Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীটফল

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প189 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২১-৩০. সত্যিকার সুখে সংসার

    ২১.

    এখন খেয়াল হয় বন্দনার, সত্যিকার সুখে সংসার করেছেন তিনি সেই তখন, যখন ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল। যখন তাদের মাকে তাদের থেকে অনেক বড় মনে হত, অনেক বুদ্ধিধারী মার কাছেই ছিল তাদের পরম আশ্রয়। …যখন তারা স্বাধীনচিত্ততায় মত্ত হয়ে মাকে তুচ্ছ ভাবতে শেখেনি।

    ওদের সেই শৈশবে বাল্য, ছাত্র জীবন, ধীরে ধীরে একটির পর একটির বড় হয়ে ওঠা, তবু অসম বয়েসের ছয় ভাইবোনের একত্রে কল কল্লোল। কোথায় গেল সেই সুখময় দিন। হঠাৎ হঠাৎ যেন ওদের ছুটির সময়ের অবিরাম ক্যারম পেটার ঠক ঠক শব্দ কানে আসে বন্দনার। কানে আসে একটা গল্পের বই নিয়ে রীতা অমৃতার কাড়াকাড়ি, হাসির হুল্লোড়। …খোকা আর বাপীর মধ্যে খেলার মাঠ আর খেলোয়াড়দের নিয়ে তর্কযুদ্ধ।

    শানু আর টিপু অবশ্য সিঁড়িভাঙা অঙ্কে ওদের থেকে বেশ খানিকটা ছোটই, তবু ওদের কাছে বসে বসে পাকামিতে ওস্তাদ হয়ে উঠে সেই তর্কে নাক গলাতে যেত। আর ওদের দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধটা ঘটত মিনিটে মিনিটে। যত ভাব তত ঝগড়া। থামাতে প্রাণ যেত বন্দনার।

    ভবদেব সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফিরতেন, তাঁকে ঘিরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যেন উল্লাস উৎসব পড়ে যেত।

    বন্দনারও তাতে অংশ থাকত বইকী, কিন্তু সেটা তো মনের মধ্যেই, বসবার সময় তো হত না একতিল। হিমসিম খেয়ে যেতেন। ছটা ছেলেমেয়েকে চালনা করা সোজা নাকি? তার সঙ্গে আবার রুণ বুড়ো শ্বশুর। নিরীহ নির্লিপ্ত ভদ্র, সবই ঠিক, তবু তো দায়িত্ব।

    ভবদেব তো বাড়ি ফিরেই জিজ্ঞেস করতেন, বাবার চা খাওয়া হয়েছে? স্ত্রীকে ক্ষুব্ধ করার পক্ষে এটুকুই তো যথেষ্ট।

    তার মধ্যে আবার ছেলেমেয়েদের মাস্টার আসা। তাঁদেরও কিছুটা আপ্যায়নের দায় থাকত। …তখন তো রাতদিনের লোকও ছিল না।

    অতএব বন্দনা তখন সব সময় ভাবতেন, কী করে এই অসুবিধেজনক দিনগুলোকে ঠেলে পার করব। বুঝতে পারতেন না এই দিনগুলোই সুখের দিন, সোনার দিন। বুঝতে জানতেন না, তাই তখন বন্দনার রাতদিন চিন্তা ছিল, কবে এরা বড় হয়ে উঠবে। কবে মানুষ হবে।

    ধারণা ছিল ওরা এক একখানা মানুষ হয়ে উঠলেই, স্বস্তি আর শান্তি, সুখ আর নিশ্চিন্ত বন্দনার হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেবে। অথচ তখন বন্দনার ইচ্ছেই ছিল শেষ কথা। বন্দনার ব্যবস্থাই ছিল নিরঙ্কুশ।

    এখন বন্দনার মাঝে মাঝে সেই আপন ইচ্ছেয় চালিত হওয়ার দিনগুলোর ছবি মনের সামনে ফুটে ওঠে, আর ভাবেন কী বোকাই ছিলাম তখন, কী অন্যমনস্ক! টের পাইনি সেই দিনগুলোই ছিল সুখের। অবস্থাটা যেন পরশ পাথরের খ্যাপার মতো। নেশার মতো ছুটেছি সত্যিকার জীবন পাবার আশায়।

    ভাবতাম হাতের কাছের এই ঝঞ্ঝাটগুলো মিটিয়ে ফেলতে পারলেই আসবে সেই জীবন। দিন পাবার নিশ্চিত বিশ্বাসে, দিনের পর দিন দিন রাত্রিগুলোকে শুধু ঠেলবার জিনিস ভেবেছি, ভাবিনি উপভোগের। ভাবিনি পাওয়াটাকেই বাজে বলে বাজে খরচ করে চলেছি।

    হঠাৎ এখন দেখছি আর কিছু পাবার নেই, সব শুন্যের অঙ্কে গিয়ে ঠেকেছে।

    এখন আর বন্দনার ইচ্ছেই শেষ কথা নয়। বন্দনার ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে না। বন্দনার ইচ্ছে আর ব্যবস্থার উপর নিরন্তর আসে সমালোচনার ঝাঁপট!

    এখন শুধু সংসারের প্রতিটি সদস্যের ইচ্ছের বোঝয় বোঝাই হওয়া নৌকোখানাকে ঠেলে ঠেলে নদীপার হওয়া (এমনকী দূরপ্রবাসী মেয়েদের চিঠির মাধ্যমেও এসে হাজির হয় নানান ইচ্ছের ঝোলা। তাদের চিঠির মধ্যেও প্রছন্ন থাকে আর এক ধরনের সমালোচনা। বন্দনা যে নিজের বুদ্ধির দোষেই নিজের জীবন পেলেন না, এই তাদের বক্তব্য)।

    তবু হালটা তো হাত থেকে নামান চলবে না। শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে থাকতেই হবে।

    অতএব লোকে জানে বন্দনার মেজছেলে বিজনেস করে ফাঁপছে, বন্দনার ছোট ছেলে পরীক্ষার পড়া পড়ে পড়ে এমন কাহিল বনে বসে আছে যে পরীক্ষাটাই দিয়ে উঠতে পারে কিনা সন্দেহ, বন্দনার ছোট মেয়েটাকে আর বন্দনা সাত সমুদ্র সাতাশ নদী পার করতে দেবেন না বলে, একটা অকৃতী অধম পাত্র ধরে পাত্রস্থ করবেন ঠিক করে রেখেছেন।

    আর বন্দনার বড় ছেলে, এবং তার বউ?

    ছেলের কথা বাদ দাও, চব্বিশ ঘণ্টা অফিসের কাগজপত্র নিয়ে ডুবে থাকে, তাই নরলোকে তাকে দেখতে পায় না, এবং বিদুষী বউ আরও বিদুষী হবার তালে নিত্যদিন লাইব্রেরি ছুটছে, আর সেখানে অগাধ গ্রন্থ সমুদ্রে ডুরে বসে থাকছে।

    বর্তমানে এই মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন সুখী সংসারী সার্থক গৃহিণী বন্দনা সেন।

    .

    ২২.

    বড্ড যেন কেমন নিঝুম নিঝুম। হঠাৎ এমন স্তব্ধতা কেন?

    শানুর ভিতরটা যেন কেমন খাঁ খাঁ হয়ে উঠছে।…পার্থ নামের ছেলেটার আর পাত্তা নেই কেন?

    মামার বিশ্বাসঘাতকতায় মামার উপর রাগ হতে পারে, তাই বলে বিশ্ব সংসারের ওপর রাগ হয়ে যাবে? শানু বেচারি যে হাঁকরে থাকে জ্ঞান নেই?

    ভদ্রা যে এখনও বাপের বাড়ি বসে নেই, সেটা নিশ্চিত। অতএব তার ছুতো দেখান ধাষ্টামো হবে।…চন্দ্রাটাও তেমনি অভদ্র, কেন রে বাবা একবার এমনি পাড়া বেড়াতেও আসতে নেই?

    হঠাৎ শানু মনের মধ্যে একটু বিদ্রোহীর সাহস এনে ফেলল। …কেন, সেই বা কীসের জন্যে পরাধীন হয়ে থাকবে? বাড়ির বউ, যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে বেরিয়ে যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করবার পর্যন্ত সাহস নেই মার, এত কীসের কাজ তোমার, আর যত শাসন শানুর উপর?

    শানু আয়নার সামনে দাঁড়াল।

    মুখটাকে বেশ একটু মাজাঘষা করল, চুলটাকে দারুণ কায়দায় আলগা বাঁধনে বাঁধল, একখানা হালকা নীল রঙের শাড়ি বার করে পরল, বেরিয়ে এসে চটিটা পায়ে দিয়ে খুব অনায়াসে বলল, মা একটু বেরোচ্ছি।

    বন্দনা তাকিয়ে দেখলেন। এই অনায়াস ভঙ্গিটা যে যুদ্ধসাজ, তা বুঝতে দেরি হল না। বন্দনা যুদ্ধে নামলেন না। সংক্ষেপে বললেন, আচ্ছা।

    শানু এই উত্তরটা আশা করেনি। শানু বাদ প্রতিবাদের ভাষাটা ঠিক করে এসেছিল, কাজে লাগল না, তাই একটু থতমত খেল।

    তারপর বলল, বেশি দেরি হবে না।

    মা বলল, ঠিক আছে।

    কে না জানে ঠিক আছে শব্দটার মানেই হচ্ছে ঠিক নেই। তবু শানু আপাতত আর দাঁড়াল না। যা হয় এসে হবে। কে জানে লোকটাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে কিনা।

    পাওয়া গেল, কিন্তু এই অবস্থায় পাওয়া যাবে এমন অদ্ভুত ভাবনাটা কি ভেবেছিল?

    না, এটা শানুর ভাববার সীমানার বাইরে ছিল।

    শানু দূর থেকেই দেখতে পেল পার্থদের গলির মুখে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। আর তারপরই দেখতে পেল পার্থদের চাকর বিষ্টু একহাতে একটা সুটকেস, আর অন্য হাতে একটা ছোট বেডিং নিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে তুলল।

    আরে, ভদ্রা কি তাহলে এখনও পর্যন্ত বাপের বাড়িতে গেঁটিয়ে বসে ছিল?… যাক খুব সময় আসা গেছে। শানু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে এল।…দেখতে পেল গাড়ির মধ্যে পার্থর বাবা বসে। মানুষটিকে শানুর কেমন একটু ভয় ভয় লাগে। অকারণই বলতে হয়, তবু ওই দু দিকে ঝোলা পুরুষ্ট গোঁফ জোড়াটা সমেত গোলগাল ভারী গম্ভীর মুখখানা দেখলেই শানুর সেই যে ছেলেবেলায় বুক কাঁপত, এখনও পর্যন্ত সেটা আর গেল না।

    শানু ভেবে পেল না ইনি আবার কোথায় যাচ্ছেন।..শানু আস্তে পাশ কাটিয়ে চোখে চোখ পড়ার ভয়ে ঘাড় নিচু করে গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। নাঃ সময়টা ঠিক নির্বাচন হয়নি। বাড়ির কর্তা মালমোট নিয়ে রেলগাড়িতে চড়তে যাচ্ছেন, এ সময় কি আর বাড়ির ছেলেটাকে নিভৃতে পাওয়া যাবে? শানুর কপালটাই মন্দ।

    না, ইনি নিজে আবার কোথায় যেতে যাবেন, খুব সম্ভব ভদ্রাকেই পৌঁছতে যাচ্ছেন। জামাই ছুটি-ফুটি পায়নি বোধহয়।

    গোটা কতক বোধহয়কে মনের মধ্যে ভাঁজতে ভাঁজতে শানু পার্থদের বাড়ির দরজায় এসে গেল। দেখল চন্দ্রা হাতে একটা জলের ফ্লাস্ক ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    শানু একটু অবাক হল, চন্দ্রা তাকে দেখে হাসল না কেন? দেখা মাত্রই তো শানুদি বলে উফুল্ল মুখে এগিয়ে আসে। ব্যাপার কী রে বাবা, মেসোমশাই কি কারও অসুখ-বিসুখ বা মরা-টরার খবর শুনে কোথাও যাচ্ছেন?

    তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল শানু, মেসোমশাই কোথায় যাচ্ছেন রে চন্দ্রা?

    চন্দ্রা মুখটা ঝটকা মেরে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, বাবা আবার কোথায় যেতে যাবে?

    শানুর যদিও খুব অপমান হল, ওরও ইচ্ছে হল ওই রকম ঝটকা মেরে উলটোমুখো চলে যেতে। কিন্তু ঘটনাটা তো জানা দরকার। রোগ শোকের ব্যাপার নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে। রাগ চেপে বলল, ট্যাক্সিতে মেসোমশাইকে বসে থাকতে দেখলাম।

    বাবা স্টেশনে তুলে দিতে যাচ্ছে বলে চন্দ্রা এমনভাবে দরজার মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল, যাতে চট করে পাশ কাটিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়া শক্ত। শানু কি ফিরে যাবে?

    না কি আবারও মান খুইয়ে জিজ্ঞেস করবে, কাকে তুলে দিতে যাচ্ছেন রে?… কাকে, ভাবতে গিয়েই শানুর বুকটা হিম হিম লাগল। শানুর মনে হল খুব কঠিন একটা উত্তরই শুনতে হবে শানুকে।

    মনে হতেই শানু সহসা নিজেই কঠিন হয়ে গেল। দৃঢ় গলায় বলল, সর তো!

    শানুর মুখের রেখাতেও কাঠিন্য।

    চন্দ্রা এই হুকুমটা ঠিক লঙ্ঘন করতে পারল না। মুখ বেজার করে একটু পাশ হল। শানু তাকে প্রায় ঠেলে দিয়েই ভিতরে ঢুকে এল।

    শানু দালানে পা ফেলতেই দেখতে পেল একটা বেতের সাজি গোছের মধ্যে কিছু ফল, দু-একটা টিফিন কৌটো, কীসের যেন বোতল, আর তার পাশেই একটা ব্রিফকেস বসানো রয়েছে। তার মানে এরাও গাড়ির মধ্যে উঠবে গিয়ে।

    শানু সামনে কাউকে দেখতে পেল না।

    কাউকে ডাকতেও গলা দিয়ে শব্দ বার হল না শানুর। আস্তে আর একটু এগিয়ে গেল, আর তখনই পার্থদের ভাঁড়ার-কাম-ঠাকুরঘর থেকে পার্থর মার কাঁদো কাঁদো গলা শুনতে পেল, বাড়ির ভাত কে খায় তার ঠিক নেই, আর তুই ওই একটা তুচ্ছ চাকরির জন্যে উড়িষ্যার জঙ্গলে গিয়ে পড়ে থাকতে যাচ্ছিস।

    শানুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা ইলেকট্রিক শক খেলে গেল।

    তা হলে যাচ্ছে আসলে পার্থ!

    আর যাচ্ছে, চাকরি পেয়ে।

    তার মানে চাকরি একটা হয়েছে পার্থবাবুর। হোক সেটা তুচ্ছ এবং উড়িষ্যার জঙ্গলে, শানুকে একবার জানানোর দরকার মনে হল না? ভাগ্যিস হঠাৎ এ সময় এসে পড়েছিল শানু।

    আর একটা বেলা পরে এলে, পার্থর দেখা মিলত না।

    আচ্ছা এরকম করল কেন পার্থ? হয়তো সত্যিই চাকরিটা তুচ্ছ, জেদ করেই নিয়েছে পার্থ। হতে পারে মামার ব্যবহারে ধিক্কারেই যে করে তোক একটা কাজ জোগাড় করে ফেলেছে, তবু

    তবু শানুকে জানাবে না?

    কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে শানুকে না জানিয়ে। শানুর কাছেও তুচ্ছতার লজ্জা!

    এর পর পার্থর গলার স্বর শোনা গেল।

    ওঃ! যাত্রাকালে ঠাকুর ঘরে প্রণাম করতে ঢাকা হয়েছে। তা বেশ। ঠাকুরটাকুর কিছুই তো মানা হল না বাবুর। চাকরিটি হল আর করাতের সব দাঁত প্লেন হয়ে গেল?

    মা যখন কাঁদ কাঁদ হয়ে কথা বলছিল তখন বোধহয় সাহেব হেঁট মুণ্ডে মুণ্ডু কৈছিলেন, তাই উত্তর দিতে দেরি হল। এখন উত্তরটা শুনতে পেল শানু। পার্থ বলল, তুচ্ছ হতভাগাদের জন্যে তুচ্ছ ছাড়া কি আর গভর্নরের চাকরি জুটবে মা?

    মামার উপর রাগ করে তুই, শোধটা আমার উপর নিলি বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল পার্থর মা, পাশে পাশেই পুত্র।

    পার্থর পরনে দামি সুট। পার্থর হাতের মুঠোয় বোধহয় ঠাকুরের নির্মাল্য, পার্থর কপালে দইয়ের ফোটা।

    শানুকে দালানের জানলার ধারে রেলিংটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা-ছেলে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।

    তারপর পার্থর মার গলা থেকে একটি রসকষহীন প্রশ্ন বেরোল, শানু কতক্ষণ?

    এই তো!

    তোমায় কে খবর দিল?

    শানু পার্থর মুখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করল, পেরে উঠল না। পার্থর চোখ দেয়ালের দিকে। শানু অগত্যা পার্থর মার প্রশ্নটারই উত্তর দিল–প্রায় সেই রকমই শুকনো গলায়, খবর দিতে যাবার কার দায় পড়েছে মাসিমা? জানতাম না, এমনিই এসেছি।

    ওঃ! তা বোসো। পার্থ আয়। যাত্রা করে আর বৃথা কথা ভাল নয়।

    বলেই ছেলের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চললেন।

    নাঃ! নির্জন মুহূর্তের প্রশ্ন আর নেই।

    শানু কষ্টে গলার স্বর ঠিক রেখে বলল, বেশ তো পার্থদা! চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছ, একটু জানলামই না। ঠিকানাটা কী?

    পার্থ অবহেলার গলায় বলল, জঙ্গলের আবার ঠিকানা।

    আঃ পার্থ! উনি গাড়িতে বসে

    পার্থর মা বেতের সেই সাজিটাকে উঠিয়ে নিলেন। নিলেন কিন্তু চলে গেলেন না। তার মানে পার্থকে রেখে নড়বেন না।

    আশ্চর্য! তবু শানু ছুটে চলে গেল না! শানু কি টের পাচ্ছে না তার মধ্যে ভয়ানক একটা তোলপাড় চলছে।… শানুর কি ভয় করছে না মান মর্যাদা খুইয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেলতে পারে সে।

    কী জানি শানুর কীসের এত সাহস। তাই মরিয়া হয়ে বলে উঠতে পারল, জঙ্গল হোক যাই হোক ঠিকানা তো একটা থাকবেই পার্থদা!

    পার্থ হঠাৎ কঠিন গলায় বলে উঠল, থাকলেও, তোমার কী কাজে দেবে?

    শানু পার্থর মার অসহিষ্ণু ভঙ্গি দেখেও কষ্টে গলার স্বর ঠিক রেখে বলল, দেবে বইকী। মানেটা তো জানতে হবে আমায়?

    মানে!

    পার্থ হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল, পার্থর মা রাগী গলায় বলে উঠলেন, এ তো আচ্ছা ঝামেলা হল। ট্রেন ফেল করিয়ে দেবে নাকি বাছা? ওর ঠিকানায় তোমার কী দরকার? তুমি কি ওকে চিঠি লিখতে বসবে? নে নে চল পার্থ।… র‍্যালা করতে আসবার আর সময় পেল না।

    এঁর কণ্ঠ থেকেই কি সেই সুধাসিক্ত স্বর ঝংকৃত হত, কী রে শানু, বন্ধু শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় মাসিমাকে ভুলেই গেছিস। আয় বোস।

    জীবনে কি কখনও চোখের জল পড়েনি শানুর?

    পড়েনি আবার? ওই অভিমানী মেয়ে! শত শতবার পড়েছে।…মাকে খরখরিয়ে শুনিয়ে দিতে পারে শানু, কিন্তু বাবার কথার সামান্য উনিশ-বিশে চোখে জল আসে শানুর।

    দিদিরা যখন প্লেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে টা-টা করে আকাশে উড়ে যায়, এয়ারপোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভীষণ একটা অভিমানের যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে জল পড়ে শানুর, কিন্তু এরকম জল কি কোনওদিন পড়েছে শানুর চোখ দিয়ে, যা গালের চামড়াটা পুড়িয়ে দিয়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে?

    .

    ২৩.

    ক্রিং ক্রিং ক্রিং!

    রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে ফোনটা ধরলেন বন্দনা।

    টেলিফোন এবাড়িতে বেশিদিনের ঘটনা নয়! যদিও বছর আষ্টেক দশ আগে ভবদেব আবেদন করে রেখেছিলেন, তবে খোঁজ নিতে গেলে যা নমুনা পাওয়া যেত, তাতে ধরে নেওয়া হচ্ছিল আরও বছর আষ্টেক-দশ অপেক্ষা করতে হওয়াটা আশ্চর্য নয়।

    ভবদেব তো তখন রীতিমত কর্মজীবনে, উচ্চপদে, তবু সুবিধে করে উঠতে পারেননি।

    একদিন হেসে বলেছিলেন ভবদেব, শুনেছি নারকেল গাছ পুঁতে ফল খাবার আশা করা চলে না, এক পুরুষে পোঁতে, পরের জেনারেশানে ফল খায়। …টেলিফোনের ব্যাপারটাও দেখছি তাই। আমার জীবদ্দশায় বোধহয়–

    কিন্তু বাপীর পকেটে যেই মালক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটল, বাপী দেখিয়ে দিল জলের মতো জল ঢালতে পারলে একদিনেই ফল ফলান যায়।

    অতএব ভবদেবের জীবদ্দশাতেই বাড়িতে টেলিফোন বেজে উঠেছে। ..তবে তাঁর আর কতটুকু প্রয়োজন? …সুখ যা হয়েছে বন্দনার বোনেদের। নন্দনা, চন্দনা দিদিকে একবার পাকড়ে ফেলতে পারলে ঘণ্টাখানেকের কমে লাইন ছাড়ে না। …লাইনের মধ্যে অন্য লোক এসে গেলে বাকবিতণ্ডা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, তবু নাছোড়। বিশেষ করে বন্দনা।…

    অবশ্য কিছুটা সুবিধে ভোগ করেছে শানুও।..পার্থ কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি থেকে, শানুর নিজের বাড়ি থেকে মার কান বাঁচিয়ে।

    যাক সে নাটকে তো এখন যবনিকা পড়ল।

    শানুর তাই ছুটে এসে ফোন ধরবার জন্যে মাথাব্যথা নেই। …বারবার বেজে যাচ্ছে দেখে বন্দনাই ছুটে এলেন।

    হ্যালো বলার আগেই নন্দনার গলা শোনা গেল, দিদি, শুনেছিস কাণ্ড!

    নন্দনার বাভঙ্গিই অবশ্য এই রকম। প্রায়শই কাণ্ড দিয়েই কথা শুরু করে সে।

    বন্দনা চমকিত হলেন না, শান্তভাবেই বললেন, কী আবার কাণ্ড হল?

    কিন্তু কাণ্ড কাহিনীটা শুনে চমকিত না হয়ে পারলেন না। বলে উঠলেন, বলিস কী? যাঃ!

    যাঃ মানে? আমি কি আর সঠিক না জেনেই বলছি তোকে? এই তো আসছি চন্দনার বাড়ি থেকে। …কী আশ্চর্য দেখ। আমাদের একবার ঘুণাক্ষরেও জানায়নি।

    বন্দনা বললেন, তাই তো দেখছি। তোকে কে বলল?

    সে এক মজা! সুকুমারের সঙ্গে এ বাড়ির চৌধুরী সাহেবের একটা স্টেশনারি দোকানে দেখা। দেখে কিনা সুকুমার একটা বেবিফুড কিনতে এসেছে, আর জিজ্ঞেসবাদ করছে কোনটা ভাল হবে, কোনটার কী দাম।… পিছন থেকে শুনে চৌধুরী সাহেব তো তাজ্জব, সুকুমারের আবার হঠাৎ বেবিফুডে কী দরকার পড়ল! জিজ্ঞেস করায়, না কি বলতে চাইছিল না, বলছিল সিক্রেট ব্যাপার মেজদা, তারপর বলেই ফেলল। তবে বাক্যদত্ত করে নিল ও, যে ব্যাপারটা ফাঁস করে বসেছে এটা যেন ওর গিন্নির কাছে ফাঁস না হয়।

    বন্দনা বললেন, বাক্যদত্ত করিয়ে নিয়েছিল? তা চৌধুরী সাহেব তো বাক্যটা ভালই রাখল।

    নন্দনা হি হি করে হেসে উঠল। বলল, চৌধুরী তো আর বুদ্ধ নয়, তক্ষুনি বলে নিয়েছে গিন্নির কাছে ফাঁস না করে পারব না ভাই, ওই পারমিশানটা চেয়ে রাখছি।… তারপর আর কী? আমি তো আর বাক্যদত্ত হয়ে যাইনি? তা ছাড়া তোকে বলব না এ তো আর হয় না?

    তা ছোটনের ওখানে যাবার আগেই বললে পারতিস, আমিও যেতাম তোর সঙ্গে

    ভেবেছিলাম রে দিদি। তা চৌধুরীই আবার বলল, দিদি ব্যস্ত সংসারী মানুষ, ওনাকে হুড়িয়ে বার করে নিয়ে যাবে? খোদা জানে সুকুমারটা চালাকি মারল কিনা। ইয়ার আছে তো। হয়তো আর কারও বেগার খাটতে এসেছিল দোকানে। …নিজে আগে দেখে এসো সত্যি কিনা। তা এলাম চক্ষুকর্ণের সন্দেহ ভঞ্জন করে। তুই যাবি তো বল! কবে যেতে পারবি?

    বন্দনা বললেন, দেখি। তুই যে গেলি, কীরকম দেখলি ছোটনকে? রেগে গেল না তো?

    নন্দনা হেসে উঠল, প্রথমটা তো সুকুমার বেচারাকে এই মারে কি সেই মারে। তারপরই অন্য মূর্তি। একেবারে মা যশোদা! চোখে মুখে বাৎসল্য রস উপচে পড়ছে। মেয়ে নিয়ে কী সোহাগ!

    বন্দনা বললেন, মেয়ে?

    সেই তো! আমি তো বলেই ফেললাম, নিলি, নিলি, একটা ছেলে নিতে পারতিস। শুনে লেকচার ঝেড়ে দিল একখানা। মেয়েরাই মেয়েদের বিরোধীপক্ষ, উইমেন্স লিব আর আসবে কোথা থেকে? ছেলেতে মেয়েতে তফাত কী, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    বন্দনা একটু থেমে বললেন, অনাথ আশ্রম থেকে?

    না, না, হসপিটাল থেকে। আগে থেকে নাকি নানান জায়গায় বলে রেখেছিল, এক জায়গা থেকে খবর দিয়েছিল–

    মা মরে গিয়েছিল?

    নন্দনা বলল, তাই হবে হয়তো। অত আর জিজ্ঞেস করিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাকি বলেও না। বলে বাচ্চার পাস্ট হিস্ট্রি জেনে লাভ কী? তার তো আর জাতি ধর্ম বর্ণ কিছুই নেই, ধরে নিন ঈশ্বরের কাছ থেকেই আপনার কাছে এসেছে।

    বন্দনা বললেন, ছোটনটা যে তলে তলে এত আকুল হয়ে ছিল, বোঝা যায়নি।

    .

    ২৪.

    বন্দনা ভবদেবের কাছে এসে বসলেন, শুনেছ কাণ্ড? ছোটনটা নাকি

    ভবদেব একটু হাসলেন, বললেন, জানি।

    বন্দনা ভুরু কোঁচকালেন, কী জানো?

    হসপিটাল থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে এসেছে

    তুমি জানতে?

    ওই আর কি, সুকুমার আসছিল তো তখন মাঝে মাঝে, বলছিল পাগলা বনে গেছে দাদা, নিজেও পাগল হয়ে উঠেছে, আমাকেও তাই করে ছাড়ছে। বলে, মাদার টেরেসার কাছে যাও, কোনও অরফানেজে যাও। হাসপাতালে হাসপাতালে খবর নাও।

    ভবদেব একটু থামলেন, তারপর বললেন, সুকুমারের অনুপস্থিতিতে চন্দনা নিজেও নাকি রিকশা করে কাছাকাছি কোনও হসপিটালে গিয়ে জমাদারনীদের কাছে আর্জি করেছে তাদের ঘরে তো বাচ্চাকাচ্চা বেশি হয়, যদি কেউ একটা বিক্রি করে

    জমাদারনী! জমাদারনীদের কাছে

    বন্দনা বসেই ছিলেন তাই, দাঁড়িয়ে থাকলে বোধ হয় বসেই পড়তেন।

    ভবদেব বন্দনার কাতরতা দেখে হেসে ফেললেন, বললেন, তোমরাই তো বলো শিশু নারায়ণ।

    বলি! তাই বলে জমাদারনীর ঘর থেকে

    ভবদেব বললেন, দুর্ভিক্ষের সময় লোকে বুনো কচুর ডাঁটা তুলেও খায় বন্দনা।

    বন্দনা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন।

    ওই দুর্ভিক্ষের ক্ষুধাটা যে কী, তা তো আর অনুধাবন করবার মতো ক্ষমতা নেই বন্দনার।

    ভাবলেন, অথচ দেখে মনে হত না ছোটনের মধ্যে এত হাহাকার!

    .

    ২৫.

    এ বাড়ির সব থেকে ভাল আর সাজান ঘরটা স্বভাবতই নীরার। অথবা সঠিক বলতে-খোকার। জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠভাগ এটা তো সংসারশাস্ত্রের রীতি।

    এই সজ্জিত ঘরটি আরও সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে বাপীর সম্প্রতিকার অবদানে। বাপী ছোটমেসোকে বুদ্ধিদান করে এই ঘরের পিছনের প্যাসেজটা থেকে খানিকটা কেটে বার করে নিয়ে মিস্টার অ্যান্ড মিসেসের ঘরের সঙ্গে একটা অ্যাটাচ বাথরুম বানিয়ে দিয়েছে। যেটার অভাবে নাকি কনেবউ এসে মাথায় হাত দিয়ে পড়েছিল।….

    সম্প্রতি একটা টিভি সেট কিনে ম্যাডামের ঘরে ফিট করে দিয়ে গেছে বাপী। এবং আমার করে বসে দেখার জন্যে একটা ডানলোপিলোর গদি-সংবলিত সোফা উপহার দিয়েছে।

    দেখে দেখে অবশ্য শানু রাগে জ্বলা গলায় বলেছে, পয়সা থাকলেই যে সব পয়সা বাজে খরচ করে ফেলতে হবে, তার কোনও মানে নেই ছোড়দা।

    ছোড়দা হেসে হেসে বলেছে, আরে, খরচ না করলে কী করে টের পাওয়া যাবে, জিনিসগুলো ঢিল পাটকেল না পয়সা।

    তবে আরকি, এবার মহারানির জন্যে সোনার সিংহাসন বানিয়ে দে!

    বাপী ঘর ফাটিয়ে হেসেছে, উঃ মেয়েদের কী জেলাসি! সতীন কথাটা কিছু না, মেয়ে হলেই হল।

    যা তা বলবি না বলছি ছোড়দা।

    যা তা, মানে? দেখিস না মেজমাসি তার প্রাণের দিদি আমাদের জননীকে কী দারুণ হিংসে করে।

    বলেছে তোকে! মেজমাসির অভাবটা কী?

    ঈর্ষাটা কি আর লোকে অভাবে করে রে? করে স্বভাবে। যাক, কিঞ্চিৎ ওয়েট করো সিস্টার, তোমার বিয়েটা লাগতে দাও, দেখিয়ে দেব খরচ করা কাকে বলে।

    দোহাই তোর ছোড়দা, রক্ষে কর। ভগবান জানে তুই কোন রাস্তা ধরে চলেছিস!

    রাস্তা কী রে? বল কোন গলি!

    বাপীর আবার হাসি, মালক্ষ্মী কি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার মেয়ে রে?…বাহনটির কথা স্মরণ কর? অন্ধকারেই আনাগোনা।

    এত দুঃসাহস ভাল নয় ছোড়দা। দেখিস কোনদিন না কী বিপদে পড়িস।

    পড়লে পড়ব। একদিন তো মরতেই হবে বলে, কি বেঁচে থাকতে খাবি খেতে হবে? সাধ মিটিয়ে নেওয়াই হচ্ছে বেস্ট, বাপীর এই জীবনদর্শনের ফসলে বাপীর দাদার ঘরে এখন অনেক সাজসজ্জা!

    খোকা অর্থাৎ সুদেব সেন, আরামদায়ক সেই আসনটায় বসে সিগারেটটাকে মুখ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে, ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চারদিক তাকিয়ে দেখছিল আর ভাবছিল এত আরাম, এত নিশ্চিন্ত, এত নিরাপত্তা, এইসব ছেড়ে, উটকো একটা জায়গায় চলে যেতে হবে তাকে। হবেই। অমোঘ বিধিলিপির সংকেত পাচ্ছে সুদেব। ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট করে যা পাগল করছে নীরা!

    শুরু করেছিল সেই প্রথম দিনই।

    সেই মোহময় ফুলশয্যার রাত্রে। ভঙ্গিটা আরও মোহময়। ফুলে ভারাক্রান্ত বিছানা, দামি সেন্ট-এর সৌরভে ভারাক্রান্ত বাতাস, আর প্রসাধন-ভারাক্রান্ত রূপসী নববধূ।

    হাতের নাগালের মধ্যে একটি অপরূপা নারীদেহ। বরাবর খোকা নামে পরিচিত লোকটার বোধের জগতে আসছিল না, সে মর্তলোকে আছে, না স্বর্গলোকে। কবিতা-টবিতার তেমন ধার ধারে না, তাই তখন অনুভব করেনি, সেই পরীর মতো মেয়ের মদির দুটি চোখের মধ্যেই তার সর্বনাশ ঘোষিত হয়ে আছে।

    বউ বলেছিল, উঃ। কত যে লোক এ বাড়িতে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, বরাবরের স্বপ্ন ছিল ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে আছি শুধু আমি আর আমার বর।

    খোকা আশ্বাস দিতে যাচ্ছিল, এত লোক তো বিয়েবাড়ি বলে! সবাই তো আর থাকবে না। দেওয়া হল না আশ্বাস, শেষের কথাটার ধাক্কায়। … কিন্তু সর্বনাশের এত আয়োজন তো সবটা ব্যর্থ হতে পারে না? তাই বেকুব বনে যাওয়া খোকা বলে বসেছিল, আমারও তাই

    কিন্তু নববধূ তো ক্রমশ দেখছে সে ইচ্ছের বালাই মাত্র নেই লোকটার মধ্যে। লোকটা যেমন কুনো, তেমনি আয়েসি! আর তেমনি কিপটেও। আলাদা ফ্ল্যাটের নামেই তাই গায়ে জ্বর আসে। জানে তাতে পকেটে খাবলা পড়বে।

    অতএব এখন আর মদির আঁখি তুলে স্বপ্নের ছবির কথা নয়। উঠতে বসতে জ্বলন্ত দৃষ্টির দাহর সঙ্গে প্রজ্বলিত ভাষণ! সে ভাষণের মর্মার্থ হচ্ছে–এই গোরুর গোয়ালের মধ্যে থাকতে পারবে না নীরা, থাকতে পারবে না এত আটক বাঁধনের মধ্যে। পরগাছা হয়ে থাকবার জন্যে সে বিয়ে করেনি। তার নিজস্ব একটা জীবন চাই!

    বুদ্ধু খোকার এমন বুদ্ধি জোগায় না যে মুখের উপর বলে ওঠে, বিয়েটা তুমি করনি। ঘটিয়ে দিয়েছিলেন তোমার বাবা। আর দেখেশুনে গোরুর গোয়ালেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

    নাঃ, এত সাহস নেই সুদেবের।

    কোন ছেলেটারই বা থাকে সে সাহস?

    কটা পুরুষের? যে পুরুষ সদা অসন্তোষময়ী, সদা অভিযোগকারিণী স্ত্রীকে বলে উঠতে পারে, তোমার বাবা যেমন দেখে বিয়ে দিয়েছিল তেমনই থাকতে হবে। বেশি ফ্যাচফ্যাচ করতে এসো না।

    এত দুঃসাহস হবে? পাগল! তারা তাই সদা অপরাধীর মূর্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সদা সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে স্ত্রীর মেজাজ সামলে বেড়ায়, আর যে তোয়াজনীতির প্যাঁচে পড়ে বসে, তা থেকে আর উদ্ধার পাবার উপায় খুঁজে পায় না।

    সুদেবও পাচ্ছে না সে উপায়। জোর গলায় একবার বলে উঠতে পারছে না, মাথা খারাপ! এই আরাম, আয়েস, নিশ্চিন্ততা, নিরাপত্তা, মা-বাপ, ভাই-বোন সব ত্যাগ করে আমি তোমার ফ্ল্যাটের স্বপ্ন সফল করতে অকূলে ভাসতে যাব? নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারব?…

    বলে উঠতে পারছে না বলেই কেবলই মিনমিন করে স্তোক দিয়ে চলেছে, আরে চেষ্টার কি ত্রুটি করছি? খুঁজছি তো! বলে তো রেখেছি কতজনকে। একটা ফ্ল্যাট পাওয়া যে আজকাল কী দুরূহ!

    আর মনে মনে বলে, সুখ সইছে না। দুবেলা বাড়া ভাত পাচ্ছ, চারবেলা চা-টিফিন পাচ্ছ, আঙুলটি নাড়তে হচ্ছে না, তার উপর যখন ইচ্ছে চটি পায়ে দিয়ে আঁচল উড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছ, কোনও দায়িত্বের ধার ধারছ না। কোনওদিন একবার চা বানালে তো লোকে কৃতার্থ হয়ে গেল। …আলাদা ফ্ল্যাটে গেলে চলবে এসব?… কত ধানে কত চাল বুঝবে তখন।

    বলতে কি ভারী দুঃখই হয় সুদেবের, দুঃখে অভিমানে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এই হতভাগা শালা বাপের হোটেলে থেকে মিনিমাম কিছু হোটেল চার্জ দিয়ে, দুটো পয়সা জমাচ্ছিল, প্রাণে সইছে না। ধার করে ফ্ল্যাট কিনতে হবে, তোমার নবাবির দায় মিটিয়ে মিটিয়ে সংসার করতে হবে, ফতুর হতে কদিন বাকি থাকবে?

    তার মানে বন্দনার ছেলেও মনে মনে কথার চাষ করে। মনের অবস্থা এই, কে যেন তাকে ঠেলতে ঠেলতে নদীর একেবারে কিনারায় এনে ফেলেছে, অপেক্ষায় আছে শেষ ধাক্কাটা মারবার। …তবে

    একটুই শুধু আশা–

    .

    সিগারেটটা হাতেই জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে গেছে। আর একটা ধরাল। আর ঠিক তক্ষুনি দরজার ভারী পরদাটা সবেগে ঠেলে সরিয়ে ঘরে ঢুকে এসে নীরা নিজেকে খাটের উপর নিক্ষেপ করে বলে উঠল, তোমরা ভেবেছ কী বলতে পারো? আমি একটা নজরবন্দি আসামি? সব সময় আমার পিছনে স্পাই লাগিয়ে রাখা হচ্ছে কেন? কীসের জন্যে?

    সন্ত্রস্ত সুদেব তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, কী হল হঠাৎ?

    হঠাৎ আবার কী? সব সময়ই আমার গতিবিধির উপর চর বসিয়ে রাখা হয়। এই যে তোমার উঁচুমনভাই বাপী সেন, তিনিও তো কম যান না দেখলাম। আমি কবে কখন কোন পাড়ায় একটা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেছি তার পর্যন্ত রেকর্ড রাখা হয়ে গেছে। অসহ্য! আর কী মীন মাইনডেড! আমি বড় ভাজ, আমাকে একটু বাইকে চড়িয়ে নিলে নাকি পারিবারিক পবিত্রতা খতম।… কাওয়ার্ড একটা। চমৎকার একখানা বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিল বটে বাবা!

    সুদেব অভিযোগের সবটা না বুঝলেও, অতি তাড়াতাড়ি চোরের ভূমিকায় নেমে পড়তে দ্বিধা করল না। মুখটা ঝুলিয়ে ফেলে বলল, সেই চিরকেলে গতানুগতিক মনোবৃত্তি আর কি! বাড়ির বউ।

    থাক থাক! একঘেয়ে কথা ঢের শুনলাম। তুমি একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করবে কিনা?

    সুদেব মাথা চুলকে বলল, চেষ্টা তো করছিলাম, তবে ভাবছি ঠিক এরকম একটা অসুবিধেকর অবস্থার মুখে বোধ হয়

    কী, কী বললে?

    ঠিকরে উঠল নীরা। লাল টকটকে মুখে চাপা রাগের গলায় বলল, কী ভেবে বসে আছ শুনি? অবস্থাটাকে পোষণ করেই চলব? ওই আনন্দেই আছ বুঝি?

    নীরা রাগে হাঁপাতে থাকে।

    সুদেব থতমত খেল।

    সুদেবের আশালতাটি ছিঁড়ে পড়ল।

    চুপচাপ একটুক্ষণ সিগারেট খেয়ে উঠে এসে আস্তে নীরার পিঠে একটু হাত ঠেকিয়ে বলল, নীরা!

    নীরা হাতটাকে গায়ে আরশোলা বসার মতো ঝেড়ে ফেলে ভুরু কুঁচকে তাকাল।

    সুদেব জয় মা কালী বলে ঝুলে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল, বলছিলাম কি, বড় অনেকগুলো দিন তো এগিয়েই গেল, বোধ হয় দেরিই হয়ে গেল, এখন ইয়ে একটু বেশি রিস্ক নেওয়া হবে না?

    নীরা উঠে দাঁড়াল।

    সুন্দর মুখটাকে বিদ্রুপে অসুন্দর করে বলল, দেরি হয়ে গেল, সেটা বোধ হয় আমারই দোষে?

    সুদেব চোরের অধম হয়ে ঘাড় চুলকে বলল, তাই কি বলছি? আসলে কিছু জানাটানা তো ছিল না, তোমার পরেশদাও রাজি হচ্ছিল না–এখন, মানে ইয়ে তোমার শরীরের কথা ভেবেই বলছি।

    থাক! যথেষ্ট হয়েছে। দরদ উথলে উঠছে।

    নীরা আবার খাটের উপর বসে পড়ে সাপিনীর মতো গজরাতে গজরাতে বলল, একটা অ্যাকসিডেন্টের জের টানতে আমি জীবনটাকে জন্মের শোধ বরবাদ দেব?

    আহা, অতটা ইয়ে ভাবছ কেন? একটু বড়টড় হয়ে গেলেই তো

    দয়া করে থামবে তুমি? ওঃ! অসহ্য! মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে।

    এরপর আর কিছু করার নেই।

    সুদেব ভাবল, আচ্ছা, পুরুষমানুষদের মাথাগুলো কখনও ছিঁড়ে পড়ে না কেন? কী দিয়ে গাঁথা থাকে ঘাড়ের সঙ্গে? টাইট স্ক্রু দিয়ে? আর মেয়েদের?

    .

    ২৬.

    ঠিকানা জোগাড় হয়নি, তবু শানু ঘাড় গুঁজে বসে চিঠি লিখে চলেছে। লিখে চলেছেই বলা চলে, কারণ দিন তিনেক ধরে চিঠিটা লিখছে শানু। একশো বার লিখে একশো বার ছিঁড়ে অবশেষে শেষ করল আজ।

    লিখল, সেদিন তোমাদের ওই অদ্ভুত ব্যবহারটার মানে জানতে চেয়েছিলাম পার্থদা, জানবার সুযোগ দাওনি। না দাও–অনেক ভেবে ভেবে, মনে হচ্ছে মানেটা বোধ হয় বুঝতে পেরে গেছি। যদিও খুব বিশ্বাসে আসছেনা। …কিন্তু আর কোথাও তো কোনও মানের ছিটেফোঁটা পাইনি। তবে বেদম অবাক হয়ে গেছি পার্থদা। চিরদিন আমার চোখে তুমি ছিলে বুদ্ধির আকর! কী দারুণ দারুণ চমক লাগান সব কথাই বলে এসেছ! মনে জানতাম আর সকলের মাপকাঠিতে তোমায় মাপা যায় না। তুমি রাজপুত্তুর হয়েও, নিজেকে গরিব বেকারদের একজন ভাবতে, তুমি অসাধারণ ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতার অনেক উপরে। তুমি খুব একটা কিছু! এই বুন্ধুমির জন্যে নিজের ওপর ভারী করুণা হচ্ছে এখন।

    তবে করুণা তোমার জন্যেও পার্থদা! বেচারি! এত বুদ্ধিধর হয়েও পরের মুখে ঝাল খেয়েই ঝালের জ্বালায় ছটফটিয়ে দেশান্তরি হয়ে গেলে। নিজের ধৈর্যটুকুও হল না। আসলে ভিতরে ফাঁকা থাকলেই এত সহজে এমন ঘটে।

    অথচ কী নিশ্চিন্দিই ছিলাম।

    বোকার যা দশা!

    তোমার মনে আছে পার্থদা, অমি তখনও ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াই, স্কুল ছেড়েছি, স্কুলের ফ্রকগুলো ছাড়িনি। হঠাৎ একদিন তুমি বলে বসলে, এই, কাল থেকে তুই আর ফ্রক পরবি না। শাড়ি পরবি।

    অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, বলেছিলাম, কেন?

    তুমি আমার খোলা চুলের একটা গোছায় একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বললে, আমার ইচ্ছে। …সেই একটা মুহূর্তে বয়েসটা আচমকা অনেকটা বেড়ে গেল। সেই একটা কথাতেই স্থিরনিশ্চয় হয়ে গেলাম, অতঃপর তোমার ইচ্ছেতেই পরিচালিত হতে হবে আমায়। তোমার ইচ্ছে বাকি জীবনটা আমার পরম আর চরম।

    তা হলে ভাবো, ওই নীরেট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে করুণা হবে না? সেদিন তো হঠাৎ অবাক হয়ে যাওয়া ওই মেয়েটা অসহ্য অপমানের জ্বালায় আরও দারুণ একখানা গবেটমি করে বসতে যাচ্ছিল, নেহাত পাকেচক্রে করে উঠতে পারল না। বিশ্বাস করো নেহাতই হাতের কাছে একগাছা শক্তপোক্ত দড়ি আর ঘরের সিলিঙে উপযুক্ত একটা আংটার অভাবেই হয়ে উঠল না। …তারপর? বোধবুদ্ধি আসার পর মেয়েটার সে কী হাঁফছেড়ে বাঁচা! তখন তার মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করল, বাবার পায়ে পড়ে কাঁদতে বসতে ইচ্ছে করল, ভাইদের দেখে আহ্লাদ হতে লাগল, এমনকী মহারানিটিকে পর্যন্ত ডেকে বলে ফেলল, ইস বউদি রে, তোর সব শাড়িগুলোই কি সমান সুন্দর?

    বাব্বাঃ! এই এতগুলো ভালবাসার লোককে প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসছিলাম!

    পরদিন সকালে উঠে দেখে যেন অবাকই হয়ে গেলাম, পৃথিবীর যেখানে যা ছিল সব ঠিক আছে, আর তার মধ্যিখানে আমিও আছি। কী রোমাঞ্চকর সেই সুখ! …যাক, এসব কথা, তোমায় লেখার কোনও মানে নেই। শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি, অভাবও অনেক সময় হিতকারী হয় পার্থদা। ধরো না কেন তোমার ধৈর্যের অভাবটাই তো আমাকে ভবিষ্যতের দুর্দশা থেকে বাঁচাল।…অনেকদিন আগে একবার এক মিনিটে অনেকটা বয়েস বেড়ে গিয়েছিল, আবারও সেদিন তাই হল।

    অতএব আপাতত শানু নামের মেয়েটা একটা বুড়ি, যার চোখে আর রঙিন চশমার বালাই-ফালাই নেই।

    যদি ভবতোষ সেনের ছোটমেয়েকে দেখ সংসার ফংসারের গাড্ডায় না পড়ে, গোসাবা কি বাসন্তীতে গিয়ে চারটি কুচোকাঁচাঁদের চরাচ্ছে, কিংবা একটা বয়স্কা নারীশিক্ষা কেন্দ্রে বসে চারটি বুড়ি চরাচ্ছে, তা হলে যেন ভেবে বোসো না, আহা! মেয়েটা হতাশ প্রেমে জীবনটাকে বরবাদ করে দিল।

    মোটেই সেটা নয়! আসল কথা ওই সংসারের গাড়ায় পড়তে না চাওয়া! ভাবতে ভীষণ ভাল লাগছে পার্থদা, পৃথিবী রইল, আমি রইলাম, আর আমার ইচ্ছেটা রইল বন্ধন-ফন্দনের বালাই ঘুচিয়ে। এরপর আর আমাকে অন্য কারও ইচ্ছেয় পরিচালিত হতে হবে না। …সুখ না?

    ও হ্যাঁ। ভাবতে বোসো না যেন তুমি উড়িষ্যার জঙ্গলটা বেছে নিয়েছ বলে শানু সুন্দরবনটা বেছে নিল। তা না হলে গড়িয়াহাট বালিগঞ্জ নয় কেন? গোসাবা বাসন্তী কেন?

    পাছে ভেবে বসো, তাই ভুলটা ভেঙে রাখছি–একটা টেনেটুনে বি এ পাশ মেয়ের আর কোথায় চাকরি জুটবে শুনি?

    জঙ্গুলে হাওয়ায় আশা করি শরীরের স্বাস্থ্যটা অন্তত ফিরছে! ঠাঁই করে একটা নমস্কারই করে ফেললাম।
    ইতি—

    ইতি’র নীচে আর কিছু লিখবে কি না লিখবে সেটা ভাবতেই ঘণ্টা কাটল। তারপর কিছু না লিখেই মুড়ে ভাঁজ করে খামে ভরে ফেলল।

    .

    ২৭.

    টিপু আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেন বেরিয়ে যায়। এটা দেখে স্বস্তি আসবে না অস্বস্তি আসবে সেটাই সমস্যা বাড়ির লোকের।

    আস্তে আস্তে কি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতে চাইছে? তা হলে তো তার থেকে ভাল আর কিছু নেই। কিন্তু যাচ্ছেটা কোথায়? সেটাই ভাবনা। কে গোয়েন্দাগিরি করতে যাবে? কার কত সময়?

    খোকা?

    এত আদিখ্যেতা তার নেই।

    বাপী? তার গতিবিধির হদিস না জানার জন্যেই তো সংসার সব সময় আতঙ্কিত। তাকে কে কখন পাচ্ছে?

    ভবদেব? তিনি নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ওদের কোথায় কী আড্ডা, আমি কী করে যাব?

    শামু বলেছিল, যখন বেরোয় আমি ফলো করে দেখতে পারি। অনুমতি দাও তো যাই।

    বন্দনা বলেছেন, তুই আর জ্বালাসনে শানু!

    অতএব এখন মাঝে মাঝেই শানুর সেই সিঁড়ির পাশের সরু ঘরটায় যেটা আগে কেবলমাত্র ছেলেদের পড়ার ঘর ছিল এবং শেষ অধিকারী টুপু অতঃপর শোয়ার ঘরে পরিণত করে নিয়েছিল সেখানে উঁকি মেরে মেরে দেখে যাওয়া একটা কাজ হয়েছে।

    বাড়ি আছে? থাক! কী আর করা?

    বাড়ি নেই! তাই তো যতক্ষণ না ফেরে কাঁটা হয়ে বসে থাকো। বন্দনার স্থির সিদ্ধান্ত মাথাটাই গোলমেলে হয়ে গেছে ছেলেটার। …বন্দনা ভাবতে বসেন, শ্বশুরের কোন একজন মামা নাকি পাগল ছিলেন। শ্বশুরও তো স্বদেশি স্বদেশি করে যা করেছেন, সেও এক রকম পাগলামি। আর এই যে জ্ঞাতি দেওর বিশ্বদেব? সেও যা রগচটা, মাথা গরম মাকারই কাছাকাছি।

    তবে?

    শানু অবশ্য এসবে বিশ্বাসী নয়, শানু স্থির নিশ্চিত, টিপু খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়েছে।

    কী যে মুশকিল! যে কোনও ব্যাপারে টিপুই তো শানুর ডান হাত হয়ে উঠছিল। এখন কে যে কী করে।

    .

    চিঠিখানা নিয়ে টিপুর ঘরে উঁকি মারল শানু।

    ঘরে নেই।

    আলনার মাথা থেকে মেঝে পর্যন্ত ছাড়া পায়জামাখানা ঝুলছে, আলনার পায়ের কাছে ছাড়া গেঞ্জিটা। শানু চট করে চটিটা পায়ে গলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। আর কী ভাগ্য, দেখতে পেল টিপু যাচ্ছে।

    তার মানে এইমাত্রই বেরিয়েছে।

    শানু হনহন করে এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেলল ওকে। প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, কোথায় যাচ্ছিস রে?

    টিপু ঘাড় ফিরিয়ে শানুকে দেখে খিঁচিয়ে উঠল, পেছু ডাকলি যে?

    পেছু? তোরা আবার এসব মানিস নাকি?

    টিপু কথা বলল না, আবার এগোতে লাগল।

    শানুও পা চালাল, এই দাঁড়া না বাবা! একটা কাজ করে দে না রে!

    শানুর গলার স্বরে মিনতির ধ্বনি দেখেই বোধ হয় টিপু একটু দাঁড়াল, কী বলছিস? তা অবশ্য বলল না।

    শানু বলল, এই, শোন না ভাই। আমার একটা ঠিকানা জানার খুব দরকার, জোগাড় করে এনে দিবি?

    মানে?

    মানে হচ্ছে, পার্থদাটা না কী একটা চাকরি নিয়ে উড়িষ্যা জঙ্গলে কোথায় যেন চলে গেছে–ঠিকানা দিয়ে যায়নি–

    টিপুর মুখটা আজকাল যেন কেমন চোয়াড়ে হয়ে গেছে। টিপু সেই চোয়াড়ি মুখে একটু ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলল, ও। তোর সেই লাভার পার্থদা?

    কী বললি?

    শানুর কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল।

    রাস্তায় না হলে হয়তো ঠাশ করে একটা চড়ই কষিয়ে দিত। এখন কষ্টে রাগ চেপে বলল, বাঃ! দিন দিন খুব সভ্য হচ্ছিস তো!

    সভ্য সবাই হচ্ছে। তুই বা কত সভ্য? পার্থদা! পার্থদা তো মুখে ইয়ে করে দিয়ে চলে গেছে। আর তুই তাকে চিঠি লিখে ঠিকানা খুঁজে মরছিস!

    শানু হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।

    বলল, আর কী জানিস তুই?

    জানি অনেক কিছুই। দামি দামি সব সম্বন্ধ আসছে, তার জন্যে কর্তাগিন্নি ট্যাক্সি চেপে কনে দেখে বেড়াচ্ছেন, কী ডাঁট!

    টিপুর মুখটা খুব পাকাটে দেখাচ্ছে, কথাগুলো তো আরও। তবু শানুর টিপুর মুখটা দেখে আগের মতো ভালবাসা ভাবটা উথলে উঠল। কতকাল যেন টিপু, হু, হ্যাঁ, না, আঃ, যাঃ যাঃ ছাড়া কথা বলেনি, আত্মজনের সমালোচনা-টমালোচনাগুলো তো শানুর টিপুর সঙ্গেই বেশি ছিল। নতুন খুড়িকে যখন তখন এবাড়িতে আসতে দেখলে টিপুই তো হেসে হেসে বলত, বড়দির সঙ্গে দুটো কথা কয়ে আসি, বড়দির কাছে দুদণ্ড বসে আসি–এসবের মানে কী বল তো ছোড়দি? আর কিছু না স্রেফ ওই চাটি!… কিপটে নতুন কাকার সংসারে তো দুবার চা খাওয়া চলবে না। খাবে তো গুড়ের চা, তাও।

    ধেৎ। কে তোকে এসব সিক্রেট ফাঁস করে?

    করে। করে। পেনো করে। পেনো চায়ের দোকানে গিয়ে ধারে চা খায়, এর ওর কাছে পয়সা নিয়ে শোধ দেয়, আর বলে, আমার বাবাটি একটি চীজ বুঝলি?

    শানু বলত, তোর কাছ থেকে পয়সা নিয়েও ধার শোধ করে বোধ হয়?

    হরদম। তা নইলে তোর কাছে হাত পাততে আসি কেন?

    এই রকমই গলা-খোলা গল্প ছিল পিঠোপিঠি দুই ভাইবোনের।… সেই টিপুই ইদানীং ভীতিকর হয়ে উঠেছে।

    আজ তাই টিপুর এই স্বাভাবিক ধরনের কথায় শানু ঝাঁ ঝাঁ করা মাথাটাকেও শান্ত স্তরে নামিয়ে এনে বলল, সারাদিন তো ঘরকুনো হয়ে বসে থাকিস, এত সব খবর রাখিস কী করে?

    টিপুও কি অনেকদিন পরে এরকম ঘরোয়া কথা কয়ে একটু আরাম পেয়ে গেল? তাই বলে উঠল, আছে সাপ্লায়ার! আরও কত খবর চাস? ওই যে লক্কাপায়রা চন্দ্রাটি? দেখে মনে হয় কতই বালিকা, দু ডানায় দুটোকে লটকে উড়ছে বুঝলি?…তাদের থেকেই খবর ছড়ায়।

    চন্দ্রা! ওঃ। তাই মেয়েটা অত পাজি হয়ে গেছে। ভাবল শানু। শানুর মুখে আসছিল, কে সে দুটো?…কিন্তু ছোটভাইয়ের সঙ্গে এ আলোচনা চালাতে শালীনতায় বাধল তার। তাই ঝাপটা মেরে উলটো কথাই বলল, খবর ছড়ায়, না গুল ছড়ায়! মাসিমা মেসোমশাই কী রকম কড়া তা জানিস?

    শানুর অবশ্য তাই মনে হত। কী কড়া, উঃ।

    ও বাড়ি গিয়ে শানুকে বেশি সময়টাই তো ভদ্রা আর মাসিমার সঙ্গে গল্প করে কাটাতে হত। একবারটি বই-টইয়ের ছুতো করে পার্থর ঘরে ঢুকলেই তক্ষুনি পার্থর মার হঠাৎ সে ঘরে কিছু না কিছু কাজ পড়ে যেত।…পার্থর সঙ্গে যা কিছু গল্প তা তার শুধু রাস্তায়, দোকানে, বাসে, এখানে সেখানে।

    এখন তাই বলল, কী কড়া তা জানিস?

    টিপু কাঁধটা নাচাল।

    কড়া! হু! চন্দ্রা তোর মতো হাবা মেয়ে কিনা! ধুরন্ধর নাম্বার ওয়ান।

    শানুর হাতের মধ্যে যে চিঠিটা লুকোনো রয়েছে, তার মধ্যে তো শানু পার্থ নামের লোকটাকে প্রায় হেয় করেই খারিজ করে দিয়েছে, তবু তার জন্যে কনে দেখে বেড়ানো হচ্ছে শুনে শানুর মধ্যে সেই যে একটা প্রথম আলোড়ন উঠল, সেটা যেন শানুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিচ্ছে না। শানুর ইচ্ছে হচ্ছে কোথাও একটু বসে পড়ি, তবু পার্থর ছোটবোনটার সম্পর্কে এই অদ্ভুত খবরটা শানুকে দাঁড় করিয়ে রাখছে।

    টিপুর দিকে গভীর একটা দৃষ্টি ফেলল শানু, বলল, তুই যাস ও বাড়ি?

    টিপু অবজ্ঞায় মুখটা বাঁকাল, টিপু ওসব ছোটলোকি কারবারে থাকে না। তবে কপালে মৃত্যু আছে ওর, বলে দিলাম। সিওর। পেয়ারের লোকগুলি যা জুটেছে এক একখানি

    শানু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, কাদের ভাষায় কথা বলতে শিখেছিস আজকাল?

    যা যা! আর গোঁসাইগিরি করতে আসতে হবে না। পৃথিবীটা ভবদেব সেনের ছাঁচে চলে না বুঝলি? মহাত্মা পার্থর ঠিকানাটা চাস তো এনে দিতে পারি।

    লাগবে না।

    বলেই শানু উলটো মুখো হয়ে হাঁটতে শুরু করল!

    দীর্ঘ কয়েকদিনের চিন্তা আর তিনদিনব্যাপী শ্রমের ফসল চারপাতা জোড়া চিঠিটা কুচি কুচি তস্য কুচি হয়ে রাস্তার ধারের কাঁচা-নর্দমাটার ঘোলা জলের মধ্যে ভাসতে থাকল।

    .

    ২৮.

    গোসাবা?

    ভবদেব অবাক হয়ে বললেন, গোসাবার একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতে যাবি তুই?

    শানু তার সেই চিঠিতে খাড়া করা যুক্তিটাই ধরে রেখে একটু হেসে বলল, তা আপনার এই গড়িয়ে গড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট মেয়ের কি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে চাকরি জুটবে বাবা?

    ভবদেবের মনে হল, শানুর হাসির স্বাচ্ছন্দ্যটা যেন হারিয়ে গেছে। ভবদেবের হৃদয়ে আবেগের বহিঃপ্রকাশ নেই, কিন্তু মনে মনে তিনি তাঁর দুই ঝলমলে ঝকঝকে মেয়ের থেকে এই প্রায় ভোঁতা শ্যামলা মেয়েটিকেই যেন একটু বেশি ভালবাসেন। বন্দনা যখন বলেছেন, মেয়ের কথায় এত ধার তো লেখাপড়ায় ধার নেই কেন? ভোঁতা। ভবদেব হেসে বলেছেন, একটু না হয় ভোঁতাই হল। বেশি ধারালো ছুরিতে হাত কাটার ভয়।

    অথচ এখন সেই ভোঁতা ছুরিই হাত কাটতে বসেছে।

    মেয়ের প্রশ্নে ভবদেব বললেন, কিন্তু চাকরি জোটাটাই কি খুব জরুরি ছিল শানু?

    বাবার এই শান্ত গভীর প্রশ্নে শানু ঈষৎ অপ্রতিভ হল। তবু শানু জোর করে সপ্রতিভ হয়ে বলল, এ মা, এ কথা কে বলেছে? কিছুই না! এমনি। নিষ্কর্মা হয়ে বাড়ি বসে আছি, বিজ্ঞাপনটা দেখে হঠাৎ একটা দরখাস্ত দিয়ে ফেলেছিলাম। কে জানত যে দরখাস্ত দিলেই চাকরি হয়ে যায়!

    ভবদেব বললেন, জায়গা বিশেষে হয়। যেখানে কেউ যেতে চায় না–বিশেষ করে কোনও মেয়ে!

    শানু বলল, অ্যাডভারটাইজমেন্টে তো লিখেছে আবাসিক বিদ্যালয়ের কম্পাউন্ডের মধ্যেই ফ্রি কোয়ার্টার্স!

    ভবদেব একটু গম্ভীরভাবে বললেন, খুব সম্ভব দরমার দেয়াল আর উলুখড়ের চাল।

    শানু হেসে ফেলে বলল, তা হলে তো আরওই মজা বাবা! বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে।

    কিন্তু তোমার এই মহামায়া বালিকা বিদ্যালয়ের নিয়োগপত্রে লেখা রয়েছে অন্তত তিন বছরকাল কাজ করতে হবে, তার মধ্যে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া চলবে না। দেখেছ?

    মা হলে অবশ্যই শানুর উত্তর দেবার ভঙ্গিটা আলাদা হত, বাবার সামনে শানুর কুণ্ঠিত ভঙ্গি। বলল, দেখেছি; তিনটে বছর আর এমন কী বাবা?

    নেহাত ছেলেমানুষ আছিস বলেই এ কথাটা বললি শানু! আমার জীবনে হয়তো এখন তিনটে বছর খুব বেশি নয়, কিন্তু তোর জীবনে তিন-তিনটে বছর অনেকখানি।…দেখে আন্দাজ করতে পারলি না লোকে গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারে না, কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসে, তাই এ রকম একটা চুক্তি। অ্যাপ্লাই করার আগে আমাদের একবার জানাবি তো?

    শানু মাথা হেঁট করে বলল, বুঝতে পারিনি বাবা, লজ্জা হচ্ছিল, ভেবেছিলাম আপনারা হয়তো হাসবেন।

    ভবদেব গম্ভীর কৌতুকের গলায় বললেন, পরে কাঁদার থেকে আগে হাসাটা ভাল নয় কী? আমরা হাসব, তাই বলবি না, এই চিন্তাটাই একটা অ্যাবসার্ড ব্যাপার হয়েছে। এখন যদি আমি তোকে যেতে না দিই?

    শানু চমকে উঠল। তবু সামলে নিয়ে বলল, না দিলে আর কী করে যাওয়া যায় বাবা? তা হলে বলছেন যাব না?

    ভবদেব বললেন, থাক এক্ষুনি কিছু বলছি না, মনটাকে ঠিক করতে দুদিন সময় নিতে হবে। মুশকিল হচ্ছে ওরা যে একেবারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে বসে আছে।…তার মানে সুযোগটা লুফে নিয়েছে। আচ্ছা তুই যা এখন।

    বন্দনাই বলেছিলেন, আমি বারণ করতে গেলে তর্কাতর্কি হয়ে যাবে, তুমিই একবার ডেকে নিয়ে বোঝাও।

    কিন্তু ভার দিয়েও স্বস্তি পেলে তো? না, ওই মানুষটির জোর সম্পর্কে বন্দনা সেনের কোনও আস্থা নেই। বলে পর্যন্তই ভাবছেন, নরমপন্থী মানুষটি খুঁটিটাকে আয়ত্তে আনার বদলে না কাঁচিয়েই বসেন। বন্দনা তাই পিতা-পুত্রীর এই আলোচনা সভার ধারেকাছেই কান পেতে ঘুরছিলেন।

    যদিও মেয়ের এই হঠাৎ একটা অনাসৃষ্টি কাণ্ড করে বসবার মূল কারণ অবোধগম্য নয়। বন্দনা মেয়ের বর্তমান মানসিক অবস্থা তো বুঝছেন।

    শানু এযাবৎকাল যতই ভেবে আসুক মা অতশত বোঝে না, মা জানে ভদ্রার সঙ্গেই শানুর গলায় গলায় ভাব, তাই ওদের বাড়ি যাবার টান মেয়ের। কিন্তু শানুর সেই ধারণাটা তো আর সত্যি ছিল না। শানু ধরতেও পারেনি, বন্দনা তাঁর সেই বুঝে ফেলাটাকে উদঘাটন করতে চাননি, অবুঝ সেজে বসে আছেন।

    ইদানীং বন্দনা যে মেয়েকে বেরোনোর ব্যাপারে কিছুটা টিকটিক করতেন, তার প্রধান কারণ হচ্ছে–সেই চিরন্তন বাঙালি গৃহিণীদের ঝিকে মেরে বউকে শিক্ষা দেবার পদ্ধতি। …শানুও যদি যখন তখন বেরোয়, বউয়ের তো আরওই পরোয়া ঘুচবে। …তা ছাড়া পার্থনামের ছেলেটা যে এখনও বেকার ঘুরছে, সে খবর তো জানা। যতই শাঁসালো বাপের একমাত্র পুত্র হোক, ছেলে কিছু করে না এটা তো আর মেয়ের বিয়ে দিতে বসে লোককে বলা যায় না। আর এ ক্ষেত্রে ছেলের বাপের কাছে গিয়ে প্রস্তাবও করা যায় না।

    অতএব মেয়েকে কিছুটা রাশ টেনে রাখা ভাল।

    বন্দনার বড় মেজ দুই মেয়ের থেকে অনেক নীরেস ছোটমেয়েটার যে ওদের মতো উচ্চমানের পাত্র জুটবে না, তা তো জানা কথা, তাই বন্দনা এক হিসেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন। সত্যি তো আর ছেলেটা চিরকাল বেকার থাকবে না। তবু যাক একটা মেয়েও কাছাকাছি থাকবে।

    কিন্তু হঠাৎ যেন বন্দনার সাজানো ছকটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। হঠাৎই কানে এল, শরৎবাবুর ছেলে চাকরি পেয়ে কলকাতার বাইরে কোথাও যেন চলে গেছে, আর শরৎবাবুরা কর্তা-গিন্নি ছেলের জন্যে বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছেন। এদিকে শানুর সদা অস্থির উদ্ভ্রান্ত একটা ভাব। তারপরই আকস্মিক এই বার্তা।

    মা, একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি জুটে গেল।

    চাকরি! হঠাৎ চাকরির কথা উঠছে মানে?

    মানে আবার কী? সব মেয়েই তো আজকাল চাকরি-টাকরি করে।

    তা তোকে আবার হঠাৎ কে ডেকে চাকরি দিতে এল?

    দিল! তুমি সেই যে কী যেন একটা বল, রাজার জন্যে রানি, আর কানার জন্যে কানি! এও ধর তাই। আমার জন্যে গোসাবা মহামায়া বালিকা বিদ্যালয়।

    গোসাবা!

    বন্দনাও চমকে উঠেছিলেন। অথবা আঁতকে উঠেছিলেন। তারপর সেই চিরকালের অনাস্থাভাজন মানুষটার কাছে গিয়ে পড়েছিলেন, তুমি বোঝাও ওটাকে।

    হলে কী হবে, স্বস্তি তো নেই।

    আর যা ভেবেছিলেন, তাই! প্রায় পেকে আসা ঘুটিটা কাঁচিয়ে বসল লোকটা। মেয়ে তো স্পষ্টই বলল, যেতে না দিলে আর যাব কী করে? তখনই তো খ করে কথাটাকে বাগিয়ে ধরে বলে উঠতে হয়, তা হলে বাপু দিচ্ছি না যেতে! এখন তোমার বিয়ের কথা ভাবছি। তা নয় কিনা গড়িয়ে দিয়ে বলা হল, আচ্ছা ভাবতে সময় নিই। নাঃ! আর কি সুবিধে করা যাবে? মেয়ে ততক্ষণে একশোটা যুক্তি খাড়া করে ফেলবে।

    শানু ঘর থেকে চলে যেতে বন্দনা এসে ঢুকলেন। বললেন, বারণটা করলে না যে?

    ভবদেব বললেন, ভাবতে সময় নিলাম।

    খুব বুদ্ধির কাজ হল! একবার যখন বলে ফেলেছিল তখনই কড়াকড় বাক্যবন্দি করে ফেলতে হয়। এরপর ওকে আর তুমি আটকাতে পেরেছ। এ যুগের মেয়েদের তো তুমি চেন না? যা ধরবে, তা করেই ছাড়বে।

    ভবদেব বন্দনার উত্তেজিত রাগ রাগ আর লাল লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ফেলে বললেন, শুধুই এ যুগের? যুগে যুগে কালে কালে ওটাই তো মেয়েদের স্বধর্ম। জোরাজুরিতে জিততে না পারলে কেঁদে জেতে। কিন্তু করেই ছাড়ে।

    ওঃ। সেই রকম একখানা মেয়ে নিয়েই ঘর করে আসছ বুঝি তুমি?

    বন্দনার মুখ আরও লাল হয়ে উঠল।

    অথবা বন্দনার কপালের সিঁদুর টিপটা ঘামে গলে গড়িয়ে পড়ার জন্যেই নাক-মুখ কপাল লালচে হয়েই রয়েছে।

    ভবদেব সেই দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার কথা আলাদা। বিধাতার ভাঁড়ারে ভাগ্যবান স্পেশাল বলে কিছু মাল মজুত থাকে।

    আচ্ছা, খুব হয়েছে। মনে জেনো এই একজনই তোমার চিরবাধ্য হয়ে থাকল। পৃথিবীতে আর কেউ এমন হবে না।

    ভবদেব একটু গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে, হাত বাড়িয়ে বন্দনার পিঠটা একটু ছুঁয়ে বললেন, পৃথিবীতে এমন একজনই যথেষ্ট বন্দনা।

    .

    ২৯.

    সুকুমারের নিভৃত ফোন, দিদি, আপনি একবার আসুন দয়া করে। আপনি আসছেন না বলে আপনার ভগ্নী রেগে খেপচুরিয়াস, অভিমানে শতখান। বলছে, জানি দিদি আসবে না। চিরকাল শুচিবাইয়ের রাজা। কী জাত, কী গোত্র। এলে তো আবার ছুঁতে হবে। কাইন্ডলি দিদি। মহিলা বড় মনোকষ্টে আছেন।

    বন্দনা বললেন, ও তো একটা চিরকেলে পাগল। সময় করে উঠতে পারছি না ভাই, আচ্ছা আজই যাচ্ছি।

    রিসিভারটা নামিয়ে রেখে নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, কেবলমাত্র নিজেকে নিয়েই তো কতজন দিব্যি থাকে, আমার ভাগ্যেই চিরকাল নিজেকে বিসর্জন দিয়ে শুধু কর্তব্য করে যাওয়া। সত্যি বলতে ছোটবোনের ব্যাপারটাকে বন্দনা মতিচ্ছন্ন আখ্যাই দিয়েছিলেন। তাই শুনেমাত্রই ছুটে যাবার উৎসাহ বোধ করেননি। এখন দেখলেন যেতেই হবে। গেলে আজই যাওয়া ভাল, এখনও পর্যন্ত তো শানু লোক হাসিয়ে সুন্দরবন পাঠশালার চাকরি করতে যায়নি। এখনও উঁচু মাথাটা হেঁট হয়নি বন্দনার।

    খপ করে এসে বললেন, শানু চল আমার সঙ্গে ছোটমাসির বাচ্চা দেখে আসবি।

    আমি? আমি আবার কী করতে?

    কী করতে আবার? দেখতে!

    যদিও শানুর মন এখন খুবই অস্থির, অশান্ত, তবু শানু রাজি হয়ে গেল। হয়তো শানুর মনের মধ্যেও তার মার মতোই চিন্তা কাজ করছিল। শানু ভাবছিল এখনও পর্যন্ত আমি সকলের মধ্যে সকলের সঙ্গে আছি! এখনও আমাকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। তা ছাড়া শানু বরাবর শিশুভক্ত। একটা শিশুকে হাতের কাছে পেলে, রীতিমত মেতে ওঠে।

    শানু একটু হাসল, দেখতে? তা চল। কিন্তু কারও নতুন বাচ্চা দেখতে যে কত কী নিয়ে যাও তুমি

    এই সেরেছে! তাই তো! এটা তো খেয়াল হয়নি বন্দনার। খেয়াল হবেই বা কী, মন থেকে তো আসছে না, চন্দনা জননী হয়েছে।

    বললেন, খুব মনে করিয়ে দিলি রে শানু। নন্দনা নাকি গাদা গাদা কীসব নিয়েটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন কোথায় কী জোগাড় করি বাবা, কে মার্কেটে যায়? আমাদের আমলটা বেশ ছিল বাবা! একটা রুপোর ঝিনুক বাটি দিলেই মিটে যেত। তা নয়, সাতরকম জিনিস খোঁজা।

    শানু হাসল, এখনও মিটে যায় মা, দিতে পারলে। দাম তো একশো গুণ বেড়ে গেছে।

    বন্দনা বললেন, তাই বলছিস? দিলে সেকেলে বলবে না?

    শানু আর একটু হাসল, সেকেলেবলত, যদি দামটা আকাশে না উঠত। লোকে দামটাই বোঝে মা। তো কি একটা রুপোর বাটি কিনে এনে দিতে হবে? বল তো ঘুরে আসি মিত্র অলংকার থেকে।

    বন্দনা বললেন, সে হলে আর কেনার দরকার কী? খোকার মুখ দেখানির দরুন তো পাঁচ-ছটা বাটি-গ্লাস রয়েছে। প্রথম ছেলেকে সোনা রুপো দিয়ে দেখাই প্রথা ছিল। নতুনই তো, একটু চকচকে করে নিলেই হবে।

    শানু একটু মুখ বাঁকিয়ে ঝাল হাসি হেসে বলল, খোকার জিনিস খোকারখোকার জন্যে থাকবে না?

    বন্দনার মুখে একটু আলো আলো ভাব ফুটে উঠল। বললেন, খোকার খোকা হলে? তার জন্যে তো আমি আমার গায়ের গয়না ভেঙে সোনার ঝিনুক বাটি গড়িয়ে দেব বাছা!

    .

    বন্দনা ভেবেছিল চন্দনা হয়তো তাঁকে দেখে খুব উল্লসিত হয়ে উঠবে, কিন্তু চন্দনা উদ্ভটের মতো ব্যবহার করল। যেই বন্দনা, কইরে ছোটন তোর কন্যে দেখি–বলে ঘরে ঢুকলেন, চন্দনা যেন হাঁ হাঁ করে উঠল, দিদি দিদি, দোহাই তোর, বাইরের কাপড়-চোপড়ে যেন ওকে কোলে নিতে যাসনে। গায়ে হাত টাচ করতে ইচ্ছে হয় তো বাইরের হাতটা সাবান দিয়ে ধুয়ে আয়, শানু প্লিজ দোলনার উপর অত ঝুঁকিস না। বড়দের নিশ্বাসের হাওয়াটা লাগা ঠিক নয়। রুপোর গ্লাসটা খুব সুন্দর তো রে! সোনা একটু বড় হয়ে নিজে নিজে দুধ খাবে।…

    বন্দনা বললেন, আয়া রেখেছিস নাকি?

    চন্দনা শিউরে উঠে বলল, আয়া? আয়ার হাতে বাচ্চা সমর্পণ করা তো যমের হাতে সমর্পণ করার মতো দিদি।

    আহা বাচ্চাকে সমর্পণ করবি কেন? এই সব কাঁচাকুচি, বোতল ধোওয়াধুয়ি!

    দিদি!

    চন্দনা হতাশ গলায় বলল, বোতল দেব আয়ার হাতে।

    আরে বাবা, তুই কত সময় পাবি? ওদিকে রান্নাবান্না সংসার। এদিকে এই!

    চন্দনা একটু মধুর হাসি হেসে বলল, রান্নাফান্না আর করতে যাই না রে আমি। যে মেয়েটা বাসন মাজত, তাকেই মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। আর কাঁচাকুচি ধোওয়াধুয়ি তোর ভগ্নিপতিই করে দেয়। সব কিছু ডেটল জলে কাঁচা, আলাদা তারে শুকোতে দেওয়া, এসব কি আর বাইরের লোক দিয়ে হয়? ওরা কত নোংরা।

    শানু চারদিক তাকিয়ে দেখছিল–

    অথচ ছোটমাসির ঘরের সেই ছবিত্বঅন্তর্হিত। যেখানে যা না থাকবার সেখানে তা বসানো, ঘরের মাঝখানে দোলনা বসানো।

    আসল লোকটিই বাড়ি নেই।

    সুকুমার নাকি গেছে বাজার থেকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আনতে, রাত্রে দু-তিনবার হেঁচেছে। বড় ডাক্তারের ব্যাপার তো, তিন-চার ঘণ্টা লাইন দিতে হয়।

    .

    না ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না।

    অনেকক্ষণ পরে বন্দনা বললেন, আমরা তা হলে আজ যাই রে।

    চন্দনা শিথিল গলায় বলল, যাবি? দ্যাখ না ভাই ববিটা এই সময় দেশে গিয়ে বসে আছে, কাজ করা মেয়েটাও এল না এখনও। তোদর একটু চা খাওয়াতেও পারলাম না।

    এমনভাবে বলল, যেন ওই দোলনায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত পুতুলটাকে এদের কাছে রেখে একবার উঠে একটু চা বানাতে যাবার কথাটা ভাবনার বাইরের ব্যাপার।

    শানুর মনে পড়ল, আগে যখন কখনও ছোটমাসির বাড়ি এসেছে, কী হইচই লাফাই ঝাঁপাই ছোটমাসির। কী খাওয়াবে আর কী না খাওয়াবে ভেবে পেত না যেন। একপালা ঠাণ্ডা একপালা গরম। দোকান থেকে মিষ্টির গাদা, বাড়িতে ডিম ভাজছে। ফ্রিজ থেকে মাছ বার করে ঝাল খাওয়াতে বসছে, রাত্রের খাওয়াটা সেরে যাবার জন্যে ঝুলোঝুলি করছে।

    .

    ৩০.

    বাসে উঠে শানু বলল, ছোটমাসিকে আর সেই লোক বলে মনে হচ্ছে তোমার মা?

    বন্দনা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসলেন, হচ্ছিল না বটে।

    মানুষ এত বদলে যেতে পারে মা?

    জানলার ধারের দুটো সিট পেয়ে গেছে এরা, তাই গলা নামিয়ে কথা বলার সুবিধে হচ্ছে। বন্দনা, নিশ্বাস ফেলে বললেন মানুষই তো বদলায় শানু। জীবজন্তু পশুপক্ষী এদের স্বভাবের তো কখনও কোনও বদল নেই। মানুষই পারে হঠাৎ চমকে দিতে।

    চমকে দিতে! ঠিক বটে।

    শানু চুপ করে গেল।

    শানুর পার্থদের বাড়ির সেই ঠাকুরঘরের সামনের দালানটাকে মনে পড়ল।

    জঙ্গলের আবার ঠিকানা কী? বলে ব্রিফকেসটা হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পার্থ। শানুর মুখের দিকে না তাকিয়ে।

    এখন মা মেয়ে নিঃশব্দ।

    হঠাৎ শানুর নিজেকেও পার্থর মতো বদলে যাওয়া মানুষ মনে হল। মনে হল সেও যেন একটা সুটকেস হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মা বাবার মুখের দিকে না তাকিয়ে।

    শানুর চোখের সামনে রাস্তার ধারের একটা কাঁচা নর্দমার ঘোলা জলের মধ্যে অনেকগুলো কুচিকুচি তস্যকুচি কাগজ ভাসার একটা দৃশ্য ফুটে উঠল।

    শানুর বুক থেকে যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। ইচ্ছে করলে শানু এখনও তার মা বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারে।

    .

    বাড়ির কাছাকাছি আসার পর শানু হঠাৎ বলে উঠল, উঃ বিকেলের চা-টা না খেয়ে মাথাটা জং ধরে গেছে। মহারানি তো, আবার পাঁচ দিন ধরে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছেন। গিয়ে একটু তৈরি চা পাবারও আশা নেই।

    বন্দনা বললেন, সে বুঝি তোকে চা বানিয়ে খাওয়াবার জন্যে বাড়ি বসে থাকে?

    আহা, আমার জন্যে কি আর থাকে? মহারাজার জন্যে থাকে। তবে আমি যদি বলি বউদি একটু চা হয় না? দেয়।

    তা আর না দিয়ে কী করবে? কথাতেই তো আছে, আমি বেহায়া পেতেছি পাত, কোন বেহায়া না দেয় ভাত। তা তুই বলিস মান খুইয়ে?

    কখনও সখনও বলি মা। এক বাড়িতে বাস করে, অত ছাড়াছাড়া হয়ে থাকতে প্রাণ হাঁপায়। …তা আজ তো মান খাওয়াবার প্রশ্নই নেই। উঃ ছোটমাসি একখানা দেখাল বটে!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএই তো সেদিন
    Next Article রাতের পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }