Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিষ্কৃতি – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প68 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    নিষ্কৃতি

    তিন

    অতুল এমন অপ্রস্তুত জীবনে হয় নাই। শৈশব হইতে আদরযত্নে লালিত পালিত; বাপ-মা কোনদিন তাহার ইচ্ছা ও অভিরুচির বিরুদ্ধে কথা কহিতেন না। আজ সকলের সম্মুখে এতবড় অপমান তাহার সর্বাঙ্গ বেড়িয়া আগুন জ্বালাইয়া দিল। সে বাহিরে আসিয়া নূতন কোটটা মাটিতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া প্যাঁচার মত মুখ করিয়া বসিল।

    আজ হরিচরণের সম্পূর্ণ সহানুভূতি ছিল অতুলের উপর। কারণ, তাহারই ওকালতি করিতে গিয়া সে লাঞ্ছিত হইয়াছে-তাই সেও তাহার পাশে আসিয়া মুখ ভারী করিয়া বসিল। ইচ্ছাটা-তাহাকে সান্ত্বনা দেয়; কিন্তু সময়োপযোগী একটা কথাও খুঁজিয়া না পাইয়া মৌন হইয়া রহিল।

    কিন্তু অতুলের আর ত চুপ করিয়া থাকা চলে না। কারণ, অপমানটাই এ ক্ষেত্রে তাহার একমাত্র ক্ষোভের বস্তু নয়, সে বিদেশ হইতে অনেক ফ্যাশন, অনেক কোট-প্যাণ্ট নেক্টাই লইয়া ঘরে ফিরিয়াছে, নানা রকমে অনেক উঁচুতে তুলিয়া নিজের আসন বাঁধিয়াছে, আজ ছোটখুড়ীমার একটা তিরস্কারের ধাক্কায় অকস্মাৎ সমস্ত ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া একাকার হইয়া যায় দেখিয়া সে উৎকণ্ঠায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। হরিদাকে উদ্দেশ করিয়া সরোষে বলিল, আমি কারো কথার ধার ধারিনে বাবা! এ শর্মা অতুলচন্দর,-রোগ গেলে ও-সব ছোটখুড়ী-টুড়ী কাউকে কেয়ার করে না!

    হরিচরণ এদিকে ওদিকে চাহিয়া ভয়ে ভয়ে প্রত্যুত্তর করিল, আমিও করিনে-চুপ, কানাই আসছে। পাছে নির্বোধ অতুল উহারই সম্মুখে বীরত্ব প্রকাশ করিয়া বসে এই ভয়ে সে ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

    কানাই দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া মোগল-বাদশার নকিবের মত উচ্চকণ্ঠে হাঁকিয়া কহিল, মেজদা, সেজদা, মা ডাকচেন-শিগগির।

    হরিচরণ পাংশুমুখে কহিল, আমাকে? আমি কি করেচি? আমাকে কখ্খন নয়-যাও অতুল, ছোটখুড়ীমা ডাকচেন তোমাকে।

    কানাই প্রভুত্বের স্বরে কহিল, দু’জনকেই-দু’জনকেই-এক্ষুণি-অ্যাঁ, সেজদা, তোমার নতুন কোট মাটিতে ফেলে দিলে কে?

    প্রত্যুত্তরে সেজদা শুধু মেজদার মুখের পানে চাহিল, এবং মেজদা সেজদার মুখের পানে চাহিল, কেহই সাড়া দিল না। কানাই ভূলুণ্ঠিত কোটটা চেয়ারের হাতলে তুলিয়া দিয়া চলিয়া গেল।

    হরিচরণ শুষ্ককণ্ঠে কহিল, আমার আর ভয় কি, আমি ত কিছু বলিনি-তুমিই বলেচ ছোটখুড়ীমাকে কেয়ার কর না-

    আমি একা বলিনি, তুমিও বলেচ, বলিয়া অতুল সগর্বে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। ভাবটা এই যে, আবশ্যক হইলে সে সত্য কথা প্রকাশ করিয়া দিবে।

