সে যখন এল
সেই বৃষ্টির রাতে শতভিসার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পর অজয় বদলি নিয়ে চলে আসে উত্তরবঙ্গে৷ সুমিতা মাত্র কয়েকদিনের নোটিসে এত বছরের সংসার গুছিয়ে, নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে কেঁদেছিলো খুব৷ কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সয়েছিলো সব৷
শতভিসার ডাকনাম তিন্নি, বাবার আদুরে নাম৷ তিন্নির বয়স এখন ১৯৷ ফার্স্ট ইয়ার-এর ছাত্রী৷ তিন্নি নিজে একটু অগোছালো৷ কিন্তু রাস্তা ঘাটের মুগ্ধদৃষ্টি ওকে সর্বদাই বিদ্ধ করে৷ কিছু সময় অস্বস্তি কিছু সময় লজ্জা তিন্নিকে ঘিরে থাকে৷ পড়াশোনাটা ও ছোটো থেকেই খুব মনোযোগ দিয়েই করে৷ একটু ছটফটে বলে মা-এর কাছে মা-র আর বকুনিতে ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বাপির একটা কড়া কথায় তিন্নির চোখের জলের বাঁধ মানে না৷
সামনে চায়ের কাপ আর সংবাদপত্র থাকলেও অজয়ের মন পরে আছে কলকাতার নিজেদের বালিগঞ্জের বাড়িতে৷ একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে পৈতৃক ভিটে এসেছিল অজয়ের দখলে৷ প্রথমবারেই ব্যাংকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি, তার বছর দুয়েক পর বাবার বন্ধু জয়দেব কাকুর মেয়ে সুমিতাকে বিয়ে৷ অজয়ের বাবা তার বিয়ে চোখে দেখে যেতে পারেননি৷ মা যখন মারা গেলেন তিন্নির বয়স তখন আট-সাড়ে আট হবে৷ মেয়েটা তখন সারা বাড়িতে ঠাম্মাকে খুঁজে বেড়াতো, আর কাঁদতো৷ সুমিতাই বুদ্ধি করে নাচের স্কুলে ভারতনাট্যম-এর জন্য ভর্তি করে দিয়েছিল ওকে৷ এই তো সেদিন অফিস থেকে ফিরলে গলা জড়িয়ে ধরে নানা বায়না করতো৷ কত বড়ো হয়ে গেলো মেয়েটা৷ সত্যিই বড়ো হলো, না ২nd মার্চের ঘটনাই ওকে চুপ করিয়ে দিলো কে জানে?
আজকাল খাবার টেবিলে সুজিরপোলাও নিয়ে বাবা-মেয়ের ঝগড়াও বন্ধ হয়ে গেছে৷ এমন দিনও গেছে তিন্নি নিজেরটা খেয়ে নিয়ে বাবার থালা থেকেও কিছুটা খেয়ে নিয়েছে, অজয় সেই নিয়ে প্রায় রসাতল বাঁধিয়েছে৷ শেষে সুমিতা নিজের ভাগেরটা দুজনকে ভাগ করে দিয়েছে৷ সুমিতার সেই আনন্দটা না বুঝেই বাবা-মেয়ে পরে লজ্জা পেয়েছে৷
তিন্নি আজকাল চুল বাঁধতে গিয়ে ছটফট করে না, অজয় ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে অন্যমনস্কভাবে টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকে৷ সুমিতার সাজানো সংসারে কে যেন একপ্রস্থ কালি ঢেলে দিয়েছে৷
তিন্নি সেদিন গোলাপি সালোয়ার পরেছিলো৷ এমনিতে জিন্স আর টপই বেশি পরে৷ কথা ছিলো কলেজের শেষে ওর বাইকে করে ওদের বাড়ি নিয়ে যাবে৷ ওর বাবা-মা তিন্নি কে দেখতে চেয়েছে৷ শুনেই তিন্নি ভীষণ রাগ করেছিলো৷ কি দরকার ছিল এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে জানানোর? শোনেনি অনুপম৷ হাসতে হাসতে বলেছিলো অসুবিধা কি? বাবা- মা বউমা দেখতে চেয়েছে, শুনেই তিন্নি লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলো৷ এমনিতে অনুপম একটু গম্ভীর, তাই হাসলে বেশ লাগে তিন্নির৷ তিন্নি যখন প্রচুর কথা বলে অনুপম শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একমনে ওর বকবকানি শোনে৷ ওর দৃষ্টিতে একটা মুগ্ধতা অনুভব করে তিন্নি৷ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভালো রেজাল্ট করে ক্যাম্পাসিং-এ জব পেয়ে গেছে অনুপম৷ তিন্নির পড়াশুনা নিয়ে ও ভীষণ সিরিয়াস৷ অরুন্ধতীর বার্থডে পার্টিতে ওর সাথে আলাপ হয়েছিলো৷ তারপর তিনমাসে সম্পর্ক অনেক গভীর৷ বাপিকে বলতে গিয়েও লজ্জায় বলতে পারেনি ও অনুপমের কথা৷
গোলাপি সালোয়ারটা পরে অল্প সেজে তিন্নি যখন বেরোলো, অনুপমের মুগ্ধদৃষ্টিতে শরীরে তখন শুধুই শিহরণ৷ ওর বাবা মায়ের ব্যাবহারে তিন্নি অভিভূত৷ ও যেন ওদের কত কাছের৷ ভালোলাগায় মন ভরপুর৷ অনুপম দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলছে তাড়াতাড়ি গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট কারো, বাকি পড়াশোনাটা আমার কাছ থেকে করবে৷
দুজনেই খেয়াল করেনি কথায় কথায় বেশ রাত হয়ে গেলো৷ তিন্নি বাড়িতে ফোন করেছিলো কিন্তু এখন ভয় করছে মা বকবে বলে৷ বাইপাসের দিকটা একটু জোরেই চলছিলো বাইকটা ফাঁকা রাস্তায়, কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি হয়েছে অল্প৷
অতর্কিতে দুজনেই ছিটকে পড়লো, না গাড়ি চালানোর দোষে নয়, কয়েকজন বাইকের সামনে বাঁশ জাতীয় কিছু একটা রেখেছিলো৷ অনুপম খোঁড়াচ্ছে ,তিন্নির হাতে অল্প লেগেছে৷
হটাৎ তিন্নিকে ঘিরে ধরলো জনা চারেক ছেলে৷ টেনে হিঁচড়ে ওকে বিবস্ত্র করার আনন্দে মশগুল তারা৷ তিন্নি দেখলো অনুপম আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওকে বাঁচাবার৷ আর মনে নেই তিন্নির৷ জ্ঞান ফিরেছিলো নার্সিংহোমের বেডে৷ পাশে বাবা-মা একজন নার্স ৷ গায়ে হাতে পাশবিক অত্যাচারের দাগ এখনো বর্তমান৷ বিকালের দিকে অনুপম ওর বাবা-মা কে নিয়ে দেখতে এলো৷ তিন্নি দেখলো বাপির সাথে অনুপমের পরিচয় হয়ে গেছে৷
নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফিরেও তিন্নি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে৷ সুমিতা যতটা সম্ভব সহজ হবার চেষ্টা করছে৷ তিন্নির পছন্দের রান্নাও করেছে৷ কিন্তু কিছুই মুখে তুলছে না দুর্বল মেয়েটা৷ অজয় ওর পছন্দের গানগুলো বাজিয়েই চলেছে৷ ভারতনাট্যম এর বোলেতেও মেয়েটা স্থির৷
আত্মীয়-প্রতিবেশী সকলেই সমবেদনা জানিয়ে গেছে একবার করে৷ আড়াল থেকে কিছু ফিসফাস তার কানেও এসেছে৷ বেশকিছু জনকে তিন্নি চেনেই না৷
অনুপমের ফোন এলো বাড়ির ল্যান্ডে, একটু রাতের দিকে৷ সুমিতা ডাকতেই যাচ্ছিলো তিন্নিকে, অনুপম বারণ করলো৷
কোনোরকমে খাপছাড়া করে ওর বক্তব্য শেষ করলো৷
সুমিতা রিসিভার রাখার আগেই নিজের ঘরে রিসিভারটা রেখে দিলো তিন্নি৷ কেন জানে না কষ্টর থেকে নিশ্চিন্ত লাগছিলো তিন্নির৷
তারপরই অজয়ের বদলির সিদ্ধান্ত৷ এখানে এই ফ্ল্যাটটা ছোটো হলেও তিন্নির বেশ পছন্দ৷ কেমন নিরিবিলি আর সবুজেঘেরা৷
দোষ না করেও ওদের পালিয়ে আসতে হলো কলকাতা থেকে৷ তবে এই সুযোগে বন্ধু-বান্ধব আর ভালোবাসার সাথে নতুন ভাবে পরিচয় হলো ওর৷
প্রায় পাঁচ বছর হলো ওরা এখানে৷ ওর MCA-টা কমপ্লিট হয়ে গেলে ফিরে যাবে ভাবছে অজয়৷ সুমিতাও এখানে বড়ো একা হয়ে গেছে৷ তিন্নি ওর পড়াশোনা আর নাচ নিয়েই সর্বক্ষণ ব্যস্ত৷ অজয় অফিসে৷ সুমিতার কষ্টটা বোঝে অজয় কিন্তু কলকাতা থেকে সেই মুহূর্তে চলে না এলে তিন্নিকে বাঁচানো যেত না৷ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত না স্বাভাবিক জীবনে৷
সুমিতা ঘর-বার করছে কি হলো মেয়েটার এত দেরি কেন হচ্ছে আজ ফিরতে৷ ঘরে ঢুকলো তিন্নি একটা উস্কো-খুস্কো, জংলি গোছের ছেলেকে নিয়ে, বয়স তিন্নির মতোই৷ পরিচয় করাচ্ছে তিন্নি, ছেলেটির নাম মহসীন৷ ছেলেটি নাকি ওদের ইউনিভার্সিটি টপার৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটি বহুপরিচিতর মতো গল্প জুড়েছে অজয়ের সাথে৷ কিছুক্ষণ পর অজয় উপলব্ধি করলো ছেলেটির সব বিষয়েই প্রায় সমান দখল৷
সুমিতার হাতের খাবার খেতে খেতে খুব প্রশংসাও করলো সে৷ হঠাৎ সুমিতাকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করলো, আপনি কি গান গাইতেন? একটা গান শোনান না৷ তিন্নি হাসছে আর বলছে এটা ভুল বললে তুমি, মা কোনোদিন গান শেখেইনি৷ জানে না তিন্নি, বিয়ের পর সরোদ সর্দারের হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে দিয়েছিলো সুমিতা রাগ করে৷ অজয়ের মা পছন্দ করতো না বলে৷ এই ছেলেটা কি করে বললো? অবাক হলো সুমিতা৷ মহসীন বলেই চলেছে, কি গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত না ক্লাসিক্যাল৷ সুমিতা বললো ক্লাসিক্যাল আর নজরুলগীতি৷ মাস্টারডিগ্রিও করেছিলো সুমিতা ক্লাসিক্যালে৷
ভারি মায়াবী চোখ এই ছেলেটার৷
তিন্নি সেদিন নাচের ক্লাসে, হঠাৎ হাজির ওই মহসীন৷ কোথা থেকে একটা গিটার এনে বাজাতে শুরু করলো, একটা নজরুলগীতি৷ সুমিতা কখন গাইতে শুরু করেছে নিজেরই খেয়াল নেই৷ তিন্নির হাততালিতে সম্বিৎ ফিরলো৷
এমন একটা দিনও নেই যেদিন অজয় আর সুমিতার মধ্যে মহসীনকে নিয়ে কথা হয় না৷
ছেলেটার ছেলেমানুষি দেখলে অজয়ের হাসি পায়৷ একদিন সুমিতাকে এসে বলে আমাকে ভাত মেখে খাইয়ে দেবেন কাকিমা? অদ্ভুত ভাবে পাল্টে দিলো ওদের বাড়ির গুমোট পরিবেশটা৷
আজ তিন্নির সাথে কথা বলতেই হবে অজয়কে, কি ভাবছে ও৷ এখন তো দুজনেই সেটেল্ড৷ ভালো চাকরি করছে দুজনেই৷ যদিও মহসীন চাকরিটা কতদিন করবে কে জানে? যা পাগল ছেলে, ও নাকি মুভি বানাবে৷ এসব চাকরি নাকি ওর জন্য নয়৷
ভালোলাগে তিন্নির ওর পাগলামি, ওর কথা বলা, কিন্তু ভালোবাসতে ভয় করে৷ বোঝে না ও মহসীন কি আদৌ ওকে ভালোবাসে? একদিন বলেছিলো ও, তিন্নির সবকিছুই নাকি ওর ভালোলাগে৷
তিন্নি আজ বলেই দিলো মহসীনকে সেই রাতের কথা, অনুপমের কথা সব৷ ভিতরে ভিতরে হাসছে তিন্নি৷ দেখা যাক মুগ্ধতার আয়ু কতক্ষণ? নষ্ট মেয়ের খেতাব পেতে আর কত দেরি? হঠাৎ তিন্নির হাতটা একটু স্পর্শ করেই, ছেড়ে দিলো মহসীন৷ ও বললো, চলো আজ ওঠা যাক৷
জিতে গেছে তিন্নি৷ বাবা-মা ভুল করলেও, ও নিজে ভুল করেনি৷ চিনতে পেরেছে মুখোশধারীকে৷
ক-দিন বাড়িটা একটু বেশিই চুপচাপ৷ মা মন মরা, বাপি গম্ভীর আর তিন্নি নিজের মতোই৷
রবিবারের সকাল একটু দেরি করেই শুরু হয়৷ সবে জলখাবার বানাতে লেগেছে সুমিতা, হঠাৎ গমগমে গলায় মহসীনের ডাক কাকি…মা…৷
কি মুশকিল সঙ্গে আবার একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাও আছেন, যারা ওর ব্যাবহারে ইতস্তত করছেন বাড়িতে ঢুকতে৷
অজয় এগিয়ে যেতেই ও বললো এই আমার বাবা-মা৷ ভদ্রলোক করমর্দন করলেন৷ ওনাদের ভিতরে নিয়ে এল অজয়৷
সবাইকে অবাক করে বলেই চলেছে মহসীন৷ আসলে বোঝেনই তো আগের দিনের মানুষদের বোঝানো একটু সমস্যা, তবে আমার বাবা মা ভীষণ লিবারেল৷ শতভিসাকে বিয়ে করার জন্য সকলকে রাজি করাতে একটু সময় লেগে গেলো৷ ওই হিন্দু-মুসলিম, ধর্ম-অধর্মের ব্যাপারে সবাই তো একমত নয় তাই আরকি৷ আমার বাবা ফিজিক্স-এর প্রফেসর, মা-এর একটা নাচের স্কুল আছে৷ তিন্নির নাচের সিডি মা দেখেছে, মায়ের খুব ভালোও লেগেছে৷ বউমা হিসাবে তিন্নিকে ওদের পছন্দ হয়েছে, তাই না মা?
তিন্নির মনে হচ্ছিল গিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরে, এত কথা বলছে কেন ও? শেষে ওর বাবা বললেন এবার তুই থাম বিল্টু, আমরা কথা বলি ওনাদের সাথে৷
জলখাবার খেতে খেতেই কথা হচ্ছিলো বিয়ের ডেট, রিচুয়ালস এসব নিয়ে৷
তিন্নি পাশের ঘরে উঠে গেলো৷ পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরেছে মহসীন৷ কানে কানে বলছে ভুল ভেঙেছে?
তিন্নি কেঁদেই চলেছে৷ মনে হচ্ছে এত বছরের জমা কান্না সব আজ বেরিয়ে আসছে৷ ও আস্তে আস্তে মাথায় হাত রেখেছে আর বলছে, পাগলি এই ভাবে কখনো কিচ্ছু নষ্ট হয় না৷ শরীরটা তো একটা মনের আধার মাত্র, এত সহজে কি কেউ সেই শরীরকে অপবিত্র করতে পারে?
তিন্নি আস্তে আস্তে বললো, ঈদের দিনে আমি তোমাকে সিমুই বানিয়ে খাওয়াবো দেখো৷
মহসীন বললো, আমিও দুর্গা অষ্টমীতে ধুতি পরে অঞ্জলী দেব৷
পাগলি তোমার সাথে ঈদ-অষ্টমী কাটাবো সারা জীবন… বলেই মহসীন মাথায় হাত রাখলো তিন্নির৷