বিয়ের তেত্রিশ বছর পরেও
নয়নতারা এটা তোমার বাড়ি৷ তুমি এখানে স্বাধীন৷ না তোমার বাপের ভিটে নয়, শ্বশুরের নয়… এটা একান্ত তোমার৷ পঞ্চাশ পেরোনো নয়নতারার হালকা বলিরেখা সম্বলিত গালে অল্প রঙের ছোঁয়া৷ অবিশ্বাস্য ভাবে নয়নতারা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল,আমার বাড়ি? ধুর তাই এবার হয় নাকি? আমি মেয়ে মানুষ… আমি বাপের ঘর থেকে শ্বশুর ঘরে এসেছিলাম৷ এমন দেবতার মতো স্বামী পেয়েছিলাম৷ কত জন্মের শিবরাত্রির ফল৷ দুই ছেলে এক মেয়েকে পেয়ে নয়নতারা পরিপূর্ন নারী হয়ে উঠেছিলো মাত্র পঁচিশে৷ সতেরোর নতুন বউ পঁচিশে তিন সন্তানের মা হয়ে পুরোদস্তুর গিন্নি৷ যদিও মনিময় সেনগুপ্ত ছেলে মেয়েদের আড়ালে কানে কানে তখনো নয়ন বলে ডেকে উঠতো মাঝে মাঝেই৷ লজ্জা পেয়ে নয়নতারা বলতো, ছেলে মেয়েরা বড়ো হচ্ছে…
কথার রেশ ধরেই মনিময় বলতো ,আর আমি খোকা৷ বউকে বরাবরই বড্ড ভালোবাসতো মনিময়৷ লোকে বলতো অমন আবলুস কাঠের মতো গায়ের রঙের মনিময়-এর অমন আলতা চোবানো বউ হওয়ায় মনিময় নাকি বউকে চোখে হারাত৷ মনিময়ের দাদারা আড়ালে বলতো, মনিটা তো পুরো স্ত্রৈন্য৷ অফিস থেকে ফিরে ইস্তক বউয়ের আঁচলের নীচে ঢুকে বসে থাকে৷ পুরুষ মানুষ… একটু তাস খেলবে, আড্ডা দেবে তা নয়, ছোটোবউমার কষ্ট হবে বলে সেই মেয়ের মুখে দুধের বাটি ধরে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত৷ ছি ছি মনিটা একেবারে মেয়েছেলের অধম৷ এমন কথা নয়নতারাও শুনেছিলো তার বড়ো জায়েদের মুখ থেকে৷
রাতে বিছানায় মনিময়ের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো ঊনিশের নয়নতারা!
আমি নাকি তোমাকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছি আমার রূপ দিয়ে৷ তুমি অফিস থেকে ফিরে ঘরে এস না কাল থেকে৷ তুমি বরং দুর্গামণ্ডপে সকলের সাথে তাস খেলো৷
মনিময় অশ্রুরত বউ-এর চিবুক ধরে বলেছিলো, তোমার কোনটা পছন্দ নয়ন?
নিজের স্বামীকে কাছে পাওয়ার আনন্দ বেশি! নাকি আমি বউএর গোলাম শোনার কষ্ট বেশি?
আচ্ছা হলাম না হয় আমি আমার বউয়ের গোলাম৷ তাতে এ পৃথিবীর কার কি গো?
নয়ন… সব সময় নিজেকে সম্মান দেবে৷ মেয়েমানুষ আবার মানুষ নাকি! এমন ভাববে না৷ দেখোনি শরৎচন্দ্র তোমাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে কত লিখেছেন৷ তুমি তো পড়েওছ কতগুলো৷
অপার বিস্ময়ে পাশের মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকেছে নয়নতারা৷ ভাসুররা যেখানে ভাত দিতে দেরি হলে দিদিদের মুখের ওপর ভাতের থালা ফেলে দিয়ে গটমট করে চলে যায়, সেখানে মনিময় ঝড়ের দিনে ছাদে ছোটে বউয়ের কাপড়-চোপড় তুলে আনতে৷ সবাই মুখ টিপে হাসে৷ তবে নয়নতারা এখন একটু বড়ো হয়েছে৷ দুই সন্তানের মা, আরেকটু বেশি সংসারী… তাই একটু আধটু বুঝতে সেও শিখেছে৷ তার স্বামী ভাগ্য দেখে অন্য মহিলারা যে একটু হিংসে করে না… তা নয়৷
বিয়ের সময় কালো বর দেখে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠেছিলো নয়নের৷ কিন্তু মানুষটার ভালোবাসায় বুঝেছে গায়ের রংটাই সব নয়, মনের আলোটাই আসল৷ মনিময় বলেছে, নয়ন আমাকে তুমি ভালোবাসবে, কিন্তু ঈশ্বর জ্ঞানে যত্ন করবে না৷ ভালোবেসে যত্ন করলে সেটার আন্তরিকতা নাকি বেশি থাকে৷ সব কথা যে নয়ন বোঝে এমন নয়, তবে এটুকু জানে তার সব মনের কথা এই মানুষটাকে বলা যায় মন খুলে৷ এই মানুষের ওপর অভিমানও করা যায়৷ মনিময় বলে, তোমার অভিমান ভাঙিয়ে আবার তোমাকে কাছে পাবার মধ্যে একটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ আছে নয়ন৷
নয়নতারা বলতো, শোনো না… দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি যাবো? তারপরেই ফিরে আসবো শ্বশুরবাড়ি৷ দু-দিনে কি তোমার খুব সমস্যা হবে৷
মানুষটার চোখের তারায় কষ্ট দেখতো নয়ন৷ তবে কি ও বাপের বাড়ি যাক চাইতো না মনিময়৷ বহুবার জিজ্ঞেস করেও সঠিক উত্তর পায়নি ও৷ মনিময় গাড়ি ভাড়া করে বউকে পৌঁছে দিয়ে আসতো নয়নতারার বাপের বাড়ি৷ না কখনো বারণ করেনি, বলে নি… না যেতে হবে না৷ শুধু চোখের ওই কষ্টটার অর্থ বোঝেনি নয়নতারা৷ হয়তো ওকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবেই কষ্ট পেতে মনিময়৷ নয়ন কতবার বলেছে, মরন… তিন ছেলের বাপের আদিখ্যেতা দেখলে লোকে হাসবে৷ মনিময় বউকে জড়িয়ে ধরে বলতো, যেদিন একটা তাজমহল গড়তে পারবো শুধু তোমার জন্য সেদিনই নিজেকে তোমার শাজাহান মনে করব৷
নয়ন হেসে বলতো, এসব কি পাগলামি করো বলতো তুমি?
মনিময় খুব শান্ত গলায় বলতো, নয়ন… বাপের নয়, শ্বশুরের নয়… শুধু তোমার বাড়ি হবে একদিন৷ সেখানে তুমি থাকবে স্বাধীন ভাবে৷ হঠাৎ কাউকে দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আড়াল করবে না তোমার ওই পদ্ম পাতার মতো মুখটা৷ যেখানে তোমার পছন্দের বিউলির ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় তুমি মুখে তৃপ্তির আওয়াজ করতে পারবে৷ যেখানে তুমি স্নান ঘর থেকেই বেরোনোর সময় ঘোমটা টানতে হবে না৷
যেখানে সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ জ্বেলে তুমি আপন মনে গুনগুন করে গাইতে পারবে তোমার প্রিয় ঈশ্বর বন্দনা৷ নয়নতারা হাসি মুখে বলেছিলো, ওমা… এত লেখাপড়া শিখেছো, আর এটুকু জানোনা মেয়ে মানুষকে শ্বশুরের ভিটেতে ঘোমটা দিয়েই থাকতে হয়৷ লোকে ঠিকই বলে, তুমি একটা বউ হ্যাংলা৷ বলেই ভাঙচি কেটে পালিয়েছিলো পঁচিশের নয়নতারা৷ ওর ছুটে পালানোর ছন্দ দেখেছিলো মনিময় অবাক হয়ে৷
মাঝে মাঝেই নয়নতারা লুকিয়ে সন্ধ্যেবেলা ছাদে উঠতো৷ রাতের আকাশের তারাদের দেখতে ওর বড়ো আগ্রহ ছিল৷ একদিন বড়ো ভাসুরের মুখোমুখি হয়ে ওর ছাদে ওঠা বন্ধ হলো৷ সন্ধ্যেবেলা বাড়ির বউ ছাদে উঠে আকাশ পানে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা নাকি সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়৷ বলা যায় না ভূতে ধরতে কতক্ষণ৷
মনিময় শুনে বলেছিলো, নয়ন কষ্ট পেও না৷ আমি ব্যবস্থা করবো৷ একদিন একটা দূরবিন এনে নয়নতারার হাতে দিয়ে মনিময় বলেছিলো, ঘরের জানালা দিয়ে দূরবিন দিয়ে তাকালেই তুমি দেখতে পাবে, কালপুরুষ… অরুন্ধতী… সপ্তর্ষি মণ্ডলদের৷
নয়ন হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, এরা কারা? তারাদের নাম!
তারপর দূরবিনে চোখ রেখে মনিময় বউকে চিনিয়েছিলো তারাদের নাম৷
মনিময় বারবার বলতো, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবো নয়ন৷ নাহলে তুমি কারোর কাছে সম্মান পাবে না৷ কাল তোমার ছেলে মেয়েরা বড়ো হবে৷ আমি হয়তো থাকবো না এই পৃথিবীতে, তখন যেন ছেলে-মেয়েরা তোমাকে হাতের পুতুল করে না রাখে৷
প্রায় বলতো মনিময় এসব কথা৷ মনিময় বয়সে নয়নের থেকে প্রায় বছর পনেরোর বড়ো ছিল৷ কিন্তু এমন সরল মনের বলেই বয়েসের পার্থক্যটা কখনো নয়নের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি৷ বরং নয়নই মাঝে মাঝে কোমর বেঁধে স্বামীকে শাসন করেছে৷
তারপর আস্তে আস্তে নয়নের বয়েস বেড়েছে, ছেলে মেয়েরা বড়ো হয়েছে৷ মেয়ের বিয়ে দিয়েছে৷ নাতির মুখ দেখেছে মনিময়৷ শুধু নয়নের জন্য তাজমহল গড়া আর হয়ে ওঠেনি মনিময়ের৷ কেরানির চাকরি করে তিন ছেলে-মেয়েকে পড়িয়ে বিশেষ কিছু জমতো না৷ তবুও তাজমহলের আশায় একটা অ্যাকাউন্টে জমাত মনিময়৷ বড়ো ছেলে বিজয় যেদিন চাকরি পেলো সেদিন মনিময় ভেবেছিলো সংসারে একটু সহায় হবে৷ মনিময়ের তাজমহল তৈরি সহজ হবে৷ কিন্তু এখনকার ছেলেরা বিষয়ী হয়৷ তাই বিজয় প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে মা-কে একখানা শাড়ি আর মনিময়কে একখানা পাঞ্জাবি দিয়েই দায়িত্ব সেরেছিলো৷ বাড়ির সকলের জন্য এক বাক্স মিষ্টি এনেই বাকি টাকা নিজস্ব অ্যাকাউন্টে ভরে দিয়েছে৷ ছোটো ছেলে সুজয়ও চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে৷ তার একখানা লেগে গেলেই নয়নতারা নিশ্চিন্ত৷ কিন্তু মনিময় নিশ্চিন্ত নয়৷ কারণ বিজয় যদি বা একখানা পাঞ্জাবি এনেছিলো, সুজয় তাও আনবে না৷ কারণ সে বলে, সারাবছর কষ্ট করে পড়াশোনা করে লেখা পড়া শিখে চাকরি পাবো, তার মাইনে লোককে বিলবো কেন? এই লোকের মধ্যে অবশ্য বাবা মাও পড়ে৷ নয়ন সব সময় ছেলেদের গর্বে বুক ফুলিয়ে গল্প করলেও মনিময়ের বুকটা কেঁপে ওঠে৷
নয়নতারা যে বড়ো সরল৷ তার অবর্তমানে নয়নের ঠাঁই কোথায় হবে?
ইদানীং চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো বৃদ্ধাশ্রম দেখে ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে আসে মনিময়ের৷ মনিময়কে না হয় নয়ন প্রাণ দিয়ে দেখবে যতদিন বাঁচবে কিন্তু নয়নের কি হবে! বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ি ছাড়া সে তো আর কোনো রাস্তাও চেনে না৷
বিজয় বিয়ে করে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই নয়নের মনে বড্ড কষ্ট৷ আড়ালে চোখের জল মুছে বলে, আমি কি খুব খারাপ শাশুড়ি! তবে বউমাকে নিয়ে বিজয় কেন থাকলো না আমাদের সাথে?
সুজয়ও চাকরি পেলো৷ তবে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে৷
মনিময় রিটায়ার করেছে বছর খানেক৷ যদিও বয়েস কমানো ছিল প্রায় চার বছর৷ তাই পঁয়ষট্টি অবধি চাকরি করলো মনিময়৷ শরীরটা ক্রমাগত ভাঙছে৷ নয়নের বয়েস বেড়েছে, ঝুলপির চুল পেকেছে, গালে হাঁসের পায়ের ছাপ বয়েস জানান দিচ্ছে৷ তবুও মনটা এখনো সেই নতুন বিয়ে করা আনার পর বউ-এর মতোই আছে৷ মনিময় মাঝে মাঝেই মজা করে বলে, নয়ন তুমি আর বড়ো হলে না৷
বালি স্টেশনের ধারে, হাঁটা পথে দক্ষিণেশ্বর মন্দির… এমন জায়গায় যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় একটা ছোট্ট বাড়ি করছে মনিময়৷
ক্রমশ ভাঙছে শরীর৷ হাতে সময় যেন কমে আসছে মনিময়ের৷ নয়নতারা বলে, কি দরকার ছিলো আলাদা বাড়ি করার? শ্বশুরের ভিটেতে তিনটে ঘর তো ভাগে পেয়েছে মনিময়েরা৷ দুই ছেলে ফিরে এলেও তো অসুবিধা কিছুই হতো না৷ মনিময় নয়নের গালে নিজের ভেঙে যাওয়া গাল চেপে ধরে বলেছে, তোমাকে যদি সম্মানই না দিতে পারলাম তবে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে সেই রাতে শপথ করেছিলাম কেন?
আজও মানুষটাকে বুঝলো না নয়ন৷ কি যে বোঝাতে চায় মানুষটা কে জানে!
প্রায় বছর খানেক লাগলো মনিময়ের ওপরে দুটো আর নীচে দুটো ঘরের তাজমহল বানাতে৷ বাড়ির গেটের সামনে সাদা শ্বেত পাথরের ফলকের ওপরে কালো অক্ষরে লেখা হলো ‘নয়নতারা!’৷ মনিময় বাড়ির নাম দিলো নয়নতারা৷
দক্ষিণের ঘরটাতে নয়নের হাত ধরে দাঁড়িয়ে মনিময় বললো, নয়ন… এ তোমার নিজের বাড়ি৷ বাপের ভিটে নয়, শ্বশুরের ভিটেও নয়৷ স্বামীর ভিটেও নয়৷ দলিলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও… মালকিনের জায়গায় লেখা আছে… নয়নতারা সেনগুপ্ত৷ এ শুধু তোমার বাড়ি নয়ন৷ নয়নতারা অবাক হয়ে বলেছিলো, আমি বাপের বাড়ি যাবো বললে, এই জন্যই বুঝি তোমার চোখে কষ্ট আসতো!
আমার নিজের বাড়ি নেই বলে?
মনিময় পঞ্চাশের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললো, এই তো আমার নয়ন আমাকে বুঝতে শিখেছে৷
গৃহপ্রবেশের দিনই বড়ো ছেলে আর বউমাকে নয়নতারা বললো, বিজয় তুই আর অনু এসে দোতলায় থাক৷ তোর বাবার শরীরটা খারাপ৷ আমারও হাঁটুর ব্যথা৷ এখান থেকে কলকাতার অফিস খুব দূরে তো নয়৷ তাছাড়া নিজেদের বাড়ি থাকতে তুই কেন ভাড়া গুনবি৷ মায়ের শেষ কথাটা হয়তো হিসেবি ছেলের মনে ধরলো৷ সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দোতলার ঘরটা নিজেদের মনের মতো করেই গুছিয়ে নিলো৷
যদিও এখন মনিময়ের সব দিনই ছুটি৷ তবুও ছুটির দিনগুলোতে বাগান করার নেশাটা বেশ পেয়ে বসেছে ওকে৷ নয়নতারার বাড়ির সামনের চত্বরটা বেশ কিছু ফুলের বাগান করেছে মনিময়৷ মেয়ে জামাই এসে দিনদুয়েক থেকে গেছে ওদের নতুন বাড়িতে৷ ছোটো ছেলেও একদিনের জন্য এসে বাবার রুচির নিন্দে করে বলেছে, বাবাটা চিরকালের কিপটে৷ মেঝের পাথরগুলো দেখেছিস! বাবা একেবারেই সস্তায় সেরেছে৷ সুজয় একবারও ভাবেনি বাড়িটাতে তারা দুই ভাই এক পয়সাও দেয়নি৷ সবটাই মনিময়ের জমানো টাকা থেকে করেছে৷
মনিময় কোনোদিনই খুব বেশি প্রতিবাদ করে উঠতে পারেনি কারোর কথার৷ আজও ছেলেদের করা সমলোচনা মুখ বুজে সহ্য করে নিলো৷ সারাজীবনই বড্ড হ্যাটা সহ্য করলো মনিময়৷ বিয়ের পর থেকে স্ত্রৈন্য, পরে শুনেছে মেনি মুখো, এখন শোনে হাড় কেপ্পন৷ কি আর করবে… বয়েস হয়েছে, শরীরে তেজ কমেছে৷ এখন তো আর এই বুড়ো শরীর নিয়ে তেজ দেখাতে পারে না৷ তাছাড়া ছেলেদের কিছু বললেই, নয়নের বড়ো রাগ হয়৷ দু-দিন কথা বলে না মনিময়ের সাথে৷ নয়নের ওই গম্ভীর মুখটা মনিময়ের কাছে মৃত্যুর সমান৷ তাই ছেলেদের কিছুই বলে না ৷
সকালবেলা উঠে বাগানে গাছের গোঁড়ায় চা পাতা দিচ্ছিলো মনিময়৷ হঠাৎই বড়ো ছেলের গলা শুনলো নিজেদের বেডরুম থেকে৷ খুব প্রয়োজন ছাড়া তো বিজয় কখনো বাবার ঘরে ঢোকে না৷
নয়নতারা বলছে, কিন্তু তোর বাবাকে না বলে…
বিষয়টা এখনো ঠিক বুঝতে পারছে না মনিময়৷ হাতের মাটি ধুয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে দাঁড়ালো ঘরের দরজায় আড়ালে৷ বিজয়ের হাতে কিছু কাগজ,আর বউমার হাতে পেন৷
বিজয় বলছে, মা তোমাদের বয়েস হয়েছে৷ বাবা তো চিরকালের গোঁয়ার৷ তাই তোমার নামে বাড়ি করে বসলো৷ এই বুড়ো বয়েসে কত সমস্যা হতে পারে বলতো, সম্পত্তি নিয়ে৷ তুমি এখানে একটা সই করে দাও৷ কোনো প্রয়োজনে যেন আমি তোমার হয়ে বাড়ির ট্যাক্স ক্লিয়ার করতে পারি৷
নয়নতারা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে৷ মনিময় অনেক ইশারা করে বারণ করছে… কোনো ভাবেই যেন নয়নতারা সইটা না করে৷ কিন্তু নয়নতারা একবারও দরজার দিকে তাকাচ্ছে না৷
মনিময় খুব ভালো করে জানে, বিজয় কায়দা করে বাড়িটা লিখিয়ে নিচ্ছে মায়ের কাছ থেকে৷ পরে হয়তো উকিল দিয়ে পাকা করিয়ে নেবে৷ মনিময়ের সমস্ত জমানো টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে নয়নের জন্য ওর নিজের বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলো৷ সেটুকুও ছেলেরা নিজের নামে করে নিতে চাইছে…
নয়নতারা নিশ্চয় পরম বিশ্বাসে সই করেই দেবে৷
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে দেখবে মনিময়৷ ছেলের সামনে নয়নকে যদি সই করতে বারণ করে, তাহলে চূড়ান্ত অপমানিত হবে মনিময় বিজয়ের কাছে… হয়তো নয়নও ভুল বুঝবে৷
সন্তানের কথায় বরাবরই বড্ড অন্ধ নয়ন৷
নয়ন পেনটা হাতে নিয়েছে৷ বিজয় একটা জায়গা দেখালো… যেখানে সইটা করে দিতে বললো৷
হঠাৎই মনিময়কে চমকে দিয়ে নয়নতারা বললো, না বিজয় আমি সই করবো না৷ এটাতে সই করলে আমাকে আবার ছেলের বাড়িতে থাকতে হবে৷ তোর বাবা বলেছিলো, আমি যতদিন বাঁচবো স্বাধীন ভাবে নিজের বাড়িতে বাঁচবো৷
না বিজয়,আমি নিজের বাড়িতে খোলা ছাদে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে চাই৷ আমি মারা গেলে তোরা দুই-ভাই ভাগাভাগি করিস নয়নতারাকে৷ কিন্তু আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন পর্যন্ত নয়নতারা আমারই থাক৷ বেগনভেলিয়া গাছের ফুলগুলো তখনও দুলছে নয়নতারা লেখা ফলকের ওপরে৷
পাশেই বাচচাদের স্কুলের প্যারেড বেরিয়েছে… প্রজাতন্ত্র দিবসের জন্য৷ দেশাত্মকবোধক গানে সকালের বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ৷
মনিময়ের মনে হলো, এতদিনে নয়নতারা মেয়েমানুষের স্বাধীনতার মূল্য বুঝলো৷ নিজেকে সম্মান দিতে শিখলো৷ বিজয় বেরিয়ে গেলো মাথা নিচু করে৷
মনিময় ঘরে ঢুকতেই নয়নতারা হঠাৎ ওর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বললো, হ্যাঁ গো মেয়েমানুষেরও নিজের বাড়ি হয়৷ একেবারে নিজের বাড়ি৷ মনিময়ের বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলো তার সতেরোর নয় পঞ্চাশের বউ৷ বিয়ের তেত্রিশ বছর পরেও মনিময়ের মনে হল নয়ন যেন তার সেই সদ্যবিবাহিত বউ৷ ওই জন্যই সারাটা জীবন মনিময়কে লোকে বউ হ্যাংলা বলে গেল৷