    হরিচরণের চেহারা আরও খারাপ হইয়া গেল। একে ত ছোটখুড়ীমা যে কেন ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন তাহা জানা নাই, তাহাতে কাণ্ডজ্ঞানহীন অতুল কি যে বলিয়া ফেলিবে তাহাও আন্দাজ করা শক্ত। একবার ভাবিল, সেও পিছনে গিয়া উপস্থিত হয় এবং সর্বপ্রকার নালিশের রীতিমত প্রতিবাদ করে। কিন্তু, কিছুই তাহার সাধ্যায়ত্ত বলিয়া ভরসা হইল না। এদিকে হাজিরির সময় নিকটতর হইয়া আসিতেছে-কানাই শমন ধরাইয়া গিয়াছে, এবার নিশ্চয় ওয়ারেণ্ট লইয়া আসিবে। হরিচরণ আত্মরক্ষার উপস্থিত আর কোন সদুপায় খুঁজিয়া না পাইয়া, সহসা গাড়ুটা হাতে তুলিয়া লইয়া বিশেষ একটা স্থানের উদ্দেশে সবেগে প্রস্থান করিল। ছোটখুড়ীমাকে বাড়িসুদ্ধ লোক বাঘের মত ভয় করিত।

    অতুল ভিতরে ঢুকিয়া সংবাদ লইয়া জানিল, ছোটখুড়ীমা নিরামিষ-রান্নাঘরে আছেন। সে বুক ফুলাইয়া দোরগোড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। কারণ, এ বাটীর অন্যান্য ছেলেদের মত সে এই ছোটখুড়ীমাটিকে চিনিবার অবকাশ পায় নাই। স্ত্রীলোকেও যে ইস্পাতের মত শক্ত হইতে পারে ইহা সে জানিতই না। অথচ, সাধারণ দুর্বলচিত্ত ও মৃদু আত্মীয়-আত্মীয়তার কাছে জন্মাবধি প্রশ্রয় পাইয়া তাহার মা, খুড়ী, জ্যাঠাই প্রভৃতি গুরুজন সম্বন্ধে একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মিয়াছিল, ইঁহাদিগের মুখের উপর শুধু কড়া জবাব দিতে পারিলেই কাজ পাওয়া যায়। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাটা খুব জোরে প্রকাশ করিতে পারা চাই। তাহা হইলেই ইঁহারা সায় দেন, অন্যথা দেন না। যে ছেলে ইহা না পারে তাহাকে চিরকাল ঠকিয়া মরিতেই হয়। এখানে আসিয়া অবধি সে হরিচরণের বেশভূষার অভাব লক্ষ্য করিয়া এই ফন্দিটা গোপনে তাহাকে শিখাইয়াও দিয়াছিল। অথচ, এইমাত্র নিজের বেলায় কোন ফন্দিই খাটে নাই, ছোটখুড়ীমার তাড়া খাইয়া কড়া জবাব ত ঢের দূরের কথা-কোনপ্রকার জবাবই মুখে যোগায় নাই-হতবুদ্ধির মত নিঃশব্দে বাহিরে চলিয়া আসিয়াছিল। তাই এখন ফিরিয়া গিয়া সমস্ত অপমান কড়ায়-গণ্ডায় শোধ দিবার অভিপ্রায়ে সে অমন মরিয়ার মত রান্নাঘরে দ্বারের কাছে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই স্থানটা হইতে শৈলজার মুখের কিয়দংশ স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল, এমন কি মুখ তুলিলেই তিনি অতুলকে দেখিতে পাইতেন; কিন্তু রান্নায় অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় অতুলের পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলেন না, মুখ তুলিয়াও চাহিলেন না। কিন্তু অতুল খুড়ীমাকে আজ ভাল করিয়া দেখিল নিমিষমাত্র, তথাপি সে অনুভব করিল এ মুখ তাহার মায়ের নয়, জ্যাঠাইমার নয়-এ মুখের সুমুখে দাঁড়াইয়া নিজের অভিপ্রায় জোর করিয়া ব্যক্ত করিবার মত জোর আর যাহারই থাক, অন্ততঃ তাহার গলায় নাই। তাহার বিস্ফারিত বক্ষ আপনি কুঞ্চিত হইয়া গেল এবং সে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার এটুকু পর্যন্ত সাহস হইল না-কোনরকম সাড়া দিয়াও ছোটখুড়ীমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

    নীলা কি কাজে এই দিকে আসিতেছিল। হঠাৎ সেজদার পায়ের দিকে চাহিয়া সে থমকিয়া জিভ কাটিয়া দাঁড়াইল, এবং অলক্ষ্যে থাকিয়া ভীত ব্যাকুল ইঙ্গিতে পুনঃ পুনঃ তাহাকে জানাইতে লাগিল, জুতা পায় দিয়া দাঁড়াইবার স্থান ওটা নয়।

    ছোটখুড়ীমার আনত-মুখের প্রতি কটাক্ষে দৃষ্টিপাত করিয়া অতুল অন্তরে কণ্টকিত হইয়া উঠিল। একবার মনে করিল নিঃশব্দে সরিয়া যায়, একবার ভাবিল, জুতা-জোড়াটা হাতে তুলিয়া লইয়া উঠানে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেয়। কিন্তু ছোটবোনের সুমুখে ভয়ের লক্ষণ প্রকাশ করিতে তাহার অত্যন্ত লজ্জা বোধ হইল। এই নিষেধটা সে যথার্থই জানিত না এবং স্পর্ধাপূর্বক তাহা অমান্যও করে নাই। কিন্তু পিতামাতার কাছে নিরন্তর অবারিত ও অসঙ্গত প্রশ্রয়ে তাহার অভিমান এতই সূক্ষ্ম ও তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল যে একটা কাজ করিয়া ফেলিয়া শেষে ভয়ে পিছাইয়া দাঁড়াইতে তাহার মাথা কাটা যাইত। ভীত-বিবর্ণমুখে সেইখানে দাঁড়াইয়া নিজের সর্বনাশ উপলব্ধি করিয়াও সে অভিমানী দুর্যোধনের মত সূচ্যগ্র ভূমিও পরিত্যাগ করিতে পারিল না।

    শৈলজা মুখ তুলিল। সস্নেহে মৃদু হাসিয়া বলিল, অতুল এসেচিস? দাঁড়া বাবা-ও কি রে! জুতো পায়ে? নীচে যা-নীচে যা-

    বাড়ির আর কোন ছেলে অনুরূপ অবস্থায় শৈলজার হাতে এত সহজে নিষ্কৃতি পাইলে ছুটিয়া পলাইয়া বাঁচিত, কিন্তু অতুল ঘাড় গুঁজিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

    শৈলজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জুতো পায়ে দিয়ে এখানে আসতে নেই অতুল, নীচে যাও।

    অতুল শুষ্কমুখে ক্ষীণস্বরে কহিল, আমি ত চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি-এখানে দোষ কি?

    শৈলজা ধমকাইয়া উঠিল, দোষ আছে-যাও।

    অতুল তথাপি নড়িল না; সে মানসচক্ষে দেখিতে লাগিল, হরিচরণ, কানাই, বিপিন প্রভৃতি আড়াল হইতে তাহার লাঞ্ছনা উপভোগ করিতেছে। তাই বজ্জাত ঘোড়ার মত ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, আমরা চুঁচড়ার বড়িতে ত জুতো পায়ে দিয়েই রান্নাঘরে যেতুম-এখানে চৌকাঠের বাইরে দাঁড়ালে কিচ্ছু দোষ নেই।

    ইহার স্পর্ধা দেখিয়া শৈলজা দুঃসহ বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শুধু তাহার দুই চোখ দিয়া যেন আগুন ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল।

    ঠিক এইসময়ে হরিচরণের বড়ভাই মণীন্দ্র ডাম্বেল ও মুগুর ভাঁজিয়া ঘর্মাক্তকলেবরে বাইরে যাইতেছিল। শৈলজার চোখের দিকে চাহিয়া সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েচে খুড়ীমা?

    ক্রোধে শৈলজার মুখ দিয়া স্পষ্ট কথা বাহির হইল না। নীলা দাঁড়াইয়াছিল, অতুলের পায়ের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, সেজদা জুতো পায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে-কিছুতে নাবছে না।

    মণীন্দ্র হাঁকিয়া কহিল, এই-নেবে আয়!

    অতুল গোঁ-ভরে বলিল, এখানে দাঁড়াতে দোষ কি? ছোটখুড়ী আমাকে দেখতে পারে না বলে শুধু যা যা কচ্চে।

    মণীন্দ্র তড়াক করিয়া রকের উপর লাফাইয়া উঠিয়া অতুলের গণ্ডে একটা প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া কহিল, ‘ছোটখুড়ী’ নয়-‘ছোটখুড়ীমা’; ‘কচ্চে’ নয়-‘কচ্চেন’-বলতে হয়-ইতর কোথাকার!

    একে মণীন্দ্র পালোয়ান লোক, চড়ের ওজনটাও ঠিক রাখিতে পারে নাই, অতুল চোখে অন্ধকার দেখিয়া বসিয়া পড়িল।

    মণীন্দ্র ভারী অপ্রতিভ হইয়া গেল। এতটা আঘাত করা সে ইচ্ছাও করে নাই, আবশ্যকও মনে করে নাই। ব্যস্তভাবে ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহার হাতদুটা ধরিয়া দাঁড় করাইয়া দিবামাত্রই অতুল ক্রোধোন্মত্ত চিতাবাঘের মত মণীন্দ্রের গায়ের উপর লাফাইয়া পড়িয়া, আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া এমন সকল মিথ্যা সম্পর্ক ধরিয়া ডাকিতে লাগিল, যাহা হিন্দুসমাজে থাকিয়া, জ্যাঠতুত-খুড়তুত ভায়ের মধ্যে হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। মণি প্রথমটা বিস্ময়ে একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। সে মেডিক্যাল কলেজের উঁচু ক­াসে পড়ে এবং বয়সে ছোট ভাইদের চেয়ে অনেকটাই বড়। তাহারা বড়ভাইয়ের সুমুখে দাঁড়াইয়া চোখ তুলিয়া কথা কহিতে পারে না। এ বাড়িতে ইহাই সে চিরকাল দেখিয়া আসিয়াছে। কেহ যে এই-সমস্ত অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ উচ্চারণ করিতে পারে ইহা তাহার কল্পনারও অগোচর। আর তাহার হিতাহিত জ্ঞান রহিল না-অতুলের ঘাড় ধরিয়া সজোরে তাহাকে সানের উপর নিক্ষেপ করিয়া, লাথি মারিয়া ঠেলিয়া উপর হইতে প্রাঙ্গণের উপর ফেলিয়া দিল। কানাই, বিপিন, পটল প্রভৃতি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রৈ রৈ শব্দে চীৎকার করিয়া উঠিল। মণীন্দ্রের মা সিদ্ধেশ্বরী আহ্নিক ফেলিয়া ছুটিয়া আসিলেন, মেজবধূ নির্জন ঘরে বসিয়া গোটা-দুই সন্দেশ গালে দিয়া জল খাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন-গোলমাল শুনিয়া বাহিরে আসিয়া একেবারে নীলবর্ণ হইয়া গেলেন। মুখের সন্দেশ ফেলিয়া দিয়া, মড়াকান্না তুলিয়া ঝাঁপাইয়া আসিয়া ছেলের উপর উপুড় হইয়া পড়িলেন। সমস্তটা মিলিয়া এমনি একটা গণ্ডগোল উঠিল যে, বাহির হইতে কর্তারা কাজকর্ম ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

    শৈলজা রান্নাঘর হইতে মুখ বাড়াইয়া বলিল, মণি, তুই বাইরে যা। বলিয়া পুনরায় নিজের কাজে মন দিল। মণি নিঃশব্দে চলিয়া গেল। তাহার পিতা মেজবৌমার উন্মাদ ভঙ্গী দেখিয়া লজ্জা পাইয়া প্রস্থান করিলেন।

    এই মহামারী ব্যাপার কতকটা শান্ত হইয়া গেলে, হরিশ ছেলেকে প্রশ্ন করিলেন।

    অতুল কাঁদিতে কাঁদিতে ছোটখুড়ীর প্রতি সমস্ত দোষারোপ করিয়া কহিল, ও বড়দাকে মারতে শিখিয়ে দিলে-ইত্যাদি ইত্যাদি।

    হরিশ চিৎকার করিয়া বলিলেন, ছোটবৌমা, মণিকে যে তুমি খুন করতে শিখিয়ে দিলে, কেন শুনি?

    নীলা রান্নাঘরের ভিতর হইতে ছোটখুড়ীর হইয়া জবাব দিল, সেজদা কথা শোনেন নি, আর বড়দাকে গালাগালি দিয়েচেন, তাই।

    নয়নতারা ছেলের তরফ হইতে বলিল, তবে আমিও বলি ছোটবৌ-তোমার হুকুমে ওকে মেরে ফেলছিল বলেই প্রাণের দায়ে ও গাল দিয়েচে, নইলে গাল দেবার ছেলে ত আমার অতুল নয়!

    নয়ই ত। বলিয়া সায় দিয়া হরিশ আরও ক্রুদ্ধস্বরে জানিতে চাহিলেন-তোর ছোটখুড়ীমাকে জিজ্ঞাসা র্ক নীলা, উনি কে যে অতুলকে মারতে হুকুম দেন? কথা যখন ও না শুনেছিল, তখন কেন আমাদের কাছে নালিশ না করা হল? আমরা উপস্থিত থাকতে উনি শাসন করতে গেলেন কেন?

    নীলা এই তিনটি প্রশ্নের একটারও উত্তর দিল না।

    সিদ্ধেশ্বরী এতক্ষণ বারান্দার একধারে অবসন্নের মত চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন। তাঁহার পীড়িত দেহে এই উত্তেজনা অত্যধিক হইয়া পড়িয়াছিল। একে ত, এ সংসারে তিনি ছেলেপুলে মানুষ করা ছাড়া সহজে কোন বিষয়েই কথা কহিতে চাহিতেন না, কারণ তাঁহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, ভগবান এ বাটীর সম্বন্ধে সুবিচার করেন নাই। তাঁহাকে বড়বধূ এবং গৃহিণী করিয়াও উপযুক্ত বুদ্ধি দেন নাই, অথচ শৈলকে সকলের ছোট এবং ছোটবৌ করিয়াও রাশিপ্রমাণ বুদ্ধি দিয়াছেন। হিসাব করিতে, চিঠিপত্র লিখিতে, কথাবার্তা কহিতে, রোগে শোকে চারিদিকে নজর রাখিতে, সকলকে শাসন করিতে, রাঁধিতে-বাড়িতে, সাজাইতে-গুছাইতে ইহার জুড়ি নাই। তিনি প্রায়ই বলিতেন, শৈল আমার পুরুষমানুষ হইলে এতদিনে জজ হইত। সেই শৈলকে যখন মেজকর্তা কটূক্তি করিতে লাগিলেন, তখন হঠাৎ বোধ করি, ভগবান তাঁহার মাথার মধ্যে গৃহিণীর কর্তব্যবুদ্ধি গুঁজিয়া দিয়া গেলেন।

    সিদ্ধেশ্বরী একটু রুক্ষস্বরে বলিয়া ফেলিলেন, বেশ ত মেজঠাকুরপো, তাই যদি হয়, তবে তুমিই বা আমাদের কাছে নালিশ না করে নিজে শাসন করছ কেন? মা বেঁচে, আমি বেঁচে-ঝি-বৌকে শাসন করতে হয় আমরা করব! তুমি পুরুষমানুষ, ভাশুর-ও কি কথা-বাইরে যাও। লোকে শুনলে বলবে কি!

    হরিশ লজ্জা পাইয়া বলিলেন, তুমি সবদিকে দৃষ্টি রাখলে ভাবনা কি বৌঠাকরুন। তা হলে কি একজন আর একজনকে বাড়ির মধ্যে হত্যা করে ফেলতে পারে? বলিয়া বাইরে যাইবার উপক্রম করিতেই তাঁহার স্ত্রী বাধা দিয়া বলিলেন, বেশ ত, দাঁড়িয়ে দেখই না, উনি ঝি-বৌকে কেমন শাসন করেন।

    হরিশ সে কথার আর জবাব না দিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleতরুণের বিদ্রোহ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article বিপিনের সংসার – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }