Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প391 Mins Read0

    ০২. হঠাৎ একদিন

    ০২. হঠাৎ একদিন

    হারভার্ডের জীবন শেষ হওয়ার পর ভাবি এবার কোথায়! কোন দেশ? কোন শহর! কোথাও দাঁড়াতে চাই, পায়ের তলায় মাটি চাই। যাযাবর জীবনের ইতি বারবার টানতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি, আর যেন ব্যর্থ না হই। বাংলার মেয়ে বাংলায় ফিরবো। দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন আমায় তাড়া করে, আমার পায়ে পায়ে হাঁটে, সেঁটে থাকে গায়ে। এত কিছু ঘটে গেল বাংলায়! বই নিষিদ্ধ, অবান্তর কুৎসা, নিন্দা, তারপরও বাংলায় ফেরার ইচ্ছে। বিশুদ্ধ জল হাওয়া, ঝলমলে নগর, নিরাপদ জীবন ফেলে কলকাতায় ফিরি। বিদেশ থেকেই ট্রায়াংগুলার পার্কে একটি আসবাবওয়ালা বাড়ি এক মাসের জন্য ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারটা পাকা করে, তবে। হোটেলে থাকার আর একদমই ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে কি কোনওকালে ছিল। উপায় ছিল না বলে থাকতে হয়েছে। ট্রায়াংগুলার পার্কের বাড়িতে মানুষে, কোলাহলে, বন্ধুতে, ব্যস্ততায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে পুরো একমাস কাটাই। খোঁজ করতে থাকি একটি বাড়ির যেখানে অস্থায়ী নয়, রীতিমত স্থায়ী বাস করব, যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন। স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে থাকে, সেইসব অচিন দেশের অচিন পাখির অচিন পাখা। অতিকায় সব পাখা আমাকে অদৃশ্য করে ফেলে।

    সুইডেনের ভারতীয় দূতাবাসে আমার লেখা পছন্দ করেন এমন একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন, কেন ছিলেন কে জানে! ভিসা করতে গেলে দিব্যি আমাকে ‘এক্স ভিসা দিয়ে দিলেন, যেটির, পরে জেনেছি, মেয়াদ ছমাস অন্তর অন্তর বাড়িয়ে অনন্ত কাল ভারতে থাকা যায়। এখন থেকে আর পর্যটক নই, রীতিমত বাসিন্দা আমি। কত শত স্বপ্ন মনের উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলে, হঠাৎ যে কখন কোন্ ঘরটা কেনা হয়ে যায়, কোন্ স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।

    এক সকালে কলকাতা বিমান বন্দরে নেমেই কোনো একটা নম্বরে ফোন করে বাড়ি ভাড়া নেব, এক্ষুণি এই মুহূর্তে বললে ওপারের অচেনা এক কণ্ঠস্বর থেকে এক থোকা বিস্ময় ঝরে পড়ে। এভাবে বাড়ির কিছুই না দেখে বাড়ি ভাড়া কেউ নিয়েছে বলে তার জানা নেই। ধুলোধূসরিত খালি বাড়িতে খালি হাতে উঠে তোশক বালিশ খাট সোফা বাসন কিনে নিয়ে আসি, হ্যাঁ সেই সকালেই, সেদিনই। কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে, কোথায় আসবাব পত্র, কোথায় চাল ডাল, সে ধারণা দেওয়ারও অবশ্য লোক ছিল না। প্রশ্ন করলে, যারা ঘিরে থাকে, আমি নামী বলে, বা আমি আমি বলে সবাই অপ্রস্তুত হয়, উত্তর নেই, অথবা ভুল উত্তর। সংসার ওই ভুল দিয়েই শুরু হয় আমার। আমার কলকাতার সংসার।

    দু’দিনেই বাড়ি বাসযোগ্য করে ফেলি। চারদিনে সাজানো। সাতদিনে ঝলমলে। ছ’মাসে মনে হয় তিরিশ বছরের সংসার। বারান্দায় শৈশবের সব ফুল। নানা রঙের ফুল ফুটে সুবাস ছড়াতে থাকে বাড়িময়। রাতে হাসনুহেনার গন্ধে বাড়ি ভেসে যায়। প্রায়ই একটি হাসনুহেনার টব শিয়রের কাছে এনে রাখি। ঘ্রাণ শুকতে শুকতে শৈশবে যেমন ঘুমোতাম, তেমন ঘুমোই। শহরের মধ্যিখানে চমৎকার বাড়ি। নিরাপদ বাড়ি। ঠিক রাস্তার ওপরে নয়। দুদুটো লোহার ফটক পেরিয়ে, দারোয়ান পেরিয়ে তবে ভেতরে ঢুকতে হয়। খোলা বারান্দা। মশলার সুগন্ধ ভেসে আসে রান্নাঘর থেকে, বারান্দায় অল্প অল্প উড়তে থাকে শুকোতে দেওয়া কাপড়। কী আশ্চর্য সুন্দর এই দৃশ্য! কতকাল আমি আমার শৈশব কৈশোরকে এত কাছ থেকে দেখি না। আলোয়, হাওয়ায় বাড়িটি সত্যিকার বাড়ি হয়ে ওঠে। আমার সাত নম্বর রাওডন স্ট্রিটের বাড়ি।

    শহর আগের মতোই, তবে দীর্ঘদিনের বন্ধুটি নেই শহরে। যে বন্ধু সুসময়ে দুঃসময়ে ঠিক একই রকম পাশে থাকতেন, যাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময় কথা বলা যেত, সেই নিখিল সরকার, নেই। সেই অথৈ সমুদ্র, সেই নিমগ্ন সাধক, সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই। জগৎ আমার, টের পাই, ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কী রকম খালি হয়ে যাচ্ছে। মাও নেই, বাবাও নেই, নিখিল সরকারও নেই। আত্মীয় স্বজন থেকেও নেই, চেনা পরিচিত লোকদের বন্ধু বলে ডাকি। ঘন ঘন দেখা করতে আসা ভক্তদেরও বন্ধু বলি। তাড়াহুড়ো করে একটা তাসের ঘরের মতো কিছু গড়ে তুলছি কি! মাঝে মাঝে সবকিছুকে অদ্ভুত এক মায়া, রহস্যের জালের মতো মায়াবি এক জাল অথবা জীবন নিয়ে নিতান্তই বালখিল্য রসিকতা বলে মনে হয়।

    রাওডন স্ট্রিটের বাড়ির দুয়ার সবার জন্য খোলা। সবার জন্য, এমন কী অচেনা মানুষের জন্যও আপ্যায়নের অন্ত নেই। আতিথেয়তা আমার অন্তরে। কত ঠিক-মানুষ, কত বেঠিক মানুষ, কত ভুল, কত ধূর্ত আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছে। কাউকেই বেঠিক বা ভুল ভাবতে আমার ইচ্ছে করেনি। আজও করে না। এরকমই আমি। এরকমই সাদাসিধে আর নিরীহ। ঘরের পোশাকে আর হাওয়াই চপ্পলে হেঁটে হেঁটে দিব্যি ঘুরে বেড়াই শহর। ফুটপাত থেকে সস্তা জিনিস পত্তর কিনি। গড়িয়াহাটের বাজার থেকে বেড়ালছানা তুলে এনে আদরে আহ্লাদে বড় করি। সাদামাটা ধুলোবালির জীবন। আবার এই জীবনই মুহূর্তে ঝলমলে হয়ে উঠতে পারে। বই মেলায় স্টলের দরজা বন্ধ করে রাখতে হয় ভিড় ঠেকাতে। পুলিশের লাঠিচার্জের দরকার হয় ভক্তদের উন্মাদনা দূর করতে। তারপরও পাঠকদের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাহিত্যজগতের মাতব্বরদের সঙ্গে ওঠা বসা নেই মোটেই। কাউকে দাক্ষিণ্য দেওয়া বা গুরু মানা আমার স্বভাবে নেই। সত্য কথা কোনও রাখঢাক না। করে বলে দেওয়া, মাতব্বরদের, শুনেছি, একেবারেই পছন্দ নয়। নিভৃতে আমি বাস করি আমার মতো। দেশি জীবনের বাইরেও আরেক জীবন আছে। পশ্চিমের দেশে যেতে হয় ঘন ঘন। অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে বা বক্তৃতা দিতে, বা পুরস্কার নিতে। কোনও না কোনও আমন্ত্রণ থাকেই। শুধু পশ্চিমের দেশেই ভালো ঘটনা ঘটছে, তা বলবো না। ভালো কিছু কলকাতাতেও ঘটে। ব্যাগ ফিল্মস আমার ‘ফরাসি প্রেমিক’-এর গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য চুক্তিপত্রে সই নিয়ে যায়, কণিমাইটের টাকাও দিয়ে যায়। খুব ঘটা করে আমার লেখা ভূমিকা সম্বলিত শত বছরের রবিবাসরীয় গল্পগুলোর নির্বাচিত একটি সংকলন বের হয় ‘আনন্দ’ পাবলিশার্স থেকে। ‘আনন্দ’ আমার লেখা বইগুলোর সমগ্র করার জন্যও উদ্যোগ নেয়। আমার ‘শোধ’ গল্পটি নিয়ে টেলিভিশনে এক মাসের একটি সিরিয়াল দেখানো হয়। অন্য সব সিরিয়ালের চেয়েও জনপ্রিয় হয় এটি। মেগা সিরিয়ালের গল্প লেখার জন্য আমন্ত্রণ জোটে। লিখতে থাকি মেগাসিরিয়ালের গল্প। গল্পের নাম দিই ‘দুঃসহবাস’। ওদিকে সুটিংও হতে থাকে। ‘ফেরা’ গল্প নিয়ে অনেকদিন হল নাটক হচ্ছে। বিভিন্ন মঞ্চে। গিরিশ মঞ্চে, মধুসূদন মঞ্চে, রবীন্দ্র সদনে সেই নাটক দেখি। তা ছাড়া বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের অসাধারণ সব নাটক দেখাও হয়। একবার নান্দীকার আয়োজন করলো নাট্যসপ্তাহের, সেইসব নাটক শেষ হলে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আমাকে মঞ্চে ডাকতেন যেন বিজয়ী কলা কুশলীদের মাল্যদান করি। নিজেকে কলকাতার সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক জগতের একজন মনে হয়। কখনও মনে হয় না আমি কলকাতার লোক নই, আমি অন্য দেশ থেকে এসেছি। সেই কিশোরী বয়স থেকেই তো কলকাতার সঙ্গে সখ্য আমার। সেকালে সেঁজুতিতে যাদের কবিতা ছাপাতাম, অথবা যাদের লিটল ম্যাগে আমার কবিতা ছাপা হত, একদিন ওদের যে ক’জনেরই খোঁজ পাওয়া যায়, সবাইকেই আ আর রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করি বাড়িতে। কেউ এখনও লিখছে, কিন্তু যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ তান্ত্রিক হয়ে গেছে, কেউ ব্যবসায়ী, তারপরও পুরোনো দিনগুলো ফিরে পেতে চাওয়ার আকুলতা আমি টের পাই আমার ভেতর। দেশ থেকে দাদা আসে। ঝুনু খালা আসে। দাদার ছেলে শুভও বেড়াতে আসে। সবাইকেই আদরে ডুবিয়ে রাখি। আর কলকাতা দিতে থাকে আমাকে দুহাত ভরে। সকালে বাংলা খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ কোথায় আর পেতাম জগতে। বিকেলে কোনও একটা বাংলা ম্যাগাজিন, বা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়া। সন্ধেয় বাংলায় আড্ডা আর রাতে এক গুচ্ছ বাঙালি মিলে হৈ হৈ করে বাঙালি খাবার! তাছাড়া তো আছেই টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করার আমন্ত্রণ। আর আছে বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করা। নানা লেখক কবির বইএর ফিতে কাটা। বিভিন্ন মঞ্চে কবিতা পড়া। আর ‘ধর্ম মুক্ত মানববাদী মঞ্চ’ নিয়ে স্বপ্ন দেখা। বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্ম কিন্তু ধর্মমুক্ত মানুষদের জড়ো করে একটি মানববাদী সংগঠন গড়ে তুলি, নিজেকে ইচ্ছে করেই রাখি নেপথ্যে। সংগঠনের উদ্দেশ্য সত্যিকার ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা এবং আইন প্রতিষ্ঠা করা, মেয়েদের শিক্ষিত আর স্বাধীন করা, মসজিদ মাদ্রাসার উৎপাত বন্ধ করা। পশ্চিমবঙ্গের আনাচ কানাচ থেকে আগ্রহীরা জড়ো হতে থাকে। অন্ধকারে পড়ে থাকা মুসলমান সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ নিই, খুব ছোট বটে দল, কিন্তু স্বপ্ন ছোট নয়। বাতি খুব উজ্জ্বল, কিন্তু সব আঁধার ঘরে, সব অন্ধকার গলিতে পৌঁছে দেবার লোকবল নেই। না থাকুক, কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠান করা, লিফলেট বিতরণ, মিটিং মিছিল চলতে থাকে।

    দৈনিক স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম লিখি। এক একটি কলাম হাজার বছরের সংস্কার ভেঙে নতুন সময়ের দিকে, নারী পুরুষের সমতার দিকে, একটি সুস্থ সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখাতে দেখাতে হাত ধরে নিয়ে চলে। নিখিল সরকার নেই, তবে শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত আর প্রশান্ত রায়-এর সঙ্গে হয় সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক আলোচনা। একদিন ঘটা করে মরণোত্তর দেহদানও করে ফেলি। মরে গেলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা পড়বে শরীর। দুটো চোখ আর দুটো কিডনি চলে যাবে যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছে। দেশের নানা রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ এলে ঘুরে আসি, বইয়ের উদ্বোধন, নয়তো ভাষণ। যেখানেই যাই একদিকে ভক্তের ভিড়, আরেকদিকে মৌলবাদী বিক্ষোভ। কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মহারাষ্ট্র, দিল্লি। বাকি জীবন কলকাতায় থাকবো, এতে কোনো দ্বিধা নেই বলে একটা গাড়ি কিনে ফেলি একদিনের নোটিশে। বাড়িও কিনি, চমৎকার একটা দোতলা বাড়ি।

    এক উঠতি কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এক ডাক্তারের সঙ্গেও অদ্ভুত একটাঅমীমাংসিত সম্পর্ক গড়াতে থাকে। এমন সময় সেই দিনটি আসে, কালো সেই দিনটি।

    বাড়ি থেকে অনেকদিন বেরোই না। অনেকদিন একটানা বসে থেকে ভালোও লাগছিল না। ডক্টর ইনাইয়া বলছিলেন হায়দারাবাদে আমার ‘শোধ’ বইটা বেরোচ্ছে, তাঁর স্ত্রী অনুবাদ করেছেন, যেন যাই একবার ওখানে, বই উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতায়। এর আগে দুবার তিনি আমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া বা আমার বক্তৃতা শোনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, যেতে রাজি হইনি। এবার রাজি হয়েছি। রাজি হওয়ার কারণ বোধহয় নতুন জায়গা, আমার একটু হাওয়া পাল্টানো, একটুখানি কলকাতার একঘেয়েমি কাটানো। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরবো, কোনও সুটকেস, কোনও টুথব্রাস, কোনও কাপড় চোপড় নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নীল শিফনের একটা শাড়ি পরে নিলাম। ইস্ত্রিও করা নেই। দলামোচা হলেও খুব একটা বোঝা যায় না। আর গেলেই বা কী! কাপড় চোপড় নিয়ে মাথা আমি ঘামাই না। সাজগোজ নিয়েও না। একসময় তো লিপস্টিক পরাও বাদ দিয়েছিলাম। এখন চুলটা এলোমেলো হলে একটুখানি আঁচড়াই আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পরি, এতে শুকিয়ে চড়চড় হওয়া থেকে ঠোঁটের বাঁচা হয়।

    হায়দারাবাদ বিমান বন্দরে নেমে ডক্টর ইনাইয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক হই। নিরাপত্তা-পুলিশ কোথায়! ভেবে নিই, পুলিশ অনুষ্ঠানে থাকবে, বিমান বন্দরে আসেনি। ঝকঝকে একখানা গাড়িতে আমাকে উঠিয়ে হোটেলে নিয়ে গেলেন ইনাইয়া। পাঁচতারা হোটেলের একটা ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন অনুষ্ঠানের আগে আমার বিশ্রামের জন্য। ঘরটা সুন্দর। বিছানায় শুয়ে একটুখানি টেলিভিশন দেখি। উঠে চা বানিয়ে খাই। এরমধ্যেই ফোন। কী, নিচে নামতে হবে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান কোথায়, কী ধরনের অনুষ্ঠান, তার কিছু আমি জানি না। ইনাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে কড়া অস্ত্রের উচ্চারণে তিনি ঠিক কী বলেন বা বলতে চান, তার বেশির ভাগই বুঝতে পারি না। জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ প্রোটেকশন রাখেন নি?

    ইনাইয়া এর উত্তরে কী বললেন, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হল না।

    ‘যে রাজ্যেই যাই, আমার জন্য তো নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়। আপনি করেননি?’

    এবার যা বললেন, তা খুব কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করে যেটুকু উদ্ধার করতে পারলাম, তা হলো–‘করিনি.. হে হে। ছোটখাটো অনুষ্ঠান। তেমন প্রচার হয়নি। খামোক পুলিশের ঝামেলা করার দরকার কী!’

    ‘ও। আসলে ঝামেলা করতে নয়, পুলিশ প্রোটেকশন বরং ঝামেলা এড়াতেই রাখতে হয়।‘

    ‘হে হে।‘

    আমি জানিনা ইনাইয়াকে কেন স্মরণ করিয়ে দিলাম না যে এই হায়দারাবাদে আমি গত দু’দুবার আমন্ত্রণ পেয়েও আসা বাতিল করেছি, তার একমাত্র কারণ এ শহরকে আমি নিরাপদ বলে ভাবিনি। কারণ মুসলমানরা এ শহরে আমার বিরুদ্ধে এর আগে কিছু হৈ চৈ করেছে, কাগজে পড়েছি বইয়ের দোকান ভাংচুর করেছে আমার লজ্জা বিক্রি করছিলো বলে। আমার ভুলো মন। ভুলেই হয়তো গিয়েছিলাম এ শহরে মুসলমানের সংখ্যা অন্য অনেক শহরের তুলনায় বেশি। মুসলমানের সংখ্যা বেশি হলেই মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা বেশি হওয়ার আশংকা থাকে। মৌলবাদীরা আমাকে বহুবছর ইসলাম-বিরোধী খেতাব দিয়ে বসে আছে। সব মোছা যায়, এই খেতাব মোছা যায় না। আমার নাস্তিকতা, আমার মানববাদ, আমার বিজ্ঞানমনস্কতা, আমার মানবতা কিছুই মানুষের মস্তিষ্কে গভীর করে গেঁথে যাওয়া ‘আমি ইসলাম-বিরোধী এই বিশ্বাসের কাঁটাটি উপড়ে ফেলতে পারেনি।

    অনুষ্ঠান হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। উদ্বোধন হলোবইয়ের। আমার ‘শোধ’ উপন্যাসের তেলুগু অনুবাদ। একজন তেলুগু লেখক এবং একজন অনুবাদক নিজেদের লেখা এবং অনুবাদ সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আমি বললাম মানবাধিকার বিষয়ে। ‘শোধ’ নারীবাদী বই। শোধের প্রধান চরিত্র ঝুমুর নিজেকে পুরুষের সম্পত্তি হতে দেয়নি, প্রতিবাদ করেছে। নারী যে পুরুষের বা সমাজের সম্পত্তি নয়, এ কথাই চিরাচরিত কোমল কণ্ঠে বললাম। আমার কণ্ঠস্বর কিছুতেই ‘মিছিলের ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ বলা মেয়েদের মতো হয়ে ওঠে না। শান্ত, শিষ্ট, নম্র, নরমই রয়ে যায় যতই ক্রুদ্ধই হই না কেন, যত কঠিন কথাই বলি না কেন!

    অনুষ্ঠান শেষে বেরোবো দুপুরের খাবার খেতে, তখনই ঘটনাটি ঘটে। প্রেস ক্লাবের সামনের দরজা দিয়ে কিছু লোক ভিতরে ঢুকে তেলুগু ভাষায় চিৎকার করতে করতে আমার দিকে এগোতে থাকে। চিৎকার করে কী বলছে তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমার দিকেই বা এগোচ্ছে কেন, তাও জানি না। হঠাৎ দেখি, হাতের কাছে যা পাচ্ছে, ফুলের তোড়া, বই, ব্যাগ, চেয়ার–সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে আমাকে লক্ষ্য করে। ঠেকাতে গিয়ে ক’জন আহত হলেন। সাংবাদিকরা ব্যস্ত ক্যামেরায় ছবি তুলতে। আমি ওদের পেছনে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমার গায়ে কী এসে লাগল, নিয়ে ভাবছিলাম না। ভাবছিলাম, ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যু থেকে কী করে বাঁচবো আমি। কেউ একজন আমাকে টেনে পেছনের দরজার কাছে নিয়ে গেল, ক্লাবঘর থেকে আমাকে বের করে নেবে, গাড়িতে ওঠাবে। আক্রমণকারীরা তখন পেছনের দরজার দিকে দৌড়ে আসছে। বুঝে যাই, গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। পেছনের দরজাটি আমি দ্রুত বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জোরে লাথি মেরে দরজার কাঁচ ভেঙে ফেললো ওরা। কী করে বাঁচবো, এই ভাবনা মাথায়, অন্য সব ভাবনার লেশমাত্র কিছু নেই কোথাও। দৌড়ে যাই সামনের দরজায়। না, ওদিক দিয়েও বেরোনোর কোনও উপায় নেই। প্রেস ক্লাব ঘিরে ফেলেছে আক্রমণকারীরা। সামনের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল। ক্লাব ঘরটার ভেতর আমি আর কিছু নিরীহ নারী। দু’একজন পুরুষও সম্ভবত ছিলেন। ওঁরা ভাঙা দরজার সামনে চেয়ার ফেলে উঁচু বাঁধ তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমাকে বললেন থামের আড়ালে লুকোতে। কেউ বললেন টেবিলের তলায় ঢুকে যেতে। কিন্তু ফাঁকা ঘরটার মধ্যে যেখানেই লুকোই আমি, বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়লে আমাকে হাতের মুঠোয় পেয়েই যাবে ওরা। বাইরে বিকট শব্দে তখন জানি না ক’জন লোকের স্লোগান চলছে, ‘ নাসরিন মুর্দাবাদ’। স্লোগান ছাড়াও অন্য চিৎকারের শব্দ। এমন সময় মঞ্চের নীল পর্দার পেছনে যে একটি গোপন দরজা ছিল, শুনি সেটি খোলার চেষ্টা চলছে বাইরে থেকে। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে পেয়ে যাবে চোখের সামনে। আবার থামের আড়াল থেকে অন্য আড়ালে দাঁড়ালে বাঁধ দেওয়া দরজা ভেঙে ঠিকই খপ করে ধরে ফেলবে আমাকে। বাঁধের দরজা ভাঙতে বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছিলেন সাংবাদিকরা। নিজেরা আহত হয়েও ঠেকাতে চাইছিলেন ওই ভয়ংকর মারমুখো লোকদের। ছবি তোলা বাদ দিয়ে অনেকে তখন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। মৃত্যু যে কোনও মুহূর্তে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াবে। মুহূর্তগুলো আমার বুকের ভেতর ঢং ঢং করে বাজছিল। যে কোনও সময় শেষ মুহূর্তের ঘণ্টা বাজবে। অসহায় আমি ঘরটির মধ্যে এক আড়াল থেকে আরেক আড়ালে যাচ্ছি। শখ করে পরা গলার মঙ্গলসূত্ৰ কখন ছিঁড়ে পড়ে গেছে, খেয়াল করিনি। কেউ জানে না, কী করে বাঁচানো যাবে আমাকে। দরজার বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের ভীষণ, বিকট আওয়াজের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন ঘরের কয়েকজন। যে কোনও মুহূর্তে ধাক্কা খেয়ে ওঁরা উল্টে পড়বেন। বাইরের চিৎকার আর স্লোগানের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বুকের ভেতরে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজেই চলেছে। অনুরোধ করে যাচ্ছি কেউ যেন একবার পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু কে দেবে? সকলেই উদভ্রান্ত। এমন ঘটনা কোনোদিন তাঁরা চোখের সামনে ঘটতে দেখেননি। ছুটোছুটি। কারও কারও আর্ত চিৎকার। যখন প্রাণে মারা হবে আমাকে, কিছু বুলেট ছিটকে গিয়ে বা ছুরির কোনো অংশ বেকায়দায় ওদের পেটে পিঠে লেগে গিয়ে ওঁরা আবার আহত হন কি না, এ নিয়ে কী ওঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কে জানে। প্রথম দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দৃশ্যগুলো দেখতে থাকলেও বিস্ফোরণের আশংকা করে আয়োজক এবং দর্শকের মধ্য থেকেও অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আমি একা পড়ে যাচ্ছি। ক্রমশ দেয়ালের দিকে যাচ্ছি। আর কোনও আড়াল নেই সামনে। আমার মনে হতে থাকে ডানদিকের দরজা ভাঙা প্রায় বুঝি সারা, মনে হতে থাকে বাঁ দিকের দরজায় বাঁধের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে হত্যাকারীরা। কয়েকটা লাথি, কয়েকটা ধাক্কা, তাহলেই উল্টে পড়বে উঁচু করে রাখা চেয়ারগুলো। পা পা করে এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। আর অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি পুলিশের আওয়াজ পেতে। না, পুলিশ ত্রিভুবনে নেই। কেউ জানে না কী ঘটছে হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। আমার যে চোখ ফেটে জল আসবে তাও আসছিল না। শরীর শিথিল হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়বে, তাও পড়ছিল না। হত্যাকারীদের সঙ্গে যদি পিস্তল থাকে। গুলি ছুড়বে। যদি ছুরি থাকে, কুপিয়ে মারবে। আর, কিছু যদি না থাকে, মাথায় আঘাত করবে লোহার চেয়ারগুলো দিয়ে। নয়তো পিষে মারবে পায়ের তলায়। এরা তো অনেকজন। আমি একা। ক্রমশ একা হচ্ছিলাম। ঢং ঢং শব্দ আরও বিকট স্বরে বাজছিল। আমি তো জানি এরাই ফতোয়া দেয় আমার বিরুদ্ধে। এরাই মাথার দাম ঘোষণা করে, এরাই চিৎকার করে মুন্ডু চায়, এরাই ফাঁসির দাবিতে পথে নামে, এরাই ক’দিন পরপর আমার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়, বই পোড়ায়। এর আগে কোনোদিনই এরা এতটা হাতের কাছে আমাকে পায়নি। এরা এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারে আমাকে। যে কোনও মুহূর্তেই এখন আমি দেখতে পাবো জীবনের শেষ মুহূর্তকে। মৃত্যু ঠিক কী রকম। খুব কষ্ট হবে কী! এরা কি বুকে বা মাথায় গুলি করবে, নাকি কেটে কেটে কষ্ট দিয়ে দিয়ে ধর্ষণ করে করে পিষে পিষে মারবে।

    হঠাৎ পুলিশ এলো। ওই ভাঙা দরজার বাঁধ ভেঙে পুলিশ ঢুকলো, হত্যাকারী ঢোকার আগে। আমার নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ওরাই করলো। দেয়ালে সেঁটে থাকা আমার পাথর শরীর অথবা অস্থির শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল, মুষ্ঠি আলগা হল হাতের। শুনলাম মৌলবাদীদের ভোলা হচ্ছে পুলিশের ট্রাকে। তারপর আমাকেও নিরাপত্তার শক্ত বেষ্টনীতে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল, দ্রুত আড়াল করা হল। শুভাকাঙ্খীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

    এর মধ্যে মৃত্যুর মুখটি তো আমার দেখা হয়ে গেছে। ওরা যখন হত্যা করে, ওভাবেই করে। সব তছনছ করে। জানিয়ে শুনিয়ে দেখিয়ে। পয়গম্বরের নাম নিতে নিতে। পতাকা ওড়াতে ওড়াতে। আজ আমার অলৌকিক বেঁচে যাওয়া। জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান ছিল এক সুতোর। আমার আশংকা মৃত্যু আমার ওভাবেই হবে কোনও একদিন। কোথাও যখন আমি কবিতা পড়ছি, কোথাও যখন আমি মানবতার কথা বলছি, অতর্কিতে কেউ আমার হৎপিন্ড ফুটো করবে।

    কী দোষ করেছি আমি? ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নির্যাতন, আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে কথা বলা কি অন্যায়? মানবাধিকার আর মানববাদের পক্ষে দাঁড়ানো কি অন্যায়? ঘৃণার আগুনে আমাকে যে করেই হোক তারা পুড়িয়ে মারবে। কেন, কার কী ক্ষতি আমি করেছি?

    আমাকে জীবন দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। শুধু ভারতবর্ষ থেকেই নয়, ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও পেয়ে যাচ্ছি যুক্তিবাদী, মুক্তবুদ্ধি আর শুভবুদ্ধির মানুষের সমর্থন। চোখে আমার জল এসেছে মৌলবাদীদের আক্রোশ আর তাদের বিষ দাঁত দেখে নয়। যখন বিধ্বস্ত আমি, যখন মৃত্যুর গুহা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে আনা হল, যখন শুনছিলাম কারও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘ভালো আছো তো? বা আমি তোমার সঙ্গে আছি, বা আমরা তোমার পাশে আছি, তখন এসেছে চোখে জল।

    আমার আর একা লাগে না। জানি আমরা সংখ্যায় বেশি, আমরা, যারা গণতন্ত্রে আর মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করি। আর তারা চিরকালই সংখ্যায় কম, যারা বাক স্বাধীনতা বিরোধী, মানবতাবিরোধী, অসহিষ্ণু, মৌলবাদী। যুদ্ধ কি আমার একার সঙ্গে তাদের? যুদ্ধ তো আমাদের সবার সঙ্গে তাদের! একটি সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য, একটি সুন্দর দেশ গড়ার জন্য, একটি বাসযোগ্য জগৎ গড়ার জন্য আমরা ওই ভয়ংকর অথচ ক্ষুদ্র শক্তির বিরুদ্ধে আপোসহীন ভাবে লড়তে পারি। আমরা সবাই। পারি না?

    আমার ভাবনাগুলোকে থামিয়ে দিয়ে গাড়ি সশব্দে থামে খোদ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। প্রকৃতির কাছে তখন আমার প্রার্থনা শুরু হয়, যেন হিন্দু বেষ্টিত হয়ে থাকি, যেন কোনও মুসলমান পুলিশের মুখোমুখি না হই। দোতলায় উঠিয়ে পুলিশের বড় বড় লোকদের সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে। ধর্ম বড় ভয়ংকর। বড়কর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে আড়চোখে বুকে লাগানো নামখানা পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিই। পুলিশের সবাই খুব অমায়িক আর আন্তরিক। আক্রমণকারী মৌলবাদীদের সবাইকেই চেনেন পুলিশের লোকেরা। ঘরের টিভিতে প্রেসক্লাবের কুৎসিত আক্রমণের ঘটনাই দেখানো হচ্ছে। থেকে থেকে বড়কর্তা মন্তব্য করছেন। আমাকে দিয়ে ওদের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগপত্র লিখিয়ে নিয়ে আমাকেও বলছেন, ‘সব কটাকে হাজতে নেওয়া হচ্ছে, একটুও ভাববেন না। আমার আর ভাবনার কী! আমি তো শহর ছেড়ে চলেই যাচ্ছি। এ শহরে কখনও আর আসা হবে বলেও মনে হয় না।

    সন্ধ্যেয় ফেরার কথা ছিল কলকাতায়, এয়ারলাইনসে ফোন করে সময়টা এগিয়ে আনলেন বড়কর্তা। বিকেলে আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলেন পুলিশ কর্তারা। কোনও সাংবাদিকের জানার কথা নয় আমি কখন বিমান বন্দরে পৌঁছোবো। তারপরও সাংবাদিকের ভিড়। সম্ভবত সারাদিন বসে থেকে অপেক্ষা করারই উদ্দেশ্য ওদের। স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, সাক্ষাৎকার দেব না। কিন্তু কেউই বন্দর থেকে সরে যায় না। ভিড় করেই থাকে। কলকাতায় পৌঁছেও ওই একই অবস্থা দেখি। বন্দর ছেয়ে আছে সাংবাদিকে। কী করে লোক জানলো কখন আসছি আমি, কে জানে! বাড়িতে দেখি আঙিনা ভরে আছে। টিভি ক্যামেরায়, সাংবাদিকে। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিইনি। কারও সঙ্গেই কথা বলিনি। ঘটনা যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ অন্যরা করুক। আমাকে করতে হবে কেন প্রতিবাদ! সেই কতকাল থেকে লড়ছি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। আমার মলিন মুখখানাই, আমার সন্ত্রস্ত দেহখানাই টিভিতে দেখিয়ে বলতে হবে কেন যে আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। মানুষ মুখ খুলুক। সারা দেশ দেখেছে কী ঘটেছে। নিজের ওপর হামলার ঘটনা নিজে আর কত বর্ণনা করবো। যথেষ্ট কি হয়নি। আমার কি ক্লান্তি বলতে কিছু নেই! আমার কি রাগ হওয়া উচিত নয়। আমি কি লেখক হয়েছি লেখার জন্য নাকি লেখার অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য। আর কত আমাকে মার খেতে হবে, অনুযোগ করতে হবে, তাড়া খেতে হবে, কাঁদতে হবে।

    বাড়িতে উদ্বিগ্ন বন্ধুরা, আমার ফেরার অপেক্ষা করছিলো। ভেতরের অসহ্য আগুন বা শীতলতা আমাকে স্তব্ধ করে রাখছিলো। সবাই জানতে চাইছিল কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, আদ্যোপান্ত। কাউকেই আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু বেড়ালটাকে খুঁজছিলাম। ফোন বেজে চলেছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। শুধু বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করেছে। চাইছিলাম বন্ধুরা সবাই বাড়ি থেকে চলে যাক। আমাকে একা থাকতে দিক। আমার ঘুম পেয়েছিলো। খুব ঘুম। যেন হাজার বছর ঘুমোইনি। কিন্তু ঘুমোতে কি পেরেছি! বারবারই সেই মুখগুলো ভাসছিল চোখের সামনে, আততায়ীদের ভয়ংকর ক্রুদ্ধ মুখ, হিংস্র শরীর। মৃত্যু একেবারে দু’হাত দূরে এসে দাঁড়ালে মানুষের ঠিক যেমন লাগে, আমারও তেমন লেগেছিলো। আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য হয়তো ওদের ছিল না। কিন্তু সেসময় তো আমার জানা ছিল না ওরা বিধায়ক, দলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে বলে এসেছিলো আমাকে আক্রমণ করে এলাকায় নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। আমি তো ভেবেছিলাম ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ মৌলবাদী গোষ্ঠী এতদিনে আমাকে হাতের কাছে পেয়েছে। নিরাপত্তাহীন, নিরস্ত্র আমাকে হত্যা করে বেহেসতে যাবার এমন মোক্ষম সুযোগ ওরা হাতছাড়া করবে না। অনেক ছোটখাটো মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেঁচে বেরিয়েছি। এবার আর কোনও উপায় নেই। ওদের থাবা থেকে আমার বাঁচার এবার আর উপায় নেই। প্রাণে আমাকে মারেনি। পারেনি বলবো না। ইচ্ছে করলেই পারতো। ইচ্ছে না করলেও ক্রোধ মানুষকে এমন অমানুষ করে ফেলে যে মেরে ফেলা তখন খুব কঠিন হয় না। তখন বরং মারাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

    মৃত্যু থেকে উঠে আসা আমি। পুনরুত্থিত আমি। দ্বিতীয় জীবন আমি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন
    Next Article বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ফেরা – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.