প্রেমের বাইরে
শোনো, রিয়া ওসব বন্ধু ফন্দু ছাড়ো৷ আমি বলে দিয়েছি তোমার যাওয়া হবে না তো হবে না৷ বাবার গুরুগম্ভীর গলার সামনে একটু মিইয়ে যায় রিয়া৷ এমনিতে ওর ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য পাড়ার লোকেরা ওকে বেশ সমীহ করেই চলে৷ এমনকী রিয়ার মাও মেয়েকে একটু সমঝেই চলে৷ একমাত্র বাবার কাছেই জব্দ হয়ে যায় ও৷
দিনসাতেক ধরে প্ল্যান করা আছে দীপ্তর সাথে মুভি দেখতে যাওয়ার৷ ডেনিম জিন্সের ওপরে রেডিস টপ, চুলে পনিটেল বেঁধে চোখে সবে মাত্র কাজলের রেখাটা টানছে এমন সময় রমেন বাবু হঠাৎ কেন নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন সেটাই বুঝতে পারছে না রিয়া৷ আর্মি অফিসারদের মেজাজ বোঝা দায়৷ বাবা বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকেন না৷ কর্মক্ষেত্র থেকে ফোন করেই রিয়ার খোঁজ নেন৷ এখন মাস খানেক ছুটি… তাই বাড়িতেই ডিউ কাজগুলো কমপ্লিট করেন উনি৷ ওনার এই ছুটির দিনগুলোই রিয়ার শাসনের মধ্যে থাকার সময়৷ তবে দীপ্তকে নিয়ে বাবা মা কোনোদিনই কিছু বলেননি, দুই বাড়িতেই জানে ওরা একে অপরের পরিপূরক৷ ওদের বন্ধুত্বটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতোই সর্বজন বিদিত৷ আজ হঠাৎ কি এমন হলো যে বাবা দীপ্তর সাথে রাস্তায় বেরোতে বারণ করছে! বাবার মুখের ওপর প্রশ্ন করার সাহস ওর নেই, আবার দীপ্তকে কষ্ট দেবার অধিকারও ওর নেই৷ ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়েছে রিয়া, বারবার দীপ্তর ফোন আসছে… হয়তো আইনক্সের সামনে দাঁড়িয়েই ফোনটা করছে ও৷ বাবার চোখে ধুলো দিয়ে বেরোতে পারবে না রিয়া৷ ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ওর,তারপরেই একটা তীব্র রাগ, বিতৃষ্ণা জমা হচ্ছে মনের মধ্যে৷ নিজের ঘরে ঢুকেই দীপ্তকে বললো, তুই একা দেখে নে মুভিটা, আমার যাওয়া হলো না রে৷ দীপ্তকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোনটা সুইচ অফ করে দিলো রিয়া৷ রিয়া জানে দীপ্ত এই মুহূর্তে কি করছে… বেশ কিছুক্ষণ উদাসী চোখে মুভির পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ছিঁড়ে ফেলে দেবে টিকিট দুটো৷ তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে রিয়ার হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ করবে,মাথা ঠান্ডা কর পাগলি৷ রাগ করিস না৷ আরেকদিন আসবো আমরা মুভি দেখতে৷
রিয়ার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, দীপ্ত কি করে বুঝতে পারে যে ওকে কষ্ট দিয়ে রিয়া কিছুতেই ভালো থাকতে পারে না! হয়তো দ্বিগুন কষ্ট পায় ও নিজেই৷
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে হোয়াটস আপ ওপেন করে রিয়া দেখলো, আজ কোনো মেসেজ নেই৷ অবাক হওয়ার থেকেও বেশি ভয় পেলো ও৷ কোনো বিপদ হলো না তো দীপ্তর! হৃৎপিন্ড দ্রুতগামী হলো, বাইকটা বড্ড স্পিডে চালায় জানোয়ারটা৷ তাহলে কি কোনো অ্যাকসিডেন্ট! নিজের মুখেই হাত চাপা দিয়ে আতঙ্ক চাপার চেষ্টা চালাচ্ছিল ও৷
বার তিনেক ফোন করে এখন ক্লান্ত লাগছে রিয়ার৷ মন আর মস্তিস্ক দুটোই বিকল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে৷ কি হলো দীপ্তর! এর জন্য দায়ী একমাত্র রিয়া৷ ও-ই দীপ্তকে বলেছিল, একদিন অফিস থেকে ছুটি নে, আমার প্রিয় হিরোর মুভিটা থ্রি ডি তে দেখতেই হবে৷ যদি রিয়া জোর না করতো, অথবা বাবার চোখে ধুলো দিয়ে যদি রিয়া যেতে পারতো, তাহলে হয়তো… দুচোখ বেয়ে নোনতা জলের ধারা নামছে ওর৷
শুধু রিয়ার জন্যই মিনতি আন্টি তার একমাত্র সন্তানকে হারালো৷ হয়তো রিয়া যায়নি বলেই মনখারাপ ছিল দীপ্তর, তাই বাইকটা গতিবেগ হারিয়ে… আর ভাবতে পারছে না রিয়া৷ হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ওর৷ মনে পড়ে যাচ্ছে বহু পুরোনো সব স্মৃতি৷ বহু পুরোনো হয়েও যারা টাটকা বাতাসের মতো৷
যোগমায়া কোয়েড স্কুলের ক্লাস সিক্সের দুদিকে ঝুঁটি বাঁধা মেয়েটা ক্লাস এইটের ছেলেটাকে সাইকেল গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ উঁচু গলায় বললো, এই আমার সাইকেলের চেনটা পড়ে গেছে, একটু তুলে দিবি?
ছেলেটা চমকে উঠেই সামলে নিয়ে বলেছিল, আগে উঁচু ক্লাসের ছেলেকে তুই নয় তুমি আর দাদা বলতে শেখ, তারপর হেল্প করবো৷ মেয়েটি মুখটা ১৮০ ডিগ্রী বেঁকিয়ে বলছিল, আমি সমান হাইটের ছেলেদের দাদা বলি না বুঝলি৷ ছেলেটা বন্ধুদের থেকে একটু বেঁটে ছিল আর মেয়েটা ছিল সমবয়সিদের থেকে একটু লম্বা৷ ছেলেটা বলেছিল,তাহলে নিজেকে যখন সুপারম্যান মনে করিস, তখন নিজের কাজ নিজেই করে নে৷
মেয়েটা বিরক্ত মুখে বলেছিল, তুই পারবি না সেটাই বল৷ তারপর ছোটো ছোটো হাতে কালি লাগিয়ে চেষ্টা চালিয়েছিলো সাইকেলের চেনটা জায়গামতো লাগাতে৷ ছেলেটা দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে মেয়েটার জেদ দেখছিলো৷
মেয়েটার লালচে হাতদুটো কালো হয়ে গিয়েছিল৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম… তারপর চেনটা না লাগাতে পেরে সাইকেলটা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল৷ পাশ দিয়ে ফুলস্পিডে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ছেলেটার,… কিন্তু মেয়েটাকে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে দেখে মনের কোনো গোপন গলিতে কি যেন একটা হয়ে গিয়েছিল৷ দে, আমি ঠিক করে দিচ্ছি… মেয়েটা তখনও ঘাড় গোঁজ করে বলেছিলো, আমি কিন্তু তোকে দাদা বলতে পারবো না৷
সাইকেলটা ঠিক করে ছেলেটা বলেছিল, তুই আমাকে দীপ্ত বলিস৷
রিয়ার ঠোঁটে এক চিলতে দুষ্টু হাসির ছোঁয়া৷
তাহলে আমরা বন্ধু হলাম বেশ৷
বন্ধুত্বটা শুরু হয়েছিল সেই থেকে৷ দু ক্লাস উঁচু ছেলের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে গোটা স্কুলে হাসাহাসি চলেছিল, বন্ধুরা বলেছে এটা আসলে প্রেম, ওরা ন্যাকামি করে বন্ধুত্ব বলে চালাচ্ছে৷
বিকেলে লেকের ধারে বসে বাদাম আর চিপস খেতে খেতে রিয়া আর দীপ্ত সকলের আলোচনা শুনে হেসে বলেছে, ভাবতে দে সকলকে, আমরা জানি আমরা কি!
রিয়া বলতো, যতদিন পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা ওই জলের মতো স্বচ্ছ থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমি তোর সাথে মিশবো৷ ভালোবাসার সম্পর্কের মতোই বন্ধুত্বেও প্রতিশ্রুতি শব্দটা হয় সেটাই প্রমান করত ওদের সম্পর্কটা৷
তাই ওই গুজগুজ ফিসফিস কোনোদিনই দেওয়াল তোলেনি ওদের সম্পর্কের মাঝে৷ বরং সাদা শার্ট আর ব্লু স্কার্টের পাশে ব্লু প্যান্ট আর সাদা শার্টের সাইকেল দুটো ঝড়ের গতিতে উড়ে গেছে সব আলোচনাকে পিছনে ফেলে৷ প্রথম প্রথম দুই বাড়িতেই বারণ করতো, ওই মেয়েটার সাথে এত কীসের গল্প?
অথবা ওই ছেলেটার সাথে এত ঘুরিস না৷ তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছে সকলেই৷ আলোচনা হয়েছে ছেলে-মেয়েদুটো বড়ো নির্লজ্জ৷
রিয়ার গানের স্কুলের সামনে বৃষ্টির দিনে ছাতা হাতে অপেক্ষারত দীপ্তকে দেখে সকলেই মুখ টিপে হেসেছে৷ অনেকে বলেছে,ওই দ্যাখ রিয়ার বন্ধু নামের প্রেমিকটা৷ দীপ্তও ভিতরে ভিতরে হেসেছে৷ কারণ রিয়ার মনের সব খবর একমাত্র দীপ্তই জানে৷ রিয়া যে সেই ছোটো থেকে রক্তিমকে ভালোবাসে সেটা আর কেউ না বুঝলেও দীপ্ত বোঝে ৷ রিয়াটা একটা যাচ্ছেতাই! মুখে এত বড়ো বড় কথা, অথচ সেই স্কুল থেকে ভালোবেসেও কলেজে পৌঁছে গিয়েও আজও রক্তিমকে প্রোপজ টা করে উঠতে পারলো না৷ দীপ্ত বলেছিল, রিয়া আমি বরং একদিন বলি রক্তিমকে৷ দিয়া মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, না তুই নয়৷ বললে আমিই বলবো৷ সেই কলেজ প্রায় পেরিয়ে গিয়ে তবে রিয়া রক্তিমকে জানিয়েছিল৷ তাও তো দীপ্ত আর ও দু-দিন ধরে পরামর্শ করেছিল, রক্তিমকে ঠিক কি বলা যায়!
অবশেষে রক্তিম আর রিয়ার প্রেমটা বেশ ভালোই জমে উঠেছে৷ যদিও তাতে দীপ্তর আর রিয়ার বন্ধুত্বে এতটুকুও ঘাটতি ঘটে নি৷ কারণ রক্তিম বলে,তোদের মতো দুটো পাবলিক এক জায়গায় থাকলে হার্ট অ্যাট্যাকের রুগীর অক্সিজেন লাগবে না, তোদের মুখ নিঃসৃত কথাই যথেষ্ট৷
রক্তিম আপাতত চাকরি সূত্রে হায়দ্রাবাদ৷ তাই রিয়ার সব অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে দীপ্তকেই৷ এমনকী ম্যাট্রিমনির ভালো ভালো মেয়েকে জাস্ট একবার দেখেই নাক কুঁচকে ক্যানসেল করছে রিয়া, সেটাও বসে বসে সহ্য করতে হচ্ছে ওকে৷ কি করবে, রিয়ার অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না দীপ্ত৷ রিয়ার মুখ ভার হবে এমন কোনো কাজ করা এ জীবনে ওর পক্ষে অসম্ভব৷
এই রিয়া, আমার বিয়েটা হোক, এটা তুই চাস তো? নাকি রক্তিমের সাথে ফুলশয্যায় ঘর থেকে আমাকে কল করে বলবি, প্যারামাউন্টের শরবত খেতে ইচ্ছে করছে, এনে দে৷ মানে যে ভাবে তুই আমার জন্য ক্যাটরিনা খুঁজতে বসেছিস… তাতে আমি না সলমনের মতো চিরকুমার থেকে যাই৷
দু-চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে রিয়ার৷ ফোনটা রিং হয়ে হয়ে থেমে যাচ্ছে৷ রিয়ার ফোন শুনতে পেয়েও ধরবে না দীপ্ত এটা কল্পনারও বাইরে৷ আজ মুভি দেখতে যায়নি বলে হয়তো একটু অভিমান হতে পারতো দীপ্তর, কিন্তু তাই বলে রিয়া চিন্তা করছে জেনেও ফোন রিসিভ করবে না… এটা হতে পারে না৷ ভেঙে পড়া গলায় দীপ্তর মাকে ফোনটা করলো রিয়া… না দীপ্ত এখনো বাড়ি ফেরেনি৷ এখন কি থানায় যাওয়া উচিত? এরকমই ভাবছিল রিয়া৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর ঘরের জানালায় একটা ঠুকঠুক আওয়াজ৷ চমকে উঠে জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো উস্কোখুস্কো চুলে দীপ্ত দাঁড়িয়ে আছে৷ মায়ের কাছে শুনেছে, আত্মারা নাকি চলে যাবার আগে একবার প্রিয় মানুষকে দেখতে আসে… তবে কি দীপ্ত! ভয়ে ভয়ে কান্নাভেজা চোখে দীপ্তর দিকে তাকাতেই ও বললো, এদিকে আয়৷
নিস্তেজ পা দুটোকে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো জানলার গ্রিলের সামনে৷ তারপরেই হাউমাউ করে কেঁদে রিয়া বললো, দীপ্ত প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না,আমি যমরাজের সাথে ঝগড়া করেও তোকে ফিরিয়ে আনবো রে৷
দীপ্ত খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো, সে তুই যার সাথে ইচ্ছে পরে ঝগড়া করিস৷ আপাতত এটা নে… হাতে একটা লাল কালো পেনড্রাইভ৷ এতে আছে মুভিটা৷ যদিও হলপ্রিন্ট, তবুও তুই দেখতে পারবি৷
রিয়া আর উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরেই বললো, তুই বেঁচে আছিস?
মানে? আমি মরবো কেন? মরলে তুই আর তোর রক্তিম মর৷ শালা মরে গিয়ে ভুত হয়ে ফুলশয্যা কর৷ আমার, ওই নাগের বাজারের মেয়েটাকে বিয়ে করে প্যারিসে হানিমুন করার ইচ্ছে! তা নয় শালা বলে কিনা, তুই মরিস নি?
রিয়ার চোখে জল৷ তাহলে ফোনটা ধরছিস না কেন?
ওহ, তাই বল! আরে আগের বার মুভি দেখতে গিয়ে আমার ফোন বেজেছিলো বলে তুই কেলিয়েছিলি মনে আছে? তাই এবারে সেই দুপুর থেকে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম৷ সর্বনাশ তোর ৪৬ টা মিস কল?
হ্যাঁরে এত ফোন করেছিলিস কেন?
রিয়া বললো, তুই মরে গেলে কি কি মেনু করবো সেগুলো ঠিক করার জন্য৷
দীপ্ত ওর সেই বোকা বোকা হাসিটা হেসে বললো, কিছু করিস আর নাই করিস অ্যাটলিস্ট ইলিশ ভাঁপাটা রাখিস, নাহলে আমার আত্মার তৃপ্তি হবে না রে৷
দীপ্ত বাইকে স্টার্ট দিয়েছে, পিছন থেকে কেউ চেঁচিয়ে বললো, সাবধানে চালাস জানোয়ার৷ তারপরের দুর্গা দুর্গাটা শুধু রিয়া আর মা দুর্গাই জানলেন, ওটা আর শুনতে পেল না দীপ্ত৷
কিছুক্ষণ পরেই হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ঢুকলো, কাল দেখা হলে কুড়ি টাকা দিয়ে দিস, হল প্রিন্ট হলেও কুড়ি নিয়েছে৷
এই হচ্ছে দীপ্ত৷ আইনক্সের তিনশো টাকা নষ্ট হওয়ার দুঃখ নেই, কুড়িটাকা যতক্ষন না রিয়ার কাছ থেকে নিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ওর শান্তি নেই৷
রাতে খাবার টেবিলে বসেই আলোচনাটা শুরু হলো রিয়ার বাড়িতে৷
বাবাই প্রথম মুখ খুললেন৷ রক্তিমের বাবা মা ফোন করেছিলেন, বিয়ের দিন ঠিক করার জন্য৷ তার সাথে একটু ক্ষোভও প্রকাশ করলেন ওনারা৷ রিয়ার এই দীপ্তর সাথে মেশাটা ওনারা ভালো চোখে দেখছেন না৷ যতই হোক বাড়ির বউ করে যাকে নিয়ে যেতে চাইছেন তার নামে কানাঘুষো শুনতে কাদেরই বা ভালো লাগে৷ রক্তিমের বাবা বললেন, ছেলে যখন পছন্দ করেছে তখন আপত্তি ওনাদের নেই, তবে এই ছেলেদের সাথে মেলামেশাটা যদি একটু কম করে তো মঙ্গল৷ আর তো রিয়া ছোটোটি নেই৷
রিয়া রুখে উঠে বলেছিলো, ছেলে বলতে তুমি কার কথা বলছো? দীপ্ত? রক্তিম খুব ভালো করেই জানে আমার সাথে দীপ্তর সম্পর্কটা ঠিক কি?
মা মুখটা গোমড়া করে বললো, তুই কাকে ভালোবাসিস, দীপ্তকে না রক্তিমকে?
রিয়ার স্পষ্ট উত্তর দুজনকেই৷
তাহলে কাকে বিয়ে করবি সেটা ক্লিয়ার করে বল৷
মায়ের কথায় অবাক হয়ে রিয়া বললো, বিয়ে? দীপ্ত আমার বন্ধু মা, ওকে বিয়ে করার কথা উঠছে কি করে? বিয়ে আমি রক্তিমকেই করবো৷ কিন্তু তার জন্য দীপ্তর সাথে বন্ধুত্ব কেন নষ্ট করতে হবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না!
বাবা বেশ গম্ভীর গলায় বললেন,তোকে আর কিছু বুঝতে হবে না৷ যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছি আমরা,তাই আজ রক্তিমের বাবা পরোক্ষভাবে অপমান করতে পারলেন আমাকে৷ আজ থেকে আমি যেন দেখি না তুই দীপ্তর বাইকে ঘুরছিস৷ কোনোদিন বাবা এভাবে কথা বলেনি রিয়ার সাথে৷ অন্য ব্যাপারে শাসন করলেও দীপ্তকে নিয়ে বাবা-মায়ের বিরূপ মন্তব্য ছিল না কোনোদিন৷ আজ হঠাৎ হলো কি?
রাতে রক্তিমকে ফোন করে ঘটনাটা বলতেই রক্তিমের গলাতেও অন্য সুর৷ রিয়ার কানে এসে লাগলো রক্তিমের কথাগুলো৷ দেখ রিয়া, আমি চাইনা আমাদের পরিবারের কেউ তোমাকে আর দীপ্তকে নিয়ে কোনো অশালীন কথা বলুক৷ তাছাড়া দীপ্ত তোমার সম্পর্কে দাদা বা ভাই হয় না৷ আর ছেলেমেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব কথাটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না রিয়া৷ কিছু দিন পরেই দুজনের মধ্যে একজনের মনে আরেকজনের প্রতি অন্য একটা কর্নার তৈরি হয়৷ তাই বলছি, দু-দিন পরেই আমাদের বিয়ে, একটা আলাদা পরিবারের বউ হয়ে আসবে তুমি, এখন আর দীপ্তর সাথে নাই বা অতটা মিশলে! তাছাড়া তুমিই বা দীপ্তর বিয়েটা হতে দিচ্ছ না কেন? সব মেয়েকেই অপছন্দ করে ওর বিয়েটা কেন ডিলে করছো! রক্তিমের গলায় এই প্রথম সন্দেহের আভাস পেলো রিয়া৷ এই প্রথম কোনো কথা দীপ্তর কাছে না বলে চেপে গেল রিয়া৷ এই প্রথম মনে হলো ওদের সেই স্কুল লাইফের বন্ধুত্বে একটা বড়ো কালির আঁচর টেনে দিলো রিয়া নিজেই৷ তারপরই গত পরশুর স্নিগ্ধা নামে যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিল দীপ্তর জন্য সেই মেয়েটার ছবিটা দীপ্তকে পাঠিয়ে বললো, দেখিস… আমার ভালো লেগেছে৷ চোখ দুটোতে সততা আছে মেয়েটার৷
সঙ্গে সঙ্গে দীপ্ত বললো, ব্যস আমার বসের যখন পছন্দ হয়েছে, তখন চোখ বন্ধ করে ভরসা করবো৷ ডিডি গেঞ্জির মতোই৷ অন্যদিন হলে দীপ্তকে লেগপুল করতে ছাড়তো না রিয়া৷ কিন্তু আজ রক্তিম, বাবা, মা সকলের মনের একটা অন্ধকার দিক চোখের সামনে এসে পড়ায় বেশ কষ্ট দিচ্ছে রিয়াকে৷ অগুনতি পুরোনো স্মৃতি ভিড় করে আসছে চোখের সামনে৷ দীপ্তর বলা সব কথারা শ্রুতিপটে এসে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে রিয়াকে৷
তোর ব্রায়ের ফিতেটা ঠিক করে নে রিয়া, পিছনের ছেলেগুলো তাকাচ্ছে আর মুখ টিপে হাসছে৷
রিয়া তোর ওই দিনগুলোতে সাইকেলিং না করে আমার বাইকে যাতায়াত করতে পারিস৷
এই রিয়া! রক্তিমকে বলেছিস, তোর যে শসাতে এলার্জি আছে! বলে রাখিস কিন্তু, না হলে ও কিকরে জানবে তুই কি কি খেতে ভালোবাসিস, কোনটাতে তোর এলার্জি… তোর প্রিয় রং কি, তোর প্রিয় পাগলামি হলো… পেন্সিলের নিব দিয়ে লোকের হাঁটুতে খোঁচা মারা৷ এটা না জানলে বেচারা রক্তিমটা তো খোঁচা খেয়ে খেয়ে মরেই যাবে৷
রিয়ার জ্বর গায়ে একলা বিছানায় শুয়ে থাকার দিনে দক্ষিণের জানালার ফাঁক দিয়ে ফুচকা চুরমুর সাপ্লাই দেওয়ার লোকটাও যে দীপ্তই, তাই ওকে এভাবে শুধুমাত্র সকলের কথা শুনে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারছে না রিয়া৷ কি করে মুছে ফেলবে ওদের সেইসব পাগলামির রঙিন ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে৷ কি করে শুধু অন্য জেন্ডার বলে অস্বীকার করবে ওদের এতদিনের বন্ধুত্বকে৷ কি করে দীপ্তকে বলবে, তুই আর আমার সাথে বেশি মিশবি না, সামনেই আমার বিয়ে৷ তোর লিঙ্গ আলাদা তাই তোর সাথে বন্ধুত্বের ইতি টানতে হবে… এগুলো কি করে বলবে রিয়া?
ধূসর বেরঙিন ভাবনার মাঝেই দীপ্তর ফোন৷
এই রিয়া তোর এই রবিবার সময় হবে, ওই স্নিগ্ধাদের বাড়ি থেকে যোগাযোগ করেছে রে, বলছে রবিবার দেখতে যেতে৷ তুই যেদিন বলবি সেদিনই যাবো আমি ক্যাটরিনা পছন্দ করতে৷ গলায় একটা হালকা হাসি রয়েছে দীপ্তর৷ রিয়া জানে যেমনি ও বলবে ও যেতে পারবে না মেয়ে দেখতে, তেমনি এই হাসিটা নিমেষে মিলিয়ে যাবে দীপ্তর মুখ থেকে৷ তারপর অভিমানী গলায় ও বলবে,তোর কি ইচ্ছে রে বাঁদরি, আমি সারাজীবন কুমারী হয়ে বসে থাকি?
রিয়া মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে, কুমারী নয় গাম্বাট ওটা কুমার হবে৷
আরে আইবুড়ো পাবলিকের মনের ব্যথাটা বোঝ পাগলি, জেন্ডার বুঝতে যাস না৷ তাকে কি করে রিয়া বলবে, দীপ্ত তুই শুধু ছেলে বলেই তোর সাথে আমি আর বন্ধুত্ব রাখতে পারবো না! দীপ্ত হয়তো প্রথমে অবিশ্বাসী গলায় বলবে,কি হলো রে! মাথায় বায়ু উঠে গেছে? কাল কি বেশি চুরমুর গিলেছিস?
দীপ্ত, তোর সাথে একটা সিরিয়াস কথা ছিল রে! তোর কি সময় হবে এখন শোনার?
না, হবে না, নিশ্চয় বিগবাজারে কোনো গোলাপি কুর্তি দেখেছিস, আজ বিকালে আমাকে নিয়ে বিগবাজারে যেতে চাস… সরি আমি যাবো না৷ আচ্ছা বেশ যেতে পারি কিন্তু বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে৷
প্লিজ দীপ্ত একটু সিরিয়াস হয়ে শুনবি?
রিয়ার গলার স্বরটা এই মুহূর্তে একটু অপরিচিত লেগেছিল বলেই হয়তো থমকে গিয়েছিল দীপ্তর ভুলভাল বকার বেগটা৷
রিয়া খুব শান্ত স্বরে ওর স্বভাব বিরুদ্ধ ঠান্ডা গলায় বলল, রক্তিমদের বাড়ি থেকে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে আসছে, তাই এখন থেকে তোর সাথে মেলামেশাটা বন্ধ করতে হবে৷
ওরা ছেলেদের সাথে বেশি মেলামেশা পছন্দ করে না৷
বেশ কিছুক্ষণ ওপ্রান্তের মানুষটা নিশ্চুপ৷ শুধু তার নিঃশ্বাসের আওয়াজেই রিয়া টের পাচ্ছে দীপ্ত নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে৷ দীপ্ত নিজেকে সামলাতে চাইছে৷ তাই চুপ করে আছে৷ কিছুতেই ধরা পড়বে না রিয়ার কাছে৷ ওর দুর্বলতা যেন কোনোভাবেই দেখতে না পায় রিয়া৷ এটা ওদের দুজনের একটা অদ্ভুত স্বভাব৷ কেউ কারোর কাছে এতটুকু ভাঙবে না৷ যদিও দুজনেই খুব ভালো করে বোঝে দুজনের মনের অবস্থা৷ তবুও সেটাকে অপ্রকাশিত রেখে দেবার একটা চেষ্টা রয়েই যায়৷
দীপ্ত বললো, ঠিকই বলেছে রক্তিম, তোর এই উরনচন্ডী স্বভাবের পরিবর্তন দরকার৷ তাই আজ থেকেই তোর সাথে আমার ব্রেকআপ৷ শুধু একটাই আফসোস, আমার জীবনসঙ্গিনী বাছার সময় তুই থাকতে পারলি না৷
ফোনটা কেটে দিয়েছে দীপ্ত৷ না, একটাও দীর্ঘশ্বাস শুনতে দেয়নি রিয়াকে৷ বরং বলেছে, থাক ভালোই হলো রে… তোর মতো হিংসুটেকে নিয়ে গেলে আবার বিয়েটা কেঁচিয়ে যেত৷ চুপ করেছিলো রিয়া, অবাধ্য চোখের জলকে শাসন করে দমিয়ে রেখেছিলো৷ বারবার মনে মনে বলেছে, ক্ষমা করিস দীপ্ত৷
আমি তোর নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারলাম না৷ কাউকে বোঝাতে পারলাম না, একটা ছেলে আর মেয়ে শুধু প্রেমিক প্রেমিকাই হয় না, বন্ধুও হয়৷ তারা একে অপরকে ভালোও বাসে, কিন্তু সেই ভালোবাসার মধ্যে সংসার গড়ার বাসনা থাকে না, থাকে না শরীর ছোঁয়ার আগ্রহ৷
গুনে গুনে তিনদিন পরে দীপ্তর ফোনটা এসেছিল, কি রে হিংসুটি তোর কি ফোন করাও নিষেধ নাকি?
তিনদিনের গুমোট বাতাসের পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়েছিল রিয়া৷
তোর পছন্দের স্নিগ্ধার সাথেই বিয়েটা ফাইনাল হয়ে গেল৷ আমার মতো গাম্বাটকেও মেয়েটা পছন্দ করলো বুঝলি৷ এখন বল দেখি কি রঙের বেনারসী কিনব আমার বউয়ের জন্য?
দীপ্ত বিয়ের শপিং-এ বেরিয়েছে, ওর সাথে মুখে ওড়না ঢাকা একটা মেয়ে,যার নির্দেশে কেনা হচ্ছে দীপ্তর বউ-এর বিয়ের পোশাক৷ মেয়েটা মাঝে মাঝেই বলছে, স্নিগ্ধার মাথা খারাপ হয়ে যাবে তোকে নিয়ে চলতে৷ একমাত্র আমি বলেই তোকে সহ্য করি৷ ওড়নায় মুখ ঢেকেই দীপ্তর বিয়ের বাজার সারছিলো রিয়া৷ কি করবে! সকলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও দীপ্তর সাথে শপিংয়ে বেরোতে হয়েছিল ওকে৷ বহুদিন আগেই কথা দিয়েছিল দীপ্তকে, তোর বিয়েটা আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেব৷ দীপ্তর জীবনে সেভাবে প্রেম আসেনি বলেই বড্ড দুঃখ ছিল ওর৷ কথার খেলাপ করতে পারেনি রিয়া, তাই এই লুকোচুরি৷
এদিকে রক্তিমের বাড়ি থেকেও বিয়ের ডেট ফাইনাল করে গেছে৷ দীপ্তর তত্ত্ব গুছিয়েই নিজের শপিংয়ে হাত দেবে রিয়া৷ পাগলটাকে বিশ্বাস নেই, হয়তো গায়ে হলুদের জন্য নীল রঙের শাড়ি কিনবে কালার ব্লাইন্ডটা৷ কালার ব্লাইন্ড বললেই দীপ্ত বলতো, ঠিকই বলেছিস আমি সত্যিই কালার ব্লাইন্ড তাই তোর কাল্টিকেও ফর্সা দেখি রে৷ পিঠে একটা গুম করে কিল পড়বে জেনেও এটা বলতই দীপ্ত৷ রিয়ার লেগপুল করে যা আনন্দ তা নাকি খেজুড় গুড়ের মাখা সন্দেশ খেয়েও পায় না দীপ্ত৷
সেদিনও গড়িয়াহাট থেকেই দু-হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছিলো দীপ্ত আর রিয়া৷ রিয়ার মুখে আপাদমস্তক ওড়না জড়ানো৷ কোনোভাবেই চেনা সম্ভব নয়, তবুও হঠাৎই রক্তিম এসে দাঁড়িয়েছিলো ওদের সামনে৷ পথ রোধ করে রিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, কালই ফিরেছি হায়দ্রাবাদ থেকে৷ শুনলাম তুমি বান্ধবীদের সাথে শপিংয়ে বেরিয়েছ৷ আমার স্থির ধারণা ছিলো তুমি দীপ্তর সাথেই বেরোবে৷ কারণ এই বন্ধুত্ব নামক মুখোশের আড়ালে যে নোংরা খেলাটা চলছে সেটার আকর্ষণ ত্যাগ করা তোমাদের দুজনের পক্ষেই একটু কষ্টকর৷ আমার একটাই প্রশ্ন রিয়া তোমাকে, তুমি দীপ্তকে বিয়ে করে নিচ্ছ না কেন? তাহলে আর ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে এগুলো করতে হয় না৷ এতদিনের ভালোবাসার মানুষটার দাঁত নখ বের করা রূপটা দেখে চমকে উঠেছিলো রিয়া৷ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলো রক্তিমের দিকে৷
রক্তিমের বাড়ির লোকজন না হয় ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্ব বোঝে না৷ কিন্তু সেই কলেজ লাইফ থেকেই তো রক্তিম জানে ওদের সম্পর্কের কথা৷ ওদের খুনসুটির সাক্ষীও হয়েছে রক্তিম বার কয়েক… এসব জেনেও এই ভাষায় কি করে কথা বলছে রক্তিম৷
রিয়া কিছু বলার আগেই দীপ্ত বললো, আমি ওর মনের অলিগলি সব চিনি রক্তিম, তাই ওকে স্পর্শ না করেই রিয়া আমার প্রাণের কাছেই থাকে৷ আর তুই ওকে প্রেমিকা হিসাবে পেয়েও চিনতে পারলি না৷ কথাটা শেষ হবার আগেই দীপ্তকে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বসলো রক্তিম৷ ঘটনার আকস্মিকতায় রিয়া হতচকিত হয়ে গিয়েছিলো৷ দীপ্ত অসহায় ভাবে তাকিয়েছিলো রিয়ার দিকে৷ রিয়া যদি একবার প্রতিবাদ করত রক্তিমের ব্যবহারের, তাহলেই হয়তো দীপ্তর ওই করুণ চাহনিটা পরিবর্তিত হতো৷ কিন্তু রিয়ার ওই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই অপমানে নীল করে দিয়েছিলো দীপ্তর মুখটা৷ রিয়ার হাত থেকে ব্যাগদুটো নিয়ে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিলো দীপ্ত৷ একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়েই চলে গিয়েছিলো ও৷ রক্তিমকে পাল্টা চড় মারেনি দীপ্ত৷ না আর রিয়াকে কোনো মেসেজও করেনি ও৷ এমনকী রিয়ার ফোনও রিসিভ করেনি দীপ্ত৷
শুধু ওর বাবা এসে ছেলের বিয়ের কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিল রিয়ার বাবাকে৷ সপরিবারে যেন উপস্থিত থাকে৷
প্রায়ই দুই বন্ধু ঝালমুড়ির নারকেল নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে করতে বলতো,আজ অন্তত নারকেলটা আমায় দে, আমার বিয়েতে তোকে পেট ভরে খাইয়ে দেব৷
রক্তিমের সেদিনের ব্যবহারের পর রিয়ার মন থেকে রক্তিমের প্রতি ভালোবাসা আর অবশিষ্ট নেই৷ এখন যে বিয়েটা ওর সাথে হতে চলেছে সেটা শুধুই সমঝোতা৷ সমাজের চোখে বাবা মায়ের সম্মানহানি না হয় সেটাই কারণ৷
দীপ্ত ওর গায়ে হলুদের ছবি পোস্ট করেছে ফেসবুকে৷ রিয়া স্পষ্ট দেখলো দীপ্তর ওর হলুদ মাখা মুখের চোখ দুটো কাউকে যেন খুঁজছে৷ রিয়া বলেছিলো,শোন পাগলা, তোকে গায়ে হলুদ প্রথম আমিই মাখাবো৷ দীপ্ত হয়তো ভাবছে শেষ মুহূর্তে সব বাধা কাটিয়ে রিয়া ঠিক হাজির হবে ওর বিয়ের আসরে৷
না যায়নি রিয়া! যেতে পারেনি দীপ্তর সামনে৷ ওর ফর্সা গালে সেদিনের রক্তিমের থাপ্পড়টার দাগটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো প্রতিবাদ করতেই পারেনি, তারপর কোন মুখে গিয়ে বলবে, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড দীপ্ত, ফর এভার৷
রক্তিম ক্ষমা চেয়েছে রিয়ার কাছে সেদিনের ব্যবহারের জন্য৷ না, পারেনি রিয়া রক্তিমকে ক্ষমা করতে৷ তবুও ওদের সামাজিক ভাবে বিয়েটা হচ্ছে৷
দীপ্তর বিয়ে মিটে গেছে তিন সপ্তাহ আগেই৷ ফেসবুকে ওর আর স্নিগ্ধার ছবি দেখে লাভ ইমোজি টিপেও সরিয়ে নিয়েছে রিয়া৷ দুটিকে দারুণ মানিয়েছে৷ পাগলটাকে মেরুন ধুতি আর গরদ রঙের পাঞ্জাবিতে অতটাও হাঁদারাম লাগছিলো না বিয়ের দিন৷
নিজের মনেই হাসছিলো রিয়া৷
তখন উচচ মাধ্যমিক টেস্ট চলছিলো দীপ্তর৷ ঘরে বসে দিনরাত পড়েযাচ্ছিলো দীপ্ত৷ রিয়ারও মাধ্যমিক৷ হঠাৎই বিকেলে ফোন করে দীপ্ত বললো, রিয়া সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আয়৷
ওদের একটা অলিখিত চুক্তি ছিলো, কেউ ডাকলে আরেকজন তাকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করবে না৷ সেই শর্ত অনুযায়ীই রিয়া বেশ কিছু জেরক্সের কাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো বাড়ি থেকে৷ তারপর দীপ্তর পড়ে পড়ে ড্যামেজ হয়ে যাওয়া মাথাকে অক্সিজেন পাঠাতে ওরা শুরু করেছিলো ফুচকা দিয়ে আর শেষ করেছিলো কয়েত বেলের আচার দিয়ে৷ রাত থেকে শুরু হয়েছিলো রিয়ার বমি আর পেটখারাপ৷ সেই শুনে সকালবেলা কাঁচুমাচু মুখ করে দীপ্ত দাঁড়িয়েছিলো রিয়ার বাড়ির সামনে, হাতে কাঁচকলা আর গাঁদাল পাতা নিয়ে৷ রিয়া এগুলো খেলে তুই ঠিক হয়ে যাবি, কাল ঘুগনিটা খাওয়া হয়নি টকজল দিয়ে ,ওটা ডিউ আছে৷ রিয়া মারতে উদ্যত হলেই সাইকেল নিয়ে ভোকাট্টা হয়েছিলো দীপ্ত৷
কিছু স্মৃতি বড্ড সুখকর৷ মনের মণিকোঠায় স্থায়ী জায়গা নিয়ে নেয়৷ আর কিছু স্মৃতি বিস্মৃতি হয়ে গেলেই শ্রেয়৷ যেমন রক্তিম সেদিন দীপ্তকে বলেছিল, তোর লজ্জা করে না আমার বাগদত্তার সাথে এভাবে মিশতে৷ কি চাস, আমি সেকেন্ড হ্যান্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াই?
বমি পেয়ে গিয়েছিলো রিয়ার৷ এই রক্তিমকেই ও ভালবেসেছে এতগুলো বছর ধরে! বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো রিয়া৷ ইচ্ছে করছিলো এই সম্পর্কের নাগপাশ থেকে মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু পারেনি৷ তাহলে সকলে মনে করতো হয়তো ওদের ওই নোংরা ধারণটাই সত্যি! কিছুতেই ওদের এই পবিত্র বন্ধুত্বের সম্পর্কের গায়ে কাদা ছুঁড়তে দেবে না ভেবেই রক্তিমকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছিল ও৷
রিয়ার বিয়ের দিন দীপ্ত এলো না৷ ভালোই করলো এলো না৷ দীপ্ত আর কোনোদিন রক্তিমের সম্মুখীন হোক সেটাই চায় না রিয়া৷
বিয়ের পর রিয়া নতুন সংসার, নতুন পরিবেশ, নিজের গড়া গানের স্কুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে৷ রক্তিম এখন হায়দ্রাবাদে৷ বিয়ের পর দীপ্তর সাথে আর দেখাই হয় না রিয়ার৷ এমনকি একটা ফোন বা মেসেজও করেনি দীপ্ত৷ তবুও রোজ ওর প্রোফাইলটা চেক করাটা রিয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে৷ হোয়াটস অ্যাপের লাস্টসিন দেখে একদিন টাইপ করেও ফেলেছিলো, এই বাঁদর এত রাত পর্যন্ত অন আছিস কেন? বউটাকে সময় দে জানোয়ার৷ তারপরেই মনে হয়েছে এগুলো বলার অধিকার রিয়া হারিয়েছে বহুদিন আগে৷ তাই লিখেও ডিলিট করেছে ও৷
মাঝে মাঝেই রিয়ার মনে হয়.. আচ্ছা দীপ্তর কি এখনো রিয়া নামের মেয়েটাকে মনে পড়ে? নাকি দীপ্তর মনে ওর সম্পর্কে শুধুই তিক্ত অভিজ্ঞতা!!
***
দিন মাস বছর কেটে গেল রিয়ার সাথে কথা না বলে, দেখা না করে৷ আগে হলে একটা দিনও অসহ্য হয়ে উঠত ওর সাথে কথা না বলে, ওকে না রাগিয়ে থাকা৷ মাঝে মাঝেই আয়নার সামনে একমনে দাঁড়িয়ে থাকে দীপ্ত৷ নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না৷ এটাই কি সেই দীপ্ত, যে ওই অভিমানী মেয়েটার অভিমান ভাঙানোর জন্য ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতো রিয়ার গানের স্কুলের সামনে৷ পাছে অন্ধকারে ও কোনো নারকীয় ঘটনার সাক্ষী না হয়ে যায়৷ যেন মনে হতো রক্তিম বোধহয় দায়িত্ব দিয়েছে দীপ্তকে, রিয়াকে সাবধানে আগলে রাখার৷ না, রক্তিমের জন্য নয়, দীপ্ত যেত রিয়ার টানেই৷ যেমন রিয়াও ব্যাগ থেকে নিজের টিফিনটা বের করে বলতো, নে হাঁদারাম খেয়ে নে৷ নিশ্চয় না খেয়েই বেরিয়ে এসেছিস! রিয়া নাকি দীপ্তর মুখ দেখেই বুঝে যেত ওর পেটের অবস্থা৷
এতই যদি বুঝতো ওকে তাহলে সেদিন যখন রক্তিম ওভাবে অকথ্য ভাষায় দীপ্তকে অপমান করলো তখন কি করে চুপ করে ছিলো রিয়া? শুধুই রক্তিমকে ও ভালোবাসে বলে? রক্তিম ওর উডবি বলে?
তাহলে দীপ্ত কি কিছুই ছিলো না রিয়ার কাছে? বন্ধুত্ব শব্দটা কি এতটাই মূল্যহীন? এত বছরের মান অভিমান ঝগড়া কি তবে শুধুই অভিনয় ছিলো?
একরাশ প্রশ্ন এসে ভিড় করে ধরে দীপ্তকে৷ রিয়ার নাম্বার ডায়াল করেও অবাধ্য আঙুলকে শাসন করে থামতে বাধ্য করেছে দীপ্ত৷
স্নিগ্ধা এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে, আমি একটা কল করবো রিয়াদিকে? আমার অন্তত কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ছিলো৷ ওনার জন্যই তো আমি তোমাকে পেলাম! স্নিগ্ধা জানে রিয়াই ছবি দেখে দীপ্তর জন্য পছন্দ করেছিলো ওকে৷ রিয়া বলেছিলো, এই মেয়েটাই একমাত্র তোর মতো বুদ্ধুরামের সাথে সংসার করবে!
রিয়াই বোধহয় ঠিক চিনেছিলো স্নিগ্ধাকে৷ সত্যিই দীপ্ত ভীষন সুখী স্নিগ্ধাকে পেয়ে৷
না থাক স্নিগ্ধা, আমি চাইনা আমার জন্য রক্তিম আর রিয়ার সম্পর্কে ফাটল ধরুক৷
নোনতা জলকে চোখের পাতায় আটকে রেখে অফিস বেরিয়ে গেছে দীপ্ত৷
***
একদম ম্যাচিওর স্টেজ রিয়ার৷ এই সময়টা রক্তিম বাড়িতে থাকলে ভালো হত৷ রক্তিমও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছুটি পাবার জন্য৷ নিজের সন্তানকে জন্মাতে দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না ও৷ কাল রাতেই রিয়া বললো, শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে৷ এদিকে রক্তিমের বাবা মায়েরও যথেষ্ট বয়েস হয়েছে৷ রাত-বেরাতে প্রয়োজন হলে কি যে করবে!
ছুটিটা বোধহয় কাল পরশু পেয়ে যাবে রক্তিম৷
হঠাৎই অসহ্য পেন শুরু হলো রিয়ার৷ দেওয়াল ঘড়ি টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত তখন এগারোটা দশ৷
রক্তিমকে এখন ফোন করেও লাভ নেই৷ আগামী কাল এসে পৌঁছাবে ও৷ একটু আগেই ফোনে জানিয়েছে৷ শ্বশুর মশাই রেগুলার রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যান৷
কোনো কিছু না ভেবেই নাম্বারটা ডায়াল করলো রিয়া৷ ঠিক সেই আগের মতো৷ কোনো সংকোচ নেই৷ মনে কোনো দ্বিধা নেই রিয়ার৷ নিশ্চিত জানে,ওর ফোন পেয়ে কিছুতেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না দীপ্ত৷ সেই ভরসাতেই লেবার পেন নিয়ে প্রথম ফোনটা করেছিলো দীপ্তকে৷
এম্বুলেন্স নিয়ে ডিরেক্ট রিয়ার শ্বশুর বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলো দীপ্ত৷ অসহ্য যন্ত্রনা নিয়েও হাসি ফুটেছিল রিয়ার মুখে৷ এককবারও মনে হচ্ছিলো না প্রায় দু-বছর পরে দেখা হলো দীপ্তর সাথে! মনে হচ্ছিলো গতকাল যেন স্কুল থেকে দু-জনে একসাথে বাড়ি ফিরেছিলো, আবার পরেরদিনই কথা হলো৷ দীপ্ত বললো, কীরে খুব কষ্ট হচ্ছে?
রিয়া ঘাড় নেড়ে ম্লান হেসে বলেছিলো, তোকে বিরক্ত করলাম রাত দুপুরে!
কথা না বলে গাড়িতে উঠে পর৷ ফালতু ফরম্যালিটি করিস না রিয়া৷ ওটা তোকে জাস্ট মানায় না৷ বরং তোর রাগী গলায় নির্দেশ শুনতেই আমি অভ্যস্ত ছিলাম৷
তোর ডাক্তারকে ফোন করেছিস রিয়া?
কতদিন পরে দীপ্তর মুখে নিজের নাম শুনলো রিয়া৷
ঘাড় কাত করে বললো, হ্যাঁ মিস্টার চ্যাটার্জী নার্সিংহোমে আসছেন বললেন৷ আর রক্তিম কালই …
রক্তিম নামটা শুনেই নিমেষে দীপ্তর মুখে নেমে এলো কালো মেঘের ছায়া৷
রিয়ার ছেলে যখন চিৎকার করে জানান দিলো যে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে তখন রাত প্রায় তিনটে৷ ও. টি.-র বাইরে তখন একটাই মানুষ দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে৷ যে ছিলো রিয়ার সর্বক্ষণের সুখ দুঃখের সঙ্গী৷
বিয়ে বাড়িতে চুলে লাগানোর জন্য ফুল কিনে এনে দেওয়া থেকে শুরু করে শাড়ির কুঁচি অবধি ঠিক করিয়েছে রিয়া ওকে দিয়ে৷ আজ রিয়ার সন্তানের জন্ম মুহূর্তেরও সাক্ষী একমাত্র সেই মানুষটাই৷
রিয়ার বাবা কর্মসূত্রে সেদিনও বাইরে৷
ভোর রাতে লাল চোখ আর মুখে হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলো দীপ্ত৷ একমুখ হেসে বললো, বুঝলি রিয়া তোর ছেলে তোকে একটা ‘মা’ বলে ডাকবে, আর আমাকে দুটো মা,… মামা৷ তাহলে বল… কার দাম বেশি?
রিয়া হেসে বললো, অবশ্যই তোর৷
বুঝলি রিয়া, তোর ছেলেটাকে আমি সাইকেল চালানো শেখাবো৷ তোর মতো রং সাইড দিয়ে গিয়ে লোককে ধাক্কা মেরে বলবে না… দেখে চলতে পারেন না!
অনেকদিন পরে দুজনের প্রাণ খোলা হাসিতে নার্সিংহোমের ঘরটা গমগম করছিল৷ নার্স এসে বললেন, আহা কি করছেন? আস্তে….এটা নার্সিংহোম৷
সেটা শুনেও দুজনেই আড়ালে চোখ টিপলো… সেই যেমন স্কুলে লুকিয়ে রাখতো নিজেদের দুষ্টুমিগুলো৷
রক্তিম এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এসেছে নার্সিংহোমে৷
ওর বাবাও এসেছেন৷
সকলেই দীপ্তর দিকে একটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে৷
দীপ্ত অপরাধী মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো৷
রিয়া বললো, তুই কোথায় যাচ্ছিস দীপ্ত?
দাঁড়া ওকে বেবিকটে এখুনি দেবে৷ তুই না মামা! মায়ের থেকেও একটু বেশি, তাই তুইই ওকে আগে কোলে নিবি৷
একটু অপেক্ষা কর৷
রক্তিমের চোখের দিকে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়েই কথাটা বললো রিয়া৷
বুঝলি দীপ্ত, সকলে বোঝে না যে ছেলে আর মেয়ের মধ্যেও শুধু বন্ধুত্ব হতে পারে৷ নিছক মনের টান… হয়তো সেটা প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর থেকেও একটু বেশি৷
আমার ছেলেটাকে একটু বড়ো হতে দে দীপ্ত, তারপর আবার তোর বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াবো৷
দীপ্তর মুখে অনাবিল হাসি৷
রক্তিম নিশ্চুপ৷ পেরেছে… এতদিন পরে রিয়া পেরেছে দীপ্তর সেদিনের অপমানের শোধ নিতে৷
রক্তিম আস্তে করে বললো, পারলে ক্ষমা করিস দীপ্ত৷
দীপ্ত কিছু বলার আগেই রিয়া বললো, ও তোমাকে অনেকদিন আগেই ক্ষমা করেছে রক্তিম, তাই আজ তোমার স্ত্রী বিপদে পড়েছে জেনেও সব ভুলে তাকে হেল্প করতে চলে এসেছে৷
তারপর একটু থেমে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, এটাই আমার দীপ্ত৷ যার কাছে বন্ধু শব্দটার অন্য মানে, অনেকটা ব্যাপ্তি…