ফিসফিস
কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে শুভেন্দুর৷ অনেক চেষ্টা করেও ওর প্রিয় দোকানের স্পেশাল বিরিয়ানিটা কিছুতেই গলা দিয়ে নামছে না যেন৷ কোথাও একটা ছোটো কাঁটা খোঁচা দিয়েই চলেছে৷
দুটো অবয়বের ছবির অবিরাম আনাগোনাই দৃষ্টিপথকে বাধা দিয়ে চলেছে৷ মৌসুমী আর ওর পরিবারের সকলেই দারুণ মুডে আছে আজ৷ মৌসুমী সকলকে গর্ব করে বলছে, আমার পাগলটা আজ সি.ই.ও হয়েছে৷ ভাবা যায়! এমন একটা প্রমোশন এত কম বয়সে?
মৌসুমীর আদরের ডাকগুলো আজ সব পাবলিক হতে বসেছে আনন্দের চোটে৷
মৌসুমীর বাবা, মা আত্মীয়রা জামাইয়ের উন্নতিতে আপ্লুত৷
ছোট্ট রেহানকে নানা রকম চকলেট গিফট করছে পার্টিতে আসা মানুষগুলো৷ হ্যাঁ, আজ হাবির প্রোমোশনের আনন্দে একটা পার্টি থ্রো করেছে মৌসুমী৷ গোটা ব্যাপারটা ওই সামলে নিয়েছে৷ এত সুন্দর এরেজমেন্ট করেছে মৌসুমী, যে শুভেন্দু বিকেলে বলছিলো, তোমাকে আমাদের কোম্পানির ককটেল পার্টির অ্যারেজমেন্ট-এর দায়িত্ব দিলে তো তুমি ফাটিয়ে দেবে গো৷ স্বামীর প্রশংসায় মৌসুমীর ফর্সা গালে আবিরের ছোপ৷ ওদের প্রেমটা বিয়ের আগের বছর দুয়েক অতিক্রম করে বিয়ের প্রায় ছয় বছর হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে গতানুগতিক নিয়মে৷
মৌসুমী জানে শুভেন্দুর উন্নতির পিছনে ওর অবদান ঠিক কতটা৷ শুভেন্দুর ওই ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে ওকে বের করে আনতে কম খাটতে হয়নি মৌসুমীকে৷ প্রথমে তো উত্তর কলকাতার ওই পুরোনো ভাড়া বাড়ির থেকে আজকের এই অবস্থায় তুলে আনতে কম সাধ্যসাধনা করতে হয়নি মৌসুমীকে৷ আসার পরেও শিকড়ের গায়ে লেগে থাকা মাটি ধুতে ধুতে একসময় হাঁপিয়ে যেতো মৌসুমী৷ তাও হাল ছাড়ে নি৷ রবিবারের ছুটির রাতগুলো বাবা-মায়ের কাছে কাটানোর জন্য কি ব্যাকুলতা ছিল শুভর৷ উফ, রবিবার বাড়িতে স্পেশাল ডিস বানিয়ে, বন্ধুদের ডেকে তাস ক্যারামের আড্ডা বসিয়ে তবেই ওই বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করতে পেরেছে৷
ধুর! ব্রিলিয়ান্ট মানুষগুলো যখন ফালতু সেন্টিমেন্টকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে তখন তাদের বোঝানো যে কতটা কঠিন সেটা একমাত্র মৌসুমীই জানে৷
শুভেন্দুর বাবা ভোলানাথ দত্ত রিটায়ার্ড মানুষ৷ আর্মিতে কাজ করেছেন৷ সারাজীবনই তিনি বাইরে বাইরেই কাটিয়েছেন৷ মা সাদামাটা গৃহবধূ৷ একমাত্র সন্তান শুভেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকা একটা মানুষ৷ রমলা দেবীর প্রথম সন্তান মাত্র ছয় মাসে মারা যাওয়ায় শুভেন্দুর ওপর ভয়, আতংক, দুশ্চিন্তা নিয়ে অতি সাবধানতা আছড়ে পড়েছিলো যেন৷
শুভেন্দুও ভাবতে শুরু করেছিল, মায়ের কথাই হলো বেদ বাক্য৷ মা কিছু বললে, শুভেন্দুর যুক্তি বুদ্ধি তখন কাজ করতো না৷ অথচ ওই স্বল্প ভাষী মহিলা যে ঠিক কি চায় সেটা মৌসুমীর থেকে ভালো আর কে জানে?
রঞ্জনা আর ওর হাজবেন্ড মিস্টার গুপ্তা ঢুকলেন মৌসুমীদের ফ্ল্যাটে৷
রঞ্জনা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ইন্টিরিয়ার ডেকোরেটর মনে করে৷ কারোর ফ্ল্যাটে ঢুকেই মিষ্টি হেসে বলে, এহে… এই টিউলিপ ঝাড়টা ঘরের কর্নারে রেখেছো কেন? ফ্রন্টে রাখো অথচ মনে হবে কর্নারে৷
এমন ধরনের হালকা উপদেশ ও দিয়েই থাকে এই ধরনের ঘরোয়া পার্টিতে৷
মৌসুমী অপেক্ষায় ছিল, কতক্ষণে ওর ঘর সাজানোর খুঁত ধরবে?
হঠাৎ রঞ্জনা বলে উঠল, বাহ মৌসুমী তোমার ব্যালকনির কাটিং প্লান্টগুলো কিন্তু জাস্ট অসাম৷
অন্যের প্রশংসা করতে যাদের কষ্ট হয় এমন মানুষদের কাছে সেটা পেলে বেশ অপ্রত্যাশিত আনন্দ হয়৷ মৌসুমীও শুভেন্দুর কানে কানে ফিসফিস করে বললো, দেখো দেখো মিসেস গুপ্তাও তোমার বউ-এর গুনের প্রশংসা করছে৷ ক্লান্ত হাসলো শুভেন্দু৷ আসলে এই লোক দেখানো প্রতিযোগিতার থেকে আনন্দটা গ্রহণ করতে আজও অক্ষম শুভেন্দু৷ রেহান এসে গুটি গুটি পায়ে বললো, পাপা তোমার কি মন খারাপ?
শুভেন্দু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কি করে বুঝলি?
রেহান তার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে বললো, ওই যে তুমি আজ পায়চারি না করে এক জায়গায় চুপটি করে বসে আছো, তাই!
এই স্বভাবটা শুভেন্দু পেয়েছিল তার বাবা ভোলানাথ দত্তর কাছ থেকে৷ বাড়িতে অতিথি আসবে শুনলেই বাবার পায়চারি বেড়ে যেত৷ ঘনঘন রান্নাঘরে যেত আর দরজার বাইরে থেকে মাকে জিজ্ঞেস করতো, কি গো তোমার আর কতদূর৷ আরে দাদা-বৌদিরা যে এসে পড়বে!
শেষে আসানসোলের জ্যেঠু-জেঠিমা এসে বাবাকে বলতো, ভোলা তুই এবার একটু শান্ত হয়ে বোস৷ আমাদের যত্ন রমলা কিছু কম করবে না৷ বাবার ওই অস্থির হওয়ার স্বভাবটা নিয়ে মা মাঝে মাঝে মজা করে বলতো, হ্যাঁ গো যখন বর্ডারে শত্রুর সাথে তুমি যুদ্ধ করতে তখন কি শত্রুরা আসার আগেই গুলি ছুঁড়তে? নাকি পায়চারি করতে কখন শত্রু আসবে বলে৷ শুভেন্দু মায়ের মজায় হেসে গড়িয়ে পড়তো৷
বাবা তখন ওর মাথায় চাটি মেরে বলতো, চুপ কর মায়ের চামচা৷
একটা ক্রিকেট ব্যাট এনেছিলাম তোর জন্য৷ কিন্তু মায়ের ফরে কথা বললি বলে, ওটা আমি পাঁচুর ছেলেকে দিয়ে দেব৷ শুভর তখন করুণ অবস্থা৷ একবার মায়ের দিকে তাকাত, আরেকবার বাবার দিকে৷ শেষে মা বলতো, আমার মানিকের ব্যাট কেউ অন্য কাউকে দিয়ে দেখুক দেখি! তার আজ দুপুরে মাংসের ঝোল বন্ধ৷
বাবা নিরুপায় মুখ করে বলতো, বেশ বেশ ব্যাট-বল শুভকেই দিচ্ছি৷ মায়ের আদুরে বাঁদর একটা৷
বাবা মায়ের ওই ছোট্ট ছোট্ট আনন্দগুলোকে আজ বড়ো মিস করে শুভেন্দু৷ ইদানিং মানিওর্ডারের টাকাটাও রিটার্ন আসছে শুভেন্দুর অ্যাকাউন্টে৷
ভোলানাথ দত্ত-এর নামটা ভোলানাথ হলেও তিনি অপমানের জ্বালাটা মনে রেখেছেন ভালো করেই৷
রেহান আবার বললো, পাপা তুমি চকলেট আইসক্রিম খাবে? আমি খেয়েছি৷ দারুন৷
ঘাড় নেড়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শুভ বললো, আমি দুধ মালাই খেতে খুব ভালোবাসতাম জানিস রেহান৷
আইসক্রিমের বাক্স মাথায় বিশে দাদু প্যাঁক প্যাঁক হর্ন বাজিয়ে যেত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে৷ আমি মায়ের আঁচলে বাঁধা খুচরো আট আনা নিয়ে ছুটতাম৷ তারপর চুষে চুষে খেতাম ওই কাঠি লাগানো সাদা রঙের আইসক্রিম৷
রেহান কৌতুহল নিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে পাপার দিকে৷ হাঁ করে গিলছে পাপার ছোটোবেলার গল্প৷ মনের মধ্যে প্রশ্ন একটাই… তারমানে পাপাও একদিন ছোট ছিলো!
মৌসুমী বিরক্ত মুখে বললো, তোমার প্রোমোশনের জন্য পার্টি, তোমার ফ্ল্যাটে পার্টি হচ্ছে৷ অথচ আনসোশ্যালের মতো এক কোণে মনমরা হয়ে বসে আছো! এভাবে সকলের সামনে আমাকে ছোটো করতে তোমার লজ্জা করছে না শুভ৷ অপ্রস্তুত মুখে শুভেন্দু বললো, বলো কি করতে হবে ?
মৌসুমী বললো সকলের সাথে কথা বলো৷
সংসারের শান্তি বজায় রাখতে গেলে কিছু কিছু বাধ্যবাধকতা বোধহয় থেকেই যায়৷ শুভেন্দুও বিতর্ক এড়াতে সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে লাগলো৷ বুকের ভিতরের রক্তক্ষরণটা বাইরে আসতে দিলো না কিছুতেই৷
গত ছয় বছর ধরে ক্ষতটাকে মলম লাগিয়েও একটু সারাতে পারেনি শুভেন্দু৷ তবে পুরুষ মানুষ কাঁদলে বড্ড অপদার্থ লাগে৷ সকলেই শুভেন্দুর এই উন্নতির জন্য প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ তবে শুভেন্দু জানে এদের মধ্যে বেশিরভাগই মনে মনে হিংসা করছে৷ এই লোক দেখানো আশীর্বাদে আর যাইহোক শুভেন্দুর মনের তৃপ্তি আসা সম্ভব নয়৷
যেদিন প্রথম এই চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেছিলো ও সেদিন মা লুকিয়ে গিয়েছিলো কালীঘাটে৷ ওখানের পূজার ফুল নিয়ে এসে আলতো করে মাথায় বুলিয়ে বিজবিজ করে কিছু একটা বলেছিলো৷ না, আদৌ শুনতে পায়নি শুভ মায়ের বলা কথাগুলো, শুধু বুঝেছিলো মা মন থেকে সমস্ত দিয়ে ভালো চাইছে শুভর৷
সেই মনপ্রাণ দিয়ে বিনাস্বার্থে মঙ্গলকামনা করার মতো কেউ নেই এই পার্টিতে৷
এত বড়ো ফ্ল্যাটে কিছুতেই ভোলানাথ দত্ত আর রমলা দত্তর জায়গা হয়নি৷ মৌসুমী বলে, প্রাইভেসি নষ্ট হয়ে যায়৷ সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়৷ দূরে দূরেই ভালো৷ কে জানে, কি ভালো! ওই বছরের দুটো দিন নিজের জন্মস্থানে নিজের মায়ের কাছে অতিথির মতো আতিথেয়তা নিতে যেতে মোটেই ভালো লাগে না শুভেন্দুর৷
মা যেন তটস্থ হয়ে শুভেন্দুদের যত্ন করে৷ বাবা পায়চারি করে, ছেলে, বৌমা, নাতির কোনো অযত্ন যেন না হয়৷ নিজের পেনশনের টাকায় সাধ্যের বাইরে গিয়েও বাজার করে নিয়ে আসে৷ মা হাঁটুর ব্যথা নিয়ে সব রান্না করে৷ আর শুভেন্দু-মৌসুমী গিয়ে বিজয়ার দিনে প্রনাম সেরে আসে৷ না, বাবা মা কোনো দিন তাদের শরীর খারাপের খবর জানায় না শুভেন্দুকে৷
শুধু শুভেন্দুর জন্মদিনের দিন মা নিজের হাতে পায়েস বানিয়ে, সকালবেলা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে এসে ওকে আশীর্বাদ করে যায়৷ কলকাতার দুটো প্রান্তে বাস করেও যেন কয়েক যোজন দূরত্ব ওদের মধ্যে৷ একটা হিমশীতল প্রাচীর তুলে রেখেছে বাবা-মা, সেখানে আজ আর শুভেন্দু চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না৷
শুভেন্দু একদিন অফিস থেকে ও বাড়ি গিয়েছিলো৷
বাবা কড়া গলায় বলেছিল, বউমাকে না জানিয়ে কখনো এ বাড়িতে আসবে না শুভ৷ পরে এ নিয়ে অশান্তি হোক সেটা আমরা চাই না৷ তোমার কোনো ক্ষতি আমরা চাই না৷
পার্টির দুর্দান্ত মেনু, মৌসুমীর রুচিবোধ নিয়ে সকলে ভূয়সী প্রশংসা করে ফিরে গেছে অনেকক্ষণ৷
শুভ বললো, মৌ… বাবা-মাকে জানালে না কেন, আমার প্রোমোশনের খবরটা?
মৌসুমী আদুরে মুখে বললো, আর কবে মানুষ হবে সোনা?
প্রমোশন মানে কি শুধুই উঁচু পোস্ট? সাথে তো তোমার স্যালারিও বাড়বে৷ বাবা মাকে এখন সাত দিচ্ছ৷ এরপরে প্রমোশনের খবর পেলে ওটা চোদ্দো হয়ে যাবে হয়তো৷
বুকের ভিতরটা কষ্টে নীল হয়ে গেলো শুভেন্দুর৷ এই মেয়েটাকেই একদিন ভালোবেসেছিল ও৷ একে দেখেই মনে হয়েছিলো, স্বর্গীয় উদারতা আছে মেয়েটার চোখ দুটোতে! সত্যি, নিজের মানুষ চেনার ক্ষমতার ওপর আরেকবার ধিক্কার জানালো ও৷
আর ইচ্ছে করছিলো না বলতে, যে মৌ ভোলানাথ দত্ত মধ্যবিত্ত হতে পারে,বড়ো বাড়ির মালিক না হতে পারে, নাতির অন্নপ্রাসনে একভরি সোনার হার গিফট না করতে পারে কিন্তু আত্মসম্মানটা তার মারাত্মক৷ যবে থেকে ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি আমরা, যখন থেকে আমি অতিথির মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছি, তবে থেকেই আমার পাঠানো টাকা নির্দিষ্ট ডেটে অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয় আবার ফেরত আসে ঠিক তিনদিন পরেই৷ না কোনো মাসে অন্যথা হয়নি এর৷ কোনো কথা না বলে ফেরত পাঠায় বাবা৷
মা-কে জিজ্ঞেস করতে গেলে বলেছিল, যদি তেমন দরকার পড়ে তাহলে তোরা তো রইলি৷
‘রইলি’ কথাটার মধ্যেই ছিল দূরে সরিয়ে দেবার ইঙ্গিত৷
কারণটা অবশ্য বাবা-মা কোনোদিনই বলে নি৷ কেন শুভেন্দুকে এতটা পর করে দিলো ওরা৷ তবে শুভেন্দুর দৃঢ় বিশ্বাস মৌসুমী এমন কিছু বলেছিলো যে কারণে …
না হলে রাসবিহারীর এই ফ্ল্যাটটা নেওয়ার সময় বাবার উৎসাহ চোখে পড়ার মতো ছিল৷
এমনকী এই ফ্ল্যাট পছন্দের সময় মা বলেছিল, হ্যাঁরে শুভ ব্যালকনি থাকবে তো? আমি কিন্তু তোদের সাজানো টবের পাশে একটা ছোট্ট তুলসী গাছ রাখবো৷ তোরা যতই ব্যাকডেটেড বল না কেন!
সারাজীবন ভাড়া বাড়িতে থাকার পর প্রথম নিজেদের বাড়িতে উঠে আসার উত্তেজনাটাই ছিলো আলাদা৷ তারপরই হঠাৎ করে মা ব্যাগ গোছানো বন্ধ করে উদাস চোখে বলেছিলো, শুভ তোরাই যা ওই ফ্ল্যাটে৷ এত বছরের সংসার ছেড়ে যেতে পারবো না রে৷ শুভ রাগ করেছিলো, অভিমান করেছিলো৷ বাবা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলো, আর মা ওদের সংসারটা গুছিয়ে দিতে সাহায্য করে যাচ্ছিলো৷ ভোলানাথ দত্ত কোনোদিনই খুব সংসারী ছিলেন না৷ বাড়ি করবো, গাড়ি কিনবো এসব ভাবনা থেকে শতহস্ত দূরে থেকেছেন চিরকাল৷ শুধু জলের মতো টাকা খরচ করেছিলেন, শুভেন্দুকে মানুষ করতে৷ ওখানে কোনো কার্পণ্য ছিলো না৷
তারপর মা প্রায় জোর করে ওদের পাঠিয়ে দিয়েছিলো নতুন কেনা ফ্ল্যাটে৷ চলে আসার দিনও মা কপালে হাত ঠেকিয়ে ফিসফিস কিছু বলেছিলো৷
রেহানের জন্মের সময় মা বাবা এসে কয়েকদিন ছিলো এই ফ্ল্যাটে৷ কিন্তু মৌসুমী নার্সিংহোম থেকে ফিরেই দু-জন আয়া নিযুক্ত করতেই মায়েরা ফিরে গেলো বাড়িতে৷
সেদিনও কিছু বলেনি মা৷ তবে শুভেন্দু জানতো নিশ্চয় মৌসুমী কিছু বলেছে৷
এভাবেই কেটে গেলো অনেকগুলো বছর৷ ক্রমশ দুরত্ত্ব বেড়েছে… নিজের সন্তান হয়ে গেছে ক্ষণিকের অতিথি৷
মৌসুমী বললো, দিনরাত অন্যমনস্ক হয়ে থাকার কিছু হয়নি৷ তোমার বাবা মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে নেই৷ যথেষ্ট শক্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুঝলে?
ইউনিভার্সিটির গাছের নিচের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে যাচ্ছে শুভেন্দুর৷ হাতের ওপরে হাত রেখে মৌসুমী বলেছিলো, শুভ তোমার বাবা-মা আমার নিজের বাবা মায়ের মতোই হবে৷ তাদেরও আমি সমান ভাবে ভালোবাসবো৷
প্রেমের শেষ পর্বে যখন মৌকে নিয়ে মায়ের সামনে হাজির হয়েছিলো শুভেন্দু৷ মা ওদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বলেছিলো, তোদের দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে৷ যাক বাবা, আমাকে আর কষ্ট করে মেয়ে খুঁজতে হলো না৷
বাবা বলেছিলো, তোমাদের বাড়িতে আমরা কবে যাবো মৌসুমী? শুভর চাকরি পাবার পরে, নাকি এখনই?
ওকে সেদিনই নিজেদের বাড়ির মেম্বার করে নিয়েছিলো ভোলানাথ দত্ত আর রমলাদেবী৷ মা ইউনিভার্সিটি বেরোনোর সময় প্রায়ই একটা টিফিনবক্স হাতে ধরিয়ে বলতো, মেয়েটার জন্য একটু খাবার বানালাম …দিয়ে দিস কিন্তু৷
মৌ সেইসব ভালোবাসাগুলো কি করে ভুলে গেলো এত তাড়াতাড়ি৷
রাত থেকেই মৌয়ের হঠাৎ করেই পেটের ব্যাথাটা মারাত্মক বেড়েছে৷ আগে বার দুয়েক হয়েছিলো৷ বদহজম বলে ওষুধ খেয়ে চালিয়েছে ও৷ আজ মধ্যরাত থেকেই শুরু হয়েছে অসহ্য যন্ত্রনা৷
পাশে ঘুমন্ত রেহান৷ কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না শুভেন্দু৷ আসলে অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সামলালেও বাড়ির এসব সময় খুব হেলপ্লেস লাগে ওর৷ এইধরণের কিছু হলে সাধারণত বাবাই সামলাত আগে৷ এখন মৌসুমীই সব দিকটা দেখে৷ অসহায় লাগছিলো শুভেন্দুর৷
এত রাতে পরিচিতদের ফোনে বিব্রত করাটা বড্ড খারাপ লাগে৷ নিরুপায় হয়েই বাবাকে ফোনটা করলো শুভ৷
বাবা বেশি প্রশ্ন না করেই ফোনটা রেখে দিল৷
অ্যাম্বুলেন্স-এর ভরসা না করেই নিজের গাড়ি করে নিয়ে যাবে ভাবছিলো শুভেন্দু৷
ছটফট করছে মৌসুমী৷ রেহানকে কার কাছেই বা রেখে যাবে এত রাতে!
ফোন করার ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় বাবা-মা দুজনেই হাজির ওদের ফ্ল্যাটে৷ মা বললো, দেরি না করে, তোরা বেরিয়ে পর, আমি থাকছি রেহানের কাছে৷
নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে মৌ-কে নিয়ে নার্সিংহোমের দিকে ছুটলো ওরা৷
বাবা বারবার বলছিলো, মৌ চিন্তা করিস না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে!
মৌয়ের গল্ডব্লাডারে প্রবলেম ধরা পড়ল৷ অপারেশন না করলেও চলবে,তবে দীর্ঘদিন ওষুধ খেয়ে, খুব সাবধানে থাকতে হবে ওকে৷
মৌসুমীর অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো শুভেন্দুর৷ এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে কেটে যাচ্ছিল ওর দিনগুলো৷ বাবা মায়ের প্রতি টান আবার মৌয়ের ভালোবাসা৷ মৌ শুভেন্দুকে যে ভীষণ ভালোবাসে সে ব্যাপারে নিশ্চিত ও৷ কিন্তু শুভেন্দুর শিকরটা উপড়ে এনে বাঁচিয়ে রাখতে চায় ওকে৷
লোকে বলে, বিয়ের পরে মেয়েরাই নাকি অসহায় হয়ে পড়ে৷ শুধু কি মেয়েরা! শুভেন্দুর এই দোলাচলের নির্ঘুম রাতের সাক্ষী থাকে কেবল ওর ঘরের সিলিং৷ যে বলে, তুমি পুরুষ… তুমি শ্রষ্টা৷ তোমাকে ভেঙে পড়লে চলবে না৷ তোমাকে নোনতা জলেরাও সাহায্য করবে না কষ্ট কমাতে৷
তিনদিন নার্সিংহোমে থেকে ফিরে এলো মৌ৷
রেহানকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিলো মৌ৷
মুখে বলছিলো, নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে শুধুই মনে হচ্ছিলো, আমি যদি না ফিরি তাহলে কি হবে তোর?
তুই মা-কে ছাড়া কি করে থাকবি?
রেহান আলটপকা বলে বসলো, কেন মা… পাপাও তো ঠাম্মাকে ছাড়াই থাকে!
মৌ বড়ো বড়ো চোখে তাকালো মায়ের দিকে৷ আপনি এই দু-দিনেই ছেলেটার মাথায় এসব ঢুকিয়েছেন?
ওই জন্যই বলেছিলাম, যদি নিজের ছেলের উন্নতি চান তো তার থেকে দূরে থাকুন৷ ভাগ্যিস সেদিন আবেগের বশে আপনাদের এই ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে তুলিনি৷ তাহলে এতদিনে এই সংসার…
শুভেন্দু বললো, তুমি এসব কি বলছো! তুমি বাবা মা-কে এসব বলেছিলে?
মৌ তখন উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে৷
হ্যাঁ বলেছি৷ তোমার মা আমরা ওই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফিসফিস করে কীসব বলতো৷ আমাদের খারাপ চাইতো তোমার মা৷ আর সেই জন্যই আমি ওনাদের থেকে তোমাকে আলাদা করতে চেয়েছিলাম৷ তাই জন্যই আজ তোমার এত উন্নতি৷
বাহ্যিক উন্নতিটাই চোখে পড়ে মৌয়ের, শুভেন্দুর ভিতরের ক্ষয়টা অগোচরেই থেকে গেল ওর!
এভাবে মৌ শুভেন্দুর চোখে ধীরে ধীরে নিচু হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে ফেলছে নিজের সম্মান৷
কিছুতেই বুঝবে না মৌ! শুভেন্দু সকলকে নিয়ে থাকতে চায়৷ দুজনেরই পৃথক জায়গা ওর মনে৷
বাবা একপাশে চুপচাপ বসে ছিলো এতক্ষণ৷ এবার বললো, রমলা তুমি সারাজীবন কেউ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফিসফিস করে কি বলতে? আমিও কখনো জানতে চাইনি৷ আজ যখন বদনাম উঠলো তখন শুনতে চাই৷
মা কোনো কথা না বলে, শাড়ি পরে রেডি হয়ে বলল, আর কখনো এ বাড়িতে আসবো না শুভ৷ তুইও আর যাস না৷
শুভ বললো, মা আমি জানি তুমি আমাদের মঙ্গল কামনা করেই কিছু বলতে৷ সকলের সামনে বলে দাও না মা৷
রমলাদেবী দৃঢ় গলায় বললেন,এই শেষ বয়সে এসে পরীক্ষা দিতে পারব না শুভ৷
বেরিয়ে গেছে বাবা মা৷
রেহান খেলছে নিজের মনে৷ মৌ সোফায় বসে টিভি দেখছে৷ শুভেন্দু খবরের কাগজ পড়ার বৃথা চেষ্টা করে চলেছে৷ আর মনে পড়ে যাচ্ছে প্রত্যেক পরীক্ষার আগে সেই মায়ের ফিসফিস করে বলার ভঙ্গিমাটা৷
মৌ বলেছে, ওই বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই নাকি শুভেন্দুর মনের ওপর প্রভাব পড়ে৷ সেটা নাকি মায়ের ওই গুনতুকের কথার জন্যই৷
শুভ অপারগ৷ না বোঝাতে পারেনি মৌ-কে, যে বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ওর যেমন মন খারাপ করে, ঠিক তেমনি শুভেন্দুরও মনখারাপ করে৷
মৌ অশিক্ষিতের মতো বলেই চললো, মা চায় আমার কাছ থেকে তোমাকে আলাদা করতে৷ তাই ফিসফিস করে কি যেন বলে তোমার মাথায় হাত দিয়ে৷
রেহান তিনচাকার সাইকেলে চেপে ডাইনিংয়ে ঘুরতে ঘুরতেই আপন মনে বকেই চলেছে৷ হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা কানে এলো শুভেন্দুর৷
‘ভগবান আমার পরমায়ু ওকে দাও৷ ওর সব দুঃখ আমাকে দাও৷ জীবনের সব সাফল্য ওর হোক৷’ রেহানের আদো আদো কথায় পরিষ্কার হচ্ছিলো না কথাগুলো৷
তবুও শুভেন্দু বার দুই জিজ্ঞেস করতেই রেহান বললো, ঠাম্মি সেদিন আমাকে স্কুল বাসে তোলার সময় বলছিলো৷ আমি সন্ধ্যেবেলা মায়ের জন্য কাঁদছিলাম তখন ঠাম্মি আবার বললো৷ ঠাম্মি বললো, আমার মা নাকি নার্সিংহোমে শুয়ে শুয়ে এগুলোই বলছে৷ আমি শুনতে পাচ্ছি না বলায় ঠাম্মি জোরে জোরে বললো৷ মানে হলো, ঠাম্মির যত বয়েস ততদিন আমি বাঁচবো…
বাড়ির বাইরে থেকেই মায়ের সেই বিশেষ পালংশাক-এর ঘন্টটার গন্ধ পাচ্ছিল শুভেন্দু৷
খুব ইচ্ছে করছিলো সেই আগের মতো মায়ের রান্না ঘরে ঢুকে মা-কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে৷
আজ আর বোধহয় সেটা হয় না৷
শুভেন্দু বললো, মা… আমি তোমাদের কাছে সেই আগের মতো থাকতে চাই৷ থাকতে দেবে না আমায়?
মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ধুর পাগল, ছেলে বড়ো হলে মায়ের কাজ কমে৷ ঝক্কি কমে৷ নিশ্চিন্তে ঈশ্বরের নাম করার দিন আসে৷ তুই এখন সংসারী৷ রেহান আর মৌ আছে৷ তাদের দায়িত্ব তোর৷ তুই ফিরে যা শুভেন্দু৷
আমাদের তোকে ছাড়া থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে রে৷ কিন্তু রেহান আর মৌ তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না৷
রান্নাঘরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মৌসুমী শুনলো তার শ্বাশুড়ীর গুনতুকের ভাষা৷ লজ্জায় নিজের কাছেই নিজে ছোটো হয়ে যাচ্ছিলো ও৷ তবে মানুষটাকে যেটুকু চিনেছে তাতে জানে এত সহজে এই পাথরসম অভিমান ভাঙবে না৷ এই অভিমানকে ওকেই ভাঙতে হবে, মেয়ে হয়ে… বউমা হয়ে নয়৷ ভুলের পাহাড় জমেছিলো এতদিন, কম কথা বলা মানুষটার সম্পর্কে৷
আজ আর এই বাড়িতে ঢুকে ক্ষমা চাওয়ার মুখটাও নেই মৌয়ের৷ ধীরে ধীরে গাড়িতে গিয়ে বসলো ও৷
আজও বাড়ি ফেরার সময় দাঁড়িয়ে থাকলো মা, কিন্তু শুভেন্দুর মাথায় হাত রেখে আর ফিসফিস করে কোনো কথা বললো না৷
তবে শুভেন্দু নিশ্চিত মা মনে মনে নিশ্চয় বলছে, আমার পরমায়ুটা ওর হোক ভগবান…