নিশিগন্ধা
নতুন বৌমাকে ঘিরে লম্বা লাইনটা চলেছে কৈলাসনাথের মন্দিরের গর্ভগৃহের দিকে। পেশায় ডাক্তার দীপ্তানু রায়চৌধুরী নীরবে ধীরে ধীরে হাঁটছে বউয়ের পিছন পিছন, গাঁটছড়াটা সামলে। রায়চৌধুরী বাড়ির কনিষ্ঠ সন্তান দীপ্তানু সদ্য এম.বি.বি.এস পাশ করেছে। এ বাড়ির ছেলেদের ছাব্বিশ বছরের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে এই নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে, এম.ডি না করেই বিয়েতে রাজি হতে হয়েছে দীপ্তানুকে। মনে মনে বিরক্ত হলেও বাবা রাজেন্দ্র রায়চৌধুরী আর জ্যেঠু বিজেন্দ্র রায়চৌধুরীর মুখের ওপর কথা বলতে অপারগ দীপ্তানুকে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। খুব ছোট থেকেই দীপ্ত জানত, লাভ ম্যারেজ নামক শব্দটা ওদের বাড়িতে নিষিদ্ধ। তাই মেডিক্যাল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পায়েল বলে একটি মেয়েকে ভালো লাগলেও, নিজের মনকে জোর করে অনুভূতিশূন্য করে রেখেছিল ও। প্রতাপপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির ছেলে কলেজে এসে প্রেম করছে জানলে, গোটা পরিবার ওর পড়াশোনা ছাড়িয়ে দিয়ে, নিয়ে চলে আসত প্রতাপপুরে। তাই চুপচাপ নিজের ডাক্তারি পড়ার স্বপ্নপূরণ করেছে মন দিয়ে। এ বাড়ির বাইরে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে থাকার সময়েও মনের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করত। শুধু মনে হত, বন্ধুদের সাথে একদিন ককটেল পার্টিতে গিয়ে ড্রিংক করলেই বোধহয় কৈলাসনাথ মন্দিরের ঘন্টাটা বেজে উঠবে বিপুল আওয়াজে। খুব ছোট থেকেই শুনেছিল, পরিবারের কেউ কোনো অন্যায় কাজ করলেই নাকি ওই মন্দিরের বিগ্রহ নড়ে ওঠে আর বেজে ওঠে ওই মন্দিরের ঘণ্টাটা। প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ নড়ে চড়ে ঘণ্টা বাজাতে বাধ্য হচ্ছেন এ বাড়ির মানুষদের পাপের কারণে, এটা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত।
দীপ্তর বিধবা বড়পিসি নাকি চাষাদের একটা ছেলের সাথে পালানোর চেষ্টা করেছিল মধ্যরাতে। ঠিক তখনই বেজে উঠেছিল, কৈলাসনাথ মন্দিরের ঘণ্টাটা। আর বিজেন্দ্র রায়চৌধুরীর বন্দুকের নিখুঁত নিশানায় চাষাদের ছেলেটা তখনই প্রাণ হারিয়েছিল। বড়পিসি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে হার্ট ফেল করে মারা গিয়েছিল। এ পরিবারের কেউ পাপ কাজ কিছু করলে, কৈলাসনাথ সহ্য করেন না। কৈলাসনাথ দুহাত ভরে দিয়েছেন রায়চৌধুরী পরিবারকে। কিন্তু অনাসৃষ্টি কিছু দেখলেই এই ঐশ্বর্য্য কেড়ে নিতেও পিছপা হবেন না। ছোট্ট থেকে গল্পের ছলে এমন অনেক কথা শুনতে শুনতে বিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্র দীপ্তানুও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, সত্যিই ওই মায়াঘণ্টা বাজে।
রানী কালারের বেনারসীতে আসল সোনার কাজ। মাথায় সোনার মুকুট পরে নিশিগন্ধা হাঁটছে। সবজে ঘাসের মধ্যে তার আলতা চোবানো পা পড়ছে।
নিশিগন্ধাকে বিয়ের আগে একবারই মাত্র ভালো করে দেখেছিল দীপ্তানু। বাবা রাজেন্দ্র রায়চৌধুরী পাশে বসে বলেছিল, তোমার মতো শিক্ষিত ছেলের জন্য আমরাও শিক্ষিত মেয়েই পছন্দ করেছি। নিশিগন্ধা নাকি সাইকোলজি নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে এই বছরই। ওদেরও বনেদী পরিবার। তবে দীপ্তানুদের মতো জমিদার বাড়ি নয়।
নিশিগন্ধার চোখে চোখ পড়ে যেতেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল দীপ্ত। কিন্তু অনুভব করছিল মেয়েটা ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। সামনে বাবা থাকায় দীপ্তর ভালো করে তাকানোই হয়নি নিশিগন্ধার দিকে। তাছাড়া দীপ্ত জানত, রাজেন্দ্র রায়চৌধুরী সব ঠিক করেই রেখেছেন। দীপ্তানুর হ্যাঁ বা না তে কিছুই পরিবর্তন হবে না। তাই দীপ্তকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মেয়ে পছন্দ হয়েছে? তখন নির্বাক দর্শকের মতোই ঘাড় নেড়ে সে বলেছে, তোমার পছন্দই সঠিক বাবা।
দীপ্তানুর জন্য প্রতাপপুরে নতুন হসপিটাল তৈরি করা হচ্ছে। রায়চৌধুরীদের নিজেদের জায়গায়, তাদেরই টাকাতে বানানো হচ্ছে হসপিটাল। সরকার থেকেও অনুদান পেয়েছে রায়চৌধুরীরা। দীপ্তানু তখনই বুঝেছে, ওর কলকাতা ফেরা আর হল না। উচ্চশিক্ষা নেওয়া আর সম্ভব নয়। স্পেশালিস্ট হওয়া বোধহয় আর হল না। প্রতাপপুর গ্রামেই ওকে ডাক্তারি করে জীবন কাটাতে হবে। বাবাকে আলতো করে বলতে গিয়েছিল দীপ্ত। বাবা গম্ভীর স্বরে উত্তর দিয়েছেন, তোমাকে ডাক্তারি পড়িয়েছি গ্রামের উপকারের আশায়, কলকাতায় গিয়ে কোনো হসপিটালে জয়েন করার জন্য নয়। দীপ্ত বলেছিল, আরেকটু পড়তে চাই….
বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী বলেছিলেন, বেশি পড়লে জমিদারি রক্তের অবমাননা করা হবে। মন দিয়ে গ্রামের লোকের রোগ ভালো করে সুস্থ করে তোলো।
এ বাড়ির মহিলাদের কোনোদিনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার অধিকার নেই। তাই দীপ্তর মা বা জেঠিমা রান্নাঘরের আড়াল থেকে শুনেছে মাত্র। দীপ্তর জেঠুর দুই মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বংশে পুত্রসন্তান বলতে দীপ্ত একা। কারণ ওর ছোটকাকা বিয়ে করেনি। লোকে নরেন্দ্রকে ছবিবাবু বলে ডাকে। নরেন্দ্র রায়চৌধুরীকে যখন তখন বিশাল দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে সাদা ক্যানভাসে আঁকি বুঁকি কাটতে দেখা যায়। এবাড়ির ছেলে হিসাবে নরেন্দ্ররও বিয়ে ঠিক হয়েছিল ছাব্বিশের ঠিক আগেই। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগে আগেই নরেন্দ্রর মাথার গন্ডগোল দেখা যায়। তাই আর বিয়েটা হয়ে ওঠেনি শেষ মুহূর্তে। রায়চৌধুরী বাড়ি থেকে সেই মেয়ের ক্ষতিপূরণ বাবদ, বিয়ের সব গয়না দিয়ে আসা হয়েছিল। সেই থেকেই সংসার, অর্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন নরেন্দ্র রায়চৌধুরীর ধ্যান-জ্ঞান রং তুলি। রঙের খেলায় তিনি অস্তগামী সূর্যকে দীঘির জলে নামিয়ে আনেন। পথচলতি লোকজন কাজ ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার জীবন্ত ছবির দিকে। দীপ্তানু একবার বলেছিল, কাকু কলকাতায় আর্ট এক্সিবিশনে তোমার ছবি নিয়ে গেলে তো হয়। নরেন্দ্র রায়চৌধুরী কৌতুকের হাসি হেসে বলেছিল, পাপ হবে। ছবিকে আমি ভালোবাসি, তাকে বেচে দিলে মায়াঘণ্টা বাজবে, কৈলাসনাথ রাগ করবেন।
মিতবাক নরেন্দ্র রায়চৌধুরী বসে ছিল কৈলাসনাথ মন্দিরের চাতালে। তার সামনে ছড়ানো রং তুলি।
সাদা ক্যানভাসে দুটো চোখ এঁকে কাকু আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বসেছিল। উলুধ্বনি শুনে তাকিয়ে দেখলো, নতুন বউ সঙ্গে নিয়ে মন্দিরের উদ্দেশ্যে চলা দলটার দিকে।
গাঁটছড়াতে টান পড়ল দীপ্তর। নিশিগন্ধা কাকুর ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
পিছন থেকে দীপ্তর দুই জেঠতুতো দিদি বলে উঠল, নতুন বউ, মন্দিরে চলো।
উনি কে হন দিদিভাই? এই প্রথম দীপ্ত নিশিগন্ধার গলার স্বর শুনতে পেল ভালো করে।
বড়দি বলল, উনি তোমার কাকাশ্বশুর। নিশিগন্ধা ঘোমটা সরিয়ে মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়েই প্রণাম করে বসল নরেন্দ্র রায়চৌধুরীকে।
সবাই হই হই করে উঠে বলল, মন্দির চত্বরে ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে মানুষকে প্রণাম করতে নেই নতুন বউ।
নিশিগন্ধা হকচকিয়ে গেল। নরেন্দ্র রায়চৌধুরী বেশ জোরেই বলে উঠলেন, পেয়েছি, পেয়েছি, বাকি মুখটা আমি আঁকতে পারব। একেই তো খুঁজছিলাম এতদিন। দীপ্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল মিতবাক কাকুর দিকে। নতুন বৌমাকে দেখে পাড়াসুদ্ধ লোকের সামনে এসব কি বলছে কাকু!
নিশিগন্ধাও ঘোমটা খুলে অপলক তাকিয়ে আছে কাকুর দিকে। মুখে স্মিত হাসি।
মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের কোনো অপ্সরী হঠাৎ করেই পথ ভুলে নেমে এসেছে পৃথিবীর মাটিতে।
সকলের গেল গেল রব শুনে নিশিগন্ধা ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে ঢুকল মন্দিরের ভিতরে।
লাল রঙের পোশাক পরা, কপালে সিঁদুরের তিলক আঁকা তান্ত্রিককে দেখে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল নিশিগন্ধার। শিবের বিগ্রহের সামনে প্রনাম সেরে আবার বিপত্তি করে বসল নিশিগন্ধা। কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই বিশাল ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিল লম্বা দড়িতে টান দিয়ে।
দীপ্তানু ভয়ে কেঁপে উঠে বলল, একি করলে নিশিগন্ধা? ওটা মায়াঘণ্টা। ওর ইচ্ছে না থাকলে ওকে জোর করে বাজানো যায় না। ও তখনই বাজে, যখন প্রতাপপুরে কোনো পাপ হয়। রায়চৌধুরী বাড়ির কেউ পাপ করলে তবেই ও স্বেচ্ছায় বাজে।
ততক্ষণে গুজগুজ, ফিসফিস শুরু হয়ে গেছে আত্মীয়দের মধ্যে।
কাকাশ্বশুরের খারাপ দৃষ্টিতে নাকি আজ বাজল মায়াঘণ্টা। নিশিগন্ধাকে নিয়ে সবাই চলে এল জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে। দীপ্ত দেখল এত ঘটনার মাঝেও নরেন্দ্র একমনে এঁকে চলেছে। তার সাদা ক্যানভাসে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে নিশিগন্ধার মুখটা। কাকুর মুখে তৃপ্তির হাসি।
দীপ্তর মনটা বিষিয়ে গেল। কাকুকে সে এতদিন অন্যরকম ভাবত, আজ সেই শ্রদ্ধাটুকুও চলে গেল।
কাকুর ক্যানভ্যাসের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল দীপ্তানু।
জুঁই আর গোলাপে সেজে উঠেছে ওদের ফুলশয্যার খাট। দীপ্ত গরদের পাঞ্জাবি পরে বৌভাতের সব ঝামেলা মিটিয়ে যখন ঘরে ঢুকল তখন পেঁয়াজখোসা রঙের বেনারসী পরে খাটের ঠিক মধ্যিখানে বসে আছে নিশিগন্ধা। সকালের সব তিক্ততা আস্তে আস্তে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, দীপ্ত এগিয়ে গেল নিশিগন্ধার দিকে। ঘোমটা সরাতেই গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। দীপ্ত ওর একটা হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, নিশিগন্ধা তোমার আমাকে ভালো লেগেছে?
নিশিগন্ধা কাটা কাটা স্বরে বলল, আমি ভেবেছিলাম আমি একজন পুরুষ মানুষকে বিয়ে করেছি। যে পেশায় ডাক্তার। রোগীর কাছে যে ভগবান। অন্যায়ের সামনে যে তলোয়ারী। কুসংস্কারের সামনে সে প্রখর সূর্যের আলো। যার আলোয় সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ভুলটা ভাঙল মন্দিরে গিয়ে, দেখলাম মেরুদণ্ডহীন একজন মানুষ আমার সিঁথি রাঙিয়েছে।
দীপ্তানুর ফর্সা গালে সজোরে পড়লো থাপ্পড়টা। নতুন বউয়ের লজ্জা অবনত মুখ দেখবে আশা করেছিল। আস্তে আস্তে তার চিবুক ধরে তার লজ্জা ভাঙাবে ভেবেছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল নিশিগন্ধার এমন স্পষ্ট বাক্যে। সানাইয়ের সুরটা দীপ্তর কানে ব্যঙ্গের মতো শোনাচ্ছে।
তবুও জেগে উঠল রায়চৌধুরী বাড়ির পুরুষসত্ত্বা। মুহূর্তে ভুলে গেল, সে একজন ডাক্তার। তার শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি বিসর্জন দিয়ে বেরিয়ে এল জমিদারী রক্ত।
নিশিগন্ধার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল দীপ্ত। নিস্পৃহ নিশিগন্ধা বলল, চিন্তা নেই, তুমি তৃপ্ত হও। তোমাদের রায়চৌধুরী বাড়ির মায়াঘণ্টা এখন বাজবে না। তুমি আমায় রেপ করলেও বাজবে না। তোমাদের বংশের ও ঘণ্টা পুরুষদের পাপে নড়ে না।
তাই তুমি নিশ্চিন্তে আমায় রেপ করো। আমি চিৎকার করব না। আমিও নিশ্চিন্ত, শারীরিক কোনো ক্ষতি হলে ওষুধ তো রেপিস্টের কাছেই আছে। তীরের মতো বিঁধছিল দীপ্তর কানে নিশিগন্ধার কথাগুলো। নিশিগন্ধার নরম মিষ্টি শরীরের আড়ালে যে এমন ভয়ঙ্কর একটা রূপ আছে, সেটা কল্পনা করতে পারেনি দীপ্ত।
নিজের শরীরের নীচে পিষে দিতে চেয়েছিল ও নিশিগন্ধার কোমল দেহটা। কিন্তু তার আগেই উষ্ণতায় পুড়ে যাচ্ছিল ওর শরীর। এমন সৌন্দর্য দেখেও উত্থিত হল না ওর পুরুষাঙ্গ। বরং অপমানে ঝলসে যেতে শুরু করল ওর গোটা মনটা। ছিটকে সরে এল দীপ্ত, নিশিগন্ধার কাছ থেকে। কাঁসার গ্লাসে রাখা জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে বলল, আমাকে যখন তোমার এতই অপছন্দ, তখন তুমি আমায় কেন বিয়ে করলে?
নিশিগন্ধা খুব ঠান্ডা গলায় বলল, রায়চৌধুরীদের গল্প শুনেছিলাম, শুনেছিলাম এরা সৎ, পরোপকারী….এটা জানতাম না এরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, এরা মেরুদণ্ডহীন। নিশিগন্ধা বলল, আগে নিজেকে প্রমাণ করো, তারপর আমার সবটুকু পাবে। জোর করে নয়, আমার মন-শরীর আমি নিজেই তোমায় অর্পণ করব। সেদিন দেখবে, আমার সমস্ত রক্তবিন্দু তোমাকে চাইছে।
দীপ্ত চুপচাপ বসে থাকল ফুল সাজানো বিছানায়।
পাশ ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল নিশিগন্ধা।
বন্ধুদের কাছে ফুলশয্যার রাতের একটা বর্ণনা শুনেছিল দীপ্ত। সেইমতোই এগিয়েছিল ওর চিন্তা-ভাবনা। সেটাকে মুহূর্তে টুকরো টুকরো করে দিল নিশিগন্ধা। এলোপাথাড়ি ঝড়ে ভেঙে দিল আজকে রাতের রঙিন স্বপ্নগুলো।
দীপ্তানু ঘুমন্ত নিশিগন্ধার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেঁদে ফেলল নীরবে।
মনে মনে বলল, আমিও চেয়েছিলাম মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে। আমিও চেয়েছিলাম এই পরিবারের কুসংস্কার, ভুলভাল নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে না বাঁধতে, কিন্তু পারিনি। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে এসেছি, মা, জেঠিমা, পিসিরা ভয়ে কাঁপছে, সর্বদা তটস্থ হয়ে আছে। দিদিরা আড়চোখেও কখনো কোনো তরুণের দিকে তাকায়নি, পাছে বেজে ওঠে ওই ভয়ঙ্কর ঘণ্টা। যদিও ওই ঘণ্টার আওয়াজটা ঠিক কেমন সেটা আজ পর্যন্ত শুনতে পায়নি দীপ্ত। নেহাত আজ নিশিগন্ধা ভুল করে বাজাল বলেই শুনলো।
শিউরে উঠেছিল আওয়াজটা শুনে। যদিও আর পাঁচটা মন্দিরের ঘন্টার মতোই গমগমে কিন্তু অনেক মিথ জড়িয়ে আছে বলেই অন্যরকম শিহরণ হয়েছিল ওর রক্তে। বড়পিসি এ বাড়ির সব থেকে বড় মেয়ে। যেদিন রাতে শেষ বেজেছিল মায়াঘণ্টা, যেদিন রায়চৌধুরী বাড়ি থেকে শেষ গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল…সেদিনই বড়পিসি হার্টফেল করে মারা গিয়েছিল। তখন দীপ্ত মাত্র ছয়মাসের বাচ্চা। পুরো ঘটনাটাই ও শুনেছিল জেঠিমার কাছে। কলকাতায় পড়তে যাওয়ার আগে জেঠিমাই বলেছিল, এমন কোনো অন্যায় কাজ করো না যাতে আবার শুনতে হয় মায়াঘণ্টার আওয়াজ। কেন জেঠুর বিরুদ্ধে খুনের কোনো কেস হয়নি সেটাও জানে না দীপ্ত। মনে হয় টাকা দিয়ে লাশ গায়েব করেছিল।
ভয়ে ভয়ে দিনরাত কাটতো দীপ্তর। অ্যানাটমির ক্লাসে ঢুকে দুবার কৈলাসনাথকে মনে মনে প্রণাম করত। মরা শরীরগুলো কাটার সময় ভয় করতো দীপ্তর।
কে জানে এতেও পাপ হচ্ছে না তো?
মেয়েদের শরীরের নানা অঙ্গ যখন প্রথম চিনেছিল, তখনও ভেবেছিল, পাপ করছি না তো।
আতঙ্কে কাটাতে কাটাতে কবে যে ও মানসিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে গেছে, সেটা নিজেও বুঝতে পারেনি।
নিশিগন্ধা ঘুমাচ্ছে, দুগাছা অবাধ্য চুল এসে পড়েছে ওর কপালে। কপালের সিঁদুরের টিপটাকে ধেবড়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে যেন।
দীপ্তর খুব ইচ্ছে করছিল, নিশিগন্ধার ভিজে ভিজে ঠোঁটদুটো একবার ছুঁয়ে দেখতে। কান্না পাচ্ছিল ওর। বলতে ইচ্ছে করছিল, আমিও রায়চৌধুরী বাড়ির ভয় কাটিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম নিশি, বিশ্বাস করো, রাত জেগে পড়ার সময় একা একা ভেবেছি, মুক্তির উপায় কি! খুঁজে পাইনি। তোমার মতো করে বলতে পারিনি নিশি। নীলাকাশে উড়ন্ত পাখিটাকে আমার বড্ড হিংসা হয় গো, স্বাধীন ডানা দুটো কেড়ে নিতে ইচ্ছে করে।
চোখের জলটা মুছে ফিসফিস করে বলল দীপ্ত, যতদিন না তুমি ডাকবে আমায়, ততদিন তোমার কাছে আসব না নিশিগন্ধা। আমি রেপিস্ট নই। ভালোবাসার কাঙাল।
দীপ্তর বোধহয় একটু ঘুম এসে গিয়েছিল মধ্যরাতে। ঘুম থেকে উঠেই দেখলো পাশে নিশিগন্ধা নেই। ঘুম চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, তখন সাড়ে চারটে বাজে। সূর্যের আলো শুধু অন্ধকারের চাদরটাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করছে। পুরোটা সরাতে পারেনি, তাই আধো অন্ধকার রয়েছে।
এসময় নিশিগন্ধা কি বাথরুমে গেল? পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল দীপ্ত। মিনিট পনেরো পরেই পা টিপে টিপে নিশিগন্ধা এসে ঢুকল ঘরে। দীপ্ত কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ হয়েই পরে রইল।
সকাল হতেই বিয়েবাড়ির আত্মীয়স্বজনের চিৎকারে রায়চৌধুরী বাড়ি জমকালো হয়ে উঠল।
বৈঠকখানা ঘরে দীপ্তানুকে ডেকে জেঠু আর বাবা বললেন, আজকেই তোমার হাসপাতালের উদ্বোধন হবে। তুমি রেডি থেকো। দীপ্ত বলল, কিন্তু বাবা, আমি একা কি করে হাসপাতাল চালাব?
বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী হাসি মুখে বললেন, আরো ডাক্তার আসছে তো। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশি মাইনে পাবে বলে কলকাতার ডাক্তাররা আসছে প্রতাপপুরে। ঠিক সেই সময়েই আবার ঘটল বিস্ফোরণ। নতুন বৌমা, যার গায়ে এখনো ফুলশয্যার গন্ধ, যারা পায়ের আলতা এখনো ফিকে হয়নি, যার সিঁদুর এখনো গোটা কপালময় ছড়িয়ে, সে এসে সবার মাঝে বলে বসলো, কিন্তু জেঠু, কলকাতা থেকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কয়েকজন ডাক্তারকে ধরে আনলেই তো আর প্রতাপপুরের হাসপাতাল ভালো চলবে না, বেস্ট ডক্টর আনতে হবে। স্পেশালিস্ট ডক্টর আনতে হবে। কার্ডিও, নেফ্রো, গাইনো, চাইল্ড এমন। বিভিন্ন স্পেশালিস্টদের আনতে হবে। একজন ডাক্তার মানেই তো সে সব জানে এমন নয়?
স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী। দরজার পিছন থেকে জেঠিমা আর মা ইশারা করে ডাকছে নিশিগন্ধাকে। তার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
গমগমে গলায় বাবা বললেন, তুমি এখানে কি করছ নতুন বৌমা? এঘরে তোমার ঢোকা নিষেধ, এ কথাটা তোমার শাশুড়িমা বলেননি তোমায়?
নিশিগন্ধা অবলীলায় বলল, কেন এ ঘরে কি আছে? আপনারা সবাই আছেন, আমি এলে কিসের সমস্যা?
বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, বৌমা যে ডাক্তারগুলোকে আনতে বলছে, সেটা কি ঠিক বলছে? একটা হসপিটালে এতরকম ডাক্তার লাগে?
দীপ্তানু ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, কথাটা ও ঠিকই বলছে। স্পেশালিস্ট ডক্টর হলে ভালো ট্রিটমেন্ট হয়। যেহেতু এই প্রতাপপুর কলকাতা থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে, তাই ট্রিটমেন্টের দরকার পড়লে, লোকে তো সবসময় কলকাতা ছুটতে পারে না!
বিজেন্দ্র নিশিগন্ধার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখছি আমরা ভাবনাচিন্তা করে, তুমি এখন ভিতরে যাও।
নিশিগন্ধা বলল, আমি এই আলোচনায় থাকলে আপনাদের কি ধরণের সমস্যা হচ্ছে? সেটা যদি একটু বলেন।
জেঠিমা ভিতর থেকেই ডাকলেন, নিশিগন্ধা, চলে এসো। ঘাড় গোঁজ করে, বিরক্ত হয়ে নিশিগন্ধা চলে গেল ভিতরে।
বাবা বললেন, দীপ্ত… বৌমাকে সহবত শিখিয়ে দিও। এটা রায়চৌধুরী পরিবার। কিছু নিয়মকানুন আছে এবাড়ির। আমরা যত্নে লালন করেছি সেগুলোকে। বৌমাকে শিখিয়ে দিও।
দীপ্তর মনে পড়ে যাচ্ছিল ফুলশয্যার রাতের কথাটা। একে কিছু শেখাবে কি করে সেটাই ভাবছিল মনে মনে। ওকে অন্যমনস্ক দেখে জেঠু বলল, তুমি হাসপাতালে এসো, নিজের কাজ বুঝে নাও। আমরা এত বুঝি না। বিঘের পর বিঘে জমির চাষবাস বুঝলেও ডাক্তারি আমরা বুঝি না, তাই তোমাকেই সেটা বুঝে নিতে হবে। দীপ্ত ঘাড় নেড়ে বলল, আমি আসছি।
দীপ্ত নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখল, একটা নীলচে শাড়ি পরে ভিজে চুলে দাঁড়িয়ে আছে নিশিগন্ধা।
জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে কৈলাসনাথ মন্দিরের চূড়ার দিকে। রোদের আলোয় চূড়ার ত্রিশূলটা চকচক করছে।
দীপ্ত ওর পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, নিশিগন্ধা…
জলে ভেজা চুলটা এসে ঝাপটা দিল দীপ্তর মুখে।
নিশিগন্ধার চুলের ডগায় জমে থাকা জলের বিন্দু এসে ভিজিয়ে দিল দীপ্তর গাল।
অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় ভরে গেল দীপ্তর মন।
নিশিগন্ধা অন্যমনস্কের মতো বলল, ওই ত্রিশূলটা কি রোজ পরিষ্কার করা হয়?
দীপ্ত বলল, আমি তো ঠিক জানিনা, তবে পুরোহিতমশাই চব্বিশঘণ্টা থাকেন মন্দিরের গর্ভগৃহে।
ভ্রু কুঁচকে নিশিগন্ধা বলল, আমি বৈঠকখানায় গেলে কি তোমারও অসুবিধা হয়?
দীপ্ত মাথা নিচু করে বলল, রায়চৌধুরী বাড়ির বউরা কেউ বাইরের ঘরে আলোচনার সময় যায় না।
নিশি কোমরে হাত দিয়ে বলল, সে তারা আলোচনার বিষয়বস্তু বুঝতে পারবে না বলে যায় না। আর তুমিই বা কি করে শুধু এম.বি.বি.এস ডক্টর দিয়ে হসপিটাল চালাতে চাইছো? নিজেই বা কেন এম.ডির জন্য পড়াশোনা করছ না?
লোকে তো ভরসা করে আসবে এই হাসপাতালে!
দীপ্ত সংকোচে গলা নামিয়ে বললো, বাবা, জেঠু যা ভালো বুঝবেন সেই নিয়ে….
নিশিগন্ধা ফিক করে হেসে বলল, তাহলে এক কাজ করো, তোমার বাবার গলায় স্টেথোস্কোপ আর তোমার জেঠুর হাতে ছুরি ধরিয়ে দিয়ে, তুমি কাল ট্রাক্টর নিয়ে চাষ করতে বেরও। দেখো, তোমার বাবা আর জেঠু নিশ্চয়ই ভালোই চিকিৎসা করবেন।
দীপ্তানু বেশ বুঝতে পারছিল, এ মেয়েকে এত সহজে বাগে আনতে পারবে না রায়চৌধুরীদের আভিজাত্যের অহংকার। বরং এই মেয়ে সে অহংকার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে খুব সহজেই।
দীপ্ত আলাপ করার ঢঙে বলল, তোমার তো সাইকোলজি ছিল, তাই না?
নিশিগন্ধা বলল, হ্যাঁ, সাইকোলজি নিয়ে পড়েছি বলেই তো আমি বুঝতে পারলাম, একমাত্র ছোটকাকু সুস্থ মানুষ এবাড়ির। বাকি সবাই পাগল। অকারণ অহংকারে ঢেকে রয়েছে সকলের মন। তাই স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি কাজ করছে না এদের।
দীপ্ত বিরক্ত হয়ে বলল, ছোটকাকুর সাথে বেশি কথা বলতে যেও না তুমি। এমনিতেই কাকু তোমার ছবি এঁকেছেন, আর তুমি মায়াঘণ্টা বাজিয়ে ফেলেছিলে, সেই নিয়ে আলোচনা চলছে। কবে কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যায় সেই নিয়ে সবাই ভয়ে আছে!
নিশিগন্ধা বলল, দীপ্ত, তোমাকে দেখতে এত সুন্দর, তোমার রেজাল্ট এত ভালো, কিন্তু তুমি এমন বুদ্ধু কেন?
নতুন বউয়ের মুখে বুদ্ধু কথাটা শুনতে মন্দ লাগল না দীপ্তর। বিশেষ করে কাল রাতে বউয়ের যে সব বাণী শুনেছিল, তার থেকে অনেক সেফ শব্দ বুদ্ধু।
দীপ্ত বলল, বেশ আমি না হয় বুদ্ধু, কিন্তু তোমাকে বেশি সাহসী হতে হবে না।
নিশিগন্ধা শাড়ি থেকে দাঁত দিয়ে একটা সুতো ছিঁড়ে বলল, এই সুতোটা এই শাড়িটাতে এক্সট্রা ছিল। তাই আমি এটাকে ফেলে দিলাম। তোমার মধ্যেও ভয় নামক একটা বস্তু এক্সট্রা আছে। ওটাকে যেদিন ঝেড়ে ফেলে দেবে, সেদিন থেকে নিশিগন্ধা তোমার।
দীপ্ত আলতো স্বরে বলল, কাল রাতের ব্যবহারের জন্য সরি।
নিশিগন্ধা মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, আমিও একটা খারাপ কথা বলেছিলাম, ওটার জন্য ওই দিন সরি বলব, যেদিন তুমি সত্যিকারের পুরুষ হয়ে উঠবে। দীপ্তর হাঁ করা মুখের সামনে দিয়েই নুপুর বাজিয়ে বেরিয়ে গেল নিশিগন্ধা।
বেরোনোর আগে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, বেস্ট অফ লাক ডাক্তারবাবু। তোমার হসপিটালের শুরুর জন্য।
দীপ্তর খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, যাক রেপিস্ট নই তাহলে।
নিশিগন্ধাকে শাশুড়ি আর জেঠশাশুড়ি মিলে অনেক বোঝালো, রায়চৌধুরী বাড়ির নিয়মকানুন।
মেয়ে সবটা মন দিয়ে শোনার পর বলল, তার মানে এ বাড়ির পুরুষরা কোনো পাপ করলে ও ঘণ্টা বাজে না তাই তো? শুধু মেয়েরা কিছু করলেই বাজে?
জেঠিমা বেশ রাগী গলায় বললেন, হ্যাঁ বাপু তাই বাজে। এ বাড়ির পুরুষরা কোনো দোষ করে না।
নিশিগন্ধা ভালো মেয়ের মতো চলে এল।
সন্ধেবেলায় যখন দীপ্ত হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরল, তখন দেখল নিশিগন্ধা ঘরে নেই।
মা, জেঠিমা টিভির সামনে মনোযোগ দিয়ে সিরিয়াল দেখছে। বাবা আর জেঠু যথারীতি তাসের আড্ডা বসিয়েছে। প্রতাপপুরে শহুরে কালচার প্রবেশ করলেও রায়চৌধুরীরা ইচ্ছে করেই তাদের বাড়িতে বনেদীয়ানা বজায় রেখেছে। এ বাড়িতে ঢুকলেই বোঝা যায় একবংশ শতাব্দীর ঝড়ো হাওয়াকে জোর করে বাইরে থমকে দেওয়া হয়েছে। জমিদারি প্রথা উঠে গেলেও এরা নিজেদের জমিদার বলতেই পছন্দ করেন। আর তাই চেষ্টা করে আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। সন্ধেবেলা টিভি সিরিয়ালের সাথে সাথে গ্রামোফোনের আওয়াজও ভেসে আসে। সকলেই রয়েছে, শুধু নিশিগন্ধা নেই দেখেই একটু অবাক লাগল দীপ্তর।
তাহলে নিশিগন্ধা কোথায়?
ছোটকাকুর ঘরে আলো জ্বলছে দেখে পায়ে পায়ে ঐদিকে এগোলো দীপ্ত।
একটা চেয়ারে চুল খুলে নিশিগন্ধা বসে আছে, আর কাকু একমনে তার সাদা ক্যানভাসে এঁকে চলেছে নিশিগন্ধাকে। নিশির ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি, কাকুর ক্যানভাসের ছবিতেও হাসিটা হুবহু এক।
দীপ্তর অসহ্য লাগছিল। দমবন্ধ হয়ে আসছিল।
বিরক্ত হয়ে দুমদাম পা ফেলে চলল নিজের ঘরে।
প্রায় আধঘণ্টা পরে নিশিগন্ধা এসে বলল, কেমন হল হসপিটালের কাজ? আমায় একদিন নিয়ে যাবে?
দীপ্তানু গম্ভীর হয়ে বলল, জীবনে হসপিটাল দেখো নি? মানুষের রোগ হলে ওখানে যায়। ওটা মিউজিয়াম নয়, যে দেখতে যাবে।
নিশিগন্ধা আলতো স্বরে বলল, জানো কারোর ভালোবাসা কেড়ে নেবার মতো পাপ আর হয় না। সেদিনও যদি মায়াঘণ্টা না বেজে থাকে, তাহলে আর কবে বাজবে।
দীপ্ত বললো, হেঁয়ালি আমি মোটেও পছন্দ করি না।
তুমি জানো দীপ্ত, রোজ রাতে তোমার মা কাঁদেন? আমি তো মাত্র কদিন এসেছি এবাড়িতে, তারমধ্যেই টের পেয়েছি।
তুমি জানো দীপ্ত, রোজ সকালে তোমার জেঠিমা অপমানিত হন?
দীপ্ত বোকার মতো তাকিয়ে বলল, মা কাঁদে কেন?
নিশিগন্ধা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বলল, সেটা তো তোমারই জানার কথা দীপ্ত। আমিও এখনো সঠিক জানিনা। তবে মায়ের কান্না দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি এই রহস্য খুঁজে বের করবোই।
দীপ্ত বলল, তোমার কি সব ব্যাপারে নাক না গলালেই চলছে না! নতুন বউ একটু ভদ্র হয়ে থাকো না। এর ওর ঘরে আড়িপাতার কি দরকার তো বুঝলাম না।
নিশি চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, আমি এখন এ বাড়ির মেম্বার। তাই এ বাড়ির সব কিছু জানাটা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। তুমি চোখ থেকেও অন্ধ, সেটা তোমার সমস্যা দীপ্ত।
দীপ্ত মনে মনে ভাবছিল, এই মেয়েটা এত কথা বলে কেন? সবেতে মাথা গলানোর স্বভাবটাই বা কেন?
দীপ্ত এবাড়ির ছেলে হয়েও এত কিছু জানে না। আর এই মেয়ে দুদিন বাড়িতে ঢুকেই এসব জেনে যাচ্ছে কি করে? এত কথা ওকে কে বলছে?
ছোটকাকু তো কম কথার মানুষ। সাতটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয়। আর কাজের লোকদের কাছ থেকে শুনবে, এমন রুচি নিশির নয়। ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল দীপ্ত। শুধু এটুকু বুঝল, নিশিগন্ধার এই অতিকৌতূহল ওর জীবনে বিপদ আনতে চলছে।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল নিজের মতো করেই।
হসপিটালের কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দীপ্তানু।
বারকয়েক কলকাতা যেতে হয়েছে। ও.টি-র জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করতে গিয়েছিল।
একটা ফাঁকা বিল্ডিংকে হসপিটাল বানিয়ে তোলা যে মুখের কথা নয়, সেটা বেশ বুঝতে পারছিল দীপ্ত।
তারমধ্যে রোজই বাড়ি ফিরে নিশিগন্ধার নামে কিছু না কিছু শুনছিলই।
ইদানিং বিরক্ত লাগছিল দীপ্তর। বেশি সাহসী হবার তো দরকার নেই। এতদিন যত্নে লালন-পালন করা সংস্কারকে হঠাৎ এসে ভেঙে ফেলার মতো দুঃসাহসিক কাজ তো আর নেই! নিশিগন্ধা বোধহয় সেই খেলতেই মেতেছে। দীপ্ত এ কদিনে যেটুকু তাকে চিনেছে তাতে বেশ বুঝেছে, এ মেয়ে কারোর কথা শুনে চলার মতো মেয়ে নয়।
ওকে দেখলে শান্ত মনে হলে কি হবে, আসলে নিশিগন্ধা বড্ড অবাধ্য।
রাতে বাড়ি ঢুকেই দেখল, ঘরের মধ্যে দুঃশ্চিন্তায় পায়চারি করছে নিশি।
দেখেই দীপ্তর ভয় হল, তার মানে আজ আবার কিছু ঘটিয়েছে। ও ঘরে ঢুকতেই আক্রমণ…
তোমার মা রোজ রাতে কেন কাঁদে তুমি জানো? ছেলে হয়ে এটুকুও খোঁজ রাখো না?
তোমার গরিব মামার বাড়িতে তোমার মাকে একবারের জন্যও যেতে দেওয়া হয় না। তোমার মামা খুব অসুস্থ, তুমি জানো দীপ্ত?
তার চিকিৎসার জন্য তুমি কি করেছ? তুমি তো সম্পর্কে তার ভাগ্না হও, তুমি খোঁজ নিয়েছ তার?
দীপ্ত মাথা নিচু করে বলল, যেটা জানো না, সেটা নিয়ে কথা বলো না। আমার মা মামার বাড়ি যায় না, কারণ বাবার অপমান হবে তাই। মামাদের অবস্থা একেবারেই ভালো নয়, বাবা সাহায্য করতে গিয়েছিল, মামা জেদ করে নেয়নি। সেই থেকেই ও বাড়ির সাথে সম্পর্ক নেই আমাদের। মা নিজেই রাখেনি।
নিশিগন্ধা বিদ্রুপের স্বরে বলল, রাখতে দেননি তোমার বাবা। দেখো এবার থেকে রোজ রাতে বাজবে তোমাদের মায়াঘণ্টা। রোজ রাতে তোমার মায়ের চোখের জল পড়ে যে। তাই তোমার বাবার পাপের জন্যই বাজবে।
দীপ্ত চিৎকার করে বলল, আর তোমার পাপ? এই যে ছোটকাকুর সাথে এই কদিনের মধ্যেই এমন সম্পর্ক বানিয়ে ফেললে, যে তার মডেল হয়ে গেলে! প্রায় দিনই দেখতে পাই কাকুর ক্যানভাসে তোমার অবয়ব। বিভিন্ন পোজে তুমি রয়েছ কাকুর রংতুলিতে। এটা বুঝি পাপ নয়?
নিশিগন্ধার চোখের তীব্র ঘৃণায় বিদ্ধ হচ্ছিল দীপ্ত। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই ও বলল, সম্পর্কে উনি তোমার শ্বশুর হন।
নিশিগন্ধা হিসহিসে গলায় বলল, হ্যাঁ হন। শ্বশুর হলে কি আমার ছবি আঁকতে নেই? উনিও ছবি আঁকতে ভালোবাসেন, আমিও ছবি ভালোবাসি। এতে পাপের কি দেখলে? দীপ্ত বলল, নিজের মনকে জিজ্ঞেস করো, ঠিক উত্তর পেয়ে যাবে।
—নিশিগন্ধা শুধু অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ছিঃ।
দুজনেই জেগে আছে একই খাটের দুটো প্রান্তে। মাঝের শূন্যতাটা ওদের দূরত্বটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দীপ্ত হঠাৎ বসে বলল, শুনতে পাচ্ছ?
মায়াঘণ্টার আওয়াজ। দীপ্তর গলা ভয়ে শুকিয়ে গেল। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা।
রায়চৌধুরী বাড়ির সব ঘরে জ্বলে উঠল আলো। সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
নিশিগন্ধাও বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
সবার মনেই এক প্রশ্ন, কেন বাজল ঘণ্টা!
হঠাৎই রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে নিশি বলে উঠল, মা আপনার চোখে জল কেন?
কাঁদছিলেন? কে ফোন করেছিল একটু আগে?
মামা কি আর বেঁচে নেই?
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দীপ্তর মা। এসব কথা এই মেয়েটা কি করে জানল! কেউ তো খবরও রাখেনি তার। কোনোদিন তার চোখের জলও দেখতে পায়নি কেউ। চোখ থেকে বেরিয়ে গালেতেই শুকিয়ে গেছে। এবাড়ির কেউ লক্ষ্য করেনি। আজ এই মেয়েটা প্রথম ওর নোনতা জলের খোঁজ নিচ্ছে। কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে দেখেই হয়তো কষ্টটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল রাজেন্দ্র রায়চৌধুরীর স্ত্রীর।
থরথর করে কাঁপছে দীপ্তর মা। জমিদার গিন্নির সব ব্যক্তিত্ব ভুলে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে, জড়ানো গলায় বললেন, দাদা বিকেলেই মারা গেছেন। যেতে দিল না কেউ আমায়। এখন দাহ করে ফিরল হয়তো।
নিশিগন্ধা বলল, ওই জন্যই বোধহয় বাজল মায়াঘণ্টা। রায়চৌধুরী বাড়ির পাপে বেজে উঠল। দাদার মৃত্যুতে বোনকে যেতে না দেওয়ার মতো পাপ আর বোধহয় নেই।
বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, দীপ্ত, অনেক হয়েছে অনাচার, এই বউকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। রায়চৌধুরী বাড়িতে জায়গা হবে না এমন মুখরা, অপয়া বউয়ের।
শুনেছিলাম বৌভাতের দিনই নরেন্দ্রর খারাপ দৃষ্টিতে তাকানোর পরেই বৌমা বাজিয়েছিল ওই ঘণ্টাটা।
অপয়া বউকে ফেরত দিয়ে এসো।
দীপ্ত নিশ্চুপ দর্শক হয়ে দেখছে। মনে মনে রেগে উঠছে কাকুর ওপরে। সময়ে বিয়ে না করার জন্যই এমন চারিত্রিক অবনতি হয়েছে কাকুর। সেই জন্যই দীপ্তর জীবনটা শেষ হয়ে গেল এক লহমায়।
রাজেন্দ্র রায়চৌধুরী বললেন, আমাদের পরিবারের এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন আছেন, যারা আমাদের অপমান করেছেন। আমরা তাদের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখি না। যদি কেউ রাখতে চায়, তাহলে এ বাড়ি থেকে যেন সে বেরিয়ে যায়।
কথাগুলো যেহেতু দীপ্তর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলা, তাই সে তাড়াতাড়ি আশ্রয়চ্যুত হবার ভয়েই নিজের আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিল।
নিশিগন্ধাকেও এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। বিজেন্দ্র রায়চৌধুরীর কথাই এ বাড়ির শেষ কথা।
নিজের ঘরে ঢুকেই দীপ্ত বলল, কেন এমন করলে নিশি? কেন সব কিছুকে ওলটপালট করে দিলে?
নিশিগন্ধা বলল, প্রতাপপুর ছাড়ার আগে আমার আরেকটা কাজ বাকি আছে, সেটা একদিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে।
দীপ্ত অপলক চোখে তাকিয়ে আছে নিশির দিকে। মেয়েটার চোখে কোনো ভয় নেই। গলায় কম্পন নেই। সংসারে প্রবেশের আগেই বদনাম নিয়ে চলে যাবার দুশ্চিন্তা নেই। এক বুক হতাশা আর কষ্ট নিয়েই শুয়ে পড়ল দীপ্ত।
ভোররাতে ঘুম ভাঙতেই দেখল, নিশিগন্ধা নেই।
মনের মধ্যে সন্দেহ হতেই চুপি চুপি গিয়ে দাঁড়াল কাকুর ঘরের সামনে। ভিতরে ফিসফিস করে শুনতে পাচ্ছে নিশির গলার আওয়াজ। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল দীপ্ত।
নিশিগন্ধা বলছে, বিয়েটা আজকেই করতে হবে।
আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, তার আগেই এই কাজটা সারতে হবে। ভয় পেলে একদম হবে না।
বড়পিসি যে ভাবে মরেছে আমরা মরব না।
বিয়েটা আজ রাতের লগ্নেই সারতে হবে। এই গয়নাগুলো এখানে থাকল….
ঘেন্নায় দীপ্তর ঠোঁটটা বেঁকে যাচ্ছিল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না ওর। শেষ পর্যন্ত নিশিগন্ধা ছোটকাকুকে বিয়ে করতে চাইছে?
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক, সম্পর্কে শ্বশুর হয়, তাকে!!
এই ছোটকাকু বাবার থেকে বয়েসে অনেকটাই ছোট। দীপ্তকে ছোট থেকে কত ভালোবেসেছে কাকু, বাবার থেকেও বেশি। এখন অবশ্য কাকু একটু কেমন হয়ে গেছে, নিজের গণ্ডির বাইরে বেরোতেই চায়না। মা বলে, সময়ে বিয়ে না করলে এমন তো হবেই। এবাড়ির ছেলে, ছাব্বিশের পর অবিবাহিত ঘুরছে, কৈলাসনাথের অভিশাপেই মাথাটা গেছে। মা জেঠিমার মুখে শুনে শুনে দীপ্তরও দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, এবাড়ির ছোট ছেলে নরেন্দ্র রায়চৌধুরীর সত্যিই মাথা খারাপ।
কিন্তু নিশিগন্ধার হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণটা কি!
যদি সত্যিই নিশি এটা করে, তাহলে প্রতাপপুরে রায়চৌধুরী বাড়ির সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না। দীপ্তানু রায়চৌধুরীর দিকে লোকে আঙুল দেখিয়ে বলবে, এর বউ বিয়ের মাসখানেক পরেই কাকাশ্বশুরকে বিয়ে করেছে।
দীপ্তর কাছে যে অসহায় রোগীরা আসবে, তারাও ফিকফিক করে হাসবে।
অসহ্য যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে দীপ্তর। দমবন্ধ হয়ে আসছে ওর। নিশি এরকম করলে ওকে আত্মহত্যা করতে হবে। লজ্জায়, অপমানে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ওর।
নিশিগন্ধা ঘরে ঢুকতেই দীপ্ত বলল, কোথায় ছিলে?
একটু অপ্রস্তুত গলায় নিশি বলল, পাশের ঘরে।
দীপ্তর আর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল না, কেন এমন করতে চলেছে ও?
তার বদলে জানতে চাইল, তোমার প্যাকিং কমপ্লিট? শুনেছ তো, জ্যেঠু তোমাকে ওবাড়িতে দিয়ে আসতে বলেছে!
নিশিগন্ধা বলল, শুনেছি। তুমিও নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হয়েছ আমাকে তাড়াতে পেরে।
নতুন জীবন শুরু কর দীপ্ত। একটা ঘরোয়া, বাধ্য মেয়েকে বিয়ে করে নিও। যে তোমাকে সম্মান করবে, ভালোবাসবে।
নিশিগন্ধার চোখে জল চিকচিক করছে।
দীপ্ত মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তুমিও নতুন জীবনে খুশি থেকো। অনেক বিবেচনা করেই নিশ্চয়ই এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ!
লোকে বলে ভালোবাসা অন্ধ, কথাটা বোধহয় খুব সত্যি তাই না নিশিগন্ধা?
নিশিগন্ধা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, সত্যি ভালোবাসা অন্ধ। মানুষ অনেক সময় এমন কাউকে ভালোবেসে ফেলে, যাকে সে অপছন্দ করে।
এটা কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, একটা মানুষের সব কিছু বিরক্তিকর, অথচ সে মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলছে, তাই না দীপ্ত?
আলমারি খুলে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল নিশিগন্ধা। এত কম দিনে বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি খুব কম মেয়েরই ঘটেছে। নিশির জন্য হয়তো ওর বাবা-মাকে সমাজের চোখে ছোট হয়ে যেতে হবে। কিন্তু তাই বলে এসব অন্যায় সহ্য করা সত্যিই সম্ভব নয় ওর পক্ষে। বিশেষ করে যার হাত ধরে এ বাড়িতে ঢুকেছে সেই মানুষটাও এদেরই দলে।
দীপ্তর উদাসীন চোখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা গুছিয়ে নিল নিশিগন্ধা। তবে আজকের এই অপমানের শোধ নিয়ে তবে ও রায়চৌধুরী বাড়ি ছাড়বে। নিশিগন্ধা এমনই জেদি মেয়ে। বরাবর ঠিক টাকে ঠিক আর ভুলটাকে ভুল বলে অপ্রিয় হয়েছে ও লোকের চোখে। কিন্তু তবুও এটা অভ্যেস হয়ে গেছে। এ বাড়ি থেকে দেওয়া গয়নাগুলো বক্সে ঢুকিয়ে দীপ্তর হাতে দিয়ে বলল, তাকে দিও। বিয়ের আংটিটাও আছে এর মধ্যে।
দীপ্তানু কথা না বলে তাকাল নির্ভীক চোখ দুটোর দিকে। মনের মধ্যে তোলপাড়টা অনেকক্ষণ ধরেই চলছে। চিরকাল মুখচোরা ছেলে বলে পরিচিত ছিল স্কুল, কলেজে। তাই নিশিগন্ধার সাহস দেখে মনে মনে মেয়েটাকে সম্মান করতে শুরু করেছিল। সম্মান থেকেই হয়তো জন্ম নিয়েছিল ভালোবাসার। কিন্তু নিশিগন্ধার কাকুর সাথে নিজের মুখে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল দীপ্ত।
একঘর শূন্যতার মধ্যে শুধু দুজনের নিশ্বাসের আওয়াজ। নবদম্পতির ভাঙা ঘরে কোনো জোনাকিও প্রবেশ করেনি ভুল করে। অন্ধকারে কোনো আলোক রেখা নেই যেন। ভোরের আলোও যেন থমকে গেছে দুয়ার প্রান্তে এসে।
সকাল সকাল দীপ্ত বেরিয়ে গেল। হসপিটালের কয়েকটা কাজ আছে। কালকেই নিশিগন্ধার বাপের বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসতে হবে ওকে। যদি অবশ্য তার আগে ও নিজেই না পালিয়ে যায়।
কাজের ফাঁকে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল ও।
ইচ্ছে করেই দুপুরে আর বাড়ি ফিরল না। মুখোমুখি হতে চায়না নিশিগন্ধার। ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরোতে পারে ততই সুবিধা। ভুলতে হবে নিশিগন্ধার ভিজে চুলের গন্ধ, ভুলতে হবে ওর দীঘল চোখের সাহসী চাহনি। এ একমাসের সব কিছু ভুলতে হবে দীপ্তকে।
বাড়ি ফিরেই দীপ্ত দেখল, নিশিগন্ধা নিজের মনে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে।
একটা গোলাপি শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, সিঁথিতে এখনো সিঁদুরটা বেশ লাল হয়েই রয়ে গেছে। দীপ্তর ওর সিঁথির দিকে তাকাতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। নিশিগন্ধাও জানে আর কোনো কথাই নেই দুজনের মধ্যে। অবশিষ্ট সময়টুকু একরাশ অস্বস্তি নিয়ে কোনোমতে কাটিয়ে দেওয়া।
দীপ্তর ঘুম আসেনি। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে লুকাতে চাইছে নিশিগন্ধার থেকে। খুব সন্তর্পণে খাট থেকে নামল নিশিগন্ধা। তারপরে হাতে কিছু একটা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। দীপ্ত জানে ওরা কোথায় যাচ্ছে। আটকাবে না দীপ্ত। যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই করুক নিশিগন্ধা। ভালো থাকুক ও।
পা টিপে টিপে এগোল নিশিগন্ধা। রায়চৌধুরী বাড়ির জনপ্রাণী টের পেলেও হবে না। আজ রাত ভোর হলেই ওকেও বেরিয়ে যেতে হবে এই বাড়ি থেকে। তারমধ্যেই ও চরম প্রতিশোধ তুলবে এই বাড়ির বিরুদ্ধে। নরেন্দ্র রায়চৌধুরী যখন সাথ দিচ্ছে, তখন এদের এতদিনের লালিত কুসংস্কারের মুখে একটা থাপ্পড় মারবেই নিশিগন্ধা।
নরেন্দ্র রায়চৌধুরী একটু ভীত গলায় বলল, যদি মায়াঘণ্টা বেজে ওঠে তাহলে কিন্তু যে কোনো একজনের প্রাণ যাবে। নিশিগন্ধা বলল, তাড়াতাড়ি চলো তুমি। ভয়ের কিছু নেই, এতদূর এগিয়ে এখন ফিরে আসার কোনো মানেই হয় না।
নরেন্দ্র চেপে ধরল নিশিগন্ধার হাতটা।
ফিসফিস করে বলল, তুমি এখনও বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী আর রাজেন্দ্র রায়চৌধুরীকে চেনই না। আমি তোমাকে যেটুকু বলেছি সেটা যৎসামান্য। ওদের চিনলে তুমি এসব করার সাহস দেখাতে না নিশি। মাত্র একমাস হলো তুমি এবাড়িতে এসেছ। আমার কাছ থেকেই জেনেছ সবকিছু। যদি নিজে ওদের রূপ দেখতে তাহলে হয়তো পিছিয়ে যেতে।
পরিবারের সম্মানহানির ভয় থাকলে ওরা সব থেকে প্রিয়জনকে শেষ করে দিতেও পিছপা হয় না। বড়দি যে ছেলেটার সাথে পালাচ্ছিল, সে ছেলেটাকে মেরে ফেলার পরে, পুলিশকে কিনে নিতে ওদের দুদিনও লাগেনি। এই যে মেজবৌদির দাদা মারা গেল, তাতেও মন গলল না এদের। আমি কতবার মেজবৌদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে ওদের বাড়িতে দিয়ে এসেছি লুকিয়ে। বাড়িতে জানতে পারলে আর রক্ষে থাকত না নিশিগন্ধা। আজ তুমি আগুনের সাথে যুদ্ধে নেমেছ। আমি আমার কথা ভাবছি না, আমি ভাবছি তোমার কথা। তোমাকে তো আর থাকতে দেবে না এই বাড়িতে। যদি একবারও দাদারা জানতে পারে ওই দিন রাতে আমার লোকেরা মায়াঘণ্টা বাজিয়েছিল, তাহলেও কিন্তু আর রক্ষা নেই।
নিশিগন্ধা বলল, ওইদিন মায়াঘণ্টা বাজার দরকার ছিল। মায়ের কান্নার প্রতিশোধ নেবার জন্যই প্রয়োজন ছিল। ভাবুক রায়চৌধুরী বাড়ির লোকেরা,শুধু মেয়েরা অন্যায় করলেই মায়াঘণ্টা বাজে, তাই নয়। এবাড়ির পুরুষদের অন্যায়েও বাজে মায়াঘণ্টা।
নিশিগন্ধা নরেন্দ্রর হাতটা ধরে ঝটকা টান দিয়ে বলল, ওই গাছটার পিছনে একটু দাঁড়াও। কেউ মনে হচ্ছে আমাদের ফলো করছে। একটা পায়ের শব্দ পেলাম যেন।
আর কোনো রাস্তা আছে কৈলাসনাথ মন্দিরে পৌঁছানোর?
এদিক ওদিক তাকিয়ে নরেন্দ্র বলল, পিছনের গেট দিয়ে বেরোলেই সামনে পড়বে মন্দিরের দরজা।
সদানন্দ তান্ত্রিক ওখানে বসে সাধনা করে। ওদিকে একটা ছোট কালী মন্দিরও আছে। ওখানে গ্রামের লোকের ঢোকা বারণ। ওর পাশ দিয়ে দুটো সিঁড়ি উঠলেই কৈলাসনাথ মন্দিরের চাতালে পৌঁছে যাওয়া যাবে। নিশিগন্ধা বলল, তাহলে তাই চলো।
অন্ধকারে দুটো ছায়া মূর্তি খুব সাবধানে পা ফেলে এগোচ্ছে। তবুও ভয় পাচ্ছে নরেন্দ্র। সে এবাড়ির সকলকে চেনে। একটা কাজের লোকও যদি ওদের বেরোতে দেখে থাকে তাহলেই খবর চলে যাবে বিজেন্দ্র রায়চৌধুরীর কানে। আর যদি তার মধ্যেই মায়াঘণ্টা বেজে ওঠে রাতের নিস্তব্ধতাকে বিঘ্ন করে, তাহলে গোটা প্রতাপপুর জেগে উঠতে সময় নেবে না।
নিশিগন্ধা ফিসফিস করে বলল, এসে গেছি, তাই না?
নরেন্দ্র ইশারায় দেখাল, সদানন্দ তান্ত্রিক আগুন জ্বালিয়ে পাহারায় বসে আছে। তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মন্দিরে পৌঁছানো সত্যিই কঠিন।
তবুও ওরা খুব সাবধানে পৌঁছাল মন্দিরে। নিশিগন্ধা বলল, তোমাকে যা যা করতে বলেছিলাম সেগুলো করেছ তো? নরেন্দ্র ঘাড় নেড়ে বলল, তোমার কথামতোই কাজ করেছি। ওই তো ও এসে গেছে….
সাদা থান পরে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন মন্দিরের চাতালে। ভয়ে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে।
নিশিগন্ধা তার কানে কানে বললো, ঐদিকে গিয়ে তাড়াতাড়ি এগুলো পরে নাও। আমাদের হাতে সময় কম। মহিলা ভয়ে ভয়ে বলল, আমি রায়চৌধুরী বাড়ির বউ হতে চাই না। আমি শুধু ছোট রায়চৌধুরীকে ভালোবাসতে চাই আজীবন। ওনার কোনো ক্ষতি হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। উনি কেন বিয়ে করেননি সে শুধু আমি জানি। আমার বিয়ের আগে থেকেই আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি গরিবের মেয়ে, তাই বাবা যাকে পারল ধরে বিয়ে দিয়ে দিল। তার কঠিন অসুখ ছিল, সে খবরও কেউ নিল না। বছর ঘোরার আগেই বিধবা হয়ে ফিরে এলাম প্রতাপপুরে।
সেই থেকেই আমি দূর থেকে দেখি ছোট রায়চৌধুরীকে। কতবার বলেছি, বিয়ে করে সংসার করো, কে শোনে কার কথা।
নিশিগন্ধা বলল, আর দেরি নয় রুক্মিণী কাকিমা, আমি এগুলো সব জানি। কাকু আমায় সব বলেছে। এই কদিনেই কাকু আমায় তার মেয়ের মত স্নেহ করেছে। তাই তো আমি এ বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে, তোমাদের এক করে দিয়ে যেতে চাই। আমি নরেন্দ্র রায়চৌধুরীকে বাবার আসনে বসিয়েছি। ইনি একমাত্র মানুষ যিনি এই পরিবারে বাস করেও, ভালোবাসা নামক শব্দের জন্য গোটা জীবনটাকে নষ্ট করতে পারেন।
লাল বেনারসী আর নিশিগন্ধার দেওয়া গয়না পরে, সেজেছে রুক্মিণী। নরেন্দ্র অপলক তাকিয়ে আছে তার শৈশবের প্রেমিকার দিকে। কত কত বছর থেকে একমনে এই মেয়েটাকে চেয়েছে ও। নিশিগন্ধা বলল, কাকু দেরি করো না। মন্দিরে ঢুকে সিঁদুরটা আগে পরিয়ে দাও।
রুক্মিণী ভয়ে ভয়ে বলল, যদি বেজে ওঠে মায়াঘণ্টা?
নিশিগন্ধা বলল, কিছু হবে না। ভালোবাসার জয় হবে।
সিঁদুর হাতে নিয়ে নরেন্দ্র এগোচ্ছিল রুক্মিণীর দিকে। কৈলাসনাথের পাশে পার্বতী মূর্তির পায়ের কাছে রয়েছে অসংখ্য সিঁদুর কৌটো। এখানে বিয়ের পরে সবাই আসে সিঁদুর পরতে। দুপা এগোতেই সদানন্দ তান্ত্রিক গমগমে গলায় বলল, পাপ…ভয়ানক পাপ…লাল কৌপিন পরে সে এগোচ্ছে মায়াঘণ্টার দিকে। ঘণ্টা বাজাতেই হবে তাকে। এতদিন পর্যন্ত যেকোনো খারাপ কাজের আগে সে নিজে হাতে বাজিয়েছে মায়াঘণ্টা। প্রতাপপুরের লোকে জানে মায়াঘণ্টা অলৌকিক শক্তিতে বাজে, মন্দিরের বিগ্রহ নিজেই বাজায়, কিন্তু সদানন্দ জানে তার দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা নেই এখানের লোকের। তাই ভুল দেখলেই রায়চৌধুরীদের সতর্ক করে এসেছে ও দীর্ঘ এত বছর ধরে। আজও ছোট রায়চৌধুরীর বিয়ের আগেই বাজাতে হবে ঘণ্টাটা। তাহলেই আটকে যাবে এই ঘোর পাপ। নিচু জাতের মেয়েটা কিছুতেই বউ হতে পারে না ওই বাড়ির। সদানন্দ এগোচ্ছে…নরেন্দ্রর চোখে অসহায় চাহনি। নিশিগন্ধা বিহ্বলের মতো বলল, তাড়াতাড়ি করো কাকু।
সিঁদুর দেবার আগেই সদানন্দ বিশাল ঘণ্টার দড়িটা ধরে টান দিল। কিন্তু বাজল না ঘণ্টা।
একহাতে করে ঘণ্টার দড়িটা চেপে ধরে আছে দীপ্তানু রায়চৌধুরী। সদানন্দ একটু যেন থমকে গেছে। দীপ্ত বলল, কাকু পরিয়ে দাও।
ঘণ্টা বাজবে না, জয় হবে ভালোবাসার।
রুক্মিণীর সাদা সিঁথিটা সিঁদুরে রাঙা হয়ে উঠল।
নরেন্দ্র বলল, রুক্মিণী আমরা পেরেছি। কৈলাসনাথকে সাক্ষী করে বিয়ে করতে পেরেছি। সেই কোন ছোটবেলায় আমরা এই মন্দিরে এসে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমরা বিয়ে করব, আজ বুড়ো বয়েসে এসে আমার মেয়েটার জন্য সেটা সত্যি হল। জানো রুক্মিণী, সাহস দরকার হয়। আমার মেয়েটার বড্ড সাহস। প্রথম দিন বাড়িতে ঢুকেই আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, কাকু আপনার চোখে এত কষ্ট কেন? আমাকে মেয়ে ভেবে সবটা বলে দিন তো! আমি বলেছিলাম, আমাকে তুমি বল রে মা। এতদিন এবাড়িতে ঘুরছি কেউ আমার মনের দুঃখের খবর নেয়নি। আর মাত্র কদিন এসেই নিশি বুঝেছিল, আমার মনে নিশ্চয়ই কোনো কষ্ট জমা আছে। ওর সাহসের জন্যই আজ আমরা এক হতে পারলাম।
রুক্মিণী নিশিগন্ধার মাথায় হাত রেখে বলল, সুখে সংসার করো।
সদানন্দ গজরাতে গজরাতে বলল, এ ঘোর পাপ…মায়াঘণ্টা বাজবেই, বাজবেই মায়াঘণ্টা।
দীপ্ত তখনও দড়িটা চেপে ধরে বলল, না বাজবে না মায়াঘণ্টা।
দীপ্তানু বলল, কাকু চলো বাড়িতে যাই। নরেন্দ্র বলল, কিন্তু দাদারা…
নিশিগন্ধা বলল, তুমি অন্যায় করোনি কাকু। মনটাকে শক্ত করো। চলো বাড়িতে যাই।
ওরা বাড়িতে ঢুকেই দেখল, মায়াঘণ্টা না বাজলেও রায়চৌধুরী বাড়ির সকলে জেগে গেছে। কেউ বোধহয় খবরটা দিয়ে দিয়েছে। বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী পায়চারি করছে আর বলছে, এখুনি বিদেয় করো মেয়েটাকে। ওই অপয়া মেয়েটাই এবাড়ির সর্বনাশ করছে।
নরেন্দ্রর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে নিশিগন্ধা। ও আস্তে আস্তে বলল, এবারে মুখ খুলতে হবে কাকু, তোমাকে বলতেই হবে। এ বাড়িতে তোমারও অধিকার আছে। আমার দিব্যি, বলতেই হবে।
নরেন্দ্র কাঁপা গলায় বলল, দাদা, রায়চৌধুরী বংশের রক্ত আমার গায়েও বইছে। তাই আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এবাড়িতেই থাকব।
রাজেন্দ্র রায়চৌধুরী আর বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী অবাক হয়ে নিজেদের হেরে যাওয়া দেখছিলেন। শান্তশিষ্ট ভাইটার নতুন রূপ দেখে তারাও বিস্মিত।
বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী বললেন, দীপ্ত, গাড়ি রেডি আছে, এই মেয়েকে এখুনি ফেরত দিয়ে এসো ওদের বাড়িতে। ডিভোর্স, কোর্ট-কাছারি আমরা পরে সামলে নেবো। আগে একে বিদেয় করো।
দীপ্ত নিশিগন্ধার হাতটা ধরে বলল, জেঠু, আমি ওকে শাস্ত্রমতে বিয়ে করে এনেছি। তাই ওর সব দায়িত্ব আমার। ওর সব অন্যায়ের দায়ও আমার। ওকে নিয়ে আমি আজই কলকাতা চলে যাচ্ছি।
রাজেন্দ্র রায়চৌধুরী তার অবাধ্য সন্তানকে বললেন, ভেবে দেখো…আমাদের সকলকে ছেড়ে তুমি…
দীপ্ত কিছু বলার আগেই নরেন্দ্র বলল, না, দীপ্ত এখানেই থাকবে। আমার ভাগে ওরা থাকবে। সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ওপরে উঠে গেল ওরা।
দীপ্তর মা এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, কৈলাসনাথ তোমার মঙ্গল করুক বৌমা। তুমিই হয়তো পারবে এবাড়ির সব নিয়ম ভাঙতে। আমরা তো ভীতু, কিন্তু তোমার তো অনেক সাহস মা। তুমিই পারবে।
নিশিগন্ধা মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আমি একা সাহসী হলে তো হবে না মা। আপনাকে, জেঠিমাকেও সাহসী হতে হবে।
জেঠিমা একটু দূর থেকেই বললেন, ধন্য মেয়ে তুমি।
বেঁচে থাকো। নরেন্দ্রর কষ্ট দেখে আমারও খুব মনখারাপ হত। কিন্তু কিছু করব, সে সাহস কোথায়!
কথাটা বলতে বলতেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের গলার হারটা খুলে রুক্মিণীকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, ভালো রাখিস নরেন্দ্রকে। ও যে বড্ড বাড়ি ছাড়া।
জানিনা, আরো কত ঝড় আসতে চলেছে। এরা কি আর চুপ করে থাকবে!
নিশিগন্ধা বলল, জেঠিমা, আমরা এতজন। বাবা আর জ্যেঠু তো মাত্র দুজন। দেখি না কারা জেতে।
জেঠিমা বললেন, নরেন্দ্র রুক্মিণীকে নিয়ে ঘরে যাও। মেয়েটা ভয়ে আধখানা হয়ে গেছে। সবাই তো আর ডাকাত নয়। কথাটা নিশিগন্ধার দিকে তাকিয়েই বললেন।
নিজেদের ঘরে ঢুকেই নিশিগন্ধা অভিমানী গলায় বলল, আজ তো আমাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসার কথা ছিল….
দীপ্তানু পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বললো, এমন সাহসী, ডাকাত বউকে অন্য কোথাও পাঠাতে সাহস পাচ্ছি না।
নিশিগন্ধা ছটফট করতে করতে বলল, কেন?
কানের লতিতে হালকা করে কামড়ে দীপ্তানু বলল, আমার মনটা ডাকাতি করে নিয়ে পালাচ্ছিল, তাই ভেবে দেখলাম, এই ডাকাতকে বন্দী করে রাখতে হবে।
নিশিগন্ধা অস্ফুটে বলল, আমি একা ডাকাত না, তুমিও বেশ বড়সড় ডাকাত। তাই আজ রাতে মন্দিরের চত্বরেই আমার সমস্ত মনের ওপরে দখল নিয়ে নিলে।
দুটো শরীর মিশে যাচ্ছিল, ভেসে চলছিল আবেগে। আর ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল রায়চৌধুরী বাড়ির অযৌক্তিক কিছু নিয়মের বেড়াজাল। মায়াঘণ্টা যেন চিৎকার বলছিল, ভালোবাসি…ভালোবাসি।
সমাপ্ত