যেদিন দেখা হল
এই দাঁড়াও দাঁড়াও … আমি এখানেই নামবো ঋজু৷ ঋজু তখনো বাইকটা থামায়নি, একটু স্লো করেছে সবে, বাইক থেকে ঝপাং করে লাফ মেরে নেমে পড়লো প্রিয়াঙ্কা৷ হেলমেটটা খুলে ভ্রূ দুটো ওপরে তুলে মুখে অল্প বিরক্তির চিহ্ন মাখিয়ে ঋজু বললো, প্রিয়াঙ্কা তুমি কিন্তু টিন এজের উন্মাদনাটা পেরিয়ে এসেছো৷ তাই এভাবে চলন্ত বাইক থেকে নামার পরিণতিটা তোমার অজানা নয়৷ ঋজুর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে প্রিয়াঙ্কা বললো, শোনো কলেজ পাশ করলেই যে বুড়ি হয়ে যেতে হবে এমন মাথার দিবিব কে দিয়েছে শুনি? আমার শ্বশুর মিস্টার রাঘব রায় নাকি?
প্রিয়াঙ্কার এই আলটপকা কথাগুলোর জন্যই একমুহূর্তও চেষ্টা করেও গম্ভীর হয়ে থাকতে পারে না ঋজু৷
তবুও কপট রাগ দেখিয়ে বললো, তুমি আমার বাবাকে টানছো কেন?
প্রিয়াঙ্কা বেশ হাসি মুখে বললো, তুমি তো প্রাইমারি স্কুলের বাচচাদের মতো স্যারকে নালিশ করতে যাচ্ছ যে, স্যার আমার বাবার নাম বলেছে৷
শোনো ঋজু, আমার হবু শ্বশুরকে আমি যতদূর চিনেছি, তিনি মারাত্মক মাই ডিয়ার মানুষ৷ তাই তার ছেলে হয়ে তোমার এমন বুড়োটে হাবভাব ছাড়ো তো৷
হাত দুটো ওপরে তুলে প্রিয়াঙ্কা বললো, বাইক চালাবে যেন মনে হবে হাওয়ায় উড়ছি৷ তা নয়, খুঁজে খুঁজে এমন পাবলিকের সাথে প্রেম করছি যিনি ৪০-৫০ এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন৷ তোমার বাইকটাও সেদিন দুঃখ করে আমাকে বলছিল, আমার তো মাঝে মাঝে নিজেকে অটো মনে হয়৷ ঋজু এবার হেসে ফেলে বললো, আমার বাইকটা আজকাল তোমার সাথেও কথা বলছে?
মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ারে পড়া মেয়েটা বাচচাদের মতো নির্মল হেসে বললো, বলে তো৷ তোমার মতো গোমড়া মুখো কেউ নয়৷ ঋজু ঘাড় নেড়ে হেসে বললো, তোমার বকবকানির চোটে বাইক কেন, গাছপালা, রাস্তাঘাট সবাই তোমার সাথে কথা বলতে শুরু করবে৷
এখন যাও, তোমার ফ্ল্যাট দেখা যাচ্ছে৷
নিজের ফ্ল্যাটের বেশ কিছুটা আগেই রোজ নেমে যায় প্রিয়াঙ্কা৷ মুখে বড়ো বড়ো কথা বললে কি হবে, কমপ্লেক্সের কেউ দেখে ফেলার ভয়টা বেশ ভালোই পায় ও৷
ঋজু বললো, আমি কিন্তু তোমার হবু শ্বশুর আর শাশুড়িমাকে তোমার ছবি দেখিয়ে দিয়েছি৷ কিন্তু তুমি আজ পর্যন্ত আমার কথাটা বলতেই পারলে না বাড়িতে৷
তুমি কোনো বেকার ছেলেকেও কিন্তু বিয়ে করতে চাইছো না প্রিয়াঙ্কা! আমি যথেষ্ট ভালো জব করি৷
প্রিয়াঙ্কা বাঁদিকের গজ দাঁতটা বের করে মিষ্টি করে হেসে বললো, এক্সামটা শেষ হলেই বলবো৷ না হলে বাপি যা রাগী… হয়তো পড়াটা কমপ্লিট করতে দিলো না৷ কথাটা বলার সময় ওর চোখের উদাস দৃষ্টিটা চোখ এড়ালো না ঋজুর৷
প্রিয়াঙ্কার টপের সিগ্রিন রংটা যেন ঋজুকে মনখারাপি বাতাস উপহার দিয়ে চলে গেল৷ ঋজু জানে কমপ্লেক্সে ঢুকেও ওই বিশেষ বাঁকের ফাঁকটা দিয়ে প্রিয়াঙ্কা একবার অন্তত ঘুরে দেখবেই ওকে৷ সেই অপেক্ষাতেই ওইদিকে তাকিয়ে আরেকটু দেখার আকাঙ্খা…
প্রিয়াঙ্কা যেন একঝলক দমকা বাতাস৷ ও চলে গেলেই ওর শূন্য স্থানে গুমোট বাতাসের আবির্ভাব ঘটে৷ তখন ঋজু ল্যাপটপে অফিসের প্রজেক্টেও মন দিতে পারে না, এমনকী বন্ধুদের সাথে ক্যারাম পিটিয়েও মন ভালো করতে পারে না৷
প্রিয়াঙ্কার কথা বলার টপিক্সের শেষ নেই যেন৷ ফেসবুকের জোকস থেকে ওর পেটুক প্রতিবেশীর রান্নার আইটেম পর্যন্ত মন দিয়ে শুনতে হয় ঋজুকে৷ না হলেই অভিমানী দুটো চোখে টলমল করে জল, আর ঠোঁট ফুলিয়ে প্রিয়াঙ্কা বলে, যাও শুনতে হবে না৷ তুমি আমাকে আর একটুও ভালোবাসো না৷ এই একটুও ভালোবাসো না কথাটা শুনলেই ঋজুর ইচ্ছে করে ভরা জনগণের মধ্যেই পাগলিটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে, সারাজীবন সাথে থাকবো৷ যে কোনো পরিস্থিতিতে পাশে থাকবো তোমার৷
তবে মাঝে মাঝেই একটা অদ্ভুত সন্দেহের বীজ মনের মধ্যে মাথা চাড়া দেয় ঋজুর৷
প্রিয়াঙ্কার এত কথার মধ্যে কোনো ভাবেই ওর মায়ের কথা আসে না কেন?
বাপি বকবে, বাপির খেতে দেরি হবে…এসব শুনতে পেলেও মায়ের কথায় প্রিয়াঙ্কা একেবারে নীরব৷ এমনকী ঋজু কিছু জিজ্ঞেস করলো ও কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়৷
প্রিয়াঙ্কার সাথে ঋজুর পরিচয়টা হয়েছিল বড্ড কাকতলীয় ভাবে৷ ট্রেনের লেডিজ কম্পার্টমেন্টে৷
ছোটো মাসির বাড়ি থেকে ফিরছিল ঋজু৷ শ্রীরামপুর স্টেশনে ছুটে এসে ট্রেনে ধরেছিল ও৷ নিতান্ত ভুল করেই উঠে পড়েছিলো লেডিস কম্পার্টমেন্টে৷ গ্যালপিং ট্রেনের অনেক সুবিধার মধ্যে এই আরেক অসুবিধা৷ ইচ্ছে থাকলেও পরের স্টপেজে নামতে পারেনি ঋজু৷
কম্পার্টমেন্টে তখন মহিলাদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে৷ নেহাত ঋজুর পোশাকে ভদ্রতার ছাপ দেখেই হয়তো তখনও গালাগাল খায়নি ও৷ কয়েকজন মহিলা তো এমন ভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন, মনে হচ্ছে হঠাৎ করে কোনো অ্যানাকোন্ডার সম্মুখীন হয়েছেন৷ ঠিক সেই সময় সকলের পরামর্শে নেত্রী গোছের এক মহিলা গলা ঝেড়ে বলে উঠেছিলেন, দেখে তো ভদ্র বাড়ির মনে হয়, তো উদ্দেশ্য এমন নিচ কেন? লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে মেয়ে দেখার সুযোগ পেলে মন্দ লাগে না, কি তাই না?
ঠিক কি করা উচিত সেটা বোঝার আগেই আরো কয়েকজন শুরু করলো হাঙ্গামা৷ ঠিক তখনি গোলাপি ওড়না সামলে একটি মেয়ে বেশ চাঁচাছোলা গলায় বললো, উনি তো দরজার ধারে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আরে বলছেন তো উনি ভুল করে উঠে পড়েছেন৷ উনি দরজার ধারে দাঁড়িয়ে থাকলেও কি আপনাদের ইজ্জত যাচ্ছে? তাহলে অমন ইজ্জতকে তো ঘরে রেখে রাস্তায় বেরোনো উচিত৷
ঋজু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো, টিকালো নাকের মেয়েটার দিকে৷
এতগুলো মহিলার সামনে একজন মাত্র মেয়ে যে এমন ভাবে প্রতিবাদ করতে পারে সেটা দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না ঋজু৷
তবে ওর ওই চিৎকার করে বলার জন্যই হয়তো অন্যরাও একটু থেমে গিয়েছিলো৷ আর সেই সুযোগেই ঋজু অনভ্যস্ত চোখে তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে৷ তারপর হাওড়া স্টেশনের জনস্রোতে মিশে যাওয়ার কথা ছিলো, হারিয়ে ফেলা উচিত ছিলো দুজনে দুজনকে… তবুও দৈব আশীর্বাদের মতোই গোটা স্টেশনের জনস্রোতে ভাসতে ভাসতেও চার জোড়া চোখ বারবার চোখাচোখি হচ্ছিলো৷ তাই হয়তো স্টেশন থেকে এক্সিটের রাস্তায় ঋজু থমকে দাঁড়িয়ে কোলাহলের মধ্যেই মেয়েটাকে বলে উঠেছিলো, থ্যাংক ইউ ম্যাম… কথার রেশ টেনে মেয়েটি বলেছিল, প্রিয়াঙ্কা মিত্র৷
সেদিন রাতেই ঋজু রায় নামক একটা অ্যাকাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়েছিল প্রিয়াঙ্কা৷ প্রায় হাজার খানেক রিকোয়েস্ট পেন্ডিং থাকলেও ঋজু রায়ের বন্ধুত্ব গৃহীত হয়েছিলো মাত্র আধঘন্টার মধ্যেই৷
মেসেঞ্জারে প্রথমেই হাই না লিখে ঋজু লিখলো, সকালের ওই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার জন্য ধন্যবাদ দিয়েও কৃতজ্ঞতার ভার লাঘব করা যাবে না৷
প্রিয়াঙ্কা দুটো স্মাইলি পাঠিয়ে লিখলো, আপনি কি প্রায়ই লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়েন? আর কোনো না কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই আপনাকে বাঁচায়, আর আপনি নিশ্চয়ই তাকেও এভাবেই ধন্যবাদ দেন৷ আর নিশ্চয়ই আপনার হ্যান্ডু চেহারা দেখে সে মেয়েও…
নিজের সম্পর্কে হ্যান্ডু সার্টিফিকেট পেয়েও নূন্যতম আনন্দ হচ্ছিলো না ঋজুর৷ কি চিবিয়ে চিবিয়ে অপমান করছে মেয়েটা৷ এর থেকে তো নারীবাদীদের ঘাড় ধাক্কায় ট্রেনের নীচে পড়া ঢের ভালো ছিলো৷
ঋজু শুধু লিখলো, সরি ম্যাম… আমি কলকাতার ছেলে, তাই ওই লাইনের ট্রেনে একটু কমই চড়তে হয়৷ আর আজই প্রথম এমন ভুল হলো৷ লেডিস কম্পার্টমেন্ট-এর জায়গার পরিবর্তনের জন্যই ভুলটা হয়েছিলো, অথবা ট্রেন ঢুকে যাওয়ার পরে ছুটে এসে ওঠার জন্যই …
প্রিয়াঙ্কা লিখলো, আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে দেখলাম মহিলা মহলের হাট বসে গেছে, এগুলোও কি লেডিস কম্পার্টমেন্ট, লেডিস টয়লেটে ভুল করে যাওয়ার ফলেই হয়েছে?
ঋজু আর একটা কথাও না বলে নেট অফ করে দিলো৷ এ মেয়েটা মনে হয়, নিজের বাড়ির ভিখারিকে নিজে বিদেয় করার পক্ষপাতী৷ তাই সকলের সামনে থেকে বাঁচিয়ে এখন একা একা অপমান করে সুখ নিচ্ছে৷ এর সাথে আর একটাও কথা নয়৷
ভগবান বোধহয় ঋজুর এই সিদ্ধান্তে একচোট হেসেছিলেন সেদিন৷
তাই পরেরদিন বাইক নিয়ে অফিস বেরোনোর রাস্তাতেই জেব্রা ক্রসিং-এ কেউ একজন পাশ থেকে বলে বসলো, গাড়ির পিছনের সিটটা ফাঁকা দেখছি৷ ভুল করে কোনো মেয়েকে বসান নি দেখছি!
চমকে উঠে তাকাতেই গতকালের উদ্ধারকারিনীকে দেখে চমকে উঠেছিলো ও৷ সামলে নিয়ে বলেছিল, সুন্দরী মেয়েদের বোধহয় এরকমই ধারণা, যে বিশ্বের সব ছেলে লুজ ক্যারেক্টার৷
প্রিয়াঙ্কা মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, দুনিয়ার সবাই না হলেও আপনি যে লুজ ক্যারেক্টার সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি৷
সিগন্যাল গ্রিন হতেই বাইক স্টার্ট করেছিল ঋজু৷ পিছন থেকে এক জোড়া চোখের দুষ্টুমিমাখা হাসিকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে গিয়েছিল ওর বাইক৷
অফিসে ঢুকেই নেট অন করতেই ফার্স্ট মেসেজ…
ইস, আপনার চয়েস ভীষণ খারাপ৷ অমন অরেঞ্জ কালারের শার্ট কেউ পরে? আপনাকে স্কাই ব্লু ব্যাপক লাগবে বস৷ স্কাই ব্লু পরে দেখুন, লেডিস টয়লেটেও আপনি মার খাবেন না৷
প্রথম মেসেজটা হজম করলেও, দ্বিতীয়টা নেওয়া জাস্ট অসম্ভব ছিল৷ তাই দুটো রাগের ইমোজি পাঠিয়ে দিলো ঋজু৷
এরপর বেশ কিছুদিন মেসেজের আদানপ্রদান হয়নি৷
যখন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো প্রিয়াঙ্কা নামের মেয়েটাকে… ঠিক তখনই একদিন দেখলো, একটা কুকুর ছানাকে কোলে নিয়ে মেয়েটা বেশ উদ্বিগ্ন মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে৷
ঋজুর মনে পড়ে গেলো মুখটা৷ মিষ্টি মুখের আড়ালে ঋজুকে বলা সেইসব অপমানগুলো আরেকবার পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠলো ওর৷ বিরক্তিতে মুখটা হয়তো একটু বেঁকেই গিয়েছিল৷ তাই অন্য দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো ও৷ সেই মুহূর্তেই চিৎকারটা কানে এলো, এই যে ও ঋজু বাবু… এই যে লেডিস কম্পার্টমেন্ট… শুনেই গাটা রাগে রিরি করে উঠলো ঋজুর৷ তবুও ভদ্রতার খাতিরেই বাইকে ব্রেক কষে দাঁড়ালো৷ কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ওই মেয়েটা ওর বাইকের পিছনে এসে লাফিয়ে উঠে বসেছে কুকুর ছানা সমেত৷
একটা নরম পারফিউমের গন্ধ এসে ঝাপটা দিলো ঋজুর নাকে৷ মেয়েটা বড্ড কঠিন ধাতের হলেও সুগন্ধিটা বেশ মিষ্টি ব্যবহার করেছে৷ কিন্তু তাই বলে পারমিশন ছাড়া এভাবে লাফিয়ে বাইকে বসাটা ঠিক মানতে পারছিল না ঋজু৷ তাই ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, আপনি এভাবে আমার বাইকে! প্রিয়াঙ্কা বেশ রাগী গলায় বলল, চালাতে পারেন না? শুধু বাইকের সামনে সানগ্লাস পরে পোজ দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে মেয়েদের ইম্প্রেসড করতেই পারেন? অদ্ভুত মানুষ তো আপনি! বাইক নিয়ে ছবি দেন, অথচ ডাবল ক্যারি করতে পারেন না৷ দেখছেন আমি একটা বিপদে পড়েছি….
প্রিয়াঙ্কা নিজের মনে বকবক করেই যাচ্ছিলো৷ বেশ কিছুক্ষণ রান করার পরে ঋজু বললো, ধরে বসুন পড়ে যাবেন৷ প্রিয়াঙ্কার একহাতে কুকুর ছানা, তাই অন্য হাতটা রাখলো ঋজুর কাঁধে৷ আলতো স্পর্শে বাইকটা একবার টাল খেয়ে গেল যেন৷ প্রিয়াঙ্কা বললো, ফেলবেন নাকি? ঋজুর কাঁধের আলতো স্পর্শটা আরেকটু স্পষ্ট হলো, হয়তো পড়ে যাওয়ার ভয়েই প্রিয়াঙ্কা চেপে ধরলো ওকে৷
ঋজু বললো, বকবক থামিয়ে কোথায় যাবেন যদি বলতেন তাহলে একটু উপকার হত আরকি৷ আমার অফিসটা যেহেতু আমার শ্বশুর মশাইয়ের নয়, তাই সেখানে লেটে পৌঁছালে আমায় কৈফিয়ৎ দিতে হয়!
প্রিয়াঙ্কা খিল খিল করে হেসে বললো, ওমা… আপনি পড়াশোনাতেও ফাঁকিবাজ ছিলেন, তাই আশা করেছিলেন, যে শ্বশুরের কোম্পানিতেই চাকরি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন! এত মহা মুশকিলের পাল্লায় পড়েছে ঋজু৷
প্রিয়াঙ্কা বললো, আমি ভেটেনারি ডক্টরের কাছে যাবো… একটা বাঁক নিলেই নেমে পড়বো৷
এমনিতেও আপনার মতো মেয়েদের ইম্প্রেসড করা পাবলিকের বাইকে আমিও সেফ নই৷ অসহ্য লাগছিলো ঋজুর, এভাবে অপমান হজম করতে৷
পশু চিকিৎসালয়ের সামনে বাইকটা থামাবার আগেই প্রিয়াঙ্কা লাফিয়ে নেমেছিলো৷
অদ্ভুত মেয়ে তো, প্রাণে ভয় বলে কিছু নেই …কথাটা বলেই ঋজু বুঝেছিলো প্রিয়াঙ্কা আর দাঁড়িয়ে নেই ওর কথা শোনার জন্য৷
সে ততক্ষণে ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরে ঢুকে পড়েছে৷
সেই মুহূর্তেই ঋজুর ওখান থেকে চলে যাওয়ার কথা৷ তবুও কখনো কখনো মাথা আর মন একসাথে কাজ করতে নারাজ হয়৷ মাথা বলছে চলে যেতে, মন টেনে ধরে আছে, প্রিয়াঙ্কাকে এভাবে এখানে ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক নয় বলে সমানে বুঝিয়ে চলেছে ঋজুকে৷ অবশেষে মনের কাছে মাথা হার স্বীকার করলো৷ আজ অফিসে বসের কাছে দায়িত্ব নিয়ে গালাগালি শুনবে বুঝেও বাইক স্টার্ট নিলো না৷
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে কুকুর ছানাটাকে কোলে নিয়ে প্রিয়াঙ্কা বেরোচ্ছিলো … ওকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই একমুখ হেসে বললো, বুঝলাম … আপনার জবটাও আপনি শ্বশুরকে ধরেই পেয়েছেন, তাই এভাবে অফিস টাইমে লেট করতে পারলেন৷
ঋজু কথা ঘুরিয়ে বললো, আপনার পাপি এখন ঠিক আছে?
প্রিয়াঙ্কা অবাক হয়ে বলল, এ আমার পাপি নয় ঋজু বাবু৷ আমার বাপি বাড়িটাকে চিড়িয়াখানা বানানোর পক্ষপাতী নয়৷ এ আমাদের বাড়ির সামনের ড্রেনের ধারে পড়েছিলো৷ মা মারা গেছে কাল ভোরে৷ তাই সকাল থেকে কুঁইকুঁই করে কেঁদে যাচ্ছিলো৷ আমি ইউনিভার্সিটি যাবার আগে দেখতে পেলাম৷ মা মরা বাচচা তো, কেউ দেখার নেই৷ তারপর দেখলাম কানের পাশে লালচে হয়ে রক্ত জমেছে৷ তাই ডক্টর দেখিয়ে নিয়ে গেলাম৷ মা ছাড়া কদিন বাঁচবে কে জানে৷ একটু অন্যমনস্ক হয়েই বললো, তবে মা ছাড়াও সন্তানরা বাঁচে বুঝলেন!
ঋজুর মনটা যে ভিতরে ভিতরে ভিজে গেছে সেটার ছবি বোধহয় বাইরেও কিছুটা এসে পড়লো৷ আচমকা বললো, আপনি কি ছোটো থেকেই এই স্পিডে কথা বলেন?
ধরুন, এই কথার ফোয়ারা যখন ছোটাতে পারেন না তখন তারা কোথায় থাকে যদি সে ব্যাপারে কিছু বলেন!
প্রিয়াঙ্কা এতক্ষণে বেশ জোরে হেসে বললো, এই প্রথম আপনি একটা দারুন প্রশ্ন করলেন৷
ঋজু আলতো করে বললো, আপনাকে কি বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে?
বাইকের পিছনে বসেই ঋজুর কাঁধে হাতটা রাখলো প্রিয়াঙ্কা৷ এবার আর বলতে হলো না, ধরে বসুন৷ একটা হাতের স্পর্শে যে রক্তের শিরা উপশিরারা এভাবে তাদের চলার পথ বদল করে, লাফালাফি করতে শুরু করবে সেটা একটু আগে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ঋজু৷ ওর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যখন দ্রুতগামী তখনই আচমকা প্রিয়াঙ্কা বলে বসলো, প্রেম করেন আপনি?
আরেকটু হলেই একজন ঝাঁকাওয়ালাকে ধাক্কা দিতো ঋজু৷ কোনোমতে সামলে নিয়ে বললো, কেন লেডিস কম্পার্টমেন্টে ভুল করে উঠে পড়লে বুঝি তাকে নির্ঘাত প্রেমও করতে হয়!
প্রিয়াঙ্কা বললো, আপনি মশাই বড়ো আনরোম্যান্টিক৷
একটা মেয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটুকুও জানেন না দেখছি৷
প্রিয়াঙ্কার নির্দেশেই ওর কমপ্লেক্সের একটু দূরে ওকে নামিয়ে দিয়েছিলো ঋজু৷
প্রিয়াঙ্কা বলেছিলো, আপনার ফোন নম্বরটা দিন৷ যেদিন আমার টোটোয় বা অটোতে চাপতে ইচ্ছে করবে সেদিন আপনাকে ডাকবো৷
একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঋজু বলেছিল, ঠিক বুঝলাম না৷ আমি টোটো চালাই আপনাকে কে বললো?
প্রিয়াঙ্কার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি… চল্লিশ স্পিডে যারা বাইক চালায় আমি তাদের তাই মনে করি৷
ফোন নাম্বার না দিয়েই বাইকে স্টার্ট দিয়েছিলো ঋজু৷
রাতেই মেসেঞ্জারে মেসেজ ঢুকলো, আমার ফোন নম্বরটা রাখুন৷
প্রিয়াঙ্কা নিজের দশ ডিজিটের নম্বরটা সেন্ড করেছিলো ঋজুকে৷
ঋজু বুঝতে পারছিলো, তার এই ছাবিবশ বছরের জীবনে তীব্র গরমে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করে বসন্ত প্রবেশ করেছে৷ তাই সেদিন খাবার টেবিলে মায়ের মেয়ে দেখার কথা উঠতেই বলে ফেলেছিলো, আমি যদি কাউকে পছন্দ করি তাহলে কি তোমাদের আপত্তি থাকবে?
বাবা, চিকেনের টুকরোটা মুখে ভরে বললো, ওই প্রিয়াঙ্কা নামের মেয়েটা? যার প্রোফাইল পিকচারের কমেন্টে তুই সেদিন বিউটিফুল বানানটা ভুল লিখেছিলি৷ হ্যাঁরে তোকে আমি কনভেন্টে পড়িয়েছিলাম রে৷ এতটা এক্সসাইটমেন্টের কি আছে… যে বানান ভুল করতে হবে? মা ফিসফিস করে বললো, আমাকেও দেখিও তো মেয়েটিকে৷
আধ খাওয়া খাবার ফেলেই নিজের ঘরে পালিয়েছিল ঋজু৷ মনে মনে বলেছিল, এইজন্যই ফ্রেন্ড লিস্টে কোনোদিন বাবা মাকে রাখতে নেই!
তারপরেই প্রিয়াঙ্কার ফোন নম্বরে ফোন করে বলেছিলো, কাল দেখা হতে পারে?
প্রিয়াঙ্কা বলেছিল, কোথায়… লেডিস পার্লারে?
আর ধৈর্য্য না রাখতে পেরে ঋজু বলেছিল, বেশ পার্লারের বাইরেই না হয় অপেক্ষা করবো৷
না পার্লারের সামনে নয়, ওদের দেখা হয়েছিলো, ইডেন গার্ডেনের সামনে৷ বেশ কিছুক্ষণ কথা ছাড়াই ওরা পাশাপাশি হেঁটেছিলো৷ প্রিয়াঙ্কার মতো মোস্ট টকেটিভ মেয়েও চুপচাপ পা মেলাচ্ছিলো ঋজুর সঙ্গে৷ শুধু ওদের ঘন নিঃশ্বাস আর আঙুলে আঙুলে হঠাৎ ছুঁয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলোই বলে দিচ্ছিলো ওদের মনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস৷
থমকে দাঁড়িয়ে ঋজু বলেছিলো, বিশ্বাস করো, আমি লেডিস কম্পার্টমেন্টে ইচ্ছে করে উঠিনি৷ বিশ্বাস করো, আমি মেয়েদের দেখার জন্য কখনো লেডিস টয়লেটে যাইনি… কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়াঙ্কা বলেছিল, জানি৷ সেদিন ট্রেনে তোমার অসহায় চোখদুটো আমি পড়তে পেরেছিলাম, আমিও ওই দিন বড়ো মামার বাড়ি থেকে ফিরছিলাম৷ তোমার চোখ দুটোই বলেছিল, তুমি অসাবধানতার শিকার হয়েছো…
ঋজু হাঁটু গেড়ে সামনে বসে বলেছিলো, এখন আমার চোখ দুটো পড়ে বলতো… কি বলতে চাইছে সে৷ প্লিজ হেল্প মি৷
প্রিয়াঙ্কার লজ্জা পাওয়া মুখে শেষ বিকেলের আলো পড়েছে৷ ঋজু বোকার মতো তাকিয়ে বললো, বিউটিফুল৷
ঠোঁটটা টিপে হাসি চেপে প্রিয়াঙ্কা বললো, বানানটা ভুল করেছিলে যেদিন সেদিনই বুঝেছি তুমি… কথা শেষ না করেই চোখটা নামিয়ে নিলো প্রিয়াঙ্কা৷
ওদের সম্পর্কটা ছোট্ট কাগজের নৌকায় চেপে ভাসতে ভাসতে পাড়ি জমিয়েছিল পরিণতির দিকে৷ ঋজুর বাড়ির সকলেরই প্রিয়াঙ্কাকে পছন্দ৷ কিন্তু প্রিয়াঙ্কা এখনো ঋজুর কথা জানায়নি বাড়িতে৷
ঋজু অনেক অভিযোগ করেছে এ নিয়ে৷ প্রায় একবছর হতে চললো ওদের সম্পর্ক… এখনো কেন ঋজুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলো না প্রিয়াঙ্কা, এই নিয়েও রাগারাগি করেছে ও, কিন্তু প্রতিবারই প্রিয়াঙ্কা এড়িয়ে গেছে৷ মনোমালিন্য শেষ হয়ে আবার ওদের ভালোবাসার নৌকায় পাল তুলেছে ওরা, কিন্তু তবুও নিজের কমপ্লেক্সের কিছুটা দূরেই বাইক থেকে নেমে পড়েছে প্রিয়াঙ্কা৷ ঋজুর বাড়িতে বিয়ের জন্য কথা চলছে বলেই রাতে ফোন করে ও প্রিয়াঙ্কাকে বললো, বাবা মা তোমাদের বাড়িতে যেতে চায়৷
প্রিয়াঙ্কা বললো, বাড়িতে না এসে বিয়েটা হবে না তাই না ঋজু? আসলে আমি চাইছি না ওনারা বাড়িতে আসুন৷
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করেই ছিলো ঋজু৷
কয়েকদিন ধরেই প্রিয়াঙ্কা কিছুতেই ঋজুর ফোনটা রিসিভ করছে না৷ এমনকী হোয়াটস অ্যাপেও অনলাইন নেই৷ বিয়ের কথা বলতেই এমন পরিবর্তন আশা করেনি ঋজু৷ তবে কি প্রিয়াঙ্কার এত ভালোবাসা সব অভিনয় ছিলো? অফিসে কাজের ফাঁকে অন্যমনস্ক ঋজু বারবার কল করছে প্রিয়াঙ্কাকে ৷ আজ তিনদিন ধরেই ফোনটা সুইচ অফ৷ ওর বান্ধবী পারমিতাও কিছু বলতে পারলো না৷ এক্সাম শেষ, তাই আর ইউনিভার্সিটিও যাচ্ছে না ওরা৷
এদিকে বাড়িতে বাবা ডিনার টেবিলে বললো, কি রে.. প্রিয়াঙ্কার বাবা-মায়ের সাথে কথা বললি? সামনের রবিবারটাই ফাইনাল করে ফেল তাহলে৷
টানাপোড়েনে অস্থির হয়ে গেছে ঋজু৷ অবশেষে কোনো উপায় না পেয়েই ঠিক যেখানে ও মাঝে মাঝেই প্রিয়াঙ্কাকে বাইক থেকে নামিয়ে দিতো সেখানে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো৷ বাইক থেকে লাফিয়ে নেমেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে টাটা দেওয়ার কথাটা মনে পড়ে গেলো ঋজুর৷ প্রিয়াঙ্কা যেন ওর মনের সবটা টাটকা বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে৷ নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ঋজুর৷ তবুও ভয়ে ভয়েই ওদের কমপ্লেক্সের দিকে এগুলো ও৷ এই বাউন্ডারিটা গত একবছরে পার করতে দেয়নি প্রিয়াঙ্কা৷ দূর থেকেই ওদের ফ্ল্যাটটা দেখেছিল ঋজু৷
একটু যে নার্ভাস লাগছে না তা নয়, তবুও ভালোবাসার টানেই ও এগিয়ে গেল হলুদ আর নীল রঙের ব্যালকনিটার দিকে৷ ওদের ফ্ল্যাটটা থার্ড ফ্লোরে৷ লিফটের ভরসা না করেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো ও৷ প্রতিটা পদক্ষেপে একটা অজানা আতঙ্ক৷ প্রিয়াঙ্কা কি ওকে আর চায় না?
তাই এভাবে ইগনোর করছে ওকে! শেষ পর্যন্ত ওদের দু-জনের একসাথে দেখা স্বপ্নগুলো কি বিফলে যাবে?
কাঁপা হাতে ওদের ফ্ল্যাটের বেলটা বাজালো ঋজু৷ নেম প্লেটে ওর বাবার নাম দেখেই শিওর হলো৷
দরজাটা যিনি খুললেন, তাকে দেখে বোঝাই যায় তিনি এ বাড়ির পরিচারকা নন৷ আবার বয়েসের হিসেব করলে প্রিয়াঙ্কার মা বলে ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে৷
ঋজু আমতা আমতা করেই বললো, প্রিয়াঙ্কা আছে…আমি ওর বন্ধু৷
ভদ্রমহিলা গম্ভীর গলায় বললেন, ওই নামে তো এবাড়িতে কেউ থাকে না?
ঋজু ঘাবড়ে গেছে৷ তবে কি প্রিয়াঙ্কা নিজের পরিচয়টাও মিথ্যে দিয়েছিলো? এত মিথ্যে কেন বলবে প্রিয়াংকা! মাথার ভিতর সব গুলিয়ে যাচ্ছিলো ওর৷
মহিলার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ঋজু বললো, কিন্তু এটাই তো প্রমথ বাবুর বাড়ি৷ ওনার মেয়েই তো প্রিয়াঙ্কা….
মহিলা গম্ভীর ভাবে বললেন, বলছি না ওই নামে কেউ নেই৷
ফিরে আসবে ভেবেই পিছন ফিরলো ঋজু, ঠিক সেই সময়ই ভীষণ পরিচিত গলায় কেউ ডেকে উঠলো… ঋজু প্লিজ যেও না৷
পা দুটো থমকে দাঁড়িয়ে গেছে ঋজুর৷
ওই মহিলা দরজাটাকে আটকে রেখেছিলেন, যাতে ঋজু ভিতরটা দেখতে না পায়৷ ঋজু মহিলাকে কিছুটা ধাক্কা মেরেই ঢুকে গেলো ভিতরে৷
ভিতরের একটা ঘর থেকেই আবার আওয়াজটা এলো… ঋজু আমি এই ঘরে৷
ঘরটা ঠেলতেও খুলছিলো না দেখেই ঘুরে দাঁড়িয়ে মহিলাকে বললো, দরজাটা খুলবেন, নাকি আমি পুলিশে খবর দেব?
মহিলাও আরেকটু গলা চড়িয়ে বললো, খবর দিন… কিন্তু আমিও বলবো, আপনি জোর করে এই বাড়িতে ঢুকে…
কথা শেষ হবার আগেই, ঋজু পকেট থেকে ফোনটা বের করলো৷
মহিলা চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই অবিন্যস্ত প্রিয়াঙ্কা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঋজুর বুকে৷ প্লিজ বাঁচাও৷
জু একটু হকচকিয়েই গেছে৷ উচ্ছল, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মেয়েটার কি এমন হলো, যে চোখের নিচে কালি, চুলগুলো রুক্ষ, পোশাক অগোছালো…
প্রিয়াঙ্কার গালে শুকনো জলের রেখা দেখেই মাথার মধ্যে আগুন ধরে গিয়েছিল নিতান্ত শান্ত মাথার ছেলেটারও৷ প্রিয়াঙ্কার মুখের মিষ্টি হাসিটাই ঋজুর মনখারাপ ভালো করার চাবি কাঠি, সেই হাসিটাই যখন কান্নায় পরিবর্তিত হয়ে গেছে তখন আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না ঋজু৷
প্রায় চিৎকার করেই বলে ফেললো, ইনি কে? প্রিয়াঙ্কা বলো ইনি কে?
প্রিয়াঙ্কা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমার মা৷
মা! মা তোমাকে আটকে রেখেছিলো কেন?
আমার সৎ মা… আমার যখন ক্লাস ফাইভ তখন আমার মা মারা যায়, আমাকে যত্ন করার জন্য বাপি ওনাকে এ বাড়িতে এনেছিলো৷ তারপর আমার বাপিকে ব্ল্যাকমেল করে বিয়ে করে রয়ে গেছেন এ বাড়িতে৷ আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করে গেছেন, শুধু সমাজের ভয়ে আমরা চুপ করেছিলাম, বাপির চাকরির ভয়ে চুপ করে থাকতে হয়েছিলো আমাদের৷ আমি চেষ্টা করেছিলাম, বিশ্বাস করো, ওনাকে মা করে নিতে৷ ভালোবেসে আপন করতে চেয়েছিলাম৷ পারি নি, হেরে গেছি৷ তোমাকেও বলিনি, যদি তুমি দূরে সরে যাও আমার থেকে তাই…
সেদিন আমি বাড়ি ফিরে বাপিকে তোমার আর আমার বিয়ের কথাটা বলার পর থেকেই , আমার বাপিকে খাবারে মধ্যে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, আর আমাকে বন্ধ করে রেখেছে৷
আমার বিয়েতে বাপি গয়না, টাকা খরচ করবে বলেই এমন করছে৷
ঋজু অস্ফুটে বললো, মা ডাকের আগে একটা ছোট্ট শব্দ বসায় মানুষটার এতটা পরিবর্তন হয়ে যায়! এটা ধারণাই ছিল ওর৷ এতদিন জানতো মা মানেই অনেকগুলো না বলা অনুভূতির সমন্বয়৷ আজ বুঝলো, সৎ মা শব্দের অর্থ সম্পুর্ন আলাদা৷
প্রিয়াঙ্কা বললো, ঋজু দিনরাত বাড়ির এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাসি মুখে ঘুরতাম বলেই হয়তো কেউ বুঝতেই পারে নি, হাসির আড়ালেও কষ্ট লুকিয়ে রাখা যায়৷
প্রিয়াঙ্কার গলাটা ধরে এলো শেষের দিকে৷
পাশের ঘরে প্রিয়াঙ্কার বাপি ঘুমাচ্ছিলেন৷ প্রিয়াঙ্কা ডেকেও তুলতে পারছিলেন না ভদ্রলোককে৷ ঋজু বাইরে এসে দেখলো, মহিলা আর নেই৷ গোটা ফ্ল্যাট খুঁজেও তাকে পেলো না ওরা৷
সম্ভবত পুলিশের ভয়েই পালিয়েছে৷
প্রিয়াঙ্কা আর ঋজু তবুও পুলিশে একটা ডায়রি করে রাখলো, ছবি সমেত৷
দিন দশেক পরে ঋজুর বাবা মা গিয়েছিল ওদের ফ্ল্যাটে প্রিয়াঙ্কার সাথে বিয়েটা ফাইনাল করতে৷ বাড়ি ফিরে থেকে বাবা ঋজুকে দেখলেই মুচকি মুচকি হাসছিলো, দেখেই সন্দেহ হলো ঋজুর৷ ভ্রূ কুঁচকে বললো, বাবাই তুমি আমাকে দেখে হাসছো কেন? আমি কি জোকার?
রাঘব বাবু হেসে বললেন, ভাগ্যের কি পরিহাস রে, আমার সাথে তোর মায়ের দেখা হয়েছিলো, কলেজের লেডিস টয়লেটে৷ প্রথম দিন কলেজে ঢুকেই এত মেয়ে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে গন্ডগোল পাকিয়েছিলাম, আর তোদের শুনলাম, লেডিস কম্পার্টমেন্টে!
তার মানে হবু শ্বশুরের কাছে কোনো কথাই বলতে বাদ রাখেনি প্রিয়াঙ্কা৷
রাতে ফোন করেই ঋজু বললো, আর কি কি গল্প করলে শ্বশুর মশাইকে…
প্রিয়াঙ্কা বললো, বেশি কিছু নয়… শুধু বললাম, তুমি বার তিনেক আমাকে চুমু খেতে এসেও লোক জন দেখে ফেলবে বলে ব্যর্থ হয়েছো… আর বার দুয়েক আমার ইউনিভার্সিটির সামনে ঘাবড়ে গিয়ে আমার বদলে অন্য মেয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য ঝাড় খেতে খেতে খাওনি… আর …
ঋজু বললো, আরো কিছু ছিল নাকি আমার ইতিহাসে?
প্রিয়াঙ্কা বললো, ছিল তো! সেই বন্য মুহূর্ত যখন তুমি হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে আই লাভ ইউ বলেছিলে, আর আমার মতো নির্লজ্জ মেয়েও লজ্জা পাচ্ছিলো… সেটার কথাটা আমি সকলের কাছে থেকে চেপে গেছি৷
ঋজু বললো, সামনের মাসের দশ তারিখটা আসতে একটু বেশিই দেরি করছে তাই না?
প্রিয়াঙ্কা বললো, জানো ঋজু, তোমার মা আমাকে কথা দিয়েছেন, আমাকে মা শব্দের সঠিক অর্থ বোঝাবেন, ভালোবাসা দিয়ে৷ আমি আবার মা পাবো৷
তারমানে আমার ভালোবাসাটা কেড়ে নেওয়ার ধান্দায় আছো? বলেই মুচকি হাসলো ঋজু৷
আলতো হেসে ফোনটা কেটে দিলো প্রিয়াঙ্কা৷
মেসেজ ঢুকলো… যেদিন তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো, সেটাই ছিল আমার জীবনের সব থেকে শুভক্ষণ৷