অন্তরালে
পায়ে পায়ে গোলাপী শাড়িটা জড়িয়ে যাচ্ছে বিহুর। সামনে ঘন অন্ধকার। শুধু গাছের সারি। সূর্য বোধহয় এখানে কখনো প্রবেশ করেনি। তাই গাছের পাতাগুলো কেমন কালচে হয়ে গেছে। পাখিগুলোও মনমরা হয়ে ডাকতে ভুলে গেছে। কি ভয়ঙ্কর অন্ধকার। বিহু দৌড়াচ্ছে। প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। এত দৌড়াতে তো ও কখনো পারত না। রাস্তায় বেরিয়ে একটু হেঁটেই তো সোহমকে বলত, ট্যাক্সি ডাকো। আজ এত দৌড়াচ্ছে কি করে!
ক্লাস ফাইভে একবার বিহু একশো মিটারের রানে নাম দিয়েছিল। ওর পাশ দিয়ে সুজাতা, অনুরাধারা সবাই হাওয়ার মতো দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। বিহু খুব চেষ্টা করেছিল। সামনের টেবিলে সাজানো লাল রঙের টিফিনবক্সটা ছিল ফার্স্ট প্রাইজ। লাল টুকটুকে বক্সটা খুব পছন্দ হয়েছিল বিহুর। তাই ওটা পাবার লোভেই হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু তবুও বন্ধুরা সবাই ওকে পিছনে ফেলে রেখে হাওয়ার গতিতে পৌঁছে গিয়েছিল লক্ষ্যস্থলে। ও সবুজ মাঠে চক খড়ির সাদা দাগের ভিতরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল।
সে এত কি করে দৌড়াচ্ছে আজ! পায়ে শাড়ি জড়িয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে শাঁখ বাজছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বিহুর, তবুও ও অক্লান্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে। পালাতেই হবে ওকে। যতই ছুটছে ততই পিছনে পায়ের আওয়াজগুলো এগিয়ে আসছে ওর দিকে। দুটো হাত দিয়ে নিজের কান দুটো চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল….আমি মা হতে চাই। আমি চাই…
এসি ঘরে শুয়েও দরদর করে ঘামছে বিহু।
ওর চিৎকারে চমকে উঠে পড়েছে সোহম। ঘুম চোখেই
ওকে ধরে ঝাঁকিয়ে সোহম বলল, কি হয়েছে? এত ঘামছো কেন? হাঁপাচ্ছ কেন?
ডিভানের পাশের ছোট্ট টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে সোহম বলল, আগে জল খাও।
বিহু তখনও থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, একটা অন্ধকার জঙ্গল। অনেক হিংস্র পশু, কোথাও শাঁখ বাজছিলো, উলু দিচ্ছিল। আমি পালাচ্ছিলাম। দৌড়াচ্ছিলাম, কিন্তু আমার শাড়িটা পায়ে জড়িয়ে আমি পড়ে গেলাম। মাটিতে আছড়ে পড়লাম। আর ওই মানুষগুলো আমায় ঘিরে ফেলল। সোহম দু-হাত দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল বিহুকে। বিহু সোহমের লোমশ বুকের মধ্যে মাথা রেখেই গুমরে কেঁদে উঠল।
সোহম আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আজ সারাদিন নন্দিতার সাধের অনুষ্ঠানে নানারকম কাজ করেছ আর ওইসব ভুলভাল ভেবেছো, তাই না বিহু? আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, চলো এই সময়টা দুদিনের জন্য আমরা বেরিয়ে আসি। তুমি তো শুনলে না। তোমার একমাত্র ননদের সাধের অনুষ্ঠানে তুমি না থাকলে নাকি খুব নিন্দে হবে বলে রয়ে গেলে। আমি জানতাম, তোমাকে সবাই উল্টোপাল্টা কথা বলবে আর তুমি আবার ডিপ্রেশনে চলে যাবে। মাঝে মাঝে আমার অদ্ভুত লাগে তোমাকে। তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো, নাকি বাড়ির লোকেদের?
কতবার বললাম, আমরা একটা ফ্ল্যাট রেন্টে নিয়ে নিজেদের মতো থাকি। তুমি কিছুতেই নিজের স্বাধীন সংসার চাও না। তুমি সেই এ বাড়ির ছোটবৌমা হয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করো। বাড়িতে এত লোকজন এসেছে আজ। কার মুখে চাপা দেব বলত?
সারাদিনের ভাবনার ফলে এখন এই সব স্বপ্ন। বিহুর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে সোহম বলল, আমরা যদি বাবা-মা না হতেই পারি, তাহলে একটা বেবি অ্যাডপ্ট করব। সে তোমাকে মা বলে ডাকবে। শিশুর আবার জাত কি বিহু?
সোহমকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বিহু বলল, না, কিছুতেই না। সে আমার গর্ভে থাকবে। একটু একটু করে বড় হবে সে। আমি তাকে অনুভব করব নিজের শরীরে।
আমার আর তোমার রক্তে সে বড় হবে। তোমার মতো নাক হবে, আমার মতো চোখ। আর ঠোঁটটা হবে তোমার মায়ের মতো। এ পরিবারের সন্তান হবে সে। রোজ রোজ একই কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত সোহম। তুমি প্লিজ দত্তক নেওয়ার কথা বলবে না। আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন বছর। লোকের দশ বছর পরেও বাচ্চা হয়। আমি শুনেছি। আমরা ডক্টরের কাছে যাব। ট্রিটমেন্ট করানোর দরকার হলে করাবো। কিন্তু তুমি কথা দাও, এত তাড়াতাড়ি তুমি হাল ছেড়ে দেবে না?
সোহম বিহুর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বললো, বেশ শান্ত হও তুমি। এখন ঘুমিয়ে পরো। বন্ধু অভিজিত তো গাইনোকোলজিস্ট। আমরা ওর কাছে যাব। এখন ঘুমাও প্লিজ।
বিহু শান্ত মেয়ের মতো বালিশে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আমি মা হব। আমি মা হব।
বিহুকে শান্ত করে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল সোহম। ও জানে বিহু কাল সকালে উঠেই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবার জন্য বায়না ধরবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, দুটো কাঁটাই একসঙ্গে তিনটের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনো রাত অনেকটা বাকি। এখন না ঘুমালে সকালে উঠে অফিস যাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। তার ওপরে এখন ব্যাংকে ইয়ার এন্ডিং চলছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসাবে কাজের দায়িত্বও নেহাত কম নয়।
কিন্তু চেষ্টা করলেও আর ঘুম আসবে না সোহমের।
অনেক এলোমেলো ভাবনা এসে ভিড় করছে মাথার মধ্যে।
বিহু আগে এমন ছিল না। হাসিখুশি, ভীষণ প্রাণচঞ্চল ছিল। বিয়ের আগেও বছর দুই ওরা চুটিয়ে প্রেম করেছে। বিহুর সাথে সোহমের আলাপ হয়েছিল মেট্রোতে। সোহম তখন সদ্য ব্যাংকে জয়েন করেছে। নতুন চাকরি, সারাদিনের খাটুনির পরে মেট্রোতে একটা বসার জায়গা পেয়ে সোহমের চোখদুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎই কানের কাছে একটা চিৎকার শুনে চমকে উঠেছিল। একটা মেয়ে জলপাই রঙের কুর্তি পরে, সোহমের দিকেই অঙ্গভঙ্গি করছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই তাকাল সোহম। মেয়েটা বেশ দাপটের সাথে একটা রোগা মতো ছেলের হাতের কব্জি ধরে বলছে, আমি দেখেছি। নিজে চোখে দেখেছি। মোটেই ওটা মাটিতে পড়ে যায়নি। আপনি ওনার পকেট থেকে তুলে নিলেন। ভদ্রলোকের পোশাক পরে চুরি করতে লজ্জা করে না।
সোহম বুঝল, একটা পকেটমারকে ধরেছে মেয়েটা। তাই এত উত্তেজিত। ইদানীং মেট্রোতে ফেরার সময় প্রায়ই লোকজন চিৎকার করে, পকেটমার।
রোজই সোহম নিজের প্যান্টের পকেটেটা একবার ভালো করে দেখে নেয়, ওরটা আছে তো!
আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছিল। তাই চোর ধরা বীরাঙ্গনা মেয়েটাকে বেশি পাত্তা না দিয়েই আবার চোখ বুজেছিল ও। মিনিট দুই পরেই কানের কাছের হাউমাউ আওয়াজটা থেমে গিয়েছিল। নিশ্চিন্তে আরো মিনিট দশেক পাওয়ার ন্যাপ নেবার আশা করেছিল সোহম।
সেই সময়েই একটা ভারিক্কি হাতের ছোঁয়ায় আবার বাধ্য হয়ে তাকাতে হল ওকে। একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, আপনি তো মশাই লাকি ম্যান। আমার ওয়াইফ তো গত পনেরো বছর ধরে আমার ওয়ালেট কেটে কেটে একটা গয়নার শোরুম বানিয়ে ফেলল। আর আপনার ওয়াইফ তো দেখছি পকেটমারের সাথে লড়াই করে আপনার মানিব্যাগ উদ্ধার করেছেন। সত্যি মশাই, এমন ভাগ্য বলেই, ভিড় মেট্রোতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন।
সোহম অবাক হয়ে ভাবছিল ভদ্রলোক কি পাগল নাকি!
ওর বয়েস মাত্র সাড়ে সাতাশ। সদ্য একমাস হলো ব্যাংকের জবটা পেয়েছে। এর মধ্যে আবার বিয়েই বা কবে করল, যে ওয়াইফ জুটে গেল। সত্যি বলতে কি ও সেভাবে প্রেমও করেনি। একবারই বড়দার বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে দাদার এক দূর সম্পর্কের শ্যালিকাকে পছন্দ হয়েছিল সোহমের। বার দুই আড়চোখে তাকাতেই একটা ষণ্ডা মতো বাইসেপ ট্রাইসেপওয়ালা ছেলে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এই যে, ওদিকে নজর দিও না, জামাইয়ের ভাই। ওটা আমার বুক করা। তাই শোকেস, গোডাউন কোনোদিকেই তাকিয়ে লাভ নেই গুরু। পাঞ্জাবি পরে এসেছো, গেঞ্জি পরে ফেরত গেলে ভালো লাগবে?
বিয়ে বাড়িতে নিজের গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার পরা ছবিটা কল্পনা করেই মেয়েটার দিকে আর ভুলেও তাকায়নি সোহম। তবুও ওর তৃতীয় নয়ন দেখেছিল, মেয়েটা মুচকি হেসে ওকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছিল। তাই প্রেমে ওর বড় ভীতি। বলা তো যায়না, ওইদিন মেয়েটাকে ভুল করে প্রোপোজ করে ফেললে ও হয়তো ওই বডি বিল্ডারের হাতে মার খেয়ে সারাজীবন বাড়িতে বসে থাকত। এখনকার মেয়েগুলো যে ঠিক কটা বডিগার্ড পুষে রাখে সেটা বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না। সোহম তো নিতান্ত অপটু অবলা পুরুষ। তাই ওইদিন থেকেই কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে হলে, ও চারপাশটা একবার আগে দেখে নেয়, প্রেম তো দূরের গল্প।
লোকে শুনলে হাসবে যে সোহমের মতো দেখতে শুনতে মন্দ নয়, চাকুরি করা ছেলে এখনো মার্কেটে সিঙ্গেল ঘুরে বেড়াচ্ছে! প্রেমই করতে পারল না, তারপরে আবার বিবাহিত স্ত্রী। বাড়ির ছোট ছেলে বলেই হয়তো বাড়ির লোকও ওর বিয়ের কথা তেমন বলে না। সোহম বোধহয় বাড়ির সকলের চোখে এখনো হাফপ্যান্ট পরা, হাতে লালিপপ ধরা বাচ্চা। আর যেহেতু ওর দুই দাদার আর এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, তাই বাড়িতে বৌমার অভাবও মা কখনো ফিল করে না। বড়বৌদি হাউজওয়াইফ, কিন্তু মেজবৌদি বেশিরভাগ দিন বাপের বাড়িতেই থাকে। ওখান থেকেই তার অফিস কাছে। তাই ছুটি ছাটাতে শ্বশুরবাড়ি আসে। যদিও সোহম হিসেব করে দেখেছে, এ বাড়ি থেকে মেজবৌদির অফিস যেতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিট। আর ও বাড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্যই মেজবৌদি দিনের পর দিন নাকি নেহাত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাপের বাড়িতে থাকে। সোহম এসব বুঝলেও বাড়িতে কিছুই বলতে পারে না। ছোট ছেলের মুখে নাকি বেশি কথা মানায় না।
ইদানীং বাঙালি ছেলেদের বিয়ের বয়েস চব্বিশ থেকে বেড়ে ত্রিশ বত্রিশ হয়েছে। তাই সাড়ে সাতাশ বছরকে ঠিক বিবাহযোগ্য মনে করে না কেউ।
সোহম তাই আগ্রহ নিয়েই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ওয়াইফ? কোথায় দাদা? আমাকেও একটু চেনান প্লিজ।
ভদ্রলোক একমুখ হেসে বললেন, সে আমি ভালোই বুঝেছি, সদ্য বিয়ে হয়েছে তাই তো?
কিন্তু এই আমি আজ বলে গেলাম, আপনার স্ত্রী ভাগ্যটি যথেষ্ট ভালো।
সোহমের পাশে দাঁড়িয়ে শ্যাওলা কুর্তি বিরক্ত স্বরে বলল, এই যে স্যার, আমি ওনার ওয়াইফ নই। আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
ভদ্রলোক একটু নাছোড় গোছের। তবুও গোঁফের ফাঁকে হাসিটাকে লুকিয়ে, রগর করে বললেন, বুঝেছি, মান-অভিমান। না না, হওয়াটা তো ভুল কিছু নয় মশাই। উনি এতক্ষণ ধরে পকেটমারটার সাথে লড়াই করলেন, আর আপনি কোথায় পাশে দাঁড়াবেন, তা নয় ঘুমাচ্ছিলেন!
না গো মেয়ে, তুমি রাগ করে ঠিক করেছো। এরকম কেয়ারলেস মানুষকে নিয়ে কি সংসার করা যায়?
এতক্ষণে সোহমের একটু সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। লোকটা হঠাৎ পকেটমার আর মেয়েটার সাথে সোহমকে কেন জড়াচ্ছেন! নিজের পকেটে হাত দিয়েই ব্যাপারটা বুঝল। অসহায় চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা গেটের দিকে এগোচ্ছে নামবে বলে।
সোহম নিজের গন্তব্যের দুটো স্টপেজ আগেই লাফিয়ে উঠে পড়লো। মেয়েটার সাথে ও নেমে পড়ল ওয়ালেট ফেরত পাবার আশায়। স্টেশনে নেমেই মেয়েটাকে আমতা আমতা করে বলল, ম্যাডাম আমার ওয়ালেটটা কি আপনি পেয়েছেন? মেয়েটা ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বলল, আপনার ঘুম ভাঙল? এতক্ষণে আপনার খেয়াল হল যে আপনার পিকপকেট হয়েছে? যখন চিৎকার করে বললাম, যে আপনার পার্স চুরি করে পালাচ্ছে, তখন তো আপনি চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখেছিলেন।
সোহম অসহায় গলায় বলল, ওই পার্সে আমার এটিএম কার্ড থেকে শুরু করে বাইকের চাবি অবধি আছে। টাকার থেকেও ওগুলো বেশি ইম্পরট্যান্ট। ওই জন্য আমার পার্সটা একটু মোটাসোটা থাকে।
মেয়েটা বলল, সে আমি কি করব! আপনার ভাবগতি দেখে আমি ভাবলাম আপনার অনেক আছে তাই হয়তো এটা পকেটমারের জন্যই দান করে দিলেন। তাই আমি ওকে হাতেনাতে ধরতেও আপনার হুঁশ ফিরল না। শেষে আমি আপনার ওয়ালেটটা ওই পকেটমারকেই ফেরত দিয়ে দিলাম। ও অনেক কষ্ট করে আপনার পকেট থেকে ওটা বের করেছিল। লোকের পরিশ্রমের ফসল আমি কেন নেব? তাই ওটা ওকেই দিয়ে দিলাম। মেয়েটার শেষ কথাটা শুনে মাথায় হাত দিয়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে পড়ল সোহম। গাড়ির ডুপলিকেট চাবি বানানো থেকে শুরু করে, এটিএম ব্লক করে আবার নতুন অ্যাপ্লিকেশন করতে হবে। সেটা নাহয় ও নিজে ব্যাংকে আছে সামলে নেবে। কিন্তু মায়ের প্রেসক্রিপশনটাও তো পার্সেই ছিল। আর প্রায় হাজার তিনেক টাকাও। ইস, কেন যে ক্লান্ত হয়ে চোখ দুটো বন্ধ করেছিল সোহম, আজকেই সুযোগমতো পিকপকেট হয়ে গেল। মেয়েটা যদিও বা ধরল…
নিজের ওপরেই বিরক্ত লাগছিল সোহমের। মেয়েটা কোথায় গেল আর দেখার দিকে মন ছিল না সোহমের।
বেঞ্চে বসেই ভাবছিল, আবার একটা মেট্রো ধরে নিজের স্টেশনে যেতে হবে। বাইকটা গ্যারেজে আছে, ওখানেই পড়ে থাকবে, অটো ধরে বাড়ি ফিরতে হবে।
ভাবনার মধ্যেই সোহমের সামনে একটা হাত এগিয়ে এলো। হাতে সোহমের ব্রাউন লেদারের মোটা পার্সটা। চমকে উঠে সোহম দেখল, শ্যাওলা কুর্তি পরে মেয়েটা ওর সামনে পার্সটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আর মুচকি মুচকি হেসে বলেছে, চোর ধরলাম, কমিশন দেবেন না?
সোহম আপ্লুত হয়ে বলল, কি বলে যে ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছি না। আমার নাম সোহম রায়। আপনি?
বিহু পুরোকায়েত।
সোহম একটু হেসে বলেছিল, আপনি বুঝি ভালো নাচতে পারেন?
মেয়েটা একটু লাজুক গলায় বলেছিল, ওই আরকি। একটু আধটু।
সোহম আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাল। উজ্জ্বল দুটো চোখ, টিকলো নাক, গায়ের রং শ্যামলা, দুই ভ্রুর মাঝে ছোট্ট একটা কালো টিপ। সাজ বলতে ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক, এতেই মেয়েটাকে ভীষন মিষ্টি লাগছে। সেক্সি, হট এসব শব্দ মনে আসে না এই মেয়ের চেহারা দেখে। একটাই বিশেষণ মাথায় আসবে, ঝকঝকে স্মার্ট অথচ ভীষণ মায়াবী।
সোহম বলল, আপনি পার্সটা আমায় না দিয়ে নেমে পড়লেন যে!
বিহু মুচকি হেসে বলল, দেখছিলাম, কতক্ষণে আপনার টনক নড়ে। পার্সে আপনার অ্যাড্রেসটা ছিল। ভেবেছিলাম কাল ফোন করে ফেরত দেব। কিন্তু ওই ভদ্রলোক সব ঘেঁটে দিল।
সোহম হেসে বললো, ওই ভদ্রলোকের সাথে আপনার কি নিয়ে তর্ক হচ্ছিল?
বিহু রেগে রেগে বলল, আরে উনি বলছিলেন, আমি আপনার…
থমকে গেল বিহু। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, যাকগে, আপনি আপনার পার্স পেয়ে গেছেন। এবার আসুন।
সোহম নিজের ফোন নম্বর লেখা কার্ডটা বের করে বিহুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, যেকোনো প্রবলেমে কল করবেন, আমিও যদি আপনার কোনো উপকারে লাগতে পারি….
বিহু বলল,আপনার ট্রেন এসে গেছে।
সোহম ট্রেনের দিকে এগোতে এগোতেই বলল, আপনার ফোন নম্বরটা?
৭৪৩৪৫৬৮০১ লেখার পরেই ট্রেনে পা দিলো সোহম। শেষ ডিজিটটা আর শোনা হল না।
বাড়ি ফিরেও বিহুর মুখটা বারবার মনে পড়ছিল সোহমের। ইস, ফোনের লাস্ট ডিজিটটা শোনা হল না তো। নিজের ফোনটা বের করে ওই নম্বরের শেষে ০ লিখে ডায়াল করতেই এক ফার্নিচার মিস্ত্রি ফোনটা ধরে বলল, আপনার ড্রেসিংটেবিল কাল আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে বৌদি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। বৌদি ঘুম থেকে উঠে ওটাতেই মুখ দেখবে স্যার।
ভয়ে ভয়ে সোহম ফোনটা কেটে দিল। ধুর, এভাবে হয় নাকি! একমাত্র বিহু যদি কল করে তবেই আবার কথা হওয়া সম্ভব, না হলে রাস্তার পরিচয় রাস্তাতেই শেষ হয়ে গেল। তবে আজ বিহু না থাকলে সোহমের বাইকে করে বাড়ি ফেরা আর হত না। বাড়ির সকলের কাছে নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেত। মায়ের প্রেসার, সুগারের ওষুধও আজ কেনা হত না।
সোহম পাশ ফিরে বিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে আমার জীবনে। তাই তো ভালোবাসা শব্দের অর্থ বুঝলাম। তুমিই আমায় ভালোবাসতে শিখিয়েছ বিহু। আমার বাচ্চা হোক আর নাইহোক, তোমায় আমি কিছুতেই হারাতে পারব না।
বিহু ঘুমিয়ে গেছে। সোহমের বোনের সাধের অনুষ্ঠান ছিল আজ বাড়িতে। সারাদিন পরিশ্রম করেছে মেয়েটা, তারপরে নিশ্চয়ই অতি আপন পাবলিকরা বলতে শুরু করেছে, নন্দিতার দ্বিতীয় সন্তান হয়ে গেল, আর তোমার কোলে একটা এল না! বিহু সোজাসাপ্টা মেয়ে। ওইসব কথা ওর মনে কি ধরনের এফেক্ট ফেলেছে, আর কেউ না বুঝুক সোহম ভালোই বোঝে।
বিহুর প্রতিটা অনুভূতির মানে বোঝে সোহম, ওর শিরা উপশিরাগুলোও পরিচিত সোহমের। ওই জন্যই কিছুতেই ঘুম আসছে না ওর। বাচ্চা বাচ্চা করে ক্ষেপে উঠেছে বিহু আজ একবছর ধরেই। বার বার প্রেগনেন্সি কিট দিয়ে টেস্ট করে যখন রেজাল্ট নেগেটিভ পেয়েছে ও, তখনই গুমরে বসে থেকেছে। ওই সময় ভালো করে খাওয়াদাওয়া অবধি করে না। সোহম মুভি কি শপিংয়ের কথা বললেই, ক্ষেপে গিয়ে বলে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আমি মা হতে চাই।
বিহুর এই পাগলামি দেখেই সোহম গিয়েছিল একদিন অভিজিতের চেম্বারে। সবটা শুনে অভিজিত সোহমের কয়েকটা টেস্ট করতে বলেছিল।
টেস্টের রিপোর্ট দেখেই চিন্তিত স্বরে ও বলেছিল, সোহম, আমার মনে হয় সত্যিটা বিহুর কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। দেখ, তোর রিপোর্টগুলো ওকে বললেই ও বুঝতে পারবে প্রবলেমটা ঠিক কোথায়!
সোহম অভিজিতের হাত দুটো ধরে রিকোয়েস্ট করেছিল,প্লিজ অভি, এসব আমি ওকে বলতে পারবো না। ও জানতে পারলেই হয়তো আমায় ছেড়ে চলে যাবে রে। বিহুকে ছাড়া এক মুহূর্ত আমি থাকতে পারব না। এসব রিপোর্ট আমি লুকিয়ে রেখে দেব। তাছাড়া এসব ডাক্তারি টার্ম ও বুঝবেও না।
অভিজিত বলেছিল, সোহম তুই তো ওকে এত ভালোবাসিস, তাও এতটা মিথ্যে বলবি!
সোহম মাথা নিচু করে বলেছিল, হারাতে চাইনা বলেই তো বলব।
সেদিনের পর থেকে বিহুর ওই ডাক্তারের কাছে চলো, দুজনের ক্রোমোজোম টেস্ট করব, কথাটাতেই আতঙ্ক জন্মে গেছে সোহমের। আর কেউ না জানুক ও তো সত্যিটা জানে। এরপর গোটা বাড়ির সকলেই হয়তো জানবে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে ও ভাবে না। ওর ভাবনা শুধু বিহুকে নিয়ে। সোহমের রিপোর্টগুলো জানার পর ও যদি সোহমকে ছেড়ে, এবাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তখন সোহম কি করবে। বিহুর ফোনের লাস্ট ডিজিট খোঁজার মতো করে ওকে খুঁজে বেড়াবে কি করে!
ফোন নম্বর খোঁজার ব্যাপারটা মনে পড়ে গেলেই নিজের মনেই হেসে ওঠে সোহম। কি ছেলেমানুষিই না করেছিল সোহম। রোজ অফিসের পর বিহুর লাস্ট ডিজিট খোঁজাটা একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল।
পরের দিন শেষে একটা ১ বসাতেই কোনো এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ফোন ধরেছিল।
কিছু না শুনেই বলতে শুরু করেছিল, হ্যাঁ স্যার, কাল আপনার কামারপাড়ার বাড়িতে ভোর সাতটার মধ্যেই আমার একটা ছেলে ব্লাড নিতে চলে যাবে। আমার মনে আছে স্যার। নো টেনশন।
সোহম মনে মনে হেসেছিল। শেষপর্যন্ত কি বিহুর নম্বর খুঁজতে একবোতল রক্ত দিতে হবে নাকি!
ইনজেকশনে সোহমের সেই ছোট্ট থেকেই খুব ভয়।
পরের দিন ফোন পৌঁছেছিল এক টিভির কেবলের অফিসে। সে ভদ্রলোক তো দুটো কাঁচা দিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে বাবা জানি, মাত্র আধঘণ্টা কেবল লাইন অফ আছে। আমাদের মেশিনে প্রবলেম হয়েছে। শালা, ফোনের পর ফোন এসেই যাচ্ছে। একদিন ‘বউ কথা কও’ সিরিয়াল না দেখলে কি আর বউ সত্যিই কথা বলবে না দাদা! আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি তো।
সোহম মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ধুত্তোর। আর ট্রাই করব না। ৯ অবধি যেতে যেতে বাপঠাকুরদার নাম ভুলিয়ে দেবে পাবলিক। তারপরেও হয়তো বিহু নিজের নম্বরই দেয়নি। দু-মিনিটের পরিচয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছেলেকে নিজের নম্বর নাই দিতে পারে। ওটা হয়তো ফেক নম্বর। প্রতিদিনই মেট্রোতে ওঠার সময় একবার ভিড়ের মধ্যে মুখগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেয় সোহম। হয়তো দেখা হবে আবার আচম্বিতে। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছিল। সোহমের মোটামুটি এই শহরের কল মিস্ত্রি থেকে বিউটিপার্লার সব জায়গায় ফোন করে গালাগাল শোনা কমপ্লিট। ১ এর পরে ০ থেকে ৯ সব বসিয়ে ট্রাই করে নিয়েছে ও। না কোনটাতেই বিহুকে পাওয়া যায়নি। বিশাল কলকাতা শহরে হারিয়ে গেল মেয়েটা।
অসমিয়া নাচের তালটুকুই যা সোহমের মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। একটা মেয়ে পকেটমারের সাথে যুদ্ধ করে ওর ওয়ালেটটাকে বাঁচিয়েছিল, এইটুকু গল্প করা ছাড়া আর এগোলো না পরিচয়টা।
রবিবারের বিকেলে ব্যচেলার ছেলের যা করণীয় সেটাই করছিল সোহম। সারাদুপুর ল্যাদ খেয়ে সন্ধেতে হয় একবার পাড়ার ক্লাবে ঢুঁ মারবে, নয় একটা মুভি দেখবে এই চিন্তাই চলছিল ওর মাথার মধ্যে। হঠাৎই মোবাইলটা বেজে উঠল। নম্বরটা খুব চেনা চেনা লাগছিল, শেষ দুটো ডিজিট ছাড়া। রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে মেয়েলি গলায় কেউ একজন বলে উঠল, চিনতে পারছেন মিস্টার ঘুমকাতুরে?
সেদিন স্টেশনে ট্রেনে ওঠার আগে পর্যন্ত চিৎকার করে করে নম্বরটা জানলেন, তারপর একটা কলও তো আর করলেন না। সত্যি, ইদানীং মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ আর নেই বললেই চলে। কমিশন দেবার ভয়ে আর যোগাযোগই করলেন না।
সোহম হাতে অসহিষ্ণু গলায় বলল, আপনিই তো আমাকে ভুল নম্বর দিয়েছিলেন। প্রথমত সেদিন ট্রেনের আওয়াজে আপনার কন্ট্যাক্ট নম্বরের শেষ ডিজিটটা আমি শুনতে পাইনি। এখন তো দেখছি শুধু শেষটা নয় তার আগের ডিজিটটাও আমি ৭ এর জায়গায় ১ লিখেছিলাম। আর ওই জন্য ট্রাই করে করে গোটা কলকাতার কেবল থেকে বিউটিপার্লার সবার সাথে পরিচয় হয়ে গেল আমার।
বিহু ঝর্ণার মতো হেসে উঠল ফোনের অন্য প্রান্তে। তারপর নরম গলায় বলল, কেন, আবার পকেটমারি হয়েছে বুঝি আপনার? পিক পকেটের পরে আবার বুঝি ওয়ালেটটা কেউ ফেরত দেয়নি? ঐজন্যই কি আমার কথা মনে হয়েছিল?
সোহম একটু থমকে গিয়ে বলেছিল, মোটেই না। আমার এমনিই মনে হচ্ছিল।
বিহু আবার একটু জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, যাক, কেউ অন্তত খুঁজেছে। তবে কাল মেট্রোতে যেভাবে গোটা কম্পার্টমেন্টে দৃষ্টি দিয়ে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছিলেন, তাতে মনে হল, আবার বোধহয় হারালেন কিছু!
সোহম চমকে উঠে বলল, আপনি কাল ছিলেন ওই কম্পার্টমেন্টে? তাহলে আমি কেন দেখতে পেলাম না! আপনি যখন দেখলেন তখন কথা কেন বললেন না!
বিহু বলল, আমি ভাবলাম বিশেষ কাউকে খুঁজছেন হয়তো। তাই আর দেখা দিলাম না। আপনি কি কাউকে খুঁজছিলেন?
সোহম নিজেকে সামলাতে না পেরেই বলে বসল, আপনাকেই তো খুঁজছিলাম। অদ্ভুত মেয়ে তো, খুঁজছি দেখেও লুকিয়ে পড়লেন!
বিহু হালকা হেসে বলল, যাকগে এখন কি করছেন?
সোহম হালকা চালে বলল, প্ল্যান নেই কিছু। মুভি দেখব কিনা ভাবছিলাম।
বিহু বলল, সন্ধে ছটায় রবীন্দ্রসদনের সামনে আসতে পারবেন?
সোহমের লোহিত রক্তকণিকায় একটা উষ্ণ অনুভূতি বয়ে গেল যেন।
দেরি না করে বলল, নিশ্চয়ই আসব।
বিহু বলল, নম্বরটা সেভ করে নিন। খুঁজে না পেলে কল করবেন। এবারে আর ভুল হবে না তো?
সোহম হেসে বলেছিল, ভুল কি মানুষ বারবার করে!
হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে পেলে আর হারাতে দেয় না।
বিহু ফোনটা কেটে দিয়েছিল।
সোহমের এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। অদ্ভুত একটা আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত মন জুড়ে। বিগত জীবনে ও কোনোদিন কারোর ডাকে সাড়া দিতে ছুটেও যায়নি। তাই হয়তো নিজের মনের আবেগকে সম্বরণ করা সত্যিই কঠিন হয়ে উঠেছিল ওর পক্ষে। তবুও পছন্দের ক্যাজুয়াল টিশার্ট আর জিন্স পরে রওনা দিয়েছিল রবীন্দ্রসদনের উদ্দেশ্যে। গেটের সামনে পৌঁছাতেই একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে বললো, আপনি মিস্টার সোহম রায়, তাই তো?
বিহুদি আপনাকে হলের ভিতরে যেতে বলল।
অপরিচিত ছেলেটার সাথে একদিনের পরিচিত বিহুর উদ্দেশ্যে হলের ভিতরে পা রাখতেই সোহম বুঝতে পেরেছিল, দর্শকাশনগুলো প্রায় সব ভর্তি। কোনো অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। কিন্তু ওর উদগ্রীব চোখ দুটো বিহুকে খুঁজছিল। কোথাও নেই বিহু।
ওই ছেলেটিই আবার বলল, সোহমদা, দিদি আপনাকে চেয়ারে বসতে বলেছে।
একটু অবাক হয়েছিল সোহম। বিহু আসতে বলল, অথচ তার দেখা নেই। এখন কি এখানে বসে ওকে ক্ল্যাসিকাল মিউজিক শুনতে হবে নাকি!
এর থেকে তো বাড়িতে বসে আই পি এল দেখা ভালো ছিল।
সবাই নড়ে চড়ে বসল। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা মাইক্রোফোন হাতে স্টেজে উঠলেন। ভীষণ সামঞ্জস্যপূর্ণ গলায় বললেন, এখুনি শুরু হতে চলেছে আজকের নৃত্যনাট্য ”রক্তকরবী”। বিভিন্ন ভূমিকায় যারা অভিনয় করেছেন তাদের নাম হল, নন্দিনীর ভূমিকায় রয়েছেন, বিহু পুরকায়েত। ভদ্রমহিলা আরো নাম বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সোহমের মাথায় আর কিছুই ঢুকছিল না।
সেদিন আচমকাই ওর নামটা শুনে সোহম জানতে চেয়েছিল, বিহু নাচ জানে কিনা! অসমিয়াদের মধ্যে বিহু গান, বিহু নাচ ভীষণ বিখ্যাত, তাই মজা করেই জিজ্ঞেস করেছিল সোহম। বিহু লাজুক মুখে বলেছিল, ওই আরকি। তারমানে বিহু আজ নিজের ডান্স প্রোগ্রাম দেখাবার জন্যই এখানে ডেকে এনেছে সোহমকে। সোহমের অন্যরকম একটা আনন্দ কাজ করছিল মনের মধ্যে। সেই সময়েই গলায়, কানে রক্ত করবী ফুলের সাজে সেজে মঞ্চে ঢুকল বিহু। সোহম যেহেতু সামনের সারিতেই বসেছে, তাই চোখাচোখি হল। বিহুর গোলাপি ঠোঁটে হাসির ছোঁয়া।
সোহম নাচ তেমন না বুঝলেও, বিহু যখন মঞ্চে নাচছিল, তখন ও মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। কি সুন্দর অঙ্গভঙ্গি, কি মিষ্টি ওর নাচের মুদ্রাগুলো।
নৃত্যনাট্য শেষ হবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল সোহম। মেয়েটা সত্যি ভালো নাচে।
উঠে হলের বাইরে যাওয়ার আগেই দেখা হল বিহুর সাথে। আলতো হেসে বলল, দুমিনিট ওয়েট করুন আসছি। হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সোহম।
মেকআপ পরিষ্কার করে, ড্রেস চেঞ্জ করে মিনিট দশেক পরে হাঁপাতে হাঁপাতে এল বিহু।
এসেই বলল, আপনার আজ সন্ধেটা নষ্ট করে দিলাম, তাই না?
সোহম চকলেটের প্যাকেটটা বিহুর হাতে দিয়ে বলল, রোজ এভাবে নষ্ট করে দিন আমার সন্ধেগুলো। আপনি এত ভালো নাচেন! মারাত্মক সারপ্রাইজড হয়েছিলাম, আপনাকে মঞ্চে দেখে।
বিহু চকলেটের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কেন?
সোহম হেসে বলল, তখন একটা কারণ ছিল, এখন দুটো কারণের জন্য।
বন্ধুত্বটা হয়েছিল সেদিনই। বিহু খুব মিশুকে মেয়ে। সোহমের মতো রামগরুরের ছানাকেও কথায় কথায় হাসিয়ে ছাড়ত। বিহুকে এক নজর দেখলেই সোহমের সব মনখারাপ ভালো হয়ে যেত।
বন্ধুত্ব, ফোনে কথা, দেখা হওয়া সবকিছুর মাঝে কবে যে সোহম বিহুকে ভালোবেসে ফেলেছিল ও বোধহয় নিজেও জানতে পারেনি। তবে একটা উপলব্ধি ওর তখনও হত, বিহুকে ছাড়া বাঁচা মৃত্যুর সমান।
এক অস্তগামী সূর্যকে সাক্ষী রেখে সোহম বলেছিল, বিহু, আমার সাথে খেলনাবাটি জীবন কাটাবে? আমার সাথে মান-অভিমান জীবন কাটাবে?
