Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিষ্কৃতি – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প68 Mins Read0
    ⤶

    নিষ্কৃতি

    নয়

    কোন একটা অভাব লইয়া-তা সে যতই গুরুতর হউক, মানুষ অনন্তকাল শোক করিতে পারে না। সিদ্ধেশ্বরীর কাছে তাঁহার শয্যার শূন্যতা ক্রমশঃ পূর্ণ হইয়া আসিতে লাগিল। শৈলর ঘরের দিকটা তিনি মাড়াইতেই পারিতেন না, এখন সে বারান্দা স্বচ্ছন্দে পার হইয়া যান-মনেও পড়ে না। কানাই-পটলের সংবাদ তিনি বিবিধ উপায়ে সংগ্রহ করিবার জন্য অহরহ উৎকণ্ঠিত থাকিতেন, এখন সে উৎকণ্ঠার অর্ধেক তিরোহিত হইয়া গেছে। এইরূপে সুখে-দুঃখে এক বৎসর ঘুরিয়া গেল।

    সেদিন হঠাৎ সিদ্ধেশ্বরীর কানে গেল যে, দেশের বিষয় লইয়া আজ ছয় মাস ধরিয়া ছোট-দেবরের সহিত তাঁহাদের মামলা চলিতেছে। মকদ্দমা চালাইতেছে হরিশ নিজে। দেওয়ানী ত চলিতেছেই, গোটা-দুই ফৌজদারীও ইতিমধ্যে হইয়া গেছে। খবর শুনিয়া সিদ্ধেশ্বরী ভয়ে ভাবনায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিলেন।

    স্বামীর নিকট হইতে সম্পূর্ণ কৌতূহল নিবৃত্তি করিবার মত সংবাদ জানার সুবিধা হইবে না জানিয়া তিনি সন্ধ্যার সময় হরিশের কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, বল কি ঠাকুরপো, ছোটঠাকুরপো করচে তোমার দাদার সঙ্গে মামলা?

    হরিশ উচ্চ অঙ্গের একটুখানি হাস্য করিয়া কহিলে, তাই ত হচ্চে বৌঠান।

    সিদ্ধেশ্বরী মুখ পাংশুবর্ণ করিয়া বলিলেন, আমার যে বিশ্বাস হয় না, মেজঠাকুরপো। এখনো যে চন্দ্র-সূর্যি উঠচে।

    নয়নতারা খাটের একধারে বসিয়া খেঁদিকে ঘুম পাড়াইতেছিল, মৃদুস্বরে কহিল, সে ত উঠচেই দিদি। আর এই ছোট-দেওরকেই তোমরা হাজার হাজার টাকা ব্যবসা করতে দিতে। সে সব তখন যায়নি, যাচ্চে এখন।

    সিদ্ধেশ্বরী দুঃসহ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মকদ্দমা কেন?

    হরিশ বলিলেন, কেন! দেখলুম, মকদ্দমা না করে আর উপায় নেই। দেশের বিষয়ই বিষয়। দেখলুম আমরা গেলে আমাদের মণি-হরি-বিপিন-ক্ষুদে এক কাঠা জমি-জায়গা ত পাবেই না-দেশের বাড়িতে হয়ত ঢুকতে পর্যন্ত পাবে না। ধর না বড়বৌ, দেশে যা-কিছু আছে, সে-ই সমস্ত দখল করে বসে গেছে। খাজনাপত্র আদায় করচে, খাচ্চে দাচ্চে-একটা পয়সা পর্যন্ত দেবার নাম করে না। বিষয় যা-কিছু তা ত দাদাই করেচেন, অথচ দাদার চিঠির একটা জবাব পর্যন্ত দিলে না-এমনি নেমকহারাম রমেশ। আমিও বাড়ি থেকে তাকে বার করে দিয়ে তবে ছাড়ব এই আমার প্রতিজ্ঞা।

    সিদ্ধেশ্বরী আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, আচ্ছা, তারাই বা ছেলেপিলে নিয়ে যাবে কোথায়?

    হরিশ বলিলেন, সে খবরে আমাদের ত দরকার নেই, বড়বৌ।

    সিদ্ধেশ্বরী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দাদা কি বললেন?

    হরিশ বলিলেন, দাদা যদি তেমন হতেন, তা হলে ত ভাবনা ছিল না বড়বৌ। যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, রমেশ তাঁর খেয়ে-পরে, তাঁর টাকায় তাঁরই বিষয় নিয়ে গোলযোগ বাধিয়েচে, তখনই তিনি মত দিলেন। ফৌজদারীতে রমেশ ত দাদাকেই জড়িয়ে তোলার চেষ্টায় ছিল। অনেক কষ্টে আমাকে সেটা ফাঁসাতে হয়েচে।

    নয়নতারা ফিসফিস করিয়া বলিল, আচ্ছা, ছোটঠাকুরপোই যেন দোষী, কিন্তু, আমি কেবল ভাবি দিদি, ছোটবৌ কি করে এত মত দিলে, আমরা আর সবাই দুষ্টু বজ্জাত হতে পারি, কিন্তু সে তার বট্ঠাকুরকে ত চেনে। তাকে জেলে দিয়ে সে কি সুখ পেত?

    সিদ্ধেশ্বরীর আপাদমস্তক বারংবার শিহরিয়া উঠিল। তিনি আর একটি কথাও না বলিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

    তথা হইতে আসিয়া সিদ্ধেশ্বরী স্বামীর ঘরে প্রবেশ করিলেন। গিরীশ যথারিতী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মুখ তুলিয়া স্ত্রীর মুখের প্রতি চাহিতেই তাঁহার অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা আজ তাঁহারও চোখে পড়িল। হাতের কাগজখানা রাখিয়া দিয়া বলিলেন, আজ কখন জ্বর এল?

    সিদ্ধেশ্বরী অভিমানভরে বলিলেন, তবু ভালো, জিজ্ঞাসা করলে।

    গিরীশ ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, বিলক্ষণ! জিজ্ঞেসা করিনি ত কি? পরশুও ত মণিকে ডেকে বললুম, তোর মাকে ওষুধ-টষুধ দিস? তা আজকালকার ছেলেগুলো হয়েচে সব এমনি যে, বাপ-মাকে পর্যন্ত মানে না।

    সিদ্ধেশ্বরী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, বুড়োবয়সে মিথ্যে কথাগুলো আর ব’লো না, পনর দিন হয়ে গেল, মণি তার পিসির ওখানে এলাহাবাদে গেছে, আর তুমি তাকে পরশু জিজ্ঞাসা করলে! কখনো যা করনি, তা কি আজ করবে? তা নয়, আমি সেজন্যে আসিনি। আমি জানতে এসেচি, ব্যাপারটি কি? ছোটঠাকুরপোর সঙ্গে মামলা-মকদ্দমা কিসের?

    গিরীশ মহা খাপ্পা হইয়া উঠিলেন, সেটা একটা চোর! চোর! একেবারে লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে! বিষয়পত্র সব নষ্ট করে ফেললে। সেটাকে দূর করে না দিলে দেখচি আর ভদ্রস্থ নেই-সমস্ত ছারখার ধ্বংস করে দিলে।

    সিদ্ধেশ্বরী প্রশ্ন করিলেন, আচ্ছা তা যেন দিলে, কিন্তু মামলা-মকদ্দমা ত শুধু শুধু হয় না, টাকা খরচ করা ত চাই? ছোটঠাকুরপো টাকা পাচ্ছে কোথায়?

    ইতিমধ্যে হরিশ নামিয়া আসিয়া ছেলেদের পড়িবার ঘরে যাইতেছিলেন, দাদার উচ্চকণ্ঠে আকৃষ্ট হইয়া ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিলেন। তিনি জবাব দিলেন-টাকার কথা ত এইমাত্র মেজবৌ বলে দিলেন বড়বৌঠান! পাটের দালালির নাম করে দাদার কাছ থেকে হাজার-চারেক নিয়েছিল, সেটা ত হাতে আছেই; তা ছাড়া, ছোটবৌমার হাতেই ত এতদিন টাকাকড়ি সমস্ত ছিল-বুঝেই দেখ না!

    গিরীশ পুনরায় উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, আমার সর্বস্ব নিয়ে গেছে, কিছু কি আর রেখেচে হে হরিশ! সেটা একেবারে বেহেড লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে! শুক্রবার দিন কোর্টে এসে বলে-বাড়ি-ঘরদোর মেরামত করতে হবে, পাঁচশ টাকা চাই।

    হরিশ অবাক হইয়া গেলেন, বলেন কি? সাহস ত কম নয়!

    গিরীশ কহিলেন, সাহস বলে সাহস! একেবারে লম্বা ফর্দ-এখানটা সারাতে হবে, ওখানটা গাঁথতে হবে; এটা না বদলালে নয়, ওটা না করলেই চলে না। শুধু কি তাই! সংসারের অনটন-শীতের কাপড়-চোপড় কিনতে হবে-ধান কিনে, আলু কিনে রাখতে হবে,-এমনি হাজারো খরচ দেখিয়ে আরও তিনশ টাকার দরকার।

    হরিশ অসহ্য ক্রোধ কোনমতে সংবরণ করিয়া শুধু কহিলেন, নির্লজ্জ! তারপরে?

    গিরীশ বলিলেন, ঠিক তাই। হতভাগার একেবারে লজ্জাশরম নেই-এক্কেবারে নেই। এই আটশ’টাকা নিয়ে তবে ছাড়লে।

    নিয়ে গেল? আপনি দিলেন?

    গিরীশ বলিলেন, না হলে কি ছাড়ে? নিয়ে তবে উঠল যে!

    হরিশের সমস্ত মুখখানা প্রথমটা অগ্নিবর্ণ হইয়া পরক্ষণেই ছাইয়ের মত হইয়া গেল। স্তব্ধ হইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া কহিলেন, তা হলে মামলা-মকদ্দমা করে আর লাভ কি দাদা?

    গিরীশ তৎক্ষণাৎ বলিলেন, কিছু না, কিছু না। নিজের সংসারটা যে চালিয়ে নেবে হতভাগার সেটুকু ক্ষমতাও নেই-এমনি অপদার্থ হয়ে গেছে। শুনি, বৈঠকখানায় দিব্যি আড্ডা বসিয়ে দিনরাত তাস-পাশা চলচে, আর খাচ্চেন-ব্যস্। মানুষ যেমন শিব-স্থাপনা করে, আমাদেরও হয়েচে তাই-বুঝলে না হরিশ! বলিয়া নিজের রসিকতায় নিজেই মাতিয়া উঠিয়া হোহো রবে হাসিয়া ঘর ভরিয়া দিলেন।

    হরিশ আর সহ্য করিতে না পারিয়া নিঃশব্দে উঠিয়া গেলেন। দাঁতে দাঁতে চাপিয়া বলিতে লাগিলেন, আচ্ছা, আমি একাই দেখচি।

    মাঘ মাসের বাইশে মকদ্দমার দিন ছিল। বিশে গিরীশের এক জ্ঞাতিকন্যার বিবাহে কন্যার পিতা আসিয়া গিরীশকে চাপিয়া ধরিলেন, দাদা, তুমি উপস্থিত থেকে আমার মেয়ের বিবাহ দাও, এই আমার বড় সাধ। তোমাকে একটি দিনের জন্যেও অন্তত দেশে যেতে হবে।

    ‘না’ শব্দটা গিরীশের মুখ দিয়া বাহির হইবার জো ছিল না। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজী হইয়া বলিলেন, যাব বৈ কি ভায়া, নিশ্চয় যাব।

    কন্যার পিতা নিশ্চিন্ত হইয়া প্রস্থান করিলেন। কিন্তু এই ‘নিশ্চয়’ কথাটার বাস্তবিক অর্থ যথাকালে যে কি হইবে, তাহা সবচেয়ে বেশী জানিতেন সিদ্ধেশ্বরী। সুতরাং প্রতিশ্রুতির বিবরণ যদিচ স্বামী বিস্মৃত হইয়াছিলেন, স্ত্রী হন নাই।

    বিশে সকালে গিরীশ আকাশ হইতে পড়িয়া কহিলেন, বল কি! আজ যে আমার সেই জয়পুরের মক-

    না, সে হবে না। তোমাকে যেতেই হবে। উকীল হয়ে পর্যন্ত ত মিছে কথা বলে আসচ-আজ একটা কথাও রাখো। পরকালের ভয় কি তোমার এতটুকু হয় না?

    গিরীশ কুণ্ঠিত হইয়া কহিলেন, পরকাল? তা বটে-কিন্তু-

    না, কিছুতে হবে না, তোমাকে যেতেই হবে। যাও।

    অতএব গিরীশকে দেশে যাইতে হইল।

    যাইবার সময় সিদ্ধেশ্বরী অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, ছেলে দুটোকে-বলিয়াই হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিলেন!

    আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে, বলিয়া গিরীশ বাহির হইয়া পড়িলেন। কিন্তু কি হবে, তাহা স্বামী-স্ত্রীর কেহই বুঝিলেন না। নয়নতারা গা টিপিয়া সিদ্ধেশ্বরীকে অন্তরালে ডাকিয়া কহিল, ও বাড়িতে কিছু খেতেটেতে বট্ঠাকুরকে মানা করে দিলে না কেন?

    সিদ্ধেশ্বরী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন?

    নয়নতারা মুখখানা বিকৃত-গম্ভীর করিয়া বলিল, বলা যায় কি দিদি!

    সিদ্ধেশ্বরীর চোখ দিয়া তখনও জল পড়িতেছিল। আঁচলে মুছিয়া ফেলিয়া একটুখানি চুপ করিয়া বলিলেন, সে তুমি পার মেজবৌ। শৈলর গলা কেটে ফেললেও সে তা পারবে না। বলিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।

    মকদ্দমার তদবির করিতে দুই-একদিন পূর্বে যাইবার জন্য রমেশ ঘরের মধ্যে প্রস্তুত হইতেছিল। শৈল সেখানে ছিল না। সে ঠাকুরঘরের মধ্যে দেহ হইতে তাহার সর্বশেষ অলঙ্কারখানি খুলিয়া ফেলিয়া জানু পাতিয়া বসিয়া গলবস্ত্র, যুক্তকরে মনে মনে বলিতেছিল, ঠাকুর, আর ত কিছু নাই; এইবার যেমন করিয়া হোক আমাকে নিষ্কৃতি দাও। আমার ছেলেরা না খাইয়া মরিতেছে, আমার স্বামী দুশ্চিন্তায় কঙ্কালসার হইতেছেন-

    ওরে কেনো-ওরে পটলি-

    শৈল চমকিয়া উঠিল,-এ যে তাহার ভাশুরের কণ্ঠস্বর! জানালার ফাঁক দিয়া দেখিল, তিনিই বটে। পাকা চুল, কাঁচা-পাকা গোঁফ, সেই শান্ত স্নিগ্ধ সৌম্যমূর্তি। চিরকালটি যেমনটি দেখিয়া আসিয়াছে, ঠিক তাই। কোন অঙ্গে এতটুকু পরিবর্তন ঘটে নাই। কানাই পড়া ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া প্রণাম করিল; পটল খেলা ছাড়িয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপস্থিত হইল। তাহাকে তিনি কোলে তুলিয়া লইলেন।

    রমেশ ঘর হইতে বাহির হইয়া প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিল।

    গিরীশ কহিলেন, এমন সময়, কোথায় যাওয়া হবে?

    রমেশ কুণ্ঠিত অস্পষ্টস্বরে বলিল, জেলায়-

    গিরীশ চক্ষের পলকে বারুদের মত প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন-হতভাগা, লক্ষ্মীছাড়া, তুমি আমার খাবে-পরবে, আর আমারই সঙ্গে মামলা করবে? তোমাকে এক সিকি-পয়সার বিষয়-আশয় দেব না-দূর হও আমার বাড়ি থেকে; এখখুনি দূর হও-এক মিনিট দেরি নয়-এক কাপড়ে বেরিয়ে যাও-

    রমেশ কথা কহিল না, মুখ তুলিল না; যেমন ছিল তেমনি বাহির হইয়া গেল। দাদাকে সে যেমন ভক্তিমান্য করিত, তেমনি চিনিত। এইসব তিরস্কারের অন্তঃসারশূন্যতা সম্পূর্ণ অনুভব করিয়া সে তখনকার মত মুখ বুজিয়া বাহির হইয়া গেল।

    তখন শৈল আসিয়া দূর হইতে গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিল।

    গিরীশ আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, এস, এস, মা এস। সে স্বরে উত্তাপ নাই, জ্বালা নাই-বাহির হইতে প্রবেশ করিয়া কোন লোকের সাধ্য নাই যে, বলে এই মানুষটাই মুহূর্তকাল পূর্বে ওরূপভাবে চীৎকার করিতেছিল।

    গিরীশের নজরে কোনদিন কিছু পড়ে না; কিন্তু আজ কেমন করিয়া জানি না, তাঁহার দৃষ্টিশক্তি আশ্চর্য নৈপুণ্য লাভ করিল। শৈলর প্রতি চাহিয়া কহিলেন, তোমার গায়ে গয়না দেখচি নে কেন ছোটবৌমা?

    শৈল অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল।

    গিরীশের কণ্ঠস্বর পুনরায় এক এক পর্দা চড়িতে লাগিল-ঐ হতভাগা শুয়ার বেচে খেয়েচে। গয়না কার? আমার। ওকে আমি জেলে দিয়ে তবে ছাড়ব, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    বাইশে মকদ্দমার দিন অপরাহ্ন বেলায় হরিশ মুখ কালি করিয়া হুগলীর আদালত হইতে বাটী ফিরিয়া আসিলেন এবং ধড়াচূড়া না ছাড়িয়া বিছানায় শুইয়া পড়িলেন।

    নয়নতারা কাঁদ-কাঁদ হইয়া সহস্র প্রশ্ন করিতে লাগিল; খবর পাইয়া সিদ্ধেশ্বরী ছুটিয়া আসিয়া পড়িলেন। কিন্তু হরিশ সেই যে পাশ ফিরিয়া নীরব হইয়া রহিলেন, কেহই তাঁহার মুখ হইতে একটা জবাবও বাহির করিতে পারিল না।

    মকদ্দমায় যে হার হইয়াছে তাহাতে সংশয় নাই,-দুই জায়ে নিরন্তর বুঝাইতে লাগিলেন-মকদ্দমায় হার-জিত আছেই-তা ছাড়া এখনও হাইকোর্ট আছে, বিলাতে আপীল করা আছে-এরই মধ্যে এমন করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িবার কিছুমাত্র হেতু নেই।

    কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এই দুটি স্ত্রীলোকের যে আশা-ভরসা ছিল, নিজে উকীল হইয়াও হরিশের তাহার কণামাত্রও দেখা গেল না।

    সিদ্ধেশ্বরী আর সহ্য করিতে না পারিয়া হরিশের হাত ধরিয়া বলিলেন, মেজঠাকুরপো, আমি বলচি, তোমাদের হার হবে না। যত টাকা লাগে আমি দেব, তুমি হাইকোট কর। আমি আশীর্বাদ করচি তুমি জিতবেই।

    এতক্ষণে হরিশ মুখ ফিরাইয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না বৌঠান, সে হবার জো নেই-সব শেষ হয়ে গেছে। হাইকোর্টই বল, আর বিলাতই বল-কোথাও কোন রাস্তা নেই। বিষয় সমস্তই দাদার নামে খরিদ ছিল। বিয়ে দিতে গিয়ে তিনি-সর্বস্ব ছোটবৌমার নামে দানপত্র করে দিয়ে এসেছেন। রেজিস্ট্রি পর্যন্ত হয়ে গেছে। দেশের দিকে মুখ ফেরাবারও আর পথ নেই।

    দুই জায়ে মুখোমুখি হইয়া পাথরের মূর্তির মত বসিয়া রহিলেন।

    সন্ধ্যার পর গিরীশ আদালত হইতে ফিরিয়া আসিলে যে কাণ্ড ঘটিল তাহা বর্ণনাতীত। কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মাদ বলিয়া লাঞ্ছনা করিতে কেহ আর বাকী রাখিল না।

    গিরীশ কিন্তু সকলের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বুঝাইতে লাগিলেন, যে এ-ছাড়া আর কোন রাস্তাই ছিল না। হতভাগা নচ্ছার বোম্বেটে, ছোটবৌমার গয়নাগুলো বেচিয়া খাইয়াছে, আর একটু হলেই বাড়ির ইঁটকাট পর্যন্ত বেচিয়া খাইত-দেশের বাড়ির অস্তিত্ব পর্যন্ত লুপ্ত হইয়া যাইত। তিনি সকল দিক বিশেষ বিবেচনা করিয়াই ভরাডুবি হইতে বংশকে নিষ্কৃতি দিয়া আসিয়াছেন।

    শুধু সিদ্ধেশ্বরী একধারে স্তব্ধ হইয়া বসিয়াছিলেন, ভালমন্দ কোন কথাই এতক্ষণ বলেন নাই। সবাই চলিয়া গেলে, তিনি উঠিয়া আসিয়া স্বামীর সম্মুখে দাঁড়াইলেন। চোখদুটিতে জল তখনও টলটল করিতেছিল; দুই পায়ের উপর মাথা পাতিয়া পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, আজ তুমি আমাকে মাপ কর। তোমাকে যার যা মুখে এলো-বলে গাল দিয়ে গেল বটে, কিন্তু তুমি যে তাদের সবাইয়ের চেয়ে কত বড়, সে-কথা আজ যেমন আমি বুঝেচি এমন কোনদিন নয়।

    গিরিশ মহা খুশী হইয়া মাথা নাড়িয়া বারংবার বলিতে লাগিলেন, দেখলে বড়বৌ, আমার সবদিকে নজর থাকে কিনা! রমেশ কালকের ছোঁড়া, সে আমার চোখে ধূলো দিয়ে আমার এত কষ্টের বিষয় নষ্ট করে দেবে! এমনি কায়দা বেঁধে দিয়ে এলুম যে, আর সেখানে বাছাধনের চালাকিটি চলবে না।-বলিয়া কি জানি নিজের কোন্ হাসির কথায় নিজেই হোহো শব্দে হাসিয়া ঘরদ্বার পরিপূর্ণ করিয়া ফেলিলেন।

    (সমাপ্ত)

     

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleতরুণের বিদ্রোহ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article বিপিনের সংসার – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }