পাগলি তোমার জন্য
তিথি জেদ ধরেছিল, এই ছেলেকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না৷ ধুর ছেলেটা মোটা ফ্রেমের চশমা পরে, জিন্স পরে না সেই অদ্যিকালের তৈরি করা প্যান্ট পরে৷ আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা কি বলবে? অসম্ভব!
একমাত্র বাপি বুঝিয়েছিলো, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে… তিথি মা, আমি বলছি এই ছেলে তোকে খুব সুখে রাখবে৷
বাপির বাধ্য তিথি কিছুটা অনিচ্ছাতেই রাজি হয়েছিলো সৌম্যকে বিয়ে করতে৷ শুধু ভালো চাকুরি আর চরিত্রবান ছেলে! এই সার্টিফিকেটের জন্যই শেষ পর্যন্ত ক্যানসেল করতে পারেনি তিথি বিয়েটা৷
বান্ধবীরা বলেছিলো, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে মনের মিল হওয়া ভার! তিথিকে কি কোনোদিন বুঝবে ওই অপরিচিত মানুষটা৷
বিয়ের আগে বার দুয়েক ফোনে কথা বলার চেষ্টাও করেছিলো সৌম্য কিন্তু তিথি এগোতে দেয় নি৷ তিথির কাছে ফোনে কবিতা শুনতে চেয়েছিলো সৌম্য৷ তিথি শোনায় নি৷ শেষে নিজেই জয় গোস্বামীব ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’-টা আবৃত্তি করে শুনিয়েছে সৌম্য৷ তিথি কোনোদিন এই লোকটার সাথে আদম-ইভ জীবন কাটাবে না, কিছুতেই না৷
এতদিন ধরে যারা তিথিকে প্রপোজ করেছিলো আর যাদের এক কথায় তিথি রিজেক্ট করেছিলো তাদের মুখগুলোর সাথে মেলাতে চাইছিলো এই গোঁমড়ামুখোর চশমা চোখোকে৷
শুধুই কান্না পাচ্ছিলো তিথির৷
বৈশাখ মাসের তীব্র গরমে বিয়ের আসরেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো তিথি৷ সৌম্য কানের কাছে এসে ধীরে ধীরে বললো, আমি যেটা বলবো শুনবে প্লিস৷
বিয়ের আসরেই কাউকে একটা নির্দেশ দিলো নুন চিনির জল আনতে৷ কাউকে বললো, স্ট্যান্ড ফ্যানটা শুধু তিথির দিকে ঘুরিয়ে দিতে৷ পুরোহিতকে তো রীতিমতো ধমক লাগালো, এতো নিয়মকানুনের জন্য৷ অবশেষে বিয়ে কমপ্লিট হলো৷ একমুহূর্তও তিথির হাতটা ছাড়ে নি সৌম্য৷ বিরক্ত লাগছে তিথির, দু-বার নিজের হাতটা ওর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে যেতেই সৌম্য বললো, ঘরের বিছানায় চুপটি করে শুয়ে পরবে, আমি হাত ছেড়ে দেব৷
প্রথমদিন থেকেই এই কর্তৃত্ব মোটেও পছন্দ নয় তিথির৷
কোনোরকমে সাতটা দিন কাটিয়ে দিলো তিথি শ্বশুরবাড়িতে৷ সৌম্যর সাথে এক ঘরে এক বিছানাতে শুয়েও নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক রেখেছে তিথি৷ সৌম্য একেবারে বন্ধুর মতো আচরণ করছে, যেন কত পরিচিত৷ অথচ একবারও কাছে আসতে চায়নি, কোনোরকম স্বামীর অধিকার ফলাতে আসেনি৷ তবে কি বান্ধবীরা ভুল বলেছিলো!
অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গিয়ে কিছুতেই ফিরবে না জেদ ধরলো তিথি,নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই৷
সৌম্যও রাজি, সে তার মাকে বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব নিয়ে ফিরে গেলো৷
ঠিক দু-দিন পর থেকেই নিজের বাড়ি ঘর সব অসহ্য লাগতে শুরু করলো তিথির৷ বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, পুরোনো বান্ধবীদের সাথে গল্প করতেও ভালো লাগছে না, মায়ের হাতের রুইপোস্তও তেতো লাগছে৷ ওবাড়ির শাশুড়িমাকে ফোন করেছে, উনিও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলেছেন… ফিরে এসো তিথি৷
কিন্তু ওই মানুষটা একবারও বলেনি ফিরে আসার কথা! এই নাকি বাপি মায়ের আদর্শ জামাই৷ আজ তিনদিনে একটাও ফোন করেনি সে তিথিকে৷ তিথি একটা কল করেছিল, সৌম্য রিসিভ করেনি৷ তিথিও কোনো বিশেষ টানে ফোন করেনি, শুধু ভদ্রতার খাতিরেই… নাকি অন্য কিছু!
আজ বান্ধবীদের সাথে মুভি দেখবে, শপিং করবে, প্রচুর এনজয় করবে তিথি৷
সারাদিন সকলের সাথে এত আনন্দ করেও কিছুই ভালোলাগছে না তিথির৷
রাত তখন প্রায় বারোটা, সৌম্যর ফোনে তিথির নম্বর৷
ফোনটা ধরেই, সৌম্য বললো… এতো রাত পর্যন্ত জেগে থেকো না তিথি৷ ঘুমিয়ে পর, না হলে তোমার মাইগ্রেনের যন্ত্রণাটা শুরু হবে৷
কোনো কারণ ছাড়াই তিথির দু-চোখ ভিজে গেছে৷
তোমার মা, মানে মামনি বলছিল, ওবাড়িতে ফিরে যেতে, তাই ভাবছিলাম…
তিথিকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সৌম্য বললো, আমি মা কে বুঝিয়ে বলবো, চিন্তা করো না৷ তুমি নিশ্চিন্তে থাকো… মা আর বলবে না৷
এতটা অসহায় তিথির নিজেকে কখনো লাগেনি৷ মনে মনে চাইছে, সৌম্য একবার বলুক, তিথি চলে এসো!
এবার রাখি তিথি, আর কিছু বলবে? ভালো থেকো৷
না আর কি!
ফোনটা কেটে দিলো সৌম্য৷
অব্যক্ত একটা কষ্টে ছটফট করছে তিথি৷ কিছুতেই ঘুমুতে পারছে না৷ শুধু মনে পড়ে যাচ্ছে… সৌম্যর কথাগুলো৷
‘তিথি তুমি কি স্নান করবে এখন? আমি তাহলে পরে ঢুকবো বাথরুমে৷’
‘তিথি তুমি কি খেতে ভালোবাসো? তাহলে আজ বাজার থেকেই সেটাই আনবো৷’
‘তুমি ঘরের ভিতর নাইটি পর এতো গরমে শাড়ি পরে থেকো না৷ তোমার কষ্ট হবে!’
‘তিথি ফুচকার গাড়ি… বাড়ির সামনে দাঁড় করালাম৷ চলে এসো…’
আশ্চর্য দু-দিন আগের এই সৌম্য এখন তিথির সাথে কথাই বলতে চাইছে না! এই নাকি ভালো ছেলে৷ বাজে, পচা ছেলে একটা… কালই বাপিকে বলতে হবে৷
আনমনা তিথি বই এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভেবে চলেছে, এই যে দখিনা বাতাসের মিষ্টি হাওয়ায় ওর মন খারাপ করছে, নীল আকাশের একাকীত্ব ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, লাল গোলাপের পাপড়িরা ওকে অভিমান জানাচ্ছে… এই হঠাৎ পরিবর্তন কি শুধুই ওই অপছন্দের মানুষটার জন্য!
কেন বার বার ওই মানুষটার হাসি ভরা মুখটার মধ্যে আবছা কষ্টটা তিথির চোখের সামনে এসে প্রশ্ন করছে!
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা তিথি মন মরা হয়ে ছাদে ঘুরছিলো৷ আলো আঁধারীতে মুখটা আবছা লাগলেও চিনতে অসুবিধে হলো না সৌম্যকে৷
সত্যিই কি সৌম্য আসছে! দুরদুর করে ছাদ থেকে নামতে নামতেই ভাবছিলো তিথি, সামনে দাঁড়িয়ে কি বলবে! কি করে বলবে এই সাত দিনে আমি তোমাকে…
আর এই তিনদিনে তোমাকে বড্ড…
ছাদ থেকে নামতেই সৌম্য ঠিক সামনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে৷
কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, এই সাত দিনেই তুমি আমাকে… কি তিথি?
এই তিনদিন তুমি আমাকে বড্ড… কি?
এই ছেলেটা কি মনের কথা শুনতে পায় নাকি?
যাক বাবা ভাগ্যিস তিথি পরের দুটো বলেনি৷
সৌম্য বললো, পরের কথাগুলো তুমি কমপ্লিট করবে নাকি আমি?
তিথি অপ্রস্তুত… ধ্যাৎ! তুমি খুব খারাপ! বলেই সৌম্যর চওড়া নিরাপদ বুকে মুখ লুকালো৷ সৌম্য বললো, গোলাপি ঠোঁট দুটো ধার দিলে বলে দিতে পারি তোমার না বলা কথাগুলো৷