নীরবে তোমায় দেখি
ব্লু জিন্সের ওপরে লালচে কালারের শর্ট কুর্তিটা পরে বাসে উঠতেই বন্ধুরা লাফিয়ে উঠল, শেষ পর্যন্ত কাকু আসতে দিল? ইস! বিয়াস, তুই না এলে ট্যুরটা কমপ্লিটই হত না।
কলেজে ট্যুরের টাকা জমা দেবার পরে, ফর্ম ফিলাপের পরেও বাপি বেঁকে বসেছিল। কারণ একটাই, ছেলেরাও তো ট্যুরে যাবে! দুহাজার উনিশে দাঁড়িয়ে বিয়াসকে এটা শুনতে হবে ও ভাবেনি। তাই বিরক্ত হয়ে বলেছিল, প্লিজ বাপি, তুমি সেই প্রাচীনপন্থীদের মতো কথা বলো না। এদিকে মুখে তুমি সাম্যের গান গাইছ, আলোচনা সভায় গিয়ে ছেলে, মেয়েদের সমান অধিকারের দাবি তুলছ, আর নিজের মেয়ের বেলায় বলছ, ছেলেদের সাথে কলেজ ট্যুরে যেতে হবে না। বিয়াস কায়দা করেই গৌরীশংকরবাবুকে রাজি করিয়েছে।
বয়েসকালের একমাত্র সন্তান বলেই বোধহয় বাপির বিয়াসকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা।
বিয়াসের মায়ের দুটো সন্তানই গর্ভে মারা গিয়েছিল।
ডাক্তাররা বাচ্চার আশা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন, সেই অবস্থায় বিয়ের প্রায় এগারো বছর পরে বিয়াস জন্মেছিল। তাই গৌরীশংকরবাবু আর ইন্দিরাদেবীর কাছে বিয়াস সাত রাজার ধনের মতো। কিন্তু এই অতিরিক্ত আদরটাই বিয়াসের একেবারে নাপসন্দ। সেই মাধ্যমিক থেকে বাবা-মায়ের সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছে বিয়াস। ওর মাধ্যমিকের পরীক্ষার দিনগুলো বাপি আগেভাগে অফিসে ছুটি নিয়ে নিত। পরীক্ষা হল থেকে বেরোলেই হাতে ডাব ধরিয়ে বলত, প্রচুর কষ্ট হয়েছে না রে মামনি? খেয়ে নে। বন্ধুদের হাসি আর টিপ্পনী শুনেও বাপি বলত, ওসব কানে নিস না। এই নিয়ে ঝগড়া চলত মা, বাপির সাথে। কেন তোমরা আমায় বড় হতে দেবে না! এটাই বিয়াসের একমাত্র দাবি ছিল। অনেক বলে বলে একটু পরিবর্তন হলেও, ওকে নিয়ে পজেসিভনেস কমেনি বাপির। তাই কলেজ ট্যুরে দীঘা যাওয়ার কথা শুনে প্রথমেই বারণ করে দিয়েছিল। সাথে এও বলেছিল, আমি দিন দুয়েকের মধ্যেই সিমলার টিকিট কাটছি। আমরা তিনজনে ঘুরে আসব।
বিয়াস রেগে গিয়ে বলেছিল, না আমি সিমলা যাব না। আমি ফ্রেন্ডদের সাথে দীঘাই যাব। সেদিন থেকে বাড়ির পরিবেশে চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। বিয়াসের আড়ালে বাপি-মা এই ট্যুর নিয়ে অনেক আলোচনাও করেছে। শেষ পর্যন্ত মা রাজি হলেও, বাপি কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বাপির এই পজেসিভনেসের জন্যই এখনো অবধি একটাও প্রেম করে উঠতে পারেনি বিয়াস। ক্লাস ইলেভেনে পাশের বাড়ির বিপুলদাকে খুব ভালো লেগেছিল। প্রায়ই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিপুলদার ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকত। বিপুলদাও ধীর পায়ে এসে দাঁড়াত ওদের বারান্দাতে।
দিন সাতেক পরে হঠাৎ বিয়াস খেয়াল করল, ও ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই বিপুলদা ভয়ে নিজের ঘরের জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিপুলদার কি হয়েছে বোঝার আগেই মানদাপিসি বলেছিল, তোমার বাবা গিয়ে বিপুলকে খুব বকে এসেছে গো। আমি ছাদ থেকে দেখেছি কাপড় মেলতে মেলতে। তাই ওই ছেলেটা ভয়ে আর তোমার দিকে তাকাচ্ছে না।
সেদিন থেকে বিয়াস বুঝেছিল, প্রেম ওর কপালে জাস্ট নেই। বাপি,মায়ের আদরের অত্যাচারে, অকারণ শাসনে ওকে বাঁচতে হবে। তাই বিয়াসও নতুন স্ট্রাটেজি আবিষ্কার করেছে। ও কাঁদছে দেখলেই বাপি গলে গিয়ে সবেতে রাজি হয়ে যায়। সেই কান্না আর কিছু যুক্তিকে সামনে রেখেই দীঘা যাওয়ার প্ল্যানটাকে সাকসেসফুল করেছে বিয়াস। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে বাপিকে। রাজি বলা চলে না, কিছুটা নিমরাজি। ওতেই চলবে ভেবে প্যাকিং কমপ্লিট করেছিল বিয়াস। বেরোনোর সময়েও বাপির মুখে চাপা অভিমান দেখেছিল। বাচ্চাদের মতো ঠোঁটটা ফুলিয়ে বলেছিল, দেখো বন্ধুদের মাঝে যদি বাপিকে মনে পড়ে তো দু-একটা ফোন করো। বিয়াস বাপির চুলগুলো এলোমেলো করে বলছিল, আর তো বছর দুয়েক পরে তোমার রিটায়ারমেন্ট, এবার তো একটু বড় হও প্লিজ। নিশ্চয়ই ফোন করব, তুমি মন খারাপ করবে না। মাত্র দুদিন তো। মা মাথায় হাত রেখে বলেছিল, মেয়েবেলার স্বাধীনতা উপভোগ করে নে প্রাণ ভরে।
সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে বিয়াস। নামের সাথে ওর চরিত্রের বড্ড মিল। বিপাশা নদীর মতোই ও খরস্রোতা। পাথরে ধাক্কা খেয়েও যার গতি দুর্বল হয় না। বন্ধুরা বলে, বিয়াসকে নদী না বলে ঝর্ণা বলা বেস্ট। ছিপছিপে চেহারার বিয়াসের মুখে এখনো পর্যন্ত কেউ দুঃশ্চিন্তার ছায়া দেখেনি। পড়াশোনা ভালোই করে, তবে ভীষণ সিরিয়াস নয়। দু-নম্বর কম পেলে রিভিউ করার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া স্টুডেন্টের দলে পড়ে না ও। বরং নাচ নিয়ে একটু বেশিই পজেসিভ। নাচের গুরুকে নিয়ে কেউ কুকথা বললে, বিয়াস তাকে দুটো থাপ্পড় ধরিয়ে দিতেই পারে। এমনিতে বিয়াস খুব হাসিখুশি কিন্তু রেগে গেলে ও ভয়ঙ্কর। বন্ধুরা সবাই ওর সব গুণগুলোই জানে, তাই ওকে একটু সমঝে চলে। পিঠের ব্যাগটা ওপরের বাংকে তুলে সিটে বসতেই, গদিওয়ালা সিটের নরম ভাবটা অনুভব না হয়ে বরং একটু শক্ত লাগল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো, ওর সিটে একটা মোবাইল ফোন পড়ে আছে। স্ক্রিনের সাইজ সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি। নামি কোম্পানির মুঠোফোন। ফোনটা খুলেই দেখল পাসওয়ার্ড অবধি নেই।
মনে মনে বলল, কি কেয়ারলেস রে বাবা। নিজের মোবাইলটাও সামলে রাখতে পারে না এমন পাবলিকও তার মানে কলেজে আছে। বিয়াসের কাছে তো ওর স্কাই ব্লু নতুন মোবাইলটা ভীষণ প্রিয়।
মা বলে, দিনরাত কি যে খুট খুট করিস। ফেসবুক, হোয়াটসআপ, অনলাইনে শপিং সবই তো এই মোবাইলটা থেকেই। এমনকি বাড়িতে কম্পিউটার থাকা সত্ত্বেও ওর প্রিয় সিনেমা ও মোবাইলেই দেখে। তাই কারোর মোবাইল এমন পড়ে থাকতে দেখে অবাকই হয়েছিল বিয়াস।
মোট তিনটে বাসে ওরা স্টুডেন্টরা যাচ্ছে, আরেকটাতে প্রফেসররা। তবে প্রতি বাসে দুজন করে প্রফেসরও আছেন। তুলনামূলক কম বয়েসি লেকচারাররা আছেন স্টুডেন্টদের বাসগুলোতে। বিয়াস উঠতেই কুণাল বলল, খুব ইচ্ছে ছিল, আমাদের কেমিস্ট্রির বিমানবাবু আমাদের বাসেই যাবেন। সারা রাস্তা কোয়ান্টামের ফর্মুলাগুলো বুঝতে বুঝতে যাব।
বাস শুদ্ধু সকলে হেসে উঠল। কারণ একটাই, কুণালকে বিমানবাবু মোটেই সহ্য করতে পারেন না। অকারণ অবান্তর প্রশ্ন করে আসল পড়ায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যই কুণাল মার্ক হয়ে গেছে বিমানবাবুর চোখে।
রিতেশ বলল, স্যার বোধহয় তুই এই বাসে আছিস দেখেই পালিয়েছেন। স্যারের বিপি বাড়িয়ে দিবি তুই।
বিয়াসদের বাসে এখনো কোন প্রফেসর আছেন, সেটা দেখেনি বিয়াস। তার আগেই ওর সিটে এই ফোনটা!
ফোনটা নিশ্চয়ই এই বাসে করে যাচ্ছে এমনি কারোর।
পাশ থেকে মালবিকা বলল, কি রে অমন বিরক্ত হয়ে রয়েছিস কেন! বিয়াসের পাশে যে মালবিকা বসবে এটা বন্ধুরা জানে। তাই মালবিকার পাশের সিটটা সবাই ফাঁকা রেখেছিল। বিয়াস বলেছিল, লাস্ট মুহূর্তে বাপিকে রাজি করিয়েও ঠিক পৌঁছে যাব। তাই আমার সিট রাখবি।
বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই মালবিকার ফোনে মেসেজটা ঢুকেছিল, আসছি রে। আমাকে ছাড়া বাস স্টার্ট করবি না।
বিয়াসের সাথে ওর বন্ধুত্ব সেই ইলেভেন থেকে। একে অপরকে এতটাই চেনে যে অনেক কথাই মুখে না বললেও, ওরা বুঝে যায়। এই যেমন অন্য বন্ধুরা যখন বলছিল, বিয়াস বোধহয় আসবে না। তখন মালবিকার মন বলছিল, বিয়াস আসবে। তাই বিয়াসকে দেখে সকলে চমকে গেলেও মালবিকার মুখে হালকা হাসির রেখা ছুঁয়ে গিয়েছিল। মনে মনে বলেছিল, জানতাম আসবি।
মালবিকা বলে, আমি বিয়াসকে খুব ভালো করে চিনি। আর বিয়াস বলে, সব বন্ধুর মধ্যেও বেস্টফ্রেন্ড বা বেস্টি বলে যদি কেউ থাকে সেটা মালবিকা। ও আমার বেস্টি।
তো সেই বেস্টির দিকে তাকাতেই বিয়াস বলল, তুই নতুন মোবাইল কিনেছিস আর আমায় বলার প্রয়োজন মনে করিস নি? আমি একটা মাথার ক্লিপ কিনলেও তোকে জানাই মালবিকা!
মালবিকা আকাশ থেকে পড়ার মুখ করে বলল, আমি ফোন কিনেছি? কই না তো। কথা বলেই নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে বলল, এই দেখ, আমার গতবছরের ফোন। যতদিন চলবে একে আমি আগলে রাখব। এতে আমাদের দুজনের কত স্মৃতি আছে বলত। কত ছবি, কত মেসেজ। এমনকি নির্ঘুম রাতের খিল্লি অবধি আছে নিশ্চিন্তে সেভ করা। তাই একান্ত খারাপ না হলে একে বাতিল করার ইচ্ছে আমার নেই রে বিয়াস।
বিয়াসের দুই ভ্রুর মাঝে চিন্তার চাপ। সুন্দর মুখটায় দুঃশ্চিন্তায় ছায়া।
মালবিকা বলল, কি রে কি হয়েছে?
বিয়াস ফোনটা দেখিয়ে বলল, তুই দেখিসনি, এটা আমার সিটে পড়েছিল!
মালবিকা বলল, আমি তো তুই আসছিস কিনা দেখার জন্য জানালার ধারে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম, খেয়াল করিনি তো। তবে আমি যখন এই সিটটাতে বসলাম তখন তো ছিল না মনে হচ্ছে।
বিয়াস একটু চিন্তিত মুখে বলল, যদি বাসের কারো হয় তো ভালো, আর যদি অন্য বাসের কারোর হয় তাহলে এখন খুঁজে বের করতে হবে।
মালবিকা বলল, আমাদের তো কলেজ থেকেই বলে দিয়েছিল, গড়িয়ার এই স্ট্যান্ডে চারটে বাস থাকবে, আমরা এসে যে যার সিটে বসব। তাই আমাদের সিটে তো ফোন পড়ে থাকার কথা নয় রে!
বিয়াস একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, তুই কি বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে এলি?
মালবিকা বলল, না ছোটদা বাইকে করে দিয়ে গেল।
তুই কিসে এলি?
আমি বাড়ির গাড়িতে। বাপি আসতে চেয়েছিল, আমি বলেছি, প্রফেসররা গার্জেন অ্যালাও করবেন না। এসব ঢপ দিয়ে আসতে হয়েছে। বাপিকে নিয়ে আসলে হয়তো, একই বাসে ছেলেমেয়ে যাচ্ছে দেখে আমাকে আবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেত। বাপি জানে মেয়েরা আলাদা বাসে যাবে।
মালবিকা হেসে বলল, বিয়াস, তুই পারিস বটে!
কি করব বল, এখনো ছেলেমানুষি করলে, এমন বলতেই হবে। কিন্তু এই ফোনটা কার?
মালবিকা ফোনটা হাতে নিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
এই বিয়াস, তুই আমাকে বোকা বানাচ্ছিস?
এটা তো তোর মোবাইল রে। দেখ, হোম স্ক্রিনে তোর ছবি।
বিয়াস চমকে উঠে ফোনটা নিয়ে দেখলো, হ্যাঁ হোমস্ক্রিন জুড়ে ওর হলদে ওড়না উড়ছে।
সম্ভবত কলেজের গেটের সামনে তোলা। ছবিটার বয়েস তা প্রায় মাস পাঁচেক তো হবেই। এটা সেকেন্ড ইয়ারের ছবি নয়।
মালবিকা আবার ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো, এই কবে কিনলি রে! কত পড়ল? আগের কিউটটা আছে তো! ওতে কিন্তু আমাদের অনেক মোমেন্ট বন্দি করা আছে। বিক্রি করবি ভাবলে, আগে আমায় ওগুলো সেন্ড কর।
বিয়াস অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, বিশ্বাস কর মালবিকা, এটা আমার মোবাইল নয়। বন্ধুদের কেউ ইচ্ছে করে এভাবে বোকা বানাচ্ছে।
গ্যালারি ওপেন করতেই, বিয়াসের নানা অঙ্গভঙ্গির ছবি।
এমনকি কলেজ গেটের বাইরে হাঁ করে ফুচকা খাওয়া অবধি। ফেস্টের নাচের ছবিতে পুরো গ্যালারি ভর্তি।
এমনকি ক্লাসে একমনে বিয়াস লিখছে, তার ছবিও এই মোবাইলটাতে আছে। বিয়াস নিজে বোধহয় ওর এত ছবি তোলেনি কোনোদিন।
মালবিকা একটু সেলফি পাগল আছে। তাই ও ছবিগুলো দেখে এক্সাইটেড হয়ে বলল, এই বিয়াস, কি দারুণ ছবি তোলার হাত রে। তুই ঘামে ভিজে চুলগুলো কপাল থেকে সড়াচ্ছিস, তার ছবিটাও কি সুন্দর তুলেছে রে।
একে দিয়ে আমাদের ট্যুরের ছবিগুলো তোলালে হয়। ফেসবুকে পোস্ট করা যাবে। মালবিকা বরাবরই এমন হালকা স্বভাবের। কিন্তু বিয়াসের কপালে চিন্তার রেখা।
সিটে বসে মালবিকার বকবক শুনতে শুনতেই ফোনটা ঘাঁটছিল বিয়াস। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়!
গোটা গ্যালারিতে ওর অন্তত গোটা কুড়ি-পঁচিশ ছবি। আর কন্ট্যাক্ট নম্বরে বিয়াসেরই দুটো নম্বর।
একটার পাশে লেখা-নদী।
আরেকটার পাশে, দামাল বিয়াস।
অবশ হয়ে আসছিল বিয়াসের হাত।
এটা কার ফোন! ভাবনার মধ্যে গভীর ভাবে ডুব দিল বিয়াস। কলেজের প্রথম দিন থেকে মনে করলে তিনজনের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে।
এক- ওদের ডিপার্টমেন্টের সৌরনীল। যে অকারণ গোটা ক্লাস জুড়ে বিয়াসের দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এখনো অবধি একই ডিপার্টমেন্টে পড়েও সৌরনীলের সাথে পরিচয় হয়নি বিয়াসের। ছেলেটার দিকে বিয়াস যে কদিন তাকিয়েছে, সে কদিন মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকানোর চেষ্টা করেছে। একদিন মালবিকা বলেছিল, হ্যাঁরে সৌর, তুই বিয়াসের দিকে তাকিয়ে কি দেখিস!
সৌর নাকি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল, ওকে দেখি। ওকে আমার খুব ভালো লাগে। মালবিকা বলেছিল, প্রোপোজ করে দে।
সৌর নাকি ঘেমে নেয়ে তুতলে বলেছে, বিয়াসকে আমার বড্ড ভয় করে।
বিয়াসের অবশ্য এমন ভিতু টাইপের হাঁ করা ছেলে দু-চোখের বিষ। তাই সৌরনীলকে নিয়ে কোনোদিন ভাবেনি বিয়াস। বরং বন্ধুদের বলেছে, কিছুদিন পরে আমি টাকা দেব, সৌরনীলকে তোরা চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস। এভাবে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখের মধ্যে ফ্লুইড কমে যাবে, তখন ড্রপ দিতে হবে। সৌরনীল নাকি বিয়াসের কথাটা শুনে বলেছিল, বিয়াসকে দেখতে দেখতে আমি অন্ধ হতে চাই।
এমন ন্যাকা মার্কা কথাবার্তা বিয়াসের অসহ্য লাগে। তাই সৌরনীলের তাকানোকে ও মোটেই পাত্তা দেয়নি। সামনে বলতে ভয় পায় বলেই কি এ এভাবে ফোন ফেলে রেখেছে বিয়াসের সিটে। অনেকের মতো ও জানত, বিয়াস মালবিকার পাশেই বসবে। তিনটে সিট পরেই সৌরনীল বসে আছে, তাকিয়ে দেখল বিয়াস। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিল। আর চোখদুটো বিয়াসকে খুঁজছিল বোধহয়। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে যাচ্ছিল।
সৌরনীল বাদে আরো দুটো নাম মাথায় এল বিয়াসের।
দ্বিতীয় নামটা হল, কলেজ ইউনিয়নের লিডার অর্পণ মল্লিক। কলেজের ফার্স্ট ডে থেকে বিয়াসের প্রতি যে ওর চাপ আছে, সেটা বিয়াস বেশ বুঝতে পেরেছিল।
যতই অ্যাটিটিউড দেখাক, বিয়াসকে দেখলেই ওর কথাবার্তা একটু হলেও আড়ষ্ট হয়ে যায়। আর বিয়াসের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখনই সচেতন করে বলে, বিয়াস, সাবধান। অর্পণ নাকি পাঁচ বছর ধরে এই কলেজের জিএস। কলেজ কর্তৃপক্ষও নাকি চেষ্টা করে ওকে পাশ করাতে পারছে না। পাশ করে নিজের কেরিয়ার গোছানোর থেকেও জিএস থাকাটা বোধহয় ওর কাছে বেশি সম্মানের। বড়লোকের বখে যাওয়া টাইপ ছেলে এই অর্পণ। বেশিরভাগ সময় কেয়ারলেস বিউটিতে বিশ্বাসী।
কে বলে কেয়ারলেস বিউটি কথাটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য! কিছু কিছু সময় তো ছেলেরাও এলোমেলো, উদাসীন টাইপের সুন্দর হবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। যেমন অর্পণ ফেডেড জিন্সের ওপরে খাদির পাঞ্জাবি পরে আর ট্রিম করা হালকা দাড়ি, মাথায় এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে সকলকে বোঝাতে চায়, নিজের সম্পর্কে ও কতটা উদাসীন। কিন্তু বিয়াস খেয়াল করে দেখেছে, কথা বলতে বলতে অর্পণ ওর আঁচড়ানো চুলটাকে ইচ্ছে করে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বিয়াস এইধরনের পাবলিককে আঁতেল বলে। কথায় কথায় ফ্রয়েড আউড়ায় আর কার্ল মার্কস, লেনিনের মতাদর্শ নিয়ে বড় বড় লেকচার ঝাড়ে, ঠোঁটের ডগায় থাকে দামি সিগারেট…এই অর্পণকে বিয়াস জাস্ট ইগনোর করেছে।
কলেজের ফার্স্ট দিনই অর্পণ এসে বলেছিল, কোনো ছেলে যদি কখনো বিরক্ত করে তো একবার শুধু অর্পণ মল্লিককে ডাকবে, ব্যাস। বলার ভঙ্গিমায় অহংকার সুস্পষ্ট ছিল। বিয়াস হাসি মুখে বলেছিল, বোধহয় ডাকার প্রয়োজন হবে না। অর্পণের চোখের বিস্ময়কে উপেক্ষা করেই বিয়াস বলেছিল, ওইটুকু বিরক্তির উত্তর দেবার মতো ক্ষমতা বিয়াস চ্যাটার্জির আছে। তাই টেনশন করবেন না দাদাভাই।
অর্পণ তাড়াতাড়ি শুধরে দিয়ে বলেছিল, দাদাভাই নয়, আমাকে অর্পণদা বলে ডেকো।
বিয়াস আরেকটু হেসে উত্তর দিয়েছিল, যদি কখনো সত্যিই ডাকার দরকার হয়, তাহলে অবশ্যই দাদাভাই বলে ডাকব। অর্পণের নিখুঁত ট্রিম করা দাড়ির ভাঁজে বিস্ময়কে আটকে রেখেই বিয়াস সামনে দিয়ে গটগট করে চলে এসেছিল। আর সেই মুহূর্ত থেকেই বিয়াস হয়ে গিয়েছিল ওদের ডিপার্টমেন্টের সব থেকে সাহসী মেয়ে। নিজের হাসিখুশি স্বভাবের জন্যই সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিল খুব সহজেই। তারপরও কলেজ ফেস্টের দিন নাচের প্রোগ্রাম শেষে অর্পণের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখেছিল।
ওর মতো ডেসপারেট ছেলের পক্ষেই বোধহয় বিয়াসের এত ছবি তোলা সম্ভব। যেহেতু ইউনিয়নের লিডার, তাই যে কারোর হাতে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেই সে বিয়াসের দুটো ছবি তুলে অর্পণকে দিয়ে দেবে। বড়লোকের ছেলের এমন ফোন নষ্ট করতেও গায়ে লাগবে না।
এই বিয়াস! কি এত ভাবছিস রে! বাসে উঠে থেকে দেখছি তুই যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছিস! পাশের সিট থেকে অনুষ্কা বলল। বিয়াস সামলে নিয়ে বললো, ওখানে গিয়ে কি কি করব তার প্ল্যান করছি রে।
মালবিকা বলল, এই স্যাররা আসছেন, এবারে মনে হয় বাস ছাড়বে। বিয়াস হেলান দিয়ে বসার আগেই দেখল, বয়স্ক প্রফেসররা কেউ নয়, দুজন অল্পবয়সি লেকচারার উঠলেন বাসে। দুজনেই পাশকোর্সের লেকচারার। পাশকোর্সের ক্লাস করার সময়ই যা দেখা হয় এনাদের সাথে। দেবাশীষ স্যার ভীষণ মাইডিয়ার। কিন্তু কৃশানু স্যার বড্ড রাশভারী। বয়েস এই সাতাশ, আঠাশ হবে ওনাদের। দেবাশীষ স্যার উঠেই বললেন, ব্রেকফাস্ট করেই বাস স্টার্ট করা হবে। কৃশানু স্যার আলতো স্বরে বললেন, যে যার সিটে বসো। আনন্দ করো, কিন্তু অসভ্যতামি নয়। মালবিকা বলল, এই বিয়াস, কৃশানু স্যারের মুখটা দেখ, কেউ যেন জোর করে নিমপাতা গিলিয়ে দিয়েছে। অমন মুখ করেই বোধহয় দীঘার বিচে ঘুরবে। বিয়াস বলল, পার্সোনালিটি থাকাটা জরুরি। ওই দেখ, সবাই মিলে দেবাশীষ স্যারের কি অবস্থা করছে। ওরা তাকিয়ে দেখল, ব্রেকফাস্টের প্যাকেট বিলি করতে করতে স্যার নাজেহাল হয়ে গেছেন। ছেলেগুলো নিজের প্যাকেট লুকিয়ে বলছে, পাইনি স্যার। স্যার অসহায় চোখে তাকিয়ে বলছে, তোমায় দিলাম যে! হালছাড়া গলায় বললেন, আর তো মাত্র কয়েকটা প্যাকেট পড়ে আছে, মেয়েরা তো সবাই এখনও পায়নি খাবার!
বিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে একটু চিৎকার করেই বলল, স্যার, ওই কলা, ডিম ওদের দিয়ে দিন। সামনেই একটা রেস্টুরেন্ট পড়বে, আমরা যে কজন পাইনি তারা আলুপরোটা খেয়ে নেব। এখানে আলুপরোটাটা ব্যাপক বানায় উইথ আচার। কথাটা বোম পড়ার মতোই পড়ল বাসে। প্রায় গোটা পনেরো প্যাকেট এসে জমা হল, দেবাশীষ স্যারের হাতে।
নীলাদ্রি আর চন্দ্রাণী বলল, স্যার খেলে আমরা সবাই খাব।
দেবাশীষ স্যার হেসে বললেন, বারোটো প্যাকেট কম পড়ছিল। বিয়াসের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট। বাঁচালে আমায়।
নীলাদ্রি ওর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, দীঘায় পৌঁছে বিয়াসের টাকায় বিচের ধারে বসে ব্রেকফাস্ট করব। চিটিং করার শাস্তি।
বিয়াস একটু হেসে বলল, সে তোদের আমি একদিন খাইয়ে দেব, তাই বলে আজ বাসে প্যাকেট নিয়ে তোরা যেটা করছিলি, ওটা জাস্ট বদমাইসি।
বিয়াস কোনোমতে খাবারটা খেয়ে আবার ফোনটাতে মন দিল।
মালবিকা ফিসফিস করে বলল, তোকে আজ বড্ড অন্যরকম লাগছে রে। ফোনটা কি সত্যিই তোর নয়?
বিয়াস ঘাড় নেড়ে বলল, সত্যিই আমার নয়।
কিন্তু কার সেটাই খোঁজার চেষ্টা করছি। আমার নাম্বার দুটো ছাড়া আর কিছুই নেই রে।
সৌরনীল, অর্পণ বাদ দিলেও আরেকটা নাম মাথায় আসছে বিয়াসের। কিন্তু সে এরকম কিছু অ্যাটলিস্ট করবে না। এতটা রোম্যান্টিক ভাবে প্রোপোজ করার পাবলিক সে অন্তত নয়। তবুও একবার আড়চোখে তাকাল তার দিকে।
তার উদাসীন চোখ দুটো বাইরের দিকে, হাতের ম্যাগাজিনের পাতা আপন খেয়ালে উড়ে যাচ্ছে। সামনে বিয়াস উপস্থিত, তবুও তার দৃষ্টিতে রয়েছে প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা। না বিয়াস এখনো জানে না, এই নামটাকে সৌরনীল বা অর্পণের সারিতে অ্যাড করা যাবে কিনা! কারণ সেভাবে স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিতই বিয়াস পায়নি ওদিক থেকে। তবুও কেন যে বিয়াসের মনে হয়, সে একটু হলেও দুর্বল বিয়াসের প্রতি, সেটা অবশ্য বিয়াস বোঝে না। নিজের মনকে বারবার প্রশ্ন করেছে, তবে কি বিয়াস নিজেই দুর্বল তার প্রতি, তাই এমন মনে হয়! মন কোনো সুনিশ্চিত উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে বলেছে, অনুভূতিগুলো বড্ড সূক্ষ্ম হয়, তাই সেগুলো উপলব্ধি করতে গেলে খুব ধীরে ধীরে অনুভব করতে হবে। বিয়াস তাই নিজের স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই তার সামনে চুপ করে থাকে। নাহলে সৌরনীল বা অর্পণের মতো কবেই ইগনোর করতে শুরু করত।
কিন্তু ইগনোর করার বদলে আগ্রহী হয়ে ওঠে তার নিঃস্পৃহতা দেখে। মালবিকাকে সব কথা বললেও এই কথাটা কিছুতেই বলতে পারেনি বিয়াস। অথচ বিয়াস ক্লাস করতে করতে একদিন পরিষ্কার দেখেছিল, সে বিয়াসের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে কিছু ভাবছে। তার চোখেমুখে লেগেছিল মুগ্ধতা। ওই মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে বিয়াসের মতো দস্যি মেয়েও লজ্জা পেয়েছিল।
বিয়াসের মা বলে, ভগবান নাকি বিয়াসকে ছেলে করতে করতে মেয়ে করে গড়ে ফেলেছেন। লজ্জা নামক বস্তুটি নাকি বিয়াসের শরীরে তিলতম নেই। আর এই অতিরিক্ত সাহসও নাকি মেয়েদের থাকা উচিত নয়, যেটা বিয়াসের আছে। কিন্তু বিয়াস মাকে গিয়ে বলতে পারেনি, যে বিয়াসও লজ্জা পায়। শুধু তাকে দেখলেই লজ্জা পায়।
মালবিকা বলল, এই তুই দেবাশীষ স্যারের দিকে অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন!
বিয়াস ঠোঁট টিপে হেসে বলল, স্যার কিন্তু দারুণ হ্যান্ডু।
মালবিকা টিপ্পনী কেটে বলল, আবার ব্যাচেলর। ট্রাই করতে পারিস।
বিয়াস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, না বস, প্রেম আপনা-আপনি হয়ে যায়…ওসব ট্রাই করে হয় না।
মালবিকা বললো, অর্পণদা এসেছিল জানিস তো। এসেই বলল, বিয়াস আসেনি? ওকে বোলো, কোনো প্রবলেম হলে যেন আমার নম্বরে একটা মিস কল দেয়, আমি পাশের বাসে আছি, চলে আসব।
আর তোর একনিষ্ঠ পূজারি সৌরনীলও বার দুয়েক খোঁজ করেছিল। তুই উঠতে সে নিশ্চিত হয়ে জায়গায় গিয়ে বসল।
বিয়াস বলল , দাঁড়া এই ফোনে কি গান লোড করা আছে দেখি। কুড়িয়ে পেলাম যখন তখন একটু গান তো শুনি।
এমএক্স প্লেয়ার খুলতেই আরেক চমক।
পনেরোটা মতো গান লোড করা আছে। সবকটাই বিয়াসের ভীষণ পছন্দের। এমনকি এর মধ্যে গোটা সাতেক গানে তো নিজেই নেচেছে।
একটু একটু করে ফোনটার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে বিয়াসের। ফোনের গ্যালারি ভর্তি ওর ছবি, কন্ট্যাক্ট লিস্টে শুধু ওর দুটো নাম, মিউজিক গ্যালারিতে ওর পছন্দের গান….এটা যদি বিয়াসকে প্রোপোজ করার টেকনিক হয়, তাহলে বিয়াস অলরেডি ফিদা।
আরো চমক বাকি ছিল বিয়াসের।
ভিডিওতে রয়েছে ওর কলেজ ফেস্টের কুড়ি মিনিটের নাচের ভিডিও। দেখেই চমকে উঠল বিয়াস।
ভিডিওর ওপরে লেখা, খরস্রোতা বিয়াস, নাচের তালে।
বিয়াসের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা।
উঠে দাঁড়িয়ে বিয়াস চেঁচিয়ে বললো, এই ফোনটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি, এটা কার?
বাসের সিটে পড়ে ছিল।
সকলের মধ্যেই একটা তৎপরতা লক্ষ্য করল বিয়াস।
সকলেই নিজের নিজের পকেট, ব্যাগ হাতড়ে দেখছে নিজের ফোন জায়গা মতো আছে কিনা!
বিয়াস একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যাকে সৌরনীল আর অর্পণের পরে রাখবে কিনা ভাবছিল!
গোটা বাসের মধ্যে একমাত্র তারই কোনো চঞ্চলতা দেখল না বিয়াস। হঠাৎই বিয়াসের দিকে চোখ পড়ে যেতেই সে সচল হল। আলতো করে নিজের পকেটে হাত দিয়ে তার ফোনটা আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল যেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘাড় নিচু করে আবার ম্যাগাজিনের পাতায় মন দিল সে। বিয়াস তার দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক। কিন্তু সে আর তাকাল না বিয়াসের দিকে।
বিশ্বপক্ক মনজিত বলল, বিয়াস তুই ফোনটা আমায় গিফট করে দে। আমি আমার পুরনোটা ওয়েলেক্সে দেব দেব ভাবছিলাম, তাই হয়তো গড আমার জন্যই তোর হাতে ওটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তুই ওটা আমায় দিয়ে দে।
দেবাশীষ স্যার আর কৃশানু স্যার বললেন, হই হট্টগোল নয়। বিয়াস ফোনটা দাও, দেখছি আমরা।
বিয়াস খিলখিল করে হেসে বলল, জাস্ট ফান। এই দেখো, এটাতে আমারই ছবি দিয়ে ওয়ালপেপার করা। সবাই বড্ড চুপচাপ ছিল, তাই সবাইকে একটু ওয়ার্ম আপ করলাম আরকি।
বন্ধুরা হাসতে হাসতে বলল, এই জন্যই তো তুই বিয়াস, এই ইউনিক ভাবনাগুলোর জন্যই তোকে মিস করি।
বিয়াস একটু কায়দা করে বলল, বেশ বেশ এত প্রশংসার দরকার নেই, সবাই চাঁদা তুলে আমায় একদিন খাইয়ে দিস। দেবাশীষ স্যার হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা এনজয় করো।
বিয়াস আবার নিজের সিটে বসে ফোনটা ঘাঁটতে লাগল।
ফেসবুক, হোয়্যাটসআপ তো নেই ফোনটাতে। এমনকি সিমও নেই। কিন্তু একটা নোট প্যাড আছে।
নোট প্যাডে অনেক লেখা। মালবিকা ফেসবুকে মন দিয়েছে। কয়েকজন মিলে অন্ত্যক্ষরী শুরু করেছে। বেসুরো গানের সুর কানে আসছে। লাঞ্চ টাইমের আগে আর বোধহয় বাস থামবে না।
বিয়াস নোট প্যাডের লেখাগুলোর দিকে তাকাল।
প্রথম লেখাটা ওকেই সম্বোধন করে।
বিয়াস,
প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছিলাম, সেদিন তেমন কোনো আগ্রহ বোধ করিনি। কলেজের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু একটু একটু করে ধারণাটা বদলে যাচ্ছিল। তুমি স্বভাবে আমার ঠিক উল্টো। আমি বরাবররের ইন্ট্রোভার্ট। লোকে আমায় শান্ত ছেলে বলত । মনের কথা কখনোই মুখ ফুটে বলতে পারতাম না। আর তোমার তো মুখটাই মনের ছবি। ঠিক পাহাড়ি নদীর মতো। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে আসছো বলেই হয়তো এত স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছতাটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। এখন মধ্যরাত। সারা শহর ঘুমোচ্ছে। আমি নির্ঘুম চোখে তোমায় চিঠি লিখছি। বিনা কাগজের চিঠি। এ চিঠি হয়তো কোনোদিন পৌঁছাবে না তোমার কাছে। তবুও একান্ত গোপন অনুভূতিগুলোকে সাজানোর চেষ্টা করলাম মাত্র।
জানি ব্যর্থ হলাম। ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের এই এক সমস্যা, এরা গোপনেও মুখচোরা। ভালো থেকো দুরন্ত বিয়াস। এমন খামখেয়ালি থেকো। সকলের থেকে আলাদা।
ইতি
শূন্য
কেন শূন্য লিখলাম জানো? আমার পরিচয়টা আমি কোনোদিন তোমার কাছে প্রকাশ করতে চাইনা।
অবশ হয়ে আসছিল বিয়াসের অনুভূতিগুলো। অদ্ভুত অজানা একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছিলো প্রতিটা শিরা-উপশিরায়।
স্ক্রল করছিল বিয়াস। সব লেখাগুলো পড়তে হবে ওকে।
অদৃশ্য একজনের মনের অনুভূতি জানার দুর্বার আকর্ষণ পেয়ে বসেছে ওকে। কে এই শূন্য!
বিয়াস,
আজ তোমাকে দেখলাম আকাশনীল কুর্তিতে। শরতের আকাশকে টেক্কা দিয়ে হাঁটছিলে তুমি। আমি ছিলাম ঠিক তোমার পিছনেই। বেশকিছু বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে হাসছিলে তুমি। উজ্জ্বল তোমার উপস্থিতি। সকলের মধ্যে মিশে গিয়েও অসাধারণ হয়ে থাকার ক্ষমতাটা বোধহয় তোমার জন্মগত। তুমি তোমার কপালে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে শাসন করে সরিয়ে দিলে, কিন্তু তারাও বোধহয় আমার মতোই অবাধ্য। তাই তোমার নিষেধ না শুনেই কিছুক্ষণের মধ্যেই পড়ল এসে আবার তোমার দুই ভ্রুর মাঝখানে। আমিও যেমন চোখ সরিয়ে নিয়েও আবার তাকাতে বাধ্য হই, ঠিক তেমনি।
জানো বিয়াস, তোমাকে দেখার পর থেকে নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। পড়াশোনার ফাঁকে তোমার মুখটা মাঝে মাঝেই আমার দৃষ্টিপথকে আড়াল করে রাখে। আর তখন আমার মনের মধ্যে একটা অশান্ত হাওয়া এলোমেলো করে দেয় ভাবনার তারগুলোকে।
আমি জানি বিয়াস, আমি তোমার পছন্দের তালিকায় কিছুতেই থাকতে পারি না। আমি তোমার মতো উচ্ছল নই, আমি কথা বলতে পারি না। আমি আনস্মার্ট। তাই সাহস করে কোনোদিন বলতেও যাবো না তোমাকে। আমার ভালোবাসা তাই খুব স্বার্থপর। একতরফা ভালোবেসেই আমি খুশি। যদি তোমার সামনে দাঁড়ালে তুমি কখনো ব্যঙ্গ করো, আমার ভালোবাসা সেটা হয়তো সইতে পারবে না। তার থেকে এই ভালো।
ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম। কাজের মাসির কাছে মানুষ। তাই হারানোর বেদনাটা আমি জানি। একতরফা ভালোবাসায় হারানোর ভয় নেই। তাই তুমি সব সময় আমার।
বিয়াস মুখ বেঁকিয়ে বলল, সব বুঝে বসে আছেন উনি!
মালবিকা বলল, এই বিয়াস, কাঁদছিস কেন?
বিয়াস চমকে উঠে নিজের গালে হাত ছোঁয়ালো। দেখলো দুফোঁটা গরম জল ধীরে ধীরে গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতে চাইছে। তাড়াতাড়ি জলটা মুছে নিয়ে বলল, তোর দুঃখে রে মালবিকা।
মালবিকা অবাক হয়ে বলল, আমার দুঃখে মানে!
এই যে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও তুই একটাও সেলফি তুলতে পারলি না, প্রতিবারই ঠিক ক্যামেরা ক্লিক করার সময়েই বাসটা বাম্পার পেরোচ্ছিল, আর তোর ছবিটা হেজি হয়ে যাচ্ছিল, এই দুঃখে কাঁদছি।
মালবিকা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঘুরে বিয়াসকে জড়িয়ে ধরে বলল, একমাত্র তুই আমার মনের দুঃখের টের পাস রে।
তুই তো মন দিয়ে মোবাইল ঘাঁটছিলিস, কি করে বুঝলি আমার এগারো নম্বর ছবিটাও ভালো এল না?
বিয়াস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কারণ প্রতিবারই তুই বলেছিলিস, ইস, এটাও গেল। একটাও ভালো হচ্ছে না।
ওই কথাগুলো শুনেই বুঝলাম, তোর পিকগুলো ফেসবুকে আপলোড করার মতো হচ্ছে না।
তবে তুই আরেকটা কাজ করতে পারিস। যেমনি বাম্পারটা পেরোলো, সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা তুলে নিতে পারিস। একটা বাম্পার থেকে আরেকটার দূরত্ব একটু হলেও বেশি থাকে। অন্তত একটা ছবি তোলা যেতেই পারে। মালবিকা চোখ বড় বড় করে বলল, একদম ঠিক বলেছিস। আমি তো এতক্ষণ উল্টো করছিলাম। বাম্পারটা পেরোনোর পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যেমনি তুলতে যাচ্ছি অমনি….
লাভ ইউ বিয়াস।
বিয়াস,
খুব ইচ্ছে করে কলেজের ক্যাম্পাসে সবার সামনে চিৎকার করে বলি, লাভ ইউ। ভালোবাসায় দোষ কি! অন্যায় তো কিছু করিনি। কিন্তু ওই যে হারিয়ে ফেলার ভয়। যদি মুখের ওপর বলে দাও, তুমি এনগেজড, তাহলে তো ভালোবাসার রাস্তাটাও বন্ধ হয়ে যাবে। তার থেকে এই বেশ ভালো আছি। আমার একান্ত ভালোবাসা আছে, আর আড়চোখে তোমায় দেখা আছে। আজ সন্ধ্যেতে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার অনেক ছবি তুলেছি। তুমি স্টেজে নাচছিলে। মনে হচ্ছিলো একটা চঞ্চল ময়ূরী তার দুটো ডানা মেলে নাচছে। নাচের পুরো ভিডিওটা তুলেছি। জানো বিয়াস, এই ফোনটা আমি কিনেছি শুধু তোমাকে এর মধ্যে বন্দি করে রাখব বলে। অন্য কিছু থাকবে না এই ফোনে। কি ভাবছো, বড্ড পজেসিভ! তা একটু আছি। অন্য কারোর নাম্বারের পাশে তোমার নাম থাকুক চাইনি আমি। গ্যালারিতে তোমার ছবির পাশে আরও পাঁচটা ছবি থাকুক, চাইনি আমি।
বিয়াস পড়তে পড়তে মুখ ভেঙছে বলল, তবুও কোনোদিন প্রকাশ করবে না তাই তো।
কিন্তু মিস্টার, তুমি যে আমার কাছে ধরা পড়ে গেছো। এখন শুধু সকলের সামনে তোমার স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে আমায়।
বিয়াস,
একদিন খোলা চুলে নীল শাড়ি পরে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে? আমি আমার ক্যামেরা বন্দি করব তোমায়। নজর বন্দিও করতে পারি।
আচ্ছা বিয়াস, ধরো তোমার ওপরে দায়িত্ব পড়ল আমাকে প্রোপোজ করার, কি ভাবে বলবে তুমি!
হ্যাঁ, আমি পারিনি প্রোপোজ করতে, তাই বাধ্য হয়ে তুমি হাল ধরেছ! এবার বলো, কিভাবে প্রোপোজ করবে?
জানি, ভনিতা না করেই তুমি এসে বলবে, ভালোবাসলে লুকিয়ে থাকা কেন! মেরুদণ্ড সোজা রেখে যখন বলতেই পারো না, তখন ভালোবাসার দরকার কি!
কি ঠিক বললাম তো! তুমি তো এমনই বিয়াস। তলোয়ারের মতো ঝকঝকে। কিন্তু আমি যে পারি না। তোমাকে দেখলেই আমার কথারা আমার সাথে অসহযোগিতা করে, কোথায় যেন বেপাত্তা হয়ে যায় সব শব্দগুলো। পড়ে থাকে শুধু একরাশ অনুভূতি। যেগুলো আমি উপলব্ধি করতে পারলেও তোমাকে বোঝাতে পারব না। আবার আজ আরেকটা অন্যায় করলাম। তুমি যখন ক্লাসে বসে একমনে খাতায় লিখছিলে, তখন একটা ছবি তুলে নিলাম তোমার। বেখেয়ালি বিয়াস ধরা পড়ল ফ্রেমে।
খুব ভয়ে থাকি আমি। বলতে পারো আতঙ্কে। এই বুঝি কেউ এসে বলল, অমুকের সাথে বিয়াস এনগেজড হল। বিশ্বাস করো, ভাবলেই আমার বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে ওঠে। তারপর নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ভালো থাকুক বিয়াস। এমনি লাগামছাড়া, উচ্ছল থাকুক। আমি তোমায় বাঁধতে চাইনা বিয়াস। তুমি চলো নিজের ছন্দে।
জানি একদিন তুমি পড়বে এই লেখাগুলো, আর হেসে ভাববে, পাগলের পাগলামি!
বিয়াস মুচকি হেসে বলল, ভুল ভাবব কি! পাগলই তো। এত ভালোবাসা লুকিয়ে যে ঘুরে বেড়ায় সে পাগল ছাড়া কি!
মালবিকা গান শুনতে শুনতে ঘুমোচ্ছে। গোটা বাসই ঝিমোচ্ছে প্রায়।
বিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল তার দিকে। তারও চোখ বন্ধ। কানে হেডফোন, সম্ভবত গান শুনছে।
ওদের বাসটা যখন দীঘা পৌঁছালো তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে যাবার প্রস্তুতি করছে। মাঝে একটা ধাবা টাইপের জায়গায় ভাত খেয়েছিল ওরা।
বেশ কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার শুরু করেছিল যাত্রা।
দীঘায় পৌঁছাতেই চারটে বাসের সব যাত্রী একজায়গায় মিট করল। হই হুল্লোড় দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
মধ্যবয়স্ক প্রফেসররা বললেন, তোমরা কলেজ স্টুডেন্ট। তাই আশা করি তোমরা নিজেরা বুঝে চলা ফেরা করবে। আমরা হোটেলে যাচ্ছি। তোমরা সমুদ্র ঘুরে তারপর এসো।
প্রত্যেকেই বারবার দীঘা ঘুরে গেছে। কিন্তু বন্ধুদের সাথে আসার আলাদা মজা আছে। তাই চির পরিচিত দীঘার সমুদ্রও যেন আজ নতুন করে ভালো লাগছে সকলের।
বিয়াস নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে বলল, চল মালবিকা, কটা সেলফি তুলি। আর বাপিকে একটা কল করে দিই।
মালবিকা আর বিয়াস দলছুট হয়ে ছুটছিল বিচের দিকে। বিয়াসের কাঁধের ব্যাগের মধ্যেই আছে নতুন পাওয়া ফোনটা। ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই যেন একটু বদলে গেছে বিয়াসের হাবভাব। লজ্জা নামক অস্বস্তিকর বস্তুটি মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ওর চোখের পলকে। আর ওর চোখ দুটো বিচের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে গ্রে টিশার্ট পরা মানুষটাকে।
কিছু বন্ধু অলরেডি জলে নেমে গেছে প্যান্ট গুটিয়ে।
মেয়েগুলোও জিন্সের নীচটা গুটিয়ে আপাতত ঢেউ খাচ্ছে। মালবিকা বলল, চল ঢেউকে পিছনে রেখে ছবিটা তুলি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝপ করে সূর্যটা ডুবে গেল জলের ওপরে। আকাশের রক্তিম আভা মুছে গিয়ে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত আকাশ। তারমধ্যেই চারদিকের দোকানে জ্বলে উঠল নিয়ন আলো। ঝকঝক করে উঠল বিশ্ববাংলার ‘ব’ টা।
দূর থেকেই প্রফেসর মিতালি গুপ্তা বললেন, উঠে এসো সবাই। কাল বিকেলে বাস ছাড়া হবে। কাল সকালে সমুদ্র স্নান করো সবাই। সন্ধের দিকে সিবিচে থেকো না। ঢেউয়ের বেগ বাড়ছে।
বর্ণালী বলল, জানতাম প্রফেসররা সঙ্গে এলে সাতটাকেই রাত করে ফেলবে। এখন থেকে হোটেলে ঢুকে কি করবি বলতো! চল একটু মার্কেটে ঘুরি।
দেখতে দেখতে সাতজন প্রফেসরই এসে পৌঁছালো বিচে। স্টুডেন্টরাও মনখারাপ করে উঠে পড়ছিল।
সবাইকার দাবি মার্কেটে একটু ঘুরবে,খাবে…
স্যার, ম্যামরা অন্ধকারে সমুদ্র দেখছেন। ওপরের বাঁধানো চত্বরে বসে।
ছেলেমেয়েরা এলোমেলো ঘুরছে।
হঠাৎই মালবিকা খেয়াল করল, বিয়াস নেই ওর পাশে। ভিড়ের মধ্যে এদিক ওদিক তাকাল। না বিয়াস নেই।
তাহলে কি বিচে! কিন্তু ও তো উঠে এল মালবিকার সাথেই। পিছন ফিরে বিচে যাওয়ার আগে রিং করল ওর ফোনে। নট রিচেবেল বলছে।
বর্ণালী, অদিতি, চন্দ্রাণীদের দলটা একটা মুক্তোর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এটা ওটা দেখছে। ওখানেও দেখতে পেলো না বিয়াসকে। এভাবে মালবিকাকে কিছু না বলে তো ও চলে যাবে না কোথাও!
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো, অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথেই দামাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র। অজস্র ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বিচে। ঢেউয়ের আওয়াজে নিজের গলার স্বরই ভালো করে শোনা যাচ্ছে না। মালবিকা মালতি ম্যামকে গিয়েই বললো, ম্যাম বিয়াসকে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। সামনের দোকানগুলোতে খুঁজলাম।
ম্যাম ছাড়াও অন্যান্য স্যাররা বিরক্ত হয়ে বললেন, এই জন্যই তোমাদের নিয়ে ট্যুরে আসতে নেই। এত বড় বড় ছেলে মেয়েরা যদি অবাধ্যতা করো, তাহলে তো আর কিছুই বলার থাকে না। এখন সব আনন্দ বাদ দিয়ে টেনশন নিয়ে খোঁজো মেয়েটা কোথায় গেল!
দেবাশীষ স্যার বললেন, ফোনে ট্রাই করেছো?
মালবিকা ঘাড় নেড়ে বলল, স্যার নট রিচেবেল বলছে।
বিচে এখনো বেশ কিছু মানুষ ইতস্তত ঘুরছে। কিন্তু কেউ জলের মধ্যে নেই। সমুদ্র থেকে একটু তফাতে হাঁটছে মানুষ। হঠাৎই মানিক স্যার বললেন, জলের মধ্যে ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে! দেখো তো! আমার দেখার ভুল নয়তো!
মালবিকা কিছু দেখার আগেই একটা বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল বালিতে।
তার আগেই কৃশানু স্যার লাফিয়ে নেমে ছুটল সমুদ্রের দিকে। দেবাশীষ স্যার বললেন, কৃশানু আস্তে। ঢেউগুলো বড় ভয়ঙ্কর। আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতা ছিল, আজ সন্ধের পর জলে না নামার। আমি একটু আগে ওয়েদার রিপোর্টে দেখলাম। ততক্ষণে আমাদের স্টুডেন্টরা সিবিচ ছেড়ে উঠে এসেছে বলে, আমি আর কিছু বলিনি।
কৃশানু….সাবধানে।
এবারে পরিষ্কার হল, ওটাই বিয়াস। কোমরের থেকেও বেশি ভিজিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের সামনে। মালবিকা ফিসফিস করে বলল, বিয়াস তো এমন নয়। সাহসী ঠিকই, কিন্তু এমন বেসামাল নয়।
কৃশানু ছুটে গিয়ে আরেকটা বড় ঢেউ আসার আগেই বিয়াসকে হ্যাঁচকা টান দিলো।
নোনতা জলে ভিজে বিয়াস টাল সামলাতে না পেরে কৃশানুর বুকের ওপরে এসে পড়ল।
কোনোমতে টাল সামলে নিয়েই চেঁচিয়ে উঠল সদা শান্ত, গম্ভীর কৃশানু রায়।
ছি! এমন ছেলেমানুষি তোমার কাছে আশা করিনি। সকলকে টেনশনে ফেলে, হ্যারাজ করে আনন্দ পাচ্ছিলে তুমি! পারলে এভাবে আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে। কিছু যদি হয়ে যেত! যদি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেত, কি করতাম আমি! কি জবাব দিতাম তোমার বাবার কাছে! কৃশানু থরথর করে কাঁপছে উত্তেজনায়। বিয়াস একেবারে নিশ্চুপ। মুখে একটাও কথা নেই। প্রাণচঞ্চল বিয়াস যেন মুহূর্তে শান্ত নদী হয়ে গেছে। জলের তরঙ্গটুকুও অনুভব করা যাচ্ছে না।
কৃশানু আবার বলল, এসব ছেলেমানুষির মানে কি!
দেখো বিয়াস, তুমি সাহসী, হই হুল্লোড়ে সেগুলো মানা যায়। কিন্তু এভাবে নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনো অর্থ নেই। এগুলোকে সাহস বলে না, বলে দুঃসাহস। আর দুঃসাহস মানুষের বিপদ ডেকে আনে।
কৃশানু বিয়াসের একটা হাত শক্ত করে ধরে বলল, ওপরে চলো। নোনা হাওয়ায় শরীর খারাপ করবে, হোটেলে গিয়ে ভিজে পোশাক চেঞ্জ করে নাও। এভাবে কোনোদিন ভয় দেখিও না বুঝলে! গভীর গলায় কথাগুলো বললো কৃশানু। কৃশানুর শক্ত মুঠোর মধ্যে বিয়াসের হাতটা তিরতির করে কাঁপছে।
দুজনেই উঠে এল ওপরে।
স্যারেরা বিয়াসকে বেশি বকাবকি না করেই বলল, ভুল করেছ। আর যেন ভুল না দেখি।
মালবিকা বিয়াসকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই যে বললি, ব্যাগটা ধর, আমি চপ্পলটা ঝেড়ে নিই, তারপর ওখানে কেন গেলি বিয়াস!
এই নে তোর ব্যাগ। তোর ফোনটা কি ব্যাগের মধ্যেই পরে আছে! আমি তো তোকে কতবার কল করছিলাম। বিয়াসের ঠোঁটে হালকা হাসির ছোঁয়া।
বিয়াসদের রুমে মালবিকা, বর্ণালী আর বিয়াস। ওরা তিনজনই থাকবে এই রুমটাতে। বর্ণালী হড়বড় করে বলল, যা ভয় দেখিয়ে দিয়েছিলি বস। হ্যাঁ রে তুই তো প্রেম করিস না, তাহলে ওটা সুইসাইড নয়, বলনা বিয়াস, তাহলে ওটা কি!
বিয়াস বলল, প্রেমে পড়ার ইঙ্গিত। জানিস তো কেউ প্রেমে পড়লে এমন উদাসীন হয়ে যায়। আমারও মনে হচ্ছে, আই অ্যাম ইন লাভ।
মালবিকা বলল, কার প্রেমে!
শেষ পর্যন্ত সৌরনীল!
তবে ছেলেটা কি ভীতুর ডিম রে। চন্দ্রাণী বললো, সৌর তোর প্রিয়তমা ঢেউয়ের সামনে, যা গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আয়। সৌর বলল, জলে আমার ফাঁড়া আছে, তাই নামতে পারব না। তাছাড়া বিয়াস খুব সাহসী, ও এখুনি উঠে চলে আসবে দেখ। বর্ণালী হেসে বলল, আর আমাদের কৃশানু স্যার তো পুরো হিরোর মতো লাফ দিল, সেটা বল।
বিয়াস বলল, থাম তো তোরা। আজ অবধি চশমা পরা, অমন গম্ভীর মুখের হিরো দেখেছিস!
মালবিকা মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলল, যাই বল, কাল স্যারকে একটা থ্যাংকস জানাতেই হবে আমাকে। আমার বেস্টিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
বিয়াস বিছানায় শুয়ে বলল, তোরা যেমন করছিলিস, তেমন কিছু নয়। ঘড়িতে মাত্র আটটা পনেরো মতো বাজছিলো তখন। মধ্যরাত নয়। আমিও মাঝ সমুদ্রে চলে যাইনি। কোমর অবধি জলে দাঁড়িয়ে ছিলাম মাত্র। তোদের সবেতে বেশি ভয় তাই….
বর্ণালী বলল, তুই তো এমন বলছিস বিয়াস, যেন পাড়ার সুইমিংপুলে কোমর অবধি জলে দাঁড়িয়ে মজা করছিস। আরে আজ নাকি সন্ধের পর থেকে সমুদ্রে না নামার সতর্কতা জারি করা ছিল।
বিয়াস আড়মোড়া ভেঙে বলল, মালবিকা, আমার খাবারটা প্লিজ রুমে নিয়ে আসবি। আমার পায়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে রে।
ওরা ঘাড় নেড়ে চলে গেছে নিচের ডাইনিং হলে।
একলা ঘরে পাগলের মতো হাসছিল বিয়াস।
নতুন ফোনটা নিয়ে তার নোট প্যাডে লিখল, ছুটে গিয়ে সমুদ্র থেকে আমাকে বাঁচানো মানেই সে সাহসী নয়। নিজের অনুভূতিগুলোকে যে প্রকাশ করতে পারে না, সে আমার চোখে ভীষণ ভীতু।
আপাতত নীল শাড়ি নেই। তাই নীল কুর্তি পরে কাল দাঁড়াব ব্যালকনিতে। ভীতুরামের একটা ইচ্ছে অন্তত পূরণ হোক।
আর হ্যাঁ, এই গানগুলো সব কটা আমারও প্রিয়। ছবি তোলার হাতটাও মন্দ নয়। কিন্তু ক্লাস নিতে এসে লুকিয়ে ছাত্রীর ছবি তোলার দোষে জেল পর্যন্ত হতে পারে।
ভালোবাসাটা যে একতরফা নেই, সেটা শুধু জানিয়ে দিলাম গোমড়ামুখোকে। আরেকটা কথা, মোবাইলটা ভুল করে আমার সিটে ফেলে রাখা হয়েছিল, নাকি ইচ্ছে করে!
যে ভাবেই রাখা হোক, প্রোপোজের পদ্ধতিটা ভীষণ রোম্যান্টিক। তাই তো বিয়াস হঠাৎ থমকে গেছে। ছুটতে ছুটতে থামতে চাইছে, শান্ত হয়ে বইতে চাইছে নতুন বাঁকে।
খেয়ে দেয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল বিয়াস।
স্বপ্ন দেখল, চশমা পরা, গম্ভীর মুখের মানুষটা তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলছে, এভাবে কেউ চিন্তায় ফেলে আমাকে! ঘুমের মধ্যেই শিউরে উঠল বিয়াস। বালিশটাকে আঁকড়ে ধরে বলল, বেশ করব তোমায় চিন্তায় ফেলব।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল বিয়াস। কুয়াশার মধ্যে দিয়েই সমুদ্র দেখছিল ও।
দরজায় কেউ নক করল। মালবিকা গিয়ে দরজা খুলতেই, পরিচিত গলার স্বরে কেঁপে উঠল বিয়াস।
এলোপাথাড়ি হাওয়াতে উড়ছে ওর এলোচুল।
ওর পরনে নীল রঙের কুর্তি।
পিছনে পায়ের শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওর কাছে।
বিয়াসের হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ করেই দ্রুতগামী হল। যেন কত কাজ পড়ে আছে ওর, তাই লাবডুব আওয়াজে ছুটোছুটি করছে বুকের বামদিকে। দু-সেকেন্ডেই সব কাজ সারতে হবে তাকে। নিজের হৃদযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে বিয়াস।
পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। ধীর গলায় বলল, রাতে খেতে নামলে না, তাই বিমানবাবু খোঁজ নিতে বললেন। শরীর ঠিক আছে তো! যদি জ্বর আসে, তাহলে কিছু ওষুধ দিতে হবে বললেন মালতিদি।
বিয়াস ঘুরে দাঁড়াল। সোজাসুজি তাকাল তার দিকে। তার চোখে অপলক মুগ্ধ দৃষ্টি।
দাড়ির ভাঁজে অল্প হাসির ছোঁয়া।
বিয়াস বলল, বিমানবাবুকে গিয়ে বলবেন, আমি একদম পারফেক্ট আছি। মালতিম্যামকে বলবেন, ওষুধ লাগবে না।
আচ্ছা, বলেই ঘুরতে যাচ্ছিল কৃশানু। তার আগেই বিয়াস ওর হাতটা ধরে বললো, আর কৃশানুস্যারকে বলবেন, তার ফোনটা যেন নিয়ে যায় আমার কাছ থেকে।
কৃশানুর চোখে লজ্জা। অসহায় গলায় বলল, ধরে ফেলেছো!
বিয়াস চোখের ইশারায় বলল, অনেকদিন আগেই। কবে বলুন তো!
কৃশানু বললো, কবে!
যেদিন ক্লাস করাতে করাতে বলেছিলেন, আজ বিয়াস চ্যাটার্জি অ্যাবসেন্ট! আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম, দরজা দিয়ে ঢোকার সময় শুনলাম আপনার কথাটা। আপনার গলায় শুধু একজন স্টুডেন্টের খোঁজ নেওয়ার অনুভূতি ছিল না, সাথে আরো কিছু ছিল।
আরেকদিন আপনি আনমনে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে। সামনে বই খোলা, অথচ আপনার দৃষ্টি আমার দিকে…ধরা তো আপনি সেদিনই পড়ে গেছেন।
কৃশানু লজ্জিত গলায় বলল, সরি। পারলে ক্ষমা করো।
বিয়াস বলল, এই নিন আপনার ফোন। কৃশানু হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো।
বিয়াস বললো, নোট প্যাডে আমিও কিছু লিখেছি, পড়ে দেখবেন।
মালবিকা আর বর্ণালী পিছনে দাঁড়িয়ে বোধহয় কিছুটা শুনেছে, মালবিকা বলল, সত্যি! কৃশানু স্যার!
হ্যাঁরে, স্যারকে দেখে তো মনে হয়, রোম্যান্স শব্দটা স্যার লাইফে শোনেন নি…
বিয়াস বলল, শোনেনি হয়তো, তবে অ্যাপ্লাই করতে পারে।
চল বিচে যাওয়া যাক।
সিঁড়িতে নামার সময়েই কৃশানুর সাথে চোখাচোখি হল বিয়াসের। কথা না বলে কৃশানু ফোনটা এগিয়ে দিল বিয়াসের দিকে।
ও ফোনটা হাতে নিয়েই নোটপ্যাডটা খুলে দেখল, গোটা পেজ জুড়ে …বিয়াস, লাভ ইউ লেখা।
বিয়াস কৃশানুর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, লিখলে হবে না, মুখেও এই কথাটাই বলতে হবে!
কৃশানু আলগা হেসে বলল, মুখে বলতে না পারলেও আমার ভালোবাসা আপেক্ষিক নয়, চিরস্থায়ী।
বিয়াস চুপিচুপি বলল, কাইন্ডলি বিমানবাবুকে আমার হয়ে একটা খবর দিয়ে দেবেন! বলবেন, আমি বলেছি, আমি কৃশানুকে ভালোবাসি।
কৃশানু হেসে বলল, প্রাণচঞ্চল বিয়াস। এমনই থেকো, পাল্টে যেও না।
ভোরের সদ্য ওঠা লালচে সূর্য জানিয়ে দিয়ে গেল, নতুন দিনের সূচনা হল।
কৃশানু ফিসফিস করে বলল, ভালোবাসি।
বিয়াস একটু জোরেই বলল, লাভ ইউ…
সমাপ্ত