Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নীবারসপ্তক – কৌশিক মজুমদার

    কৌশিক মজুমদার এক পাতা গল্প246 Mins Read0

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ— জাবুলন

    প্রিয়নাথ পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। এতটা পথ, তাও রেলযোগে। ট্রেনে হাজার কিসিমের পেঁচাপেঁচি লোকের ভিড়। তায় আবার একটা ট্রেন মিস করলে পরের ট্রেন অনেকক্ষণ পরে। এই তাড়াহুড়ো প্রিয়নাথের না-পসন্দ। চুঁচুড়া যেতে বজরার চেয়ে ভালো কিছু হয় না। পুলিশের নিজের বোট বিভাগ থেকে একটা আট দাঁড়ের বজরা ভাড়া করলে এক বেলাতেই দিব্যি চুঁচুড়া পৌঁছে দিত। টমসন সাহেব সেই ব্যবস্থা করে দিলে প্রিয়নাথের নিজের রাহাখরচাও কিছু হত না। কিন্তু ওদিকে সাইগারসন সাহেব বারবার করে বলে দিয়েছেন পালকি বা বজরায় না যেতে। কেন কে জানে? স্ত্রী কলকাতায় নেই। বাসার চাকরটাও ছুটি নিয়েছে কদিন হল। স্পিরিট স্টোভ জ্বেলে কোনওক্রমে চাল ডাল চাপিয়ে অপটু হাতে খিচুড়ি বানিয়ে নিল প্রিয়নাথ। তাতেও বিস্তর দেরি হয়ে গেল। সাড়ে দশটায় হাওড়া থেকে প্রথম ট্রেন। দরজায় তালা মেরে রাস্তায় নেমে পকেটঘড়ি দেখল। নটা বেজে গেছে।

    একটু দূরেই রাস্তার মোড়ে ছ্যাকরা গাড়ির স্ট্যান্ড। ঘোড়াগুলো নিবিষ্ট মনে মিউনিসিপ্যালিটির লোহার ট্যাংক থেকে জল খাচ্ছে আর ছোলা চিবোচ্ছে। কোচোয়ানরা বিজাতীয় হিন্দি ভাষায় নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাশা করছে। চকচকে কালো রঙের ফার্স্টক্লাস ফিটন আর ব্রুহামগুলোকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল প্রিয়নাথ। এই ওয়েলার ঘোড়ায় টানা গাড়ি চড়ে আরাম, কিন্তু খরচায় বেজায় বেশি। মাইল প্রতি আট আনা। বরং লাল রঙের থার্ড ক্লাস ছ্যাকরাতে তিন আনায় প্রতি মাইল যাওয়া যাবে। দরদস্তুরের প্রশ্নই নেই। গাড়ির গায়ে এনামেলের প্লেটে ভাড়ার চার্ট লাগানো। এককালে এই দরদামের চোটে ঝগড়া, মারামারি এমনকি খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। তাই ইদানীং সরকার বাহাদুর গাড়ির কোচোয়ান আর মালিকদের সঙ্গে কথা বলে ভাড়া নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। দুটো ক্যাংলামতো দেশি ঘোড়া একটা থার্ড ক্লাস গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পা ঝাড়ছিল। কোচোয়ান ভিতরে করে মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে।প্রিয়নাথ গিয়ে হালকা ঠেলা দিল। “এই যে ভাই, হাওড়া স্টেশন যাব। চলো।”

    চোখ বন্ধ করেই অবলীলায় কোচোয়ান জবাব দিলে, “নেহি যায়েঙ্গে।”

    এই এক মুশকিল। উপরি ভাড়া না দিলে এদের নড়ানো যায় না। সরকার নানারকম চেষ্টাচরিত্র করেছে। আদেশ দিয়েছে কোনও যাত্রীকে ফেরানো যাবে না, কিন্তু সে কথা এদের কানে ঢোকায় কার সাধ্যি!

    প্রিয়নাথ গলা চড়াল। “পুলিশ, চল…”

    টকটকে লাল চোখে ধড়মড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমেই একটা সেলাম ঠুকল কোচোয়ান, “চলিয়ে সাব। কাঁহা যায়েগা?”

    “প্রথমে এখান থেকে ক্লাইভ স্ট্রিট, সেখান থেকে হাওড়া স্টেশন”, গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করতে করতে জবাব দিল প্রিয়নাথ

    “বহত খুব।”

    ক্লাইভ স্ট্রিটে এখনও অফিসযাত্রীদের ভিড় শুরু হয়নি। হবে আর খানিক বাদে। নিজের অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল তারিণী। দাড়ি কামানো। কিন্তু চোখের তলায় কালি। মনে হয় আগের রাতে ভালো ঘুমায়নি। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রিয়নাথ তাকে ডেকে নিল। গাড়ি এসে থামল গঙ্গার এপারেই। স্টেশন হাওড়ায় হলেও, টিকিট আড্ডা কলকাতাতেই। মিন্টের বাড়ির ঠিক পাশ ঘেঁষে। গাড়ি থেকে নেমেই তারিণী “দেখি ব্রিজ খোলা আছে না বন্ধ” বলে কোথায় যেন দৌড় দিল।

    বছর কুড়ি আগে কলকাতা থেকে হাওড়া যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়েছে এই ভাসমান পন্টুন ব্রিজ। তার আগে ট্রেন ধরতে হাওড়া যেতে গেলে রেলের স্টিমারই ভরসা ছিল। ব্রিজ হওয়াতে হাওড়া যাওয়া এখন অনেক সোজা। একের পর এক কাঠের ডেক জুড়ে ব্রিজ। জাহাজ গেলে মাঝের অংশ খুলে ফেলা হয়। তখন যাতায়াত বন্ধ থাকে। তারিণী সেইজন্যেই খবর নিতে গেল বোধহয়। প্রিয়নাথ গেল টিকিট কাউন্টারের দিকে। সেখানে গিয়ে দ্যাখে আর- এক নাটক চলছে।

    থার্ড ক্লাস বুকিং অফিসে প্রচুর লোকের ঠেলাঠেলি। ভিড় সামলাতে রেলের চাপরাশিরা মাঝে মাঝেই সপাসপ বেতের বাড়ি লাগাচ্ছে। লোকের তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই। এ ওকে ধাক্কা দিচ্ছে, মারছে, “গু খেগোর বাচ্চা” বলে গালি দিচ্ছে। শুধু শোনা যাচ্ছে, “মশাই শ্রীরামপুর!” “বালি বালি!” “আমাকে দুটো চন্দননগর দিন না।” টিকিটবাবু একটা টুলের উপরে বসে আছেন। সামনে একটা শতছিদ্র আমকাঠের টেবিলের উপরে খোপকাটা আলমারি। তার মধ্যেই টিকিটগুলো স্তরে স্তরে সাজানো। টিকিটবাবুও রেগে গিয়ে মাঝেমধ্যেই “চোপ রও”, “নিকলো” বলে চিৎকার করছেন আর হাতের লোহার স্ট্যাম্প দিয়ে টিকিটে তারিখ ছাপাচ্ছেন। ভুল হচ্ছে। শ্রীরামপুরের টাকা নিয়ে বালির টিকিট পেয়ে কেউ চিৎকার জুড়েছে, কেউ আবার টিকিটের দাম কেন বেশি, তা নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছে।

    প্রিয়নাথ দেখল এই লাইনে দাঁড়ালে আজ আর যাওয়া যাবে না। সে সেকেন্ড ক্লাসের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই লাইন অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। টিকিটের দামও বেশি। থার্ড ক্লাসে রিটার্ন টিকিটের সুযোগ নেই। এখানে আছে। দুই টাকা দিয়ে দুজনের দুটো রিটার্ন টিকিট কেটে পিছন প্রিয়নাথ দেখল তারিণী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

    “আমরা সেকেন্ড ক্লাসে যাচ্ছি?”

    “হ্যাঁ, কেন?”

    “আসলে কোনও দিন সেকেন্ড ক্লাসে চাপিনি কি না। চলুন স্যার, এখন জাহাজ নেই। ব্রিজ দিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু গাড়িতে যাওয়া মুশকিল।”

    “কেন?”

    “দেখে এলাম গোটা ব্রিজে গোরুর গাড়ির ভিড়। একটা গাড়িও নড়তে পারছে না। তাই গাড়ি ধরতে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়।”

    “বেশ”, বলে কোচোয়ানের ভাড়া মিটিয়ে দিল প্রিয়নাথ। এক আনা দিল। এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল যা হোক।

    ব্রিজে উঠে দেখল তারিণীর কথাই ঠিক। মালবোঝাই গোরুর সেতু ঠাসাঠাসি। তার উপরে ব্রিজের ধার বরাবর নানা খাবারের দোকান। সব মিলিয়ে পথচারীদের লবেজান। কোনওক্রমে ভিড় ঠেলে স্টেশনে পৌঁছে দেখল ট্রেন প্রায় ছাড়ে ছাড়ে। কিছুদিন আগে অবধিও হাওড়া স্টেশনে একটাই প্ল্যাটফর্ম ছিল। ইদানীং আরও দুটো নতুন প্ল্যাটফর্ম হয়েছে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ট্রেন দাঁড়িয়ে হুইসল মারছে। প্ল্যাটফর্মগুলো ছোট। তাই ইউরোপিয়ান ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীরা প্ল্যাটফর্ম থেকে গাড়িতে উঠতে পারে। থার্ড ক্লাসের পাঁচটা বগি প্ল্যাটফর্মের বাইরেই থাকে। ট্রেনের বগির তলায় তিন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। এতকাল ওইভাবেই ট্রেনে উঠেছে। এই প্রথম প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে উঠল। উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। কাঠের লম্বা বেঞ্চ। আসনের তলায় অনেকে ছোটো ছোটো নানা পণ্যসামগ্রী রেখেছে। যাঁদের মালের পরিমাণ বেশি, তাঁরা মালের জন্য আলাদা এক টাকা ভাড়া গুনেছেন। টিকিট চেকার সেগুলো মিলিয়ে নিচ্ছেন। সেকেন্ড ক্লাসে তেমন ভিড় না হলেও প্রায় প্রতিটা আসন পূর্ণ। ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনের একটা দোকান থেকেই সংবাদপত্র আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়েছিল প্রিয়নাথ। গম্ভীর মুখে সেই পত্রিকাটাই পড়তে লাগল। তারিণী খানিক উদাস চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর একটু আলগোছেই বলে উঠল, “আপনার স্ত্রী সন্তানরা আপনার কাছে নেই, ছোটোটা একেবারে শিশু। আপনার মনখারাপের কারণ আমি বুঝতে পারি।”

    চমকে উঠল প্রিয়নাথ। এসব তারিণী কীভাবে জানল?

    “তুমি কি আমার উপরেও গোয়েন্দাগিরি করছ নাকি হে? বেশি বাড়াবাড়ি করতে এসো

    না। সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেব”, বেশ বিরক্ত হয়েই বলল প্রিয়নাথ। হেসে ফেলল তারিণী, “আজ্ঞে বাচাল মানুষ, কখন কী বলে ফেলি ঠিক নেই। তবে আপনার আশঙ্কা ভুল। খানিক আগে আমি জানতামও না যে আপনি বিবাহিত।”

    “তবে? এ কথা বললে কীভাবে?”

    “অনুমানে। যেভাবে আমি অনুমান করতে পারছি যে আপনার চাকর কাম রাঁধুনিটি ছুটিতে গেছে, তাই ভোরে উঠে হাত পুড়িয়ে আপনাকেই খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে হয়েছে।”

    প্রিয়নাথের চক্ষু চড়কগাছ। এখন যা বলছে তা জানা তো কারও পক্ষেই সম্ভব না। গণপতির সঙ্গে থেকে তারিণীও কি জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে? বছর চারেক আগে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে সাইগারসন সাহেব এমনই অনুমান করে তাকে চমকে দিয়েছিলেন মনে আছে, কিন্তু নিতান্ত সাধারণ এই ব্যক্তি সেই ক্ষমতা আয়ত্ত করল কীভাবে?

    যেন প্রিয়নাথের মনের কথা বুঝতে পেরেই তারিণী বলল, “স্যার, আমিই বলি তবে। ছ্যাকরা গাড়িতে উঠে অবধি আপনি বারবার আপনার তর্জনীতে ফুঁ দিচ্ছিলেন আর বুড়ো আঙুল বোলাচ্ছিলেন। আঙুলে কাটা নেই, লাল হয়ে আছে, কিন্তু এখনও ফোসকা পড়েনি। মানে আঙুল পুড়েছে বটে, তবে বেশিক্ষণ আগে না। আজ সকালেই। সকাল সকাল কেন আপনার আঙুল পুড়ল ভাবতে ভাবতে আপনার পোশাকে চোখ পড়ল। সাদা শার্টের দুই জায়গায় হলুদ দাগ আর এক জায়গায় একটা চাল অবধি শুকিয়ে লেগে আছে। বোঝা গেল আপনার রাঁধুনিটি নেই। নিজেকেই রেঁধে খেয়ে আসতে হয়েছে। তারপরেই দেখলাম ফুলহাতা জামার ডানদিকের হাতার উপরে কালো বুট পালিশের দাগ। মানে জুতোটাও শেষ মুহূর্তে আপনাকেই পালিশ করতে হয়েছে। যে মানুষ নিজে নিজের কাজ করতে অভ্যস্ত তার এইরকম হবে না। এদিকে একই দিনে রাঁধুনি আর চাকর দুজনেই অনুপস্থিত সেটাও মেনে নেওয়া মুশকিল। ফলে সিদ্ধান্ত একটাই। দুজনে আসলে একই লোক। স্ত্রী বাড়িতে থাকলে এসবের প্রশ্নই উঠত না।”

    “আর বলো কেন? পরশু ছুটি নিয়েছে ব্যাটা। কাল আসার কথা ছিল। আজ সকাল অবধি পাত্তা নেই। কিন্তু আমি বিবাহিত সেটা বুঝলে কী করে?”

    “স্টেশনে আপনার কেনাকাটি দেখে। সংবাদপত্র কিনেই আপনি এক বোতল কুন্তলীন আর দেলখোস কিনলেন। স্ত্রীর মানভঞ্জনে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। কিন্তু তারপরেই আপনার মনে হল সন্তানদের কথা। আপনি একখানি খেলনা গাড়ি আর একটি ঝুমঝুমি কিনলেন।

    ফলে সিদ্ধান্ত, সন্তান নয়, অন্তত দুটি সন্তান আছে আপনার। আর আমার ধারণা সত্যি হলে বড়োটি পুত্রসন্তান। ছোটোটি সদ্যজাত। হয়তো সেইজন্যেই আপনার স্ত্রীকে এখন তাঁর বাপের বাড়ি থাকতে হচ্ছে। সামনেই অক্ষয় তৃতীয়া। আপনার বাড়ি যাবার কথা ছিল। সদ্য জানতে পেরেছেন হয়তো যাওয়া হবে না। তাই স্ত্রীর মানভঞ্জনের জন্য এসব কিনে নিলেন।” প্রিয়নাথের বিস্ময়ভাব কাটেনি। অস্ফুট স্বরে সে শুধু বলতে পারল, “ধন্য তুমি, ধন্য তুমি তারিণী। আমাদের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট জানে না তারা তোমার মতো হিরের টুকরোকে হারাল। আমি টমসন সাহেবের কাছে তোমার হয়ে তদ্বির করব।”

    ম্লান একটা হাসি ফুটে ওঠে তারিণীর মুখে, “আপনি চার বছর পরে আমাকে স্মরণ করেছেন সেটাই আমার ভাগ্যি! এর বেশি কিছু চাওয়া আমার পক্ষে বাতুলতা।” এদিকে গাড়ি শেওড়াপুলি পেরিয়েছে। ট্রেনের কামরা ভিখিরিদের খোল করতালের গানে মেতে উঠেছে—

    আয় গো আয় মোহান্তের তেল নিবি কে
    হুগলির জেলখানায় তেল হতেছে।
    এ তেল এক ফোঁটা ছুঁলে, টাক ধরে না চুলে
    বোবায় মাখলে কথা, বাঁজার হয় ছেলে।

    কুড়ি বছর হয়ে গেল। কেচ্ছার শেষ হল না। বাবু নবীনচন্দ্রের সুন্দরী বউ এলোকেশীকে দেখে তারকেশ্বরের মোহান্ত মাধব গিরির দেহে মদন-আগুন জ্বলে উঠল। নবীনের অনুপস্থিতিতে মোহান্ত এলোকেশীর সতীত্ব নাশ করে। এলোকেশীও মোহান্তের দিকে ঢলে পড়ে। মোহান্তের হাত থেকে বউকে রক্ষা করতে নবীন আঁশবটি দিয়ে এলোকেশীর মাথা কাটে। বিচারে মোহান্তের জেল হয়। সেই কাহিনি এখনও মুখে মুখে ফেরে। গানের সঙ্গে আবার কেউ কেউ টাকে চুল গজানোর তেল বেচে, কেউ আবার বেচে বটতলার বই “মহন্তের এই কি দশা!!” এক আনা দিয়ে একখানা বই কিনেই নিল প্রিয়নাথ। কিন্তু পড়তে শুরু করার আগেই তারিণী তাড়া দিল।

    “উঠুন স্যার, চন্দননগর এসে গেছে। এরপরেই চুঁচড়ো। গাড়ি মাত্র এক মিনিট থামবে।”

    চুঁচুড়াতে নেমে চিঠির ঠিকানায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল তারিণী। “এ আমার চেনা বাড়ি।। চলুন”, বলে প্রিয়নাথকে পালকির আড়ার দিকে নিয়ে চলল। পালকি বেহারারা তারিণীর পুর্বপরিচিত। ফলে মাত্র তিন আনায় রাজি হয়ে গেল। তারিণী পালকি নেবে না। সে পাশে পাশে হেঁটে যাবে।

    পালকিতে মিনিট দশেক যেতেই সাদা বড়ো বাড়িটা চোখে পড়ল প্রিয়নাথের। গঙ্গার একেবারে ধারেই সাহেবি বাড়ি। সামনে বাগান। পোর্টিকো। তবে কলকাতার সাহেবি বাড়ি থেকে একটু অন্যরকম। অন্য ধাঁচের। পাশেই সুন্দর একখানা পার্ক।

    “এই বাড়ি একশো বছরের বেশি পুরোনো। এক ওলন্দাজ সাহেবের বানানো। ইংরেজরা এককালে এই বাড়িতে স্বাস্থ্য উদ্ধারে আসতেন। মাঝে কিছুদিন সংস্কারের কাজে বন্ধ ছিল….” হাঁটতে হাঁটতেই জানাল তারিণী।

    এখানকার গরম কলকাতার চেয়ে কম। কারণ হয়তো গঙ্গার হাওয়া। এত জোরে হাওয়া বয় যে পাড়ে বসে থাকলে হাওয়ার আওয়াজে অন্য কোনও কথা শোনা যায় না। গেটের সামনে পালকি নামাল বেহারারা। সদরে বল্লম হাতে পাইক দাঁড়িয়ে। প্রিয়নাথ নিজের নাম বলতেই রাস্তা ছেড়ে দিল। বোধহয় তাদের আসার খবর আগাম বলা ছিল। সামনের কেয়ারি করা বাগানে নানারকম বিদেশি ফুল ফুটে আছে। মাঝে মাঝে মার্বেলের নারীমূর্তি। সেসব পেরিয়ে মূল দরজায় যেতে এক নেটিভ চাকর তাদের দিকে দৌড়ে এল। সাইগারসন সাহেব কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই একেবারে বশংবদ হয়ে “এদিকে আসুন। সাহেব সবে ঘুম থেকে উঠে ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করছেন” বলে বাড়ির অন্যপাশে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সাহেবি আমলের পুরোনো বাড়ি। দেওয়াল খুব মোটা আর ছাদ খুব উঁচু। চারিদিকে আমবাগান হবার জন্য ভিতরটা বেশ ঠান্ডা। খাবার ঘরে বিরাট বড়ো সেগুন কাঠের টেবিলের একপ্রান্তে সাহেব বসে ব্রেকফাস্ট সারছিলেন। টেবিলে থরে থরে খাবার, ফল, ফলের জুস সাজানো। সাহেব অবশ্য এসব কিছুই মুখে তুলছেন না। তিনি একমনে পাশের একটা প্লেটে একফালি বাঁকা চাঁদের মতো পাউরুটিতে গোলাপি জেলি মাখিয়ে খাচ্ছেন। পাশেই লম্বা ডাঁটিওয়ালা রুপোর কাপে একটা কাঁচা ডিম রাখা। সঙ্গে চামচ। রুটির পরেই সাহেব এই ডিম ভেঙে খাবেন। প্রিয়নাথদের দেখেই একগাল হেসে উঠে দাঁড়ালেন সাইগারসন। প্রিয়নাথ আগের দিন সাহেবের তামাক কিনে এনেছিল। সাহেব তা পেয়ে দারুণ খুশি। প্রিয়নাথ আর তারিণীকে বললেন তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে। প্রিয়নাথ বেশি কিছু খেল না। তারিণী বোধহয় কিছু খেয়ে আসেনি। সে গোগ্রাসে গিলতে লাগল। খাবার টেবিলে মাথায় একটা চৌকো পাখা ছাদ থেকে ঝুলছে। ঘরের একধারে এক ভৃত্য দাঁড়িয়ে। সে একবার পাখার দড়িটা টানছে, আর ছাড়ছে, যেমনভাবে লোকে ঘণ্টা বাজায়।

    প্রিয়নাথ দেখল এবার কাজের কথায় আসা উচিত। বলল, “কিছু জরুরি কথা ছিল সাহেব। জরুরি আর গোপনীয়। টমসন সাহেব আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেছেন। তারিণী বরং এখানে খেতে থাক, আমরা নাহয় অন্য ঘরে…”

    “আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে অফিসার। আমি তারিণীকে আপনার পথপ্রদর্শক হিসেবে আসতে বলিনি। বরং আপনাকেই অনুরোধ করেছি তারিণীকে নিয়ে আসতে। আমার প্রয়োজন আপনার সঙ্গে যতটা, তার সঙ্গে অণুমাত্র কম নয়।”

    প্রিয়নাথ অবাক। তারিণীর দিকে তাকিয়ে দেখল তারও খাওয়া বন্ধ। সেও অবাক চোখে সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। সাইগারসন চোখের ইশারা করলে পাঙ্খাবরদারটি সেলাম ঠুকে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। যাবার আগে বন্ধ করে গেল ঘরের ভারী দরজাটা।

    এবার সাইগারসন নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে বসলেন তারিণীর ঠিক উলটো দিকের চেয়ারে। পকেট থেকে একটা ব্রায়ার রুট পাইপ বার করে তাতে প্রিয়নাথের আনা তামাক ভরতে ভরতে তারিণীর দিকে তাকিয়ে সরাসরি তাকেই প্রশ্ন করলেন সাইগারসন “তারিণী, যা বলবে সত্যি কথা বলবে। যদিও আমি বিশ্বাস করি তুমি মিথ্যে বলতে পারবে না। তবু বলছি, যা জানো, যতটুকু জানো, গোটাটাই আমায় বলো। কিচ্ছু গোপন করলে মহা বিপদ।”

    তারিণীর খাওয়া বন্ধ। পাশেই কাচের পাত্র থেকে গেলাসে জল ঢেলে মুখের খাবারটা কোনওক্রমে গিলে ফেলে তারিণী প্রশ্ন করল, “বলুন সাহেব, কী জানতে চান আপনি?”

    “জাবুলনদের নিয়ে তুমি কী জানো?”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিনিরয় – কৌশিক মজুমদার
    Next Article আঁধার আখ্যান – কৌশিক মজুমদার

    Related Articles

    কৌশিক মজুমদার

    নোলা : খাবারের সরস গপ্পো – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    সূর্যতামসী – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    আঁধার আখ্যান – কৌশিক মজুমদার

    August 4, 2025
    কৌশিক মজুমদার

    অগ্নিনিরয় – কৌশিক মজুমদার

    August 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.