হাত চিঠি
অনেক কষ্টে যেদিন এই ছোট্ট দোতলা বাড়িটা শেষ করেছিলাম সেদিন নিজের মধ্যে কেমন এক গর্ব অনুভব করেছিলাম৷ এই প্রথম অপদার্থ জামাই থেকে পদার্থ হতে পারার সুপ্ত সম্মানটা যেন আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল আমাকে৷ আত্মজীবনী শোনানোর আগে আমার পরিচয়টা একটু দিয়ে দিই আপনাদের৷ আমি অমল বসু৷
ভ্রূ কুঁচকে অকারণে ভাবতে বসবেন না, কোথাও কি আদৌ শুনেছেন অমল বসু নামটা! না শোনেন নি৷ সেটেলমেন্টের সামান্য কর্মচারীর নাম না শুনলেও আপনার দৈনন্দিন জীবনের কোনো হেরফের হবে না বলেই আমার বিশ্বাস৷ তবুও বলি, আমি সেটেলমেন্ট অফিসে চাকরি করি, কেরানি বলতে পারেন৷ আমার বয়স বছর বিয়াল্লিশ৷ এমন কিছু হ্যান্ডু চেহারা আমার নয় যে মহিলারা একবার দেখে দ্বিতীয় বার ঘুরে তাকাবেন৷ কলেজেও নেহাতই গোবেচারা স্বভাবের জন্যই আমাকে সব মেয়ে বান্ধবীরা বয়ফ্রেন্ডের জায়গায় পিওন ভাবতেই বেশি ভালোবাসতো৷ মেয়েরা বলতো, অমল বিশ্বাস কর তুই আমার প্রিয় বন্ধু৷ না, গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের মতো ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ বলে দু-দিন পরে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির মতো ব্যাপার নয়৷ আমি সত্যিই সকলের শুধুই বন্ধু ছিলাম৷ বান্ধবী ও বন্ধুদের কাছে আমি এই কারণেই পপুলার ছিলাম যে, আমি কখনই দশটা চিঠি বিলির দায়িত্ব নিয়েও ফেলিওর হই নি৷ যদিও সেই সব কলেজ প্রেমই যে পরিণতি পেয়েছে এমন নয়৷ কিছু তো দু-চারটে চিঠির পরই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে৷ এখনকার ভাষায় যাকে বলে ব্রেকআপ৷
এই চিঠি বিলির সূত্র ধরেই আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল কলেজেরই এক মহিলা পিওনের ,তার নাম প্রভাতী৷ প্রভাতীও বিশ্বাসী পিওন বলেই পরিচিত হয়েছিল, আমাদের বিনোদবিহারী কলেজে৷
একদিন আমার জেঠুর খুব শরীর খারাপ ছিল, হাতে তখন আর্জেন্ট গোটা পাঁচেক প্রেমপত্র৷ এমত অবস্থায় কলেজেও যেতে পারছি না৷ জেঠুকে নিয়ে ডাক্তার-বদ্যি করতে হচ্ছে৷ তখন বিপদ তারণ করলো ওই প্রভাতী৷ প্রভাতীর হাতে ওই পাঁচটা চিঠি দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম৷
সেম প্রফেসনের অনেক গোপন কথা থাকে, সেই সূত্রেই প্রভাতীর সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেশ জমে উঠেছিল৷
কোন বইয়ের মধ্যে করে চিঠি বহন করলে বাড়িতে মোটেই ধরা পড়বে না সেটা ওই আমাকে শিখিয়েছিল৷ বাড়ির লোকের সব সময় আগ্রহ থাকে অঙ্ক আর ইংরেজি বইয়ের প্রতি, অবহেলিত হয় বাংলাটাই৷ তাই বাংলা বইটাই ভীষণ সেফ৷
মুশকিলটা বাঁধলো কলেজ পাশ করে যখন ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করলাম৷ ততদিনে প্রভাতী আর আমি দুজনেই হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি যে, আমরা আর জাস্ট ফ্রেন্ড নেই৷ লোকের চিঠি বহন করতে করতে আমাদেরও চিঠি লিখতে সাধ জাগছে মনে৷
প্রথম চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম প্রভাতীকে৷
চিঠিটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিলাম, এটা অনন্যাকে দিয়ে দিও, সুবোধের চিঠি৷ তবে সুবোধ বলেছিল, ও নাকি ভীষণ বানান ভুল করে, তাই একবার পড়ে নিতে৷ আমার সময় হয়নি প্রভাতী, তুমি একবার দেখে নিও৷
পরেরদিন প্রভাতী এসে আরেকটা চিঠি আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, সুবোধকে বলে দিও, অনন্যা বলেছে, বানান ভুল তেমন নেই, তবে ভালোবাসি কথাটা ওভার রাইটিং হয়েছে বলে বাতিল হয়ে যেতে পারে!
সেদিন আমি হেসে ফেলেছিলাম৷ বলেছিলাম, আর প্রভাতীর কি মত? ওভার রাইটিং হলে ভালোবাসা বেশি হয় নাকি বাতিল হয়৷
ও কিছু না বলেই চিঠিটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়েছিল৷
সেই প্রথম আমি কাঁপা হাতে আমার জন্য লেখা কোনো চিঠি খুলেছিলাম৷
প্রভাতী লিখেছে, শপথ কর সারাজীবন একসাথে একই পথে চলবো৷
তারপর তো শুধুই ভেসে যাওয়া৷
প্রভাতী ছিল ধনীর দুলালী৷ আমি অমল বসু নিতান্তই মধ্যবিত্ত৷ মধ্যবিত্তদের হূদয় বড়ো হলেও সামর্থ্য থাকে কম৷ নুন, তেলের হিসেব কষতে কষতেই ঝুলপির চুলে পাক ধরে যায়৷ বেড়াতে যাওয়া বলতে তারাপীঠ, পুরী, দিঘা৷ পুজোর সময় নতুন শাড়ির গন্ধ নেওয়া৷ সমস্যাটা শুরু হলো বিয়ের কটা মাস পরেই৷
আমি তখন সেটেলমেন্টের অফিসে সবে নতুন চাকরি পেয়েছি৷ মাইনে তেমন কিছুই নয়৷ শুধু সরকারি চাকরি এটুকুই বুক ফুলিয়ে বলতে পারছিলাম৷
প্রভাতী প্রতি মুহূর্তে মানিয়ে নিতে নিতে হয়তো ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত৷ আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন আমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি৷ কম উপায় করা ভাইকে দয়া দেখিয়েই দিদি মাকে তার সংসারে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলো, নাকি তার বাড়ি পাহারা দেবার সবসময়ের একজন বিশ্বাসী মানুষকে পেয়ে হাতছাড়া করতে চায়নি, সে তর্কে আমি কখনোই ঢুকতে চাইনি৷ তবে আমার বিয়ের পর পরই দিদি মা-কে নিয়ে ভূপাল চলে গিয়েছিলো৷
প্রভাতী নিজের সংসার নিজের মতোই চালাতে শুরু করেছিলো৷ আমি শুধু মাইনের টাকাটা এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম৷
মাঝে মাঝেই দেখতাম প্রভাতী খাতায় কাটাকুটি করে হিসেব কষছে৷ এদিক ওদিক থেকে খরচ কমিয়ে ইলেকট্রিক বিল ম্যানেজের চেষ্টা চালাচ্ছে৷
শ্বশুর বাড়ির অনুষ্ঠানে আমরা বরাবরই একটু কমা উপহার নিয়ে হাজির হতাম৷
উপহারের মূল্য ভালোবাসায় নয়, অর্থের মূল্যেই বিবেচ্য হত প্রভাতীর বাপের বাড়িতে৷ ওর কাকা, জ্যাঠার মেয়েরা বা ওর নিজের দিদিও মাঝে মাঝেই প্রভাতীকে মিষ্টি করে বলতো, ওহ এই শাড়িটা তো হাতি বাগানে মাত্র দুশো টাকায় ফুটে বিক্রি হচ্ছে রে৷
আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই আমি প্রতিবার প্রভাতীর মুখে একটা গোপন কষ্ট দেখতাম৷
কে জানে আমাকে বিয়ে করাটা হয়তো ওর ভুলই হয়েছে! এই দু-কুঠুরি ঘরের বদ্ধ আবহাওয়ায়, টানাটানির সংসারে ও হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছে৷ মাঝেই মাঝেই আজকাল প্রভাতীকে বড় বিষণ্ণ লাগে আমার৷
আর ঠিক তখনই অপরাধ বোধ কাজ করে৷
একদিন রাতের অন্ধকারে আমি প্রভাতীর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ভুলতে চাইছি আমার ব্যর্থতা, ঠিক সেই সময়েই প্রভাতী বললো, আমি একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছি৷
ওর কোমল শরীরী আকর্ষণকে উপেক্ষা করে ছিটকে সরে এসেছিলাম আমি৷
চাকরি! চাকরি করবে তুমি?
এমনিতেই তোমার বাবা তার ছোটো জামাইকে অপদার্থ বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন৷ এখন যদি তোমাকে চাকরি করতে হচ্ছে দেখেন তাহলে তো বলবেন,আমি তোমার টাকায় বসে বসে খাবো বলেই তোমাকে চাকরি করতে পাঠাচ্ছি৷
প্রভাতী বললো, বাবার কাছ থেকে হাত পেতে আমরা তো টাকা চাইছি না৷ আমরা দুজনেই লেখাপড়া জানি৷ নিজেরা পরিশ্রম করে সচ্ছল ভাবে থাকতে পারলে সেটা করবো না কেন?
প্রভাতী আস্তে আস্তে বললো, তাছাড়া এরপর তো আমরা তিনজন হবো৷ তখনও তো খরচ অনেক বেড়ে যাবে!
আমার শিক্ষিত মন সায় দিচ্ছে প্রভাতীর চাকরি করাতে, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মনটা বিদ্রোহ করছে, ঘরের বউ চাকরি করবে!
মনের দ্বন্দ্ব মেটাতে দু-দিন তারাপীঠ থেকে ঘুরেও এলাম৷ প্রভাতী ততদিনে মনস্থির করেই ফেলেছে চাকরিটা সে করবে৷
দুজনের রোজকারে যে সচ্ছলতা এসেছে সেটা আমাদের গ্লোয়িং স্কিনই বলে দিচ্ছে৷ বাপের বাড়ির দিকের অনুষ্ঠানে গিয়েও প্রভাতী বেশ গর্ব করেই বলছে, নিউ মার্কেট ছাড়া মার্কেটিং করে পোষায় না৷
টাকা কি বদলে দেয় মানুষকে? কেন যে বারবার মনে হচ্ছিলো আমার সেই পরিচিত প্রভাতী বদলে যাচ্ছে! মনের ভুল হয়তো৷ প্রভাতী তো চেষ্টা করছিলো আমাদের দুজনকেই ভালো রাখতে৷
অবশেষে ব্যাংকে লোন করে, প্রভাতীর একটা টাকাও না নিয়ে ব্যালকনি সমেত ওপরে দুটো আর নীচে দুটো এই ছোট্ট দোতলা বাড়িটা তৈরি করেছিলাম আমি৷ বাড়িটা ছোটো হলেও বেশ আধুনিক ডিজাইনের বলেই হয়তো গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে এসে আমার শ্বশুরমশাই প্রথম বললেন, যাক! এতদিনে অমল যাহোক একটা ভালো জিনিস করতে পারলো৷
যদিও সংসার খরচটা প্রভাতী সামলে ছিল বলেই আমার পক্ষে বাড়িটা করা সম্ভব হয়েছিল৷ তবুও মধ্যবিত্তের জীবনে বাড়ি করাটা একটা বড়ো অ্যাচিভমেন্ট, তাই অহংকার যে আমার একটু আধটু হচ্ছিল না তা নয়৷ আমার চালচলনে হাবে ভাবে সেটা হয়তো অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে৷ বিশেষ করে প্রভাতীর চোখে তো বেশ অচেনা হয়ে গিয়েছিলাম আমি৷
নতুন রঙে আমার বাড়ি যখন সেজে উঠেছে তখন বেআক্কেলের মতো প্রভাতী একটা পেরেক দিয়ে নতুন দেওয়ালে খুদিয়ে লিখে দিয়েছিল, My sweet home…
ঝাঁ চকচকে দেওয়ালে ওর ওই লেখা দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল৷ আমি বেশ উঁচু গলায় বলেছিলাম, এই বাড়ির একটা ইটেও তোমার রোজকারের কোনো টাকা নেই, অথচ তুমি দেওয়ালে লিখে দিলে যে, তোমার বাড়ি?
নিজের অহংকার না দেখালেই হচ্ছিলো না, প্রভাতী! লোকজনের কাছে প্রমান করতে চাইছো যে বাড়িটা তুমি বানিয়েছো?
না, অত কথা বলা মেয়েটাও সেদিন চুপ করে গিয়েছিলো৷ শুধু দু-চোখ দিয়ে অবিরত জল গড়াচ্ছিলো ওর৷ আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই বললাম, আমি একটা প্রশ্ন করেছি তোমাকে?
প্রভাতী কান্না চেপে বলেছিল, ভুল হয়ে গেছে৷ আমি আমার বাড়ি লিখেছি৷ কারণ আমি ভেবেছিলাম, যা কিছু তোমার সেটাই হয়তো আমার৷
পরের দিন অফিস থেকে ফিরে দেখলাম বাড়িতে তালা ঝুলছে৷ আমি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েই দরজা খুললাম৷
যদিও অন্যদিন প্রভাতী এই সময় স্কুল থেকে ফিরে আসে৷
তবে বাড়ি হবার পর বেশ কয়েকদিন দেরি করেই ফিরছিল, হয় ঘরের পর্দা, নয়তো, ফুলদানি, শো পিস এসব কিনে আনছিলো ঘর সাজাবে বলে৷ আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আবার ওসব কিনতেই গেছে, তাই দেরি হচ্ছে৷ কিন্তু সন্ধ্যে সাতটা বেজে যেতে কেমন একটা ঠান্ডা স্রোত বুকের মধ্যে বইতে শুরু করলো৷
তবে কি রাগ করে কোথাও …
প্রথমেই প্রভাতীর মোবাইলে ফোন করলাম, সেটা আমাদের টিভির টেবিলেই বাজছে৷ ফোন ছাড়া বেরিয়েছে দেখেই ওদের বাড়িতে ফোন করলাম, না সেখানেও যায়নি৷
বিছানায় গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম আমি৷
বেডরুমের কোণের দেওয়ালে লেখা My sweet home… আচ্ছা My বলতে তো আমার অর্থাৎ অমল বসুরও বোঝায়! তাহলে আমি কাল অত রেগে গেলাম কেন! ও তো প্রভাতীর বাড়ি লেখেনি! আর যদি আমার তৈরি করা বাড়িতেও নিজের নাম লিখেও থাকতো তাহলেও তো সেটা ভালোবেসেই, অধিকারবোধ থেকেই লিখতো! আমার মাথায় আর কিছুই আসছিল না তখন৷
বড্ড হেল্পলেস লাগছিলো৷
আমি এদিক ওদিক খুঁজছিলাম, যদি কোনো চিঠি লিখে রেখে যায়…
কয়েকটি বইয়ের সাথে একটা একটা খাম পড়লো মেঝেতে৷
একটা নয় বেশ কয়েকটা চিঠি৷
সব কটারই নীচে লেখা অমল বসু৷
আশ্চর্য! এগুলো ওর লেখা চিঠি?
অথচ প্রভাতীর হাতের লেখায়৷
পড়তে পড়তে চোখ দুটো জ্বালা করছিল আমার৷
চিঠিতে প্রভাতী লিখেছে,
সেদিন ওই বাদল রঙের শাড়িটা তোমার যে খুব পছন্দ হয়েছে সেটা আমিও দোকানে বসেই বুঝেছিলাম৷ কিন্তু ট্যাগ-এর প্রাইসটা দেখে তুমি অন্য শাড়ি বাছলে, আমার কষ্ট হলো প্রভাতী৷ বিশ্বাস কর, নিজেকে অপদার্থ মনে হলো৷
কিন্তু প্রভাতী আমি তোমাকে ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি৷
এমনই ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা যেগুলো আমার মনে হয়েছিল, সেগুলো শুধু চোখের ভাষা পড়ে প্রভাতী নিজেই লিখেছে আমার নাম করে৷ নীচে সই করেছে অমল বসু৷
এতটা বুঝতো প্রভাতী আমাকে!
আমার সব না বলা কষ্টগুলোও ও এভাবে অনুভব করছে আমার হয়ে!
একটা প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্টও হাতে পেলাম আমি৷ প্রভাতী দু-মাসের প্রেগন্যান্ট৷ বাড়ির ঝামেলায় আমি এতটাই উদভ্রান্ত হয়ে ছিলাম যে আমি খেয়ালই করিনি ওকে৷
অথচ প্রেসক্রিপশনে ও প্রভাতী বসুর নিচে প্রযত্নের জায়গায় যথারীতি অমল বসুই লিখেছে৷
আমার সন্তান এখন প্রভাতীর গর্ভে৷ ভাবতেই কেমন যেন বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো৷
সন্তান আমাদের আরো আগেই হওয়া উচিত ছিল৷ শুধু তাকে যাতে কোনো দারিদ্র স্পর্শ করতে না পারে তাই প্রভাতীই বলেছিল, আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে তাকে আনবো পৃথিবীতে৷
আমি তো খেয়ালই করিনি কবে সে এসে গেছে আমাদের মধ্যে৷
তার মানে কাল আমার বলা কথাগুলো আমার সন্তানও প্রভাতীর পেটের মধ্যে থেকেই শুনেছে৷
প্রভাতীর একটা চিঠিতে সে লিখেছে, আমি বাবা হতে চলেছি প্রভাতী, তুমি আমাকে পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়াতে চলেছো৷
হয়তো প্রভাতী খুঁজছিল কোনো নিবিড় মুহূর্ত যখন কানে কানে আমাকে বলতো, আমার বাবা হবার খবরটা৷
আমার বয়ানে যে এত চিঠি লিখতে পেরেছে সে কেন বুঝলো না, আমি হঠাৎ করে রাগের মাথায় কাল অমন বলেছিলাম!
প্রভাতীর কলিগদের ফোন করেই চলছি, না কারোর বাড়ি যায়নি প্রভাতী৷
বিয়ের পর থেকে হাতে গুনে ও কয়েকদিন মাত্র বাপের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে৷ কখনো আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতো না৷
আমার ফোনটা বোকার মতো চুপটি করে পড়ে আছে সোফায়৷ আমি ভাবছি কেউ কি বাকি পরে গেল খোঁজ নেওয়া থেকে?
হঠাৎ আমার ফোনের রিংটা বাজছে… আরে সুবোধ!
সেই কলেজের সুবোধ৷ কলেজের বন্ধুদের মধ্যে জনা তিনেকের সাথেই এখনো যোগাযোগ আছে আমার৷ সুবোধ আর অনন্যার বিয়েটা হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত, তাই ওদের দুজনের সাথেই সম্পর্কটা রয়ে গিয়েছিল৷
তবে অনন্যাই সাধারণত প্রভাতীকে ফোন টোন করে, সুবোধ খুবই কম ফোন করে৷ এখন হঠাৎ ও!
ফোনটা ধরতেই চাপা গলায় সুবোধ বললো, প্রভাতী আমাদের বাড়িতে রয়েছে রে৷
ওকে দেখে মনে হলো, তোদের মধ্যে বোধহয় ঝগড়া হয়েছে৷ অনন্যাকে বলছিল, একটা লেডিস মেস খুঁজে দিতে! আমি পাশের ঘরে এসে তোকে খবরটা দিলাম৷
আর এক মুহূর্ত দেরি না করেই আমি চিঠিটা লিখে ফেললাম৷
সুবোধ-এর বাড়িতে যখন পৌঁছুলাম তখন রাত প্রায় নটা৷ সুবোধের হাতে চিঠিটা দিয়ে বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম৷
সুবোধ গিয়ে আমার শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলোই বলেছিল প্রভাতীকে ৷
সুবোধ বলেছিল, তুই তো জানিস প্রভাতী আমি বরাবরই বাংলা বানানে কাঁচা, তাই তুই যদি চিঠিটা একবার চেক করে তবে এটা অনন্যাকে দিস ,তাহলে বিয়ের আট বছর পরে আমাদের প্রেমটা আবার জমে যাবে৷
প্রভাতী কথা না বলে চিঠিটা খুলেছিল, ভালোবাসি কথাটা আজও চিঠিতে ওভার রাইটিং হয়ে রয়েছে দেখেই, ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছে হয়তো… আমি জানতাম প্রভাতী আসবে৷ আসতে ওকে হবেই৷
আমরা যে একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসি, মধ্যবিত্ত ভালোবাসায় ঐশ্বর্য্যের প্রলেপ পড়লেও তা বড্ড হিসেবী থেকে যায়, কিছুতেই নিজের জিনিসের ওপর অধিকার ছাড়তে চায়না৷
প্রভাতী সামনে আসতেই আমি বোকা বোকা হেসেছিলাম৷ ওটা আমার জন্মগত হাসি৷
তবুও প্রভাতী আমার মতো অকর্মণ্যর বুকেই মাথা গুঁজে নিজের কান্না সামলে ছিল৷
আমি কানে কানে বলেছিলাম, আমি জানি আমি বাবা হতে চলেছি৷
প্রভাতী চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তার মানে তুমি আমার লেখা সব চিঠিগুলোও পড়েছো?
আমি বললাম ওগুলো তোমার লেখা কোথায়, ওগুলোতো সব অমল বসুর লেখা৷
তারপর আমরা ফিরে এসেছিলাম, my sweet home-এ৷
এখন আমি বিয়াল্লিশের কোটায় রান করছি৷ তবুও প্রভাতীর হাতেই আমাদের সংসারের সুখের চাবি৷ আমাদের একটা মেয়ে হয়েছে, সে সবে বাবা বাবা বলে ডাকতে শিখেছে৷ মাঝে মাঝেই সে বাবার জায়গায় ভুল করে বোকা বলে ফেলছে আমাকে৷ আসলে মেয়েটার দোষ নেই, প্রভাতী মাঝে মাঝেই আমাকে বলে, বুড়িয়ে মরতে চললেও তোমার বোকা বোকা হাসিটা যাবে না৷
মেয়েটাও বুঝে গেছে আমি একটু বোকাই আছি৷
অবশ্য প্রভাতীর ওই বোকা বলার ধরনটা আমার ভীষণ মিষ্টি লাগে৷ বিয়ের দশ বছর পরও মাঝে মাঝেই প্রভাতীর ভিজে চুল আর এলোথেলো আঁচল দেখে আমার মাথায় সেই বাসর ঘরের দুষ্টু বুদ্ধিগুলো ঘুরতে থাকে৷
প্রভাতী আমার চোখ দেখেই সব বুঝে যায়, তাই আগেই বলে বসে, এখন মেয়েকে ঘুম পাড়াব৷
এই হলো আমার, মানে অমল বসুর বিয়াল্লিশ বছরের আত্মজীবনী৷
আমার মধ্যবিত্ত ভালোবাসায় কিন্তু কোনো খামতি পাবেন না আপনারা৷ আমি হয়তো আমার বউকে সুইজারল্যান্ড বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি, আইফেল টাওয়ারের সামনে চুমু খেতে পারিনি, আমি হয়তো ম্যারেজ এনিভার্সারিতে ডায়মন্ড নেকলেস ওর গলায় পরিয়ে দিতে পারিনি কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি ধর্মাবতার, আমি জ্ঞানত প্রভাতীকে ছাড়া আর কোনো মহিলাকে কখনো ভালোবাসিনি৷ আজীবন ঝগড়া ঝাটির মধ্যেও ওকেই ভালোবাসতে চাই৷