চকলেট
একটা করে দিন কাটছে জেলের মধ্যে৷ অন্ধকার কুঠুরীতে আলোর রেখা কমই পৌঁছায়৷ এখন অভ্যেস হয়ে গেছে রাজদীপের৷ হয়েও তো গেল বেশ কয়েকটা দিন৷ বিনা বিচারে জেল খাটছে ও৷ তবে ওর বিশ্বাস আর কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হয়তো মুক্তি৷
মুক্তি! মুক্তি কি সত্যিই চায় রাজদীপ! কে আছে ওর অপেক্ষায় ..নীল আকাশ আর কমলা সূর্য ছাড়া আর কারোর নাম তো মনে পড়ছে না ওর৷
তবে একটা মুখ মনে পড়ছে বারবার৷ তার চোখের জলটাও বুকে এসে বিঁধেছে৷
যতবার সেই মুখটা দেখেছে রাজদীপ ততবার তার চোখে একটাই আকুতি ছিল, কেন করলি?
কেন করেছিল সেটা শুধু রাজদীপই জানে৷ আর এটাও জানে ও ঠিক করেছিল৷
এই উনিশ বছরের জীবনে এত বড়ো কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে জেনেও করেছিল৷ বিরোধী পক্ষের টাকার জোরে ও যে প্রায় একমাস বিচারহীন ভাবে পচে মরবে সেটাও জানতো, তবুও করেছিল৷
কারণ পাঁচ বছর বয়সে ললিপপের দিবিব খেয়ে বলেছিলো, তোকে আমি রক্ষা করবো দিভাই৷ ক্লাস সিক্সের সাথী একমুখ হেসে বলেছিলো, পাগল ভাই আমার! তুই তো কতো ছোটো! তুই কি করে আমাকে রক্ষা করবি! তুই রক্ষা করবি কথাটা শিখলি কোথা থেকে! রাজদীপ ওকে ছোটো ছেলে বলায় ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিলো, রামায়ণে লক্ষণ সীতাকে বলেছিল যে৷
প্রিয় ললিপপটা আরেকবার চুষে নিয়ে ঠোঁট ভর্তি লালা নিয়েই সাথীর গালে চুমু খেয়েছিলো রাজদীপ৷ সাথী রেগে গিয়ে বলেছিলো, ভাই… তুই আমার গালে লালা লাগিয়ে দিলি?
বেশ করেছি, বলেই দে ছুট৷
রাজদীপ জানত না ওই সেভেনের মেয়েটা গালটা ধোয়ার আগে আরেকবার হাত বুলিয়ে নিত পরম স্নেহে৷
মা বলতো, দুটোই পাগল৷ যেমন ভাই, তার তেমনি দিদি৷
বাবার প্রিয় ছিলো দিদি, মায়ের একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিলো তার বিচচু ছেলেটার ওপরে৷
বাবা বলতো, তোমার আদরে জলজ্যান্ত হনুমান তৈরি হবে তোমার রাজা বেটা, তখন সামলিও৷ মা রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, একটু দুষ্টু ঠিকই কিন্তু প্রাণে বড়ো মায়া দয়া৷ বড়ো হলেই শান্ত হয়ে যাবে৷ বড়ো হচ্ছিল রাজ৷ প্রথম স্কুলে গিয়েছিল দু-দিকে বিনুনি করা ওই মেয়েটার হাত ধরে৷ যে মেয়েটা সারা রাস্তা বোঝাতে বোঝাতে যাচ্ছিলো, ভাইসোনা স্কুলে গিয়ে দুষ্টুমি করতে নেই৷ শুধু লেখা পড়া করতে হয়৷ রাজ বলেছিলো, তাহলে দুষ্টুমি কোথায় করে দিদিভাই!
গালে হালকা ভালোবাসার থাপ্পড় মেরে সাথী বলেছিলো ,শুধু দিদিভাই-এর কাছে করতে হয়৷
রাজের যত বায়না ছিল দিদির কাছে৷ চিররুগ্ন মা দিনরাত সংসারের কাজ সামলে সন্ধ্যে হলেই বিছানা নিতো৷ বাবাও দুই সন্তানের সব খরচ সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো৷ একমাত্র নিজের খাতার পিছনের পাতায় ভাইকে কাটাকুটি খেলতে দিত দিদি৷ বাবার বকুনি শুনেও লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের খাতার পাতা ছিঁড়ে এরোপ্লেন বানিয়ে দিত ভাইয়ের আব্দারে৷
ভাইয়ের হয়ে কোমর বেঁধে খেলার মাঠে একাই ঝগড়া করে যেত সাথী৷ সম্পর্কটা যে এমনই ছিলো৷ রাজদীপ যখন মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট করলো তখন দিদিভাই চিৎকার করে বলেছিলো, বলতাম না আমার ভাই সব থেকে ভালো৷ দিদিভাই ক্লাস ইলেভেন থেকেই টিউশনি করতো, আর তার মাইনের টাকার সিংহভাগ খরচ করত রাজদীপ৷ হঠাৎই দিদিভাই মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরি পেয়ে গেল স্কুলে৷ রাজদীপকে আর পায় কে৷ প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই সাথী একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিল ভাইকে৷ নিজের কোনো অ্যান্ড্রোয়েড ফোন ছিল না৷ ওদের বাড়ির প্রথম অ্যান্ড্রোয়েড ফোনটা এসেছিল আদুরে ভাইয়ের জন্য৷ বাবা বলেছিলো, সাথী নিজের বিয়ের জন্য কিছু জমা৷ আমার চাকরি থেকে তো খাওয়া পড়া ব্যতীত কিছুই জমে না৷ তোর বিয়ের গয়না তোকেই তৈরি করতে হবে৷ বাবার চোখ থেকে অসহায়তার জলপড়েছিলো নীরবে৷ সেই প্রথম রাজদীপ বুঝতে পেরেছিলো সে নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে৷ এতদিন দিদিভাই-এর জন্য রাজদীপ বিষয়টা অনুভবই করেনি কখনো৷ ওর মায়ের গায়ে থাকে নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে কাপড়৷ বাবার শার্ট-এর কাপড়টা টেরিকটের৷ গরমে বাবার কষ্ট হয়৷ দিদির চুড়িদারগুলো হাতিবাগানের ফুটের দোকান থেকে কেনা৷ একমাত্র রাজদীপই ব্র্যান্ডেড জিন্স পরে, দামি রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের ট্রিট দেয়৷
রাতে শুয়ে থেকে থেকে দু-চোখে ঘুম আসছিলো না রাজদীপের৷ পায়ে পায়ে দিদির ঘরে ঢুকে দেখলো, দিদি খাতা পেন নিয়ে নোট তৈরি করছে৷ দিদির টেবিলে ওদের দুজনের পছন্দের ললিপপটা রেখে ও বলেছিলো, দিদিভাই সরি রে৷ আমি বড্ড অবুঝ ছিলাম৷ সাথী একমুখ হেসে বলেছিলো, যাক! এতদিনে আমার ভাইটা বড়ো হয়েছে৷ আমি জানতাম যেদিন তুই সত্যিকারের বড়ো হবি, একমাত্র সেদিনই বাবার অর্থনৈতিক অবস্থাটা বুঝতে পারবি৷
দিদিভাই রাত্রি বেলাতেই মুখে চকলেট ললিপপটা খেতে খেতে বলেছিল,নিজেরটা দিলি … নাকি এটা আমার জন্য কিনেছিলি?
রাজদীপ দিদিভাই এর গালে চুমু খেয়ে বলেছিলো, নিজেরটা দিলাম৷ তোকে আমি সব দিতে পারি ৷ সাথী হেসে বলেছিলো, আর রক্ষা করবি না আমাকে? লজ্জা পেয়ে পালিয়ে এসেছিলো রাজদীপ৷
এনে খাবার… খেয়ে নে৷ আজ বোধহয় কোনো একটা উকিল আসবে তোর সাথে দেখা করতে৷ ভাবনার ছন্দে বিরতি ঘটলো রাজদীপের৷ লাল চালের ভাত,ডাল, রুটি..সবই বিস্বাদ৷ এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে রাজদীপ৷ প্রথম প্রথম নোনতা জলে মিশে যেতো মুখের গ্রাস৷ ইদানীং চুপ করে খেয়ে নেয়৷ কে আনবে উকিল ওর জন্য! বাবা বলেছে ,অকাল কুষ্মান্ড জেলেই পচে মরুক৷ মা শুধু কেঁদেছিল৷ দিদিভাই বলেছিল, কেন করলি এমন! ছি!
ওই একটা ছি-এর পর থেকেই বাঁচার ইচ্ছেটা ক্রমাগত তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা ৷ জেলে বইপত্র অ্যালাও আছে৷ কিন্তু পড়তে পারছে না রাজদীপ৷
ডায়রি খুলে বসেছে৷ হাবিজাবি লিখবে বলে৷ বাবা ওর এই ভুলভাল লেখা দেখে বলেছিলো, কমলা তোমার ছেলে মাইকেল মধুসূদন হবে৷ পড়া বাদ দিয়ে কাব্য লিখছে৷
না কাব্য রাজদীপ লিখতে পারে না৷ ও যেটা পারে সেটা হলো, কিছু অবাধ্য শব্দকে একই সূত্রে গাঁথতে পারে৷
ভালোবাসার জন্য একটা মন চাই৷ খুনিরাও ভালোবাসে৷ সব খুন প্রতিহিংসা থেকে হয় না৷ কিছু নিজেকে বাঁচাতে করতে হয়৷ সেই আবির রঙা বিকেলে, সেই চিত্তরঞ্জনের হিল টপ টিলার ওপরের অভিসন্ধিটা ধরতে পারেনি দিদিভাই৷ একমাত্র সাক্ষী ছিল রাজদীপ৷ না, সামলাতে পারেনি নিজেকে৷ চোখের সামনে দিদিভাইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেখে কি করে একটা ভাই নিশ্চুপ থাকতে পারে!
শেষ পর্যন্ত অবশ্য দিদিভাইও অবিশ্বাসী চোখে তাকালো ওর দিকে৷ তখনই শেষ হয়ে গিয়েছিল রাজদীপ৷ দিদিভাই-এর চোখের ওই ঘৃণা মিশ্রিত অবিশ্বাসটাই যথেষ্ট ছিল৷ না, জেলের এই অন্ধকার ঘরে কয়েদিদের সাথে থাকতে ওর কষ্ট হচ্ছে না, এই রকম খাবার খেতে ওর কষ্ট হচ্ছে না, শুধু কষ্ট হচ্ছে ওই দু-চোখে জল নিয়ে সাথীর বলা … ছি ওই শব্দটায়৷
ওর পক্ষের কোনো উকিল নেই৷ তাই কেসও কোর্টে ওঠেনি৷ উকিল নেই,নাকি ওর মতো অপরাধীকে কেউই আর নীল আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নিতে দেখতে চায় না৷ নিজের দিদির সাথে যে এমন করতে পারে তাকে বোধহয় শুধু অপরাধী বললেও কম বলা হবে৷
ভাবনার অতলে প্রবেশ করাটাই একমাত্র কাজ রাজদীপের৷ চূড়ান্ত অবসন্ন অবসরে…শুধু স্মৃতি ঘেঁটে যাওয়া৷ নিজের বন্ধ চোখের সামনে হঠাৎই আবিষ্কার করলো মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরে লুকিয়ে কাঁদা এক অসহায় ভাইকে৷ উনিশ বছরের ৫ ফুট লম্বা পুরুষ মানুষ ভেউ ভেউ করে কাঁদলে বিয়ে বাড়ির সকলেই লেগপুল করতে শুরু করবে৷ তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই বাথরুমে ঢুকে কেঁদে নিজেকে হালকা করে আসছিল৷ রাজদীপের এই ঘনঘন বাথরুমে যাওয়া আর মুখে চোখে জল দিয়ে আসাটা কেউই নজর করেনি৷ কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত ধরা পরেই গেল! হলদে রঙের শাড়ি, গোটা মুখে তখনো কাঁচা হলুদের ছোপ লাগা …আলতো করে কানের কাছে এসে বললো, তোর কি ডায়াবেটিস হয়েছে ভাই? এতবার বাথরুমে ঢুকছিস কেন?
কোথা দিয়ে জল বের করছিস?
তার চোখেও জল টলটল করছে৷ তবুও ভাইকে হাসানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল সাথী৷ অন্য ছেলেদের মতো একগাদা বন্ধু নিয়ে হুল্লোড় করতে পারে না রাজ৷ তার যত গোপন কথা সব দিদির কাছে৷ কবে কোন মেয়েকে দেখে প্রেম জেগেছিল মনে তাও শুনতে হয়েছে সাথীকে৷ সাথী বিয়ে করে চলে গেলে রাজদীপ যে একান্তই একা হয়ে যাবে সেটা আর কেউ না বুঝুক সাথী জানে৷
তার ভাইটার গোটা পৃথিবী জুড়ে শুধুই দিদিভাই৷
সাথী বলল, কৃষ্ণেন্দুর কোনো বোন আছে কিনা খোঁজ করবো তোর জন্য?
রাজ রেগে গিয়ে বলল, আর কয়েকটা দিন পরে বিয়ে করতে পারতিস! তখন তো বাবা বলেছিল…দেখতে এলেই কি বিয়ে হয়? লাখ কথার পরে নাকি বিয়ে হয়৷ কই দিদিভাই তোকে তো প্রথম দেখাতেই ওরা বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল৷ আর তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে এক পা বাড়িয়ে দিলি!
চিত্তরঞ্জন তো কত দূর বল! ইচ্ছে হলেই ছুটে যেতে পারবো না৷
দিদিভাই ভাইয়ের ঘন চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলেছিল, সে তো ওদের দেশের বাড়ি৷ কৃষ্ণেন্দু তো কলকাতায় ফ্ল্যাট বুক করেছে রে৷ মাত্র কয়েকমাস পর থেকেই আমি তোর খুব কাছেই চলে আসব৷ তাছাড়া আমার স্কুল তো কলকাতায়৷ তুই ছুটির সময় স্কুলের গেটে চলে যাবি… আমি আর তুই আড্ডা দিয়ে ফিরবো৷ কেউ জানতেও পারবে না৷
রাজদীপ চোখে জল নিয়েই হেসে বলেছিল, যেমন সেই স্কুল থেকে ফেরার সময় কয়েতবেলের আচার খাওয়াটা আজও মা জানে না ,তাই না?
তাহলে এতবড় ছেলে বোকার মতো কাঁদছিস কেন?
যা বাবার কত কাজ, তুই হেল্প কর৷ দিদিভাইকে সান্ত্বনা বাণী শোনার পর একটু হাসি ফুটেছিল রাজের মুখে৷ তবুও এত তাড়াতাড়ি এত চট করে দিদিভাই-এর বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিল না ও৷
বাবা বলেছিল, ঘর শত্রু বিভীষণ! ভালো সম্বন্ধ এসেছে … কোথায় বড়ো ভাই হয়ে এগিয়ে আসবে তা নয় ব্যাগড়া দিচ্ছে৷ ঘাড়ের ওপর সোমত্ত মেয়ে বসে থাকলে নাকি বাবা মায়েরা মরেও শান্তি পায় না৷
রেগে গিয়ে রাজদীপ বলেছিলো, দিদিভাই কারোর ঘাড়ে বসে খাচ্ছে না৷ বরং মাস গেলে দিদিভাই একগাদা টাকা এনে দিচ্ছে সংসারে৷
রাজদীপের সব অমতকে তুচ্ছ করেই সাথীর বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল মাত্র এক মাসের মাথায়৷ কৃষ্ণেন্দুদাকে এমনি দেখতে শুনতে মন্দ নয়৷ ভালো চাকরি করে৷ কিন্তু তবুও দিদিভাই-এর জন্য ঠিক পছন্দ হয়নি রাজের৷ ছেলেটা যেন সব সময় ডোমিনেট করে রাখতে চায় মানুষকে৷
দিদিভাইকে যদি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে না দেয়? রাজদীপরা মধ্যবিত্ত হতে পারে কিন্তু মেয়ের স্বাধীনতায় কখনো হস্তক্ষেপ করেনি রাজকমল বাবু৷ বরং রাজদীপ আর সাথীর মধ্যে কখনো কোনো পার্থক্য করতেও দেখেনি ও৷ বাবা ছেলের থেকে মেয়েকেই ভালোবেসেছে বরাবর৷
সেখানে কৃষ্ণেন্দুদার বাবা প্রথম দিনেই হাসতে হাসতে বললেন, চাকরি করা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি বটে কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে মাইনের অর্ধেক টাকা বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে!
রাজকমল বাবু হাত নেড়ে বলেছিলেন,এতদিন আমাদের মেয়ে ছিল আমরা নিয়েছি৷ কাল যখন আপনাদের বউমা হবে তখন কি আর আমাদের সেই অধিকার থাকবে!
বিয়ের পর কি তার মানে দিদিভাই আর রাজের থাকবে না! ওই বাড়ির বউ হয়ে যাবে!
রেগে মেগে চিৎকার করে রাজ বলেছিল, আমার দিদিভাইকে নিয়ে গিয়ে যদি কোনো অত্যাচার করে তাহলে সবাইকে খুন করে দেব আমি৷
বাবা বলেছিল, বংশের কুলাঙ্গার!
কেউই শোনেনি রাজদীপের নিষেধ৷ শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণেন্দু দত্তর সাথেই বিয়েটা হচ্ছে সাথীর৷ সেদিন সকাল থেকেই বারবার দু-চোখ ভরে উঠছিল নোনতা জলে৷ তবুও রাজদীপ নিজেকে সামলেছে দিদিভাই-এর সুখের কথা ভেবে৷
কনকাঞ্জলি দিয়ে মা যতটা কেঁদেছিল তার থেকে অনেক বেশি কেঁদেছিল রাজ৷ মনে হচ্ছিল ওর একান্ত কোনো দুর্মূল্য জিনিসকে কেউ কেড়ে নিয়ে চলে গেল৷
বুকের ভিতরের হাহাকার নিয়েই ঘরে ঢুকেছিলো রাজ৷ ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলতেই চোখে পড়লো, এক ড্রয়ার নানা রকম চকলেট৷ তার মধ্যে রাজের ফেবারিট চকলেট ললিপপটাও আছে৷
ওগুলোকে আঁকড়ে ধরেই কেঁদে ফেলেছিলো রাজ৷ দিদিভাই-এর সব দিকে খেয়াল৷ ছোটো থেকেই চকলেটের প্রতি ওর মারাত্মক লোভ৷ সেই লোভে আরো ইন্ধন জুগিয়েছে দিদিভাই৷ ওই ব্যাগ বোঝাই চকলেট সাপ্লাই দিয়েছে ভাইকে৷
বিয়ের ঠিক একমাস পরেই রাজদীপ খবর পেলো কৃষ্ণেন্দুদার নাকি একটা এফেয়ার আছে৷ বাড়িতে মেনে নেবে না বলেই ওই বয়েসে বড়ো অন্য কাস্ট-এর মহিলার সাথে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলেছে কৃষ্ণেন্দুদা৷ দিদিভাই-এর সরল মুখটা মনে পড়ে গিয়েছিলো রাজের৷ কৃষ্ণেন্দুদার নামে ওর করা প্রশংসাগুলোও৷ ইস! কি নিষ্পাপ ভাবে কৃষ্ণেন্দুদাকে বিশ্বাস করে চলেছে দিদিভাই৷ কথাটা যে সত্যি সেটা দু-দিন কৃষ্ণেন্দুদাকে ফলো করেই ধরে ফেলেছিলো রাজদীপ৷ শুধু দিদিভাই-এর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেনি৷
সেই সময়েই দিদিভাই-এর দেশের বাড়ি চিত্তরঞ্জনে যেতে হবে শুনেই দিদিভাই বলেছিলো, চল রাজ… তুইও ঘুরে আসবি৷ ওখানের আমলাদহী বাজার,হিল টপ টিলা…মাইথনেও ঘুরে আসবো সকলে৷
দিদিভাই-এর সাথে কয়েকদিন থাকা যাবে এই ভেবেই এক কথায় রাজি হয়েছিলো রাজ৷
কৃষ্ণেন্দুদার বারবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফোনে কথা বলা, মেসেজ লেখার ধরনগুলো কেন চোখে পড়ছে না দিদিভাই-এর! এটা ভেবেই রাগ হচ্ছিলো রাজের৷
আসুন আপনার কেস যিনি লড়বেন তিনি এসেছেন!
একজন মধ্যবয়স্ক উকিল অনেক ভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ঘটনার দিনের সব কথা৷ রাজ যাওয়া থেকে অ্যাকসিডেন্ট পর্যন্ত সবটা বললো উকিলকে৷
কালই কোর্টে উঠবে কেসটা৷ উকিল কিছুতেই বলতে চাইলো না কে ওনাকে নিযুক্ত করেছে৷
তাহলে কি শেষ পর্যন্ত রাজকমল বাবুই নিজের সম্মানের কথা ভেবে ছেলেকে ছাড়াতে চাইছেন দিন কুড়ি পরে!
কোর্টে যে মানুষটাকে বসে থাকতে দেখলো তাকে আর কোনোদিন সামনে দেখবে ভাবেনি রাজদীপ৷ সে বহুদিন আগেই কৃষ্ণেন্দু দত্তর স্ত্রী হয়ে গেছে৷ রাজদীপের দিদিভাই আর নেই৷
দিদিভাই ওর দিকে তাকাচ্ছে না৷ বাবা আর দিদিভাই দুজনে পাশাপাশি বসে আছে৷
সাক্ষী হিসাবে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে কাঠগড়ায় উঠলো কৃষ্ণেন্দু দত্ত৷
রাজদীপ মনে মনে বললো, মরেনি শুয়োরটা৷ মারতে পারেনি ওকে৷ দিদিভাই নিশ্চই যমের সাথে লড়াই করে স্বামীর প্রাণ বাঁচিয়ে এনেছে৷
এসব দেখার থেকে বিনা বিচারে জেলে পরে থাকা ভালো ছিলো৷ কারণ দিদিভাই বোধহয় আজ স্বামীর পক্ষ নিয়েই লড়বে৷ সেদিন কৃষ্ণেন্দুদাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে তুলতে দিদিভাই বলেছিলো, আমি তোকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না৷ আজ তুই আমার যে সর্বনাশ করলি … ছি! তোকে ভাই ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে৷
দিদিভাই-এর বলা লাস্ট কথাগুলো আজও কানে বাজছে৷
কৃষ্ণেন্দু বললো, আমি তো এখনো বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ করে আমার শান্ত শালাবাবু কেন আমার মাথায় অতবড়ো একটা পাথর ছুঁড়ে মারলো৷ মাথার পিছনে যে ভাবে লেগেছিলো, তাতে আমি বেঁচে আছি সেটাই ভগবানের দয়া৷
রাজদীপের উকিল প্রশ্ন করেছিলো, আপনার বিবাহিত জীবন কেমন কৃষ্ণেন্দু বাবু?
এক গাল হেসে ও বলেছিলো, ধুর মশাই! নতুন বিয়ের পর একথা কাউকে জিজ্ঞেস করা মানেই বোকামি৷ আমার সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী৷ আমার সাথে দারুণ বন্ডিং৷
উকিল বললো, তাহলে আপনি প্রায়ই অফিস ছুটির পরে গড়িয়াহাটের ফ্ল্যাটে কি করতে যান?
চমকে উঠে ঢোক গিলে কৃষ্ণেন্দু বললো, আমার এক দূর সম্পর্কের রিলেটিভ একা থাকে তাই খোঁজ খবর নিতে…
এই রিলেটিভের কথা নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীও জানেন! তিনিও নিশ্চয় চেনেন ওই রিলেটিভ কে?
এবার তোতলাচ্ছে কৃষ্ণেন্দু৷
তবুও সামলে নিয়ে বললো, এই অ্যাক্সিডেন্টের সাথে ওই ফ্ল্যাটের কি সম্পর্ক আছে? অকারণ ওসব টানছেন কেন?
আছে আছে মিস্টার দত্ত! এই দুর্ঘটনার সাথে ওই মহিলার অনেকটা সম্পর্ক আছে৷
তো সেদিন হিলটপে আপনারা কি করছিলেন?
আমার শালা বাবু প্রথম আমাদের দেশের বাড়ি গিয়েছিলো তাই সাথী আর আমি ওকে চিত্তরঞ্জন ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছিলাম৷
আমরা সবাই ছবি তুলেছিলাম, চিপস খাচ্ছিলাম… হঠাৎই আচমকা রাজদীপ আমার মাথায় পিছন থেকে আঘাত করতে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই৷
শুধু দেখেছিলাম ওর চোখে খুনির দৃষ্টি আর হাতে বড়ো পাথর৷ হয়তো ওখান থেকেই কুড়িয়ে নিয়েছিলো৷
সাথী দত্তকে ডাকা হয়েছে সাক্ষী দিতে৷
রাজদীপের মনে হলো, কয়েকযুগ পরে সে তার প্রাণভ্রমরাকে সামনে দেখলো৷ তার দিদিভাই, তার আদরের দিদিভাই৷
কিন্তু দিদিভাই ভেবেছে, রাজদীপ হিংসা থেকে এটা করেছে৷ হয়তো কৃষ্ণেন্দুর সাথে বিয়েতে ওর আপত্তি ছিল বলেই ওকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো৷
সাথী প্রথমে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো৷ ওর চোখ দুটো স্থির হয়ে গেছে রাজদীপের দিকে৷ ছেলেটা কয়েকদিন না খেয়ে খেয়ে যেন অনেকটা রোগা হয়ে গেছে৷ দাড়িতে মুখটা ভরে গেছে৷
সাথী বলতে শুরু করলো, ওই দিন আমার স্বামী আমাকে মারতে চেয়েছিলো৷ বাড়ির লোক ভাবতো আমি অসাবধানে পরে গিয়ে মরেছি৷ তারপর ওকে আর কেউ বিয়ের জন্য জোর করতো না৷ আর গড়িয়াহাটের ওই মহিলার কাছে যাওয়াটা হয়ে যেত অবারিত দ্বার৷ একি বলছে দিদিভাই! দিদিভাই জানলো কি করে যে কৃষ্ণেন্দু সেদিন সাথীকে উঁচু টিলা থেকে নিচে ফেলে দিতে চেয়েছিলো!
কৃষ্ণেন্দু বললো, ভাইকে বাঁচাতে তুমি এভাবে চক্রান্ত করতে পারলে সাথী?
সাথী মোবাইল খুলে বের করলো বেশ কয়েকটা ছবি৷ দিদিভাই তখন সেলফি তুলছিলো৷
সেই সেলফিতেই ধরা পড়েছে কৃষ্ণেন্দুদার ঠেলে ফেলে দিতে আসা হাতটা৷
প্রিন্ট আউট জমা দিলো উকিল৷
দিদিভাই বললো, আমার ভাইয়ের প্রতিটা রক্ত কণিকার চলাফেরা আমি চিনি৷ যে ছেলে কখনো ইঁদুর মারতে পারে না সে হঠাৎ মানুষ মারতে যাবে কেন?
তখন কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে হসপিটালে যমে মানুষে টানাটানি চলছিলো, তাই এসব কিছু আমার মাথায় কাজ করেনি৷ ভাই অ্যারেস্ট হয়েছে৷ কৃষ্ণেন্দুর বাবা টাকা খাইয়ে কেসটা ঝুলিয়ে রেখেছিলো৷
কৃষ্ণেন্দু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকেই অনবরত মনে পড়ে গেছে, দিদিভাই ললিপপের দিব্যি আমি তোকে রক্ষা করব৷ তখনই ছবিগুলো দেখতে দেখতে আবিষ্কার করি খুনির হাত কোনটা! তারপর খোঁজ নিতে গিয়ে ওর অবৈধ রিলেশনটার কথাও জানতে পারি৷ এমনকি ফোনে ওর কথাও শুনি,তার রেকর্ডিংও আছে…
কৃষ্ণেন্দু বলছে, চেষ্টা তো করলাম মলি… হিল টপ থেকে সাথীকে ফেলে দেবার৷ কিন্তু শালা ভাইটা সব ভেস্তে দিলো৷
সেদিন দরজার ফাঁক থেকে ওর এই কথাগুলো রেকর্ড করেছিলাম আমি৷ কৃষ্ণেন্দু বুঝতে পারেনি৷ তাহলে হয়তো আরেকবার চেষ্টা করতো ওর পৃথিবী থেকে আমাকে সরাতে৷
দিদিভাইএর চোখে জল৷ আমার ভুল বোঝার জন্য আমার ভাইটা কষ্ট পেল৷
জেল হয়ে গেল কৃষ্ণেন্দুর৷ স্ত্রীকে খুন করতে যাওয়ার প্রচেষ্টার কারণে৷
দিদিভাই-এর হাত ধরেই জেল থেকে বেরোলো রাজদীপ৷
দিদিভাই বাবার চোখ বাঁচিয়ে রাজের হাতে দিলো ওর ফেবারিট চকলেট ললিপপ৷
কানের কাছে এসে দিদিভাই বললো, হ্যাপি চকলেট ডে ভাইসোনা৷
রাজদীপ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ললিপপের দিব্যি বলছি, তোকে আমি রক্ষা করব সবসময়৷