নিবিড় বসন্ত
অফিসের কাজ সামলে ইদানীং শপিংয়ে যাওয়ারও সময় পায় না ঈপ্সিতা। অথচ এককালে শপিং ছিল ওর ফেভারিট হবি। প্রয়োজনীয় জিনিস আজকাল অনলাইনেই কিনে নেয়। পুরোনো দু-চারজন বন্ধুর সাথে এখনও যোগাযোগ আছে ঈপ্সিতার। ওরা বলে, মাত্র ঊনত্রিশেই তুই বুড়ি হয়ে গেলি। ও নিশ্চুপ থাকে। হয়তো ওরাই ঠিক বলছে। আজকাল মা-ও বলে, ঈপ্সি তুই হাসতে ভুলে যাচ্ছিস। অথচ একদিন ওর হাসির চোটে বন্ধুরা বলত, দিনরাত কোলগেটের অ্যাড দিস না তো!
জোর করে ল্যাপটপটা খুলে নিজের কাজে মন দিল ঈপ্সিতা। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে আছে ও। দিনরাত খাটার পরে আর পিছন ফিরে দেখার বিশেষ সময় পায় না। ভাগ্যিস পায় না! পিছন ফিরে তাকালেই এত হলদে পাতা সামনে এসে দাঁড়ায়, যে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
কাজের ফাঁকেই হোয়াটসআপে মেসেজ ঢুকল, তোর অফিস পাড়ায় একটা এক্সপো হচ্ছে। আমরা তিনজনে আসছি, তুই রেডি থাক।
ঈপ্সিতা লিখতে যাচ্ছিল, আজ হবে না রে। কিন্তু ও টাইপ করার মাঝেই নির্দেশ দিয়ে অফলাইন হয়ে গেল রচনা। এই এক মেয়ে। সেই কলেজ লাইফ থেকে একই থেকে গেল। দিনরাত হৈহুল্লোড় খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনুশ্রী আর পারমিতাটাকেও সঙ্গী করেছে এখন। তিনজনে গোটা কলকাতা মায় শান্তিনিকেতন অবধি ঘেঁটে ফেলছে।
এমবিএ করার সময়ে কলেজের বেশিরভাগ বান্ধবীদের সাথেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ঈপ্সিতার। অনেকেই মাস্টার্স, এম এস সি করতে চলে গিয়েছিল। একমাত্র রচনার তাগিদেই ওর সাথে কোনোদিন বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি ঈপ্সিতাকে। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে। চূড়ান্ত মনখারাপের দিনেও মন ভালো করে দেয় রচনার বোগাস, ভুলভাল কথাগুলো। মেপে কথা বলার মেয়ে রচনা কোনদিনই ছিল না। বিয়ের পরেও স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বামীর টাকায় একটা বুটিক খুলে বসেছে। ঈপ্সিতা নিজের মনেই আলতো করে হেসে বলল, সকলেই মোটামুটি সুখী আছে। একমাত্র ওই…তো
আবার রচনার মেসেজ ঢুকল, আমরা দশ মিনিটের মধ্যে তোর অফিসের সামনে পৌঁছাচ্ছি। দেরি করিস না। অগত্যা ওকে টেবিল ছেড়ে বেরোতেই হল।
হালকা পায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলো ও। একটু ফ্রেস হয়ে নিতে হবে। ব্যাগ থেকে লিপস্টিক আর লাইনারটা বের করে নিল। চুলটাও ব্রাশ করতে হবে। পাশের টেবিল থেকে অরিজিৎ বলল, চললে নাকি?
ঈপ্সিতা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, পুরোনো বন্ধুদের হঠাৎ আক্রমন। যাব না বললে অফিস ভাঙচুর করবে।
রচনা বোধহয় ঠিকই বলে ঈপ্সিতাকে। শক্ত খোলসটা ছেড়ে এবার বেরোতে শুরু কর ঈপ্সিতা, তোর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে দুর্ঘটনা ভেবে বেরিয়ে আয় প্লিজ।
কিন্তু ঈপ্সিতার মনে হয় এই কঠিন আবরণের মধ্যেই ও ঠিক আছে। আবার এর থেকে বেরোতে গেলেই হোঁচট খাবে। কিন্তু ফ্রেস বাতাসের অভাবে মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে। অক্সিজেনের অভাবে তখন ও হাঁসফাঁস করে, তবুও প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারে না খোলা আকাশের নিচে। স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে না কারোর সাথে। একমাত্র রচনাই ছিল সেই প্রথম দিন থেকে। ওর সামনেই ঘটেছিল সব ভাঙাগড়ার হিসেব-নিকেশ। তাই ও কিছু বললে ঈপ্সিতা না বলতে পারে না। সেই একাকীত্বের দিনগুলোতে, সেই ভুল সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্তগুলোতে রচনাই ওকে সামলে ছিল।
মুঠোফোনটা ভাইব্রেট করছে, নম্বরটা দেখেই এক চিলতে হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। ফোনটা রিসিভ করেই ঈপ্সিতা বলল, নামছি রে। জাস্ট টু মিনিটস।
রচনা হড়বড় করে বলল, কুইক।
গাড়ি পার্ক করতে দিচ্ছে না এখানে।
যা ভেবেছিল ঠিক তাই। অনুশ্রী, পারমিতা হৈহৈ করে উঠল, তাড়াতাড়ি উঠে আয়।
অনুশ্রী বলল, এই ঈপ্সিতা তোকে কি মিষ্টি লাগছে রে। আমরা তিনজনেই বড্ড বুড়িয়েছি, তুই কিন্তু সেই কলেজ গার্ল হয়েই আছিস। ঈপ্সিতা বলল, সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা অবধি খাটি অফিসে, তারপরও কলেজগার্ল আছি বলছিস! তাহলে মনে হচ্ছে অফিসের ওয়াটার পিউরিফায়ারটা অরিজিনাল বুঝলি।
প্রায় মাসখানেক পরে আবার অফিসের প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বেরোলো ঈপ্সিতা। বাড়ি থেকে উবের বুক করে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ি। রাস্তার দু-পাশের আলো জ্বলা প্রাণচঞ্চল তিলোত্তমাকেও ভালো করে দেখে না ঈপ্সিতা। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে উবেরে যায়। রাস্তার দিকে ইচ্ছে করেই তাকায় না। ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলো হঠাৎ করেই রাস্তার মোড়ে ফুচকা স্টলে, কিংবা আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আর নাছোড় হয়ে বলে উঠে, বেশ ছিল সেইদিনগুলো।
কি রে কি ভাবছিস বলতো?
রচনার কথাতেই সম্বিৎ ফিরল ঈপ্সিতার। ওই আমাদের কলেজের পুরোনো দিনগুলোর কথা। বেশ ছিল বল?
পারমিতা বেশ গম্ভীর ভাবে বলল, কই আর ভালো ছিল! আমার ক্রাশকে সুনয়না শালা বিয়ে করে নিল, আর তুই বলছিস ভালো ছিল? চারজনেই একসাথে হেসে উঠল।
মেলাটা খুব বড় নয়। বিশেষ করে ঈপ্সিতাদের ছোটবেলার নাগরদোলা আর কাঁচের চুড়ির মেলা তো মোটেই নয়। ওইজন্যই বোধহয় গালভরা নাম দিয়েছে এক্সপো। ঈপ্সিতা তো এটাই বুঝতে পারছিল না, লোকে নিউমার্কেটে না গিয়ে মেলায় কেন আসবে! না আছে মেলার ধুলো, না আছে পাঁপড়, তেলেভাজার গন্ধ…বড্ড সাজানো-গোছানো নিখুঁত দোকানগুলো। চারিদিকে তাকিয়ে এটাকে মেলা তো কখনোই বলা যায় না। মেলা বলতেই যেসব দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে তার কিছুই নেই। তবুও লোকের ভিড় আছে। সে তো ট্রেনে বাসেও ভিড় হয়। রচনা বললো, এইজন্যই এক্সপোগুলোতে আসতে এত ভালো লাগে। ইউনিক কালেকশন থাকে। ধুলো নেই, চিৎকার নেই, ছিমছাম।
ওদের বন্ধুদের গ্রুপটা একটা বুটিকে ঢুকেছে। তিনজনেরই শাড়ি কুর্তির খুব নেশা।
ঈপ্সিতা একাই পায়ে পায়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়াল। চাবির রিঙের ওপরে খোদাই করে নাম লেখাচ্ছে। ঈপ্সিতা সামনেটা দাঁড়াতেই অল্পবয়সি ছেলেটি বলল, নেবেন দিদি? কি নাম হবে?
ঈপ্সিতা আনমনে বলে ফেলল, প্রিয়ম।
মুহূর্তের মধ্যেই চেঞ্জ করে বলতে যাচ্ছিল, না, ঈপ্সিতা। কিন্তু কথাটা বলার আগেই কেউ একটা ওর কুর্তি ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। অন্যমনস্ক ঈপ্সিতা সেদিকে তাকাতেই দেখল, একটা বছর দুই-আড়াইএর বাচ্চা ছেলে, ওর জামা ধরে টানছে।
ঈপ্সিতা একটু ইতস্তত করেই বলল, কে তুমি? বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে বলল, মা।
ভিড় থেকে বাঁচাতেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল ও।
বাচ্চাটা দু চোখে জল নিয়ে ডেকে উঠল, মা। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো ঈপ্সিতার। আজ যদি সে বেঁচে থাকত, তাহলে তার বয়েসও প্রায় এরকমই হত।
মুখটা বাচ্চাটার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ঈপ্সিতা বলল কোথায় তোমার মা?
তোমার নাম কি?
বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, পিপুল।
পাপা হারিয়ে গেছে।
ঈপ্সিতা পিপুলের চোখটা মুছিয়ে দিয়ে বলল, বেশ পিপুল চল আমরা তোমার মা, পাপাকে খুঁজে বের করি।
পিপুল আবার কেঁদে ঈপ্সিতার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, মা।
ওকে খুঁজতে খুঁজতেই অনুশ্রী, রচনারা চলে এসেছে। পিপুলকে কোলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঈপ্সিতাকে দেখেই রচনা বলল, এটা কে রে!
পারমিতা গালটা টিপে দিয়ে বলল, ওমা কি মিষ্টি রে দেখতে।
ঈপ্সিতা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হারিয়ে গেছে রে।
অ্যাড্রেস বলতে পারছে না। ভয় পেয়েছে বোধহয়।
রচনা বলল, চল এনকোয়ারিতে গিয়ে দেখি কি হয়।
বাচ্চাটা একটা বেলুন দেখে বলল, মা নেব।
পারমিতা বলল, মরেছে, এ তোকে মা বলছে যে রে। পুলিশি কেসে পড়ে যাবি তো।
সকলের কপালেই চিন্তার ভাঁজ। পিপুল হাতে লাল বেলুন পেয়ে কান্না থামিয়েছে।
এনকোয়ারিতে ঢুকতেই এক রাশভারী ভদ্রলোক বললেন, চারজনে মিলে হারিয়ে যান কি করে।
পিপুল আবার ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল, মা… জল।
রচনা বলল, আসলে একটা অ্যানাউন্স করতে হবে, এই বাচ্চাটা সম্ভবত হারিয়ে গেছে। মানে এর বাবা, মা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
ভদ্রলোক ভারী ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল, মান-অভিমান? স্বামী বুঝি সিগারেট ফুঁকতে গেছে। তাই তার নাম অ্যানাউন্স করে তড়িঘড়ি ডেকে আনার প্রচেষ্টা!
ভদ্রলোক গোঁফের আড়ালে হালকা হেসে বললেন, বেশ বেশ। এমন প্রেম মন্দ নয়। ঈপ্সিতা ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে পিপুলের মুখে ধরে ছিল। ছিটকে উঠে বলল, এটা আমার বাচ্চা নয় দাদা। বিশ্বাস করুন। আমি একে মেলায় পেলাম। ভদ্রলোক নিজের কাঁচাপাকা চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, দেখছেন, মাথার চুলগুলো কিন্তু এমনি পাকেনি। পেকেছে অভিজ্ঞতায়। বাচ্চারা আর কিছু বুঝুক না বুঝুক নিজের মাকে বেশ চেনে। দেখুন পুচকুটা আপনাকে মা বলে ডাকছে। এতজনের মধ্যে আপনাকেই মা বলে কেন ডাকবে বলুন তো। ম্যাডাম, স্বামীর সাথে হাজার রাগ অভিমান হোক, কিন্তু নিজের গর্ভের সন্তানকে নিয়ে রসিকতা করবেন না। কতজন এই মা ডাক শোনার জন্য কাতর হয়ে থাকে, আর আপনাদের মত অত্যাধুনিক মহিলারা এটাকে নিয়ে ছেলেখেলা করেন।
ঈপ্সিতার চোখদুটো লাল, মুখটা থমথম করছে। বিপদ বুঝেই রচনা সামলে নিয়ে বলল, দাদা অফিসে আর কেউ নেই? ভদ্রলোক বললেন, না নেই। মেলা কমিটি জানে কাকে এনকোয়ারিতে রাখা যাবে, তাই আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন।
রচনা বলল, দাদা একটা কাজ করুন, এই বাচ্চাটার বাবা আসলে বরং আপনি এই অ্যাড্রেসে পাঠিয়ে দেবেন। বাচ্চাটার নাম পিপুল। ভদ্রলোক একমুখ হেসে বলল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি অবশ্যই বলব, আপনার গিন্নী রেগে আছে। শিগগির যান।
অনুশ্রী ফিসফিস করে বলল, ঈপ্সিতা, এখানে নিজের অ্যাড্রেস আর ফোন নম্বর দিয়ে বেরিয়ে চল। লোকটার তার কাটা বুঝলি।
ঈপ্সিতা ওদের খাতায় নিজের নাম আর বাড়ির অ্যাড্রেসটা লিখে বেরিয়ে এল। অনুশ্রী বলল, এখন কি হবে?
পারমিতা দাঁত দিয়ে নখ কেটে বলল, থানায় যাবি?
ঈপ্সিতা দেখল মাটিতে বেলুনটা পড়ে গেল।
রচনা বেলুনটা তুলে বলল, পিপুল মস্তান তো ঘুমিয়ে পড়েছে রে। কি হবে!
ঈপ্সিতার গলাটা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে পিপুল।
নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মহিলার কাঁধে মাথা রেখে। একটা হাত ঈপ্সিতার পিঠের ওপরে ঝুলছে। অন্যটা ওর গলাটা জড়িয়ে ধরা।
একটু ভেবে ঈপ্সিতা বলল, রচনা, আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিতে বল তোর ড্রাইভারকে। এতটুকু বাচ্চাকে নিয়ে থানায় ছোটাছুটি করতে পারব না। তাছাড়া বাচ্চাটার খিদেও তো পাবে। যার বাবা, মা এতটা কেয়ারলেস হয়, তারা তো ভুগবেই। খুঁজুক ওরা নিজেদের সন্তানকে।
আমার অ্যাড্রেস দিয়ে গেলাম। যদি মেলায় খোঁজে, তো পেয়ে যাবে।
চল, আগে বাড়ি গিয়ে পিপলুকে কিছু খাওয়াতে হবে। অনুশ্রী একটু চিন্তিত গলায় বলল, আমাদের তো সকলেরই নিজস্ব সংসার আছে, তাই একে তো আমাদের কারোর বাড়িতে নিয়েও যেতে পারব না রে।
কর্তারা তেড়ে আসবে।
ঈপ্সিতা হালকা হেসে বলল, আমি নিয়ে যাব পিপলুকে। ও তো আমাকেই মা ডেকেছে।
রচনা ফিসফিস করে বলল, ঈপ্সি, প্লিজ মায়ায় জড়াস না, কালই হয়তো ওর বাবা-মা যাবে তোদের বাড়িতে। তাই প্লিজ…
ঈপ্সিতা গাড়িতে উঠে পিপলুকে নিজের কোলে শুইয়ে নিয়ে বলল, না রে, মায়া আর কি! নিজেরটাকেই ধরে রাখতে পারলাম না। পাঁচ মাসে পেটের মধ্যেই চলে গেল।
অন্যের বাচ্চাকে আর ধরে রাখব কি করে!
পারমিতা বলল, আচ্ছা ঈপ্সিতা, তুই তো আরেকবার ট্রাই করতে পারতিস!
ঈপ্সিতা অন্যমনস্ক স্বরে বলল, আসলে কি বলতো, সৌরভের সাথে আর ওর ফ্যামিলির সাথে আমার কোনোদিনই বনিবনা হয়নি। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, তারপরে আমি সার্ভিস করি। বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকি। এনিয়ে রোজই সৌরভ আর ওর মায়ের সাথে কিছু না কিছু অশান্তি চলছিলোই। তারপর আমি প্রেগনেন্ট হওয়ার পরে সৌরভের মা বলেছিল, জবটা ছেড়ে দিতে। আমি রাজি হইনি ন্যাচারালি।
তারপরে মিসক্যারেজটা আমাদের নড়বড়ে সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতেছিল।
তবে কি জানিস তো, সৌরভের ফ্যামিলি কিন্তু মিউচুয়াল ডিভোর্সের বিষয়ে কোনো ঝামেলা করেনি। ছেলের আবার বিয়ে দেবে বলেছিল ওর মা।
একটু ঘরোয়া মেয়ে চাই ওদের। আমি ওদের জন্য পারফেক্ট ছিলাম না।
আলতো করে হাসল ঈপ্সিতা। এখন মনে হয় চলে এসে ভালো করেছি। বাবা-মায়েরও তো আমি ছাড়া কেউ নেই বল। বাবার শরীরটাও বেশ খারাপের দিকেই। রচনা সব কিছু ঝেড়ে ফেলার মতো গলায় বলল, যাকগে পাস্ট ইস পাস্ট।
শোন আপাতত তুই পিপুলকে নিয়ে যা বাড়িতে, তারপর কাল সকালে দেখা যাবে।
ঈপ্সিতা কোলে শুয়ে থাকা পিপুলের দিকে তাকাল আরেকবার। সে বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
বাড়ির সামনে এসেই ঈপ্সিতা বলল, আজ তোদের ভিতরে আসতে বললাম না। বাবা-মাকে কনভিন্স করাতে হবে পিপুলকে আজ রাতটা বাড়িতে রাখার জন্য, তাই তোদের ….
ওকে কথাটা শেষ না করতে দিয়েই পারমিতা বললো, ধুর পাগলী এত সংকোচ করছিস কেন, কলেজ লাইফ থেকে তোর বাড়ি কি কম এসেছি! অন্যদিন সবাই মিলে এসে কাকিমার হাতের মাংসের ঘুগনিটা খেয়ে যাব। আজ তুই বাচ্চাটাকে সামলা। কাল সকালে সবাই মিলে আলোচনা করে থানায় যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
ঈপ্সিতা বাড়ির সামনে নামতেই অনুশ্রী ওর হাতে লাল বেলুনটা ধরিয়ে দিল। এই নে, এটা নে, মহারাজ আবার ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করলে দিবি।
পিপুল চোখ রগড়াচ্ছে, তার মানে এবারে উঠবে।
ঈপ্সিতা ওর নরম চুলগুলো সরিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে ফ্ল্যাটের কলিংবেলটা বাজাল।
ঘড়িতে তখন রাত আটটা। কলকাতায় অবশ্য এটাকে রাত বলে না। বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতায় তো এটাকে সদ্য সন্ধে বলা উচিত। কারণ ঈপ্সিতার পাশের ফ্ল্যাটের রিমঝিম বেশ চড়া লিপস্টিক লাগিয়ে, অফ সোল্ডার একটা টপের ওপরে বেশ জমকালো জুয়েলারির নেকপিস আর লম্বা দুল পরে ঈপ্সিতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পিপুলকে ঘুরে ঘুরে দুবার দেখে বলল, রিলেটিভ?
ঈপ্সিতা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। রিমঝিম সম্ভবত কোনো পার্টিতে যাচ্ছে। একই ফ্ল্যাটে পাশাপাশি দীর্ঘদিন থেকেও ঈপ্সিতা কোনোদিন রিমঝিমের মতো স্বাধীনতা পায়নি। সেই ছোট থেকেই বাবার শাসনের ফলে ওকে সন্ধের পর বাড়িতে চলে আসতে হয়েছে।
ঈপ্সিতা জানে বাবা-মা এখন দুজনে জমিয়ে সিরিয়াল দেখছে। আগে শুধু মা-ই সিরিয়াল দেখত, কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পরে মায়ের সাথে রেগুলার দেখে দেখে গত একবছরে বাবারও সিরিয়াল দেখার নেশা হয়ে গেছে।
দরজাটা এখন মা-ই খুলবে। সে ব্যাপারে ঈপ্সিতা নিশ্চিত।
পিপুল বোকার মতো অপরিচিত পরিবেশে তাকাচ্ছে। ঘুম এখনো পুরো ছাড়েনি। ঈপ্সিতারও হাত টনটন করছে, এতক্ষণ বাচ্চা কোলে নেওয়ার অভ্যেস না থাকলে যা হয় আরকি। তবুও ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তো আর লিফটে দাঁড় করিয়ে বলতে পারে না, এই আমার হাত ব্যথা করছে।
তাছাড়া পিপুলের মুখটা এতটা মায়াময়, যে ওকে দেখলেই নিজের সব কষ্ট ভুলে যাবে মানুষ।
যেদিন ঈপ্সিতার মিসক্যারেজ হয়েছিল সেদিন সৌরভ বলেছিল, আসলে কি বল তো, মা হওয়ার যোগ্যতা সকলের থাকে না। তোমার মতো কেরিয়ার সচেতন মহিলাদের তো বিয়ে করাই উচিত নয়। মা হওয়া তো দূর কি বাত।
শরীরের কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা ভুলে ঈপ্সিতা অপলক তাকিয়ে ছিল সৌরভের দিকে। বছরখানেক হলেও তো সংসার করেছিল মানুষটার সাথে।
একবারও মাথায় হাত বুলিয়ে বলেনি, কষ্ট হচ্ছে ঈপ্সিতা!
না, বলেনি ওদের বাড়ির কেউই। বরং দোষারোপের বড় খাতাটা খুলে ধরেছিল ঈপ্সিতার সামনে। তাই ওই বাড়ি থেকে চলে আসার সময়ে একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করেনি ঈপ্সিতার।
মা দরজাটা খুলেই বলল, কি রে ঈপ্সি এত দেরি আজ!
অফিসের কাজে আটকেছিলি? কোলে এটা কে? কমপ্লেক্সের কেউ!
এতগুলো উত্তর একসাথে দেওয়া সম্ভব নয় বলেই পিপুলকে কোলে নিয়ে মাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ঈপ্সিতা। পিপুলকে সোফায় বসিয়ে ও বলল, মা একটু দুধ বিস্কিটের ব্যবস্থা করো। তারপর বলছি সব। পিপুল এদিক-ওদিক দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। ঈপ্সিতা ওর হাতে বেলুনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, পিপুল টয়লেট করবে তো? চলো…
মা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। বাবার নজর এখনও টিভির দিকে, তারমাঝেই প্রশ্ন করল, কোনো কলিগের বাচ্চা?
বাবা-মাকে কি বলবে খুঁজছিল ঈপ্সিতা, বাবার প্রশ্নে মাথার মধ্যে উত্তরটা সেট হয়ে গেল।
আলতো করে ঘাড় নেড়ে বলল, এসে বলছি।
পিপুল এতক্ষণে কথা বলল, মাম্মা, পাপার কাছে যাব।
এতক্ষণ মা বলে ডাকছিল ঈপ্সিতাকে এবারে মাম্মা হল। আর পাপা নামক কেউ আছে সেটাও জানা গেল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ঈপ্সিতা।
কারণ নিজের বাড়িতে পিপুলকে কিভাবে পরিচয় দেবে সেটাই বেসিনের ঠান্ডা জলে মুখ ভেজাতে ভেজাতে ভাবছিল ঈপ্সিতা। বাবা-মা যদি শোনে এক্সপোতে গিয়ে পিপুল হারিয়ে গিয়েছিল আর ঈপ্সি ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, তাহলে বাবা ভয়ে কেঁদেই ফেলবে। মা হাউমাউ করে গোটা কমপ্লেক্সের লোককে ডাকবে। তারপর যদি পিপুল ঈপ্সিতাকে মাম্মা বলে ডাকে, তাহলে আর দেখতে হচ্ছে না। আইনি ঝামেলা এবাড়ির লোকের বড্ড অপছন্দের জিনিস। আইনি ঝামেলায় পড়তে হবে বলেই, বাবা নিজেদের দেশের বাড়ির সম্পত্তি নির্দ্বিধায় ছোট ভাইদের দিয়ে দিয়েছে। এমনকি ঈপ্সিতার ডিভোর্সের আগেও বাবা-মা রাত জেগে বসে থাকত, কোর্ট-কাছারির ভয়ে। নেহাত মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়েছিল বলেই রক্ষে।
মা ডাক দিল, ঈপ্সি, আয়…খাবার রেডি।
পিপুল একটা সোফার পাশে একটা টেডি দেখতে পেয়ে সেটাকে জড়িয়ে ধরে হামি খেতে খেতে বাবার দিকে এগোলো। বাবা পিপুলকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল তোমার নাম কি? পিপুল স্মার্টলি উত্তর দিলো। পিপুলের এখনো সব কথা পরিষ্কার হয়নি। বেশ ভেঙে ভেঙে একটা দুটো কথা বলে ও।
মা বলল, বছর দুই হবে না বাচ্চাটার। ঈপ্সিতা দুধ আর বিস্কুট খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, হ্যাঁ। সব কথা বলতেও পারে না। বললেও বোঝা যাচ্ছে না কি বলছে।
মা পিপুলের গালটা টিপে দিয়ে বলল, তোর কোনো কলিগ কোনো ট্যুরে যাচ্ছে নাকি রে? তাই তুই ওকে নিয়ে এসেছিস?
ঈপ্সিতা অস্বস্তি ভরা গলায় বলল, হ্যাঁ।
মা পিপুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বড্ড মায়াবী রে চাউনিটা। আজ সে থাকলেও এমনই হত, তাই না গো? বাবার দিকে তাকিয়েই কথাটা বলল মা।
বাবা একবার আড়চোখে ঈপ্সিতাকে দেখে নিয়ে বলল, হ্যাঁ রে এ দিন দুই থাকবে তো? এর জামা-কাপড় কোথায়?
ঈপ্সিতা কাঁপা গলায় বলল, ওর মা গুছিয়ে দিয়েছিল, আমিই ভুলে গেছি।
এখন কি হবে!
বাবা বলল, তুই কি যে করিস না। দাঁড়া আমিই বরং সামনের দোকান থেকে দুটো কিনে আনছি।
কিন্তু এই দুদিন পিপুল আমাদের কি বলে ডাকবে বলত?
ঈপ্সিতা জানে বাবা বরাবরই খুব বাচ্চা ভালোবাসে।
আলতো স্বরে ঈপ্সিতা বলল, পিপুল ওটা দাদু।
পিপুল ঈপ্সিতার কথা অনুসরণ করেই বলল, দাদ্দু।
বাবা এসে পিপুলকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, আরেকবার দাদু বল পিপুল… পিপুল আবার বলল, দাদ্দু। বাবার চোখে খুশির ছোঁয়া। মা বেশ গম্ভীর স্বরে বলল, বাড়িতে আরেকটা মেম্বারও আছে। তাকে কি বলে ডাকবে, সেটাও যে শেখাতে হবে এটা বোধহয় সবাই ভুলেই গেছে। ঈপ্সিতা অবাক হয়ে দেখছিল, পিপুলের উপস্থিতিতে মুহূর্তে বদলে গেল ঈপ্সিতাদের বাড়ির পরিবেশটা। টিভি বন্ধ। পছন্দের সিরিয়ালের এপিসোড হয়ে যাচ্ছে বলে কোনো আফসোসও নেই দুজনের চোখে।
বাবা পিপুলকে দিয়ে আরো বার দুয়েক দাদু বলিয়ে বলিয়ে শব্দটার সাথে বেশ পরিচয় করিয়ে ফেলল।
ঈপ্সিতা বলল, পিপুল, এই দেখ, একে দিদা বলবে।
পিপুল হয়তো নতুন শব্দ শেখার ইচ্ছেতেই বলে উঠল, দিদ্দা। মা বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে বলে উঠল, তোর বাবাকে দশবার অভ্যেস করাতে হচ্ছিল, আর আমাকে দেখ কেমন একচান্সে ডাকল।
বাবা মুখ বেঁকিয়ে বলল, আপাতত আমার ওয়ালেটটা দাও, পিপুলের জন্য দু সেট অন্তত জামা কিনে আনি।
মা তখন পিপুলকে কোলে নিয়ে দিদা বলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বাবা সামনের দোকান থেকে পিপুলের জন্য দুটো নরম জামা আর একটা গাড়ি কিনে এনেছে।
গাড়ি পেয়ে মহারাজ গোটা ড্রয়িংয়ে সেই গাড়ির পিছন পিছন ছুটে বেড়াচ্ছে।
ঈপ্সিতার মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। বাবা-মাকে কি সত্যিটা বলে দেবে, নাকি কাল নিজেই গিয়ে থানায় একটা ডায়রি করে আসবে!
দুজন বয়স্ক মানুষের পিপুলকে ঘিরে উন্মাদনা দেখেই মুহূর্তে ওদের হঠাৎ পাওয়া আনন্দটুকুকে কেড়ে নিতে ইচ্ছে করছিল না ওর।
রাতের খাওয়া মিটে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। পিপুল ঈপ্সিতার বিছানায় ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। পিপুলের গায়ের মিষ্টি গন্ধটা এসে ঝাপটা দিচ্ছিল ঈপ্সিতার নাকে। ঘুমন্ত পিপুলের কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল ঈপ্সিতা। নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে। সত্যিই শিশু আর ফুলের আলাদা ক্ষমতা থাকে মন ভালো করে দেবার মতো। আজ অফিস থেকে যখন বেরোচ্ছিল, তখনও ঈপ্সিতা জানত না দিনটা আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা হবে। ঝড়ের মতো ঘটে গেল অসম্ভব সব ঘটনাগুলো। ঈপ্সিতা ভাবছিল, বিয়ে আর করবে না সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে। যতই মা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করুক যে, আবার নতুন করে শুরু কর ঈপ্সি, ঈপ্সিতা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, আর নয়। কিন্তু পিপুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর ওদের নিশ্চুপ একঘেয়ে বাড়িটার এই কয়েকঘণ্টার মধ্যে আকস্মিক পরিবর্তন দেখে ঈপ্সিতা ভাবছিল, একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করলে মন্দ হয় না। বাবা-মাও একটা খেলার সঙ্গী পাবে এই বয়সে। আর ঈপ্সিতা পাবে একাকীত্ব কাটানোর ওষুধ। বেশিরভাগ নির্ঘুম রাত্রি জানে একাকীত্বের যন্ত্রণা কার নাম। ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার কষ্ট কাকে বলে!
পিপুল পাশ ফিরে ঘুমের মধ্যেই মুচকি হাসছিল। ওর হাসি দেখে ঈপ্সিতার ঠোঁটেও হাসির রেখা দেখা দিল। হয়তো বীরপুরুষের ঘুমের মধ্যেই কোনো দুষ্টুমির কথা মনে পড়েছে, তাই ফিক ফিক করে হাসছে ঘুমের ঘোরে।
বাবা-মা যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত পিপুলকে আপন করে নিতে পেরেছে তখন ঈপ্সিতা যদি দত্তক নেয়, তাহলেও তাকে আপন করে নিতে বোধহয় খুব বেশি অসুবিধা হবে না। সেও ঈপ্সিতাকে মাম্মা বলবে, বাবাকে দাদ্দু আর মাকে দিদ্দা বলে ডাকবে।
পিপুলকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল ঈপ্সিতা।
ভোর ভোর ফোনটা ভাইব্রেট করছিল ঈপ্সিতার। কিন্তু আজ যেহেতু সানডে তাই আজ ওঠার তাড়া নেই। তবুও ঘুম চোখে দেখল একটা আননোন নম্বর। সাতটা বাজে, আরেকটু ঘুমোবে ঠিক করেই ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে পিপুলকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল।
আধঘণ্টা পরেই ফ্ল্যাটের বেলটা ঘনঘন বেজে উঠল।
কাজের মাসি তো এতবার বেল বাজায় না, দুধওয়ালাও একবারই বাজায়। দুবার বেল বাজলেই মা দরজা খুলতে খুলতেই চেঁচিয়ে বলে, দুটো পা দিয়েই তো হেঁটে আসতে হয় গো, ডানা তো আর গজালো না এ জন্মে, তাই তুমি একবার বেল বাজালেও হেঁটে আসব, দুবার বাজালেও হেঁটেই আসব। এমনকি পাঁচবার বাজালেও উড়তে পারব না।
তাই এ বাড়িতে যারা নিত্য যাতায়াত করে, কাজের মাসি, রাঁধুনি, দুধওয়ালা, ধোপা এরা মায়ের চিৎকারের ভয়ে একবার করেই বেল বাজায়।
তার মানে যে এসেছে সে অন্তত এবাড়ির চেনাদের মধ্যে পড়ে না।
হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠল ঈপ্সিতার, পুলিশ নয় তো! পিপুলের বাবা-মা পুলিশ নিয়ে আসেনি তো! পাশেই পিপুল ঘুমোচ্ছে জড়সড় হয়ে। ঈপ্সিতা ওর পাশে বড় পাশবালিশটা দিয়ে লাফিয়ে নামল বিছানা থেকে। বাবা-মা দরজা খোলার আগেই ছুটে গেল গেটের দিকে। মা রান্নাঘর থেকেই বলল, তোর বাবা তো এইমাত্র মর্নিংওয়াকে বেরোলো, গিয়েই ফিরে এল নাকি। ঈপ্সিতা দরজার কাছে যেতে যেতে বলল, আমি দেখছি।
দরজাটা খুলতেই যাকে দেখল, ভূত দেখলেও এতটা চমকাত না ঈপ্সিতা।
সামনের মানুষটাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে অবাক চাউনিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ঈপ্সিতাই আগে বলল, তুই? এত সকালে তুই এখানে কি করছিস?
এটা তোর ফ্ল্যাট? তোরা কসবার বাড়ি থেকে এখানে শিফট করলি কবে?
ঈপ্সিতা বলল, সেটা জেনে তোর তো কোনো লাভ নেই! তো হঠাৎ সকাল সকাল কি মনে করে আমার ফ্ল্যাটে এসেছিস সেটা জানালে খুশি হব।
দেখ ঈপ্সি, এতবছর পড়ে আমি যে তোর সাথে ঝগড়া করতে আসিনি, সেটুকু অন্তত তুই বুঝতে পারছিস।
না রে প্রিয়ম, পারছি না। আসলে তুই তো গোঁয়ারের মতো ঝগড়া করা ছাড়া আর কিছুই পারিস না। কথাটা বলেই মুখটা বেঁকালো ঈপ্সিতা।
প্রিয়ম সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, এখনও এমন করেই মুখ বেঁকিয়ে কথা বলিস!
একইরকম আছিস তুই ঈপ্সি। একটুও বদলাসনি।
ঈপ্সিতা গম্ভীর গলায় বলল, তোর চশমা কবে থেকে?
আর সামনের চুলটা অমন ফাঁকা হয়ে গেছে কেন? বউ বুঝি তোকে চুলের মুঠি ধরে খুব টানে?
প্রিয়ম আলতো হেসে বলল, সবাই তো তোর মতো ঝগড়াটে নয়, যে ঝগড়া হলেই চুল ধরে টানবে!
ডাক্তার দেখিয়েছিলাম বুঝলি ঈপ্সি, ডাক্তার বলল, তিনবছর কনটিনিউ চুল টানার ফসল এটা।
ঈপ্সিতা চোখটা নামিয়ে নিয়ে বলল, ওহ তার মানে তোর বউ শুধু আদর করে। ঝগড়া, মারামারি হয় না তাই তো!
ভালো ভালো, তুই যে ভালো আছিস এটা জেনেই খুব ভালো লাগছে রে প্রিয়ম।
বলছি, তুই কি আমায় বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে দিবি ঈপ্সি? আমি একটা প্রবলেমে পড়ে এসেছি তোর কাছে।
ঈপ্সিতা সচেতন হয়ে বলল, ভিতরে আয়।
মা রান্নাঘর থেকেই বলল, কে এসেছে রে ঈপ্সি?
ঈপ্সিতা গলা তুলে বলল, আমার বন্ধু।
প্রিয়ম ঠেঁটের ফাঁকে হেসে বলল, বন্ধু? এখনও তোর শত্রু হইনি বুঝি!
ঈপ্সিতা ওর কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়েই বলল, কোথায় আছিস এখন? পাঁচটা বছর কিন্তু খুব একটা কম সময় নয়! কতকিছু বদলে যায় মানুষের জীবনে।
প্রিয়ম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ঈপ্সিতার দিকে। ফিসফিস করে বলল, জানিস ঈপ্সি, কলেজে যখন যেতিস স্বাভাবিক ভাবেই সবাই যাতে তোকে সুন্দরী বলে তাই বেশ মেকআপ করে যেতিস কিন্তু আজ এমন সদ্য ঘুম ভাঙা, এলোমেলো তোকে দেখে মনে হচ্ছে ভোরের শিউলিফুল। আবার নতুন করে না তোর প্রেমে পড়ে যাই।
প্রিয়মের কথাটা শুনেই বহুদিন পরে আবার ঈপ্সিতার গালে লালচে ছোপ ধরল।
তবুও সামলে নিয়ে বলল, সেটা কিন্তু এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার হয়ে যাবে, সাবধান।
প্রিয়ম সেইভাবেই তাকিয়ে বলল, তোর বর কিছু বলে না?
ঈপ্সিতা আলতো হেসে বলল, বলে তো। বলে সদ্য ঘুম ভাঙা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর না করলে নাকি ওর দিন শুরু হয় না।
প্রিয়ম বলল, তোর বরের সাথেও অমন ঝগড়া করিস, অভিমান করে সাতদিন সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিস!
সামান্য একটা মিথ্যে বলার শাস্তিতে সম্পর্কে ছেদ টানিস? এতদিনের সব উজাড় করা ভালোবাসা ভুলে যাস মুহূর্তে? নাকি মাথায় সিঁদুর সে দিয়েছে ভেবে তাকে ছাড়তে পারিস না। লাভারের সাবস্টিটিউট হয়, তাই না ঈপ্সি, কিন্তু বরের হয় না। তাই তাকে মেনে নিতেই হয়।
ঈপ্সিতা বলল, আর তুইও বুঝি এখনও বউকে মিথ্যে বলিস। বন্ধুদের সাথে লেটনাইট পার্টি সেরে এসে বেমালুম বলিস, জেঠুর জন্য সারারাত নার্সিংহোমে ছিলাম। আসলে কি বল তো প্রিয়ম, তোর বউ তোকে বড্ড ভালোবাসে, তাই এই মিথ্যেগুলোকে হজম করেও তোকে ভালোবাসে।
প্রিয়ম ধীর গলায় বলল, আর মিথ্যে বলি না রে।
ঈপ্সিতা ব্যঙ্গের স্বরে বলল, বাহ, তোর বউ তোকে মানুষ করে দিয়েছে তাহলে। আমি তো তিনবছরে পারিনি।
প্রিয়ম অসহায় গলায় বলল, তোর ছেড়ে চলে যাওয়াটা আমায় বদলে দিয়েছে। জানিস ঈপ্সি, আমি জব জয়েন করার মাস দুয়েকের মধ্যেই শুনলাম, তুইও জব পেয়েছিস। ভাবলাম আরেকবার তোর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। নিচু হয়ে বলি, ঈপ্সি তোকে ছাড়া বাঁচাটা বড্ড কঠিন। কিন্তু সেই সময়েই শুনলাম, তোর নাকি বিয়ের দেখাশোনা শুরু হয়েছে। তুই তো জানিস, রেগে গেলে আমারও মাথার ঠিক থাকে না। আমায় ভুলে তুই ভালো আছিস শব্দটাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য।
মাস দুয়েকের মধ্যে আমিও বিয়ে করে ফেললাম। না রে লাভ ম্যারেজ আর সম্ভব হল না। আমারও অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।
ঈপ্সিতা বলল, হ্যাঁ তোর বিয়ের খবরটা আমাকে দিয়েছিল শান্তনু। হঠাৎই ফোন করে বলেছিল, এই ঈপ্সি, তোদের সত্যি ব্রেকআপ হয়েছে? আগের মতো মিথ্যে রাগ নয়? তুই কি জানিস, প্রিয়ম বিয়ে করতে চলেছে! তোরা কি পাগল নাকি রে! অকারণ সামান্য ইগোর বশে নিজেদের জীবনটা নষ্ট করে দিতে চলেছিস!
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রিয়ম বলল, হ্যাঁ জানি, তুই বলেছিলি, প্রিয়ম বিয়ে করে ভালো থাকবে না রে। আমি ছাড়া ওকে কেউ সহ্য করবে না।
ঈপ্সিতা নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতেই বলল, কিন্তু আমার সেই অলীক ধারণাকে বদলে দিয়ে তুই তো বেশ সুখেই আছিস প্রিয়ম। এতগুলো বছর ধরে সংসার করে প্রমাণ করে দিয়েছিস, তুই লাভার হিসাবে ফেলিওর হলেও স্বামী হিসাবে পারফেক্ট, তাই ওসব পুরোনো কথা বাদ দে।
প্রিয়ম ঘোরের মধ্যেই বলল, বড্ড সংসারী হয়ে গেছিস না রে? আগে তো পুরোনো কথাতেই বাঁচতে চাইতিস।
সবাই অবশ্য বলে, মেয়েরা নাকি বিয়ে হলে বদলে যায়।
তুইও কিন্তু অনেক বদলে গেছিস ঈপ্সি। আগের মতো রাগ করলি না, চিৎকার, দোষারোপ কিচ্ছু না, বড্ড চুপচাপ।
এতটা পাল্টে যাস না ঈপ্সি, যাতে আরো বছর পাঁচেক পরে তোর সাথে দেখা হলে তোকে সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে না হয়।
ঈপ্সিতা দাঁত চেপে বলল, আমার সাথে হঠাৎ তোর কি প্রয়োজন পড়লো সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। জীবনে মুখ দেখবি না বলেছিলি তো, মনে আছে প্রিয়ম।
প্রিয়ম মুখটা নিচু করে বলল, হ্যাঁ সেটা বলেছিলাম যখন তুই বলেছিলি, মিউচ্যুয়াল ব্রেকআপ চাস। কারণ এত দিনের রিলেশনে থেকে তুই বুঝেছিস যে, তোর আর আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই একসাথে সংসার করা জাস্ট ইম্পসেবেল। মনে করে দেখ, তুই আগে বলেছিলিস। ঈপ্সিতা বলল, হ্যাঁ বলেছিলাম। কারণ তুই অ্যাডজাস্ট করতে পারতিস না। পারতিস না বললে ভুল হবে, আমার সাথে হয়তো পারতিস না, এখন তো অনুসূয়ার সাথে বেশ আছিস, তাই না!
ঘাড় নেড়ে প্রিয়ম বলল, তা আছি। আসলে কি বলত, অনুসূয়া তোর মত ঝগড়া করে না।
ঈপ্সিতা তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়ে বলল, তো সাতসকালে এই ঝগড়াটের কাছে এসেছিস কেন?
প্রিয়ম মুচকি হেসে বলল, এই তো এতক্ষণে পারফেক্ট ঈপ্সি। এই টোনটা পাচ্ছিলাম না বলেই না মিস করছিলাম।
ঈপ্সিতা মুখ লাল করে বলল, আগে বল কেন এসেছিস?
প্রিয়ম আলতো করে বলল, তোর সুখের সংসার ভাঙতে আসিনি এটুকু নিশ্চিত বলতে পারি। এসেছি অন্য একটা প্রয়োজনে। পুরোনো সম্পর্কের জের টেনে তোর কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতেও আসিনি।
ঈপ্সিতা বলল, তুই নিজেকে বোধহয় একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছিস। তুই ভাবলি কি করে তুই এলেই আমার সংসারে ভাঙন ধরবে। অমন ঠুনকো সম্পর্ক আমাদের এটাই বা ভাবছিস কেন রে। সৌরভের সাথে আমার বন্ডিংটাও তোর আর অনুসূয়ার থেকে কিছু কম নয় বুঝলি! তাই ওসব টেনশন করিস না।
প্রিয়ম অন্যমনস্কভাবেই বলল, টেনশন করতাম রে তোকে নিয়ে। শুধু মনে হত তুই ঝোঁকের মাথায় বিয়েটা করলি বটে কিন্তু সংসার করতে পারবি কি! আদৌ কি কেউ তোকে বুঝবে! তোর ওই রাগী রাগী মুখোশের আড়ালের মুখটাকে কেউ কি খুঁজবে! আজও হয়তো মনের মধ্যে ভয়টা জমাট বেঁধেই ছিল। কিন্তু এখন তোকে দেখে একটু হলেও নিশ্চিন্ত হলাম। তুই সুখে আছিস দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। জানিস ঈপ্সি, আমি এই ছয়মাস হল কলকাতায় ব্যাক করেছি। আগে তো ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম।
ঈপ্সিতা বলল, হ্যাঁ শুনছিলাম, তুই কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে শিফট করেছিস।
আসলে কি বল তো পালাতে চেয়েছিলাম। তোর থেকে অনেক দূরে। তোর সাথে কাটানো কলকাতার অলিগলির স্মৃতিগুলো ধাওয়া করে বেড়াত ওই সময়টাতে। এমনকি ফুচকা, আইসক্রিম খেতে গেলেও মনে পড়ত তোকে। তাই পালিয়েছিলাম রে ঈপ্সি।
ঈপ্সিতা কঠিন গলায় বলল, বিয়েটা কবে করলি, আমার বিয়ের খবর পাওয়ার পর না আগে!
বার দুই হিসেব করার চেষ্টা করে প্রিয়ম বলল, বাদ দে। বহু বছর আগের কথা। আর তোর খবর আমি বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করিনি জানিস ঈপ্সি। আসলে কি বলত, সবাই জানত তুই আর আমি একটাই ইউনিট। তাই ব্রেকআপের পর সকলের চোখের ওই বিস্ময়ের চাউনিটা সহ্য করা বড্ড মুস্কিলের ছিল।
ঈপ্সিতা শান্ত স্বরে বলল, আদৌ কি কিছু ঘটেছিল আমাদের মধ্যে! রোজকার ঝগড়াই কিন্তু হয়েছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই ইগো নামক নাছোড় বস্তুটা আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। কে আগে ভাঙবের প্রতিযোগিতা করতে করতে দূরে সরে গিয়েছিলাম আমরা।
প্রিয়ম বলল, হ্যাঁ তারপরেই তুই বলেছিলি মিউচ্যুয়াল ব্রেকআপ চাইছি। তোর সাথে থাকা যায় না।
অন্য সময় হলে আমিও হয়তো বোঝাতাম তোকে, কিন্তু একটা অসহ্য অভিমান এসে চেপে ধরেছিল আমাকে। বারবার মনে হচ্ছিল, এটা তুই বলতে পারলি!
কি করে বললি! দূরে চলে যেতে চাইছিস আমার থেকে, মুক্তি চাস আমার বন্ধন থেকে! তাই কোনো আর্গুমেন্টে যাইনি রে ঈপ্সি। তোকে খোলা আকাশে বাঁচতে দিয়েছিলাম। নীরবে সরে গিয়েছিলাম।
ঈপ্সিতা ভারী গলায় বলল, আমিও ভেবেছিলাম, একবারও বললি না, তোকে ছাড়া পারব না থাকতে, তাই কিছুটা জেদের বশেই সরে এসেছিলাম তোর কাছ থেকে।
যাকগে, তুই ভালো আছিস এটাই তো খুশির খবর প্রিয়ম।
প্রিয়ম আলগা হেসে বলল, শুধু আমি একা ভালো নেই, তুইও আছিস। একদিন ভাবতাম তোকে ছেড়ে নিশ্বাস নিতে পারব না আমি। মানুষ সত্যি অভ্যাসের দাস, তাই দেখ সেই তোকে ছেড়েই কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর।
রান্নাঘর থেকে মা ডেকে বলল, ঈপ্সি, পিপুলের জন্য ব্রেকফাস্টে কি বানাব রে!
চমকে উঠে দাঁড়াল প্রিয়ম। ঈপ্সি পিপুল তাহলে তোর কাছে! মেলার ভদ্রলোক তাহলে ঠিক অ্যাড্রেসই দিয়েছেন। ভোরে ট্রেন থেকে নেমে অবধি হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি পিপুলকে।
ঈপ্সিতা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, পিপুল তোর ছেলে!
ছি, প্রিয়ম তুই সেই একইরকম কেয়ারলেস রয়ে গেলি। আগেও আমাকে পার্কে দাঁড় করিয়ে রেখে তুই লেট করতিস, জল কিনতে গিয়ে সিগারেট খেয়ে ফিরতিস। ভাবলাম বিয়ের পর পাল্টেছিস, ছিঃ! নিজের সন্তানকে যে মেলায় হারিয়ে ফেলে তার আবার বাবা হওয়ার শখ।
প্রিয়ম রাগী গলায় বলল, বেশি লেকচার দিস না। আমি ওকে মেলায় নিয়েই যাইনি। আমি কাল কলকাতায় ছিলাম না। একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার বাড়ির কাজের মাসি ওকে মেলায় এনেছিল। তারপর বেলুন কিনতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে পিপুলকে। ভয়ে আমাকে ফোনে কিছু বলেওনি। আমি ভোরে বাড়ি ঢুকতেই কেঁদে কেটে বলল। আর পুষ্পাদিই এই অ্যাড্রেসটা দিল। বললো, মেলার এনকোয়ারি থেকে দিয়েছে।
ঈপ্সিতা তবুও চিৎকার করে বলল, আর মা কি করছিল? হ্যাঁ রে শুধু বাবা হলেই হয়না, কিছু দায়িত্ব থাকে। ওইটুকু একটা বাচ্চা, যদি খারাপ কারোর হাতে পড়ত! তোর লজ্জা করেনা, তুই এখানে এসে পুরোনো ভালোবাসার কথা বলছিস, অথচ একবারও ছেলেটার খোঁজ করলি না।
প্রিয়ম কাঁচুমাচু হয়ে বলল, তোকে দেখে সব ঘেঁটে গিয়েছিল। ঈপ্সিতা, পিপুল কোথায়? তুই ওকে কি মেলাতেই পেলি।
ঈপ্সিতা তখনও একইভাবে বলল, ওর মা নিশ্চয়ই ভীষণ কাঁদছে। তোর মতো হাজবেন্ড যার কপালে জুটেছে, সে যে কাঁদবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আসলে কি বল তো, তোর মধ্যে এই কেয়ারলেস ভাবটাই আমার সব থেকে বিরক্তিকর ছিল। এতগুলো বছর কেটে গেল, তুই কিন্তু সেম রয়ে গেলি।
প্রিয়ম নিজের সমর্থনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই ঈপ্সিতার মা এসে বলল, পিপুল তোর কলিগের বাচ্চা নয়! তুই ওকে মেলায় কুড়িয়ে পেয়েছিস? কই বলিসনি তো!
ঈপ্সিতা বলল, না কলিগের বাচ্চা নয়। এই যে পিপুলের কেয়ারিং ফাদার। নিজের সন্তানকে হারিয়ে ফেলে গল্প জুড়েছিল।
মা একটুক্ষণ তাকিয়ে বলল, কেমন আছো প্রিয়ম?
একটু রোগা হয়ে গেছো আগের থেকে।
প্রিয়ম উঠে মাকে প্রণাম করে বলল, আপনি কেমন আছেন আন্টি?
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সবই তো শুনেছ। আর কেমন থাকব।
মা কোনদিকে কথা এগোতে চাইছে সেটা বুঝেই ঈপ্সিতা বলল, মা পিপুলকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু খাইয়ে দাও। ওর সিনসিয়ার পাপা ওকে নিয়ে যাবে।
মা ধীর পায়ে চলে গেল।
প্রিয়ম বহুবার এসেছে ঈপ্সিতাদের কসবার বাড়িতে। বাবা-মা ভালোই বুঝত ওরা শুধু বন্ধু নয়, তার থেকেও বেশি কিছু। তাই ঈপ্সিতা যখন বাড়িতে বলেছিল,পাত্র দেখো, আমি বিয়ে করব! তখন মা অবাক গলায় বলেছিল, আর প্রিয়ম!
ঈপ্সিতা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ও বরযাত্রী আসবে! বাবা আলতো স্বরে বলেছিল, অভিমান করে হঠকারিতা করছিস না তো ঈপ্সি?
ঈপ্সিতা মনকে শক্ত করে বলছিল, আমি ভেবেই বলছি বাবা। বাবা,মা অবাক হলেও মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর কিছু বলেনি। আজ এত বছর পরে প্রিয়মকে দেখে মা বোধহয় ঈপ্সিতার অতীতের সব বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই সেটা হতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই প্রিয়ম ভাববে, ঈপ্সিতার মতো মুডি মেয়ে সংসার করতে পারেনি। প্রিয়মকে ছেড়ে দিয়ে ও খুব কষ্টে আছে। এসব কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না ভেবেই ঈপ্সিতা বলল, অনুসূয়াকে ফোন করে জানিয়ে দে যে ওকে পেয়েছিস!
প্রিয়ম একটু ইতস্তত করে বলল, সে বলছি’খন।
আগে পিপুলকে দেখি একবার।
ঈপ্সিতা দেখল মা পিপুলকে কোলে নিয়ে আসছে। এখনও পুরো ঘুম ভাঙেনি পিপুলের।
তবুও দুটো হাতে দুটো খেলনা নিয়েই মায়ের কাঁধে মাথা রেখেছে পিপুল। ওকে দেখেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল প্রিয়ম। প্রিয়মকে দেখেই পিপুল ঘুম গলায় বলে উঠল, পাপা।
প্রিয়মের চোখটা ছলছল করছে। ঈপ্সিতা আলতো করে বলল, কাঁদিস না পাগল। ও একেবারে পারফেক্ট আছে। কাল সন্ধের থেকে আমার বাড়িটাকে মাতিয়ে রেখেছে। তুইও ওর সাথে ব্রেকফাস্ট করেই যা এখান থেকে।
প্রিয়ম পিপুলকে বুকের কাছে চেপে ধরে বলল, তোকে কোনোদিন থ্যাঙ্কস বলিনি ঈপ্সি। কিন্তু আজ বলছি রে। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে তুই ফিরিয়ে দিলি। তুই তো জানিস বল, আমি বরাবরই এলোমেলো, একমাত্র পিপুলই আছে যে আমাকে এখনো ঘরমুখী করে রেখেছে, তাকে তুই ফিরিয়ে দিলি।
ঈপ্সিতা একটু নরম গলায় বলল, বয়েস হয়েছে, বাবা হয়েছিস, এত এলোমেলো হলে চলে না প্রিয়ম।
মায়ের সাথে রান্নাঘরের দিকে এগোলো ঈপ্সিতা।
পিছন থেকে প্রিয়ম বলল, এই ঈপ্সি, পিপুল কি আমার নাম বলতে পেরেছিল তোর কাছে?
ঈপ্সিতা ঘাড় নেড়ে বলল, কই না তো। ও তো শুধু পাপা বলেছিল। তার থেকে আমি আন্দাজ করেছিলাম ওর একটা পরিবার আছে।
প্রিয়ম মুখে একটু কৌতূহলের হাসি ফুটিয়ে বলল, তাহলে বোধহয় পিপুলের হাতের চাবির রিংটা তোরই।
ঈপ্সিতা দেখল, পিপুলের একহাতে ছোট্ট টেডি আর অন্য হাতে কালকের মেলা থেকে কেনা কাঠের চাবির রিংটা। যেটাতে গোটা গোটা করে লেখা আছে, প্রিয়ম।
ঈপ্সিতা একটু থমকে গিয়ে বলল, হবে বোধহয় বহুবছর আগেকার।
প্রিয়ম তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, অথচ দেখে মনে হচ্ছে কালই কেনা, তাই না! বড্ড চকচকে, ভীষণ নতুন। প্রথম প্রেমের মতো অমলিন, তাই না?
ঈপ্সিতা উত্তর না দিয়ে চলে গেল।
চাবির রিংটা হাতে নিয়ে প্রিয়ম ফিসফিস করে বলল, জানি আজও ভালোবাসিস। আমিও বাসি রে পাগলী। কিন্তু বলা হবে না আর কোনোদিন। আগের মতো চিৎকার করে আর বলতে পারব না, ঈপ্সিতা শুধু আমার।
ঈপ্সিতার হাতে কর্নফ্লেক্সের বাটি। আর একটা ছোট্ট টাওয়েল। পিপুলকে কোলে বসাতেই পিপুল গালে একটা হামি খেয়ে বলল, মা।
প্রিয়ম একটু চমকে বলে উঠল, তোকে মা বলছে পিপুল?
ঈপ্সিতা একটু লজ্জিত স্বরে বলল, তোর ছেলে তোর মতোই তো হবে। কাকে কি বলতে হয় তাও জানে না। তোর মতোই ভুলভাল। পিপুলকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে ঈপ্সিতা বলল, পিপুল, খেয়ে নাও তো পাপার সাথে বাড়ি যেতে হবে তো। ওখানে তোমার মাম্মা আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
পিপুল চামচের খাবারটা খেয়ে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তুমি মাম্মা।
ঈপ্সিতা আড়চোখে তাকাল প্রিয়মের দিকে।
দেখল সেই আগের মতো অপলক তাকিয়ে আছে প্রিয়ম।
একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল রক্তকণিকায়। অন্যরকম একটা অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছিল মনে। ওর খুব কাছে বসে আছে প্রিয়ম, তবুও ওর নয়, অন্য কারোর স্বামী, পিপুলের বাবা।
ঈপ্সিতা সামলে নিয়ে বলল, কিছু মনে করিস না। ও কাল আমায় দেখে থেকেই মা বলছে। হয়তো অনুসূয়াকে ভেবেছে।
প্রিয়ম আলতো হেসে চেয়ে চুমুক দিয়ে বলল, ওর ভালোনাম কি জানিস?
আয়ুস।
চমকে উঠে ঈপ্সিতা বলল, তুই ওর নাম আয়ুসই রেখেছিস?
প্রিয়ম অসহায় গলায় বলল, তুই যে বলেছিলি ছেলে হলে আয়ুস আর মেয়ে হলে ইরানী…তাই…
অনসূয়া জানে তুই…যতই হোক ও তো পিপুলের মা। এটা তুই ঠিক করিস নি প্রিয়ম। পিপুলের মায়ের পছন্দের নাম দেওয়া উচিত ছিল তোর।
ঈপ্সিতাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রায় চিৎকার করে বলল প্রিয়ম, অনেকক্ষণ কন্ট্রোল করলাম ঈপ্সি আর পারছি না রে। কে মা? অনুকে কি আদৌ মা বলা যায়, সেটা আগে বল।
পিপুল পেটে আসার পরই অ্যাবরশন করবে বলে মেতে উঠেছিল। যাহোক যুদ্ধ করে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখলাম ওর গর্ভের মধ্যে একটাই কন্ডিশনে, বাচ্চাটা হয়ে গেলেই ও ডিভোর্স চায়।
তুই জানিস, পিপুল জন্মের পর কোনোদিন মায়ের দুধ খায়নি। পিপুলের জন্ম আর আমাদের মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স একসাথে হয়েছে। পিপুলের কোনো দায়িত্ব ও নেয়নি। অনুসূয়া এখন হায়দ্রাবাদে। বছরখানেক আগে বিয়েও করেছে সে। মডেলিং, ডান্স এসব নিয়ে মেতে উঠেছিল আগে থেকেই। এখন কি করে জানি না। একবারও ফোন করে ছেলেটার গলা শুনতে চায়নি কোনোদিন। কিসের মা রে ঈপ্সি। শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। তাই পিপুলের বাবা আমি, আর আমিই ওকে মানুষ করব।
হাঁপাচ্ছে প্রিয়ম। দ্রুত কথাগুলো বলে নিশ্বাস নিল প্রিয়ম।
ঈপ্সিতার চোখে জল চিকচিক করছে।
এত কষ্ট করেছিস, তবু আমাকে একবার জানাসনি। ওইটুকু পিপুলকে নিয়ে তুই…তুই তো নিজের জামাপ্যান্টই কখনো ভাঁজ করতে পারতিস না প্রিয়ম।
প্রিয়ম ভাঙা গলায় বলল, ব্যাঙ্গালোরে অফিস, কাজের প্রেসার আর এদিকে পিপুল। খুব মিস করেছি তোকে। শুধু মনে হত, তুই থাকলে আমার সাথে ঝগড়া করেও পিপুলকে কোলে তুলে নিতিস। মা গিয়ে মাসখানেক ছিল। কিন্তু একমাসের বাচ্চা আর কত বড় হয় বল!
ঈপ্সিতা একটা হাত দিয়ে প্রিয়মের হাতটা ধরে বলল, সরি। সরি ফর এভরিথিং। তোর খারাপ থাকার পিছনে সব দোষটা আমার। তোকে চিনেও কেন যে আমি ভুলটা করে ফেললাম!
পিপুল ঈপ্সিতার কোলের কাছে ঘেঁষে বসে আছে।
প্রিয়ম শান্ত স্বরে বলল, বাদ দে আমার অতীত। আপাতত আমি আর পিপুল বেশ আছি। অগোছালো, এলোমেলো। হারিয়ে যাওয়া, ফিরে পাওয়া…
আমরা এবার উঠব ঈপ্সি। আমি চাইনা আমার আর পিপুলের জন্য তোর সংসারে কোনো ক্ষতি হোক।
ঈপ্সিতা একটু ইতস্তত করে বলল, আমারও সংসার নেই। কবেই ভেঙে গেছে সে নরম বালির ঘর। হয়তো একটা ইরানী এসেছিল আমার গর্ভে কিন্তু আমি তাকে রাখতে পারিনি।
জানিস প্রিয়ম, যখন পেটের মধ্যেই বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল, তখন সৌরভদের বাড়ির সকলে আমাকে অপয়া, অলুক্ষণে বলেছিল। এমনকি সৌরভও বলেছিল, আমার মা হওয়ার যোগ্যতা নেই। ওই মানসিক কষ্টের দিনগুলোতে খুব মনে হত ,তুই পাশে থাকলে এরকম হত না। না বুঝেই হয়তো রাত নটায় আমার জন্য ফুচকা নিয়ে এসে বলতিস, খেয়ে নে। মনখারাপ ঠিক হয়ে যাবে ঈপ্সি।
জানিস প্রিয়ম, জীবনে খুব বেশি গোছানো মানুষের দরকার হয় না, বরং ভালোবাসাটা বড্ড জরুরী।
ঐদিনগুলোতে ফেসবুকে খুঁজেছি তোকে।
প্রিয়ম হেসে বলল, তুই যাতে খুঁজে না পাস তাই ফেসবুকে আমার অ্যাকাউন্টের নাম আলাদা আছে।
ঈপ্সিতা কান্না ভেজা গলায় বলল, আমিও অন্য নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছি, যাতে তুই আর জীবনেও আমায় দেখতে না পাস।
প্রিয়ম বলল, তুই একইরকম অভিমানী থেকে গেলি ঈপ্সি।
ঈপ্সিতা বলল,আর তুই সেইরকমই গোঁয়ারগোবিন্দ।
নোনতা জল শুকিয়ে যাচ্ছে গালে, চিবুকে। ঠোঁটের ফাঁকে অল্প হাসির ছোঁয়া নিয়ে ঈপ্সিতা বলল, আমি জানতাম, আমি ছাড়া কেউ তোর সাথে ঘর করতে পারবে না। তখনই বলেছিলাম।
প্রিয়ম ঈপ্সিতার হাতটা টেনে নিয়ে বলল, ঠিক বলেছিলি। তুই ছাড়া সত্যিই আমায় কেউ বোঝে না রে।
ঈপ্সিতা বলল, আমিও পারলাম না রে। ঝগড়াটা মিস করতাম বড্ড। তোর একগুঁয়েমি, পজেসিভনেস, ধরা পড়ে মিথ্যে বলা, ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে কথা বলা…সবকিছু মিস করতে করতে আমার আমিটাকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। জানিস প্রিয়ম, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই চিনতে পারতাম না। পাল্টে যাওয়া ঈপ্সিতাকে জিজ্ঞেস করতাম, কেন পাল্টে গেলি?
আয়নার ঈপ্সিতা উত্তর দিত, ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি বলে।
পিপুল আবার ঈপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা।
প্রিয়ম গাঢ় গলায় বলল, পিপুলের জন্য আবার শুরু করা যায় না!
ঈপ্সিতা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পিপুল আমার কাছে থাক, তুই বেরো। এখন তো তুই খুব তেল দিবি। যেমন প্রপোজের দিন বলেছিলি… তোকে সবটুকু সুখ দিতে চাই। তারপর আবার যাকে তাই। চূড়ান্ত অসভ্য।
প্রিয়ম আলগা হেসে বলল, বেশ পিপুল তবে তার মায়ের কাছেই রইল। বাবা নাহয় রোজ একবার করে এসে মা, ছেলেকে দেখে যাবে।
তবে হ্যাঁ আমি কিন্তু সেদিনও তোকে মিথ্যে বলিনি ঈপ্সি। আজও তোকে দিতে পারি, কৃষ্ণচূড়ার সবটুকু লাল। আমার রক্তের সবটুকু উষ্ণতা। দেবদারু গাছ থেকে সেদিনের মতো পাতা পেড়ে দিতে পারি। আমার প্রিয় চকলেট আইসক্রিমের শেষ কামড়টা আজও তোর।
আমার ঠোঁটের নিকোটিনের গন্ধটা এখনও তোরই আছে। আমার বুকের বামদিকের হৃৎস্পন্দনে এখনো তোর নাম।
ঈপ্সিতা কিছু না বলে পিপুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, আবার আমায় মা বলে ডাক পিপুল। জানিস তো তোর বাবা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল, তুই দিবি না তো।
প্রিয়ম বলল, বাবা-ছেলে আজ থেকে তোর বাধ্য। শুধু আর দূরে সরিয়ে দিস না আমায়।
ঈপ্সিতা বলল, মনে রাখিস, শুধু পিপুলের জন্য। তোকে আমি মোটেই ভালোবাসি না।
প্রিয়ম চাবির রিংটা হাতে নিয়ে বলল, জানি তো।
সমাপ্ত