উষ্ণতা মনের কোণে
দূরপাল্লার ট্রেনের এই এক বিরক্তিকর বিষয়, সময় কাটানো৷ মঞ্জরী বেশি বই ভরতে দেয়নি৷
ব্যাগে ওর যত রকমের ড্রেসে ভর্তি করেছে৷ সুনির্মল বলেছিলো, মঞ্জরী এত ড্রেস ক্যারি করে কি হবে? আরে হরিদ্বারে তোমাকে চেনেই বা কে?
মঞ্জরী অভিমানী গলায় বলেছিলো, কি করবো, আমরা তো বিয়ের পর হানিমুনে যায়নি৷ বিয়ের একবছর পর এটাই তো আমাদের হানিমুন৷ যদিও আসল সত্যিটা এখনো মঞ্জরী জানে না৷ সুনির্মলের এটাও যাওয়া হত না, নেহাত মাসতুতো ভাই বিজন এখন হূষীকেশ পোস্টেড৷ ওই সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলেই, ব্যাংকে ক-দিন ছুটি ম্যানেজ করে চলেছে হরিদ্বার৷ আসলে ব্যাংকের ওই চার দেওয়ালের মধ্যে একটা টেবিলে বসে থেকে থেকে বাইরে বেরোলেই কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করে সুর্নিমলের৷ কিন্তু মঞ্জরী ছোটো থেকেই ওর বাবা মায়ের সাথে প্রচুর বাইরে বেড়াতে গেছে, তাই ওই নেশাটা ওর আছে৷ যদিও হরিদ্বারে মঞ্জু আগেও এসেছে, কিন্তু সুনির্মলের সাথে এই প্রথম৷
মঞ্জুর ইচ্ছে একদিন হরিদ্বারে থেকেই হূষীকেশের দিকে যাবে৷ বাকি তিনটে দিন পাহাড়ের রানি মুসৌরীতে কাটাবে৷
মুসৌরীর ম্যালে বসে বসে পাহাড়ের গায়ের আলোর প্রদীপ জ্বালা দেখবে দুজনে৷
সুনির্মলের একটু থ্রিলার বই পড়ার নেশা৷ ফ্রেডরিক ফরসাইথ, জেমস হেডলিচেথ-এর দুটো মাত্র বই ও মঞ্জুকে লুকিয়ে ঢোকাতে পেরেছে ব্যাগে৷ মঞ্জুর বক্তব্য, বেড়াতে এসে শুধুই ঘোরা, বই পড়া চলবে না৷
ঘরকুনো সুনির্মলের মনে হচ্ছে এমন সাতদিনের ছুটিটা ঘুরে ঘুরেই নষ্ট হবে৷
তারপর এই দু-দিনের ট্রেন জার্নি … কাহাতক আর বাইরের সবুজ দেখে প্রাণ ভরানো যায়৷ সুনির্মল তো আর কবি নয়, যে দুটো অচেনা গাছ দেখে কাব্য লিখে ফেলবে!
মঞ্জরীর (?) তে প্রচুর বন্ধু, তাই ও কোথাও একটু নেটওয়ার্ক পেলেই চ্যাট করছে৷
সুনির্মলের আবার ওই লিখে লিখে কথা বলার অভ্যাস নেই৷ মঞ্জু বলে,ও নাকি হরপ্পা সভ্যতার আমলের লোক৷
পাশের ভদ্রলোকেরও বোধহয় ঘুম হয় না৷ একটা জার্নালে চোখ রেখেছেন ভদ্রলোক৷
সুনির্মল উঁকি দিয়ে দেখে বুঝলো, বইটা ফটোগ্রাফির ওপর৷
আলাপ করার উদ্দেশ্যেই সুনির্মল বললো, ছবি তোলার নেশা বুঝি!
ভদ্রলোক হেসে বললেন, হাতুড়ে ফটোগ্রাফার৷ ভালো তুলতে পারি না তবে নেশা আছে৷
ভদ্রলোকের নাম রাধামোহন রায়৷ পেশায় প্রফেসর৷ তবে ছুটি পেলেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান৷ আপাতত গন্তব্য মুসৌরী৷ পাহাড়ের গায়েই নাকি একটি ছোট্ট বাড়ি করে রেখে দিয়েছেন রাধামোহন বাবু৷ অবসর কাটানোর জন্য৷
এমনিতে কলকাতায় থাকেন৷ সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইংরাজির প্রফেসর৷ নিজেই নিজের অনেক গল্প করতে লাগলেন, সুনির্মলরা হানিমুনে যাচ্ছে শুনে হালকা রসিকতাও করলেন৷
যাক বাবা! সহযাত্রী একটু মিশুকে হলে তাও সময়টা কেটে যায়৷
মঞ্জুও গল্প জুড়েছে ওই পাশের ভদ্রমহিলার সাথে, মহিলার বয়েস মঞ্জুর মতোই৷ তাই মাঝে মাঝে বেশ জোর গলায় হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ওদের৷
রাধামোহন বাবু বললেন, আমরা নিঃসন্তান৷ আমার স্ত্রী কিছুতেই কলকাতায় একমাসের বেশি থাকতে চায় না৷ তার নাকি কলকাতার ভারী বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়৷
তাই শুভ্রা দেবী মানে ওনার স্ত্রী নাকি বেশিরভাগ সময় একাই মুসৌরীতে থাকে৷
সুনির্মল জিজ্ঞেস করেছিল, ওনার অসুবিধে হয় না?
হেসে বললেন, আমার স্ত্রী অসম্ভব সুন্দরী আর বিদুষী মহিলা৷ আমি নেহাতই ছাপোষা৷ তাই তার ইচ্ছেতেই আমাকে চলতে হয়৷ শুভ্রা দেবীর বয়স বছর পঞ্চাশ৷ তবে তার রূপের আগুন নাকি এখনো বেশ জ্বলন্ত৷
রাধামোহন বাবু বেশ গর্বের সাথে বললেন, আরে তার ত্বকের মসৃণতা মোমকেও হার মানাবে৷
অল্প বয়সে তো শুভ্রাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোলেই অল্প বয়েসি ছেলেরা পিছু নিতো৷ কখনো রানিং কমেন্ট ছুঁড়তো… বরিয়া আইটেম বস৷
ভদ্রলোকের বলার ধরনে, সুনির্মল হেসে ফেলেছিলো৷ বেশ হালকা ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছে দুজন অসমবয়েসীর মধ্যে৷
বছর ত্রিশের সুনির্মল ভুলেই গেছে রাধামোহন বাবুর বয়েস প্রায় বাহান্ন বছর৷
উনি আর ওনার ওয়াইফ হানিমুনে নাকি পুরী গিয়েছিলেন৷ শুভ্রাদেবীকে নিয়ে পুরীর সমুদ্রে স্নানের গল্প করে চলেছেন৷
কোথা দিয়ে যেন নিমেষে ট্রেনের একঘেয়ে জার্নিটা পার হয়ে গেলো৷
রাধামোহন বাবু নিজের ফোন নম্বরও দিলেন৷
ভদ্রলোক এতো হাসেন, যে মনেই হয় না ওনার কোনো কষ্ট আছে৷ এই বয়েসেও উনি যে নিঃসন্তান…মনের গোপনে কষ্ট লুকিয়ে হেসে চলেছেন৷ ওনার সাথে কথা বলে সুনির্মলের একটা কথাই মনে হয়েছে, ভদ্রলোক তার সুন্দরী বিদুষী বউকে নিয়ে বেশ গর্বিত৷ মঞ্জুরী শুনেই বললো, শুভ্রা দেবী কপাল করে স্বামী পেয়েছেন, দিনরাত শুধু বউয়ের প্রশংসা! আর তোমাকে তো কোনোদিন একটু খোলা মনে আমার রূপের প্রশংসা করতেও দেখলাম না৷
মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা! এদের কাছে কখনোই নিজের স্বামী ভালো নয়৷ সুনির্মলের ছোটো শালির বর দেবেশের মতো কেয়ারিং হাজবেন্ড নাকি গোটা বিশ্বে নেই৷ মঞ্জুর মতে তার বাবা হলেন আইনস্টাইন৷ তার মত জ্ঞানী পুরুষকে শ্বশুর হিসাবে পেয়ে সুনির্মলের মানব জীবন ধন্য হয়ে গেছে ৷
যদিও শ্বশুর মশাইয়ের ধারণা, মঞ্জুর মতো সাতাশ বছরের বাচ্ছা মেয়েকে সুনির্মল বড়োই অনাদর করে৷
যাইহোক মঞ্জু মুখে যতই সুনির্মলকে অপদার্থ বলুক না কেন, মনে মনে যে ভালোবাসে সেটা ওর আচার ব্যবহারে বোঝাই যায়৷
আসলে মেয়েরা বোধহয় স্বামীর মধ্যেও একটা ছোটো সন্তানকে খোঁজে৷ যাকে মাঝেসাঝে বেশ বকা ঝকা করে তৃপ্তি পাওয়া যাবে৷
অল্প বয়সে মাকে হারানোর পর মঞ্জুর ওই আদর মেশানো বকুনি খেতে সুনির্মলের মন্দ লাগে না৷
রাধামোহন বাবু বললেন, মেয়েরা হচ্ছে কাঁচের মতো৷ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বেশ ধারালো, কিন্তু একটু আঘাতেই ভঙ্গুর৷ বিশেষ করে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে আঘাত পেলে তো তাদের ভাঙতে সময় লাগে না৷ সুনির্মলের পিঠ চাপড়ে বললেন, একটু সাবধানে আর যত্নে রেখো ভায়া৷ অসময়ে এই দুর্মুখ মহিলা ছাড়া বিশেষ গতি নেই৷
হরিদ্বারে নেমে উনি গাড়ি ধরলেন৷ ফোনে যোগাযোগ হবে, কলকাতা গিয়েও যোগাযোগ করবেন… এমনি কথা হলো ওনার সাথে৷
স্বল্প সময়ে মঞ্জুরও বেশ ভালো লেগে গেলো ভদ্রলোককে৷ ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে যাবার জন্য রিকোয়েস্ট করলো মঞ্জু৷
শুভ্রা দেবীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলে মঞ্জু বললো, গোটা ট্রেনে যেভাবে ওনার রূপের আর গুনের প্রশংসা শুনলাম তাতে ওনাকে দেখার ইচ্ছেটা বেড়েই গেছে৷
বিজন হরিদ্বারে হোটেল বুক করেই রেখেছিলো৷
হোটেলটা মঞ্জুর মতো খুঁতখুঁতে মহিলারও একচান্সে পছন্দ হলো৷ মঞ্জু হেসে বললো, যাক তোমার ভাই অন্তত আমার রুচিটা বুঝতে পেরেছে, তুমি তো পারলে না!
সুনির্মল নিজের ব্যাগ থেকে বই বের করতে যাবে এমন সময় খেয়াল করলো, রাধামোহন বাবুর বেটার ফটোগ্রাফির বইটাও ওর হাত ব্যাগের মধ্যে ঢুকে গেছে৷
এই রে লাস্ট সময় সিট থেকে জিনিস ঢোকাতে গিয়ে ওনার বইটাও সুনির্মলের হাত ব্যাগে চলে এসেছে৷
হরিদ্বারে হর কি পিয়ারীর ঘাটের সন্ধ্যে আরতির সময় সুনির্মল অপলক চেয়েছিল গঙ্গার জলের দিকে৷ অদ্ভুত আলোর প্রতিচ্ছবি পড়ছিল৷
তার মানে মানুষের ছায়ার মধ্যেও থাকে তারই প্রতিকৃতি৷ ছায়াটা যার তার চরিত্রও হয়তো প্রতিফলিত হয় ওই ধোঁয়াশা শরীরের মধ্যে৷
হূষীকেশে বিজনের কোয়ার্টারে দেড় দিন বেশ হাসি মজাতেই কাটলো৷
কলকাতার মঞ্জুরীর সাথে এই উত্তাল গঙ্গা ধারের মঞ্জুরীর যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য৷
এই মঞ্জরী কথায় কথায় হেসে উঠছে, তরঙ্গিনী গঙ্গার মতো৷
বাঁধন ছাড়া কুমারীর বেনির মতোই উচ্ছল৷
সুনির্মল যেন এক বছরের পরিচিত স্ত্রীকে নতুন রূপে আবিষ্কার করলো৷
কোনো অভিযোগ নেই ওর, রাস্তার ধারের মোসের দুধের চাও মঞ্জু তৃপ্তি করে খাচ্ছে৷
ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছে সুনির্মলের নিস্তরঙ্গ জীবনের পাতাগুলো৷
মাঝে মাঝেই মঞ্জুরীর সাথে ওকেও ছবিতে পোজ দিতে হচ্ছে৷ ঐ সেলফি গুলো নাকি মঞ্জুরি ফেসবুকেতে পোস্ট করবে৷
মঞ্জুর কাছে শুনেছিল মুসৌরী নাকি পাহাড়ের রানি৷
সত্যি মুসৌরীর সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না৷
সুনির্মলের মতো বেরসিক মানুষকেও মুসৌরীর ম্যাল প্রেমিক বানিয়ে ছাড়লো৷
ম্যাল রোডে মঞ্জুর সাথে হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচিচল কোনো এক কল্পলোকে৷
হঠাৎই মঞ্জু হাত ধরে টানছে সুনির্মলের৷
ওর দৃষ্টির দিকে তাকাতেই যাকে দেখতে পেলো তাকে দেখেই সুনির্মলের মুখে হাসি ফুটলো৷
এখানে এসেও বার দুই ফোনে ট্রাই করেছিল রাধামোহন বাবুকে কিন্তু যোগাযোগ করে উঠতে পারে নি৷
দ্রুত পা চালাচ্ছিল সুনির্মল৷
সঙ্গে মঞ্জুও প্রায় ছুটছিলো৷
কিন্তু ওনার আজকের হাঁটাচলা তাকানোর মধ্যে কেমন যেন একটা উদাসী ভাব৷ উপাসনা এক্সপ্রেসের কামরার সেই হাসি খুশি মানুষটাই যেন নন৷
হঠাৎ সুনির্মলের মাথায় শার্লক হোমস ভর করলো যেন… ঠিক পাঁচ হাত দূরে দূরে ওরা পিছু নিয়েছে ভদ্রলোকের৷ উদ্দেশ্য আজ ওনার বাড়িতে গিয়ে চমকে দেয়া৷
একটা ছোট্ট সাজানো একতলা বাড়ির সামনে গিয়ে থামলেন ভদ্রলোক৷
রাধামোহন বাবু যে বললেন, এখানে ওনার স্ত্রী শুভ্রাদেবী থাকেন?
তাহলে বাড়ির বাইরে থেকে তালা দেওয়া কেন?
বেশ কিছু অগোছালো প্রশ্ন তখন সুনির্মল আর মঞ্জুকে কৌতূহলী করে তুলেছে৷
ঠান্ডা খুব বেশি না থাকলেও সমতলের মানুষদের একটুতেই শীত অনুভব হয়ে থাকে৷ তাই বেশ করে দুজনে পুলভার পরেই বেরিয়েছে৷ এখন চড়াই রাস্তায় জোরে হেঁটে আর উত্তেজনায় বেশ গরম লাগছে সুনির্মলের৷
রাধামোহন বাবু চাবি খুলে ভিতরে ঢুকলেন৷
ঘরে আলো জ্বাললেন, ঘরে ঢুকে দুটো জানালাও খুলে দিলেন৷ হিমেল বাতাসকে যেন ঘরের মধ্যে আহ্বান করছেন৷
সুনির্মল আর মঞ্জু একটা অনৈতিক কাজ করে বসলো অকারণ কৌতুহলের বসে৷
জানালায় চোখ রাখতেই যেটা চোখে পড়লো সেটা দেখে মঞ্জুর তো অজ্ঞান হবার অবস্থা৷
সুনির্মলের হাতটা শক্ত করে ধরলো মঞ্জু৷
ঘরের মধ্যে যে মহিলা ঘুরছেন, তার গোটা মুখটা বীভৎস ভাবে পোড়া৷ এমন কি ডান হাতের দিকটাও পুড়ে গেছে৷
ভদ্রলোক গিয়ে সোফায় বসলেন, মহিলা দু-কাপ কফি নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলো৷
সুনির্মলের আর ধৈর্য থাকছিলো না৷ রাধামোহন বাবু গোটা ট্রেনে শুধু ওনার স্ত্রীর রূপের বর্ণনা করে গেছেন৷ কোথায় সেই স্ত্রী? এই দগ্ধ মহিলাই বা কে?
কলিং বেলের আওয়াজে রাধামোহন বাবু নিজেই দরজা খুললেন৷ ভূত দেখার মতোই চমকে উঠেছেন সুনির্মলকে দেখে৷ দরজার বাইরে থেকেই ড্রয়িং রুমটা দেখা যাচ্ছে৷ মঞ্জু স্পষ্ট দেখলো, মহিলা ঘোমটার আড়ালে নিজের মুখটা ঢেকে নিলেন৷
রাধামোহন বাবু নিরুপায় হয়ে ওদের ভিতরে ডাকলেন৷
সুনির্মল ভনিতা না করেই বললো, একটা কথা বলুন তো দাদাভাই ইনি কে?
খুব ধীরে ধীরে শান্ত গলায় রাধামোহন বাবু একটা রূপকথার গল্প শোনালেন৷
শুভ্রা দেবী আর রাধামোহন বাবু তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে আর থার্ড ইয়ারে পড়েন৷ প্রেমের সমুদ্রে ভাসছেন দুটো তরুণ হূদয়৷
চাকরির অপেক্ষা, চাকরি পেলেই বিয়ে…
পরমা সুন্দরী শুভ্রা দেবীকে নিয়ে গর্বিত প্রেমিক রাধামোহন বাবু বড্ড সাবধানী৷ শুভ্রা দেবীকে অনেকেই প্রোপজ করেছে৷ ওরা দুজনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একে ওপরের কাছে৷
ঠিক এমন সময় শুভ্রাদেবীর বাবা হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান৷ বাড়ি ভাড়া বাকি পড়তে থাকে ওদের৷ ওদের মাথার ছাদ থাকবে তাই বাড়িওলার ছেলের সাথে বিয়ের শর্তে শুভ্রার মা রাজি হয়ে যায়৷
শুভ্রাও যেন ঘোরের মধ্যেই বিয়ে করে নেয় বাড়িওলার মদ্যপ ছেলেকে৷ তারপর শুরু হয় শুভ্রার ওপর অকথ্য অত্যাচার৷
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা সহ্য করে নেয় ও৷
ততদিনে রাধামোহন বাবুও চাকরি পেয়ে গেছেন৷ শিক্ষকতা করছেন৷ শুভ্রার সাথে নতুন করে যোগাযোগ হয় ওনার৷
উনি শুভ্রাকে বলেন, ওই মাতাল স্বামীকে ছেড়ে চলে আসতে… শুভ্রারও বোধহয় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো৷ শুভ্রার দুধে আলতা গায়ে তখন শুধুই কালসিটের দাগ৷
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ওরা দু-জন পালাবে ঠিক করেছিল৷ শুভ্রা ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলো৷
কি করে যেন ওর স্বামী সেটা টের পেয়ে গেলো, শুভ্রার বাড়ির পিছনের দরজার কাছে যখন রাধামোহন বাবু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তখনি উনি শুনতে পেলেন শুভ্রার ভয়ংকর আর্তনাদ৷ দরজা খুলে যখন ঢুকলেন, দেখলেন চোখের সামনে জ্বলছে শুভ্রা৷ ওর স্বামী ওর গায়ে কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে৷
শুভ্রাকে বাঁচাতে পারলেও ওর পোড়াটা আটকাতে পারেন নি উনি৷
যেহেতু শুভ্রার ডিভোর্স হয়নি তাই বিয়েটাও করে উঠতে পারেনি ওরা৷ কলকাতা থেকে বহু দূরে, যেখানে ওরা কলেজ লাইফে প্ল্যান করেছিলো হানিমুনে আসবে সেই মুসৌরীতে এই ছোট্ট বাড়িটা কিনে এখানেই শুভ্রাকে রেখেছিলো রাধামোহন বাবু৷ শুভ্রা বাঁ চোখে ভালো দেখতেও পায়না৷ হয়তো আগুনে পোড়ার এফেক্ট৷
নিজের চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছে, রাধামোহন বাবু হেসে বললেন, তবুও আমরা দারুণ আছি৷ আমি মাসে একবার করে আসি আর দুজনে হারিয়ে যাই মুসৌরীর হিমেল উদাসী বাতাসে৷ উনি বললেন, হ্যাঁ মিথ্যে বলি আমি লোকের কাছে৷ আমার স্বপ্নগুলো সাজিয়ে বলতে মন্দ লাগে না৷
তবে শুভ্রা আজও আমাকে সেই কলেজ লাইফের মতোই উষ্ণতা দেয়৷ শরীরে নয় আমরা আমাদের উষ্ণতা অনুভব করি মনে মনে৷ উনি বললেন, আমি প্রচুর ছবি তুলি, সব শুভ্রার জন্য৷ ও আর বাইরে বেরোতে চায় না, তাই পৃথিবীটা দেখতেও পায়না, আমার ছবির ফ্রেম বন্দির মধ্যেই ওর দুনিয়া দেখা৷ ঐ ফটোগ্রাফির বই গুলোও আমি কিনি ওর জন্যই৷ একটা অমলিন পবিত্র হাসি রাধামোহন বাবুর মুখে৷
পৃথিবীর কোনো দুঃখ যেন ওনাকে স্পর্শ করতে পারেনি৷
মঞ্জু কোনো কথা না বলে রাধামোহন বাবুকে আর শুভ্রাদেবীকে প্রণাম করলো৷
শুভ্রা দেবী ঘোমটার আড়াল থেকেই বললেন, কোনো পরিস্থিতিতেই নিজের প্রাণের মানুষটাকে আড়াল হতে দিও না৷
ম্যাল রোড ধরে হাতে হাত দিয়ে হাঁটছে সুনির্মল আর মঞ্জু৷ এক অকৃত্রিম ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে, পাহাড়ের গায়ের আলোর প্রদীপ জ্বলা দেখছে দু-জনে৷