তুমিই আমার লাকি চার্ম
আমি ওসব শুনতে চাই না ঠাম্মি, আমার পরীক্ষার সময় তুমি কেন কাকাই-এর বাড়ি যাবে? আরেক সপ্তাহ অ্যাটলিস্ট থেকে যাও৷ আমার উচচমাধ্যমিকটা শেষ হওয়া পর্যন্ত তো থাকো৷ প্লিজ ঠাম্মি৷ একমাত্র নাতনির বায়নায় চোখে জল এসে গিয়েছিল কমলা দেবীর৷ কি করে বোঝাবেন নাতনিকে যে তিনি নেহাতই নিরুপায়৷ ঐন্দ্রিলা নামটা কমলা দেবীরই দেওয়া৷ বড়ো বউমা অবশ্য তখন বলেছিল, কোনো ফিল্ম আর্টিস্টের নামে মেয়ের নাম রাখবে৷ তবে তার সে আশা পূরণ হয়নি৷ বার্থ সার্টিফিকেটে নাম লেখার সময় কমলা দেবীর বড়ো ছেলে ইন্দ্রনাথ মেয়ের আর কোনো নাম মনে করতে না পেরে বাধ্য হয়েই সেই মুহূর্তে ঐন্দ্রিলা নামটাই বলে বসেছিলো৷ তাই কমলাদেবীর নাতনির নাম ঐন্দ্রিলা বসু৷ নিজের দেওয়া নাম বলেই কিনা জানেন না কমলা দেবী জন্মের পর থেকেই ঐন্দ্রিলাকে বাড়ির নাম …রিনি বলে কমই ডেকেছেন৷ বেশির ভাগ সময়েই ঐন্দ্রিলা বলেই ডাকেন উনি৷ সেই ছোট্ট থেকেই ঠাম্মির প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ আছে ওর৷
সব বন্ধুদের ঠাম্মার মতো ওর ঠাম্মি একেবারেই সেকেলে নয়, বরং দারুণ আধুনিক৷ কমলা দেবী আই পি এল দেখেন,বই পড়েন৷ দাদু বিশ্বনাথ বসুর ছিল বদলির চাকরি, তাই বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে ঠাম্মি অন্য প্রদেশের রান্নাও শিখেছেন৷ ঐন্দ্রিলার সবচেয়ে ভালো লাগে ঠাম্মির হাতের ধোকলা৷
কমলা দেবী এই সত্তর বছর বয়সেও মেরুদন্ড সোজা করে হাঁটেন, লুটিয়ে শাড়ি পরেন, এক কোমর সাদা পাকা চুল, স্নানের পরে মুখে সুগন্ধী ক্রিম মাখেন৷ ঐন্দ্রিলার বন্ধুরা বাড়িতে এসেই ঠাম্মির সাথে গল্প জুড়ে দেয়৷ ঠাম্মির অভিজ্ঞতার ঝুলিও একটুখানি হালকা হয়৷ স্কুলের বান্ধবীরা ঐন্দ্রিলাকে ঘিরে ধরে বলেছিল,তুই কি লাকি রে, তোর ঠাম্মিটা বড্ড সুন্দর৷ স্কুল বেরোনোর আগে ঠাম্মির ফর্সা গালে চুমু খেয়ে তবেই ঐন্দ্রিলা বেরোয়৷ প্রতিদিন ঠাম্মি একই কথা বলেন, জীবনে সতর্ক থেকো, দেখো কেউ যেন ঠকিয়ে দিতে না পারে! সাধারণত বড়োরা আশীর্বাদ করেন, ভালো করে পড়াশোনা করো, বড়ো মানুষ হও এসব বলে৷ সেখানে ঠাম্মির আশীর্বাদটাও যেন ব্যতিক্রমী৷
এই স্বতন্ত্রা মহিলার চোখেও জল দেখেছিলো ঐন্দ্রিলা৷
ঠাম্মি তুমি কাঁদছো কেন? দাদুর জন্য?
ঐন্দ্রিলা যখন ক্লাস সিক্স তখন দাদু মারা গিয়েছিলেন৷ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ছিল,সময় পায়নি বাড়ির লোক৷ ঠাম্মি বলতেন, তোর দাদু বড়ো ভাগ্যবান,তাই সম্মান থাকতে থাকতে স্বর্গে পাড়ি জমালেন৷ আবার কখনো বলতেন, তোর দাদু বড়ো স্বার্থপর, সারাজীবন আমি তার পাশে ছিলাম, অথচ তিনি থাকলেন না আমার শেষ জীবনটায়৷
ঐন্দ্রিলা এখন বড়ো হয়েছে, বেশ কিছু জটিল শব্দের মানেও বুঝতে শিখেছে৷ তবে ঠাম্মির চোখের জলটা নীরবে কেন বেরোচ্ছে সেটাই বুঝতে পারে না ও৷ দাদুর জন্য? নাকি বাবা মায়ের এমন নির্লিপ্ত ব্যবহারের জন্য!
যদিও ঠাম্মি বলেছেন, দিদিভাই, তুই এখনো ছোটো, তাই সংসারের জটিল বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে বুদ্ধি নষ্ট করিস না৷ ঠাম্মির কথাগুলো বড্ড আপন মনে হয়, আর ঠাম্মির গায়ের ওই মিষ্টি ঠাম্মি ঠাম্মি গন্ধটা যেন নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শেখায়৷
বলো না ঠাম্মি, তুমি থাকবে আমার পরীক্ষার টাইমে?
ধুর পাগলি, আমার তোদের বাড়ি থাকার মেয়াদ যে শেষ রে! দু মাস শেষ৷ এবার তো তোর কাকাই এর বাড়ি জ্বালাতে যাবো৷ ঠাম্মির গলার অভিমানটা স্পষ্ট হল৷ ঐন্দ্রিলা বললো,বেশ আমি বরং মাকে বলবো,তোমাকে যেন আমার পরীক্ষা পর্যন্ত এখানেই রাখা হয়৷
কমলা দেবী জানালার বাইরে উদাস দৃষ্টি মেলে বললেন, দিদিভাই তুই কি চাস তোর ঠাম্মির সম্মানহানি হোক! সে কারোর কাছে ছোটো হয়ে যাক! ঐন্দ্রিলা মন খারাপ করে রুবিকে কল করলো, জানিস রুবি ঠাম্মি কালই কাকাই-এর বাড়ি চলে যাবে৷ আমার পরীক্ষার সময় ঠাম্মি থাকবে না৷ মাধ্যমিকের পুরো সময়টা ঠাম্মির মুখ দেখে আমি এক্সাম দিতে গিয়েছিলাম, তাই হয়তো অত ভালো রেজাল্ট হয়েছিল! এবার তো কেমিস্ট্রি নিয়ে এমনিতেই ঘেঁটে আছি, তারপর যদি ঠাম্মির মুখ না দেখে পরীক্ষা দিতে যাই তো জানিনা কি হবে!
রুবি একটু থেমে বললো, তুই বড়ো সেকেলে ঐন্দ্রিলা৷ আজকাল আর এসব পয়া অপয়া কেউ মানে রে? তুই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, এমনিতেই দুর্দান্ত রেজাল্ট আর জয়েন্টে চান্স পাবিই পাবি৷ এর জন্য কারোর মুখ দেখে যাবার দরকার নেই৷ ধুর! এদের কি করে বেস্ট ফ্রেন্ড বলবে ঐন্দ্রিলা! এরা কেউ ওর মনের অবস্থাটাই বুঝছে না৷ অপরাজিতা তো শুনে হেসেই খুন৷ শেষে বলল, এক কাজ কর, একটা টেস্ট হয়ে যাক৷ আমাদের ফেলুরাম অরিনটাকে গোটা পরীক্ষাটা তোর ঠাম্মির সামনে বসিয়ে দিয়ে দেখ, ব্যাটার ম্যাথে ফেল করা কেউ আটকাতে পারে কি না!
পড়ার মাঝেও বারবার উত্তরের ঘরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল ঐন্দ্রিলার৷ আজও ওই ঘরে লাইট জ্বলছে৷ ঠাম্মি বসে বসে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়ছেন৷ কাল থেকে ওই ঘরে আর লাইট জ্বলবে না৷ কাল সকালেই ঠাম্মি চলে যাবে কাকাই-এর বাড়ি৷ ইস! রকির এ কদিন খুব আনন্দ হবে৷ রকি ক্লাস ফাইভে পড়ে৷ ঐন্দ্রিলার খুড়তুতো ভাই৷ ঠাম্মা গেলে তার একটাই বায়না,যত রাজ্যের রূপকথার গল্প শোনা৷ ঠাম্মির ফেরার জন্য এখনও চারমাস অপেক্ষা করতে হবে ঐন্দ্রিলাকে৷ ওদের বাড়ি থেকে যাবে কাকাই-এর বাড়ি, সেখান থেকে আবার পিসিমনির বাড়িতে দু-মাস থেকে তারপর ফিরবে ঠাম্মি৷
মনটা ভীষণ খারাপ ঐন্দ্রিলার, তার মধ্যে সামনেই জীবনের একটা বড়ো পরীক্ষা৷
আজ বই পড়ায় মন নেই কমলাদেবীর৷ মনটাকে শত চেষ্টা করেও বাগে আনতে পারছেন না৷ পুরোনো সব স্মৃতিরা ভিড় করে আসছে দৃষ্টিপথে৷ মনে পড়ে যাচ্ছিল নিজের মা হবার কথা৷ চোখ বন্ধ করলে মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা৷ যখন ওষুধের ঘোরের মধ্যে হসপিটালের নার্স এসে বললেন,কমলা তোমার একটা ফর্সা ফর্সা ছেলে হয়েছে৷ প্রথমে খুব কান্না পেয়েছিল কমলার৷ ছেলে! ছেলে কেন! মেয়ে হোক এই কামনা করে দু-বেলা ষষ্ঠী ঠাকুরকে প্রণাম করেছিল সে৷
একটা ফুটফুটে মেয়ে, যে বুঝবে মেয়ে জন্মের কষ্টের কথা৷ তবে সন্তানকে কোলে নিয়ে সব ভুলেছিল কমলা৷ তখন ওই কাপড়ের পুটলির হাত-পা নাড়া দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল কমলার৷ অবাক হয়ে ভেবেছিল,এই নড়াচড়া করা পুতুলটা এতদিন তার পেটের মধ্যে ছিল? এই দুমদাম লাথি মারতো পেটের মধ্যে? নিজের মনেই হেসে উঠেছিল কমলা৷ কমলার স্বামী বিশ্বনাথ বাবু বলেছিলেন, ছেলের নাম দেব ইন্দ্রনাথ৷ আমার ছেলের আমার নামে মিলিয়ে নাম রাখবো৷ সকলের কাছেই শুনছিলো কমলা, বিশ্বনাথের ছেলে ইন্দ্রনাথ! কমলার গর্ভজাত খুব তাড়াতাড়ি পর হয়ে গিয়েছিলো৷ একেবারে শিশুবেলাটাই শুধু কাছে পেয়েছিলো ছেলেকে৷ তারপরেই ইন্দ্রনাথকে ভালো হোস্টেলে ভরতি করে দিয়েছিলো ওর বাবা৷ বদলির চাকরিতে ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলেই৷ না ক্ষতি কিছু কমলার হয়নি৷ একবছর অথবা দু-বছরের জন্য সংসার পেতেছিল কমলা নতুন নতুন ভাড়া বাড়ি অথবা কোয়াটারে৷ সেখানের আকাশ-বাতাস যখনই কমলাকে আপন করতে চেয়েছিলো তখনই কমলা তাদের ছেড়ে চলে এসেছে অন্য জায়গায়৷
ভাড়া বাড়ির উঠোনে বসানো পাতি লেবু গাছে যখনই সবে ফুল ধরেছে তখনই হয়তো বিশ্বনাথ এসে খবর দিয়েছে ব্যাগ গোছাও কমলা, এবার এদের ছাড়তে হবে৷ যাযাবরের জীবনে কোনো কিছুর প্রতিই মায়া বাড়ায়নি কমলা৷ নিজের হাতে বোনা উলের আসন বা বালিশের ঝারণগুলো গোছাতে গেলেও ইন্দ্রর বাবা বলেছেন, কি ছেলেমানুষি হচ্ছে কমলা! অকারণ লাগেজ ভারী করছো কেন?
নুন, চিনির বাহারি কৌটোগুলোও কখনো কখনো ফেলে আসতে হয়েছে পুরোনো ঠিকানায়৷ এর মধ্যেই কমলার গর্ভে দ্বিতীয় ভ্রূণের সঞ্চার হয়েছে৷ মনে মনে কল্পনা করেছে কমলা,একটা পুচকি মেয়ের টলমল পায়ের হাঁটার শব্দ৷ ইন্দ্র ছুটি ছাটায় বাড়ি এসেছে৷
বাবার সাথেই তার বেশি ভাব৷ হোস্টেলের টাকা পয়সা বাবাই দেয়,মা তো শুধু নাড়ু, মোয়ায় ব্যাগ ভরায়৷ তাছাড়া মায়ের বড্ড খারাপ স্বভাব,স্কুলের বন্ধু, যাদের সাথে ইন্দ্র মেলামেশা করে তাদের স্বভাব সম্পর্কে খুঁটিয়ে জানতে চায় মা৷ এতটা কৌতূহল বিরক্ত লাগে ইন্দ্রর৷ বাবা সে তুলনায় অনেক স্মার্ট৷ বাবার একটাই কথা, যে ভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ইন্দ্রকে৷ তার জন্য যে সব সময় সৎ পথ অবলম্বন করতে হবে এমন নয়৷ মায়ের বোকা বোকা সেন্টিমেন্ট …কাউকে কখনো ঠকাবি না ইন্দ্র, সেটা দ্বিগুন হয়ে তোর কাছেই ফিরে আসবে৷ এসব শুনলে মাথাটা গরম হয়ে যায় ওর৷ সিক্সের ছেলের যে সব কিছুই পার্সোনাল সেটা একটু একটু করে বুঝতে শিখেছিল কমলা৷ তাই তো একটা মেয়ে চেয়েছিল৷ যে বুঝবে কমলাকে৷ পুতুল খেলার সংসার ভেঙে গেলেও যে মনখারাপ হয়, এটা একমাত্র মেয়েরাই বোঝে৷
না, ইন্দ্রর বোন নয় ভাইই হলো৷ তাকেও বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছিল কমলা৷ ইন্দ্রর বাবা তারও নাম দিলেন অমরনাথ৷ কারণ দ্বিতীয় সন্তানের নামের শেষেও নাথ রাখতেই হবে৷ কমলার যাযাবর জীবনের সমাপ্তি তখনও ঘটলো না৷ ইন্দ্রর বাবা বলেছিলেন, বিদেশ বিভুঁয়ে কে তাকে রেঁধে খাওয়াবে! তাই কমলাকেও ঘুরতে হবে তার সাথে৷ ছেলেরা ছোট্ট থেকে থাকবে হোস্টেলে৷ কষ্ট হত কমলার৷ ছেলেদের আধো আধো গলার মা ডাক শুনতে না পেরে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠত কমলার৷ সেদিনও এমনি নিরুপায় ছিল কমলা৷
মা তোমার গোছগাছ কমপ্লিট? কাল সকালেই অমর গাড়ি পাঠাবে, রেডি থেকো৷ তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়েই আমি আর সোনালী একটু বেরোব৷ সোনালীর দাদার ছেলের সামনেই জন্মদিন৷ সোনার দোকানে যেতে হবে একবার৷
আজও ইন্দ্র মা বলেই ডাকে,কিন্তু এই ডাকে কেন যে কোনো প্রাণের টান খুঁজে পান না কমলা দেবী, কে জানে?
ইন্দ্র! সামনেই তো ঐন্দ্রিলার উচচ মাধ্যমিক, একটু দেখিস… মেয়েটা যেন মন খারাপ করে বসে না থাকে৷ পরীক্ষাটা যেন ভালো দেয়৷ ওদের কথার মাঝেই ইন্দ্রর বউ সোনালী বলে উঠলো,আমি ওর মা ,তাই ওর ভালো-খারাপটা আমি ভালোই বুঝি মামনি৷ প্লিজ,তুমি সব ব্যাপারে নাক গলিও না৷ তাছাড়া রিনি যথেষ্ট বড়ো হয়েছে৷ সেও জানে ঠাম্মা কারোর চিরকাল থাকে না৷ কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেলেন কমলা দেবী৷ হ্যাঁ, মৃত্যু উনিও চান৷ সকলের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার থেকে অসহ্য কষ্ট আর কিছুতেই নেই৷ তিনি বহুবার ছেলেমেয়েদের কাছে বলেছেন,তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে৷ কিন্তু তার সন্তানরা রাজি হয়নি৷ সমাজে ওদের একটা সম্মান আছে,একটা পজিশন আছে৷ লোকে যদি জানে যে তারা বয়স্ক মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে, তাহলে সমাজের চোখে ছোটো হয়ে যাবে৷ সেটা তাদের চাকরির জন্য ক্ষতিকারক হবে৷ অগত্যা ভাগের মা৷ তিন সন্তান দু-মাস করে এই ঝামেলা টেনেই চলেছে৷
সোনালী বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে.. যে তার মেয়ের ঠাম্মাকে খুব বেশি প্রয়োজন নেই৷ ইন্দ্র বলল, খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো৷ সকালবেলা গাড়ি এসে যাবে৷
সব সংসারেই কমলা দু-মাসের অতিথি৷ গৃহিণী হতে পারল না আজও৷ ইন্দ্রনাথ আর অমরনাথকে ভালো হোস্টেলে পড়াতে বেশ খরচ হচ্ছিল ওদের বাবার৷ তারপরেও দেবযানী এসেছিল কমলার কোল জুড়ে৷ মুখটা যেন কমলা বসানো, এমনকী গায়ের রংও কমলার মতোই দুধে আলতা৷ নামের শেষে নাথ রাখার দায় নেই বলেই মেয়ের নাম রাখার অধিকার পেয়েছিল কমলা৷ দেবযানী ছোট্ট থেকেই ভীষণ অভিমানী৷ দুই দাদার খুব আদরের৷ দুই দাদা যখন ছুটিতে বাড়ি ফিরতো তখন বোনকে নিয়ে তাদের আহ্লাদের শেষ ছিল না৷ দেখতে দেখতে দেবযানী বড়ো হয়ে উঠলো, কমলার ঝুলপিতে রূপালী রং ধরল৷ বিশ্বনাথ দেশে ফিরে একটা বাড়ি করবে স্থির করল৷
কমলাকে নির্দেশ দেওয়া হল, যতদিন না পর্যন্ত বিশ্বনাথের ট্রান্সফার হয় ততদিন পর্যন্ত নতুন বাড়ি তৈরির দেখাশোনা কমলাকেই করতে হবে৷
প্রথমে ঘরকুনো কমলার ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল৷ বাড়ি তৈরি দেখা তো পুরুষদের কাজ৷ ও কি পারবে? তারপরেই মনের মধ্যে তোলপাড় করে উঠেছিল, ভাড়া বাড়ি বা কোয়ার্টার নয়, নিজস্ব বাড়ি হবে ওদের৷ নিজের সংসার হবে৷ বাগানের এক চিলতে সবুজরা মালকিন বলে চিনবে কমলাকে৷ ছোট্ট দেবযানীকে কোলে নিয়ে একাই ভাড়া থাকছিল কমলা বিশ্বনাথের পছন্দের জায়গা রানাঘাটে৷ রানাঘাটেই তিনকাটা জায়গা সস্তায় পেয়ে কিনে রেখেছিল বিশ্বনাথ৷ সেই জায়গাতেই বাড়ি তুলবে মনস্থ করেছিল৷ কমলার পছন্দ মতো রান্না ঘর, শোবার ঘর ….বাড়ির রংও কমলার পছন্দ মতো৷ এই প্রথম কমলার ইচ্ছে অনুযায়ী এত কিছু হয়েছিল৷ তবে কি সংসারে কমলার মূল্য বাড়ল?
শুধু বাড়ি রেজিস্ট্রির দিন কমলা জানতে পারল, বাড়ি তৈরি হল বিশ্বনাথ বসুর নামে৷ আর নোমিনি রইলো বিশ্বনাথ বাবুর তিন ছেলে মেয়ে! কমলার রাগ বা দুঃখ কিছুই হয়নি৷ বারবার মনে হয়েছে এরা তো তারই শরীরের অংশ৷ তারই রক্ত মাংসে গড়া৷
এদের বাড়ি মানেই নিজের বাড়ি৷ কমলার আজও মনে আছে ইন্দ্রর বাবা যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল সেদিন চমকে গিয়েছিল৷ কমলা যে দোতলা বাড়ি এমন সুন্দর ভাবে দাঁড় করাতে পেরেছে সেটা দেখেই অবাক হয়েছিল মানুষটা৷ চিরটা কাল তার নির্দেশে চলা নেহাতই ছাপোষা কমলাও তাহলে কিছু পারে!
ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে করতেই,তাদের স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করতে করতেই কেটে গেছে কমলার জীবন৷ এতকাল বিশ্বনাথ বসুর স্ত্রীর পরিচয়ে বেঁচেছিলো, এখন বাঁচে ইন্দ্রনাথ, অমরনাথ-এর মা হয়ে৷ তবে সব থেকে বড়ো ধাক্কাটা কমলা পেয়েছিল আদরের মেয়ে দেবযানীর কাছ থেকে৷
দেবযানী ক্লাস টেনে পড়ার সময় একটা মোটর গ্যারেজের বিবাহিত কর্মচারীর প্রেমে পড়ে যায়৷ কমলা যতবার মেয়েকে শাসন করতে গেছে ততবারই দেবযানী বাবাকে বলেছে, মা নাকি তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে৷ ইন্দ্রর বাবাও একমাত্র মেয়ের আব্দারে অন্ধ হয়ে গিয়ে কমলাকেই ভুল বুঝেছিলো বারংবার৷
দেবযানী কোনোদিন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মায়ের সম্মুখীন হত না৷ মায়ের মুখ দেখে বাড়ি থেকে বেরোলে নাকি তার সব কাজে বাধা পরে৷ গোপনে চোখের জলকে সঙ্গী করে জীবন কাটাচ্ছিলো কমলা৷ ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল সব কিছু৷ হঠাৎই ইন্দ্রর বাবার খেয়াল হলো মেয়ের ভাবগতি ভালো নয়৷ রিটায়ারের বছর দুয়েক আগেই মেয়ের উচচমাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখে আশা ছেড়ে দিয়ে বিয়ের পাত্র খুঁজতে লাগলো৷
দেবযানীর বিয়ে হয়ে গেল৷ ছেলেটি বড়ো ভালো৷ দেবযানীর পাশে মানিয়েছিলো ভালো৷ কমলার কনকাঞ্জলি নেওয়া ছাড়া কাজ বিশেষ ছিল না বললেই চলে৷
মেয়েকে মানুষ করার আশায় জলাঞ্জলি দিয়েছিল অনেক দিনই৷ চাকরি থেকে রিটায়ার করে আসার পরে বিশ্বনাথ বাবু উঠে পড়ে লাগলেন ছেলেদের চাকরির জন্য৷ দুই ছেলেই পড়াশোনায় ভালো ছিলো, চাকরি পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না৷
ছেলেদের বিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের সংসার গোছানো সবেতেই কমলা ছিল … ছিল আবার ছিল না৷ আসলে ওর ভূমিকাটা অনেকটা অণুঘটকের মতো৷ হয়তো থাকলে ঘটনাটা একটু ত্বরান্বিত হয়, আবার না থাকলেও চলে যায়৷
কমলার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা ছিল ইন্দ্রর মেয়ে হওয়া৷ নাতনির মুখ দেখে খুশি হয়ে কমলা বলেছিল, ইন্দ্র আমার একটা কথা রাখবি, মেয়েটার নাম ঐন্দ্রিলা দিবি?
মায়ের কথার গুরুত্ব কোনো দিনই সংসারে ছিল না৷ তবুও কি মনে করে যেন ইন্দ্রনাথ মেয়ের নাম রেখেছিল ঐন্দ্রিলা৷ মেয়েটা ছোট্ট থেকেই ঠাম্মিকে বড্ড ভালোবাসে৷ মা বাবা দুজনেই চাকরিক্ষেত্রে বেরিয়ে গেলে ঠাম্মাই ছিল ওর একমাত্র সঙ্গী৷ তারপরেই কমলার জীবনে নেমে এসেছিল আরেক কালবৈশাখী৷ মাথার ওপর থেকে নামমাত্র ছাদটাও ভেঙে গিয়েছিল৷ বিশ্বনাথ বসু মারা গিয়েছিলেন কার্ডিও অ্যারেস্টে৷ কমলা হয়েছিল ভাগের মা৷ বাবার টাকা যেহেতু তিন ভাই বোনে ভাগ করে নিয়েছিল, তাই কমলা দেবীকেও বছরের চারমাস জামাই বাড়িতে কাটাতে হয়৷ নিজের মেয়ের মুখে শুনতে হয়,কপাল করেছি বটে… বিয়ের পরেও শান্তি নেই৷ মাকে এনে রাখতে হয়৷ কমলা দেবী শুধু শোনেন৷ ধৈর্যের পরীক্ষায় উনি বহুদিন আগেই ফুলমার্কস পেয়েছেন৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করা বাড়ি ছেলে মেয়েরা মিলে বিক্রি করে দিয়েছে, উনি দেখেছেন৷ ওনার নিজের হাতে তৈরি বাগান ঝোপ ঝাড় হয়ে গেছে, সেটাও উনি তাকিয়ে দেখেছেন৷
খুব ইচ্ছে ছিল নাতনির পরীক্ষাটা কাটিয়ে তবে ছোটো ছেলের বাড়ি যাবেন৷ মেয়েটা মুখটা করুণ করে বলছিলো, ঠাম্মি আমার এক্সামটা প্লিজ থাকো৷ কিন্তু গত পরশুই বড়ো বউমা আর বড়ো ছেলের আলোচনাটা কানে এসেছিল৷ ইন্দ্র আর সোনালী বলছিলো, আর তো মাত্র দুটো দিন! তারপরেই …
ওদের মুক্তির নিঃশ্বাসটা সজোরে কানে এসে ধাক্কা দিয়েছিলো কমলাদেবীর৷
বুকের ভিতরটা মোচড় দিচ্ছিল ঐন্দ্রিলার করুণ আর্তি শুনে৷ ঠাম্মি প্লিজ থাকো! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় মাঝে মাঝে৷
চুপি চুপি নাতনির ঘরে ঢুকলেন কমলা দেবী৷ ঐন্দ্রিলা খাতায় লিখছিল৷ ঠাম্মিকে দেখেই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল৷ মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললেন কমলা দেবী৷ তারপর ঐন্দ্রিলার দুই গালে চুমু খেয়ে বললেন, তোর পিসিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম,পূরণ হয়নি৷ তোকে নিয়ে আবার স্বপ্ন দেখছি৷ আমার রক্তের একটা মেয়ে অন্তত স্বাধীন ভাবে ডানা মেলুক নীলাকাশে৷
কালো পেড়ে সাদা শাড়ির মহিলাটি ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন৷ ঐন্দ্রিলার দু-চোখ ছাপিয়ে জল এলো সেদিকে তাকিয়ে৷
সকাল হতেই হাসি মুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছোটো ছেলের পাঠানো গাড়িতে উঠে বসলেন কমলা দেবী৷ ঐন্দ্রিলাই শুধু ঠাম্মির যাওয়ার আগে ঘরে খিল দিয়ে বসে রইলো৷ বড়ো বউমা বললো, তুমি এসো মামনি, ওর পরীক্ষা তাই সময় নষ্ট করতে চাইছে না৷
কমলার এবাড়িতে নির্ধারিত সময় শেষ, তাই একদিনও বাড়াতে চায় না সোনালী৷
ঠিক ভাবে পৌঁছে ফোন করে দিও একটা৷ ইন্দ্র দায়িত্ব শেষ করলো৷
রবিবার অমরের ছুটি৷ কমলা দেবী ঢুকলেন ছেলের ঘরে৷ একমনে ল্যাপটপে কাজ করছিলো অমর৷ চোখ তুলে তাকিয়ে আলতো করে বললো, ভালো আছো তো?
কমলা দেবী সামলে নিলেন৷ বললেন, না, একবার মা বলে ডাক অমর, বহুদিন তোর মুখে মা ডাক শুনিনি৷
আস্তে করে ঘাড় নেড়ে বললেন ,ভালো আছি রে৷ তোর মুখটা শুকনো লাগছে কেন?
অমর একটু ক্লান্ত হেসে বললো, কাজের চাপ৷ কথা শেষ মা ছেলের মধ্যে৷ এই অমরই ছুটির দিনে মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরতো৷ মা তারপর পেত্নিটা কি বট গাছেই থেকে গেল! বলো না মা! বলে বলে অস্থির করে দিত ছুটির সকালগুলো৷
বেশ কিছুক্ষণ বোকার মতো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলার মতো কথা খুঁজে না পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কমলা দেবী৷
মন মরা হয়েই পরীক্ষা দিতে বেরোলো ঐন্দ্রিলা৷ সোনালী বিরক্ত মুখে বললো, মনে রেখো এই রেজাল্টের ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করে আছে৷ নিজের ফিউচারের কথাটা ভেবো৷ একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধার জন্য নিজের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো নিশ্চয় জলাঞ্জলি দেবে না ?
ঐন্দ্রিলা রাগী মুখে বললো, ঠাম্মি আর এক সপ্তাহ এখানে থাকলে কি তোমাদের খুব বড়ো ক্ষতি হয়ে যেত?
ইন্দ্র মেয়ের দিকে একনজর তাকিয়ে বললো, তোমার পিসিমনি আজও বিশ্বাস করে তোমার ঠাম্মা তার জন্য অপয়া৷ তোমার মাও কিন্তু পিসিমনির কথার সত্যতা যাচাই করে দেখেছে৷ দেবযানী খুব একটা মিথ্যে বলে না৷
ঐন্দ্রিলার কষ্ট হচ্ছে…কি করে বোঝাবে এদেরকে যে ঠাম্মি ওর লাকি চার্ম৷ গতবার আবৃত্তিতে ডিস্ট্রিক্টে ফার্স্ট হওয়ার পিছনে কারণ ছিল শুধু ঠাম্মিকে দেখে বাড়ি থেকে বেরোনো৷ এর আগে প্রতিবার জেলায় সেকেন্ড হয়ে রাজ্যস্তরে যেতে পারেনি ঐন্দ্রিলা৷ ট্যালেন্ট হান্ট কম্পিটিশনের দিনও বেরোনোর আগে ঠাম্মি জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলো, সেই জন্যই ঐন্দ্রিলা গোল্ড মেডেল জিততে পেরেছিল৷ মা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না৷ আজও বারবার মনে হচ্ছে প্রথম পরীক্ষাটাই খারাপ হবে ওর৷
বাবা মা দুজনেই অফিস চলে গেল হলের সামনে থেকেই৷ মা যাওয়ার সময় বলে গেল,কুসংস্কারে বিশ্বাস করো না৷ ঐন্দ্রিলা খাতায় চোখ বোলাচ্ছিলো৷ মনে পড়ে যাচ্ছিল ঠাম্মির কথাগুলো৷ পারবি না তুই? পারবি না আমার স্বপ্ন পূরণ করতে?
সন্ধ্যেবেলা মা জিজ্ঞেস করল, পরীক্ষা কেমন হলো রিনি?
রিনি এক মুখ হেসে বললো, দুর্দান্ত মা৷
বলেছিলাম না,নিজের মনের জোরটাই আসল৷ ওই সত্তর বছরের মহিলা তোমার ট্যালেন্ট বাড়াতে বা কমাতে পারবেন না৷ এটা মাথায় রেখো৷
বাবা সিমলা যাওয়ার টিকিট কেটে রেখেছে৷ রিনির পরীক্ষাটা শেষ হবার অপেক্ষা৷ আগামী কালই রিনির লাস্ট পরীক্ষা৷ এটা হয়ে গেলেই আপাতত ছুটি৷
রিনি শেষ পরীক্ষা দিয়ে বেরোনোর পরেই খবরটা পেলো ইন্দ্র৷ মাকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শব্দটাই মাথায় ঢুকতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো ইন্দ্রর৷ সত্তর-বাহাত্তরের মহিলা তো আর বাড়ি থেকে পালাতে পারে না! তাহলে গেল কোথায়?
অমরদের বাড়ির কাজের লোকটা নাকি বলেছে,বাড়ির সবাই বেরিয়ে গেলেই ঠাকুমা ভালো শাড়ি পরে কোথায় চলে যেত৷ ঘন্টা দুয়েক পরে আবার ফিরে আসত৷ মেয়েটা জিজ্ঞেস করতে গেলে ঠাকুমা নাকি বলেছে,বলবে না কোথায় গিয়েছিল৷ আর যদি কাউকে বলে, তাহলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে৷ তাই মেয়েটাও কাউকে কিছু বলেনি৷
আবার ফোনটা বাজছে ইন্দ্রনাথের৷ আননোন নাম্বার৷
রিসিভ করতেই একজন মহিলা বললেন,আমি অঙ্কুর নার্সিংহোম থেকে বলছি৷
কমলা বসু আমাদের নার্সিংহোমে রয়েছেন৷
কোনো দিকে না তাকিয়ে ইন্দ্র আর অমর গিয়ে পৌঁছালো অঙ্কুর নার্সিংহোমে৷ খবর পেয়ে দেবযানী, সোনালী,ঐন্দ্রিলাও এসে গেছে৷ বুকের কাছের শাড়িতে রক্তের ছোপ৷ মাথায় ব্যান্ডেজ৷ কমলা দেবী নির্লিপ্ত মুখে শুয়ে আছেন বেডে৷
অমর ঢুকেই হম্বিতম্বি শুরু করলো৷ হঠাৎ এসব কি শুরু করেছো? আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না তুমি?
একা একা কোথায় গিয়েছিলে তুমি? প্রশ্নের ঝাঁক ছুটে এলো কমলা দেবীর দিকে৷ উনি নির্বাক৷ জীবনে অনেক সহ্য করেছেন, আজও নাহয় দুটো কটু কথা শুনলেন!
হঠাৎই কোথাও কিছু নেই ঐন্দ্রিলা কেঁদে উঠলো৷ কাঁদো কাঁদো মুখেই বললো, ঠাম্মিকে বোকো না কেউ৷ ঠাম্মি আমার বায়নার জন্যই আমার কাছে এসেছিলো৷ ওখান থেকে ফেরার সময়েই হয়তো…
ঠাম্মি গেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতো, তোমরা চলে যাবার পরেই ঠাম্মি আসতো আমার সাথে দেখা করার জন্য৷ কারণ আমিই বলেছিলাম,ঠাম্মির মুখটা না দেখলে আমার এক্সাম ভালো হবে না৷ তাই…
সকলের উৎসুক চোখ কমলা দেবীর ওপর স্থির৷
কমলা দেবী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলেন৷ তারপর বললেন,দেবযানীর কাছে আমার মুখটা ছিল অপয়া৷ ওর কোনো কাজই নাকি ভালো হতো না আমাকে দেখে বাইরে বেরোলো৷ অথচ ঐন্দ্রিলা বলে, আমি নাকি ওর লাকি চার্ম! ওর নাকি এক্সাম খারাপ হবে আমায় না দেখলে৷ জীবনের শেষ খেয়া পাড়ি দেবার আগে বুঝে নিতে চাইছিলাম সত্যিই আমি লাকি কিনা! ঐন্দ্রিলা বললো, ঠাম্মি তুমি সত্যিই ভীষণ পয়া, কেন জানো? কারণ অন্তর থেকে যদি কেউ কারোর জন্য মঙ্গল কামনা করে সে কখনো অপয়া হতে পারে না৷
কমলা দেবী বললেন, তোমরা চিন্তা করো না, আমার বিশেষ কিছু লাগেনি৷ ট্যাক্সি থেকে নামতেই একটা রিকশা এসে ধাক্কা মারল, তাই পড়ে গিয়ে…
আসলে শেষ বয়সে এসে নিজের নামের পাশ থেকে অপয়া শব্দটা সরিয়ে দিদিভাই-এর লাকি চার্ম শব্দের প্রতি তীব্র লোভ জন্মেছিল৷ তাই দিদিভাই-এর এক্সাম হলের সামনে যেতাম ওকে দেখা দেব বলে৷
দেবযানীর মাথা নীচু৷ ইন্দ্রর মুখে অস্বস্তি৷ অমর মায়ের চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে৷ কি করে বলবে অমর, যে গত দু-বছর ধরে আটকে থাকা প্রোমোশনের খবরটা ও পেয়েছে গত কালের মেইলে৷ ঠিক মা বাড়িতে ঢোকার আধঘণ্টা পরেই৷
সোনালী মুখটা নীচু করেই ভাবছিলো, গতকাল মা চলে আসার পরই ওদের রান্নাঘরে একটা বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল৷ ওর ওড়নাটায় আগুন লেগে গিয়েছিলো৷ কোনো মতে বেঁচে গেছে বিপদ থেকে৷ তবে কি রিনির কথাই ঠিক!
দেবযানীর প্রেম পর্বে যতবার মায়ের মুখটা দেখে বেরিয়েছিলো ততবারই ঝগড়া হয়েছিলো অভয়ের সাথে৷ ঝগড়া হতে হতে ওদের সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিলো একসময়৷ দেবযানী দায়ী করেছিলো মায়ের অপয়া মুখটাকে৷ এক মাস আগেই দেবযানী খবর পেয়েছিলো, কালীমাতা গ্যারেজের কর্মচারী অভয় বেরা চোরাচালান কাজের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছে৷ সেদিনই দেবযানীর মনে হয়েছিলো ভাগ্যিস অভয়ের সাথে ওর সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিলো!
ভাগ্যিস ও মায়ের মুখটা দেখে বেরিয়েছিলো! ঐন্দ্রিলা ঠাম্মির গালে গাল ঘষে বললো, তুমি দেখো ঠাম্মি তোমার স্বপ্ন পূরণ হবেই৷ আমি ভালো রেজাল্ট করবোই৷ কমলা দেবীর চোখে আগেও বহু নোনতা জলের ধারা নেমেছে, তবে আজকে তার দু-চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু৷ ঐন্দ্রিলা ঠাম্মির গালে চুমু খেয়ে বললো, তুমিই আমার লাকি চার্ম৷