শরীরের পবিত্রতা
এই দিনরাত এমন ন্যাকামি করো না তো৷ সবই বিয়ের আগে না ,শুনতে শুনতে আমি জাস্ট বিরক্ত হয়ে গেছি ইন্দ্রানী৷ অ্যাট লিস্ট কিস তো করতে দেবে তোমার ওই জুসি ঠোঁট দুটোতে!
আমূল কেঁপে উঠলো ইন্দ্রানী৷
আধুনিক কালের মেয়ে হলেও মনে মনে ও ভীষণ সনাতন পন্থী৷ বিয়ের আগে শরীর কেউ ছোঁবে না গোছের মানসিকতার বশবর্তী৷ সৌনক প্রায়ই ভিড় রাস্তায় ইন্দ্রানীর হাত ধরতে গিয়েও টিপ্পনি কেটেছে৷ ওহ..তোমার হাত ধরলে তো আবার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে! আজব প্রেমিকা জুটিয়েছি আমি বটে৷ বন্ধুরা শুনলে আমাকে নিয়ে খিল্লি করবে বুঝলে!
আমি আজ কোনো কথা শুনবো না ইন্দ্রানী৷ তোমাকে আজ ইউনিভার্সিটির পরে আমার বাড়িতে যেতেই হবে৷ আগে প্রমিস করো৷ একরাশ অভিমান গলায় নিয়ে আব্দার জুড়লো সৌনক৷
ইন্দ্রানী ভালোবাসার পুরুষের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়েও শেষ চেষ্টা করলো, কিন্তু সৌনক ..রাত হয়ে যাবে যে৷ ইউনিভার্সিটির পরে গানের ক্লাস সেরে আবার তোমাদের বাড়ি!
ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ইন্দ্রানী… আমার বার্থ ডে আর তুমি প্রেজেন্ট নেই৷ অফিস কলিগরা কি বলবে বলতো!
তাছাড়া আজ মা-বাবার সাথেও তোমার পরিচয়টা করিয়ে দেবো সোনা৷ প্লিজ একদিন তোমার বাড়িতে ম্যানেজ করো৷
ইন্দ্রানী চিন্তান্বিত মুখে বললো, বেশ দেখছি৷ মুশকিলটা হলো শীতের দিনে সাড়ে পাঁচটা মানেই সন্ধ্যে৷ গানের ক্লাস মিস করলেই গানের নীলিমা দি ডিরেক্ট মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, কি রে ইন্দ্রানী আজ এলো না কেন! তখন! তখন কি উত্তর দেবে ইন্দ্রানী৷ সৌনক-এর কথা এখনো বাড়িতে বলেনি৷ যদিও সৌনকের সাথে ওর বছর দুয়েকের সম্পর্ক৷ তবুও বাবার সামনে দাঁড়ালেই কেমন একটা অজানা ভয় চেপে ধরে ওকে৷
আসলে ছোটো থেকেই যৌথ পরিবারের রক্ষণশীল পরিবেশে বড়ো হয়েছে ইন্দ্রানী৷ বাবা, জ্যেঠুর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেমের কথা বলবে, এমন সাহসই ওর নেই৷ ওদের বাড়ির কেউ প্রেম করে বিয়ে করেনি৷ অভিভাবকরা দেখা শোনা করে বিয়ে দিয়েছে সকলের৷ এমনকী ইন্দ্রানীর ছোটো কাকার বিয়ের সময় ছোটো কাকিমাকে কাকুর খুব একটা পছন্দ ছিলো না৷ তবুও জেঠুর মুখের ওপর কোনো কথা না বলতে পেরেই চুপ করে ছাদনা তলায় বসেছিলো কাকু৷ ইন্দ্রানীর ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে, কি করে বলবে ও সৌনকের কথা!
বিশেষ করে ফেসবুকে পরিচয়, তারপর প্রেম শুনলেই তো বাবা আর জ্যেঠু ওর ইউনিভার্সিটি যাওয়াই বন্ধ করে দেবে৷ মাঝে মাঝে খুব দমবন্ধ লাগে ওর৷ বান্ধবীরা জিন্স টপ পরে, ও সেই একই ফুলহাতা চুড়িদার৷ ক্লাসের বন্ধুরা মজা করে বলে, ওরে আমাদের কাননদেবী এসে গেছে৷ আওয়াজ খেতে খেতে এখন ও অভ্যস্ত৷
মুশকিলটা হলো, সৌনকের সাথে পরিচয় বা বন্ধুত্ব হলেও প্রেম করতে তেমন আগ্রহী ছিল না ইন্দ্রানী৷ নিজের বাড়ির পরিবেশ তো ও জানতো৷ কিন্তু নিজের সব কথা সৌনকের সাথে শেয়ার করতে করতে কবে যে ওদের সম্পর্কটা প্রেমে পরিণত হয়ে গেছে ইন্দ্রানী নিজেও জানে না৷ মাঝে মাঝে ওরও মনে হয়, সৌনক বোধহয় এবার বিরক্ত হচ্ছে৷ কোথাও মিট করার কথা হলেই ইন্দ্রানী বলে, দেরি করে ফিরলে বাড়িতে বকবে৷ আজ ওর জন্মদিনে কি করে বলবে ইন্দ্রানী, যে পার্টিতে যাবে না!
কাঁচুমাচু গলায় ইন্দ্রানী বললো, বেশ আমি ট্রাই করছি সৌনক, কিন্তু আধঘন্টার বেশি থাকব না কিন্তু৷
যা ইচ্ছে করো, তাও এসো প্লিজ৷
আর হ্যাঁ, আজ একটা শাড়ি পরে এসো কিন্তু৷
কথাটা শোনার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে ভয় করতে শুরু করেছে ইন্দ্রানীর৷ বন্ধুদের বাড়ির নিমন্ত্রণ থাকলে তারা মা বাবার সাথে ফোনে কথা বলে, দল বেঁধে যায়৷ বাড়িতে প্রবলেম হয় না৷ এক্ষেত্রে বলবেই বা কি!
বেশ আমতা আমতা করে ইন্দ্রানী চায়ের টেবিলে গিয়ে বাবার সামনে গিয়ে বলল, বাবা… আজ গানের স্কুল থেকে একটা বান্ধবীর বাড়ি যাবো৷ কিছু নোটসের দরকার৷ বাবা মুখটা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরা ঔরঙ্গজেবের মতো করে বললো, বাড়িটা কোথায়? কী নাম বান্ধবীর?
সুলগ্না …এত মিথ্যে একসাথে বলতে গিয়ে যেন ধরা না পড়ে যায়৷ বাড়ি ওই গাঙ্গুলিবাগানের দিকে৷ ওদের বাড়ি থেকে ওটা একটু দূরে আছে তাও৷ বাবা যাও যেও না বলে বললো, বেশি দেরি করো না যেন৷ এই শীতেও ইন্দ্রানীর হাতের তালু ঘেমে গিয়েছিলো৷
যাইহোক, এত কাণ্ডের পর আবার মায়ের কাছে বলবে কি করে, যে শাড়ি পরে যাবে!
