অবশেষে খুঁজে পেলাম তোমাকে
আর যাই করিস ওই মেয়ের দিকে ভুলেও তাকাস না সৌম্য, একবার যদি তোর লাইফে ঢোকে তাহলে তোর কেরিয়ার ফিউজ হয়ে যাবে গুরু৷ শত হস্ত দূরে থাক ওই ডেঞ্জারাস সুন্দরীর থেকে৷ ওকে তুই কাঁটা গাছের ফুল ভাব রে৷ রিতেশ না বললেও জুঁইকে ভালো করেই চেনে সৌম্য৷ মেয়েটার সব ভালো কিন্তু এত ফাঁকিবাজ যে পড়াশোনার নামে জ্বর আসে৷ কেতকি আন্টি মানে জুঁইয়ের মা সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাকে যেন একটা বলছিলেন, মেয়েটাকে নিয়ে জ্বলে গেলাম দিদি৷ ওর মাধ্যমিকের আগে ওর বাবার হাই প্রেশার হয়ে গিয়েছিলো৷ দিনরাত ভাবতো, মেয়ে আমার ফেল করলে, লোক সমাজে মুখ দেখাবো কি করে! ওর উচচমাধ্যমিকের সময় তো ওই নাস্তিক মানুষ ভোর থেকে কালীমন্দিরের চাতালে ধর্ণা দিয়ে পড়েছিলো, মেয়ে যেন পাশটুকু করে মুখ রক্ষে করে৷ না হলে স্কুলে লজ্জায় ঢুকতে পারতো না ওর বাবা৷ লোকে বলতো, হেড মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে কিনা ফেল করেছে! এখন দেখো.. দিনরাত স্কুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওই নামেই কলেজে ভর্তি হয়েছে৷ আমি তো রোজ বলি, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও, না হলে শুধু প্রেশার কেনো তোমার হার্টের ভাল্ব ব্লক হতেও সময় লাগবে না৷ সৌম্যকে দেখেই কেতকি আন্টি আবার বললেন, আমাদের বিট্টুকে দেখো, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়৷ যখনই দেখি তখনই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পড়তে যাচ্ছে৷ প্রশংসায় কুপোকাত হয় না এমন মানুষ নেই বললেই চলে৷ সৌম্যও হেসে বলেছিলো, আন্টি আপনাদের শরীর ভালো তো? স্যার ভালো আছেন?
কেতকি আন্টি আবার নাক টেনে একই সুরে বলেছিলেন, আর ভালো! তোদের স্যার তো ওই এক মেয়ের চিন্তা করে করেই দেহ রাখবেন রে৷
জুঁইয়ের বাবা বিতান বসু হাই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই, কেমিস্ট্রির শিক্ষক৷ এ অঞ্চলে ওনার বেশ নাম ডাক আছে৷
এখন অবশ্য ওনাকে নিয়ে কম ওনার মেয়েকে নিয়ে আলোচনা বেশি হয়৷ সকলের মুখেই এক কথা, কি বাবার কি মেয়ে! মাধ্যমিক, উচচমাধ্যমিকে কোনো মতে পাশ করে কলেজে ঢুকেই এক্সট্রা পাখনা লাগিয়েছে জুঁই৷ দিনরাত যেন উড়ে বেড়াচ্ছে৷ মাস্টারমশাইকে দেখলে খারাপ লাগে৷ ওনার হাত দিয়ে কত ভালো ছেলে মেয়ে বেরোলো, আর নিজের মেয়েটাই একটা জলজ্যান্ত হনুমান হয়েছে৷
সন্ধ্যে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, ফুটবল খেলার মাঠে সৌম্য, রিতেশ আর অয়ন বসেছিলো৷ সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাওয়া পার্পেল কালারের স্কুটিটা যে কার, সেটা বুঝতে কারোর কোনো অসুবিধা হলো না৷ ওকে দেখেই বিশেষজ্ঞের মতো রিতেশের বিখ্যাত উক্তি বেরিয়ে এলো৷ সৌম্য চোখটা সরিয়ে বললো, ভাবলি কি করে ওই বই বিমুখ মেয়েকে আমি আমার লাইফে ঢুকতে দেবো! যদিও বলার সময় গতবছর সরস্বতী পুজোর দিন দেখা জুঁইয়ের হালকা গোলাপি ঢাকাই পরা মুখটা মনে পড়ে বুকের রক্ত একটু হলেও ছলকে উঠলো ওর৷
অয়ন বরাবরই একটু চুপচাপ৷ কিন্তু ওর নেটওয়ার্ক খুব ভালো৷ তাই ও যেটা বলে তার সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই চলে না৷ অয়নই বললো, এত সুন্দরী অথচ এখনো কারও প্রেমে পড়েনি কিন্তু৷ এই তো সেদিন আমাদের পাড়ার ভলিবল প্লেয়ার সুমনদা জুঁইকে প্রোপোজ করেছিলো, তো মেয়ের কি রাগ! বলে কিনা, লেখাপড়ায় খারাপ ছেলেকে নাকি সে বিয়ে করতে পারবে না৷ রিতেশ বললো, যা বাবা…ও নিজেই তো ফেলুরাম৷ অয়ন বললো, তা বলতে পারবো না৷ তবে সুমনদা রাতে ক্লাবে এসে হাসছিলো আর বলছিলো, তাই শুনলাম৷ যাক বাবা, লোকের কথা ভেবে লাভ নেই, ওদের এবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ার৷ তাই এসব নিয়ে আলোচনা করার সময় নেই বললেই চলে৷ বরং গ্রূপ স্টাডি করলে কাজ দেবে৷ বিশেষ করে সৌম্য ব্যানার্জির ওপরে শুধু ওর বাবা-মা নয় গোটা কলোনির একটা আলাদা এক্সপেক্টেশন আছে৷ কারণ সৌম্যর প্রতিটা রেজাল্ট লোককে গর্ব করে বলার মতোই৷ এমনকি জয়েন্টেও ও প্রথমের দিকেই র্যাঙ্ক করেছিলো৷ তাই একচান্স-এ ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই চান্স পেয়ে গিয়েছিলো৷
বাড়ি ঢুকতেই মা গম্ভীর গলায় বললো, বিট্টু এই কয়েকটা মাস একটু মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর, বিকালের এই মাঠের আড্ডাটা না হয় কয়েকদিন বন্ধ থাক৷ আমার কলিগরা সকলেই বলেন, তোমার ছেলে তো ক্যাম্পাসিঙেই দারুন কিছু পাবে৷ তোর কাছে তো বেশ কিছু ভালো কোম্পানির অফারও এসেছিলো ফোর্থ ইয়ারের প্রথমেই৷ মানসম্মান টুকু রাখিস৷ শেষে যেন বিতান বাবুর মত আমারও সম্মান নিয়ে টানাটানি না হয়৷ সৌম্যর মা একটা নামি গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা৷ ছেলেকেও নিজের মনের মতো করেই বড়ো করেছেন৷ সৌম্যও ছোটো থেকে মায়ের আদর্শেই মানুষ হচ্ছে৷ বাবা তো বেশির ভাগ সময় কাজের সূত্রে বাইরেই থাকেন৷ মাসে হয়তো একবার আসেন৷ ব্যাঙ্গালোর থেকে রেগুলার রাতে ফোন করে বাবাই প্রথম খোঁজ নেন, সৌম্যর পড়াশোনাটা কেমন চলছে৷ এত বায়না করেও মায়ের কাছ থেকে সাইকেলের বেশি কিছু আদায় করতে পারেনি সৌম্য৷ উচচমাধ্যমিকের পর একটা মোবাইল ফোন৷ ওদের কলেজে প্রায় বেশির ভাগ বন্ধুই বাইকে আসে৷ সৌম্য আজও বাসে চেপেই কলেজ যায়৷ টুকটাক যাওয়ার জন্য ওর সাইকেল আছে৷ মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় ওর৷ ও তো মন দিয়েই পড়াশোনা করে, তবুও কেন যে মা এত শাসন করে কে জানে! রিতেশ, অয়ন পর্যন্ত ওর মাকে ভয় পায়!
দক্ষিণের জানালাটা খুলে পড়তে বসলো সৌম্য৷ হঠাৎই একটা চিরকুট এসে গায়ে পড়লো৷ খুলতেই দেখলো লেখা রয়েছে, পড়ে পড়েই একদিন বুড়ো হবে তুমি৷ তারপর তোমার চুল পেকে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, তুমি লাঠি নিয়ে হাঁটবে, তখনো তুমি পড়েই যাবে৷ এত মোটা মাথা নিয়ে কি পড়ো বলতো? আমার তো পরীক্ষার আগে তিনদিন পড়লেই সব মুখস্ত হয়ে যায়৷
চিরকুট পড়া শেষ করে তাকাতেই দেখলো, স্কুটির ওপরে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে কিছু একটা খাচ্ছে জুঁই৷ আর ওর দিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসেই চলেছে৷
ওর হাসিটা দেখেই রাগে পিত্তি জ্বলে গেল সৌম্যর৷ বেশ জোরেই চেঁচিয়ে বললো, পরীক্ষার আগে দু-দিন পড়লে ওই থার্ড ডিভিশনই জুটবে৷
ফেলুরাম কোথাকারের৷
জুঁই জিভ ভেঙিয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দিলো৷
ওর ওই উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতেই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো সৌম্য৷ হঠাৎই চোখের সামনে জানালাটা বন্ধ হতে দেখে চমকে উঠলো৷
ধীর গলায় মা বললো, আমি এসি টা চালিয়ে দিচ্ছি৷
পড়ার সময় অন্যমনস্ক হওয়ার দোষেই যে রাস্তার ধারে দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল সেটুকু বুঝতে দেরি হলো না সৌম্যর৷ কোনো মতে পায়ের নিচে চিরকুটটা চালান করেছে সৌম্য৷ যদি একবার মায়ের হাতে ওটা পড়ে, তাহলে কাল সকালেই মা বিতান বাবুর বাড়িতে গিয়ে ওনাকে আর ওনার মেয়েকে অপমান করে আসবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত৷ মালিনী দেবী সবকিছুতে ছাড় দিলেও, ছেলের পড়াশোনা নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করবেন না৷
মা চলে যেতেই চিঠিটা আরেকবার পড়লো সৌম্য৷ এখন আর রাগ হচ্ছে না জুঁইয়ের ওপর৷ বরং বেশ মজা লাগছিলো৷ ও তো না হয় পড়াশোনা করতে করতে বুড়ো হয়ে যাবে বলে ভবিষ্যৎ বাণী করেছে মেয়েটা৷ কিন্তু একবারও ভাবে নি যে পড়াশোনা না করে করে ও কি খুকি থাকবে! ঠোঁটের কোণে আলগা হাসির রেখাটা ছুঁয়ে গেল সৌম্যকে৷ বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা সব ফুল ফুটিয়ে দিয়ে সালংকরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কাঁচের জানালার ভিতর দিয়েও লাল রঙের আধিক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সৌম্যর চোখে৷ সেদিকে তাকিয়েই নিজেকে প্রশ্ন করলো সৌম্য, আচ্ছা ও কেন জুঁই এর চিঠিটা আড়াল করলো মায়ের কাছ থেকে! কেন জুঁইকে মা অপমান করুক সেটা চাইছে না ও! তবে কি….
রিতেশের সাবধান বাণী কানে বাজলো যেন, ওই মেয়ের দিকে ভুলেও তাকাস না সৌম্য, তোর ফিউচার ডুম হয়ে যাবে রে৷ মেয়েটা এমনিতে তো খারাপ নয়, কিন্তু কেন যে একটু ভালো করে পড়াশোনা করে না, আর সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে কে জানে! স্যার তো একটু শাসন করতেও পারেন মেয়েকে৷ অবশ্য লোকে বলে, স্যার নাকি কোনোভাবেই ওই মেয়েকে পড়তে বসাতে পারেন না৷ ধুত্তোর, গোটা সন্ধ্যেটা যাবে ওই মেয়ের কথা ভেবে ভেবে৷ জোর করে নিজের পড়ায় মন দিলো সৌম্য৷ তবুও কেন যে আজ বারবার জুঁইয়ের ওই নোজ রিং পরা মুখটা ভেসে উঠছে বইয়ের পাতায় সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না সৌম্য৷ চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে জুঁইয়ের মুখ ভেসে ওঠা বেইমান বইটাকে দূরে সরিয়ে রেখে অন্য বই খুলে বসলো ও৷ সেখানেও ওই বিছুটি মেয়ের হানাদারি শুরু হলো৷ রিতেশ ঠিকই বলেছিল, বিকেলে ওই মেয়ের দিকে তাকানোটাই পাপ হয়ে গেছে সৌম্যর৷ তাছাড়া জুঁইকে তো আজ থেকে চেনে না সৌম্য, একই পাড়ার বাসিন্দা হিসাবে শুধু নয়, জুঁই-এর বেশ কিছু দুষ্টুমির ভিক্টিম হয়েছিলো ও নিজে৷
জুঁই সৌম্যর থেকে বছর চার পাঁচের ছোটো হবে৷ তাই ক্লাস টেনে পড়ার সময় জুঁইকে ছোটো মেয়ে বলে স্নেহ করেই একদিন বৃষ্টির মধ্যে টিউশন থেকে ফেরার পথে রাস্তায় নিজের সাইকেলে চাপিয়েছিলো সৌম্য৷ কিছুটা আসার পরই পিছন ফিরে দেখছিলো, কেরিয়ারে জুঁই নেই৷ সন্ধ্যেবেলা, বর্ষাকালে মেয়েটা কোথাও পড়ে গেলো ভেবেই ভিজে ভিজেও ওকে খুঁজতে শুরু করেছিল সৌম্য৷
এমনিতেই ওর ঠান্ডা লাগার ধাত, ভিজে জামায় বেশিক্ষণ থাকলে অবধারিত জ্বর আসবে কাল৷ তবুও মেয়েটা রাস্তায় যেচে ওর সাইকেলে চাপতে চেয়েছিলো বলেই দায়িত্ব একটা থেকেই যায়৷ বৃষ্টিটা জোরে আসায় পুরো ভিজে গিয়েছিলো ও, তখনই খেয়াল করলো, নীলচে ফ্রক পরে একটা মেয়ে বেমালুম মুখার্জী কাকাদের বাগান থেকে বেলফুল তুলছে৷ তীব্র বৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছিলো না, তবুও কাছে গিয়ে বুঝলো ওটাই জুঁই৷ আপন মনে ভিজে ভিজে ফুল তুলছে৷ সৌম্য রেগে গিয়ে বলেছিল, তুমি যে আমার সাইকেলে চেপে বললে, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে, তাহলে এখানে কি করছো? মেয়েটা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, হাবলুরাম, ভালো করে সাইকেলটাও চালাতে পারে না৷ পিছনের মানুষটা যে লাফিয়ে নেমে পড়েছে সেটাও বোঝে না৷ বোকার মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সৌম্য বলেছিল, নেমে পড়লে কেন?
জুঁই নিশ্চিন্ত মনে বলেছিল, এই যে এত ফুল দেখলাম বলে!
জুঁই এমনই বেআক্কেলে, বলেছিলো কেতকি আন্টি৷ ওরাও নাকি সন্ধ্যের থেকে মেয়েকে খুঁজে বেরোচ্ছিলো৷ পার্ক থেকে কখন যে মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো কেউ টেরও পায়নি৷ জুঁই সেই ফাইভ-সিক্স থেকেই মারাত্মক চঞ্চল৷ আর যত কূট বুদ্ধি ওর মাথাতেই বাসা বাঁধে৷ সেদিন রাতেই সৌম্যর জ্বর এসেছিলো৷ মা বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, সৌম্য বৃষ্টিতে ভিজেছিলো কিনা! সৌম্য জ্বরের ঘোরেও বলেনি, কার জন্য ও সেদিন ভিজেছিলো!
মায়ের বকুনি চুপচাপ সহ্য করেছিলো৷ তবুও জুঁইয়ের নামটা সামনে আসতে দেয়নি!
আরেকবারের অভিজ্ঞতাও আছে সৌম্যর৷ ওই মেয়ের পাল্লায় পড়ে হিমশিম খাওয়ার কথাটা আজও মনে আছে ওর৷
স্কুলের সরস্বতী পুজোয় দারুণ করে সেজে অঞ্জলী দিচ্ছিলো জুঁই৷ সৌম্য কানের পাশে গিয়ে বলেছিলো, ঠাকুরকে ডাকো যেন মাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করিয়ে দেন৷
আচমকা এক ঘর স্টুডেন্টের সামনে জুঁই বলেছিলো, হ্যাঁ ঠাকুরকে বলছিলাম, আমার হবু বরের যেন অনেক বিদ্যে হয়৷ আমার ছেলে-মেয়েদের তো সেই পড়াবে তাই তার শিক্ষাটা খুব জরুরি৷ মেয়েরা সবাই হি হি করে হেসে উঠেছিলো৷ দিদিমনির ছেলের বোকা বোকা মুখ দেখে মেয়েগুলোর হাসি থামতেই চায় না৷ কি কুক্ষণে যে মায়ের সাথে মায়ের স্কুলে পুজো দেখতে এসেছিল সেটা ভেবেই নিজের মাথায় চাটি মারতে ইচ্ছে করছিল৷ জুঁইয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত দুটো মেয়ে বললো, হ্যাঁরে জুঁই মালিনী ম্যামের ছেলেই বুঝি তোর…
মিচকি হেসে জুঁই বলেছিল, তোরা যে কি করে সব বুঝে ফেলিস! সৌম্য এত পড়ে বলেই তো আমি আর পড়ি না৷ বাবা-মা দুজনে শিক্ষিত হয়ে কি হবে বল! যে কোনো একজন ছেলে-মেয়েদের পড়ালেই চলবে৷ কান দুটো লাল হয়ে গিয়েছিলো সৌম্যর৷ ছুটতে ছুটতে টিচার রুমে এসে মাকে বলেছিল, আমি এখুনি বাড়ি যাবো৷
মা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষিকারাও জিজ্ঞেস করেছিলো, কেউ কি কিছু বলেছে সৌম্য? মেয়েরা কি খারাপ ব্যবহার করেছে তোমার সাথে?
জুঁই নামটা ঠোঁটের ডগা থেকে গলার মধ্যে দিয়ে গিলে নিয়ে বলেছিলো, মা আমি নিজের কলেজে যেতে চাই৷ সব ফ্রেন্ডসরা ওখানে আছে৷ মা একটু রাগী চোখে তাকিয়ে বলেছিল, সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে এসো৷
কোনো মেয়ে যে এভাবে ইনসাল্ট করতে পারে সেটা ধারণাই ছিল না সৌম্যর৷
ওই ঘটনার পর থেকেই জুঁইকে দেখলেই সৌম্য একটু এড়িয়েই চলে৷ তবে খবর সবই কানে আসে৷ উচচমাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন মা যখন নিজের স্কুলের রেজাল্ট বলছিল, তখন ও আলটপকা জিজ্ঞাসা করেই ফেলেছিলো, জুঁই পাস করেছে মা?
মা মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর ভাবে বলেছিলো, হ্যাঁ আমাদের বিনোদিনী স্কুলের বদনাম ওই মেয়ে৷ কোনোমতে থার্ড ডিভিশনে পাশ করে আনন্দে সবাইকে চকলেট খাওয়াচ্ছিলো৷ দেখো আমার ব্যাগেও একটা চকলেট আছে৷ লজ্জা বলে এতটুকু কিছু নেই ওই মেয়ের৷ খারাপ লাগে বিতান বাবুর মতো জ্ঞানী মানুষটার মুখ দেখে৷ মানুষটা লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেছেন৷ ওসব কথা আর কানে ঢুকছিলো না সৌম্যর৷ ভিতরে ভিতরে খুব আনন্দ হচ্ছিলো ওর৷ যাক, আজ আর কদমতলার মাঠে কেউ বলতে পারবে না বিতান বাবুর মেয়েটা ফেল করেছে জানিস৷ সকাল থেকেই বেশ টেনশনে ছিল সৌম্য৷ চুপি চুপি মায়ের ব্যাগ থেকে চকলেটটা বের করে মুখে ঢুকিয়ে হেসে ছিল ও৷ যেন খুব কাছের কারোর সাকসেসের আনন্দ পেয়েছিল৷ যদিও সৌম্যর এমন হবার কারণটা তখনো ওর অজানাই রয়ে গিয়েছিলো৷ আসলে জুঁইয়ের নাম শুনলেই সবাই নাক কুঁচকে বলতে শুরু করে, ওই মেয়ের মতো নির্লজ্জ নাকি একটাও নেই এ চত্বরে, কাজ নেই কর্ম নেই চবিবশ ঘন্টা টংটং করে ঘুরেই চলেছে, তাই জুঁইকে নিয়ে কারোর সাথেই কথা বলতে পারে না সৌম্য৷ এমনিতেই ওই ঠোঁট কাটা মেয়ের জন্য সৌম্যর কোনো বন্ধুরা ওকে সহ্য করতে পারে না৷ ক-দিন আগেই অয়নকে দেখে জুঁই নাকি বলেছে, আরে বিদ্যাসাগরের সেকেন্ড এডিশনের আর একজন কোথায়? অয়ন বলতে গিয়েছিলো, তুমি লেখাপড়ার ধারে কাছে যাও না বলে কি কেউ করবে না? জুঁই সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, তোমার বন্ধু সব পড়ে নিচ্ছে বলেই আমি আর চাপ নিচ্ছি না৷ অয়ন এসে বলেছিলো, বুঝলি সৌম্য জুঁইয়ের মতিগতি কিন্তু ভালো নয় রে, তোর ওপর চাপ আছে৷
সৌম্য লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিলো, ধুর তোদের ভুল ধারণা৷ চাপ থাকলে কেউ সকলের সামনে অমন অপমান করতে পারে?
রিতেশ গম্ভীর চালে ওর মন্তব্য ছুঁড়ে ছিলো… আরে তুই পাত্তা দিস না বলেই বিরক্ত হয়ে ওসব করে! তবে বস, আগে থেকে বলেই দিচ্ছি, তোর মা কিন্তু ওই গান্ডু মেয়েকে কিছুতেই নিজের বউমা বলে মানবে না৷ গবেট মেয়ে হবে কিনা আমাদের ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার সৌম্য ব্যানার্জির বউ? তাছাড়া তোর মায়ের কথাটাও ভেবে দেখিস, মালিনী ম্যাম কি করে তার স্কুলের সব থেকে অগামার্কা মেয়েকে মেনে নেবেন বলতো!
রিতেশের কথা শুনে ভিতরে ভিতরে কেমন একটা রাগ হচ্ছিলো সৌম্যর৷ আচমকা বলে বসেছিলো, জুঁই গবেট তো তোর কি? অকারণ ওর নামে এসব বাজে কথা বলছিস কেন রে? জুঁই তোর কোনো ক্ষতি করেছে কি?
সৌম্যর এই হঠাৎ রাগ দেখেই রিতেশ মিচকি হেসে বলেছিলো, তুমি গুরু শেষ, বেশি করে পড়াশোনা করো, ছেলে মেয়েদের তোমাকেই পড়াতে হবে কিনা!
সৌম্য পালিয়ে বেঁচেছিলো সেদিন৷
আর মাত্র এক সপ্তাহই বাকি আছে সৌম্যর ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার৷
দিনরাত এক করে খেটে চলেছে ও৷ এটা ওর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ৷ তাছাড়া এই রেজাল্টের ওপর ওর ভবিষ্যৎওে নির্ভর করছে৷ সেদিনও সন্ধ্যেবেলা একটা এরোপ্লেন চিঠি উড়ে এসে পড়লো ওর গায়ে৷ দূরে যথারীতি জুঁই দাঁড়িয়ে আছে৷ কিন্তু আজ আর হাসি নেই মুখে, বরং একটু যেন বিষণ্ণ৷
চিঠিটা খুলতেই দেখলো, প্রথমেই লিখেছে …সামনেই তোমার এক্সাম, আমি জানি তুমি দারুণ পরীক্ষা দেবে৷ আমি জানি তুমি সাকসেসফুল হবেই৷ আর বোধহয় বেশি দিন তোমার ওপরে অত্যাচার করবো না৷
চিঠি থেকে চোখ তুলে দেখলো, জুঁই আর নেই৷ রাস্তাটা ফাঁকা ৷
মনে মনে একটু হাসলো সৌম্য৷ যাক মেয়েটা অবশেষে শান্ত হয়েছে৷ পরিষ্কার লিখেছে, সে নাকি আর সৌম্যকে অত্যাচার করবে না৷ হয়তো লেখা পড়ায় মন বসেছে জুঁইয়ের৷ নিজের জগতে ডুবে ছিল সৌম্য বেশ কয়েক সপ্তাহ৷
আপাতত কিছুটা নিশ্চিন্ত৷ এক্সাম শেষ৷ এখন জবের জন্য অপেক্ষা৷
ওদের বন্ধুদের সন্ধ্যের আড্ডাটা আবার বেশ জমে উঠেছে ফুটবল খেলার মাঠে৷
সেদিনও ঝালমুড়ি খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো, ওরা নিশ্চয়ই ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিতে জব পাবে, একে অপরের থেকে দূরে চলে যাবে৷ রিতেশ হয়তো ব্যাঙ্গালোর চলে গেল… কারণ রিতেশ ক্যাম্পাসিং-এ ব্যাঙ্গালোরের একটা কোম্পানির কাছ থেকে অফার পেয়েছিল৷
ইস, এই আড্ডাটা মিস করব৷
সৌম্য ঘনঘন জুঁইদের বাড়ির রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল৷ এই সময় তো মেয়েটা স্কুটি চালিয়ে কোনো একটা টিউশন থেকে ফেরে৷ বন্ধুরা বলে টিউশন বলিস না ,বল গপ্পো করে ফেরে জুঁই৷
সৌম্যর অবাধ্য চোখ দুটো বন্ধুদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করেই বারবার চলে যাচ্ছিল জুঁই-এর বাড়ি ফেরার রাস্তার দিকে৷ সেই পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে মেয়েটাকেও আর দেখেনি সৌম্য৷ তাছাড়া ওর ওই দুষ্টুমিভরা চিঠিগুলোও মিস করছিলো ও৷
মেয়েটা বড্ড ঠোঁট কাটা, ক্যাটক্যাট করে শুনিয়ে দেয় ঠিকই তবে ওর বড়ো বড়ো চোখ দুটোতে যে সারল্য খেলা করে সেটাই ওকে আকর্ষণীয়া করে তুলেছে সৌম্যর কাছে৷ অয়ন বললো, ওদিকে তাকিয়ে আর চাপ নিও না বস, জুঁইকে বোধহয় দেখতে এসেছিলো৷ বিতান স্যার বিধান দিয়েছে, ও যদি পার্ট ওয়ানে পাশ না করতে পারে, তাহলে মানে মানে শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে শ্বশুরবাড়ি বিদেয় করবে! রিতেশ সঙ্গে সঙ্গে ফোরন কাটলো, আহারে কার কপাল যে পুড়বে তা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন৷
যা বাবা! জুঁইয়ের বয়েস কত! মাত্র উনিশ …এই বয়েসে কেউ বিয়ে দেয়? স্যারের মতন শিক্ষিত মানুষ এটা কি করে করতে পারেন?
আরে কেতকি আন্টি বলছিলেন, ওই মেয়েকে বিদেয় না করলে নাকি বিতান স্যার ওর চিন্তায় চিন্তায় হার্টের রোগ বাঁধিয়ে ফেলবেন৷
তাই আরেকবার ফেল দেখবার আগেই মানে মানে কারোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন আরকি!
সৌম্য বললো, আরেকবার ফেল মানেটা কি! জুঁই কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ক্লাসে ফেল করেনি৷ পাশটুকু অন্তত করেছে…
অয়ন হেসে বললো, সৌম্য ওই ভাবে পাশ করাকে পাশ বলে না, বোর্ডের দয়া বলে রে৷
বাড়ি ফিরে মনমরা হয়ে বসেছিল সৌম্য৷ মেয়েটা যতই দস্যি হোক তাই বলে এত কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাবে ভেবেই কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিলো৷ তাছাড়া আজ অবধি কেউ যেটা জানে না, সেটা হলো জুঁইয়ের ওই গুন্ডামিগুলোও বড্ড ভালো লাগে সৌম্যর৷ কালী পুজোর রাতে যখন চকলেট বোমের আওয়াজে কলোনি চমকে ওঠে, তখনও পথ চলতি লোক বলে ওঠে, উফ! মাস্টার মশাইয়ের মেয়েটা যে কি ডাকাত৷
জুঁইয়ের ওই দিনরাত ছেলেদের মতো পোশাক পরে সবেতে নাক গলানোর স্বভাবটাই যেন বেশি টানে ওকে৷ সেই মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে, লোকের ঘরে রান্না করতে দেখলে সত্যিই কষ্ট হবে সৌম্যর৷ রাতে ছটফট করতে করতেই ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিলো সৌম্যর৷ যদিও আজ ওর ঘুমটা খুব দরকার৷ কারণ আগামী কাল ওর একটা ইম্পর্টেন্ট ইন্টারভিউ আছে, সকাল দশটার মধ্যেই পৌঁছাতে হবে ওকে৷ ভোর রাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল সৌম্য৷ স্বপ্নের মধ্যে জুঁই এলো লাল ঢাকাই শাড়ি পরে, একটু দূর থেকে হাত নেড়ে বললো, চললাম সৌম্য…. আর তোমাকে জ্বালাবো না৷
ধড়ফড় করে উঠেই দেখলো, মা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে৷ ইশারায় বললো, ঘড়ি দেখ৷
তাই তো আটটা বেজে গেছে৷ মা রেডি হচ্ছিলো স্কুলে যাবার জন্য, বাবা সকাল সকাল বেস্ট অফ লাক জানালো ফোনে৷ মা নিজের রেডি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই সৌম্যর ব্রেকফাস্ট রেডি করতে করতে বললো, তুই বরং আজ গাড়িতে করে চলে যা, আমি না হয় শ্যামল কাকুকে বলে দিচ্ছি৷ শ্যামল কাকু বহুদিনের পরিচিত ড্রাইভার৷
কিন্তু শ্যামল কাকুকে ফোন করেও পাওয়া গেলো না৷ সৌম্য বললো, জাস্ট রিল্যাক্স মা, আমি ট্যাক্সি ধরে নেবো মোড়ের মাথা থেকে৷
রাস্তায় বেরোতেই বিপদের গন্ধ এসে নাকে লাগলো৷
কোনো এক ট্যাক্সি চালকের গায়ে হাত দিয়েছিল প্যাসেঞ্জার, তাই রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে সমস্ত ট্যাক্সি চালকরা৷ নিত্য যাত্রীদের চূড়ান্ত হয়রান অবস্থা৷ কিন্তু সৌম্যর হাতে মাত্র ঘন্টা খানেক সময়, তার মধ্যে ওই অফিসে পৌঁছাতে না পারলে আজকের ইন্টারভিউটা মিস হয়ে যাবে৷ পিছনে বাসের লম্বা লাইন, অটো চালকরা বসে তাস খেলছিলো৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ কোথাও নড়বার ইচ্ছে নেই তাদের৷
মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক অসহায়ের মতো তাকাচ্ছিল সৌম্য৷ ঠিক সেই সময় কেউ কানের কাছে এসে বললো, এসো, কোথায় যাবে চলো পৌঁছে দিই৷
ডেনিম জিন্সের ওপরে ক্রিম কালারের টপ, পায়ে স্নিকার, চোখে সানগ্লাস….
প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল সৌম্য৷ তারপর বুঝলো, মেয়েটা আর কেউ নয়, বিখ্যাত জুঁই বসু৷
সৌম্য বললো, রাস্তায় জ্যাম দেখছো না? এর মধ্যে স্কুটিও চলবে না৷ জুঁই ফিচেল হেসে বললো, চিন্তা নেই৷ মালিনী ম্যামের গুড বয়কে আমি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো না৷ উফ, এই মেয়েটা কি কোনো কথাই সোজা করে বলতে পারে না?
জুঁই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, দেখো গুরু তোমার সামনে যখন সব রাস্তা বন্ধ, তুমি যখন ফিরে যাবে ভাবছো তখন যদি একটা কচ্ছপও তোমাকে দ্রুত পৌঁছে দেবে বলে, তাহলে তোমাকে হেল্প নিতেই হবে৷
সৌম্য বললো, জ্ঞানের ঘর তো রীতিমতো টনটনে৷ আর কথা না বাড়িয়ে নিজেকে ওই বিচচুর স্কুটিতে সমর্পণ করলো সৌম্য৷ মেয়েটা লোকের বাড়ির গলি দিয়ে, কারোর বাগানের গেট খুলিয়ে, কোনোভাবে পেরোলো এলাকার জ্যামটা৷ তারপর তো সৌম্য বুঝতেই পারছিল না ও রয়াল এনফিল্ডে বসে আছে নাকি টমটমি স্কুটিতে৷ কারণ এই মুহূর্তে জুঁই যে স্পিডে আশে পাশের গাছপালাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে, এই স্পিড স্কুটিতে ওঠে বলে সৌম্যর জানা ছিল না৷ পাক্কা পনেরো মিনিট আগেই সৌম্যকে ইন্টারভিউ অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলো জুঁই৷
সৌম্য থ্যাংকস জানিয়ে ছুটছিলো লিফটের দিকে৷
পিছন থেকে ওর হাতটা ধরে টানলো জুঁই৷
হাতে একটা ছোট্ট চিরুনি নিয়ে বললো, চুলটা ঠিক করে দিই প্লিজ৷ এমন এলোমেলো চুলে কেউ ইন্টারভিউ দিতে যায়!
সত্যিই বড্ড ঘেঁটে গিয়েছিলো সৌম্যর চুলগুলো, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির আয়নায় দেখতে পেলো ও৷
জুঁই আলতো করে ছোঁয়ালো চিরুনিটা৷ সৌম্যর গোটা শরীরটা সেকেন্ডের জন্য অবশ লাগছিলো যেন৷ অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছিলো মন৷ এমন উরনচন্ডী মেয়েও এত কেয়ারিং হতে পারে! চুল ঠিক করতে করতেই সৌম্য বললো, আজ বিকেলে একটু দেখা করা সম্ভব তোমার সাথে?
ঘাড় নেড়ে জুঁই বললো, কোথায় জানিও, চলে যাবো৷
কোনোমতে জুঁইয়ের ফোন নম্বরটা নিয়েই ছুটলো সৌম্য৷ পিছন থেকে তখনও জুঁইয়ের বেস্ট অফ লাক ভেসে আসছিলো৷
পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখলো অন্তত গোটা কুড়ি মিসকল হয়ে গেছে মায়ের৷ মাকে একটা কল করে জানিয়ে দিলো, ও সেন্টারে পৌঁছেছে৷ পরে কল করে সব বলবে৷
ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেরোনোর আগেই সৌম্য বুঝতে পারছিল, জবটা ওর হবে৷
সেন্টার থেকে বেরিয়েই ফার্স্ট ফোনটা করলো জুঁইকে৷ বার দুয়েক বাজার পরে বিরক্ত গলায় বলল, হ্যালো…
সৌম্যর গলা পেয়েই উচ্ছসিত হয়ে বলল, বলো কেমন হলো! অবশ্য আমি জানতাম তুমি পারবেই৷ স্বয়ং বিদ্যাসাগর মারা গিয়ে বলে তুমি জন্মেছো… জুঁইয়ের কথার ঝাঁপি বন্ধ হবে বলে মনে হলো না সৌম্যর৷ তাই একটু চেঁচিয়েই বললো, ভালো হয়েছে, বিকেলে মায়াকানন পার্কের সামনে থেকো৷
জুঁই ওকে স্কুটি করে পৌঁছে দিয়েছে শুনেই মায়ের মুখের শিরাগুলো কঠিন হলো৷ সেটা লক্ষ্য করেও সৌম্য বললো, আজ জুঁই না থাকলে যে কি হত! মা একটু বিরক্ত হয়েই বললো, ওকে একটা থ্যাংকস জানিয়ে দিও৷
সৌম্যর তখন দৃষ্টিপথে একটাই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি চলছে, ওর হাত টেনে ধরে চিরুনি নিয়ে জুঁই বলছে, চুলটা ঠিক করে দিই প্লিজ৷
যা খামখেয়ালি মেয়ে, বিকেলে আসবে তো…
ভেবে ভেবেই বাকি সময়টা কাটিয়ে দিলো সৌম্য৷ সাড়ে পাঁচটার একটু আগেই পার্কের সামনে পৌঁছে গেল ও৷
চারিদিকে খুঁজেও পার্পেল স্কুটির দর্শন পেলো না৷ প্রতিটা মুহূর্তকে এক একটা ঘন্টা মনে হচ্ছিলো ওর৷
মিনিট পনেরো অপেক্ষার পর মহারানির দেখা পাওয়া গেলো৷ এসেই বললো, আমি কি দেরি করে ফেললাম?
সৌম্য বললো, না আমিই আগে এসেছি৷
সব থেকে বিরল দৃশ্যের দর্শক হলো আজ সৌম্য৷ জুঁইও লজ্জা পেল৷ চোখ দুটো নামিয়ে নিয়ে বললো, বলো কি বলবে?
আশে পাশের লোকের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সৌম্য বললো, হঠাৎ বিতান স্যার তোমার বিয়ে দিতে চাইছেন কেন? মানে এত কম বয়সে…
কথা শেষ হবার আগেই একরাশ অভিমান ঝরা গলায় জুঁই বললো, ফেলুরাম মেয়ে, তাই বাবার প্রেস্টিজ ডাউন হয় বুঝলে? আমি যদি পার্ট ওয়ানে পাশ করি তাহলে আমাকে আরও দুটো বছর গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হবে, নাহলে এ বছরই সানাই বাজবে বাড়িতে৷ বলার সময় চোখদুটো একটু ছলছল করে উঠলো জুঁইয়ের৷ বললো, বাবার যখন ইচ্ছে আমাকে পর করেই দেবে তখন তাই করুক৷
সৌম্য দ্রুতগামী গাড়িগুলোর দিকে চোখ রেখে বললো, কিন্ত তুমি পাশ করলে আমরা আরও দুটো বছর সময় বেশি পাবো৷ আমারও এস্টাব্লিশ হবার জন্য দু বছর এখনো চাই জুঁই৷
জুঁইয়ের মুখে এখন ডুব সূর্যের লালচে আভা৷
সৌম্য রিপিট করলো কথাটা, আমাকে আরও দুটো বছর তুমি দেবে না জুঁই?
কিন্তু মালিনী ম্যাম কি…
মাকে রাজি করানোর দায়িত্বটা আমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করো৷ দুটো বছর পরে যদি তোমার বাড়ির সানাইটা বাজে, আর বর বেশে যদি আমাকে দেখো তাহলে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে জুঁই?
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জুঁই বললো, তোমাকে দুটো বছর আমি দিলাম৷
রাতে খাওয়ার টেবিলেই মায়ের সম্মুখীন হলো সৌম্য৷ খুব সাবধানে বললো, মা আমি জুঁইকে ভালোবাসি৷ আকাশ থেকে পড়লেও বোধহয় এতটা চমকে উঠতো না মালিনী দেবী৷ তার বিট্টু, তারই ছায়ায় বড়ো হওয়া বিট্টু কিনা তারই চোখের দিকে তাকিয়ে ওই বখে যাওয়া মেয়েটাকে ভালোবাসার কথা জানাচ্ছে! এর থেকে আশ্চর্যের আর কি বা হতে পারে!
তবুও চমকের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে মালিনী দেবী বললেন, লজ্জা করবে না, নিজের স্ত্রী গ্র্যাজুয়েট নয় এটা লোককে বলতে পারবে? তুমি জানো না বিতান বাবু সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে ওই মেয়ের জন্য ছেলে দেখছেন, ও মেয়ে কলেজের গন্ডি পেরোতে পারবে না বলেই আমারও বিশ্বাস৷
সৌম্য দৃঢ় স্বরে বললো, আসলে কি জানো মা, তোমরা শিক্ষক শিক্ষিকারা ভালো ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে অভ্যস্ত৷ তারা তোমাদের স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে এই আশায় তাদের জন্যই তোমরা সবটুকু এনার্জি খরচ করো, আর মিডিওকারদের তোমরা ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না’ বলে বলে তাকে আরও পিছিয়ে দাও৷ বিতান বাবুও তাই করেছেন বাবা হিসাবে, আর তুমিও একই ট্রিটমেন্ট করেছো শিক্ষিকা হিসাবে৷ তাই জুঁইয়ের মনে বদ্ধপরিকর ধারণা জন্মে গেছে ও পারবে না৷ একবার যদি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে, তুই নিশ্চয়ই পারবি, দেখতে ও স্টার না পেলেও ফার্স্ট ডিভিশন ঠিক পেতো৷
মাকে চমকে দিয়েই সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সৌম্য৷ ছেলের বলে যাওয়া কথার অনুরণন চলছিল মালিনী দেবীর মনে৷ বিট্টু কি ঠিকই বলছে… সত্যিই তো জুঁইকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে সকলের সামনে অপমান ছাড়া তো আর কিছু করেননি কোনোদিন৷ জুঁই পড়া পারেনি বলে বকেছেন, কিন্তু কি করে পারবে তার উপায় তো কখনো খোঁজেন নি৷ এবার বোধহয় মিডিওকার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আরেকটু ভাবা উচিত মালিনী দেবীর৷ মাঝে মাঝে ছোটোরাও না বুঝেই দারুণ সত্যিগুলো তুলে ধরে৷ ছেলের কাছেও আজ নতুন করে শিখলেন উনি৷
সৌম্য রোজ জুঁইকে ফোন করেই জিজ্ঞেস করে, মনে রেখো তোমার পরীক্ষা আর মাত্র একমাস৷ আর মাত্র পনেরো দিন… মাত্র সাতদিন…
দিনরাত টং টং করে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা এখন চুপচাপ বই-এর পাতায় নিজের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছে৷ কালো কালো অক্ষরগুলো ওকে হাতছানি দিয়ে বলছে, জুঁই পাশ করতে পারলেই তোকে সবাই ভালো বলবে… সৌম্যর স্বপ্ন পূরণ হবে৷ সৌম্যকে বন্ধুরা আর বলবে না, জুঁইয়ের দিকে তাকাস না৷
কলেজের রেজাল্ট আউটের দিন সৌম্যও জুঁইয়ের কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এটা শুধু জুঁইয়ের চ্যালেঞ্জ নয়, এটা ওদের যৌথ লড়াই৷ একে একে জুঁইয়ের সব বন্ধুরা বেরিয়ে আসছে৷ জুঁইয়ের দেখা নেই, টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো সৌম্যর৷
জুঁই তো বলেছিল, পরীক্ষা ভালোই দিয়েছে ও৷ অয়ন শুনে বলেছিল, ওরে সৌম্য ও মেয়ে তিনটে প্রশ্নের উত্তর লিখলেই ভাববে দারুণ পরীক্ষা দিয়েছি৷
ভয়ে ভয়ে কলেজের গেটের দিকে তাকাচ্ছিল সৌম্য৷
জুঁইয়ের মাথা নীচু করে হাঁটার ভঙ্গিমা আর চোখে জল দেখেই যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে সৌম্যর৷
হেরে গেল সৌম্য৷ মায়ের সামনে, বিতান স্যারের সামনে চূড়ান্ত পরাজয় হলো ওর৷
কানের কাছে এসে জুঁই বললো, নাও তোমাকে দিলাম আরও চারটে বছর!
সৌম্য প্রায় চিৎকার করে উঠলো, পাশ করেছো জুঁই?
ঘাড়টা ধীরে ধীরে নাড়িয়ে জুঁই বললো, পাশ নয়, ভালো রেজাল্ট হয়েছে আমার৷ প্রফেসররাও বোধহয় চমকে গেছেন৷ তাই ওনাদের সাথে কথা বলতে গিয়েই একটু দেরি হলো৷
সৌম্য বললো, চলো জুঁই …তোমার হবু শাশুড়িমাকে প্রনাম করে আসবে৷ জুঁই ঘাড় নেড়ে বললো, এখন না দুবছর পরে কলেজের গন্ডি পেরিয়ে তারপর যাবো৷
সৌম্য বললো, দু বছর চেয়েছিলাম চার বছর কেন দিলে বুঝতে পারলাম না৷
জুঁই আলতো হেসে বললো, ভাবছি গ্র্যাজুয়েশনের পর মাস্টার্সটাও করে নেবো৷ তাহলে আর কেউ বলতে পারবে না, সৌম্য ব্যানার্জি একটা অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছে৷
সৌম্য হাসতে হাসতে বললো, দেখেছো জুঁই শুধু আমি নয় তুমিও পারো, তুমিও পারবে৷
দূর থেকেই গানটা ভেসে এলো ওদের দুজনের কানেই… আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে … দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি…