ব্রেক আপ
চিঠিটা যখন পেলো অরুন্ধতী তখন বেশ কিছুটা দেরিই হয়ে গেছে৷ প্রজ্ঞা তখন কলেজে বেরিয়ে গেছে৷ কলেজেই গেছে তো? নাকি অন্য কোথাও৷ এমনিতেই হাই প্রেসার বলে একটুতেই ঘাম হয় অরুন্ধতীর৷ তারপর চিঠিটা পড়ার পরে তো হাত পা ঠান্ডা হয়ে ঘামতে শুরু করেছে৷ তার এমন শান্ত মেধাবী মেয়ের হঠাৎ কি এমন হলো যে এতবড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে? সুদীপকে কি একবার ফোন করবে? কিন্তু সে তো মেয়ে বলতে এমন অজ্ঞান যে এই খবর শুনে হয়তো পড়িমরি করে অফিসের সব কাজ ফেলে ছুটবে৷ না থাক, আপাতত সুদীপকে ফোনটা করতে গিয়েও করলো না অরুন্ধতী৷ বাথরুমে ঢুকে মাথার মাঝখানে একটু জলের ঝাপটা দিল৷ অরুন্ধতীর যখন খুব রাগ হত তখন ওর মাও ওর মাথার মাঝখানে থাবড়া করে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে দিত৷ এই বয়েসে এসে ওর রাগটা কমেছে বরং সকলের জন্য চিন্তাটা বেড়েছে৷ নিজে মা হয়ে বুঝেছে, মায়েদের রাগ দুঃখের প্রকাশটা একটু অন্যরকম৷ সংযত হয়ে চলতে হয় জীবনে৷ কারণ সংসারের ভারটা যে তখন মায়ের ওপরেই বর্তায়৷ এখন অবশ্য অরুন্ধতীর রাগ নয়, ক্ষোভ জমেছে মনে৷ তাই ঠান্ডা মাথায় কাজ করাটা বড্ড জরুরি৷ একবার… দু-বার… তিনবার ফোনটা করলো অরুন্ধতী৷ আর সময় নেই, ফোন রিসিভ করছে না প্রজ্ঞা৷ তাহলে কি চিঠির কথাই সত্যি! বার বার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে প্রজ্ঞার লেখা চিঠির অক্ষরগুলো৷ দুর্বল পায়ে, কাঁপা হাতে আলমারি খুলল অরুন্ধতী৷ হাতের সামনে যেটা পেল সেই চুড়িদারটাই গলিয়ে, বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে ছুটল ও৷ এই অফিস টাইমে ট্যাক্সি পেলে হয়…
ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে ভরা আছে চিঠিটা৷ যেটা প্রজ্ঞা লিখেছে ওর কোনো এক বয়ফ্রেন্ডকে৷ বয়ফ্রেন্ড না বলে লাভার বলাই শ্রেয়৷
বড়ো হয়ে গেলো প্রজ্ঞা৷ অরুন্ধতীর চোখের সামনে দিয়েই এতটা বড়ো হয়ে গেল! মা হয়ে একটু টেরও পেল না৷ অরুন্ধতীর তো আজও মনে হয় এই সেদিন! হেলথ কেয়ার নার্সিংহোমে শুয়ে আছে অরুন্ধতী৷ সুদীপ প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে, কি গো খুব কষ্ট হচ্ছে৷ সত্যি কষ্ট হচ্ছিল অরুন্ধতীর৷ একটু আগেই নার্সদিদি এসে বলেছিলেন, লেবার পেন ভোগ না করে কি কেউ মা হয়!
যন্ত্রনায় কুঁকড়ে উঠছিলো অরুন্ধতী৷ সুদীপ বলেছিলো, ডক্টরকে বলি, সিজার করে দিতে৷
গোঁ ধরে বসেছিল অরুন্ধতী, কিছুতেই না … তারপর সিজার করতে গিয়ে যদি আমার বেবির কোনো ক্ষতি হয়৷ কয়েকদিন আগেই শুনেছিলো, এক বান্ধবীর সিজার করতে গিয়ে নাকি সদ্যোজাতর মাথায় আঘাত লেগেছিলো৷ আজকের মতো তখন সিজারটা অতটাও উন্নত ছিলো না৷ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলো অব্যক্ত যন্ত্রণা৷ কষ্টে মুখ নীল হয়ে যাচ্ছিলো অরুন্ধতীর৷
রাত প্রায় নটা নাগাদ নার্সিংহোমের নিস্তব্ধতা ভেঙে চিৎকার করে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলো ছোট্ট মেয়েটা৷ মেয়েরই শখ ছিল সুদীপ আর অরুন্ধতীর৷ নাম আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো৷ সুদীপ ফিসফিস করে বলেছিলো, প্রজ্ঞা৷
ছোট্ট ছোট্ট হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো বুলিতে মা ডাকার দিনটা আজও মনে আছে অরুন্ধতীর৷ সুদীপ অভিমানী গলায় বলেছিল, হ্যাঁ গো বাবা কবে বলবে৷ সেই প্রজ্ঞা বড়ো হয়ে গেল৷ মাকে লুকাতে শিখে গেল এত কিছু৷ ঠিক কবে থেকে অরুন্ধতী প্রজ্ঞার এতটা পর হয়ে গেল সেটা ভেবেই ক্ষোভ জমেছে মনে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের কোনো অভিমানকেই স্থায়ী হতে দেবে না অরুন্ধতী৷ একমাত্র লক্ষ্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রজ্ঞার কাছে পৌঁছানো৷
প্রিয় নিশান,
ভেবে দেখলাম জানিস, অনেক ভাবলাম, তুই আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, আমি বড্ড একা৷ ভীষণ নিঃস্ব হয়ে গেলাম৷ গত একবছরে আমাদের কাটানো সময়টা ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ বিশেষ করে তোর সাথে অঙ্কিতাকে দেখে প্রথমে একটু চমকালেও বুঝতে পারলাম, তুই এখন আমাকে নয়, অঙ্কিতাকে ভালোবাসিস৷ অনেক ভেবেও খুঁজে বের করতে পারলাম না, আমার দোষটা ঠিক কি ছিল?
আমার বাবা চাকরি করে আর অঙ্কিতাদের বড়ো ব্যবসা, গাড়ি বাড়ি তাই? নাকি অঙ্কিতার শরীরী বিভঙ্গ তোকে বেশি আকর্ষণ করলো! যাইহোক, অবান্তর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আর বোধহয় কোনো মানেই হয় না৷ বরং কিছু প্রশ্ন সমাধানহীন ভাবেই চলুক আমার সাথে৷ জানিস নিশান, প্রথম যেদিন তুই আমাদের ফিজিক্সের ব্যাচে অংশুমান বাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রোপোজ করেছিলি, সেদিন, কেন জানি না….আমার সমস্ত সত্ত্বা বলে উঠেছিল, ভালোবাসি৷ আমি তোকে খুব ভালোবাসি৷
গত পরশু যখন তুই আবার আমাদের কলেজ ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে বললি, আমাদের মধ্যে নাকি হেল অ্যান্ড হেভেনের ডিফারেন্স,তখনও মনে হল, আমি তোকে সত্যি খুব ভালোবাসি৷ তবে বুঝতে পারলাম না, গত একবছরে এই আকাশ পাতাল পার্থক্যটা তুই কেন নোটিশ করিস নি!
তখনো বোধ হয় তুই অঙ্কিতাকে চিনতিস না, তাই না রে?
কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস কর, খুব কষ্ট হচ্ছে৷ বাপি, মা আমাদের ছোট্ট বাড়ি, ছোট্ট উঠোন, তার পাশে আমার বসানো কাঁঠালি চাঁপার গাছ, কলেজ ক্যাম্পাস, বন্ধুদের সকলকে ছেড়ে চলে যেতে সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে রে৷ কিন্তু গত দু-দিন অনেক ভেবে দেখলাম,তোকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা সত্যি কঠিন৷ তোরা ভালো থাকিস৷ তাই …..চললাম…
প্রজ্ঞা
ট্যাক্সিতে বসে চিঠিটা আরেকবার পড়লো অরুন্ধতী৷ প্রজ্ঞার পড়ার টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা ছিল চিঠিটা৷ সম্ভবত কলেজের ব্যাগে ভরতে ভুলে গেছে লাস্ট মোমেন্টে৷ হয়তো কলেজে গিয়ে কোনো বন্ধুকে দিয়ে পাঠাতো ওই নিশানের কাছে৷ তারপরেই হয়তো… আর ভাবতে পারছে না অরুন্ধতী৷ মেয়েটা কি আদৌ আছে, নাকি ভুলের ফাঁদে অলরেডি…
প্রজ্ঞাকে ছাড়া কি আদৌ বাঁচা সম্ভব অরুন্ধতী বা সুদীপের৷ ওদের দুজনের জীবনই তো ওই কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে৷ ওদের স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব সময়ের সমস্ত কথাবার্তায় একটাই নাম বারবার ঘুরে ফিরে আসে,সেটা হলো …প্রজ্ঞা৷
দাদা দাঁড়ান দাঁড়ান৷ এই তো কলেজ এসে গেছে৷
ব্যাগ থেকে ট্যাক্সিভাড়াটা মিটিয়েই ছুটলো অরুন্ধতী৷
ঠিক গত বছর এই কলেজের সামনে এসেই অরুন্ধতীর গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল৷ এতবড়ো নামী কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়েই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ও বলেছিলো, প্রজ্ঞা বিশ্বাস কর, স্বপ্ন ছিলো রে…সেই নিজের স্কুল লাইফ থেকে স্বপ্ন ছিলো, এই কলেজে ভরতি হবার৷ হঠাৎ করেই বিশেষ কারণে উচচমাধ্যমিকের রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাওয়ায় ভরতি হতে পারিনি৷ তারপর থেকে যতবার এর পাশ দিয়ে গেছি, ততবারই ভিতরের বিশাল সবুজ ক্যাম্পাসটা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে৷ আজ এতগুলো বছর পরে এই ক্যাম্পাসের ডাকে সাড়া দিতে ঢুকছি এই কলেজে৷ নিজের ক্ষমতায় নাইবা হলো, তোর রেজাল্টের জোরেই না হয় পা দিচ্ছি স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে৷ প্রজ্ঞা মায়ের হাতটা চেপে ধরেছিলো৷ মুখে বলেছিলো, মা আমি পারবো তো? অরুন্ধতীর বুকের ভিতরে তখন ভয় আর আনন্দের মিশেল চলছিলো৷ তবুও মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলেছিলো, তুইই পারবি৷
ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলবি, মা আমি পেরেছি৷ প্রজ্ঞার চোখে জল দেখেছিলো সেদিন অরুন্ধতী৷ মেয়েটা তো তার এমনই ছিল৷
সুদীপ কলেজের ভিতর থেকে হাত নেড়ে ডেকেছিলো৷ ভিতরে ঢুকতেই বলেছিলো, মা মেয়েতে গেটে দাঁড়িয়ে কি করছিলে?
সামলে নিয়েছিলো অরুন্ধতী, মায়ের দেখাদেখি প্রজ্ঞাও৷ সুদীপ প্রায়ই বলে, মা মেয়ে দুটোই সমান, ক্রাইঙ মেশিন৷ ভারত মহাসাগরের সব জল মা মেয়ের চোখে এসেই জড়ো হয়৷ সত্যিই তাই, প্রজ্ঞাটাও হয়েছে মায়ের মতোই৷ কিছু হলেই ঠোঁট দুটো কামড়ে দু-চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নামে৷
ক্লাস চলছে B K M-এর৷ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস৷ অন্যদিন হলে ওনার মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটা কথা নোটস বানানোর উপাদান হিসেবে ডায়রিতে নোট করতো প্রজ্ঞা৷ আজ পারছে না, কিছুতেই পারছে না৷ মনে পড়ে যাচ্ছে, নিশানের দেওয়া সব প্রতিশ্রুতির কথা৷ যদিও পড়াশোনায় সিনসিয়ার বা ক্লাস বাঙ্ক করতো না বলে নিশানের সাথে সময় খুব কমই কাটিয়েছে ও৷ তবুও ক্লাসের ফাঁকে হোয়াটস আপে ছোট্ট মেসেজ ঢুকতো, ক্যান্টিনে এসো প্লিজ৷ অনেকক্ষণ তোমাকে না দেখে আছি৷ নিশানের মেসেজ পেয়েই মুখে হালকা হাসির রেখা দেখা দিতো প্রজ্ঞার৷ পরের পিরিয়ডটা করেই ছুটতো ক্যান্টিনের দিকে৷ দূর থেকে দেখতে পেতো, নিশানের শার্টের স্ট্রাইপগুলো৷ ওর পোশাকগুলো ততদিনে প্রজ্ঞার রীতিমতো পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো৷ বুকের ভিতর আগাম কালবৈশাখীর বার্তা শুনতে পেতো প্রজ্ঞা৷ নিশানের যত কাছে এগিয়ে যেত ততই ভিতরের তোলপাড়টা বেশি করে অনুভব করত ও৷
ওকে সামনে পেয়েই নিশান একটা বোকা বোকা হেসে বলতো, কি করব… তোকে না দেখে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না যে! কখনো প্রজ্ঞাকে তুমি সম্বোধনে লিখতো নিশান, আর ডাকত তুই বলে৷ আবার মাঝে মাঝে খেয়ালি গলায় বলে উঠতো, প্রজ্ঞা এবার তোকে তুমি বলা প্র্যাকটিস করি৷ খুব কম সময় নিশানের সাথে কাটালেও সেসব মুহূর্তকে প্রজ্ঞা মারাত্মক হিসাবির মতোই অল্প অল্প করে খরচ করে৷ পাছে বেশি খরচ হয়ে যায়, আর ওদের একসাথে কাটানো মুহূর্তের স্মৃতিগুলো ফুরিয়ে যায়… যদিও দু-দিন আগেও ভাবেনি প্রজ্ঞা, নিশান কখনো ওকে বলতে পারে, প্রজ্ঞা তোর আর আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক৷ ভবিষ্যতে আমাদের বড্ড এডজাস্ট করতে হবে রে৷ সেটা নাকি দুজনের পক্ষেই খুব ক্ষতিকারক হবে৷ আকাশ থেকে পড়েছিলো প্রজ্ঞা! ভবিষ্যৎ? বর্তমানের একটা মুহূর্তও তো ও কাটাতে পারবে না নিশানকে ছাড়া! ফার্স্ট টার্মে ফার্স্ট হওয়ার কথা তো দূরে থাক, মনের যা অবস্থা তাতে ফার্স্ট ক্লাস পেলে হয়! আর তো মাত্র কয়েকদিন পরেই পরীক্ষা৷ নিষ্ঠুর কথাটা অমানবিক ভাবে জানিয়ে দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলো নিশান৷ পিছন ফিরে একবার দেখেওনি প্রজ্ঞার জীবন্ত লাশটা কি ভাবে বাসে ট্রামে করে বাড়ি ফিরবে! প্রায় অসার পা দুটো নিয়ে চলতে পারেনি প্রজ্ঞা৷ চুপ করে একটা বেঞ্চে বসেছিলো দীর্ঘক্ষণ৷ তারপরেই বাপির ফোনটা এসেছিলো, কি রে আজও কি চকলেট আইসক্রিমের বার নেবো, নাকি স্ট্রবেরি খাবি? চমকে উঠেছিলো ও৷ কিছুক্ষণের জন্য মৃত মস্তিস্ক জেগে উঠে বলেছিলো, তোর একটা বাড়িও আছে, সেখানে দুজন মানুষ আছে তোর পথ চেয়ে৷ ধীরে ধীরে নিজের নিষ্প্রাণ শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি অবধি নিয়ে গিয়েছিলো প্রজ্ঞা৷
রাতে খাবার টেবিলে বাপির পাত থেকে পটল ভাজা চুরি করেনি বলেই একটু চোখে লেগেছিলো মায়ের৷ মা বলেছিলো, প্রজ্ঞা তোর কি শরীর খারাপ?
আসলে প্রজ্ঞাকে যদি দশটা পটলও ভেজে মা সাজিয়ে দেয়, তবুও বাপির পাতের থেকে অন্তত একপিস ওকে হাত সাফাই করে খেতেই হবে৷ নাহলে যে পেটটা ঠিক ভরে না৷
ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে, টিভিতে খেলার হাইলাইটস বা নিউজ দেখাটা বাপির দীর্ঘদিনের অভ্যাস৷ সেই সুযোগে প্রজ্ঞা বাপির পাত থেকে এটা সেটা চুরি করে নেয়৷ মা দেখতে পেয়ে প্রজ্ঞাকে বকে, আর বাপিকে আবার সেকেন্ড টাইম দেয়৷ এই খুনসুটিটাই ওদের খাবার টেবিলে৷ প্রজ্ঞার দুস্টুমির জন্যই মা পটল ভাজা প্রজ্ঞার থালায় কম, আর বাপির থালায় বেশি দেয়৷ যাতে প্রজ্ঞা চুরি করার পরেও মানুষটা দুটো পায় আরকি! আজ নিজের গুলোই খেলো না দেখে প্রথম খটকাটা লেগেছিল অরুন্ধতীর৷ প্রজ্ঞা সামলে নিয়ে বলেছিলো, আজ খেতে ইচ্ছে করছে না মা৷ বাপি কপালে হাত দিয়ে বলেছিলো, কই জ্বর নেই তো! হয়তো তাপ লেগে গেছে, তাই ক্ষিদে নেই৷ কোনোমতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিলো প্রজ্ঞা৷ তারপরেই হোয়াটস আপটা খুলে বুকটা হু হু করে উঠেছিলো৷ যা ভেবেছে ঠিক তাই, নিশানের ছবি দেখা যাচ্ছে না৷ তার মানে হোয়াটস আপে ব্লক করে দিয়েছে ওকে৷ পাগল পাগল লাগছিলো প্রজ্ঞার৷ মেসেজের পর মেসেজ পাঠাচ্ছিল, একটাও সেন্ড হচ্ছিলো না৷ ডাবল টিক দেখার জন্য বারবার নিজের নেট কানেকশন চেক করছিলো ও৷ আর সহ্য না করতে পেরে অবশেষে কলটা করেই ফেলেছিলো প্রজ্ঞা৷ মাত্র একবার রিং বাজতেই বিজি টোন শো করছিলো৷ তার মানে ওর ফোন নম্বরটাও ব্ল্যাক লিস্টে ফেলে দিয়েছে নিশান৷ প্রজ্ঞার দু-চোখ বেয়ে নোনতা জলের ধারা৷ তবুও যেন কষ্টগুলো কিছুতেই জমাট বাঁধছিলো না৷ তরল অবস্থাতেই মাথা থেকে গলায়, গলা থেকে হূদয়ে এসে অবশ করে দিচ্ছিলো ওর ভাবনা শক্তিকে৷ পুরোনো মেসেজ চেক করে যাচ্ছিলো৷ দু-দিন আগেও হাজার হাজার প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসেছিলো ওর হোয়াটস আপ উইন্ডো৷ মনের মধ্যে যখন তীব্র আলোড়ন চলছিলো, ঠিক তখনই ফোনটা এসেছিলো অঙ্কিতার৷
দেখ প্রজ্ঞা, নিশান তোকে আর ভালোবাসে না৷ ও এখন আমার সাথে এনগেজড৷ সো প্লিজ, তুই আমাদের মধ্যে আর ঢুকিস না৷
একরাশ শূন্যতা এসে গিলে খাচ্ছিল প্রজ্ঞার অন্ধকার রাতের ঘুমবিহীন চোখদুটোকে৷ তবুও বাপি মা যাতে বুঝতে না পারে সেই জন্যই যতটা পেরেছে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে চায়ের টেবিলে৷ মায়ের চোখে বোধহয় একটু বেমানান ঠেকেছিলো প্রজ্ঞার চোখের রক্তাভা৷ তাই আনমনেই দু-বার বেশি তাকিয়েছিলো মা ওর দিকে৷ তারপর বলেছিলো, রাত জেগে এত পড়ার কি আছে, শরীর খারাপ করবে যে৷ রাত জেগে পড়াটা যদিও প্রজ্ঞার দীর্ঘদিনের অভ্যেস, তবুও গতকাল রাতটা যে পড়ার জন্য জাগেনি সেটা মনে হতেই একটা অব্যক্ত কষ্ট হচ্ছিল৷ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গেছে ওর৷ নিশানকে ছাড়া বেঁচে থাকার বিশেষ অর্থ খুঁজে পায়নি জীবনে৷ হেরে গেছে ও ভাগ্যের কাছে,অঙ্কিতা হারিয়ে দিয়েছে ওকে৷ বেশ কয়দিন ধরেই নিশানের ব্যবহারে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলো যেন৷ অঙ্কিতার সাথে দু-একবার ঘুরতেও দেখেছে৷ কিন্তু মনে কোনো সন্দেহ আসেনি, ভেবেছে ওদের দুজনের নিছকই বন্ধুত্ব৷ আসলে কোনো মানুষকে যদি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে ফেলে কেউ, তখনই বোধহয় একটা বোবা অন্ধত্ব ঘিরে ফেলে৷ তখন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই আর দৃষ্টিগোচর হয় না৷
তাই হয়তো নিশানের ওই ছাড়া ছাড়া ব্যবহার, বাঁধন আলগা করার ইঙ্গিত, অঙ্কিতার সাথে ঘনিষ্ট হবার সম্ভাবনা.. সবই দেখেও দেখেনি প্রজ্ঞা৷ আর যখন বুঝতে পারলো তখন আর নিজেকে সামলানোর ক্ষমতাটাই অবশিষ্ট নেই ওর৷
ক্লাস শেষ হলো, ওর সামনে বই এর অক্ষরগুলো তখনো ঝাপসা৷ হোয়াটস আপ ব্লক, তাই রুমিকে দিয়েই পাঠিয়ে দেবে ওর লেখা শেষ চিঠিটা৷ নিশান বুঝুক, প্রজ্ঞা ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসতো! নিজের জীবনটা পর্যন্ত শেষ করে দিতে পারে ও নিশানের জন্য৷
ব্যাগটা হাতরাচ্ছে প্রজ্ঞা৷ চিঠিটা পাচ্ছে না কিছুতেই৷ হ্যাঁ, কলেজ বেরোনোর আগে, টেবিল থেকে ও চিঠিটা ব্যাগেই ভরেছিলো৷ তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে কোনোমতে কান্না চেপে চুমু খেয়েছিলো৷ তাহলে চিঠিটা গেল কোথায়?
প্রজ্ঞা বিশ্বাস….একবার প্রিন্সিপালের রুমে আসবে৷
স্যার তোমাকে ডাকছেন৷ চমকে উঠেছে প্রজ্ঞা! কলেজের ফোর্থ ক্লাস স্টাফই হবে বোধহয়, ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞাকে ডাকলেন৷
ক্লাস শুদ্ধু সকলেই জিজ্ঞেস করছে, কি রে প্রজ্ঞা কি হয়েছে? হঠাৎ প্রিন্সিপ্যাল!
প্রজ্ঞা নিজেও বিশবাঁও জলে৷ হঠাৎ কেনই বা ডাকছেন স্যার! আর কতক্ষণই বা থাকবে এই পৃথিবীতে! কয়েকঘন্টা মাত্র, দেখা যাক কি বলে!
প্রিন্সিপ্যালের রুমের কাঁচের দরজাটা ঠেলতেই বিস্মিত হয়ে গেছে প্রজ্ঞা৷ ও কি ঠিক দেখছে, নাকি ওর ক্ষতিগ্রস্ত মাথার ভুলভাল ভাবনা৷
প্রিন্সিপ্যালের সামনের চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাকে পিছন থেকে দেখেও অচেনা লাগেনি প্রজ্ঞার৷ কিন্তু যে প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েই চলেছে সেটা হলো, মা হঠাৎ কলেজে কেন?
নিজের ফোনটা চেক করলো৷ হ্যাঁ বার চারেক মিস কল৷ তবে কি কারোর কিছু হয়েছে?
বলুন স্যার, নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই ভীষণ অপরিচিত লাগছিলো প্রজ্ঞার৷ কেমন যেন হেরে যাওয়া একটা মানুষের গলা৷
স্যার গম্ভীর ভাবেই বললেন, তোমার মা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন৷ আরও চমকের বোধহয় বাকি ছিলো৷ সেই ভরতির দিনের পরে আর কখনো মা কলেজের দরজায় পা দেয়নি, আজ হঠাৎ কলেজ থেকে নিতে চলে এল! ঘাবড়ে যাওয়া মুখে মায়ের দিকে তাকাতেই অরুন্ধতী বলল, থ্যাংক ইউ স্যার৷
মেয়ের দিকে চোখ টিপে ইশারা করল, চল…
মাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্লাস থেকে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে চলে এলো প্রজ্ঞা৷ বেরিয়েই বললো, মা তুমি? এভাবে হঠাৎ করে?
অরুন্ধতী খুব মজার ছলে বললো, আরে এই রাস্তায় এসেছিলাম, তোর কলেজের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম ক্লাস বাঙ্ক করে মুভি দেখার মজা কেমন সেটা আমার স্টুডিয়াস মেয়েটাকে বোঝাই আজ!
প্রজ্ঞা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ একদিন টিউশন কামাই করলে যে মা ভালো করে কথা বলে না প্রজ্ঞার সাথে, বৃষ্টির দিনে কলেজ যাবে না বললে যে মা বলে…আমাদের স্বপ্নটা নিয়ে তুই ছিনিমিনি খেলছিস? সেই মা কিনা ক্লাস বাঙ্ক করে মুভি দেখতে চাইছে!
আনন্দে লাফিয়ে উঠে প্রজ্ঞা বললো, তোমার হলো কি?
অরুন্ধতী অভিমানী মুখে বললো, কেন রে তোর মা কি একবারে বুড়ি হয়ে গেছে, যে মুভি দেখতেও ইচ্ছে করবে না? মুভির আগে আমরা কোল্ড কফি খাবো, ব্রেকে কোল্ডড্রিঙ্ক, পপকর্ন…
প্রজ্ঞার যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ তার মা নিয়ম ভাঙতে চাইছে৷ মা যেন আজ ছেলেমানুষ-এর মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রজ্ঞাকে একবার জড়িয়ে ধরছে, একবার চুমু খাচ্ছে৷ বহুদিন পরে বোধহয় মা প্রজ্ঞাকে ছোট্ট মেয়ের মতো আদর করছে৷ মা নিজের গানের স্কুল আর বাপি অফিসের কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে প্রজ্ঞার বড্ড একা লাগে৷ মা কর্তব্য করতো ঠিকই কিন্তু মাকে যেন আর সেই ছোটোবেলার মতো কাছের মনে হত না৷
প্রজ্ঞার বুকের ভিতরের দীর্ঘশ্বাসটা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো৷ মা ততক্ষণে ফুচকা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে৷ প্রজ্ঞার মুখে একটা বড়ো ফুচকা ভরে দিয়ে বললো, মুখ ফাঁক না করে খেতে পারলেই আইসক্রিম ফ্রি৷ প্রজ্ঞাও মায়ের ছেলেমানুষিতে যোগ দিয়েছে ততক্ষণে৷ মুভি, খাওয়া দাওয়া, শপিং করে যখন বাড়ি ফিরলো তখন বাপি নিজেই এককাপ চা নিয়ে বসে টিভি চালিয়েছে৷ মেয়েকে দেখেই বললো, তোরা কি নিষ্ঠুর রে… আমাকে না নিয়ে, আগে থেকে কোনো প্ল্যান না করে, দুজনে ঘুরে এলি!
অরুন্ধতী আজ সম্পূর্ণ অন্য মুডে৷ হাসতে হাসতেই বললো, আজ মা-মেয়ের ট্রিপ ছিল, বাপির নো এন্ট্রি৷
ডিনার টেবিলে বসেও টুকিটাকি কথাবার্তার পরে প্রজ্ঞা ঢুকে পড়লো নিজের ঘরে৷ ফেসবুকে ওকে ব্লক করেনি নিশান৷ কিন্তু মেসেঞ্জার ব্লক৷ তার মানে ভিতরের বিষয়টা ঠিক এমন…অঙ্কিতা আর নিশানের সব রকম আনন্দ সুখের ছবি দেখুক প্রজ্ঞা অথচ নিশানের সাথে কখনো যোগাযোগ না করতে পারুক৷
মায়ের নম্বরটা নিশ্চয়ই নিশান ব্লক করবে না, মায়ের ফোন থেকে কি একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করবে প্রজ্ঞা, ও কি সত্যিই প্রজ্ঞাকে ভুলে গেল৷
মা এখনো রান্নাঘরে কি সব গোছাচ্ছে৷ ডাইনিংয়ে মায়ের ফোনটা রয়েছে, চুপি চুপি গিয়ে ফোনটা হাতে নিলো ও৷
বুকের ভিতরটা একটা অজানা উত্তেজনায় তোলপাড় হচ্ছে, রিং বাজছে নিশানের৷ সেই পুরোনো গানটা…
আজ কাল তেরে মেরে পেয়ার কি চর্চে হার জাবান পর….
গানটা প্রজ্ঞাই সেট করে দিয়েছিলো৷ যেদিন বিশ্বজিৎ স্যার আচমকা প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা নিশান তোমার আর প্রজ্ঞার মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে?
নিশান এসে প্রজ্ঞাকে বলেছিলো, জানিস আমাদের বিশ্বজিৎ স্যারও জেনে গেছেন আমাদের রিলেশনশিপের কথা৷ সেই দিনই প্রজ্ঞা এই গানটা সেট করে দিয়ে বলেছিলো, সকলের মুখে মুখে র্চ্চা হোক আমাদের প্রেম কাহিনি৷
বুকের বাম পাশের লাব ডুব আওয়াজের গতি আরো দ্রুত হয়েছে প্রজ্ঞার৷ হঠাৎ ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েই মা বললো, হ্যালো নিশান….আমি প্রজ্ঞার মা বলছি৷
আকাশ থেকে পড়লেও হয়তো এতটা চমকে উঠত না প্রজ্ঞা৷ নিশানের নাম মা কি করে জানলো!
মা বলেই চলেছে, জানো নিশান, আমি ভেবেই ছিলাম আমার তোমাকে একটা থ্যাংকস জানানো একান্ত প্রয়োজন৷ এই যে তুমি দায়িত্ব নিয়ে প্রেমের নাটক করে প্রজ্ঞার দুর্দান্ত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টটাকে নিজের মিডিওকার রেজাল্টের দিকে টেনে নামাচ্ছিলে এটার থেকে তুমি ওকে রেহাই দিয়েছ দেখে আমি বিশেষ খুশি হয়েছি বাবা৷ খুব ভালো থেকো৷ সত্যি বলতে কি অঙ্কিতাই তোমার সঠিক পার্টনার৷ না হলে ভবিষ্যতে প্রজ্ঞা যখন ইউনিভার্সিটি টপার হবে তখন আবার তোমার মেল ইগোতে ধাক্কা লাগবে৷ আমার বোকা মেয়েটা হয়তো, তোমার খারাপ লাগবে বলেই, নিজের পড়াশোনা বিসর্জন দিয়ে তোমার মতোই ওই নামী কলেজে ভরতি হয়েছির দায় সামলানোর মতোই রেজাল্ট করে বসতো৷ আসলে কি জানো, আমাদের বিশাল স্বপ্ন ওকে নিয়ে৷ তোমাকে যে কি বলে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না৷ প্রজ্ঞার বার্থ ডে-তে ইনভাইট করলে এসো কিন্তু বাবা, তুমি আমাদের যা উপকার করেছ….
এই যা! প্রজ্ঞা তোর বন্ধু তো ফোনটা কেটে দিলো রে৷ ধুত্তোর! নিশানের ফেবারিট ডিসগুলো জানা হলো না৷
প্রজ্ঞা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সম্পূর্ণ অপরিচিত অরুন্ধতীর দিকে৷ নিজের গর্ভধারিনীকেই যেন চিনতে পারছে না ও৷ ধীর স্থির গম্ভীর মায়ের মুখে একটা ফচকে হাসির রেখা৷ নিশানকে যে মিছড়ির ছুরিটা দিয়ে এফালা ওফালা করলো মা, সেটা কোথায় ছিলো এতদিন৷ প্রজ্ঞাকে ওই ভাবে অপমান করে চলে যাবার পরেও তো প্রজ্ঞা পারেনি প্রতিঅপমান ফিরিয়ে দিতে৷
অরুন্ধতী পরিষ্কার চোখে তাকালো প্রজ্ঞার দিকে৷ ধীর স্বরে বললো, বস তোর সাথে কথা আছে৷
নিশানের কথা কীভাবে মা জানলো সেই নিয়ে ভিতরে ভিতরে বেশ টেনশন চলছে ওর৷ মা আমি বুঝতে পারিনি নিশান এমন ছেলে…
অরুন্ধতীর হাতে একটা চিঠি৷
পড়ে দেখ….
তার মানে কি প্রজ্ঞার চিঠিটা মা-এর কাছে! কিন্তু রং দেখে তো মনে হচ্ছে কাগজটা বহু পুরোনো৷
অরুন্ধতী,
দেখো, আমার মায়ের একটাই শর্ত আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেবার, সেটা হল তোমাকে গানটা ছেড়ে দিতে হবে৷ ভদ্র বাড়ির বউ জলসায় গান গেয়ে বেড়াবে এটা আমার মা মেনে নেবে না৷ আমাদের ভালোবাসার খাতিরে গানটা তোমাকে ছাড়তেই হবে৷ তোমার সিদ্ধান্ত জানিও৷
জয়দীপ
প্রজ্ঞার চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে৷ জয়দীপ! নামটা আরেকবার উচচারণ করলো প্রজ্ঞা৷ কারণ এই গোটাগোটা সুন্দর হাতের লেখাটা ওর বিশেষ পরিচিত৷ অনেকবার ভাইটু মানে ছোটোমাসির ছেলের খাতায় দেখেছে৷ ভাইটুকে জিজ্ঞেসাও করেছিলো প্রজ্ঞা৷ ভাইটু বলেছিলো, এটা তো পাপার হাতের লেখা৷ তার মানে কি জয়দীপ রায়, মানে ছোটো মেসোমশাই!!
ধীরে ধীরে ঘাড়টা আলতো করে নেড়ে অরুন্ধতী বললো, হ্যাঁ তোমার ছোটো মেসোমশাই৷ আমাদের তিনবছরের প্রেম ছিল৷ হঠাৎই আমি যখন মিউজিক নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম তখন তার মনে হয়েছিল, আমার গান গাওয়াটা অন্যায়৷ আসলে বোধহয় তখন তোর ছোটো মাসিকে বিশেষ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল জয়দীপের৷
মেয়ে আজ অরুন্ধতীর সমবয়সি বান্ধবী যেন৷ তাই নিজেকে উজাড় করে বলেই চলেছে অরুন্ধতী… জানিস প্রজ্ঞা, আমি পরিষ্কার জানিয়েছিলাম, গান আমার জীবন, তুমি আমার একটা অঙ্গ, সেই অংশে পচন ধরলে সেটা কেটে ফেলে দেওয়া উচিত৷ কিন্তু জীবনকে ত্যাগ করলে বাঁচবো কি করে!
তারপরেই দেখেছিলাম, তোর ছোটোমাসির ডায়রির পাতায় জয়দীপের দেওয়া চিঠি রাখা আছে৷ বিশ্বাস কর প্রজ্ঞা, সেই মুহূর্তে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়েছিলো৷ মনে হয়েছিলো, আর বেঁচে থেকে লাভ নেই৷ শেষ করে দিই নিজেকে৷ পরমুহূর্তেই ভেবেছি, জয়দীপ কোনোদিনই আমার যোগ্য ছিলো না৷ তাই হয়তো চলে গেছে সঠিক ঠিকানায়৷
শুধু প্রেম, বিয়ে নিয়েই তো জীবন নয়৷ নিজেকে প্রমাণ করাটাও একটা জয়, চূড়ান্ত পাওয়া৷ নিজেকে উঁচু আসনে বসানোর লড়াইটার মধ্যেও একটা ভালোবাসা আছে৷
প্রজ্ঞা বললো, মা তারপরেও তুমি মেসোমশাই এর সাথে, মাসির সাথে এত ভালো ব্যবহার করো কি করে?
অরুন্ধতী হেসে বললো, ধুর বোকা মেয়ে, জয়দীপ চলে গিয়েছিল বলেই না আমি মিউজিকে মাস্টার্স করতে পারলাম, আজ নিজের এতবড়ো একটা স্কুল করতে পেরেছি৷ সবই তো জয়দীপের বেইমানির জন্যই সফল হয়েছে৷ তাই ওরা এলে আমি রেঁধে বেড়ে খাওয়াই৷
দেখবি, তুইও একদিন নিশানকে করুণার চোখেই দেখবি৷ যখন তুই অনেক উঁচুতে উঠে যাবি, তখন নীচের দিকে তাকিয়ে দেখবি তোর এই উঁচুতে ওঠার পিছনে এই নিশানের অবদানও কিছু কম নেই৷
অদ্ভুত মায়ের যুক্তি৷ তবে প্রজ্ঞা একটা জিনিস অনুভব করলো, এই ক-দিন ধরে বুকের মধ্যে হু হু করা কষ্টের উপলব্ধিটা যেন অনেকটা হালকা হয়ে গেল৷
অরুন্ধতী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আত্মহত্যা তো হেরে যাওয়া মানুষরা করে প্রজ্ঞা৷ জেতার লড়াই তো করে ভবিষ্যতের বিজয়ীরা৷
আরেকটা কথা সব সময় মনে রাখবি, কার জন্য তুই নিজের মূল্যবান জীবনটা শেষ করছিস! সে কি আদৌ তোর যোগ্য ছিলো? ভালোবাসা শুধু একটা শব্দ নয় প্রজ্ঞা, ভালোবাসা মানে অনেকগুলো অনুভূতির সমন্বয়৷ একজন কেউ জীবন থেকে চলে গেলেই ভালোবাসা শেষ হতে পারে না৷
প্রজ্ঞা কান্না ভেজা গলায় বলল, লাভ ইউ মা৷
লাভ ইউ ভেরি মাচ…
সুদীপ দরজার বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখার পরে মনে মনে বললো, জয়দীপ ঠকে গেছে৷ ভাগ্যিস জয়দীপ চলে গিয়েছিল, তাই আমার আকাশে অরুন্ধতীর মতো উজ্জ্বল নক্ষত্রের উপস্থিতি ঘটেছিলো৷
হয়তো সুদীপের পায়ের আওয়াজ পেয়েই অরুন্ধতী বললো, ওই দেখ প্রজ্ঞা, বাইরে আরেকটা হিংসুটে লোক দাঁড়িয়ে আছে৷ শুধু আমাকে ভালোবাসিস বলছিস বলে, হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে৷ তুই বরং তোর বাপিকে ডেকে একটু আদর করে দে৷
একমুখ হাসি নিয়ে সুদীপ বললো, আসলে তো আমার মেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসে, সেটা তো আমি জানিই, তাই আর হিংসা করলাম না৷
মা ঠিক বলে, ভালোবাসা শুধু একটা শব্দ নয়, অনেকগুলো অনুভূতির সমন্বয়৷
বাপির কোলে মাথাটা গুঁজে দিলো প্রজ্ঞা৷ ভালোবাসা নামক অনুভূতি এসে স্পর্শ করে যাচ্ছে প্রজ্ঞার মাথার চুলগুলো৷ বাপি হাত বুলিয়ে দিচ্ছে প্রজ্ঞার মাথায়৷ চোখের সামনে নতুন স্বপ্ন ভাসছে প্রজ্ঞার… নিজেকে নিজের কাছে প্রমান করার৷