঠোঁট উল্টে তার একটা বই টেনে নিয়ে বলল, তোর জানার ইচ্ছা থাকলে তুই বের করে নে।

    মেয়েটা কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে সরে গেল। নিতু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পিছনে বসে আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে। বসে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছে সবার চোখে এক ধরনের ভয়। নিতু তার পাশে বসে থাকা মিতুলকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটা কে?

    কাসেম।

    কাসেম? কাসেম তো ছেলেদের নাম।

    হ্যাঁ। ওর ভাবভঙ্গি ছেলেদের মতো নামও ছেলেদের।

    নিতু অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে মিতুলের দিকে তাকাল, মিতুল মাথা নেড়ে বলল, সত্যি! কাসেমের বাবা নেই। যখন জন্ম হয়েছে মায়ের খুব ঝামেলা ছিল তাই খেয়াল করে দেখে নাই ছেলে না মেয়ে। ভেবেছে ছেলে হয়েছে তাই নাম রেখেছে কাসেম। পরে দেখেছে মেয়ে তখন আলসেমী করে নাম আর পাল্টায় নাই।

    আশ্চর্য!

    এরকম সময়ে হেঁটে হেঁটে রুনু আর ঝুনু হাজির হল। এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে ঝুনু বলল, নিতু! তোর কী সাংঘাতিক সাহস?

    রুনু মাথা নেড়ে বলল, হা! কেমন করে তুই পারলি?

    নিতু গলা নামিয়ে বলল, কী করব? ধরা পড়লে তো এমনিতেই খুন হয়ে যাব।

    তা ঠিক।

    এখন কী হবে?

    নিতু আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় ঘণ্টা পড়ে গেল বলে বলতে পারল না, সবাই ক্লাশে ফিরে এল।

     

    বুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে মেয়েরা নিজেদের মাঝে কথা বলার বিশেষ সুযোগ পায় না—তার মাঝেও খুব কষ্ট করে তারা খানিকটা সময় করে নিল, বিকালে ঘুমের পরে, রাত্রে খাবার টেবিলে, খাবার পরে এবং ঘুমানোর ঠিক আগে। নিতু যে মহাবিপদে পড়েছে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা যায় কী না সেটা নিয়ে আলোচনা। তানিয়া খুব কম কথা বলে, সে মাথা নেড়ে বলল, একটা মাত্র উপায়।

    রেবেকা চোখে চশমাটা চেপে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, কী উপায়?

    যদি কোনোভাবে বিশ্বাস করানো যায় যে সত্যি সত্যি নিতু স্লিপ ওয়াকিং করে, সত্যি সত্যি ঘুমের মাঝে হাঁটে, তাহলে বিপদ কাটতে পারে।

    সেটা কীভাবে করবি?

    আবার নিতুকে ঘুমের মাঝে হাঁটতে হবে। সবাইকে দেখিয়ে।

    নিতু বলল, এটা আর কঠিন কী? আমি তো হাঁটতেই পারি।

    তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু সেটা সবার বিশ্বাস হতে হবে। বিশেষ করে হোস্টেল সুপার। আর খোরাসানী ম্যাডাম।

    মিল বলল, সেটা কীভাবে করা যায়।

    তানিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এমন ভাবে স্লিপ ওয়াকিং করতে হবে যেটা খুব ভয়ংকর। যেটা কেউ করে না। যেটা দেখলেই সবাই বিশ্বাস করবে যে এইটা সত্যি।

    নিতু বলল, ঠিক বলেছিস। কী করা যায়?

    একটা ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে তুই যদি কার্নিশ ধরে হাঁটতে থাকিস আর আমরা হোস্টেল সুপারকে ডেকে আনি, তার সামনে তুই হাঁটবি।

    রুনু একটু শিউরে উঠে বলল, সর্বনাশ! যদি পড়ে যায়?

    পড়ে গেলে তো শেষ।

    আরো ভয়ংকর করা যায়। যদি চোখ বন্ধ করে ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে পারিস।

    রেবেকা শিউরে উঠে বলল, সর্বনাশ! দৃশ্যটি চিন্তা করেই তার হাত যা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

    পারবি তুই? পারব না কেন। একবার পারব।

    তানিয়া হঠাৎ বলল, দাঁড়া, আমার মাথায়, আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। যদি শিপ ওয়াকিং করে ভয়ংকর কিছু একটা করতেই চাস তাহলে সবচেয়ে ভয়ংকর কাজটা করলে কী হয়?

    সবাই তানিয়ার দিকে ঘুরে তাকাল, সবচেয়ে ভয়ংকর?

    হ্যাঁ।

    কী সেটা?

    তানিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে কাজটা কী বলতেই সবাই মুখে হাত দিয়ে আর্ত চিৎকার করে ওঠে। তানিয়া সরু চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, পারবি?

    নিতু বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, পারব।

    রুনু ঝুনু চিৎকার করে বলল, না! না নিতু না।

    রেবেকা নিতুর হাত ধরে বলল, খবরদার নিতু, পাগলামো করিস না। এটা করতে যাস নে।

    মিতুল ফ্যাকাসে হয়ে মাথা নাড়তে থাকে, বলে, না, না, কী সর্বনাশ!

    নিতু শুধু মুখ শক্ত করে বলল, না। এটাই সবচেয়ে ভালো। তাহলে কেউ আর অবিশ্বাস করবে না।

     

    গভীর রাত। সবাই ঘুমুচ্ছে, তার মাঝে নিতু এবং অন্য সবকয়টি মেয়ে বিছানা থেকে নেমে এল। নিতু তার টেবিলের উপর থেকে একটা পুরানো খবরের কাগজ নিয়ে সেটা পাকিয়ে একটা লাঠির মতো করে নিল, তারপর গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, গেলাম।

    সাবধানে থাকিস।

    এর মাঝে আবার সাবধানে থাকব কী করে?

    তাও ঠিক।

    খুব সাবধানে দরজা খুলে নিতু বের হয়ে গেল। ওরা চুপ করে বসে থেকে খানিকক্ষণ সময় দেয়। নিতু গতকালকের মতো আজকেও কার্নিশ ধরে হেঁটে গিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে যাবে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেল নিতু খোয়া বাঁধানো রাস্তাটার কাছে চলে এসেছে। খোরাসানী ম্যাডামের ভয়ংকর কুকুরটাও ছুটে এসে নিতুকে ঘিরে নাচানাচি করছে। এরকম ভয়ংকর কুকুরকে যে এভাবে বশ করে ফেলা সম্ভব নিজের চোখে না দেখলে ওরা কেউ বিশ্বাস করত না।

    তানিয়া সবার দিকে তাকিয়ে বলল, রেডি?

    অন্যেরা মাথা নাড়ল।

    চল তাহলে।

    পাঁচজন দড়াম করে যত জোরে সম্ভব দরজাটা খুলে ঘর থেকে ছুটে বের হল। তারপর সবাই দুদ্দাড় করে বারান্দা ধরে দৌড়াতে থাকে, মধ্যরাতে তাদের পায়ের শব্দ আর আধা আতংকিত কথাবার্তায় হঠাৎ হোস্টেলের অনেকে জেগে ওঠে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। রুনু ঝুনু তানিয়া মিতুল আর রেবেকা এই পাঁচজন হোস্টেল সুপারের দরজা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল, প্রায় সাথে সাথেই হোস্টেল সুপার দরজা খুলে বের হয়ে এল। মহিলা এমনিতেই শুকনো চিমশে এই মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠার পর তাকে আরো শুকনো দেখাচ্ছে, ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, কী? কী হয়েছে?

    মিতু বলল, সর্বনাশ।

    হোস্টেল সুপার আরো ভয় পেয়ে বলল, কী সর্বনাশ?

    আমাদের রুমে যে নতুন মেয়েটা এসেছে—

    হ্যাঁ। কী হয়েছে তার? মরে গেছে?

    না, মরে নাই।

    তাহলে?

    সে নাই।

    না। রেবেকা চোখে মুখে আতংকের একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, হঠাৎ করে বিছানা থেকে উঠে চোখ বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে গেল।

    হোস্টেল সুপার ভুরু কুচকে বলল, বের হয়ে গেল? কোথায় বের হয়ে গেল?

    জানি না।

    রুনু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, দেখলাম রেলিং ধরে কার্নিশে নেমে গেছে।

    কার্নিশ? হোস্টেল সুপার চিৎকার করে বলল, কার্নিশে?

    হ্যাঁ।

    সর্বনাশ! বলে প্রায় দৌড়ে হোস্টেল সুপার বারান্দায় রেলিংয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরে দাঁড়িয়ে এবারে সবাই দেখতে পায়, অনেক দূরে ছায়ামূর্তির মতো নিতুকে দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারে হাঁটছে, তাকে ঘিরে নাচানাচি করছে। ভয়ংকর দর্শন একটা কুকুর।

    হোস্টেল সুপারের চোয়াল স্কুলে পড়ল। খানিকক্ষণ সেই দৃশ্যের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। কোনোভাবে একটা টোক গিলে বলল, নিশ্চয়ই জীনের আছর হয়েছে।

    তানিয়া মাথা নাড়ল, না ম্যাডাম। স্লিপ ওয়াকিং।

    স্লিপ ওয়াকিং?

    হ্যাঁ। ঘুমের মাঝে হাঁটা।

    ঐ ঐ মেয়েটা ঘুমের মাঝে হাঁটছে? এখন ঘুমাচ্ছে?

    জি ম্যাডাম। তানিয়া গম্ভীর গলায় বলল, যখন বারান্দায় হাঁটছিল তখন আমরা দেখেছি চোখ বন্ধ ছিল।

    হোস্টেল সুপার খানিকটা জড় বুদ্ধি মানুষের মতো কাজেই সে নিজে থেকে কিছুই করতে পারছিল না, তানিয়া তাই তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে, ম্যাডাম।

    কী?

    আমাদের কি খোরাসানী ম্যাডামকে খবর দেওয়া উচিত না?

    হোস্টেল সুপারের শুকনো চিমশে থাকা মুখ ভয়ে আরো চিমশে হয়ে উঠল, মেয়েদের মতো অন্য সবাই খোরাসানী ম্যাডামকে ভয় পায়। শুকনো গলায় বলল, খোরাসানী ম্যাডামকে কেন?

    নিতুকে তার ঘরে এনে ঘুম পাড়াতে হবে না?

    তাহলে?

    কুকুরটা যে সাথে আছে। অন্য কেউ কাছে গেলে যদি কামড়ে দেয়?

    ও।

    যদি কুকুরটা নিতুকে কামড়ে দেয়?

    ও। হোস্টেল সুপারকে খুব বিভ্রান্ত দেখাল বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, তাহলে খোরাসানী ম্যাডামকে ডাকা উচিত?

    রেবেকা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, ম্যাডাম। ভালোমন্দ যদি কিছু হয়—

    কিন্তু কিন্তু–

    কিন্তু কী?

    আমার মনে হয় জীনের আছর। হোস্টেল সুপার ফ্যাকাশে মুখে বিড় বিড় করে সূরা পড়তে থাকে। তারপর শুকনো মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, একা একা যাওয়া কী ঠিক হবে?

    জমিলার মাকে ডেকে আনি?

    সেইটা তো আর ভীতু।

    তাহলে।

    তো-তোরা গিয়ে ডাকতে পারবি না?

    সর্বনাশ! ওরা ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। না ম্যাডাম। খোরাসানী ম্যাডামকে আমরা খুব ভয় পাই।

    আ-আ-আমরাও কিছু একটা বলতে গিয়ে হোস্টেল সুপার থেমে গেল।

    আপনারাও ভয় পান?

    হোস্টেল সুপার কোনো কথা না বলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

    মাঝ রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা হোস্টেল সুপার এবং আরো কয়েকজনের কথাবার্তা শুনে ভয়ে ভয়ে আরো দু-একজন মেয়ে দরজা খুলে উঁকি দিল, তার মাঝে যাদের সাহস বেশি তারা কী হচ্ছে দেখার জন্যে বের হয়ে এল। সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখে স্কুলের মাঠে গভীর রাতে একটি মেয়ে হাঁটছে, তাড়াতাড়ি হাঁটা নয়, খুব ধীরে ধীরে হাঁটা, অনেকটা যেন স্বপ্নের একটা দৃশ্য। তাকে ঘিরে একটা কুকুর নেচে কুদে বেড়াচ্ছে কিন্তু সেই মেয়েটার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

    হোস্টেল সুপার শেষ পর্যন্ত জমিলার মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। জমিলার মা এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠা মেয়েগুলোকে নিয়ে একটা ছোট মিছিলের মতো সবাই খোরাসানী ম্যাডামের বাসার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সবার হাতেই কোনো না কোনো ধরনের লাঠি সোটা হঠাৎ করে কুকুরটা যদি তাদের দিকে তেড়ে আসে সে জন্যে। সবার সামনে জমিলার মা, তার হাতে একটা ছয় ব্যাটারির টর্চ লাইট। কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ছোট মিছিলটা খোরাসানী ম্যাডামের বাসার দিকে এগুতে থাকে। স্কুলের সীমানার একেবারে শেষ মাথায় তার ছোট একতালা বাসা। খোরাসানী ম্যাডাম একা সেই বাসায় থাকে, তার সাথে আর কেউ থাকতে পারে সেটা অবিশ্যি বিশ্বাস করার কথাও নয়।

    ঘরের দরজায় কয়েকবার শব্দ করার পর ভেতর থেকে একটা হুংকার শোমা গেল, কে?

    হোস্টেল সুপার চি চি করে বলল, আমি।

    ভেতর থেকে খোরাসানী ম্যাডাম ধমক দিয়ে বলল, আমি কে?

    হোস্টেল সুপার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট।

    এত রাত্রে কী ব্যাপার? বলে খুট করে দরজা খুলে গেল এবং তাকে দেখে সবগুলো মেয়ে একটা আর্ত চিৎকার করে পিছনে সারে এল। খোরাসানী ম্যাডাম একটা হাফপ্যান্ট এবং তার উপরে একটা টী-সার্ট পরে আছে, চুলগুলো উশখু খুশকু চোখ লাল দেখে মনে হয় পাগলা গারদ থেকে কোনো একটা জন্তু ছুটে এসেছে।

    খোরাসানী ম্যাডাম হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের সাথে এতগুলো মেয়েকে দেখে হকচকিয়ে গেল, তাদের সামনে এরকম পোশাকে চলে এসেছে বলে একটু অপ্রস্তুতও হল। কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম মেয়েদের মানুষ বলেই গণ্য করে না, কাজেই অপ্রস্তুত ভাবটা ঝেড়ে ফেলে গলা ফাটিয়ে ধমক দিয়ে বলল, কী হয়েছে?

    হোস্টেল সুপার থতমত খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, নতুন মেয়েটা কীভাবে কীভাবে জানি বের হয়ে গেছে।

    বের হয়ে গেছে? হ্যাঁ, স্লিপ ওয়াকিং।

    স্লিপ ওয়াকিং? খোরাসানী ম্যাডাম একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সকাল বেলা এসেমব্লিতে স্লিপ ওয়াকিংয়ের কথা শোনার পর সে একটু খোঁজ খবর নিয়েছে। শহরের একজন ডাক্তার বলেছে এই বয়সের ছেলে মেয়েদের মাঝে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ঘুমের মাঝে ওরা খুব বিচিত্র কাজ করে ফেলতে পারে। খোরাসানী ম্যাডাম অবিশ্যি ডাক্তারের সাথে পুরোপুরি একমত নয়—-তার ধারণা শক্ত পিটুনি দিয়ে এই ধরনের রোগ বালাই সারিয়ে তোলা সম্ভব। খোরাসানী ম্যাডাম একবার হোস্টেল সুপারের পিছনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, এই চামচিকাগুলো এখানে কী করছে?।

    হোস্টেল সুপার মিন মিন করে বলল, না মানে এত রাত তাই মানে ইয়ে–

    খোরাসানী ম্যাডাম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কোথায় আছে ঐ ধড়িবাজ আরশোলা? নেউলের বাচ্চা?

    মাডামের কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল টুক টুক করে পা ফেলে। ঘুমের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে নিতু এই দিকেই এগিয়ে আসছে। সবাই হঠাৎ করে একেবারে চুপ করে এক পাশে সরে গেল, শুধু খোরাসানী ম্যাডাম দুই হাত কোমরে রেখে যুদ্ধের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

    সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাঝে নিতু এগিয়ে আসছে। হাত দুটি সামনে তুলে ধরা, সেই হাতে লাঠির মতো কিছু একটা ধরে রেখেছে, আরো একটু কাছে এলে বোঝা গেল সেটা একটা খবরের কাগজ পাকিয়ে একটা লাঠির মলে করা হয়েছে। সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে খোরাসীন ম্যাডামের কুকুরটা, সেটা লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছে যেন খুব একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে।

    খোরাসানী ম্যাডাম আরো একটু এগিয়ে গেল। কোমরে হাত দিয়ে মাথাটা আরো একটু নিচু করে নিয়ে আসে যেন নিতুর মুখটা ভালো করে দেখতে পারে। নিতু ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে আরো একটু এগিয়ে এল, সবাই দেখতে পেল তার দুই চোখ বন্ধ। সে ঘুমের মাঝে হাঁটছে। নিতু হেঁটে হেঁটে খোরাসানী ম্যাডামের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর যে ব্যাপারটি ঘটল তার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। নিতু খবরের কাগজ পাকিয়ে তৈরি করা খাটো লাঠিটা দিয়ে চটাশ করে গায়ের জোরে খোরাসানী ম্যাডামের গালে মেরে বসল। ঘটনাটা ঘটল এত হঠাৎ করে যে কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সবাই একটা চিৎকার করতে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে থেমে যায়। নিতু তখন খবরের কাগজের পাকানো লাঠিটা হাতে নিয়ে খোরাসানী মাল্লামের অপর গালে মেরে বসল, এবারে আগের থেকেও জোরে। খোরাসানী ম্যাডাম কাক করে একটা শব্দ করে তাল হারিয়ে নিচে পড়ে যায়, তার চোখ বিস্ফোরিত সেখানে বিস্ময়, অবিশ্বাস এবং আতংক!

    নিতু হঠাৎ করে ঘুরে গেল, তারপর যেভাবে এসেছিল ঠিক সেইভাবে চোখ বন্ধ করে দুই হাত সামনে তুলে হেঁটে যেতে শুরু করে যেন কিছুই হয় নি। খোরাসানী ম্যাডামের কয়েক মুহূর্ত লাগল ব্যাপারটা বুঝতে, যখন বুঝতে পারল কী ঘটেছে তখন হঠাৎ আঁ আঁ করে শব্দ করে ওঠে দাঁত কিড় মিড় করে নিতুর দিকে ছুটে যেতে থাকে। ভয়ে আতংকে সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলল, এক্ষুনি শুনবে নিতুর আর্তনাদ এবং যখন চোখ খুলে তাকাবে দেখবে খোরাসানী ম্যাডাম টেনে নিতুর মাথা ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলেছে, ফিনকি দিয়ে নিতুর কাঁটা মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে সেই রক্তে খোরাসানী ম্যাড্রিম ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে!

    কিন্তু তার বদলে হঠাৎ সবাই শুনতে পেল কুকুরের গর্জন এবং তার পর হঠাৎ করে বিশাল কিছু যেন প্রচণ্ড শব্দ করে আছড়ে পড়ল। ভয়ে ভয়ে সবাই চোখ খুলে তাকাল এবং দেখল খোরাসানী ম্যাডাম মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, তার বুকের ওপর দুই পা তুলে কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলি দাঁত বের করে সেটা হিংস্র চোখে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আছে, তার ভাবভঙ্গিতে কোনো লুকাছাপা নেই। একটু নড়লেই সে খোরাসানী ম্যাডামের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে। নিতু তার নতুন মনিব তাকে সে যেভাবে পারবে সেভাবেই রক্ষা করবে।

    খোরাসানী ম্যাডাম হতভম্ব হয়ে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে শুয়ে রইল। সবাই দেখতে পেল এত হৈ চৈ গোলমালের মাঝেও নিতু এতটুকু বিচলিত না হয়ে সোজা হোস্টেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

    তানিয়া নিচু গলায় অন্যদেরকে বলল, চল, আমরা যাই।

    চল।

    মেয়েদের দল যখন নিতুর পিছু পিছু হোস্টেলে ফিরে যেতে শুরু করল তখন খোরাসানী ম্যাডাম চিঁ চিঁ করে বলল, এই কুত্তাটাকে কেউ সরাও না কেন?

    হোস্টেল সুপার তোতলাতে তোতলাতে বললেন, আ-আ-আপনার কুকুর। আপনি বললেই সরে যাবে নিশ্চয়ই।

    খোরাসানী ম্যাডাম মিন মিন করে বলল, এই সিংঘি, সর বলছি।

    কুকুরটা সরে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না বরং ধারালো দাঁত বের করে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে গর্জন করে এগিয়ে গেল, যতক্ষণ পর্যন্ত নিতু হোস্টেলে নিরাপদে ফিরে না যাচ্ছে সে তাকে নড়তে দেবে না!

    নিতু ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, পিছু পিছু অন্য সবাই। কিছুক্ষণের মাঝেই সরা হোস্টেল নীরব হয়ে পড়ে। তবে, কেউ যদি অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে শোনার চেষ্টা করত তাহলে আবিষ্কার করত দোতালার মাঝামাঝি দুইশ বারো নম্বর ঘর থেকে ছয়টি মেয়ে প্রাণপণে তাদের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করেও সুবিধে করতে পারছে না। একটু পরে পরে তাদের হাসির শব্দ বালিশ চাপা দেয়া সত্ত্বেও বের হয়ে আসছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবৃষ্টির ঠিকানা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article দীপু নাম্বার টু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }