স্বপ্ন স্বপ্ন সত্যি
ও ম্যাডাম দাঁড়ান দাঁড়ান ..ম্যাডাম…
বাপরে এতো দেখছি পি টি ঊষার বোন৷ এত ছুটেও কিছুতেই মেয়েটাকে ধরতে পারলো না সাগ্নিক৷ বেশ হাঁপাচ্ছে৷ ফা;নের অল্প উষ্ণতাতেও টিশার্টটা ভিজে গেছে৷ বহুদিন পরে এতটা রাস্তা ছুটলো ও৷ এখন দিকভ্রান্তের মতো লাগছে৷ বাস থেকে নেমে অচেনা জায়গায় এতটা ছুটেছে৷ সন্ধ্যের অন্ধকারে কোনদিকে যেতে হবে তালগোল পাকিয়ে গেছে ওর৷ এই জন্যই বলে লোকের ভালো করতে গেছো তো মরেছ! এখন এই অচেনা জায়গায় বাস কখন পাবে কে জানে? কি মরতে যে ছোটো পিসিকে দেখতে এসেছিলো কে জানে৷ আর ভিড়ের চোটে কেন যে ওই ফাঁকা লেডিস সিটে নিজের পশ্চাৎদেশের আরাম খুঁজেছিলো তাও জানে না ও৷
এই আরামবাগের দিকে সাগ্নিক এসেছিল সেই বছর দশেক আগে মায়ের সাথে৷ হঠাৎই ছোটো পিসি বাথরুমে পরে গিয়ে হাত ভেঙেছে, শুয়ে শুয়ে তার নাকি একমাত্র ভাইপো সাগ্নিককেই দেখতে ইচ্ছে করছে৷ আর যায় কোথায়! বাবা, মা, ঠাম্মা সকলে মিলে সাগ্নিককে ধরে বেঁধে রবিবারের ছুটির ঘুমটার চোদ্দো বাজিয়ে পাঠিয়ে দিলো ছোটো পিসিকে দেখতে৷ সাগ্নিক বলেছিলো, হোয়াটস আপে ভিডিও কল করে নেবে৷ তাই শুনে বাবা তো পারলে কানের পাশে সেই ছোটোবেলার মতো একটা থাপ্পড়ই মেরে বসতো৷ নেহাত এই বেকারত্বের যুগে সাগ্নিক কপাল করে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলেছিলো তাই একটু সম্মান করেই হয়তো বাবা শুধু বকুনির ওপর দিয়েই গেল৷ বললো,তা আজ এক কাজ করো সানুর মা, ওকে বরং পাঁঠার মাংসের বাটিটা দেখিয়েই সরিয়ে নিও৷ দর্শনেই অর্ধেক ভোজন হয়ে যাবে৷ হোয়াটস আপে ভিডিও কলিঙের মতো৷ বাবার এই এক দোষ! বরাবর সাগ্নিকের দুর্বলতম জায়গা মাংসের বাটি নিয়ে খোঁটা দেওয়া৷
অগত্যা, সাগ্নিক ঠাম্মার দেওয়া বড়ি, মায়ের করে দেওয়া গাজরের হালুয়া নিয়ে সকাল সকাল কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিলো আরামবাগের উদ্দ্যেশে৷ আসার সময় বেশ ভালোই এলো৷ ছোটো পিসির হাত ভেঙে গেলেও গলার জোরে আর ওদের বাড়ির রান্নার মাসির যত্নে সাগ্নিকের দুপুরের ভোজনটা নেহাত মন্দ হয়নি৷ তারপর বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষার্থে যেমনি বিছানা ছুঁয়েছে … দু-চোখ বেইমানি করায় দুপুরের ট্রেনটা মিস হয়েছে৷ ছুটির দিনেও বিকেলের দিকে বাসে এত ভিড় কেন থাকে কে জানে? সারাসপ্তাহ ছুটোছুটি করেও যে এই একদিন বেড়াতে যেতে কি করে মন হয় মানুষের তা সাগ্নিক বোঝে না৷ মনটা উচাটন হয়ে আছে৷ আই পি এলের ক্রিকেট ম্যাচটা গেল৷ এদিকে নেটওয়ার্কের যা অবস্থা তাতে খেলা দেখা সম্ভব নয়৷ তারপর ভিড় বাসে বাঁদর ঝোলা হতে হতে হঠাৎই একটা সিট ফাঁকা পেয়ে নিশ্চিন্তে বসেছিলো৷ পরে খেয়াল করেছিলো ওটা লেডিস সিট৷ রণ রঙ্গিনী মূর্তিতে কেউ এসে তখনো বলেনি, অন্ধ নাকি? জানেন না এটা লেডিস সিট?
তাই পাশের মেয়েটার থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বাঁচিয়ে বসেই ছিলো সাগ্নিক৷
মেয়েটা বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিলো৷ বারবার নিজের আঙুলের পার্পেল কালারের নেলপলিশটা অন্য হাতের নখ দিয়ে খুঁটছিলো৷ নিখুঁত করে লাগানো নেলপলিশ যখন কোনো মেয়ে নিজের হাতে তুলে দেয়, তখন সে যে কতটা আনমনে আছে সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷ না, মেয়ে দেখার বদনাম সাগ্নিকের নামে নেই৷ আঠাশ বছর বয়েসেও একটাও প্রেম করে উঠতে পারেনি ও৷ দু এক জায়গায় ঝাড়ি মারতে গিয়ে মার খেতে খেতে বেঁচে গিয়ে পালিয়ে এসেছিল সেই কলেজ লাইফে, তারপর থেকে আড়চোখে সুন্দরী দেখা ছাড়া আর কোনো দোষ ওর নেই৷ এই মেয়েটিকেও সাগ্নিক দেখতো না, একে তো লেডিস সিটে বসে থাকতেই হাঁটু কাঁপছিলো৷ ইদানিং অবলা নারী জাতির মায়ার ওপরে আর ভরসা না করাই ভালো৷ তায় আবার পাশের মেয়ের দিকে তাকাতে গিয়ে বাঁশ খাওয়ার কোনো রকম ইচ্ছে ওর ছিলো না৷ কিন্তু ওই যে, ফাগুন মাসের মনে আবির রঙের প্রভাবেই হয়তো মেয়েটার বারবার লাভস লকস সরানোটা দেখতে গিয়েই চোখ চলে গেল ওর সুন্দর চোখের দিকে৷ চোখ দুটো সুন্দর হলেও কাজলটা ঘেঁটে গেছে৷ চোখ দুটোও বেশ লাল৷ বোধহয় কেঁদেছে৷ হয়তো ব্রেকআপ হয়েছে৷ এই বজ্জাত ছেলেগুলোর জন্যই সাগ্নিকদের মতো নিপাট ভালো মানুষদেরও মেয়েরা লাদেন মনে করে৷ এই যে মেয়েটা কাঁদছে, নিখুঁত পার্পেল নেলপলিশ নষ্ট করছে, চোখের কাজল ঘেঁটে ফেলছে… এরপরেও কি আর কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করা এর পক্ষে সম্ভব?
হঠাৎই মেয়েটি সাগ্নিকের হাঁটুতে গুঁতো মেরে, ভিড় ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বাস থেকে নেমে পড়লো৷ পাশে পড়ে রইলো নেলপলিশের থেকে আরেকটু হালকা পার্পেল কালারের ভ্যানিটি ব্যাগটা৷ সাগ্নিক খেয়াল করলো কুর্তিটাও পার্পেল ছিলো৷ পুরো ম্যাচিং৷ যা! এখন কি হবে! তখনও বাসের ক্লিনার চেঁচিয়ে যাচ্ছে, আস্তে লেডিস… বাচচা কোলে৷ সাগ্নিক লোকের পা থেঁতলে, পিঠে কুনুয়ের গুঁতো মেরে কোনো মতে দরজার কাছে পৌঁছে বললো, আমি নামবো৷ দুটো কাঁচা কাঁচা গলার মধ্যে আটকে রেখেই ক্লিনার বললো, এতক্ষন কি ঘুমুচ্ছিলেন?
যাই বলুক, ট্রেনের সাথে বাসের এটাই তফাৎ৷ বাস হলো মায়ের মতো৷ যতই বকুক, কোলে বসিয়ে খাইয়ে তবে তার শান্তি৷ বন্ধ গেট আবার খুলে সাগ্নিককে নামিয়ে দিলো ক্লিনার৷ এই যদি ট্রেন হতো, তো বাবার মতোই বলতো, একবেলা উপোষ করলে কেউ মরে যায় না৷ তাই ওকে পরের স্টপেজেই নামতে হতো৷
যাইহোক পিঠে নিজের ব্যাগ, কাঁধে লেডিজ ব্যাগ নিয়েই ছুটছিলো সাগ্নিক৷ বাংলার সেরা সেরা মনীষীদের পরোপকারী মানসিকতার কথা মনে পড়ছিলো ওর৷ রামমোহন রায় মেয়েদের জন্য সতীদাহ বন্ধ করতে পারলেন, আর ও সামান্য ব্যাগটা পৌঁছে দিতে পারবে না? মেয়েটাকে দু-বার ম্যাডাম ম্যাডাম বলে ডাকতেই, মেয়েটা জোরে ছুটলো৷ কিছুতেই ধরতে পারলো না সাগ্নিক৷ তার বদলে এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বোকার মতো এদিক ওদিক যানবাহন খুঁজে চলেছে ও৷ আচ্ছা মেয়েটা কি ভোজবাজির মতো উবে গেল নাকি? নাকি কোনো গলিঘুঁজিতে ঢুকে পড়লো? এখানের কোনো চায়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে হয়, এখান থেকে কলকাতা যাবার সহজ রুট কি আছে? চায়ের দোকানি বললেন, আপনি তো ভুল করেছেন… ট্রেনে গেলে অনেক সোজা হতো৷ বাস ধরতে গেলেন কেন? এটা কাপসিট গ্রাম৷ আপনি এক কাজ করুন, এখান থেকে বাস ধরে… কথা শেষের আগেই বেশ কিছু লোকজন জুটিয়ে বাসের মেয়েটিই এগিয়ে আসছে এদিকে৷ মেয়েটির হাঁটার ধরনে মোটেই আর সেই কষ্ট কষ্ট মুখ নেই৷ রীতিমতো প্রতিবাদী ভাবমূর্তি ফুটে উঠেছে৷ সাগ্নিকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, ওই দেখুন… ওই যে ওই লোকটা.. সেই বাস থেকে আমার পিছু নিয়েছে৷
জনা দশেকের নারী সম্মান উদ্ধারকারীর দলটার মধ্যে সবচেয়ে লম্বা একটু দাদা টাইপ লোকটা এসে সাগ্নিককে ভস্ম করে দেবার মতো তাকিয়ে বললো, কে বে! আমাদের গ্রামে এসে আমাদের ঘরের বোন মেয়েকে লাইন মারছিস? শালা ক্যালানি খাসনি কখনো!
বেগতিক দেখে সাগ্নিক মেয়েটার ব্যাগটা উঁচু করে ধরে বললো, এটা বাসে পড়েছিল… আমি এটা দিতেই…
প্রতিবাদী নারীর এতক্ষণে খেয়াল হয়েছে যে তার কাঁধে ব্যাগ নেই৷ বেশ নেত্রীর ঢংয়েই বললো, বিশুদা ছেড়ে দাও, ভদ্রলোক বোধহয় ব্যাগটা দেওয়ার জন্যই আমার পিছু নিয়েছিলেন৷
বাওয়াল বন্ধ হয়ে গেলে কিছু মানুষ খুব আপসেট হয়ে যায়৷ এদের মুখ গুলোও প্রদীপ নিভে যাওয়া সলতের মতো হয়ে গেল৷ বিশুদা বললো, তোরা যে কি করিস না নীরা! খামোকা আমাদের তাসের আড্ডাটা ভেস্তে গেল৷ ভিড় পাতলা হয়ে গেছে৷ শুধু ছেলেটা মেয়েটাকে কিভাবে ব্যাগ ফেরত দেবে এটা দেখার জন্যই কয়েকটা ওই উৎসাহী কৌতূহলী চোখ আড়চোখে তাকাচ্ছে৷
নীরা নামক মেয়েটির মুখে সংকোচ, চোখে অপরাধীর দৃষ্টি৷ সাগ্নিক ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললো, আসলে আপনি নামার পরেই খেয়াল করলাম ব্যাগটা পড়েছিলো, তাই…
মেয়েটি বললো, সরি, এক্সট্রিমলি সরি৷ আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা মুশকিল, তাই বুঝতে না পেরে আপনাকে হ্যারাজ করতে যাচ্ছিলাম৷ সাগ্নিক মনে মনে ভাবলো, বিশু বাহিনী যদি মারতে শুরু করতো তাহলে এতক্ষণে ওর পিঠের চামড়া গুটিয়ে যেত৷ তাই আপাতত সুরেলা কণ্ঠের সরিতে খুব বেশি বিগলিত হলো না ওর মন৷ মেয়েটি অপ্রস্তুত গলায় বললো, আপনাকে তো এ চত্বরে দেখিনি৷ নতুন বুঝি?
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সাগ্নিক বললো, আমার বাড়ি কলকাতা৷ এসেছিলাম আরামবাগের কাছে, পিসির বাড়ি৷ একটা ট্রেন মিস করে বাস ধরেছিলাম… তারপরেই …
মেয়েটি ঢোক গিলে বললো, এইরে! তাড়াতাড়ি আসুন৷ তারপরেই ব্যাগ থেকে চাবিটা বের করে একটু দূরের একটা সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে নিজের মেরুন কালারের স্কুটিটাতে স্টার্ট দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি চাপুন৷ আপনাকে ট্রেন ধরিয়ে দিচ্ছি৷
জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের বাইকের পিছনে চাপার অভিজ্ঞতা হতে চলেছে সাগ্নিকের৷ মেয়েটা সম্ভবত স্যান্ডেলের কোনো পারফিউম মেখেছে৷ মৃদু একটা গন্ধ এসে লাগছে সাগ্নিককে নাকে৷ পিঠে ফেলা অবাধ্য চুলগুলো সাগ্নিকের দৃষ্টিপথকে আড়াল করছে মাঝে মাঝেই৷ সাগ্নিক বললো, আপনার নাম কি? এখানেই থাকেন?
মেয়েটি একটু গলা চড়িয়ে বললো, নীরা দত্ত৷ আমার এখানেই বাড়ি৷
সাগ্নিক রায়, সেটেলমেন্টে চাকরি করি৷ ট্যাংরায় বাড়ি৷
মেয়েটা বললো, না আপনার ৮.৪৫-এর ট্রেনের খবর হয়নি এখনো, পেয়ে যাবেন৷
সাগ্নিক তখনও ঘোরের মধ্যেই আছে৷ নীরা স্কুটি দাঁড় করিয়ে বললো, স্টেশন দেখা যাচ্ছে৷ পেয়ে যাবেন ট্রেনটা৷
কি বলা উচিত সাগ্নিকের? শুধু ধন্যবাদ! নাকি পরবর্তী যোগাযোগের উপায় খুঁজে নেওয়ার জন্য ফোন নাম্বারটা চেয়ে নেওয়া উচিত?
ভাবতে গেলে নীরা চলে যাবে৷ ইতস্তত করে, ঢোক গিলে বলেই ফেললো সাগ্নিক…পথের পরিচয় কি পথেই শেষ হয়ে যাবে?
যদি এতক্ষণের ব্যবহারে বিশ্বাস জেগে থাকে তাহলে ফোন নম্বরটা কি পেতে পারি?
হাওড়া যাওয়ার ট্রেনের খবর হলো৷
নীরা বললো, নম্বর নিতেই পারেন৷ তবে সবটা জেনে আর ফোন করার ইচ্ছেটা হয়তো থাকবে না আপনার৷
ইচ্ছেটা না হয় আমার ওপরেই ছেড়ে দিন, নাম্বারটা বলুন প্লিজ৷ নাম্বারটা ফোনে লোড করতে করতেই ছুটে গিয়ে ট্রেনটা ধরলো সাগ্নিক৷
এরকম একটা মেয়েকেই কি ও স্বপ্ন দেখত ভোর রাতে? যার মধ্যে মেয়েলী জড়তা থাকবে না, অকারণে আদিখ্যেতা করবে না, অথচ পরিমিত রুচিবোধের প্রকাশ থাকবে তার ব্যবহারে৷ লাভ অ্যাট ফার্সট সাইট কথাটা কি আদৌ সত্যি? এই বয়েসে কি এসব ছেলে মানুষী হয়? তবুও কেন বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওর ওই স্কুটির পিছনে বসে আসার সময় নীরার আন্তরিকতাটা৷ ব্যাগটা ফেরত নিয়ে তো চলে যেতেই পারতো ও৷ কি প্রয়োজন ছিল সাগ্নিককে এভাবে উপকার ফিরিয়ে দেবার৷
স্বপ্ন স্বপ্ন সত্যির মধ্যে দিয়েই বেশ রাত করে বাড়ি ফিরলো সাগ্নিক৷ এখন কি মেয়েটাকে ফোন করাটা ঠিক হবে?
সকালেই বরং কল করবে সাগ্নিক৷
সোমবারের সকালে বেশ হুড়োহুড়ি করতে হয় সাগ্নিককে৷ একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলেই ওদিকে গিয়ে স্নান খাওয়া সারতে লেট হয়ে যায়৷ বাস মিস,অফিসে লেট…তাই সোমবারটা বড়ো অপছন্দের ওর৷ নিরুপায় হয়েই বিছানা ছাড়ল ও৷ ঘুম চোখেই আবার মনে পড়লো পার্পেল ব্যাগের মালকিনকে৷ অকারণে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা দিয়েই টাইগারহিলের সূর্যোদয়ের মতোই মিলিয়ে গেল সাগ্নিকের ঠোঁট থেকে৷ তাড়াহুড়োতে কাল ফোন নম্বরটা নীর বলে সেভ করা হয়ে গেছে৷ আকারটা নেই৷ তা ভালো, নীর মানে তো জল… জীবনদায়িনী৷
ওপ্রান্তে রিং বাজছে৷ বুকের ভিতরটা ধুকপুক করছে সাগ্নিকের৷ হৃৎপিণ্ডের কার্যকরী যন্ত্রটি বলছে, বেশি সাহস ভালো নয়… হূদয় পাশ থেকে ফুট কেটে বললো, প্রেমে আর যুদ্ধে সাহসী হওয়া প্রয়োজন৷ এই মুহূর্তে সাগ্নিক হূদয়ের কথাই শুনলো৷ যাঃ গোটা রিংটা বেজে শেষ হয়ে গেল৷ হয়তো অচেনা নাম্বারের ফোন রিসিভ করে না নীরা৷ কেমন একটা ভালো না লাগা মেঘ ছেয়ে যাচ্ছে ওর মন জুড়ে৷
মা হাঁক পারলো, সানু তাড়াতাড়ি কর বাবা, আজও বাস মিস করবি ৷ ঠাম্মা বললো, পুরুষ মানুষ এত দেরি কেন হয় রে রেডি হতে?
মনখারাপি সুর নিয়েই বাথরুমে ঢুকলো সাগ্নিক৷ ওর কপালটাই খারাপ৷ এমনিতেই কোনো মেয়েকে ওর তেমন পছন্দ হয় না৷ কলেজে নীহারিকা বলে একজনকে পছন্দ হয়েছিল৷ প্রোপোজ করতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একসা৷ নীহারিকা বেশ সাহসী গোছের মেয়ে ছিল৷ অকারণ লজ্জায় লাল হয়ে থাকতো না চবিবশ ঘন্টা৷ প্রেমিককে সোনা, বাবু বলা ন্যাকা মেয়ে নয় আরকি৷ কিন্তু প্রোপোজ করতে গিয়েই চাপ খেয়েছিল৷ নীহারিকার ওপরে নাকি কলেজ ইউনিয়নের নেতা সমরজিৎ-এর নজর ছিল৷ তাই মাঝ পথে কাঁটার মতোই সাগ্নিককে মারাত্মক থ্রেট করে বলেছিলো, ভবিষ্যতে যেন নীহারিকার দিকে আর না তাকায়৷ নীহারিকাও সমরজিৎ-এর বাইকে করে সাগ্নিককে টা টা করে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর থেকেই প্রেম নামক বস্তু থেকে বেশ কিছুটা দূরে থেকেছে সাগ্নিক৷
ঠাম্মার উৎপাতে মা বেশ কয়েকটা মেয়ের ছবি দেখিয়েছে ওকে৷ মেয়েগুলো সুন্দরী, শিক্ষিতা কিন্তু ওই যে সাগ্নিক যেটা চাইছে সেটা নয়৷ তলোয়ারের মতো দুটো চোখ… যার চাহনিতে ফালাফালা হয়ে যাবে ওর পুরুষত্বের অহংকার৷ বহুদিন পরে ওই কাজল ঘেঁটে যাওয়া চোখ দুটোতে সেই আগুন দেখেছিল৷ কান্না ভেজা চোখও যে এতটা বাঙময় হয় সেটা এই প্রথম দেখলো সাগ্নিক৷
সানু তোর ফোন বাজছে…বাবার গলা৷ ফোন! তবে কি মিস কল দেখে নীরা… কোনো মতে গামছা জড়িয়েই বাথরুম থেকে পড়িমরি করে ছুটে ঘরে এসে হামলে পরে ফোনটা ধরলো সাগ্নিক৷ নীর কলিং….
হ্যালো, আমার ফোনে এই নম্বর থেকে একটা মিস কল ছিল…কে বলুন তো আপনি?
নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার আগেই সাগ্নিক বললো, হ্যাঁ ,আমি কল করেছিলাম৷ আমি সাগ্নিক… কাল আপনি আমাকে স্কুটি করে…
কথা শেষ করতে না দিয়েই নীরা বললো, তার থেকে বলুন, কাল আপনি আমার ব্যাগটা ফেরত দিতে গিয়ে বাসটা ছেড়ে দিয়েছিলেন৷
বাহ, মেয়েটির সৌজন্যবোধ তো অদ্ভুত৷ নিজের উপকারটাকে ছোটো করে কেমন ওরটাকে বড়ো করে দেখছে৷
কাল ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছে ছিলেন?
হ্যাঁ পৌঁছেছিলাম৷ আপনার ব্যাগের সব জিনিস ঠিক আছে তো?
কেন, নিজেকে বিশ্বাস করেন না বুঝি?
একটু হেসে সাগ্নিক বললো, সব সময় কি নিজেকে বিশ্বাস করা উচিত? কোনো কোনো সময় তো নিজের ওপরেই সব থেকে বেশি ভরসা কম থাকে৷ এই যেমন গত কাল সন্ধ্যে থেকে আপনি আমার মনের বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছেন৷ এটা বোধহয় আপাতত আমার আয়ত্তের বাইরে৷
ওপ্রান্তে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীরা বললো, একটা মানুষকে চিনলেন না, জানলেন না, তার পরিচয় পেলেন না… তার আগেই মনে জায়গা দিয়ে দিলেন? এত হটকারী হলে তো জীবনে ঠকবেন!
নীরার গলায় বিদ্রুপের আভাস পেয়েই সাগ্নিক বললো, চিনতেই তো চাইছি৷ জানতেই তো চাই সম্পূর্ণ ভাবে৷ সে সুযোগটুকু অন্তত দিন৷
একটু গম্ভীর গলায় নীরা বললো, আপাতত স্কুলে বেরোব৷ একটু তাড়া আছে৷
আপনি স্কুল টিচার?
না, কোনো সরকারি চাকরি করি না৷ আমার একটা নাচের স্কুল আছে৷
মাই গড, আপনি ড্যান্সার?
কেন আমাকে জানার ইচ্ছেটা বুঝি শেষ হয়ে গেল? কি মনে হচ্ছে … নেচে বেড়ানো মেয়েরা খুব খারাপ হয়? বলেই ফোনটা কট করে কেটে দিলো নীরা!
যা বাবা! মেয়েটা কি পাগল নাকি? সাগ্নিক কখন বললো ড্যান্সার মানে সে খারাপ হবে?
কি মুশকিল রে বাবা৷
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে আরামবাগ থেকে ফেরার পর৷ সাগ্নিক কিছুতেই অফিসের কাজে মন বসাতে পারছিল না৷ আবার অযথা নীরাকে ফোন করে বলতেও পারছিল না, আমার এই আনমনা হয়ে যাওয়ার পিছনে আপনিই দায়ী৷
ফেসবুকে নীরার নাচের ভঙ্গিমায় বিভিন্ন ছবি রয়েছে৷ নীরার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢুকে ওর ছবি দেখাটা সাগ্নিকের রোজকার একটা অবশ্য কাজে দাঁড়িয়ে গেছে৷
হোয়াটস আপে টুং করলো… অপ্রত্যাশিত ভাবেই নীরার নাম্বার থেকে একটা মেসেজ ঢুকলো৷
আপনাদের পাড়ায় যাচ্ছি দিন সাতেক পরে৷ একটু হেল্প চাই৷
সাগ্নিক টাইপ করলো, উপকার করতে পারলে ধন্য হবো৷
আমাদের নাচের টিমের একটা অনুষ্ঠান আছে রবীন্দ্রসদনে৷ যদি ওই দিন ফিরতে না পারি, গোটা বারো মেয়ের থাকার ব্যবস্থা কি ভাবে করবো যদি একটু বলেন? মানে, কোনো হোটেল বুক করা যদি যায়…
আমাকে দেখে তো আপনার ভদ্রলোকই মনে হয়েছে নাকি? তাহলে দায়িত্ব যখন দিলেন তখন নিশ্চিন্তে থাকুন৷
নীরা বললো, আমি কারোর উপরে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি না৷
সাগ্নিক লিখলো, একবার বিশ্বাস করে দেখুন না! বিশ্বাস শব্দের আগে সবসময় ‘অ’ যোগ নাই বা করলেন!
নীরা হাল ছাড়া গলায় বলল, অগত্যা৷
ছোট্ট থেকে সাগ্নিকের যত প্ল্যান, যত গোপন কথা সব ঠাম্মার সাথে৷ আজও অফিস যাবার আগে ঠাম্মার ঘরে ঢুকলো৷ ঠাম্মা এক মনে একটা বই পড়ছিল৷ বিরাশি বছরের সারদা দেবীর চোখ কান এখনো তীক্ষ্ণ৷ সাগ্নিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রেমে পড়েছিস? তা মেয়েটা কেমন?
সাগ্নিক চমকে গিয়ে ভ্যাবলার মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলল, তুমি কি করে বুঝলে?
তোর হাঁটার মধ্যে একটা ভয় ভয় লজ্জা রয়েছে রে ছোঁড়া৷ একমাত্র প্রেমে পড়লেই মানুষ ইঁদুরকেও সমীহ করে…
ঠাম্মা, আমি তোমাকে সমীহ করি না?
ঠাম্মা কানটা সাগ্নিকের কানের কাছে নিয়ে এসে বললেন, এবার বল দেখি কেসটা৷ সবটা শুনে সাগ্নিকের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই অফিস যা, কেসটা আমি হ্যান্ডেল করছি৷ সারদা দেবীর স্বামী ছিলেন নামকরা উকিল৷ তাই ওনার কথাবার্তায় দাদুর কথার ছাপ স্পষ্ট৷ সাগ্নিক আমতা আমতা করে বললো, কিন্তু বাবা?
অফিসে গিয়েও ঠিক করে কাজ করতে পারছিল না সাগ্নিক৷ এখন মনে হচ্ছে ছোটোপিসির হাতটা কেমন আছে জানার জন্য আরেকবার আরামবাগ যাওয়া উচিত৷ কিন্তু বাড়িতে কি বলবে! ধুর, এই মেয়েটার বাড়ি এত দূরে কেন? আপাতত নীরার হোয়াটস আপের লাস্ট সিন দেখা আর ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘাঁটা ছাড়া কোনো কাজ করতে ভালো লাগছে না সাগ্নিকের৷ এ তো অদ্ভুত রোগ!
শঙ্খ বাজা সন্ধ্যেয় সাগ্নিক ফোনটা করলো নীরাকে৷ আপনাদের কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেছে৷ নিশ্চিন্তে আসুন৷
নীরা তখন বেশ শঙ্কিত গলায় বলল, হোটেলটা ভালো তো… মানে বুঝতেই পারছেন এতগুলো অল্পবয়সী মেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে যাওয়া৷
আচ্ছা, আপনার আমাকে কি মনে হয়? আমি কি বাচচা? মেয়েদের সিকিউরিটি, কিছুই বুঝি না?
নীরা বেশ গম্ভীর গলায় বললো, না আপনাকে কেন বাচচা মনে হবে….আপনি তো দারুন স্কুটি চালান….
সাগ্নিক আমতা আমতা করে বললো, লেগ পুল করছেন? কি করে বুঝলেন? আমি বাইকে ভয় পাই?
যেভাবে সামান্য স্পিডে আমার কাঁধটা খামচে ধরেছিলেন তাতেই বুঝে গেছি৷
সাগ্নিকের সরল হাসিতে হঠাৎ একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে ভিজিয়ে দিলো নীরার মন৷ নীরা কোনোদিনই প্রেমে বিশ্বাসী নয়৷ ভালোবাসা মানেই ব্রেকআপ, আর তারপর বাকি জীবনটা দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘুরে বেড়ানো৷ ওসব ঝামেলায় ও কোনোদিনই যায়নি৷ মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর থেকেই বাবা মা অতিষ্ট করে তুলেছে বিয়ে দেবার জন্য৷ এমনকী তিন বছর বয়স থেকে শেখা নাচটা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে এই বিয়ের চক্করে৷ বাবা এক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে প্রায় পাকা করে ফেলেছে নীরার৷ অথচ তাদের কনজারভেটিভ ফ্যামিলি কোনো ভাবেই নীরাকে নাচ কন্টিনিউ করতে দেবে না৷ মা বাবা বলেছে ,মানিয়ে তো নিতেই হবে৷ ভালো ছেলে,ভালো পরিবারের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস করতেই হবে৷ নীরার ঘুঙুর বাঁধা পাগুলো তালের সাথে সাথে আর নাচবে না শুনেও বাবা মায়ের এতটুকু কষ্ট অবধি হচ্ছে না, ভাবলেই দু-চোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসছে৷ এরাই নাকি ওর জন্মদাতা! ওর নিজের লোক! কষ্টে গলা বুজে এলো৷ পাত্রপক্ষরা আঙুলের মাপ নিয়ে চলে যাবার পরে যত প্রতিবাদী মেয়েই হোক,এই বিয়ে ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সাহস দেখানোটা বেশ কঠিন কাজ৷ সেটা নীরা বুঝতে পারছে বেশ৷ বাবাকে অনেক বুঝিয়েছে বাবা, কিন্তু বাবা কিছুতেই এই বিয়ে বাতিল করবে না৷ নীরার মৃত্যু দেখবে বাবা, তবুও রজতের সাথেই বিয়ে দেবে৷ সেই জন্যই সাগ্নিক যখন বলছে ওকে আরও জানতে চায়, তখন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নীরা৷ সাগ্নিক যদি আর পাঁচমাস আগে আসতো ওর জীবনে তাহলে হয়তো … মাত্র কয়েকদিনেই ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগে গেছে ওর৷
একটা নাম না জানা স্টেশনের বেদিতে মুখোমুখি বসে আছে দুজনে৷ সামনে দিয়ে দ্রুতগামী ট্রেনেরা চলে যাচ্ছে স্বশব্দে৷ বেশ খানিকক্ষণ পরে সাগ্নিক বললো, এই স্টেশনে আমি এই প্রথম৷ তুমি এসেছিলে আগে?
একবারই এসেছিলাম এক বান্ধবীর বাড়ি৷ তখনই বেশ ভালো লেগেছিল স্টেশনটা৷ শিমুলবাড়ি নাম অথচ কোনো শিমুল গাছের দেখা নেই৷
বেশির ভাগ ট্রেনই স্টেশনটাকে অবহেলা করে, বেশির ভাগেরই স্টপেজ নেই এখানে৷ তাই যাত্রী চলাচল বেশ কম৷
নীরা বললো, সব তো শুনলে … এখন বলো, কি করা উচিত?
সাগ্নিক বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো, তাই বলে এত দিনের সাধনা এক কথায় ছেড়ে দেবে?
আজ যদি তোমার উড বি কে বলা হয়, তার জবটা ছেড়ে দিতে, সে কি দেবে?
মাথা নিচু করে বসে আছে নীরা৷ হঠাৎই হাঁটু গেঁড়ে নীরার সামনে বসে পড়েছে সাগ্নিক৷ হাতটা বাড়িয়ে বললো, চলো নীরা পালাই৷ দেখো হাওড়াগামী ট্রেনের খবর হলো… চলো নীরা পালাই…
সারাজীবন ছন্দে নাচবে তোমার পা, কথা দিলাম৷ চলো নীরা…
নীরা হাত রাখল সাগ্নিকের হাতে৷ লোকাল ট্রেনটা এসে দাঁড়িয়েছে শিমুলবাড়ি স্টেশনে৷ সাগ্নিক নীরার হাত ধরেই পা দিলো ট্রেনের কামরায়৷ হাতের তালু থেকে নীরা ঝটিতে হাতটা সরিয়ে নিল৷ তুমি ফিরে যাও সাগ্নিক … পারবো না আমি৷
অসহায় কষ্টে বুকটা মুচড়ে উঠলো নীরার৷ সাগ্নিকের চোখে আশাভঙ্গের কষ্ট৷ ট্রেনটা শিমুলবাড়ি স্টেশন ছাড়িয়ে এলো৷ পিছনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো নীরা৷ ওর দু-চোখে জল৷ আজও কাজলটা ঘেঁটে গেল যেন৷
বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় চলছে৷ তার আগে রবীন্দ্রসদনে এটাই ওর শেষ পারফরম্যান্স৷
হোয়াটস আপে মেসেজ ঢুকলো, সাগ্নিক লিখেছে ঠিক টাইমে বাড়ি পৌঁছে গেছি নীরা৷
বার কয়েক অনেক কথা টাইপ করেও ডিলিট করে দিলো নীরা৷ শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছে,সাগ্নিকের হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্যটা৷
নীরার প্রোগ্রাম দেখতে সাগ্নিক ওর বাবা মা দুজনকেই নিয়ে এসেছে৷ সাগ্নিকের বাবা তো নীরার মাথায় হাত রেখে বললেন, গুণী মেয়ে, আমার কত শখ ছিল ছেলেটা গিটার বাজানো শিখুক৷ তো দু-দিন পিংপিং করে সব শেষ৷ ছেলেটা আমার অপদার্থ! অন্যসময় হলে সাগ্নিককে লেগপুল করার সুযোগটা কিছুতেই হাত ছাড়া করত না নীরা৷ কিন্তু সেদিনের পর থেকে ফোনে সাগ্নিকের কাছে অনেকবার ক্ষমা চেয়েও অপরাধী মনে হয়েছে নিজেকে৷ সাগ্নিক খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করছে… কিন্তু তবুও ওর অন্যমনস্ক মুখটা দেখেই নীরা বুঝতে পারছে ওর ভিতরে কিছু একটা চলছে৷ যদিও ওরা সারা জীবন ভালো বন্ধু হয়ে থাকবে কথা দিয়েছে৷ তবুও শুধুই ভালো বন্ধু ভাবতে পারছে না আর৷
সাগ্নিক কোনো হোটেলই বুক করেনি ওদের জন্য৷ সকলকে নিয়ে গিয়ে তুললো নিজের বাড়িতে৷ তিনতলা বাড়ির ওপরের তিনটে ঘরে সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওদের থাকার৷
সাগ্নিকের ঠাম্মা তো নীরার চিবুক ছুঁয়ে বলেই ফেললেন,এই বুঝি আমার নাত বউ?
সাগ্নিক সামলে নিয়ে ঠাম্মার কানে কানে কিছু বললো৷
ঠাম্মার চোখে অবিশ্বাসী দৃষ্টি৷ নীরার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে দেখেই সাগ্নিক বললো, তুমি এত হেজিটেট করো না, তোমার বিয়ের দিন আমি কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে আসবো৷
নীরা ধীরে ধীরে বলেছিল, পেরেছো ক্ষমা করতে আমাকে?
ভুল তো তোমার নয় নীরা! এত কম দিনের পরিচয়ে কেউ কি কাউকে বিশ্বাস করে? ভুলটা আমার ছিল৷ আমিই সব কিছু না জেনে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম৷ নিজেকে দোষী ভেবো না প্লিজ৷
সাগ্নিকের গলার আবেগি স্বর বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে নীরাকে৷ ওর পঁচিশের বসন্তকে অনবরত রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সাগ্নিকের উপস্থিতি৷
এটা ভালোবাসা ছাড়া আর কি! তবুও জোর করেই নিজের মতের বিরুদ্ধেই বিয়েটাতে রাজি হয়েছে নীরা৷
ঠাম্মাকে কথা দিয়ে এসেছে নীরা, আবার আসবে৷ সাগ্নিকের বাবা মাও বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছেন৷ অন্তত ছেলের পছন্দটুকু বুঝতে পেরেছেন৷ নীরা যে শুধুই ছেলের বন্ধু নয় সেটুকু বুঝেই ওর মা বললেন, আমার ছেলে কিন্তু খুব বড়ো মনের নীরা৷
সেটা এই ক-মাসে জেনে গেছে নীরা৷ না হলে শিমুলবাড়ির ঘটনার পরে আর হয়তো যোগাযোগই রাখতো না সাগ্নিক৷
সাগ্নিকদের পুরো পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে কার্ড এসেছে ওদের বাড়িতে…
নীরার বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র৷
নীরার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ওর আশীর্বাদের ছবি৷ পাশের ছেলেটা যে নীরার উড বি এটা কিছুতেই যেন মন থেকে মানতে পারছে না সাগ্নিক৷ বুকের ভিতরে তোলপাড়, রক্ত ক্ষরণ হয়েই চলছে৷ সেদিন যদি ঝোঁকের মাথায় নীরা সাগ্নিকের হাতটা ধরে চলে আসতে পারতো কলকাতায়, তাহলে হয়তো এই আশীর্বাদের ছবিটাতে ওর ছবি থাকতো… হয়তো লালচে সিঁদুরে নীরার সিঁথি রাঙিয়ে দিচ্ছে সাগ্নিক, এটাই হত নীরার প্রোফাইল পিকচার৷
মা ঘরে ঢুকে বললো, নীরার জন্য কিছু একটা গিফট কিনতে হবে তো সানু?
বাড়ির সকলে বারণ করেছিল নীরার বিয়েতে সাগ্নিককে যেতে৷ এমনকি অমন কঠিন হূদয় বাবাও এসে বলেছিল, সানু যাকে ভালোবাসো.. তাকে অন্যের হতে দেখতে পারবে? কষ্ট হবে না তোর?
নিশ্চুপ থেকেছে সাগ্নিক৷ নিজে হাতে গিফট কিনেছে৷ নীরার গায়ের সেই চন্দনের পারফিউমের গন্ধে ঘুম ভেঙে গেছে মাঝরাতে৷
বিয়ের দিন সকালে সাগ্নিক চলে গিয়েছিল পিসির বাড়ি৷ ওখান থেকে নীরাদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়৷ হয়তো নীরা বাড়িতে ওর পরিচয় দিয়েছে নেহাতই পরিচিত অথবা বন্ধু৷ হয়তো আরেকটু বাড়িয়ে বলেছে… উপকারী বন্ধু৷ গতবার আরামবাগ থেকে ফেরার সময়েই বাসে দেখা হয়েছিল নীরার সাথে,আর আজ এখানে এসেছে নীরার বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে৷ ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস৷ ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রেখে সকলের দৃষ্টির আড়ালে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে সাগ্নিক৷ তবুও পিসি বললো, হ্যাঁরে সানু তোর কি কিছু হয়েছে? চোখগুলো অত লাল কেন?
নীরার প্রিয় রং হালকা সবুজ… আজ সাগ্নিকের শার্টের রংও হালকা সবুজ৷ এখনো নীরার মনের কাছাকাছি পৌঁছানোর কি অসীম ব্যাকুলতা ওর৷ নিজের মনকে বারবার বলছে সাগ্নিক, সামলে রাখ সাগ্নিক, নিজেকে সামলে রাখ৷
কনের সাজে নীরাকে অপূর্ব লাগছে৷ লাল বেনারসী, লালচে ওড়না, ফুলের মালা জড়ানো রয়েছে ওর খোঁপায়৷ কপালে অল্প চন্দন আঁকা৷ ঠিক এই বেশেই নীরা এসেছিল সাগ্নিকের স্বপ্নে৷ তবে সেদিন ওর পাশে সাগ্নিকও ছিল বর বেশে৷ আজ সেই স্থানে অন্য কোনো মুখ৷
বর এসেছে বর এসেছে… আওয়াজটা সব বিয়ে বাড়িতে ভীষন স্পেশাল৷ ওই মুহূর্তে যে যেখানেই থাকুক বর দেখতে ছুটে যাবেই৷ নীরা একাই বসেছিলো ওর নিজের ঘরে৷
সাগ্নিক গিফট প্যাকটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, সময় পেলে আমার দেওয়া উপহারটা খুলে দেখো৷
নীরার চোখে কৌতূহল… কি আছে সাগ্নিক এতে?
ভালো থেকো নীরা৷
ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সাগ্নিক৷
প্যাকেট ছেঁড়ার আওয়াজ আর তারপরে বেশ জোরেই একটা ভেঙে পড়া কান্নার শব্দ ও শুনতে পেল নীরার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে৷
বর আসনে বর এসে বসেছে৷ নীরা বলেছিল ওর উড বি নাকি ভীষণ মেজাজী৷ মারাত্মক ডোমিনেন্ট মানসিকতার৷ সাগ্নিক দেখছিলো রজতকে৷ ওর চোখ দুটোয় অহংকারী দৃষ্টির আনাগোনা৷
সাগ্নিকের হোয়াটস আপে মেসেজ ঢুকলো… বাড়ির সামনে আমার স্কুটিটা রয়েছে, দেখো চাবি লাগানোই আছে৷ ভালো চালাতে পারো না জানি… অন্তত গ্যারেজ থেকে বের তো করতে পারবে?
সাগ্নিকের ছোট্ট উত্তর…পারবো৷
পিছনের দরজা দিয়ে লাল বেনারসী পরা মেয়েটা বেরিয়ে এলো৷ তারপর আস্তে অথচ শাসনের স্বরে বললো, পিছনে বস৷ তোমাকে বিশ্বাস নেই,মাঝরাস্তায় হয়তো ফেলেই দিলে৷
বেনারসীর আঁচল কোমরে গুঁজে স্কুটিটা স্টার্ট দিলো নীরা৷ বাড়ি থেকে কিছুটা আসার পরই বললো, আমার কোমর ধরে না বসে থেকে মাথার ওড়না, ফুল এগুলো অন্তত খোলো সাগ্নিক৷ এই ধরা-চুড়ো পরে ট্রেনে উঠলে লোকের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকবে না৷ সাগ্নিক নীরার পিছনে বসে ওর ওড়ানো, খোঁপার ফুল খুব সাবধানে খুলে বললো, এগুলো এখন কি করবো নীরা? নীরা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, নিজে পরে নাও… ছুঁড়ে ফেলে দাও আর কি!!
আবারো হাওড়া যাবার ট্রেনের খবরটা শুনেই দৌড় লাগলো দুজনে৷ কোনোমতে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেই হাঁপাচ্ছিলো নীরা৷
সাগ্নিক বললো,আমার বাড়িতে তো কিছুই জানে না…একটা ফোন করবো?
নীরা মুচকি হেসে বললো, ঠাম্মা সব ব্যবস্থা করে রাখবে বলেছে৷ আমি বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই ঠাম্মাকে কল করে দিয়েছিলাম৷ ঠাম্মা শুধু বললো, আমার নাতিটাকে ঠিকমত বাড়ি অবধি নিয়ে আয় নীরা, তারপর সব আমার দায়িত্ব৷
নীরার কাঁধে সেই পার্পেল ব্যাগটা৷ তার থেকে বের করলো সাগ্নিকের দেওয়া গিফটা৷ বের করতেই অনেকগুলো ঘুঙুর একসাথে ঝমঝম করে বেজে উঠলো৷ নীরা ঘুঙুর জোড়া নিয়ে নিজের গালে মাথায় ঠেকালো৷
সাগ্নিক নীরার হাতটা ছুঁয়ে বললো, তোমার জীবনের ছন্দকে থামতে দেব না আমি, কথা দিলাম৷
সাগ্নিকের খুব ইচ্ছে করছে, নীরার ওই কাজল ঘেঁটে যাওয়া চোখের ওপরে নিজের ঠোঁট দুটো রেখে বলতে, স্বপ্নে ছিল তোমার রোজ আনাগোনা৷ আজ সব স্বপ্ন স্বপ্ন সত্যি হলো আমার জীবনে৷