আজও ছিল গোপন
ডক্টর উনি বাঁচবেন তো? আপনাদের এখানে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেওয়া কি পসিবেল? প্লিজ ডক্টর, ওনাকে বাঁচান৷ আপনি বলছেন, ওনার হার্ট দুর্বল৷মানতে পারলাম না, নিরুপম দত্তর আর যাই দুর্বল হোক, হূদয় কখনো দুর্বল হতে পারে না৷
বয়স্ক ডাক্তার বাবু বেশ কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,আপনি কে? উনি তো বললেন ওনার কোনো রিলেটিভ নেই৷ উনি নিঃসন্তান৷ তাহলে আপনি ওনার কে?
একটু থেমে সুদীপ্ত বললো, আমি ওনার ছাত্র ছিলাম৷ আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন উনি৷ আজ আমার এই প্রতিষ্ঠার পিছনে ওনারই অবদান আছে৷
সম্ভবত বাইপাস করতে হবে৷ তিনটে ভাল্ব ব্লক…
ডক্টরের কথা শেষ হবার আগেই সুদীপ্ত বললো, টাকাটা কোনো প্রবলেম নয়, শুধু যে ভাবে হোক বাঁচান ওনাকে৷
ডক্টর আপাদমস্তক ভালো করে তাকালেন সুদীপ্তর দিকে৷ পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে অর্থ এর কাছে ধরা দিয়েছে স্বেচ্ছায়৷
ডক্টর বললেন, কিন্ত উনি যদি জিজ্ঞেস করেন অপারেশনের খরচ কোথা থেকে এলো?
সুদীপ্ত চমকে উঠে বললো, নাম বলবেন না, বলবেন ওনার এক ছাত্র দিয়েছে৷
একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও আপাতত নিরুপম বাবুর অপারেশনটা জরুরি ভেবেই হয়তো আর কথা বাড়ালেন না৷
ভজহরি নামে নিরুপম বাবুর যে দেহাতি পরিচারক ওনাকে এখানে অজ্ঞান অবস্থায় এনেছে সেই এগিয়ে এসে বললো, তুমি ভাগ্যিস ফোন নম্বরটা দিয়ে গিয়েছিলে, তাই ফোন করে জানাতে পারলাম৷ না হলে দাদাবাবু যা গোঁয়ার একরোখা মানুষ, তাতে তো কাউকে খবর দিতেই দিতো না৷ টাকাও তো তেমন জমাননি কোনোকালে৷ দুঃস্থ ছাত্রদের সাহায্য করেই কাটিয়েছেন গোটা জীবন৷ নেহাত পৈতৃক সূত্রে বাড়ি বা কিছু সম্পত্তি ছিল তাই রক্ষে৷
সুদীপ্ত পেশায় ডাক্তার৷ তবে গায়নোকোলজিস্ট৷ কিন্তু কাছের মানুষের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট শুনে অন্যান্য সাধারণ পেশেন্ট পার্টির মতোই ব্যবহার করে ফেললো দেখে নিজেই চমকে গিয়েছিল ও৷ একজন গায়নো সার্জেন হয়ে ও.টি বা অপারেশন শব্দগুলো ভীষণ চেনা হলেও আজ প্রথম অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে৷ ঠিক যেমন ও অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরোনোর পরে পেশেন্টের বাড়ির লোকেদের উদ্বিগ্ন মুখের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, ঠিক তেমনি ও নিজেও আজ অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে লাল আলো জ্বলা দরজার সামনে৷
বাইপাস সার্জারি হচ্ছে নিরুপম দত্তর৷
এক কালের ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন প্রধান শিক্ষক মহাশয় আজ সংজ্ঞাহীন ভাবে শুয়ে আছেন সাদা চাদরে৷ বেত হাতে বলছেন না, ডিসিপ্লিন কথাটার অর্থ শেখো৷ এটিকেট শব্দের মানে বোঝো… যার জীবনে ডিসিপ্লিন নেই সে কখনো মেরুদন্ড সোজা রেখে চলতেই পারে না৷
আসলে নিরুপম স্যার এমনই একজন মানুষ যিনি অসহায় অবস্থায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন, এটা কল্পনা করাও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য৷
নার্সিংহোমের চেয়ারে বসে এক একটা মিনিটের হিসাব কষছে সুদীপ্ত৷ হয়তো তার চেম্বারের বাইরে আজ বিশাল লাইন, রাজেশ নিশ্চয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে৷ ডক্টর আজ বসবেন না বলতেই সকলে কম্পাউন্ডার রাজেশকেই চেপে ধরবে৷ সব বুঝতে পারছে সুদীপ্ত কিন্তু আজ সে নিরুপায়, একান্ত অসহায়৷
দূরে একটা স্কুলবাড়ি থেকে প্রার্থনা সংগীত ভেসে আসছে৷
একটা ছেলে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে,আজ একটু দেরি হয়ে গেছে ছেলেটার৷ প্রার্থনায় যোগ দিতে পারেনি ছেলেটা ,ভয়ে মুখটা শুকিয়ে গেছে৷ তার আশঙ্কাই ঠিক হলো, স্কুলে ঢুকতেই নিরুপম স্যারের মুখোমুখি৷ স্যার কোনো কথা না বলে গোটা স্কুলের সামনে ক্লাস নাইনের ফার্স্ট বয়কে কান ধরে নীলডাউন করে দিলেন৷ লজ্জায় চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার৷ চোখ থেকে দু-ফোঁটা অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে৷ দূর থেকে ক্লাসের ছেলেরা আওয়াজ দিলো, সুদীপ্ত কাঁদিস না রে… ফার্স্টবয়রাও নীলডাউন হয়, মেনে নিতে শেখ৷
কষ্টটাকে গলার মধ্যে রেখে দিয়েই সেদিন ওই সবুজ মাঠে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকা ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করেছিল, একদিন স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে নিরুপম দত্তকে বলতেই হবে, ঋষি অরবিন্দ বিদ্যালয়ের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছেলেদের তালিকায় সুদীপ্ত রয়েছে৷ নিরুপম স্যার একদিন স্বীকার করবেন,আজকের শাস্তিটা সুদীপ্তর প্রাপ্য ছিল না৷
দাঁতে দাঁত চেপে মাঠের রোদে বসেছিল সুদীপ্ত৷ পুরো চল্লিশ মিনিট মনে মনে শুধু একটাই কথা আউড়ে গিয়েছিল, একদিন আসবে… নিশ্চয়ই আসবে৷
বাড়ি ফিরতেই মা সুদীপ্তর নিভে যাওয়া মুখ দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন,কি হয়েছে? সুদীপ্ত সেদিন একটা কথাই বলেছিল, একদিন দেখিয়ে দেব,আমিও পারি৷
সুদীপ্ত যে ঘরটায় পড়তো সেই ঘরে একটা শক্ত চেয়ার, আরেকটা টেবিল, টেবিলে একটা টেবিল ল্যাম্প৷ আরেক পাশে তোষক পাতা সিঙ্গেল খাট৷ যে কেউ ওই ঘরে ঢুকলেই বুঝতে পারবে ওদের তিনতলা শ্বেত পাথরের মেঝের অবস্থাপন্ন বাড়িটার সব থেকে দৈন্য ঘরটা সুদীপ্তর জন্য বরাদ্দ৷ সুদীপ্ত টেবিল ল্যাম্পের হলদে আলোয় মধ্যরাতে ঘুম চোখে পড়তে পড়তে কতবার ভেবেছে একবার অন্তত মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে আদর খেয়ে আসতে৷ কিন্তু ততবারই নিরুপম বাবুর ক্লাসের মধ্যে করা বিদ্রুপ কানে ভেসে উঠেছে৷ মাধ্যমিকে জেলার সেরা হলেই যে সে জাতে উঠে গেল এমন নয়৷
ওই খটখটে কথাগুলোই রাত পর্যন্ত ঘুমোতে দিত না সুদীপ্তকে৷ ঘুমও বোধহয় ভয় পেত ওনাকে, তাই সুদীপ্তর ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি৷
সেদিন ছিল এপ্রিলের একটা কালবৈশাখীর সন্ধ্যে৷ সারাদিন দাবদাহের পর সন্ধ্যেবেলা উত্তাল হাওয়া আর উদ্দাম বৃষ্টিতে তাপমাত্রা একটু কমেছিলো৷ মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল থেকে সুদীপ্ত বেরিয়েছিলো বৃষ্টি থামার ঠিক পরেই৷ শহুরে গাছপালাগুলোও ঝড়ের দাপটে কুপোকাত, গ্রামের গাছপালারা অনেক সহনশীল হয়, মাটি কামড়ে বসে থাকে৷ যেমন হোস্টেলের ওই ভয়ানক র্যাগিং-এর পরেও সুদীপ্ত মাটি কামড়ে পড়ে আছে নিজেকে প্রমাণের জন্য৷ কয়েকজন তো অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে, এখনো ফেরেনি৷ না, তিনদিন বিছানায় শুয়ে থাকলেও বাড়ি ফেরেনি সুদীপ্ত৷ জয়েন্টে র্যাঙ্ক করার পরেও নিরুপম বাবু বলেছিলেন, সিঁড়ির নিচের ধাপে দাঁড়িয়ে আছো, ছাদে পৌঁছাতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হবে৷ কখনো এতটুকু প্রশ্রয়ের হাসি হাসতে দেখেনি সুদীপ্ত৷ ওই মুখে হাসি দেখার লোভে, ওই গলায় প্রশংসার ভাষা শোনার লোভে সুদীপ্ত দিনরাত এক করে পড়েছে তবুও কখনো মুখের কোনো রেখা নরম হয়নি নিরুপম বাবুর৷ সুদীপ্তর জেদ আরো বেড়েছে৷
কালবৈশাখী বিধস্ত বৃষ্টিভেজা রাস্তায় আনমনে হাঁটছিলো সুদীপ্ত৷ পেনের রিফিল শেষ হয়ে গেছে৷ ওর ফেবারিট পেন৷ জন্মদিনে মায়ের কাছ থেকে গিফট পেয়েছিল ও৷ সেইদিন থেকে এই পেনটাতেই লেখে ও৷ পেনবক্সে অনেক পেনের ভিড় হলেও এই ব্রাউন কালারের পেনটা ছাড়া যেন ওর অক্ষরেরা কথা বলে না৷
চোখে তীব্র আলো আর কানে বিকট আওয়াজ আসতেই থমকে গিয়েছিল ও৷
সামনেই মৃত্যুর হাতছানি৷ একটা চার চাকা এসে ওর পায়ের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়ালো৷ সাবধানী গাড়ি চালক, তাই আজ বেঁচে গেল সুদীপ্ত৷
গাড়ি থেকে নেমেই বছর উনিশের মেয়েটা রাগী গলায় বলল, কাওয়ার্ড! এভাবে সুইসাইড করতে বেরিয়েছেন৷ জীবনের সব পাওয়ার মধ্যে একটা না পাওয়া হলেই আপনাদের মরতে ইচ্ছে করে তাই না?
অবস্থার আকস্মিকতা কাটিয়ে সুদীপ্ত বলেছিল, সরি ম্যাম৷ ততক্ষণে গাড়ির চালক একটু বয়স্ক মানুষটি বেরিয়ে এসে বলছেন, আহা! উর্মি ওভাবে না বকে দেখ ওর কোথাও লাগলো কিনা!
শোনো বাবা, এরা তো নিজের বাবা-মায়ের কথা না ভেবেই জীবন শেষ করতে বেরিয়েছিলো, তাই ওসব ছোটখাটো কাটা ছেঁড়ায় এদের বিশেষ লাগে না৷ মেয়েটার কথার ধরনে সুদীপ্তর মারাত্মক রাগ হয়েছিলো৷ মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে সুদীপ্ত বলেছিলো, শুনুন স্যার আমি কোনো ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষ নয়৷ আমি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট৷ একটা প্রয়োজনে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম৷ হ্যাঁ, অন্যমনস্ক ছিলাম ঠিকই..
কথা শেষ না করতে দিয়েই উর্মি নামক বাচাল মেয়েটা বলে উঠলো, যাক আপনার যে লজ্জা হয়েছে এতেই আমি সুখী৷ সুইসাইড করা যে অন্যায় সেটা যে বুঝেছেন সেটাই যথেষ্ট৷
কি একরোখা অসভ্য মেয়েরে বাবা, সুদীপ্ত এতবার বলার পরেও সেই একই পয়েন্টে ফিক্সড হয়ে আছে৷
সুদীপ্ত রেগে মেগে বলেছিলো, হ্যাঁ আমার খুব দুঃখ, আমার গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে তাই আমি মরতে যাচ্ছিলাম, এবার হ্যাপি?
উর্মি চোখ বড়ো বড়ো করে বলেছিলো, শুনলে বাপি শুনলে… বলেছিলাম না, ব্রেকআপের পরে সুইসাইড করাটা এখনকার ছেলেদের একটা ফ্যাশন৷ এ একবার ব্যর্থ হয়েছে, আমরা বেরিয়ে গেলেই হয়তো গাড়ি ছেড়ে রেললাইন বাছবে৷ একে আজ রাতে আমাদের বাড়িতেই আটকে রাখতে হবে৷ সুদীপ্তর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো৷ কি ভয়ংকর মেয়ের পাল্লায় পড়লো রে বাবা৷ হোস্টেলে বলা নেই যে আজ বাইরে থাকবে৷ গেটম্যান রঘুদা দেখেছে ওকে বাইরে বেরোতে৷ বাবা মেয়ের মধ্যে চোখের ইশারাটা বোঝার আগেই সুদীপ্তকে প্রায় ধরে পাকড়ে গাড়িতে তোলা হলো৷ নিরুপায় সুদীপ্ত গাড়ির নরম সিটে গোঁজ হয়ে বসেছিল৷ উর্মি বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছিলো৷
জীবনে একবার হেরে যাওয়া মানেই ব্যর্থতা নয়, জীবন অনেক বড়ো৷ আত্মহত্যা তারাই করে যারা লড়তে জানে না৷
উর্মির বাবা, ভদ্রলোক একমনে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, আর মেয়ে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার বিতরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল৷
সুদীপ্ত রাগী চোখে তাকিয়ে বলেছিলো, উচচমাধ্যমিকে কত পার্সেন্টেজ মার্কস পেয়েছো?
মেয়েটি চমকে উঠে বলেছিলো, (?)৷
সুদীপ্ত আরো গম্ভীর গলায় বলেছিলো, (?)৷
উর্মি মুখে চিকচিক আওয়াজ করে বলেছিল, ছি ওই (?) এর জন্য এরকম কাজ করছিলে?
না, আমি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, সেকেন্ড ইয়ার…
আমি বোঝাতে চাইলাম (?) পেয়েও যদি তুমি এমন সেজেগুজে ঘুরতে পারো, তাহলে আমি অত নাম্বার পেয়ে কেন সুইসাইড করতে যাবো?
মেয়েটি বড়ো বড়ো চোখ করে বলেছিল, ওটাই তো… ভালো ছেলেদের ফ্রাস্ট্রেশন বেশি হয়৷
পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে৷
উর্মি কলিং…
তুমি কোথায় সুদীপ্ত? রাজেশ বললো, তুমি নাকি চেম্বার করোনি?
এই একটা মানুষের কাছেই মিথ্যে বলতে পারে না সুদীপ্ত৷
আমি বাঁকুড়াতে আছি৷ একটা নার্সিংহোমে৷
উর্মি আরেকটু গভীর স্বরে বললো, নিরুপম বাবু ভালো আছেন? ওনার কিছু হয়নি তো?
প্রথম দেখার দিনের ভুল বোঝাবুঝির পর থেকেই উর্মি বোধহয় সুদীপ্তর প্রতিটা নিঃশ্বাস চিনতে পারে৷ আজ দশ বছর পরেও একই ভাবে বুঝতে পারে সুদীপ্তর অন্তরটা৷
সুদীপ্ত কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললো, তুমি খেয়ে নিও প্লিজ, আমার হয়তো দেরি হবে বাড়ি ফিরতে৷
গত তিনবছরের বিবাহিত জীবনে এই একটা ব্যাপারেই উর্মিকে অন্ধকারে রেখেছে সুদীপ্ত৷ আজও আলগোছে এড়িয়ে গেলো বিষয়টা৷ উর্মি হয়তো কিছু বুঝেই বললো, সাবধানে ফিরো৷
বহু বছর আগের ভাবনায় আবার ছেদ পড়লো৷ অতীতে ফিরে গিয়ে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে সময়ের হিসেব ছিলো না সুদীপ্তর৷ মনে হচ্ছিলো কয়েক যুগ কেটে গেছে বোধহয়৷ ঘড়ির কাঁটায় মাত্র ত্রিশ মিনিট পেরিয়েছে৷ অপেক্ষার আরো দেড় ঘন্টা এখনো বাকি৷ ও. টি.-র সামনে এভাবে বসে থাকার অভিজ্ঞতা এই প্রথম৷ কারণ সুদীপ্তর মা যখন মারা গিয়েছিলেন তখন ও ছিলো বাড়ির বাইরে৷ সবে সেই বছর ডাক্তারি পাশ করেছিলো৷ নিজে ডাক্তার হয়েও সেরিব্রাল অ্যাট্যাকে চলে যাওয়া মা-কে আটকাতে পারেনি সুদীপ্ত৷ ওর মনখারাপের দিনে, অনবরত অবাধ্য জলের ধারা গাল বেয়ে নেমে আসার দিনে মা-ই ছিল একমাত্র বন্ধু যিনি বলতেন, নিজেকে প্রমাণ কর, দেখবি ভালোবাসা, সম্মান তোর পদচুম্বন করবেই৷ মায়ের সব কথার অর্থ বুঝুক না বুঝুক এটুকু বুঝতো মা কখনো মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে পারে না৷
লালপেড়ে আটপৌরে শাড়ি পরা নিতান্ত গ্রাম্য মহিলার মধ্যেও যে এত ব্যক্তিত্ব থাকতে পারে, এত সহনশীলতা থাকতে পারে সেটা সুদীপ্ত বুঝেছিলো ওর মাকে দেখেই৷ সেই মাও যখন চলে গেল তখন ও একবারে একা হয়ে গেল৷ কারণ বাবার সাথে ওর মনের দূরত্ব সেই শিশুবেলা থেকেই৷ অন্যান্য বন্ধুদের মত ও কখনো বাবার গলা জড়িয়ে বায়না করেনি৷ কখনো বলেনি বাবা, আমাকে একটা চকলেট কিনে দেবে! বাবা যেন ভিন গ্রহের বাসিন্দা৷ বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেললেও মা বলতো, তোর বাবার সাইকেলের বেল শুনলাম, ব্যাট রেখে পড়তে বোস৷ বাবা আর ভালোবাসা শব্দ দুটো তাই সুদীপ্তর কাছে ছিল সম্পূর্ন বিপরীতধর্মী দুটো শব্দ৷যাদের মেলবন্ধন কখনো সম্ভব নয়৷তাই বাবার কাছে ভালোবাসা আদর এগুলো প্রত্যাশা না করেই শুধু মা-কে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খেয়েছিলো সুদীপ্তর জীবন৷ তারপর অবশ্য উর্মি এসেছিলো৷ কালবৈশাখী থেমে যাবার পরেই আরেক দমকা বাতাস এসেছিলো সেদিন সন্ধ্যেতে৷ ভাবলেই আজও ঠোঁটের কোণে হাসি এসে যায় সুদীপ্তর৷
উর্মিদের বাড়ির সামনে যখন ওদের গাড়িটা থামলো তখন রাত প্রায় নটা৷ উর্মি গোটা গাড়িতে জোর করে সুদীপ্তর ডান হাতটা ধরেছিলো৷ ওর সন্দেহ ছিল আত্মহত্যা করতে না পারা মানুষ মরিয়া হয়ে হয়তো চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে আবার অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবে৷ ওই মেয়েকে বোঝানো সম্ভব নয় ভেবেই সুদীপ্ত মুখ বন্ধ করে বসেছিলো৷ উর্মির বকবক তাতে একটুও কমেনি৷ ও যে ফার্স্ট ইয়ার ইকোনমিক্স অনার্সে আশুতোষ কলেজে পড়ে আর একটা এন.জিও.তে যুক্ত হয়েছে রিসেন্ট… সমস্ত বলে গেল এক নিঃশ্বাসে৷
তার মাঝে মাঝেই সুদীপ্তর প্রতি নির্দেশ দিচ্ছিলো, রাগ শরীর মন সব কিছুর জন্যই বড়ো ক্ষতিকর৷ গার্লফ্রেন্ডের ওপরে রাগ করে সুদীপ্ত আজ যেটা করতে যাচ্ছিলো তাতে ওর মা কত কষ্ট পেতো৷ ছেলে হিসাবে মায়ের কথাটাও তো সুদীপ্তর বোঝা উচিত৷ চোখ বন্ধ করে সুদীপ্ত যেন ওর মায়ের মুখটা ভাবে, আর এক থেকে একশো উল্টো দিকে গোনে৷ তাহলেই ওর মৃত্যু চিন্তা মাথা থেকে পালাবে৷
চূড়ান্ত অধৈর্য্য হয়েই সুদীপ্ত বলেছিলো, মৃত্যু চিন্তাটা কিছুতেই যাচ্ছে না৷ এই মুহূর্তে ওর উর্মিকে খুন করতে ইচ্ছে করছে৷ সেটা শুনে মেয়ে আরেকটু চেপে ধরেছিলো সুদীপ্তর হাতটা৷ বলেছিলো, তাহলে দুশো থেকে গুনতে শুরু করো৷ উর্মির সহজ সরল সমাধান দেখে আর রাগ করে থাকতে পারেনি সুদীপ্ত৷ বরং পুতুল পুতুল মেয়েটার নরম হাতের মধ্যে নিজের হাতটাকে সমর্পণ করে চুপচাপ বসেছিলো ও৷ উর্মির উষ্ণ স্পর্শ সুদীপ্তর পড়াশোনা করা ভালোছেলের ইমেজের ভিতে ভাঙ্গন ধরাচ্ছিলো যেন৷
উর্মির মা-ও সুদীপ্তকে অনেক বোঝালেন, বাবা মায়ের মুখটা মনে করেও যেন ভবিষ্যতে এমন কাজ আর না করে ও… উর্মির গম্ভীর বাবাও বললেন,যখনই একা লাগবে উর্মির কাছে এসে গল্প করো৷ তবুও ওসব কাজ ভুলেও করতে যেও না৷
তারপর থেকে প্রতিদিন রাতে হোস্টেলের সিনিয়র ছেলেরা ডাইনিং হল থেকে ডেকে বলতো, সুদীপ্ত তোর গার্লফ্রেন্ড ফোন করেছে দেখ৷
রোজ রাতে নয়টায় হোস্টেলের ল্যান্ডফোনের রিংটা শুনলেই রিসিভ না করেও কেউ না কেউ হাঁক পারতো, সুদীপ্ত তোর ফোন৷
ফোনটা ধরতেই উর্মি বলতো, ভালো আছো৷ পড়াশোনা ঠিক চলছে৷ এখন আর এক্সের কথা ভেবে মনখারাপ করো না৷ ওই সব ভুল কাজ করতে যেও না কিন্তু৷
প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও পরে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল সুদীপ্তর৷ তখন ন-টা পাঁচ বাজলেই কান খাড়া করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো উর্মির ফোনের৷
সুদীপ্ত কাউকে বোঝাতে পারেনি উর্মি ওর প্রেমিকা নয়৷ উর্মি সেই অর্থে ওর বন্ধুও নয়৷ আসলে উর্মি যে সুদীপ্তর ঠিক কি, সেটাই বোধহয় রহস্য৷
বন্ধুদের পরামর্শেই ফাগুনের এক কৃষ্ণচূড়া রঙিন হওয়া বিকালে সুদীপ্ত দেখা করেছিল উর্মির সাথে৷
উর্মির হালকা গোলাপি ওড়না আর দুরন্ত চুল, কথা না শোনা অবাধ্য দুষ্টু ছেলের মতোই উড়ছিলো হাওয়ায়৷ সেদিকে আনমনে তাকিয়েই সুদীপ্ত বলেছিলো, বহুদিন রোজ ফোনে খোঁজ নিয়ে তুমি আমাকে আগলে রেখেছো৷ কিন্তু এটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে৷ আমার গার্লফ্রেন্ড ফিরে এসেছে৷ সেই এবার থেকে আমার খোঁজ রাখবে, তাই আজ থেকে তোমার ছুটি৷ কুনাল বারবার বলেছিলো কথাটা বলার সময় যেন তোর মুখে হাসি না থাকে, বরং উর্মির জন্য একটু দুঃখ৷ কিন্তু অভিনয়ে বরাবরই ভীষণ দুর্বল বলেই স্কুলের নাটকে ওকে মৃত সৈনিকের পার্ট দেওয়া হয়েছিল৷ সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ কথাটা বলার সময় সুদীপ্তর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে গিয়েছিল উর্মি৷ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, লজ্জা করে না! আত্মসম্মান নেই তোমার! একদিন যে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, যার জন্য ঝড় বৃষ্টির রাতে সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে, সে ফিরতেই তুমি গলে জল হয়ে গেলে?
প্রায় চিৎকার করেই উর্মি বলেছিলো, আর আমি যে তোমাকে ভালোবাসি… সেটার কি হবে?
সুদীপ্ত ওর কথার সূত্র ধরেই বলেছিলো, কই এ কথা তো তুমি কখনো বলোনি, যে তুমি আমাকে ভালোবাসো৷
উর্মি আরেকটু রেগে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলেছিলো, ভালোই যদি না বাসবো তবে গত দশ মাস ধরে রেগুলার তোমার হোস্টেলের ফোনে ফোন করে করে নম্বরটা মুখস্থ করে ফেললাম কি করে?
সুদীপ্ত উর্মিকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলো, সারাজীবন এভাবেই আমাকে আগলে রাখবে তো? কেউ ছিল না আমার জীবনে৷ আমি সুইসাইড করতেও যাচ্ছিলাম না সেদিন, এগুলো যেমন সত্যি, তেমনি আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি সেটাও ধ্রুব সত্য৷
তারপর মান অভিমানের পর্ব মিটিয়ে ভালোবাসার নৌকায় পাড়ি দিতে দিতেই ওরা কাটিয়ে দিলো আরো দশ বছর৷ সাত বছরের প্রেম পর্ব সেরে দুটো ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিও কাটিয়ে ফেলেছে ওরা৷ উর্মি সব সময় আগলে রেখেও সুদীপ্তর ওই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার স্বভাবটার পরিবর্তন করতে পারেনি আজও৷
কলকাতার নামী গাইনো সার্জেন, সুন্দরী স্ত্রী, অর্থ, সম্মান সব পেয়েও যেন সুদীপ্ত বড্ড অসুখী৷ উর্মি বহুবার জিজ্ঞেস করেছে, সমস্যাটা ঠিক কি?
সুদীপ্ত যখন সবে পাশ করেছে তখনই হঠাৎ একদিন খবর পেয়েছিল মা মারা গেছেন৷ সুদীপ্ত আর উর্মির বিয়েতে আত্মীয় বলতে সবই উর্মির বাড়ির, আর সুদীপ্তর কয়েকজন কলিগ আর বন্ধুবান্ধব উপস্থিত ছিল৷ সুদীপ্তর বাড়ির কাউকে চেনে না উর্মি৷ এমনকী ওর গ্রাম বিদ্যাসাগর পল্লীতেও কখনো নিয়ে যায়নি ওকে৷ শুধু শুনেছিলো ঋষি অরবিন্দর একজন শিক্ষকই নাকি বলেছিলেন, সুদীপ্ত বড়ো হয়ে অমানুষ হবে৷ ওই কথাটাই বারংবার আঘাত করতো সুদীপ্তকে৷ তবুও উর্মি বুঝেছিলো ওর শিক্ষক নিরুপম বাবুর প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা মিশ্রিত রাগ আছে৷ যদিও যতবারই উর্মি নিরুপম বাবুর কথা জিজ্ঞেস করতো ততবারই সুদীপ্ত বলতো, ওনার মতো শিক্ষক আমি খুব কমই পেয়েছি৷ এছাড়া শ্বশুরবাড়ির দিকের কারোর নামও কখনো শোনেনি উর্মি৷ এমনকী বাঁকুড়া যাবার নাম করলেও নিয়ে যায়নি সুদীপ্ত৷
মাস ছয়েক আগে এমনই সকাল থেকে বেপাত্তা ছিলো সুদীপ্ত৷ ফোনের পর ফোন করে জেনেছিলো ও নাকি বাঁকুড়া গেছে৷ স্কুলের কৃতী ছাত্রের সম্মান পেয়ে পুরস্কার নিতেই নাকি গিয়েছিলো৷
হ্যাঁ, উর্মি অবশ্য তাই জানতো, কিন্তু শুধু পুরস্কার নিতেই বিদ্যাসাগর পল্লীতে আসেনি সুদীপ্ত৷ সাথে নিরুপম বাবুর বিশ্বস্ত পরিচারক ভজহরির সাথেও দেখা করেছিলো লুকিয়ে৷ নিজের ফোন নম্বরটাও দিয়ে গিয়েছিলো তখনই৷
লাল আলো নিভে গেল৷ অপারেশন কমপ্লিট… উদগ্রীব সুদীপ্ত ভয়ে ভয়ে তাকালো বন্ধ দরজার দিকে৷ ডক্টর বিশ্বাস বেরিয়েই বললেন, বয়সটা তো অস্বীকার করলে চলবে না৷ নিরুপম বাবুর বয়েস প্রায় সত্তর বাহাত্তর তো হবেই৷ এ বয়েসে এতবড়ো একটা অপারেশনের পর একটু সময় তো লাগবেই৷
তবে এ যাত্রা বোধহয় বেঁচে গেলেন৷
ডক্টরের মুখে আশার বাণী শুনে একটা কথাই মনে হলো, অনেক সময় সারাদিনের প্রেশারের পরে সুদীপ্ত কখনো কখনো পেসেন্টের বাড়ির মানুষগুলোকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে দেয়, প্রি ম্যাচিউরড বেবী৷ মায়ের অবস্থাও খুব ভালো নয়৷ তখন ও. টি.-র বাইরের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা মানুষটার ঠিক কতটা ভয় করে সেটা ভেবেই আঁতকে উঠলো সুদীপ্ত৷ যাক,নিরুপম দত্ত তাহলে ঠিক হয়ে যাবেন… এই আশাটুকই এই মুহূর্তে বড্ড প্রয়োজন ছিল ওর৷
আই. সি. ইউ.-তে রয়েছেন নিরুপম বাবু৷ বাইরের ছোট্ট কাঁচ দিয়েই দেখছিলো সুদীপ্ত, সেই চূড়ান্ত অহংকারী মানুষটাকে৷ ধবধবে সাদা চাদরে চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে আছেন৷ নিজেকে সারাজীবন ধরে ছাত্র তৈরির কারখানা মনে করে, বাইরের মুখোশটা পরেই নিজের শখ আহ্লাদ ত্যাগ করে কাটিয়ে দিলেন জীবনটা৷ মানুষটাকে দেখলেই মনে হয় মায়া-দয়াহীন যন্ত্র৷ যার কাছে আবেগ, চোখের জলের তিলতম মূল্য নেই৷
পিছন থেকে ভজহরিদা বললো, ডাক্তার বাবু বললেন, এখনো ইনজেকশন দেওয়া আছে, তাই ঘোরের মধ্যে আছেন৷ কাল সকালের আগে কথা বলা যাবে না ওনার সাথে৷
আপনি চলুন না আমাদের বাড়িতে, আজ রাতটা থাকবেন৷
এতক্ষণের উত্তেজনায় শরীরটাও অবশ লাগছিলো সুদীপ্তর৷ এমনিতেও কলকাতা থেকে এতটা পথ ড্রাইভ করে আসা, তারপর মনের এই মারাত্মক টানাপোড়েনে ও সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত৷
উর্মিকে ফোন করে বললো, অপারেশন হয়ে গেছে, কিন্তু আজ রাতে ফিরছি না৷ কাল ওনাকে দেখে দুপুরের দিকে ফিরবো৷
উর্মির এই এক অদ্ভুত স্বভাব, মনের মধ্যে যতই কৌতূহল থাকুক, পরিস্থিতি বিচার করে সে কৌতূহল দমন করতে ও পারে৷ আজও তার ব্যতিক্রম হলো না৷ আলতো করে শুধু বললো, সাবধানে থেকো৷
ভজহরিদার বাড়ির রাস্তাটা ওর ভীষণ চেনা৷ বাড়ির উঠানে পা দিতেই একঝাঁক শৈশবের স্মৃতি আবিষ্ট করে দিলো সুদীপ্তকে৷
ভিজিটিং আওয়ারের বেশ কিছুটা আগেই নার্সিংহোমের দরজায় উপস্থিত হয়েছে সুদীপ্ত৷ বুকের ভিতর তোলপাড়৷ কত বছর পর আবার মুখোমুখি হবে নিরুপম বাবুর৷ ঠিক কি বলে শুরু করা উচিত! স্যার কেমন আছেন? নাকি অন্য কিছু…
ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেল নার্সিংহোমের ভিতরে৷ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা… এক এক মিনিট যেন কয়েক বর্ষ দূর৷ তবুও অপেক্ষার সময় শেষ হলো… নিরুপম দত্তর বাড়ির লোকের ডাক পড়লো৷
খুব ধীরে পায়ে বেডের সামনে এসে দাঁড়ালো সুদীপ্ত৷
এখন কেমন আছেন?
বন্ধ চোখ দুটো খুলেই নিজের চমকানো ভাবটা কাটিয়ে সেই গম্ভীর স্বরেই বললেন, তোমাকে কে খবর দিলো?
ভজহরিকে এবার ছুটি দিতে হবে দেখছি৷
অভিমানে সুদীপ্তর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো৷ আমি এসে কি আপনার মান খোয়ালাম?
সে তো ডাক্তারি পাশ করে যখন কলকাতায় স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করলে সেদিনই তুমি তোমার জন্মভূমিকে অসম্মান করেছো৷ এখানের হসপিটালেও সন্তান জন্ম নেয়, এখানে ভূমিষ্ঠ হয়েও সদ্যোজাতরা প্রসূতিকে মা বলেই চিৎকার করে৷ অথচ এখানের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরা এ অঞ্চলের হসপিটালকে পরিত্যাগ করে রুরাল হসপিটালে কোনো ফেসিলিটিস নেই বলে৷
অল্প অল্প হাঁপাচ্ছেন নিরুপম বাবু৷
এখুনি এতগুলো কথা একসাথে বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি৷
সুদীপ্তর চোখে জল৷
আপনার ডায়রি পড়লাম কাল সারা রাত ধরে৷ কঠিন আবরণের ভিতরের নিরুপম স্যারকে চিনলাম ভজহরিদার তিনমহলা বাড়ির দক্ষিণের ঘরে গিয়ে৷ কবে থেকে ওই ঘরে বাস করছেন আপনি?
শুধু তোষক পাতা খাটে শুতে কষ্ট হয় না আপনার?
একটু থেমে নিরুপম বাবু বললেন, যেদিন থেকে ওই বাড়ির অকৃতজ্ঞ ছেলে কলকাতাবাসী হয়েছে সেদিন থেকেই৷
এটিকেটটা আজও শিখলে না৷ অন্যের ডায়রি না বলে পড়তে নেই এটুকুও শেখায়নি তোমার শহুরে শিক্ষা!
সুদীপ্ত আজ মরিয়া… ছিঁড়তেই হবে ওই কাঠিন্যের মুখোশ৷ শুধু ভুল বুঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর৷
আপনার ডায়রির প্রথম পাতায় দেখলাম… দীপকে আজ স্কুলে নীলডাউন করিয়ে রেখেছিলাম, অঘোরে ঘুমুচ্ছে ছেলেটা৷ হাঁটু দুটোতে কালচে ছোপ৷ কোনোদিন যেন না ভাবে হেডস্যারের ছেলের সব অন্যায়েরই ছাড় মিলবে৷ স্কুলে লেট করে আসার শাস্তি সকলকে যা দেওয়া হয় তাই দিলাম৷
পরের পাতায়…
দীপকে প্রথম দিন স্কুলে যাবার সময়েই বলেছিলাম, আজ থেকে স্যার বলবে, বাবা ডেকে ফেলো না স্কুলে৷ দীপের ঠোঁট কেঁপেছিলো৷ তবে প্রমান করলো ও নিরুপম দত্তর ছেলে৷ কী মারাত্মক জেদ ওই ছেলের, কখনো কখনো বাবা ডাকটা শোনার জন্য আকুল হয়ে উঠতো মন, তবুও দীপ কঠিন স্বরে বলতো, নিরুপম বাবু, নয়তো হেড স্যার৷
দীপের মা একবার বলেছিলো, ধুর পাগল বাড়িতে বাবা বলিস না কেন?
ছেলের স্পষ্ট উত্তর ছিলো, বদ অভ্যাস ত্যাগ করেছি৷ বাবা ডাকটা ভুলেছি অনেক কষ্টে৷ স্কুলে গিয়ে সিলি মিসটেক করলে নিরুপম দত্তের সম্মানহানির সম্ভাবনা আছে৷
কথাগুলো বলার সময় অভিমানে বুজে গিয়েছিলো দীপের গলা৷
যেদিন প্রথম ওর মা এসে বলেছিলো, দীপ নাকি কোনো একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে… সেদিনই ভেবেছিলাম, পড়াশোনা, কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে৷ শেষ হয়ে যাবে আমার সব স্বপ্ন৷ ফোন ধরে একটা কথাই বলেছিলাম, আমি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দেব, এ বাড়িতে আর ঢুকো না কখনো৷ দীপের মা বলেছিলো, পাষান হূদয়৷
দীপ জানতো, তার বাবা নামক যন্ত্রটা বোধহয় শুধু বেত নিয়ে শাসন করতেই জানে, এটা জানতো না, যে রোজ রাতে দীপ ঘুমিয়ে গেলে ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ে পাতলা চাদরটা আমিই ঢেকে দিতাম৷ থাক, লুকিয়ে থাক পিতৃস্নেহ৷ প্রকট হোক শিক্ষকের শাসন৷
পরের পাতা ওল্টালো সুদীপ্ত…
ভেবেছিলাম, ডাক্তারি পাশ করে বাঁকুড়ার হসপিটালে চাকরি নেবে৷ অন্তত গ্রামে ফিরে এসে এখানে মানুষদের কথা ভাববে…
নিরুপম দত্ত ব্যর্থ শিক্ষক, ছাত্র গড়ার কারখানায় রয়ে গেলাম, মানুষ গড়তে পারলাম কই!
মন খারাপ করে, বিশেষ করে যেদিন পুকুরে মাছ ধরা হয়, ভজহরিকে এত বারণ করি, পেটির মাছটা আমার পাতে না দিতে… ওটা তো দীপ খেতো, কাঁটা বাছতে পারতো না ভালো৷
বাবাকে ভুলে গেছে দীপ, সাথে নিরুপম স্যারকেও৷
হঠাৎই নিরুপম বাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, বন্ধ করো তোমার ডায়রি পড়া৷
ডায়রির পাতাটা বন্ধ করলো সুদীপ্ত৷
অভাবনীয় একটা দৃশ্যের সম্মুখীন হলো ও৷
কঠিন কঠোর মানুষটার গাল বেয়ে নোনতা জল গড়িয়ে পড়ছে৷
কাঁপা হাতে জলটা মুছে দিলো সুদীপ্ত৷ বার তিনেক বা… বা… উচচারণ করেও বাবা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ও৷
পকেটের মুঠোফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো৷ ফোনটা ধরতেই উর্মি বললো, সুদীপ্ত, উর্মি নিরুপম স্যারই তোমার বাবা? কখনো বলোনি কেন? আলমারি গোছাতে গিয়ে তোমার মাধ্যমিকের রেজিস্ট্রেশন কার্ডটা পড়লো ওপরের তাক থেকে৷ ওখানেই দেখলাম…
সুদীপ্ত বললো, বাবা… হ্যাঁ আমার বাবা৷
নিরুপম স্যার সাড়া দিয়ে উঠলেন ছেলের ডাকে, বল দীপ, কিছু বলছিস…
অবশেষে বাবা ডাকটা সম্পূর্ণ করতে পারলো ও৷
বাবা, আমি বাড়ির একতলায় চেম্বার করতে চাই, সপ্তাহে একদিন এখানে বসবো আপাতত৷
নিরুপম দত্তরের ভাঁজ পরা গালে হালকা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো… যেন মনের আনন্দটা ছেলের সামনে কিছুতেই প্রকাশ না পায়, সেভাবেই বললেন, হ্যাঁ তোমার মায়েরও ইচ্ছে ছিলো তুমি অন্তত একদিন বিদ্যাসাগর পল্লীতে কম ভিজিটে রুগী দেখো৷
সুদীপ্তও হাসলো মনে মনে, কিছুতেই নিজের ইচ্ছে প্রকাশ না করাটা মানুষটাই তো তার আদর্শ শিক্ষক৷ ভাবাবেগ চেপে রাখা মানুষটাই তো তার বাবা৷ শুধু মনে মনে বললো, এমনই থেকো বাবা, নত হওয়া তোমাকে মানায় না৷