বিহু সোহমের বুকে মাথাটা রেখে বলেছিল, তোমার সাথে ঝগড়া-আদরে কাটাবো জীবন।
সোহম বাড়ির পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে না করে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে দেখেই মায়ের মুখ প্রথম গোমড়া হয়েছিল। একমাত্র বড়দা বলেছিল, ওর জীবন, তাই সিদ্ধান্তটা ওরই হওয়া উচিত। বিহু যেহেতু নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বড় হয়েছিল, তাই জয়েন্ট ফ্যামিলির আদবকায়দা বুঝতে ওর একটু সময় লেগেছিল। বাবা-মা আর বিহুর ছোট্ট সংসার থেকে এসে ভাসুর, জা, ননদ, শ্বশুর,শাশুড়ির নিয়মকানুনের প্যাঁচে পড়ে প্রথম প্রথম বিহু বেশ ঘাবড়ে যেত। ওর অসহায় মুখটা দেখেই সোহম একদিন বলেছিল, বিহু চলো, আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যাই। এখানে থাকলে তোমার নাচ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের প্রাইভেসি বলে আর কিছু থাকবে না। আর তাছাড়া মায়ের তোমাকে অপছন্দ বলেই হয়তো, সব সময় তোমার দোষ দেখে। এসব আমার ভালো লাগে না বিহু। আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, তোমাকে সবটুকু সুখ দেব বলে। এখন তো উল্টোটা হল, তুমি আমার সবকিছুর ওপরে তীক্ষ্ন নজর রাখছো। আমার ঘড়ি থেকে ড্রেস সব তুমি সাজিয়ে রাখো যত্ন করে, আর আমি তোমাকে একটু কমফোর্টও দিতে পাচ্ছি না।
সোহমের কথা শুনে, ওর চুলগুলো নিজের আঙুলে করে এলোমেলো করে দিতে দিতে বিহু বলেছিল, হেরে যেতে বলছ? পালিয়ে যেতে বলছ?
আমি তো তোমাদের বাড়িতে এসেছি সবে মাত্র পাঁচ মাস। আমায় আরেকটু সময় দাও, আমি ঠিক এবাড়ির সকলের প্রিয় বৌমা হয়ে উঠবোই।
এই নিয়ে বিয়ের পর থেকে মান, অভিমান হতেই থাকে ওদের। এমনকি হানিমুনে গিয়েও ঝগড়া হয়েছিল বিহুর সাথে। সোহম বলেছিল, বিহু আমরা আমাদের মতো করে সময় কাটাই কতক্ষণ। তুমি তো সারাক্ষণ সংসারের সকলের মধ্যে নানা কাজে ব্যস্ত। অবহেলিত হচ্ছি আমি আর তোমার নাচ। যে দুটোকে তুমি সব থেকে ভালোবাসতে, সে দুটোকেই তুমি বাতিলের দলে ফেলে দিয়ে, এ বাড়ির প্রিয় বৌমা হবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছ।
বিহু অভিমান করে বলেছিল, তুমি সব সময় এবাড়ি, এ বাড়ি বলো, এটা বুঝি তোমার বাড়ি নয়?
সোহম বলেছিল, আমি তো অস্বীকার করিনি। তাই বলে বাড়ি শুদ্ধু লোক তোমায় কথায় কথায় অপদস্ত করে বলবে, তুমি কিছুই জানো না। এটা সহ্য করাটাই কি যোগ্য স্বামীর কাজ!
বিহু আদর করে বলত, বড়দি ঠিকই বলে, সোহমটা বড্ড বউ হ্যাংলা।
মা বলেন, আমার ছেলেটা তো বউয়ের কোনো দোষই দেখতে পায়না।
সোহম তবুও গোঁজ হয়ে বলেছিল, এরকম কিন্তু কথা ছিল না। বিয়ের আগে আমরা নিজেদের একটা রঙিন পৃথিবী গড়েছিলাম বিহু। সেখানে তোমার একটা নিজস্ব নাচের স্কুল থাকবে। অনেক বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ের পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজে মুখরিত হবে চারিদিক।
আমি অফিস থেকে ফিরলে তুমি আমার পাশে বসে শোনাবে তোমার সারাদিনের গল্প। আমার ফিরতে দেরি হলে অভিমানে ঠোঁট ফোলাবে। আমি তোমার মান ভাঙাতে ছুটির দিনে তোমায় নিয়ে ভিক্টোরিয়া যাবো। সেসব তো এখন অলীক স্বপ্ন মনে হচ্ছে বিহু। আমি ভাবতেই পারিনি, তুমি নাচ ছেড়ে দিয়ে, মাস্টার্স এর পরে বিএড না করে, আর পাঁচটা সাধারণ ঘরোয়া বউয়ের মতো দিনরাত রান্নাবান্নার কাজ শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
বিয়ের পর পর প্রায়ই এই নিয়ে মনোমালিন্য হত সোহম আর বিহুর মধ্যে। বিহুর এই বদলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সোহম। তবুও বিহুকে আরো বেশি করে ভালোবেসে ফেলছিল ও। বিহু হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবে না, মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে বিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে সোহম। ফিসফিস করে বলেছে, আমি যে ওই মেট্রোর মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলাম বিহু, আমি যে রবীন্দ্রসদনের নন্দিনীর প্রেমে পড়েছিলাম, কেন এত বদলে যাচ্ছ তুমি!
তিন বছরের বিবাহিত স্ত্রী বিহুর মধ্যে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সেই বিহুকে খুঁজে পায়না সোহম। যার চলার ছন্দে মনে হত, এ সব কিছু জয় করতে পারে। এ ঝর্ণার মতো হাসতে পারে, দুঃখে হাউমাউ করে কাঁদতে পারে, আনন্দে চিৎকার করে বলতে পারে, সোহম আই লাভ ইউ। ঝগড়া করে বলতে পারে, নেহাত ভালোবাসি, তাই ছেড়ে যেতে পারি না।
বছরখানেক ধরে বিহুর একটাই চিন্তা মা হতে হবে ওকে। বাড়ির সকলে ওকে বুঝিয়েছে, মাতৃত্বই হল নারীর পূর্ণতা। তাই বিহু ক্ষেপে উঠেছে মা হবার জন্য। এমনকি মাঝরাতে প্রায়ই স্বপ্ন দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকে।
সোহম কিছু বোঝাতে গেলেই বলে, হানিমুন হল, তিনটে ট্যুর হলো। অগুনতি মুভি দেখা হয়েছে, নিমন্ত্রণ বাড়ি যাওয়া হয়েছে, বিয়ের পর তো সবই হয়েছে সোহম। তিন তিনটে বছর কেটে গেছে। আমার বান্ধবীরা সবাই মা হয়ে গেছে। তাহলে আমি কেন নয়! আর তোমারই বা এ ব্যাপারে এত অনীহা কেন?
অনেকেরই বাচ্চা আসতে একটু প্রবলেম হয়। তারা ডক্টর দেখায়। আমরা কেন কোনো ডক্টরের কাছে যাচ্ছি না সোহম? এই একটা ব্যাপারে তোমার গা ছাড়া ব্যাপারটা কিন্তু আমার মনে অন্য সন্দেহ দানা বাঁধতে বাধ্য করেছে।
সোহম একটু বিরক্ত হয়েই বলেছে, প্রেগনেন্সি টেস্টের কিট তো বাড়িতেই আনছি যখন বলছ। পজেটিভ হলে তো আটকাবার কিছু নেই।
বিহু অপলক তাকিয়ে থেকেছে সোহমের দিকে। তারপর কাটা কাটা শব্দে বলেছে, আমি দুজনেরই ফার্টিলিটি টেস্ট করাতে চাই। দেখতে চাই প্রব্লেমটা ঠিক কার, তোমার না আমার। তোমাদের বাড়ির লোক একতরফা বলেই চলেছে, আমার নাকি মা হবার ক্ষমতা নেই।
আমি ম্যাগাজিনে, গুগুলে পড়েছি সোহম। বাচ্চা হবার ব্যাপারে ৬০ পর্যন্ত মেন ফার্টিলিটি ইম্পর্টেন্ট। বিহুর অবিশ্বাসী চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কুঁচকে গিয়েছিল সোহম। আর সেই ভয় থেকেই অভিজিতের কাছে গিয়েছিল। অভিজিত ওর স্কুলের বন্ধু। একসাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়া বন্ধু এখন নামি ডক্টর। তবে ডক্টর হলেও ওর মধ্যে কোনো অহংকার নেই।
যেখানেই দেখা হয়েছে, আগের মতোই এক মুখ হেসে বলেছে, সোহম মনে রাখিস তোর কাছে আমার এখনও একটা খাওয়া বাকি আছে। সোহম হাসি মুখে বলেছিল, কিসের জন্য রে?
অভিজিত গলাটা ততোধিক গম্ভীর করে বলেছিল, ক্লাস সেভেনের একটা ক্রিকেট ম্যাচে আমি আম্পায়ার হয়েছিলাম। তুই আউট হয়েছিলি দেখেও আউট দিইনি। তুই বলেছিলি, কালিদার ঘুগনি খাওয়াবি। তারপর বেমালুম চেপে গিয়েছিলিস।
সোহমের খুব ইচ্ছে করছিল, আজকের নামি ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে বলতে, পাল্টাস না। এমনই থাকিস।
সেই অভিজিতের কাছেই শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল সোহম নিজের সমস্যা নিয়ে। বিহুর পাগলামি দিনকে দিন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। আর বাড়ির মানুষগুলোও তেমন। সোহমের বোন নন্দিতা যেদিন থেকে দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট হয়েছে, সেদিন থেকেই সবাই বলতে শুরু করেছে, নয় নয় করে তিনবছর তো হল, এবারে অন্তত একটা বাচ্চা নাও। সোহমের মায়ের তো মুখের একটাই কথা.. বয়েস তো হচ্ছে, ছোট ছেলের সন্তানের মুখ দেখে ভালোয় ভালোয় যেতে পারলে হয়। সোহম যখন খেতে বসে আর বিহু খাবার পরিবেশন করে তখন মা এই সব কথা বেশি বলে। সোহম দেখেছে বিহুর হাতটা কেঁপে ওঠে। চোখ দুটো নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
বিহুর ওই প্রাণহীন চোখদুটো দেখে ডাল মাখা ভাতের গ্রাসটা গলার কাছে আটকে যায়।
বিহুর ঠোঁট দুটো রক্তশূন্য হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আর তরকারি নেবে?
সোহম ঘাড় নেড়ে না বলে, জোর করে খাবার থালাটা ফাঁকা করে উঠে যায়।
রামধনুর কাছ থেকে অনেকটা রং ধার করেছিল সোহম, ওদের দুজনের সংসারটা সাজাবে বলে। বিহুর সাথে প্রেমপর্বেই সোহম বুঝেছিল, বিহু ভীষণ ইনোসেন্ট, খুব রোম্যান্টিক একটা মেয়ে। একটুতেই ওর চোখে জল আসে আর অল্পেই সে হেসে কুটোপাটি করতে পারে। তাই ও ভেবেছিল, হলুদ দিয়ে আঁকবে ওদের ঘুম ভাঙা সকালটা। নীল থাকবে মধ্যরাতের বিছানায়। হালকা কমলাকে রাখবে বিহুর অভিমান ভাঙাতে। সবুজকে রাখবে ওদের মনের গভীরে। কিছুতেই যেন ফ্যাকাসে না হয় ওই গাঢ় সবুজ, সেদিকেও নজর রাখবে সোহম। লাল থাকবে বিহুর ঠোঁটে। যেখানে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে সোহম ফিরে পাবে সব তৃপ্তি। বেগুনি থাকবে বিহুর বাহারি শাড়ির আঁচলে, যেখানে বাঁধা থাকবে সোহমের মন। সারা পৃথিবী ঘুরে এসেও বিহুর আঁচলই হবে ওর শেষ আশ্রয়।
এখন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে বিহুকে কাঁদতে দেখে মনে হয়, সে রং মিলেমিশে রংহীন হয়ে গেছে তাদের কিছুতেই আলাদা করতে পারে না সোহম। যেন মনে হয় একটা কালো রঙের পর্দা সবটা ঢেকে দিয়েছে।
ওদের দেখা সেই ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল কোনো এক অজানা আতঙ্কে। প্রতি মাসে প্রেগনেন্সি কিটের নেগেটিভ দাগগুলো বিহুর মনে বয়ে নিয়ে আসে অনেকখানি হতাশা। আর সেই হতাশা যে শুধু বিহুর তা নয়, সোহমেরও কষ্ট হয়, যখন অফিস কলিগরা মিষ্টির প্যাকেট সামনে ধরে বলে, মিষ্টি মুখ করো, আমি বাবা হয়েছি। অথবা দু-একজন সিনিয়র বলেই বসেন, সোহম এবারে একটা বেবি নিয়ে নাও। হয়ে গেল তো বিয়ের নিমন্ত্রণ খেয়েছি তিনবছর। এবারে সাধের, অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণগুলোও খাওয়াও। শেষে কি রিটায়ার করে বাদ যাব নাকি নিমন্ত্রণ থেকে!
এসব কথাগুলো যখন শোনে সোহম তখন আলতো হেসে বলে, সে আপনারা কবে খাবেন বলুন না, একদিন জমিয়ে খাইয়ে দেব। কিন্তু ভিতরে ভিতরে চাপা যন্ত্রণাটা তো ওরও হয়। বিহু কিছুতেই বুঝতে চায় না, যে সন্তান সোহমও চায়। ওর ইচ্ছে করে একটা ছোট্ট হাত ওর গলা জড়িয়ে ধরে বাবা বলে ডাকুক। কিন্তু নিজেদের সব ভালোলাগাকে উপেক্ষা করেই বিহু দিনরাত বাচ্চা বাচ্চা করে ক্ষেপে উঠেছে। আর ওই এই অসহিষ্ণুতার জন্যই সোহম অফিস ফেরত ছুটেছিল অভিজিতের কাছে।
অভিজিত সেদিন বন্ধু নয়, ডাক্তারের মতোই পরামর্শ দিয়েছিল সেমেন টেস্টের।
সোহমের সব টেস্টের রিপোর্ট দেখে অভিজিত বলেছিল, তুই একদিন বিহুকে নিয়ে আয় আমার কাছে। আমি বরং ওকে বুঝিয়ে বলি, ও কোনোদিন মা হতে পারবে না।
সোহম ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বলেছিল, প্লিজ অভিজিত, বিহুকে এসব বলিস না। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না রে। অভিজিত ওর পিঠে হাত দিয়ে বলেছিল, কিন্তু বিহু তো একদিন এসব জানতে পারবেই, তখন তুই কি করবি?
সোহম চিন্তিত মুখে বলেছিল, ওকে তোর কাছে নিয়ে আসব, তুই একটু মিথ্যে বলতে পারবি না আমার জন্য। সেদিনের ক্রিকেট ম্যাচের মতো!
অভিজিত হাসি মুখে বলেছিল, তোদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মিথ্যেই না হয় বলব।
তবে খুব সাবধানে রাখিস এসব রিপোর্ট। বিহু যেন দেখতে না পায়।
সোহম নিজের অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজের ফাইলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল এসব রিপোর্টের পেপারগুলো।
কিন্তু তবুও কি আটকানো গেল বিহুকে। এই তো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে কাঁদছে। বলছে দুজনের ফার্টিলিটি টেস্ট করব। তাহলে তো সোহমের এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখার সব প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে গেল। শুধু যে বিহু জানবে তা তো নয়, বাড়ির সকলে জানবে। তার থেকে বরং কাল সকালে ও নিজেই বাড়ির সকলে আর বিহুকে সব জানিয়ে দেবে।
কি যে করা উচিত সেটাই ভাবতে পারছে না ও। কি ভাবে আটকাবে বিহুকে ডক্টরের কাছে যাওয়া থেকে সেটাই বুঝতে পারছিল না সোহম।
আরেকটা নির্ঘুম রাত কাটল সোহমের। বাইরে পাখির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিয়ের পর পর বেশ কয়েকবার ওরা দুজনে একসাথে ভোর হওয়া দেখেছিল। সারারাত ধরে বকবক করে করে ভোরের সূর্যের নরম আলো যখন জানালার কাঁচ দিয়ে চোখে পড়েছিলো,তখন দুজনে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, চলো ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিই।
সেই নির্ঘুম মিষ্টি রাতের সাথে আজকের রাতের অনেকটা পার্থক্য আছে। আজ সোহমের মাথায় নিরন্তর ভাবনার জাল বোনা চলছে।
বিহুর মুখে এখনও ভয়ের ছায়া। কেমন যেন গুটিয়ে আছে মেয়েটা। আত্মীয়স্বজনদের একনাগাড়ে একই কথা শুনে শুনেই বোধহয় বিহু এমন একরোখা হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় পরোক্ষভাবে দোষারোপ করছে সোহমকে। সেদিনও যেমন বলল, তোমার মাসি বলছিলেন, আমার নাকি কোনো শারীরিক প্রবলেম আছে। কিন্তু আমি যথেষ্ট সুস্থ সোহম। তাই কার শারীরিক সমস্যা, সেটা জানাটাও জরুরি। একতরফা আমি দোষ কাঁধে নিয়ে থাকবোই বা কেন। এই কথাটা শুনলেই বুকটা কেঁপে ওঠে সোহমের।
বিহু ঘুম থেকে উঠে বসল বিছানায়। আগের রাতের স্বপ্নের কথা ধরেই বলল, কাল নন্দিতার সাধে যারা যারা এসেছিলেন, প্রত্যেকে ইন্ডিভিজুয়ালি আমায় বলেছেন বেবির কথা। তুমিও তো সামনেই ছিলে সোহম, অথচ দেখ কেউ তোমায় কিন্তু কিচ্ছু বলল না। কারণ মা হওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব তো আমার তাই না?
তুমি আজ অফিসে যাবে না। আমরা আজ তোমার বন্ধুর চেম্বারে যাব। সোহম পলকা প্রতিবাদ করে বলল, এভাবে পরপর দুদিন ছুটি নেওয়া যায় না ব্যাংকে। প্লিজ বিহু এমন অবুঝ হয়ো না।
বিহু ঠোঁটটা চেপে ধরে বলল, আমার কিছু একটা হয়ে গেলে তোমার অফিস তোমায় ছুটি দেবে তো?
সোহম বিহুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, কি পাগলামি হচ্ছে? তুমি তো এত অধৈর্য নও। এমন ছেলেমানুষি কি তোমার সাজে? আর বিহু পৃথিবীতে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি আছেন। তারা কি সকলে নিজেদের সম্পর্কটাকে এভাবে শেষ করছে। যদি আমাদের বাচ্চা না হয়, যার দোষেই হোক, তাহলে আমরা অ্যাডপ্ট করতে পারি। সেও তো একটা ফুলের মতোই ছোট্ট শিশু হবে। সেও তো তোমায় মা বলেই ডাকবে।
বিহু হিসহিস করে বলল, হ্যাঁ আর তোমার রিলেটিভসরা সবাই ওপেনলি বলতে শুরু করবে, সোহমের বৌটা বাঁজা। বন্ধ্যা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে সোহম। তুমি বোধহয় সেটাই চাও তাই না সোহম?
নিজের শারীরিক অক্ষমতা ঢাকার জন্যই বোধহয় তুমি কিছুতেই আমায় ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে চাইছো না। বিহুর কথাটা শুনেই বুকটা মুচড়ে উঠল সোহমের।
বিহু বলেই চলেছে, নিজের অক্ষমতাটা আমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেবার এর থেকে ভালো পন্থা তো আর কিছু হতেই পারে না। কিন্তু তুমি নিয়ে না গেলেও আমি আজ যাবই ডক্টরের কাছে। এবং আমি আমার ফার্টিলিটি টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে এসে তোমাদের বাড়ির সকলের মুখের সামনে ধরে প্রমাণ করে দেব, কে অযোগ্য।
সোহম হালছাড়া গলায় বলল, বেশ, আমি অভিজিতকে কল করে দেখছি, ওর আজ কটা থেকে চেম্বার।
বিহু বললো, গোটা কলকাতায় ও ছাড়াও আরও ডক্টর আছে। যদি অভিজিত না বসে, তাহলে অন্য কাউকে দেখো।
সোহম ফোনটা সেরে বলল, অভিজিত আমাদের সকাল এগারোটা নাগাদ যেতে বলল।
বিহু কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই সোহম আবার ফোন করল অভিজিতকে। ফিসফিস করে বলল, আগের টেস্টের কোনো কথা যেন বিহু জানতে না পারে, খেয়াল রাখিস।
কিছুক্ষন পরেই বড়বৌদির গলা পেল সোহম, অবশ্যই ডক্টরের কাছে তো যাওয়া উচিতই। নয় নয় করে কম বছর তো হল না। আধুনিক ছেলেমেয়েরা এনজয় করবে বলে বাচ্চা নিতে দেরি করে বলেই পরে এত সমস্যা হয়।
মা বলল, এবারে যদি ভগবান মুখ তুলে চায়।
ঘরে বসে চা খেতে খেতে সব কথাই কানে আসছিল সোহমের। আজ যে ডক্টরের কাছে যাবে, সেটা বিহু গিয়ে ডাইনিংরুমে বলার পর থেকেই আলোচনাটা আবার শুরু হয়েছে।
অসহ্য লাগছিল সোহমের। ও মোবাইলটা খুলে কাছাকাছি ফ্ল্যাট খুঁজছিল। বিহুকে রাজি করিয়ে এ বাড়ি থেকে বেরোতে হবে ওদের। নাহলে কিছুদিনের মধ্যেই বিহুকে নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যেতে হবে। মেয়েটাকে মানসিক রোগী করে দেবে সোহমের পরিবার।
মেয়েটা যেমন হাসতে ভুলে গেছে , তেমনি করেই একটু একটু করে হয়তো সোহমকেই ভুলে যাবে।
সারাটা রাস্তা বিহু একটা কথাও বলেনি সোহমের সাথে। অভিজিতের চেম্বারে ঢুকে শুধু বললো, প্রবলেমটা তুমি বলবে, না আমি?
সোহম আলতো করে বলল, তুমিই বলো।
অভিজিতের একটা প্রশ্নতেই বিহু কেঁদে ফেললো।
অভিজিত জিজ্ঞেস করলো, ধরুন, টেস্টের রিপোর্টে দেখা গেল প্রবলেমটা আপনার, তখন আপনি কি করবেন? অথবা প্রবলেমটা সোহমের, তখন কি আপনি ওকে ছেড়ে চলে যাবেন?
বিহু ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল, আমার প্রবলেম হলে আমি ওকে মুক্তি দেব। ওর সমস্যা হলে, অবশ্যই পাশে থাকব। সোহমের মুখে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা দিল। ও বিহুর হাতটা ধরে বলল, সত্যি! আমার প্রবলেম হলে, তুমি পাশে থাকবে?
বিহু ঘাড় নেড়ে বললো, থাকব।
অভিজিত বলল, সোহম কয়েকটা টেস্ট লিখে দিলাম। আমার নিজস্ব ল্যাবে যা, হয়ে যাবে।
বিহু ফেরার পথে বলল, কি হল, কোথায় যাবে? এদিকে কেন যাচ্ছি আমরা?
সোহম কানে কানে বলল, আজ আমরা মেট্রোতে ফিরব।
বিহুর ঠোঁটে হালকা হাসি। সোহমের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, যদি পিক পকেট হয়?
তুমি আছো তো, চোর ধরবে বলে।
বিহুর চোখমুখ দেখেই সোহম আন্দাজ করেছিল, ও বেশ টেনশনে আছে কদিন। মাঝে একদিন কাউকে ফোনে বলতেও শুনল, সামনের সপ্তাহেই বোধহয় পেয়ে যাব রিপোর্টগুলো। তারপর দেখা যাক। হ্যাঁ প্রয়োজনে ট্রিটমেন্ট তো করবোই।
সোহমের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা রক্তস্রোত বয়ে গেল।
অভিজিত ফোনে বললো, তোদের রিপোর্ট চলে এসেছে। যেটা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক রে। তোর আগের বারের রিপোর্টের সাথে এই রিপোর্টের কোনো অমিল নেই। বিহুরও না দেখেই যেটা ভেবেছিলাম, সেটাই ঠিক। ডাক্তারি পরিভাষায় অভিজিত আরো অনেক কিছু বলল, কিন্তু তার বেশিরভাগই বুঝতে পারল না সোহম। তবে জিস্টটা বুঝেছে খুব ভালো করেই।
ফোনটা রাখতেই বিহু পাশ থেকে বলল, অভিজিতদার কল ছিল? কি বলল?
সোহম সাবধানে বলল, রিপোর্টগুলো এসে গেছে। আজকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলল।
বিহু অপলক তাকিয়ে বলল, আর কিছু বলেনি?
সোহম অসহায় গলায় বলল, প্রব্লেমটা আমার বিহু।
আর কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে গেল সোহম। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদল সোহম। মাথার ওপর থেকে ঠাণ্ডা জলের ধারা এসে ধুয়ে দিচ্ছে ওর চোখের নোনতা জল। বিহু সকলের সামনে চোখের জল ফেলতে পারবে, কিন্তু সোহম পারবে না। পুরুষ মানুষরা কাঁদলে বড্ড কাপুরুষ লাগে। তাই তারা ছোট থেকেই অনুভূতি লুকোতে শিখে যায়।
সকলে জানবে সোহমের শারীরিক অক্ষমতার জন্যই ওদের বাচ্চা হল না। বাড়ি থেকে আস্তে আস্তে পাড়ায় ছড়াবে। পাড়ার ছেলেরা ওকে দেখে মুখ টিপে হেসে বলবে, শালার বাচ্চা জন্ম দেবার ক্ষমতা নেই। নিজের ভিজে চুলগুলো মুঠো করে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল সোহম।
বাথরুম থেকে যখন বেরোলো তখন ওর চোখ দুটো রক্তবর্ণ। বিহু নরম গলায় বলল, মনখারাপ করো না। নিশ্চয়ই কোনো ট্রিটমেন্ট আছে।
সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে ড্রয়িংরুমে সকলের সামনে সোহম রিপোর্টগুলো দেখিয়ে বলল, আজ তোমাদের সত্যিটা বলেই দিচ্ছি। বিহুর মা হতে কোনো বাধা নেই। সমস্যাটা আমার শরীরের। আমি বাবা হতে পারব না। প্রবলেমটা এতটাই বেশি, যে ট্রিটমেন্ট করে সারানো সম্ভব নয়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করব।
কেউ কিছু বলার আগেই সোহমের মা বলল, এবাড়িতে অজাত কুজাতের বাচ্চা ঢুকবে না সোহম।
বড়দা বললো, হ্যাঁরে, টেস্টটিউব বেবি করা যায়না?
সোহম হাসি মুখে বলেছিল, বড়দা, তোমার ভাই সরকারি চাকুরে। ওতে যা খরচ হবে, সেটা বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবুও দেখবো ডক্টরের সাথে কথা বলে।
বিহুর দিকে তাকিয়ে মা বলল, ক্ষমা করো ছোটবৌমা। এতদিন মিথ্যে তোমাকে দোষ দিয়েছি। আমরা আগের দিনের মানুষ, ভাবি মেয়েদের দোষেই বোধহয় বাচ্চা হয়না। সোহম বলল, মা আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি রেন্টে, আমার অফিসের কাছে। আমি কিছুদিনের জন্য ওখানে শিফট করতে চাই।
সবাই কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যা ভালো বুঝিস।
বিহু প্যাকিং করতে করতেই বলল, চলে যাওয়াটা কি খুব দরকার ছিল সোহম। বাড়ির সবাই তো ব্যাপারটাকে সাদা চোখেই দেখেছে। এমনকি মা আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।
সোহম ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল, আমার ফাইল থেকে তোমার আমার প্যানকার্ড, আধার কার্ড এগুলোও গুছিয়ে নিও বিহু।
আমরা সানডে শিফট করব।
বিহু বুঝলো, সোহমের মনটা খারাপ। হয়তো এই বাচ্চা না হবার কারণে নিজেকেই মনে মনে দোষী করছে সোহম।
তাই এই বাড়ির লোকগুলোর কাছ থেকে পালাতে চাইছে। বিহু কথা দিয়েছিল, এমন অবস্থায় ও অন্তত পাশে থাকবে।
সোহমের দিকে তাকিয়ে বিহু বলল, মন খারাপ করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা কখনোই ভেবো না, তোমার প্রবলেম বেরিয়েছে বলে, আমি তোমায় কম ভালোবাসবো।
সোহম বলল, জানি, তুমি আরো বেশি করে ভালোবাসবে। কিন্তু প্লিজ বিহু, সেই ভালোবাসায় যেন করুণা না মিশে থাকে!
বিহু মনে মনে বলল, ভালো তো তোমাকেই বাসা যায় সোহম। কজন পুরুষের এমন ক্ষমতা থাকে! যে সকলের সামনে সত্যিটা জোর গলায় প্রকাশ করে নিজের স্ত্রীকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
সোহম অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরেই গোছগাছ করছিল বিহু। যে কোনো কারণেই হোক, এবাড়ির সকলে একটু চুপচাপ আছে এই দুদিন। বিহুর মনে হয়েছে, ওরা চলে যাবে বলেই হয়তো মনখারাপ এদের। বিহুরও তেমন ইচ্ছে ছিল না এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবার। ঝগড়াঝাঁটির মধ্যেও তো ছিল সবাই একসাথেই। দুপুরে খাওয়ার সময়েও সকলের মুখে মেঘের পূর্বাভাস দেখল ও।
আধার কার্ড, প্যানকার্ড খুঁজতে খুঁজতেই বিহুর হাতে এল সোহমের একবছর আগের ফার্টিলিটি টেস্টের রিপোর্টগুলো। দেখেই চমকে গেল বিহু। তার মানে সোহম নিজের অক্ষমতার কথা জেনেও বিহুকে কিছুই বলেনি! চুপচাপ বিহুর কান্না দেখে গেছে! মন থেকে ঘৃণাই আসছিল সোহমের প্রতি। তবুও ভাবছিল, হয়তো লজ্জায় বলে উঠতে পারেনি সোহম।
দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়ে রেডি হয়ে নিল বিহু।
দুজনের রিপোর্টগুলো ব্যাগে ভরে নিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বিহুর মায়ের পরিচিত এক ডক্টরের কাছে গিয়ে একবার দেখাবে রিপোর্টগুলো। যদি কোনো ট্রিটমেন্ট থাকে সোহমের, সেটাই করাবে বিহু। সোহমকে এভাবে সংকুচিত হয়ে থাকতে দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল বিহুর। ডক্টরের চেম্বারে যখন পৌঁছালো তখন বিকেল চারটে। ডক্টর প্রলয় ঘটক বয়স্ক মানুষ। বিহুর মা যে কোনো গাইনি সমস্যাতে ওনাকেই দেখিয়েছেন। বিহুও এসেছে বার দুয়েক। দুজনের রিপোর্ট অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন ডক্টর। তারপর বিহুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি জানতে চাইছো?
বিহু উদগ্রীব হয়ে বলল, সোহমের যদি কোনো ট্রিটমেন্ট করানো যেত। ডক্টর বাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তোমার হাজবেন্ডের সব তো একেবারে পারফেক্ট। বলতে পারো বেশিই স্ট্রং। ওর ট্রিটমেন্ট করাতে চাইছো কেন?
বিহু অবাক হয়ে বলল, আপনি ভালো করে দেখুন ডক্টরবাবু, সোহমের স্পার্মকাউন্টিং এতটাই কম, যে ও কোনোদিন সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না।
বয়স্ক ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, আমার মাথার চুল পেকেছে অভিজ্ঞতায়। সোহমের কোনো প্রবলেমই নেই। প্রবলেম তো তোমার। তোমার ওভারির গঠনেই সমস্যা। এটা তোমার জন্মগত সমস্যা। এর কোনো ট্রিটমেন্ট হয়না মা।
বিহুর মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। চেম্বার থেকে বেরোনোর সময় হাত-পাগুলোও অবশ লাগছিলো ওর। সোহম মিথ্যে কেন বলল! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই প্রেসক্রিপশন থেকে নম্বর বের করে অভিজিতকে কল করল বিহু।
অভিজিত খুব ধীর গলায় বলল, আমি সোহমকে বলেছিলাম বিহু, তোমার কাছে সত্যিটা বলে দিতে। আজ নয়, একবছর আগে ও যখন ওর নিজের টেস্ট করিয়েছিল আমার ল্যাব থেকে, তখনই আমি ওকে বলেছিলাম, তোর সব পারফেক্ট। তার মানে প্রবলেমটা বিহুর। তোমাকে না দেখেই আমি বুঝেছিলাম, সোহমের যখন সব কিছু পারফেক্ট তাহলে সমস্যাটা তোমার। কিন্তু সোহম কিছুতেই তোমার কিছু টেস্ট করাতে চায়নি। বলেছিল, আমি বিহুকে হারাতে পারব না। ও যখনই জানবে আমার জন্য নয়, ওর জন্য আমাদের বেবি হবে না, তখন থেকেই ও নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করবে। আমি আমার বিহুকে চাই।
এবারের টেস্টের পরেও ও আমাকে মিথ্যে বলতে বলেছিল বিহু। কিন্তু কেন জানিনা মনে হল, তোমার সোহমকে চেনা দরকার। ওর তোমার প্রতি ভালোবাসার গভীরতাটা জানা দরকার। ও তোমার জন্য সবটুকু দিতে পারে বিহু। আমার বন্ধু বলে বলছি না, আমি এমন স্বামী খুব কমই দেখেছি,যে স্ত্রীর শারীরিক সমস্যাকে নিজের কাঁধে চাপিয়ে, স্ত্রীকে সমাজের চোখে নির্দোষ প্রমাণ করে। তবে শোনো বিহু, এতে কারোরই কোনো দোষ নেই। এটা শুধু মাত্র একটা শারীরিক প্রবলেম ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে কারোর কোনো হাত নেই।
বিহুর ফোনের স্ক্রিনটা ভিজে যাচ্ছে, ওর চোখের জলে। গাল বেয়ে নোনতা জল ভিজিয়ে দিচ্ছে মুঠোফোনটাকে।
বিহু শুধু কান্না ভেজা গলায় বলল, থ্যাংক ইউ অভিজিতদা।
বিহু উবেরে বসে ভাবছিল, ও সবটা জেনে গেছে সেটা সোহমকে বলা কি উচিত? নাকি সোহমের লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টাকে সম্মান করা উচিত?
ভাবতে ভাবতেই ফিরে যাচ্ছিলো ওদের পুরোনো দিনগুলোতে। দুজন মানুষের মান-অভিমান খুনসুটিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে বিহুর।
রাতে সোহমের বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে বিহু বলল, আমাদের ফ্ল্যাটটা আমরা দারুণ করে সাজাব। আপাতত রেন্টে থাকছি, এরপরে কিন্তু আমাদের নিজেদের একটা ফ্ল্যাট চাই। আমি ভাবছি আবার নাচের স্কুলটা শুরু করব।
সোহমের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বিহু বলল, ভেবে দেখলাম, একটা ছেলেই অ্যাডপ্ট করব। যে তোমার মত করে আমাকে ভালোবাসবে।
সোহমের চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বিহু বলল, তোমার রামধনুর কাছ থেকে ধার করা রংগুলো দিয়ে সাজাব আমাদের সংসারটা। সেখানে একটা বিচ্চু ছেলে দিনরাত সেই রংগুলো এলোমেলো করে দেবে, তুমি আর আমি আবার সাজাব।
সোহম বলল, আমি একটা হোমে কথা বলেছি। তুমি রাজি থাকলে তোমাকে নিয়ে গিয়ে পেপার্স রেডি করতে বলব।
বিহু সোহমকে অঁকড়ে ধরে বলল, তোমাকে আরো অনেক বেশি ভালোবাসতে চাই। কি ভাবে বাসব একটু শিখিয়ে দেবে?
সোহম নিজের শরীরটা বিহুর শরীরে মিশিয়ে দিতে দিতে বলল, সব সময় ভাববে, আমরা একটাই ইউনিট। তুমি আমি আলাদা নয়, একটাই। আমাদের সুখ-দুঃখ সব একই।
সমাপ্ত