Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিষিদ্ধ – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প347 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    পঞ্চাশ!

    পঞ্চাশ!

    কাল একটা পত্রিকা থেকে একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে পঞ্চাশ হওয়ার পর জীবন কেমন বোধ হচ্ছে জানতে চাইলেন। পঞ্চাশ নিয়েই একটা স্টোরি লিখছেন কাগজে। নিজেই বললেন, আগে বলা হত, চল্লিশে জীবন শুরু হয়, এখন বলা হয় পঞ্চাশে জীবন শুরু হয়। আপনিও নিশ্চয়ই তাই মনে করেন?

    আমি জানি ওপাশ থেকে হ্যাঁ উত্তরের আশা নিয়ে বসেছিলেন সাংবাদিক। আমার না শুনে বেশ অবাক হলেন। তাঁর চমকানোর শব্দও যেন ফোনে পাওয়া গেল। আমি যা বললাম তা হল, পঞ্চাশের পর জীবন শুরু হয়, এ নিতান্তই বয়স হওয়ার ফলে যে একটা চরম হতাশা আসে, সেটার সান্ত্বনা। পঞ্চাশে বরং জীবন শেষ হওয়ার শুরু। মানুষের গড় আয়ু খুব বেশি নয়। অনেক কচ্ছপও আমাদের চেয়ে বেশি বাঁচে। খুব সৌভাগ্যবান হলে আশি বা তার ওপরে বাঁচে মানুষ, তা না হলে পঞ্চাশ থেকেই সা ধারণত কঠিন অসুখগুলো ধরতে শুরু করে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার। আমার পরিবারে আছে হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, কিডনি ফেইলুর, ক্যানসার। আমাকে এর মধ্যেই হাই ব্লাড প্রেশারে ধরেছে, আর সেদিন। ডেঙ্গু বয়ে আনলো হাই ব্লাড সুগার। এ দুটোর টেনশন তো আছেই, তার ওপর আছে। শরীরের কোথাও আবার ক্যানসার হচ্ছে না তো চুপচাপ?– এই দুশ্চিন্তা। কয়েক মাস আগে আমার ছোটদার প্যানক্রিয়াস ক্যানসার ধরা পড়েছে। ওর বানসার সত্যি বলতে কী ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে আমাকে। মার হয়েছিল ক্যানসার, ছোটদার হলো, তাহলে কি আমারও হবে ওই রোগ! আমারও জিনে ঘাপটি মেরে আছে কোনও মন্সটার? মা বেঁচেছিলেন সাতান্ন বছর বয়স অবধি, বাবা মারা গেলেন সাতষট্টি বছর বয়সে। দাদার একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল ষাটে পা দিয়ে। আমাদের বেঁচে থাকা ওই পঞ্চাশ ষাটের খুব বেশি ওপরে যাবে না। তারপরও ভেবেছিলাম, একবার জেনোম সিকোয়ান্সিং করবো। কোটি টাকার ব্যাপার। জেনোম সিকোয়েন্সিং করবো শুনে এক বন্ধু বললো, মরার হাজার রকম কারণ থাকতে পারে, শুধু কি আর জেনেটিক ডিজিজে লোকে মরে! অ্যাকসিডেন্টে মরছে না মানুষ। তা ঠিক। এত আকাশে আকাশে উড়ি, কবে যে প্লেন ক্রাশ করবে কে জানে! ওই সিকোয়েন্সিংএর উৎসাহ তারপর আর পাইনি। সব ক্যানসারই তো জেনেটিক নয়, আমার মার আর ছোটদার ক্যানসার জেনেটিক বলে অনেক ডাক্তারই মনে করেন না। মনে না করলেও নিজের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে সেদিন লিভার হাসপাতালে গিয়ে কোলনোস্কপি করে এলাম। কোলন। ঠিক আছে। কোলন ঠিক আছে কিন্তু অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ঠিক আছে কিনা কে বলবে, কিন্তু ওই প্রতি অঙ্গের টেস্ট করতে দৌড়োবো, এত উদ্যম আমার নেই। এমনিতে আমি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার লোক নই। যত পারা যায়, ডাক্তার এড়িয়ে চলি। সারা বছর কেবল যাবো যাবো করি, যাই না। নিজে ডাক্তার বলে, সম্ভবত এই হয়, ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অত কাঠখড় পোড়াতে ইচ্ছে করে না। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নাও, যাও, টাকা দাও, লাইনে দাঁড়াও, অপেক্ষা করো। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ওই টাকা দেওয়াটা বা অপেক্ষা করাটা থেকে বেঁচে যেতাম সবসময়। ওসব আগে কখনও করতে হয়নি। এখনও করতে ইচ্ছে করে না। আর রোগ দেখতে গিয়ে আমার সঙ্গে এদেশের কোনও ডাক্তার তো ডাক্তারী ভাষায় কথা বলেন না। আমি বরং ডাক্তারী ভাষায় প্রশ্ন ঐশ্ন করলে ডাক্তাররা ভাবেন, আমি সম্ভবত বেজায় শিক্ষিত কোনও রোগী, অথবা ইন্টারনেটে রোগ শোক সম্পর্কে পড়ে জ্ঞান অর্জন করেছি। নিজে ডাক্তার, এ কথাটামুখ ফুটে কাউকে বলি না। আজ কুড়ি বছর ডাক্তারি করি না। অত বছর ডাক্তারি না করলো নিজেকে ডাক্তার বলতে অস্বস্তি হয়। এদিকে ডাক্তার তো দিয়েই যাচ্ছেন অ্যাডভাইজ, হাঁটাটা যেন হয়। ওই আধঘন্টা হাঁটার কথা ভাবলেই শরীরে আলসেমির চাদর জড়াই। এই অঞ্চলে হাঁটতে বড় অনিচ্ছে আমার। ইওরোপ আমেরিকায় কিন্তু এই অনিচ্ছেটা হয় না। পরিবেশ খুব বড় একটাব্যাপার বটে। জীবন যে কোনও সময় ফুরোবে, এই সত্যটা আগের চেয়ে এখন বেশি ভাবি বলেই, পজিটিভ একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করছি, আমি আগের মতো সময় নষ্ট করি না। টুয়েনটিজ আর থার্টিজ গর্দভের মতো সময় প্রচুর নষ্ট করেছি। তখনও এই বোধোদয়টা হয়নি যে সময় কম জীবনের। জানতাম, কিন্তু সে জ্ঞানটাকে আমি থিওরিটিক্যাল জ্ঞান বলবো। সত্যিকার বোধোদয় হওয়ার জন্য ওই বয়সে পা দেওয়া চাই। চল্লিশেও যে খুব হয়েছিল বোধোদয়, তা বলবো না। পঞ্চাশে এসে হঠাৎ যেন নড়ে চড়ে বসেছি। প্রচুর পড়ছি, লিখছি। আজে বাজে কাজে সময় নষ্ট করি না। এমনকি রাতের ওই সাত আট ঘণ্টার ঘুমটাকেও অহেতুক আর সময় নষ্ট বলে মনে হয়। খুব লাইকমাইণ্ডেড এবং ইন্টারেস্টিং লোক না হলে কারও সঙ্গে আড্ডাও আজকাল আর দিই না। আর কিছুদিন পর ভাবছি একা বেরিয়ে পড়বো পৃথিবীর পথে। যে দেশগুলো দেখা হয়নি, অথচ দেখার খুব ইচ্ছে, দেখবো। জীবনকে অর্থপূর্ণ যতটা করতে পারি, করবো। জীবনকে যতটা সমৃদ্ধ করতে পারি, করবো। সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, সাজি কি না আগের চেয়ে বেশি।

    এরও উত্তর আশা করেছিলেন, হ্যাঁ বলবো। আমি বললাম, আগেও আমি কখনও বেশি সাজগোজ করিনি, এখনও না। পঞ্চাশে এসে সাজগোজ বাড়িয়ে দেব কেন, আমি কি অস্বীকার করতে চাইছি যে আমার পঞ্চাশ? রিংকল বেড়েছে বটে, তবে ভয়ংকর কিছু নয়। আর হলেও ক্ষতিটা কী শুনি? শরীরই কি আমার সম্পদ যে এর রিংকল টিংকলগুলো লুকিয়ে রেখে কচি খুকি ভাব দেখাবো? অস্বীকার করি না, গ্রে হেয়ার। এ যে কোত্থেকে এলো জানি না, সাতান্ন বছর বয়সেও আমার মার একটিও চুল পাকেনি। পঁচাশি বছর বয়সেও আমার নানির চুল অতি সামান্যই পেকেছে। আমার বাবার চুল আমি চিরকাল মিশমিশে কালোই দেখেছি। আমার ছোটদার চুল পাকেনি বললেই চলে। তবে দাদার চুল নাকি সেই তার চল্লিশ বছর বয়সেই পেকে একেবারে পুরো সাদা। আমার চুল পাকার জিনটা আর দাদার ওই চুল পাকার জিনটা একই জিন, নিশ্চয়ই ইনহেরিট করেছি কোনও আত্মীয় থেকে। জানিনা কার থেকে। এই অকালপক্কতাকে মাঝে মাঝে কালো বা সোনালি করি। একসময় যখন দাদার মতো পুরো সাদা হয়ে উঠবে সব চুল, তখন ভাবছি অ্যাণ্ডারসন কুপার বা অমিতাভ ঘোষের মতো চুলে আর হাত দেবো না। চুল পাকার সঙ্গে বেশ বুঝি যে বয়সের কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের পরিবারে বয়স বাড়াবার একটা প্রবণতা আছে। আমার বাবা যে তাঁর ষাট বছর বয়স থেকে নিজের বয়স আশি বছর বলতে শুরু করেছিলেন, যতদিন বেঁচে ছিলেন আশিই বলেছেন। আমার দাদা তো প্লাস বলবেই তার বয়স বলতে গেলে। বত্রিশ প্লাস, ফরটি সিক্স প্লাস, ফিফটি টু প্লাস। প্লাসটা দিতে হয়না, দরকার নেই, এসব বলেও আমি লক্ষ করেছি দাদা প্লাসটা কিছুতেই মাইনাস করতে পারে না। দাদার ওই ছোটবেলা থেকেই মনে হতো, বেশি বয়স হলে সমাজে সম্মানটা একটু বেশি পাওয়া যায়। সম্মান পাওয়ার জন্য দাদার বরাবরই বড় শখ। সে যুগে বাবারা ছেলেমেয়েদের বয়স একটু কমিয়ে বলতেন। ইস্কুলে। কিন্তু আমার বাবা বলে কথা, বয়স সবারই এক দু বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষার দরখাস্তে। অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন, অল্প বয়স বলে বিয়েটা যদি আবার না দেওয়া হয়, নিজের বয়স কয়েক বছর বাড়িয়ে বলেছিলেন, সেই যে বয়স বাড়াতে শুরু করেছিলেন, বয়স বাড়ানোর রোগটা বাবার আর যায়নি। নিজের তো বা ড়িয়েছিলেন, নিজের ছেলেমেয়েদের বয়সও বাড়িয়েছিলেন। ইস্কুলে কিন্তু আমাকে পাঁচ বছর বয়স হলে পাঠান নি। তিন বছর বয়স হতেই চ্যাংদোলা করে ক্লাস থ্রিতে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমারও ফট করে বয়স বলে দেওয়ার স্বভাব আছে। তবে দাদার। মতো ওই প্লাসটা বলি না আমি। ওই যে লোকে বলে, মেয়েরা বয়স বলে না, কথাটা তো ঠিক নয়। বরং আমার পরিবারের বাইরের পুরুষদের আমি কখনও বয়স বলতে শুনিনি, কখনও বললেও দুতিন বছর কমিয়ে বলেছে। আসলে পঞ্চাশ হলেও পঞ্চাশ। যে হয়েছে, এটা শরীরে মোটেও অনুভব করি না, সে কারণেই সম্ভবত বিশ্বাস হয়না যে পঞ্চাশ হয়েছে। শরীরের অনুভুতিগুলো আগের মতোই আছে। এর কারণ, জানি না, মেনোপজ এখন অবধি না হওয়ার কারণে কি না। মেয়েরা যত বয়স বাড়ে তত সাহসী হয়, ছেলেরা যত বয়স বাড়ে তত ভীরু হয়। মেয়েরা যৌবনে সাতপাঁচ ভাবে, এগোবে কী এগোবে না ভাবে, ছেলেরা ডেয়ারিং যৌবনে, যত যৌবন ফুরোতে থাকে, তত একশ একটা দ্বিধা আর ভয় আর সাত পাঁচ ভাবার মধ্যে খাবি খেতে থাকে। টুয়েনটিজএ সেক্স নিয়ে বড় সংকোচ ছিল আমার, থার্টিজেও ছিল। চল্লিশের পর থেকে সেই সংকোচটা ধীরে ধীরে দূর হয়েছে। হরমোন টরমোন ফুরিয়ে গেলে কী রকম অনুভব করবো জানি না। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর যা কিছু বাড়ে, সেগুলো তো দুদ্দাড় উপভোগ করে যাবো, যেমন অভিজ্ঞতা বাড়া, বুদ্ধি বাড়া, বিচক্ষণতা বাড়া, ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইটে না দেখাটা বাড়া, কমপ্লেক্সিটি বোঝার ক্ষমতা বাড়া, জীবন সম্পর্কে জ্ঞানটা বাড়া। চূড়ান্ত ভালো দিকটা এখন হাতের মুঠোয়। তবে সঙ্গে নিগেটিভ যে জিনিসটা আছে, সে হলো আমি সাভান্ত নই, মনে রাখার ক্ষমতা আগের চেয়ে কম।

    ভুলে যাওয়াটা আগের চেয়ে, লক্ষ্য করেছি বেশি। পনেরো বছর বয়সে, মনে আছে, একটা সিনেমা দেখে এসে আমাদের এক প্রতিবেশির কাছে পুরো সিনেমাটা বর্ণনা করেছিলাম, প্রতিটা সংলাপ, প্রতিটা অ্যাকশন, হুবুহু। আর এখন একটা সিনেমা দেখার মাসখানেক পর দেখা যায় নামটাই ভুলে গেছি সিনেমার। অনেক সময় এমন হয়, কোনও সিনেমা দেখছি, কিছুটা দেখার পর বুঝি যে এ আমি আগে দেখেছি। আর, মানুষের নাম ধাম ভুলে যাওয়ার বাতিক আমার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। নি বাসিত জীবনে শত শত মানুষের সঙ্গে শত শত শহরে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, পরে যখন ওদের সঙ্গে আবার কোথাও দেখা হয়, ওরা সব হেসে এগিয়ে এসে বলে আমাদের দেখা হয়েছিল আগে। বড় অপ্রতিভ বোধ করি। ভুলে যাই বলে মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয় আমার বুঝি আলজাইমার রোগটা না হয়েই যাবে না। আমার পরিবারে কারও আলজাইমার ছিল না বা নেই। বন্ধুরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, আমার আসলে এত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে যে সবাইকে মনে রাখাটা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলে, আমার সিলেকটিভ আলজাইমার, মনে রাখার যেটা সেটা ঠিকই মনে রাখছি, ভুলে যাওয়ার গুলো ভুলে যাচ্ছি। সাংবাদিক এবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি মোবাইলের নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করি কি না। পঞ্চাশে মানুষের জীবন শুরু হয়, আধুনিক টেক নোলজি ব্যবহার করে রীতিমত নার্ড বা টেকি বনে যায়। বললাম, আমি খুবই কমই মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। অত টেকি নই। কিন্তু মাল্টিটাস্কিং খুব চলে। চব্বিশ ঘন্টা কমপিউটার ব্যবহার করি। হয় ডেস্কটপ, নয় ল্যাপটপ, নয় আইপ্যাড, নয়তো আই ফোন। কিছু না কিছু হাতে থাকেই। সেই নব্বই সাল থেকে কমপিউটারে লিখছি, আমার বইগুলো সব আমারই কম্পোজ করা। লেখালেখির জন্য যতটা টেকি হওয়ার প্রয়োজন, ততটাই আমি। তবে খেলাখেলির জন্য যতটা দরকার, ততটা নই। সোশাল নেটওয়ার্ক ইউজ করি। টুইটারে প্রচণ্ড উপস্থিতি আমার। ফেসবুকে অতটা না হলেও আছে। আসলে ফেসবুকে লোকে আমার নামে এত ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছে যে ফেসবুকে যেতেই রাগ হয়। ব্লগ লিখি, ইংরেজিতে, বাংলায়। একটা ওয়েবসাইট আছে, আপডেট করাটা কম হয়। কমপিউটারে মূলত লেখা পড়ার কাজটাই করি। তবে ইন্টারনেটকে, সত্যি কথা বলি, লাইফ সাপোর্ট বলে মনে হয়। বইয়ের লাইব্রেরিকেও যেমন মনে হয়। ঘর ভর্তি বই থাকবে না, দরকার হলে একটা বই উঠিয়ে নিতে পারবো না, ভাবলেই বুকে ব্যথা হতে থাকে।

    বেশ আছি কিনা। বেশ আছি। ঘরে অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটা বেড়াল। মাঝে মাঝে বুদ্ধিদীপ্ত কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা কথা হয়। কলকাতা থেকে বছরে দুবার বন্ধুরা এসে কদিন করে কাটিয়ে যায়। বিদেশের বিদ্বজ্জনের সঙ্গে কনফারে ন্সে, সেমিনারে মত বিনিময় হয়। মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষী, ছোটমনের হিংসুক লোকেরা শত্রুতা করে ঠিক, তবে বড় মানুষের কাছে সম্মান প্রচুর পাই। বেশ আছি। বয়স হচ্ছে, এ নিয়ে দুঃখ করে তো লাভ নেই। আমি যেমন বিশ্বাস করি না পঞ্চাশে জীবনের শুরু, এও বিশ্বাস করি না পঞ্চাশেই জীবনের শেষ। তবে কোনও বয়সই মন্দ নয়। আমরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি, এই জীবনের পরে আর কোনও জীবন নেই, জীবন একটাই, আর চাইলেও কোনওদিন জীবন ফেরত পাবো না বলেই বয়স হয়ে যাওয়া বয়সগুলোকে মেনে নেওয়া এবং বয়সগুলোকে সে যে বয়সই হোক না কেন সেলেব্রেট করা উচিত| এই উচিত কাজটি বা ভালো কাজটিই যথাসম্ভব করতে চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে অসুখ বিসুখ হবে, অথবা হঠাৎ করেই, মরে টরে যাবো, এ হচ্ছে অপ্রিয় সত্য। কিন্তু প্রিয় সত্যও তো আছে। জন্মেছিলাম বলে, কিছুকাল বেঁচেছিলাম বলে এই মহাবি শ্বকে জানতে পারছি, কোথায় জন্মেছিলাম, কেন, চারদিকে এত সহস্র কোটি গ্রহ নক্ষত্র, ওরা কোত্থেকে এলো, কী করে এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে এত কিছুর মেলা, এত কিছুরই বা খেলা কেন, কী করে আবর্তিত হচ্ছে, কী করে প্রাণের সৃষ্টি, কেন বিবর্তন, কী করে মানুষ আর তার ইতিহাস এগোলো! না জন্মালে এসব জানা থেকে, এসব দেখা থেকে, এসব বোঝ থেকে, এসবের রহস্য আর রস আস্বাদন থেকে তো বঞ্চিত হতাম। বিশ্ব হ্মাণ্ডের সবকিছু কবিতার মতো সুন্দর। সত্যের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। ছোটবেলা থেকে মিথ্যে একেবারে সইতে পারিনি। সত্যের মধ্যেই দেখেছি অগাধ সৌন্দর্য। জীবন যতক্ষণ, ততক্ষণ জীবনটাকে যাপন করবো, জীবনের উৎসব করবো। বেঁচে আছি, এ খুব চমৎকার ঘটনা। তবে বেঁচে আছির চেয়ে কী করে বেঁচে আছি, সেটা বড় ব্যাপার। অন্ধত্ব, কুসংস্কার, হিংসে, ঘৃণার মধ্যে বেঁচে থাকাটাকে আমি মোটেও ভালোভাবে বেঁচে থাকা বলি না। কেউ কেউ নিজের জন্য শুধু স্ফুর্তি আর আনন্দ কাটাতেই ভেবে নেয় বেঁচে থাকার সার্থকতা, কেউ মনে করে কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন করাটাই সব, কেউ আবার ভাবে অন্যের জন্য ভালো কিছু করলে জীবন অর্থপূর্ণ হয়। কেউ কেউ পরিবারের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে জীবনে সার্থকতা আনে। এই মহাবিশ্বের কিছু যায় আসে না আমাদের ছোট ছোট জীবনের ছোট ছোট সাহকিতায় বা ব্যর্থতায়। তবে আমরা ভেবে তৃপ্তি পাই যে আমরা সার্থক। পথ চলায় এই তৃপ্তিরও হয়তো প্রয়োজন। আছে। এ আমাদের চলায় প্রাণ দেয়, চলার গতিতে ছন্দ দেয়। |

    কখনও ভাবিনি পঞ্চাশ হবো। একসময় কুড়ি বা তিরিশ হওয়াকেই সবচেয়ে বয়স হয়ে যাওয়া বলে ভাবতাম। এখন পঞ্চাশে এসে মনেই হয় না যে বয়স হয়েছে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, যেন হাজার বছর ধরে বেঁচে আছি। বয়স চুলে হয় না, ত্বকে হয় না, বয়স মনে হয়। আমার এখনও মনের বয়স একুশ। একুশ! একটু ক্লিশে হয়ে গেল না! হলো না, কারণ একুশ বলতে একুশ বছর বয়সী শরীরও বোঝাইনি, ভুল করা আর হোঁচট খাওয়ার বয়সও বোঝাইনি, একুশ বলতে চারদিকের অসংখ্য অজানাকে জানার ব্যাকুলতা, আর অদম্য আগ্রহের বয়সটাকে বুঝিয়েছি। কলকাতার একটা সাহিত্য পত্রিকা থেকে আজ দীর্ঘ দিন যাবৎ একটা সাক্ষাৎকার চাওয়া হচ্ছে। দেব দেব করে আজও দেওয়া হয়নি। আজ দুয়ার খুলেই প্রশ্নোত্তর দিচ্ছি।

    ১. প্রায় দু বছর আগে একটি সাহিত্য পত্রিকার জন্য আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন আপনার কণ্ঠে অভিমান আর ক্ষোভ অতিমাত্রায় লক্ষ্য করেছিলাম। এখন কি অবস্থা কিছুটা পাল্টেছে? উত্তর: কী নিয়ে অভিমান করেছিলাম বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম, তা তো বলবেন মশাই! আমার অভিমান, ক্ষোভ, রাগ ইত্যাদির পেছনে বড় কোনও কারণ থাকে। এমনিতে আমি খুব হাসিখুশি মানুষ, ছোটখাটো ভুলত্রুটিগুলোর জন্য মানুষকে নিরন্তর ক্ষমা করে দিই। তার মানে এই নয় যে কারও কোনও ভয়ংকর বদমাইশি দেখবো, আর না দেখার ভান করে অন্য দিকে চলে যাবো। অন্যায় যদি দেখি, রাগ করবো না? যেদিন কিছুতেই কিছু আসবে যাবেনা আমার, ক্ষোভ টোভ মরে ভূত হয়ে যাবে, রাগ করার মতো কিছু ঘটলেও রাগ করবো না, সেদিন বুঝবেন আমার মৃত্যু হয়েছে। এই যে অতিমাত্রা শব্দটা ব্যবহার করলেন, সেটা আবার অদ্ভুত! ক্ষোভের মাত্রা কী করে মেপেছিলেন আপনি? ক্ষোভ ঠিক কতটা হলে মাত্রার মধ্যে থাকে, কতটা হলে থাকে না, সেটা বোঝাবে কে? এই মাত্রাটা মাপার দায়িত্বটা কার, বলুন তো! গজফিতেটা ঠিক কার কাছে থাকে? যে ক্ষোভ দেখায় নাকি যে ক্ষোভ দেখে? নাকি তৃতীয় কোনও ব্যক্তি? সমাজের সবাই আপনারা মাত্রা মাপার মাতব্বর হয়ে গেলে চলবে কী করে বলুন। মানুষকে একটু নিজের মতো নিজের মত প্রকাশ করতে দিন। আপনার মাথায় ডাণ্ডা যতক্ষণ নামারছি, অর্থাৎ ভায়োলেন্স যতক্ষণ না করছি, ততক্ষণ আমাকে সইতে শিখুন।

    ২. সেই সাক্ষাৎকারে আপনি একটি প্রসঙ্গ তুলেছিলেন যা তার আগে কেউ জানতো না। আরও বেশি মানুষের জানা উচিত বলেই আমি সেই প্রসঙ্গটি আর একবার এখানে উত্থাপন করতে চাই। আপনি জানিয়েছিলেন যে আপনি যে শুধু মুসলিম মৌলবাদ বিরোধী তা নয়, আপনি সমস্ত ধরনের মৌলবাদের বিরোধী। যে কারণে গুজরাত দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মৌলবাদ বিরোধী যে সংগঠন তৈরি হয় তাতে আপনি এককালীন বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আপনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে শঙ্খ ঘোষ সব কিছু জানা সত্ত্বেও কেন এই কথা প্রকাশ্যে জানাননি। শঙ্খ ঘোষ পরে একটি চিঠিতে আপনার কথা স্বীকার করে জানিয়েছিলেন যে আপনি নিজেই ওই কথা প্রকাশ্যে জানাতে নিষেধ করেছিলেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

    উত্তর: আমি সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী সেটা আমার বই পড়লেই জানা যায়। এমন নয় যে আপনাকে দেওয়া গত সাক্ষাৎকারে এই কথাটা আমি প্রথম জানিয়েছি।

    এই ক্ষোভের কথাই তাহলে বলছিলেন! শুনুন, শঙ্খ ঘোষকে আমি বলেছিলাম যে, আমি যে টাকা দিলাম গুজরাতের উদ্বাস্তু মুসলমানদের জন্য, তা নিজের প্রচারের জন্য নয়, কিছু দান করে বড়াই করাআমি পছন্দ করি না। মানুষকে বরাবরই আমি নিভুতেই সাহায্য করি, ঢোল পিটিয়ে করিনা। শঙ্খ ঘোষকে বিনীত ভাবে শুধু জানিয়েছিলাম, আমি ঢোলে বিশ্বাসী নই, আর ঢোলের শব্দও আমাকে একটু অপ্রতিভ করে। কিন্তু আমাকে যখন মুসলিম বিরোধী অপবাদ দিয়ে হায়দারাবাদে শারীরিক আক্রমণ করা হলো, একটা বীভৎস মৃত্যু আমার প্রায় ছুঁই ছুঁই দূরত্বে ছিল, সেদিনই কলকাতায় ফিরে এলে আমাকে যখন ঘরবন্দি করলো সরকার, পার্ক সার্কাসের রাস্তায় কিছু পকেটমার নেমেছিল বলে মুসলিম বিরোধী অজুহাত তুলে যখন আমাকে রাজ্যছাড়া করলো, আর দিল্লিতেও আমাকে যখন নিরাপদ বাড়ির নাম করে একই রকম গৃহবন্দি করা হয়েছিল, প্রতিদিন চাপ দেওয়া হচ্ছিল দেশ ছাড়ার জন্য, মুসলমানরা রৈ রৈ করে ধেয়ে এসে আমাকে প্রায় ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে এমন যখন রাজনৈতিক অবস্থা, সামনে মৃত্যু আর নির্বাসন, যে কোনওটিকে যখন আমার বেছে নিতে হবে, তখন শঙ্খ ঘোষ চুপচাপ বসে সবই দেখছিলেন, সবই জানছিলেন, শুধু একবার মুখ ফুটে কোথাও একবারের জন্য বলেননি যে, মুসলিমবিরোধী বলে যা প্রচার হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে, তা সত্য নয়। শঙ্খ ঘোষ চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। দান করে নাম কেনার প্রচার, আর নিবাসন বা মৃত্যু থেকে আমাকে বাঁচানোর প্রয়োজনে একটা সত্য প্রচার– এই দুই প্রচারের মধ্যের তফাতটা শঙ্খ ঘোষ জানেন না আমি বিশ্বাস করি না।

    শঙ্খ ঘোষ সত্যকে সেদিন প্রকাশ করলে জানি না কতটা লাভ হতো। হয়তো খড় কুটোর মতোই মূল্যহীন হতো তাঁর বিবৃতি। তবে যেহেতু ওই দুঃসময়ে আমি হতাশার অতলে ডুবছিলাম, প্রাণপণে কিছু খড়কুটোই খুঁজছিলাম আঁকড়ে বাঁচার জন্য।

    যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। ছাড়ুন ওসব পুরোনো কথা। আমাকে পশ্চিমবঙ্গে থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পুরো ভারতবর্ষ থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছিলো। কয়েক বছর পর আবার অনুমতি পেয়েছি বটে দিল্লিতে থাকার, তবে পায়ের তলার মাটি এখনও বড় নড়বড়ে।

    ৩. আপনার বিড়াল মিনুকে নিয়ে চূর্ণী গাঙ্গুলী ছবি বানাচ্ছেন। যা আসলে আপনার জীবনের একটা অংশ। আপনার জীবন নিয়ে সরাসরি ছবি করলে অসুবিধে হতে পারে মনে করেই কি তা না করে মিনুকে নিয়ে ছবি করার কথা ভেবেছেন চূর্ণী?

    উত্তর: চূর্ণী কী ভেবেছে সে তো আমি জানি না মশাই। মিনুকে নিয়ে কৌশিকের একটা স্ক্রিপ্টই তৈরি ছিল। কৌশিকেরই করার কথা ছিল ছবি। তবে এখন ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কৌশিকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে ছবি চূর্ণীই করবে। চূর্ণী এসেছিল মিনুকে দেখতে। মিনুও তো বেজায় খুশি। মিনু, আমার কেন যেন মনে হয়, বুঝতে পেরেছে যে, ওকে নিয়ে ছবি হচ্ছে। বেশ একটা নায়িকা নায়িকা ভাব করে কদিন হাঁটা চলা করলো। শুনুন বাপু, আমার জীবন নিয়ে ছবি করতে লোকের ভয় পাওয়ার কোনও তো কারণ দেখি না। যদি কেউ ভয় পায়, সে তার দুর্বল স্নায়ুর দোষ। ভয় পেলেই ভয় পাওয়া হয়, না পেলেই পাওয়া হয় না। যারা ভয় পায়, তারা আমার বেড়াল কেন, আমার বাড়ি থেকে তিরিশ মাইল দূরে যে ইঁদুরগুলো দৌড়াচ্ছে, সেই ইঁদুরগুলোর ছবি তুলতে গেলেও দেখবেন হাত কাঁপছে।

    ৪. মহেশ ভাট নাকি আপনার জীবন নিয়ে ছবি করার ইচ্ছের কথা জানিয়েছি। লেন? সেটার কী হলো?

    উত্তর: সেটার কী হল সেটা মহেশ ভাটকেই না হয় জিজ্ঞেস করুন। আজ তেরো বছর আগে ঘোষণা করেছিলেন আমাকে নিয়ে ছবি বানাবেন। তারপর হয়তো ছবি। বানানোর আইডিয়াটা মাথা থেকে একসময় ঝেড়েও ফেলেছিলেন। কী কারণ, কিছুই জানি না। আমি মনে করি, কোনও চিত্রপরিচালক কোনও একটা বিষয় নিয়ে ছবি বানানোর ইচ্ছের কথা বলতেই পারেন। পরে সেই ইচ্ছেটা তিনি পরিবর্তন করতেই পারেন। মত প্রকাশের যেমন অধিকার আছে, মত পরিবর্তনেরও মানুষের তেমন অধিকার আছে। তবে অবাক হয়েছি কিছুদিন আগে যখন তিনি পুরো অস্বীকার করে বসলেন যে আমাকে নিয়ে ছবি বানানোর কথা কস্মিনকালেও তিনি নাকি বলেননি। সবচেয়ে মজার বিষয়, ইন্টারনেটের দৌলতে পুরোনো কাসুন্দি বেশ ঘাঁটা যায়।

    ৫. আপনার ভূমিকায় যদি আপনাকে অভিনয় করতে বলা হয়, আপনি রাজি

    উত্তর: না। কারণ আমি অভিনয় করতে জানি না। যারা মিথ্যে কথা বলে তারা ভালো অভিনয় জানে। যেহেতু আমি মিথ্যে বলতে জানি না, আমাকে দিয়ে আর যাই হোক, ওই অভিনয়টা হবে না।

    ৬. মৌলবাদীদের ভয়ে শুধু রাজনৈতিক দলগুলি নয়, বিভিন্ন মিডিয়া হাউজ আপনাকে নিষিদ্ধ করেছে। তবে ইদানীং কিছু পত্রিকায় আপনার লেখা দেখতে পাচ্ছি। অবস্থাটা কি কিছুটা পাল্টেছে?

    উত্তর: ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুএকজন ছাপোষা সাংবাদিক কোনওরকম নিষেধা জ্ঞার তোয়াক্কা না করে আমার লেখা ছাপাচ্ছে মাঝে মাঝে। পাঠক এতে বিষম খুশি, গোগ্রাসে পড়ছে লেখা। কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে এত পাঠককে! দুঃখ হয়। আসলে কী জানেন, ভয়টা একটা বিচ্ছিরি রোগ। এই রোগটা বাংলাতেই বেশি। একসময় বাংলায় সব নির্ভীক প্রতিবাদী বিপ্লবী মানুষ বাস করতেন। এই বাংলা এখন আর সেই বাংলা নেই। বাংলাটা এখন যেন কেমন ভীতুদের, আপোসকামীদের, সুবিধে বাদীদের, আদর্শহীনদের, বুদ্ধিহীনদের রাজ্য হয়ে উঠছে। এই বাংলাকে ভালোবেসে সেই সুদুর নির্বাসন থেকে একসময় সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চলে এসেছিলাম, বড় ভালোবেসে বাসা বেঁধেছিলাম। সেই বাসা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বাংলার লোকেরা। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমার ভেঙেছে, সেটা মন। এখনও দুঃস্বপ্নের মতো সেই দিনগুলো?

    ৭. অনেক চিত্র পরিচালক নাকি আপনার গল্প বা উপন্যাস নিয়ে ছবি করতে গিয়ে নানা ভাবে পিছিয়ে এসেছেন?

    উত্তর: কোথাও নিশ্চয়ই তাঁদের সমস্যা হয়। কোথাও গিয়ে তাঁরা হয়তো বাধা পান। কোথায় সেট, এখনও জানি না। একটা ভুতুড়ে ব্যাপার এখানে আছে। পরি চালকরা আমার কাছে আসছেন। স্ক্রিপ্ট পড়িয়ে কনস্ট্রাক্ট সই করে নিয়ে যাচ্ছেন। তারপর কী যে হয়, কোন খাদে যে তাঁদের ফেলে দেওয়া হয়, কে যে ফেলে দেয়, কে যে। কী করে, তার কিছুই আমি জানি না। অনেককে শুধু অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেছি।

    ৮. পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি সাহিত্যিক চান না আপনার লেখা এখানে ছাপা হোক। বা আপনি কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বাস করুন। এদের এরকম মনোভাবের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

    উত্তর: কেন চাননা ওঁরা, সেটা ওঁদের জিজ্ঞেস করুন। আমি কী করে বলবো ওঁরা কেন চান না আমি কলকাতায় বাস করি বা কলকাতায় আমার লেখা ছাপা হোক। এক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া কেউ মুখ খুলে আমাকে বলেননি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। পুরো ২০০৭ সাল জুড়ে যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে রাজ্য থেকে তাড়াবার জন্য প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন ভালোয় ভালোয় চলে যাই। আর, অন্য কার মনে কী ছিল বা আছে, সেটা তো আমি বলতে পারবো না। মনের কথা খুলে বললে তবেই না বুঝতে পারা যায় মনে কী আছে। না বললে বোঝাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, দেখা হলে সবাই তো হাসি মুখ করে সম্ভাষণই জানাতেন। মনে-এক-মুখে-আরেকদের নিয়ে চিরকালই আমার একটু সমস্যা হয়।

    ৯. আপনার জনপ্রিয়তাকে এঁরা ঈর্ষা করেন বলে মনে করেন?

    উত্তর: আমি জানি না কেউ ঈর্ষা করেন কি না। তবে, সহকর্মীদের জনপ্রিয়তা কে একটু আধটু ঈর্ষা প্রায় সবাই করে। শুধু সাহিত্যের জগতে নয়, সব জগতেই। লেখাপড়ার জগতে, খেলাধুলার জগতে, নাটকের জগতে, সঙ্গীতের জগতে, শিল্পের জগতে, বাণিজ্যের জগতে। কোথায় ঈর্ষা নেই? ঈর্ষা থাকা তো ক্ষতিকর নয়। বরং ঈর্ষা থাকলে প্রতিযোগিতাটা থাকে, আরও ভালো কিছু লেখার, আরও ভালো কিছু করার আগ্রহ জন্মায়। খুব কম মানুষই বলে যে কাঁধটা দিচ্ছি, কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে তুমি একটু বড় হও। কিন্তু, ওর জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করি, সুতরাং ওকে এ তল্লাটে আর চাই না, ওকে যে করেই পারো খতম করে দাও, এটা কোনও ভদ্রলোকের মীমাংসা নয়। এই মীমাংসা অতি দুর্বল চিত্তের, অতি নড়বড়ে স্নায়ুর, অতি ভঙ্গুর মনের লোকেরা করে। ওদের, মানে ওই ভীতু আর কুচুটে কুচক্রীদের দিয়ে ভালো সাহিত্য হওয়াটা মুশকিল। ওরা খালি মাঠে গোল দেওয়ায় জন্য মুখিয়ে থাকে। বোঝেই না যে এতে কোনও বীরত্ব নেই।

    ১০. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আপনি যে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন, তাতে বাঙালির আবেগ ধাক্কা খাবে জেনেও আপনি ঝুঁকি নিয়েছেন। এতদিন। বাদে এই অভিযোগ করা কি খুব জরুরি ছিল?

    উত্তর: বাঙালির আবেগে ধাক্কা না দেওয়ার দায়িত্বটা আমাকে কে দিয়েছে? যে-ই দিক, কারও আবেগ বাঁচিয়ে চলা আমার কাজ নয়। বিশেষ করে সেই আবেগ, যে। আবেগ সত্য শুনতে রাজি নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছুদিন ধরেই বলছিলেন, উনি নাকি বই ব্যানের বিরুদ্ধে। এটি সত্য নয়। আমার দ্বিখণ্ডিত ব্যান করার জন্য ২০০৩ সালে উনি অনেক লেখালেখি করেছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সরকারকে বলেছেন, আর এখন কি বলছেন তিনি চিরকালই সব রকমের বই ব্যানের বিরুদ্ধে। আমি সবিনয়ে তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলাম। তখনই কথায় কথায় ওই প্রসঙ্গ উঠলো, যৌন হয়রানিতে আমাকেও যে বাদ দেননি সেটা। শহরের সাহিত্য জগতে শুনেছি অনেকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনেক কথাই জানে, কিন্তু সবাই নাকি চেপে যায়। কারণ উনি খুব নামী দামী মানুষ। নামী দামী মানুষেরা অন্যায় করলেও সেটাকে অন্যায় হিসেবে দেখতে নেই। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো অহরহই বলছে, পুরুষমানুষ তো, ওরকম তো একটু করবেই। কিন্তু ওরকম করাটা যদি না মানি? তবে দোষটা আমার। পুরু মানুষের অন্যায় করাটা অন্যায় নয়, তার অন্যায় না মানাটা আমার অন্যায়। এই সমাজের নামী দামী কারও বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করা মানে নিজেকে জেনে বুঝে শূলে চড়ানো।

    এতদিন বাদে অভিযোগ করেছি কেন? ঠিক কতদিন বাদে অভিযোগ করলে সেটা ঠিক, আর কতদিন বাদে করলে বেঠিক, শুনি? আমি কি বাপু কোর্টে গিয়ে পিনাইল ভ্যাজাইনাল-ধষর্ণের অভিযোগ করেছি যে আমাকে খুব দ্রুত অভিযোগটা করতে হবে কারণ ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য তৈরি থাকতে হবে, কিছুদিন বাদে হলে যে পরীক্ষাটা সম্ভব নয়? যৌন হয়রানি মানেই, বেশির ভাগ ডিকহেড (বাই দ্য ওয়ে, ডিকহেড শব্দটা বাংলাভাষায় ঢোকাটা অত্যন্ত জরুরি, এর সমার্থক কোনও বাংলা শব্দ নেই।) ভাবে, পিনাস বুঝি ভ্যাজাইনাতে ঢুকেছেই ঢুকেছে, আরে বাপু ও ছাড়াও তো যৌন হয়রানি হয়। আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে জাপটে ধরে আমার বুক খামচে ধরলেও তো হয়, নাকি হয় না? বিচ্ছিরি ঘটনাটা পুষে ছিলাম অনেকগুলো বছর। কোর্টেও যাইনি, কাগজেও যাইনি। সেদিন বই ব্যান নিয়ে ওই অনর্গল মিথ্যেটা যদি সুনীল গঙ্গোপা ধ্যায় না বলতেন, তাহলে হয়তো হয়রানির কথাটা বলাই হতো না কখনও। কিছু লেখায় দুঃখ করে যেটুকু লিখেছিলাম, সেটুকুই থাকতো। এখন মনে হয়, বলে ভালোই করেছি। কোনও অস্বস্তি মনের মধ্যে পুষে রাখা ঠিক নয়। মহামানবের সম্মান পান, আর তলে তলে যে ওই কীর্তিগুলো ঘটান, তা জানুক মানুষ। মেয়েরা এবার মুখ খুলুক, অনেক তো মুখ বুজে থাকী হল, আর কত! বাংলাদেশের এক লম্পটের মুখোশ উন্মোচন করেছিলাম বলে সারা দেশ আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেছে, পশ্চি মবঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে। যেন সুনীল সম্পর্কে আমি একটি অক্ষর বানিয়ে বলেছি। যে হয়রানির শিকার হয়েছে, তাকে অসম্মান করে, অপমান করে, যে হয়রানি করেছে তাকে মাথায় তুলে সম্মান দেখিয়ে এরা আবারও প্রমাণ করেছে যে এরা কতটা নীচ, কতটা অসভ্য, কতটা নারীবিদ্বেষী, কতটা পুরুষাঙ্গ-পূজারী!

    শুনেছি বাদল বসু বইয়ের দেশ-এ সুনীলকে মহামানব হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করেছেন, আমার সম্পর্কে বস্তা বস্তা মিথ্যে ঢেলেছেন। সুনীলের প্রশংসা করতে গেলে তাঁর লেখা নিয়ে কথা বলুন, তাঁর জীবনের ভালো ভালো দিক নিয়ে কথা বলুন, তাতেই তো তাঁকে বড় করা যায়। আমাকে ছোট করে তাঁকে বড় করতে হবে কেন? এত ছল চাতুরী আর মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে কেন? বাদল বসু সুনীলকে আমার চেয়েও বেশি চেনেন। হেনস্থা হয়রানির খবর তাঁর অজানা নয়। কিন্তু পুরুষ পুরুষেরই পক্ষ নেবে। যত বড় লেখকই হই না কেন, আমি তখন কেবলই মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ মুখ খুললে ওঁরা সকলেই খুব রাগ করেন।

    ১১. এতটা জনপ্রিয়তা আপনার প্রাপ্য ছিল না। মৌলবাদীরা আপনাকে জনপ্রিয় করেছে। কী বলবেন?

    উত্তর: একেবারে উল্টো। আমি খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলাম বলে মৌলবাদীরা আমার কলম কেড়ে নিতে চেয়েছে বা আমার লেখাকে বন্ধ করতে চেয়েছে বা আমাকে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছে। অজনপ্রিয় অনামী লেখককে নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না। ভয় জনপ্রিয় লেখককে, যদি সে লেখক মৌলবাদবিরোধী লেখা লেখে, যে দুটো পিলার মৌলবাদীরা সজোরে আঁকড়ে ধরে রাখে, ধর্ম আর পুরুষতন্ত্র, সে দুটোতে যদি ফাটল ধরিয়ে দেওয়ার মতো আঘাত করতে থাকে লেখা দিয়ে। আমি যখন বিরানব্বই সালে প্রথম আনন্দ পুরস্কার পাই, তখনও মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেনি বা ফতোয়া জারি করেনি। এর দেড় দুবছর পর করেছে। দেশে বিদেশে। জনপ্রিয় হয়ে উঠছি, এ তাদের আর সয়নি। মৌলবাদীদের কারণে আমার জনপ্রিয়তা শুধু নষ্টই হয়নি, বরং আকাশ থেকে পাতালে নেমেছে। ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে, আর ওদিকে আমাকে তাড়িয়েও মৌলবাদীরা শান্ত হয়নি, তাদের অসংখ্য প্রচার মিডিয়া নিরন্তর ব্যস্ত থেকেছে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে কুৎসা রটাতে, আমার প্রতি মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করতে, মানুষের মন থেকে আমাকে মুছে ফেলতে, আমার বই-পাঠ থেকে পাঠককে বিরত রাখতে। বছরের পর বছর ওরা মগজধোলাই করেছে সাধারণ মানুষের। আমি নাকি বিজেপির টাকা নিয়ে লজ্জা লিখেছি। আমার নাকি চরিত্র ভালো নয়। একটা অল্প শিক্ষিত, ধর্মভীরু, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীবিরোধী সমাজে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার জাদুর মতো কাজ করেছে। এক এক করে আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। প্রকাশকেরা বই প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। পত্র পত্রিকা আমার লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। যে লেখক সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নন্দিত লেখক ছিল বাংলাদেশে, কেবল মৌলবাদী, ধর্মবাদী, নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিকদের অপপ্রচারে সে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একটা নিন্দিত আর নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত হল। এত বিরোধিতা, এত বিদ্বেষ, এত আক্রমণ, এত নিন্দা, এত কুৎসা, এত অপপ্রচার, এত নিষ্ঠুরতা, এত অসভ্যতা, এত রূঢ়তা, এত অন্যায়, এত অবিচার আমার প্রাপ্য ছিল না।

    ১২. অন্যান্য দেশে আপনি লেখক হিসেবে কেমন সম্মান পেয়ে থাকেন?

    উত্তর: লেখক হিসেবে সম্মান কোথাও প্রচণ্ড পরিমাণে পাই। কোথাও কিছুটা কম। কোথাও মাঝারি ধরনের। কোথাও চলনসই। কিন্তু কোনও দেশ বাংলার মতো, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো, এত অপমান আমাকে করে না। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ বা রাজ্য থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়না। কিছু উগ্রপন্থী ধর্মবাদীদের মতের সঙ্গে আমার মত মেলে না বলে আমাকে জন্মের মতো চোখের আড়াল করা হয় না, নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হয় না। এত অবিবেচক আর এত অসহিষ্ণু হতে কোনও দেশকেই দেখিনি। এত ভয়ংকর নির্মমতা কোনও দেশ আমার সঙ্গে কখনও করেনি।

    ১৩. অন্য দেশ থেকে উল্লেখ করার মতো পুরস্কার।

    উত্তর: আছে বেশ কিছু। আমার আত্মজীবনী পড়ে দেখুন। পাবেন। নয়তো যেসব বইয়ের জ্যাকেটে পরিচিতি আছে, পড়ে নিন, ওতে লিস্ট আছে।

    ১৪. মৌলবাদীদের চাপে অনেক শিল্পী সাহিত্যিক দেশছাড়া হয়েছেন। মকবুল ফিদা হোসেন, সালমান রুশদি, আয়ান হিরসি আলী প্রমুখ। আপনি নিজেকে এঁদের থেকে আলাদা মনে করেন?

    উত্তর: কতগুলো নাম দেখি তোতা পাখির মতো শুধু মুখস্থই করেছেন। এঁদের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছেন বলে তো মনে হচ্ছে না। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এক মকবুল ফিদা হোসেন ছাড়া মৌলবাদীদের চাপে আর কেউ দেশ ছাড়েননি। সালমান রুশদি তাঁর দশ বছর বয়স থেকে ইংলেণ্ডে থাকেন। ইংলেণ্ডই তাঁর দেশ। মৌলবাদীদের চাপে তাঁকে ইংলেণ্ড ছাড়তে হয়নি। বরং তিনি ওখানে প্রচুর নিরাপত্তা রক্ষী পেয়েছেন। আয়ান হিরসি আলী সোমালিয়া থেকে এসে নেদারল্যাণ্ডে থেকেছেন, ওদেশের নাগরিক হয়েছেন, মৌলবাদীরা হুমকি দেওয়ার পর নেদারল্যা ণ্ডেই ছিলেন, ওখানেই নিরাপত্তা পেতেন। একসময় পুরোনা ফাইল পত্র ঘেঁটে একজন ডাচ সংসদ সদস্য বের করলেন যে নেদারল্যাণ্ডে আশ্রয় চাওয়ার সময় আয়ান নিজের সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য দিয়েছিলেন, মিথ্যে তথ্য দেওয়ার কারণে আয়ানের পার্লামেন্টের সদস্য পদটী চলে যায়। তখন তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ নামের এক ডানপন্থী সংগঠনের আমন্ত্রণ পেয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেন, ওখানেই স্কলার হিসেবে আছেন।

    আমার নির্বাসন ওঁদের চেয়ে আলাদা। মকবুল ফিদা হোসেনকে ভারত সরকার। দেশ থেকে বের করে দেয়নি। আমাকে বাংলাদেশ সরকার দেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং কুড়ি বছর হলো, আজো দেশে ফিরতে দিচ্ছে না। মকবুল ফিদা হোসেনকে উল্টে ভারত সরকার অনেক অনুরোধ করেছিল দেশে ফেরার জন্য। কিন্তু তিনি কাতারের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, দেশে ফেরেননি।

    ১৫. আপনি বিয়ে বিরোধী। অথচ আপনি আগে বিয়ে করেছেন। তখন বোঝেননি বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের অসারতার কথা?

    উত্তর: না। তখন বুঝিনি। তখন বুঝিনি বলেই তো বিয়ে করেছিলাম। আমি কি জন্ম থেকেই একজন সর্বজ্ঞানী মানুষ? আমি তো ঠকতে ঠকতে, সইতে সইতে, ভুগতে ভুগতে যা শেখার শিখেছি। অন্যের জীবন থেকেও শেখা যায়, অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা অনেক শিখি। তবে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার কোনও তুলনা হয় না। বিয়ে করেছিলাম বলেই তো বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের অসারতা বুঝেছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিয়েটা যে ভীষণ কুৎসিত একটা প্রভু দাসীর সম্পর্ককে মুখ বুজে বয়ে বেড়ানো, তা বিয়ে না করলে অত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারতাম না। যে সমাজে নারীর সমানাধিকার আছে, সে সমাজে বিয়েটা কেউ করতে চাইলে করতেই পারে।

    ১৬. সংসার বলতে কী বোঝেন?

    উত্তর: সংসার বলতে সংসারই বুঝি। চিরকাল আমি আমার একার সংসারই করেছি। আমার এখনকার সংসারটি আমার আর আমার বেড়ালের। আমি খুব সংসারী মানুষ। বাড়িঘর গোছানো, সাজানো, নিজে বাজার করা, বাগান করা, রান্নাবান্না করা, বন্ধুদের নেমন্তন্ন করা, হৈ চৈ করে খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, এসব তো আছেই, আর যখন একা, নীরবতা শুয়ে থাকে পাশে, তখন ভাবি, লিখি, পড়ি। এই সময়টা আমার খুব প্রিয়। প্রিয় আরও এ কারণে, যে, আমার ভাবার, লেখার, পড়ার জন্য যে নৈঃশব্দ্য প্রয়োজন, যে নির্জনতা প্রয়োজন তা আমি চমৎকার পেয়ে যাই। কেউ চিৎকার করার। নেই, কোনও কিছু দাবি করার, আদেশ করার, উপদেশ দেওয়ার, ধমক দেওয়ার কেউ নেই। দাদাগিরি বা স্বামীগিরি দেখানোর কেউ নেই এখানে। এই না থাকাটা সংসারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

    সংসারটা হচ্ছে স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা। এ দুটো যদি না থাকে, তবে সে সংসার সংসার নয়। শুধুই সন্ত্রাস।

    ১৭. শাহবাগ আন্দোলনকে কী চোখে দেখেন?

    উত্তর: বিশাল এক ব্যাপার ঘটিয়েছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। নো কান্ট্রি ফর উইমেন নামে যে ফ্রি হট ব্লগ লিখি আমি, ওতে অন্তত পনেরো ষোলোটা ব্লগ লিখেছি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সেকুলার আন্দোলন নিয়ে। বেশ কিছু বক্তৃতা ছিল আমার গত দুতিন মাসে, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টে, বেলজিয়ান পার্লামেন্টে, কানাডায়, ফ্রান্সে, আয়ারল্যাণ্ডে– এই আন্দোলন নিয়ে বলেছি। দেশ নিয়ে হতাশা ছাড়া আর কিছুই তো ছিল না। শাহবাগ একটু আশা জাগিয়েছে। একটা ট্রেণ্ড তৈরি তো হলো অন্তত। মানুষ দেখিয়ে দিল প্রয়োজনে লক্ষ লক্ষ লোক পথে নেমে ধর্মীয় বর্বরতার প্রতিবাদ করতে জানে। এর আগে তোমুখ বুজে থাকাটাই ছিল নিয়ম। কথা না বলাটাই ছিল রীতি। ভয় পাওয়াটাই ছিল সংস্কৃতি।

    তবে শাহবাগ আন্দোলনের সবকিছুকেই যে একশয় একশ নম্বর দিয়েছি, তা নয়। আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। মৃত্যুদণ্ডের কোনও দাবি আমি মেনে নিইনি। তবে মৌলবাদ বিরোধী ওদের যে আন্দোলন, তা ভীষণভাবে সমর্থন করেছি।

    ১৮. আগামী প্রজন্মের কাছে কী হিসেবে চিহ্নিত হতে আপনার ভালো লাগবে? একজন লেখক হিসেব নাকি একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে?

    উত্তর: আগামী প্রজন্ম তো ভেড়া নয় যে সবাই এক পথেই যাবে। কারও কবি হিসেবে, কারও লেখক হিসেবে আমাকে ভালো লাগতে পারে, কারও অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে, কারও শুধু মানুষটাকে, তার আপোসহীন সংগ্রামটাকে হয়তো ভালো লাগবে, কারও কারও ভালো লাগবে তার সততা আর নিষ্ঠাকে। কত মানুষ কত রকম ভাবে চিহ্নিত করতে পারে আমাকে। কোনও লেখকই নয়, বলবে কেউ। কেউ কেউ চিহ্নিত করবে নাস্তিক হিসেবে। অথবা, হয়তো ভুলেই যাবে আমাকে। কী হবে ভবিষ্যতে তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই মোটেও। আমাকে মনে রাখুক বা আমাকে ভুলে যাক, একই কথা। কবে যেন একটা কবিতা লিখেছিলাম, অমরত্ব নামে। অমরত্ব নেবে? অজস্র অমরত্ব আমার পড়ার টেবিলে, বইয়ের আলমারিতে, বিছানায়, বালিশের তলায়..ঘর থেকে বেরোলে অমরত্ব আমার ব্যাগে, আমার প্যান্টের পকেটে, আমার শাটে, চুলে.. কী করে কবে যে অমরত্ব আমার খোঁজ পেয়েছিল। অমরত্ব নেবে নাও, যত খুশি। অমরত্বের কাঁটা এমন বেঁধে যে সারারাত ঘুমোতে পারিনা। যতটুকু আছে সব কেউ নিয়ে নিলে কিছুটা নিস্তার পাই। অমরত্বে বিশ্বাস নেই আমার।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফরাসি প্রেমিক – তসলিমা নাসরিন
    Next Article নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }