Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিশীথিনী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প140 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক

    ১২

    মিসির আলি নরম স্বরে বললেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক। আমার এক ছাত্রী কি এ বাড়িতে—।’

    বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘আসুন, আমি নীলুর বাবা। আমার নাম জাহিদুল ইসলাম।’

    ‘স্লামালিকুম।’

    ‘ওয়ালাইকুম সালাম। বসুন আপনি, নীলু এসে পড়বে।’

    ‘ওকে খবর দিন। আমি বেশিক্ষণ থাকব না, আকাশের অবস্থা ভালো না–ঝড়-বৃষ্টি হবে।‘

    জাহিদ সাহেব তাঁর মেয়েকে খবর দেয়ার জন্যে মোটেই ব্যস্ত হলেন না। খবর দেয়ার কিছু নেই। নীলু খবর পেয়ে গেছে। দশ মিনিট আগেই সে বলেছে, ‘স্যার আমাদের বাসার দিকে রওনা হয়েছেন। এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যে।

    নীলুর মুখ উজ্জ্বল এবং হাসি-হাসি। এইসব জাহিদ সাহেবের ভালো লাগছে না। এক জন মাঝবয়সী অধ্যাপকের জন্যে এত আগ্রহ নিয়ে তাঁর মেয়ে অপেক্ষা করবে কেন?

    তিনি একটি সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়েকে নিজের পাশে চান–যার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। কী হবে না হবে, যা সে আগে থেকে বলতে পারবে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে যে গ্রহণ করবে আর দশটি মেয়ের মতো।

    মিসির আলি বললেন, ‘আমি আপনার এ-বাড়িতে আগে এক বার এসেছি। আনিস সাহেব বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর স্ত্রীকে কিছুদিন চিকিৎসা করেছিলাম।’

    ‘আমি জানি।’

    ‘আনিস সাহেব কি এখনো এ-বাড়িতে থাকেন?’

    ‘না।’

    ‘অন্য কোনো ভাড়াটে এসেছে বুঝি?’

    ‘না, বাড়ি ভাড়া দিই না এখন, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।

    ‘এ কথা বলছেন কেন?’

    ‘রানু মেয়েটা এ-বাড়িতে না থাকলে, আজ আমার মেয়ের এ-অবস্থা হত না।’এত জোর দিয়ে তা বলা কি ঠিক? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউ তো জানি না।’

    জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। রোগা, কালো এবং কিঞ্চিৎ কুঁজো হয়ে বসে থাকা এই লোকটিকে তাঁর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। নীলু এই লোকটির মধ্যে কী দেখেছে? জাহিদ সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে উঠে চলে যেতে। কিন্তু বাইরের একটি লোককে একা বসিয়ে রেখে উঠে চলে যাওয়া যায় না। তিনি লক্ষ করলেন, ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন। তাঁর সামনেই অ্যাশটে তবু তিনি চারদিকে ছাই ফেলছেন। কী কুৎসিত স্বভাব! এরা ছাত্রদের কী শেখাবে? নিজেরাই তো কিছু শেখে নি!

    মিসির আলি বললেন, ‘আপনার আরেকটি মেয়ে ছিল। ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?’

    ‘হ্যাঁ।’

    কোথায় আছে সে?’

    ‘বাইরে।‘

    বিলুর প্রসঙ্গ উঠলেই জাহিদ সাহেব অনেক কথা বলেন। কিন্তু আজ এই লোকটির সঙ্গে কোনো কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

    ‘মিসির আলি সাহেব।’

    ‘জ্বি?’

    ‘আমার মাথা ধরেছে, আমি একটু শুয়ে থাকব। কিছু মনে করবেন না। আমি নীলুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

    ‘জ্বি আচ্ছা।’

    জাহিদ সাহেব নীলুর ঘরে উঁকি দিয়ে অবাক এবং দুঃখিত হলেন। নীলু শাড়ি বদল করেছে। সাধারণ শাড়ি বদলে বেগুনি রঙের চমৎকার একটি শাড়ি পরেছে এবং চুল বাঁধছে। এর মানেটা কী?

    ‘নীলু।’

    ‘জ্বি?’

    ‘তোর স্যার বসে আছেন নিচে।’

    ‘যাচ্ছি বাবা।’

    ‘বেশিক্ষণ ওঁকে আটকে রাখা ঠিক না। আকাশের অবস্থা খারাপ।’

    ‘বাবা, আমি তো ওঁকে আজ রাতে এখানে থেকে যেতে বলব।’

    ‘সে কী! কেন?’

    ‘আমার কথা শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যাবে। এত রাতে আমি ওঁকে ছাড়ব না।’

    ‘কথাটা তাহলে দিনের বেলা বল। কাল ওঁকে আসতে বলে দে।’

    ‘বাবা, ওঁর সঙ্গে আজই আমার কথা বলা দরকার। একটা রাত উনি এখানে থাকলে, তোমার কি কোনা আপত্তি আছে?’

    জাহিদ সাহেব হ্যাঁ, না–কিছুই বলতে পারলেন না। নীলু বলল, ‘আমাদের গেস্টরুমটা ঠিকঠাক করে রেখেছি। উনি সেখানেই থাকবেন। তুমি এত গম্ভীর হয়ে আছ কেন বাবা? আপত্তি থাকলে বল–আমার আপত্তি আছে।’

    ‘আমার আপত্তি আছে।’

    ‘আপত্তিটা কেন?’

    ‘ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে তোর এত কিসের খাতির?’

    ‘খাতির কিছু নেই বাবা। উনি আমার টীচার এবং চমৎকার এক জন টীচার। আমি অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর প্রতি আমার অন্য রকম একটা শ্রদ্ধা আছে।’

    ‘এই জন্যেই কি এত শাড়ি-গয়না পরে সাজতে শুরু করেছিস?’

    ‘না বাবা, সে জন্যে সাজছি না এবং তুমি যা ভাবছ তাও ঠিক না। আমি এত সাজগোজ করছি, কারণ স্যার রিকশা করে আসতে আসতে ভাবছিলেন, আমাকে দেখবেন বেগুনি রঙের একটা শাড়িপরা অবস্থায়। কাজেই আমি এইভাবে সেজেছি। রহস্যময় সবকিছুতে স্যারের অবিশ্বাস আছে, আমি সেটা দূর করতে চাই। চলে যেও না বাবা, আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। এই স্যার রানু আপার ব্যাপারটা খুব ভালো জানেন। রানু আপার রহস্যের সঙ্গে আমার রহস্যের একটা মিল আছে। সেই মিল নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমি কথা বলব।’

    নীলু দম নেয়ার জন্যে থামল। জাহিদ সাহেব কী বলবেন, ভেবে পেলেন না।

    ’বাবা।’

    ‘বল।’

    ‘স্যার যদি আজ রাতে এ বাড়ির গেস্টরুমে থাকেন, তোমার কি খুব বেশি আপত্তি হবে?’

    ‘না।’

    ‘আমি যখন স্যারের সঙ্গে কথা বলব, তখন তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে থাকতে পার।’

    ‘না, আমি শুয়ে থাকব, আমার মাথা ধরেছে।’

    ‘না বাবা, তোমার মাথা ধরে নি। তুমি আমার স্যারকে খুবই অপছন্দ করছ বলে এ-রকম করছ। বাবা, তোমাকে শুধু একটা কথা বলি–মানুষ হিসেবে উনি প্রথম শ্রেণীর। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না?’

    ‘বিশ্বাস করব না কেন? করছি।’

    ‘না, তুমি করছ না। তাতে অবশ্যি কিছু যায় আসে না, তবে তুমি যদি বিশ্বাস করতে, তাহলে আমার ভালো লাগত। ঠিক আছে বাবা, তুমি যাও, শুয়ে থাক। রাত দশটার সময় টেবিলে ভাত দেব, তখন তোমাকে ডাকব।’

    নীলু বসার ঘরে ঢুকল নিঃশব্দে। মিসির আলি চাঁপা ফুলের হালকা একটা সুবাস পেয়ে চমকে পেছনে ফিরলেন। নীলু বলল, ‘কেমন আছেন স্যার?’

    তিনি কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তাঁর দারুণ অস্বস্তি ও লজ্জা লাগতে লাগল। একটা বিব্রতকর অবস্থা। কারণ তিনি রিকশায় আসতে-আসতে নীলুকে যেভাবে দেখবেন কল্পনা করেছিলেন, সে ঠিক সেভাবেই সেজেছে। কাকতালীয় মিল বলে একে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। দুটি কারণে এ রকম হতে পারে। হয়তো নীলু এ-রকম সেজে বসে ছিল। তিনি তাঁর ই এস পি-র মাধ্যমে তা টের পেয়েছেন। এটা সম্ভব নয়, কারণ মিসির আলি খুব ভালো করেই জানেন, তাঁর কোনো ESP ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় কারণটি যদি সত্যি হয়, তাহলে বড় অস্বস্তির ব্যাপার হবে। তিনি রিকশায় আসতে-আসতে যা ভাবছিলেন, নীলু তা টের পেয়েছে এবং সেইভাবে সেজেছে। এ রকম হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

    মিসির আলি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁর মনে নীলু সম্পর্কে যে-সব কল্পনা আছে, তা তিনি আড়াল করে রাখতে চান। বিশেষ করে ট্রেনে আসতে-আসতে যে স্বপ্নটা দেখেছেন। এটি যদি নীলু টের পায়, তাহলে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘দেখ নীলু, স্বপ্নের ওপর আমার হাত নেই। স্বপ্ন হচ্ছে স্বপ্ন।’

    কিন্তু মনোবিজ্ঞানের এক জন শিক্ষক হিসেবে তিনি জানেন, স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। অবচেতন কামনা-বাসনার ছবি। তিনি তাকালেন নীলুর দিকে। মেয়েটির মুখে হাসি। ছোটদের দুষ্টুমি দেখে বড়রা যে-রকম হাসে, সে-রকম।

    নীলু বলল, ‘স্যার চলুন, আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি।’

    ‘আমি বেশিক্ষণ বসব না নীলু। আকাশের অবস্থা ভালো না, ঝড় হবে।’

    ‘হলে হবে। ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে ঠিক এই মুহূর্তে আপনাকে ভাবতে হবে না।’

    বারান্দায় অন্ধকার। সেখানে পাশাপাশি দুটি বেতের চেয়ার দেয়া আছে। গ্রিল থাকা সত্ত্বেও বারান্দায় বসে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়, যে-আকাশে অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, ‘কী বলবে তুমি, বল।’

    নীলু বলল, ‘আপনি একবার ক্লাসে ESP-র ওপর বলেছিলেন। আপনার মনে আছে?’

    ‘আছে।’

    ‘আমার এবং আমার কয়েকজন বন্ধুর ESP আছে কি না তা পরীক্ষা করলেন। মনে আছে?’

    ‘হ্যাঁ, মনে আছে। জেনার কার্ড’ দিয়ে পরীক্ষা।

    ‘সেই পরীক্ষায় আমরা কেউ পাস করতে পারি নি। তার মানে, আমাদের কারোরই এক্সটা সেনসরি পারসেপশান ক্ষমতা নেই।’

    ‘হুঁ, তা ঠিক। যাদের লজিক খুব তীক্ষ্ণ, তাদের এটা থাকে না। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের, যাদের লজিক খুব দুর্বল–তাদের থাকে।’

    ‘স্যার, আমি জানি না আমি এখন একটি নিম্নশ্রেণীর প্রাণী কিনা, কিন্তু আমার ESPক্ষমতা অনেক বেশি। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন, আমি বলে দিতে পারি।

    নীলু বলতে-বলতে হেসে ফেলল। এবং হাসি ঢাকার জন্যে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। মিসির আলি খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। কারণ, তিনি একটি আপত্তিকর ভাবনা ভাবছিলেন। তিনি ভাবছিলেন–নীলুর সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দু’ জনেই ভিজে জবজবে। হুড তোলা এবং পর্দা ফেলা। রিকশাওয়ালা বাতাস কাটিয়ে বহু কষ্টে এগুচ্ছে। তিনি নীলুর হাত ধরে আছেন।

    ‘স্যার।’

    ‘বল।

    ‘শুধু শুধু আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আমরা সবাই তো এ-রকম কত অদ্ভুত অদ্ভূত চিন্তা করি, এবং এটাই তো স্বাভাবিক।’

    ‘হুঁ, তা ঠিক। আমার সঙ্গে কী বলতে চাচ্ছিলে বল। আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ঝড় আসবে।’

    বলতে না বলতেই বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বাতাস বইতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। নীলু মৃদু স্বরে বলল, ‘রানু আপাকে তো আপনি ভালো মতন চিনতেন, তাই না স্যার?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘রানু আপার সঙ্গে আমার কী কী মিল আছে?’

    ‘কোনো মিল নেই। প্রতিটি মানুষই আলাদা। এক জন মানুষের সঙ্গে অন্য এক জন মানুষের মিল থাকে সামান্যই।’

    ‘কিন্তু রানু আপার অসম্ভব ইএসপি ক্ষমতা ছিল। ছিল না?’

    ‘তা ছিল।’

    ‘আমারও আছে। আছে না?’

    ‘হ্যাঁ, আছে।’

    ‘রানু আপা কি আপনাকে কখনো বলেছিল, তার ভেতরে এক জন দেবী বাস করেন?’

    ‘বলেছিল।’

    ‘আপনি বিশ্বাস করেন নি?’

    ‘না, করি নি। এইসব ছেলেমানুষি জিনিস বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।’

    না?’

    ‘স্যার, রানু আপা যা বলত, এখন আমি যদি তা-ই বলি–আপনি বিশ্বাস করবেন

    ‘না।’

    ‘পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে স্যার।’

    একসময় ঝড়-বৃষ্টিকেও রহস্যময় মনে করা হত, এখন করা হয় না। মানুষের জ্ঞান, মানুষের বুদ্ধি রহস্যময়তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে যত অলৌকিক ব্যাপার আছে, তার প্রতিটির পেছনে আছে একটি লৌকিক ব্যাখ্যা।’

    মিসির আলি সিগারেট ধরালেন এবং বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন-

    ‘দেখ নীলু, তুমি বলছ, তোমার ভেতর এক জন দেবী আছেন। সেই দেবী যদি এই মুহূর্তে তোমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন এবং আমাকে বলেন ‘এই যে মিসির আলি সাহেব।’ তাহলেও আমি ব্যাপারটা বিশ্বাস করব না। আমি খুঁজব একটা লৌকিক ব্যাখ্যা।’

    ‘কী হবে সেই ব্যাখ্যা?’

    ‘আমি যা দেখব, মনোবিজ্ঞানীর ভাষায় তার নাম হেলুসিনেশন। কিছু-কিছু ড্রাগ্‌স্‌ আছে, যা খেলে হেলুসিনেশন হয়। যেমন এলএসডি। ইংল্যাণ্ডে আমি এক ছাত্রকে দেখেছিলাম–সে এলএসডি খেত যিশুখ্রিস্টকে দেখার জন্যে। এলএসডি খেলেই সে যিশুখ্রিস্টকে দেখতে পেত। তুমি বুঝতেই পারছ, সে যা দেখত, তা হেলুসিনেশন।’

    নীলু দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইল। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। এক-একটা বাতাসের ঝাপটা এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে, তবু দু’ জনের কেউ নড়ল না। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু মিসির আলির সিগারেটের আলো ওঠানামা করছে।

    নীলু ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘স্যার।’

    ‘বল।

    ‘আমি একটি খারাপ লোকের হাতে পড়েছিলাম স্যার। একটা ভয়ঙ্কর খারাপ লোক আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নির্জন একটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সে একটা ক্ষুর নিয়ে এসেছিল আমাকে মারতে। তখন সেই দেবী আমাকে রক্ষা করেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমার দেখা। দেবীকেও আমি দেখেছি। একটি অপূর্ব নারীমূর্তি।’

    ‘তুমি বলতে চাও, তারপর থেকে সেই দেবী তোমার সঙ্গে আছে?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘তুমি যা দেখেছ, তার যে একটা লৌকিক ব্যাখ্যা হতে পারে–তা কি তুমি

    ভেবেছ?’

    ‘সবকিছুর ব্যাখ্যা নেই স্যার।’

    ‘চেষ্টা করে দেখি, এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় কিনা।’

    ‘ঠিক আছে, চেষ্টা করুন।‘

    ‘রানু মেয়েটির সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল। তার কাছ থেকেই দেবীর ব্যাপারটি তুমি শুনেছ। একটা নতুন ধরনের কথা। রোমান্টিক ফ্লেভার আছে দেবীর ব্যাপারটায়, কাজেই জিনিসটা তোমার মনে গেঁথে রইল। তুমি নিজে যখন বিপদে পড়লে, ঐ জিনিসটাই উঠে এল তোমার মনের ভেতর থেকে। একটা হেলুসিনেশন হল। তীব্র মানসিক চাপ এবং তীব্র হতাশা থেকে এই হেলুসিনেশনের জন্ম। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে stress induced hallucination.

    ‘ঐ খারাপ লোকটি মারা গেল কীভাবে?’

    ‘তার মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক কারণে। পা পিছলে উল্টে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে বা এইজাতীয় কিছু। এখানে দেবীর কোনো ভূমিকা নেই। লোকটির সুরতহাল রিপোর্ট থেকেই তার মৃত্যুর কারণ বের হয়ে আসা উচিত। কী ছিল পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে?’

    মিসির আলি প্রশ্নের জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন। কোনো জবাব পাওয়া গেল না। নীলু মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। অন্ধকারে পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কেন জানি তাঁর মনে হল, মেয়েটি কাঁদছে। কাঁদবে কেন সে? কাঁদার মতো কোনো কথা কি তিনি বলেছেন?

    ‘নীলু।’

    ‘জ্বি।’

    ‘আমি এখন উঠি? আমার যাওয়া দরকার। এ-বৃষ্টি কমবে না। যত রাত হবে, তত বাড়বে। তুমি কি আমাকে আরো কিছু বলবে?’

    নীলু জবাব দিল না। মিসির উঠে দাঁড়ালেন।

    ’তোমার বাবাকে খবর দাও, বিদেয় নিয়ে যাই।’

    নীলু কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’

    তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘বাসায় যাচ্ছি, আর কোথায় যাব?’

    ‘না আপনার বাসায় যাওয়া হবে না। আজ রাতে আপনি এখানে থাকবেন।’

    ‘কী বলছ তুমি!’

    ‘আপনার জন্যে ঘর রেডি করে রেখেছি। সঙ্গে অ্যাটাচ্‌ড্ বাথরুম আছে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।’

    ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এখানে কেন থাকব?’

    এখানে থাকবেন, কারণ আজ রাতে লোহার রড নিয়ে একটি ছেলে আপনাকে মারতে যাবে। আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না বা বানিয়েও কিছু বলছি না। আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি। ঐ ছেলেটির নাম যদি আপনি জানতে চান, তাও বলতে পারি। কি, জানতে চান?’

    মিসির আলি ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘ওর কী নাম?’

    ‘ওর নাম ফিরোজ। স্যার, আপনি কি আমি যা বলছি, তা বিশ্বাস করছেন?’

    ‘বুঝতে পারছি না। আমি একটি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছি।’

    ‘দ্বিধার মধ্যে পড়েন বা না পড়েন–আমি এখান থেকে আপনাকে যেতে দেব না, কিছুতেই ন

    মিসির আলি লক্ষ করলেন, মেয়েটি কঠিন স্বরে কথা বলছে। তার কথা বলার ধরন থেকেই বলে দেয়া যায়, এই মেয়ে তাকে যেতে দেবে না।

    ‘নীলু, আমার বাসায় কাজের মেয়েটি আছে একা।‘

    ‘না, ‘ইমা’ আপনার ঘরে নেই। আপনার ফিরতে দেরি দেখে সে বাড়িওয়ালার ঘরে ঘুমুতে গেছে।’

    ‘তুমি ওর কী নাম বললে?’

    ‘যা নাম, তা-ই বললাম—ইমা।’

    ‘ইমা?’

    ‘হ্যাঁ, ইমা।’

    ‘ওর বাবার নাম বলতে পারবে?’

    ‘ইমা নাম থেকেই আপনি ওর বাবাকে বের করতে পারবেন।’

    বলতে-বলতে নীলু হেসে উঠল। হাসিতে একটি ধাতব ঝঙ্কার। অন্য এক ধরনের কাঠিন্য। যেন এ নীলু নয়, অন্য একটি মেয়ে। অচেনা এক জন মেয়ে

    ‘স্যার আসুন, আপনাকে আপনার ঘর দেখিয়ে দিই। ড্রয়ারে মোমবাতি আছে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে-বসে বৃষ্টির শোভা দেখুন। আমি যাব রান্না করতে।’

    ‘তোমাদের টেলিফোন আছে না?’

    ‘আছে। দিয়ে যাচ্ছি আপনার ঘরে। যত ইচ্ছা টেলিফোন করুন।’

    টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও ফিরোজদের বাড়ির কাউকে ধরা গেল না। হয় টেলিফোন নষ্ট, কিংবা রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না। আশ্চর্য ব্যাপার।

    বাড়িওয়ালা করিম সাহেবকে টেলিফোন করলেন। করিম সাহেব জেগে ছিলেন এবং তিনি জানালেন হানিফা তাঁর বাসাতেই আছে। ঘুমুচ্ছে।

    মিসির আলি মোমবাতি জ্বালিয়ে গেস্টরুমে বসে রইলেন একা-একা। এখনো ইলেকট্রিসিটি আসে নি। বাজ পড়ে কোনো ট্রান্সফরমার পুড়েটুড়ে গেছে হয়তো। কেউ ঠিক করবার চেষ্টা করছে না। এ দেশে কেউ কোনো কিছু ঠিক করবার জন্যে ব্যস্ত নয়। শহর অন্ধকারে ডুবে আছে তো কী হয়েছে? থাকুক ডুবে। দুষ্ট লোকেরা অন্ধকারে বেরিয়ে আসবে? আসুক বেরিয়ে। আমরা কেউ কারো জন্যে কোনো মমতা দেখাব না। মমতা এ-যুগের জিনিস নয়।

    কিন্তু সত্যি কি নয়? মমতা কি কেউ-কেউ দেখাচ্ছে না? নীলু যে তাঁকে আটকে রাখল, তার পেছনে কি মমতা কাজ করছে না?

    সে কেন তাঁকে এই মমতাটা দেখাচ্ছে? কেন, কেন? তাঁর ভুরু কুঞ্চিত হল। কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। জ্বর আসছে নাকি?

    তিনি আবার সিগারেট ধরালেন। প্যাকেট শূন্য হয়ে আসছে। রাত কাটবে কী করে? এ বাড়িতে এখনও কোনো কাজের লোক তাঁর চোখে পড়ে নি, যাকে সিগারেট আনার জন্যে অনুরোধ করা যায়।

    ‘স্যার, আপনার চা।’

    নীলু এসে দাঁড়িয়েছে। মোমবাতির আলোয় কী সুন্দর লাগছে তাকে! মিসির আলি বিব্রত স্বরে বললেন, ‘চা তো চাই নি।’

    ‘রান্না হতে দেরি হবে। চা খেয়ে খিদেটা চেপে রাখার ব্যবস্থা করুন।’

    তিনি চায়ের পেয়ালা হাতে নিলেন, এবং নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, ‘তুমি আমার নিরাপত্তার জন্যে হঠাৎ এত ব্যস্ত হলে কেন?’

    নীলু মৃদু হেসে বলল, ‘এই প্রশ্নের জবাব এখন দেব না। একদিন নিজেই বুঝতে পারবেন। চায়ে চিনি হয়েছে কি না তাড়াতাড়ি দেখুন। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।’

    ‘হয়েছে।’

    নীলু নিঃশব্দে চলে গেল। মিসির আলির হঠাৎ মনে হল, তিনি চাঁপা ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন। হালকা সুবাস, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা গাঢ় হল। তিনি ঘরের ভেতর ফিসফিস কথা শুনলেন। কে কথা বলছে? দমকা বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল, এবং তিনি স্পষ্ট শুনলেন, মল পরে হেঁটে যাওয়ার মতো কে যেন তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন। এ-সব মনের ভুল। এ জগতে কোনো রহস্য নেই। আশেপাশে নিশ্চয়ই কোনো চাঁপা ফুলের গাছ আছে। গন্ধ আসছে সেখান থেকেই।

    কিন্তু তবু তাঁর মনে হচ্ছে, দরজার ওপাশে পর্দার আড়ালে কেউ-একজন দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। কে সে? অন্য ভুবনের কেউ? নাকি অবচেতন মনে তার জন্ম? পৃথিবীর সমস্ত অশরীরীর জন্মই কি অবচেতন মনে নয়? অবচেতন মন জিনিসটির অবস্থান কোথায়? মস্তিষ্কের নিউরোনে? নিউরোনের বৈদ্যুতিক আবেশ‍ই কি আমাদের নানান রকম মায়া দেখাচ্ছে? তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। পর্দাটি খুব নড়ছে। যেন কেউ পর্দা নাড়িয়ে

    তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে।

    তিনি দেয়াশলাই জ্বাললেন। আলো আসুক। আলোর স্পর্শে সব মায়া কেটে যাক। তিনি যেন নিজেকে সাহস দেবার জন্যেই বললেন, ‘এ পৃথিবীতে রহস্যের কোনো স্থান নেই।’

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনিষাদ – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article ময়ূরাক্ষী – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }