Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প391 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৮. নিরাপদ বাড়ির কবিতা

    ০৮. নিরাপদ বাড়ির কবিতা

    অ.

    সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে, এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা। গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও সত্য বললে একঘরে করে সমাজ, দেশছাড়া করে দেশ। গৃহবন্দি করে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র শাস্তি দেয়, সত্য বোলো না।

    তার চেয়ে মিথ্যে বলো, বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে, বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলোআছে, চাঁদেরও আছে,বলল যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া, বলল যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে বানানো, বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা হাড় খুব বাঁকা। বলল যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে, ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গ বা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে। তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা। বলো যে বিশ্ব ব্রহ্মারে অগুনতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিলো, মিথ্যে।

    মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে, তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে, হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে। একা একা অন্ধকারে হমুখো মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।

    তুমি সত্য বলো না তসলিমা, বাঁচো।

    .

    আ.

    আমার শহর যাকে বলেছিলাম, সে শহর আমার নয়, সে শহর ধুরন্ধর রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী, আর নারী-পাচারকারীর শহর। বেশ্যার দালালের শহর, লম্পটের শহর। ধর্ষকের শহর সে শহর। আমার শহর নয়, সে শহর কেউ খুন বা ধর্ষিতা হলে, অত্যাচারিত হলে কিছু যায়-আসে-না-দের শহর। আমার শহর নয়, সে শহর মুখে-এক-মনে-আরেকদের শহর। বস্তির না-খাওয়াদের পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে যাওয়াদের শহর, ফুটপাথে মরে থাকা-ভিখিরিকে আলগোছে ডিঙিয়ে যাওয়াদের শহর। বিপদের আঁচ পেলে তড়িঘড়ি গা-বাঁচানোদের শহর। অন্যায়ের স্তূপে বসে মুখ-বুজে-থাকাঁদের শহর। আমার নয়। ইহ আর-পরলোক নিয়ে-বঁদ-হয়ে-থাকাঁদের শহর, জ্যোতিষীর শহর, আখের-গুছোতে-ব্যস্ত থাকাঁদের শহর, সুযোগসন্ধানীর শহর।

    সে শহর আমার শহর নয়। কিছুতেই। সে মিথুকের শহর। কূপমন্ডুকের শহর। ঠগ, জোচ্চোরের শহর, আমার নয়। সে শহর সুবিধেবাদীর, স্বার্থান্ধর, পাঁড় ধর্মান্ধদের শহর। তাদের শহরে আমরা গুটিকয় মুক্তচিন্তার মানুষ, কিছু যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী, কিছু সৎ, সজ্জন বড় ভয়ে ভয়ে বাস করি।

    .

    ই.

    রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে এখন আর বিরক্ত হই না। রাতে ভালো ঘুম না হলে দিনটা ভালো কাটে না–এরকম বলে লোকে। দিন যদি ভালো না কাটে, তাতে কি কিছু যায় আসে! আমার দিনই বা কেন, রাতই বা কেন। দিন দিনের মতো বসে থাকে দূরে, রাতও রাতের মতো, ঘুমিয়ে থাকার গায়ে মুখ গুঁজে গুটিশুটি শুয়ে থাকে জেগে থাকা। এসব দিন রাত, এসব সময়, এসব দিয়ে আমার করার কিছু নেই, জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু দিয়ে। আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়েও সরাতে পারি না, জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতেও পারি না কোথাও আপাতত।

    .

    ঈ.

    বন্দুক হাতে সেনারা ঘুরছে চারদিকে, মাঝখানে নিরস্ত্র আমি। সেনারা কেউ আমাকে চেনে না , নিরস্ত্র নারীর দিকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকায়। কেউ জানে না এখানে হঠাৎ কী কারণে আমি! ময়লা শরীর, মলিন কাপড়চোপড়, মনমরা উড়ুক্কু চুল, গায়েপায়ে শেকল নেই আমার, কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে, টের পায় ওরা, চাইলেও দু’পা এগোতে পারবো না টের পায়। ওদের চোখের তারায় বীভৎস এক টের পাওয়া দেখি। বন্দুকগুলো, জানে ওরা, ভয় দেখাতে, বেয়নেটগুলো, বুটজুতোগুলো ভয় দেখাতে। ভয় না পেলে ওরা আঘাত পাবে খুব, কাউকে আঘাত দেওয়ার অধিকার আমার আইনত নেই। ওরা যদি ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে বলে, এর তো দেখি ডর ভয় নেই। শেকল ভাঙতে চাইছে প্রাণপণে। ওপরতলা আমাকে নির্ঘাত ফাঁসি দেবে। ফঁসির দিনক্ষণ ঠিক হলে, খেতে দেবে মাছের ঝোল, ইলিশ চিংড়ি ইত্যাদি।

    যদি বলি, খাবো না! ফাঁসির মঞ্চে উঠে যদি একটাও দীর্ঘশ্বাস না ফেলি? গলায় দড়ি পরাবার পরও যদি ভয় না পাওয়ার দুঃসাহস আমার হয়?

    .

    উ.

    কয়েকবছর ধরে আমি মৃত্যুর খুব কাছে, প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মার সামনে, আমার বাবা, প্রিয় কিছু মানুষের সামনে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছি কয়েক বছর। কয়েক বছর ধরে আমি জানি না ঠিক বেঁচে আছি কি না, কয়েক বছর ধরে বেঁচে থাকা এবং না থাকার ব্যবধান কমে কমে শূন্যে এসে সুতোর মতো নড়ছে। কয়েক বছর ধরে আমার ভেতরে বাইরে যে মানুষটা বাস করে, সে বীভৎস বোবা একটা মানুষ, যার বৃক্ষ থেকে শেষ শুকনো পাতাটাও ঝরে গেছে, জীবন থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিয়েছে বসন্ত। আমার যদি মৃত্যু হয় আজ রাতে, কেউ কিছু বোলো না, শুধু কোথাও কোনও শিউলি গাছের নিচে একটা এপিটাফ পুঁতে দিও, কয়েক বছর ধরে লেখা আমার এপিটাফ, সাদা কাগজের গায়ে সাদা। রঙে, সযত্নে লেখা এপিটাফ।

    .

    ঊ.

    কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও? কবি নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে হয়তো, কবি নিয়ে ইট পাটকেলও হয়েছে, আগুন হয়েছে, কবিকে কেউ গৃহবন্দি করেনি, কোনও দেশ। এই ভারতবর্ষ, এই সভ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দী, কবিকে গ্রহণ করেছিলো, মুহূর্তেবর্জনও করেছে এর বালখিল্য ধর্ম, এর নিষ্ঠুর রাজনীতি। কোনও অপরাধ করেনি কবি, কবি আজ গৃহবন্দি। কবি এখন আকাশ না দেখে দেখে জানে না আকাশ কেমন দেখতে, মানুষ না দেখে দেখে জানে না মানুষ কেমন, কবির সামনে এক জগৎ অন্ধকার ফেলে চলে গেছে তারা, তারা আর এ পথ মাড়াবে না বলে গেছে। আজ একশ পঞ্চান্ন দিন কবি গৃহবন্দি, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানেনা হৃদয় আছে এমন কেউ পৃথিবীতে আর বাস করে কি না, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানে না, কবি বেঁচে আছে কি নেই। কার কাছে সে তার দিনগুলো ফেরত চাইবে, অন্ধকার সামনে নিয়ে বসে কবি ভাবে, কে তার জীবনে দেবে রোদ্দুর ফিরিয়ে, কে তাকে নিভৃতে জীবনের মন্ত্র দেবে কোনও একদিন। অন্তত সান্ত্বনা দিতে কবিকে তো বলুক মানুষ, এর আগে গৃহবন্দি ছিল যারা, অধিকাংশই কবি ছিল–নিঃসঙ্গতা থেকে মনে মনেও কিছুটা মুক্তি পাক সে।

    .

    ঋ.

    চেয়েছিলাম মানুষের অন্ধত্ব দূর করতে, চেয়েছিলাম মানুষের মোহর করা হৃদয় থেকে বৈষম্যের, হিংসের, অন্ধকারের আর অসুস্থতার শেকড় উপড়ে ফেলে ভালোবাসা রোপণ করতে। আমার চাওয়ার শাস্তি আমাকে দিয়েছে প্রিয় ভারতবর্ষ।

    .

    এ.

    কিন্তু কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে এই অজ্ঞাতবাসে, একটা স্বাধীনচেতা মানুষকে জন্মের মতো তুলে এনে আচমকা খাঁচায় বন্দি করলে কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে সে! খাঁচা থেকে আদৌ কোনওদিন মুক্তি পাবে কি না, মানুষের কোলাহলে মানুষের মতো কোনওদিন জীবনখানি যাপন করতে পারবে কি না, জানতে না পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত কী করে হবে সে! আলোর মানুষেরা কতদিন পারে অন্ধকারে অন্ধের মতো সাঁতরাতে। আমার শরীরে তীরের মতো বিঁধে রয়েছে দুশ্চিন্তা, যতক্ষণ ওই খাঁচা থেকে মুক্তি নেই, ততক্ষণ তীর থেকেও নেই।

    .

    ঐ.

    কাল রাতে দেখি একটি টিকটিকি কোত্থেকে লাফিয়ে গায়ে পড়ে বাহু বেয়ে আমার ঘাড়ের দিকে চলে গেল, ঘাড় পার হয়ে মাথার দিকে, চুলের জঙ্গলে শরীর আড়াল করে দ্বিতীয় টিকটিকির দিকে ঘণ্টা দুয়েক অপলক তাকিয়ে থেকে ভোররাত্তিরের দিকে কানের পাশ দিয়ে নেমে শিরদাঁড়ায় গিয়ে বসে রইল। দ্বিতীয়টি স্থির শুয়ে ছিল আমার ডান পায়ের ঘঁটু থেকে ইঞ্চি দুয়েক নিচে। সারারাত একচুলও নড়েনি। ওদের সরাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা আমি যা করছিলাম, তাই করি, চোখ বুজে পড়ে থাকি। মনে মনে একশ থেকে এক অবধি বারবার করে গুনি। কোনও কারণ নেই গোনার, তারপরও গুনি।

    যে বিছানায় আমি ঘুমোচ্ছি, দীর্ঘদিন হল সেটি আধোয়া কাপড়, এঁটো বাসন, হিজিবিজির খাতা, চায়ের দাগে বাদামি হয়ে থাকা পুরোনো পত্রিকা, চুল আটকে থাকা চিরুনি, মিইয়ে যাওয়া মুড়ি, খোলা ওষুধপত্র, কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম ইত্যাদির স্থূপ। দুশর মতো বড় বড় কালো পিঁপড়ে সারা বিছানা জুড়ে কদিন হল নোঙর ফেলেছে। আটঘাট বেঁধে লেগে গেছে নতুন বসত তৈরি করতে।

    আমাকে দখল করে নিচ্ছে ওরা। ওরা খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। কুঁকড়ে থেকে থেকে দিন দিন ওদের মতোই ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি আমি। এ অবধি একটি পিঁপড়েও, আশ্চর্য, আমার শরীর জুড়ে উৎসব করছে ধ্রুপদী নৃত্যের, ভুলেও কামড় দেয়নি। আমাকে, আমার বিশ্বাস, ওদেরই একজন মনে করে ওরা!!

    সম্ভবত মানুষের জগতের চেয়েও এই পোকামাকড়ের জগতেই বেশি নিরাপদ আমি।

    .

    ও.

    দিনের পর দিন যাচ্ছে, স্নান করি না। মাস পেরোচ্ছে, গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, স্নানের তবু কোনও ইচ্ছে জাগে না, কেনই বা স্নান করবো, কী লাভ স্নান করে। এক অদ্ভুত অনীহা আমাকে অধিকার করে রাখে।

    তিনবেলা লোক আসে খাবার নিয়ে পছন্দ হোক বা না হোক, খেতে হয়। না খেয়ে যদি বাঁচা যেত–বলে দিতাম কাল থেকে যাই দিক, অন্তত খাবারটা যেন না দেয়।

    ঘুমোতে যাবার আগে ভয় হয়, যদি কিছু হয়! যদি আর না জাগি! ঘুমোলে চমকে চমকে বার বার উঠে যাই, আশেপাশে তাকাই, আমার ঘর কি এ ঘর? না, এ আমার ঘর নয়।

    নির্বাসন নেহাতই একটা দুঃস্বপ্ন, এ সত্যি নয়–এই স্বপ্নটি সারাদিন দেখি, ঘুমোলে স্বপ্ন যদি উবে যায়, ঘুমোতে ভয় হয়।

    চার দেওয়াল ঘেরা ওই চতুষ্কোণ ঘরটির মধ্যেই হাঁটাচলা করো যদি নিতান্তই করতে হয়–

    এরকমই আদেশ এসেছে। ঘর ঘরের মতো পড়ে থাকে, আমি এক কোণে আদেশে অবশ হয়ে, স্তব্ধ বসে ভাবি, বিশাল বিস্তৃত এই পৃথিবী, কবে থেকে এত কৃপণ হল!

    জেলেও শুনেছি কিছু নিয়ম থাকে, দেখা সাক্ষাৎএর সময় ইত্যাদি নাকি থাকেই, আমারই কিছু নেই। স্বজন বন্ধু বলতে কিছু থাকতে নেই এক আমারই, জেলের সুবিধে চেয়ে আবেদন করি প্রতিদিন, নিরুত্তর সবাই।

    .

    ঔ.

    এভাবেই, যেভাবে রেখেছে আমাকে, সেভাবেই থাকতে হবে, যদি থাকি, যদি নিতান্তই থাকতে চাই এদেশে। এভাবেই কারাগারে, বন্ধ ঘরে, একা। কতদিন, কত মাস বা বছর? তার কোনও ঠিক নেই। কোনওদিন কি জীবন ফিরে পাবো? ঠিক নেই।

    কী কারণ এই বন্ধ ঘরের? বেরোলেই দেশের দশটা লোকের মৃত্যু হতে পারে।

    চমকে উঠি। –আমার কারণে? চোখ নিচু করে লোক বলে, –হ্যাঁ। বলি, –একবার মুক্তি দিয়েই দেখুন, দেখুন কতটা যুক্তিহীন এই অভিযোগ। ওদিকে মানুষ তো ভেবে বসে আছে, আমার জন্য বুঝি সব আয়োজন, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা আমার জন্য, আমি যেন না মরি! কাউকে না কাউকে নিরাপত্তা দিতে, হয়তো এ পৃথিবীরই নিয়ম, কাউকে না কাউকে হারিয়ে যেতে হয় অদ্ভুত আঁধারে। আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে নিরাপত্তা দিচ্ছে, আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে অভাবনীয় নিশ্চিন্তি দিচ্ছে,

    খুব জানতে ইচ্ছে করে, কারা সেই দশজন? তারা কি রাস্তার লোক নাকি রঙিন দালানবাড়ির লোক! তারা কি আদপেই লোক, নাকি লোকেদের লোকাতীত লোকনীতি? কাঁদের বাঁচাতে আজ আমাকে প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে মৃত্যুর বীভৎস মুখ!

    .

    ক.

    এমন একটা নিরাপদ বাড়িতে আমাকে বাস করতে হচ্ছে যেখানে ভালো না লাগলে বলতে পারার আমার কোনও অধিকার নেই যে ভালো লাগছে না। এমন একটা নিরাপদ বাড়ি যেখানে কষ্ট পেতে থাকবো আমি, কিন্তু কাঁদতে পারবো না। চোখ নামিয়ে রাখতে হবে আমাকে, কেউ যেন দেখতে না পারে কোনও অমীমাংসিত যন্ত্রণা।

    এমন একটা বাড়ি যেখানে ইচ্ছেগুলোকে প্রতিদিন ভোরবেলা খুন হয়ে যেতে হয়, আর সন্ধের আগে আগেই বাড়ির উঠোনে পুঁতে দিতে হয় ইচ্ছের মলিন মৃতদেহ।

    দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৈঃশব্দ্য ভাঙি নিরাপদ বাড়ির, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই বাড়ির বাইরে বা ভেতরে। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে যাই, ভয়ে ভয়ে জাগি, নিজের ছায়ার সঙ্গে যতক্ষণ জেগে থাকি মনে মনে কথা বলি। জানি না কোত্থেকে বিষদাত সাপ এসে থিকথিকে ক্রোধ আর ঘৃণা ছড়াতে ছতে সারাদিন আমার শরীর বেয়ে হাঁটাহাঁটি করে, হিসহিস করে বলতে থাকে, চলে যাও, সীমান্ত পার হয়ে দূরে কোথাও, কাক পক্ষী না দেখে কোনও দুর্গম পর্বতের দিকে কোথাও চলে যাও। ছায়াটির শরীর বেয়েও সাপ বলতে বলতে যায়, যাও, জন্মের মতো যাও। বন্ধুরা, প্রার্থনা করো, নিরাপদ বাড়ি থেকে কোনও একদিন যেন নিরাপদে বেরোতে পারি বেঁচে। প্রার্থনা করো, যেন কোনও একদিন একটি অনিরাপদ বাড়িতে বাস করার সৌভাগ্য আমার হয়।

    .

    খ.

    একটু মানুষ দেখতে দেবেন? রাস্তার মানুষ? মানুষ হাঁটছে, হাসছে, মানুষ ডানদিকে যেতে গিয়ে কী মনে হল বাঁদিকে হেঁটে গেল, মানুষ মাঠে, দোকানে, সিনেমায়, জলসায়, থিয়েটারে। মানুষ দৌড়োচ্ছে। মানুষ গাড়িতে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, মানুষ চলছে, দেবেন?

    একটু মানুষ দেখতে দেবেন? বাড়িঘরের মানুষ, ভালোবাসছে, স্বপ্ন-দেখছে মানুষ? ভাবছে। দেবেন দেখতে?

    ‘জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু ছিটেফোঁটা মেঘ বা রোদ্র দেখা যায়, তা দেখেই বাঁচতে হবে’, ‘মানুষ’, ওঁরা বলে দিয়েছেন ‘হবে না। আমার মানবজীবন এভাবেই পার করতে হবে মানুষবিহীন।

    .

    গ.

    নিজের দেশই যদি তোমাকে দেশ না দেয়, তবে পৃথিবীতে কোন দেশ আছে তোমাকে দেশ দেবে, বলো! ঘুরে ফিরে দেশগুলো তো অনেকটা একইরকম, শাসকের চেহারা চরিত্র একইরকম। কষ্ট দিতে চাইলে একইরকম করে তোমাকে কষ্ট দেবে, একইরকম আহাদে সুঁই ফোঁটাবে, তোমার কান্নার সামনে পাথর-মুখে বসে মনে মনে নৃত্য করবে। নাম ধাম ভিন্ন হতে পারে, অন্ধকারেও ঠিকই চিনবে ওদের চিৎকার, ফিসফিস, হাঁটাচলার শব্দ শুনে বুঝবে কারা ওরা, যেদিকে হাওয়া, সেদিকে ওদের দৌড়ে যাওয়ার সময় হাওয়াই তোমাকে বলবে কারা ওরা। শাসকেরা শেষ অবধি শাসকই।

    যতই তুমি নিজেকে বোঝাও কোনও শাসকের সম্পত্তি নয় দেশ, দেশ মানুষের, যারা ভালোবাসে দেশ, দেশ তাদের। যতই তুমি যাকে বোঝাও এ তোমার দেশ, তুমি একে নির্মাণ করেছো তোমার হৃদয়ে, তোমার শ্রম আর স্বপ্নের তুলিতে এঁকেছো এর মানচিত্র। শাসকেরা তোমাকে দূর দূর করে তাড়ালে কোথায় যাবে! কোন দেশ আর দরজা খুলে দাঁড়ায় তাড়া খাওয়া কাউকে আশ্রয় দিতে! কোন দেশ তোমাকে আর কোন মুখে দেশ দেবে বলো!

    তুমি কেউ নও এখন আর, মানুষও বোধহয় নও। হারাবার তোমার বাকিই বা কী আছে! এখনই সময় জগৎকে টেনে বাইরে এনে বলে দাও, তোমাকে ওখানেই দাঁড়াবার জায়গা দিক, ওখানেই ঠাঁই দিক, দেশের সীমানা ফুরোলে ‘কারও মাটি নয়’ অথবা নো ম্যানস ল্যান্ড বলে যেটুকু মাটি থাকে, সেই অবাঞ্ছিত মাটিই, সেটুকুই না হয় আজ থেকে তোমার দেশ হোক।

    .

    ঘ.

    ভারতবর্ষ শুধু ভারতবর্ষ নয়, আমার জন্মের আগে থেকেই ভারতবর্ষ আমার ইতিহাস। বিরোধ আর বিদ্বেষের ছুরিতে দ্বিখন্ডিত হওয়া, ভয়াবহ ভাঙন বুকে নিয়ে উধ্বশ্বাস ছোটা অনিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে আমার ইতিহাস। রক্তাক্ত হওয়া ইতিহাস, মৃত্যু ইতিহাস। এই ভারতবর্ষ আমাকে ভাষা দিয়েছে, আমাকে সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতিতে। শক্তিময়ী করেছে। স্বপ্নে। এই ভারতবর্ষ এখন ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে সব ইতিহাস, আমার জীবন থেকে আমার অস্তিত্ব, আমার স্বপ্ন থেকে আমার স্বদেশ।

    নিঃশেষ করতে চাইছে বলে আমি আজ নিঃস্ব হব কেন! ভারতবর্ষ তো জন্ম দিয়েছে। মহাত্মাদের। আজ তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে, এই অসহায়, এই অনাথ, এই অনাকাঙ্খিত আমার দিকে। দেশের চেয়েও দীর্ঘ এই হাত, দেশ কাল ছাপিয়ে এই গোটা কয় হাত আমাকে জাগতিক সব নিষ্ঠুরতা থেকে বড় মমতায় নিরাপত্তা দেয়। তাদেরই আমি দেশ বলে আজ ডাকি, তাঁদের হৃদয়ই আজ আমার সত্যিকার স্বদেশ।

    .

    ঙ.

    আমার দেশটি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার যন্ত্রণা দেখছে আজ এক যুগেরও বেশি। আমার দেশটি দেশে দেশে আমার বন্দিত্ব দেখছে, দূরত্ব বেড়ে গেলে দূরবীন লাগিয়ে দেখছে, বেজায় হাসছে,পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করছে আমার সর্বনাশ।

    আমার দেশ এমন ছিল না আগে, দেশের হৃদয় বলে কিছু ছিল, দেশে মানুষ বলে কিছু ছিল। দেশ এখন আর দেশ নেই। কতগুলো স্থবির নদী শুধু, কতগুলো গ্রাম আর শহর। এখানে ওখানে কিছু গাছপালা, কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আর, ধূসর চরাচরে মানুষের মতো দেখতে কিছু মানুষ।

    আমার দেশে এককালে প্রাণ ছিল খুব, এককালে কবিতা আওড়াতে খুব মানুষ, এখন কবিকে নির্বাসন দিতে কেউ দু’বার ভাবে না, এখন কবিকে মাঝরাত্তিরে নিশ্চিন্তে ফাঁসি দিয়ে ফেলে গোটা দেশ, পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে মর্মন্তুদ মৃত্যু।

    দেশটি ভালোবাসতে জানতো আগে, দেশ এখন হিংসে শিখেছে, চোখ রাঙানো শিখেছে। দেশের হাতে এখন ধারালো সব তলোয়ার থাকে, দেশের কোমরে গোঁজা মারণাস্ত্র, মারাত্মক সব বোমা, দেশ এখন আর গান গাইতে জানে না।

    দুনিয়া তছনছ করে দেশ-খুঁজছি এক যুগেরও বেশি, এক যুগেরও বেশি ঘুম নেই, উন্মাদের মতো দেশ দেশ করে দেশের কিনারে এসে দেশকে স্পর্শ করতে দু হাত বাড়িয়ে আছি। আর শুনি কিনা, হাতের কাছে দেশ যদি একবার পায় আমাকে, তবে নাকি আমার রক্ষে নেই।

    .

    চ.

    আমার বাংলা আর বাংলা নেই, সোনার বাংলা এখন ক্ষয়ে যাওয়া, আমার রুপোলি বাংলার গায়ে মরচে, পূর্ব পশ্চিম আজ একাকার। ধর্মান্ধরা ছড়ি ঘোরায়, ভীতুরা মাথা নত করে হাঁটে, নিশ্চিতই কবন্ধের যুগ এই যুগ। সাহস আর সতোর নির্বাসন হয়ে গেছে, বাংলা এখন কুচক্রী শাসক আর তাঁবেদারে ঠাসা, বাকিরা নির্লিপ্ত, জীবনযাপনকারী, হয় জড়, নয় জঞ্জাল।

    এই বাংলার জন্য যত জল আমার দুচোখে আছে দিলাম, কোনওদিন একদিন যেন উর্বর হয় মাটি, যেন জন্ম নেয় মানুষ, যেন দুর্ভাগা-বাংলা মানুষের বাসযোগ্য হয় কোনওদিন একদিন।

    .

    ছ.

    মরে গেলে লাশখানা রেখে এসো ওখানে, মেডিক্যালের শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষে, মরণোত্তর দেহদান ওখানেই করেছি, রেখে এসো কলকাতা শহরে লাশ। জীবিত নেবে না আমাকে ও শহর। মরলে নেবে তো? প্রিয় কলকাতা!

    .

    জ.

    মিনু নেহাত বেড়াল নয়। আমার কন্যা। কন্যাটিকে ফেলে আসতে হয়েছে কলকাতায়, নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসেছিল দীর্ঘদিন, এখনও মলিন মুখে জানালায় বসে থাকে, দিন গোনে। শীত কাটাতে হল একা একা, নরম লেপের তলায় আমার উষ্ণতা পেতে পেতে এ বছর আর ঘুমোনো হল না ওর। আমার অপেক্ষা করে ওর শীত গেল, ছুটির গরমকাল যেন না যায়! যে-করেই হোক আমাকে ও চায়, ফিরে পেতে চায় নির্ভাবনার সেইসব দিন।

    গড়িয়াহাট থেকে তুলে আনা শিশুটি কয়েকবছরে ধীরে ধীরে বুকের ধন হয়ে উঠেছিল। স্বজন বলতে এক আমিই ছিলাম ওর, জগৎ বলতে এক আমিই। আমার কিশোরী কন্যাটি তার ঘর বাড়ি, তার বিছানা বালিশ ছেড়ে রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া প্রিয় বারান্দাটি ছেড়ে, খেলনা-ইঁদুর ছেড়ে মন-মরা বসে আছে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে, দিনশেষে চোখ ভেসে যেতে থাকে চোখের জলে। কলকাতা, আমাকে দাওনি, আমার নিরাশ্রয় কন্যাটিকে আশ্রয় দিও, আমাকে রাখোনি, আমার অনাথ কন্যাটিকে দেখে রেখো।

    .

    ঝ.

    কূপমন্ডুকের দল বিপক্ষে গেলেও, কট্টরপন্থীরা আস্ফালন করলেও, কবন্ধরাঘিরে ধরলেও, মানুষ থাকে পাশে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা থাকে। যখন রাজ্য তাড়ায়, যখন ক্ষমতা বিপক্ষে যায়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, মানুষ সরতে থাকে, মানুষ পালায়। শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিতরাও নিরাপদ আড়াল খোঁজে, প্রতিষ্ঠান সরে যায়, বেসরকারি ক্ষুদ্র দলও ক্ষুদ্র গর্তে লুকোয়, স্বনামধন্যরা চোখ বুজে থাকে। বন্ধু বলে যাদের চিনি, তারাও আচমকা অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

    হাতে গোনা কিছু মানুষ শুধু পাশে থাকে, নির্ভেজাল কিছু মানুষ। সাহস আর সততা সম্বল করে সত্যিকার কিছু স্বার্থহীন বন্ধু থাকে পাশে।

    ওরা আজ মিছিল করছে, ওরা মোমবাতি হাতে হাঁটছে সন্ধের শহরে, জোট বেঁধে বিচার চাইছে অবিচারের। কে বলেছে এই সংগ্রাম একার আমার? বাক স্বাধীনতা রক্ষা হলে এদেশের মানুষেরই হবে, এ আমার একার নয়, স্বপ্নবান মানুষের সবার সংগ্রাম। এই দুঃসময় আমার একার নয়, আমাদের সবার দুঃসময়। যদি কোনওদিন জয় হয় মুক্তচিন্তার–ব্যক্তি আমার চেয়ে শতগুণ হবে ভারতবর্ষের জয়।

    এ আমার একার কিছু নয়, আমার পাশে ওরা নয়, বরং ওদেরই পাশে, ওই অবস্থান ধর্মঘটের পাশে, অনশনের পাশে, ওই মিছিলের মানুষের পাশে, ভারতবর্ষের পাশে, আমি আছি, দূর কারাবাস থেকেও আছি, ঘোর অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার থেকেও আছি পাশে।

    ঞ.

    বেঁচে আছি!

    .

    ট.

    তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে ওরা, তোমার জীবন থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে বন্দি করেছে ব্যালটবাক্সে। কোনও স্বজনের একটি হাতও, সামান্য সুযোগ নেই, একবার স্পর্শ করো, তোমারই জীবনের কণামাত্র তোমার অধিকারে নিয়ে তোমার সুযোগ নেই একবার যাপন করো। মানো বা নাই মানো, অন্যের সম্পত্তি এখন তুমি, তোমার কিছুই আর তোমার নেই, একঘর হাহাকার ছাড়া তোমার জন্য বরাদ্দ একফোঁটা কিছু নেই। স্বাধীনতা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের ভুতুড়ে জিনিস।

    ওদের ইচ্ছে তুমি উন্মাদ হও, স্নায়ুতন্ত্রে যদি খুব শক্তি ধরো, উন্মাদ হতে যদি না-ই পারো, তবে দেশ ছাড়ো, যে করেই হোক ছাড়ো, এ দেশ তোমার নয়। মাটি কামড়ে কতদিন কে-ই বা পড়ে থাকতে পারে! এত ঘৃণা, এত থুতু, এত লাথি কতদিন সইতে পারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখা মানুষ। ওরা চাইছে, উন্মাদ যদি না-ই হও, দেশ যদি না-ই ছাড়ো, অন্তত মরো।

    তুমি সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে গতকাল, যা হয় তা হোক, আপাতত কোনওটিরই সম্ভাবনা নেই। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীত কণ্ঠে বলেছে, দিনে দিনে তোমাকে অসম্ভব সহিষ্ণু করে গড়ে তোলার পেছনে অবদান ওদেরই। এখন আগুনে পোড়ালেও তুমি পুড়ে পুড়ে আর দগ্ধ হবে না, বড়জোর যদি কিছু হও ইস্পাত হবে।

    .

    ঠ.

    আমি তো মানুষ ছিলাম, সমাজ সংসার ছিল, স্বপ্ন ছিল। বারান্দার ফুলগাছ, বাজার হাট, বিকেলবেলার থিয়েটার, বন্ধুর বাড়ি–আর সবার মতো আমারও ছিল। হঠাৎ কিছু লোক তুড়ি মেরে মুহূর্তে আমাকে নিষিদ্ধ বস্তু বানিয়ে দিল!

    কার কী নষ্ট করেছিলাম আমি? কিছুই তো ছিল না আমার, শুধু ওই স্বপ্নটুকু ছিল, ওই স্বপ্ন সম্বল করে বেঁচে ছিলাম সুখে দুখে, নিজের মতো। ব্যস্ত শহরের ভিড়ে, রোদে ভিজে, আর সব মানুষের মতো আমার ওই সামান্য বেঁচে থাকাটুকু–কেন কেড়ে নিতে হবে কারও!

    নিষিদ্ধ বস্তুকে গর্তে পুরে রেখেছে রাজার লোকেরা। ধর্ম-ধ্বংস-করা ডাইনিকে অবশেষে পাকড়াও করা গেছে ঢাড়া পিটিয়ে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে খবর, ধর্মান্ধদের হ্যাঁ করা মুখে ঢেলে দিচ্ছে সুস্বাদু খাদ্য, সন্ত্রাসীদের জিভ থেকে ঝরানো হচ্ছে গনগনে লাভা।

    কারও খেলার জিনিস তো নয়। আমার জীবন তো জীবন! জনতার আদালত বলে কোনও আদালত কোথাও কি নেই?

    .

    ড.

    বাড়িটা তুই, আছিস কেমন? তোর বুঝি খুব একলা লাগে? আমারও তো, আমারও খুব। রাত্তিরে কি ভয় করে না? জানলাগুলো হঠাৎ করে ধড়াস করে খুলে গেলে? কেউ এসে কি দরজা নাড়ে? ধুলোয় ধূসর ঘরবারান্দায় কেউ ঢোকে কি, ভয় জাগে যে? চোর ডাকাতের বাড় বেড়েছে। নাকি হাওয়াই ঢোকে, ঝড়ো হাওয়া! হাওয়াই বা কোথায় এখন, সম্ভবত আমিই ঢুকি, মনে মনে আমিই বোধহয়। হেঁটে বেড়াই ঘরগুলোতে, অন্ধকারে চিনতে পারিস। পায়ের আওয়াজ বুঝিস কিছু? বাড়িটা তুই, লেখার ঘরটা দেখে রাখিস, সবকিছুই তো ওই ঘরে রে, জীবনটাই লেখার জীবন, ন-আলমারি বইপত্তর, লেখাপড়ার দুনিয়াটা, ওসব ছেড়ে ভালো থাকি! মনে মনে আমিই বোধহয় অশরীরী ঘুরি ফিরি ফেলে আসা ঘরদুয়ারে চোখের জল ফেলে আসি! বারান্দার গাছগুলোতে জল যে দেবে, কেউ তো নেই! চোখের জলে বাঁচবে না গাছ? চোখে আমার এক নদী জল, এক সমুদ্র চাস যদি বল, পাঠিয়ে দেব, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস। তোকে ছাড়া নির্বাসনে এক মুহূর্ত মন বসে না, বেড়ালটাও বাড়িতে নেই, খাঁ খাঁ করছে বাড়ির ভেতর, ধুলোয় তুই ডুবে আছিস, আঁচল দিয়ে মুছে দেব, চোখের জলে ধুয়ে দেব, অপেক্ষা কর, বাড়িট। তুই। তুই কি আর শুধুই বাড়ি। তুই তো আমার হারানো দেশ। তুই তো আমার মাতৃভাষা। তুই কি আর শুধুই বাড়ি! এক যুগেরও বেশি সময় বুকের ভেতর তোকে লালন করেছি তুই জানিস তো সব। দীর্ঘকালের স্বপ্ন তুই, স্বপ্ন বলেই তোকে ডাকি, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস, আমায় একটু বাঁচিয়ে রাখিস।

    .

    ঢ.

    আশাগুলো একটু একটু করে চোখের জলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে, আশাগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে নিরাশার লু হাওয়া। এই কঠোর নির্বাসনে স্বজন বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনও অপরাধ না করে আমি অপরাধী, যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হবে। একটু আশার আশায় সারাদিন বসে থাকি, কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে যদি ভুল করেও ঢোকে। সারারাত জেগে থাকি, ধুলোর ওপরও উপুড় হয়ে আশা বলে কিছু যদি আচমকা চিকচিক করে, খুঁজি। কিছু নেই। জীবন পেতে আছি, পারো তো কিছু আশা দিও, সামান্য হলেও ক্ষতি নেই, দিও। মিথ্যে করে হলেও দিও, তবু দিও।

    .

    ণ.

    অপরাধীরা বড় নিশ্চিন্তে যাপন করছে তাদের জীবন, ধাপ্পাবাজি, ধর্মব্যবসা, সবকিছুই দেদার চলছে, বুক ফুলিয়ে পাড়ায় হাঁটছে, আরও কী কী অপরাধ করা যায়, তার মতলব আঁটছে, অপরাধীরা চমৎকার আছে ভারতবর্ষে, তাদের গায়ে টোকা দেওয়ার দুঃসাহস কারও নেই।

    তারা অন্যায় করেছে বলে, শাস্তি তারা নয়, আমি পাচ্ছি, আমি শাস্তি পাচ্ছি যেহেতু তারা আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে। তারা আমাকে দেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে বলে,আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার ব্যবস্থা চলছে সাতমাস ধরে। আমাকে হত্যা করার বেআইনি ফতোয়া জারি করেছে বলে, দেশের আইন ভেঙেছে বলে, তারা নয়, শাস্তি পাচ্ছি আমি।

    অপরাধ করিনি বলে এখনও অপেক্ষা করছি। দেখছি হেঁচকা টান দিয়ে নিরপরাধের গোটা জীবনটা তুলে কোথাও কোনও অজ্ঞাতস্থানে ঝুলিয়ে রাখতে কতদিন পারে দেশ। দেখছি একশ কোটি মানুষের দেশের কতদিন লাগে অবশেষে মানবিক হতে!

    এ দেশ আমার পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারীর মাতৃভূমি বলে নয়, এরই জল-হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা বলে নয়, এরই সংস্কৃতি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বলে নয়। আমি মানুষ বলে দাবি, মানুষের হয়ে দাবি –ভারতবর্ষকে ভালোবেসে এই দাবি–অপরাধীকে শাস্তি -দেওয়া যদি নীতি হয়, তোক, নিরপরাধকে নির্যাতন করার নীতি যেন না হয় এ-দেশের।

    .

    ত.

    অথৈ অন্ধকারে, অদ্ভুত অজ্ঞাতবাসে পড়ে থাকা অসার আমার কাছে কেউ নেই আসে। চাঁদের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি, মানুষের কাছে, আশ্চর্য, চাঁদও শিখেছে ফাঁকি। জীবনে অমাবস্যা ঢেলে দিয়ে পূর্ণিমা পালায়,পেছনে দৌড়ে দৌড়ে কত ডাকি, আয়, ফিরে আয়। চাঁদের কী আসে যায়! মানুষের কাছে দুদন্ড ইদানীং মানুষই থাকে না, দূরত্ব খোঁজে আত্মার আত্মীয়, জন্ম জন্ম চেনা।

    দক্ষিণ থেকে উতল হাওয়ারা ছুটে ছুটে ছুঁতে আসে, হাওয়াই ভরসা ছিল অতপর অজ্ঞাতবাসে। হা কপাল! হাওয়াও উজাড় করে হাহাকার দিল, জীবনে যা কিছু ছিল বা না-ছিল, নিল। আকাশের কাছে কিছুই চাই না, ও আর কী দেবে? দিলে এক শূন্যতা দেবে। ও আমার যথেষ্ট আছে, ও নিয়েই আছি, ও নিয়েই ভারতবর্ষের অজ্ঞাতবাসে বাঁচি।

    .

    থ.

    তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা দোষ আমার বার করো, কিছু একটা দোষ তোমরা সবাই মিলে বার করো, না হলে অকল্যাণ হবে তোমাদের। সবাই মিলে তোমরা বলো কী কারণে আমাকে নির্বাসন দিয়েছে। আমার জন্য কোথাও মড়ক লেগেছে। কোথাও শিশুমৃত্যু, ধর্ষণ বা গণহত্যার মতো কোনও অপরাধ আমি করেছি, এরকম কিছু একটা বলল, নির্বাসনের পক্ষে অন্তত দুটো তিনটে যুক্তি হলেও দাঁড় করাও। যতদিন না জুৎসই কোনও দোষ ধরতে পারছো, যতদিন না কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ঘৃণার আঙুল তুলে দেখাতে পারছে কুলাঙ্গারকে, ততদিন কী করে ক্ষমা করবে নিজেদের! কিছু একটা দোষ পেলে আমিও স্বস্তি পেতাম। নির্বাসনকে অতটা নির্বাসন বলে মনে হত না। কিছু একটা দোষ বার হোক আমিও চাই, শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে তোমাদের ফের আলিঙ্গন করতে আমিও চাই।

    কী দোষে আমাকে সমাজচ্যুত করেছে, বলো। কিছু একটা দোষ বার করো, দোষ বার করে দোষ-স্থলন করো নিজেদের। ইতিহাসকে কেন সুযোগ দেবে কুটি করার! একখন্ড মধ্যযুগ এনে সভ্যতাকে কেন কলঙ্কিত করেছে, কিছু কারণ বার করো এর। না যদি পারো, আমাকে বাঁচাতে নয়, তোমাদের বাঁচাতেই আমাকে মুক্তি দাও..

    .

    দ.

    অন্নদাশংকর রায় একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি’। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ছিল, একটা সময় এমন কথাও বলতো লোকে।

    বন বাদাড় আর নদ পেরিয়ে, মাসির কোলে এসেছিলাম কাঁদতে আমি মায়ের শোকে।

    মাসিই কিনা কোল দিল না, কাঁদার জন্য কাঁধ দিল না, মাসির প্রিয় বুনো ফুল, হঠাৎ হল চক্ষুশূল। সকাল সন্ধে মাসিই তাড়ায়, মাসিই বলে মর গে যা, কোথায় যাবে অনাথ মেয়ে, কোন মুলুকে খুঁজবে মা?

    .

    ধ.

    আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় কলকাতা। ভালো নেই আমি, এভাবে কেউ কোনওদিন ভালো থাকেনি কোথাও। এভাবেই তুমি আমাকে রেখেছো কলকাতা, এভাবেই নির্বাসনে, এভাবেই একঘরে করে। এভাবেই অন্ধ কূপে। পায়ের তলায় পিষছে প্রতিদিন, প্রতিদিন পিষছো পায়ের তলায়। গলাটিপে ধরেছো কথা বলেছি বলে, হাত কেটে নিয়েছো লিখেছি বলে। কাউকে হত্যা করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি, কারও দিকে পাথর ছুঁড়িনি, মানবতার পক্ষে কিছু অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমাকে তোমার পছন্দ নয়। আমাকে উৎখাত করেছে আমার মাতৃভাষা থেকে, উৎখাত করেছে আমার মাটি ও মানুষ থেকে, উৎখাত করেছো জন্ম-জন্মান্তরের ইতিহাস থেকে, উৎখাত করেছো ঘর বাড়ি বাসস্থান থেকে, পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আশ্রয় থেকে। আমি ভালো নেই তাতে কী! তুমি ভালো থেকো, তুমি বড় বড় কবির শহর, সাহিত্যিকের শহর, দার্শনিক শুভবুদ্ধির শহর, ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর তুমি, কলকাতা, তুমি তো সংস্কৃতির পীঠস্থান, কলকাতা, তুমি ভালো থেকো। তুমি সুখে থেকো প্রিয় কলকাতা, নাচে গানে থেকো, উৎসবে আনন্দে, মেলায় খেলায় থেকো সুখে। তুমি তো মহান, তুমি বিরাট, তুমি অট্টহাসি হাসো, জগৎ দেখুক।

    .

    ন.

    একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রতিদিন এক থোকা গোলাপ পাঠাতেন আমার কলকাতার বাড়িতে। তিনি এদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য করেছিলেন, বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, তাঁর কাছ থেকে আমি গোলাপ পেয়েছি প্রতিদিন। ক্ষমতার চাবুক মেরে যারা আমার মনকে রক্তাক্ত করছে, জীবনকে, জীবনের সব স্বপ্নকে প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে, তারা শুধু আমাকে নয়, ওই স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও রক্তাক্ত করছে চাবুক মেরে, প্রতিদিন। তারা জানেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওই গোলাপের রঙ রক্তের চেয়েও লাল। এখন আর গোলাপ নয়, এখন এক ঠিকানাহীন ঠিকানায় প্রতিদিন আমার জন্য মনে মনে চোখের জল পাঠান তিনি, এই জল দিয়ে আমার ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা করি। গোলাপের স্মৃতি থেকে বিশুদ্ধ সুগন্ধ বাতাস নিয়ে এই স্বাসরোধ করা পরিবেশে খাস নিই। এই স্বাধীন দেশের গোপন কুঠুরিতে পরাধীনতার শক্ত-শেকলে বাঁধা নির্বাসিত নিঃস্ব নারী, তাকে আজ মুক্ত করার শক্তি নেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীরও। স্বাধীনতা হয়তো এ জীবনে আমার দুরূহই হবে পাওয়া। ওই গোলাপগুলোকে ডাকবো স্বাধীনতা বলে, ওই চোখের জলগুলোই আমার স্বাধীনতা।

    .

    প.

    সারা বছর বসে থাকি এই মেলাটি আসবে বলে। এই মেলাটির অলি গলির ভিড়ের মধ্যে নতুন বইয়ের গন্ধে ঘ্রাণে, ধুলোবালির ধূসর হাওয়ায়, হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই মেলাটি আসবে বলে আকাশপারের উতল হাওয়ায় ইচ্ছে মতো ঘুড়ি ওড়াই। বছর বছর এই মেলাটি আসে বলেই স্যাঁতসেঁতে এক ঘরের কোণেও খুব গোপনে ভীষণ সুখে, স্বপ্নসহ বেঁচে থাকি। আমার তো আর পুজো-আচ্চা, ঈদ-বড়োদিন নেই, আমার একটি মেলাই আছে, প্রাণের মেলা,এই একটি মেলায় মানুষ দেখি কাছের মানুষ, সাত-নদী-জল সাঁতরে তবু একটুখানি ছুঁতে আসে। এই মেলাটিই ধর্মকর্ম, ধূপের কাঠি, ধানদুব্বো। এই একটি পরব, একটি সুখ-ই, নিজের জন্য তুলে রাখি। শিল্প-মেলায় আগ্রহ নেই, জুয়োর মাঠ, ব্যবসা পাতি, সন্ধে হলে উৎসবে নেই, ককটেলে নেই। এই একটি মেলাই একমাত্র। এই মেলাটিই শৈশব দেয়, কৈশোর দেয়, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেসব এঁটেল মাটির আনন্দ দেয়। এই মেলাটির সারা গায়ে মাতৃভাষা, মাথার ওপর স্নেহসিক্ত মায়ের আঁচল। এই মেলাকেই অন্য অর্থে জীবন বলি।

    এটিও তুমি কেড়ে নিলে? স্বদেশহারা স্বজনহারা সামান্য এই সর্বহারার সবটুকু সুখ বুকের ওপর হামলে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে এক থাবাতে ছিনিয়ে নিতে পারলে তুমি ভারতবর্ষ? দাঁত বসিয়ে কামড় মেরে ছিঁড়েই নিলে যা-ছিল-সব? হৃদয় বলতে কিছুই কি নেই ভারতবর্ষ? হৃদয় তবে কোথায় থাকে ভারতবর্ষ?

    .

    ফ.

    আজ যদি বেঁচে থাকতেন গান্ধিজী, যে করেই হোক বন্দি শিবির থেকে আমাকে উদ্ধার করতেন। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। এ আমি হলফ করে বলতে পারি, দিতেন। হৃদয় বলে যেহেতু তার কিছু ছিল, তিনি দিতেন। বাড়ির ঘর দোর উঠোন আঙিনায় নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি, উছলে পড়া খুশি, বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দিয়ে সাজানো সংসার-সমুদ্রে আমার সঞ্জীবনী সাঁতার দেখে বড় সস্নেহে হাসতেন তিনি। হৃদয় বলে যেহেতু কিছু ছিল তাঁর, হাসতেন। আমাকে আমার মতো যাপন করতে দিয়ে আমার জীবন, আমি নিশ্চিত, তিনি স্বস্তি পেতেন। গান্ধিজী যদি বেঁচে থাকতেন আজ, দেশের দুর্দশা দেখে তার দুঃখ হত। কালসাপের মতো ফঁসে ওঠা অসহিষ্ণুতার সন্ত্রাস বন্ধ করতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিতেন তিনি। নিশ্চয়ই দিতেন। আমাকে আর কতটুকু, মূলত দেশটাকেই বাঁচাতেন।

    .

    ব.

    বরং বাঘ টাঘ নিয়ে বলো, কৃষ্ণসার হরিণ নিয়ে কথা বলে। মানুষের কথা বলোনা, মানুষ খুব ভয়ংকর। বাঘকে খাঁচাবে তো রক্ষে নেই। হরিণের গায়ে হাত তুলেছো কী মরেছো। মানুষকে খোঁচালে চলে, বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেও ঠিক আছে। যে মানুষ যুক্তি দেখায়, তর্ক করে, ভাবে, ভাবনাটা ছড়ায়, তারা মানুষ তো নয়, আগুন।

    আগুন যে করেই হোক নেভাতে হয়। যে মানুষগুলো জন্তুর মতো, ভাবনা নেই, বেশ আছে, খায় দায় ঘুমোয়, যেভাবে অন্যরা চলে, সেভাবে চলে। ওদের বাঁচিয়ে রাখো। জন্তুরা খায় দায় ঘুমোয়, আর জঙ্গলের শোভাবর্ধন করে। এই চিন্তাশক্তিহীন লোকগুলোও লোকালয় শোভিত করে আছে বহুকাল। এরাই থাকুক বেঁচে। দুধে ভাতে। চিন্তকদের কথা ছাড়ো, কৌশলে বন্দি করো ওদের, পারলে মেরে ফেলো!

    ওদের কথা নয়, বরং অন্য কথা বলল। হরিণ টরিণ।

    .

    ভ.

    একটা কথা আমার মুখ থেকে শুনবে বলে সবাই বসে আছে। একটা বাক্য শুনবে বলে বসে আছে, দুটো শব্দ শুনবে বলে, দুটো মাত্র শব্দ। আতঙ্কে,ভয়ে, বিবর্ণ হয়ে, কাঠ হয়ে, যেন বলে ফেলি একদিন, গুডবাই ইন্ডিয়া। দিন যাচ্ছে, সপ্তাহ শেষ হচ্ছে, মাস পেরোচ্ছে, মাসের পর মাস। আমার মুখের দিকে কয়েকশ রক্তচক্ষু, কয়েকশ বছর আগে বন্ধ হয়ে থাকা পুরোনো ঘড়ির কাঁটার মতো স্থির, ডানে বামে ওপরে নিচে সর্বত্র বাদুরের কানের মতো উৎসুক কান, জগতের সবচেয়ে মধুর শব্দদ্বয় শুনবে বলে, গুডবাই ইন্ডিয়া। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও বিশ্বাস করছি সত্যে। সততায়। বিশ্বাস করছি সৌন্দর্যে। শিল্পে। সহমর্মিতায়।

    যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতে হবে শব্দদুটো, যদি আমাকে করতেই হয়–দু’চারটে ঘৃণাই যেদিন উথলে উঠে সুনামি ঘটাবে, যদি ঘটায়ই মনুষ্যত্ব পায়ে পিষে ধর্মান্ধতার নিশান ওড়াবে মানুষ শহর নগর জুড়ে যেদিন –যেদিন আমারই রক্তের ওপর আমি লাশ হয়ে ভেসে থাকবো, ঠুকরে খাবে একপাল শকুন আমার ফুসফুস যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতেই হবে শব্দদুটো, সেদিন যেন গভীর রাত্তির হয়, আমাকে যেন দেখতে না হয় দেশটির মুখ, দেখতে না হয় দুপুরের শান্ত পুকুর, আমগাছতলা, উঠোনের রোদ্দুর, যেন ভুলে যাই দেশটির সঙ্গে কখনও আমার কোনও আত্মীয়তা ছিল। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও প্রাণপণে পাথর করে রেখেছি জিভ। আমি উচ্চারণ করতে চাইছি না–এখনও চাইছি ভালোবাসার জয় হোক।

    .

    ম.

    যাদের সঙ্গে বাস করবে বলে আমি অন্ধকূপে পড়ে আছি, অপেক্ষা করছি, এক একটা মুহূর্ত এক একটা যুগের মতো যদিও দীর্ঘ, করছি। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে ত্যাগ করছি আনন্দ উৎসব, জীবন যাপন, সমাজ সংসার, স্বাধীনতা, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে শরীর ক্ষয় করছি, ভেঙে গুঁড়ো হতে দিচ্ছি মন। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে প্রতিদিন জল ফেলছি চোখের, নিঃসঙ্গতার গায়ে সারারাত ধরে টুপটুপ ঝরে পড়ছে সে জল, ভেসে যাচ্ছে বয়স, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে বুকের মধ্যে বিশাল এক প্রত্যাশার প্রাসাদ গড়েছি, তারা কারা? তারা কি আমাকে মনে করে একবারও? কখনও হঠাৎ? কোনও দিন? কাঁদের সঙ্গে বাস করবো বলে ভয়ংকর দাতালের বিরুদ্ধে এক বিন্দু পিঁপড়ে হয়েও লড়াই এ নেমেছি? তারা কি আমার মতো ভালোবাসা জানে? আদৌ কি তারা ভালোবাসে?

    .

    য.

    আমাকে কোনও একদিন কোনও বরফের দেশে, নির্বাসনে পাঠাবে ভারতবর্ষ। জমে যেতে যেতে একটু তাপ চাইবো, সামান্য উত্তাপ, দূর পরবাসে কে আছে যে দেবে কিছু স্মৃতিই যদি একমাত্র বাঁচায় আমাকে। সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে।

    আমার মধ্য কলকাতার আকাশ ছাওয়া বেড়াল-বেড়াল-বাড়িটাতে, বিকেল বেলা সুস্মিতা আসতেন কিছু না কিছু নিয়ে, কোনওদিন রাবড়ি, কোনওদিন ধনে পাতার আচার। গল্প বলতেন জীবনের, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কী করে তিনি তিনি হলেন। স্বাতী আর স্বপ্নার তুমুল তারুণ্য, উরি উচ্ছ্বাস, ঢোলের মতো বাজতো ঘরদোরে। শর্মিষ্ঠা নামের মেয়ে কত কত কবিতা আওড়ে সন্ধেগুলো উজ্জ্বল করেছে। বড় ভালোবেসেছিল শিবানী, বড় স্বজন ছিল শর্মিলা। বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ চলে আসতেন, হাতে সীলভোগ, হাতে মিহিদানা, মুখে সলজ্জ সম্ভাষণ। হঠাৎ উদয় হয়ে সকৌতুকে জীবন বলতো রঞ্জন। সুমিতাভে মগ্ন হওয়া সেই তীব্র বর্ষাগুলো। আর সেইসব সুব্রতময় দিন!

    বরফে জমতে থাকা আমার শীতার্ত নির্বাসনে সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয় দেবে। জঙ্গিপুর থেকে গিয়াসউদ্দিন আসতেন, চব্বিশ পরগনা থেকে মোজাফফর, আমাদের চোখের সরোবরে স্বপ্ন সাঁতার কাটতো,অবিশ্বাস্য সব সুন্দরের স্বপ্ন।

    দেশ থেকে দাদা আসতো একতাল শৈশব নিয়ে, কাঁধে করে উঠিয়ে আনতো দেশের বাড়ি, দাদার গা থেকে গন্ধ বেরোতো হাসনুহানার। হাসনুহানার ওই গন্ধই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে। দূর পরবাসে জমে জমে বরফ হতে থাকা আমাকে কে বাঁচাবে আর, যদি স্মৃতিই না বাঁচায়।

    .

    র.

    বিখ্যাতদের সঙ্গে ওঠাবসা আমার কখনও ছিল না। নামী নামী লোকেরা আমার আশেপাশে খুব একটা ঘেঁসেনি কোনওদিন, অথবা সন্তর্পণে আমিই দূরে দূরে থেকেছি ভয়ে বা সংকোচে। আমার মতো করে তাই বাস করতে পারতাম শহরে, আমার মতো করে মাটিতে মাটির মানুষের সাথে। সহজ সাধারণরাই সাধারণত আমার স্বজন, বাজারের ঝকাওয়ালা, তরকারিওয়ালা, মাছ কাটার টগবগে ছেলেরা, মাছওয়ালা, চায়ের দোকানের বেজায় ভদ্রলোকটি, ধনঞ্জয় ধোপা, আর সেই মল্লিকপুর থেকে আসা মঙ্গলা, সোনারপুরের সপ্তমী, এদের ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো? ওদিকে দুর্গা প্রতিমার মতো মুনা, কল্যাণী থেকে ছুটে আসা গার্গী, মানসী মেয়েটির ওই একবার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া, ছেড়ে কোথায় কোন নির্বাসনে যাবো আমি? উঠোনের ঘাসে ফুটে থাকা মনকাড়া ফুল, ‘মালিদা মালিদা, ও ফুলের নাম কী?’ একগাল হেসে মালিদা কতদিন বলেছে, ‘ও ফুলের তো দিদি কোনও নাম নেই।

    দিগন্ত অবধি কত মাঠ জুড়ে কত সুগন্ধ ছড়ানো কত নামহীন ফুল,ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো?

    .

    ল.

    যারা দিচ্ছে কারাগারে আমাকে পাহারা, তাকায় বিস্ময় নিয়ে মাঝে মধ্যে তারা, কী কারণে পড়ে আছি একা একা জেলে জগৎ সংসার দূরে বহুদূরে ফেলে! বুঝতে পারেনা তারা, চোখের তারায় হয়তো কফোঁটা জল কাঁপে করুণায়! কানে কানে বারবারই প্রশ্ন করে যায় কে বাঁচে এভাবে স্বাধীনতাহীনতায়? আমি কি বুঝিনা বুঝি? একা অন্ধকারে বসে থেকে দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ে হাড়ে। কী করে এতটা ধৈর্য কোথায় পেলাম? ধৈর্যের পরীক্ষা হলে কার বদনাম! কে কার পরীক্ষা নেবে, মানবে কে হার! আমাকে করেছে বন্দি ক্ষুব্ধ সরকার। পরীক্ষা আমার নয়, তাদের এবার, কতদিনে করে দেখি বিষফোঁড়া পার। ধৈর্যের যা কিছু বাঁধ, ভেঙে সর্বনাশ, লাভ নেই টেনে ধরে ইস্পাতের রাশ! আপাতত করে নিচ্ছে ধর্মবাদ চাষ! পরেরটা পরে হবে, পরে রাজহাঁস। চুনোপুটি ধৈর্য ধরে বছর যাওয়াবে, তিমিরা সইবে কেন! আস্ত গিলে খাবে। আমার না হয় আশা আজকাল ক্ষীণ। ধর্মবাদের ফসল কোনও একদিন তাদের তুলতে হবে নিজেদের ঘরে, ভরে যাবে সবকটা ঘর বিষধরে। কালসাপগুলো পোষা দুধ কলা দিয়ে, একেকজনকে খাবে গিলে বা চিবিয়ে। সেদিনের কিন্তু খুব বেশি নেই বাকি, যেদিন জানবে তারা নিজেদেরই ফাঁকি দিয়ে গেছে দিন দিন, মনোবলহীন, তুখোড় রাজনীতিক, দূরদৃষ্টিহীন।

    .

    ষ.

    আমি জেলে থাকি তাতে কার কী! এরকম কত লোক জেলে আছে! অন্যায় করিনি তাতেই বা কী! কত নিরপরাধ মরে পড়ে আছে কতখানে! ফাঁসি হয়ে যায় কত নির্দোষের, যাবজ্জীবনও হচ্ছে তো প্রতিদিনই। আমি কারাগারে এ আর এমন কী! এ তথ্য নতুন নয়। অনেক লেখককে শাসকেরা ভুগিয়েছে বিভিন্ন দেশে। খুব কিছু অভিনব নয় কারাগার-বাস। এরকম বলে দায়িত্ব এড়ান বড় বড় লোক। হঠাৎ কখনও রহস্যময় মৃত্যুটি এসে গেলে খবর বেরোবে, আপদ মরেছে অবশেষে। তাতেই বা কারও কিছুই কি যায় আসে। কজন দাঁড়াবে জানতে মৃত্যুর কারণ, প্রতিবাদ মিছিলে সাকুল্যে কুড়িজন হবে তোক? অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বটে, ক্ষমতাকে কম বেশি সবাই আমরা চিনি। নির্বাসনে না গেলে মানুষ কি চেনা যায়। এই মেরুদন্ডহীনের দেশে ভাবতে লজ্জা হয় ভালোবেসে বাস করি। হাতে গোনা কিছু সৎ ও সাহসী মানুষ হৃদয়ে রয়ে যাবে যতদিন বাঁচি, এই দেশ থেকে আর প্রাপ্তির কিছু নেই।

    .

    স.

    অভিজ্ঞতার জন্য সবার অন্তত এক বার নির্বাসনের জীবন ভোগের প্রচন্ড দরকার।

    পরাধীনতার কিছু না পোহালে স্বাধীনতা কী জিনিস কী করে বুঝবে, কেই বা বুঝবে। মর্যাদা দেবে কেন! স্বাধীনতা পেতে লড়াই করছি শৈশব থেকে প্রায়, আমি বুঝি এর গভীর অর্থ, আবশ্যকতা কত। জীবন দেখেছি বলে প্রাণপণে জীবন ফেরত চাই অনেকের মতো নাহলে নিতাম পরাধীনতায় ঠাই। স্বাধীনতা ভোগ যারা প্রতিদিনই করছে জানেনা এর আসল মানেটা আসলে খুবই সামান্য কিছু কি না। পরাধীনরাও গৃহস্থঘরে মরে পচে গলে যায়, সারাজীবনেও জানতে পারেনা কী যে তারা অসহায়।

    যুদ্ধ করেই বোঝাতে চাইছি যুদ্ধ করতে হয়, স্বাধীনতা চাই সবাইকে দিতে, কেবল আমাকে নয়, নিজে না ভাঙলে, নিজের শেকল কেউই ভাঙেনা এসে, প্রয়োজনে পাশে মানুষ কোথায় দাঁড়াবে যে ভালোবেসে! ধর্মতন্ত্র আমাকে ফাঁসিয়ে মিথ্যেকে দিল জয়। লক্ষ নারীকে পুরুষতন্ত্র বন্দি করেছে ঘরে, বিক্রি হচ্ছে শত শত লোক ধর্মান্ধের কাছে। স্বাধীনতা আজ দুর্লভ খুব দুর্ভাগাদের দেশে।

    .

    হ.

    একটা সরল সোজামানুষকে নিয়ে রাজনীতিকরছো তোমরা, তার সত্য কথাবলা তোমাদের সহ্য হচ্ছে না, তার সততা তোমাদের আর পছন্দ হচ্ছে না। তাকে রাজ্য ছাড়া করেছে, আচমকা তাকে তার ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে বিমান বন্দরে, ঘর বাড়ি যেমন ছিল, ওভাবেই এখনও পড়ে আছে, যে বইটা পড়ছিলাম, সেটা ওভাবেই খোলা, লেখার খাতাটাও ওভাবে, কলমের নিব খোলা থেকে থেকে কালি শুকিয়ে গেছে সম্ভবত, লেখকের কলমের কালি শুকিয়ে ফেলতে চাইছো তোমরা। লেখককে তার লেখার ঘরে যেতে দিতে চাইছো না, লেখককে বন্দি করেছো, যেভাবে কোনও ঘৃণ্য হত্যাকারীকে বন্দি করো। যেভাবে ফাঁসি দেওয়ার জন্য রেখে দাও দাগী আসামীকে, সেভাবে আমাকে রেখে দিয়েছে, কোথায় কোন গুহায় রেখেছো কাউকে জানতে দিচ্ছো না, পৃথিবীর কাউকে না, আমাকেও না।

    লেখককে ভাবতে দিতে চাইছো না, লেখককে লিখতে দিতে চাইছো না, লেখককে বাঁচতে দিতে চাইছো না, তোমাদের না-চাওয়াগুলো স্পষ্ট দেখছে পৃথিবী। ভাবনা কী। তোমাদের বশীভূত লেখকেরা, পোষ্য ঐতিহাসিকেরা স্বর্ণাক্ষরে তো লিখেই রাখবে ইতিহাসে তোমাদের নাম!

    .

    ড়.

    আমি এখন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে বন্ধ একটা জানালা আছে, যে জানালা আমি ইচ্ছে করলেই খুলতে পারি না। ভারি পর্দায় জানালাটা ঢাকা, ইচ্ছে করলেই আমি সেটা সরাতে পারি না। এখন একটা ঘরে আমি বাস করি, ইচ্ছে করলেই যে ঘরের দরজা আমি খুলতে পারি না, চৌকাঠ ডিঙোতে পারি না। এমন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে আমি ছাড়া প্রাণী বলতে দক্ষিণের দেয়ালে দুটো দুস্থ টিকটিকি। মানুষ বা মানুষের মতো দেখতে কোনও প্রাণীর এ ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় আমার।

    আর কোনও শব্দ নেই চারদিকে, শুধু মাথা ঠোকার শব্দ। জগতের কেউ দেখে না, শুধু টিকটিকিদুটো দেখে, বড় বড় চোখ করে দেখে, কী জানি কষ্ট পায় কিনা–মনে হয় পায়। ওরাও কি কাঁদে, যখন কাঁদি? একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে বাস করতে আমি চাই না। একটা ঘরে আমি বাস করতে বাধ্য হই, একটা ঘরে আমাকে দিনের পর দিন বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র, একটা ঘরে, একটা অন্ধকারে, একটা অনিশ্চয়তায়, একটা আশংকায় একটা কষ্টে, শ্বাসকষ্টে আমাকে বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র। একটা ঘরে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা।

    একটা ঘরে আমাকে বাধ্য করছে প্রিয় ভারতবর্ষ…..

    ভীষণ রকম ব্যস্তসমস্ত মানুষ এবং মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের সেদিন দু’সেকেন্ড জানি না সময় হবে কিনা দেখার, ঘর থেকে যেদিন জড়বস্তুটি বেরোবে, যেদিন পচা গলা একটা পিন্ড। যেদিন হাড়গোড়। মৃত্যুই কি মুক্তি দেবে শেষ অবধি? মৃত্যুই বোধহয় স্বাধীনতা দেয় অতপর চৌকাঠ ডিঙোনোর! টিকটিকিদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে সারাদিন, ওদেরও হয়তো দুঃখ হবে মনে। গণতন্ত্রের পতাকা পেঁচিয়ে প্রিয় ভারতবর্ষের মাটিতে আমাকে পুঁতে দেবে কেউ, কোনও সরকারি লোক সম্ভবত। সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে চৌকাঠ নেই ডিঙোতে চাওয়ার, সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে শ্বাসকষ্ট নেই।

    .

    ঢ়.

    কখনও কোনওদিন যদি অন্তরিন হতে হয় তোমাকে, যদি শেকল পরায় কেউ পায়ে, আমাকে মনে কোরো। যদি কোনওদিন যে ঘরটিতে তুমি আছো সে ঘরের দরজা ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকে বন্ধ করে কেউ চলে যায়, মনে কোরো। সারা তল্লাটে কেউ নেই তোমার শব্দ শোনে, মুখ বাঁধা, ঠোঁটে শক্ত সেলাই। কথা বলতে চাইছো, কিন্তু পারছে না। অথবা কথা বলছো, কেউ শুনতে পাচ্ছে না, অথবা শুনছে, শুনেও গা করছে না, মনে কোরো। তুমি যেমন খুব চাইবে কেউ দরজাটা খুলে দিক, তোমার শেকল সেলাই সব খুলে দিক, আমিও তেমন চেয়েছিলাম, মাস পেরোলেও কেউ এ পথ মাড়ায়নি, দরজা খুলে দিলে আবার কী হয় না হয় ভেবে খোলেনি কেউ। মনে কোরো।

    তোমার যখন খুব কষ্ট হবে, মনে কোরো আমারও হয়েছিলো, খুব ভয়ে ভয়ে সাবধানে মেপে মেপে জীবন চললৈও আচমকা অন্তরিন হয়ে যেতে পারে যে কেউ, তুমিও। তখন তুমি আমি সব একাকার, দুজনে এক সুতো তফাৎ নেই, তুমিও আমার মতো, তুমিও অপেক্ষা করো মানুষের, অন্ধকার কেঁপে আসে, মানুষ আসে না।

    .

    য়.

    এমনই অপরাধী, মানবতার এমনই শত্ৰু আমি, এমনই কি দেশদ্রোহী যে দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার। দেশই তবে কেড়ে নেবে আমার বাকিটা জীবন থেকে আমার স্বদেশ। দেশ দেশ বলে অন্ধের মতো উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ পাহাড় সমুদ্র আর সারি সারি বৃক্ষ অন্ধের মতো আকাশ চাঁদ কুয়াশা রোদ্দুর, অন্ধের মতো ঘাস লতাগুল্ম মাটি আর মানুষ হাতড়ে হাতড়ে দেশ খুঁজেছি। পৃথিবী ফুরিয়ে অবশেষে জীবন ফুরোতে দেশের তীরে এসে বসা ক্লান্ত পিপাসার্ত মানুষের নিশ্চিন্তিকে তুমি যদি টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাও, আঁজলার জলটাও ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে মৃত্যুদন্ড দাও, তবে কী নামে ডাকবো তোমাকে, দেশ?

    বুকের ওপর মস্ত পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে বুটজুতোর পা দিয়ে গলা পিষছো, খুঁচিয়ে তুলে নিয়েছো দুটো চোখ, মুখ থেকে টেনে বের করে নিয়েছে জিভ, টুকরো করেছে, চাবুক মেরে চামড়া তুলে নিয়েছে, গুঁড়ো করে দিয়েছে পা,পায়ের আঙুল, খুলি খুলে মস্তিষ্ক থেঁতলে দিচ্ছো, বন্দি করেছে, যেন মরি, যেন মরে যাই, আমি তবু দেশ বলেই তোমাকে ডাকি, বড় ভালোবেসে ডাকি। কিছু সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমি দেশদ্রোহী, মিথুকের মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তুমি চলবে বলে আজ আমি দেশদ্রোহী। মানবতাকে যেন মাটি দিয়ে দিই নয়তো সাত আসমানে উড়িয়ে দিই–তর্জনী তুলে বলে দিয়েছে। আর যা কিছুই থাক বা না থাক, দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার। আমার জীবন থেকে, তুমি দেশ, হৃদয় খুঁড়ে নিয়ে গেলে আমারই স্বদেশ।

    .

    ৎ.

    ওদেরই তাহলে স্বাধীনতা দেওয়া হোক, ওদের জন্যই খুলে দেওয়া হোক অতপর অস্ত্রাগার। তলোয়ারগুলো তুলে নিক, কোমরে গুঁজে নিক পিস্তল, হাতে হাত-বোমা, দারুল ইসলাম এর মন্ত্র মাথায় নিয়ে ওরা না হয় বেরিয়ে পড়ুক, যেদিকে যত মুরতাদ পাক মুণ্ডু কেটে নিক। মেয়েদের মারুক, মেরে ফেলুক। নতমস্তক নারীদের গায়ে বোরখা চাপিয়ে দিক, ঘরবন্দি করুক। ঘন ঘন পুত্র পয়দা করতে ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলুক। পৃথিবীর যত পুরুষ আছে, এক যোগে সবাই না হয় তালিবান হয়ে যাক, আর্জেন্টিনা থেকে আইসল্যান্ড, মালদ্বীপ থেকে মরক্কো, বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন ওদের দখলে চলে আসুক। ইসলামের পবিত্র জমিতে পরম শ্রদ্ধায় মাথা ঠেকাক আমাদের জননেতাগণ। মুকুট পরিয়ে দিক এক একটা জঙ্গির মাথায়। কৃতকর্মের জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করুক জননেতাগণ। ধর্মান্ধর পা-ধোয়া পানি পান করে পুণ্যবান হোক আমাদের জননেতাগণ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন
    Next Article বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ফেরা – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }