Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিশীথিনী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প140 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৮. মোহনগঞ্জ স্টেশনে মিসির আলি

    ৮

    মোহনগঞ্জ স্টেশনে মিসির আলি নামলেন রাত সাড়ে সাতটায়। গায়ে প্রবল জ্বর। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। চোখ মেলতে পারছেন না, এ-রকম অবস্থা। তাঁর নিজের বোকামির জন্যে এটা হয়েছে।

    শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। কামরায় লেখা ‘পঁচিশ জন বসিবেন।’ বসেছে পঞ্চাশ জন। আরো পঞ্চাশ জন দাঁড়িয়ে। অসম্ভব গরম। বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে আসছে উৎকট দুর্গন্ধ। বারবার মিসির আলির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। নরক-যন্ত্রণা বোধ হয় একেই বলে। যাত্রীদের মধ্যে এক জন রোগী আছে, যে কিছুক্ষণ পরপর গোঁ-গোঁ শব্দ করছে। সেই শব্দ শুনে মনে হয়, এক্ষুণি বোধ হয় তার প্রাণবিয়োগ হবে। ভয়াবহ অবস্থা!

    মিসির আলি শ্যামগঞ্জ নেমে পড়লেন। খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নেবেন, এ-আশায়। ট্রেন ছাড়ার সময় হঠাৎ মনে হল–ছাদে বসে গেলে কেমন হয়? অনেকেই তো যাচ্ছে। বাতাসের অভাব হবে না সেখানে। গ্রামের ভেতর দিয়ে ট্রেন যাবে, টাটকা বাতাস পাওয়া যাবে। তিনি ছাদে উঠে পড়লেন।

    ছাদের অবস্থা বেশ ভালো। চমৎকার হাওয়া। মিসির আলি নিজেকে ধন্যবাদ দিলেন, ঠিক সময়ে ঠিক সিন্ধান্তটি নেবার জন্যে।

    সিন্ধান্ত ঠিক ছিল না। হিরণপুর আসবার আগেই আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। প্ৰবল বাতাস বইতে শুরু করল। ধরবার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। তাঁর মনে হতে লাগল, যে-কোনো মুহূর্তে তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে চষা খেতে ফেলবে। জীবনের ইতি হবে সেখানেই। বাতাসের সঙ্গে-সঙ্গে বর্ষণ। বৃষ্টির ফোঁটা সুচের মতো গায়ে বিধছে। আর কী ঠাণ্ডা! যেন বরফের চাঁই থেকে গলে গলে পড়ছে।

    একটা ভালো অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার কথা অন্যকে বলার মতো সুযোগ কি আর হবে? মিসির আলি বাতাসের ঝাপ্টা সামলাবার চেষ্টা করছেন। ছাদের ওপরে বসা মানুষগুলোর কেউ-কেউ আজান দিতে শুরু করেছে। আল্লাহকে খুশি করার একটা চেষ্টা। আল্লাহ্ খুশি হলেন কি না বোঝা গেল না–ঝড়-বৃষ্টি কিছুই কমল না, তবে ড্রাইভার ট্রেন দাঁড় করিয়ে ফেলল। ছাদের ওপরে বসে-থাকা অসহায় মানুষগুলোর আজানের শব্দ নিশ্চয়ই তাঁর কানে গিয়েছে। আজানের ধ্বনি একেবারে বৃথা যায় নি।

    ঝড় আধ ঘন্টার মতো স্থায়ী হল। এবং পরের কুড়ি মিনিটের মধ্যে মিসির আলির গায়ের তাপ হুহু করে বাড়তে লাগল! মোহনগঞ্জ স্টেশনে নেমে তাঁর মনে হল, প্লাটফরমেই শুয়ে পড়েন।

    ‘স্যার, আপনি কি মিসির আলি?’

    ‘হুঁ।’

    ‘আমি চৌধুরীবাড়ি থেকে আপনাকে নিতে এসেছি স্যার।’

    ‘ও, আচ্ছা।’

    ‘আপনি কোন ট্রেনে আসবেন সেটা বলেন নাই, আমি সকাল থেকে সব ক’টা টেন দেখছি।’

    ‘খুব কষ্ট দিলাম–না?’

    ‘জ্বি স্যার, তা দিলেন।’

    মিসির আলি হেসে ফেললেন। বেশ ছেলেটি। বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট। কথাবার্তায় কোনো গ্রাম্য টান নেই।

    ‘কি কর তুমি?’

    ‘এখানকার কলেজে স্যার বি. এ. পড়ি। চৌধুরীবাড়িতে থাকি।’

    ‘নাম কি তোমার?’

    ‘জহুরুল হক।’

    ‘জহুরুল হক সাহেব, চল রওনা হওয়া যাক।’

    ‘চলুন। আপনার মালপত্র কোথায়?’

    ‘মালপত্র কিছুই নেই। একটা হ্যাণ্ডব্যাগ ছিল, সেটা বাতাসে উড়ে গেছে।‘

    ‘বাতাসে উড়ে গেছে মানে?’

    ‘ছাদে বসে এসেছি তো—-ঝড়ের মধ্যে পড়েছি।’

    ‘বলেন কী! কী সর্বনাশ!’

    ‘শোন জহুরুল–এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা কী? আমার কিন্তু হাঁটার ক্ষমতা নেই।

    ‘হাঁটা ছাড়া তো যাওয়ার অন্য কোনো ব্যবস্থাও নেই। নদীতে এখনো পানি হয় নি, নৌকা চলে না।‘

    মিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পথে নামলেন। সেখানে আবার তাঁকে বৃষ্টিতে ধরল।

    .

    তাঁর জ্বরের ঘোর কাটতে দু’ দিন লাগল। পুরোপুরি আচ্ছন্ন অবস্থা গেল এ দু’ দিন। সবকিছু স্বপ্নদৃশ্যের মতো। যা দেখেন, তাই মনে হয় কাটা-কাটা খণ্ডচিত্র। একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই।

    একটি অপরূপা রূপবতী মেয়েকে প্রায়ই উদ্বিগ্ন মুখে তাঁর পাশে বসে থাকতে দেখেন। এই মেয়েটিই বোধহয় নাজনীন। মেয়েটি মাথায় পানি ঢালে। মাথার চুল টেনে দেয় এবং অত্যন্ত নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘চাচাজী, এখন কি একটু ভালো লাগছে? বলুন, ভালো লাগছে?

    তাঁর ভালো লাগে না। তবু মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলেন, ‘ভালো লাগছে মা, বেশ ভালো লাগছে।’

    এক জন বয়স্কা মহিলাকেও প্রায় সর্বক্ষণই তাঁর ঘরের চেয়ারে বসে থাকতে দেখেন। ইনি বোধহয় নাজনীনের মা। এই মহিলাটি কথাটথা বলেন না।

    চব্বিশ ঘন্টা থাকবার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকে থাকতে হল এক সপ্তাহ। চার দিনের দিন তিনি নিজের ঘর থেকে বেরুলেন এবং খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার জ্বর বাঁধিয়ে ফেললেন। সেই জ্বর পুরোপুরি ছাড়ল না কখনো। তবু এর মধ্যেই যে-সব কাজ করবার কথা, সব করলেন।

    প্রথম কাজ ছিল ফিরোজ এসে যে-সব জায়গায় গিয়েছে, সে-সব জায়গায় যাওয়া।

    দেখা গেল, সে খুব বেশি বেড়ায় নি। বাড়ি এবং শিয়ালজানি খাল—এ দু’য়ের মধ্যেই তার গতিবিধি সীমিত ছিল। এক দিন শুধু ‘উত্তরবন্ধ’ বিলে গিয়েছিল মাছ ধরা দেখতে। সেখানে সে নিজেই নেমেছিল মাছ মারতে। তখন শিং মাছ কাটা ফুটিয়ে দেয়। সে ভয়ে অস্থির হযে পড়ে। তার ধারণা, সাপে কেটেছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। কারণ, ঘটনাটি ঘটে তার অসুস্থ হবার আগের দিন। খুব সম্ভব ঘটনাটি তার মনের ওপর ছাপ ফেলে। রাতে তার একটু জ্বরজ্বরও হয়।

    যে বটগাছের নিচে চশমাপরা লোকটির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, সেই গাছটিও তিনি দেখতে গেলেন। এবং গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হল, ঘটনাটি এখানে ঘটে নি। ফিরোজের বর্ণনা অনুসারে জায়গাটা নির্জন। দু’একটা পরিত্যক্ত হিন্দু ঘরবাড়ি ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু বটগাছটা যে-অঞ্চলে, সে জায়গাটা নির্জন নয়। পাশেই শিয়ালজানি খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকো, যার ওপর দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। নদীর ওপারেই কয়েক ঘর কুমোরের বাস। তাদের বাড়িভর্তি ছেলেমেয়ে, যারা খুব হৈচৈ করে খেলে। এই অঞ্চলটিকে নির্জন বলা চলে না।

    ঘটনাটি নিশ্চয়ই অন্য কোথাও ঘটেছে এবং ফিরোজ ঘোরের মধ্যে হেঁটে-হেঁটে চলে এসেছে বটগাছের নিচে, যেখানে অন্য লোকজন তাকে দেখতে পায়।

    মিসির আলি শিয়ালজানি খালের দু’পার ধরে প্রচুর খোঁজাখুঁজি করলেন, কোনো বকুল গাছ পাওয়া যায় কি না। পাওয়া গেল না।

    তাঁর দ্বিতীয় কাজ ছিল, এখানে আসার পর ফিরোজের সঙ্গে যাদের দেখা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আলাপ করা। জানতে চেষ্টা করা, তারা ফিরোজের আচার ব্যবহারে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছে কি না। দেখা গেল, খুব অল্পকিছু লোকজনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। কেউ তেমন কিছু বলে নি। মিসির আলি প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর ইন্টারভ্যুর খুটিনাটি লিখে ফেললেন। কয়েকটি নমুনাঃ

    মোসাম্মাৎ সালেহা বেগম

    বয়স ৫০/৫৫। আজমল চৌধুরীর মা। পর্দানশিন। কম কথা বলেন। রাতে চোখে ভালো দেখতে পান না।

    প্রশ্ন : ফিরোজ ছেলেটি কেমন?

    উত্তর : ভালো।

    প্রশ্ন : কেমন ভালো?

    উত্তর : এত বড় লোকের ছেলে, কিন্তু অহঙ্কার নাই।

    প্রশ্ন : বুঝলেন কী করে অহঙ্কার নেই?

    উত্তর : আমার পা ছুঁয়ে সালাম করল।

    প্রশ্ন : যে দিন সে অসুস্থ হয় সে-দিন, অর্থাৎ অসুস্থ হবার আগে কি তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?

    উত্তর : হয়েছিল, চা খাওয়ার সময়।

    কোনো কথা হয়েছিল?

    প্রশ্ন : উত্তর : না।

    প্রশ্ন : ওকে দেখে কি আপনার একটু অন্যরকম লাগছিল?

    উত্তর : না। তবে চোখ-মুখ ফোলা ছিল। রাতে ঘুম হয় নি, সে-জন্য বোধহয়।

    প্রশ্ন : বুঝলেন কী করে, ওর রাতে ঘুম হয় নি? কারণ আপনার সঙ্গে তো শুর কোনো কথা হয় নি।

    উত্তর : সে আজমলের কাছে বলছিল, তাই শুনলাম।

    প্রশ্ন : আপনি জিজ্ঞেস করেন নি, কী জন্যে ঘুম হয় নি?

    উত্তর : না।

    নাজনীন সুলতানা

    বয়স ২০/২১। মমিনুন্নেসা কলেজ থেকে বি. এ. পাস করে বাড়িতে আছে। অপরূপ রূপবতী। মায়ের মতো স্বল্পভাষী নয়। ইনহিবিশন কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। লাজুক নয়। কথাবার্তায় মনে হল অত্যন্ত জেদি, তবে হাসিখুশি ধরনের মেয়ে।

    প্রশ্ন : কেমন আছ নাজনীন?

    উত্তর : ভালো আছি চাচা, আপনি এমন খাতা-কলম নিয়ে প্রশ্ন করছেন কেন? আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি কোনো পত্রিকায় ইন্টারভ্যু দিচ্ছি।

    প্রশ্ন : ফিরোজকে তোমার কেমন লেগেছিল?

    উত্তর : ভালো।

    প্রশ্ন : কেমন ভালো?

    উত্তর : বেশ ভালো! (এই পর্যায়ে মেয়েটি ঈষৎ লজ্জা পেয়ে গেল। )

    প্রশ্ন : ঠিক কী কারণে তুমি বলছ, বেশ ভালো?

    উত্তর : জানি না কী কারণে।

    প্রশ্ন : ফিরোজ অসুস্থ হবার পেছনে কি কোনো কারণ আছে বলে মনে হয়?

    উত্তর : এইসব নিয়ে আমি কখনো ভাবি নি চাচা।

    প্রশ্ন : আচ্ছা, ফিরোজ অসুস্থ হয়ে তোমাদের বাড়িতে এল। সে-সময় তুমি তার সামনে গিয়েছিলে? তোমাকে কি সে চিনতে পেরেছিল?

    উত্তর : চিনতে পেরেছিলেন কি না, তা তো চাচা বলতে পারব না। তবে উনি খুব হৈচৈ করছিলেন, আমাকে দেখে হৈচৈ থামিয়ে ফেলেন। রাতের বেলাও খুব চিৎকার শুরু করলেন। তখন ভাইয়া আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমকে দেখে চুপ করে গেলেন।

    প্ৰশ্ন : আচ্ছা, এখন আমি একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি। জবাব দিতে না চাইলে জবাব দিও না। প্রশ্নটি হচ্ছে–ধর, ফিরোজ যদি এখন পুরোপুরি সেরে যায় এবং তোমাকে বিয়ে করতে চায়, তুমি কি রাজি হবে?

    উত্তর : (খুব সহজ এবং শান্ত গলায়) হ্যাঁ, হব। চাচা, আজকের মতো থাক। আপনার জন্যে এখন শরবত নিয়ে আসি–নাকি চা খাবেন? আপনি খুব ঘনঘন চা খাচ্ছেন–এটা কিন্তু চাচা ভালো না।

    হরিপ্রসন্ন রায়

    এম. বি. বি. এস.

    স্থানীয় ডাক্তার। বয়স ৪০/৪৫। ব্যস্তবাগীশ লোক। এ অঞ্চলে তাঁর খুব পসার আছে। ইন্টারভ্যু চলাকালেই দু’ জন লোক তাঁকে নিতে এল। কথা বেশি বলেন।

    প্রশ্ন : আপনি কখন রুগীকে দেখতে এলেন?

    উত্তর : আমাকে খবর পাঠিয়েছে পাঁচটায়। তখন যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ ধর্মপাশা থেকে এক জন পেসেন্ট এসেছে, এখন-তখন অবস্থা। পেটের ব্যথা। আলসার ছিল, সেই পেইন, কাজেই আমি সন্ধ্যার পরে গিয়ে উপস্থিত হই। ধরুন ছ’টা সাড়ে ছ’টা। শীতকাল তো ছ’টার সময় চারদিক অন্ধকার। আপনি কী দেখলেন? মানে রুগীর অবস্থার কথা বলছি।

    প্রশ্ন : উত্তর : গোঁ-গোঁ শব্দ করছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। হিস্টিরিয়ার লক্ষণ মনে হল। চোখ বড়-বড় করে ঘোরাচ্ছিল। ভয়াবহ অবস্থা! আমি নাড়ি দেখলাম। হার্টবিট ছিল খুব হাই। হিস্টিরিয়াতে এ রকম হয়।

    প্রশ্ন : অষুধপত্র কী দিলেন?

    উত্তর : তেমন কিছু না। ঘুমের অষুধ দিয়েছি, ফেনোবারবিটন। তারপর বললাম ইমিডিয়েটলি ঢাকা নিয়ে যেতে।

    প্রশ্ন : কতক্ষণ ছিলেন আপনি?

    উত্তর : রাত দশটা পর্যন্ত ছিলাম। ওরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। নাজনীন কান্নাকাটি করছিল। কাজেই রুগী ঘুমিয়ে না-পড়া পর্যন্ত ছিলাম।

    প্রশ্ন : ঘুমের মধ্যে রুগী কি কোনো কথাবার্তা বলছিল?

    উত্তর : না, সাউণ্ড ঘুম। আমি ঘুমের মধ্যে আরে কবার নাড়ি দেখলাম। হার্টবিট বেশি ছিল, তবে আগের চেয়ে কম। কত ছিল তা মনে নেই।

    প্রশ্ন : গায়ে টেম্পারেচার ছিল?

    উত্তর : আমি যখন দেখি, তখন অল্প ছিল। নাইনটি নাইন পয়েন্ট ফাইভ। আমি চলে আসার সময় বলেছিলাম, সকালবেলা আবার দেখব। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। ভোর পাঁচটার ট্রেনে রুগীকে নিয়ে তারা ঢাকা চলে যায়।

    জহুরুল হক

    বয়স ২০/২১। স্থানীয় কলেজের ছাত্র। বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট। চৌধুরীদের বাড়ি লজিং থাকে। এদের সঙ্গে ক্ষীণ আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। কথাবার্তা শুনে ধারণা হল, নাজনীন মেয়েটির প্রতি সে খানিকটা অনুরক্ত।

    প্রশ্ন : ফিরোজের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল?

    উত্তর : জ্বি-না। আমি একটু দূরে দূরে ছিলাম। প্রশ্ন : দূরে-দূরে ছিলে কেন?

    উত্তর : আজমল ভাই সব সময় তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে থাকতেন। আমি আজমল ভাইকে সব সময় এড়িয়ে চলি। তাঁকে ভীষণ ভয় পাই। কাজেই……।

    প্রশ্ন : ভয় পাও কেন?

    উত্তর : আজমল ভাই ভীষণ রাগী। চট করে রেগে যায়। ওদের ফ্যামিলির সবাই খুব রাগী। এখনো ওদের মধ্যে কিছুটা জমিদার-জমিদার ভাব আছে। সবাইকে মনে করে ছোটলোক।

    প্রশ্ন : ফিরোজ কেন অসুস্থ হয়েছিল বলে তোমার ধারণা?

    উত্তর : জানি না কেন হয়েছে। তবে লোকে বলে, ওরা ধুতুরার বীজ খাইয়ে পাগল করে ফেলেছে।

    প্রশ্ন : বল কী তুমি!

    উত্তর: না, আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। লোকে কী বলে, সেটা বললাম।

    প্রশ্ন : লোকে এ-জাতীয় কথা কেন বলছে?

    উত্তর : এদের পূর্বপুরষরা খুব অত্যাচারী জমিদার ছিল। এরা মানুষের প্রাণ অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল। এরা প্রচুর অন্যায় করেছে, সেই জন্যেই এ-সব বলে।

    প্রশ্ন : তুমি মনে হয় এদের ওপর রেগে আছ?

    উত্তর : না, রাগব কেন? সত্যি কথাটা আপনাকে বললাম।

    মোহনগঞ্জে আসায় মিসির আলি সাহেবের তেমন কোনো লাভ হয় নি। এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য পান নি, যেটা তাঁর কোনো কাজে আসবে। চট করে অবশ্যি কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। খুঁজতে হয়। জট খোলবার প্রথম ধাপই হচ্ছে অনুসন্ধান। অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো কোনো আলোর ইশারা থাকতে হবে। সে-রকম কোনো আলোর সন্ধান মিসির আলি এখনো পান নি।

    তবে যাবার দিন ভোরবেলায় একটি সূত্র পাওয়া গেল। অস্বস্তিকর একটি সূত্র, যাকে গ্রহণ করাও যায় না, আবার ফেলে দেয়াও যায় না। নাজনীন এসে বলল, ‘চাচা, আসুন, আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাব।’

    ‘কী মজার জিনিস?

    ‘আমাদের এক পূর্বপুরুষ পিতলের একটা কলসি পেয়েছিলেন। কলসিভর্তি ছিল মোহর। সেই মোহর পেয়েই তারা জমিদার হল।’

    ‘কলসিটায় কোনো বিশেষত্ব আছে?’

    ‘না। সাধারণ কলসি, তবে অমাবস্যার সময়ে এটা ঝনঝন শব্দ করে।’

    ‘তুমি নিজে শুনেছ?’

    ‘না, তবে অনেকেই শুনেছে। আমি আর ভাইয়া এক অমাবস্যার রাতে কলসির পাশে জেগে ছিলাম। কিচ্ছু শুনতে পাই নি।’

    মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, ‘প্রাচীন মোহরভর্তি কলসি–এ-জাতীয় গল্প খুব প্রচলিত। তবে এ-সবের কোনো ভিত্তি নেই।’

    ‘চাচা, অনেকেই কিন্তু শব্দ শুনেছে।

    ‘হয়তো ইঁদুর ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ইঁদুর শব্দ করেছে।’

    মিসির আলি কলসি দেখার জন্যে কোনোরকম আগ্রহ বোধ করলেন না। শুধুমাত্র নাজনীনের মনরক্ষার জন্যে সঙ্গে গেলেন। দোতলার উত্তরের সবচেয়ে শেষের ঘরটির তালা খুলল নাজনীন। মিসির আলির শিরদাঁড়া দিয়ে একটি ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। কলসির কারণে নয়। এ-ঘরে কয়েকটি পুরনো পেইনটিং আছে। তাদের একটিতে খালি-গায়ে একটি লোক ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট। চোখে সোনালি চশমা। শুকনো ধরনের কঠিন একটি মুখ।

    ‘নাজনীন, এ-ছবিটা কার?

    ‘আমার দাদার বাবা। উনি খালিগায়ে ঘোড়ায় চড়তেন।’

    ‘নাম কি ওঁর?’

    ‘মাসুক চৌধুরী।’

    ‘ওঁর সম্পর্কে আর কী জান তুমি?’

    ‘বিশেষ কিছু জানি না। শুনেছি, খুব অত্যাচারী ছিলেন। তারপর এক দিন সন্ধ্যাবেলা ঘোড়ায় চড়ে আসছিলেন। হঠাৎ প্রজারা তাঁকে ঘিরে ফেলে।’

    ‘তারপর?’

    ‘তারপর আবার কি? মেরে ফেলে। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারে।—চাচা, এই দেখুন কলসি। আবার কি কি যেন লেখাও আছে গায়ে। চেষ্টা করে দেখুন, পড়তে পারেন কি না। পালি ভাষায় লেখা।’

    লেখা পড়ার ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহ বোধ করলেন না। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘তোমার দাদার বাবাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারে?’

    ‘হ্যাঁ। ওঁর কথা এত জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

    ‘এমনি জিজ্ঞেস করছি। আচ্ছা, ফিরোজ কি এই ঘরটি দেখেছে? সে কি এই ঘরে ঢুকেছিল?’

    ‘জ্বি না।’

    ‘কী করে বুঝলে ঢোকে নি?’

    ‘কারণ, ঘরটা তালা দেয়া থাকে। এই তালার একটিমাত্র চাবি। সেই চাবি থাকে আমার কাছে।’

    ‘জানালা-টানালা দিয়ে এই ঘরে ঢোকার কোনো উপায় নেই, তাই না?’

    ‘উঁহু, আর উপায় থাকলেই শুধু শুধু জানালা দিয়ে ঢুকতে যাবেন কেন? কী আছে এই ঘরে?’

    মিসির আলি দাঁড়িয়ে রইলেন ছবির সামনে। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমছে। তিনি জট খুলতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু জট খুলছে না। আরো পাকিয়ে যাচ্ছে। ফিরোজ যদি এক বার এই ঘরে ঢুকত, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটাই অনেক সহজ হয়ে যেত। তিনি বলতে পারতেন–ফিরোজ এই ছবিটি দেখেছে। তার মনে ছাপ ফেলেছে এই ছবি। পরবর্তী সময়ে ছবির মানুষটিকেই সে দেখেছে। হেলুসিনেশন। কত সহজ সমাধান।

    কিন্তু ফিরোজ এই ছবি দেখে নি।

    মিসির আলি বললেন, ‘একটিমাত্র চাবি?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘তুমি কি নিশ্চিত যে এই ঘরের দ্বিতীয় কোনো চাবি নেই?’

    ‘হ্যা, নিশ্চিত।’

    মিসির আলি আবার তাকালেন ছবির দিকে। তাঁর কেন জানি মনে হল, ছবির মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিদ্রুপের হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনিষাদ – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article ময়ূরাক্ষী – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }