প্রতিদ্বন্দ্বী
ক্লাসে ঢুকেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল মৌপিয়া। বাইরে থেকে মা হাত নেড়ে চুপ করতে বলছে তবুও নার্সারীর মৌপিয়া মল্লিকের কান্না কিছুতেই থামছে না।
হঠাৎই একটা ছেলে এসে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তুই কি বুদ্ধু? স্কুলে এসে পড়াশোনা করতে হয়, জানিস না? স্কুলে এসে কেউ কাঁদে?
অতিপক্ক ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল মৌপিয়া।
ছেলেটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। বেশ বিজ্ঞ বিজ্ঞ মুখ করে বললো, অভীককে দেখে শেখ। আমি স্কুলে ঢুকেই মাকে বললাম, টা টা। নিজের চোখটা টেনে দেখিয়ে বলল, দেখ, অভীকের চোখে জল আছে কি।
ফোঁপানি থামিয়ে মৌপিয়া বলল, তোর নাম অভীক?
অভীক একটু গম্ভীর গলায় বলল, শুধু অভীক নয়, আমার নাম, অভীক সেন। আমার আরও নাম আছে, বিটু, মটু, বাবাই…তোর যেটা পছন্দ, তুই সেই নামে ডাকিস।
মৌপিয়া চোখে জল নিয়ে ফিক করে হেসে বলেছিল, আমার মটু নামটা পছন্দ। অভীক নাক কুঁচকে বলেছিল, বেশ ক্লাসে অভীক বলে ডাকিস, কিন্তু আড়ালে তুই মটু বলতে পারিস। মৌপিয়ার কান্না থেমে গিয়েছিল অভীকের বকবকানি শুনে। সবজান্তার মতো অনেক কিছু শোনাচ্ছিল অভীক। এমনকি দু-কলি গান গেয়েও শোনালো। তারপর কানে হাত দিয়ে বলল, আমি শ্রদ্ধেয় মেঘবর্মন রায়ের কাছে গান শিখি। মৌপিয়া বলল, আমিও গান গাই, মা বলেছে আমাকে গান শেখাবে।
বন্ধুত্বটা শুরু হয়েছিল স্কুলের প্রথম দিনেই।
কিন্তু টেকেনি বেশিদিন। কি করে যেন একতরফা কম্পিটিশনে পরিণত হয়েছিল। অভীক চেয়েছিল টিকিয়ে রাখতে, খুব যত্ন করে আগলে রাখতে, কিন্তু মৌপিয়া ক্লাস ওয়ানে সেকেন্ড হয়ে যাওয়ায় বিপত্তিটা বেঁধেছিল।
ক্লাস টিচার যেমনি বললেন, মৌপিয়া মল্লিক সেকেন্ড আর অভীক সেন ফার্স্ট হয়েছে, ঠিক তখন থেকেই নিষ্পাপ হাসিটা হারিয়ে গিয়েছিল মৌপিয়ার ঠোঁট থেকে।
নার্সারীতে মৌপিয়া ফার্স্ট হয়েছিল, অভীক কিছুই হয়নি। কিন্তু ক্লাস ওয়ানে এসে সব হিসেব এলোমেলো করে দিয়ে অভীক হয়েছিল ফার্স্ট, আর মৌপিয়া গুনে গুনে মাত্র চার নম্বর কম পেয়ে সেকেন্ড হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় শব্দটাতে যে মৌপিয়ার এতটা অ্যালার্জি, সেটা ও নিজেও বুঝেছিল ঠিক সেইদিনই।
লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে মুখ গোমড়া করে বসেছিল মৌপিয়া।
অভীক অপরাধীর মতো মুখ করে বলেছিল, কি হয়েছে তোর? মাম্মা মেরেছে নাকি? মন খারাপ কেন?
মৌপিয়া বিরক্ত হয়ে বলেছে, তুই আজ থেকে আমার বন্ধু নয়। আর কথা বলিস না আমার সাথে। অভীক অবাক হওয়া গলায় বলেছে, কেন রে মৌ, আমি কি করেছি?
মৌপিয়া চোখ দুটো লাল লাল করে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছে, তুই কেন ফার্স্ট হলি? তুই এই ক্লাসে না থাকলে আমিই ফার্স্ট হতাম।
অভীক বোকার মতো নিজের রেজাল্টটা নিয়ে ছলছল চোখে বলেছে, এই নে তুই এই ফার্স্ট লেখা রেজাল্টটা নে, আমায় তোর সেকেন্ড লেখাটা দে। আমার মা আমায় একটুও বকবে না সেকেন্ড হলে। তুই আমারটা নিয়ে যা। আন্টি তাহলে আর তোকে বকবে না।
এতক্ষন পরে ক্লাস ওয়ানের মৌপিয়া মল্লিকের মুখে হাসি ফুটেছে। অভীকের রিপোর্ট কার্ডটা ব্যাগে ভরতে ভরতে বলেছে, বেশ আর তোর সাথে আড়ি করলাম না।
অভীক এক মুখ হেসে বলেছে, কোনোদিন আড়ি করবি না তো? আমি পরের এক্সামে একটু কম কম লিখবো, তাহলেই তুই ফার্স্ট হবি। আর কখনো আমার ওপরে রাগ করবি না কিন্তু। মৌপিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী গলায় বলেছে, আমি ফার্স্ট হলে আর তোর সাথে কখনো ঝগড়া করব না।
অভীক সেদিন নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু যখনই মা বলল, একি তুই মৌপিয়ার রিপোর্ট কার্ড এনেছিস কেন, তোরটা কোথায়? তখনই ওর ছোট্ট মাথায় অনেক দুশ্চিন্তা এসে ভিড় করেছিল, এই রে তার মানে আন্টিও তো বুঝে ফেলবে মৌপিয়ার হাতে অভীকের রিপোর্ট কার্ড! আন্টি যদি মৌকে মারে, কি হবে তাহলে?
কাল স্কুলে গিয়ে যদি আবার মৌপিয়া সৌভিকের সাথে গল্প করে, ওর সাথে না করে, তাহলে কি হবে? যদি অভীকের সাথে কাট্টি করে দেয় মৌপিয়া, তাহলে তো ওর খুব কষ্ট হবে। মা বলল, স্কুলে গিয়ে মৌপিয়াকে ওর রিপোর্ট কার্ড ফেরত দিয়ে নিজেরটা আনবে বুঝলে?
ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়েছিল অভীক।
স্কুলেতেও ভয়ে ভয়েই ঢুকেছিল অভীক। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিল মৌপিয়াকে। অনেক খুঁজে বের করেছিল, একটা বাহারী গাছের পাশে মুখ ভারী করে বসেছিল মৌপিয়া। অভীক আস্তে করে বলেছিল, আন্টি বকেছে?
মৌপিয়া অভীকের রিপোর্ট কার্ডটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, মাম্মা আমায় খুব মেরেছে। আর সেটা তোর জন্য। আজ থেকে আর একদম কথা বলবি না আমার সাথে। মৌপিয়ার চোখে জল। অভীকের খুব কষ্ট হচ্ছিল মৌপিয়াকে দেখে। ঠিক সেদিন থেকেই অভীক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর কোনোদিন ফার্স্ট হওয়া যাবে না।
ক্লাসে পাশাপশি বসলেও মৌপিয়া আর অভীককে কাছের বন্ধু ভাবতো না। তাই সেদিন গানের ক্লাসে ঢুকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল অভীক। স্যারের সামনে বসে আছে মৌপিয়া। একটা সাদা ফ্রক পরে আছে ও। ঠিক যেন পরীর মতো। মাথায় দুটো সাদা ক্লিপ।
অভীকের মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল, ওর বেস্টফ্রেন্ড গানের স্কুলেও একসাথে থাকবে ভেবেই খুশি হয়েছিল ও।
কিন্তু ভুলটা ভেঙেছিল দু-সেকেন্ডের মধ্যেই।
অভীক ওর পাশে বসতেই মৌপিয়া বলেছিল, আমি এখানে গান শিখতে এসেছি রে, মা বলেছে বেস্ট হতে। তাই তোর সাথে খেলা করে সময় নষ্ট করব না।
অভীকের চোখে অভিমানে জল চলে এসেছিল।
তবুও কোনোদিন রাগতে পারেনি অভীক এই অহংকারী, স্বার্থপর মেয়েটার ওপরে।
এরপর থেকে জীবনের প্রতিটি এক্সামে অভীক ইচ্ছে করে সেকেন্ড হয়ে মৌপিয়াকে জিতিয়ে দিয়েছে। গোটা দুয়েক জানা কোশ্চেনের আনসার ও বন্ধুদের বলে দিলেও নিজে লিখত না। কোশ্চেন পেপারে ক্রস দেওয়ার সময় ভাবত, মৌপিয়ার জন্য। অলিখিত চুক্তির মতোই চলে আসছিল নিয়মটা। ক্লাসের সকলেই জানত, মৌপিয়া মল্লিক ফার্স্ট আর অভীক সেন সেকেন্ড হবেই। রেজাল্টের দিন মৌপিয়া বলত, আমার ফার্স্ট হওয়াতে আনন্দ নেই, অভীককে হারিয়ে আনন্দ।
অভীক কথাটা শুনে বোকার মতো হাসত। যাক মৌপিয়া ওকে হারানোর জন্যও তো চেষ্টা করে! অন্তত মৌপিয়ার মনের কোনো একটা কোনে তো আছে অভীকের নামটা। বন্ধুত্বটা একতরফা সেটা অভীক বুঝেছিল ক্লাস নাইনে উঠে।
একই সেকশনে ওরা পড়েছিল ক্লাস টেন পর্যন্ত।
ক্লাস নাইনে হঠাৎই একদিন মৌপিয়া এসে বলেছিল, জানিস অভীক, তুই ছেলেটা খারাপ নোস, কিন্তু তোর সাথে কম্পিটিশনে মজা নেই। সেই ক্লাস ওয়ানের পরে আর কিছুতেই তুই ফার্স্ট হতে পারলি না। এমন কম্পিটিশনে সত্যি মজা নেই, বড্ড বোরিং।
মৌপিয়া মুখে যতই বলুক, অভীক জানে সেকেন্ড শব্দটাতে মৌয়ের বড্ড কষ্ট। তাই অভীক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, কি করব! প্রতি বার চেষ্টা করি তো, কিছুতেই তোর কাছে জিততে পারি না।
মৌপিয়ার চোখ দুটো গর্বে আর অহংকারে উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস নাইনে অভীক অপলক তাকিয়ে ছিল আত্মবিশ্বাসী একটা মেয়ের দিকে।
বন্ধুরা বলত, প্লিজ অভীক একবার ট্রাই কর, একবার ওই অহংকারী মেয়ের দেমাকটা ভেঙে দে, একবার ওকে সেকেন্ড করে দে, আমরা পারছি না, তুই ট্রাই করলেই পারবি। অভীক হালকা চালে বলত, কিন্তু আমার যে হারতে ভালো লাগে। কয়েকটা বন্ধু আড়ালে বলেছিল, ভালোবাসিস?
অভীক চোখ দুটো বন্ধ করে সেই নার্সারীর মেয়েটাকে দেখে বলেছিল, জানি না। তবে ওর চোখের জল আমায় কাঁদায়।
বন্ধুরা বলেছিল, তুই বড্ড বোকা রে অভীক। মৌপিয়ার মতো মেয়েরা ভালোবাসতে জানে না। ক্লাস নাইনের বুদ্ধিতে ভালোবাসার মতো জটিল শব্দের অর্থ না বুঝলেও মৌপিয়া ক্লাসে অ্যাবসেন্ট থাকলে যে অভীকের দমবন্ধ হয়ে আসে এটা ও বেশ বোঝে। মৌপিয়া এমনিতে খুব মুডি। যেদিন ইচ্ছে হয় সেদিন নিজে ডেকে অভীককে জিজ্ঞেস করে, ম্যাথ প্রিপারেশন কেমন রে? ফার্স্ট টার্মের কোর্স কমপ্লিট?
কিন্তু যেদিন মুড থাকে না, সেদিন যদি অভীক জিজ্ঞেস করে, কি রে মৌপিয়া খুব পড়ছিস?
মৌপিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে, কেন এক্সামে হারাবি আমায়?
অদ্ভুত একটা কষ্ট হয় অভীকের। কষ্টটা যে কেমন ও নিজেও বোঝে না। মা প্রিয় খাবার বানিয়ে না দিলে যেমন মন খারাপ হয় তেমন নয়, বাবাই ট্যুরে না নিয়ে গেলে যেমন হয় তেমনও নয়, টিচাররা বকলে যেটা হয় সেটাও নয়। অন্যরকম অজানা একটা অনুভূতি। অন্য বন্ধুরা কথা না বললে এই কষ্টটা কখনো অনুভব করে না অভীক। কিন্তু মৌপিয়া যখন অন্যদের সাথে গল্প করে অথচ অভীকের দিকে ফিরেও তাকায় না তখনই চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করে অভীক।
সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। তাই স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। মৌপিয়াকে দেখতে পাওয়ার রাস্তা শুধুই গানের স্কুলে।
মৌ যখন গান গায়, অভীক অবাক হয়ে শোনে। কি মিষ্টি মেয়েটার গলা। কিন্তু তবুও যে কেন মেঘবর্মনবাবু মৌপিয়াকে বলেন, অভীককে দেখো শেখো। মৌপিয়া শুধু গান গাইলেই হবে না। একটা তীক্ষ্ন কান তৈরি করতে হবে। নিজের গানের খুঁত ধরার জন্য। আমার এত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একমাত্র অভীকেরই এই বিশেষ গুনটা আছে। একমাত্র ওই গাইতে গাইতে থেমে গিয়ে একটা লাইনকে দ্বিতীয়বার গেয়ে বলে, স্যার এটা কি ঠিক হল, কেন সুরটা ঠিকমতো লাগছে না স্যার!
মৌপিয়া, তোমার গলায় স্বয়ং সরস্বতীর বাস। তুমি তালটার দিকে একটু খেয়াল রেখো। অভীক আর তুমি তো খুব ভালো বন্ধু, ওর সাথে আলোচনা করো প্রয়োজন হলে। অভীক বড্ড ভালো ছেলে।
মেঘবর্মনবাবুর প্রশংসা শোনার পরেই মৌপিয়ার ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে যায়। অভীক বেশ বুঝতে পারে আবার দ্বিতীয় শব্দটা কষ্ট দিচ্ছে মৌকে। অভীক ওর কানের কাছে গিয়ে বলে, স্যার আমায় ভালোবাসেন তাই প্রশংসা করেছেন, আসলে তুই বেস্ট রে মৌ। অমন গলা আর কার আছে! মৌপিয়ার গালের লালচে রাগ কমলেও স্বাভাবিক হতে পারেনা।
কিন্তু এই গানের ক্লাসটা কিছুতেই মিস করে না অভীক। গানের টান ছাড়াও মৌপিয়ার জন্য মন খারাপ করে ওর।
মৌপিয়ার স্কুল অ্যাবসেন্টের দিনে সমস্ত ক্লাস ওয়ার্ক রেডি করে রাখতো অভীক, পরের দিন মৌ ঢুকলেই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলত, তুই তো দুদিন আসিসনি, এই নে এই দুদিনের ক্লাস ওয়ার্ক।
অথচ অভীকের যখন জ্বর হয়েছিল, সাতদিন অনুপস্থিত ছিল ও, তখন কিন্তু তিনদিন চাওয়ার পরে পেয়েছিল মৌপিয়ার খাতাগুলো। বন্ধুরা বলেছিল, অভীক তুই বড্ড নির্লজ্জ রে। ওই মেয়েটাকে সেই ওয়ান থেকে হেল্প করে গেলি আর ওই মেয়ে একতরফা নিয়েই গেল। এবার তো থাম। অভীক মুচকি হেসে বলেছে, থামার ক্ষমতাও আমার হাতে নেই রে, সেটাও মৌপিয়াই নিয়ে নিয়েছে।
সমস্যাটা বাঁধল মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর।
অভীক মৌপিয়ার থেকে গুনে গুনে এগারো নম্বর বেশি পেয়ে গেছে। অভীকের নিজেরও খুব মন খারাপ। সৌভিকই বলল, মৌপিয়ার থেকে এবারে অন্তত তুই বেশি পেলি, স্কুলের টপার তুই।
বন্ধুরা এসে অভিনন্দন জানাচ্ছিলো অভীককে। কিন্তু ওর চোখ খুঁজে চলেছিল মৌপিয়াকে। শেষে দেখল, স্কুলের পাঁচিলের কাছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে মৌপিয়া।
অভীক ভয়ে ভয়ে কাঁপা পায়ে এগোলো ওর দিকে।
দেখল কাজল কালো চোখে জল।
এই মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিত কিছুই না বুঝে, অভীক বলল, এই নে, আমার রিপোর্ট কার্ডটা নে। তাহলে আর আন্টি তোকে বকবে না।
দুচোখে জল নিয়েই মুচকি হেসেছিল মৌপিয়া।
তারপর রাগী মুখে বলেছিল, এতদিন তাহলে আমায় করুণা করেছিলিস। তোর করুণায় আমি এতদিন ফার্স্টগার্ল হয়ে ছিলাম তাহলে!
অভীক হাসি মুখে বলেছিল, করুণা শব্দটা তোর সাথে বড্ড বেমানান রে মৌ। তোর ওই অহংকারী রূপটাই আমার বেশি ভালো লাগে। ওই প্রতিযোগীতার মানসিকতা, ওই হার না মানা দম্ভ, এগুলোই যে তোর সাথে ভীষণ ভালো ম্যাচ করে।
মৌপিয়া বিরক্ত মুখে বলেছিল, কিন্তু তুই বড্ড বিরক্তিকর। কি করে জানা কোশ্চেন ছেড়ে দিতিস আমার জন্য? তোর কষ্ট হত না?
অভীক ঘাড় নেড়ে বলেছিল, তোর চোখে জল দেখলে বেশি কষ্ট হত রে।
মৌপিয়া ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, স্কুলের টপারকে কংগ্রাটস
অভীক এই প্রথম স্পর্শ করল মৌপিয়াকে। সেই নার্সারীর আদুরে, অভিমানী মেয়েটা…অভীককে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া মেয়েটা, সেই দ্বিতীয়কে অ্যাভয়েড করা মেয়েটা আজ প্রথম হাত ধরল অভীকের।
বুকের বাম দিকের যন্ত্রটা হঠাৎ দ্রুতগতি হল অভীকের।
কাঁপা গলায় অভীক বলল, মৌপিয়া আমি তোকে করুণা করি নি রে, তোর সাথে আমার কোনোদিন কোনো প্রতিযোগিতাও ছিল না, তুই স্কুলে না এলে ক্লাস করতে ইচ্ছে করত না, তুই গানের ক্লাসে না গেলে তাল কাটে এখনো। কেন যে মনে হয় তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড, কে জানে!
মৌপিয়া শান্ত গলায় বলল, আমার এত অত্যাচারের পরেও তোর এই কথা মনে হয়? তুই কি পাগল?
এতদিন দেখছিস আমায়, এখনো বুঝিস নি, আমি একটা অত্যন্ত স্বার্থপর, অহংকারী মেয়ে। আমি এতগুলো বছর তোকে শুধু ইউজ করেই নিয়েছি রে অভীক, এবং এরপরেও কিন্তু আমার মানসিকতা পাল্টাবে না একটুও। কারন আমার মাম্মা খুব ছোট থেকে আমার মনে একটা শব্দকে গেঁথে দিয়েছে, অলওয়েজ ফার্স্ট, নেভার সেকেন্ড।
অভীক বলল, জানি তো তুই সবার প্রথমে থাকতে চাস, আমিও সেটাই চাই রে। তাই তোর চাওয়ার সাথে আমার চাওয়ার কোনো বিরোধ নেই। দুজনের চাওয়ার যখন এত মিল, তাহলে আর বেস্টফ্রেন্ড হতে বাধা কোথায়?
মৌপিয়া কিছু না বলেই চলে গেল। ওর চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল অভীক। কিছু তো একটা আছে মেয়েটার মধ্যে। বন্ধুরা বলে, মৌপিয়া মারাত্মক হিংসুটে, অভীকের মনে হয়, অন্য কিছু। মৌপিয়ার মধ্যে একটা কুয়াশা কুয়াশা রহস্য রয়েছে। ওই রহস্যের টানেই যেন অভীক ছুটে যায় ওর কাছে। ওর অবজ্ঞা দেখেও সরিয়ে আনতে পারে না নিজেকে। এই মনেহয় ও সম্পূর্ণ চেনে মৌপিয়াকে, পরক্ষণেই মনেহয় বড্ড অচেনা। রহস্য ঘেরা মৌপিয়া তাই অভীকের মনের দুয়ারে পথ রোধ করে দাঁড়ায় বারবার।
ক্লাস ইলেভেনে দুজনে ভর্তি হল অন্য স্কুলে। শুধু কেমিস্ট্রি স্যার আর গানের স্যার এক। বাকি সব আলাদা।
মৌপিয়াকে ডেকে অভীক জিজ্ঞেস করেছিল, হঠাৎ তুই গার্লস স্কুলে চলে গেলি যে?
মৌপিয়া মুখ বেঁকিয়ে বলেছে, ওখানে ফার্স্ট হওয়া কঠিন বলে, ওখানে কেউ আমায় করুণা করার নেই বলে।
অভীক আলগা হেসে বলেছিল, একটা কথা বল মৌপিয়া, তুই কি সবার ওপরই এমন রেগে থাকিস, নাকি শুধু আমার ওপরে?
যদি শুধু আমার ওপরে রেগে থাকিস, তাহলে বলব, আমি খুব খুশি। আর যদি সবার ওপরেই এমন রাগিস তাহলে ভাবব, আমি ভীষণ আনলাকি। উত্তর দেয়নি মৌপিয়া। চুপচাপ চলে গিয়েছিল।
মৌপিয়া একদিন হঠাৎই টিউশন ব্যাচের সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, সৌভিক বলছিল, তুই নাকি বন্ধুদের কাছে বলেছিস, তুই আমাকে ভালোবাসিস? শোন অভীক, ওই আপেক্ষিক শব্দটার আমার কাছে কোনো গুরুত্ব নেই। আমি আমার বাবা, মাকে ছাড়া আর কাউকে ভালো টালো বাসি না। তাই আমার সামনে ওসব কাব্য করতে কখনো আসবি না। ওসব ন্যাকামো আমার জাস্ট পোষায় না। তাছাড়া আমরা আর এক স্কুলেও পড়ি না, এক ক্লাসেও না, তাই তুই আমার কম্পিটিটরও নোস, সুতরাং দূরত্ব বজায় রেখে চল আমার সাথে।
ব্যাচের সবাই অভীককে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল। লজ্জায় আর অপমানে নীল হয়ে যাচ্ছিলো অভীক। হাত পা কাঁপছিল, কপাল ঘামছিল…শেষে কেমিস্ট্রির স্যার বললেন, কি অভীক, এই তোমার ভালো ছেলের মুখোশ? ক্লাস ইলেভেনেই পড়াশোনা ছেড়ে প্রেম করতে নেমে পড়েছ?
অভীক নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। সব ভাষা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে ওর গলার কাছে। মৌপিয়া বদ-রাগী, খুব মুডি, কিন্তু অভীককে এভাবে সকলের সামনে অপমান করবে, কিছুতেই ভাবতে পারেনি অভীক। সেই ছোট্ট থেকে ভালো ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, ভদ্র ছেলে তকমা এঁটে গিয়েছিল অভীকের গায়ে। আজ হঠাৎ সেই তকমাটা খুলে চূড়ান্ত অভদ্র ছেলের তকমাটা পরিয়ে দিল মৌপিয়া। স্যারের কাছ থেকে এতটা অপমান সহ্য করতে হবে, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বসেছিল ও। আর একবারের জন্যও তাকায়নি মৌপিয়ার দিকে। টিউশন ছুটির পরে এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে সাইকেলের প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়েছিল ও। ওর মনে হচ্ছিল, আরো জোরে চালাতে হবে ওকে। মৌপিয়া নামটার বন্ধন থেকে সরে যেতে হবে দূরে।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে বারবার মৌপিয়ার কাছে ছুটে আসা নয়, বরং মুক্তিবেগের মাধ্যমে চলে যেতে হবে ভাবলেশ, অনুভূতি শূন্য কোনো জগতে। যেখানে অভীকের চারপাশে শুধু সোনালী নম্বর থাকবে, ভালো কেরিয়ার থাকবে, কিন্তু ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব নামক বোকা বোকা আবেগ থাকবে না। হাওয়ার মতো উড়ছিল অভীকের সাইকেল। পারতেই হবে অভীককে, ওই নামটা থেকে পালাতে হবে ওকে। প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িতে ঢুকেই মায়ের সম্মুখীন হয়েছিল অভীক।
মা ইন্দ্রাণীদেবী খুব শান্ত স্বরে বলেছিলেন, কে অপমান করল? কেমিস্ট্রি স্যার? কেন, তুই তো হোমওয়ার্ক করে গিয়েছিলিস, তাহলে?
মায়ের চোখে ধরা পড়ে যাবার ভয়েই অভীক কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ইন্দ্রাণীদেবী এসে ঢুকেছিলেন অভীকের ঘরে। ছেলের রক্তাভ চোখ আর বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে সন্দেহ করেছিলেন, মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে। ছেলের মাথায় আলতো করে হাত রাখতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল অভীক। চুপচাপ দেখছিলেন ইন্দ্রাণীদেবী। ছেলেকে নোনতা জল ফেলার সুযোগ দিয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ।
তারপর আস্তে আস্তে বলেছিলেন, আমাকেও কি বলা যায় না অভি?
অভি মায়ের কোলে মাথা রেখে বলেছিল, মা আজ সকলের সামনে মৌপিয়া আমাকে অপমান করেছে, আর মৌয়ের কথা শুনে স্যারও বাজে ভাবে কথা বলেছেন। আমি ঐ স্যারের ব্যাচে আর পড়ব না।
ইন্দ্রাণীদেবী ধীর গলায় বললেন, কি বলেছে মৌপিয়া?
অভীক একটু সংকোচের সাথেই বলল, আমি ওকে আমার বেস্টফ্রেন্ড মনে করি মা। তাও ও আমায় বলল, আমি যেন ন্যাকাপনা করে ওকে ভালোবাসি, ওকে ছাড়া বাঁচব না এসব বলতে না যাই, ওর নাকি এসব ন্যাকামো জাস্ট আসেনা। আমি তো কখনো ওকে এসব বলিনি মা, তাহলে ও কেন এভাবে সকলের সামনে….
অভীকের চোখটা নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ইন্দ্রাণী বললেন, ভালোবাসা তো কোনো অপরাধ নয়। কাউকে ভালোলাগাও অপরাধ নয়। কিন্তু আগে নিজেকে বুঝতে হবে সে তোমার ভালোবাসার যোগ্য কিনা!
যে মেয়ে তোর থেকে দু-নম্বর কম পেয়েছে বলে, তোর সাথে ঝগড়া করে, সে তোর যোগ্য নয় অভি।
যে মেয়ে সেই নার্সারী থেকে টেন পর্যন্ত স্কুলে অ্যাবসেন্টের দিনের সমস্ত ক্লাস ওয়ার্ক তোর কাছ থেকে পেল, সে যখন অস্বীকার করে বন্ধুত্ব, তখন জানবি সে বন্ধু শব্দের অর্থ বোঝে না!
অভি, তোর হয়তো মৌপিয়াকে ভালো লাগে, হয়তো ভালোও বাসিস, কিন্তু শান্ত মনে ভেবে দেখবি তো, কম্পিটিশন করা ছাড়া মৌপিয়া তোকে বন্ধু হিসাবে কোনোদিন দেখেছে কিনা!
অভীক বলল, এসব আমি জানি মা। কিন্তু তবুও মৌকে ভুলতে পারি না যে!
ছেলের মাথাটা নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে ইন্দ্রাণী বললেন, ভুলতে হবে না তো, শুধু আজকের ঘটনাটাকে মনে রাখতে হবে। কাল থেকে মৌকে ভালোবাসলেও সেটা মনে মনে। কেমিস্ট্রি স্যার আর মৌকে দেখিয়ে দিতে হবে, তুই বেস্ট। জানিস অভি, এই মৌপিয়ার মতো মেয়েরা কিন্তু তোর মতো ছেলেকেই ভালোবাসে, কখনোই লাস্টবেঞ্চের কাউকে ভালোবাসে না। ভালোবাসা তো দূরে থাক, তাকে মানুষই মনে করে না। তোর মতো গুডবয়রাই থাকে এদের পছন্দের সারিতে, কিন্তু তবুও নিজের অহংকার ধরে রাখবে বলেই ওই দুর্বলতাটাকে চেপে রাখে। আর তাই তোকে অপমান করে দূরে সরাতে চায়, বুঝলি কিছু? আসলে ও কিন্তু তোর প্রতি দুর্বল। আর নিজের মনের দুর্বলতা ঢাকতেই তোর ওপরে অত্যাচার করে যাচ্ছে।
অভীক বিছানায় উঠে বসে বলল, তার মানে মৌপিয়াও আমায় পছন্দ করে! তাহলে কেন এমন করে!
ইন্দ্রাণী আবার বললেন, পাছে তোর প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায় তাই।
মা, আমি ভেবেছি কেমিস্ট্রি ব্যাচে আর যাব না।
ইন্দ্রাণীদেবী, স্মিত হেসে বললেন, পালাতে চাইছিস? মৌপিয়ার থেকে? তাহলে তো মেঘবর্মন স্যারের কাছ থেকেও পালাতে হয়!
শোন অভি, তার থেকে বরং তুই এক কাজ কর, স্কুল, পড়াশোনা সব ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে ঘরের মধ্যে বসে থাক। তাহলে আর মৌপিয়ার সাথে দেখা হবে না।
অভীক আঁতকে উঠে বলল, পড়াশোনা? আমার কেরিয়ার? আমার গান?
ইন্দ্রাণীদেবী আরো গভীর স্বরে বললেন, তাহলে মৌপিয়ার সামনে বসে ওকে ইগনোর কর, ওর থেকে দূরে গিয়ে নয়। কিন্তু মা, মৌয়ের সামনে গেলেই আমার কষ্ট হয়। আমি কিছুতেই ওকে ভুলতে পারি না।
ইন্দ্রাণীদেবী বললেন, ভুলবি কেন বোকা ছেলে, ভোলার ভান করবি। নিজেকে বেস্ট প্রমাণ করবি। হাজার চেষ্টা করেও যেন মৌপিয়া তোর থেকে এক নম্বরও না বেশি পায়।
কিন্তু মা সেকেন্ডে ওর বড্ড এলার্জি। আমি ওর থেকে বেশি পেলেই ও আরো রাগ করবে যে!
অভি, মৌপিয়ার সেকেন্ডে এলার্জি কিন্তু ফার্স্ট এ ওর ভালোবাসা, তাহলে তুই ফার্স্ট হলেই ও তোকে আর ঘৃণা করবে না। খেয়াল রাখবি, মৌয়ের সামনে বসে তোকে ওকে ইগনোর করতে হবে, আর নিজেকে বেস্ট প্রমাণ করতে হবে। আমি বলছি অভি, একদিন ওই মৌপিয়াই তোর কাছে ক্ষমা চাইবে।
মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে ফেলল অভীক। মা আমি কি পারব?
ইন্দ্রাণীদেবী ছেলের মাথায় হাতটা রেখে বললেন, প্রেমে আর যুদ্ধে বেশ কিছু কূটনীতির পথ অবলম্বন করতে হয় অভি। আর তুই যখন মৌপিয়াকে ভালোবেসেই ফেলেছিস, তখন এটুকু তো তোকে করতেই হবে।
অভি চোখে জল নিয়েই হেসে বলল, ইউ আর গ্রেট মম। আমার বেস্ট মা।
ইন্দ্রাণীদেবী বললেন, এই যে আমি তোকে এত ভালো একটা কূটনৈতিক বুদ্ধি দিলাম, এর বিনিময়ে আমায় কি দিবি?
অভীক চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল, বলো তোমার কি চাই?
একটুক্ষণ ভেবে, ইন্দ্রাণী বললেন, আমার প্রাণবন্ত, উচ্ছল, ছেলেটাকে ফেরত চাই।
অভীক হাসতে হাসতে বলল, পারব মা, আমি মৌপিয়ার সামনে বসে ওকে জাস্ট ইগনোর করে দেখাতে পারব।
ইন্দ্রাণীদেবী বললেন, দাঁড়া, তোর বাবাকে বলি আজ চাইনিজ আনতে, ছেলে প্রেমে পড়েছে, তাই একটু সেলিব্রেট করব। অভীক লজ্জা পেয়ে বলল, মা, প্লিজ, এটা ঠিক প্রেম নয়।
ইন্দ্রাণী বললেন, ওই হল। ভালোলাগা বা সামথিং স্পেশাল।
অভীক আলতো করে হেসে বলল, এখন মনে হচ্ছে, মৌপিয়া নয়, তুমিই আমার বেস্টফ্রেন্ড।
রবিবার বিকেলে নির্দিষ্ট সময়েই অভীক পৌঁছাল মেঘবর্মন স্যারের কাছে। সামনেই ওর ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ফোর্থ ইয়ার, আর রবীন্দ্র সংগীতের মাস্টার ডিগ্রির পরীক্ষা। তাই গানের ক্লাস কামাই করার কোনো উপায়ই নেই। তাছাড়া ক্লাস অফ করা মেঘবর্মনবাবু একেবারেই পছন্দ করেন না।
বড় ঘরটাতে সুন্দর করে সাদা চাদর পাতা, ফুলদানিতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, দেওয়ালে রবিঠাকুরের ছবি। দক্ষিণ কোণে পর পর তিনটে তানপুরা সাজানো আছে। সামনে রয়েছে খান চারেক হারমোনিয়াম আর তবলা। অভীক ঢুকেই দেখল, বৃষ্টিস্নাত আকাশকে টেক্কা দিয়ে আরো ঝকঝকে একটা নীলচে চুড়িদার পড়েছে মৌপিয়া। স্টেপকাট চুলের পিছন দিকে ব্যাকক্লিপ। গানের ডায়রি খুলে কিছু একটা দেখছিল।
দুই ভ্রুর মাঝেই ছোট্ট কালো টিপে অহংকারী শব্দের প্রতিফলন। স্বয়ং সরস্বতী যেন একহাতে বিদ্যা আর গলায় সংগীত নিয়ে বলছে, আমিই শ্রেষ্ঠা।
অভীক আড়চোখে একবার তাকাল মৌপিয়ার দিকে। অন্যদিন হলে হ্যাংলার মতো ওর পাশে গিয়েই বসে অভীক। হাপিত্যেস করে বসে থাকে, কখন মৌপিয়ার মুখ থেকে একটা গোটা বাক্য শুনতে পাবে।
আজও বেখেয়ালে মৌপিয়ার দিকেই এগোতে যাচ্ছিল অভীক। এত বছরের অভ্যেস কি সহজে ছাড়া যায়, তাই অভ্যাসবশত ওদিকেই পা বাড়িয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই নাকে এসে ঝাপটা দিল ভেজা রজনীগন্ধার গন্ধটা। আর সাবধান করে বলল, সামনে থেকেও ভুলে থাকতে হবে। মনে পড়ে গেল মায়ের বলা কথাগুলো। নিজের আবেগকে মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণে এনে বর্ণালীর পাশে গিয়ে বসল অভীক। বর্ণালী একটু অবাক হয়েই তাকাল ওর দিকে। তারপর বলল, কি গো অভীকদা, আজ তুমি মৌপিয়াদির পাশে না বসে, আমার পাশে বসলে যে ?
অভীক হালকা সুরে বলল, তোর গানের ভুল ধরে তোকে বকা খাওয়াব বলে। অভীকের বলার ঢঙেই হেসে উঠল বর্ণালী। বর্ণালীর হাসির আওয়াজে ডায়রি ছেড়ে এদিকে তাকাল মৌপিয়া।
চোখাচোখি হয়ে গেল অভীকের সাথে।
অভীক দৃষ্টি ফেরাল দেওয়ালে টাঙানো রবিঠাকুরের দিকে। তবে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বেশ টের পাচ্ছে, বর্ণালীর থেকেও বেশি অবাক হয়েছে মৌপিয়া। অভীকের কাছে অকারণে গুরুত্ব পেয়ে পেয়ে ওটাই ওর অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। নার্সারী থেকে ক্লাস ইলেভেন, সময়টা তো নেহাত কম নয়। আজ বেনিয়ম হতেই মহারানীর ভ্রু কুঁচকে গেছে একটু হলেও। অভীক মনে মনে বললো, মা আই লাভ ইউ, ইউ আর গ্রেট।
মেঘবর্মনবাবু ঢুকেই মৌপিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাগেশ্রীর সুরে একটা তানকারি করো তো।
অভীক পরিষ্কার দেখল, মৌপিয়ার মুখ থেকে বিস্মিত হয়ে যাওয়া শিরা উপশিরারা তখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়নি। তবুও তানপুরাটা টেনে নিয়ে গলা লাগানোর চেষ্টা করলো। প্রথমেই ভুল। অভীকের কানে এসে খট করে লাগল।
মৌপিয়ার এমন ভুল তো হয়না সচরাচর। বুকটা কষ্টে মুচড়ে উঠল। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল, কেমিস্ট্রি স্যারের ব্যঙ্গাত্মক কথাগুলো। মাথা নিচু করে শান্ত হয়ে বসল অভীক। নিজের মনে চর্চা করে নিল বাগেশ্রীর সুরটা।
ততক্ষনে স্যার অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, আর কটা দিন পরে এলাহাবাদ থেকে পরীক্ষকরা আসবেন, তাদের সামনে এই গাইবে তোমরা?
মৌপিয়ার আঙুল থেমে গেছে। আবার শুরু করার চেষ্টা করল। মিললো না গলা। কি কারণে যেন আজ চূড়ান্ত অসহযোগিতা করছে ওর গলা। ফর্সা কানের লতিদুটো লাল। কপালে বিজবিজে ঘাম। আকাশনীল ওড়না দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিল ও।
মেঘবর্মন বাবু বললেন, তুমি কি আজ কোনো কারণে অন্যমনস্ক আছো মৌ? মনযোগ না দিলে সংগীত কখনো নিজেকে ধরা দেয় না। আগে নিজেকে উজাড় করে দাও, তারপর সংগীত তোমাকে দু-হাত ভরে দেবে।
মৌপিয়া তুমি পাশে সরে বসো। অভীক, তুই এসে অবাধ্য রাগটাকে কব্জা কর দেখি।
স্যার বরাবরই আর সকলকে তুমি বললেও অভীককে তুই করে ডাকেন। আর অভীকের সম্পর্কে এতটাই উচ্চাশা ওনার যে মনে করেন, একদিন অভীক ওনাকে ছাড়িয়ে যাবে, সেদিন হবে ওনার জয়। শিষ্যের কাছে হেরে গিয়ে জয়ী হবেন উনি।
মৌপিয়া কথা না বলে তানপুরাটা এগিয়ে দিল অভীকের দিকে।
অভীক মৌপিয়ার হাত থেকে তানপুরাটা না নিয়ে, নিজেই উঠে গেল দক্ষিণ কোনে। লাল ভেলভেটে মোড়া ওর প্রিয় তানপুরাটা নিয়ে তারগুলোকে বেঁধে শুরু করলো তানকারি।
মুহূর্তের মধ্যে অভীক ভুলে গেল, ওর বাম পাশে বসে আছেন স্যার, ডান পাশে মৌপিয়া আর বর্ণালী। সামনে রয়েছে বিশ্বজিৎ, সুচেতনা, তিথি….এতজনের উপস্থিতিকে ভুলে সুরের মায়ায় ভাসছিল অভীক।
ডান দিকে একবার চোখ পড়তেই দেখল, মৌপিয়ার চোখের কোলে জলের রেখা।
অভীক চোখটা বন্ধ করে নিয়ে গাইছে। তানপুরার তারগুলোও যেন একাত্ম হয়ে গেছে ওর গলার সাথে।
মিনিট বারো চোদ্দো পরে যখন ও থামল,তখন মেঘবর্মনবাবু বললেন, ওরে অভীক, বুড়ো বয়েসে এত কাঁদাস কেন আমায়!
গানের ক্লাস থেকে বেরিয়ে দেখল, মৌপিয়া দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। অন্যদিনগুলোতে অভীক ওর সামনে গিয়ে বলে, তোর গলাটা ধার দিবি মৌ। বড্ড মিষ্টি রে! মৌপিয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, তাও তো স্যার তোকেই বেশি প্রাধান্য দেন, তুইই ওনার প্রিয় ছাত্র। আমি আর প্রিয় হলাম কোথায়! অভীক আলতো হেসে বলে, স্যারের কথা বাদ দে, উনি আমায় একটু বেশিই প্রশ্রয় দেন। কিন্তু আমার কান বারবার বলে, তোর মতো মিষ্টি গলা আমি খুব কম শুনেছি।
মৌপিয়া বেঁকিয়ে উত্তর দেয়, স্যারের পক্ষপাতিত্ব তাহলে তোর বেশ ভালোই লাগে, কি বল!
অভীক কিছুতেই এই মেয়েটার কথার মানে বোঝে না।
আজও রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল মৌপিয়া। অভীকের সাইকেলটা আপনা থেকেই শ্লথ গতি হতে শুরু করেছিল। মনে হচ্ছিলো, এখুনি মৌপিয়ার সামনে গিয়ে প্যাডেলগুলো বলবে, এবার একটু রেস্ট নিই। আমাদের চালক তো এখানেই দাঁড়াবে। নিজের প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া পা দুটোকে আবার জোর করে সচল করে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল অভীক।
হাওয়ার বেগে বেরিয়ে গেল মৌপিয়ার সামনে দিয়ে।
অভীক বেশ অনুভব করতে পারছে, আরেকজন চূড়ান্ত ঘাবড়ে গিয়ে অভীকের চলে যাওয়া দেখছিল।
দিনগুলো মারাত্মক ব্যস্ততায় কাটছে অভীকের, সামনেই উচ্চমাধ্যমিক। মাঝরাতে পড়ার মাঝে মৌপিয়ার মুখটা এসে কালো অক্ষরগুলোকে ঝাপসা করে দিতে চায়। কিন্তু অভীক শক্ত হাতে ধরে থাকে ডুবতে চাওয়া মনের রাশটাকে। কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবে না ওর প্রায় একবছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা শক্ত নৌকাটাকে।
টুয়েলভের প্রথমেই হঠাৎ করে মৌপিয়া কেমিস্ট্রি স্যারের কাছে আর পড়তে আসছিল না। সৌভিক বলল, ও অন্য টিচার নিয়েছে, ওর এখানে প্রবলেম হচ্ছিল।
অভীক কথাটা শুনে মনে মনে হেসেছিল। কিসের প্রবলেম মৌপিয়ার? তবে কি অভীককে সামনে দেখলেই তার অসুবিধা হচ্ছে। তবে কি ন্যাকামি না জানা, ভালোবাসা শব্দের মানে না বোঝা মেয়েটা আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলছে অভীককে! ইলেভেনের রেজাল্টের পরে অভীককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, কারোর করুণা ছাড়াই আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি। বলার সময় আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল অভীকের রিয়াকশন। নিরুদ্বিগ্ন অভীককে দেখে জানতে চেয়েছিল, ব্যাচের কে কেমন পেয়েছে?
সৌভিকই অভীকের নম্বর বলেছিল। নিজের থেকে অভীকের নম্বর বেশি আছে দেখেই মহারানী ঘাড় হেঁট করে বসেছিল।
তারপরেই কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করেই ছেড়ে দিল এই টিউশনিটা।
গত সপ্তাহে গানের ক্লাস থেকে ফেরার সময় বৃষ্টিতে ভিজে মৌপিয়ার চটি ছিড়ে গিয়েছিল। রিকশা, টোটো না পেয়ে রাস্তায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছিল দেখে সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল অভীক। গম্ভীর স্বরে বলেছিল, কেরিয়ারে চাপ, বাড়িতে নামিয়ে দিচ্ছি। কথা না বলে অভীকের কেরিয়ারে গোঁজ হয়ে বসেছিল মৌপিয়া। একটা হাতে ছাতা অন্য হাতটা খামচে ধরেছিল অভীকের শ্যাওলা রঙের গেঞ্জিটাকে।
কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া মুষলধারে বৃষ্টির জল তখনও রাস্তা থেকে নামেনি। অভীক রাস্তার জল কেটে পায়ে জোর দিয়ে সাইকেলটা চালাচ্ছিল। তারমধ্যেই কানে এল, সরি। না শোনার ভান করে ফাঁকা রাস্তায় জোরে বেলটা বাজাল অভীক। মৌপিয়ার একটা হাত ছুঁয়ে আছে অভীকের পিঠ। মনে মনে বলল অভীক, আজ আমি তোর খুব কাছে থেকেও অনেকটা দূরে আছি মৌপিয়া।তাই তোর স্পর্শ আজ আর আমার মনে আলোড়ন তুলছে না রে। মনের নরম, কোমল অনুভূতিগুলো তুইই একটা একটা করে ভেঙে দিয়েছিস সেই নার্সারীর প্রথম দিন থেকে। প্রেমিকা হতে তো বলিনি তোকে, বেস্টফ্রেন্ড তো হতে পারতিস। কিন্তু তুই শুধু কম্পিটিশন বুঝিস। তাই আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনের প্রতিটি এক্সামে তোকে হারাবোই আমি।
মৌপিয়া বলল, তুই কিছু বললি?
অভীক শুধু দায়সারা উত্তর দিলো, না তো।
মৌপিয়ার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, নাম।
অপ্রস্তুত মৌ, হাতে ছেঁড়া চটি নিয়ে বলল, ভিতরে আয়। কফি খেয়ে যাবি।
অভীক উদাসীনভাবে তাকিয়ে উত্তর দিল, না মৌপিয়া, সেই ইচ্ছেটাই চলে গেছে রে।
পিছন ঘুরে প্যাডেলে চাপ দেবার আগেই আগুনের মতো ধেয়ে এলো প্রশ্নটা। অন্য কাউকে ভালোবাসিস বুঝি? মনে রাখিস, ওসব করতে গেলে পড়াশোনার বারোটা বাজবে কিন্তু।
অভীক পিছন ফিরেই উত্তর দিল, সেকেন্ডে তোর এলার্জি, আমার নয় কিন্তু।
মৌপিয়া হিসহিস করে বলল, ওহ, তার মানে স্বীকার করলি, দ্বিতীয় প্রেম করছিস?
অভীক হাসতে হাসতে বলল, আমার লাইফে প্রথম প্রেম কিছু ছিল নাকি, যে দ্বিতীয় প্রেম করব?
খালি পায়ে রাগী মুখে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল মৌপিয়া। অভীক মুচকি হেসে বলল, দেখি মৌ, তুই কবে ভাঙিস! এখন আমি পরিণত, এখন আমি ভীষণ শান্ত। নিজের সাথে যুদ্ধ করে আমি এখন জয়ী। দীর্ঘদিন নিশ্চুপ অপেক্ষা করতে পারব তোর অহংকার ভাঙার।
উচ্চমাধ্যমিকের পর জয়েন্টে বসতে হবে, তাই গানের ক্লাসে একটু ইরেগুলার হয়ে যাচ্ছিল অভীক। হঠাৎই বিকেলের দিকে ফোনটা এলো। অচেনা নম্বর। কিন্তু রিসিভ করতেই চিরপরিচিত গলা আর সেই পরিচিত ভঙ্গিমায় মৌপিয়া বলল, জয়েন্ট আমিও দেব। আশা করছি মেডিকেলে চান্সও পাবো। কিন্তু তার মধ্যেও গানটা নিয়মিত করছি। আর তুই পড়া আর গান একসাথে সামলাতেই পারছিস না। অভীক, তোর প্রেমিকা বোধহয় তোকে সেকেন্ড হতে ইন্সপায়ার করে তাই না?
গানের স্যার তোকে কল করতে বলেছিলেন, তাই করলাম। নাহলে তুই কি করছিস, না করছিস নিয়ে আমার জাস্ট কোনো ভাবনা নেই। আর মাত্র সাতদিন পরে জয়েন্ট, তারপর একটা জেলা স্তরের সংগীত প্রতিযোগীতায় নাম দিতে বলছিলেন স্যার। উনিই আমাদের দুজনের নাম দিয়ে দিয়েছেন বোধহয়। তোকে জানিয়ে দিতে বললেন।
ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলছিল মৌপিয়া। সাথে গলায় মিশে আছে ওর সেই বিশেষ রাগটা। যেটা একমাত্র অভীকের সাথে কথা বলার সময়েই উদয় হয় ওর গলায়!
অভীক চুপচাপ শুনছিল, আর অনুভব করছিল এই মুহূর্তে মৌপিয়ার মুখটা ঠিক কেমন দেখতে লাগছে।
আজ কি চুড়িদার পরেছে, নাকি লং স্কার্ট? মৌপিয়ার সব পোশাকের রং অবধি মুখস্ত অভীকের। আজ বোধহয় মৌ রানীকালার আর ব্ল্যাক কম্বিনেশনের লং স্কার্টটা পরেছে। অভীকের খুব ইচ্ছে করছিল, একবার জিজ্ঞেস করে, এই মৌ, আজকে কি তুই রানীকালারের স্কার্টটা পরেছিস? কিন্তু ঠোঁটের ডগায় আসা কথাটাকে গিলে নিয়ে ও বলল, থ্যাংকস তোকে। স্যারের কথা শুনে আমায় কল করেছিস বলে। বাই, রাখছি এখন।
আরেকটু জ্বলে গিয়ে মৌপিয়া বললো, ফোনটা আমি তোকে করেছিলাম রে, তাই রাখার তাড়াটা তোর থেকেও আমার বেশি।
অভীক আরেকটু হলেই হো হো করে হেসে ফেলত।
তার আগেই কট করে ফোনটা কেটে দিলো মৌ নিজেই।
অভীক খেয়াল করেনি, ওদের কথার মাঝেই কখন মা এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। ইন্দ্রাণীদেবী বললেন, মৌপিয়া কল করেছিল?
অভীক ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই মা বলল, এখনও কি একই রকমের জেদি আছে মেয়েটা?
অভীক একটু লজ্জা পেয়েই বলল, গলছে মনে হচ্ছে। আসলে খুব কঠিন বরফ তো, তাই একটু সময় লাগছে।
মা চোখ বড় বড় করে বলল,বড্ড পেকেছিস। ভালো করে পড়াশোনা কর। দুজনেরই সামনে জয়েন্ট, এসব বাদ দিয়ে পড়ায় মন দাও।
অভীক আলতো হেসে বলল, জানো মা, এখন ফার্স্ট শব্দটাকে আমিও ভালোবাসছি। তাই তুমি টেনশন করো না, আমিও ফার্স্ট চান্সেই জয়েন্টে পাব।
ইন্দ্রাণীদেবী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, না, মেয়েটার ক্রেডিট আছে বলতে হবে। একদিন আমার এই ছেলেই নিজের রিপোর্টকার্ড অন্যকে দিয়ে চলে এসেছিল, এখন সেই ছেলেই চ্যালেঞ্জ করছে। এই আত্মবিশ্বাসটা কিন্তু ওই অহংকারী স্বার্থপর মেয়েটার জন্যই এসেছে তোর মধ্যে। অভীক মুচকি হেসে বলল, লাভ ইউ মা।
বেশ কয়েকদিন হল এক্সাম শেষ হয়ে গেছে। বন্ধুরা মিলে মুভি দেখতে যাওয়ার প্ল্যানও হচ্ছে। সৌভিকই ক্রিকেট মাঠে গিয়ে প্রথম বলল, চল একটা মুভি দেখে আসি। অভীক আপাতত গান নিয়ে ব্যস্ত। মেঘবর্মনবাবু অনেক আশা করে বলেছেন, বুঝলি অভীক আমি সংগীতের প্রতিযোগিতা পছন্দ করি না। কিন্তু যখন কেউ প্রশ্ন তোলে আমার শিক্ষার সততা নিয়ে, তখন একবার অন্তত প্রমাণ করতেই হয়, আমার ছাত্রছাত্রীরাও পারে।
অভীক জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার কেউ কিছু বলেছে?
স্যার একটু গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, আমার স্ত্রী বলেছেন। উনি নজরুলগীতির শিল্পী। হঠাৎই সেদিন বললেন, তোমার ছাত্রদের কোনো কম্পিটিশনে পাঠাও না কেন? ভয় পাও বুঝি!
বুঝলি অভীক, বড্ড অপমানিতবোধ করলাম।
অভীক ভেবেছিল, মৌপিয়া বুঝি একটাই পিস জন্মেছে পৃথিবীতে, যে অকারণে কম্পিটিশনে নেমে আনন্দ পায়। ভগবান যে এমন আরো তৈরি করেছেন, সেটা এই প্রথম বুঝল।
অভীক কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল, স্যার উনি আর আপনি কি একই শিক্ষকের কাছে গান শিখেছেন?
স্যার সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললেন, একই শিক্ষকের কাছে সংগীত শিক্ষা করতে গিয়েই আমাদের পরিচয়। আর তারপর বিয়ে। তা প্রায় পঁচিশ বছর বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছি। তবুও সুযোগ পেলেই আমায় অপমান করতে ছাড়ে না। অভীক জেলা স্তরের সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাইজটা নিয়ে আসতেই হবে তোকে।
তুই আর মৌপিয়া দুজনকে নিয়ে আমি যাব। অনুষ্ঠানটা আমাদের কলকাতাতেই হবে।
এ কদিন ভালো করে প্র্যাকটিস কর দুজনেই। সপ্তাহে দু-তিনদিন করে আয় ক্লাসে, এক্সাম তো শেষ, তাই তোদের প্রবলেম হবে না।
অভীক ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আমার কোনো প্রবলেম নেই স্যার। আমি কাল থেকেই আসব।
মুভি দেখতে গিয়ে বন্ধুরা বলল, এই অভীক তুই নাকি প্রেম করছিস, কে রে মেয়েটা?
অভীক আকাশ থেকে পড়ার গলায় বলল, আগে বল আমি যে প্রেম করছি সেটা তোদের কে বলেছে?
সৌভিক আর অনিরুদ্ধ দুজনেই একসাথে বললো, মৌপিয়া বলল। বলল, তুই নাকি প্রেম করছিস! মেয়েটা কে মৌ অবশ্য এখনো জানে না, তবে প্রেম করছিস সে বিষয়ে ও হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত।
অভীক আলতো হেসে বলল, তোরা এক কাজ কর, ওর কাছ থেকেই আমার গার্লফ্রেন্ডের নামটা জেনে নিস।
মনে মনে বলল, কেন মৌপিয়া, ভালোবাসা শব্দটাতেই নাকি তোর বড্ড অ্যালার্জি? তোর নাকি এসব ন্যাকামি একেবারেই পছন্দ নয়, বোকা বোকা সেন্টিমেন্ট! তাহলে এখন কেন অভীকের প্রেমিকা খুঁজতে ব্যস্ত তুই?
গানের মঞ্চে ওঠার আগে স্যার বললেন, দুটো রাউন্ড হবে, বুঝলি। শেষের রাউন্ডটাতেই ফার্স্ট, সেকেন্ড ঠিক করবে। ফার্স্ট রাউন্ডেও অনেককে বাদ দেবে। স্যারের মুখে বেশ চিন্তার চিহ্ন। এতক্ষনে অভীকের বেশ ভয় করছে। মৌপিয়া আড়চোখে তাকাচ্ছে অভীকের দিকে। স্যারের কান বাঁচিয়ে বলল, বেস্ট অফ লাক। অভীকের কেমন একটা ভয় করছে। মনে হচ্ছে ও ভালো গাইতে পারবে না।
ফার্স্ট রাউন্ডের পর দশজন মতো সিলেক্টেড হয়েছে। তবে জাজদের কথা শুনে বেশ বোঝা যাচ্ছে আজকের কম্পিটিশনে মৌপিয়াই ফার্স্ট হবে। অভীকের গলা ঠিক মতো সায় দেয়নি। স্যারও অভীককে বললেন, ফার্স্ট রাউন্ডে কিন্তু তোর পারফরমেন্স ততটা ভালো হয়নি। সেকেন্ডটাতে আরো ভালো করতে হবে। মৌপিয়ার মাথায় হাত রেখে স্যার বললেন, বড্ড ভালো গাইলি রে। অনেকেই পাশে বসে বলছিলেন, মেয়েটার গলায় স্বয়ং দেবীর বাস। জানিস মৌ, আজ খুব গর্ব হচ্ছে তোর জন্য। এই প্রথম স্যার মৌকে তুই করে বললেন, সেটা দেখেই অভীক বুঝতে পারল, আজ মৌপিয়া স্যারের কাছে ওর মতোই প্রিয় হয়ে উঠল। শ্রোতাদের মধ্যে কানাঘুষো শোনা গেল, মৌপিয়া বলে মেয়েটাই বেস্ট গেয়েছে। অনেকের মুখ থেকে অবশ্য অভীক সেন নামটাও শুনল অভীক। কিন্তু ও নিজে জানে, আজ ফার্স্ট মৌপিয়ারই হওয়া উচিত। অভীক হয়তো অন্যদের থেকে ভালো গেয়েছে, কিন্তু মৌপিয়ার থেকে কিছুতেই ভালো নয়।
অভীকের পরের রাউন্ডও খুব ভালো হয়নি, অন্যদের তুলনায় হয়তো ভালো, কিন্তু অভীকের হিসাবে খারাপ। আর তিনজন গাইতে বাকি আছে। স্টেজ থেকে নামতে নামতেই অভীক বেশ বুঝতে পারল, আজ মৌপিয়া স্যারের সম্মান বাঁচবে।
অভীকের পরে যে ছেলেটা গাইলো সেও ভালো গাইলো। তবে দুটো জায়গা অভীকের কানে লাগল।
মৌপিয়া মল্লিকের নাম অ্যানাউন্স হয়ে গেছে। কিন্তু মৌপিয়া নেই। মেঘবর্মনবাবু বললেন, হ্যাঁরে মেয়েটা তো তুই গেয়ে আসার পরেও আমার পাশেই বসে ছিল। গেল কোথায়?
অভীক এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হলের বাইরে বেরিয়ে গেল। স্যার বললেন, দেখ দেখ, খুঁজে নিয়ে আয় ওকে।
অভীক পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজে চলেছে। মৌপিয়া অনুপস্থিত বলেই তার পরের প্রতিযোগী স্টেজে উঠে গেছে। প্রতিযোগিতার সময় শেষ হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকবে না। মঞ্চের এই বিপাশা বলে মেয়েটা গাইতে গাইতেই যেভাবে হোক খুঁজে আনতে হবে মৌকে।
হলের বাইরে একটা ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা পাতা ছিঁড়ছে মৌপিয়া। অভীক ওকে দেখেই চিৎকার করে বলল, তুই এখানে কি করছিস? তোর নাম অ্যানাউন্স হয়ে গেছে, অন্য একজন গাইতে শুরু করেছে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস! মৌপিয়ার মধ্যে কোনোরকম বিচলিত ভাব নেই। সে চুপ করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। অভীক ও হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিল….চল। স্যার খুঁজছেন। কম্পিটিশনের টাইমের মধ্যে গাইতে তো হবে! আর হয়তো দুজন বাকি আছে। মৌ তাড়াতাড়ি চল প্লিজ।
মৌপিয়া বলল, সেই নার্সারী থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত তোর করুণাতে নিজেকে ফার্স্টগার্ল বলেছি। অনেক বন্ধুরাই বলেছে, জানিস মৌপিয়া,অভীক আমাকে যে প্রশ্নের উত্তরটা পরীক্ষা হলে বলে দিয়েছিল, নিজেই সেটা লেখেনি। খাতা দেখার সময় দেখলাম রে। কি পাগল ছেলে কে জানে। বন্ধুরা কেউ তোর পাগলামীর কারণ না জানলেও, আমি জানতাম। অভীক বলল, সেসব পুরোনো কথা বাদ দে। এখন তুই চল। শেষ প্রতিযোগী গাইছে এখন। প্লিজ চল।
মৌপিয়া আলতো হেসে বললো, এই প্রাইজটা তোকে দিলাম। অতোগুলো প্রাইজের বদলের আজ একটা তোকে দিতে চাই।
অভীক বলল, ছেলেমানুষি করিস না। তুই আজ ফার্স্ট হবি রে পাগলী।
মৌ মুখ ভেঙিয়ে বলল, কোনটা ছেলেমানুষি! তুই এতদিন ধরে যেটা করে এসেছিস? ওটাকে তো আমি ভালোবাসা বলে জানতাম অভীক।
অভীক অপলক তাকিয়ে আছে মৌপিয়ার দিকে। হলের বাইরে ভেসে আসছে শেষ প্রতিযোগীর গান…আমারও পরান যাহা চায়, তুমি তাই….
অভীকের হাতের মধ্যে তিরতির করে কাঁপছে মৌপিয়ার হাতটা।
মৌপিয়া শান্ত স্বরে বললো, আমার সেকেন্ডে বড্ড অ্যালার্জি, তুই সেকেন্ড হলে আমি ভালোবাসবো কি করে!
অভীক বললো, আগে বল, এটা করুণা না ভালোবাসা?
মৌ মুচকি হেসে বললো, তোর ট্রফিটা আর সার্টিফিকেটটা আমাকে দিবি কিন্তু, নাহলে আমি খুব কাঁদব।
অভীক বলল, তুই কি এমনই থাকবি?
মৌ বলল, আমি এমন বিদঘুটে বলেই না তোর এত পছন্দ!
স্টেজে অ্যানাউন্স হচ্ছে….প্রথম স্থান অধিকার করেছে অভীক সেন।
অভীক বলল, একটুও ইচ্ছে করছে না এই প্রাইজটা আনতে যেতে। এটা কোনমতেই আমার নয়। আমি জানি আমি আজ ভালো গাইনি। তুই ইচ্ছে করে….
মৌপিয়া হাসতে হাসতে বলল, এবার বোঝ শয়তান, ক্লাসের ফার্স্ট প্রাইজটা নেওয়ার সময় আমার কেমন ইনসাল্টিং লাগত। আর ঐজন্যই আমি তোর ওপরে চব্বিশঘণ্টা রেগে থাকতাম।
অভীক বলল, বুঝলাম। আর রেগে থাকবি না তো!
মৌপিয়া আলতো করে অভীকের হাতটা ধরে বলল, একসাথে চলব অনেকটা পথ। ঝগড়া করব, কম্পিটিশন করবো, হিংসা করব আর অনেকটা ভালোবাসবো।
অভীক বলল, তুই ভালোবাসতে পারিস?
মৌপিয়া বলল, শিখে গেছি। এতবছর ধরে একজনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে শিখে গেছি।
বাই দ্য ওয়ে তুই নিশ্চয়ই মেডিক্যাল পড়বি। তার মানে আরো পাঁচ বছর আমায় জ্বালাবি।
অভীক বলল, পাঁচ বছর নয়, সারাজীবন জ্বালাবো তোকে।
মৌপিয়া বলল, যা প্রাইজটা আর তোর নামের সার্টিফিকেটটা আমায় দে।
অভীক বলল, আগে সেরকম করে কাঁদ তারপর।
হাসছে মৌপিয়া… অভীক তাকিয়ে আছে ওর চিরপরিচিত হাসিটার দিকে।
সমাপ্ত