Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীটফল

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প189 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫১-৬০. হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে

    ৫১.

    নিজে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই বাপী পানুর হাসপাতালে চলে এল।…কার্ড নেই? হুঃ! বাপীর ঢোকা আটকাবে কার্ডের অভাবে?

    .

    পানুর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল।

    বাপীদা! তুমি! তু-তুমি বেঁচে আছ।

    বাপীর হা হা হাসিটা এখনও হারায়নি দেখা যাচ্ছে। কী মনে হচ্ছে? বাপীদার ভূত?

    পানুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

    বাপীর জামার নীচে এখনও ব্যান্ডেজ, তবু বাপী সোজা দাঁড়িয়ে। বলল, কেন তোকে কেউ আমার কথা বলেনি?

    আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করিনি। আমি চোখের সামনে দেখলাম তোমায় ছুরি বসিয়ে দিল

    থাক এখন বেশি কথা বলিস না। আছিস কেমন?

    কী জানি!

    আরে! তুই কেমন আছিস তুই জানিস না? ডাক্তার তো বলেছে ভাল হয়ে উঠছিস।

    পানু মলিন ভাবে বলল, ভাল বলেই বা কী? এখান থেকে বেরোলেই তো আবার মারবে। মরতে আমায় হবেই বাপীদা, তাই ভাবছি সবার আগে তোমায় একটা কথা বলে দেব।

    বাপী বিরক্তির গলায় বলল, মরতে তোকে হবেই মানে? আবার কে মারবে?

    যারা মেরেছিল। দিগেন আর তার দল।

    ওঃ! তো ওই দিগেনটার লাশ ফেলে দিলেই হবে? না কি দল সুদ্ধুই—

    শিউরে উঠল পানু। বলল, বাপীদা, একবার বেঁচে গেছ, আবার আমার জন্যে

    পাকামি রাখ, তোর জন্যে কি আমার জন্যে সে কথা থাক। আমার কথার জবাব দে। পুরো দলটাকেই খতম করা দরকার?

    বাপীদা, আমি জানি না। আমার মাথার মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি জান না বাপীদা ওরা কী ভীষণ

    আচ্ছা। কে ভীষণ সে হিসেব পরে হবে। তা ওরা যদি অত ভীষণ, তো এ বাড়ির ছেলে হয়ে ওদের সঙ্গে মিশতে গেলি কেন?

    জানতাম না বাপীদা! বুঝতে পারিনি। কিন্তু পালিয়ে আসার আর উপায় ছিল না। একেবারে কুমিরের কামড়। আমার কী ইচ্ছে ছিল ওকে আমি চন্দ্রাদের বাড়ি নিয়ে যাই! চন্দ্রার সঙ্গে মিশতে সুবিধে করে দিই—

    পামু থামল। হাঁপাচ্ছে।

    বাপী বলল, থাক বুঝেছি। কিন্তু মরার আগে কী যেন বলবি বলছিলি–

    কাছে সরে এসো।

    বাপী একটু এগিয়ে গেল।

    পানু খুব আস্তে বলল, টিপুকেও ওরা মারত, টিপু টের পেয়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে আছে।

    বাপী ওর কাঁধটা চেপে ধরল।

    টিপু বেঁচে আছে? ঠিক জানিস? কোথায় আছে?

    ঠিক জানি না। তবে মনে হয় তার সেই সেইখানেই—

    আশ্চর্য!

    বাপী, অধৈর্য গলায় বলল, সেইখানটা কোথায়?

    বড়বাজারের একটা ফলওয়ালার দোকানের–আসলে লোকটা গুণ্ডা, ফলওলা সেজে থাকে। তার দোকানের পিছনে একটা লুকোনো ঘর আছে

    তাড়াতাড়ি বল পানু। তাকে টিপু চিনল কী করে?

    এমনি। ইচ্ছে করেই ভাব করেছিল টিপু। বলেছিল ওর শাগরেদ হয়ে গেলে দিগেনদের খতম করে ফেলা যাবে! দিগেনের উপর খুব ঘেন্না তো।

    নাম জানিস লোকটার?

    জানি, রসিদ। আপেল বেচে।

    পানুর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু বলল, টিপুরে আমরাই খারাপ করে দিয়েছি বাপীদা।…

    ওকে জোর করে নেশার জিনিস ধরিয়েছি

    হঠাৎ পানু ওর বাবার ভঙ্গিতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল, মরবই তো, বলতে আর লজ্জা কী! আমরা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম বাপীদা, খারাপ খারাপ জায়গায় যেতে শিখেছিলাম, তার জন্যে মার গয়না পর্যন্ত দিগেন বলল, টিপু বড় লোকের ছেলে, ওটাকে দলে নিলে সুবিধে।..বাপীদা। একদিন ওকে জোর করে সেইখানে নিয়ে গেলাম। ওকে খারাপ করে ছাড়লাম। তারপর থেকেই ও যে কী হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বোধ হয় পাগলই হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ একদিন চলে যেত রসিদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলে তেড়ে মারতে আসত। আর দিগেন কিংবা আমাকে দেখলেই বলে উঠত, সব কথা বলে দেব।… সেদিন, মানে চিড়িয়ার মোড়ের সেদিনকার ব্যাপারে দিগেন ভেবেছিল, টিপুই নিশ্চয়ই তোমায় জানিয়ে দিয়েছে। …উঃ ভাগ্যিস তুমি গিয়ে পড়েছিল বাপীদা। নইলে চন্দ্রা আর বাড়ি ফিরতে পেত কিনা কে জানে। ওই শালা দিগেনের মতলব ভাল ছিল না।

    বাপীর মুখটা স্টিলের মতো হয়ে উঠছিল। তবু বাপী বলল, থাক, বুঝে নিয়েছি, তুই চুপ কর। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

    পানুর চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়ল। …বলল, হ্যাঁ, বাপীদা, খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকে বড় ব্যথা। ধাই ধাই করে লাথি মেরেছিল তো।

    একটু উত্তেজিত হল, মারবে। সুবিধে পেলেই আবার মারবে। শেষ পর্যন্ত শেষ করবে। ওদের অনেক কথা আমি জেনে ফেলেছি। জানে তো। তুমিও সাবধানে থেকো বাপীদা, তোমাকেও মারবার তালে থাকবে। …তুমি ছাড়া আমায় আর কেউ ভালবাসে না বাপীদা। মানুষ বলে ভাবেও না।

    বাপী গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, তা অমানুষ হয়ে গেলে আর মানুষ ভাবতে যাবে কী করে?

    আমি বড্ড বোকা বাপীদা। তাই ওদের সঙ্গে

    বাপী হেসে উঠল, বলল, এখন হাসপাতালের খাটে তাই অনুতাপ। বেরোলেই আবার নিজেকে খুব চালাক মনে হবে।

    বেরোলে!

    বেরোতে ভয় করে বাপীদা। বেরোলেই তো শেষ করে দেবে। এক এক সময় ভয় করে, এর মধ্যেই চুকে এসে না খতম করে দেয়।

    বাপী উঠে দাঁড়াল। বলল, তার আগে ছুঁচোটা নিজেই খতম হবে নিশ্চিন্দি থাক। থাকে কোথায় শালা?

    এই তো পঞ্চাননতলায়।

    ঠিক আছে।

    বেরিয়ে এল বাপী। দাঁড় করিয়ে রাখা ট্যাক্সিটায় এসে বসল। ইস! কতগুলো দিন তার গাড়িটা গ্যারেজে পড়ে রয়েছে। বাপীর হাত দুটো নিসপিস করে উঠল। ড্রাইভারের হাতের দিকে তাকিয়ে…

    ভবতোষ বলেছিলেন, ছাড়বার সময়টা সঠিক জানতে পারলে এসে নিয়ে যাব। বাপী উড়িয়ে দিয়েছিল, নিয়ে যাবার কী আছে? বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নেব, চলে যাব।

    .

     ৫২.

    বাড়ি ঢুকেই হইহই করে উঠল বাপী।

    আরে ছোড়দি, কী কেলেঙ্কারি করেছিস। কী মোটান মুটিয়েছিস। উঃ। খুব টানিস কেমন?

    বন্দনা বললেন, এতদিন পরে দেখা, এসেই দিদিকে খুঁড়ছিস? টানা আবার কী কথা?

    ও তুমি বুঝবে না। …আরে, এইটা বুঝি তোর?…

    টপ করে মেয়েটাকে তুলে ধরে উঁচু করে বলল, তোর কাছে তোর মেয়েকে দেখাচ্ছে ঠিক হাতির পাশে ইঁদুর।

    বাচ্চাটা সরু সরু গলায় কিচকিচিয়ে কীসব বলে উঠল, এবং বাপীর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল।

    হাসতে লাগল বাপী।

    এইটুকু বাচ্চা ইংরিজি ঝাড়ছে, তোমার খুব মজা লাগছে না মা?

    মজা।

    বন্দনার চোখ উথলে জল আসে, বলেন, সবাই মিলে যা সাজা দিয়ে চলেছ, তাতে আর মার মজা লাগার ক্ষমতা নেই বাবা!

    এই তোমাদের সেই পেটেন্ট প্যানপ্যানানি। ফাদার কোথায়?

    এই তো আবার থানায় গেছেন ছেলেটার খোঁজ নিতে।

    বাপী গম্ভীর ভাবে বলল, বাবার আর খোঁজ নিতে যাবার দরকার নেই, যা করবার আমিই করব।

    বন্দনার বুক জুড়ে একটা ভরাটি সুখ উথলে উঠল। এই আশ্বাসবাণী তাঁর কৃতবিদ্য বড়েছেলে একবারও দিতে পারেনি।

    অমৃতার পরনে এখন শাড়ি, হালকা মিহি জর্জেট। হাত ন্যাড়াই এবং বন্দনার মতে মাথাও ন্যাড়াই। ব্লাউজ একটা গায়ে দিয়েছে বটে, তবে দেওয়া না দেওয়ায় পার্থক্য সামান্যই। কাঁধের উপর একটা ইঞ্চিখানেক টেপ প্রমাণ করছে মহিলার গায়ে জামা আছে।

    বাপী বলল, এদিকে তো হাতি হয়েছিস, এক মিটার কাপড়ে কটা জামা বানাস?

    এই সেরেছে।

    বন্দনা প্রমাদ গুনলেন।

    বন্দনা তাড়াতাড়ি বললেন, কী রে তোরা কি আবার ছেলেবেলার মতো খুনসুড়ি শুরু করে দিলি? ও রকম জামা এখানেই বা কে না পরছে?

    কী ভাগ্যিস অপমানে মুখ কালো করল না অমি, কামানো আঁকা ভুরুজোড়া ধনুকের মতো তুলে বলল, যে দেশে এসে পড়েছি, হাতিরাও ইঁদুর বনে যেতে দেরি হবে না রে বাপী। ভেজাল খাওয়া, নোংরা পরিবেশ, লোডশেডিং, দমবন্ধ বাতাস, সব মিলিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

    গুড। দরকারি কাজ যত তাড়াতাড়ি শুরু হয় মঙ্গল। মাতৃদেবী, শানুর খবর কী?

    কী জানি—

    বন্দনার গলা কেঁপে উঠল, গিয়ে পর্যন্ত তো মাত্র দুখানা পোস্টকার্ড দিয়েছি, নেহাত আমি ভাল আছি, তোমরা কেমন আছ এই রকম। একটা ভাল চিঠি পাইনি।

    তার মানে খুব ভালই আছে। না হলে

    ইনিয়ে বিনিয়ে চারপাতা চিঠি লিখত।

    বন্দনা একটা নিশ্বাস ফেললেন।

    মায়ের প্রাণ যেন অন্য কথা বলছে।

    বাপী বলল, দু একটা জরুরি কাজ হাতে রয়েছে, সেগুলোর ফয়সালা করে, একবার ঘুরে আসতে পারি।

    বন্দনা আঁতকে উঠে বললেন, এক্ষুনি আবার তোর কী এত জরুরি কাজ? দুদিন বাড়িতে শুয়ে বসে বিশ্রাম কর তো।

    বাড়িতে শুয়ে বসে? বাপী সেন?

    হা হা করে হেসে উঠল বাপী। এই ছোড়দি, তোর ওই লাশটা টেনে তুলতে পারবি? পারিস তো বল গাড়িটা বার করি।… তোকে আর এই পুতুলটাকে একটু ময়দানে ঘুরিয়ে আনি।

    যদিও লাশ শব্দটা হাড় জ্বালিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট, তবু ময়দানে বেড়িয়ে আসার প্রস্তাবটা ছাড়া যায় না।

    উঠে পড়ল।

    অভ্যাসের বশে প্রসাধনের উপর আর একটু প্রসাধন করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

    .

    ৫৩.

    মেয়ে এসে পড়ায় ভবদেবকে কক্ষচ্যুত হতে হয়েছে। ঠাঁই হয়েছে সত্যদেব সেনের পরিত্যক্ত কক্ষে।

    এ ব্যবস্থায় বন্দনা দুঃখিত, কিন্তু ভবদেব বেশ আরাম পেয়েছেন। হঠাৎ মনে হচ্ছে নিজেকে যেন আস্ত করে দেখতে পাচ্ছেন।

    সত্যদেব তাঁর মাথার কাছের জানলাটায় খিল লাগিয়ে রাখতেন, ভবদেব দুহাট করে খুলে রাখেন। ওই একটুখানি জানলা দিয়েই অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। আশেপাশে দেয়াল, পরিবেশ ঘিঞ্জি, তবু আকাশটা তো অবারিত। আকাশটা তো ঘিঞ্জি নয়।

    মানুষের যে আকাশটাকেও দেখবার দরকার আছে, এ কথা ভবদেব কোনওদিন অনুভব করেননি। বোধহয় কোনওদিন খেয়ালও করেননি ভূদেব সেনের তৈরি এই সেন পরিবারের বাড়িটার মাথার উপর একটা আকাশ আছে।

    অথচ এখন মাথার দিকের ওই জানলাটা খুলে দিয়ে যখন ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেন, মনে হয় সারাজীবন ধরে মস্ত একটা লোকসান ঘটিয়ে এসেছে।… কত নীল, কত নক্ষত্রের অপচয় ঘটেছে। খুব জরুরি ছিল ওটা দেখা।

    আলো নিভিয়ে ফেলার আগে ভবদেব তাঁর বাবার খাতাখানার সাদা পড়ে থাকা পাতাগুলোয় কিছু কিছু লিখে রাখছেন আজকাল। যেমন সেদিন লিখেছিলেন–স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার মাঝখানে যে একটা সীমারেখা থাকা নিয়ম, সেটা এ যুগ খেয়াল করে না।

    কবে লিখেছিলেন? যেদিন অমিকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এলেন, সেইদিন না?

    কিন্তু তখন বোধ হয় ভবদেবের হিসেবে কিছু গড়বড় ছিল। ভবদেব তখনও জানতেন না তাঁর মেয়ে ওই সীমারেখাটা লঙ্ঘন করে–পতি এবং পতিগৃহ ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় চলে আসেনি। জানতেন না। কারণ ও নিজেই জাহির করেছিল, অসহ্য হয়ে উঠেছিল, তাই তো ত্যাগ করে চলে এসেছি। একটা জানোয়ারের সঙ্গে কতদিন ঘর করা যায়?

    সেটাই তো বিশ্বাস করতে হয়েছিল ভবদেবকে, আর ভবদেবের পরিবার পরিজনকে।

    অথচ সে কথাটা বানানো ছিল অমৃতার। যেমন এযাবৎকাল বানিয়ে এসেছিল তার সুখের সাগরে। ভাসার কাহিনী। রঙিন ছবিগুলো? সে অবশ্য ফ্যাশানের দান। প্রথম জীবনটা তো মোটামুটি উজ্জ্বলই ছিল। বাচ্চাটা জন্মাবার পর থেকেই বদল ঘটার শুরু। সর্বনাশা লাস্যময়ী এক সহকর্মিণীর কবলে পড়ে ভবদেব সেনের মেজ জামাই জ্যোতি মজুমদার অন্ধকারের দিকে তীব্রভাবে ধাবিত হতে লাগল।

    এমনিতেই ছিল একধরনের বদমেজাজি, যার জন্যে তার দুরন্ত ফ্যাশানের সঙ্গে তাল দিতে দিতে ভবদেব সেনের মেয়েকে দারুণভাবেই বদলে যেতে হয়েছে। স্বামীর বদ খেয়ালের অনুসরণ করতে করতে নিজেই সে বদখেয়ালি হয়ে উঠেছে। পানাসক্ত লোকটার মন রাখতে, হতে হয়েছে পানাসক্ত। তবু শেষরক্ষা হল না। শুধু নিজেই সেই আসক্তির জোয়ারে ভেসে গেছে অসহায়ের মতো।

    তবু যতক্ষণ না বিচ্ছেদ ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অতি সুখী দম্পতির ভান করে চলাই সমাজের বিধি, অথবা ফ্যাশানের খাজনা।… তাই রঙিন ছবির প্যাকেটে ঘাটতি ঘটেনি। অমৃতা সেই রংচঙে সাবানের ফানুসটাকেই লোকচক্ষে জাহির করে এসেছে।

    কিন্তু এখন? বিচ্ছেদটা তা হলে হয়েই গেছে?

    না, সেটুকু ধৈর্যও সয়নি মাতাল চরিত্রহীন বদমেজাজি জ্যোতি মজুমদারের। তার বর্তমান পরিবেশে। অশান্তি অবৈধ জীবনযাপনের কোনও বাধা নেই, উপার্জন করে প্রচুর। বাধা লাগছিল স্ত্রী কন্যাকে। তাই সে তার স্ত্রী কন্যাকে যৎপরোনাস্তি দুর্ব্যবহারে পীড়িত করে, শেষ পর্যন্ত সেই সহকর্মিণীকে নিজের ফ্ল্যাটে এনে তুলে এদের জোর করে ভারতবর্ষে চালান করে দিয়েছে। সাদা বাংলায় যাকে বলা হয় তাড়িয়ে দিয়েছে।

    কিন্তু সে সত্য কি প্রকাশ করবার? নাঃ। প্রকাশ করবার জন্যে কিছু সত্য তৈরি করতে হয়! হয়তো পৃথিবীর তাবৎ নারীসমাজকেই এই শিল্পটিকে আয়ত্ত করতে হয় প্রাণপণে।

    বানানো সত্য, দূর থেকে বোকা বানাতে পারে, কাছ থেকে পারে না। অন্তত বেশিদিন পারে না। তাই পরে কোনও একদিন ভবদেব লিখে রেখেছিলেন, মেয়েটা আমাদের আচ্ছা বোকা বানিয়ে রেখেছিল।

    আর একদিন শুধু লিখলেন, মেয়েটা বড় দুঃখী।.. লেখাটা যেন নেশায় দাঁড়াচ্ছে এখন।

    আজ লিখলেন, নিশ্চিত বুঝছি, বাপী একটা খুন করবে। কারণ বাপীরা বদলা নেবার মন্ত্রে দীক্ষিত।… এই যুগ ওকে এই মন্ত্রই জপতে শিখিয়েছে।… বাপী যদি পরাধীন দেশে জন্মাত, হয়তো বাঘা যতীন হতে পারত, হয়তো ক্ষুদিরাম, এখন স্বাধীন দেশে বাপীদের সামনে বদলা নেওয়া ছাড়া আর কোনও আদর্শ নেই।…

    সর্বদাই তাই উপাদানের কী অপচয়ই ঘটতে দেখে চলেছি আমরা।

    আলোটা নিভিয়ে দিলেন, হঠাৎ খুব বেশি অন্ধকার হয়ে গেল। বোধ হয় অমাবস্যার কাছাকাছি কোনও তিথি।

    .

     ৫৪.

    তা যে যুগের যে মন্ত্র। বাপী জানে ওই বদলা নেওয়াটা তাড়াতাড়ি দরকার। ওটাই বাপীর দু-একটা জরুরি কাজের প্রথম আর প্রধান। ওটা না হলে পানু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও, চলে আসতে ভয় পাবে। ওটা না হলে টিপু নামের মাথা বিগড়ে যাওয়া ছেলেটাকে পাড়ায় নিয়ে আসা যাবে না। …আর ওটা না করে ফেলতে পারলে পাড়ার চন্দা নামের মেয়েটা নিরাপদ হতে পারবে না।

    তা ছাড়া বাপী সেন নামের ছেলেটা নিজে? ভয় না থাক, অস্বস্তি থেকে যাচ্ছে একটা। …কুকুর হইতে সাবধান হওয়াই ভাল।

    অতএব বাপী তার প্রধান জরুরি কাজটাকেই প্রথমে সেরে ফেলল। রোজই ভোরের সময় গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। খানিক পরে ফেরে, হয়তো চায়ের দোকানে বসে চা খেয়ে আসে।… সেদিন খুব তাড়াতাড়ি ফিরল।

    এসেই হাঁকডাক শুরু করল, এই ছোড়দি, দারুণ চা তেষ্টা পেয়েছে, চটপট চা বানা।

    বন্দনা অবাক হয়ে বললেন, ও আবার কী চা বানাতে যাবে?

    কেন, এ কাজটাও ভুলে গেছে? এই ছোড়দি, তবে যে শুনি ওদেশে বাসনমাজা থেকে ঘর সাজানো পর্যন্ত সব নিজেদের করতে হয়।

    ছোড়দি সোফার উপর ধপাস করে বসে পড়ে বলল, করা হয়েছে এযাবৎ!

    তবে?

    তবে আবার কী! মার পবিত্র রান্নাঘরে এই ম্লেচ্ছ মেয়েটার ঢোকার পাসপোর্ট আছে কিনা জানি না

    বন্দনা বলে উঠলেন, তোদের আর কী! ভাইবোন এক হলেই, মাকে নিয়ে পড়া। চিরকাল এক অভ্যেস। চা-তো রোজই করে আসছি আমি।

    আর করবেন না হে বন্দনা দেবী, পিপেকে একটু কাজটাজ করিয়ে হালকা করে ফেলার চেষ্টা করুন। ছোড়দি–

    ছোড়দি গা ছেড়ে হেসে উঠে বলল, সেই চেষ্টাই চলছে বটে।… এই এত বছর ধরে কী কী খাওয়া হয়নি আমার। সেটাই ভেবে ভেবে, পিপেয় ভরে ফেলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

    হ্যাঁ হচ্ছে, বোস তুই চা আনছি। কতই খাস।

    বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন বন্দনা।

    বাপী ভাবল, আচ্ছা কিছুতেই কেন অনুভবে আনতে পারছি না এইমাত্র আমি একটা খুন করে এসেছি।… পর পর দুটো গুলি ছুঁড়েছি, কপালে আর বুকে।… লেক-এ মর্নিং ওয়াক করতে আসা দু-একটা বুড়ো এদিক ওদিক তাকিয়ে বোধ হয় বলাবলি করল, সক্কালবেলাই কোথায় বোমাবাজি শুরু হয়ে গেল রে বাবা।

    তা ওর কপালে আজই জীবনের শেষদিন ছিল বোঝা যাচ্ছে। তা নইলে পঞ্চাননতলা থেকে লেকের বেঞ্চেতে ঘুমোতে আসবে কেন?… এত তাড়াতাড়ি যে সুযোগ জুটে যাবে, আশা করিনি। বড় বেশি সহজে মিটে গেল যেন। তাই বোধ হয় সাফল্যের উত্তেজনাটা আসছে না।

    ঘরে এসে আরশির সামনে দাঁড়াল বাপী।

    মুখে কি কোনও ছাপ পড়েছে?

    কই? কিছু তো বুঝতে পারছি না। তার মানে এটা কোনও ব্যাপারই নয়। …যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে গুলিতে কারও খুলি উড়িয়ে দিতে পারলেই হয় বীরত্ব, আর অন্য ক্ষেত্রেই খুন। হঁঃ। কিছু অনুতাপ আসছে না আমার।… যাক পানুকে খবরটা দিয়ে আসতে হবে। আচ্ছা ছুঁচোটার মা বাবা আছে? চুলোয় যাক, এটা আবার ভাবতে বসছি কেন?

    .

    ৫৫.

    বাপীর ওই বীরত্বের কাজটায় কিন্তু কোথাও কোনও চাঞ্চল্য উঠল না। কেনই বা উঠবে? …শহরে কোনওখানে যদি কোনও অজ্ঞাতনামা যুবককে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, সেটা কি একটা চাঞ্চল্যকর খবর? আদৌ–খবর কিনা তাই তো সন্দেহ। নিত্যদিনের দশ-বিশটা স্বাভাবিক সংবাদের মধ্যে আর একটা সংবাদ বই তো নয়!

    কিন্তু এই খবরটি বীরত্ব হিসাবে কেমন করে যেন একজনের কাছে পৌঁছে গিয়ে তাকে বিগলিত করল। সে ছুটে এসে বাপীকে ত্রাণকর্তা বলে প্রায় পায়ে পড়তে এল।

    একদার বিরোধীপক্ষ বিশ্বদেব সেন কিছুদিন আগে বাপীকে দেবতা আখ্যা দিয়েছিল, এখন বলল, ত্রাণকর্তা পরিত্রাতা।

    হলেও ঘরের মধ্যে, হলেও অফুটে, তবু দেয়ালেরও যে কান আছে, এটা তো আর মিথ্যা নয়? এও এক রকম প্রমাণিত সত্য।

    পুলিশের বাপের সাধ্যি নেই বাপী সেনের চুলের ডগাটিও টাচ করে। এই নিশ্চিন্ততার দুর্গে বাস করছিল বাপী। সেই নিশ্চিন্ততায় চিড় খেল।

    বাপী গুনগুন করে গান চালাতে চালাতে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল, সুদেব এসে যা কখনও করে না, তাই করল। বাপীর বিছানায় বসে পড়ে বলল, ওবাড়ির নতুন কাকা তখন নীচের ঘরে তোকে কী বলছিল রে?

    .

    ৫৬.

    নিরুপায়তা বোধ করি এক ধরনের সাহসের জোগানদার, অসহায়তা একটু আত্মশক্তির। যেন মরার বাড়া তো গাল নেই! … একবার বই-তো দুবার মরব না। …অতএব যা থাকে কপালে

    স্কুল ছুটির পর শানু শক্ত গলায় প্রশ্ন করল, মিস্টার চক্রবর্তী, আমি বাড়িতে যে সব চিঠিগুলো লিখছি সেসব চিঠি কোথায় যাচ্ছে?

    বিনা নোটিশে হঠাৎ এরকম একটা প্রশ্নের জন্যে অবশ্যই প্রস্তুত ছিলেন না জগন্নাথ, একটু থতমত খেলেন, তবে লোক তো ঘুঘু, সেটা প্রকাশ হল না। পেঁচার মতো মুখ করে বললেন, এ কথা আমায় জিজ্ঞেস না করে, ডাক বিভাগকে জিজ্ঞেস করলেই ভাল হত না মিস সেন?

    শানু তেমনি কাঠগলায় বলল, ডাকবাক্স পর্যন্ত না পৌঁছলে, ডাক বিভাগের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।

    না পৌঁছলে? তা তার জন্যে কি আমায় কৈফিয়ত দিতে হবে?

    তা কাউকে তো দিতেই হবে! আমার বিশ্বাস, চিঠিগুলো আপনার হেফাজতেই থেকে যায়।

    কী? কী বললেন?

    চক্রবর্তীর গোল মুখটা বাঘের মতো দেখতে লাগল, আমি আপনার চিঠি চুরি করি?

    আপনি চুরি করেন তা তো বলছি না, ডাকবাক্সে ফেলতে দেওয়া চিঠি কোথাও আটকে যায় এটাই আমার বিশ্বাস।

    বাঘমুখ খ্যাঁকশিয়ালে পরিণত হয়ে গেল।

    খিঁচোনো প্রশ্ন, আপনার এ বিশ্বাসের হেতু?

    হেতু তো রয়েইছে। সেখান থেকে যে চিঠি আসে, তাতে আমার লেখা চিঠি পৌঁছেছে, এমন মনে হয় না। দু-একটা পোস্টকার্ডই মাত্র পৌঁছেছে।

    চক্রবর্তী নীরেট গলায় বললেন, চিঠি মারা গেলে আমি দায়ী হব? সরকারের ডাক ব্যবস্থা আজকাল খুব ভাল? …তবে যদি

    লোকটা আবার খ্যাঁকশিয়াল হাসি হেসে বলল, তবে যদি বাড়ির কেয়ারে প্রেমপত্র-টত্র চালান করে থাকেন, হয়তো গার্জেনরা

    থামুন! আজেবাজে কথা বলবেন না। মনে করবেন না শখ করে এই একটা বাজে জায়গায় কাজ করতে এসেছি বলে, আমার কেউ কোথাও নেই। এভাবে চললে আমি নিজে পোস্ট অফিসে গিয়ে টেলিগ্রাম করে আসব। এখানে খুব অসুবিধেয় আছি।… আমার দাদা মন্ত্রীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, তার কানে এ কথা উঠলে

    চক্রবর্তী বুনো মোষের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে বললেন, ওঃ! সেই দাদার নাম বুঝি পার্থ? কী রকম দাদা? পাড়াতুতো? এই যে একটু আগে একটা পোস্টকার্ড এসেছে তাঁর! দেখছেন কদিন চিঠি আসে?

    নিজের ড্রয়ার খুলে একটা দিন বারো আগের তারিখসংবলিত পোস্টকার্ড বার করে বাড়িয়ে ধরলেন।

    পত্ৰলেখকের নামটা কি ভুলে গেছে শানু? না কি হাতের লেখাটা চিনতে পারছে না? তানইলে কেন অমন ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অবশ্য সেই কিছুক্ষণটা সামান্যক্ষণই। ..শানুর মনে হল, একজোড়া চোখের শ্যেনদৃষ্টি তার শরীরে যেন ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে।

    তেমনি কঠিন গলায় শানু বলল, কবে এসেছে।

    বললাম তো, আজ।

    ডেলিভারি ডেট-এর ছাপের উপর এত বাড়তি কালির ছাপ কীসের?

    কালির ছাপ কীসের। সেটাও আমায় জানতে হবে। আপনি যে আমায় অবাক করছেন মিস সেন।

    অবাক আপনিও করছেন মিস্টার চক্রবর্তী। চিঠিটা এতক্ষণ আমায় দেওয়া হল না, হঠাৎ আপনার ড্রয়ারের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। অদ্ভুত নয়? ভবিষ্যতে যদি আবার চিঠির গোলমাল দেখি, আমায় ব্যবস্থা নিতে হবে।

    চিঠিটা ব্যাগে ভরে নিয়ে বেরিয়ে গেল স্কুল থেকে।

    না পড়েই ব্যাগে ভরে ফেলল?

    পার্থ নামটা সম্পর্কে এতটাই কৌতূহলশুন্য হয়ে গেছে গোসাবা মহামায়া প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দিদিমণি শান্তস্মিতা সেন।

    না কি ওই চিঠিটা পড়ার জন্যে কিছু সময়ের দরকার ছিল না? হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই পড়া হয়ে গেছে? হয়তো বা মুখস্থও হয়ে গেছে।

    .

    ৫৭.

    জিনিসটাকে ছোড়দির কাছে পৌঁছে দিয়ে এসে, বাপী খোশমেজাজে আবার বেরোবার জন্যে জুতোর মধ্যে পা গলাচ্ছিল, বন্দনা পিছন থেকে তীব্রস্বরে বলে উঠলেন, বাপী!

    বলুন মাদার।

    থাম। ছোড়দিকে কী দিয়ে এলি?

    দেখে ফেলেছ জননী? উঃ কী শার্প চোখ! তুমি যদি টিকটিকি পুলিশে যোগ দিতে মা—

    বাপী! সবসময় রংতামাশা ভাল লাগে না! বল চুপিচুপি, কী সাপ্লাই করা হল?

    বাপী কিন্তু মার উত্তেজিত শাসনবাণীতেও স্বভাবগত রংতামাশা ছাড়ল না। হেসে হেসে বলল, বুঝতেই তো পেরেছ বাবা! তা নইলে আর এমন ফায়ার হয়ে উঠতে না।

    তার মানে তুই ভাই হয়ে হাতে করে ওই ছাইভস্ম এনে জোগান দিচ্ছিস?

    করা যাবে কী? একটা ব্যাহ্যাবিট করে বসেছে, হঠাৎ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে যে মারা পড়বে।

    অমন মেয়েমানুষের মরাই মঙ্গল! ফস করে কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল বন্দনার। স্বরে রুক্ষতা ছিল, ছিল তীব্রতাও।

    বাপী গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, এককথায় মেয়েটা মেয়েমানুষ হয়ে গেল মা? মানুষকে একটু বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। নিশ্চয় জানো ও এতদিন যে জায়গায় কাটিয়ে এল, সেখানে লোকে জলের বদলে মদ খায়, চাকফির মতো ওটা স্বাভাবিক পানীয় ওখানে

    বন্দনার চোখে জল এল। হয়তো এই ধিক্কারে, হয়তো বা একটা রূঢ় কথা বলে ফেলার আত্মগ্লানিতে, বললেন, মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। আমায় কে কবে বুঝতে চেষ্টা করেছে বলতে পারিস?

    এই সেরেছে! এখানেও সেই বদলা নেবার ব্যাপার। বোঝে না অবোধরা। বুদ্ধিওলা প্রাণীরা ঠিকই বোঝে মাদার! আরে বাবা চোখ-ফোখ ভিজিয়ে বোসো না প্লিজ! এক্ষুনি নাক লাল করে সর্দি মুছতে বসবে!

    আমি তোর ইয়ার, না?

    বলে বন্দনা চোখ মুছে বসে যাওয়া ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, তোদের ঠাকুমার পেতে রেখে যাওয়া আমার এই চিরকেলে পুণ্যের সংসার, এখানে এসব অনাচার–ওই পাপ জিনিস আরেব্বাস!

    বাপী বলে উঠল, ওই পাপ জিনিসটা তো আমিও একটু আধটু খাই জননী

    বন্দনার যে সন্দেহ নেই তা নয়, এবং অনুধাবন করে থাকেন ওই একটু আধটুর সীমা লঙ্ঘন করে না। কী উত্তর দেবেন ভেবে না পেয়ে বোকার মতোই একটা কথা বলে বসলেন। বললেন, বাড়িতে বসে খাস?

    আহা না হয় বাইরেই গর্হিত কাজটা সেরে আসি, কিন্তু সেই বডিটা নিয়েই তো বাড়িতে ফিরি, বসবাস করি? তাতে তোমার পুণ্যের সংসারের পবিত্রতা নষ্ট হয় না?

    হঠাৎ হেসে উঠল, আরে বাবা, তোমার জ্যেষ্ঠপুত্তরটা তো বাড়িতে বসেই

    কী? কী বললি? খোকা? খোকা খায় ওসব?

    আহা অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন গো মাদার। রোজ কি আর খায়? বিনে পয়সায় ভালমন্দ মাল একটু পেলে সদ্ব্যবহার করে। আমার হাতে যে ছাই মাঝে মাঝেই ফরেনের দ্রব্য কিছু কিছু এসে যায়, প্রাণ ধরে একা সাবাড় করা যায়? গুরুজনকে উপহার দিয়ে দিই। খোকা খুকু দুজনেই একটু র‍্যালিশ করে, হা হা হা। আবে বাবা কী হল? মুখফুখ সাদা করে ফেললে যে! প্লিজ, হার্ট ফেল-টেল করে বোসো না। আহা, বড় বেশি ইনোসেন্ট রয়ে গেছ। তোমার আর মিস্টার ভবদেব সেনের আসল জায়গা হচ্ছে মিউজিয়ামে।

    হাসতে হাসতে চলে গেল গুনগুন করতে করতে।

    গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বার করতে করতে ভাবল, শালা রসিদটাকে তো ধরতে পারা যাচ্ছে না, সব সময় হাওয়া। আজ একটা ফয়সালা না করে ছাড়ছি না। সারারাত ওর বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও। টিপুটাকে বাড়িতে এনে না ফেলতে পারলে পেনোকেও তো তার শনিধনের খবরটা দিতে যেতে পারছি না।

    রসিদের ডেরাটা আবিষ্কার করে ফেলেছে বাপী আর রসিদের ওখানে যে ওই ধরনের একটা ছেলে রয়েছে কিছুদিন থেকে, সে খবরও পেয়েছে।

    .

     ৫৮.

    বাপী সোজাসুজি প্রশ্ন করে বসল, ছেলেটার জন্যে কত ছাড়তে হবে দোস্ত?

    রসিদের চেহারাখানা স্রেফ নাট্যমঞ্চে সাজা গুণ্ডার মতোই। পরনে চেক লুঙ্গি, গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি, গলায় কালো কারে গাঁথা একখানা রুপোর পদক! পান খাচ্ছে কষ বেয়ে রস গড়িয়ে। বেরিয়ে এসেছে হাতে একখানা ফলকাটা চাকু। বাপীর প্রশ্ন শুনে বলে উঠল, এটা কোন ফাঁদ পাতা হচ্ছে দাদা?

    ফাঁদ? আরে। ফাঁদটাদ পাততে আসিনি দোস্ত। ভাইটাকে তো চাই।

    ওই তো, ওটাই তো মুশকিলের ফাঁদ দাদা! দোস্ত বলে ডেকে, ফের লেনদেনি কারবারি কথা চলে?

    বাপী হেসে বলল, কী করব, আপনাকে দেখেই যে দোস্ত বলতে প্রাণ চাইল।

    হা হা করে হেসে উঠল লোকটা। একটা দাঁত সোনা বাঁধানো।

    হাসি থামিয়ে বলল, রসিদের পেট ভরাবার হিম্মত আছে দাদা?

    বাপী তাড়াতাড়ি জিভ কেটে দুহাতে দুকান ছুঁয়ে বলল, আরেব্বাস! এ গোস্তাকি করতে পারি? কিছু নজরানো তত দিতে ইচ্ছে হবে?

    রসিদ ছুরিসুদ্ধু হাতটা কপালে ঠেকিয়ে সেলামের ভঙ্গিতে বলল, দোস্তিটা রাখবেন দাদা, ওতেই হবে। তো সুলতানকে আমি নিজেই পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছি, যেতে চায় না। মাথাটা কিছু গড়বড় হয়ে গেছে। ভয় খায়। আমার হাত চেপে ধরে। বলে, যাব না, মারবে।

    বাপী মৃদু হেসে বলল, বলে দিন দোস্ত, যে মারত, সে খতম হয়ে গেছে।

    অ্যাঁ! রসিদ আবার ভাঙা ভাঙা গলায় হা হা করে হেসে উঠল, আরে শাবাশ। দাদা তবে আমার একটা পাকা উস্তাদ? বহুত আচ্ছা! আচ্ছা নিয়ে আসছি সুলতানকে।

    বাপী ব্যস্তভাবে বলল, ও কি ওর নাম সুলতান বলেছে?

    আরে না দাদা, ও বলেছে টিপু! তো রসিদ বলেছে, টিপু সুলতান।

    হাসল।

    ঢুকে গেল দোকানের পিছনের ডেরায়।

    প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে এল টিপুকে।

    বাপী থতমত খেল। এ কী চেহারা হয়েছে? খুব কি রোগা হয়ে গেছে? তা তো নয়? জামাটামা ময়লা? গা ধুলিধূসর? তাও তো নয়। বাপীর মনে হল ওর মুখটাই যেন বদলে গেছে। একদম বদলে গেছে।

    বলল, এই বাড়ি যেতে চাস না কেন?

    টিপু রসিদের পিছনে সরে গেল, যাব না। মারবে।

    বাপী জোর দিয়ে বলল, না মারবে না। ও মরে গেছে।

    টিপু চমকে উঠল। তারপর মাথা নাড়ল।

    বাপী ধমক দিল, আমি বলছি মরে গেছে বিশ্বাস হচ্ছে না? চল। মা কান্নাকাটি করছে জানিস না?

    মা!

    অস্ফুট উচ্চারণ।

    হ্যাঁ হ্যাঁ! মা! ভুলে গেছিস নাকি? চল চল। নে এনাকে সেলাম কর।

    আবার একটু হাসল, কুণ্ঠিত হাসি। এতদিন সুলতানকে পুষলেন, ওটা তা হলে ধারই থেকে যাচ্ছে?

    থাক। থাক! সুদে বাড়বে।

    খ্যাঁকঘেঁকে হাদির দাপটে পানের রস ছিটকে বাপীর পলিয়েস্টারের শার্টটা চিত্রিত হয়ে গেল।

    গাড়িতে উঠে টিপু কোণ ঘেঁষে চুপ করে বসে রইল। বাপী আর বেশি ঘাঁটাল না। চিকিৎসাপত্র করাতে হবে ভাল করে। বুকের বল বলে কিছু নেই। এইসব প্রাণীগুলো যদি হঠাৎ খোঁয়াড় ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে, তা হলে আর তার উদ্ধার নেই। পাপবোধেই গুবলেট হয়ে যায়। টিপেটার মতো একটা পলকা ছেলের জন্যে বাড়ির কেয়ার আরও বেশি থাকা উচিত ছিল।

    ভাবনার মধ্যেও মনটা খুব ভরাট লাগছে। হাওয়াটা আজ বড় সুন্দর।

    গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যেতে যেতে মনের ভার অনেকখানি হালকা হয়ে গেল। বেশ স্ফুর্তিস্ফুর্তি লাগছে।

    বাপী সেই স্ফুর্তির মনটাকে জিজ্ঞেস করল, এই শালা, নিজেকে কি তোর একটা মহাপাপী খুনি বলে মনে হচ্ছে? কই, টের পাচ্ছি না কেন? খুনখারাবি নিয়ে লম্বাচওড়া কথা তো বলেছিস, ঢের মুখে মুখে অনেকের গর্দান নিয়েছিস, অনেক লাশ নামিয়েছিস, কিন্তু হাতেকলমে তো ওই ছুঁচোটাই প্রথম।

    হঠাৎ হেসে উঠল, ছুঁচোটা আবার তোতলা।

    আবার ভাবল, যাক গাড়িটায় একটা কাজ হল আজ। শানুটাকেও যদি এনে ফেলা যেত। শানুটাই গাড়ি গাড়ি করে নেচেছিল।

    পেনোকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ওটাকে শ্রীযুক্ত নতুনকাকা আর শ্রীমতী নতুন খুড়ির হাতে সঁপে দিতে পারলেই মোটামুটি ছুটি। আহা বেচারি জনক-জননী, রোজ সেই খাবারের কৌটো হাতে হাসপাতালে ছোটা!

    ওটা মিটলেই শানুটাকে হিড়হিড় করে টেনে আনতে হবে। অহেতুক একটা হতচ্ছাড়া জায়গায় চাকরি নিয়ে মরেছে, একমাসে চিঠির জবাব এসে পৌঁছয় না। হোপলেস। বিহিতের দরকার।

    সর্ববিধ সমস্যার বিহিতের দায়িত্ব বাপীর ঘাড়েই এসে যাচ্ছে কেন, সে কথা জানে না বাপী। ভেবেও দেখেনি। শুধু জানে এইগুলো জরুরি। এইগুলো করতে হবে। ও রকম অভাগা জায়গা না হলে গাড়িটা নিয়েই চালিয়ে যাওয়া যেত। ড্যাম গ্ল্যাড হয়ে যেত শানু। বাড়িতে তো বাপী সেনের গাড়ি প্রায় অচ্ছুত! হুঁ আমার আদর্শবাদী পিতা অজানিত অন্ধকারলোকে থেকে আসা টাকায় কেনা গাড়িকে তো হরিজন তুল্য জ্ঞান করেন। ফার্স্ট ডে-তে অফার দিতে গিয়ে অ্যাইসান বেকায়দায় পড়েছিলাম উঃ! টাকা জিনিসটা যে আদৌ কারও নিজস্ব জিনিস নয়, যখন যাঁর কাছে চলে আসে তখন তাঁর, এই থিয়োরিটা এইসব বেচারি ওল্ডম্যানদের বোঝানো যাবে না।

    মা অবশ্য বলেছিল চড়বে। চড়ে একদিন দক্ষিণেশ্বর যাবে। কিন্তু সেই দুর্লভ অবকাশটুকু আর বার করতে পারছে না। আমার বিশ্বাস, টিপুটাকে পাওয়া গেলে পুজো-ফুজো দিতে যাবার মহান ইচ্ছা নিয়ে বসে আছে। জ্যেষ্ঠভ্রাতার অবশ্যই কোনও শুচিবাই নেই, তবে ইষ্টদেবীকে সঙ্গে না নিয়ে তো গাড়ি চাপার কোনও প্রশ্নই নেই। তা দেবী তো এখনও সিঁড়ি নামেন না।

    ছোড়দিটা যাই এসে পড়েছে, তাই ওটাকে আর বাচ্চাটাকে নিয়ে একটু শহর পয়লট্ট করে বেড়াই। শানুটা না এলে–ধেরি! বাপী সেনের আবার মন কেমন ব্যামোয় ধরল নাকি! ছ্যা ছ্যা!

    .

     ৫৯.

    বাপী চলে গেল, বন্দনা কতক্ষণ যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

    কোন পৃথিবীতে জন্মেছিলেন তিনি, কোন পৃথিবীতে বর্ধিত হয়েছিলেন, আর আজ কোন পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। ..এত অচেনা একটা জগৎ অলক্ষ্যে কখন তৈরি হয়ে চলছিল।

    তবু তখনও

    মোহভঙ্গ হতে বাকি ছিল।

    সগৌরবে ঘোষণা করেছিলেন তখন বন্দনা, তাঁর এই পুণ্যের সংসারে অনাচার ঘটাটা তাঁর অসহ্য। স্বপ্নেও ভেবেছেন কি, এই সংসারটাকেই পাতকগ্রস্ত বলে সংসারের আর এক সদস্য ঘৃণায় ধিক্কারে এটা ত্যাগ করে চলে যেতে উদ্যত।

    ভাবেননি, তাই অহংকার করে বলে উঠেছিলেন, আমার শাশুড়ির হাতে পাতা এই সংসার পুণ্যের সংসার।

    মোহভঙ্গ হল।

    বন্দনার বড়ছেলে তার বউকে সঙ্গে নিয়ে এসে, বলে উঠল, এই পাপগ্রস্ত সংসারে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব।

    রাত্রে শুতে যাবার আগে ভবদেব একগ্লাস জল খেয়ে তবে ছাদের ঘরে উঠে যান। বন্দনা সেই জলটাই দিতে এসেছিলেন। এই সময়টুকুই একটু অন্তরঙ্গ দৃষ্টি বিনিময়, সে দৃষ্টিতে ক্ষুধা হতাশা। ভাগ্যের উপর রুদ্ধ অভিমান।…

    অকারণ মানুষটাকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। যৌবনবতীরা যদি এই সংসার প্রপীড়িতা প্রৌঢ়া মহিলার এই ক্ষুব্ধ দৃষ্টি দেখে ফেলে, হয়তো হাসির ঢেউ তুলবে। কারণ তারা জানে, ভালবাসা শব্দটায় অধিকার শুধু যৌবনের।

    গ্লাসটা হাতে নিয়ে ভবদেব একটু গভীর স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আক্ষেপ আর যাচ্ছে না?

    বন্দনা কী বলতেন কে জানে, দরজায় দুটো ছায়া পড়ল। সামনের ছায়াটাই ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। খুব তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বাবা। এ বাড়িতে তো আর আমাদের থাকা চলে না। কাল সকালেই শিফট করার ঠিক করেছি।

    এক নিশ্বাসে একগ্লাস জল খেয়ে নেবার মতো করে কথাগুলো বলে ফেলল সুদেব।

    ভবদেবের বুঝতে অসুবিধে হল না, বেশ নার্ভাস হয়ে গেছে ছেলেটা।

    বুঝতে যে আর একজনও পেরেছে, তা তার আগুনঝরা দৃষ্টি দেখেই বোঝা গেল। ঝরতেই পারে, কীভাবে, যাকে সাদা বাংলায় পাখিপড়া করে বলে, সেইভাবে শিখিয়ে নিয়ে এল, বেশ ঠাণ্ডামাথায়, পরিষ্কার উচ্চারণে কাটা কাটা শব্দে ডাঁটের উপর বক্তব্যটা প্রকাশ করবে তা নয়, হাঁদার মতো তড়বড়িয়ে আধখানা রেখে, আধখানা বলে, ব্যাপারটাকে যেন গুবলেট করে দিল। তারপর? হল তো? কর্তা একখানা ধারালো ছুরি হানলেন তো?

    তা সত্যি! বাক্যটা একটু বোধহয় ধারালোই হল ভবদেবের।… প্রথমটা নয়, প্রথমে শুধু বললেন, শিফট করাটা যখন ঠিকই হয়ে গেছে, তখন আর বলার কিছু নেই। তবে কেন থাকা চলে না সেটা তোমাদের মাকে বলেছ?

    খোকা এখন একটু আত্মস্থ হল। সেই আগুনঝরা চোখের দিকে না তাকিয়েও আগুনটা অনুভব করছে তো। তাই এখন কেটে কেটেই বলল, মাকে আলাদা করে বলার কী আছে! দুজনকেই জানাচ্ছি, একটা খুনির সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

    খুনি!

    ভবদেব কিছু বলার আগে বন্দনা ছিটকে উঠলেন, খুনি মানে?

    খোকা আরও ধাতস্থ হল। বউয়ের সামনে যে অপদস্থটা হয়ে পড়েছিল, সেটা সামলে নিতে একটু বেশিই হল। বেশ থেমে থেমে বলল, আকাশ থেকে পড়লে মনে হচ্ছে। মানেটা তুমি জানো না? পেনোকে যে পিটিয়ে মেরেছিল, সে খুন হয়েছে, আর কার হাতে খুন হয়েছে জানো না? মহাদেব কাকার কাছ থেকে খাঁটি খবরটি জেনেই তবে বলা হচ্ছে।

    কিন্তু বন্দনা তো সত্যিই আকাশ থেকে পড়ে গেছেন। অথচ অজ্ঞাত একটা ভয়ে হাত-পা বুক ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কষ্টে বললেন, মহাদেবকাকা? সে তো আমাদের সঙ্গে কথাই কয় না।

    দরকার পড়লে কইতেই হয় মা। নতুনকাকা এখন স্বার্থেয় পড়ে খুনেকে সাপোর্ট করতে পারেন কিন্তু

    ভবদেব হাত তুলে থামালেন, আস্তে বললেন, ও কথা থাক। কথা হচ্ছে একটা খুনির সঙ্গে একবাড়িতে বাস করা তোমার পক্ষে অসম্ভব, এটাই জানাতে এসেছ তুমি? অথচ একজন খুনির সঙ্গে অনায়াসে একঘরে বাস করতে পারছ!

    তার মানে?

    খোকাও তীক্ষ্ণ হল।

    মানে না বোঝার কথা নয় খোকা।… এ সংসারে ভবদেব সেনের ভাবী বংশধরকে হত্যা করা হয়নি? সেটা একটা ঘৃণ্য অপরাধ নয়?

    হঠাৎ একটা সূক্ষ্ম চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেলেন ভবদেব।

    খোকা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত নেড়ে তাকে থামালেন, চলে যেতে বললেন।

    এখন একগ্লাস জল খেলেন ভবদেব, তারপর ছাদের ঘরে উঠে গেলেন। বন্দনা তাঁর পিছু পিছু যেতে যাচ্ছিলেন, তাঁকেও সেই ভাবেই নিঃশব্দে নিবৃত্ত করলেন। ওই চাপা সূক্ষ্ম হাসির দাহিকা শক্তি বড় তীব্র। অপমানের জ্বালা মেয়েরা যতটা সহজে সয়ে নিতে পারে, পুরুষের পক্ষে ততটা সহজে সম্ভব নয়, পুরুষ কিন্তু শোকে তাপে সর্বনাশেও অবিচলিত থাকতে পারে, সে অবিচলতা বজায় থাকে না অপমানে। ব্যঙ্গহাসির ওই সূক্ষ্ম সুরটুকু বড় বেশি বিচলিত করে ফেলেছে ভবদেবকে। এখন কথা অসহ্য। অসহ্য, যে কোনও মানুষের সঙ্গ।

    ঘুম আসা অসম্ভব।

    অনেকক্ষণ জেগে বসে থাকলেন ভবদেব, এক সময় খাতাটা খুলে লিখে রাখলেন, ওরা চলে যাচ্ছে। এটা আমার পক্ষে ভাগ্যের আশীর্বাদ। হয়তো আমাকেই একদিন চলে যেতে বলতে হত। সব অবস্থায় স্থির থাকব ভাবলেই কি সে শক্তি অর্জন করা যায়? অবিরত পৃথিবীর অসভ্যতার আঘাত, নির্লজ্জতার আঘাত, ধৃষ্টতা ঔদ্ধত্য আর নীচতার আঘাত, সেই শক্তির দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে চলে না?

    .

     ৬০.

    পানু নামের ছেলেটা বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল। তার মতো একটা হতভাগার জন্যে এযাবৎ তার বাপের সাধ্যের অনেক অতীত রাজকীয় চিকিৎসা চালানো হল, হল তার নিরাপত্তা আর নিশ্চিন্ততার জন্যে কল্পনার অতীত রাজকীয় ব্যবস্থা, তবু ছেলেটা এই বেইমানি করে বসল!

    ভাল হয়ে উঠছে, বাড়ি যাবার দিন গুনছে, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই একদিন ভরদুপুরে বিদঘুঁটে রকমের একটা কাশি কেসে, নার্সিংহোমের ধবধবে বিছানা লালে ভাসিয়ে, তার উপরই গড়িয়ে পড়ল।

    পড়ল ভিজিটিং আওয়ার্সের ঠিক আগেটাইতেই।

    গতরাত্রে টিপুকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মার কাছে জিম্মা করে দিয়ে পরদিন বাপী আহ্লাদের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে চলে এসেই সাত নম্বর কেবিনের দরজার পরদা সরিয়ে থমকে দাঁড়াল।

    রোগীর আপাদমস্তক সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা।

    টেবিলের ধারে একটা নার্স হেঁটমুণ্ডে একটা কাগজে কী যেন লিখছে।

    বাপী চড়া গলায় বলে উঠল, এ ঘরের পেশেন্টকে কোন ঘরে চালান করা হয়েছে?

    নার্সটা উঠে দাঁড়াল। বাপীর প্রতি তার কোনও প্রসন্নতা নেই। পেশেন্টের হামলাকারী আত্মীয়-টাত্মীয়দের প্রতি নার্সদের থাকেও না। গম্ভীরভাবে বলল, চালান করার কথা উঠছে কেন? ডেডবডি দেখতে পাচ্ছেন না? কিছুক্ষণ আগেই হি ইজ এক্সপায়ার্ড।

    কী? কী বললেন? চালাকি পেয়েছেন? দুদিন পরে রিলিজ অর্ডার পাবার কথা ওর

    নার্সটা আরও গম্ভীরভাবে বলল, তার আগেই রিলিজ অর্ডার পেয়ে গেল!

    চুপ। অসম্ভব। ঢাকা খুলুন।

    নার্সটা যেন একটা বিজাতীয় উল্লাসের মনোভঙ্গিতে সাদা চাদরের একটা কোণ তুলে ধরল।

    বাপী চোখ বুজল।

    বাপী ঝপ করে ঘুরে দাঁড়াল, চিৎকার করে উঠল, নেমকহারাম, বেইমান, ছোটলোক, শুয়োর–

    নার্সটা চোখ পাকিয়ে এসে কঠোর গলায় বলল, এসব আপনি কী বলছেন কি? যান ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান?

    বাপী দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল। প্রায় ছুটে গেটের বাইরে চলে গেল।

    নিশ্চয় এক্ষুনি নতুন খুড়িমা এসে গেট দিয়ে ঢুকবে হাতে খাবারের কৌটো নিয়ে। পিছু পিছু নতুনকাকা হাতে একটা ডাব ঝুলিয়ে।

    একদিন হেসে হেসে বলেছিল পানু, বুঝলে বাপীদা, একদিন বলেছিলাম ডাব খেতে ইচ্ছে করে, তারপর থেকে রোজ ডাবের জল খেয়ে মরতে হচ্ছে।

    বাপী কি সেই ডাব আর সেই খাবারের কৌটোর সামনে মুখোমুখি হবার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?…বাপীর কানের পরদা ফাটিয়ে দিয়ে সেই হাহাকারটাই তো ঢুকে পড়ছে বাপীর মাথার মধ্যে। আততায়ীরা মারবে বলে পানুকে ঘর থেকে টেনে বার করে নিয়ে যাওয়ায় তার মা-বাপের সেই দারুণ বীভৎস কান ফাটানো হাহাকার।…আর এখন? অদৃশ্য আততায়ী এসে পানুকে পৃথিবী থেকেই–

    মোড়ের কাছে গাড়ি পার্ক করা ছিল।

    গাড়ির দরজাটা দমাস করে, দুরন্ত বেগে বেরিয়ে গেল বাপী।

    .

    বাপীর চোখের সামনে ধবধবে বালিশের উপর চাপ চাপ জমে থাকা কালচে হয়ে ওঠা রক্তের রেখাটা ভেসে উঠছে, আর কেমন করে যেন লেকের একটা বেঞ্চের গা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

    আবার হঠাৎ সেই পুরনো প্রশ্নটা কোনখানে থেকে উঠে এল, দিগেন বিশ্বাসের মা বাপ আছে?

    বাপী সেন নামে একটা ঔদ্ধত্য, একটা চ্যালেঞ্জ কি শেষ পর্যন্ত যতসব বোকা কাপুরুষ, ভীরুদের মতো ভাবতে শুরু করবে বদলার হাত এড়াবার উপায় নেই।… কোনও এক অদৃশ্য আততায়ী ফিকিরে, ফেরে, সুযোগ মিললেই বদলা নিয়ে নিতে!

    বাপী কি সারারাত রাস্তায় ঘুরবে?

    বাপীর গাড়িতে কত তেল ভরা আছে?

    কিন্তু রাস্তার মোড়ে মোড়েই তো তেলের ভাঁড়ার।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএই তো সেদিন
    Next Article রাতের পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }