গোপন সম্পর্কের টান
অয়ন ঘরে ঢুকতেই দীপার ফোনে ফিস ফিস করে বলা কথাগুলো বন্ধ হয়ে গেলো৷
দিন তিনেক ধরে অয়ন খেয়াল করে যাচ্ছে দীপা যেন কেমন অন্যমনস্ক৷ আর ওর আড়ালে ফোন করে কারোর সাথে কথা বলে চলেছে৷
ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র একবছর, এই সময় দুজনে দুজনের কাছে খোলা জানালার মতোই পরিষ্কার থাকার কথা, অথচ দীপার এই লুকোচুরি যেন অসহ্য লাগছে অয়নের৷ ও চিরকালই একটু সাদামাটা স্বভাবের ছেলে৷ পরিষ্কার কথা বলতে পছন্দ করে৷
বিয়ের পরই চাকরি সূত্রে দেশের বাড়ি দুর্গাপুর ছেড়ে ওরা কলকাতায় পাড়ি দিয়েছে৷ অয়ন বিয়ের আগে থেকেই কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলো৷ সংসার বলতে শুধু ওরা দুজন৷
দীপা এমনিতে খুবই ভালো মেয়ে৷ ঘরোয়া, অয়নের খেয়ালও রাখে খুব৷
মনটা খারাপ করে সোফায় বসে পড়লো অয়ন৷ টিভির রিমোর্টএ চাপ দিল৷
সামনে নিউজ চ্যানেল চললেও ওর ভাবনারা পাড়ি দিয়েছে অজানার প্রান্তে৷
তবে কি দীপার কোনো প্রেমিক আছে? অয়নের অনুপস্থিতিতে দীপা কি তার সাথেই কথা বলে?
দীপা বললো, ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাবে? বানাবো?
অন্যদিন অফিস থেকে ফিরলেই দীপা নিত্যনতুন টিফিন করে দেয়৷ উপাদেয় খাবারগুলো খেতে খেতে অয়নের মনে হয়, এই তো মধ্যবিত্তের জীবন, আর কি বা চাওয়ার থাকতে পারে! আজ মনটা বড্ড খারাপ লাগছে৷ শেষ পর্যন্ত দীপার গোপন প্রেমিক??
অয়ন একটু গম্ভীর স্বরে অভিমানী গলায় বলল, আমার কথা না ভাবলেও চলবে তোমার!
দীপারও কি মন খারাপ? অন্যদিন হলে অয়নের গলার ওই উষ্ণতাটুকু ওকে ছুঁয়ে যেত৷ আজ অন্যমনস্ক ভাবে বললো, তাহলে একেবারে ডিনার করে নিও৷
ঘরে চলে গেছে দীপা৷ ড্রয়িংয়ে বসেই দেখতে পাচ্ছে অয়ন, দীপা এই ভর সন্ধ্যাবেলায় বই না পড়ে, গান না শুনে, সিরিয়াল না দেখে পাশ ফিরে শুয়ে আছে৷
নিশ্চয় প্রেমিকের সাথে মন কষাকষি চলছে৷ তাই আজ আর সংসারের প্রতি মন নেই৷ যদিও অয়ন কখনো প্রেমে পড়েনি৷ বিয়ের পরে দীপাকেই প্রথম ভালোবেসেছিলো মন প্রাণ দিয়ে৷ আসলে দীপার মতো মেয়েকে বোধহয় ভালো না বেসে পারা যায় না৷
অয়ন যতদূর জানে… প্রেমে পড়লে মানুষের সাজগোজ বেড়ে যায়, বাইরে বেরোনোর জন্য মন কাঁদে৷ এক্ষেত্রে তো উল্টো৷
দীপা তো মনে হচ্ছে গত তিনদিন চুলে চিরুনিটুকুও দেয়নি! কি হলো হঠাৎ?
অয়ন আস্তে করে গিয়ে দীপার পাশে বসলো৷ দীপার চোখের কোল বেয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে৷
দীপা কাঁদছে?
সব অভিমান ভুলে ওকে জড়িয়ে ধরতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো দীপা৷
আমাকে বলো দীপা… কি হয়েছে? দাদুর কিছু হয়েছে?
দীপার মামার বাড়ির দাদু থাকে রাঁচিতে৷ মামার বাড়ি বলা ভুল৷ ওর মামা নেই, দীপার মা একমাত্র সন্তান৷ রাঁচির বাড়িটাকে ওর দাদুর বাড়ি বলা যায়৷ যদিও এক্স জাজ নীলকান্ত ঘোষাল তার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি নাতনি দীপার নামেই লিখে দিয়েছেন৷ দীপার দিদা যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন দীপার বয়েস বছর দশেক৷
ছোট্ট থেকে দীপা ছিলো ওর দাদুর প্রাণ৷ দিদা মারা যাবার পর কলকাতায় বাবা মাকে ছেড়ে দীপা চলে গেলো ওর দাদুর কাছে৷ মা বাবার কোনো বারণই শোনেনি দীপা৷ দাদুকে ও একা থাকতে দেবে না৷ দশ বছর বয়সের একটা মেয়ের কি মারাত্মক জেদ সেটা সেদিনই বুঝেছিল দীপার বাবা মা৷
এদিকে নীলকান্ত ঘোষাল তো নাতনিকে কাছে পেয়ে জীবন ফিরে পেয়েছিলেন৷ তখনও তিনি রাঁচির কোর্টের জাজ৷
বাড়িতে ঠাকুর চাকর থাকলেও আরেকটি বছর আঠেরোর সদ্য বিধবা, অসহায় মেয়েকে রাখলেন নাতনির সর্বক্ষণের দেখা শোনার জন্য৷
দীপার বাবা মা তখন নিজেদের মেয়ের আশা ত্যাগ করেই দ্বিতীয় ইস্যু নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলেন৷ দীপার আরেকটি বোন হয়৷ নীপা আর দীপার মধ্যে বয়েসের ফারাক প্রায় এগারো বারো৷
রাঁচির নাম করা স্কুলে নাতনিকে ভর্তি করে দেন নীলকান্ত ঘোষাল৷
দাদু আর নাতনির সংসার… অগাধ সম্পত্তি…
অভাব কিছুই নেই৷ শ্যামলী মাসিও চবিবশ ঘন্টা দীপার খেয়াল রেখে যাচ্ছিলো৷
নীলকান্ত বাবুর বয়েস এখন প্রায় আশি৷ ওই একটা মানুষকেই দীপা রাতে ঘুমাতে যাবার আগেও ওষুধের ইন্সট্রাকশন দিয়ে তবে ঘুমোয়৷
অয়ন বড্ড সাধারণ৷ ওর আবার এত সম্পত্তির গন্ধ মোটে পছন্দ নয়৷ দীপার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অঢেল টাকা থাকলেও ও নিজের মাইনের টাকাতেই সংসার চালাতে পছন্দ করে৷
কি হলো বলো? দাদুর শরীর খারাপ?
দীপা বললো, আমি কয়েকদিনের জন্য রাঁচি যেতে চাই অয়ন৷
দাদুর শরীর খারাপ নয়, আমারই মন খারাপ করছে৷
কেন যে অয়নের মনে হচ্ছে দীপা কিছু একটা লোকাচ্ছে ওর কাছ থেকে৷ বিশেষ করে এবারে রাঁচি যাওয়ার জন্য অয়নকে জোরও করলো না ও৷
অয়ন ঢোক গিলে বললো, দীপা তোমার যদি কোনো ভালোবাসার মানুষ থাকে তুমি আমাকে বলতে পারো…
আমিই না হয় তোমাকে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবো৷
দীপা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল, ভালোবাসার মানুষ?
মানে প্রেমিক?
অয়ন বুকের ভিতরের চিনচিনে ব্যথাটাকে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে৷
দীপা কোনো কথা না বলে রান্না ঘরে চলে গেলো৷ মিনিট দশেক পরে বললো, এসো ডিনার রেডি৷
মাত্র একবছরের বিবাহিত স্ত্রী-র একজন মনের মানুষ আছে এটা জানার পরও ওই খাবার গলা দিয়ে নামবে এতটা স্থূলবুদ্ধির, অনুভূতিহীন মানুষও অয়ন নয়৷ তবুও বুঝতে না দিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো অয়ন৷ সেটা দেখেই হয়তো দীপা করুণাবশত বললো, খেয়ে নাও, আমার কোনো প্রেমিক নেই৷ কোনোদিন ছিলো না৷ আমার তোমার সাথে গত একবছরের সমস্ত ব্যবহার দেখে সেটুকু বোঝা তোমার উচিত ছিলো অয়ন৷
দীপার কোনো প্রেমিক নেই জানার পরও বিরক্তিকর সন্দেহটা কিছুতেই মন থেকে সরছে না৷ শুধু মনে হচ্ছে তাহলে দীপা কাকে ফোনে বললো, যত টাকা লাগে খরচ কর, ওর কিছু যেন না হয়!
ফোনের ওইটুকু কথাই অয়ন শুনতে পেয়েছে৷
ঘরে ঢুকে দীপা ব্যাগ গোছাতে লাগলো৷
শোনো, আমি মা-কে ফোন করে দিয়েছি… মা এসে দিন দুই এই ফ্ল্যাটে এসে থাকবে৷ নীপা বাবার দিকটা খেয়াল রাখবে৷ মা এসে তোমার রান্নাবান্না করে দেবে৷
অয়ন বলে উঠলো, না দীপা… অকারণে মা-কে কষ্ট দিও না৷ আমি দুদিন অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেব৷ আর ফেরার সময় রুটি তরকারি নিয়ে ফিরবো৷ তুমি আসার আগেও তো এমনি চলেছে৷
অয়নের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বললো, মা কিন্তু রাজি হয়েছিলো আসতে৷
বেশ, তাহলে বারণ করে দিচ্ছি৷
কিছু ভালো লাগছে না অয়নের৷ কেন দীপা হঠাৎ কাল রাঁচি যাচ্ছে?
কেন ওকে সব পরিষ্কার করে বলতে চাইছে না?
সারারাত এপাশ ওপাশ করতে করতেই কাটিয়ে দিল অয়ন৷ ভোরে উঠেই বেরিয়ে গেলো দীপা৷ একলা ফ্ল্যাটটা যেন একরাশ একাকিত্বের হাঁ-মুখ নিয়ে গিলে খেতে আসছে অয়নকে৷ বিয়ের পরের দিন থেকে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওদের সব ছোটো ছোটো ভালোলাগার মুহূর্তগুলো৷ বিয়ের পর রাবাংলায় হানিমুনে গিয়েছিলো ওরা৷
দুজনের খুনসুটির কিছু মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করে সাজানো আছে ড্রয়িং-এর দেওয়ালে৷
সবই তো ঠিক ছিল… তাহলে?
দরকারি দুটো ফোন সেরে নিলো অয়ন৷ ছোট্ট ব্যাগে গুছিয়ে নিলো নিজের একান্ত প্রয়োজনীয় টুকিটাকি৷
পড়ন্ত রোদে দীপার মুখটা বেশ ক্লান্ত লাগছে৷ কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত বোঝাই যাচ্ছে৷
ওদের বাড়ির শ্যামলী মাসিও কেঁদে কেঁদে কি সব বলে চলেছে৷ এতটা দূর থেকে গাড়ির মধ্যে বসে ওরা কি কথা বলছে সেটা শোনা সম্ভব নয় অয়নের পক্ষে৷ দীপার গাড়িকে ধাওয়া করে রাঁচি পৌঁছাতে পারলেও, দীপার রাঁচি আসার উদ্দেশ্য এখনো অয়নের কাছে বেশ তিমিরেই৷
ওর দাদুর তিনমহলা বাড়িতে অন্যবার এসে রাজকীয় জামাই আদর পেলেও এবার অয়নকে থাকতে হবে কোনো সাধারণ হোটেলে৷
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন নীলকান্ত ঘোষাল৷
তাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে দীপা বললো, আমি নার্সিংহোম থেকে আগে ঘুরে আসছি৷
নার্সিং হোমে কেন যাবে দীপা? কে অসুস্থ?
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে বসেছে অয়নের৷ ব্যাগ থেকে কেকের প্যাকেট বের করে প্রায় খালি পেটে কেকে কামড় মারলো অয়ন৷ ক্ষিদের অনুভূতিটাই যেন নষ্ট হতে বসেছে ওর৷
দীপা আর শ্যামলী মাসি গাড়িতে উঠে বসেছে৷
অয়নের গাড়িটাও ওদের অনুসরন করে চলেছে৷
শিকদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা রক্ত স্রোত খুব দ্রুত বয়ে চলেছে অয়নের৷
টিউলিপ নার্সিং হোমের সামনে এসে নামলো দীপারা৷ দূরত্ব বজায় রেখেই অয়নও ঢুকলো নার্সিং হোমে৷
রিশেপশনে খবর নিয়েই অয়ন এগুলো ২০২ কেবিনের দিকে৷
নীলচে বিছানায় একটি বছর সাতের ছেলে শুয়ে আছে৷ মাথায় ব্যান্ডেজ করা, হাতেও ব্যান্ডেজ৷
অদ্ভুত ব্যাপার তো…
দীপা পা টিপে টিপে ঢুকলো কেবিনে৷ বাচচাটার মাথায় হাত বুলিয়েই বেরিয়ে এলো৷ ডাক্তারের সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে বাইরে বেরোতেই সামনে এসে দাঁড়ালো অয়ন৷ না, কোনো গোয়েন্দা চরিত্রে অভিনয় করছে না অয়ন৷ তাই আর এই লুকোচুরি সহ্য হচ্ছিলো না ওর৷
ওকে দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠেছে দীপা৷ শ্যামলী মাসি ফট করে বললো, দীপন আমার বোনের ছেলে৷ গাড়ির সাথে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তাই দিদিমণি এসেছিলো দেখতে…
দীপা ধীর গলায় বললো, বাড়ি চলো৷ নীলকান্ত ঘোষালের বাড়ি যখন ঢুকছে তখন অয়ন খেয়াল করলো দীপার মুখে একফোঁটাও রক্ত নেই৷ মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে৷
দাদু অয়নের পিঠে হাত রেখে বললো, আমি বলেছিলাম দীপার বাবা মাকে… তোমাকে সবটা বলতে৷
এত বছর জাজ ছিলাম৷ কম অপরাধী, নিরপরাধী মানুষ তো দেখলাম না এ জীবনে! আমি বলেছিলাম, অয়ন সব সত্যিটা জানলেও দীপার কোনো অমর্যাদা হবে না৷
হঠাৎ কেমন একটা শীত শীত করছে অয়নের৷ কি এমন আছে দীপার অতীত জীবনে?
দীপা সোফার এক কোণে মুখটা ঢেকে অসহায়ের মতোই বসে আছে৷
দাদুই বলতে শুরু করলেন, দীপা তখন ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী৷ আমি তখন রিটায়ার করেছি৷ জীবনে কত অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি একটা কলমের খোঁচায়৷ সেসব কি মনে রেখেছিলাম!
তেমনি একজনকে রেপড কেস এবং খুনের জন্য যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিলাম জাজ থাকাকালীন৷ তার ছেলেটা তখন ক্লাস সিক্সে পড়তো৷
যদিও অপরাধীর ফ্যামেলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানার কোনো আগ্রহই আমার ছিলো না৷
সেই খুনির ছেলে রঞ্জনই যে বড়ো হয়ে আমার দিদিভাইয়ের সর্বনাশ করবে কে ভেবেছিলো?
বাবার যাবজ্জীবনের সাজার প্রতিশোধ সে তুলেছিলো দিদিভাই-এর ওপর৷ বৃষ্টির সন্ধ্যায় দিদিভাই বাড়ি ফিরছিলো টিউশন থেকে৷
খুব কাছেই টিউশন পড়তো দীপা৷
হঠাৎই গোটা চারেক ছেলে মিলে ওকে মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় একটা নিরিবিলি এলাকায়৷ বৃষ্টির জন্য পথঘাট ছিলো নিরিবিলি৷
রঞ্জন সেদিনই দীপাকে রেপড করে…
কথাটা শেষ হবার আগেই ..দীপা ছুটে চলে গেলো অন্য ঘরে৷ অতীত হলেও জীবনের সব থেকে কষ্টকর দিনটাকে আর মনে করতে চায় নি ও৷
কয়েকমাস ঘোরের মধ্যেই ছিলো দীপা৷ ওর বাবা এসে নিয়ে গিয়েছিলো কলকাতায়৷ মেয়ে তবুও স্বাভাবিক হচ্ছিল না৷ তারপরই ধরা পড়ে ও প্রেগন্যান্ট৷
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ওই অবাঞ্ছিত সন্তানকে নষ্ট করে দেওয়া হবে৷ তুমি তো জানো অয়ন… দীপা ছোটো থেকেই কি মারাত্মক জেদি মেয়ে৷ হঠাৎই ও বলে উঠেছিলো, না… আমি বাচচাটাকে মেরে ফেলবো না৷
কারো কথা শোনেনি ও৷ প্রায় প্রায় একবছর স্কুলেও যায়নি ও৷ রাঁচির বাড়ির এই ঘরে একা চুপচাপ থেকেছে ও৷ দিনগুনেছে ওই ভ্রূণের বড় হওয়ার৷ অবশেষে জন্মেছে ওই সন্তান৷ সকলের অলক্ষ্যে আমিই সব ব্যবস্থা করেছি৷ শ্যামলী সকলকে বলেছে, এটা ওর বোনের ছেলে৷ ওর বোন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে তাই… সেই থেকেই শ্যামলী ওকে মানুষ করছে৷
পড়াশোনা শেষ করেছে দীপা৷ বিয়ে ও করতে চায়নি কোনোদিনই৷ কিন্তু শুধু আমাদের অনুরোধে রাজি হয়েছিলো তোমাকে বিয়ে করতে৷ তোমাকে সবটা বলতে চেয়েছিলাম আমি আর দীপা, কিন্তু দীপার মা বলেছিলো, বাবা এ কথা পাঁচকান হলে নীপারও বিয়ে দিতে পারবো না৷
চোখের সামনে একটা সিনেমা দেখলো অয়ন৷ মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ওর৷
আস্তে আস্তে দীপার ঘরে ঢুকলো অয়ন৷ কাঠের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে দীপা৷
অয়নকে বললো, তুমি নিশ্চয় কাল ফিরে যাবে৷
অয়ন বললো, হ্যাঁ কাল তুমি আর আমি একসাথেই ফিরবো৷
দীপা কেঁদে ফেলেছে৷ তুমি এত কিছু শোনার পরেও আমাকে নিয়ে ফিরতে চাও অয়ন?
অয়ন বললো, ভালোবাসি যে তোমাকে৷ অ্যাকসিডেন্ট তো হঠাৎই আসে৷ তাকে জীবনের চিরস্থায়ী সঙ্গী করে নিয়ে এগুলে কি চলে?
দীপা তোমার ছেলে দীপনকে আমরা নিয়ে যেতে পারি আমাদের সাথে৷ ও না হয় আমাদের পরিচয়েই বাঁচবে দীপা৷
দীপা ঘাড় নেড়ে বললো, না অয়ন৷ আমি একটা অবোধ প্রাণকে হত্যা করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু ওকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না৷
আমার বাবা মা, তোমার পরিবার, নীপার বিয়ে … সবই যে যুক্ত আমার সাথে৷
রাঁচির বেস্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছে ও৷ শ্যামলী মাসি ওকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে৷ শ্যামলী মাসিকে ও মা বলে ডাকে৷ শ্যামলী মাসি সকলকে বলেছে, ওর বোন-ভগ্নিপতি মারা গেছে অ্যাকসিডেন্ট-এ… বাচচাটি বেঁচে গেছে৷
দীপন অন্তত শ্যামলী মাসির আদরে বড়ো হোক৷ আমরা দূর থেকেই ওর খোঁজ নেব৷ আসলে দু-দিন আগে স্কুল থেকে বেরিয়ে ও ছুটে রাস্তা পার হতে গিয়েই এই বিপদ বাঁধিয়েছে৷ জানার পর থেকেই বড্ড ইচ্ছে করছিল একবার দীপনকে দেখতে… ও যেন কোনোদিন জানতে না পারে ও ধর্ষিতা মায়ের ধর্ষণের ফলে জন্মানো জারজ সন্তান৷ আমি চাই দীপন অনেক বড়ো হোক৷ বাবা মা মারা গেছে মারা যায়, কিন্তু জারজদের এই সমাজ আজ অবাঞ্ছিত ভাবে অয়ন৷
এ এক সম্পূর্ণ অন্য দীপাকে দেখছে অয়ন৷ এতদিনের পরিচিত স্ত্রী নয়, অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, নিজের সিদ্ধান্তে স্থির একটি নারী৷
অয়ন কানে কানে বললো, খুব ক্ষিদে পেয়েছে দীপা৷ তোমার কোনো প্রেমিক আছে জেনে থেকে তো সেই ভাবে কিছু খেতে পারিনি তাই…
দীপার দৃষ্টিতে অয়নের জন্য ভালোবাসা ছাড়াও শ্রদ্ধার চিহ্নটা স্পষ্ট দেখতে পেল অয়ন৷