বৃষ্টি ভেজা অনুভূতিরা
সকাল থেকেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে রাকা। নিজের চেম্বারে বসে বসে পুরোনো চ্যাটগুলো পড়ছিল ও। সেইজন্যই কখনো কখনো ওর ঠোঁটের ফাঁকে হালকা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছিল। কব্জি উল্টে ঘড়িতে দেখল রাউন্ডের সময় হয়ে গেছে। ইমোশন শব্দটাকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রাকা। ও ঘড়িতে সময় দেখতে আর ক্যামেরায় ছবি তুলতেই বেশি পছন্দ করে। মোবাইলটাকে মাল্টিপারপাস ইউজ করতে একেবারেই পছন্দ করে না ও। ওর মনে হয় এতে বাকি জিনিসগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায়। অদ্ভুত কিছু প্রিন্সিপ্যাল মেইনটেইন করে ও। বছর ত্রিশ-একত্রিশের রাকাকে দেখলে মনে হয় বয়েসের থেকে একটু বেশিই গম্ভীর। হাসি শব্দটাতে যেন ভীষণ অ্যালার্জি।
যারা দূর থেকে ডক্টর রাকা সিংহকে চেনেন, তারা জানেন উনি একটু বেশিই প্রফেশনাল।
হসপিটালে যখন রাউন্ডে আসেন, তখন রুগিদের সাথে বেশ ভালো করেই কথা বলেন, খোঁজ নেন তাদের শরীরের, কিন্তু পেশেন্ট পার্টি একটা কথা দুবার জিজ্ঞেস করতে গেলেই বেশ কড়া গলায় বলেন, অযথা প্রশ্ন করবেন না। আপনাদের সব কৌতূহল দমন করার দায়িত্ব আমার নয়। প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছি, আপনার পেশেন্টের কি কি খাওয়া চলবে, আর কি কি খাওয়া চলবে না। যখন ডিসচার্জ করব, সিস্টারদের কাছ থেকে জেনে নেবেন। ওনার ওই তিরিক্ষি মেজাজের জন্যই বোধহয় নার্সরাও একটু কমই ঘেঁষে ওর কাছে। কাজে গাফিলতি দেখলে উনি সিনিয়র ডক্টরকেও ছেড়ে কথা বলেন না। নিজে নাইট ডিউটিতে ফ্লাক্সে করে কড়া ব্ল্যাক কফি নিয়ে আসেন। ঘুম যেন ধারেকাছে না ঘেঁষতে পারে তাই এমন ব্যবস্থা। কোনো নার্সকে ঢুলতে দেখলেই গম্ভীর গলায় বলেন, সারাদিন কি মুভি দেখছিলেন? রাতে ঘুম পায় কি করে! এতদিন নাইট ডিউটি করেও অভ্যাস হয়নি? নাকি ভেবেছেন, সরকারি হসপিটালে জেগে থাকার দরকার নেই? সরকারি কাজে গাফিলতি দেওয়াই যায়, এটা যতদিন না মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত ঘুম পাবেই। ওই ফাঁকিবাজি ভাবনাটাই তো আপনাদের সিডেটিভের কাজ করে।
কিছুজনকে দেখি সিরিয়াসলি কাজ করতে, বাকি কয়েকজন তো ঘুম আর গল্প পেলে কিছুই চান না। পেশেন্টরা এত এত কমপ্লেন কেন করেন আপনাদের নামে? এসব কথা নাইটের নার্সদের একটু-আধটু সবাইকেই শুনতে হয়েছে গত দেড় বছরে। যবে থেকে ডক্টর রাকা সিংহ এই হসপিটালে জয়েন করেছেন, তবে থেকেই সিকিউরিটি থেকে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে, যে গোপালপুর হসপিটালে একজন নতুন লেডি ডক্টর এসেছেন, যার মুখ আর হাত একসাথে চলে। রোগীরা ম্যামকে দেখে যেমন খুশি, তেমনি অখুশি পেশেন্ট পার্টি। রোগীর প্রতি কোনোরকম অমনোযোগী মানসিকতা দেখলেই, ভিজিটিং আওয়ারে তাদের বেশ করে অপমান করে তবেই ছাড়ে রাকা।
আজও ওয়ার্ডে রাউন্ড সেরে এসে ইমার্জেন্সিতে বসে রোগী দেখছিলেন রাকা সিংহ। ভিতরে ভিতরে যতই ভাঙাগড়া চলুক, বাইরে বোঝার উপায় নেই।
অথচ এই মুহূর্তে রাকার ভিতরে ভিতরে একটা বিধ্বংসী ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। আজ থেকে আর ফিরবে না ৩৩/B Mƒ S রোডে। আজ থেকে আর লিফটে উঠেই চার নম্বর সুইচটা অনও করবে না। ওদের অগোছালো ফ্ল্যাটের চাবিটা এখনো পড়ে আছে ব্যাগের এক কোনে। যেটা ঘুরিয়ে ও রোজ ঢোকে ফ্ল্যাটটাতে। ঢুকেই সামনের ব্রাউন লেদারের সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে টিভির রিমোটে প্রেস করে নিউজ চ্যানেল। যখন খুব ইচ্ছে করে এক কাপ কফি খাবার। তখনই বেলটা বেজে ওঠে। সোফা ছেড়ে একদম উঠতে ইচ্ছে করে না রাকার।
বার দুই বেল বাজার পরে কোনোমতে দরজাটা খুলে দিয়েই আবার সোফায় এসে বসে।
মুখে আলতো হাসি নিয়ে ভিতরে ঢোকে অংশু।
আজও আউটডোরে ভিড় ছিল! মুখ চোখের কি অবস্থা করেছ? কথাগুলো বলতে বলতেই ওয়াশরুমের দিকে এগোয় আই স্পেশালিষ্ট অংশুমান বসু।
রাকার একটুও উঠতে ইচ্ছে করেনা। ও তখনও টিভির রিমোট নিয়ে চ্যানেল সার্ফ করতে থাকে এলোমেলো।
একটা ট্রে-তে দুকাপ কফি আর সলটেড কাজু নিয়ে পাশে এসে বসে অংশু। তারপর রাকার মাথাটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে, অনেকদিন তো হল, দেশের জন্য, দশের জন্য উপকার করা। এবার অন্তত একটু নিজের দিকে তাকাও। আমাদের দিকে তাকাও। বয়সটা কিন্তু বাড়ছে রাকা, যদি ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হয়, তাহলে কিন্তু এবার বিয়েটা করা দরকার। আমাদের দুজনের বাড়িতেই যখন কোনো প্রবলেম নেই, তখন….
রাকা অংশুর বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, তুমি আমার মনের সব খবর রাখো, আর এটা বুঝতে তোমার কেন কষ্ট হয়, যে আমি সাধারণ মানুষদের জন্য কিছু করতে চাই। প্রাইভেট নার্সিংহোমে, নিজের এসি চেম্বারে নয়, বরং যাদের ক্ষমতা নেই এসব জায়গায় পৌঁছানোর তাদের জন্য…
রাকাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অংশু বলল, গত তিনবছর ধরে তো আমি একই কথা শুনছি তোমার মুখে। কিন্তু সারাদিনের এই পরিশ্রমের পর নিজেদের সময় তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আর তোমাকে কে বলল, প্রাইভেট নার্সিংহোমে রুগির সেবা করার সুযোগ থাকে না?
রাকা আলতো হেসে বলল, থাকে বুঝি! তোমার মতো আই সার্জেনদের ওরা কি আদৌ নাগাল পায়?
তোমার এক একটা অপারেশনে তুমি বোধহয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার নাও, তারপর আছে নার্সিংহোমের চার্জ। পায় ওরা তোমাকে নাগালে! নাকি রেটিনার রোগ শুধু বড়লোকদেরই হয় অংশু?
অংশু রাকার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে আইপিএল-টা চালাতে চালাতে বলল, তার মানে তুমি আপাতত কাজের প্রেসারে বিয়ে করতে পারবে না, তাই তো! এভাবে সারাজীবন কি লিভ ইন করতে হবে! আমি তো একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারিনা রাকা, বিয়েতে তোমার এত আপত্তি কিসের? আজ অবধি তোমার কোনো কাজে তো আমি বাধা দিইনি, তাই না?
রাকা নির্লিপ্ত গলায় বলল, সেটা যতদিন লাভার আছো ততদিন অধিকার ফলাও না হয়তো, লিগ্যাল হাজবেন্ড হওয়ার পর বেশিরভাগ পুরুষমানুষই নাকি বদলে যায়!
অংশু বিরক্ত গলায় বলল, একটু বোধহয় বেশিই কষ্টকল্পনা করে ফেলছ তুমি। ভুলে যাচ্ছ, আমিও একজন ডক্টর, টিপিক্যাল হাজবেন্ড নই। আর তুমিও হাউজওয়াইফ নও। আমাদের দুজনের টাইমের ক্রাইসিসটা আমাদের দুজনকেই বুঝতে হবে। যেহেতু আমরা একই প্রফেশনে আছি তাই…
রাকা অংশুকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল, আচ্ছা অংশু যদি আমরা বিয়ে না করে, এভাবে দুজনে দুজনের পাশে থাকি বন্ধন ছাড়া, তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে তোমার?
অংশু ভ্রু কুঁচকে বলল, কবে আর আমার মতামত গুরুত্ব পেলো তোমার কাছে! নেহাত তখন বয়সটা কম ছিল, তাই হয়তো আমার প্রোপোজে সাড়া দিয়েছিলে তুমি!
রাকা আদুরে গলায় বলল, তোমার মনে আছে, সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি যখন কলেজে ঢুকেছিলাম তখন সম্পূর্ণ কাকভেজা হয়ে গেছি।
অংশুর দুচোখেও যেন সেই ফেলে আসা বাইশের বসন্তের ছবি। মুচকি হেসে বলল, মনে আবার থাকবে না?
ম্যাডাম ভিজে গেছেন, তবুও গলার উষ্ণতায় খামতি নেই। আমি তখন থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। বছর বাইশের তরতাজা যুবক। যতই কাঠখোট্টা হই, বসন্ত তখন আমার চারপাশে নিজের জায়গা দখলের লড়াই চালাচ্ছে। উনি সদ্য কলেজে এসেছেন। তাতেই সিনিয়রকে ডেকে বললেন, পাশে একজন ভদ্রমহিলা ভিজে যাচ্ছে দেখেও নিজে ছাতা মাথায় হাঁটছেন, লজ্জা করে না! এইটুকু সৌজন্যবোধ নেই, আপনারা যে কি ডক্টর হবেন কে জানে!
শুধু গাদা গাদা নম্বর পেলেই ডক্টর হওয়া যায় না। মানবিকতাবোধটা এই পেশার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, বুঝলেন!
আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা জুনিয়র মেয়ের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনছিলাম। কি করবো বুঝতে না পেরে বললাম, আমায় বলছেন?
তুমি আরও রেগে গিয়ে বললে, না, বৃষ্টিকে বলছি। আমায় কেন ভিজিয়ে দিল সেই জন্য অভিযোগ করছি।
আমি একটু ভয়ে ভয়েই তোমার দিকে এগিয়েছিলাম।
তারপর বলেছিলাম, আসুন ছাতার মধ্যে আসুন, কোন ডিপার্টমেন্টে যাবেন?
তুমি ছাতায় ঢুকেই বলেছিলে, অ্যানাটমি।
আমি গোটা ছাতাটাই তোমার মাথায় ধরে নিজে প্রায় ভিজতে ভিজতে এগোচ্ছিলাম। জানো রাকা, ওই বৃষ্টি ভেজা পাঁচ ছয় মিনিট আমাকে ভীষণ ভাবে হন্ট করত।
তোমার সিক্ত শরীরকে অল্প অল্প স্পর্শ করছিল আমার শরীর। একই ছাতায় হাঁটার ছন্দে সেটাই স্বভাবিক। তোমার আঙুলের সাথে ঠেকে যাচ্ছিল আমার আঙুলগুলো। অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছিল লোহিতকণিকায়। তোমার ভেজা ভেজা চুলের গন্ধ এসে ঝাপটা দিচ্ছিল আমার নাকে।
এই রাকা, তোমায় কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি, ওটা কি পারফিউম ছিল গো, তুমি সেদিন যেটা মেখেছিলে?
রাকা অংশুর গালে ঠোক্কর দিয়ে বলেছিল, ইভিনিং ইন প্যারিস। দারুণ না গন্ধটা?
মাথাটা ওর কাঁধে সমর্পণ করে রাকা বলত, তারপর বলো…
অংশু বুঝত, রাকার ক্লান্ত অবসন্ন মনটা ফিরতে চাইছে যৌবনের আবীর রাঙানো বসন্তে। অংশু কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়েই রাকার কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলত, এই তো এখন যেমন তোমার চুলের গন্ধ এসে ঝাপটা দিচ্ছে আমার নাকে। এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার ইচ্ছেদের। সেদিনও তেমনি হঠাৎ নামা বৃষ্টি লন্ডভন্ড করে দিচ্ছিল আমার ভালো ছেলের ইমেজটাকে। মেডিকেল কলেজের অত্যন্ত ভদ্র, সোবার ছেলে অংশুমানের বাঁহাতে ছাতা ছিল ঠিকই, কিন্তু মুক্ত ছিল ডানহাতটা। আর সেই ডানহাতটার খুব ইচ্ছে করছিল, এই স্বপ্নপরীর ভেজা চুলটা একবার অন্তত ছুঁয়ে দেখতে। ভদ্র ছেলের মধ্যে তখন ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছিল সাধারণ সৌজন্যবোধ। তারমধ্যেই মেয়েটা বিপত্তিটা ঘটিয়েছিল। বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় স্লিপ করার আগের মুহূর্তে আমার হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে আতঙ্কিত গলায় বলেছিল, সরি। এক্সট্রিমলি সরি।
সেই প্রথম আমি দেখেছিলাম কাউকে, ভয় পেলেও এত সুন্দর লাগে। রাগলেও আকর্ষণীয় লাগে, আর হাসলে তো হৃৎপিণ্ড থমকে যায়।
আমাকে অপ্রস্তুতে পড়তে দেখেই নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলে, সুযোগ নিচ্ছি ভাববেন না যেন। সত্যিই পড়ে যাচ্ছিলাম। স্যান্ডেলের হিলটা একটু স্লিপারি বোধহয়।
আমি কি বলব বুঝতে না পেরেই বলেছিলাম, ইটস ওকে। তবে প্লিজ আমায় আপনি বলবেন না। বড্ড বড় বড় লাগে।
তুমি তখন হাসি মুখে বলেছিলে, আমার নাম রাকা, রাকা সিংহ। ফার্স্ট ইয়ার।
আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম, কলকাতাতেই বাড়ি?
তুমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলে। তারপর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলেছিলে, হঠাৎ বৃষ্টি মন্দ নয়, কি বলো? নতুন পরিচয় বাড়ায়।
আমার তখন সমস্ত ইন্দ্রিয় অলরেডি কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে আবেশে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। নিজেকে রাজ কাপুর ভাবতে শুরু করেছি। এলোমেলো হয়ে গেছে নিজের পরিচয়। সেই আবেশ জড়ানো গলাতেই বলেছিলাম, তুমি কি এনগেজড?
তুমি থমকে দাঁড়িয়ে গভীর ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলে, নাহলে কি প্রোপোজ করতে?
আমি কি করেছিলাম মনে নেই। তখন আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না। বোধহয় আলতো করে তোমার হাতটা ছুঁয়ে বলেছিলাম, ইংরেজীতে একটা কথা আছে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। তুমি কি সেটাতে বিশ্বাস করো রাকা?
তুমি ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বলেছিলে, আমি কত নম্বর প্রথম দেখায় প্রেম, জানতে পারি?
প্রথমে তোমার কথার মানেটাও বুঝতে পারিনি আমি। তাই ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, জানি না, কি হয়ে গেল আমার, কিন্তু তোমাকে আমার ভালো লেগে গেল আচমকাই। লজিক না মেনেই, সম্পূর্ণ পরিচয় না হয়েই…
তুমি আবার রিপিট করেছিলে কথাটা, বলেছিলে, সেটাই তো জানতে চাইছি, তুমি এমন হঠাৎ হঠাৎ প্রেমে কতবার পড়েছ?
লজ্জায় অপমানে কেঁপে উঠেছিলাম আমি। মনে হয়েছিলো, ছি ছি এ আমি কি করলাম। মুহূর্তের ভুলে এই মেয়ের কাছে আমি এভাবে ছোট হয়ে গেলাম। কি ভাবল আমাকে মেয়েটা, সুযোগসন্ধানী!
তোমাকে অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছে দিয়ে, ছাতা বন্ধ করে, ওই বৃষ্টির মধ্যেই প্রাণপণ ছুটেছিলাম।
মনে হচ্ছিল, একটা সূক্ষ্ম অপমান আমাকে তাড়া করছে। আমি যতই ছুটছি সেই অপমানের নীল বাতাসটাও আমার পিছনে ধাওয়া করে আসছে।
ওই বৃষ্টিভেজা পাঁচ মিনিট কাটানোর পর থেকেই আমি বদলে যেতে শুরু করলাম। তোমার ভেজা চুলের গন্ধ আমায় আবিষ্ট করে রাখে, আর তোমার অপমান করা কথাটা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাই তোমাকে দূর থেকে দেখলেও আমি পালিয়ে যাচ্ছিলাম।
খুব ইচ্ছে করত, পথ আটকে বলি, প্রথম দেখাতেও প্রেম হয়। কড়ি আঙুলে ছুঁয়ে গেলে সব সময় আড়ি হয় না। কিছু অনুভূতিরও জন্ম হয়। আর ওই না বলা অনুভূতিগুলোকে একসাথে গাঁথতে পারলে হয়তো শুরু হতো কোনো নতুন উপন্যাসের ভূমিকা। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করলেই তো আর বলা যায় না! তাছাড়া তুমি আমাকে প্রথম দিনেই বলেছিলে, এমন প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়াটা কি আমার হবি নাকি! ওই কথার পর আর যেই সামনে যাক, অংশুমান যে যাবে না সে ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত ছিলাম। কারণ আমার ভিতরের আমিটা কতটা সংযমী, সেটা তো আমি জানি। তাই রাকা সিংহ সম্পর্কে হাজার কৌতূহল থাকলেও কিছুতেই তাকাতাম না সেদিকে। এমন সময় পড়াশোনায় যখন একটু আনমনা হয়ে পড়েছে আমার মন, তখনই আমার বেশ ক্লোজফ্রেন্ড সায়ন্তিকা এসে বললো, এই অংশু দিনরাত এত মনমরা কেন রে! চল, কলেজফেস্টের রিহার্সাল চলছে দেখবি চল। শেক্সপিয়ারের ওথেলো নাটক হচ্ছে, ডেসডিমানো হয়েছে ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে, রাকা সিংহ। দারুণ অভিনয় করছে রে। তুলনামূলকভাবে আমাদের এতদিনের নাট্যব্যক্তিত্ব, আরে আমাদের সন্দীপ পুরো ছড়িয়ে লাট করছে রে। এতদিন পর্যন্ত সন্দীপ বলতো, ও নাকি কি সব নাট্যসংস্থায় যুক্ত। ওটা নাকি ওর ব্লাডে আছে। এখন তো ওইটুকু একটা পুচকে মেয়ের কাছে ঘোল খাচ্ছে আমাদের নাট্যসম্রাট।
সন্দীপ আমাদের বন্ধু। ওকে নিয়ে আমরা আড়ালে হাসি। ডাক্তারিটা বোধহয় ওর বাবার শখে পড়তে আসা, আসলে ওর নাকি নাট্যাভিনেতা হবার ভীষণ শখ। লাইট, ক্যামেরা, দর্শকের হাততালি এসব ওকে টানে বেশি। ছুরি, কাঁচি ওর জন্য নয়। সন্দীপকে আমরা ওর পিতৃদত্ত সারনেম চট্টোপাধ্যায় বাদ দিয়ে রায় বলে ডাকতাম। ও হেসে বলত, তোরা আশীর্বাদ কর, আমি যেন নাট্য জগতে আমার নাম উজ্জ্বল করতে পারি। এমন পাগলা হবু ডাক্তারের নাট্যপ্রতিভাকে নাকি প্রতি পদে পদে চ্যালেঞ্জ করছে ওই মেয়ে। সায়ন্তিকার কথা শোনার পরে দূর থেকে তোমাকে দেখার ইচ্ছেটা সম্বরণ করতে পারলাম না।
ওর সাথে পায়ে পায়ে বড় রিহার্সাল হলটার দিকে এগোলাম। বুকের ভিতর তখন টিপ টিপ আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে , ফিরে যাব? কি করা উচিত। নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আসা উচিত ডেসডিমনাকে। মেডিকেল কলেজের নাটক বলে কথা, আড়ম্বর মন্দ নয়। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ভিড় করে রিহার্সাল দেখছে। কয়েকজন প্রফেসরও বসেছিলেন।
গ্রে জিন্সের ওপরে রেডিস টপ পরে তুমি তখন ডায়াসের ওপরে। আমাদের সন্দীপের চোখে মুখে বেশ টেনশন। তুমি ভীষণ ক্যাজুয়াল।
মাঝখানে রাকা বলে উঠল, বাই দ্য ওয়ে, সত্যিই সায়ন্তিকা তোমার ক্লোজফ্রেন্ড ছিল বলছ? নাকি চাপ ছিল? আজও জানা হয়নি কিন্তু।
রাকাকে আরেকটু বুকের কাছে টেনে নিয়ে অংশু বলল, একটু পজেসিভনেস বাঁচিয়ে রাখো। ভাবো সায়ন্তিকার প্রশ্নটা খুঁজতে তোমাকে কাটাতে হবে আমার সাথে আরো অনেক জন্ম।
রাকা আদুরে গলায় বলল, আমি তোমার মতো রোম্যান্টিক নই, কিন্তু তোমার এই স্মৃতিচারণ বা পুরোনো কথার রোমন্থন বড্ড ভালো লাগে। একটানে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমার যৌবনের সবুজ সাহসী দিনগুলোতে।
অংশু একমুখ হেসে বলে, এখনও তুমি যৌবনেই আছো।
আর তখন দুঃসাহসী ছিলে। এখন সাহসী।
তারপর শোনো না, বলেই অংশু বলতে শুরু করল।
ডায়াসে তোমাকে দেখেই আমার সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা আবার ফিরে এলো। যেটা আগে কখনো অনুভব করিনি।
আজও মনে আছে সেই অনুভূতিটার কথা।
ছোটবেলায় একবার চড়কের মেলায় ছোটকাকার সাথে নাগরদোলায় চেপেছিলাম। নাগরদোলাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করতে করতে যখন নীচে নামছে, তখন আমার তলপেটের মধ্যে গুড়গুড় করে আওয়াজ হত যেন। বেশ ভয় ভয় মজার অনুভূতি। ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। তোমাকে ওই ডায়াসে দেখার সময় ওরকমই একটা শিহরন হচ্ছিল। তুমি ব্যস্ত ছিলে অভিনয়ে। আমিও তোমার গুণমুগ্ধদের মধ্যে একজন হয়ে ভিড়ের মধ্যে থেকেও আলাদা চোখে তোমায় দেখছি। সায়ন্তিকা আমার কানে কানে বললো, আমাদের সন্দীপকে দেখ, বেচারা না টয়লেট করে ফেলে। কপালে ঘামের আগমন হয়েছে।
তোমার চোখে তখন ডেসডিমনার দৃষ্টি। মায়াবী অথচ আতঙ্কিত। আমি অপলক তাকিয়ে আছি তোমার দিকে। আচমকা চোখাচোখি। ভাবতেই পারিনি তুমি ওখান থেকেও দেখে ফেলবে আমায়।
আমি সায়ন্তিকাকে বললাম, আমি আসছি রে।
ও একটু চমকে জানতে চাইলো, ক্লাস অফ আছে তো আজ, কোথায় যাবি?
আমি তোমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখলাম, বললাম লাইব্রেরি যাবো।
পালাতে পারলে বাঁচির মতোই ছুটে চলে এসেছিলাম।
ঠিক দুদিন পর কাকতালীয় ভাবেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তোমার সাথে দেখা। আমি কি কাজে বেরিয়েছিলাম সেটা আজ আর মনে নেই। তোমাকে দেখেই পিছন ফিরতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় তুমি বেশ জোরেই ডাকলে, অংশু?
আমার নামের পিছন থেকে ‘মান’ খসে গেছে বুঝতে পারার পরেও দাঁড়িয়ে থাকা মানে সম্মান খোয়ানো, এটা বুঝেও তোমার ডাককে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার সেদিনও ছিল না। তাই দম দেওয়া পুতুলের মতো ঘুরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমায় কিছু বলছ?
তুমি মুচকি হেসে বলেছিলে, কই না তো। আমি তো ট্যাক্সিড্রাইভার অংশুকে ডাকলাম। তোমার নাম তো অংশুমান। তাই না?
আমি পেন্ডুলামের মতো ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, সরি। আবার সেই ঘায়েল করা হাসি হেসে বললে, এখানে বোধহয় অংশু নামে কোনো ড্রাইভার নেই। তাই তোমার নামের ফার্স্ট পার্টটা যখন মিলে গেছে তখন তোমাকেই একটা প্রশ্ন করি। আজ কি কোনো ধর্মঘট চলছে?
লাইন দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, ড্রাইভার নেই। ওদিকে বাসও দেখতে পেলাম না। আসার সময় তো কোনো প্রবলেম ফিল করিনি, এখন কেন হচ্ছে।
তোমার মুখে একটু হলেও দুঃশ্চিন্তার ছাপ। আমি সাবধানে বললাম, এই এলাকায় যানবাহন বন্ধ। একজন ড্রাইভার মারা গেছেন একটু আগেই, তাই এরা আজ আর গাড়ি বের করবে না শুনলাম।
আমি কথাটা বলার পরেই তুমি একটু চিন্তিত হয়ে বললে, তাহলে তো ভুল হল এই স্টপে নেমে। এখন কি করি!
আমি তখন নিজেকে তোমার ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ করব কিনা ভাবছি। তুমি আবার বললে, প্রোপোজ করা ছাড়াও আরেকটা শব্দ আছে ইংরেজিতে, হেল্প করা। সে সম্পর্কে তোমার কিছু জানা আছে মিস্টার অংশুমান?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, একটু হাঁটতে হবে। সামনের স্টপেজ থেকে বাস ছাড়ছে। মিনিট পনেরো হাঁটলেই হবে।
তুমি বেশ গম্ভীর স্বরেই বললে, রাস্তাটা আমায় একটু চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? আমি আজ এদিকে প্রথম এলাম। আমার এক বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু সকালে এসেছি ট্যাক্সিতে, এখন যে এমন ফেঁসে যাব ভাবতে পারিনি।
আমি বেশ উৎসাহী গলায় বললাম, একটু হাঁটলেই ওই স্ট্যান্ডটা পেয়ে যাবে। বাসগুলো বাইপাস দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে আজকে।
তুমি কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলে। বলা ভালো আমায় অনুসরণ করলে। আর আমার মনের মধ্যে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বন্ধু, টিচার, ডক্টর কেন যে এগুলোর জেন্ডার হয় না। রাকা কি পুরুষ বন্ধুর বাড়িতে এসেছিল, নাকি কোনো মেয়ে। মেয়ে হলে কি বান্ধবী বলত! নাকি সবাইকেই বন্ধুর দলে ফেলে। খুব ক্লোজফ্রেন্ড কেউ বোধহয়। নাহলে ছুটির দিনে তার বাড়িতে কেন আসবে! প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই হাঁটছিলাম। কখনো পাশাপাশি, কখনো তুমি আমার পিছনে। আচমকা তোমার প্রশ্নটা ধেয়ে এল।
সেদিন নাটকের রিহার্সালে গিয়েছিলে যে মেয়েটার সাথে, ওকেও কি প্রথম দেখায় প্রেম নিবেদন করেছিলে!
কথাটা শুনেই আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। আমার সামনে কোনো থান ইট ছিল, না আমি এমনি হোঁচট খেয়েছিলাম জানি না। তবে তুমি একটা হাত দিয়ে আমার পিঠের জামাটা খামচে ধরে আমায় সামলে ছিলে। ভাগ্যিস শার্টের মেটিরিয়ালটা ভালো ছিল। তাই পিঠ খোলা অবস্থায় ফিরতে হয়নি আমায়।
তারপর বলেছিলে, সাবধানে। এখুনি পড়তে তো!
যাকগে, শোধবোধ। সেদিন তুমি আমায় বাঁচিয়েছিলে, আজ আমি তোমায়।
আবার দুপা হাঁটার পরেই তুমি থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলে, বললে না তো, ওই মেয়েটাও কি তোমার লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট?
হঠাৎ করেই আমার মধ্যে ঘুমন্ত পৌরুষ জেগে উঠেছিল। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, আমি লুস ক্যারেক্টার নই। যে কারণে অকারণে মেয়েদের ডিস্টার্ব করে বেড়াব! আর সায়ন্তিকা আমার ভালো বন্ধু, এর বেশি কিছু নয়। ইচ্ছে হলে আমার ব্যাচে, কলেজে খোঁজ নিয়ে জেনে নিও, আমি কেমন ছেলে। ওই দিন বৃষ্টির সকালে যেটা বলেছিলাম, সেটা মিথ্যে নয়। ভালোবাসা অমন হঠাৎই আসে। হিসেবনিকেশ করে অপারেশন করা যায়, চ্যানেল খুঁজে ইনজেকশন দেওয়া যায়, কিন্তু প্রেম করা যায় না। আর যারা হিসেবনিকেশ করে প্রেম করে, তাদের সম্পর্কটাকে আমি অন্তত প্রেম বা ভালোবাসা কোনোটাই বলি না। দেখো রাকা, তোমার আমাকে পছন্দ নয় বা তুমি প্রেমে বিশ্বাসী নও অথবা অলরেডি এনগেজড, হতেই পারো। সেদিনের পর থেকে আমি কি তোমাকে আর পথে ঘাটে প্রোপোজ করেছি? অথবা কোনোভাবে তোমাকে বিরক্ত করেছি? আমি তো নিজেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেলেছি তোমার থেকে, তাহলে অযথা আমাকে অপমান করে যাচ্ছ কেন?
তুমি এতক্ষণ স্থির হয়ে শুনেছিলে আমার কথা। তারপর মুচকি হেসে বলল, মাঝের এতদিন লুকিয়ে দেখা ছাড়া আর প্রোপোজ করলে না বলেই তো আরও বেশি করে সন্দেহ হলো, ওটা কি শুধুই মোহ ছিল। বৃষ্টি ভেজা রাস্তা, একই ছাতা…ওটা আকস্মিক আবেগ বোধহয়।
ভালোবাসা হলে এই কদিনে একটু অন্তত হিন্ট পেতাম।
আপাতত আমি নিশ্চিত হলাম, ওটা মোহই ছিল।
আমাকে পুরোপুরি স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়ে তুমি বললে, ওই তো বাস আসছে। টা টা।
ছুটে গিয়ে বাসের পা-দানিতে পা দিয়ে হাত নেড়ে আমার উদ্দেশ্যে একটু জোরেই বললে, থ্যাংক ইউ।
আমার তখনও মনের মধ্যে আন্দোলন চলছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, পরোক্ষভাবে তুমি তোমাকে প্রোপোজ করতে উৎসাহী করে গেলে।
আমি তখনও বাস্তব আর স্বপ্ন জগতে ভাসমান ঘুড়ি হয়ে লাট খাচ্ছি। লাট খেতে খেতেই নিজের গন্তব্যের দিকে এগোলাম। তোমার কথাগুলো কানের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কের মধ্যে নিজেদের জাল বিস্তার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন। ফলস্বরূপ আমার চিন্তাশক্তি একান্তভাবেই অবশ হয়ে গেছে।
রুমে ঢুকতেই রাজীব আর আনোয়ার বলে উঠল, কি রে..এমন কাটা কলাগাছ হয়ে ফিরলি কেন! আমি ওদের কথার উত্তর না দিয়েই বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, অফিসিয়ালি প্রোপোজ করব তোমায়। কিন্তু সেই প্রোপোজে যেন তুমি কুপোকাত হয়ে যাও। তোমার রূপমুগ্ধ আর গুণমুগ্ধর সংখ্যা যে খুব তাড়াতাড়ি আরও বেড়ে যাবে সে ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত ছিলাম। সকলের মুখেই তখন একটাই কথা, আরে ফার্স্ট ইয়ারের রাকা সিংহ বলে মেয়েটা যা অভিনয় করছে না, ওথেলো খাবি খেয়ে মরছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, শেক্সপিয়ার আমার মৃতুবান বহু বছর আগেই রচনা করে রেখে গেছেন। এখন শুধু সেটা মেডিকেল কলেজের স্টেজে অভিনীত হওয়ার অপেক্ষা। তারপর প্রোপোজালের গঙ্গা বয়ে যাবে। ওথেলোকে কেউ মনে রাখবে না, সে খুনি। কিন্তু ডেসডিমনাকে সবাই মনের মণিকোঠায় বসাবে। তাই ফেস্টের আগেই আমাকে যা করার করতে হবে।
কি করব প্ল্যান করলাম সারারাত। পড়াশোনা ছাড়া একটা নির্ঘুম রাত অংশুমান কোনোদিন কাটায়নি। তার রুমের বন্ধুরা মুভি দেখেছে, দেদার আড্ডা দিয়েছে, এমনকি চাঁদা তুলে বিয়ারও খেয়েছে, কিন্তু অংশুমান এসব আড্ডা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে পড়ায় মন দিয়েছে। রাত বারোটার পরে ঘুমিয়ে সকাল ছয়টায় উঠে পড়তে বসেছে। তাই গোটা রাত জেগে থাকার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছি, তুমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেলে! আমার মন মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছে, প্রেমে পড়লে এমন পাগলামি এসেই ভিড় করে।
সারারাত ধরে ভেবে ভেবে বের করলাম, অর্কুটে নয়, চিঠিতে প্রেম নিবেদন করব তোমায়। বাংলা আমার বরাবরই কাঁচা। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কোথায়!
প্রিয়তমা লিখে চারটে পেপার ছিঁড়ে, অবশেষে শুরু করলাম। রাকা আলতো স্বরে বললো, ওই চিঠিটা আমার মুখস্থ অংশু। আজও মুখস্থ, আমি বলছি….
বিনা সম্বোধনেই লিখলাম রাকা। প্রিয়া, প্রিয়তমার অনেক ঊর্ধ্বে থাকুক তোমার স্থান। আমি তোমাকে শুধু আমার প্রেমিকা হিসাবে দেখতে চাইনা। চাই একজন সৎ, স্পষ্টবাদী, সাহসী নারী হিসাবে। যদি সত্যিই তুমি আমায় তোমার জীবনে স্থান দাও, তবে শেষ দিন পর্যন্ত হাত ছাড়ব না। না, আকাশ থেকে চন্দ্র, সূর্য নিয়ে আসবার মতো মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করব না। বলব না, নিজের থেকেও তোমাকে বেশি ভালবাসি। শুধু একটাই কথা বলব, এই দীর্ঘ জীবন চালাতে আমাদের প্রত্যেকেরই একজন খুব কাছের বন্ধুর প্রয়োজন হয়। তোমার সেই বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। তোমার অনাবিল হাসির সাথে সাথে, নোনতা জলের ভাগীদারও হতে চাই।
বদলে কিছুই চাইছি না ভেবো না যেন! আমিও অনেক কিছু চাই রাকা। জীবনের কাছে দুহাত ভরে নিতে চাই। আবার অমন আচমকা বৃষ্টিতে একই ছাতায় তোমার আঙুল ছুঁতে চাই। একটা অচেনা গ্রামে মাটির কুটিরে কাটাতে চাই অন্তত সাতদিন। শহরের চাকচিক্য থাকবে না সেখানে। দূর থেকে ভেসে আসবে মাদলের আওয়াজ। এমনকি ইলেক্ট্রিসিটি সেখানের সব রহস্যকে মুহূর্তে ফাঁস করতে পারবে না। ঘন অন্ধকারে একটাই বাতি জ্বলবে সেই ঘরে। হাওয়ায় দুলবে বাতির শিখা। আধো অন্ধকারে আমি তোমায় দেখব রাকা। পাক্কা গোয়েন্দার মতো নয়, কবির মতো তোমার মনের তলানিতে প্রবেশ করার চেষ্টা করব। তারপর সেই গভীর মনে ডুব দিয়ে একবার ভাসব, একবার হাবুডুবু খাব। তখন তুমিই আমার হাত ধরে টেনে তুলবে কিনারে। আর ফিসফিস করে বলবে, ভালোবাসি। আমি বলব, ডুবতে চাই তোমার মনের গহনে। ভালোবাসার গভীরতা মাপার জন্য।
তুমি বলবে, তাহলে কিন্তু তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।
আমি হাসি মুখে ঝাঁপ দিতে চাই, হাঁসফাঁস করে মরতে চাই তোমার ভালোবাসার গোপন প্রকোষ্ঠে। সেখানে প্রবেশ করে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
প্লিজ রাকা, একাধিপতি করে দিও তোমার মনের রাজ্যের। ওই মুকুটটা আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে বলো, এ শুধু তোমার রাজ্য। খেয়াল রেখো বিদেশি শত্রুর আঘাতে যেন কখনো ক্ষতবিক্ষত না হয়।
জিততে চাই তোমার প্রতিটা রক্তবিন্দুর অধিকার।
উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। একটা কথায় উত্তর দিও, আমি বিজয়ী হলাম, নাকি পরাজিত !
ইতি—
অংশু (ট্যাক্সি ড্রাইভার নয়)
অংশু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলেছিল, এত কাজের প্রেসারে, এত ব্যস্ত জীবনে আজও তোমার সেই চিঠির প্রতিটা শব্দ মনে আছে রাকা?
রাকা আলগোছে বলল, আছেই তো।
অংশু বলল, তিনদিন কেটে গেছে, কোনো উত্তর নেই আমার চিঠির। ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে আমার। সেকেন্ড সেমিস্টারের পরেও এত আতঙ্কে কাটেনি দিন। কারণ আমি জানতাম, আমি ভালো রেজাল্ট করব। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসায় নেহাতই আনপর আমি, বুঝতেই পারছিলাম না, চিঠি দেখে তুমি রেগে গেছো, নাকি ব্যাকডেটেড ভেবেছ! এই দোলাচলে কাটছিল ঘণ্টা, মিনিট সেকেন্ডের হিসেবগুলো।
সেদিনও মেঘ করেছিল বেশ। বিকেল চারটের সময় আকাশ কালো করে এল। বোঝাই যাচ্ছিল মুষলধারে নামবে। আমরা তখনও ক্লাসে। ডি.সি.বি ক্লাস নিচ্ছিলেন।
হঠাৎই সন্দীপ মানে তোমার হিরো, ওথেলো এসে কানে কানে বলল, রাকা সিংহ তোকে ডাকছে। সাবধানে যাস। মুখ চোখ দেখে মনে হল, বেশ রেগে আছে। দেখছিস তো আমার এতদিনের নাট্য সাধনার বারোটা বাজিয়ে, আমার প্রেস্টিজে জাস্ট গ্যামেক্সিন ঢেলে দিল। এখন শালা জুনিয়াররা পর্যন্ত বলছে, ওই যে আমাদের মেডিকেল কলেজের গর্ব, গিরিশবাবু নেহাতই বিনোদিনীর কাছে হেরে গেল। ভেবে দেখেছিস, এই নাটক শেষ হলে আমার প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকবে না।
আমার তখন বুকের ভিতরে মাদল বাজছে। হৃৎপিণ্ড দ্রুতগামী হয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। নিজেই নিজের নাড়ি দেখে বুঝলাম, পালস অত্যন্ত হাই। সেই অবস্থায় সন্দীপের প্রেস্টিজ নিয়ে ভাবার মতো কোন অবকাশ আমার ছিল না। বরং তুমি সকলের সামনে আমাকে ইনসাল্ট করবে কিনা সেটা নিয়েই ভাবিত ছিলাম। হয়তো দেখা গেল ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরোলাম, আর তুমি ঠাটিয়ে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বললে, চিঠিতে প্রোপোজ করার দুঃসাহস তোমায় কে দিয়েছে?
তাই ভয়ে ভয়েই সন্দীপকে জিজ্ঞেস করলাম, তোকে কি বলল?
সন্দীপ নিজের দুঃখের ঝাঁপি সামলে বলল, আমাকে কিছুই বলেনি, জাস্ট বলল, তোমার বন্ধু অংশুমানকে চেনো?
আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই বলল, তাহলে চট করে গিয়ে তাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো। তবে মুখটা বেশ গম্ভীর রয়েছে! তুই কি ওর সাথে কখনো কোনো খারাপ কিছু করেছিলিস? তাহলে কিন্তু তোকে জাস্ট ছাড়বে না।
আমি বাইরে বেরিয়েই দেখলাম, কৃষ্ণচূড়ার লালচে রং লেগেছে তোমার চুড়িদার ওড়নায়। কানেতে ওই রং থেকেই ধার করে একজোড়া কানের দুল ঝুলছে। আমি চোখটা বন্ধ করতে চাইছিলাম। লালচে রঙে তোমাকে আরো সুন্দর লাগছিল। অতটা সৌন্দর্যের সামনে নিজেকে ভীষন অসহায় লাগছিলো। তবুও ধীর গলায় বলেছিলাম, আমায় ডাকছিলে? ভিতরের কালবৈশাখীর আভাস তুমি যাতে না পাও সে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম আপ্রাণ। তুমি বললে, ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে হবে, আসবে?
আমি আর কোনো কথা না বলে তোমায় অনুসরণ করেছিলাম। গেট পেরোতেই বড় বড় ফোঁটা গায়ে পড়েছিল। আমি বলেছিলাম, বৃষ্টি নামবে খুব জোরে।
তুমি ব্যাগ থেকে পার্পেল কালারের ছাতাটা বের করে বলেছিলে, ধরো। আমি ছাতাটা ধরতেই তুমি ছাতার মধ্যে ঢুকে বলেছিলে, ভাগ্যিস আজ মেঘ করেছিল। তাই তোমার একটা ইচ্ছে আবার পূরণ করতে পারলাম। তোমার কথা শেষ হবার আগেই অঝোরে নেমেছিল আকাশ কাঁপিয়ে। আমরা ভিজছিলাম। তোমার ভিজে চুল ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমার গাল। তুমি শক্ত করে ধরেছিলে আমার হাতটা, তারপর বলেছিলে, কথা দাও, জীবনের সমস্ত মুহূর্তে আমাকে প্রশ্রয় দেবে?
আমি অস্ফুটে বলেছিলাম, তোমাকে খুশি দেখতে চাই আজীবন।
কিন্তু রাকা আমি কি আদৌ তোমায় খুশি করতে পেরেছি? আমরা দুজনেই ডাক্তারি পাশ করেছি, এস্টাবলিসড হয়েছি, কিন্তু তারপরেও বোধহয় আমি তোমার সবথেকে কাছের বন্ধু হতে পারিনি।
পারলে তুমি কি তিনবছর একসাথে থাকার পরেও আমাকে চিনতে পারতে না! সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত হিসেব করলে দেখা যাবে আমরা একসাথে কাটিয়ে দিলাম প্রায় দশ-এগারো বছর। ভাবতে গেলে একটা যুগ। একটা মানুষকে চেনার পক্ষে বোধহয় যথেষ্ট। তাই না!
আমার বাবা-মায়ের বয়েস হয়েছে রাকা, তারা আমাকে সংসারী দেখতে চায়। তাদের সকলের তোমাকে পছন্দ, কিন্তু তারা আগের দিনের মানুষ, তাই লিভ ইনে বিশ্বাসী নয়। তাও আমি তোমায় তিনটে বছর আরো সময় দিলাম, এরপরেও কি নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা যায় না আমায়!
সেই বৃষ্টি ভেজা দিন থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন কি আমার ভালোবাসায় খামতি পেয়েছ তুমি?
তোমার বোনের বিয়ে হয়ে গেল, তোমার মা পর্যন্ত সেদিন আমায় ফোন করে বলল, এবারে অন্তত বিয়েটা করে নাও। এটা ফরেন নয় রাকা। তোমাকে মানতে হবে, আমরা বাঙালি কালচারে অভ্যস্ত। একটা সম্পর্কের পরিণতি বলতে আমরা বিয়েটাকেই বুঝি। প্লিজ, রাকা এবারে অন্তত একটু সিরিয়াসলি ভাবো।
এভাবেই গত তিনবছরে বারবার বলে এসেছিল অংশুমান। রাকা প্রতিবারই কাজের প্রেশারের দোহাই দিয়ে বিয়েটাকে পিছিয়েছে। আসলে রাকার ভয় করে, অংশুকে হারিয়ে ফেলার ভয়।
কাছের বন্ধুদের মুখে শুনেছিল, বিয়ের আগে নাকি লাভাররা অন্যরকম থাকে, যেমনি আইনি বন্ধনে বাঁধা হয়ে যায়, ওমনি তারা পাল্টে যায়।
রাকা ভীষণভাবে বেঁধে রাখতে চায় অংশুকে, কিন্তু কোনো প্রকট সুতোর বন্ধনে নয়, অদৃশ্য বন্ধনে। সম্পর্কটাকে অটুট রাখতেই চেয়েছিল রাকা। একা অংশুই যত্নবান ছিল সম্পর্কটাকে নিয়ে তা নয়। রাকাও যথেষ্ট সচেতন ছিল।
কিন্তু তারপরেও দূরত্ব তৈরি হল। দিনরাত রাকা শুনছিল, অংশুর এক যুক্তি। সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট জয়েন করো। বিয়ে না করলে আর একসাথে থাকা কি উচিত! এসব প্রশ্ন আপাতত ওদের দুজনের মাঝে দিনরাত প্রাচীরের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রাকা কোনোদিন ভাবেনি অংশু এভাবে বলতে পারে। অন্তত পুরোনো দিনের সমস্ত স্মৃতিকে একত্রিত করেও রাকা অংশুর এমন রূপ কখনো দেখেনি যেটা গত পাঁচদিন আগে দেখেছে।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই রাকা দেখেছিল, অংশু ফোনে কাউকে বলছে, এভাবে আর চলে না। একতরফা অ্যাডজাস্টমেন্ট করেই চলছি। বাবা-মা, পরিবারের কাছ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু পড়েছিলাম, ভালোবাসার অঙ্গীকার করেছিলাম বলে। কিন্তু তার মানে তো এই নয়, যে রাকা দিনরাত স্বেচ্ছাচারীর মতো জীবন কাটাবে!
হাসপাতাল, রুগি, ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরা, এর বাইরেও যে আমি আছি ওর জীবনে, সেটা বোধহয় ও ইদানীং ভুলে গেছে। এভাবে আমিও জাস্ট ক্লান্ত হয়ে গেছি।
আমিও মিউচ্যুয়াল ব্রেকআপ চাই। বিয়ে যেহেতু হয়নি, তাই ডিভোর্সের ঝামেলা নেই।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল রাকা। তার চিরপরিচিত মানুষটার অপরিচিত রূপটা দেখে।
অংশু ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল।তারপর সামলে নিয়ে বলেছিল, রাজ ফোন করেছিল। জানতে চাইছিল, আমরা ফিউচার নিয়ে কি ভাবছি। রাজ অংশুর পিসতুতো ভাই। রাকার সাথেও পরিচয় আছে ওর। কিন্তু রাকা ভাবতেই পারছিল না, ওর অ্যাবসেন্সে অংশু ওর নামে এভাবে বলতে পারে একজন থার্ড পার্সনের কাছে। আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করেনি রাকা।
নিজের লাগেজ গুছিয়ে চলে এসেছিল নিজের বাড়িতে। যদিও বাবা,মা যে খুব বেশি খুশি হয়নি সেটা মায়ের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল। সেদিনই মনে মনে ভেবেছিল রাকা, একটা ফ্ল্যাট নিতে হবে, কদিনের মধ্যেই। কিন্তু একটা দিন অংশুকে ছাড়া কাটিয়েই বেশ বুঝতে পেরেছিল, মিস করা শব্দের সঠিক বাংলা খুঁজে না পেলেও,অনুভূতিটা অনেকটা পেয়ে হারিয়ে ফেলার মতো। রাকারও নিজের বাড়ি ফিরে এসে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। এত বছরের অভ্যেস, একদিনে পাল্টে যাবে এটা অবশ্য ভাবাও ভুল। মাঝরাত পর্যন্ত অংশুর হোয়াটস অ্যাপের অনলাইনের টাইম চেক করে গেছে ও। অসহ্য কষ্টে সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।
ম্যাডাম, তাহলে সন্ধের দিকে এই ওষুধটাই খাবো, তাই তো!
অন্যমনস্ক রাকা ফিরে গিয়েছিল, ওদের স্বপ্ন দেখা রঙিন সন্ধেগুলোতে। যখন অংশু বলত, তুমিই আমার শক্তি। যতই ঝগড়া হোক, আমায় ছেড়ে যেও না রাকা। তুমি ছাড়া আমি বড্ড অসহায়। সেই অংশুই আজ পাঁচদিন হয়ে গেল একা আছে। রাকাকে ছাড়াই আছে। একটা ফোনও করেনি রাকাকে, নিদেন একটা মেসেজও। যাকগে, রাকাও পারবে, ওকে ছাড়াই বাঁচতে। অভিমানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল রাকার। সেই অবস্থাতেই প্রেসক্রিপশনের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ একমাস এটাই চলবে।
নেক্সট বলার আগেই ইমার্জেন্সিতে ঢুকল দুজন বয়স্ক মানুষ। ওরা যে স্বামী-স্ত্রী সেটা ওদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বয়েস আন্দাজ সত্তর-বাহাত্তর তো বটেই।
রাকার উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই, ভদ্রমহিলা বললেন, আগে নিজের দোষগুলো স্বীকার করো। বিয়ের দিন রাতে পাশে শুয়ে শুয়ে অসভ্যের মতো নাক ডেকেছিলে। জিজ্ঞেস করেছিলাম তো বলেছিলে, ঠান্ডা লেগেছে তো, তাই একটু নাক ডাকছে। লজ্জা করে না, মিথ্যে বলতে। সারাজীবন নাক ডেকে গেলে, সে ঠান্ডা লাগা তো এ জীবনে আর কমলো না।
ভদ্রলোক নিজের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললেন, এই বুড়ো বয়েসে তুমি যে নাতনির থেকে কয়েতবেলের আচার লুকিয়ে খেয়ে, মাঝরাতে কাপড়ে চোপড়ে করেছ, সেটা আগে ডাক্তারম্যামকে বলো।
এই নিয়ে কাল রাত থেকে কতবার বাথরুমে গেছ তার হিসেবটা ঠিক করে বললে, ওনার সুবিধে হয়, ওষুধ দিতে।
ভদ্রমহিলা বেশ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, আমি তো তাও বাড়িতে করেছি গো। বেনারস যাবার সময় তুমি তো স্টেশনে করেছিলে। ট্রেনের ওই বেগুনি রঙের ডিমটাও তো খেতে ছাড়ো নি। ছি ছি কি লজ্জা। আমি ভাবছি আমি যেখানেই যাচ্ছি অমন পচা গন্ধ কেন আমার পিছন পিছন যাচ্ছে। তারপর ওনার মুখ দেখে বুঝলাম, আসল কর্ম উনি করেছেন।
ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন, একটা ডিম খেলে আমার কিছুই হত না। কিন্ত তোমার ভালোবাসার চোটে তুমি নিজের ডিমটাও আমার পাতেই চালান করেছিলে, তাই অমন হয়েছিল। আমি তো আজও বুঝে পাইনা, তুমি আমায় ভালোবাসো, না আমার ক্ষতি চাও। কি কুক্ষণে যে অল্পবয়সে তোমায় বিয়ে করেছিলাম, কে জানে!
ভদ্রমহিলা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, কার যে গোটা জীবনটা বরবাদ হলো, সেটা তো হিসেব সাপেক্ষ।
রাকা অবাক হয়ে দেখছিল ওদের দুজনকে। আর মনে মনে ভাবছিল, একেবারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। অংশুর কাছ থেকে চলে আসার সিদ্ধান্তটা একেবারে সঠিক। নাহলে হয়তো বুড়ো বয়েসে জনসমক্ষে এভাবে ঝগড়া করতে হত। এরা তো একে অপরকে দোষারোপ করতে করতেই কাটিয়ে দিচ্ছে বাকি জীবনটা। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেই একটু বিরক্ত গলায় রাকা বলল, পেশেন্ট কে?
ভদ্রলোক বললেন, আবার কে? এই যে আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার বেটার হাফ। ইনি এই বুড়ো বয়েসে আচার খেয়েছেন, এনার লুজমোশন হচ্ছে। বাড়িতে ইলেক্ট্রল খাইয়েছি, কিন্তু বয়েস হচ্ছেটা ইনি ভুলে গেলেও আমি ভুলি কি করে। তাই একবার হসপিটালে দেখিয়ে নিয়ে যাই।
রাকা জিজ্ঞেস করল, পেশেন্টের নাম?
ভদ্রলোক একমুখ হেসে বললেন, মুনিয়া। ওর নাম মুনিয়া পাখি। ভদ্রমহিলার কোঁচ পড়া গালে হঠাৎ করে কেউ যেন একমুঠো আবির ছড়িয়ে দিল। ভদ্রমহিলা সামলে নিয়ে বললেন, কি হচ্ছে কি! আমার নাম মনীষা দস্তিদার।
রাকা মুনিয়া লিখতে যাচ্ছিল। তাই ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, মনীষা ? তাহলে উনি যে বললেন, মুনিয়া?
ভদ্রমহিলা বললেন, ওটা ওনার আদরের নাম। বাসর ঘরে কাঁদছিলাম দেখে উনি বলেছিলেন, আমার গলার স্বরটা নাকি মুনিয়া পাখির মতো, তাই আমায় মুনিয়া বলে ডাকবেন।
রাকা অবাক হয়ে দেখছিল বয়স্ক দম্পতিকে। এই দুমিনিট আগে আফসোস করছিলেন, দুজনে দুজনকে বিয়ে করে ভুল করেছেন বলে জনসমক্ষে আক্ষেপ করছিলেন, আবার এখুনি আদরের নাম নিয়ে লজ্জা পাচ্ছেন।
ভদ্রমহিলা বললেন, এমন কিছু হয়নি। বার ছয়েক বাথরুম যেতে হয়েছে, লুজমোশন। ওষুধ খেয়েছিলাম। কিন্তু ইনি আমার শরীর নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করেন, যে তিষ্ঠতে দেন না। যত বুড়ো হচ্ছে তত বাতিকগ্রস্ত বুড়ো হচ্ছে একটা।
ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ আমি বুড়ো হচ্ছি, আর উনি কচি হচ্ছেন।
রাকার মনে পড়ে গেল ওর যখন ফুড পয়জেন হয়েছিল, তখন অংশু পাগলের মতো করছিল। দীর্ঘদিন বাড়িতে কোনো স্পাইসি খাবার রান্না পর্যন্ত করতে দেয়নি কাজল মাসিকে। নিজেও রাকার মতো রুগির ঝোল খেয়েছিল একমাস প্রায়। রাকা বলতো, অংশু তুমি কেন খাচ্ছ না? অংশু হালকা হেসে বলত, এক যাত্রায় পৃথক ফল কখনো করা যায়! আমি ভালোমন্দ খাব আর তুমি সেদ্ধ ঝোল, তাই কখনো হয়!
অংশুও রাকার শরীর খারাপ হলে পাগলামি করত। সম্পূর্ণ ভুলে যেত, রাকা একজন এম ডি ডক্টর। অংশু নিজেও একজন এম বি বি এস। কথায় কথায় বলত, চলো তোমায় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই।
রাকাকে অন্যমনস্ক দেখেই ভদ্রলোক বললেন, ম্যাডাম, চিন্তার কিছু নেই তো? কোনো টেস্ট যদি করতে হয় প্লিজ করান।
রাকা নিজেকে সংযত করে বলল, না এখুনি টেস্টের দরকার নেই, আমি ওষুধ লিখে দিলাম। না কমলে তখন দেখব।
ভদ্রমহিলা বললেন, আর ওর প্রবলেমটা নিয়েও কিছু বলুন! শুনছ, যা যা হয়, সব বলো না ম্যাডামকে। আমার তো তেমন কিছু হয়নি, তোমারগুলো বলো।
ভদ্রলোক বললেন, আরে ধুর, আমি একদম ফিট। ভোগো তো তুমি। তোমারগুলোই বলো ওনাকে। বাইরে আরো পেশেন্ট আছে, আজ চলো মুনিয়া।
ভদ্রমহিলা বললেন, বেশ আমি তাহলে বাইরে অপেক্ষা করছি, অন্য পেশেন্টদের হয়ে গেলেই আবার তোমায় নিয়ে আসব।
রাকা একটু অসন্তুষ্ট হয়েই জিজ্ঞেস করল, আপনার কি প্রবেলম? দুজনকে কিন্তু একটা টিকিটে দেখার নিয়ম নেই। ভদ্রমহিলা বললেন, ঠিক আছে আমরা টিকিট করিয়ে আনছি। আরে ওনার প্রোস্টেটের প্রবলেম। কষ্ট পাবে, কিন্তু কিছুতেই দেখাবে না। বুড়ো হয়ে মরতে চলল, এখনো ইনজেকশনে আর ভূতে ভয় গেল না। মাঝরাতে বাথরুম পেলেও ভূতের ভয়ে আমায় ডাকে। এখন যদি আপনি ইনজেকশন দেন তাই কিছুতেই দেখাতে চাইছে না। মনীষাদেবী গলায় ঝাঁঝ এনে বললেন, যতদিন বাঁচবে আমায় জ্বালাবে।
ভদ্রলোক ইশারায় চুপ করতে বললেন মনীষাদেবীকে। তারপর প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বেরোতে বেরোতেই বললেন, চলো, আজ বেড়িয়েছি যখন, তোমার প্রোস্টেটের সমস্যাটা ডক্টরম্যাডামকে বলেই যাবো।
বয়স্ক কাপেল বেরিয়ে যেতেই একজন মা ঢুকল বাচ্চাকে নিয়ে। ঢুকেই বলল, আর বলবেন না ম্যাডাম। তিনদিন ধরে ঠান্ডা লাগিয়ে বসে আছে। রাতে ঘুমাতে পাচ্ছে না পর্যন্ত। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রাকার মনে হল, এমনই একটা সন্তান চেয়েছিল অংশু, ওর কাছ থেকে।
বাচ্চাটা মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়েছে। মায়ের মুখটা তখনও দুশ্চিন্তা মাখা। সন্তানের চিন্তায় ভ্রুতে ভাঁজ রয়েছে। বাচ্চাটাকে দেখিয়ে মা বলল, আরে এখন যত লজ্জা। ডক্টর ম্যামের কাছে এসে আর মুখই বের করতে চাইছে না। মায়ের মুখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি রয়েছে। কম দামি শাড়িতে সেই দীপ্তি একটুও ঢেকে যায়নি। সেদিকে অপলক তাকিয়ে ছিল রাকা। ভালোবাসা শব্দটা সর্বত্র আপেক্ষিক নয়।
পেশেন্ট দেখা শেষ করে বাইরে বেরোতেই সেই বয়স্ক কাপেলের মুখোমুখি হল রাকা। ভদ্রমহিলা অল্প হেসে বললেন, আরেকদিন আসব। আজ আর হল না। প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। সন্ধেবেলায় সিরিয়াল দেখতে দেখতে চা না খেলে বুড়োর মনে বড় দুঃখ জন্মায়।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বললেন, সিরিয়ালের নেশাটা আমায় কে ধরিয়েছে সেটাও বলো কিন্তু।
রাকা নিজের ব্যক্তিত্ব ভেঙে বলে ফেলল, এভাবে ঝগড়া করে, দোষারোপ করে একসাথে থাকতে ভালো লাগে!
ভদ্রমহিলা একবার রাকার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন, দিয়ে বললেন, ঝগড়া, অভিমান না থাকলে ভালোবাসাটা তো আলুনি লাগে গো ম্যাডাম। আমরা জানি, আমরা যত ঝগড়াই করি, কেউ কোনোদিন কাউকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তাই ঝগড়াটাও আমাদের এক ছাদের নিচেই করতে হবে।
রাকা হাসি মুখে বলল, সাবধানে থাকবেন।
দু পা এগোতেই ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল।
একটা মেসেজ ঢুকল…
আরেকবার ভাবলে হয় না? বড্ড একা হয়ে গেছি আমি। আসলে কি বলত রাকা, তুমি ছাড়া আমার নিজস্ব অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, হিসেবের ঘরে একটা বড় শূন্য পড়ে আছে। বুঝলাম, আমার সবটা তোমায় দিয়ে দিয়েছি সেই কবেই। তাই তুমি চলে যেতে আমি ভীষণ একা হয়ে গেছি। আমার সব ভুল ক্ষমা করে আরেকবার যদি আমায় কাছে ডেকে নিতে….
রাকা হাঁটতে হাঁটতেই টাইপ করল, বর বেশে আমার বাড়িতে না এলে আর যাবো না তোমার ফ্ল্যাটে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, সূর্য ডোবার আগেই ধ্রুবতারা উঁকি মারছে আকাশে। রাকা মনে মনে ভাবল, ধ্রুবতারা ঠিক জায়গাতেই আছে, তাকে চিনতে না পারাটা নাবিকের ব্যর্থতা। ঠিক যেমন অংশুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসাটা এতদিন পেয়েও উপলব্ধি করতে পারেনি রাকা ঠিক তেমনই। রাকা ফিসফিস করে বলল, আবার বৃষ্টিতে ভিজতে চাই তোমার সাথে। অনেকটা পথ একসাথে চলতে চাই। আমার মনের রাজ্যের তুমিই একছত্র অধিপতি অংশু। জয়ের মুকুটটা আজ থেকে তোমার মাথায় বিরাজ করুক। মুকুটের মাঝখানে জ্বলজ্বল করুক, ভালোবাসা নামক অমূল্য অনুভূতিটা।
সমাপ্ত