অভিনয়
অনেক কষ্ট করে বেশ কয়েক জনকে ধরে পাকড়ে অবশেষে এই কাজটা পেয়েছে তরুণ৷ মা বারবার বলেছে, এবার অন্তত চুরি জোচচুরি ছেড়ে একটু কাজে মন দে বাবা৷ তরুণ মাত্র দশ বছরে পিতৃহারা হয়েছিল৷ আরেকটা বছর তিনেকের ভাই তো তরুণকেই বাবা মনে করে এটা চাই ওটা চাই বায়না জুড়তো৷ স্কুলেতেও বই নেই কেন, খাতা আনিসনি কেন বলে রোজই নীল ডাউন হতে হতে একদিন বাড়ি ফিরে স্কুল ব্যাগটা টান মেরেছিলো ও৷
দূর থেকে স্কুলের প্রার্থনা সংগীত কানে এলেও আর ও পথ মারায়নি কখনো৷
মা তিনবাড়ি ঠিকে কাজ করলেও ওদের তিনটে পেটের ভাত আর গায়ের পোশাক জোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলো৷
এদিক সেদিন ঢুঁ মারতে মারতেই এই স্টুডিয়োতে চা বওয়ার কাজটা জুটে গিয়েছিল৷ পাড়ার সমরদাই কোনো পরিচালককে বলে, না প্রোডাকশনের লোককে বলে এটা জোগাড় করে দিয়েছিল ওকে৷
বাসের খালাসি থেকে বাসের পকেটমার সব কাজেই হাত পোক্ত করে ফেলেছে তরুণ৷ বছর কুড়ির তরুণের বড্ড ইচ্ছে ছিল অভিনেতা হবার৷ স্টুডিয়োতে ঢোকার আগে সমরদাকে বলেছিল, চা দেওয়ার কাজের বদলে যদি কোনো সিনেমায় সাইড রোলও একটা পেয়ে যেতাম! সমরদা মাথায় চাটি মেরে বলেছিল, তোর মা লোকের বাড়িতে বাসন মাজছে আর তুই হিরো হবার স্বপ্ন দেখছিস!! চুপচাপ স্টুডিয়োতে মাটি কামড়ে পড়ে থাক আর নায়ক-নায়িকার ফাইফরমাইস খেটে যা৷ যদি মাইনে দু পয়সা বেশি পাস তো ভালো৷ প্রায় দিনপনেরো হল তরুণ ইন্দ্রধনু স্টুডিয়োতে শুটিং টাইমে জল, চা পৌঁছে দিচ্ছে৷ স্পট বয় তরুণকে সবাই না চিনলেও কেউ কেউ তো চেনে৷
একটু আধটু শুটিং দেখারও সৌভাগ্য ওর কপালে জুটে যাচ্ছে৷ অন্তত সন্ধেবেলা পাড়ার রকে সকলকে চমকে দেবার মতো কিছু ঘটনা তো বলতে পারছে৷ কত কাছ থেকে ও নায়ক রবীন আর নায়িকা দেবিকাকে দেখেছে, সেটাই যখন তরুণ রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে তখন পাড়ার বুড়োরাও চোখ বড়োবড়ো করে শোনে৷ যতই হোক গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সাথে ওঠাবসা করা তরুণের পাড়ায় একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে৷ ও আর শুধু এখন কাজের মাসি সুধারানি দাসের ছেলে নয়৷ রীতিমতো স্টারদের সাথে কথা বলা ব্যক্তিত্বই বলা চলে৷
তরুণের ইনকামে দু-দিন ধরে সুধারানি দাসের ভাঙা রান্নাঘর থেকে মাছ, মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে৷ সুধারানি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, এবারের চাকরিটা ছাড়বি না কিন্তু৷
নায়ক রবীন আর নায়িকা দেবীকার শুটিং চলছে ইন্দ্রধনু স্টুডিয়োতে৷ হঠাৎ তরুণ চায়ের ট্রে হাতে বলে উঠল, আরে রবীন স্যার আপনার ডায়লগ থ্রোয়িংটা ঠিক হল না৷
পরিচালক থেকে নায়ক-নায়িকা সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তরুণের দিকে৷ একটা স্পট বয়ের এতটা সাহস! রবীন সেনের মতো নাম্বার ওয়ান আর্টিস্টকে অভিনয় শেখাচ্ছে?
বিরক্ত রবীন সেন পরিচালকের উদ্দেশ্যে বললেন, এরা কারা বিজনদা? চোখে মুখে চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে বিজন মিত্র বললেন, শুটিং টাইমে এদের অ্যালাও করবেন না, এই নির্দেশটা সিকিউরিটির দিকে তাকিয়েই৷ সমস্বরে চিৎকারে সকলেই থমকে গেছে৷ থরথর করে কাঁপছে তরুণ৷ চায়ের ট্রে হাত থেকে পড়ে গেছে৷ সকলের দৃষ্টি এখন তরুণের দিকে৷ নিমেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও৷ হাত, পা ছুঁড়তে ছুঁড়তেই অজ্ঞান হল ও৷ মুখে চোখে জলের ঝাপটা, একজন হাতুড়ে ডাক্তার পালস দেখে বললো, খুব স্লো চলছে৷ সম্ভবত মৃগী জাতীয় রোগ আছে৷ মিনিট দশেক পরে চোখ খুলল তরুণ৷
ক্যামেরাম্যান থেকে পরিচালক সকলের কৌতূহলী চোখ তখন তরুণের দিকে৷ নায়ক রবীনও বলল, এখন ঠিক আছো? লজ্জা লজ্জা মুখ করে করজোড়ে ক্ষমা চাইল তরুণ৷ ওর জন্য শুটিংয়ের বিরতি ঘটে গেছে বলে ক্ষমাপ্রার্থী৷ নায়িকা দেবিকা ওর হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বললেন, ডাক্তার দেখিও৷ টাকাটা কপালে ঠেকিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল তরুণ৷
রাস্তার ধারের সেলুনের আয়নায় নিজের মুখটা দেখে নিল ও৷ অভিনয়টা তারমানে এখনও ভালোই করে তরুণ৷ সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি৷ ধীরে ধীরে মৃগী রুগিদের মতো গালটা কাঁপিয়ে, ঠোঁটটা বেঁকিয়ে একটু আগে করা অভিনয়টা আরেকবার দেখে নিল আয়নায়৷ কতবার ভরা জনগণের সামনে মৃগী রোগীর অভিনয় করে তাদের পকেট কেটেছে ও৷ বেশ খানিকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখার অভ্যাসটা সেই তখন থেকেই রপ্ত করেছে তরুণ৷
দক্ষ পরিচালক বিজন মিত্রের চোখেও ধরা পড়ল না তরুণের অভিনয়টা৷ এটাকেও সত্যি বলে মনে করলেন বিজন মিত্র৷ নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালো তরুণ, নিখুঁত অভিনয়ের জন্য৷ কে বলে ও অভিনয় পারে না?
এটা তো ওর রক্তে আছে৷ সুধারানি না জানলেও, বাবার গোপন বাক্সে অনেকরকম গোঁফ-দাড়ি আর মুখোশ দেখেছিল ছোট্ট তরুণ৷ বাবা ওগুলো পরে স্টেজে অভিনয় করতো না রাতের অন্ধকারে লোকের বাড়িতে চুরি করতে যেত, সেটা অবশ্য তরুণের অজানাই রয়ে গেছে৷ তবে অভিনয়টা বাবা ভালোই করতো৷ মাকে সকলের কাছেই বলতে শুনেছে, তরুণের বাবা চটকলে কাজ করে৷ মায়ের মুখে অনেক খুঁজেও যখন কোনো অবিশ্বাসের ছাপ দেখেনি তখনই তরুণ বুঝেছিল, অভিনয়টা ওর পূর্বপুরুষের কাছ থেকেই তরুণ পেয়েছে৷