সংজ্ঞাহীন সম্পর্ক
অবশেষে আমাদের ডিভোর্সটা হয়েই গেল নিশীথ৷ রিনির গলার অবসাদটা এসে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিলো নিশীথকে৷ রিনি ‘ভালো আছে’র অনুভুতিটাই ওকে অনেকটা উচ্ছল বাতাসের তৃপ্তি দিতে পারতো৷ কিন্তু রিনি ‘খারাপ আছে’ টাই তো নিশীথের চরম শাস্তি৷
ফোনের অন্য প্রান্তে শুধুই হেরে যাওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস৷ নিশীথের বুকের মধ্যে ড্রাম বাজাচ্ছে যেন রিনির ওই নিঃশ্বাসগুলো৷ তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ও বললো, এমন অনেক পরিস্থিতিই বোধহয় আমাদের জীবনে আসে যেগুলো থেকে বেরুনোর রাস্তা থাকে না তবুও আমরা রিকোভার করে ঘুরে দাঁড়াই, তাই না রিনি?
রিনি উদাস কণ্ঠে বললো, তুমি কি তোমার অতীতের কথা বলছো?
যাক মনে পড়েছে তাহলে! আমিও কিন্তু বেঁচে আছি রিনি৷ আর তোমার জন্যই বেঁচে আছি৷
এভাবে বলো না নিশীথ৷ বন্ধুর পাশে বিপদের দিনে দাঁড়ানোর মধ্যে কোনো মহত্ব নেই৷ ওটাই একজন ভালো বন্ধুর কাজ৷
সেই একই প্রশ্ন তো আমারও রিনি! আজ তোমার পাশে একই ভাবে কি আমি থাকতে পারি না?
রিনি গম্ভীর গলায় বলল, অবশ্যই পারো৷ তবে আমি একদম ঠিক আছি৷ এই মুহূর্তে আমার সত্যিই কাউকে প্রয়োজন নেই৷ ফোনটা রেখে দিয়েছে রিনি৷
নিশীথ তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে৷
যেখানে রিনির নাম্বারের পাশে সেভ করা আছে রিনিরিনি৷
নিশীথ নিজেও জানে না কেন রিনির নামটা দু-বার লিখে রেখেছে ও৷
আসলে অফিসের সেই রিনি ছিল খুব উচ্ছল, কিছুটা পাহাড়ি তিস্তার মতো কি?
নাকি নূপুরের চঞ্চল আওয়াজ! তাই বোধহয় নিশীথ শুধু রিনি না লিখে রিনিরিনি লিখেছিলো৷
সেদিন ছিলো শুক্রবার৷ প্রাইভেট কোম্পানির অফিসের একটাই সুবিধা, সোম আর শুক্রর মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই৷ যে কোনো দিন হঠাৎ তলব আসতেই পারে, আজ লাঞ্চের পরে মিটিং হলে চলে এসো, মিটিং আছে৷
শুক্রবারের সেকেন্ড হাফে ল্যাদ খাওয়া পাবলিকরা নড়ে চড়ে বসে৷ ল্যাপটপে চেক করে নেয় প্রজেক্টের লাস্ট পেপারগুলো৷ নিশীথ বরাবরই একটু এলোমেলো স্বভাবের৷ এই ধরা বাধা দশটা-পাঁচটায় হাঁফিয়ে ওঠা মানুষ৷
দিনরাত তার একটা মন মুক্তি চায়… আরেকটা… চাকরিটা ছাড়া কি ঠিক হবে?
দোলাচলে দুলছে নিশীথ৷ একবার মনে হয়, ধুত্তোর নিকুচি করেছে৷ নিজস্ব বিজনেস করবে একটা৷ যেখানের রাজা আর প্রজা দুই ও নিজেই হবে৷
এমন মনের অবস্থাতেই সেদিন মিটিংয়ে গিয়ে উপস্থিত হলো নিশীথ৷
একই অফিস, শুধু ডিপার্টমেন্টটা অন্য ,তবুও চোখে পড়েনি কোনোদিন৷ একটু কি ব্যতিক্রমী মুখটা! ভাবতে ভাবতেই সামনে বাড়ানো হাতটা ধরে করমর্দন করলো নিশীথ, রিনি চৌধুরীর সাথে৷
আপনাকে আমি চিনি না বোধহয়৷ বেমক্কা বলে দিয়েছিল অগোছালো নিশীথ৷
রিনির ঠোঁটের কোণে একটা আলগা হাসি৷ এই ধরনের কর্পোরেট সেকশনে এমন নিষ্পাপ কথাটা বোধহয় এই প্রথম শুনেছিল রিনি৷
পরিচয় হওয়া তো নিত্য দিনের ঘটনা৷ সেই পরিচয়টা বন্ধুত্বের আঙিনায় পৌঁছালে তবেই তাকে মনে রাখতে হয়, তাই না?
মিষ্টি গলার গোছানো কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে নিশীথ বলেছিল, তবুও… এতদিন চোখে পড়েনি বলেই তো অবাক হচ্ছি৷
রিনি আলগা হেসে বলেছিলো, এই যে চিনে ফেললেন, এবার থেকে দেখবেন আপনার চোখ বাঁচিয়ে অফিসে আসতেই পারছি না৷
দুজনেই হেসেছিলো একসাথে৷
কর্পোরেট অফিসে যেটা সাধারণত হয় না সেটা হলো বন্ধুত্ব৷ কাজ, টার্গেট, জেলাস… এগুলোর মধ্যেই বাতাসটা ঘুরপাক খেতে থাকে৷ এই প্রথম হয়তো সেই ভারী বাতাসটা হালকা হয়ে রিনি আর নিশীথের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিলো বন্ধুত্ব-এর নাম নিয়ে৷
আজ আর সঠিক মনে নেই ওদের বন্ধুত্বের ভিত্তিটা ঠিক কি ছিলো! তবে এটুকু নিশীথ খুব ভালো করেই জানে, যে ওদের অনেক পছন্দই দারুন ভাবে মিলে যেত৷ সে চায়ে কম চিনি খাওয়া থেকে শুরু করে কনকনে শীতে আইসক্রিম খাওয়ার টেস্টটা পর্যন্ত৷ নিশীথ ধ্রুবসত্যের মতোই বুঝতে পারতো তার পাঁচ বছরের স্টেডি গার্লফ্রেন্ড ঈশানি ওকে যতটা না বেশি চিনত তার থেকে রিনি নিশীথকে চিনত অনেক বেশি৷ নিশীথের মনখারাপের দিন এক কাপ গরম কফি নিয়ে এসে সুমনের গান চালিয়ে রিনি বলতো, কি হয়েছে, ঈশানির সাথে ঝগড়া? আরে ঝগড়া তো প্রেমের লক্ষণ! এভাবেই নিশীথের সেই টালমাটালের দিনে সামাল দিতো রিনি৷
নিশীথ বারবার বলতো, ঈশানি আমি এই ধরা বাধা জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছি৷ আমি বিজনেস করতে চাই৷ ঈশানি কিছুতেই মানতে চাইতো না নিশীথের এই এলোমেলো জীবন৷ অবাক লাগতো নিশীথের, এতদিনেও কেন ঈশানি ওকে বুঝলো না৷ তাহলে আর ভালোবাসা কীসের! মনের মানুষটার মন কি চাইছে সেটাই যদি না বোঝে কেউ৷
চাকরিটা ছাড়বে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলো নিশীথ৷ এখানে চ্যালেঞ্জিং কাজ নেই, নিজেকে প্রমাণ করার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই৷ শুধু ওপরওলার নির্দেশে যান্ত্রিক জীবন৷
রেজিগনেশন দেওয়ার পরে সব থেকে বেশি দরকার ছিলো ঈশানিকে৷ নিশীথ ভেবেছিলো ওর মানসিক দ্বন্দ্বটা আর কেউ না বুঝুক ঈশানি বুঝবেই৷ কিন্তু ঈশানি খুব আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকলো নিশীথের ঝড়ে রাস্তা হারানো, হাল ভাঙা নৌকাটার পাশ থেকে৷ নিশীথ আগলে ধরতে চেয়েছিলো একমাত্র অবলম্বন ঈশানিকে৷ কিন্তু ঈশানি তখন নিজের লক্ষ্যে স্থির৷
সে আর কোনোভাবেই চায় না এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন৷ নিশীথ জিজ্ঞেস করেছিলো, ঈশানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না? ঈশানির পরিষ্কার উত্তর ছিলো, আমি জীবনে এই টালমাটাল অবস্থা মেনে নিতে পারবো না নিশীথ৷
বাড়ির পাশের প্রেমিকা যখন ছাদে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে শুধুমাত্র নিশীথের চলে যাবার অপেক্ষায়, তখনও সেই প্রেমকে বিশ্বাস করার আর কোনো অর্থই থাকে না৷
পাশের বাড়ির কাঁচের জানালার দিকে অপলক তাকিয়েছিলো নিশীথ৷ একদিন ওখানেই অপেক্ষা করতো ঈশানি, নিশীথের ফেরার সময়ের৷
চাকরি ছেড়েছে নিশীথ, অফিস যায় না ঠিকই তবে অফিসের রিনির সাথেই বন্ধুত্বটা অটুট রয়ে গিয়েছিলো৷
ঈশানি এভাবে ছেড়ে যাবার পর প্রায় অবসাদগ্রস্ত নিশীথকে সম্পূর্ণ ভরসা করেছিলো একটাই মাত্র মানুষ… সেটা রিনি৷ অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে হলেও ব্যবসা বিষয়ে বিশেষ সাহায্য পায়নি নিশীথ পরিবারের কারোর কাছ থেকেই৷ শুধু মানসিক জোরটা জুগিয়েছিলো রিনি৷ একমাত্র রিনিই বিশ্বাস করত, হারবে না নিশীথ৷
আর সেই জোরেই মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল ও৷ ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনের ব্যবসাটা শুরু করেছিল মনের জোরে৷ একটা ইট কাঠ পাথরের ঘরকে ও সাজিয়ে তুলেছিল মনের মতো করে৷ ‘অন্দরের রূপ’ নিশীথের কোম্পানির নাম৷ নামটাও রিনিরই দেওয়া৷
রিনির তখন অশোকের সাথে প্রেমটা চূড়ান্ত পর্যায়ে৷ বিয়ের সব ঠিকঠাক৷ প্রায়ই নিশীথ বলে, রিনি অনেক প্রেম করেছ, এবার তো বিয়েটা করো৷ নাহলে কিন্তু তোমাকেও আমার মতো বন্ধ জানালায় মাথা ঠুকতে হবে৷
রিনি হেসে বলতো, অশোক আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না নিশীথ৷ এই কথাটাতেই একটা আলাদা তৃপ্তি পেতো নিশীথ৷ যাক, তার প্রিয় বন্ধু ভালো থাকবে৷ নিশীথের ব্যবসা ততদিনে ছোট্ট চারা গাছ থেকে একটু একটু করে ফলবতী বৃক্ষের রূপ নিতে শুরু করেছে৷
না ফেরেনি ঈশানি৷ নিশীথের বাইকের পিছনের সিটটা আজ ফাঁকা ৷ ঈশানির চুলের গন্ধটা আজও ওর নাকে এসে হালকা করে ঝাপটা দিয়ে বলে যায়, একদিন খুব কাছে ছিলাম৷ আসলে দূরত্বই বুঝিয়ে দেয় একদিন কতটা কাছে ছিল তারা৷
নিশীথ এখন শুধুই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত৷ ওর প্রায় ডুবন্ত নৌকার হালটা তখনও ধরে রেখেছিলো রিনি৷ বলা তো যায় না, যা এলোথেলো ছেলে! হাসি মুখে ওর সব পাগলামির প্রশ্রয় ছিলো কেবল রিনির৷ নিশীথকে যদি কেউ ভীষণ ভাবে চিনে থাকে, সেটা কেবল রিনি৷
হঠাৎই পাশের বাড়ির ছাদে বসলো সানাই৷ বন্ধ জানালাটা হঠাৎ গেল খুলে৷ বধূবেশে নিশীথ দেখল তার প্রেয়সীকে৷ উদাস চোখেও সেদিন নোনতা জল পড়েছিলো৷ পুরুষ মানুষকে কাঁদলে বড্ড বেমানান লাগে, সেটাও সেদিন অস্বীকার করেছিলো নিশীথের মন৷ ফোনে সমানে বোঝাচ্ছিলো রিনি৷
জীবন এমনই নিশীথ৷ ওঠা পড়া, সুখ দুঃখ সব আসবে চলার পথ আটকে৷ বেরোতে তোমাকেই হবে৷
না দীর্ঘদিন ওই সানাই-এর সুর থেকে বেরোতে পারেনি নিশীথ৷ অদ্ভুত একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই চলছিল ও৷ ঈশানির অষ্টমঙ্গলা… চোখের সামনে সিঁদুর পরে স্বামীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমেছিল ঈশানি৷
রিনি বলেছিল, নিশীথ তোমার জীবনে ভালোবাসা না থাকুক, বন্ধু থাকবেই৷ আমি হারাবো না, কথা দিলাম৷ রিনির বিয়ের উদ্যোগে নিশীথ ছিল প্রধান হর্তাকর্তা৷ সব থেকে প্রিয় মানুষটিকে অন্যের হাতে তুলে দিতে সেদিন একটুও কষ্ট হয়নি নিশীথের৷ কারণ, রিনি ভালোবাসে অশোককে৷
বিয়ের পর নতুন সংসার, স্বামী, অফিস সামলে রিনির সময় কমেছিলো নিশীথকে দেবার৷ তবুও নিশীথ জানতো একটা ঠিকানা আছেই এই পৃথিবীতে যেখানে ও সুখগুলোকে নয় কষ্টগুলোকে নিশ্চিন্তে রাখতে পারবে৷ মাঝে মাঝে ফোনে কথাও হয়েছে ওদের দুজনের৷ কিন্তু রিনি তো কখনো বলেনি নিশীথকে যে তার সংসারের ভিতটা কবে আলগা হয়ে গিয়েছিল! কি মনে করেছিল রিনি, নিশীথ এসব সমস্যা শোনার যোগ্যই নয়৷ অভিমানে চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো নিশীথের৷ ঘুরিয়ে ফোনটা করে, ঝড়ের বেগে বলে দিল, তুমি কি ভেবেছিলে রিনি, নিশীথ ইমোশনাল ফুল! ওর কাছে কিছুই বলা সম্ভব নয় তাই না!
নিশীথের গলায় হয়তো এমন কিছু ছিল যেটা শোনার পর এই প্রথম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রিনি৷
বহুদিন পরে ওদের আবার দেখা…
রিনি কেঁদেই চলেছে… সামনেই নিস্তরঙ্গ গঙ্গা নিশ্চুপে বয়ে চলছে৷ পাশে বসে আছে নিশীথ!
ধীরে ধীরে রিনি বললো, চেষ্টা করেছিলাম জানো, নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম বলে আত্মীয় পরিজন কাউকে বলিনি, দিনের পর দিন অশোকের মেন্টালিটির সাথে জোর করে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু দেখলাম যেটাকে আমি ভালোবাসা বলে ভুল করছিলাম সেটা আসলে মোহ ছাড়া কিছু নয়৷
অনেক চেষ্টা করেছিলাম, অশোকের মন রাখার কিন্তু হেরে গেলাম নিশীথ৷
এই প্রথম রিনির গলায় এমন হেরে যাওয়া মানুষের লক্ষণ ফুটে উঠলো৷ যেটা নিশীথের কাছে অবিশ্বাস্য৷ এটা কি সেই রিনি? যে দু-বছর আগে ব্যবসার টালমাটাল অবস্থায় নিশীথকে বলেছিলো, ঝড় না উঠলে তুমি বুঝবে কি করে তুমি সমুদ্রতেই নৌকা চালাচ্ছ৷ দিকভ্রান্ত হতে হতেই তো নাবিক খুঁজে পায় ধ্রুবতারাকে৷
এটিকেট মেইনটেইন করাটা যে নিশীথের কোনো কালেই আসে না সেটা রিনির থেকে আর কেই বা ভালো বুঝবে?
তেমনি আলটপকা নিশীথ বলে বসলো, রিনি আরেকবার শুরু করা যায় না?
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রিনি আজকের সফল ব্যবসাদার তার খুব কাছের বন্ধুটির দিকে৷
কি বলতে চাইছে নিশীথ? কি শুরু করতে চায় ও?
ওর কথাকে গুরুত্ব না দিয়েই রিনি বললো, আবার কি শুরু করতে চাও? আবার কেরিয়ার নিয়ে ছিনিমিনি?
জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে নিশীথ বললো, না না ..আমি তোমাকে নিয়ে শুরু করতে চাইছি!
আমূল চমকে উঠেছিল রিনি৷
পাগল নাকি ছেলেটা?
সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছেলে নিশীথ৷ ও জানেও না একজন ডিভোর্সী মহিলাকে বাড়ির বউ করে মেনে নেওয়াটা অতটাও সহজ নয়৷
তবুও এই আধ পাগলের সামনে ওসব বোঝাতে যাওয়া বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়৷ এখুনি হয়তো রেজিস্ট্রি অফিসে টেনে নিয়ে বলবে ,নাও সই করো৷
সেই ওর শো রুম ওপেনিং ডেটের মতো৷ একরাশ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে রিনির হাতে কাঁচিটা দিয়ে বলেছিলো, আজকে এই ফিতে কাটার অধিকার যদি কারোর থাকে সেটা রিনির৷
রিনি দেখেছিলো, নিশীথের ফ্যামিলির লোকজনের মুখটা সাময়িক হলেও অন্ধকার হয়েছিলো৷ রিনি ইশারা করে আটকাতে চেয়েছিলো ব্যাপারটা৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা, বাবু আরেকটু গলা তুলে বলেছিলো, তুমি ফিতে টা কাটবে নাকি… আমি সব ভেঙে দেব?
একরোখা পাগলের সাথে যেদিন থেকে পথ চলা শুরু করেছিলো সেদিনই জানতো রিনি ঈশানি পারবে না এই আবেগ সর্বস্ব ছেলেটাকে সামলাতে৷ একে তো ভালোবাসা আর শাসন সমান ভাবে করতে হয়৷
আজও নিশীথ একই আছে৷ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই বলে বসলো, চলো শুরু করি৷
রিনিকে চুপ করে থাকতে দেখে নিশীথ বললো, বেশ… মাসখানেক আমি ডেমো দিই তারপর না হয় আমাকে নিয়ে গোটা জীবনটা চলতে পারবে কিনা ভাববে!
অশোকের বাড়ি থেকে চলে এসে রিনি রয়েছে একটা লেডিস মেসে৷ বাড়ি ফিরতে পারবে না ও৷ নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলে মেয়েদের কষ্টের কথা বলার লোকও যেন কমে যায়৷ সকলে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, কেন পছন্দের মানুষের সাথেও থাকতে পারলে না? দোষটা তাহলে তোমারই৷
আপাতত বেশ নিরুপায় লাগছে নিজেকে৷ কেমন একটা একাকীত্ব যেন গিলে খেতে আসছে রিনিকে৷ এর মধ্যে একমাত্র নিশীথের সাথে কথা বলার সময়েই ও ভুলে থাকতে পারে অশোকের সাথে কাটানো দুর্বিষহ মুহূর্তগুলোকে৷ নিশীথের এলোমেলো কথাতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে৷ ভীষণভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে আবার৷ ধরাবাধাহীন, জবাবদিহি বিহীন, ছন্নছাড়া একটা জীবনের হাতছানিতে খুব ইচ্ছে করে সাড়া দিতে৷ কিন্তু পিছিয়ে আসতে হয় পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই৷ তবুও তো পাখিরা ঝড়ের পরেও আবার বাসা বাঁধে, বলেছিলো নিশীথ৷
স্বামী স্ত্রী নয় শুরুটা নাহয় বন্ধু হিসাবেই হোক৷
রিনি নিমরাজি হয়েই লিভ ইন শুরু করেছে নিশীথের সাথে৷ মাত্র দু-মাসের সংসারে এটুকু খুব ভালো করেই বুঝেছে রিনি, নিশীথের নয় এটা ওরই সংসার৷ নিশীথ ওর হাতেই সপে দিয়েছে সব ভার৷ শুধু উপার্জনের অর্থটা ইদানীং এনে ধরে দিচ্ছে রিনির হাতে৷ প্রথমে রিনি আপত্তি করেছিলো, নিশীথ বলেছে… আমার থেকে তুমিই বেশি পারবে আমাকে সামলে রাখতে৷
ইদানীং রিনিকে ছাড়া বাবুর এক মুহূর্তও যেন কাটে না৷ কথায় কথায় আবার নতুন সংযোজন হয়েছে তার অভিমান৷ অশোকের শাসনের ঘেরা টোপ নেই, কিন্তু নিশীথের নির্ভরতার নরম আবেশ আছে৷
সেদিন রাতে নিশীথ হঠাৎ বলে উঠলো, আচ্ছা রিনি যদি আমাদের বিয়েটা হয়েই যায় শেষ পর্যন্ত তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে একটা ডিপ কিস করব!
রিনি লজ্জায় লাল৷ এর মুখে কি কিছুই আটকায় না?
কয়েকদিনের জন্য কাজের সূত্রেই নিশীথের কলকাতার বাইরে যাওয়া৷ অফিস থেকে ফিরে একলা ফ্ল্যাটে মনখারাপ করছে রিনির৷ কি ভীষন মনখারাপ করছে ওই বেহিসেবি ছেলেটার জন্য৷ কই অশোকও তো কাজের সূত্রে বাইরে যেতো, কখনো তো দুশ্চিন্তা ছাড়া এমন পাগল পাগল লাগেনি রিনির৷ তবে কি অভ্যাস আর ভালোবাসা দুটো ভিন্ন শব্দ?
ও কি তবে সত্যিই নিশীথকে!
ফোনটা বাজছে রিনির৷
ও প্রান্তে কোনো একটা অচেনা ব্যক্তির গলা৷ ম্যাডাম নিশীথ রায়কে আপনি চেনেন? ওনার ফোনে আপনার ফোন নম্বর পেয়ে কল করছি৷
মুহূর্তের জন্য হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা বন্ধ হয়ে গেলো রিনির৷ কি হয়েছে নিশীথের? কোনো অ্যাকসিডেন্ট?
রিনি কি তবে সত্যিই অপয়া? তাই কি ও আসায় নিশীথের….গলা দিয়ে একফোঁটাও আওয়াজ বেরোচ্ছে না ওর৷
ও প্রান্তের ভদ্রলোক বললেন, ম্যাডাম নিশীথ বাবুর এখানের কাজ শেষ৷ আমরা আজই হোটেল ছেড়ে দিয়ে কলকাতা ফিরতে চাই পুরো টিম৷ কিন্তু নিশীথ বাবু বলছেন, ওনাকে নাকি কেউ ভালোবাসার নেই কলকাতায়? তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পাঠালো… আপনি কি সত্যিই?
প্রায় চিৎকার করে উঠেছে রিনি৷ আপনি ওই জানোয়ারটাকে ফোনটা দিন… আমি দেখছি ওকে!
ও প্রান্তে চেনা হাসির আওয়াজ৷
বলো রিনিরিনি, তুমি আমাকে ঠিক কি রূপে দেখতে চাও?
আই জাস্ট কিল ইউ নিশীথ! তুমি এভাবে আমাকে… ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো রিনি৷ জানোয়ার, আই লাভ ইউ৷
নিশীথ চিৎকার করে বললো, রিনি… বাংলায় বলো… আমি ইংরাজি বুঝি না!
রিপিট করো, বলো… ভালোবাসি, নিশীথ আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি৷ আমি এতদিন এই সত্যটা লুকিয়ে রাখছিলাম৷ বলো রিনি বলো…
রিনি গলার মধ্যের কষ্ট কষ্ট সুখটাকে চেপে রেখেই বললো, চলো শুরু করি নতুন করে৷ সব ভুলে…
কিছু কিছু সম্পর্ক এমন হঠাৎই মোড় নেয়, যার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না… দৃষ্টান্ত হয়েই রয়ে যায়৷