অবশ্য মা একচান্সেই বললো, হ্যাঁ শাড়ি পরা অভ্যেস কর৷ আর তো মাত্র তিনটি মাস, তারপরেই তোর ফাইনাল পরীক্ষা হবে আর পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে৷
চুপচাপ সৌনক-এর পছন্দের হালকা গোলাপি শাড়িটা পরে নিলো ইন্দ্রানী৷
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই লজ্জা পেলো৷ মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি৷ বিয়ের পরে যে বাড়িতে সংসার করবে সেই বাড়িতে আজ ওর প্রথম পদার্পণ৷ কেমন হবে সৌনকের বাবা মা! ওকে মেনে নেবে তো? বিয়ে মানে তো শুধু স্বামী নয়, একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত গোটা জগৎ৷
তাই সৌনকের পরিবারের সকলের সাথেই পরিচয় হওয়াটা জরুরি ৷ সৌনক বলেছে এরপরেই ও ওর বাবা মাকে নিয়ে আসবে৷ ফুলের বুকে আর ওর পছন্দের পারফিউম কিনেই ট্যাক্সি ধরলো ইন্দ্রানী৷ আজ ইউনিভার্সিটিতেও সবাই আড়চোখে তাকাচ্ছিলো ওর দিকে৷ অদ্ভুত একটা ভালোলাগা মিশেছিলো ইন্দ্রানীর মনে৷ আজ গানের ক্লাসে গিয়েও মন বসাতে পারছিলো না ও৷ সৌনক একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিল ইন্দ্রানীর জন্য৷
একমুখ হেসে সৌনক বললো, যাক রাজকুমারীকে অবশেষে সম্রাট ছেড়েছেন৷ সৌনকের বাবা মাও খুব খুশি হবু বৌমাকে পেয়ে৷ সৌনকদের অফিসের কলিগদের সাথে পরিচয়ের আগেই ঘনঘন ঘড়ি দেখছিল ইন্দ্রানী৷ সেটা খেয়াল করেই সৌনক বললো, মাত্র সাতটা বাজে ইন্দ্রানী৷ অন্তত আটটা পর্যন্ত থাকো প্লিজ৷
এর মধ্যেই বাবা দু-বার ফোন করেছিলো৷ অসহায় মুখে ও বললো, সৌনক আজ আর হবে না, আমাকে এখুনি যেতে হবে যে৷
সৌনকের বেডরুমে এই প্রথম ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো ও৷ ইন্দ্রানী কেঁপে উঠছিলো প্রথম পুরুষের ছোঁয়ায়৷
ভালোলাগায় ভাসছিলো ও, তবুও সৌনক মুখটা গম্ভীর করে রেখেছিলো৷ এখুনি ঢুকবে ওর অফিস কলিগরা৷ সেই মুহূর্তেই বেরিয়ে গেলো ইন্দ্রানী৷ সৌনকই ট্যাক্সি ডেকে তুলে দিলো ওকে৷
মিনিট দশেক চলার পরেই ট্যাক্সিটা গন্ডগোল করতে শুরু করলো৷ বিরক্ত হয়ে নেমে পড়লো ইন্দ্রানী৷ কয়েক পা হেঁটে ধরে নেবে অন্য ট্যাক্সি৷ বাবার ফোনে ভয়ে ভয়েই বললো, আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে বাড়ি৷
নির্জন রাস্তা ধরে কয়েকপা হাঁটার পরেই আর কিছু মনে ছিল না ওর৷
মুখটা বাঁধা, শরীরে অকথ্য যন্ত্রনা নিয়ে সেন্স ফিরেছিল ওর৷ বেশ কয়েকজন ঘিরে ধরে ছিল ওকে৷ ওর গোলাপি শাড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ৷ ভিড়ের মধ্যেই দেখতে পেয়েছিল বাবার মুখটা৷
বেশ কয়েকদিন বাড়িতে ঘর বন্দি হয়ে বসেছিলো ইন্দ্রানী৷ বাবা নিজের চুলের মুঠি ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ইন্দ্রানীর ফোন থেকেই বোধহয় নাম্বারটা পেয়েছিল ওখানের লোকগুলো৷ আমাকে ফোন করে বললো, একটি গোলাপি শাড়ির মেয়ের …
আর বলতে পারেনি বাবা৷
কোনো এক খবরের কাগজের পাতায় ইন্দ্রানীর ছবি৷ ওই ভিড়ের মধ্যে কে যে ওর ছবি তুলেছিল বুঝতেও পারেনি অজ্ঞান ইন্দ্রানী৷ ওকে বাঁচানোর লোকের অভাব ছিল ঠিকই কিন্তু ওর ছবি তোলার লোকের অভাব ছিল না৷ এমনকী মিডিয়ার ভিড় লেগে গিয়েছিলো ওদের বাড়ির সামনে৷ ইন্দ্রানী কারোর সামনে বেরোয়নি৷
পাগলের মতো সৌনককে ডায়াল করে গেছে ও৷
কিছুতেই ফোন ধরেনি সৌনক৷ শুধু একটা মেসেজ… ক্ষমা করো ইন্দ্রানী৷ আমার বাবা মা সকলে দেখেছে তোমার ছবি৷ কেউ আর মেনে নেবে না এই সম্পর্কটা৷
কিন্তু সৌনক আমার দোষ কোথায়?
না আর উত্তর আসেনি ও তরফ থেকে৷ ধর্ষিতা মেয়েরা করুণার পাত্র হতে পারে কিন্তু কারোর প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়৷ সত্যিটা খুব সহজেই বুঝে গিয়েছিল ইন্দ্রানী৷ নিজের শরীরের ক্ষতগুলোতে ওষুধ না লাগিয়ে কষ্টটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলো ইন্দ্রানী৷ আর মনে মনে সঞ্চয় করছিলো একরাশ প্রশ্নের সম্মুখীন হবার মতো জোর৷
পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে ও ,অন্ধকারে কাউকে চিনতে পারেনি ও৷ সত্যিই চিনতে পারেনি ওর জীবনটা তছনছ করে দেওয়া মানুষ দুটো অথবা চারটেকে৷
শুধু শহরের রাস্তায় কোনো প্রতিবাদী মোমবাতি মিছিল বেরোয়নি ওকে কেন্দ্র করে, কারণ ধর্ষকরা ওকে জীবিত ছেড়েছিলো, মেরে ফেলেনি৷
ইউনিভার্সিটির লাস্ট পরীক্ষার জন্য পাগলের মতো খেটে চলছিলো ও৷ কিন্তু পড়তে বসলেই শুধু সেই কালো মুখগুলো দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো৷ নোনতা জলে ভিজে যাচ্ছিল বইয়ের পাতা৷
বাবার সাথে ইন্দ্রানী বসে আছে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট-এর চেম্বারে৷ বাবার শরীরটাও যেন ভেঙে গেছে এই সাত দিনে৷ সেই রাগী রাগী ভাবটা চলে গিয়ে কেমন বিধস্ত চেহারা নিয়েছে৷ বাবা নিজের মুখটা ঢেকে কেঁদে বলেছিলো,মেয়ের বাবার বড়ো জ্বালা৷
ওটা শুনেই বোধহয় সব থেকে বেশি কষ্ট হয়েছিলো ইন্দ্রানীর৷ ওর রাশভারী বাবাকে ভেঙে পড়তে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছিলো ওর৷
ডক্টর দিগন্ত রায় বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ইন্দ্রানীর দিকে৷ অপলক…
তারপর বললেন, কি মনে হয় তোমার, রেপ মানে কি?
মনের বিরুদ্ধে জোর করে যে কোনো কাজ! তাই তো?
ঘাড় নাড়লো ইন্দ্রানী৷
দিগন্ত বললো, একটু ভালো করে ভেবে বলো তো… জীবনে কত বার তুমি নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করেছ?
ইন্দ্রানী বললো, হ্যাঁ করেছি৷ আমার ইচ্ছে ছিল ইকোনমিক্স অনার্স নিয়ে পড়বো৷ কিন্তু বাবার ইচ্ছেয় ইংলিশ পড়ছি৷
ডাক্তারের মুখে মিষ্টি হাসি৷ এটা রেপ নয়?
কোনোদিন হয়তো ভেটকি মাছ খেতে না, কারোর অনুরোধে জোর করে ভেটকি ফ্রাই খেলে, সেটাও কিন্তু তোমার মনের বিরুদ্ধেই৷
ওই দিন রাস্তায় তুমি মনের বিরুদ্ধেই কিছু মানুষের নোংরামির স্বীকার হয়েছ, কষ্ট হয়েছে তোমার৷ কিন্তু বাকিগুলোর মতো এটা নিয়ে এত কুন্ঠিত কেন তুমি?
বছর সাইত্রিশের ডাক্তারের ঝুলপির কাছে দু একটা সিলভার লাইন৷ চোখে পাওয়ারের চশমা৷ শুধু হাসিটা অমলিন৷ পৃথিবীতে কিছুই যেন খারাপ নেই৷
শরীরের বাকি রোগগুলো যদি সারতে পারে তাহলে এটাও সারবে৷
কাঁদছিলো ইন্দ্রানী৷ ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেছিল৷
দিগন্ত বললো, ইন্দ্রানী… পবিত্রতা শরীরের মতো ক্ষণে ক্ষণে রোগে পড়া জায়গায় থাকে না, থাকে মনে৷
ইন্দ্রানী জানে না কেন! তবুও একমাত্র দিগন্তর সাথে কথা বললেই ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণ শক্তি খুঁজে পাচ্ছে৷
প্রায় রেগুলারই ফোনে কথা বলে ওরা৷ ডাক্তার নয়, দিগন্ত যেন খুব কাছের বন্ধু৷
পরীক্ষাটা ভালোই দিয়েছে ইন্দ্রানী৷ তবে এই ভালো পরীক্ষা দেবার জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিগন্তর৷ ও যদি এভাবে শক্তিসঞ্চার না করতো, তাহলে হয়তো কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না ইন্দ্রানী৷
আজ রাতে দিগন্তের কোনো একটা মিটিং আছে৷ তাই আজ ইন্দ্রানী কল করেনি ওকে৷ এই প্রথম ইন্দ্রানী বুঝতে পারলো, দিগন্তকে ইন্দ্রানী অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে৷ খুব কাছের বন্ধুর বেশিই কিছু৷
দিগন্তর বয়েস প্রায় সাইত্রিশ৷ ইন্দ্রানীর থেকে তেরো বছরের বড়ো৷ হয়তো স্ত্রী সন্তানও আছে ওর৷ ইন্দ্রানীর অসহায় অবস্থায় ওকে সাহায্য করেছে বলেই, এই ধরণের ভাবনাটা বড্ড ভুল হচ্ছে ৷ কিন্তু কেন কিছুতেই ইন্দ্রানী ওকে ভুলতে পারছে না৷ ওর বলা সব কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওর৷
ইন্দ্রানী, জীবনে কখনো ছোট্ট ডোবাকে ভালোবেসো না৷ ডোবাকে করুনা করো কিন্তু ভালোবেসো সমুদ্রকে৷ সমুদ্র তোমাকে তার বিশালতা দিয়ে প্রসারতা চেনাবে৷ আর ডোবা তোমাকে চেনাবে সংকীর্ণতা৷
কেন কে জানে আজকাল ইন্দ্রানীর সৌনককে ডোবার মতোই মনে হয়৷ একটা অন্তত সাধারণ সংকীর্ণ মনের ছেলে৷ যে ভালোবাসার অর্থই বোঝে না৷
রাত তখন প্রায় বারোটা৷
আর পারছে না ইন্দ্রানী৷ উত্তরটা আজ ওকে পেতেই হবে৷ এতক্ষণে হয়তো দিগন্ত ফিরেছে মিটিং থেকে৷ হয়তো স্ত্রীর সাথে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে৷ ফোন করাটা কি ঠিক৷ তাছাড়া ব্যক্তিগত কথা তো শুধু ইন্দ্রানীই বলতো, দিগন্ত তো নিজের ব্যাপারে কখনো কিছু বলেনি৷
প্রতিটা রিঙের আওয়াজে বুকের ভিতরে তোলপাড় হচ্ছে ইন্দ্রানীর৷ অবশেষে ঘুম গলায় ফোনটা ধরলো দিগন্ত৷
কি হয়েছে ইন্দ্রানী?
কোনো প্রবলেম?
এ প্রান্তে শুধুই ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ৷ দিগন্ত ধীর গলায় বললো, কেঁদো না ইন্দ্রানী৷ আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো৷
আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো৷ হয়তো আমিও…কিন্তু আমাদের বয়েসের পার্থক্যটা কখনো ভেবেছো? তোমার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ৷
ইন্দ্রানী কান্না ভেজা গলায় বললো, মনের বয়েসটা বুঝি গুরুত্বপূর্ণ নয়? শরীরের বয়েসটাই বুঝি সব?
দিগন্ত খোলা গলায় হেসে বললো, আমি অনাথ৷ খুব ছোটোবেলায় বাবা মা মারা গিয়েছিলেন, পিসির কাছেই মানুষ হয়েছি৷
কথা শেষ করতে না দিয়েই ইন্দ্রানী বললো, যদি তেরো বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তোমাকে ছেড়ে আমি তেরো সেকেন্ডও না থাকতে পারি, সেটাকে কি বলে ডক্টর দিগন্ত রায়?
বেশ কয়েকমাস হয়ে গেছে ইন্দ্রানী আর দিগন্তর সুখী দাম্পত্যের৷ ইন্দ্রানী এখন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা৷
ইন্দ্রানীর গোছানো সংসারের আদরে এলোমেলো দিগন্ত এখন পরিপূর্ণ৷
সেদিনও ছিলো এমনি শীতের সন্ধ্যে৷ দিগন্ত চেম্বারে৷ চেম্বার সেরে দুজনের যাওয়ার কথা ছিলো শপিং-এ৷ গাড়ি নিয়েই ওর চেম্বারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল ইন্দ্রানী৷
হঠাৎই চিৎকারটা কানে এলো ওর৷ গাড়ি দাঁড় করাতেই চোখে পড়লো একটা গোলাপি শাড়ির অল্পবয়সী মেয়ে..পাগলের মত দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটছে৷ শাড়ির কয়েক জায়গায় ছেড়া৷ ইন্দ্রানীর পাঞ্জাবি ড্রাইভার সামনে দাঁড়াতেই পিছনের ছেলে দুটো ছুট লাগলো৷ মেয়েটি ক্লান্ত…
ইন্দ্রানী গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল দিগন্তর চেম্বারে৷
প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই দিগন্ত বললো, মানসিক ভাবে বিধস্ত৷ বাড়িতে খবর দাও ইন্দ্রানী৷
দিগন্তই ফোন করেছে ওর বাড়িতে৷
মেয়েটি কান্না ভেজা গলায় বললো, আজ যদি তুমি না থাকতে দিদি তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যেত৷
হন্তদন্ত হয়ে যে মানুষটি ছুটে চেম্বারে ঢুকছে, তাকে বছর খানেক আগে জন্মদিনের সন্ধ্যেতে শেষ দেখেছিলো ইন্দ্রানী৷
মল্লিকা বলে মেয়েটি তাহলে সৌনকের স্ত্রী৷
সৌনক ঢুকেই জড়িয়ে ধরেছে নিজের স্ত্রীকে৷
ভাগ্যিস…ভাগ্যিস মল্লিকাকে বাঁচাতে পেরেছিলো ইন্দ্রানী৷ নাহলে কি করতো সৌনক! অপবিত্র ধর্ষিতা স্ত্রীকে কি ডিভোর্স করতো!
মল্লিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, এই দিদিই আমাকে আজ..
সৌনকের চোখে বিস্ময়৷ কোনটা দেখে বিস্ময়? ইন্দ্রানীর সিঁথির লাল রংটা দেখে কি?
ধন্যবাদ… সৌনকের কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ইন্দ্রানী বললো, আমার হাজবেন্ড ডক্টর দিগন্ত রায়কে থ্যাংকস জানান৷ ওই আপনার ওয়াইফের ট্রিটমেন্ট করছে এই মুহূর্তে৷
সৌনকের বিস্মিত ভাবটা কাটার আগেই ইন্দ্রানী বললো, চলো দিগন্ত…আমাদের শপিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে৷
ইন্দ্রানীর মনে পড়ে গেলো, দিগন্তর বলা সেই কথাটা… ইন্দ্রানী ডোবাকে নয় সমুদ্রকে ভালোবাসো৷ যে তোমাকে বিশালতা শেখাবে…
ডোবাকে করুণা কোরো, সমুদ্রকে আলিঙ্গন৷