অতীতকে ভালোবেসে
এই দিনটায় ভীষণ টেনশন হয় প্রদীপ্তর৷ আজ দু-আড়াই বছরেও এর কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ কলেজের প্রথম দিনের মতোই টেনশন নামক জিনিসটা বেশ চেপে বসে থাকে ওর ঘাড়ে৷ কলিগরা হেসে বলেন, প্রদীপ্তকে দেখে বোঝাই যায় না কে স্টুডেন্ট আর কেই বা প্রফেসর! কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারেনি প্রদীপ্ত যে এই দিনটায় ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে যাওয়ার আগে ও অন্তত বার তিনেক টয়লেটে ঢোকে, চার বোতল জল খেয়ে ফেলে৷ কারণ একটাই, প্রথম যেদিন এই কলেজে ঢুকেছিলো, সেদিনই ছিলো ফ্রেশারদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান৷ প্রদীপ্তও সবে মাত্র পা দিয়েছে কলেজে৷ প্রফেসর হিসাবে বয়সটাও নিতান্তই কম৷ সেদিন ফ্রেশারদের পাল্লায় পড়েছিলো ও৷ নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলো ওদের ক্লাস নিতে গিয়ে৷ মেয়েরা যে এত বিচচু হয় আগে কোনোদিন জানতেই পারেনি প্রদীপ্ত৷ ছোটো থেকে বয়েজ স্কুলে পড়ার জন্যই হয়তো মেয়ে সম্পর্কে আড়ষ্টতা ওর কোনোদিনই কাটেনি৷ কলেজে দু একটা বান্ধবী যে ওর জোটেনি তা নয়, তবুও মেয়েদেরকে ও সাধারণত এড়িয়েই চলে৷ সেদিন ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাসে ঢুকে অঙ্ক করাতে শুরু করেছিলো প্রদীপ্ত৷ হঠাৎ একটি মেয়ে বলে উঠলো, স্যার… আপনার কি রঙে এলার্জি আছে?
মানে বেশি রঙচঙে জিনিসের দিকে তাকাতে পারেন না?
প্রদীপ্ত ঘাবড়ে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুঝতে চেয়েছিলো ওর নিজের এমন কোনো অদ্ভুত রোগ আছে কিনা! দু মিনিট পর উত্তর দিলো, না এমন কোনো প্রবলেম তো নেই৷ বরং রং দেখতে তো ভালোই লাগে৷
মেয়েটির পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে স্যার আপনার কি মনে হয়, ম্যাথের ক্লাসে মেয়েগুলো বানের জলে ভেসে এসেছে? মানে আমরা কি বানভাসি স্যার?
সত্যি বলতে কি প্রদীপ্ত কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না মেয়েটার বক্তব্যটা ঠিক কি!
মেয়েগুলো খিক খিক করে হাসি শুরু করেছিলো৷ প্রদীপ্ত অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো৷ আরেকটি মেয়ে বললো, এই রাই কি হচ্ছে! বাচচা স্যার, এমন মজা করলে ভয় পেয়ে যাবে যে৷ সাতাশ বছরের প্রফেসর যে এদের কাছে নিতান্তই বাচচা ছেলে হতে পারে সেটা ভাবতেও পারেনি প্রদীপ্ত৷ রাই নামক মেয়েটি বান্ধবীর বকা খেয়ে বললো, না মানে স্যার ছেলেগুলো তো মাটি, আকাশ, মেঘ রঙের জামা পরে আছে, আমরা তো বেশি রঙচঙে পোশাক পরে আছি, আপনি একবারও আমাদের দিকে না তাকিয়ে শুধু ওদের দিকেই তাকিয়ে অঙ্ক বোঝাচ্ছেন, তাই ভাবছিলাম আপনার হয়তো কালারে এলার্জি আছে৷ অথবা আমরা মেয়েরা আপনার দৃষ্টিতে বানভাসি৷
তারপর থেকে প্রদীপ্ত আড়ষ্টতা কাটিয়ে চেষ্টা করেছে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে পড়াতে৷ কিন্তু তবুও গত দু-বছর কলেজে পড়িয়েও ওর সেই সলজ্জ ভাবটা এখনও যায়নি৷
জন্মসূত্রেই বাহ্যিক রূপটা পেয়েছে প্রদীপ্ত৷ এতে ওর বিশেষ হাত ছিলো না৷ মায়ের মতোই মুখশ্রী ওর৷ তাই তাকে কলেজের মেয়েরা আড়ালে এবং সম্মুখে হ্যান্ডু বলেই ডাকে৷ এটাও একটা চূড়ান্ত অস্বস্তির জায়গা৷ প্রতিবার এই ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে-মেয়েদের নিয়েই একটু চাপে থাকে প্রদীপ্ত৷ মাস খানেক অন্তত সময় লাগে এদের বাগে আনতে৷ স্কুল পেরিয়ে এলেও এদের স্কুলের ওই ছেলেমানুষি আর দুস্টুমিগুলো কিছুতেই ছাড়তে চায় না৷ তাই ফ্রেশারদের চোখে মুখে থাকে একটা নির্মল সারল্য৷ কিন্তু শুধু সারল্য নয় সাথে প্রফেসরদের অপ্রস্তুতে ফেলতে পারলে তাদের খিল খিল হাসির ফোয়ারায় ক্লাস মুখরিত হয়ে ওঠে৷ তাই এই দিনটায় প্রদীপ্ত বেশ একটু আড়ষ্ট হয়েই থাকে৷
আজও সেই একই ভঙ্গিতে কলেজের কমনরুমে পায়চারি করছিলো প্রদীপ্ত৷ রাজীবদা হাসি হাসি মুখে বললেন, কি ব্যাপার আমাদের তরুণ প্রফেসরের কি আজ লুজমোশন হয়ে গেছে নাকি! ফ্রেশাররা কি ইজ্জত কেড়ে নেবে নাকি তোমার?
রাজীবদা ফিলজফির প্রফেসর৷ কিন্তু এতটাই মুখ আলগা, যে সবাই একটু সমঝে চলে৷ প্রদীপ্ত পায়চারি থামিয়ে বললো, আরে কি যে বলেন, আমার তিন বছর হয়ে গেলো এই কলেজে, এখনো কি সেইদিন আছে! রাজীবদা মুচকি হেসে বললেন, তা না থাকাই ভালো৷ তবে শুনলাম নাকি এবারের ফ্রেশাররা বেশ বিচ্ছু টাইপের৷ দেখো তোমাকে আবার না অ্যাট্যাক করে বসে৷ শুনেই হাতের তালু ঘামতে লাগলো প্রদীপ্তর৷
সাহসে ভর করেই ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে ঢুকলো প্রদীপ্ত৷ ওকে দেখেই দুটো ছেলে বলে উঠলো, এই দেখ দেখ সিনেমার হিরো মার্কা প্রফেসর৷ অনেকটা রণবীর কাপুরের ছোটো ভাই টাইপ তাই না? মাঝে মাঝে নিজেরই বিরক্ত লাগে প্রদীপ্তর, মনে হয় ও কেন আরেকটু রাশভারী হলো না!
বেশ কয়েকটি মেয়ে ফিচেল হেসে বললো, আপনি আমাদের সব ক্লাস নেবেন স্যার? নিন না স্যার, প্লিজ!
প্রদীপ্ত এসব কথায় বেশি পাত্তা না দিয়েই বললো, তোমরা কারা কারা অঙ্ককে ভালোবেসে ম্যাথে অনার্স নিয়েছো, আর কারা কারা অন্য সাবজেক্টে অনার্স না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিয়েছো, সেটা একটু ক্লিয়ার করো তো৷
একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, স্যার আমার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া অধিকারী, আমি ম্যাথমেটিক্স নামটাকেই ঘৃণা করি৷ তাও অনার্স নিয়েছি৷
মেয়েটির দিকে তাকাতেই একটু চমকে উঠলো প্রদীপ্ত, একটা নিষ্পাপ সুন্দর মুখ, কিন্তু বড়ো বড়ো নিখুঁত চোখ দুটোতেই তীব্র ঘৃণা৷ যেন পারলে পৃথিবীর আহ্নিক গতিকে থামিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দিতে চায় সব কিছু৷
গত দুবছর ধরে প্রদীপ্ত শুনে এসেছে, কেউ বলেছে অঙ্ক খুব ভালোবাসে৷ কেউ বলেছে কেমিস্ট্রি অনার্স ইচ্ছে ছিলো, না পেয়ে বাধ্য হয়ে ম্যাথে নিতে হয়েছে৷ আবার কেউ কেউ বলেছে, স্যার অঙ্কে বেশি মার্কস ওঠে তাই নিয়েছি৷ এই প্রথম কেউ বললো, ম্যাথমেটিক্স সাবজেক্টটাকেই ঘেন্না করে সে৷
বড়ো একটা ঢোক গিলে প্রদীপ্ত বললো, কেন বিষ্ণুপ্রিয়া তুমি কেন ঘৃণা করো এই দুর্দান্ত সাবজেক্টটাকে? বিষ্ণুপ্রিয়া বেশ কিছুক্ষণ ডান হাতের নখ দিয়ে বাঁ হাতের নখগুলোর পার্পেল রঙের নেলপালিসকে নির্মম ভাবে খুঁটে উঠিয়ে দিলো৷ তারপর ঘাড় গোঁজ করে বললো, ম্যাথমেটিক্সের লোকেরা ভীষণ বাজে হয়, ভীষন পচা৷ জীবনের সব অঙ্ক গন্ডগোল করে দেয় এরা৷
কথাগুলো বলার সময়েই বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছিলো৷ যেন চোখের শিরা ফেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ যাহোক করে চোখের অবাধ্য জলকে শাসন করে দমন করলো বিষ্ণুপ্রিয়া৷ পাশের মেয়েটি ইশারায় বললো, এই প্রিয়া বসে পড় প্লিজ৷
এতক্ষণে মেয়েটি সম্বিৎ ফিরে পেলো যেন৷ চমকে উঠে বললো, সরি স্যার৷
প্রদীপ্ত আজকের ক্লাসটা শুরু করলো অন্য ভাবে৷ কারণটা বোধহয় ম্যাথমেটিক্স পড়া মানুষ মাত্রই যে খারাপ নয় সেটা প্রমাণের আশাতেই৷ প্রদীপ্ত বললো, আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তে অংক রয়েছে৷ শুধু খাতায় কলমে কয়েকটা সংখ্যার যোগ-বিয়োগ মানেই কিন্তু অঙ্ক শেষ নয়৷
বলেই ঘুরে দাঁড়ালো বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে৷ তারপর আস্তে করে বললো, বিষ্ণুপ্রিয়া তুমি তোমার হৃৎপিণ্ডের লাবডুব শব্দের গতি মেপেছো কখনো? না এটা শুধু একজন ডাক্তার পারেন তা নয়, একজন ম্যাথমেটিশিয়ানও পারেন৷ নিজের বুকের বাম দিকে আলতো করে হাতটা ছুঁয়ে দেখো, ওখানেও প্রতি সেকেন্ডে অঙ্কের খেলা চলছে৷ গোটা ক্লাস আজ চুপ৷ মন্ত্র মুগ্ধের মতো প্রদীপ্তর দিকে তাকিয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া৷
প্রদীপ্ত বললো, অঙ্কের এই খেলাটা কবে শেষ হবে জানো? যখন মানুষ আর অনুভব করতে পারবে না, এই ধুকপুক আওয়াজটা৷ সেদিন আর মানুষের মাথা কষতে পারবে না জটিল অংকগুলো৷
সেদিন হেরে যাবে গণিতের হিসেব নিকেশ, তার আগে পর্যন্ত এ অংকের কোনো শেষ নেই৷
ফার্স্ট চ্যাপ্টারের বেশ কিছু অঙ্ক কষে দিয়ে বেরিয়ে গেলো প্রদীপ্ত৷ কিন্তু ওর সিক্সথ সেন্স বলেছিলো, একজোড়া কৌতূহলী চোখ সমানে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে৷ চোখ দুটো অন্য কারোর নয়, বিষ্ণুপ্রিয়ার৷ ঊনত্রিশ বছরেই জীবনে প্রোপজাল কিছু কম পায়নি প্রদীপ্ত৷ কলেজ স্টুডেন্ট থেকে আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে গিয়েও প্রেম প্রস্তাব পাওয়াটাতে মোটামুটি অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলো প্রদীপ্ত৷ কিন্তু এই প্রথম কাউকে দেখে ওর মনে বসন্ত বাতাসটা উতলা হয়ে উঠলো যেন৷ মেয়েটার সাথে প্রদীপ্তর বয়েসের ফারাক প্রায় নয় বছর মতো৷ মেয়েটা নিতান্তই ইমম্যাচিওর, ওর সাবজেক্টকে ক্লাস শুদ্ধু ছেলেমেয়ের সামনে রীতিমতো অপমান করেছে, তবুও মেয়েটাকে কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না প্রদীপ্ত৷ এমনকী রাতে খাবার টেবিলে মা বললো, তুই আজ এত অন্যমনস্ক কেন রে? কলেজে কিছু হয়েছে? আজকাল তো শুনি কলেজে লেখা পড়া কম, রাজনীতি বেশি হয়, তো সেরকম কিছু বুঝি?
প্রদীপ্ত আলটপকা বলে বসলো, মা বিষ্ণুপ্রিয়াকে চৈতন্যদেব মন থেকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নেন নি কেন?
রমলা দেবী ছেলের এ হেন প্রশ্নে একটু ঘাবড়ে গিয়েই বললেন, হঠাৎ বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা কেন রে? তুই কি বাংলায় এম. এ. করবি ভেবেছিস? দেখ, আর পড়াশোনা নয়, যথেষ্ট হয়েছে৷ আমি বুড়ো হচ্ছি, এবার তো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিয়ে কর৷ তাছাড়া বাংলা আর অঙ্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার৷ মা-কে থামানো দরকার ভেবেই প্রদীপ্ত বললো, উফ মা…আমি লিটারেচার নিয়ে পড়তে যাচ্ছি না গো৷ তুমি তো জানো লিটারেচার আমার কাছে আতঙ্ক ছিলো৷ শুধু ওই ক্যারেক্টারটার সম্পর্কে একটু জানতে চাইছি৷
সেই আগে একটা সিরিয়াল হতো না টিভিতে! সিরিয়ালের কথায় মা দারুণ ইন্টারেস্ট দেখিয়ে বললো, আহা মেয়েটা যে বড়ো অভাগা রে৷ চৈতন্যদেব কোনোদিন মন থেকে স্ত্রী হিসাবে মেনেই নিলেন না অমন সুন্দরী মেয়েকে৷ লক্ষীদেবীর মৃত্যুর পর তো গৃহত্যাগী হয়ে গেলেন উনি৷
বিষ্ণুপ্রিয়াকে লোকে বললো, স্বামীকে আটকে রাখতে পারল না৷
মা নিজের মনে বলেই চলেছে, আর প্রদীপ্তর চোখের সামনে ভাসছে সাদাতে আর পার্পেল কালারের ফুল ছাপ চুড়িদার পরা মেয়েটার ভাসা ভাসা চোখ দুটোতে যেন সমস্ত পৃথিবীর রাগ এসে জমেছে৷
রাতে ঘুমের মধ্যেও বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিলো বিষ্ণুপ্রিয়ার বলা ওই মারাত্মক কথাগুলো, যারা ম্যাথমেটিক্স নিয়ে পড়ে, তারা খুব খারাপ হয়৷
আচ্ছা কেন বললো মেয়েটা এই কথা? তার মানে কি কোনো ম্যাথের ছেলের সাথে মেয়েটার প্রেম ছিল, আর ছেলেটা কি বিষ্ণুপ্রিয়াকে কোনোভাবে চিট করেছিলো, তাই ওর এতটা রাগ জন্মেছে৷ ধুর মিলছে না উত্তরগুলো৷
পরের দিন ফার্সট ইয়ারের কোনো ক্লাস ছিলো না প্রদীপ্তর৷
বিজলী ম্যাম কমন রুমে ঢুকেই বললেন, ফার্স্ট ইয়ারে একটা মারাত্মক ন্যাকা মেয়ে ঢুকেছে৷ আজ তাকে অ্যানালিসিস বোঝাতে গিয়ে বুঝলাম, এই কলেজের ম্যানেজমেন্ট বেশ টাকা খেয়ে স্টুডেন্ট ভর্তি নেয়৷ সম্ভবত মিনিস্টার কোটায় ভর্তি হয়েছে মেয়েটা৷ কিচ্ছু জানে না, জাস্ট কিচ্ছু নয়৷ বুকের ভিতরটা ধুকপুক করছিলো প্রদীপ্তর৷ ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলো, কার কথা বলছেন বিজলীদি?
বিজলীদি রাগী গলায় বললেন, ওই বিষ্ণুপ্রিয়া নাকি নাম মেয়েটার৷ কি চূড়ান্ত বেয়ারা মেয়ে রে বাবা৷ দুটো অঙ্ক দিলাম, সবাই করলো, কেবল ওই মেয়েটা বলে নাকি… অঙ্ক করা মানুষরা খুব নোংরা হয়, তাই সে কষবে না৷
আমি শেখাতে গেলাম, সারাক্ষণ পেন কামড়ে বসে থাকলো৷ বিরক্তিকর, কোথা থেকে যে এরা আসে কে জানে? বিজলীদি গজগজ করতে করতে বসে পড়লেন৷
প্রদীপ্ত সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস নিতে যাবার ফাঁকে আড়চোখে দেখলো, ফার্স্ট ইয়ারে ম্যাথের ক্লাসের দিকে৷ দেখলো মেয়েটা একমনে কি একটা পড়ছে৷ মেয়েটা নিজের চারিদিকে একটা অদ্ভুত বলয় তৈরি করে নিয়েছে, তাই তার চারপাশে কোনো বন্ধু-বান্ধবীর সমাবেশ নেই৷ সকলে আনন্দ ফুর্তি করছে, আর এ মেয়ে যেন পাথর প্রতিমা৷ প্রদীপ্তর খুব ইচ্ছে হলো, ও কি পড়ছিলো সেটা দেখার জন্য৷
নিজেকে সম্বরণ করতে না পেরে ক্লাস রুমে ঢুকে বললো, আজ বোধহয় আমার তোমাদের ক্লাস নেই৷ ক্লাস শুদ্ধু সতর্কিত৷ শুধু কোনো হুশ নেই বিষ্ণুপ্রিয়ার৷ সে এক মনে পড়েই চলেছে হাতের বইটা৷ প্রদীপ্ত বললো, তুমি কি বই পড়ছো?
চমকে উঠে নিজের বইটা লুকানোর চেষ্টা করলো৷ যদিও সেই অবসরে প্রদীপ্ত দেখে ফেলেছে যে বিষ্ণুপ্রিয়া জে ভি স্তালিনের লেখা ‘দ্বন্দ্ব মূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের’ ওপর একটা বই পড়ছে৷ অবাক হবার বোধহয় এটুকুই বাকি ছিলো প্রদীপ্তর৷
ধীরে ধীরে বললো, বিষ্ণুপ্রিয়া আমার কিছু কথা আছে তোমার সাথে৷ কলেজ ছুটির পর কমনরুমের সামনে অপেক্ষা করো৷ মেয়েটার মুখে প্রথমে ভয়ের চিহ্ন গুলো পরিষ্কার হলো, তারপর ধীরে ধীরে তা রূপ বদল করে ঘৃণায় পরিণত হলো৷
জেদি গলায় বললো, আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ অপমানে প্রদীপ্তর মুখটা নীল হয়ে গিয়েছিলো৷ তবুও সামলে নিয়ে বললো, বেশ তো তোমাকে বলতে হবে না, আমি বলবো৷
পিছন থেকে দুটো ছেলে বললো, স্যার শুধু বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে কথা আছে? আমাদের সাথে নেই? কেন স্যার আমরা ছেলে বলে? ওদের কথায় কোনো পাত্তা না দিয়েই বেরিয়ে এলো প্রদীপ্ত৷
ছুটির পরে অবশ্য প্রদীপ্ত আশা করেনি যে বিষ্ণুপ্রিয়া নামক তেজি উল্কা পিন্ডটা ওর কথা মতো ওর জন্য অপেক্ষা করবে৷ তাই ও আশা ছেড়ে দিয়েই গ্যারেজের দিকে এগোচ্ছিলো৷ ঠিক সেই সময় পিছন থেকে কেউ বললো, এই জন্যই বলি, ম্যাথ নিয়ে পড়া লোকেরা ভীষণ পচা হয়৷ কথা দিয়ে কথার দাম টুকু পর্যন্ত রাখার প্রয়োজন নেই৷
কথার ঝাঁঝালো গন্ধেই প্রদীপ্ত পিছনে না ঘুরেও বুঝে ফেলেছে নারী কণ্ঠটি কার৷
ইশারায় ও বোঝালো যে ও বিষ্ণুপ্রিয়াকেই খুঁজছিলো৷ গাড়ির ভিতরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, প্রদীপ্তও বেশ ভালোই ড্রাইভ করে, তবুও আজ আরেকজনের উপস্থিতির কারণেই বোধহয় নাকের ডগাটা ঘেমে উঠেছে প্রদীপ্তর৷ বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পরে বিষ্ণুপ্রিয়া বললো, আমাকে কি কলকাতার জ্যাম দেখানোর জন্য আপনি গাড়িতে চাপালেন! তীব্র বেগে আসা কথাটা সামলে নিয়েছে প্রদীপ্ত৷ তারপরেই গাড়ির গতি হালকা করে বললো, এবার বলো তো এই পচা সাবজেক্ট নিয়ে অনার্স শুরু করলে কেন? ইতিহাস এর মত ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট থাকতে ম্যাথের মতো বোরিং সাবজেক্ট কেন? মেয়েটা চোখ নিচু করে চুপ করে আছে৷ প্রদীপ্ত ফিসফিস করে বললো, তোমাকেও বুঝি আমার মতোই জোর করে ভরতি করে দিয়েছে?
বড়ো বড়ো চোখ দুটোতে অবুঝ অবিশ্বাসী চাহনি৷ প্রদীপ্ত জিভে একটা আফসোসের আওয়াজ করে বললো, আমার তো ফেবারিট সাবজেক্ট ছিলো বেঙ্গলি৷ আমার বাবা জেদ ধরে এই বোরিং ম্যাথ নিয়ে ভর্তি করলো৷ এখন দেখো, আমি ম্যাথের প্রফেসর৷ বিষ্ণুপ্রিয়া উৎসাহের বশে বলে বসলো, আপনার বাবাও হিটলার! আমার বাবাও আমাকে ইচ্ছে করে অপছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে৷ আমিও জেদ ধরেছি, আমি এক্সামে সাদা খাতা জমা দেব৷ আমার বাবা বলে, অঙ্কে পুরোটাই সলিড নম্বর, কিন্তু বাবা এটা জানে না যে অঙ্কের শুরুতে শূন্য বলেও একটা সংখ্যা আছে৷ সে অঙ্কবিদরা যতই তাকে সংখ্যা বলে গ্রাহ্য না করুক৷ যখন দেখবে আমি প্রতিটা এক্সামে বিগ জিরো পাচ্ছি তখন শূন্যকে সংখ্যা বলে মানতে বাধ্য হবে৷ বিষ্ণুপ্রিয়ার ঠান্ডা মাথার প্ল্যান শুনে মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে রক্তের একটা হিমস্রোত বয়ে গেলো প্রদীপ্তর৷ তার মানে মেয়েটা চুপচাপ আত্মহত্যার পথে পা বাড়িয়েছে৷ বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজের কেরিয়ারটা দায়িত্ব নিয়ে শেষ করে দেবে বিষ্ণুপ্রিয়া৷
গাড়ির কাচ ভেদ করেই শেষ বিকেলের আলো পড়েছে বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখে৷ চৈতন্যদেব মহাপুরুষ ছিলেন তাই হয়তো এমন মায়াবী চোখের জলকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন, কিন্তু প্রদীপ্ত তো আর কোনো মহান ব্যক্তি নয়৷ তার হূদয় নিতান্তই দুর্বল৷ তাই ওই মায়াবী মুখ থেকে চোখটা সরিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ মন দিলো৷ এত তাড়াতাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে পরকালে যাবার ইচ্ছে ওর নেই৷ সাথে আজ রাতে মাকে গিয়ে বলতেও হবে, ঊনত্রিশটা এমন কিছু বয়েস নয় বিয়ে করার৷ ওটা বত্রিশ তেত্রিশ হলে কিছু ক্ষতি নেই৷ প্রদীপ্তর বাবার সাথেও তো ওর মায়ের প্রায় দশ বছরের ছোটো বড়ো, দুজনে তো দারুণ একটা ইনিংস খেললো বিবাহিত জীবনে৷ তাহলে বিষ্ণুপ্রিয়া যদি ওর থেকে নয় বছরের ছোটোও হয় তাতেই বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে!!
বিষ্ণুপ্রিয়া বললো, আপনার কথা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে৷ আমাকে নামিয়ে দিন৷
মেয়েটার সব ভালো, কিন্তু দশ মিনিট অন্তর অন্তর কেন যে ক্ষেপে ওঠে কে জানে!
প্রদীপ্ত দৃঢ় স্বরে বললো, কিন্তু আমি তো আজ তোমার বাড়ি যাবো৷ তোমার বাবাকে ভীষণ বকে তারপর ফিরবো৷ উৎসাহে বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো৷ সত্যি আপনি যাবেন?
বিষ্ণুপ্রিয়াদের বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পারলো প্রদীপ্ত যে ওর বাবা বেশ ভালো গণিতবিদ৷ টাকার অঙ্কটা যে বেশ ভালো বোঝেন ভদ্রলোক সেটা আর বুঝতে বাকি রইলো না ওর৷ চারিদিকে দামি দামি ফার্নিচার, ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনের সুক্ষ নিখুঁত কাজ গোটা বাড়ি জুড়ে৷ বেশ অঙ্ক কষেই জীবনের নৌকাটাকে চালাচ্ছেন ভদ্রলোক৷ কিন্তু উনি জানেন না ওনার এই নিখুঁত গণিতকে নিমেষে ধূলিসাৎ করতে তার মেয়ে বদ্ধপরিকর৷
কানে ফোন নিয়েই ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন ভদ্রলোক৷ বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবার চেহারার আভিজাত্য দেখেই বোঝা যায়, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বড়োলোক নন৷ বিশ্বনাথ অধিকারী ইশারায় প্রদীপ্তকে বসতে বলে, ফোনের কথা শেষ করলেন৷ তারপরেই প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইনি কে ?
বিষ্ণুপ্রিয়া আলতো করে বললো, আমার কলেজের ম্যাথমেটিক্সের প্রফেসর৷ তোমার সাথে কথা বলতে চান৷
কথাটা বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো বিষ্ণুপ্রিয়া৷
এতটা আবেগের বশবর্তী হয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটার সামনে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি প্রদীপ্তর৷ ভদ্রলোক যদি অপমান করে! প্রদীপ্ত শুনেছিলো, প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়৷ আজ বুঝতে পারলো কথাটা একদম সত্যি৷ এখন বাঘের খাঁচায় বসে এসব ভেবে লাভ নেই৷ নিজেকে সামলে নিয়ে শুরু করলো প্রদীপ্ত৷ ভদ্রলোকের চোখে তখনো একরাশ বিস্ময়৷
আরেকটু হলেই প্রদীপ্ত বলে ফেলতে যাচ্ছিলো, আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিন৷ তারপর আমি বুঝবো ও ইতিহাস নিয়ে পড়বে নাকি ম্যাথ! নিজের অবাধ্য জিভকে সম্বরণ করলো কষ্ট করে৷ তারপর প্রফেসর সুলভ গাম্ভীর্য রেখে শুরু করলো, স্যার আপনার মেয়েকে হয়তো আপনি অর্থ বা পজিশনের জোরে ওই কলেজে ম্যাথে অনার্স নিয়ে ভরতি করে দিলেন, কিন্তু একবারও ভাবলেন না যে ওর ম্যাথমেটিক্স অনার্স নিয়ে পড়ার মতো ক্ষমতা আছে কিনা? আরে বাবা অঙ্কে ওর কোনো দখলই নেই৷ ও ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকছে, অঙ্ক বুঝতেই পারছে না৷
এই পর্যন্ত বলার পর বিশ্বনাথ বাবু ইশারায় থামতে বললেন, তারপর বাজখাই গলায় হাঁক পারলেন, প্রিয়া তোমার রেজাল্টের ব্লু কালারের ফাইলটা নিয়ে এসো তো৷
ভদ্রলোকের গলা শুনে প্রদীপ্তরই গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিলো, আহা রে ওই কচি মেয়েটা কি করে যে এই যমপুরীতে থাকে! যে ভাবেই হোক, মেয়েটাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে হবে৷ নিজেকে কেমন একটা পৃথীরাজ মনে হচ্ছে যেন৷
বিষ্ণুপ্রিয়া একজন পরিচারিকা গোছের মহিলার হাতে চা আর স্নাক্স দিয়ে নিজে পিছনে পিছনে ফাইল হাতে এলো৷
বিশ্বনাথ বাবু নির্দেশের সুরে বললেন, চা খান৷
ফাইল খুলে দুটো রেজাল্ট বের করে রাখলেন প্রদীপ্তর সামনে৷ দুটোতেই বিষ্ণুপ্রিয়া ম্যাথে ১০০৷ মাধ্যমিকের ইতিহাসেও অবশ্য পঁচানববই পেয়েছে৷ বাকি সবেতে মোটামুটি ঠিক ঠাক৷ ওর ম্যাথের মাধ্যমিক, উচচমাধ্যমিকের নম্বর দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো প্রদীপ্ত৷ যে মেয়ে একশো পায়, সে এই সাবজেক্টটাকে ঘৃণা কেন করবে৷
বিষ্ণুপ্রিয়া চলে গেছে৷
প্রদীপ্ত বললো, কিন্তু স্যার ও তো হিস্ট্রি ভালোবাসে৷
ওর কথাটাকে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় রেখে দিয়েই উনি বললেন, আমাদের গুষ্টির সকলে অঙ্ক ভালোবাসে৷ ওসব অতীত ঘেঁটে কিছু হবে না৷ তাই ইতিহাস কোনোভাবেই নয়৷ বিষ্ণুপ্রিয়া ম্যাথ নিয়েই পড়বে৷ আমাদের ফ্যামিলির কেউ ওই বোগাস আর্টস নিয়ে পড়েনি আজ পর্যন্ত কেউ পড়েনি৷
প্রদীপ্ত ফিরে এসেছে৷ কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের বুঝিয়ে বিশেষ লাভ হয় না৷ বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবাও সেই দলেই পড়েন৷
কলেজে রোজই একটা অন্যমনস্ক মেয়েকে ক্লাসে ধীরে ধীরে শেষ হতে দেখছিলো প্রদীপ্ত৷ কমন রুমের আলোচনাও শুনছিলো, বিষ্ণুপ্রিয়া নামক মেয়েটার নূন্যতম জ্ঞান নেই অঙ্কে৷ বিষ্ণুপ্রিয়া পরিষ্কার বলে দিয়েছে প্রদীপ্তকে, যে সে যখন অঙ্ক ভালোবেসে করতো তখন সে অনেক নাম্বার পেয়েছে, কিন্তু যখনই তার ঘাড়ে জোর করে অংককে চাপানো হয়েছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে ওই সাবজেক্টের প্রতি বিতৃষ্ণা৷ বাবা বলেছিলো, মাধ্যমিকে, উচচমাধ্যমিকে যদি ও ভালো রেজাল্ট করে তাহলে ওর পছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে হায়ার স্টাডি করতে দেবে৷ কিন্তু বাবা মিথ্যেবাদী৷ ম্যাথমেটিক্স পড়া লোকেরা মিথ্যেবাদী হয়৷
ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট আউট হলো৷ যথারীতি বিষ্ণুপ্রিয়া চারটে পেপারেই বিগ জিরো পেয়েছে৷
মনটা খারাপ হয়ে আছে প্রদীপ্তর৷ মেয়েটাকে এত বুঝিয়েও কিছু করতে পারলো না৷ মেয়েটা নিজের জেদ ধরে রাখলো৷ বেশ কিছুদিন আর কলেজে আসছে না বিষ্ণুপ্রিয়া৷ একটা অব্যক্ত কষ্ট হচ্ছে প্রদীপ্তর৷ কারোর কাছে ঠিক প্রকাশ করা যাচ্ছে না৷
সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে ঢুকেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে প্রদীপ্তর৷ সবই চেনা মুখ শুধু বিষ্ণুপ্রিয়া নেই৷
হঠাৎই একদিন মধ্যরাতে ফোনটা এলো৷ ঘুম জড়ানো গলায় প্রদীপ্ত হ্যালো বলতেই, ও প্রান্তের অতি পরিচিত কণ্ঠটি বলে উঠলো, দরজা খুলুন৷ আমি আপনার ফ্ল্যাটের সামনে৷ সিকিউরিটি আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না৷ তাছাড়া আমি জানিও না কোন ফ্লোরে আপনার ফ্ল্যাট৷
মা বলতো, ছোটোবেলা থেকে নাকি ভুলভাল স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে বিছানায় কয়েকবার টয়লেট অবধি করে ফেলেছিলো প্রদীপ্ত৷ আবার নাকি ঘুমের ঘোরে মুখে মুখে অঙ্কের থিওরি আওড়ানোটাও ওর অভ্যেস আছে৷ তাই ফোনে বিষ্ণুপ্রিয়ার গলা পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলো, এটা নিশ্চয়ই প্রেমে পড়ার সাইড এফেক্ট৷ কিন্তু যখন বুঝতে পারলো এটা স্বপ্ন নয়, রীতিমতো ঝাঁজালো গলার বক্তব্য, তখন ঝেড়ে মেরে উঠে পড়লো বিছানায়৷ কোনোমতে বারমুডার ওপরে একটা গেঞ্জি চাপিয়ে লিফট ছাড়াই নামতে শুরু করলো চারতলা থেকে৷ তিনতলায় নেমে খেয়াল হলো, তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য লিফট ব্যবহার জরুরি৷ সিকিউরিটির দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া৷ হাতে বেশ বড়ো একটা ট্রলি ব্যাগ৷ ঘড়িতে দেখলো রাত তখন তিনটে বাজে৷
ঘাবড়ে গিয়ে প্রদীপ্ত বললো, তুমি এ সময়?
বিষ্ণুপ্রিয়া নিজের ব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে বললো, এমন গামবাট সিকিওরিটি রাখেন কেন আপনাদের কমপ্লেক্সে৷ এতবার বলছি, আপনি আমার ফিয়াসে, তবুও ঢুকতে দিচ্ছে না৷ সারারাত জল না খাওয়ার জন্যই বোধহয় বেদম কাশতে লাগলো প্রদীপ্ত৷
প্রদীপ্ত যে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ভালোবাসে, এমন কথাও তো কখনো উচচারণ করেনি ওর সামনে৷ মা যা একটু আধটু জানে৷ মেয়েটা এমন কথা বললো কিসের ভরসায়! প্রদীপ্তর ছানা বড়া চোখের সামনে, বিষ্ণুপ্রিয়া বললো, আপনি যখন আড়চোখে আমার দিকে তাকাতেন তখনই বান্ধবীরা বুঝতে পেরেছিলো আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন৷ যদিও আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি৷ কিন্ত আজ এই বিপদের দিনে আপনাকেই মনে পড়লো৷ আমি ফার্স্ট টার্মে যে ইচ্ছে করে শূন্য পেয়েছি সেটা বোধহয় আমার বাবা বুঝতে পেরে গেছে৷ তাই উঠে পড়ে লেগেছে আমার বিয়ে দেবার জন্য৷ বাবারও আমার মতোই জেদ তো, তাই এভাবে আমাকে জব্দ করতে চাইছে৷
প্রদীপ্ত বললো, কিন্তু তোমার বাবা যদি আমার বাড়িতে ধাওয়া করে তাহলে?
বিষ্ণুপ্রিয়া বিরক্ত হয়ে বললো, ধুর বাবা! আমরা তো কালকেই কালীঘাটে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলবো৷ তারপরেই তো আমি আপনার বাড়িতে থেকে হিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হবো৷
প্রদীপ্ত ফিসফিস করে বললো, সব অঙ্কই কষে ফেলেছো দেখছি৷ কিন্তু প্রিয়া, আমিও তো অনাথ নই, আমারও তো মা বাবা আছেন৷ তাদের মতামত ছাড়া…
বিষ্ণুপ্রিয়া বেশ গম্ভীর ভাবেই বললো, একটা অসহায় মেয়ের কষ্ট যদি তারা না বোঝেন, তাহলে তারাই বা কীসের বাবা মা!
কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার কথায় কিছুতেই প্রদীপ্তর বাবা রাজি হলেন না৷ প্রবীর বাবুর এক কথা, তোমার বাবার কাছে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে হবে৷ বিষ্ণুপ্রিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, প্লিজ আঙ্কেল আমার বাবা ভীষণ জেদি, কিছুতেই মানবেন না৷
প্রবীর বাবু আর প্রদীপ্ত সক্কাল সক্কাল বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে চললো ওর বাড়ির দিকে৷ বিষ্ণুপ্রিয়া একদম চুপ করে রয়েছে, ওর চোখে অবুঝ অভিমান৷ অভিমানটা বোধহয় প্রদীপ্তর জন্যই৷ খুব আস্তে আস্তে বললো, জানতাম ম্যাথমেটিক্সের লোকেরা খুব খারাপ হয়৷ প্রদীপ্ত ওর হাতের উপর হাত টা রাখার চেষ্টা করলো৷ বিষ্ণুপ্রিয়া বললো, একটাও কথা বলবেন না আপনি আমার সাথে৷ আপনি ভীষণ মিথ্যুক৷ আপনার মা বলছিলেন, আপনার নাকি ছোট্ট থেকে একমাত্র ইচ্ছে ছিলো অঙ্ক নিয়ে পড়ার৷ তাই আপনাকে তারা আপনার পছন্দের বিষয় নিয়েই পড়তে বলেছিলো৷ আমার মতো ইচ্ছের বিরুদ্ধে নয়৷
প্রদীপ্ত শেষ চেষ্টা করে বললো, কিন্তু তুমি তো উচচমাধ্যমিকে ইতিহাস পড়োনি৷ তাহলে হায়ার স্টাডি করার সময় প্রবলেম হবে তো! রাগী গলায় বিষ্ণুপ্রিয়া বললো, কে বললো আপনাকে আমি H.(-এর ইতিহাস পড়িনি? আমার বান্ধবীর কাছ থেকে নিয়ে আমি গোটা ইতিহাস কোর্স শেষ করেছি৷ এবার একটু অবাক হলেন প্রবীর বাবু৷ তিনি বললেন, আমি চেষ্টা করবো তোমার বাবাকে বোঝানোর৷
ভুল বুঝেছিলেন প্রবীর বাবু, বিশ্বনাথ অধিকারী বড়োই অবুঝ মানুষ৷ প্রিয়ার মা কাঁদছে দেখেও মেয়েকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিলেন না৷ তিনি নাকি মনে করবেন তার একটাই ছেলে আছে, সে ক্লাস নাইনে পড়ে৷ আর তার মেয়ের মৃত্যু ঘটেছে গত কাল রাতেই৷ প্রবীর বাবু অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্ত প্রিয়ার বাবা প্রায় অপমান করেই বের করে দিলেন ওদের৷
শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়াকে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন প্রবীর বাবু৷
প্রদীপ্ত করুন চোখে তাকিয়ে থাকলো বাবার দিকে৷ বাবা বললেন, আগে ওর গ্রাজুয়েশনটা অন্তত কমপ্লিট হোক, তারপর দেখা যাবে৷
দেখতে দেখতে তিনটে বছর অতিক্রান্ত হলো৷ বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রতিটা এক্সামের আগে প্রদীপ্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো ওর কলেজের সামনে৷ মেয়েটার চোখে এখন আর রাগ বা ঘৃণা নেই, বরং সেদিন ফট করে বলেই ফেললো, বিয়ের পর কিন্তু মাস্টার্স করবো, পি এইচ ডি করবো আমি৷
প্রদীপ্ত শুধু হেসে বলেছিলো, বুড়ো বরকে বিরক্ত লাগবে না তো দুদিন পর?
বিষ্ণুপ্রিয়া ঠোঁটে সলজ্জ হাসি ছড়িয়ে বলেছিলো, চৈতন্য মহাপ্রভুও বয়েসে অনেক বড়ো ছিলেন৷
এবারে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে হিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া অধিকারী৷ খবরটা শোনার পড়েই বোধহয় নিজের মেয়েকে মেয়ে বলে পরিচয় দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন উনি৷ তাই প্রবীর বাবুদের ফ্ল্যাটের সামনে ওনার বিশাল গাড়িটা এসে থামলো৷ বিষ্ণুপ্রিয়া এখানে থাকে না শুনে, অবাক হয়ে বললেন, তবে আমার মেয়েটা কোথায় থাকে?
প্রবীর বাবু বললেন, আমার হবু বউমা হোস্টেলে থাকে৷
প্রদীপ্ত প্রমাদ গুনছিলো, তার মানে বত্রিশেও তার বিয়েটা হচ্ছে না৷ এবার নিশ্চয়ই বিশ্বনাথ বাবু ওনার গুনী মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন৷ এখন নিশ্চয়ই আর্টস স্ট্রিমে পড়া মেয়েকে নিয়ে আর ওনার লজ্জা হবে না৷ কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে এবার ঘুরে দাঁড়ালো বিষ্ণুপ্রিয়া৷ সে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো, সে ওই বাড়িতে ফিরবে না৷
প্রদীপ্তর প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওদের দুজনের বিয়েটা হয়েই গেলো৷ শুধু ফুলশয্যার রাতে একজনের মাথার পাশে কমিউনিস্ট ম্যানিফ্যাস্টো আরেক জনের পাশে রামানুজনের থিওরি৷ বিষ্ণুপ্রিয়া আস্তে আস্তে বললো, ম্যাথের লোকেরা খুব খারাপ নয় দেখছি৷ তবে ভীষন আনরোম্যান্টিক! প্রদীপ্ত প্রিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে বললো, বিষ্ণুপ্রিয়া, আমিও বিশ্বাস করি পছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে ভালোবেসে পড়লে মানুষ অনেক উন্নতি করতে পারে৷ আর্টস বা সায়েন্স বা কমার্স নয়, সব থেকে জরুরি হলো, সে কোনটা ভালোবাসে৷ বিষ্ণুপ্রিয়ার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে প্রদীপ্ত বললো, এই তো সবে শুরু প্রিয়া৷ তোমাকে অনেক পথ চলতে হবে৷ তোমার পি. এইচ. ডি.-র পেপারটা নিয়ে আমি যাবো বিশ্বনাথ অধিকারীর বাড়িতে৷ ওনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবো, এভাবে জোর করে কিছু হয় না৷ আমি জানি,আমি বিশ্বাস করি, আমার বিষ্ণুপ্রিয়া একদিন প্রমাণ করে দেবে আর্টস থেকেও নিজেকে প্রমাণ করা যায়৷ বিষ্ণুপ্রিয়া বললো, ভাগ্যিস এই ম্যাথমেটিক্সের পচা লোকটা আমাকে ভালোবেসেছিলো তাই তো আমি প্রাণ ভরে হারিয়ে যেতে পারলাম অতীতের অলিতে গলিতে৷