ক্যানভাস
বারবার হোয়াটসআপটা চেক করছে সুলগ্না। না মেসেজটা তো আসেনি। ডাউনের ট্রেনটা ঝমঝম শব্দে নিরিবিলি স্টেশন কাঁপিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনটাই ধরার কথা ছিল ওদের। বোলপুরের স্টেশন ঘড়ির দিকে তাকালো ও। সুলগ্নার হাতে একটা কালচে মেরুন কালারের ট্রলি ব্যাগ। হরিদ্বার যাওয়ার আগে বাবা এই ব্যাগটা কিনেছিল। তারপর থেকে কোথাও বেড়াতে গেলেই ও এই মেরুন ব্যাগটায় নিজের লাগেজ গোছাতো। আজও যেমন ইউনিভার্সিটির হোস্টেল থেকে ফেরার সময় এই ব্যাগটাতেই সব গুছিয়ে নিয়েছিল। পুরো ছুটিটা বাড়িতে কাটানোর ইচ্ছে ছিল সুলগ্নার। শান্তিনিকেতনে বাংলায় মাস্টার্স করছে সুলগ্না। ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম জাস্ট শেষ হয়েছে ওর। মাস্টার্স হয়ে গেলে ওর পি. এইচ. ডি. করার ইচ্ছে আছে। কোন বিষয়ে করবে সেটাও ভেবে রেখেছে সুলগ্না। ওর ভীষণ পছন্দের সাবজেক্ট মনসামঙ্গল। ও ভেবেই নিয়েছে, চাঁদ সওদাগরের পৌরুষ নিয়ে অনেক রচনা হলেও সনকা নেহাতই অবহেলিত। তাই এই একরোখা চাঁদ সওদাগরের সমস্ত জেদের পিছনে নীরব সমর্থনে যে নারী ছিলেন, তাকে নিয়ে কাজ করতে চায় সুলগ্না। বন্ধুরা বলে, ও নাকি ভীষন ইমোশনাল। একবাক্যে ওদের দোষারোপ বা বিশ্লেষণ মাথা পেতে মেনে নেয় সুলগ্না। সত্যিই ইমোশন শব্দটা ওর মনকে দিনের মধ্যে ছয়-সাতঘন্টা ছেয়ে রাখে। আবেগ না থাকলে বেঁচে থাকার অর্থটাই বা কি!
বন্ধুরা বলে, সুলগ্না প্লিজ, বি প্র্যাকটিক্যাল।
ও মুচকি হেসে বলে, দেখিস একদিন ভীষন ধাক্কা খেয়ে শিখে যাবো।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওর পৃথিবীটা ভীষণ রকম ফাঁকা লাগছে। শুধুই মনে হচ্ছে কেউ ওকে ভীষণভাবে ইগনোর করলো। শুধু ইগনোর, নাকি প্রবঞ্চনা! কথা দিয়েও কথা রাখলো না সে। আজ বাড়িতে বাবা,মা অপেক্ষা করে থাকবে তার সাথে আলাপের আশায়। সুলগ্না খুব বড় মুখ করে বলেছিল, একবার অন্তত আমার পছন্দের ওপরে ভরসা রাখো। দেখো আমি ভুল মানুষকে জীবনসঙ্গী বাছিনি। বাবা গম্ভীর ভাবেই বলেছিল, বিশ্বাস করি বলেই, অত দূরে পড়তে পাঠিয়েছিলাম। বিশ্বাস করি বলেই, এতদিন পর্যন্ত তোমার পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছি। নাহলে বাংলা পড়ার জন্য কলকাতা ছেড়ে তোমাকে শান্তিনিকেতন কেন যেতে হলো, সেটাই তো আমরা বুঝলাম না! বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় সুলগ্না বলেছিল, কারণ আমি বাংলাকে ভালোবাসি, সাথে কবিগুরুকেও। তাই দুটোকে একসাথে পেতেই রাঙামাটির দেশে যেতে চাইছি। বোলপুরের নিরিবিলি স্টেশনে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া ট্রেনের সমান্তরাল লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুলগ্না ফিরে যাচ্ছিলো সেই পাঁচবছর আগের কলকাতার ফ্ল্যাটে। যেদিন জেদ ধরে এসেছিল শান্তিনিকেতনে, সেদিনের বাড়ির পরিস্থিতির কথাটা মনে পড়ছিল ওর।
সুলগ্নাকে ছেড়ে থাকতে বাবা,মা দুজনেরই যে বেশ কষ্ট হবে, সেটা ওদের মুখ থেকেই বুঝতে পেরেছিল ও। কিন্তু খোয়াই, সোনাঝুড়ি ওকে ভীষন টানে। সেই কোন ছোটবেলায় একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিল, তখন থেকেই অদ্ভুত একটা টান অনুভব করে ওখানের মাটির প্রতি। ওই দাড়িওয়ালা ,কবিতা, গান লেখা মানুষটা এই পথ দিয়েই হেঁটেছেন, ভেবেই বারবার শিহরিত হয়েছিল সুলগ্না বড় বয়েসেও। তাই কিছুটা জেদ করেই উচ্চমাধ্যমিকে আর্টস নিয়ে পড়া। বাড়ির পরিবেশ তখন রীতিমত থমথমে। বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মা ফিজিক্স নিয়ে পড়েছে, তাদের মেয়ে হঠাৎ বাংলা কেন! এই প্রশ্নটার ভারেই কলকাতার দুহাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের প্রতিটা ঘরের বাতাস গুমোট হয়ে গিয়েছিল। এমনকি বড়মামা, ছোটপিসি ফোন করে বলেছিল, হ্যাঁ রে সু, আমরা যা শুনছি তা কি সত্যি! তুই নাকি বেঙ্গলি অনার্স পড়তে শান্তিনিকেতন যেতে চাস। কি নাকি বাঙালি ঐতিহ্য.. সংস্কৃতি এসব বলছিস। বড়মামা তো রীতিমত বিরক্ত গলায় বলেছিল, লিটারেচার নিয়ে পড়তে চাও তো ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ো। এসব ফালতু সেন্টিমেন্টকে মাথায় তুলে নাচছো কি করে!
বাড়িতে, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে একই আলোচনা, শেষ পর্যন্ত অরিন্দমদার মেয়েটা বাংলা নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। জয়েন্ট দিলো না, সায়েন্স নিয়ে পড়লো না, শেষ পর্যন্ত বাংলা। আরে লিটারেচারই যদি পড়বি, তো ইংরেজি পড়তে ক্ষতি কোথায়! মায়ের মুখে তখন অন্ধকার নেমেছিল। বাবার গলার স্বরে চূড়ান্ত বিরক্তি। আত্মীয়দের কৌতূহল মেশানো ব্যঙ্গ। সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরেও সেসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সামলে সুলগ্না এসেছিল শান্তিনিকেতনে। যেদিন অ্যাডমিশন নেবার জন্য প্রথম ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছিলো, সেদিন অনেকেই বলেছিল, সে শান্তিনিকেতন আর নেই। পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। সুলগ্নার কানে ওসব কথা পৌঁছাচ্ছিল না। ও তখন গাছ ঘেরা বেদীগুলোতে হাত বুলিয়ে দেখছিল, আর ভাবছিলো, কবিগুরু এগুলো হয়তো ছুঁয়েছিলেন। হয়তো এখানে বসেই সৃষ্টি করেছিলেন, তার অমর সৃষ্টির কোনো একটা। আবেশ বিহ্বল অবস্থাতেই সুলগ্না পায়ে পায়ে ঢুকেছিলো ইউনিভার্সিটির ভিতরে।
বাবা বলেছিল, মানসম্মান সব বিসর্জন দিয়েছো, এবার দেখো কি করবে! আমরা বিশ্বাস করেই তোমাকে এখানে পড়তে আসতে দিলাম। সেটুকুর মর্যাদা রাখলে কৃতজ্ঞ থাকব। বাবার ওই কথাটা আজও কানে ভাসছে সুলগ্নার। নয় নয় করে পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলো ও এই হোস্টেলে। এখানের মাটির গন্ধ, গাছের গন্ধ সব ওর ভীষন পরিচিত। নিজের বাড়ির থেকেও বেশি আপন হয়ে গিয়েছিলো সোনাঝুড়ির বন, ছাতিম তলা, মহুয়ার গন্ধ, পলাশের রং। সেই শান্তিনিকেতনই ওকে এভাবে নিঃস্ব করে দেবে ও একবারের জন্যও ভাবেনি। দশ মিনিট আগে পর্যন্ত সুলগ্না জানতো ও পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে সুখী মানুষ। কয়েকটা মুহূর্তে ওর ভাবনাগুলোকে কালো রং দিয়ে মুছে দিলো আর্য। আর্য তো রঙের খেলা করতেই অভ্যস্ত। ওর ওই রং তুলিতেই তো আবিষ্ট হয়েছিল সুলগ্না।
বিএ সেকেন্ড ইয়ারে পরিচয় হয়েছিল আর্যর সাথে। খোয়াইয়ের ধারে বিশাল একটা ক্যানভাসে ধরছিল একটু দূরে বসে থাকা এক উদাস বাউলকে। সে তখন রুক্ষ মাটিতে বসে একতারায় সুর তুলেছিল। বাউল একমনে বাজিয়ে চলেছিল মন কেমন করা সুর। আর আর্য ওর হাতের রং তুলিতে ফুটিয়ে তুলছিল বাউলের মোহহীন চোখ দুটো। গোটা দুনিয়ার কোথায় কি হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই গায়কের। দুচোখের দৃষ্টিতে উদাসীনতা, কোনো কিছুর প্রতিই যেন কোনো মোহ নেই।
সুলগ্না আস্তে আস্তে সরে গিয়েছিলো চিত্রশিল্পীর দিকে। এক মনে দেখছিল তার সৃষ্টিকে। বাউলের ছেঁড়া তালি মারা আলখাল্লা থেকে শুরু করে তার চুলের জট, সবই নিখুঁত করে আঁকছিল ছেলেটা। সুলগ্নার থেকে বড়জোর বছর চার-পাঁচের বড় হবে। এই বয়েস থেকেই কেমন নির্লিপ্ত যেন। ছবিটা আঁকা হলে অত যত্নের ছবিটা নিয়ে বাউলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও, এটা তোমার উপহার। আমায় রোজ গান শুনিয়ে তৃপ্তি দেবার জন্য। সুলগ্নার বেশ লাগছিলো ছেলেটাকে। তাই নিজেই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় করেছিল সেদিন। কোপাইয়ের অল্প জলে তখন অস্তগামী সূর্য তার শেষ আভাটুকু নিঃশেষ করে দিয়ে যাচ্ছে। পলাশের বুনো গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে এসেছে। ঝুপ করে সন্ধে নামবে তার আগে রক্তাভ আকাশ দিনশেষে প্রদীপ জ্বালাবার প্রস্তুতি করছিল। ঠিক তখনই সুলগ্না ক্যানভাস, রং তুলি দ্রুত হাতে গোছানো ছেলেটার একটা তুলি মাটি থেকে তুলে ধরে বলেছিল, আপনি বুঝি রোজই আসেন এখানে?
ছেলেটা চমকে উঠেছিলো, অপরিচিত গলার স্বরে। এতক্ষন বিভোর হয়ে ছবি আঁকার জন্যই হয়তো একহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুলগ্নার দিকে ফিরেও তাকায়নি ও। তাই এখন আচমকা ফাঁকা জায়গায় ওর গলা শুনেই চমকে তাকিয়েছিল। চা পাতা রঙের ওড়নাটা উড়ছিল সুলগ্নার কাঁধ স্পর্শ করে। এলোমেলো হাওয়াতে অবাধ্য ওড়নার একটা প্রান্ত গিয়ে লাগলো ছেলেটার মুখে। সুলগ্না তাড়াতাড়ি সামলে নিলো ওড়নাটাকে। ছেলেটা অপলক তাকিয়ে বললো, আপনার কি মনে হয়, মোনালিসার ছবিতে যে হাসিটা ছিল ওটা স্বতঃস্ফূর্ত নাকি, লিওনার্দোর মনগড়া? এই যে আপনি এখন অল্প হাসছেন, এটা কি শুধুই পরিচয় করার আগে সৌজন্যের খাতিরে, নাকি ইচ্ছে হচ্ছে বলে। আসলে কি বলুন তো, একজন শিল্পী যেভাবে তার ছবিকে দেখতে চায় সেভাবেই আঁকে। যেমন ধরুন লিওনার্দো মোনালিসার ঠোঁটের ফাঁকে এমন একটুকরো রহস্যময়ী হাসি দেখতে চেয়েছিল, তাই দেখেছিলো। তাই না?
সুলগ্না বোকার মত হেসেছিল। হঠাৎ এসব কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল ও। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষকে প্রথম দেখায় কেউ এভাবে বলতে পারে, এটাই আশ্চর্য লাগছিলো সুলগ্নার। তবুও দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কি এখানেই বাড়ি?
ছেলেটি নরম দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে বলেছিল, এই মাটিতেই জন্মেছি। বাড়ি আপাতত এখানে। নাম আর্য ঘোষাল। এর থেকে বেশি পরিচয় তো নেই।
সুলগ্না বলেছিল, আর এই এতক্ষন যেটা দেখলাম, সেটা তাহলে কি?
আর্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, নেশা। একরাশ ভালোলাগা। অনেকটা প্রাণশক্তি। ছবি আঁকা আমায় জীবনী শক্তি জোগান দেয়। ইদানিং অবশ্য একেই মূলধন করেছি নিজের পেট চালাবার জন্য। কবিগুরুর আশ্রমে সদ্য ঢুকেছি লেকচারার হয়ে। ভেবেছিলাম, স্টুডেন্টদের আঁকা শেখাবো। রং তুলি দিয়ে গল্প লিখবো। উপন্যাসের শেষ পাতা আঁকবো যত্ন করে, কিন্তু দেখলাম, ছেলেমেয়েরা ডিগ্রি জোগাড় করার জন্য ভীষণ আগ্রহী। তাই এ চাকরি কদিন করতে পারবো আমি জানিনা।
সুলগ্না বুঝেছিল, শিল্পীর মনের ক্ষিদে না মেটার আক্ষেপ। সাবধানে বলেছিল, মাথার কথাও কখনো কখনো শুনতে হয়, মন তো এলোমেলো ছোটে, তাকে একমাত্র মাথাই সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই মনের ডাকে পা বাড়ানোর আগে একটু বোধহয় ভাবার প্রয়োজন আছে।
আর্য থমকে দাঁড়িয়ে সুলগ্নার চোখাচোখি স্পষ্ট ভাবে তাকিয়ে বলেছিল, তুমিও বুঝি মাথার কথা শুনেই এই সন্ধেবেলা নির্জন কোপাইয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছো?
তোমার সাবধানী, হিসেবী বুদ্ধি তোমাকে সচেতন করছে না? বলছে না, সুন্দরী ,অল্প বয়সী মেয়ের এমন জায়গায় এসময় আসা মোটেই নিরাপদ নয়। নাকি মন বলছে, হই না একটু দুঃসাহসী, নির্জনতাও আলাদা গল্প বলে, সে গল্প শোনার লোভ ছাড়তে পারোনি বলেই, সব বাধা তুচ্ছ করে ছুটে এসেছো এখানে, তাই না?
সুলগ্না আবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়েছিল। এমন স্পষ্ট বক্তব্যের সামনে নির্বাক হয়েছিল। মনে মনে ভাবছিলো, বেশ ছেলে তো। কোনো অস্পষ্টতা নেই, স্বচ্ছ ভাবে চিন্তা করতে পারে সব কিছু। তাই তো সুলগ্নার উদ্দেশ্যটা এত সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করে দিলো। বন্ধুরা এসময় কেউ আসতে চায়না, খোয়াইয়ের এপারে। বলে, এমাটিতে শুধু সংস্কৃতির জন্মই হয়না, খারাপ মানসিকতার মানুষও জন্মায়। তাই সাবধানতার মার নেই। কিন্তু সুলগ্না ভাবে, এই তো কয়েকটা দিন ও থাকবে শান্তিনিকেতনে। এখানে মাটির গন্ধ, গাছের কলরব সব প্রাণ ভরে না নিতে পারলে আবার তিলোত্তমায় গিয়ে বাঁচবে কি করে। তখন তো এই সঞ্চয় ভেঙেই মনের খোরাক জোগাতে হবে ওকে। তাই যে কদিন এখানে আছে আগ্রাসীর মতোই গ্রহণ করতে চাই।
আর্য বললো, মডেল হতে চাও? বিনা পয়সায়। এমনই ওপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঘন্টা দুয়েক। ঠোঁটে রক্ত জমে যাবে, প্রথমে লালচে হবে, তারপর নীল…অথচ একটা টাকাও পাবে না…..রাজি?
যদি রাজি থাকো, তো আমার নম্বরটা সেভ করে নাও।
আচমকা এমন প্রস্তাবে ঘাবড়ে গিয়েছিল সুলগ্না। তবুও বললো, নম্বরটা বলুন।
আর্য নম্বরটা বলেই বললো, তুমি কিসে ফিরবে? এখন তো রিকশাও আসবে না এখানে?
সুলগ্না দেখলো, সন্ধেপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে গাছের ফাঁকে আকাশের শেষ সীমানায়। জায়গাটাও বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। উদাস বাউল তার শতরঞ্জি আর একতারা গুছিয়ে চলে গেছে নতুন ঠিকানায়। চারপাশটা শুনশান হয়ে গেছে। সুলগ্না এমনিই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সায় উঠেছিলো। তারপর রিকশা থেকে নেমে পায়ে পায়ে চলে এসেছিল এদিকটায়। ভেবেছিল দশমিনিট বসে চলে যাবে। কিন্তু আর্যর ছবি আঁকা দেখতে গিয়েই সেই দশ মিনিটটা দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। গাছের সারিতে ঘুম নামবে একটু পরেই। হঠাৎ করেই যেন নিশ্চুপ জায়গাটা আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। এমনকি পাতা খসানোর আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেছে। আর্যর কথার রেশ ধরেই থতমত খেয়ে সুলগ্না বললো, দেখি, কিছু একটা পেয়ে যাবো নিশ্চয়ই।
আর্য ঠোঁটের ফাঁকে অল্প হাসি ছুঁইয়ে বললো, না পাবে না। এ তল্লাটের সব খবর আমার জানা। যদি আমাকে রেপিস্ট না মনে হয় আর যদি আমার বাইকে চাপলে তোমার বয়ফ্রেন্ড কালকেই আমায় মারতে না আসে, তাহলে আমার বাইকে করে যেতে পারো। বাই দ্য ওয়ে কি যেন নাম বললে তোমার?
আর্যর কথায় আবারও চমকালো সুলগ্না। নিজের নামটা এখনো আর্যকে বলাই হয়নি। সুলগ্না চ্যাটার্জী। বাংলায় অনার্স করছি, বিশ্বভারতী থেকে।
আর্য ব্যাগটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বললো, দারুন একটা লগ্নে তোমার জন্ম তাই তো?
সুলগ্না ঘাড় নেড়ে বললো, আমি ঠিক জানিনা!
আর্য হেসে বললো, তুমি কখনো তোমার নামের পিছনের ইতিহাস শোনোনি? সাধারণত ঠাকুমা, দিদিমারা বলেন, এবাড়ির সবাই অনাহারে মরে যাচ্ছিলো, তোর জন্মের পর হঠাৎ করেই আম্বানির সাথে টক্কর নিতে পারছে। তো তোমার এমন কোনো গল্প নেই?
সুলগ্না এতক্ষনে জোরেই হেসে ফেলেছিলো। সেদিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আর্য বললো, হাসলেও তোমাকে মন্দ লাগেনা। তবে তোমার ঐ চিন্তাগ্রস্ত, দ্বিধা মেশানো ভঙ্গিটি ভীষন ইউনিক। আমি বরং ওটাকেই ধরবো আমার ক্যানভাসে। নিজের রূপের প্রশংসা একজন অপরিচিতের মুখ থেকে শুনতে কেমন একটা লজ্জা লজ্জা করছিল সুলগ্নার। বিশেষ করে সেই চিত্রশিল্পী যখন তার শিল্পীর চোখ দিয়ে সুলগ্নাকে দেখছিল, তখন তো আরও অস্বস্তি হচ্ছিল ওর।
বাইকে স্টার্ট দেবার আগে আর্য বললো, আমিও ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে, যদিও কুকুর,বেড়াল,ব্যাঙ সব খেয়েছি প্রয়োজনে। এসব শোনার পরেও যদি তোমার ছুতমার্গ না থাকে তাহলে বাইকের পিছনের সিটে বসতেই পারো। কারণ জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কালকের কাগজের যদি পড়তে হয়, কোপাইয়ের হাটে একটি মেয়ে…
তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
আর্যর কথাবার্তা বড্ড চাঁচাছোলা। সহ্য করা মুশকিল। শেষের কথাটা শুনেই শিউরে উঠলো সুলগ্না। আর কথা না বাড়িয়ে নিরুপায় হয়েই ওর বাইকের পিছনে গিয়ে বসল। হেলমেট পরার আগে আর্য বললো, একটু তফাতে বসো, নাহলে আবার ভাববে, আমি সুযোগ নিচ্ছি। তবে দেখো, পড়ে যেও না আবার।
সুলগ্না বিরক্ত হয়ে বলেছিল, আপনি বোধহয় নিজেকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমি আপনাকে নিয়ে মোটেই ওরিড নই। চলুন।
কোপাইকে ডানদিকে ফেলে রেখে বাইকটা চলতে শুরু করেছিল। আর্যর ঘাম আর ডিওর গন্ধ মিশে অদ্ভুত একটা পুরুষালী গন্ধ এসে ঝাপটা দিচ্ছিলো সুলগ্নার নাকে। সে গন্ধে রোম্যান্টিসিজিম নেই, আনমনা ভাব আছে। সংসারী নয়, ছন্নছাড়ার গন্ধ আছে। তবুও এই প্রথম এমন কাঠকাঠ কথা বলা ছেলেটাকে সুলগ্নার খারাপ লাগলো না। এক্সট্রা ভালো ভালো কথা বলে মেয়েদের ইম্প্রেসড করার কোনো ইচ্ছেই এর নেই। এর আগে সুলগ্নার যতগুলো ছেলের সাথে নানা সূত্রে পরিচয় হয়েছে, প্রত্যেকের মুখেই প্রশংসার বন্যা বয়ে গেছে, তবুও সুলগ্নার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেছে, এরা নয়। সে আসবে কোনো একদিন, আচমকা। যখন আসবে, তখন আমি তোমায় সিগন্যাল দেব। আজ বোধহয় হঠাৎই সেই সিক্সথ সেন্স জেগে উঠেছে, আর আর্য সম্পর্কে ওকে কৌতূহলী করে তুলেছে। ওর হোস্টেলের সামনে এসে স্পিড কমিয়ে ব্রেক কষে দাঁড়ালো বাইকটা। সুলগ্না নামতেই আর্য বললো, কোনো প্রবলেম হয়নি তো? ভদ্র ছেলের তকমাটা নিজের মাথায় পরাতে পারি তো?
সুলগ্না ঠোঁট টিপে হেসে বলেছিল, সবাইকে এমন লিফট দিলে আর ভদ্র হলেন কোথায়!
হেলমেটটা মাথা থেকে খুলে আর্য বললো, খুব কম মেয়েই আছে পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। পাগলের আঁকা দেখতে গিয়ে সন্ধে নামায়, তাই বেশি কাউকে লিফট দেবার সুযোগ কোথায় পেলাম ম্যাডাম!
যাকগে, আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখো, প্রায় দু আড়াই ঘণ্টা লাগবেই। আমার স্টুডিওতে নয়, ফাঁকা আকাশের নিচেই আঁকবো তোমায়। টবের সাজানো ফুল আঁকার সময় স্টুডিওর আঁকা ব্যাকগ্রাউন্ড মানায়, কিন্তু বন্য ফুলের জন্য মুক্ত খোলা আকাশের প্রয়োজন। সুলগ্নার সাবধানী মন ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছিল। এত সহজে ধরা পড়ে যাবে ও আর্যর সামনে! ও ভাববে মেয়েটা বোধহয় ভীষন হ্যাংলা! তাই কোনোমতে সামলে নিয়ে বললো, ভেবে দেখবো। আজ চলি। পৌঁছে দেবার জন্য ধন্যবাদ দেব না আপনাকে। বড্ড ছোট শব্দ, আর উপকারীর ঋণ শোধ করে দেবার একটা নিখুঁত প্রক্রিয়া। তাই ওটা ডিউ থাক মিস্টার আর্য ঘোষাল।
আর্য চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বললো, তুমি এত কথা বলতে পারো, এতক্ষন বুঝিনি তো!
সুলগ্না হালকা হেসে বললো, সুযোগ দেননি। আপনি বক্তা হিসেবে বেশ ভালো।
আর্য বললো, আর তুমি দুটোই, শ্রোতা এবং প্রয়োজনে বক্তা। বেশ আজ চললাম, অপেক্ষায় থাকবো তোমার রাজি হবার শুভ মুহূর্তের জন্য।
আর্যর বাইকটা শব্দ করে চলে গেল। সুলগ্নাও পায়ে পায়ে হোস্টেলে ঢুকে এসেছিল। কিন্তু এই ঘন্টা দেড়েকের ঘটনায় ও তখন বিহ্বল হয়েছিলো। অন্যরকম একটা অনুভূতি ওকে ঘিরে রেখেছিলো। রুমে ঢুকতেই জয়ন্তী প্রশ্ন করেছিল, কি রে তোকে এমন লাগছে কেন? গিয়েছিলিস কোথায়? আবার দূরে দূরে এলোমেলো ঘুরছিস! হ্যাঁ রে সুলগ্না তুই কি ভুলে যাস, তুই একটা মেয়ে! এত সাহস কিন্তু ভালো নয়। এটা আমাদের কারোরই জন্মস্থান নয়। তাই চারপাশের কেউই আমাদের চেনে না সেভাবে। যখন তখন যেখানে খুশি চলে যাস না।
সুলগ্না নিজের বেডে ধপ করে বসে বলেছিল, এই জয়ী, তোর সাথে সাগ্নিকদার কত বছরের রিলেশন রে?
জয়ন্তী একটু হকচকিয়ের বলেছিল, হঠাৎ? বছর পাঁচেক, কেন রে?
সুলগ্না বললো, প্রথম যেদিন ফিল করলি তুই ওর প্রেমে পড়েছিস সেদিন তোর কেমন অনুভূতি হয়েছিল রে?
কে আগে প্রোপোজ করেছিলিস?
জয়ন্তী হেসে বললো, বুঝলাম। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
ছেলেটা কে? আমাদের ডিপার্টমেন্টের নাকি অন্য কোনো…সুলগ্না ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, বল না, কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
জয়ন্তী বললো, আসলে কি বলতো, ওই অনুভূতিটাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায়না। অদ্ভুত রকমের ফাঁকা লাগে চারিদিক। মনে হয় চারপাশের এত কোলাহল বাদ দিয়ে শুধুই একান্তে তার কথা ভাবি। এবং তার দেওয়া ওই দুলাইনের চিঠি দশবার পড়ি।
আর আর…হ্যাঁ আরেকটা অনুভূতিও হয়, এটা কি ভালোবাসা নাকি আবেগ! নাকি মোহ নামক অনুভূতির আনাগোনা, এই দ্বন্দ্বেও কাটে দু তিনদিন। কিন্তু যখন দেখি ওই মুখটা বারবার ফিরে আসছে দৃষ্টিপথে, মনকে অবশ করে দিচ্ছে তার বলা কথাগুলো, তখন বুঝেছিলাম এর নাম ভালোবাসা। আসলে কি জানিস, প্রেম শব্দটা ভীষন গোলমেলে। এ যে কখন কার কাছে কি রূপে ধরা দেবে, সেটা কয়েক মুহূর্ত আগেও কেউ বুঝতে পারবে না। বুঝবে তখন যখন অবাধ্য মন আর নিজের কন্ট্রোলে থাকবে না।
সুলগ্না বললো, ঠিক যেমন আমার এই মুহূর্তে তোর জ্ঞান শুনতে একদম ভালো লাগছে না। আমি তোকে চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বোঝাতে বলিনি মেরি মা! আমি বলেছিলাম, সাগ্নিকদার সাথে তোর ফার্স্ট আলাপের পর ঠিক কি হয়েছিল। তুই তো প্রেম, ভালোবাসা আর মোহর মধ্যে তফাৎ আঁকতে বসে গেলি!
জয়ন্তী ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বললো, সাগ্নিকের সাথে কি ভাবে যে আমার রিলেশনটা হয়েছিল সেটা আমি নিজেও জানিনা। ওর আর আমার রুচির আকাশ পাতাল পার্থক্য। তারপরেও ওই লোফারটাকে আমি ভালোবাসি। চূড়ান্ত পজেসিভ, পাগলার মত গোঁয়ার, তারপরেও আমি যে কি করে ওকে ভালোবাসি, আমিও জানিনা, তোর কাছে কি ব্যাখ্যা দেব বল!
তবে এটুকু বলতে পারি, ও যদি পজেসিভ না হতো, ও যদি কথায় কথায় গোঁয়ারের মত ঝগড়া না করতো তাহলে হয়তো আমি ওকে ভালোবাসতাম না। সুলগ্না বললো, একি কথা। দুটো কথার মধ্যে তো মারাত্মক কনফিউশন রে! এই বলছিস, এগুলো ওর স্বভাবে আছে তাই ও বিরক্তিকর। আবার বলছিস, এগুলো আছে বলেই নাকি তুই ওকে ভালোবাসিস। ঠিক বুঝলাম না।
জয়ন্তী নিজের চুলটা এলোমেলো করে দিয়ে বললো, এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয়না সু। যার যার সম্পর্কের আলাদা আলাদা মাত্রা হয়। একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্কের গ্র্যাভিটির কোনো মিল থাকে না, বুঝলি? তাই আমার প্রেমের গল্প শুনে তোর কোনো লাভ হবে না। সুলগ্না বললো, জানিস জয়ী, প্রেম কিনা জানিনা, তবে ভালোলাগলো একজনকে। সেনাপতির মত কঠিন অথচ বাউলের মত উদাসী, তলোয়ারের মত ঝকঝকে অথচ কুয়াশার মত রহস্যময়। আমাকে তার কেমন লেগেছে জানিনা, তবে আমার তাকে ভাললেগেছে। নামটা তোকে এখনই বলবো না। যদি আবার তার সাথে আচমকা দেখা হয়, যদি আবার কখনো ওই অচেনা অনুভূতিটা উপলব্ধি করি, তখন না হয় বলবো তোকে। আগে তো নিজে শিওর হই, তারপর ভাবা যাবে।
প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সুলগ্না, স্থির হয়ে। আরেকটা ট্রেন চলে গেলো। বেশ কিছু যাত্রী নামলো, উঠলো খুব কমজনই। ঘড়ির কাঁটায় সময় এগোচ্ছে। ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো হাতের মধ্যেই। আশার আলোটা দপ করে জ্বলে উঠলো সুলগ্নার। তবে কি আর্য? কোনো কারণে কি এসে পৌঁছাতে পারেনি সেটাই বলবে?
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মা কলিং…
ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করছে না সুলগ্নার। মা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে, আর্যকে নিয়ে কটায় বাড়ি ঢুকবে ও। একসাথে ডিনার সারার কথা। ওই ফাঁকেই আর্যর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। বাবার বন্ধুর ছেলে অরিনের সাথে সামনাসামনি হবার আগে, একবার একঘন্টা সময় চেয়েছিলো সুলগ্না। আর্যকে সামনে থেকে দেখলে বাবার পছন্দ হতে বাধ্য। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই আজ আর্যকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কলকাতায়। আর্যও রাজি হয়েছিলো, তারপর কেন যে এমন করলো, সেটাই তো বুঝতে পারছে না সুলগ্না। বেশ কয়েকবার কল করে দেখল, ওর দুটো নম্বরই সুইচড অফ। গত তিন বছরের সম্পর্কে কখনো ওর মুঠোফোন সুইচ অফ ছিল বলে তো দেখেনি সুলগ্না। তাহলে আজ কেন! এটা কি শুধুমাত্র সুলগ্নাকে ইগনোর করার জন্যই। এভাবে অপমান করতে পারলো আর্য ওকে! মানছে আর্য এলোমেলো, নিজের সম্পর্কে উদাসীন। ওদের সম্পর্ক নিয়ে কোনোদিনই খুব সিরিয়াস ছিল না। বলতো, সুলগ্না প্লিজ, সংসার, বিয়ে, বাজার-হাটের হিসেব এসব আমার জন্য নয়। আমার ভালোবাসা বন্ধনহীন কুমারীর বেণীর মত স্বাধীন থাক। তাকে বিনুনি করে বেঁধে দিও না। দায়িত্ব নামক ঘেরা টোপে পড়লেই আমার ভালোবাসা দমবন্ধ হয়ে মারা পড়বে। তাই সুলগ্না আমাকে ভালোবাসলে এভাবেই বাসো, গৃহবন্দি করতে চেও না। আর্যর এসব কথা শুনেও এতগুলো বছর সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সুলগ্না। একটাই বিশ্বাসে ভর করে, যে আর্য মুখে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত কিছুতেই সুলগ্নাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। একজন বয়স্ক মানুষ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাবে? কলকাতা যাবার লাস্ট ট্রেন তো অনেক রাতে, একটু আগে সাড়ে পাঁচটার টা বেরিয়ে গেল তো!
সুলগ্না সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো, একজনের আসার কথা ছিল। ভদ্রলোক বললেন, কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কেটে গেল….কথাটা নিজের মনে বলতে বলতেই হেঁটে চলে গেলেন ভদ্রলোক। এ এলাকায় সব মানুষই কি একটু আনমনা! আর্যর মত এলোমেলো!
অবশ্য এই অগোছালো স্বভাবের জন্যই একদিন ওকে ভালোবেসেছিল সুলগ্না। এখন বুঝতে পারছে আর্যকে ভালোবেসে সংসারী করা হাতের মুঠোয় বরফকে বন্দীকে করার মতোই দুঃসাধ্য।
কিন্তু সেদিন যখন সোনাঝুড়ি বনে ওর ছবি আঁকতে অঁকতে ওকে প্রথম ছুঁয়েছিলো আর্য, সেদিন কেঁপে উঠছিল ওর সমস্ত রক্তকণিকারা। আর্যই বলেছিল, যেদিন তুমি আমার মডেল হতে রাজি হয়ে ফোন করেছিলে, সেদিনই এই জায়গাটা মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম। আর তখনই ভেবেছিলাম, তোমায় বলবো, একটা সবজে পারের কাঁচা হলুদ শাড়ি পড়তে। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়বে চিবুকে, সেখান থেকে পিছলে যাবে তোমার গলায়। আমি আমার দুধ সাদা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলবো তোমার আলটুসি রোদ মাখা আদুরে সেই ছবি। আজ সেই দিন, তোমায় সামনে রেখে উপন্যাস আঁকবো আমি আমার তুলি দিয়ে। তোমার শরীরের প্রতিটা ভাঁজে থাকবে একটা করে রহস্য। ঠিক যেন পাহাড়ি রাস্তার মোড়। একটু আগেও বোঝা যায়না ওপ্রান্তে কি অপেক্ষা করে আছে।
পরক্ষণেই মুখটা গম্ভীর করে বলেছিল, চিন্তা করো না সুলগ্না, আমার আঁকা ছবি দেখে মানুষ নারীকে সম্মান করতে শিখবে। আমার আঁকা ছবিতে তোমাকে আমি একজন নারী হিসাবে আঁকবো, সেই ছবি দেখে মানুষের মনে সেক্স জাগবে না, বরং সম্ভ্রম জাগবে। আর্যর কথার জালে সুলগ্না তখন পুরোপুরি কাত হয়ে গিয়েছিলো। মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছিল, শুধু ওর ক্যানভাসে নয় নিজেকেও বন্দি করবে আর্যর কাছে।
দু একটা পাতা খসার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ হচ্ছিল না তখন। আর্যর হাতের তুলির খস খস আওয়াজ আর সুলগ্নার নিঃশ্বাসের ওঠানামা ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না তখন। সেই মুহূর্তেই অর্ধেক আঁকা নিজের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সুলগ্না বলেছিল, আর্য তুমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করো? প্রেমে পড়ার মানে বোঝো?
অনুভূতিদের অবাধ্য হতে দেখেছো কখনো?
আর্য থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিল, প্লিজ সুলগ্না আমাকে কমপ্লিট করতে দাও। এখন কথা বললে, তোমার মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হয়ে যাবে, ঘেঁটে যাবে সব রঙেরা। আবার চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সুলগ্না। আর্য মন দিয়ে এঁকে চলেছিল ওকে। মাঝে মাঝেই গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো সুলগ্নার কাছে এসে ওর মুখটা একটু বেঁকিয়ে দিয়ে বলছিলো, বড্ড চুলবুলে তুমি। এত চঞ্চল কেন? অ্যাঙ্গেলটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে। যতবার আর্য ওকে স্পর্শ করছিল, ততবারই হৃৎপিণ্ড দ্রুতগামী হচ্ছিল। রং তুলির খেলা যখন শেষের মুখে, আর্যর ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের হাসি, চোখে তৃপ্তির দৃষ্টি, তখনই সোনাঝুড়িকে সাক্ষী রেখে সুলগ্না বলেছিল, বললে না তো, তুমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করো?
আর্য বলেছিল, করি। বাঁধনছাড়া ভালোবাসায় আমি বিশ্বাসী। আমি মনে করি যখনই কেউ তার নিজের গন্ডির মধ্যে ভালোবাসার বিশালতাকে বন্দী করতে চায়, তখনই আবেগ কমে গিয়ে, আকর্ষণ কমে গিয়ে বড্ড আটপৌরে সংসারী হয়ে যায়। নুন,তেলের হিসেবের কচকচানিতে তখন প্রেম নামক শব্দের মাধুর্য হারায়। তাই ভালোবাসাকে কখনো সুতো দিয়ে বাঁধতে নেই। লাটাই, সুতো ছাড়া উড়তে দাও আকাশে। দেখো সেখানে মনের টান থাকবে, ফিরিয়ে আনার আকুতি থাকবে, আবার মিলনের ইচ্ছে থাকবে…আর যদি লাটাইয়ে সুতো বেঁধে তাকে ওড়াও তাহলে তুমি তো জানোই এ আমার হাতে বন্দী, তাই তাকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা থাকবে না। ভালোবাসাটা তখন কেজো কথার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আমি মনে করি, বিয়ে হলো ভালোবাসার মৃত্যু, হয়তো তোমার মতে বিয়ে ভালোবাসার পরিণতি। কিন্তু আমার লজিক অন্য। দিনরাত গায়ে গায়ে ঘষাঘষি লাগলে চামড়া উঠে গিয়ে খড়ের চালটা বেরিয়ে পড়ে। তখন সে সৌন্দর্য হারায়। মাঝে মাঝে দেখা হওয়ার আকুতি থাকে না। হাতের নাগালে পাওয়া জিনিসের প্রতি যেমন মানুষের আকর্ষণ কমে যায়, তেমনি দিনরাত একটাই ছাদের নিচে কাটাতে কাটাতে তারাও আকর্ষণ হারায়। তখন ভালোবাসার সমার্থক হিসাবে অভ্যাস, কর্তব্য, প্রয়োজন এগুলো এসে ভিড় করে। তাই সুলগ্না তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমায় কোনোদিন নিজের করে পেতে চেও না। আমি ভীষণ লাগাম ছাড়া, বড্ড অবাধ্য। আমায় নিয়ে তোমার দশটা-পাঁচটার সংসার হবে না গো। আজ আমি গেস্ট লেকচারার। কাল হয়তো আমি বেকার। তখন তোমার সংসারের চাল বাড়ন্ত। অথচ তুমি দেখবে তোমার স্বামী, দুটো বিস্কিট খেয়ে আপন মনে রং তুলি দিয়ে তৃপ্ত একটা পরিবারের ছবি আঁকছে। অসহ্য হয়ে উঠবে তোমার জীবন। এসব ভাবনা ছেড়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করো।
সুলগ্নার সামনে তখন আর্যর আঁকা নিখুঁত ছবি। শাড়ির প্রতিটা ভাঁজে ফুটে উঠছে স্নিগ্ধ যৌবন। আর সুলগ্নার ভিতরে চলছে তোলপাড়। বাঁধ ভেঙে বন্যার জল ঢুকে পড়েছে ওর মনে, দুকূল ছাপিয়ে প্লাবিত করে দিচ্ছে ওকে। আর্যর বিয়েতে এত আপত্তি শুনেও সুলগ্নার মনে হচ্ছে, এই সে, যাকে ও এতদিন খুঁজেছে মনে মনে।
সুলগ্না আর্যর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, উপায় নেই আমার আর ফেরার। তোমার হাতে আমি অলরেডি বন্দী হয়ে গেছি, এখন যদি ফিরিয়ে দাও, জানিনা কি করবো!
আর্য আরেকটা হাত রেখেছিলো সুলগ্নার হাতে। বলেছিল, এই প্রথম কেউ এসব শোনার পরেও আমাকে ভালোবাসতে চাইলো! ফিরিয়ে দেব এমন সাধ্য কোথায়? আমিও যে ভালোবাসার কাঙাল। তবে আমি দায়িত্বকে বড্ড ভয় করি সুলগ্না। তাই ভালোবাসতেও ভয় আমার।
সুলগ্না আর্যর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, যদি এ সম্পর্কের সব দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিই! যদি এ সম্পর্ককে স্থায়ী করতে সবটুকু এফর্ট আমি দিই, যদি কোনোদিন দোষারোপ না করি, তাহলে কি তোমার আপত্তি আছে আর্য?
আর্য হেসে বলেছিল, এভাবে সম্পর্ক তৈরি হয়না সুলগ্না। দু তরফ থেকেই সমান টানের দরকার। আগে আমরা ভালো বন্ধু হই, তারপর দেখবো আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ঠিক কতটা তৈরি হলো! সুলগ্না অসহায় গলায় বলেছিল, বেশ তবে তাই হোক।
আর্য বলেছিল, বন্ধুত্বের সূচনায় একটা অঙ্গীকার করতে হবে। আমাদের দুজনের মধ্যে যদি কেউ একজন কথা না রাখতে পারি, তাহলে অপরজন দোষারোপ করতে পারবে না। সুলগ্না হাসতে হাসতে বলেছিল, বন্ধুত্বও শর্ত সাপেক্ষ? বেশ মেনে নিলাম। এরকম নানা শর্ত শুনেই জয়ন্তী বলেছিল, এটা কিন্তু আদৌ ভালোবাসা নয় সুলগ্না। এটা একতরফা ভালোবাসা। আমার তো মনে হয় না আর্য কোনোদিনই তোকে ভালোবাসবে। যে ছেলে প্রোপোজের সময় এত টালবাহানা করে, সে আর যাইহোক নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে পারে না। শিল্পীদের এমন অনেক গল্প শুনেছি। এরা কিন্তু কোনোদিন সংসারী হয় না। তোর ক্ষেত্রে আঙ্কেল, আন্টি সেটা কি মেনে নেবে! আর কতদিনই বা তুই ফুল এফর্ট দিয়ে এই উরণচন্ডীকে ভালোবাসবি রে? এত তোর সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর মূল্যই দেবে না। তোর মনের খবরই নেবে না।
সুলগ্না আনমনে বলেছিল, তুইই তো বলেছিলি, সকলের ভালোবাসার সংজ্ঞা এক হয় না। হয়তো আর্য আমাকে এমন ভাবেই ভালোবাসতে চায়। বিশ্বাস কর, আমি ওকে এমন ভাবে বাঁধবো, যে ও কিছুতেই সে বাঁধন খুলে বেরোতেই পারবে না। এত এত গিঁট দেব, যে গিঁট খুলতে ওকে সাতজন্ম কাটাতে হবে। জয়ন্তী বলেছিল, গিঁট না খুলে এক নিমেষে কাটাও যায় রে। দেখিস কষ্ট পাস না। তুই যেমন ইমোশনাল মেয়ে, তাতে কাউকে একবার ভালোবাসলে সহজে ভুলতে পারবি না। অকারণে কষ্ট পাবি। তাই এত কিছু বললাম।
সুলগ্না ভাঙা গলায় বলেছিল, হয়তো তুই ঠিক বলছিস, কিন্তু কি জানিস, প্রেম শব্দটার মধ্যেই একটা নিয়ম ভাঙার গল্প লুকিয়ে আছে। আরেকটা কথা তো মানবি, উপন্যাসের শেষ পাতা সব সময় মিলনান্তক হয় না। এত হিসেব করে ভালোবাসা যায় না। আমি আর্যকে অলরেডি ভালোবেসে ফেলেছি। এখন ওর থেকে সরে আসতে গেলেও কষ্ট পাবো, তার থেকে চেষ্টা করে দেখি, আমার জোর কতটা! জয়ন্তী হেসে বলেছিল, প্রতিযোগীতায় নামছিস, চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে, তাই আশীর্বাদ করি তোকে। সুলগ্না হেসে বলেছিল, পেন্নাম ঠুকতে পারবো না।
তিন বছরে বহুবার সুলগ্না আর্যর মডেল হয়েছে। বিভিন্ন ভঙ্গীতে ওকে ক্যানভাসে বন্দী করেছে আর্য। আর কোপাইয়ের পাড়ে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে কথা দিয়েছে, এসব ছবি কোনোদিন ও এক্সিবিশনে নিয়ে গিয়ে বেচবে না। আর্য সুলগ্নাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারি, কর্তব্য, দায়িত্ব শব্দগুলো আমার কাছে দুর্বোধ্য হতে পারে, কিন্তু নিজের ভালোবাসা বেচে দেব, এতটা অকৃতজ্ঞ আমি নই। সুলগ্নার দিনগুলো কাটতো পড়াশোনা আর আর্যর ভাবনায়। সব সময় যে আর্যর সাথে কথা বলতে পারে এমন নয়, বেশির ভাগ সময় ফোন করলেই আর্য বলে বিজি আছে। হয় আঁকছে, নয় ক্লাসে আছে, নয়তো কোনো এক্সিবিশনে। সুলগ্না অপেক্ষা করতো ওর ফ্রি হবার। কখনো সময় করে আর্য আর সুলগ্না চলে যেতো শহর থেকে অনেকটা দূরে। আর্যর বাইকে চেপে লং রাইডে যেতে যেতে অনেক বকবক করতো ওরা। সুলগ্না আলগোছে জিজ্ঞেস করেছিলো, সত্যি করে বলো, আমায় ভুলে থাকতে পারবে?
আর্য দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলেছিল, পারবো না। তুমি কিন্তু সেই শর্তেই আমায় ভালোবেসেছিলে সুলগ্না, যে আমায় কখনো সংসারী করতে চাইবে না। জনবিহীন জায়গায় গিয়ে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সুলগ্না। আর্য ওকে এঁকেছে মনের মত করে। তিনবছরে যে কত ছবি এঁকেছে সুলগ্নার তার কোনো ঠিক নেই। হিসেব করতেও চায়নি সুলগ্না। ও শুধু চেয়েছিল, আর্যর অভ্যাস হয়ে যেতে। অবসরের সঙ্গী নয়, সর্বক্ষণের ভাবনায় থাকতে চেয়েছিল। মাস্টার্স ভর্তি হবার পর থেকেই মা অরিনের সাথে আলাপ করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অরিন বাবার ছেলেবেলার বন্ধুর ছেলে। এতদিন নাকি বিদেশে কাটিয়ে সে কলকাতায় ফিরে এসেছে। নামি চাকরি, দামি ফ্ল্যাট, সুপাত্র অরিনকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছিলো না মা। সুলগ্না বলেছিল, আমি পি.এইচ.ডি করতে চাই। বাবা পর্যন্ত বলেছে, বিয়ের পরেও লোকে পি. এইচ.ডি করে। তাছাড়া রেজিস্ট্রি করে রাখতে সমস্যা কোথায়। তারপর তুমি পড়ো না যত ইচ্ছে। অরিনের সাথে পরিচয় করার আগে, বা সম্পর্ক বাড়ানোর আগে একবার অন্তত আর্যর পরিচয় করাতে চায় বাবা, মায়ের সাথে। সুলগ্না নিশ্চিত, আর্যকে দেখলে ওদের পছন্দ হবেই। হয়তো আর্য অরিনের মত বড়লোক নয়, অত বড় জব করেনা, কিন্তু আর্যর মত সৎ, সাচ্চা মানুষ কজন আছে!
মাস্টার্স কমপ্লিট হবার মুখেই আর্যকে বলেছিল, একবার যাবে কলকাতা?
আর্য হাসি মুখে বলেছিল, তুমি কি করে জানলে আমি কলকাতা যাবো কয়েকদিনের মধ্যেই। অবাক হয়ে সুলগ্না বলেছিল, আমি তো জানিনা, আমি তোমাকে আমার বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করাতে চাইছি।
ওরা আমার বিয়ে দিতে চায় আর্য।
আর্য হেসে বলেছিল, ভালো তো, করে নাও। আমায় নিমন্ত্রণ করো কিন্তু।
চমকে উঠেছিলো সুলগ্না। বিশেষ করে গত সপ্তাহে আর্যর স্টুডিওতে ও নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল। তারপরেও আর্য যে এভাবে বলতে পারে জাস্ট ভাবতেই পারছিল না। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে সুলগ্না বলেছিল, সেদিন সন্ধের সব অনুভূতিগুলোকে বুঝি তুমি অস্বীকার করতে চাও?
আর্য বিরক্ত হয়ে বলেছিল, সেদিনের শারীরিক খেলায় তোমার সায় ছিলনা বলছো? আমার তো মনে হয়েছিল, তুমিও সমান ভাবে এনজয় করছো।
সুলগ্না বলেছিল, আমি তো অস্বীকার করিনি সে কথা। কিন্তু ঐদিনের পর থেকে আমি আর অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী করার কথা ভাবতেই পারছি না। তাছাড়া আমি তোমায় ভীষন ভালোবাসি আর্য। আচ্ছা যদি তোমায় বিয়ে করেও কোন দায়িত্ব নিতে না হয়, তাহলে তোমার আপত্তি নেই তো। আর্য একটু ভেবে বলেছিল, পরে জানাবো।
সুলগ্না অসহিষ্ণু হয়েই বলেছিল, আর তো সময় নেই। অন্তত আমার পরিবারের সাথে পরিচয়টা করো তুমি। তারপর তোমার পরিবারের সাথে দেখা করিও আমার।
আর্য নিমরাজি হয়ে বলেছিল, কবে যেতে হবে কলকাতা?
সুলগ্নার ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটেছিল। বলেছিল নেক্সট শনিবার। আমার এক্সাম শেষ। ওইদিন সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরে সোজা কলকাতা। ডিনার করতে করতে আমাদের কথা বলবো ওদের। আর্য বলেছিল, বেশ ওই সময় স্টেশনে চলে আসবো।
এক্সাম ভালোই দিয়েছিল সুলগ্না। পড়াশোনাতে ও বরাবরই ভালো। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
সব গুছিয়ে হোস্টেল থেকে বেরিয়েই আর্যকে ফোনটা করেছিল। ফোনটা রিং হয়ে গিয়েছিল। সুলগ্না ভেবেছিল, তার মানে ও রাস্তায়। কিন্তু স্টেশনে এসে ট্রেনটা মিস করার পরে ভুল ভেঙেছিলো। বিশেষ করে যখন আর্যর ফোনটা সুইচ অফ দেখলো তখনই বুঝলো, ভুল হয়ে গেছে। সত্যিই আর্য ভালোবাসার মানে বোঝেনা। দায়িত্বর মানে বোঝা ভাবে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আর্যর স্টুডিওতে গিয়েছিল সুলগ্না। স্টুডিও পরিষ্কার করে যে ছেলেটা সে জানালো, আজ সকালেই তো দাদাবাবু দিল্লি চলে গেছে, একটা আর্ট এক্সিবিশন আছে বোধহয়।
হাতের ব্যাগটা মাটিতে রেখে নিঃশ্বাস নিয়েছিল সুলগ্না।
মনে পড়ে যাচ্ছিল জয়ন্তীর কথাগুলো। এটা ভালোবাসা নয় রে। অনেকটা এগিয়ে পিছিয়ে আসা বেশি কষ্টের। সেদিন কথাগুলো গুরুত্বহীন মনে হয়েছিল। আজ মনে হচ্ছে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেল ও। স্টুডিওটার কাঁচের জানালার দিকে আরেকবার তাকালো সুলগ্না। ওই স্টুডিওতে সাজানো আছে ওর অন্তত গোটা পনেরো ছবি। হয়তো বেশিই হবে। সুলগ্না যতবার মিট করেছে আর্যর সাথে, ততবার আর্য ওকে এঁকেছে নতুন রূপে। মাত্র দিন দশেক আগেই ঘু ঘু ডাকা নিঝুম দুপুরে নিজেকে উজাড় করে নিঃস্ব হয়েছিল ও। মনে হয়েছিল, গোটা মনটা যাকে দেওয়া যায়, সামান্য তুচ্ছ শরীর সেখানে কি এমন বাধা হয়ে দাঁড়াবে! তখনও সুলগ্না বিশ্বাস করত, আর্য মুখে যতই বলুক, দায়িত্বে ওর বড় ভয়, কিন্তু ওকে ছেড়ে থাকার ক্ষমতা আর্যর নেই। আজ এই মুহূর্তে বুঝতে পারলো, তিন বছর ধরে এত ভালোবেসেও আর্যর মনে ও একটুকরো জমি তৈরি করতে পারেনি। তাই ওর সাথে কলকাতায় ওদের বাড়িতে যাবে কথা দিয়েও দিল্লি চলে যেতে পারলো। তাছাড়া এই দিল্লি যাওয়াটা ওর নিশ্চয়ই আগেই ঠিক ছিল। তারপরেও একগাদা মিথ্যে বলেছিল সুলগ্নাকে। শান্তিনিকেতন ওকে পূর্ণ করার বদলে, এখানের মাটির মতোই রিক্ত করে দিলো। শান্তিনিকেতন শব্দটাকে ভালোবেসেছিল শুধু কবিগুরুকে ভালোবেসে। আজ ঘৃণা করলো, আর্যকে ভালোবেসে। এর থেকে কলকাতায় পড়লেই ভালো হতো। ছুটিতে এসে প্রাণ ভরে নিয়ে যেত এখানের গন্ধ, সেটাই বোধহয় ভালো ছিল। এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতেই হোস্টেলে পৌঁছালো।
ফোনটা আবার ভাইব্রেট করলো।
কান্নায় ভেঙে পড়তে ইচ্ছে করছে ওর। মাকে সবটা বলতে ইচ্ছে করছে। কষ্টে মোচড় দিচ্ছে বুকের ভিতরটা। তবুও মনকে শক্ত করে, গলাটা স্বাভাবিক রেখেই ফোনটা রিসিভ করলো সুলগ্না। মা, আমি আজ ট্রেন মিস করেছি। কাল ভোরের ট্রেন ধরবো।
মা একটু থমকে বললো, আর আর্য?
কষ্ট করে একটু জোরেই হাসলো সুলগ্না।
আর্য বলে কেউ নেই মা এখানে। ওটা শুধু তোমাদের চমকে দেবার প্ল্যান ছিল। আমি একাই ফিরছি।
মা একটু থেমে বললো, কষ্ট পাস না। মানুষের জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে, যেটার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়না। তবুও মানুষকে চলতে হয়। ঐজন্যই তো বলি, ডেস্টিনি বলেও একটা কথা আছে। আমরা যত শিক্ষিতই হয়ে যাই না কেন, ভাগ্যকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের নেই সু।
কাল ভোরেই চলে আয়। আমরা তোর জন্য ওয়েট করছি। তোর বাবাকে আমি বুঝিয়ে বললেই, সে আর রেগে থাকবে না তোর ওপরে।
সুলগ্না অস্ফুটে শুধু ডাকলো, মা।
পাশ থেকে জয়ন্তী বললো, পাগলী, মায়েরা সব বোঝে রে। আমিও কাল বাড়ি যাচ্ছি। তাহলে একসাথেই বেরোবো বুঝলি।
অনেকক্ষন দমবন্ধ করে রেখে এতক্ষনে সুলগ্না নিজের বিছানায় বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। জয়ন্তী মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কাঁদ, অনেক নোনতা জল জমেছে তোর চোখে। তিনবছরের ইগনোরে এটুকু তো কাঁদতেই হবে তোকে। নতুন জীবন শুরুর আগে, পুরোনো সবটুকুকে ধুয়ে ফেলে দে।
সুলগ্না কান্না ভেজা গলায় বলল, সত্যিই কি ভোলা সম্ভব?
জয়ন্তী আস্তে আস্তে বললো, একজন মা যদি সন্তান শোক ভুলে আবার বাঁচতে পারে, তাহলে তুই পারবি না? ভেবে দেখিস তো, একতরফা ভালোবাসা ছাড়া ওটা আর কি ছিল? এমন একটা স্মৃতি খুঁজে বের কর, যেদিন আর্য তোকে মিস করেছে, বারবার ফোন করেছে, অস্থির হয়েছে তোকে একবার দেখার জন্য….খোঁজ খোঁজ সু। তোর হাতে এখন অফুরন্ত সময়। খুঁজে দেখ, ওপ্রান্তে কি আদৌ কিছু ছিল? নাকি একজন ইনোসেন্ট, সুন্দরী মেয়েকে মডেল করার আগ্রহ ছিল। অথবা অবসর বিনোদনও বলতে পারিস। খোঁজ সু…মনের গভীরে ডুব দিয়ে দেখ।
সারারাতের শেষে ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগেছিল সুলগ্নার। জয়ন্তী ডাকে ধড়ফড় করে উঠে রেডি হয়ে নিলো। ফিরতে হবে ওকে। শান্তিনিকেতনের মোহ কাটিয়ে ফিরতে হবে। সোনাঝুড়ি, খোয়াই, ছাতিম তলার সাথে আড়ি করে ফিরতে হবে কল্লোলিনী কলকাতায়।
বাড়িতে ঢুকতেই মা জড়িয়ে ধরে বলল, পি এইচ ডি এখান থেকে করবি তুই। তোর বাবা অরিনের বাবাকে সব বলেছে। ওনারা রাজি।
সুলগ্নার ক্লান্ত লাগছিলো। আবার একটা নতুন মুখ। আবার কিছু অভিনয়ের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। বিধস্ত মন নিয়ে প্রতিবাদের জোরও দেখাতে পারলো না ও।
কাল বিকেলেই নাকি অরিনের সাথে পরিচয় হবে ওর। অরিন নিজেই আসবে সুলগ্নাকে দেখতে। খুব ছোটবেলায় কোনো একটা অনুষ্ঠানে বোধহয় দেখেছিলো ছেলেটাকে। একটু বোধহয় নাক উঁচু। আর্যর মত বেখেয়ালি নয়। নিজেই নিজের মনে একটু হেসে নিলো সুলগ্না। যাকে তিনবছরেও চিনতে পারলো না, সে কতটা উদাসীন তার বিচার করছেই বা কি করে ও!
অরিন ছেলেটা বেশ স্মার্ট। কথাবার্তায় চৌখস। বাবার সাথে নিজের ফিউচার নিয়ে আলোচনা করছিল ও। দুচারটে কথা কানে এলো সুলগ্নার। শেষ পর্যন্ত অরিনের সম্মুখীন ওকে হতেই হলো। যাকে ভালোবাসলো তাকে পেলো না আপন করে। একজন অপরিচিত মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে ওকে। সে পছন্দ করবে, দৃষ্টি দিয়ে মাপবে হয়তো।
মা এসে বললো, তুই রেডি তো? অরিনকে এঘরে নিয়ে আসছি।
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই মা গিয়ে বলল, চলো সুলগ্নার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।
বুকের ভিতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে সুলগ্নার। বারবার মনেপড়ে যাচ্ছে আর্যর মুখটা।
হাই, আমি অরিন। নিজের হাতটা প্রসারিত করে বললো ছেলেটা।
সুলগ্না সামলে নিয়ে বললো, বসুন।
অরিন বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বললো, আমি কি তোমায় পার্সোনালি কয়েকটা কথা বলতে পারি?
মা বেরিয়ে যেতেই অরিন স্পষ্ট ভাবে তাকালো সুলগ্নার দিকে। ধীরে ধীরে বললো, আমি তোমার ছবি দেখেছি। ছবি দেখেই তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার ভালোলাগাটাই তো শেষ কথা নয়, তোমার মতামতটা ভীষণ জরুরী। আর তুমি যেহেতু বাঙালী কালচারে বড় হয়ে উঠেছো, তাই আমিও কয়েকটা কথা তোমার কাছে ক্লিয়ার করতে চাই। তারপর তুমি নিশ্চিন্তে মতামত দিও।
সুলগ্না তাকিয়ে দেখলো, অরিনের চোখে অস্বস্তি। একটু যেন দ্বিধান্বিত। একবার জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে অরিন বললো, আমরা কি বাইরে কোথাও বসে কথা বলতে পারি? সুলগ্না বললো, এখানেও কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বলতে পারেন।
অরিন বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের আঙুলটা মটকে বললো, সুলগ্না, আমি কিন্তু ভার্জিন নই।
সুলগ্না অবাক হয়ে তাকালো অরিনের দিকে। ছেলেটা কি পাগল? যাকে বিয়ে করতে চাইছে, তাকে প্রথম দর্শনে এসব বলতে এসেছে!
অরিন একটু সময় নিলো। মিনিট খানেকের বিরতি। তারপর বলল, দেখো তুমি তো জানো আমি ছোটবেলা থেকেই বিদেশে ছিলাম। ওখানে ক্লাস নাইন-টেন থেকেই ছেলে মেয়েরা ডেটিং করে। কিন্তু যেহেতু আমার বাবা-মা দুজনেই বাঙালি, তাই এখানের কালচারটা আমাদের বিদেশের বাড়িতেও চালু ছিল। আমি ওদের সাথে স্কুলে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু ওদের মত হতে পারিনি। কিন্তু আমি যখন জব জয়েন করি তখন আমারই এক কলিগ ফরাসী মহিলার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। আমরা সম্পর্কে জড়াই। আমি অবশ্য রিলেশনটা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। কিন্তু তখন বুঝিনি, ও রিলেশনটা নিয়ে একেবারেই সিরিয়াস নয়। ফিজিক্যাল রিলেশন হওয়াটাও ওদেশে বড় কিছু ব্যাপার নয়। আমরা ডেটিং করেছি। কিন্তু তারপরেও আমার সাথে সংসার করতে রাজি হয়নি। আসলে কি বলতো সুলগ্না, আমরা বাঙালিরা ভালবাসার পরিণতি হিসাবে বিয়েটাকে সম্মান দিই। কিন্তু ওদের কাছে বোধহয় বন্ধনটা খুবই কষ্টকর। তাই বিয়েতে ওদের ভীষন আপত্তি। ওই ঘটনার পরেই আমি ঐ জবটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। অন্য জায়গায় জব নিয়েছিলাম। ভালোবাসা হারানোর কষ্টটা আমায় তখন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। অবশেষে আমি ফিরে এলাম কলকাতায়। আমার নিজের দেশে। ফিরতেই বাবা,মা তোমার ছবি দেখিয়ে বললো, দেখ তো পছন্দ কিনা। বিশ্বাস করো, তোমার মুখের মধ্যে যে সারল্য আছে সেটাই আমাকে বাধ্য করলো, নিজের অতীত সামনে আনতে। এখন আমি ভারমুক্ত। এবার তোমার সিদ্ধান্ত। আজকেই জানাতে হবে এমন নয়, তুমি সময় নাও। আমি আঙ্কেল, আন্টিকে বোঝাবো। আর তোমার হায়ার স্টাডির যাতে কোনো প্রবলেম না হয়, আমি সেটাও বলবো ওনাদের।
অরিন চলে গেছে। সুলগ্না স্থির হয়ে বসে আছে। কত সহজে অরিন ওর সামনে বলতে পারল, আমি ভার্জিন নই। কিন্তু সুলগ্না কিছুতেই বলতে পারল না, যে তার মন জুড়ে এখনো বসে আছে আর্য। আর্যর ভেজা ঠোঁটের ছোঁয়ার অনুভূতি এখনো অনুভব করছে ও। ভালোবাসায় ঠকে যাওয়ার কষ্টটা ঠিক কি, সেটা ওকে অরিন কি বোঝাবে! ও কি বুঝছে না! প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে উপলব্ধি করছে হারানোর যন্ত্রণা। তবুও অরিন ছেলেটা বেশ স্পষ্টবাদী। অন্তত সত্যি বলতে পারে। ভেঙে যেতে পারে জেনেও সত্যি বলতে পারে। আর আর্য তো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালিয়ে গেল সুলগ্নার কাছ থেকে।
মা এসে জিজ্ঞেস করলো, কি রে বল, অরিনকে কেমন লাগলো?
সুলগ্না শান্ত স্বরে বললো, তোমাদের ভালো লাগলে আমার আপত্তি নেই।
সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত মোট একশো সাতাশ বার কল করেছে আর্যর নম্বরে। প্রতিবারই ফোনটা বিজি পেয়েছে সুলগ্না। বেশ বুঝতে পারলো, আর্য ওকে জাস্ট ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে।
শেষে একটা মেসেজ ঢুকলো সুলগ্নার ফোনে। একটাই মেসেজ। প্লিজ, বিরক্ত করো না আমায়। যে ভালোবাসার দায় আমার নেই, সেটা জোর করে চাপাতে চেও না।
সুলগ্না একদৃষ্টে তাকিয়েছিল মেসেজটার দিকে। নোনতা জল ওর গাল, চিবুক বেয়ে স্ক্রিনে পড়লো টপটপ করে।
ঝাপসা হয়ে গেল আর্যর মেসেজটা।
মা বললো, কি রে, তাহলে তোর বাবাকে এগোতে বলি?
সুলগ্না বললো, বলো।
সন্ধের দিকে অরিনের ফোন এলো।
সুলগ্না, শুনলাম তুমি নাকি এ বিয়েতে মত দিয়েছ! দেখো, আমি হয়তো খুব রোমান্টিক নই, কিন্তু তোমার কোনোরকম স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করবো না কখনো, একথাটা আমি দিতে পারি। আর তোমার যদি ইচ্ছে হয়, শান্তিনিকেতনে গিয়ে পড়বে, সেটাও তুমি কন্টিনিউ করতে পারো। আমি আপাতত দিল্লিতে, অফিসের একটা কাজে এসেছি। কাল সন্ধের ফ্লাইটে ব্যাক করবো, তারপর তোমার সাথে দেখা করবো।
সুলগ্না বাই বলে ফোনটা রাখতেই জয়ন্তীর ফোনটা ঢুকলো। সুলগ্না সব কিছু বললো প্রাণের বান্ধবীকে।
জয়ন্তী শুনেই বললো, সৎ মানুষ বোধহয় বেশি প্রয়োজন রোম্যান্টিসিজিমের থেকে। মিথ্যের আড়ালে আর যাইহোক, ভালোবাসা বেঁচে থাকে না সু। আমি কয়েকদিনের মধ্যে যাবো তোর ফ্ল্যাটে। ডোন্ট ওয়ারি। একবার নাহয় বাবা,মায়ের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েই দেখ!
অরিনের বাবা,মা এসে সুলগ্নার সাথে গল্প করে গেল। দুজনকেই খুব পছন্দ হলো সুলগ্নার। ওরা দুজনেই অরিনের মত গম্ভীর নয়। অরিনের মা তো রীতিমত গল্প শুরু করে দিলো ওর সাথে। কবিগুরুর কবিতা দিয়েই ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বেশ মিশুকে মহিলা। হাসতে হাসতেই বললেন, আমরা কর্তা-গিন্নী একটা ফ্ল্যাটে থাকবো, তোমরা আরেকটা ফ্ল্যাটে। কাবাব মে হাড্ডি কেউ কারুর হবো না। অরিনের বাবার সাথে এখনো দশ বছর প্রেম করবো চুটিয়ে। সুলগ্না হেসে ফেলেছিলো ওনার বলার ধরনে।
আজ বিকেলে অরিন আসবে সুলগ্নার বাড়িতে। তারপর দুজনের বেরোনোর কথা আছে। বড্ড তাড়াতাড়ি সব কিছু এগিয়ে চলেছে যেন। সুলগ্নাই শুধু ভুলতে পারছে না আর্যকে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।
বারবার আর্য এসে দাঁড়াচ্ছে ওর দৃষ্টিপথে। বারংবার মনে হচ্ছে, আর্যর ভালোবাসায় কোনো খামতি ছিল না, ও তো বলেইছিলো, বিয়েতে ওর মত নেই। সেই শর্তেই তো ওকে ভালোবেসেছিল সুলগ্না। তাহলে আর্যর দোষটা কোথায়!
নানারকম প্রশ্ন এসে ভিড় করছে ওর ক্ষত বিক্ষত মনে।
জানালা দিয়েই দেখতে পেলো গাড়ি থেকে অরিন নামলো।
সুলগ্না হাত দিয়ে নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে উঠে বসলো।
অরিনের সাথে আরেকটা লোক ঢুকলো সুলগ্নার ঘরে। হাতে বেশ ভারী কিছু নিয়ে। অরিন বললো, এখানে রেখে দাও।
সুলগ্নার কৌতূহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অরিন বললো, সাদা পেপারটা তুমিই খোলো সুলগ্না।
কিছু না বুঝেই ও সাদা কাগজটা সরালো। চমকে উঠেছে সুলগ্না। থরথর করে কাঁপছে ওর ডান হাতটা। পর পর পাঁচটা ক্যানভাস। প্রতিটাই সুলগ্নার ছবি। খোয়াইয়ের ধারে, সোনাঝুড়ি গাছের নিচে…
অরিন হেসে বললো, কেমন চমকে গেলে?
আমিও চমকেছিলাম। আরে আমাদের দিল্লির অফিসের পাশেই আর্ট এক্সিবিশন হচ্ছে। এমনিই উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঢুকলাম গ্যালারিতে। দিয়েই দেখি, একজন বাঙালী ভদ্রলোক এগুলো বিক্রি করছে। আমি দেখেই অবাক। দিল্লির এক্সিবিশনে তোমার মত হুবহু দেখতে একটা মেয়ের ছবি দেখে। সবাই এসে দাম দর করছে। ভদ্রলোক বেশ চড়া দাম হাঁকালেন। দু চারজন পছন্দ করেও চলে গেল। আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল, অমন দাম-দর করা দেখে। সবাই হাঁ করে দেখছিল দেখেই অদ্ভুত একটা পজেসিভনেস কাজ করলো। মনে হলো আমার উডবিকে কেন এভাবে সবাই দেখছে। শেষে পাগলের মত সব কটা কিনে নিয়ে ফিরলাম। এয়ারপোর্টেও একটু সমস্যা হলো। তা হোক, কিন্তু তোমার মত হুবহু দেখতে কাউকে ওভাবে বিক্রি করছে দেখে রাগ হলো। আমি আর্ট বুঝি না সুলগ্না। সব ছবিই আমার একই লাগে। আমি রঙের খেলা বুঝিনা, কিন্তু তবুও এগুলো ঐভাবে দাম দর করে বিক্রি হচ্ছে দেখে, কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। তাই ভাবলাম, এগুলো বরং থাক আমাদের কাছে।
অরিন বলেই যাচ্ছে…বুঝলে সুলগ্না ওই ভদ্রলোক আর ওনার লাভার, দুজনেই বোধহয় আর্টিস্ট। আমি ওদের ছবি তুলে এনেছি। বিয়ের পর ওদের দিয়ে আমাদের দুজনের একটা ছবি আঁকিয়ে আমাদের ড্রয়িংয়ে সাজাবো। অরিন হাসছে….অমলিন হাসি। ওর চোখে দৃঢ় বিশ্বাস, এই মডেলটা সুলগ্নার মত দেখতে কেউ, সুলগ্না নয়। অবিকল একই রকম দেখতে অন্য একটি মেয়ে। পৃথিবীতে নাকি ক্লোন থাকে একই মানুষের।
সুলগ্না কাঁপা গলায় বলল, দেখি সেই ভদ্রলোকের ছবিটা।
অরিন নিজের মুঠোফোনের গ্যালারি খুলতে খুলতেই বললো, আমি ভদ্রলোকের ফোন নম্বর নিয়ে এসেছি। আমাদের পোট্রেট আঁকার জন্য কন্ট্যাক্ট করতে হবে বলেই।
ছবিতে একটা হালকা সবুজ পাঞ্জাবি পরে হাসছে আর্য। ওর কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটার চোখেও তীব্র বিশ্বাসী চাউনি। যেমন সুলগ্না বিশ্বাস করতো আর্যকে।
অরিন বললো, আর্য, ভদ্রলোকের নাম আর্য, আর ওনার লাভারের নাম দীপশিখা। দুজনেই আর্টিস্ট। বীরভূমের ঐদিকে কোথায় যেন বাড়ী বললেন। ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হলে দেখবে, ভীষণ মিশুকে মানুষ। কি সুন্দর কথা বলেন, ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমার সাথে আলাপ জমিয়ে ফেললেন। আমার মত কর্পোরেট জগতের যান্ত্রিক মানুষকে অবধি রং, তুলিতে আগ্রহ জাগিয়ে ছাড়লেন।
সুলগ্নার অজান্তেই ওর চোখ দুটো জলে ভরে গিয়েছিল। অরিন সেদিকে তাকিয়ে বলল, কি হলো? কাঁদছো কেন? আমি কি কোনোভাবে তোমায় আঘাত করে ফেললাম সুলগ্না? এই ছবিগুলো কিনে আমি কি তোমায় ইনসাল্ট করে ফেললাম? বিলিভ মি, আমি তোমাকে অপমান করার জন্য এগুলো কিনিনি। আমি জানি এগুলো তোমার ছবি নয়, কিন্তু ওভাবে লোকজন দাম করছিল দেখে, আর তোমার সাথে মিল আছে দেখেই….
সুলগ্না ডুকরে কেঁদে উঠলো। অরিন ওর হাতটা ধরে বলল, সরি। আমি এসব ছবি সরিয়ে ফেলছি। তুমি রাগ করো না প্লিজ। অরিন কাকুতির স্বরে বললো, আমি ক্ষমা চাইছি, আমি তোমায় হার্ট করে ফেলেছি না বুঝেই।
সুলগ্না ধীর স্বরে বললো, এগুলো আমি। ছবির ওই মেয়েটা আমি অরিন। আর্য আমায় এঁকেছিল। এখন আমায় বিক্রি করছে।
অরিন অপলক তাকিয়ে রইলো সুলগ্নার দিকে।
সুলগ্না একবারও না থেমে বলে গেল শান্তিনিকেতনের সব কথা। অরিন বাধ্য শ্রোতার মত শুনছিলো। কথা শেষ হবার পরে বললো, আগে জানলে এই ভদ্রলোককে আমি একটা বিগ থ্যাংকস জানাতাম। এনার জন্যই তো আমি তোমায় পেলাম সুলগ্না। মনখারাপ করো না, আমাদের জীবনটা অনেক বড়। এমন ঘটনা হয়তো প্রত্যেকের জীবনেই ঘটে, কিন্তু তাই বলে জীবন তো থেমে থাকে না। প্রতিটা সূর্য একটা করে নতুন দিনের সূচনা করে। আমরাও শুরু করি, আবার নতুন করে। আর এই ভদ্রলোককে আমি নিশ্চয়ই ডাকবো আমাদের দুজনের একসাথে একটা ছবি আঁকার জন্য। সেদিন কিন্তু তোমার দৃষ্টিতে অবজ্ঞা থাকবে, জিতে যাওয়ার আনন্দ থাকবে, প্রতিটা অঙ্গে থাকবে অহংকার, আমাকে পাওয়ার গর্ব থাকবে। আর শিল্পীর চোখে থাকবে সত্যিকারের ভালোবাসা হারানোর বেদনা। কি হলো সুলগ্না, তুমি রাজি তো?
সুলগ্না অরিনের হাতটা চেপে ধরে বলল, আমাকে বেঁচে থাকার শক্তি দাও তুমি। আমায় হায়ার স্টাডি করার ক্ষমতা জোগাও তুমি। আমাকে সবকিছু ভুলে ভালোবাসার প্রতি আবার বিশ্বাস জাগাও প্লিজ।
অরিন সুলগ্নার চোখের জলটা আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বললো, নিজেকে প্রমাণ করো সুলগ্না। প্রথম প্রেমই শেষ প্রেম নয়। যাকে ভালোবাসার পর মনে হবে তুমি নিঃস্ব হয়ে জিতে গেছো, বুঝবে সেটাই আসল প্রেম।
সুলগ্না অস্ফুটে বললো, আমি পারবো তো?
অরিন আলতো হেসে নিজের চুলটা আঙুল দিয়ে ঠিক করে বললো, যাই বলো না কেন, আর্যর থেকে কিন্তু আমি বেশি হ্যান্ডু। আর আমিও ক্লাস ওয়ানে কুঁড়ে ঘর, আর পদ্মফুল এঁকে ফার্স্ট হয়েছিলাম। তারমানে আমিও আর্টিস্ট…
সুলগ্না হেসে ফেললো। বেশ কয়েকদিন পর হাসছে ও।
অরিন সেদিকে অপলক তাকিয়ে থেকে বললো, এভাবেই হাসবে সব সময়। তোমার মুখে যেন মেঘ না জমে কখনো।
সমাপ্ত