ক্যানভাসে তোমার ছবি
খোলা বারান্দায় বসে বসে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি দেখছিলো অনিমেষ৷ বৃষ্টি ওর বড়ো প্রিয়৷ যেন মনে হয় একটানা বৃষ্টির পরে গোমড়া মুখের প্রেমিকার গোলাপি ঠোঁটে আলতো হাসির রেখা দেখা যাবার একটা ছোট্ট ইঙ্গিত থেকে যায়৷ অনিমেষের মন জুড়ে কল্পিত একটা মুখ আছে৷ অথচ ওর ক্যানভাস আর পেন্সিল কিছুতেই পারে না সেই মুখটাকে সঠিক রেখায় ফুটিয়ে তুলতে৷
তাই ভাবলেশহীন মুখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের কষ্টগুলোকে ধুয়ে নিতে চাইছিলো অনিমেষ৷
লোকে শুনলে হাসবে… বলবে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অনিমেষ চৌধুরী যার ছবির এগজিবিশনের সমস্ত টিকিট বুক হয়ে যায় এক সপ্তাহেই, সে কিনা এমন দিনে ছবি না এঁকে নিশ্চুপ হয়ে দুঃখ স্নাত হয়ে চলেছে৷ যার এক একটা ছবি ঠিক কত দামে বিক্রি হবে সেটা অনিমেষ নিজেও কল্পনা করতে পারে না৷ ওর আঁকা শেষ ওই সাদা ঘোড়ার ছবিটা তো নিলামে উঠেছিলো শেষে৷
সাধারণ মানুষের চোখে অনিমেষ দুঃখ বিলাসী৷ অর্থ আর প্রাচুর্য্যের পাহাড়ে বসে কেউ যখন বলে,আমার ব্যর্থ জীবনের ভার বহন করতে করতে আমি ক্লান্ত ,তখন আড়ালে লোকে তো হাসবেই৷
বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে৷ সামনের বাড়িগুলো এবার পরিষ্কার৷ অনিমেষের ফ্ল্যাটের সামনে এখনো বেশ কিছু দোতলা তিনতলা বাড়ি নিজেদের গরিমা বহন করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ফ্ল্যাট বাড়ির আকর্ষণে নিজেদেরকে এখনো বিকিয়ে দেয়নি৷ এই স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখার ব্যাপারটাকে অনিমেষ শ্রদ্ধা করে৷ সে মানুষ হোক অথবা অন্যান্য জিনিস৷ অঝোরে বৃষ্টিটা কমতেই দেখলো পলাশ রঙের চুড়িদারের ওড়নাটা কেও ভিজে অবস্থাতেই ওড়ানোর চেষ্টা করছে৷ অনিমেষ-এর চোখের সামনে আগুনে পলাশে মাখামাখি৷ সামনের বাড়ির ছাদে একটি মেয়ে৷ সে বোধহয় এতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজছিলো৷ এখন ওড়না নিঙড়ে কোমর ছাপানো চুল মোছার চেষ্টা করছে৷ অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়েছে, মেয়েটির মুখটা ওকে দেখতেই হবে৷ আজকাল বৃষ্টিকে ভালোবাসা মানুষ নেই বললেই চলে৷ যে কয়েকজন আছে তারাও অনিমেষের মতো আরামকেদারায় বসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে৷ কিন্তু আলিঙ্গন নয়৷ যে মেয়ে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করছে৷ প্রাণ ভরে নিচ্ছে বৃষ্টির নোনতা জলের স্বাদ৷ এ তো ব্যতিক্রমী৷ একে অন্তত একবার দেখা দরকার৷ ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি অনিমেষের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো৷ অদ্ভুত এক সারল্যে ভরা বৃষ্টিস্নাত মুখ৷
মেয়েটি নেমে গেছে নীচে৷ ছাদ ফাঁকা ৷ অনিমেষের মনে তোলপাড়৷ এই মুখটাই কি ও খুঁজে চলছিলো অনবরত?
ওর ক্যানভাসে অর্ধেক আঁকা ছবিটার পরিণতি কি ঘটাতে পারে এই মেয়েটি?
দেরি না করে স্টুডিওতে ঢুকলো অনিমেষ৷
তুলির এলোমেলো টানে বারবার আবছা হয়ে যাচ্ছে ক্ষণিকের জন্য দেখা মেয়েটার মুখটা৷ বরং প্রকট হচ্ছে সাগরিকা, পারমিতাদের মুখগুলো৷ যারা ভালোবাসা মানে শুধু অর্থ বোঝে!
সাগরিকার সঙ্গে অনিমেষের পরিচয় হয়েছিলো, ক্লাস ইলেভেনের টেস্ট পরীক্ষার পর৷ পড়াশোনায় ভালো, ছবি আঁকার বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছে,অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে অনিমেষের প্রেমে পড়তে সময় নেয়নি সাগরিকা৷ বেশ কিছুদিন ওর একলা বন্ধুহীন জীবনের সঙ্গী হয়েছিলো সাগরিকা৷ অনিমেষের আঁকাকে ভালোবেসেই নাকি সাগরিকা মানুষটার প্রেমে পড়েছে৷ মুখচোরা অনিমেষের স্কুল-কলেজে বন্ধু তেমন ছিল না বললেই চলে৷ তাই বন্ধুহীন জীবনে সাগরিকাকে পেয়ে আঁকড়ে ধরেছিল অনিমেষ৷ উচচমাধ্যমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে,জয়েন্টে চান্স পেয়েও যখন অনিমেষ বাড়ির অমতে আর্ট কলেজের দরজা পেরোলো তখনই সাগরিকা দূরে সরতে শুরু করলো৷
অনিমেষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো সাগরিকাকে নিজের কাছে ধরে রাখার৷ বড়ো আর্টিস্টদের উপার্জনের লিস্ট পর্যন্ত কালেক্ট করে দেখিয়েছিলো অনিমেষ৷ কিন্তু সাগরিকার একটাই কথা, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেই হবে… সাইডে আঁকা থাক৷
অনিমেষ বোঝাতে চেয়েছিলো, রংই ওর জীবনের একমাত্র সত্য৷ ও এতদিন পর্যন্ত জোর করে পড়েছিলো অন্য বিষয়গুলো৷ ওর চোখের সামনে রামধনু খেলা করে অবিরাম৷ পারবে না ও ওই রামধনুর হাতছানিকে অবহেলা করতে৷ সাগরিকা বলেছিলো, কেরিয়ার নেই এমন একটা ছেলের সাথে নিজের জীবন আমি জড়াতে পারবো না৷ চলে গিয়েছিলো সাগরিকা৷ মাঝপথে অনিমেষের হাত ছেড়ে চলে গিয়েছিলো ও৷ অনিমেষের ক্যানভাসে তখন শুধুই নোনতা জলের রেখা৷ অনিমেষ বুঝেছিলো, ভালোবাসায় আঘাত পাওয়া কাকে বলে৷ দীর্ঘদিন ওর তুলিরা অবাধ্য হয়েছিলো, কিছুই আঁকতে পারেনি ও৷ পার্ট ওয়ান পরীক্ষা যখন দরজায় কড়া নেড়েছিলো, তখন অনিমেষ মনের জোরে ভাঙা শিকদাঁড়াকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো৷ রাত জেগে শেষ করেছিল ওর স্বপ্নের প্রজেক্ট৷ তারপর অনিমেষের জীবনে শুধুই অনেক রঙের আঁকিবুঁকি৷ কিন্তু যখনই কোনো নারীর মুখ আঁকতে গেছে অনিমেষ তখনই ভালোবাসা, স্নেহহীন একটা নারীর অবয়ব এঁকে বকুনি খেয়েছে প্রফেসরের কাছে৷ প্রফেসর বলেছেন,কি হচ্ছে অনিমেষ! প্রেমিকার মুখ আঁকছ তুমি… সেখানে মুখের প্রতিটা রেখায় রাখো ভালোবাসার, আবেগের, মমতার টান৷ অনেক চেষ্টা করেছে অনিমেষ…কিন্তু কিছুতেই প্রেমিকার মুখ আঁকতে পারেনি কখনো৷
সকলেই আড়ালে হাসে…আর্টিস্ট অনিমেষ চৌধুরী সব আঁকতে পারে শুধু নারীমূর্তি আঁকতে ব্যর্থ!
কি করে যেন সেই আর্ট কলেজ থেকে কথাটা ছড়িয়ে পড়েছিলো ভাইরাল ফিভারের মতো৷ আজও কথাটার দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অনিমেষকে৷
নিজের পড়াশোনা শেষ করে, বেশ কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে যেদিন আর্ট কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়েছিল সেদিনও জানতো না আদৌ ধরাবাঁধা চাকরি ও ক-দিন করতে পারবে!
অনিমেষের মা কালীঘাটে পুজো দিয়েছিল, ছেলের যেন মতি ফেরে৷ হয়তো মায়ের সেই সকরুণ ডাকে সাড়া দিয়েই আজ প্রায় তিনবছর অনিমেষ চাকরিটা করছে৷
চাকরিসূত্রেই আলাপ হয়েছিলো পারমিতার সাথে৷ পারমিতা তখন সবে একটা স্কুলে জয়েন করেছে৷ যাতায়াতের পথে নিছকই আলাপটা, পারমিতার আগ্রহেই বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল৷ দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক বন্ধু৷ যাদের মনে আবেগ কম বাস্তবতা বেশি৷ কিন্তু অনিমেষ যে আবেগ শূন্য হয়ে বাঁচতে পারবে না৷ অনুভূতি না থাকলে ওর রঙেরা যে কোনো আকৃতিই নেয় না৷ অনিমেষের মা চাইছিলো ছন্নছাড়া ছেলের একটা নিখুঁত সংসার৷ ধানবাদ-এর দেশের বাড়ি ছেড়ে অনিমেষের কলকাতার ফ্ল্যাটে এসে থাকা বাবা মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়৷ এলেও দিন সাতেক থেকেই পালাই পালাই করে বাবা মা৷ তাই এবারে মায়ের ইচ্ছে, অনিমেষকে বাঁধতেই হবে সংসারের বেড়াজালে৷ পারমিতার বাড়ি অবধি চলে গিয়েছিলো ওদের দুজনের বিয়ের কথাটা৷ ঠিক তখনই অনিমেষ খেয়াল করেছিলো, ওর স্টুডিওতে ঢুকে পারমিতা বলেছিলো, এই ছবিগুলো ফেলে রেখে জঞ্জাল না বাড়িয়ে বিক্রি করে দাও৷ কয়েকটা টাকাও আসবে, আর ঘর পরিষ্কারও হবে৷
চোখের সামনে একটা সুন্দর রঙিন ছবিকে মুহূর্তে ধূসর হতে দেখেছিলো অনিমেষ৷ পারমিতার চোখের ওই লোভই আবার ধ্বংস করেছিলো অনিমেষের ক্যানভাসের রেখাদের৷ তারপর বছর খানেক শুধু কলেজে গেছে আর এসেছে৷ একটাও ছবি আঁকতে পারেনি অনিমেষ৷ আঁকতে গেলেই মানুষের ওই স্বার্থান্বেষী মুখটা চোখে ভেসে উঠেছে৷ ব্যর্থ হয়ে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছে রঙের খেলা৷ অনিমেষ-এর নিজেকে বড়ো রিক্ত মনে হয়৷ বন্ধু বান্ধবহীন, রং তুলিহীন অনিমেষ যেন মৃতপ্রায় একটা মানুষ৷ মাত্র একত্রিশেই প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা হেরে যাওয়া মানুষ৷
ক্যানভাসের সামনে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো অনিমেষ৷ বারবার চেষ্টা করছিলো একটু আগে দেখা পলাশ রঙের মেয়েটার মুখটাকে আবছা থেকে স্পষ্ট করতে, কিছুতেই না পেরে হাল ছেড়ে বসে পড়লো ও৷ কিন্তু মনের মধ্যে ওই বৃষ্টিস্নাতার চিত্রটি যেন খোদাই হয়ে গেছে৷
রেগুলার কলেজ থেকে ফিরে ব্যালকনির চেয়ারে বসে নির্দিষ্ট বাড়ির নির্দিষ্ট ছাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা৷ যদি একবার অন্তত দেখা পাওয়া যায়… তাহলে হয়তো ওর ছবিটা কমপ্লিট হয়ে যাবে৷
হঠাৎই চমকে উঠলো অনিমেষ… আজ পরেছে নীল৷
নীলাম্বরী চুড়িদারে আকাশ লজ্জা পাচ্ছে যেন৷ মেয়েটাও ওর দিকে অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই গায়েব৷
তারপরেই ফ্ল্যাটে কলিংবেলের আওয়াজ …
দরজা খুলতেই একটা ঝড় তীব্র বেগে আছড়ে পড়লো অনিমেষের ওপরে৷
রোজ বিকেল বেলা আমাদের ছাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন কেন আপনি? কি দেখেন? জীবনে কোনোদিন তো আপনাকে হাসতে দেখলাম না৷ অথচ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন!
অনিমেষের চোখে একটা অপরাধীর ছায়া৷ সরি ম্যাম! আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার দিকে তাকাইনি৷ আমার একটা অসমাপ্ত ছবি ….
মেয়েটা ঝর্ণার মতো খিল খিল করে হেসে বললো, আমাকে আপনি ম্যাম কেন বলছেন?
আমি তো দিয়া! ইস! একটা ত্রিশ-বত্রিশের লোক কিনা ছাবিবশের আমাকে ম্যাম বলে ডাকছে৷ নিজেকে বড্ড বুড়ি মনে হয়৷
আচ্ছা, শুনলাম নাকি আপনি আর্ট কলেজের প্রফেসর? তা ছবি টবি আঁকতে পারেন নাকি কলেজের ছেলেদের দিয়েই আঁকান! মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিমাতেই বহুদিন পরে হেসে ফেললো অনিমেষ৷
দিয়া বললো, আমি এখনও বেকার৷ তবে গানের টিউশনি করি বেশ কয়েকটা৷ আর বাবা মা সরকারি চাকুরে খুঁজতে গিয়ে কেরানি থেকে পিওন খুঁজে চলেছে৷
যারা আমাকে দেখতে এসেই প্রথমে জিজ্ঞেস করছে, আমি ঘরের কাজ পারি কিনা!
কেউ জিজ্ঞেস করেনি, আমি গানটা কেমন গাই!
দিয়া উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আপনি আমাকে দেখেন কেন? আমি কি পাগলি?
অনিমেষ সামলে নিয়ে বললো, পাগলিরা মন্দ কি? দৈনন্দিন জীবনের হিসেব নিকেশ কষতে কষতে নিজেদের জীবনটাকে জটিল করে তোলে না অন্তত৷
দিয়া বললো, আপনি ভারি সুন্দর কথা বলেন তো!
অনিমেষ ভালো কথা বলতে পারে? এই প্রথম কেউ এই কথাটা বললো! এতদিন শুনছে ও নাকি ভীষণ আনরোমান্টিক৷ কথাটুকুও বলতে পারে না৷
দিয়া বললো, আচ্ছা আপনার শিল্প সত্তার সাথে যদি বাস্তব জীবনের বিরোধ বাঁধে তাহলে আপনি কাকে মেনে নেবেন?
অনিমেষ একটুও না ভেবে বললো, শিল্পী জীবন৷
মেয়েটা হঠাৎ করে কোনো ভূমিকা ছাড়া অনিমেষকে জড়িয়ে ধরে বললো,থ্যাংক ইউ স্যার! আমাকে বাঁচালেন৷
বলেই আর পিছন ফিরে না তাকিয়ে নীলাম্বরী ওড়না উড়িয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে পালিয়ে গেলো৷
অদ্ভুত একটা শিহরণ শরীরে মেখে দাঁড়িয়ে আছে অনিমেষ৷ মেয়েটা কি সত্যিই পাগল? নাকি ওর মতোই আবেগতাড়িত৷ নিজের থেকেও বেশি হয়তো গানকে ভালোবাসে৷
ব্যালকনিতে এসে বসেছে অনিমেষ৷ দিয়াদের বাড়ি থেকে খুব হালকা হয়ে ভেসে আসছে … যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…
রোজ বিকালে তীর্থের কাকের মতোই বসে থাকে অনিমেষ৷ তবুও দেখা মেলে না দিয়ার৷
অধৈর্য হয়ে যায় অনিমেষ৷ একবারও কি ছাদে উঠতে নেই? একবারও কি মনে পড়ে না, কেউ একজন অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে ওর জন্য! ধুর..
সেদিনও বিরক্ত হয়ে ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে ঢুকে এলো অনিমেষ৷ তারপরেই ঝড়ের মতো প্রবেশ করলো দিয়া৷
হাতে বেশ বড়ো একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে৷ শুনুন আমার এই ব্যাগটা দিন দুই রাখতে পারবেন আপনার বাড়িতে?
তারপর পালানোর ব্যবস্থা করে আমি নিয়ে চলে যাব!
চমকে উঠে অনিমেষ বলেছিলো, কার সাথে কোথায় পালাবেন?
দিয়া একমুখ হেসে বললো, এই তো মানুষের দোষ! যেন পালাতে গেলেই কাউকে একটা দরকার৷ আরে আমি একাই পালাব, বাড়ির লোককে শিক্ষা দেবার জন্য৷ আমার গান ছাড়িয়ে বিয়ে দিতে চায় বলে৷ ব্যাগটা রাখতে পারবেন কিনা বলুন?
যদি না পারেন তো অন্য কোথাও…
আরে না সে আপনি ব্যাগ রাখতেই পারেন, কিন্তু আমি তো আপনাকে এভাবে অচেনা পথে পাড়ি জমাতে দিতে পারি না৷ অনিমেষের কথা শেষ হবার আগেই দিয়া বললো, তাহলে তো খুব ভালো হয়৷ রাস্তা ঘাটে আজকাল মেয়েদের বড়ো বিপদ৷
আপনি সঙ্গে থাকলে পালিয়ে গিয়ে আর কোনো চিন্তা থাকবে না৷ নিশ্চিন্তে দিন সাতেক শান্তিনিকেতনে থেকে ফিরতে পারবো! অনিমেষ বললো, বিয়েতে আপত্তি কীসের?
দিয়া কাঁদো কাঁদো মুখে বললো, পরাধীনতা ভালো লাগে না যে৷
আমি যদি খারাপ লোক হই? আমার সাথে পালাবে! তোমার ভয় করবে না?
দিয়া এক মুখ হেসে বলল, ধুর! আপনি খারাপ লোক হতেই পারেন না৷ বৃষ্টি, আকাশকে ভালোবাসা লোকেরা কখনো খারাপ হয় না, যান্ত্রিক হয় না৷
মেয়েটার কথায় যে সুরটা মিশে আছে এটাই বহুদিন ধরে গাইতে চেয়েছিল অনিমেষ৷
দিয়াকে আরও কয়েকদিন দেখতে হবে, মিশতে হবে ওর সাথে… তবে ও প্রেমিকার ছবিটা কমপ্লিট করতে পারবে৷ আঁকতে পারবে একটা পরিপূর্ণ নারীর ছবি৷ যার দীঘল চোখে থাকবে ভালোবাসা৷
মেয়েটার সব ভালো, তবে বড্ড চঞ্চল৷ একমুহূর্তও স্থির হয়ে ভাবতে চায় না৷
এখন যেমন অনিমেষের বিছানা গোছাচ্ছে৷ আর গজগজ করে বলছে, আচ্ছা তোমরা ছেলেরা এত নোংরা হও কেন? একটু গুছিয়ে রাখতে পারো না?
অনিমেষ খেয়াল করল দিয়া বে-খেয়ালই ওকে তুমি বলছে৷
নিজের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন খেয়াল করছে অনিমেষ৷ দিয়াকে দেখতে পেলেই একটা ভালোলাগার অনুরণন চলছে মন জুড়ে৷ যদিও দিয়া স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে ওর সাথে কিন্তু অনিমেষ দিয়াকে দেখলেই বুঝতে পারে নিজের মনের আলোড়নটা৷ এটাকে কি শুধু ভালোলাগা বলে? নাকি তার থেকে বেশি কিছু!
দিয়া বললো, আমার বিয়ে প্রায় ঠিক ৷ পাত্রকে অনেক বারণ করেছি, আমি বিয়ে করতে চাই না৷ কিন্তু পাত্রও মহা বদমাশ, কিছুতেই আমার কথা শুনল না৷ তাই ঠিক করেছি বিয়ের দু-দিন আগে থেকে বিয়ের ডেটের তিনদিন পর পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকবো৷
অনিমেষ বললো, তোমার বাবা মা যদি জানতে পারেন আমি সাহায্য করেছি তাহলে কিন্তু!
দিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, বেশ আমি ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছি৷ ব্যাগটা ধরতে যাওয়ার আগেই অনিমেষ ওর হাতটা ধরলো৷
অনিমেষের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোর মধ্যে থরথর করে কেঁপে উঠলো দিয়া৷
না, ব্যাগটা এখানেই থাক৷
আর দাঁড়ায়নি দিয়া৷
তবে রোজ নিয়ম করে ওই সময় ছাদে উঠেছে পাখিদের ঘরে ফেরা দেখতে৷ আরেকজনের মুগ্ধ দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েও পারেনি৷ অনিমেষের নির্নিমেশ দৃষ্টির সামনে দিয়ার গালদুটো ধীরে ধীরে অস্তগামী সূর্যের আলোয় আবির রঙা হয়ে উঠেছে৷
দুটো চোখ লজ্জা অবনত হয়েছে কখনো, কখনো কপট শাসনে বলতে চেয়েছে …কি হচ্ছে? এমন নির্লজ্জের মতো তাকিও না তো৷
অনিমেষের ক্যানভাসের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা ছটফটে দিয়া চুপটি করে বসে থেকেছে … জেতাতেই হবে অনিমেষকে৷ এটা যেন দিয়ার পরীক্ষা৷ অনিমেষের অসমাপ্ত নারী চিত্রকে পরিপূর্ণতা দিতেই হবে৷
অনিমেষের বিশাল ক্যানভাস জুড়ে পলাশ রঙা চুড়িদার পরে মিষ্টি করে হাসছে দিয়া৷
এতদিনে নিখুঁত একটা নারী মূর্তি আঁকতে পেরেছে অনিমেষ৷ বুকের সমস্ত জমে থাকা কষ্ট বেরিয়ে যাচ্ছে নোনতা জল হয়ে৷
অবশেষে ও পেরেছে….
দিয়া বললো, অনিমেষ… আর বোধহয় তোমার আমাকে প্রয়োজন নেই৷ তোমার অসমাপ্ত ছবির প্রয়োজনেই তো তুমি তাকিয়ে থাকতে আমার দিকে৷ এখন তো সেটা সম্পূর্ণ হয়েছে৷ এবার আমি আসি৷
অনিমেষ ক্যানভাসে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, হ্যাঁ দিয়া এসো৷ এরপর আর নারীর মুখ আঁকতে ক্যানভাস নষ্ট করতে হবে না আমাকে৷ একটার পর একটা আঁকতে পারবো৷
দিয়া আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে৷ তোমার ওই সরল দুটো চোখের জন্যই আমি আজ জিততে পারলাম ৷
অনিমেষ একবারও দেখলো না, পরিপূর্ণ জীবন্ত নারীর চোখে এখন জলের ধারা নেমেছে৷
দিয়া চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ৷ অনিমেষ এঁকে চলেছে আরও অনেক ছবির স্কেচ৷ দীর্ঘ একবছর পরে আবার হবে অনিমেষ চৌধুরীর ছবির এগজিবিশন৷
ভীষণ ব্যস্ত এখন অনিমেষ৷ বিকেলে ব্যালকনিতে দাঁড়ানোর সময় নেই আর৷
আরেকজন যে ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা আর অপেক্ষা করে করে ফিরে গেছে সেটা বোধহয় কেউ জানলো না৷
এগজিবিশনের হল বুক কমপ্লিট৷ রাতে ফ্ল্যাটে ফিরতেই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা অনিমেষের হাতে বিয়ের কার্ডটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, একজন দিয়ে গেল৷
কার্ডটা খুলেই চমকে গেল অনিমেষ৷ দিয়ার বিয়ে!
তাহলে দিয়া আর পালাচ্ছে না৷ বিয়েটা করেই নিচ্ছে৷
দিয়াকে গিফ্ট করবে বলেই স্টুডিওতে ঢুকে আঁকতে শুরু করলো দিয়ার মুখটা৷ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো একজোড়া জল থইথই চোখ৷
ছবিটা কোনোমতে শেষ করলো অনিমেষ৷ কাল সন্ধ্যেবেলা গিয়ে দিয়ে আসবে দিয়াকে৷
দিয়াদের বাড়ির ছাদেও একটা প্যান্ডেল হয়েছে৷ সন্ধ্যেবেলা টুনি জ্বলছিলো৷
ছবিটা নিয়ে দিয়াদের বাড়িতে ঢুকতেই দিয়া বেরিয়ে এলো ছুটে৷
এক নিঃশ্বাসে বললো, তুমি এসেছো অনিমেষ? আমি জানতাম তুমি আসবে!
অনিমেষ নিজের আঁকা ছবিটা গিফ্ট করলো দিয়াকে৷
ছবিটা হাতে নিয়ে দিয়া বললো, শুধু এটা দেবে বলেই এসেছিলে?
অনিমেষের মনে হচ্ছে সেই ছোটোবেলার নাগরদোলা থেকে নীচে নামার মতোই কিছু একটা হারিয়ে ফেলার অনুভূতি বুকের মধ্যে চাপ হয়ে বসে আছে৷
আজ পালাবে দিয়া? আমার সাথে?
কোনো কথা না বলে দিয়া হাতটা ধরল অনিমেষের৷
অনিমেষের গাড়ি ছুটছে শান্তিনিকেতনের দিকে৷
ওর কাঁধে মাথা রেখে দিয়া বললো, তুমি বুঝি মডেল ছাড়া আঁকতে পারো না?
অনিমেষ দিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে বললো, বিশেষ মডেল,নিজস্ব ব্যক্তিগত মডেল ছাড়া রং কথা বলতে নারাজ৷
রাতের আকাশে তখন কালপুরুষ আর অরুন্ধতী ভালোবাসা দিবসের প্রতিশ্রুতির বন্ধনে নিজেদের বেঁধে ফেলেছে৷ একই আকাশে থাকবে সারাজীবন৷