প্লে বয়
প্লে বয় বুঝিস, অর্কদীপ হলো নাম্বার ওয়ান প্লে বয়৷ এই তো কয়েক সপ্তাহ আগেই আমাকে চকলেট দিয়ে প্রোপোজ করে বললো, তার নাকি আমাকে দেখে প্রেম প্রেম পায়, আমিও হলাম বোকার বেহদ্দ, দু-দিন আগেই অর্কদীপকে তনিমার সাথে ঘুরতে দেখেও টনক নড়লো না, ওই কাটা কাটা চোখ, দৃঢ় চিবুকের মোহে পড়ে গেলাম৷ আজ অর্ক জানালো, তার নাকি বড্ড একঘেয়ে লাগছে আমাকে৷ দু-চোখে জল নিয়ে একটানা কথাগুলো বলে গেল রাইমা৷
এতটাই এক্সসাইটেড হয়ে আছে, যে সামনে পি কে বি ক্লাস নিচ্ছেন সেটাও খেয়াল করছে না রাইমা৷ গার্গী আস্তে আস্তে বললো, এখন চুপ কর রাইমা৷ স্যার তাকাচ্ছেন, একটু পরে সব শুনছি৷ তবুও রাইমার ফুঁপিয়ে কান্নাটা কিছুতেই থামছে না৷ আবার ফিসফিস করে বললো, আমি তোর কথা শুনিনি বলেই আজ এমন দিন দেখতে হলো রে গার্গী! তুই বারণ করেছিলিস অর্কদীপের প্রস্তাবে রাজি না হতে৷ তবুও আমি কিছুতেই শুনিনি৷ আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না রে৷ তবে শোন গার্গী, আমি মরলে ওই ছেলেটাকে খুন করেই মরবো৷ রাইমা হাতের পেনটা ছুড়ির মতোই ধরে আছে দেখে হাসি পেয়ে গেল গার্গীর৷ রাস্তার ধারে কুকুর চিৎকার করলে রাইমা আর সেই রাস্তা ধরে যায় না, আর সে নাকি খুন করবে ওই ছয় ফিটের অর্ককে৷ রাইমার ফিসফিস শব্দের গুঞ্জন বেশিক্ষণ চেপে রাখা গেল না৷ যথারীতি পি কে বি চশমার ফাঁক দিয়ে ওদের দিকে গম্ভীর চোখে তাকালেন৷ তারপরেই বললেন, দুজনেই বাইরে যাও৷
গার্গী আস্তে করে বললো, সরি স্যার৷ আপনার ভাইটাল ক্লাস বাদ দিয়ে বাইরে যাওয়ার শাস্তিটা দেবেন না প্লিজ৷
পি কে বি-র গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজে গার্গীর হালকা প্রতিবাদ যেন হাওয়ায় মিশে গেল৷ স্টুডিয়াস গার্গীকে এই প্রথম কোনো স্যার বাইরে পাঠালেন৷ অপমানে হাত-পা অবশ হয়ে আসছিলো তার৷
রাইমার মতো অবস্থাপন্ন নয় গার্গীরা৷ কোনো ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে গার্গী৷ মা আয়ার কাজ করে মানুষ করছে ওকে৷ তাই নামী প্রফেসরের কাছে টিউশনি নেওয়ার সুযোগ নেই ওর৷ ক্লাসটা মন দিয়েই করার চেষ্টা করে ও৷ ইকোনমিক্স অনার্স নেবার সময় ওকে অনেকেই নিষেধ করেছিলো৷ সকলেই বলেছিলো, প্রফেসরদের স্পেশাল কোচিং ছাড়া ওই টাফ সাবজেক্ট নিয়ে পাশ করা মুখের কথা নয়৷ ফার্স্ট ইয়ারে পরীক্ষার পর থেকেই সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গার্গী, সাবজেক্টটা অতটাও শক্ত লাগেনি, অনার্সে যে পরিমান কঠিন লাগছে৷ রাইমা শহরের সব থেকে ভালো প্রফেসরের কাছে টিউশন নেয়৷ গোটা ক্লাসের মধ্যে ওর মনটাই যা একটু ভালো৷ নিজের নোটের খাতাগুলো ও গার্গীকে দিয়ে সাহায্য করে৷ তাই গার্গীও বাধ্য হয় ওর হাবিজাবি বায়না রাখতে৷ এই যেমন অর্কদীপের সাথে ব্রেকআপের গল্প শুনতে গিয়েই পি কে বি-র স্ট্যাটিসটিক্যাল মেথডস এর ক্লাসের মাঝপথে ওকে বেরিয়ে আসতে হলো গাছতলায়৷ জরুরি ক্লাস নোটগুলো নিশ্চয়ই আর কারোর কাছেই পাবে না৷ যা সব হিংসুটে ক্লাসমেট ওদের!
রাইমার কোনো হেলদোল নেই৷ গাছতলায় দাঁড়িয়েও অর্ককে গালাগাল দিয়েই চলেছে, আর নাকের পাটা ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে চলেছে৷ দুধে আলতা গায়ের রঙের রাইমাকে অর্ক ঠিক কেন বাতিল করলো সেটাই রহস্য গার্গীর কাছে৷ শ্যামলা সাধারণ চেহারার গার্গী না হয় কোনোদিনই ওই গ্রিক ভাস্কর্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে না, কিন্তু রাইমা তো দারুণ সুন্দরী৷ তাহলে হলো কি! রাইমার ফোঁপানি বন্ধ হতে হতে পরের ক্লাসটাও শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হলো ওর৷
গার্গী বিরক্ত হয়ে বললো, আসল কথাটা কি তুই বলবি? নাকি আমি যাবো!
খপ করে গার্গীর হাতটা ধরে রাইমা বললো, আমি হচ্ছি বোকা, ভীষণ বোকা৷ তাই অর্কদীপের মতো প্লে বয়কে চিনতে পারলাম না৷ প্রোপোজ করার সময় কত বড়ো বড়ো কথা, লোকে বলে ভালোবাসা নাকি তাৎক্ষণিক, আমি বলি প্রকৃত ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী৷ তবে হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবেসে দেখবো রাইমা যদি সত্যিই আমার হৃৎপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যায় তাহলে বুঝবো, আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ যদি সত্যিই আমি আমার চারপাশের সব মেয়েদের মুখের মধ্যে তোমার মুখ দেখতে পাই তখনই বুঝবো আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ এত কিছু কথার ঝোঁকে আমিও রাজি হয়ে গেলাম৷ আজ বলে কিনা, রাইমা তোমার ক্ষেত্রে সত্যিই আমার ভালোবাসাটা ভীষণ ক্ষণস্থায়ী হলো৷ তোমাকে দেখে ওই অনুভূতিটা কোনোদিন এলো না, যে আমি আমাকে হারিয়ে ফেলবো৷ কথা কটা বলে আবার ফোঁপাতে লাগলো রাইমা৷
গার্গীর সব রাগ গিয়ে পড়লো থার্ড ইয়ারের অর্কদীপের ওপর৷ অর্কদীপের জন্যই আজ গার্গীর ইম্পর্টেন্ট ক্লাস মিস হয়ে যাচ্ছে৷ এদিকে হূদয় ভঙ্গ বান্ধবীকে ছেড়েও যেতে পারছে না৷ কি যে করা যায়! ওই প্লে বয় টাইপের ছেলেগুলোর জন্য গার্গীকে সাফার করতে হচ্ছে৷ চূড়ান্ত তিতকুটে মন নিয়েই ও বলল, দেখ রাই, আমি কিন্তু প্রথমেই বলেছিলাম, অমন চিত্রশিল্পী দ্বারা অঙ্কিত মুখের ছেলেগুলো মোটেই সুবিধার হয় না৷ ওই ভাবুক ভাবুক মুখ নিয়েই এরা মেয়েদের ফাঁসায় বুঝলি৷ আর তোরাও মারাত্মক গাধা, ওই একটা ছেলের পিছনে লম্বা লাইন দিয়ে আছিস৷ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের মতো অর্কর গার্লফ্রেন্ডের জায়গাটা তো একদিনের জন্যও ফাঁকা দেখি না রে৷ তুই কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলাচ্ছিস, আর ও কালকেই দেখবি নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মস্তি করছে৷
রাইমা হঠাৎ জ্বলে উঠে বললো, আমি ছাড়বো না ওই বেইমানকে৷ ও যতগুলো গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করবে আমি ততগুলোকে ভাঙচি দেব৷ গার্গী ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো, তুই শুনেছিলি ওর এক্স তনিমা, মধুমিতার কথা৷ ওরাও তো তোকে জানিয়েছিলো অর্ক ভালোবাসতেই জানে না৷ ও শুধু মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করে, তারপরেও তো তুই প্রবঞ্চিত হবি বলেই ওর প্রপোজালে এক কথায় রাজি হয়ে গেলি৷ রাইমা রুমাল দিয়ে নাক মুছে বললো, শোন গার্গী, আমিও হলাম সমর মুখার্জীর মেয়ে রাইমা মুখার্জী৷ এত সহজে ওই ছেলেকে আমি ছাড়বো না৷ আমার ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে ওর জন্য৷
গার্গী বললো, আজ অব্দি দেখেছিস, অর্ক ব্রেকআপের পর মুখ শুকনো করে ঘুরছে৷ বরং আরো সাজুগুজু করে মেয়েদের আকর্ষণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়৷
দুটো ক্লাস মিস করে এত বুঝিয়েও রাইমার ফোঁপানিটা থামাতে পারলো না গার্গী৷
মনে মনে বললো, বড়োলোকের মেয়ে কাঁদলেও ভোলানোর লোক আছে, কিন্তু গার্গীর চোখের জলের কোনো মূল্যই নেই কারোর কাছে৷ ও কাঁদলেও ওর মায়ের বুকের পাতলা সুতির কাপড় ছাড়া আর কিছুই ভিজবে না৷
তাই বন্ধু-বান্ধবের সাথে হইহুল্লোড় করলেও গার্গী কোনো সময়েই নিজের অবস্থান ভোলে না৷ যেদিনই বন্ধুদের রেস্টুরেন্টে পার্টি থাকে সেদিনই গার্গীর বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া থাকে৷ অথবা মাল্টিপ্লেক্সে মুভি দেখার নামেও গার্গী বলে, মা বকবে, তাই আজ যাওয়া হবে না৷
বন্ধুরা অনেকবার বুঝতে পেরেই ওর টিকিট কাটবে বলে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বাঁচার মেয়ে গার্গী নয়৷ করুণা দৃষ্টি ভীষণ অসহ্য লাগে ওর৷
একমাত্র রাইমাকেই ও এড়াতে পারে না৷ এই মেয়ে নাছোড়বান্দা হয়ে বলে, তুই না গেলে আমিও যাবো না৷ গার্গী বোঝে, রাইমা ওকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে৷ তাই রাইমার হাসিখুশি মুখে নোনতা জল দেখে ভিতরে ভিতরে অর্কদীপের প্রতি জ্বলে গিয়েছিল গার্গী৷
অনেক বোঝানোর পর রাইমা বলেছে, বুঝলি গার্গী! আমি যত মনমরা হয়ে থাকবো তত আনন্দ হবে অর্কর৷ এটা করা চলবে না৷ আমাকে হাসিখুশি থাকতে হবে, ওকে দেখাতে হবে ও চলে যাওয়ায় আমারও বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি৷ গার্গী হাসতে হাসতে বললো, সে তোর এমনিও বিশাল কিছু ক্ষতি হয়নি৷ কারণ আজ অবধি কোনো ঘটনাই তোর মনে দীর্ঘ রেখাপাত করেনি৷ তোর মনটা স্রোতস্বিনী ঝর্ণার মতো বহমান৷ রাইমা ভ্রূ কুঁচকে বললো, তোর এসব শক্ত শক্ত বাংলা বাদ দিয়ে বলতো, আমাকে ভালো বলছিস না খারাপ?
গার্গী বললো, ভালো বললাম রে পাগলি৷ আমার মনের মতো তোর মন তোকে কষ্ট দেয় না৷ সব ভুলে যেতে সাহায্য করে৷ আর আমার মন সব পুরোনো কথা গুছিয়ে রেখে দেয় আমাকে অবসরে ক্ষতবিক্ষত করবে বলেই৷ দুই বান্ধবীতে বেশ কিছুক্ষণ চুপটি করে ক্যাম্পাসের সবুজের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর উঠে পড়ল৷ রাইমা বললো, গার্গী, তোর অর্ককে কেমন লাগে?
ধক করে উঠলো হৃৎপিণ্ডের ভিতরে সযত্নে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিটা৷ কি বলবে গার্গী প্রিয় বান্ধবীকে, সত্যিটা নাকি মিথ্যে৷
আপাতত সত্যি বলার মতো বিপদজনক আর কিছুই হতে পারে না৷ গার্গী কি করে বলবে, কলেজে প্রথম পা দিয়েই চোখ আটকে গিয়েছিলো ওই গ্রিক ভাস্কর্যের দিকে৷ থরথর করে কেঁপে উঠেছিলো গার্গী৷ ছেলেটি ওর দিকেই এগিয়ে আসছিলো দেখে পায়ের পাতা আটকে গিয়েছিলো, গোটা শরীর অবশ হয়ে আসছিলো ওই বড়ো বড়ো চোখের স্থির চাহনির সামনে৷ ছেলেটা অপলক তাকিয়েছিলো গার্গীর দিকে৷ চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি৷ গার্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিলো ছেলেটা৷ চেনা কোনো মানুষের সাথে কি মিল পেলো নাকি, না হলে এভাবে কেউ অপরিচিতের দিকে তাকায়! অস্বস্তি হচ্ছিল গার্গীর, অথচ ফ্রেশারদের এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে সিনিয়ররা৷ প্রাথমিক বরণ করেই নাকি কলেজে এন্ট্রি দেবে এরা৷ বারবার চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল গার্গী৷ তেমন পরিচিতও কেউ তৈরি হয়নি যে তার সাথে কথা বলে মনটাকে অন্যমনস্ক করবে৷ তাই এদিক ওদিক তাকিয়েই চোখ সরাচ্ছিলো ওই মারাত্মক সুন্দর দেখতে ছেলেটার থেকে৷ শুধু কি চোখ, উথালপাথাল মনকেও বশে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলো গার্গী৷ বরাবর গার্লস স্কুলে পড়েছে, তাই সুন্দরী মেয়ে ও কম দেখেনি৷ তাদের পাশে নিজেকে বসিয়েও দেখেছে৷ তুলনা তো দূরে থাক, তাদের রূপের ছটায় ম্রিয়মান হয়ে গেছে ওর অত্যন্ত সাধারণ মুখশ্রী৷ তাই ওর দিকে কেউ এমন অপলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে ভিতরে ভিতরে যেমন অবাক হয়েছিলো, তেমনি ওর নারী সত্ত্বা হঠাৎ যেন বলে উঠেছিলো আমার মধ্যেও কি সত্যিই দেখার মতো কিছু ছিল!
যতই চোখ সরিয়ে নিক, তবুও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো, ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে দু-চোখ দিয়ে কবিতা লিখছে৷
কি লিখছে ছেলেটা! ঘন চুল, দীঘল চোখ, ফর্সা রং কিছুই তো নেই ওর৷ তাহলে কবিতায় ও কি করে কবির বনলতা হয়ে উঠবে৷ ফ্রেশারদের লাইন ক্রমাগত বড়ো হচ্ছিলো৷ পিছনের ছেলে-মেয়েরা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলো৷
অনেকেই চিৎকার করে বলছিলো, বরণ হবে নাকি সিনিয়ররা এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে র্যাগিং করছে৷ একমাত্র গার্গীর সময়ের হিসেব ছিলো না, ছিলো না চলার ক্ষমতা৷ আবেশ বিহ্বল হয়ে ও তাকিয়ে ছিলো ওর ঠিক সামনে বসে থাকা সিনিয়র ছেলেটির দিকে৷ যার চোখ এত হইহট্টগোলেও একবারও সরে নি গার্গীর দিক থেকে৷
অলিভ টিশার্ট আর ফেডেড ব্ল্যাক জিন্স, চুলগুলো বোধহয় ইচ্ছে করেই এলোমেলো করে দিয়েছে নিজেকে কেয়ারলেস দেখানোর জন্য৷ দাড়িটাও ট্রিম করে রাখা, মনে হচ্ছে যেন নিজের সম্পর্কে অসচেতন, দৃঢ় চিবুকে অল্প হাসির রেখায় কিছু বলতে চাওয়ার অভিব্যক্তি, দু-চোখে উদাসী কাব্যিক ছোঁয়া, সব মিলিয়ে যেকোনো মেয়েকে একধাক্কায় কাত করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট৷ হলও তাই, গার্গীর পিছনের একটা মেয়ে তার পাশের মেয়েটাকে বলছিলো, অলিভ টিশার্টকে দেখ, বলিউডের হিরোও হার মানাবে৷
বিরক্ত লাগছিলো গার্গীর৷ মেয়েগুলো এত হ্যাংলা হয় কেন রে বাবা! মনে মনে বোধহয় চাইছিলো, ছেলেটার দৃষ্টি যেন কিছুতেই পিছনের মেয়েগুলোর দিকে না যায়৷ ওর দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকুক….বছরের পর বছর৷
ফ্রেশারদের হাতে গোলাপ আর চকলেট ধরাচ্ছিলো সিনিয়ররা৷ গার্গীদের লাইনটা এগোচ্ছে৷ গার্গীও বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলো৷ না লাইনের সাথে সাথে এগিয়ে আসেনি অপরিচিত ছেলেটি৷
আর একজনের পরেই গার্গীকে বরণ করবে৷ পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলো ও ছেলেটাকে৷ লাইনটা প্রায় জনা পনেরো এগিয়ে আসার ফলে অনেকটা সামনে এগিয়ে এসেছে গার্গী আগের পজিশন থেকে৷ তাই অন্যদের মাথার ভিড়ে চেষ্টা করেও আর দেখতে পেলো না হঠাৎ দেখা রূপকথার রাজকুমারকে৷
ঠিক সেই মুহূর্তে সামনের মেয়েটার হাতে ফুল দিলো সিনিয়ররা৷ কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে যেতেই মেয়েটা বললো, আমার স্যান্ডেলে এলার্জি৷ হয়তো ছেলেদের হাত থেকে টিপ পরবে না বলেই বুদ্ধিটা বের করেছে৷ গার্গী ভাবছিল, ও পরবে না এই ছেলেটার কাছ থেকে টিপ৷ কি বিশ্রী ভাবে তাকাচ্ছে মেয়েদের দিকে৷ এ কি রকম বরণ রে বাবা, মেয়েগুলো গেছে ছেলেদের বরণ করতে, আর ছেলেগুলো মেয়েদের৷ ইচ্ছে করেই ফ্রেশারদের নিয়ে মজা চলছে আরকি৷
না, আমি টিপ পরব না বলার পরেই সামনে অলিভ টিশার্ট দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো, কেন একেবারে বিয়ের সময় চন্দন পরবে, তার আগে নয়৷ চমকে উঠেছে গার্গী৷ ওদের ফুল দিচ্ছিলো যে দুটো ছেলে তারা সাইডে চলে গেছে৷ এখন গার্গীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ ও যাকে খুঁজছিলো সেই মানুষটাই৷
একটা কথাও বলতে পারছিলো না গার্গী৷ কেউ যেন জোর করে ঠোঁট দুটোকে চেপে ধরেছে, হৃৎপিণ্ডের লাবডুব আওয়াজটা নিজের কানেই জোরে শোনাচ্ছে৷
ছেলেটার আঙুল চন্দন সমেত গার্গীর কপাল স্পর্শ করলো৷ গোটা শরীর মন দিয়ে ওই মুহূর্তটুকুকে আগলে রাখতে চাইলো ও৷ হাতে লাল গোলাপ দিয়ে বললো, সকলকে ইয়েলো গোলাপ দেওয়া হচ্ছে, আমি তোমাকে লাল কেন দিলাম পরে কখনো ভেবে দেখো৷ অবশ পা দুটোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো গার্গী, কানে ভেসে এলো, চুলটা খুলে রাখলে মন্দ লাগে না৷
গুনে গুনে তিনদিন কলেজে চুল খুলে এসেছিলো গার্গী, তিনদিনই অর্কদীপের মুগ্ধ দৃষ্টি ছুঁয়ে গেছে ওকে৷ একটা অবশ করা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিলো ওই ক-দিন৷ তিনদিনেই জেনে গিয়েছিলো ছেলেটার নাম অর্কদীপ সেন৷ এক ইয়ারের সিনিয়র৷ বিশাল ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে, চাকরির জন্য নয়, কলেজে পড়তে এসেছে প্রেম করার জন্য৷ ভগবান প্রদত্ত চেহারার জন্য মেয়েরা এমনিই আকৃষ্ট হচ্ছে৷
কথাটা শোনার পরেই ক্যান্টিনের কফিটা একটু বেশিই তেঁতো লেগেছিলো গার্গীর৷ স্বপ্নের পুরুষকে নিজের করে না পেলেও তার গায়ে কেউ কাদা ছেটালে বড্ড কষ্ট হয়৷ অর্কর পারিবারিক অবস্থার যা বিবরণ পেয়েছে তাতে, গার্গী যে কোনোদিনই ওই বাড়ির বউ হতে পারবে না সেটা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে৷ তবুও লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলতে অর্কই৷ তাই ওর চরিত্রে কেউ কলঙ্ক লাগাচ্ছে দেখলে বড্ড রাগ হতো৷ কিন্তু কতজনের মুখ বন্ধ করবে আর৷ সবার মুখেই অর্কর সম্পর্কে একই রকম কথা শুনতে শুনতে ভিতরে ভিতরে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলো গার্গী৷ প্রথম দর্শনের সব ভালোলাগাটুকুকে ও আগলে রাখতে চেয়েছিলো, কিন্তু পারেনি৷ নানা মন্তব্যই এসে ঘেঁটে দিয়েছিলো সব কিছু৷
রোজই কলেজে অর্কর পাশে নতুন নতুন মেয়ে দেখে দেখে চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিলো ওর৷ তারপর থেকেই আর কোনোদিন কলেজে চুল খুলে আসেনি গার্গী৷ আড়াল থেকে দেখলেও কখনো সম্মুখীন হতে চায়নি অর্কদীপের৷ আজ আবার রাইমার মুখে ওর নামটা শুনে প্রথম দেখার দিনটা চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠলো৷
কি রে, বললি না তো, অর্ককে তোর কেমন লাগে? ক্যাম্পাস পেরিয়ে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে গার্গী উচচারণ করলো ওর স্বভাব বিরুদ্ধ মিথ্যেটাকে৷
অর্কদীপ কোনোদিন আমার ভাবনায় আসেনি রাইমা৷ তাই কেমন লাগে তা নিয়ে ভাবিনি কোনোদিন৷
রাইমা কিছু একটা বলছিলো হয়তো, আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়েছিলো গার্গী৷ হঠাৎ ক্লাসের মাঝে ওরা দুজন বেরিয়ে গিয়েছিলো বলেই সকলেই জানতে চাইছিলো, রাইমার কি হয়েছে! গার্গী আস্তে করে বলেছিল, ব্রেকআপ৷ পারমিতা একটু হেসে বললো, যাক রাইমার সৌন্দর্য্য কাজ করেছে বলতে হবে, কারণ এতগুলো সপ্তাহ অর্কর গার্লফ্রেন্ড হয়ে থাকতে পারা মুখের কথা নয়৷ বেশির ভাগের মেয়াদ তো একদিন কি বড়ো জোর একমাস৷
ও নাকি এখনো খুঁজছে সেই মেয়েকে, যাকে দেখলেই ওর হৃৎস্পন্দন বলে উঠবে, এই সে৷
সোনালী বললো, জাস্ট নেওয়া যায় না৷ মেয়েগুলোও মারাত্মক নির্লজ্জ বটে৷ একে একে যাচ্ছে ওই প্লে বয়ের কাছে পরীক্ষা দিতে, কাকে দেখে ওর ধুকপুকুনি না থামে৷ একজন করে রিজেক্ট করছে, আর সে ফিরে এসে চোখের জলে সুনামি ডাকছে৷ উফ, মেয়েগুলোর কি কোনোদিন আত্মসম্মান জাগবে না! সোনালীর জ্বালাময়ী বক্তৃতাটা বোধহয় রাইমার কানে পৌঁছেছিল, তাই বেশ রাগত স্বরেই বললো, শোন সোনালী, আজ তুই এত বড়ো বড়ো ডায়লগ দিচ্ছিস, কালই যদি অর্ক এসে তোকে প্রোপোজ করে… আমি লিখে দিচ্ছি তুই ওর এক দিনের গার্লফ্রেন্ড হতেও রাজি হয়ে যাবি৷
এসব কথায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল গার্গীর৷ ওই নামটাই বেশি শুনতে চায় না ও৷ বারবার সেই পাগল করা চাহনিটা ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, সেই কলেজের প্রথম দিনের প্রতিটা কথা মনে পড়ে নিজেকে বড্ড ছোটো মনে হয়৷ ছিঃ এমন একজনকে এক মুহূর্তের জন্যও কি ভাবে মন দিয়েছিলো ও৷ মুখোশের আড়ালে নিজের মুখটা দেখে লজ্জা করে ওর৷ মনে হয় মন থেকে কি ভাবে মুছে ফেলবে ওই হঠাৎ পাওয়া দৃশ্যপটটাকে! তারপরেও বারবার দুজনে সম্মুখীন হয়েছে একে অপরের৷ নেহাতই কাকতালীয় ভাবেই৷ কলেজ সোশ্যালের দিন গেটের সামনে অর্কদীপকে দেখে ইচ্ছে করেই একটা বড়ো দলের সাথে কলেজের ভিতরে ঢুকেছিলো গার্গী৷ কিছুতেই একা হতে চায়নি ওর সামনে৷ মনের দুর্বলতাকে কিছুতেই প্রকাশ পেতে দেয়নি অর্কর সামনে৷ সেদিনও অর্ক একই ভাবে মায়াবী চোখে তাকিয়ে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিলো গার্গীর মনকে, কিন্তু চাবুকের একটা আঘাতে নিজেকে নির্দয় ভাবে শাসন করতে সক্ষম হয়েছিলো গার্গী৷ তাই আজ হয়তো রাইমার মতো ক্লাস শুদ্ধু ছেলে-মেয়ের কাছে হাসির খোরাক হতে হলো না ওকে৷ সেদিন পায়ে পায়ে একটু এগিয়েছিলো অর্ক, গার্গী থমকে দাঁড়াতে গিয়েও দ্রুত পায়ে পেরিয়ে এসেছিলো বিপদজনক জায়গাটা৷ পিছন ফিরে না তাকিয়েও বুঝেছিলো, অর্ক একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ওর দিকে৷ ঘণ্টাখানেক পরেই অর্কর বন্ধু সমিক এসেছিলো গার্গীর কাছে৷ হাতের মুঠোয় একটা রঙিন কাগজ ভরে দিয়ে ফিরে গিয়েছিলো ও৷
কাগজে গোটাগোটা করে লেখা ছিলো, তুমিই সেই মেয়ে যাকে দেখে আমার পরিচিত পৃথিবীটা মুহূর্তে থমকে যায়৷ তুমিই সেই যাকে দেখে দ্রুতগামী হয় আমার লোহিতকনিকারা, তুমিই সেই মেয়ে যাকে আমি খুঁজে বেরিয়েছি অনেকের ভিড়ে৷
তাই তো তোমাকে কখনো প্রোপোজ করবো না, আমার মতো প্লে বয়ের সংস্পর্শে তোমাকে এনে নষ্ট করবো না আমার অনুভূতিগুলোকে৷ এই অনুভূতিগুলো শুধুই আমার একান্ত উপলব্ধিতেই থাক৷ চাঁদ না ওঠা রাতে ক্লান্ত আমাকে সঙ্গ দেয় তোমার ওই লজ্জা লজ্জা আরষ্ঠ চোখদুটো৷ তাই আমি তোমাকে ভালোবাসলেও ভালোবাসা পেতে চাই না প্রত্যুত্তরে৷
বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসেছিলো গার্গী৷ তারপর চিঠিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে ভেবেছিলো, একেকজনের জন্য একেক রকম ওষুধ থাকে অর্কদীপের কাছে৷ গার্গী যেহেতু রূপসী নয়, তাই রূপের প্রশংসা করাটা নেহাতই হাস্যকর হয়ে যাবে বলেই হয়তো, এ ভাবে মনের দুয়ারে কড়া নাড়ার চেষ্টা করলো অর্ক৷ কিন্তু একটু ভুল করে ফেললো ছকটাতে, ও এখনো জানে না গার্গী ভেসে যাওয়ার মেয়ে নয়৷ গার্গী ভিড়ে মিশে যেতে চায় না, চায় না কারোর সাবস্টিটিউট হতে৷ তাই অর্কদীপ নামটার থেকেই দূরে দূরে থেকেছে ও৷ শুধু কানে এসেছে বিভিন্ন মেয়ের সাথে অর্কর ব্রেকআপের খবর৷ একেকবার গার্গীর মনে হয়েছে, এই ছেলেটা হাঁপিয়ে যায় না! ক্লান্ত হয়ে যায় না! তবে গার্গীর উদাসীনতার জন্যই হয়তো ফিল্মি কায়দায় কোনোদিন ওকে প্রোপোজ করতে আসেনি অর্ক৷
রাইমার আর সোনালীর ঝগড়াটা বেশ জমে উঠেছে৷ দুজনে দুজনকে দোষারোপ করেই চলেছে৷ নীরব দর্শক হয়ে বসেছিলো গার্গী৷ এতক্ষণে বললো, রাইমা একটা চিটার, লুজ ক্যারেক্টার ছেলের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছিস তোরা!
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে গার্গী, অর্ক চিটার৷ না, এই কথাগুলো বলতে একটুও জিভ কাঁপেনি ওর৷ বরং বুকের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জমাট বাতাসটা একটু হলেও হালকা হলো যেন৷ সোনালী বললো, অর্কদীপের মনটা তো খুবই ভালো, কলেজে কারোর ভরতির সময় টাকার ঘাটতি হলে ও হেল্প করে৷ তাছাড়া আমাদের ডিপার্টমেন্টের অনেককেই ওর সাথে যোগাযোগ রাখতেও দেখেছি, নিশ্চয়ই সাহায্য পায় বলেই রেখেছে৷
গার্গী বললো, গরিবদের করুণা করার মধ্যেও একটা আলাদা তৃপ্তি পাওয়া যায়, তাই হয়তো হেল্প করে৷ বড়োলোকদের খেয়াল খুশি নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো৷ রাইমা বুঝতে পারছিলো, ওকে চিট করেছে বলেই গার্গীর এতটা রাগ হয়েছে৷
দিনগুলো নদীর স্রোতের মতোই পেরিয়ে যাচ্ছিলো৷ গার্গী সকলের মতো মাস্টার্স ভর্তি হয়নি৷ ইকোনমিক্স অনার্স কমপ্লিট করেই চাকরির পরীক্ষার জন্য খাটছিলো৷ মায়ের দিনদিন বয়েস বাড়ছে, পরিশ্রমের ক্ষমতা কমছে৷ রাইমা খুব জোর করেছিলো মাস্টার্সে ভর্তি হবার জন্য৷ গার্গীর এত ভালো রেজাল্ট অথচ পড়াটা আর কমপ্লিট করবে না ভেবেই নাকি রাইমার কান্না পাচ্ছিলো৷ কলেজের মুখগুলো আস্তে আস্তে আবছা হয়ে আসছিলো গার্গীর জীবনে৷ একমাত্র ওই প্লে বয় ছেলেটা আর রাইমা ছাড়া সব মুখগুলোই ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে গেছে একবছরের ব্যবধানে৷ আত্মীয় পরিজনরা বাবা মারা যাবার পরেই ধীরে ধীরে সরে গেছে ওদের পাশ থেকে৷ দরিদ্র আত্মীয় বড়ো ভয়ঙ্কর, কথায় কথায় হাত পাততে পারে সেই আত্মীয়কে দেখলেও না চেনার ভান করে এড়িয়ে যায় অনেকেই৷ হাসি পায় গার্গীর৷ ওরা জানেও না, গার্গী বা ওর মা সুমিতাদেবী না খেতে পেয়ে মারা গেলেও কখনো লোকের কাছে নীচু হতো না৷ তবুও বিপদে বন্ধু চেনা যায় কথাটার সত্যতা বিচার করা হয়ে গেছে গার্গীর৷ তাই পরিজনদের ও এড়িয়েই চলে৷
রাইমা একদিন বিকেলের দিকে এসেছিলো বাড়িতে৷ ও আবার প্রেমে পড়েছে সেই খবরটা জানাতেই এসেছিলো৷ ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার একবছরের মাথায় আবার প্রেমে ভাসছে রাইমা৷ এদের জীবনে এত ঘনঘন প্রেম আসে কি করে! আর গার্গী তো এখনো নিজের দু চারখানা শাড়ির ভাঁজে ওই চিটারটার মিথ্যে চিঠিটাকে লুকিয়ে রেখেছে সযত্নে৷ মাঝে মাঝেই মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় চিঠির ভাঁজ খুলে পড়ে আবার রেখে দেয় ও৷ রাইমা আজ পুরোনো বান্ধবীকে পেয়ে কথার স্রোতে ভাসছে৷ সব কথার মাঝেই রাইমা বললো, জানিস গার্গী, অর্ক মাস্টার্স কমপ্লিট করলো না, তার আগেই বাবার বিশাল বিজনেসের দুনিয়ার যুবরাজ হয়ে বসলো রে৷ সেদিন দেখলাম, আমাদের পাড়ার বিশ্বকর্মা পুজোর ওপেনিং-এ এসেছে অল্পবয়সী বিজনেস ম্যান অর্কদীপ সেন৷ দেখেই রাগে জ্বলে উঠলো শরীরটা বুঝলি!
বেশ খানিকক্ষণ ধরে অর্কর নামে নিন্দে করে, ওর কয়েকটা বিজনেস পয়েন্টের ঠিকানা দিয়ে, ওর ফোন নাম্বার দিয়ে তবে গেলো রাইমা৷ গার্গী বললো, ওর ফোন নাম্বার নিয়ে আমি কি করবো রে রাইমা!
রাইমা বললো, রেখে দে, ইচ্ছে হলে একদিন আচ্ছা করে গালাগালি দিস আমার হয়ে৷
ফোন নম্বরটা পাওয়ার পর থেকেই বার পাঁচেক নিজের মোবাইলে ডায়াল করে ফেলেছিলো গার্গী, তারপর অস্থির মনকে শান্ত করে ভেবেছে, কেন করবে ওকে ফোন! কি বলবে ফোন করে!
বলবে… যে তোমার খামখেয়ালি চাহনি আমার জীবনে চিরস্থায়ী হয়েছে, আমি আজও বোকার মতো মনে রেখেছি তোমাকে!
এক্সামের জন্য পড়তে পড়তে বেশ রাত হয়ে যায় গার্গীর৷ ব্যাংকের দুটো রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ও, এখন অপেক্ষা শেষ দেখার৷ সেদিনও বেশ রাত পর্যন্তই পড়ছিলো গার্গী, হঠাৎই মায়ের গোঙানির আওয়াজ শুনে চমকে উঠেছিলো৷ মা কেমন একটা করছে দেখেই ভয়ে প্রতিবেশীকে ডেকেছিল৷ সবার সহযোগিতায় মাকে যখন কাছের নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিলো তখনই ডক্টর শুনিয়েছিলো সেই ভয়ঙ্কর কথাটা৷ মায়ের হার্টের বেশ কয়েকটা ভাল্ব ব্লক হয়ে গেছে, তাই বাইপাস করতে হবে ইমিডিয়েটলি৷ টাকার অঙ্কটা অসহায়ের মতোই শুনেছিলো গার্গী৷ দেড় থেকে দু লক্ষ শোনার পর মাকে মৃত ভেবে নেওয়াই শ্রেয় গার্গীর কাছে৷ কারণ অতগুলো টাকার জোগান দেবার মতো আত্মীয় সেই মুহূর্তে ছিলো না৷ তবুও ডক্টরের কাছে একদিনের সময় চেয়ে ফিরে এসেছিলো ও৷ মানুষ যখন অসহায় হয় তখনই বোধহয় ছোট্ট ছোট্ট গলিপথগুলো দিয়েও লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়৷ তাই সাতপাঁচ না ভেবেই রাইমার দেওয়া নাম্বারে ফোনটা করে বসলো অর্কদীপকে৷
ফোনের ওপ্রান্তের পরিচিত গলা পেয়েও বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়েছিলো গার্গী৷ দোলাচলে দুলছিলো ওর ভারাক্রান্ত মন৷ শেষ পর্যন্ত অর্কর কাছে হেল্প চাইবে, নাকি মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে ভাবতে ভাবতেই কঠিন মনের মেয়েটাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ফোন ধরেই৷ ফোনের অন্য প্রান্তে মানুষটা ডেকে উঠলো, গার্গী কি হয়েছে? বলো, কাঁদছো কেন?
চমকে উঠেছে গার্গী, ক-বার শুনেছে অর্ক ওর গলার আওয়াজ! কি করে নির্ভুল চিনলো ওকে?
ফুঁপিয়ে বললো, মায়ের বাইপাস করতে হবে, টাকা ধার দেবে? আমি জব পেয়েই আস্তে আস্তে শোধ করে দেব৷
অর্ক বললো, জব পেয়ে কেন এখনই শোধ করার উপায় কিন্তু তোমার কাছে আছে৷
ঘৃণায় গাটা গুলিয়ে উঠলো গার্গীর৷ অনেক শুনেছে অর্কদীপের সম্বন্ধে, ও প্লে বয়, ও লুজ ক্যারেক্টার, কিন্তু তাই বলে এতটা খারাপ সেটা বোধহয় ভাবতেও পারেনি৷ ওর কল্পনায় তো সেই ভাবুক ছেলেটার চোখ দুটোই ছিলো অমলিন৷ গার্গী দাঁতে দাঁত চেপে বললো, কখন যেতে হবে বলো তোমার কাছে৷ টাকাটা কিন্তু আমার আজই চাই৷ অর্ক গার্গীর মায়ের নার্সিংহোমের এড্রেসটা লিখে নিলো৷ আজকেই ওখানে টাকা পৌঁছে যাবে কথা দিলো৷ দুপুরে মায়ের অপারেশনের পর সন্ধ্যেবেলা হবে গার্গীর অভিসার৷ অভিসার বললে আদি কবিদের অপমান করা হবে৷ কারণ এক্ষেত্রে গার্গীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অবস্থার বিপাকে পড়ে ওকে যেতে হবে অর্কর কাছে৷
শেষ দুপুরে পশ্চিম সূর্যকে সাক্ষী রেখে ডক্টর জানালেন, মা এখন বিপদ মুক্ত৷
মাকে সঙ্কটমুক্ত করেই নিজেকে বিপদের সম্মুখীন করতে চলেছে গার্গী৷
অর্কদীপের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আলমারি খুলে সেই শাড়িটা বের করলো যেটা পরে ও কলেজ সোশ্যালে গিয়েছিল৷ নীলাম্বরী শাড়িতে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েই ট্যাক্সি ধরলো অর্কর ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে৷ খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর চুল৷ যেন কেউ কানে কানে বলছে, খোলা চুলে বেশ মানায় তোমাকে৷ সাথে সাথে অর্কর ওই কথাটাও কানে এসে ঝাপটা দিলো, জব পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কি দরকার, তোমার কাছে এখনই উপায় আছে টাকা শোধ করে দেবার৷ কষ্টে ঠোঁট দুটো বেঁকে যাচ্ছিলো গার্গীর৷ সেই মুহূর্তেই ফোনটা এলো…
অর্ক বললো, তুমি আর কত দূরে! অপারেশন তো অনেকক্ষণ মিটে গেছে গার্গী, এতটা দেরি কেন করছো!
কান্না চেপে গার্গী বললো, আমি তোমার ফ্ল্যাটের নীচে পৌঁছে গেছি৷
চলে এসো থার্ড ফ্লোরে, ডান দিকের ফার্সট ফ্ল্যাটটা আমার৷
লিফটের এর ভিতরে ঢুকতেই গাটা গুলিয়ে উঠলো গার্গীর৷ বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ওর কপালে৷ পৌঁছে গেছে অর্কদীপের ফ্ল্যাটের সামনে, বেল বাজতেই একটা বছর চোদ্দোর মেয়ে এসে দরজাটা খুলে দিলো৷ এটা আশা করেনি গার্গী৷ ভেবেছিলো আজ হয়তো সব কাজের লোককে ছুটি দিয়ে দেবে অর্ক৷ যদিও এটা ওদের বাড়ি নয়, এটা ওর নিজের দশটা ফ্ল্যাটের একটা হয়তো৷ এখানে বিছানাতেও নিশ্চয়ই আরেকজন তনিমা বা সুচেতনার মতো কেউ এসেছিলো গার্গীর আগে৷ অবশ পায়ে ভিতরে ঢুকলো গার্গী৷ মেয়েটা সোফাটা দেখিয়ে বললো, বসুন৷ কোলড্রিঙ্ক আর স্ন্যাকস নিয়ে এসে সামনে রাখলো মেয়েটি৷ কিছু খাওয়ার ইচ্ছে এই মুহূর্তে গার্গীর নেই৷ কাঁপা গলায় গার্গী জিজ্ঞেস করলো, অর্ক কোথায়?
মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ ভাবেই উত্তর দিলো, দাদাবাবু তো নেই৷ দাদাবাবু মাঝে মাঝে আসে এই ফ্ল্যাটে৷ আমি আর আমার বাবা দেখাশোনা করি এটার৷ আজ দাদাবাবু এসে বললেন, ওনার এক অতিথি আসবেন৷ তাকে যেন এটা দিই৷ একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স ধরিয়ে দিলো মেয়েটা৷ কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছে না গার্গী৷ কারুকার্য করা বাক্সটা খুলতেই খুব পরিচিত কয়েকটা জিনিস চোখে পড়লো ওর৷ চমকে উঠেছে গার্গী, এগুলো অর্কর কাছে কীভাবে এলো! গার্গীর ব্যাকক্লিপের ভাঙা অংশ, ওর একটা একটা কানের দুল, ওর পেনের ভাঙা টুকরো, এমনকি ওর হলুদ চুড়িদারের সামনের শো বোতামটা পর্যন্ত, যেগুলো কোথায় হারিয়েছিলো তার হদিস ছিলো না ওর কাছে৷
বাক্সের মধ্যেই ভাঁজ করা চিঠিটা খুললো গার্গী৷
গার্গী,
চমকে গেছো? অস্বীকার কোরো না, স্বীকার করো, তুমি চমকেছো৷ এগুলো কি করে আমার কাছে এলো সেটাই ভাবছো তো! এগুলো তোমার বান্ধবীরাই আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছে৷ তোমার যেকোনো জিনিসের বাতিল অংশ আমি বেশ চড়া দাম দিয়েই কিনেছি৷ কেন কিনেছিলাম সেটা না হয় তোমার অজানাই থাক৷
বলেছিলাম না, তুমিই সেই মেয়ে, যাকে দেখে আমার উরনচন্ডী বাতাস থমকে গেছে চিরকালের জন্য৷ ভয় পেও না, আমি তোমাকে কোনোদিন কামনা করি নি, আমি তোমাকে শুধু দূর থেকে ভালোবেসেছি৷ আজও দূর থেকেই দেখলাম তোমাকে৷ তোমার চোখের ঘৃণায় আমি প্রায়শ্চিত্ত করলাম৷ জানি প্লে বয়ের তকমা আঁটা অর্ককে তুমি কোনোদিন ভালোবাসবে না৷ তবে কি জানো গার্গী, প্লে বয়রাও কাউকে না কাউকে ভালোবাসে৷ ভাবছো তো এটাও একটা টোপ৷ না ভেবো না, কারণ কখনো ভালোবাসা ভিক্ষে করার ঝুলি নিয়ে দাঁড়াবো না তোমার দরজায়৷ তুমি চাকরি পেলে শোধ করে দিও আমার ঋণ৷ বাঁচিয়ে রেখো তোমার আত্মসম্মান৷ তোমাকে আমি বড্ড সম্মান করি গার্গী, কলেজের আর পাঁচটা মেয়ের মত তুমি আমার ঐশ্বর্য্য দেখে আমাকে ভালোবাসনি বলে৷
তুমি তো আমাকে এই রূপেই কল্পনা করতে তাই না? লুজ ক্যারেক্টার, চরিত্রহীন, চিটার…তাই আজ সেভাবেই ফাঁকা ফ্ল্যাটে ডেকেছিলাম তোমাকে৷ কিন্তু
গার্গী আমি যে তোমাকে শুধু দূর থেকে দেখতে চাই, দূর থেকে ভালোবাসতে চাই, যেমন দেখেছিলাম, কলেজের প্রথম দিনে৷ তুমি চাকরি করো, বিয়ে করো, ভালো থেকো৷ শুধু যদি কখনো প্রয়োজন হয় তখন আমাকে একবার অন্তত মনে করো৷
লালগোলাপ দিয়েছিলাম তোমাকে, কিছু দায়িত্ব তো আমারও থাকে৷ হাসছো তুমি! ভাবছো চিটারের মুখে এসব কি কথা! হাসো হাসো, হাসি মুখে তোমাকেও মন্দ লাগে না৷ ভালো থেকো গার্গী…..ভীষন ভালো থেকো৷
প্লে বয়
খেয়াল করেনি গার্গী, ওর দু-চোখের নোনতা জলে ভিজে গেছে চিঠির পাতা৷ বাক্সটা টেবিলে রেখে দিলো ও৷ ওর ফেলে দেওয়া জিনিস যার কাছে সযত্নে ছিল তার কাছেই থাক৷ গার্গী বুঝলো, খুব কাছে থেকেও সে সম্মুখীন হবে না ওর৷ আড়াল থেকেই দেখবে ওকে৷ ধীরে ধীরে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো গার্গী৷
কানের কাছে একটা সুরের অনুরণন চলছে….যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে, জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে…